Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পরির গল্প

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প27 Mins Read0

    পরির গল্প

    ছেলেবেলায় রঙ্গন ও তার দিদি কাঞ্চন যে পথ দিয়ে পায়ে হেঁটে ইস্কুলে যেত সে পথের দুই ধারে লোক দাঁড়িয়ে যেত। আর বলাবলি করত—

    এরা কারা হে?

    এরা নতুন পোস্টমাস্টারবাবুর মেয়ে। কলকাতা থেকে এসেছে।

    বল কী? দুই বোন? কই, দেখতে তো দুই বোনের মতো নয়!

    একেবারেই না। বোধহয় দুই মা।

    হতে পারে দুই মা, হতে পারে দুই।

    চুপ চুপ, শুনতে পাবে।

    শুনতে পেলে রঙ্গনের ও কাঞ্চনের কানের গোড়া লাল হয়ে উঠত। কিন্তু কী করবে? তখনকার দিনে ইস্কুলের বাস তো হয়নি আর ইস্কুলটাও হাই স্কুল হয়ে ওঠেনি। মেয়েদের ইস্কুলে মেয়েরা পড়াবে না বুড়োরা পড়াবে তাই নিয়ে তর্ক চলছিল তখনও। রাজপথে আট-দশ বছর বয়সের মেয়েদের চলাফেরা একটা দেখবার মতো ব্যাপার ছিল।

    তারপর ইস্কুলে পা দিয়েও দুই বোন আবার তেমনি লোকজনের দৃষ্টি টেনে আনত। সহপাঠিনীরা ফিসফিস গুজগুজ করত—

    দেখেছিস কেমন সুন্দরী! যেন ডানাকাটা পরি!

    পরি না ফরি, না ফরফরি।

    না ফুরফুরি।

    ওর নাম কাঞ্চন। ওর ছোটোবোনের নাম রঙ্গন।

    রঙ্গন না বেঙ্গন।

    বেঙ্গন না ব্যাং।

    আমি বলি ডানাকাটা বানরী।

    ধুর বোকা! বানরী কখনো ডানাকাটা হয়। বানরের কি ডানা আছে?

    তাহলে ও ডানাকাটা ময়না।

    না না, অতটা কালো নয়।

    তবে ডানাকাটা ময়ূর।

    না না, অতটা কুৎসিত নয়।

    তবে ও ডানাকাটা পাতিহাঁস।

    আসলে হয়েছিল কী, তাদের দুই বোনের চেহারায় বেশ কিছু বৈষম্য ছিল। এতখানি বৈষম্য বড়ো-একটা দেখা যায় না। তা বলে কোথাও যে দেখা যায়নি তা নয়। রাজশাহি জেলার একটি বিশিষ্ট জমিদার বংশে দেখা গেছে। ভাই আর্য, বোন দ্রাবিড়। বোনের বিয়ে আটকায়নি। রূপের অভাব পুষিয়ে দিয়েছে রুপো।

    পোস্টমাস্টারমশায়ের কিন্তু রুপোর ঘরে শূন্য। সেইজন্যে একদিন তাঁর মা বলেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে, ‘বউমা, তুমি আমার লক্ষ্মী। তুমি রত্নগর্ভা। তোমার বড়োমেয়ের বড়ো ঘরে বিয়ে হবে। ও-মেয়ে বেঁচে থাকলে হয়। কিন্তু…’ তাঁর স্বর সহসা নেমে এল—‘ছোটোমেয়েকে পার করতে ঘড়া ঘড়া সোনার মোহর লাগবে। ব্রজ অত টাকা পাবে কোথায়? শেষে কি ডাকঘরের তহবিল ভেঙে হাতে হাতকড়া পরবে?’

    পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসত যাকে সেই মানুষের মুখে এই উক্তি! রঙ্গন তাহলে কার কাছে সহানুভূতি পাবে? তখন তার বয়স এগারো কি বারো। বোঝে সবই কিন্তু মেনে নিতে পারে না। কেন একযাত্রায় পৃথক ফল হবে? দিদি আর সে দুজনেই স্বর্গ থেকে এসেছে। ভগবান তাদের পাঠিয়েছেন। তাহলে একজনকেই রাজ্যের সমস্ত রূপ উজাড় করে দিলেন কেন? একটুও পড়ে থাকল না আর একজনের জন্যে। বেচারি দু-বছর পরে এসেছে বলে কি রূপলাবণ্যের তলানিটুকুও পাবে না?

