Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পরিযায়ী – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প30 Mins Read0

    ১-৪. ঐশিকা

    ০১.

    ঐশিকা! ঐশিকা! ঐশিকা!

    নামটা নিজের মনেই বার বার উচ্চারণ করেছিল।

    ভারি আশ্চর্য নাম যা হোক। তাকে লেখা কাকির চিঠির কথা যেদিন প্রথম জানল কর্বুর, তখন থেকেই একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগছে ও। ব্যানার্জিসাহেবরা সকলে থাকবেন যদিও ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরের গেস্টহাউসে, তবু সেদিন থেকেই গৈরিকা বা ঐশিকা নাম দু টিকে ব্রাহ্মণ না হয়েও যে, মনে মনে গায়ত্রী অথবা পেতনি তাড়ানো মন্ত্রর মতোই কেন জপছে, তা ঠিক বলতে পারবে না। কিন্তু জপছে। ঐশিকা! কী আশ্চর্য নাম রে বাবা। কোনোদিনও অমন নাম শোনেনি।

    তার নিজের নামটা নিয়েও অবশ্য অনেকেই তাকে ঠাট্টা করে এসেছে সেই স্কুলের দিন থেকেই। বাঙালি সহপাঠীরা কেউ কেউ বলেছে, কর্পূর। অবাঙালিরা বলেছে গড়বুর, অর্থাৎ গড়বর-এর ছোটোভাই গোছের ব্যাপার আর কী!

    আসলে এখানে বাংলা ভাষা ভালো করে জানা মানুষের বড়ই অভাব। তাই কর্বুর শব্দটার মানে যে, বহুরঙা একটি ব্যাপার তা জানেই না কেউ। শিশুকাল থেকেই চরিত্রে সে নাকি চিত্রবিচিত্র তাই ঠাকুরদার-ই ইচ্ছেতে স্কুলে ভরতি করানোর সময়ে বাবা তার নাম রাখেন কর্বুর।

    ওড়িশা-বিহারের সীমান্তবর্তী এই লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ আকরের নীল-লাল নদী বওয়া এলাকাতে শুদ্ধ বাংলার চর্চা কম মানুষেই করেন। শুদ্ধ বাংলার চর্চা অবশ্য আজকাল কলকাতার সাহেব-হয়ে-যাওয়া ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া-করা বাঙালিরাও করেন না। বাঙালিয়ানা বলতে এখানে একমাত্র আনন্দবাজার রাখা। যদিও আনন্দবাজার নিজেই আর এখন তেমন বাঙালি নেই।

    তবে ওরা প্রবাসী হলেও সেনদের টাটিঝারিয়া বাংলোতে বাংলার চর্চা এখনও আছে খুব-ই। নানা দৈনিকপত্র ছাড়াও নানা লিটল-ম্যাগাজিনও নিয়মিত আসে।

    এখন দাদু বা ঠাকুমা কেউই আর জীবিত নেই কিন্তু তাঁদের মতামত সেন-বাড়িতে এখনও সমান মান্য এবং সম্মানের।

    ব্যাবসাতে ইতিমধ্যেই খুব-ই সুনাম হয়েছে কর্বুরের। ছেলেমানুষ হওয়া সত্ত্বেও। দাদু গত হয়েছেন ছ-বছর হল। উত্তরাধিকারসূত্রে বাবা দাদুর ইজিচেয়ারটা পেয়েছেন। কর্বুর পেয়েছে দাদুর ম ব্লাঁ মাস্টারপিস পেনটি। হেড অফ দ্য ফ্যামিলি হিসেবে বাবা ওই ইজিচেয়ারে বসেই সকালে হেঁটে এসে তিন কাপ চা খেয়ে, প্রায় বেলা দশটা অবধি ডাঁই করা খবরের কাগজ ও পত্র-পত্রিকা পড়েন। সকালে চা আর দু-টি ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কিট ছাড়া বাবা আর কিছুই খান না। ব্রেকফাস্টও খান না। কর্বুরের মনে হয় খবর খেয়েই বাবার পেট ভরে যায়।

    কাকু, দাদুর জীবদ্দশাতেই দাদুর চোখের মণি জিপগাড়িটাকে চেয়ে নিয়েছিল। গারাজ ভরতি নতুন নতুন গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকান ডিসপোজাল থেকে কেনা, একেবারেই লজঝড়ে হয়ে যাওয়া জিপটার প্রতি দাদুর যে কী, অসীম মমতা ছিল তা যাঁরা তাঁকে চিনতেন তাঁরাই জানতেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিল দাদুর পার্সোনাল ড্রাইভার। সিরাজুদ্দিন। দাদুর উইলে তিনি লিখে গিয়েছেন যে, সিরাজ যতদিন বাঁচবে ততদিন-ই সে মাইনে পাবে। কাজ করতে ইচ্ছে করলে কাজে আসবে, ইচ্ছে না করলে বা শরীরে না কুলোলে আসবে না। জিপটা নিয়েছিলেন যখন দাদু, তখন-ই প্রথম ম্যাঙ্গানিজ মাইনটা নেন ধুতরাতে। জিপটা আজও যে কী করে চলে, সেটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। স্টিয়ারিংটা পুরো তিন-পাক ফলস।

    জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে খুব-ই ভালোবাসতেন দাদু। যতদিন শিকার আইনি ছিল, উনিশশো বাহাত্তর অবধি, ততদিন অবধি পারমিট নিয়ে শিকারও করেছেন। ওদের বড়োবিলের বাড়ির বাইরের বারান্দা আর বিরাট বসবার ঘর দেখলে এখনও বাঘ, ভাল্লুক, বাইসন-এর মাউন্ট-করা মাথা, হাতির পা-এর মোড়া, নানারকম হরিণের চামড়াতে প্রায় মিউজিয়ম বলেই মনে হয় নবাগন্তুক মানুষের কাছে।

    কাকুও বাবার-ই মতো এঞ্জিনিয়ার। তবে মাইনিং এঞ্জিনিয়ার নন। যা কিছুই চলে না, তার সবকিছুকেই চালু রাখাটা প্রফেশনাল চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে কাকু। এখন কাকু, কাকি আর তাঁদের একমাত্র সন্তান সাত বছরের কিরিকে নিয়ে জামশেদপুরের নীলডিতে থাকেন। ব্যানার্জিসাহেব-ইহচ্ছেন কাকুর বস। যদিও কর্বুরদের পরিবারে তৈলমর্দনটা উচ্চশ্রেণির আর্ট হিসেবে পরিবারের কোনো সদস্যই গ্রহণ করেননি, তবু খাতিরদারি তো একটু করতে হয় ই, যখন ওঁরা আসছেন-ই।

    কাকুর একটা সাদা-রং ফিয়াট সিয়েনা আছে। জিপটা কাকু শুধু এখানে এলেই ব্যবহার করে। নইলে, বিশ্রামেই থাকে অন্যসময়ে। তবে এবারে যেহেতু তাঁর বড়োসাহেব আসছেন, কর্বুরকে চিঠিতে জানিয়েছেন কাকু, জিপটাকে পঞ্চমীর দিনের মধ্যে চলেবল কণ্ডিশনে আনতে। যদিও বড়োবিলে বড়োজামদার বার্ড কোম্পানি ও মিত্র এস. কে. কোম্পানির নতুন আর্মাডা ও মারুতি জিপসি থাকবে বড়োসাহেবের চড়ার জন্যে, তবুও তাঁর জঙ্গল-পাগল মেয়েরা সারাণ্ডাতে যখন যাবে তখন ওই হুডখোলা, সামনের কাচ বনেটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া পুরুষালি জিপ-এ চড়ে রিয়্যাল-রাফিং করে তারা আনন্দ পাবে। তারা নাকি ইতিমধ্যেই কাকুর মুখে জিপ-এর গল্প শুনে রীতিমতো উত্তেজিত। কাকুর তাই ইচ্ছে যে, জিপটিতে কর্বুর যেন সন্ধিপুজো করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। এবং তারপর জ্যান্ত দেবীরা এলে, গজ-এ বা নৌকোতে করে তাঁদের না নিয়ে গিয়ে, যেন ওই জিপে করেই নিয়ে যায় অকুস্থলে।

    গৈরিকা বড়ো, ঐশিকা ছোটো। তবে পিঠোপিঠি। ব্যানার্জিসাহেবের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন, যখন মেয়েদের বয়েস ছিল খুবই কম। বহুদিন বিদেশে থাকা ক্ষৌণিশ ব্যানার্জি নিজে নাকি যেমন সুদর্শন তাঁর স্ত্রীও নাকি তেমন-ই সুন্দরী ছিলেন। মেয়েদুটিও তাই ডানাকাটা পরি হয়েছে। উনি দুই মেয়েকে, বলতে গেলে সিংগল প্যারেন্ট-এর মতো মানুষ করে তুলেছেন। মেয়েদের জন্যে জীবনের অনেক সহজ সুখ, অনেক সস্তা আনন্দ বর্জন করেছেন। নিজেকে অনেকভাবে বঞ্চিত করেছেন। তবে উনি নাকি বলেন, মেয়েদের কাছাকাছি থাকতে পেরে তিনি যে, আনন্দ পেয়েছেন সেই আনন্দ তাঁকে অন্য কোনো কিছুই দিতে পারত না। এতদিন বাবা হয়েও উনি এতবছর মেয়েদের মা হওয়ার আনন্দকে জেনেছিলেন, এখন মেয়েরা দূরে চলে যাবে বলে মেয়েদের বিদাইয়ার কষ্টটাও যেন মায়ের-ই মতো বুঝতে আরম্ভ করেছেন।

    কিরি নামটি কাকুই দিয়েছে। দাদু দেননি। হো ভাষাতে কিরি মানে পোকা। কিরিবুরু মানে পোকাদের জঙ্গল। যেমন মেঘাতিবুরু মানে জমাট বাঁধা মেঘেদের মতো জঙ্গল। তা যাই হোক, কাকু, বুরু থেকে কিরি কেটে নিয়ে ছেলের নাম দিয়েছে কিরি।

    ভদ্রলোকের মতো একটা নাম তো দিতে পারত ছোটকা। কোথায় কিশা আর কর্বুর আর কোথায় কিরি। ওর চেয়ে হারাকিরি দিলেই তো হত।

    দাদু বলেছিলেন।

    দাদু তখন প্রচন্ডরকম বেঁচে। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধিও দাদু প্রচন্ডরকম জীবিত ছিলেন।

    কাকু দুঃখ পেয়েছিল ছেলের নাম সম্বন্ধে দাদুর প্রতিক্রিয়ার কথা শুনে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি।

    কর্বুরদের পরিবার দৃঢ়বদ্ধ, ঘন-সন্নিবিষ্ট, মেঘাতিবুরুর-ই মতো। তথাকথিত আধুনিকতার কোনোরকম বারফাট্টাই তাদের নিরন্ধ্র পারিবারিক বেষ্টনীকে টলাতে পারবে না মনে হয় আরও অনেকদিন। এখন পরের প্রজন্মের বউ-জামাইরা এসে যদি এতদিনের ঐতিহ্যকে নষ্ট করে দেয় তো, সে অন্য কথা। সেইজন্যেই জামাই ও বউ নির্বাচনে এই পরিবার অত্যন্ত সাবধানি।

    দিদি কিশার বিয়েতে সকলেই খুব খুশি। অত্যন্ত শিক্ষিত, উদার, বনেদি অথচ সর্বার্থে আধুনিক পরিবারেই বিয়ে হয়েছে কিশার। জামাই বিলাবল এবং তাদের পরিবারের প্রত্যেককেই এ-পরিবারের সকলের-ই খুব পছন্দ।

    .

    ০২.

    প্রতিবছর-ই পুজোর পরে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন বড়োবিল-বড়োজামদার বাঙালিরা মিলে। এবারে কথা ছিল মহড়া নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন। নাটক হিসেবে যদিও সেটি লেখা নয়। ওই নামের একটি উপন্যাসের-ই নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করছেন ওঁরা। তবে মূলউপন্যাসের মধ্যেই নাটকটি প্রায় নাটকের ফর্মেই আছে। উপন্যাসে এমন আছে যে, মান্ডুর রূপমতী নাটকটি মঞ্চস্থ করা গেল না, কারণ, যে-ছেলেটির নায়কের ভূমিকাতে। অভিনয় করার কথা, তার মা নাটক শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগে হার্ট-অ্যাটাকে মারা। গেলেন।

    ঔপন্যাসিক আসলে ওই নাটকের মাধ্যমে বলতে চেয়েছিলেন যে, আমাদের প্রত্যেকের জীবন-ই অনেকগুলি মহড়ার-ই সমষ্টিমাত্র। আসলে আমাদের জীবনে খুব কম মহড়াই অবশেষে সফল হয়, নাটকরূপে মঞ্চস্থ হতে পারে। এই আমাদের জীবনের ট্র্যাজেডি। মহড়া উপন্যাসটি কলকাতা থেকে কিনে এনেছিল নাট্যামোদী একজন। দেজ পাবলিশিং বা সাহিত্যম-এর বই। সঠিক মনে নেই। ওদের প্রত্যেককেই জটাদা একটি করে জেরক্স-করা স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়েছেন।

    সকলের পীড়াপীড়িতে এবারে কর্বুর রাজিও হয়ে গিয়েছিল নায়কের ভূমিকাতে অভিনয় করতে। কারণ, উপন্যাসটির বক্তব্য ও উপস্থাপনা তার মনে খুব-ই ধরেছিল। তক্ষ রায়ের ভূমিকাতে স্থানীয়দের মধ্যে বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং অভিনেতা জটা রায় অভিনয় করবেন ঠিক হয়েছে। উনি নাটকটি পরিচালনাও করবেন এবারে। অন্যান্যবারের সামাজিক সব নাটক পচাদা পরিচালনা করেন।

    যেদিন মহড়া প্রথম শুরু হল ঠিক সেদিন-ই কাকির চিঠি এসেছিল ঐশিকা অ্যাণ্ড কোম্পানির আগমন-বার্তা জানিয়ে। কর্বুর বলেছিল জটা রায়কে, জটাদা, আমাকে বাদ দিতে হবে। তাতে পুজো কমিটির প্রত্যেকেই বেঁকে বসেছিল। আলাদা আলাদা ডেপুটেশন গিয়েছিল বাবার এবং মায়ের কাছে পুরুষ এবং মহিলাদের। তারপর তাঁদের-ই সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে বাবার ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে ফটকা গেল বড়োবিল থেকে ভোরের বাসে টাটাতে। কাকুর উত্তরও নিয়ে এল সন্ধের বাসে। দাবি মঞ্জুর হয়েছে। কাকু নাকি বলেছে যে, ব্যানার্জিসাহেব ও তার মেয়েরা নাকি খুব খুশিই হয়েছেন। সারাণ্ডার পাঁচদিন থেকে একটি দিন কমিয়ে সন্ধেবেলা পুজোমন্ডপে মহড়া নাটকটি দেখে পরদিন ভোরেই জঙ্গলে যাবেন ওঁরা কর্বুরের সঙ্গে। এইরকম-ই ঠিক আছে।

    অভিনয় কখনো করেনি কর্বুর। কী জীবনে, কী মঞ্চে। অভিনয় করা যে, এত কঠিন সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাও ছিল না। নবাব বাজবাহাদুরের চরিত্রে অভিনয় করছে সে। আর রূপমতীর ভূমিকাতে অভিনয় করছে বড়োজামদার একজন এঞ্জিনিয়ারের রূপবতী গুণবতী কন্যা শিখী।

    মহড়া আরম্ভ হয়ে গেছে গতকাল থেকেই। এই মহড়ার-ই জন্যে বড়োবিলেই রাতে থাকতে হচ্ছে কর্বুরের। ভোর পাঁচটাতে উঠে ভোগতা মুণ্ডার বানিয়ে দেওয়া এককাপ চা খেয়ে ষাট কিমি জঙ্গলে এবড়ো-খেবড়ো পথে গাড়ি চালিয়ে খাদানে যায়। বিকেলে পৌনে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ে খাদান থেকে। বাড়ি ফিরে চানটান করে সাতটাতে যায় মহড়াতে। ফিরতে ফিরতে এগারোটা সাড়ে এগারোটা। মা, না খেয়ে বসে থাকেন। ও মহড়া থেকে ফিরলে, মা-ছেলেতে গল্প করতে করতে বসে একসঙ্গে খান।

    মাঝে মাঝে ব্যানার্জিসাহেবের মেয়ে গৈরিকা-ঐশিকার কথা ওঠান মা। মাঝে মাঝেই বড়োজামদার শিখীর কথাও ওঠে। শিখীর বাবা নিজে গাড়ি করে শিখীকে নিয়ে যেতে আসেন। আসবার সময়ে বড়োজামদার গোয়েলসাহেবের ছেলের গাড়ি করেই আসে শিখী। রাজ গোয়েলও অভিনয় করছে সেনাপতি একরাম খাঁ-এর ভূমিকাতে। গোয়েলসাহেব সেইল এর বড়ো ঠিকাদার। চারপুরুষ বিহারে থেকে থেকে এবং বাঙালি অফিসারদের খিদমদগারি করে করে ওরা ব্যাংলো বিহারি হয়ে গেছে। হিন্দি বলে বিহারিদের মতন। বাংলাও বলে বাঙালিদের-ই মতন।

    কর্বুর ঠিক বুঝতে পারে না যে, ওর মা, ইদানীং অদেখা ঐশিকা আর শিখীর কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেন কেন। বুঝতে যে, একেবারেই পারে না তা নয়। একটু একটু পারে। কিন্তু ভাব দেখায় যে, পারে না। আজকাল সে তো অভিনয় করতে একটু একটু শিখছেই। তবে ওর মা একটা কথা ছেলেবেলাতে প্রায়ই বলতেন ওকে, উলটোপালটা কথা বললে, কবু, তুই আমাকে পেটে ধরেছিস না, আমি তোকে পেটে ধরেছি? আমি তোকে যতখানি বুঝি, তুই কি আমাকে তার ছিটেফোঁটাও বুঝতে পারবি কোনোদিনও?