    দিদির সঙ্গে একসঙ্গে বেরোতেও তার লজ্জা করত। কাঞ্চন ওই অঞ্চলের সেরা সুন্দরী। যেমন তার রূপ তেমনি তার রং। তেমনি তার গড়ন পাতলা ছিপছিপে দিঘল সরল, রজনিগন্ধার মতো শুভ্র, গোলাপের মতো পেলব, আঙুরের মতো স্বচ্ছ, শিরীষের মতো ফুরফুরে। খয়েরি চুল তার মতো আর কার আছে? নীল চোখের তারা তার মতো আর কোন মেয়ের? দিন দিন তার সৌন্দর্যের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে। কত লোক আসছে তাকে দেখতে। কত বাড়িতে তার জন্যে আদরের আসন পাতা! ধন্য মেয়ে কাঞ্চন।

    আর রঙ্গন? অমন যার দিদি সে কিনা বেঁটেখাটো মোটা শ্যামল শুকনো খসখসে ভারী। এত ভারী যে ডানা থাকলেও সে উড়তে পারত না, পাতিহাঁসের মতো আস্তে হেঁটে বেড়াত। মনের দুঃখে সে খাওয়া একরকম ছেড়ে দিয়েছে। তবু তার ওজন কমতে চায় না। খেলাধুলা করলে কমত। কিন্তু তার বয়সের মেয়েদের খেলাধুলা বারণ। ছাড় কেবল ঘরে বসে দশ-পঁচিশ খেলা বা তাস খেলা। তখনকার দিনে মেয়েদের বাইরের খেলা কোথায়?

    রঙ্গনদের ইস্কুলের পড়া শেষ হয়ে গেছল। ওটা মাইনর স্কুল। বাড়িতে বসে থাকতে তো কেউ দেবে না, সংসারের কাজে রাতদিন খাটাবে—যাতে হয় সে গৃহকর্মনিপুণা, সূচিশিল্পদক্ষা। বিয়ের বিজ্ঞাপনের ভাষায়।

    ব্রজদুর্লভ কলকাতার লোক। ছুটি নিয়ে বড়োমেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করতে গেলেন ও কলকাতাদুর্লভ জামাতা লাভ করলেন। ওরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদি মুতসুদ্দি বংশ। বনেদি বলে বনেদি! এখনও কলকাতার একটা রাস্তার দু-ধারে যতগুলো বাড়ি সব ক-টাই ওদের। ভদমহিলারা ওপথ দিয়ে যান না, ভদ্রলোকেরা যান সন্ধ্যার পরে। দেহভাড়া হিসেবে যে-টাকাটা দেন তার সিংহের হিস্সা যায় বাড়িভাড়া হিসেবে।

    ওরা কুবের আর ওদের ছেলেটা কার্তিক। কাঞ্চনের সঙ্গে রাজযোটক। এ বিবাহে সকলের মনে আনন্দ, কেবল রঙ্গন প্রাণ খুলে প্রফুল্ল হতে পারে না। ছেলেমানুষ হলেও সে এইটুকু বোঝে যে দুনিয়ায় সুবিচার কোথাও নেই, ন্যায়ধর্ম নেই। যারা ভালো তারা খেতে পায় না, তাদের মেয়েদের ভালো বিয়ে হয় না। যারা খারাপ তাদের অঢেল টাকা। তারা সুন্দরী মেয়েদের বিনা পণে বিয়ে করে নিয়ে যায়। তাদের ছেলেরাও তাই সুপুরুষ হয়। তাদের মেয়েরাও বিদ্যাধরী।

    কিন্তু এর থেকে ওর সিদ্ধান্ত হল অদ্ভুত। যেমন করে হোক ওকে রূপসি হতেই হবে। রূপ যদি আসে তবে ধনসম্পদও আসবে। অভাবের ঘরে ওর বিয়ে হবে না, হবে ঐশ্বর্যের ঘরে। যার সঙ্গে হবে সে হয়তো কার্তিক নয়। কাজ নেই অমন কার্তিকে। কিন্তু সে যেন দিদির বরের চেয়ে দীনহীন না হয়। লোকে যেন বলতে পারে যে, হ্যাঁ, রঙ্গনেরও ভালো বিয়ে হয়েছে। হবে না কেন? ও-মেয়ে কি কম সুন্দর নাকি?

    ঠাকুরের ওপর ওর বিশ্বাস টলেছিল। ও তাই একমনে ডাকতে লাগল পরিকে। যে-পরির গল্প ও ছেলেবেলায় পড়েছে। ও যেন সিণ্ডেরেলা। একদিন ওকেই ভালোবাসবে অচিন রাজপুত্র। পরি ইচ্ছা করলে কী-না পারে! পরির বরে রূপসি হওয়া এমন কী অসম্ভব!