    কেন জানে না, আজকাল আর বলেন না, মা ওই বাক্যটি। ছেলে-মায়ের মধ্যেও ধীরে ধীরে ছেলের বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ব্যবধান গড়ে ওঠেই। ছেলের বিয়ে হলে হয়তো সেই ব্যবধান আরও বাড়ে। অনেক কিছু কর্বুর যেমন জানে, আবার অনেক কিছু জানেও না।

    আজ রাতে ফিরে স্ক্রিপটা নিয়ে বসল আবার ও। নাটক করতে গিয়ে, নতুন করে বুঝতে পারছে যে, এই কম্পিউটার-এর যুগেও স্মৃতিশক্তিকে একেবারে নস্যাৎ করাটা ঠিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তির খুব প্রয়োজন আছে।

    নাটকটার মধ্যে বেশ গভীরতা আছে। ডায়ালগ-এর মধ্যে দিয়ে নায়ক-নায়িকা যা বলছেন একে অন্যকে, সেই কথোপকথন একটা অন্য মাত্রা পাচ্ছে। তাদের যা বক্তব্য, তা যেন শুধুমাত্র নাটকের অন্য এক চরিত্রর জন্যই নয়, যেসব দর্শকের গভীরতা আছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সেইসব চরিত্রের মধ্যে নিজেদের-ই দেখতে পাবেন হয়তো। আইডেন্টিফায়েড হবেন।

    আজ বার বার-ই ভুল করছিল কর্বুর তার পাঠ বলতে গিয়ে। শিখী মুখ টিপে হেসেছিল একবার।

    জটাদা বলেছিলেন, কর্বুর, ভুলে যেয়ো না, তুমিই আমার নায়ক। তুমি ঝোলালে পুরো নাটকটাই ঝুলে যাবে।

    শিখী বলেছিল, কর্বুরদা, কো-অ্যাক্টরের ওপরে অন্যের অভিনয়ের মান নির্ভর করে। তোমার অভিনয়টা যদি ভালো হয় তবে আমার অভিনয় আপসেই ভালো হবে। এবং vice versa.

    জটাদা বলেছিলেন, পার্ট মুখস্থ করাটা প্রাইমারি ব্যাপার, তারপরে অভিনয়ের অন্য সবদিক। পার্ট-ই যদি মুখস্থ না করো কর্বুরসাহেব, তবে আমরা যে, ডুবে যাব।

    লজ্জা পেয়েছিল খুব-ই কর্বর। সেই কারণেই স্ক্রিপটা নিয়ে বসা। ও ঠিক করেছে, কাল রিহার্সালের সময়ে টেপ করে নেবে পুরোটা, তারপর খাদান-এ যেতে আসতে গাড়িতে ক্যাসেটটা বার বার বাজিয়ে ভুল-ত্রুটি শুধরে নেবে। মুখস্থও করে নেবে নিজের পার্ট। ধরা ছাড়াও ভালো করে লক্ষ্য করবে।

    আজ-ই কিছুটা অংশ অন্তত নিজেই পড়ে, অন্যদের পার্টসুদু টেপ করে নেবে ঠিক করল। যেখানে যেখানে ভুল হচ্ছে বারে বার। কাজটা এগিয়ে থাকবে অন্তত কিছুটা।

    শ্যামলের বেগুন-ভাতে ভাই আর মানিকের চিচিঙ্গার মতো দেখতে মেয়েলি গলার দাদা প্রম্পটার। দু-দিকের উইংস-এর আড়াল থেকে দু-জনে প্রম্পট করছে। একজনের গলা ফেন ভাতের মতো ভ্যাভ্যাতে, কিন্তু ভারী। অন্যজনের গলা আবার এমন-ই চিচি করে যে, রিহার্সাল যেখানে হয়, সেই প্রাচীন দুর্গাবাড়ির কার্নিশে-বসা পায়রাগুলো পর্যন্ত ভয় পেয়ে ডানা ধড়ফড়িয়ে উড়ে যায়।

    জটাদা সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, বি রেডি! অল ক্যারেকটারস। প্রথম দৃশ্য। তৃতীয় অঙ্ক। স্টেজ-এ নবাব বাজবাহাদুর এবং রূপমতী। লোকেশান: মান্ডুর দুর্গর পশ্চিমপ্রান্তের রূপমতী মেহাল। রেডি? নাউ স্টার্ট।

    হাতঘড়িটা, পাঞ্জাবির আস্তিনটা একবার তুলে একঝলক দেখে নিয়েই বলেছিলেন জটাদা।

    কল্পনাতে দেখা মান্ডুর দুর্গের পশ্চিমপ্রান্তর রূপমতী মেহাল-এর এক সকালবেলা। যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিল কর্বুর। নর্মদার দিকে চেয়ে-থাকা, স্নান-করে ওঠা সুকেশা, সুগন্ধি গায়িকা, রূপমতী মেহাল-এর চাঁদোয়ার নীচে বসে আছেন।

    রূপমতী বললেন–সুলতান। কিছুদিন থেকেই আপনাকে বড়ো ছটফট করতে দেখছি। আমার গান কি আর ভালো লাগে না আপনার?

    বাজবাহাদুর–সে জন্যে নয়, সে জন্যে নয়। গানও যেদিন ভালো লাগবে না রূপমতী, বিশেষ করে তোমার গান, সেদিন বাঁচা আর মরাতে তফাত থাকবে কি কোনো?

    রূপমতী-তবে? সুলতান সবসময়ে কোন চিন্তা আপনাকে এমন অন্যমনস্ক করে রাখে আজকাল?

    এমন সময়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা যাবে। অশ্বারোহীদের আসবার আওয়াজ। দূর থেকে। রূপমতী-মেহালের দিকে।

    বাজবাহাদুর ওইদিকে চেয়ে হঠাৎ-ই কথা থামিয়ে দেবেন। রূপমতী ওই দূরাগত অশ্বারোহীদের দিকে যেন, চেয়ে থাকবেন কিছুক্ষণ। এখনও দূরে আছে অনেক-ই। সুলতানের ডাকহরকরা, ভালো করে লক্ষ্য করে, যেন তাদের ধ্বজা দেখেই বুঝলেন। বুঝেই, অন্যমনস্ক হয়ে যাবেন রূপমতী।

    রূপমতী-মেহালের নীচে অমলতাস গাছেরা ফুলের স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। সামান্য প্রভাতি হাওয়ায় একটু একটু দুলছে সেই স্তবকগুলি।

    রূপমতী-কী সুন্দর। না? জাঁহাপনা?

    বাজবাহাদুর–কী?

    রূপমতী-এই ফুলগুলি। এই সকাল, নিমারের আদিগন্ত এই উপত্যকা, দূরের নর্মদাদেবী, পুণ্যতোয়া, উত্তরবাহিনী। অথচ আপনার সময়ই নেই এসব দেখবার। এমনকী গানও শোনবার।

    একজন অশ্বারোহী দুড়দাড় করে সরু সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এল। অন্যরা দাঁড়িয়ে রইল। কুর্নিশ করল সবাই বাজবাহাদুরকে। হ্রেষারব এবং অস্থির ঘোড়াদের পা ঠোকার আওয়াজে মন্থর প্রভাতি হাওয়া অবিন্যস্ত হয়ে উঠল। অশ্বারোহী এসে পাকানো এবং হলুদ রেশমি সুতোয় বাঁধা বার্তা তুলে দিল সুলতানের হাতে, মাথা ঝুঁকিয়ে। বলল–

    হোশাঙ্গাবাদ থেকে সেনাপতি লড্ডন খাঁ পাঠিয়েছেন। বাজবাহাদুর বার্তাটি খুলে পড়লেন। যুগল কুঞ্চিত হল তাঁর। বললেন, সেনাপতি একরাম খাঁকে দেখা করতে বলো আমার সঙ্গে বড়া মসজিদে। এক্ষুনি। আমি যাচ্ছি।

    (অশ্বারোহী চলে গেল আবারও দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে।)

    রূপমতী-কী খবর সুলতান? খারাপ কিছু?

    বাজবাহাদুর–খবর খুবই খারাপ। দিল্লি থেকে মোগল সম্রাট আকবর, সেনাপতি আধম খাঁকে পাঠিয়েছে মালোয়া দখল করার জন্যে। তাঁর বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসছে ক্রমশই। লডড়ন খাঁ খবর পাঠিয়েছেন হোশাঙ্গাবাদ থেকে যে, সারাংগপুরে আধম খাঁকে রুখতে না পারলে মান্ডু বাঁচানো যাবে না কোনোক্রমেই। তাকে তো ধার পেরিয়ে মান্ডুতে উঠে আসতে দেওয়া যায় না।

    একটু চুপ করে থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হেস্তনেস্ত যা হবার তা ধার-এর সমতলেই হোক। আমার মা আর আমার রূপমতীর গায়ে যেন আঁচড়টিও না লাগে।

    রূপমতী–সর্বনাশ! বড়োই খারাপ খবর এ সুলতান। আধম খাঁর বাহিনী যে বিরাট। সম্রাট আকবর তো ছেলেখেলা করার জন্যে সেনাবাহিনী পাঠান না। আপনি যদি হেরে যান তাহলে কী হবে আমার?

    বাজবাহাদুর-হারার কথা বোলো না আমাকে রূপমতী। বোলো না, হারার কথা। বোলো না।

    যা বলতে চাইছিলাম তা থেকে অনেক-ই সরে এলাম আমি রূপমতী। যেমন, জীবনে যা করতে চেয়েছিলাম, তা থেকেও। সময় হাতে বেশি নেই। আমাকে বলতে দাও। আমি চেয়েছিলাম এমন-ই এক সুলতান হতে, এই সুন্দর মান্ডুর ব্যতিক্রমী সুলতান, যিনি কোনো রাজ্য জয় করবেন না কোনো অন্য রাজার। জয় করবেন সংগীত-জগতের সমস্ত রাজ্য, জাগির জানবেন সেই আশ্চর্য জগতের ঝংকৃত অলিগলিকে, আবিষ্কার করবেন নারী ও পুরুষের প্রেমকে নতুনতর, শান্ত স্নিগ্ধ আলোয়। কী বলো তুমি? এও কি এক ধরনের রাজত্ব নয়? সাম্রাজ্য নয়? এই সাম্রাজ্যের গভীরে যাওয়ার চেষ্টাও কি রাজকার্য নয়? রাজকার্য মানে কি শুধুই মৃত্যুদন্ড? কারাগার? যুদ্ধ? রক্তপাত? নারী ও শিশুর ক্রন্দন?

    রূপমতী–আপনি কি যুদ্ধে আপনার নিজের সহোদরকে হত্যা করেননি নবাব?

    বাজবাহাদুর-আঃ। যুদ্ধ আমি করেছিলাম, সে তো প্রাথমিক যুদ্ধই, ক্ষমতাতে আসীন হওয়ার-ইযুদ্ধ সে। যা নইলে, আমি সুলতান হতাম না মাঁলোয়ার, মান্ডুর।

    রূপমতী-(হেসে) সুলতানদের জীবনে প্রাথমিক যুদ্ধ বলে কোনো কথা নেই। যুদ্ধই তাঁদের জীবনের বড়োসঙ্গী।

    আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে সবকিছু। না, জাঁহাপনা? আপনাকেও। চারদিকের এই প্রভাতি প্রকৃতিকে। আঃ। কত ফুল। কত পাখি চারদিকে? জৌনপুরিতে গান ধরব একটা? এই গম্ভীর রাগ এইমুহূর্তে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ধরি? সুলতান?

    বাজবাহাদুর–না। আমি মসজিদে যাব। সেনাপতি একরাম খাঁ অপেক্ষা করছেন সেখানে আমার জন্যে। চলি আমি, রূপমতী। সন্ধেবেলায় জেহাজ-মেহালে বরং দেখা হবে। আজ গভীর রাতে মালকোষ শুনব তোমার গলায়। জানি না, আর কতদিন শুনতে পাব তোমার গান! এ পৃথিবীতে গান, প্রেম সব-ই সুকৃতির জিনিস, উপচে-পড়া ধন এসব। ক-জনে এর কদর জানে বলো?

    .

    রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফিরতেই মা বললেন, নে ধর, তোর কাকির চিঠিটা পড়। আজ-ই এল। পড়ে আমাকে ফেরত দিস।

    কর্বুর একটু অবাক হল। ওঁরা যে, আসবেন তা তো কাকি অনেক আগেই জানিয়েছে মাকে। আবার এ চিঠি পড়ার কী দরকার।

    নীলডি
    জামশেদপুর
    ১০-৯-১০

    শ্রদ্ধাভাজনীয়াসু দিদি, অনেকদিন আপনার চিঠি পাই না। বড়োবিল-এর বাড়ির ফোন কি ঠিক হবে না? যে পরিমাণ খোঁড়াখুঁড়ি টেলিফোন ডিপার্টমেন্ট করে চলেছে গত দু-মাস হল তাতে জায়গামতো খুঁড়লে, যেমন সুবর্ণরেখায় বা স্যেশেলস আইল্যাণ্ডস-এ, সাত রাজার বা সাত জলদস্যুর গুপ্তধনের সন্ধানও তারা পেতে পারত। কবুকে বলুন যে, ওদের ধমক-ধামক দিক। নইলে অন্তত বক্তৃতাই দিক। আমাদের দেশে তো এখন বক্তৃতা দিয়েই জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা পর্যন্ত হচ্ছে। আর কর্বুর বক্তৃতাতেও যদি তাড়াতাড়ি গর্তগুলো না বোজায়, তবে কবুকে বলুন আজকের দিনের সব যুক্তির বড়োযুক্তি, সব বাগ্মিতার, নোটের বাণ্ডিল ছুঁড়ে মারতে।

    কুরুবকের বড়োসাহেব তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে যে-যাবেন শুধু সে কথাই আগে জানিয়েছি আপনাকে। এবারে একটু বিস্তার করে বলি। এতদিন কিরির পরীক্ষা নিয়ে খুব-ই ব্যস্ত ছিলাম। বড়ো করে লেখার অবকাশ ছিল না। কুরুবকের বস ব্যানার্জিসাহেবের সঙ্গে আপনি ও দাদা যখন এখানে এসেছিলেন তখন আলাপিতও হয়েছেন। তিনি তাঁর দুই কন্যা গৈরিকা ও ঐশিকাকে নিয়ে পুজোর সময়ে সারাণ্ডার জঙ্গল দেখতে যাবেন। আমাদের কর্বরবাবু তো সারাণ্ডার পোকা। বড়োবিল-এ ওঁরা ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরে বার্ড কোম্পানির অতিথিশালাতেই থাকবেন। আমি আর আপনার দেওর কর্মুর কথা ওঁদের এতই বলছি ও বলেছি যে, বলতে গেলে ওঁরা মিস্টার কর্মুর সেন-এর ভরসাতেই আহ্লাদ করে সারাণ্ডা দেখতে যাচ্ছেন। আপনারা তো ব্যানার্জিসাহেবকেই দেখেছেন শুধু, মেয়েদের দেখেননি। তাই এই বিস্তার।

    সেনসাহেবের মেয়েরা কেউই টাটানগরে থাকে না। গৈরিকা আহমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনস থেকে পাশ করেছে সবে। তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর দুজনে মিলে মাস দুই পরে স্টেটস-এ চলে যাবে। ঐশিকা দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মাসকম করে এসেছে। একটি বিদেশি টিভি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছে। শুনতে পাচ্ছি যে, চাকরিটি হয়ে যাবে। হয়ে গেলে, হয়তো দিল্লি অথবা মুম্বাইতে পোস্টিং হবে। তাই ব্যানার্জিসাহেব মেয়েরা চলে যাওয়ার আগে কটা দিন সব কাজকর্ম ছেড়ে তাদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে চান।

    আর কী লিখব। আশাকরি দাদার ব্লাডসুগার আর বাড়েনি। আপনার হাঁটুর ব্যথা কি কমল?

    কিরি ভালো আছে। পড়াশুনোতে একেবারেই মন নেই। কবু পড়াশোনাতে এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও ওকে পারিবারিক স্বার্থে ব্যাবসাতে ঢুকতে হল। এখন মনে হয়, ওকে, ও যা পড়তে চায়, তাই পড়তে দিয়ে কিরিকেই সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া ভালো ছিল। এই ব্যাবসা এমনকিছু কঠিন নয় যে, কর্বুর মত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে এতে আনন্দ পাবে। তবে কিরির বড়ো হতে যে, অনেক-ই দেরি।

    দিদি! আপনাকে এইবারে চুপি চুপি আসল কথাটা বলি। গৈরিকার বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। আমার ও আপনার দেওরের খুব-ই ইচ্ছে যে, ঐশিকার মতো একটি সর্বগুণসম্পন্না মিষ্টি মেয়ে আমাদের পরিবারের বউ হয়ে আসুক। ওরা সকলে মিলে যে, বড়োবিল-এ যাচ্ছে তাতে আমরা খুব-ই উত্তেজিত। আপনি ও দাদা ওদের সকলের সঙ্গে ভালো করে মিশতে পারবেন। কবুও বেশ ক-দিন কাছ থেকে ঐশিকাকে দেখতে পারবে। ঐশিকা এবং তার পরিবারও আপনাদের সকলকে কাছ থেকে দেখার প্রচুর সুযোগ পাবে। কুরুবককে, উনি তো বটেই, মেয়েরাও খুব-ই পছন্দ করে।

    আপনাকে কী বলব দিদি। পুজোর এখনও দেড়-দুমাস দেরি আছে কিন্তু এখন থেকেই আমি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে রয়েছি। যদি আমার এই আশা পূর্ণ হয় তাহলে আনন্দ রাখার আর জায়গা থাকবে না। আমার একটুও সন্দেহ নেই যে, আপনার ও দাদার ঐশিকাকে ভীষণ-ই ভালো লাগবে। অমন বউ এলে আমাদের পরিবারের মুখোজ্জ্বল হবে। কবুও খুব সুখী হবে। সম্ভবত।

    ভালো থাকবেন। ফোনটা ঠিক হলেই আমাকে একটা ফোন করবেন। তারপর যেমন আগে করতাম, একরাতে আমি, আর একরাতে আপনি অবশ্যই কথা বলব। কিরিরও তার জ্যাঠা জেঠিমার আর কবুদাদার গলা দিনান্তে একবার শুনতে না পেলে ঘুম আসে না।

    একটা কথা বলে এই চিঠি শেষ করছি। চুপি চুপি বলি যে, ঐশিকাকে আপনাদের কিরিবাবুর খুব-ই পছন্দ। ও-ই প্রথম আমার মাথাতে কথাটা ঢোকায়। গতশনিবার গৈরিকার জন্মদিনে ও-ও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে ব্যানার্জিসাহেবের বাংলোতে। খাওয়া-দাওয়া, গানবাজনার পর অনেক রাতে ফিরে শুতে যাওয়ার আগে আমরা বসার ঘরে বসে যখন টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখছিলাম তখন, হঠাৎ ও এসে বলে গেল, মা! কবুদাদার সঙ্গে ঐশিকা দিদির বিয়ে দিয়ে দাও না। দারুণ হবে। ভাবি হো তো এইসি।

    সেই রাত থেকে আমরা কিরির কথাটিই ভাবছি। বার বার।

    আহা! সত্যিই যদি কিরির মুখের কথাটা ফলে তবে আর আমার আনন্দ রাখার জায়গা থাকবে না।

    আমরা গাড়িতে মহাষষ্ঠীর দিন গিয়ে পৌঁছোব।

    ইতি
    স্নেহধন্যা পদ্মা

    রুক্মিণী সেন
    টাটিঝারিয়া, চড়ই চড়াই
    বড়োবিল, ওড়িশা

    চিঠিটা বার দু-তিন পড়ল কর্বুর। ওর মনের মধ্যে কিছু উত্তেজনা, কিছু ভয়, কিছু আশা, ভালোলাগা ঝিলিক মেরে গেল। কর্বুর ভাবছিল, একা এলেই তো পারতেন। মা বা কাকি বা দিদি হলে অন্য কথা ছিল। একে অনাত্মীয়া, তার ওপরে তরুণীদের ঠিক হ্যাণ্ডল করতে জানে না কর্বুর। এয়ারপোর্টের কনভেয়ার বেল্ট-এ কার্ডবোর্ডের বাক্স আসে না? লেখা থাকে, Fragile! Handle with care. মেয়েদের তেমন-ই কাঁচের বাসন বলেই মনে হয় কর্বুরের। ভেঙে গেলেই, হাতে-পায়ে কাচ ফুটে গিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটতে পারে।

    চিঠি প্রসঙ্গে কর্বুর ভাবছিল, আজকাল ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল-এর দৌলতে পৃথিবী এখন রীতিমতো দৌলতাবাদ হয়ে গেছে। চিঠি লেখে খুব কম মানুষ-ই। অথচ চিঠির কোনো বিকল্প সতিই কি কিছু আছে? বড়ো বড়ো মনীষীরা তাঁদের মন-খোলা চিঠির মধ্যে দিয়ে, তাঁদের দীর্ঘ এবং ব্যতিক্রমী ইচ্ছাপত্রর মধ্যে দিয়ে পরবর্তী সময়ের মানুষদের যতখানি দীক্ষিত ও শিক্ষিত করে গেছেন তা কি ফোন ফ্যাক্স বা ই-মেইল কোনোদিন করতে পারবে?

    ইনফরমেশন-ই সব নয়। স্মৃতিই মানুষের একমাত্র গুণ নয়। গুণ তো নয়ই বরং কর্বুরের মনে হয়, স্মৃতি এক ধরনের দোষ-ই। স্মৃতি যার অত্যন্তই প্রখর তার কল্পনাশক্তিই নষ্ট হয়ে যায়, তার বিচার-বুদ্ধি-শ্রুতি নষ্ট হয়ে যায়, তার মনুষ্যত্বও অবশেষে বিঘ্নিত হয়। Robot মানুষের বিকল্প হতে পারে অনেক ব্যাপারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে-মানুষকে পূর্ণ-মানুষ আখ্যা দিয়েছিলেন, সে-মানুষ-ই সব মানুষের আদর্শ বলে গণ্য হওয়া উচিত। সেই পূর্ণ-মানুষ কোনোদিনও Robot হয়ে উঠতে পারে না। পারবে না। কর্বুরের মনে হয়, মানুষ নিজের মধ্যে অহমিকা এবং অন্ধত্বর কারণে বিজ্ঞানের দাস হয়ে ওঠাতে মনুষ্যত্বের যে-ক্ষতি হচ্ছে, তা পরে তারা বুঝতে পারবে। কিন্তু যখন পারবে, তখন খুব-ই দেরি হয়ে যাবে। মানুষ পরম মূর্খ বলেই নিজের সঙ্গেই প্রতিযোগিতাতে নেমেছে আজ। কিন্তু এসব কথা বললে অন্যে কর্বুরকে পাগল ভাববে, পাগল বলবে।

    ফ্যাক্স বা ই-মেইল এবং ইন্টারনেট থাকুক, শুধুমাত্র বাণিজ্যের জন্যে, শিল্পের জন্যে, আধুনিক সফল মানুষের টাকা, আরও টাকা আয়ের জন্যে, তার ব্যাবসার, পেশার, শিল্পের সাম্রাজ্যর সীমা আরও বিস্তৃত করার জন্যে। কিন্তু ব্যক্তি-মানুষের সম্পর্কে চিঠি যদি আর না থাকে, আধুনিক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সম্পর্ক অচিরেই ব্যাবসার ও শিল্পের অংশীদার, খরিদ্দার অথবা প্রতিযোগীর-ই হয়ে উঠবে। স্বার্থহীন কোনো সম্পর্ক, প্রেম বা সহমর্মিতার, সমবেদনার কোনো সম্পর্ক আর বোধ হয় থাকবে না, এই কেজো-পৃথিবীতে। সে বড়ো দুর্দৈব হবে।

    ঐশিকাদের ট্যুরের একটি আইটিনিরারি দিয়ে মা বলেছিলেন কর্বুরকে, সারাণ্ডার প্ল্যানিং ওঁরা তোর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

    -সারাণ্ডাতে ক-দিন?

    –তিনরাত চারদিন।

    –একগাদা মেয়ে-ফেয়ে নিয়ে কেউ জঙ্গলে যায়?

    –কেন? মেয়েরা কি মানুষ নয়? তুই এত নারীবিদ্বেষী কবে থেকে হলি?

    –হলাম আবার কী? ছিলাম-ই তো চিরদিন।

    –তাই? বোঝা তো যায়নি।

    কাকির চিঠিটা মা বার বার-ই পড়ছিলেন আর বলছিলেন, সত্যি! খুব ভালো চিঠি লেখে রে পদ্ম। মনে হয়, যেন সামনে বসে কথা বলছে।

    কর্বুর খাবার টেবিলে মাকে ফেরত দিল চিঠিটা।

    -পড়লি ভালো করে?

    –হুঁ।

    –কী বলিস?

    -আশ্চর্য তো তুমি। চিনি না জানি না, কে বা কারা আসছেন। তা আসছেন আসুন না। এতে বলাবলির কী আছে? সত্যি। তোমরা এমন করো না!

    রুক্মিণী একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন।

    .

    ০৩.

    কর্বুর ওর নতুন সাদা ইণ্ডিকাটা নিয়ে ঠাকুরানি পাহাড়ে গিয়েছিল। গেস্ট হাউসটা পাহাড়ের ওপরে। সবচেয়ে ভালো ঘর দুটোই বুক করে রেখেছিল ও আগে থেকেই। গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারের সঙ্গেও কথাবার্তা বলে এল। তিনি বললেন, কোম্পানির হেড অফিস থেকেও ফোন এসেছিল। ব্যানার্জিসাহেবের দেখভাল ভালো না হলে আমার চাকরিই চলে যাবে।

    আজ মহালয়া। পুজো তো এসেই গেল। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ লেগেছে। শিউলি গাছের নীচে কমলা-বোঁটা সাদা-ফুলের অবিন্যস্ত আলপনা পড়েছে। বড়োজামদা আর বড়োবিলের মাঝামাঝি অনেকখানি জায়গা নিয়ে গর্জন সেন-এর অর্থাৎ কর্বুরের দাদুর বানানো একতলা বিরাট বাংলোটির মধ্যে গাছগাছালি, জগিং অথবা হাঁটার পথ, লিলিপুল, তাতে জাপানিজ গার্ডেন–শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের লিলিপুল-এর মতো, সব-ই আছে। বাংলোর ভেতরে, কিন্তু অন্যপ্রান্তে একটি বড়ো গেস্ট-কটেজ আছে তাতে দু-টি শোয়ার ঘর এবং মাঝে ডাইনিং-কাম-লিভিং রুম, সামনে পুবমুখী চওড়া বারান্দা। অ্যাটাচড বাথ। তাতে গিজার, কমোড তো আছেই এবং বিদেও আছে, মেয়েদের সুবিধের জন্যে।

    কর্বুর ভাবছিল, ওঁরা এসে এইখানে থাকলে দেখাশোনা করার সুবিধে হত। কাকু নাকি বলেওছিলেন ব্যানার্জিসাহেবকে কিন্তু উনি নাকি গা করেননি। কেন করেননি, কে জানে। হয়তো ভেবেছিলেন, অধঃস্তন অফিসারদের কাছে ব্যক্তিগত ঋণ হয়ে যাবে, নয়তো ভেবেছিলেন, সেখানে থাকাটা তাঁর নিজের এবং তাঁর নানা আরামে অভ্যস্ত মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট আরামদায়ক হবে না হয়তো।

    যাই হোক, ওঁদের যা খুশি তাই করুন। কর্বুরের কিছু করার নেই এ ব্যাপারে।

    বাংলো থেকে বেরিয়ে, যে-পথটি অনেক দূরের প্রধান সড়কে পড়েছে সেই লাল মাটির ঢেউ-খেলানো পথটাকে, বর্ষার জল পেয়ে চড়চড় করে বেড়ে-ওঠা কচিকলাপাতা-রঙা শালের চারাগাছ, সবুজ-রঙা ঝাঁটিজঙ্গল এসে যেন, দু-পাশ থেকে গলা টিপে ধরেছে। দু-পাশের বড়োগাছের ডালপালা আর ফুলপাতা মাথার ওপরে সবুজ-রঙা চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে। তাতে দিনের বেলাতে সোনা-রঙা রোদের ঝালর ঝোলে। এবং হাওয়ায় দোলে। শরতের রোদ তখন বুটি-কাটা গালচে পাতে, সোনা-সবুজ রঙা, সেই পথে। আর চাঁদনি রাতে সেই চাঁদোয়ার-ই হাজারও ঝরোকা খুলে যায়। সেই চাঁদোয়ার রং তখন হয়ে যায় রুপোলি। আর তা দিয়ে রূপসি রুপোচুর আলো চুঁইয়ে পড়ে বরখার মতো।

    ওদের বাংলোর বাগানের মধ্যে শারদীয়া গাছগাছালির মিশ্রগন্ধের মধ্যে বারোমাস্যা চাঁপা আর ম্যাগনোলিয়া গ্রাণ্ডিফ্লোরার গন্ধ থম মেরে থাকে। আমলকীর ডালেদের থেকে পাতা ঝরতে থাকে। জলপাই গাছের গাঢ় সবুজ পাতাগুলোতে তখন জেল্লা লাগে। দাদুর শখ করে লাগানো রাবার গাছগুলোর পাতাগুলো কালচে-সবুজ দেখায়। রাবার গাছে অনেক জল লাগে। তাদের জন্যই আজ থেকে ষাট বছর আগে দাদু ইংল্যাণ্ড থেকে Sprinkler আমদানি করেছিলেন। তবে গ্রীষ্মকালে বাগানের অনেক জায়গাতেই Sprinkler ব্যবহার করা হয়। এই শরতে প্রত্যেকটি গাছ এক বিশেষ সুগন্ধে সুগন্ধি হয়। বর্ষণক্ষান্ত প্রকৃতি পাখিদের গলার জুয়ারি খুলে দিয়ে ঠোঁটে মধু ঢেলে দেয়।

    দাদুর খুব-ই গোলাপের শখ ছিল। বাবা আর কাকুর সিজন-ফ্লাওয়ার আর গোলাপের চেয়ে পছন্দ বেশি স্বয়ম্ভর নানা দিশি-বিদেশি গাছের। ওদের বাগানে কদম থেকে রাধাচূড়া, আতা থেকে চালতা কোনো গাছের-ই অভাব নেই। মস্তবড়ো বটল-ব্রাশ থেকে আফ্রিকান টিউলিপ, আকাশমণি থেকে অগ্নিশিখা, অমলতাস থেকে বাসন্তী সব গাছ-ই আছে। প্রায় দশ বিঘা জায়গা নিয়ে বাংলোটা। দাদু গর্জন সেন বাংলোর নাম রেখেছিলেন টাটিঝারিয়া।

    গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের বগোদর থেকে হাজারিবাগ শহরে যেতে পথে পড়ে টাটিঝারিয়া। দাদুর খুব প্রিয় জায়গা ছিল ওই টাটিঝারিয়া। মস্তবড়ো একটা রয়্যাল টাইগারও মারেন দাদু সেখানে এক শীতের সকালে। টাটিঝারিয়ার বাংলোতেই দশদিন। সেই জায়গার নামেই বাংলোর নাম দেন। নামটি বড়োই কাব্যিক।

    কর্বুর, বলতে গেলে এই বাংলোর হাতার মধ্যেই বড়ো হয়েছে। এখনও যখন খাদানে না থাকে, তখন এই বাড়ির মধ্যেই সময় কাটে কর্বুরের। বন্ধু-বান্ধব, আজ্ঞা যাকে বলে, তা কখনোই ছিল না। নিজের চেয়ে উৎকৃষ্ট মানুষের সংস্পর্শ ওর ভালো লাগে। নইলে উৎকৃষ্ট মানুষদের সঙ্গে সময় কাটায় লাইব্রেরিতে, গান শুনে। অবসর সময়ে বাগানের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এই বাগান-ই শিশুকাল থেকে ওর মধ্যে প্রকৃতির প্রতি এক গভীর ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছে। ছুটি-ছাটা পেলেই ও সারাণ্ডার বনে বনেও ঘুরে বেড়ায়। বলতে গেলে, এই-ই প্রধান শখ ওর। শখ বলা ঠিক হবে না। বলতে হয় নেশা।

    টালির ছাদ-দেওয়া চারদিক খোলা একটি তিনকোনা ঘর বানিয়েছে বাগানের এক নিরিবিলি কোণে। সিমেন্টের গোল টেবিল ও বেঞ্চ আছে তার নীচে। সেখানে বসেই গান শোনে কর্বুর। কখনো ছবি আঁকে। ডায়েরি লেখে। কখনো কিছু লেখালেখিও করে। তবে নিজেই লেখে, নিজেই পড়ে। ও একা থেকেই আনন্দ পায় খুব। তার লেখা কবিতা বা গদ্য বা তার গাওয়া গান গাছেরা শোনে, ফুলেরা শোনে আর শোনে পাখিরা।

    এতেই খুশি কর্বুর। খাদানে ওকে যেমন সব জাগতিক কাজ করতে হয় তার সম্পূর্ণ বিপরীত জগতে বাস করে, ও যখন খাদানে থাকে না। ওর কোনোরকম সুখের জন্যে অন্য কারওকেই প্রয়োজন যে, পড়ে না একথাটা জেনে ও এক ধরনের শ্লাঘা বোধ করে। সেই শ্লাঘাকে ও ন্যায্য বলেই মনে করে। অন্তর্মুখী বলে ও নিজেকে নিয়ে গর্বিত এই সহজ বহিমুখিতার দিনে। তবে সেই গর্ব প্রচ্ছন্ন থাকে ওর নিজের-ই মধ্যে। বাইরে তার কোনোই প্রকাশ নেই। কেজোজগতে ওর যে, ব্যক্তিত্ব সেই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ওর অবসরের জগতের ব্যক্তিত্বের কোনোই মিল নেই। ঈশ্বরের কাছে তাই ও প্রার্থনা করে, সুখের-ই মতো, ওর দুখের দিনেও যেন ওর অন্য কারওকেই প্রয়োজন না হয়। ঈশ্বরের দেওয়া হাজারও সুখের ভার যদি সে বইতে পেরে থাকে এতগুলো বছর অনায়াসে কোনো জ্যোতিষীনির্দেশিত কোনো মাদুলি বা আংটি না পরেই, তাহলে সে তাঁর দেওয়া দুখের ভারও সইতে পারবে।

    তার কাকি পদ্মা তার-ই সমবয়েসি। কাকু চাকুরিতে জয়েন করে টাটাতে থাকলেও কাকি এখানেই থাকতেন। উইক এণ্ডে কাকু আসতেন গাড়ি চালিয়ে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় চলিতার্থে, কাকি তা ঠিক নয়। কিন্তু তার মনটি ভারি সুন্দর। তার শরীরের বাঁধুনিটিও। চোখ চিবুকও কাটা কাটা। কিন্তু নাকটি একটু চাপা। সেই খুঁতের ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছেন ঈশ্বর তার চোখ দুটিতে। কাকির চোখের দিকে চাইলে চোখ ফেরানো যায় না। যেদিন কাকি চোখে কাজল দিত সেদিন আড়কাঠি হয়ে যেত চোখ দুটি। কর্বুরের দুটি চোখকে সেই চোখজোড়া কোনো অদৃশ্য আঠাতে জুড়ে দিত। খড়কে-ডুরে তাঁতের শাড়িতে অথবা কটকি শাড়িতে অথবা কখনো-কখনো প্যাস্টেল শেড-এর বেগমবাহারে বা মধ্যপ্রদেশের হোসসা সিল্কে এই বাগানে প্রজাপতির মতো মনে হত কাকিকে।

    পদ্মা যখন এই বাড়িতে প্রথম আসে তখন কর্বুরের বয়স বাইশ আর পদ্মার বয়স পঁচিশ। পঁচিশ বছরের বিবাহিত নারী অভিজ্ঞতাতে বাইশ বছরের কলেজছাত্র কর্বুরের চেয়ে অনেক ই এগিয়ে ছিল। পদ্মা কাকিমা না বলে কর্বুর তাকে কিছুদিন পর থেকেই ডাকত শুধুই কাকি বলে। তাতে কারর-ই আপত্তি ছিল না। একমাত্র পদ্মার ছাড়া। পদ্মা বলত, কাকি মানে তো মেয়ে কাক। আমি কি এতই কুৎসিত?

    বলতে গেলে, প্রোষিতভর্তিকা, নিঃসন্তান অল্পবয়েসি পদ্মার একমাত্র সঙ্গী ছিল কর্বুর। ও বড়ো হয়ে ওঠার পরে কাকির সান্নিধ্য ওর শরীরের মধ্যে নানারকম উদবেগ জাগাত। এক অস্বস্তিকর ভালো লাগাতে বিবশ হয়ে পড়ত কর্বুর। তাই, ওর মতো করে ভালো যেমন বাসত কাকিকে, তেমন এক ধরনের ভয়ও জাগত বুকের মধ্যে। কাকির মধ্যে এমন কিছু ছিল যে, অঙ্গুলিলেহনে সে প্রায় সমবয়েসি কর্বুরকে তার দাস করে তুলতে পারত। কাকির

    কোনো অনুরোধ, কোনোরকম আজ্ঞাই তাকে মুখে বলতে হত না। তার চোখের ভাষাই যথেষ্ট ছিল, সেইসব ভয়ংকর অথচ শালীন খেলার দিনে। কাকি তখন ভীষণ-ই একা। কিরি তখনও আসেনি। একটা সময়ে কাকি, কাকুর ওপরে সব ভরসা ত্যাগ করেছিল। অথচ দোষটা পরোক্ষে দেওয়া হত কাকিকেই সেকথা বুঝতে পারত কর্বর। কাকি ছিল তার একমাত্র খেলার সাথি, তার কবিতা ও গানের একমাত্র শ্রোতা। তার নির্জনতার একমাত্র সাথি। কাকি জামশেদপুরে চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে মন বসে না কর্বুরের। খাদানেই থাকে অধিকাংশ সময়ে। যখন পারে তখন সারাণ্ডার কোনো বাংলোতে চলে যায়।

    মা-বাবা অখুশি হন কিন্তু তাঁদের মুডি ছেলেকে কিছু বলেন না মুখে।

    বিয়ের পাঁচ বছর পরে কলকাতার ডাক্তার ঘনশ্যাম কুন্ডুর হাতযশে পদ্মা কনসিভ করে। ছ-বছরের মাথাতে কিরি জন্মায়। এই ছ-বছরে পদ্মা ও কর্বুর দু-জনেই অনেক বড়োও বুঝি হয়েছে নিজেদের যার যার মতো করে। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বুঝির মধ্যেও কিছু অবুঝপনা তো থাকেই। সেই অবুঝপনাকে গলা টিপে যারাই মারতে জানে, মারতে পারে, তারাই শুধু জানে তাদের কষ্টের কথা। কর্বুর ও পদ্মা জেনেছিল, তাদের নিজের নিজের মতো করে সেই কষ্টকে। ঘি আর আগুন কাছাকাছি থাকলে এবং বিশেষ করে প্রকৃতির মধ্যে থাকলে, যেকোনো মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে যেতেই পারে। বাইরের নয়, ভেতরের সেই আগুনকে নিবোনোর জন্য কষ্ট যেমন আছে, এক গভীর ব্যথাজাত আনন্দও আছে। সেই কষ্ট ও আনন্দের কথা, সেই কষ্ট ও আনন্দ, যারা জীবনে কখনো পেয়েছে, শুধু তারাই জানে।

    .

    ০৪.

    গতকাল দশেরা গেছে। আজ মান্ডুর রূপমতী মঞ্চস্থ হবে। ব্যানার্জিসাহেবেরা সকলে এসে গেছেন দুপুরে। রাতে সকলেই নাটক দেখতেও আসবেন। কাকিও রয়ে গেছে নাটক দেখার জন্য।

    কর্বুরের বাবা বলেছিলেন, ব্যানার্জিসাহেবরা যখন আসবেন আমি আর তোর মা-ই যাব ওঁদের রিসিভ করতে। আর পদ্ম তো যাবেই বলেছে। তুই যা করছিস তাই ভালো করে কর। জীবনে এই প্রথম নাটক করছিস, সকলে যেন দেখে ধন্য ধন্য করে। জীবনে যা-কিছুই করবি, কোনো কিছুই খারাপ করে করিস না। এমন জেদে করবি যে, জীবনের কোনোক্ষেত্রেই যেন, তোকে কেউ হারাতে না পারে। এক নম্বর হওয়ার সাধনাই পৌরুষের সাধনা।

    মা বলেছিলেন, কেন? সাধনা কি শুধু পুরুষদের-ই একচেটে নাকি? পুরুষ-এর নয়, মানুষ-এর বলো।

    ঠিক-ই বলেছ তুমি। দিনকাল পালটে গেছে। আমরা এখনও এই পৃথিবীকে পুরুষ-প্রধান পুরুষশাসিত বলেই মনে করি। সেটা ভুল।

    কর্বুর আর পদ্ম টাটিঝারিয়ার বাইরের গেট-এ দাঁড়িয়ে কাকুকে টা-টা করে দিয়ে ফিরে আসছিল। কাকি আর কিরি নাটক দেখে তারপর-ই যাবে। সিরাজ চাচা পৌঁছে দিয়ে আসবে।

    কাকি বলল, তোমাকে কিন্তু সত্যিই নবাবের মতোই দেখাবে। স্টেজ রিহার্সালেই যা দেখাচ্ছিল।

    নবাবের পোশাক পরলেই তো নবাব হওয়া যায়। বাহাদুরির কী?

    কর্বুর বলল।

    –ঠিক তা নয়। পোশাক, কারওকে নবাবের ভড়ংটুকুই দিতে পারে মাত্র, নবাবি আছে। তোমার চেহারায়, চলাফেরায়, গলার স্বরে, চোখের দৃষ্টিতে।

    -আমাকে ফিউড্যাল বলছ?

    তারপর-ই বলল, বড়োজামদার শিখীকে কীরকম দেখাবে?

    –ওর মধ্যে আভিজাত্য বলে কোনো ব্যাপার-ই নেই। তোমার পাশে ওকে বাঁদির মতো দেখাবে। ঝুটো হিরে-মুক্তো পরলেই কি আর বাঁদি রানি হয়ে যায়?

    –আমার তো বেশ লাগে শিখীকে। স্মার্ট, বুদ্ধিমতী, ব্যক্তিত্বময়ী, হাসিখুশি।

    –হুঁ। ঐশিকাকে তত দ্যাখোনি। তাই শিখীর প্রশংসা করছ। তুমি একটি ভ্যাবাগঙ্গারাম। ক-জন মেয়ে তুমি দেখেছ জীবনে?

    –তা সত্যি। সেই শরীর-মন জাগার পর থেকে প্রথম যৌবনে মা ছাড়া, মেয়ে বলতে তো, শুধু তোমাকেই দেখেছি। তুমি আসার আগেই তো দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তুমি এমন করেই আমার সমস্তখানি মন জুড়ে ছিলে যে, অন্য কারওকে দেখবার বা জানবার সুযোগ যে, পাইনি তাই শুধু নয়, দেখবার বা জানবার কোনো তাগিদও হয়তো বোধ করিনি।

    –দোষটা তাহলে আমার-ই বলছ?

    –দোষের কথা তো বলিনি কাকি। এ তো তোমার গুণ-ই। চারুলতার মতো তুমিও যে, আমার সখী ছিলে। জীবনের যা-কিছু সুন্দর দিক, সব তো আমি তোমার মধ্যেই দেখেছি। তোমার কাছ থেকেই শিখেছি, মানে তোমার-ই সান্নিধ্যে। আমার কিন্তু মনে হয় যে, তোমাকে কাছে পেয়েছিলাম দীর্ঘ ছ-বছর, কিরি আসার আগে পর্যন্ত, তাই অন্য কোনো মেয়েকেই আমার এ-জীবনে আর ভালো লাগবে না। মেয়েদের কেমন যে, হওয়া উচিত তার-ই রোল মডেল হয়ে উঠেছ তুমি আমার কাছে।

    -লাগবে, লাগবে। ঐশিকাকে ভালো লাগবেই। কতকিছু স্বপ্ন দেখেছি আমি। হয়তো দাদা আর দিদিও দেখছেন। তোমার কাকু তো তার নিজের বয়েসটা একটু কম হলে ঐশিকাকে নিজেই বিয়ে করে ফেলতেন, ভাব দেখলে এমন-ই মনে হয়।

    -ভালোই বলেছ। আগেকার দিনে স্ত্রী গত হওয়া অনেক বাবা ছেলেদের জন্যে পাত্রী দেখতে গিয়ে মেয়ে তেমন পছন্দ হলে যেমন নিজেরাই বিয়ে করে ফেলতেন তেমন-ই আর কী!

    ওরা লতাপাতা ডালপালার চাঁদোয়ার নীচে নীচে পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ, শরতের রোদের গন্ধের মধ্যে ঝুঁদ হয়ে সবুজাভ-সোনালি পথ বেয়ে বাংলোর দিকে ফিরে আসছিল। গেট থেকে। টাটিঝারিয়ার গেট থেকে বাংলোটি প্রায় আড়াইশো মিটার মতো।

    কর্বুর বলল, আচ্ছা কাকি, আমার সুখ নিয়ে তুমি এত ভাবো কেন বলো তো?

    কর্বুরের মুখের দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রক্তিম মুখে পদ্মা বলল, ভাবব? আমি যে, তোমার মায়ের-ই মতন কবু, আমি যে, তোমার কাকিমা।

    -তা তো বটেই। সম্পর্কেই ওই কাকিমা। আমার চেয়ে কী এমন বড়ো। তোমার সঙ্গে তো আমার বিয়েও হতে পারত তুমি আমার কাকিমা না হলে।

    আরও অনেক কথাই মনে এসেছিল কর্বুরের, সেসব বলল না। গান, সাহিত্য এইসবের সাঁকো পেরিয়ে নারীর মধ্যে যে, চিরকালীন রহস্য জমা রয়েছে অনন্তকাল ধরে তার-ই হদিশ পেয়েছিল কর্বুর পদ্মার মাধ্যমে।

    –সেকথা অবান্তর। ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমি তোমার কাকিমা। তোমার গুরুজন। মনে নেই? দিদি বিয়ের পর প্রথম বছর বিজয়ার দিনে আর নববর্ষে তোমাকে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করিয়েছিলেন। তারপরে অবশ্য আমিই দিইনি তোমাকে প্রণাম করতে।

    –প্রণামের কতরকম হয়, কাকি। পা ছুঁলেও অনেক সময়ে প্রণাম হয়ে ওঠে না, আবার কারওকে চুমু খেলেও তো তা প্রণাম-ই হয়ে ওঠে।

    পদ্মা চুপ করে রইল।

    –বলল, জানি। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো চুমুরও ছিল না, প্রণামেরও নয়।

    তারপর বলল, বলো কবু, ছ-ছটা ভারি বিপজ্জনক বছর আমরা কাটিয়ে গেছি এখানে– কিরি আসার আগে অবধি! তাই না?

    –তাই। আমরা দুজনেই যে, ভ সভ্য, সম্ভ্রান্ত পরিবারের তার প্রমাণ কিন্তু আমরা দিয়েছি।

    –তা দিয়েছি। কিন্তু সেই অলিখিত সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্যে, কষ্টও তত কম পাইনি দু-জনেই আমরা। বলো তুমি?

    পদ্মা বলল।

    চমকে উঠে কবু বলল,

    –তা ঠিক! তবে মাঝে মাঝে কী মনে হয় জান?

    –কী?

    –সেই কষ্টটাই হয়তো আনন্দ ছিল।

    একটু চুপ করে থেকে পদ্মা বলল, ঠিক তাই। জীবনে যা-কিছুই গভীর আনন্দের তার বেশির ভাগ সম্ভবত কষ্টই। কষ্টটাই যে, আনন্দ তা বুঝতে অনেক-ই সময় লাগে। ত্যাগ বা বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে যে, গভীর এক শুচিস্নিগ্ধ আনন্দ আসে তা সম্ভবত সহজ এবং সাধারণ শারীরিকপ্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে আসে না কোনোদিন-ই।

    –কী জানি! জানি না। তবে আমার একটা ভয় হয় কাকি যে, যদি কখনো বিয়ে করি, কোনো মেয়েকেই আমি তোমার আসনে বসাতে পারব না।

    -একী অলক্ষুণে কথা। ছি :, ওরকম বলতে নেই। দিদি এবং দাদা আর তোমার কাকু একথা শুনতে পেলে কী ভাববেন বলো তো আমাকে? তা ছাড়া, আমি তো তোমাকে দুখি করতে চাইনি কোনোদিন-ই, সুখী করতেই চেয়েছিলাম। ওরকম করে বোলো না। আমার পক্ষে নিজেকে ক্ষমা করা সম্ভব হবে না তাহলে কোনোদিনও। তা ছাড়া, বিয়ে করলেই জানবে যে, নারী-পুরুষের সম্পর্কে শুধু মন-ই নয়, শরীরটাও অনেকখানি। দাম্পত্যর সঙ্গে নিছক মনের প্রেমে তফাত আছে অনেক-ই। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। You have to live life to know life. সব জিনিস বই পড়ে বা উপদেশ পেয়েই শেখা যায় না।

    বাংলোতে পৌঁছে ওরা দু-জনে বারান্দাতে এসে বসল। কর্বুরের বাবা এবং মা, কাকু আর কিরি রওনা হয়ে যাওয়ার পরেই বিজয়া সারতে বেরিয়ে গেছেন। একটি নতুন ফিয়াট উনো এসেছে, বাসন্তী-রঙা। বাবার ওই গাড়িটা খুব পছন্দ। নিজেই চালিয়ে গেছেন। বাবার ড্রাইভার বানোয়ারি আজ আসবে না। দশেরার দিন রাতে প্রচুর সিদ্ধি খেয়েছে আর ঢোল বাজিয়ে নেচেছে। আজ নেশা কাটতে সময় লাগবে। যদি আসেও হয়তো সন্ধের দিকে আসবে।

    পদ্মা বলল, দশটা বাজে। তুমি যাও স্নান করে নিয়ে বিশ্রাম করো। আমি কিচেনে যাচ্ছি। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে একটা ঘুম লাগাও। তারপর গরম জলে স্নান করে বেরোবে। ক টাতে পৌঁছাতে হবে?

    -চারটেতে। মেক-আপ-এ যে, অনেক-ই সময় নেবে।

    –তা তো নেবেই। নবাব হওয়া কি সোজা কথা! যাওয়ার আগে গরম জলে দুটো ডিসপিরিন ফেলে গার্গল কোরো আর আমার কাছ থেকে কাবাব-চিনির রুপোর কৌটোটা নিয়ে যেয়ো। গালে ক-টি ফেলে রাখবে, দেখবে, গলা বাঘের মতো বলছে।

    -কত বড়োকৌটো?

    ছোটোকৌটো। নস্যির কৌটো। বেঁটে কাকার ছিল। ওপরটাতে ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিক লাগানো। ভেতরটা দেখা যায়। আমার একটা পেতলের কৌটো ছিল। বেঁটে কাকা সেটা নস্যির জন্যে নিয়ে তাঁর রুপোর কৌটোটা কাবাব-চিনি রাখার জন্যে দিয়ে দেন। তোমার নবাবি জোব্বার পকেটে থাকবে। স্টেজেও তুমি জোব্বা থেকে বের করে খেতে পারবে। কৌটোটা আমি silvo দিয়ে পালিশ করে দিচ্ছি। এসব জিনিস তো নবাবদের-ই মানায়।

    –সে হবেখন।

    –তুমি যাও। বিশ্রাম করো। আমি ওদিকে যাই।

    উঠে দাঁড়িয়েই, পদ্মা বলল, কাল ভোরে কখন বেরোবে জঙ্গলে?

    –ব্রেকফাস্ট করে বেরোব। ওঁদের বলেছি, সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকতে।

    –প্রথমে কোথায় যাবে?

    –কুমডি।

    –ইশ। যেখানে আমরা বাংলোর পাশে হাতি দেখেছিলাম?

    –হ্যাঁ।

    –আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে জঙ্গলে যাওয়ার মজাই আলাদা। কত গাছ চেন তুমি, কত পাখি, কত ফুল।

    –চল-না তুমি।

    -তা হয় না।

    -কেন?

    –আমরা সকলেই চাই তুমি আর ঐশিকা দু-জনে দু-জনকে কাছ থেকে জানো।

    -তাহলে কাবাবমে হাড্ডি করে গৈরিকাকেও সঙ্গে দিচ্ছ কেন?

    হেসে উঠল পদ্মা।

    তারপর বলল, রিলিফ-এর জন্যে। একটানা একসঙ্গে থাকলে রোমিওরও, জুলিয়েটকে খারাপ লাগতে পারত।

    -তাই? আর ঐশিকার বাবা?

    –ব্যানার্জিসাহেবও দারুণ কম্পানি। কোনোরকম হ্যাঁঙ-আপস নেই ভদ্রলোকের। তাঁর স্ত্রী সত্যিই ভাগ্যবতী ছিলেন।

    -তাই নাকি? তবে লোকে যে বলে, যার স্ত্রী মরে, সেই ভাগ্যবান।

    –তারা সব বাজে লোক।

    –চল-না তুমিও। খুব মজা হবে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। আমার নার্ভাস লাগছে।

    –নার্ভাস হওয়ার পাত্ৰই তো তুমি। বাজে কথা বোলো না।

    -চলো চলো।

    –জান-না। কিরিটা একা থাকবে। স্কুলও তো খুলে যাবে কাল থেকে। তোমাদের রওনা করিয়ে দিয়ে আমিও চলে যাব টাটা। ছানা-পোনা যতদিন ছিল না, দিন অন্যরকম ছিল।

    বলেই বলল, নাঃ। আর গল্প নয়। এবার আমি যাচ্ছি। আজ বারোটার মধ্যে খেয়ে নেবে। আজ মুন্না দেবী কী রাঁধছে গিয়ে দেখি।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাখসাট – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article পরিযায়ী – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.