    রঙ্গন তাই পরিকে ডাকে। দিনরাত ডাকে। ডাকতে ডাকতে মাস কেটে যায়। বছর কেটে যায়। কেউ জানে না ওর এই গোপন কথাটি, সমবয়সিনি সখীরাও না। ওর স্থির বিশ্বাস ওর ডাক ব্যর্থ হবে না। পরির আসন টলবে। বলবে, যাই দেখি কে আমাকে ডাকছে। এসে দেখবে—রঙ্গন।

    ওদিকে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। যদি-বা কেউ কালেভদ্রে দেখতে আসছিল রঙ্গনকে, অচল টাকার মতো বাজিয়ে দেখে বলে যাচ্ছিল ফিরে গিয়ে খবর দেবে। খবর আর আসেই না। রিপ্লাই পোস্টকার্ড লিখলেও না। বয়স গড়াতে গড়াতে আঠারোয় ঠেকল। ঠাকুমা বলেন তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। এখন যদি না ফোটে তো আর কোনোদিন বিয়ের ফুল ফুটবে না।

    অগতির গতি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সং সাজিয়ে দেখানো হল। কিন্তু ভবি ভোলে না। ভায়রাভাই শিবপদবাবু বললেন, ‘দাদা, তোমাকে একটা পরামর্শ দিই শোনো। তোমার মেয়ের যত ওজন ঠিক তত ওজনের তামার পয়সা জড়ো করে তাই দিয়ে ডার্বির টিকিট কেনো। একরাশ টিকিট কিনলে একটা লেগে যাবেই। তোমার ঘোড়া যদি ডার্বি জেতে তাহলে তোমার মেয়ের ভেড়া হতে দশ-বিশ জন বাঙালির ছেলে এগিয়ে আসবেই। তখন তুমি করবে স্বয়ংবর সভার আয়োজন।’

    সমান ওজনের তামার পয়সা বলতে কয়েক হাজার চাঁদির টাকা বোঝায়। ব্রজদুর্লভ কোথায় পাবেন অত! তাঁর মেয়ে যদিও দুটি, ছেলে তো অনেকগুলি। তাদের মানুষ করতে হবে না? ভদ্রলোক কোনোরকম সুরাহা না দেখে অবশেষে ঠিক করলেন যে ডাকঘরের কেরানি শরদিন্দুর গলায় রঙ্গনের মালা পরিয়ে দেবেন।

    ছেলেটি ভালো। অতি সচ্চরিত্র। অতীব সাধু। ব্রজদুর্লভবাবুর ওপর তার অগাধ শ্রদ্ধা। রঙ্গনকেও দেখে আসছে বহুদিন থেকে। তার কোনো দাবি নেই। তার দোষের মধ্যে সে পিতৃমাতৃহীন। গ্রামে পৈতৃক ভদ্রাসন আছে, কিন্তু জমিজমার শরিক একাধিক। চাকরিই ধরতে গেলে সম্বল। আর চাকরি তো শেষপর্যন্ত পোস্টমাস্টারি।

    কোথায় কাঞ্চনের বর ঘর ধনদৌলত দাসীবাঁদি নফর মোটর আর কোথায় রঙ্গনের ভিখারি দিগম্বর। বিয়ের পরে থাকতে হবে কেরানিবাবুর আধখানা চালাঘরে, রাঁধতে হবে আধখানা ঝির সাহায্যে। ষষ্ঠীর কৃপাও তো হবে একদিন। তখন ছেলের জন্যে দুধ ঘি জুটবে না। সরু চালের ভাত জুটবে কি না কে জানে, যদি বিধবা বোনটোন এসে জোটে।

    রঙ্গন প্রাণপণে পরির নাম জপে। ওই তার হরির নাম। পরি ইচ্ছা করলে কী-না সম্ভব! কেন তবে সে শরদিন্দু কেরানির বউ হয়ে দিদির দাসীবাঁদির সমান হতে যাবে! না, সে বিয়ে করবে না।

    দুই

    পরি একদিন সত্যি দেখা দিল। স্বপ্নে।

    এই তো সেই পরি। সেই রূপকথার পরি। কেতাবের ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। দেখছ না কেমন বড়ো বড়ো দুটি ডানা! এমন ডানা কি মানুষের হয়!

    পরি বলল, ‘বাছা রঙ্গন, তুমি কী চাও? কেন আমাকে অত করে ডাকছিলে?’

    রঙ্গন হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে বলল, ‘পরি, আমার বড়ো দুঃখ।’ আমার রূপ নেই বলে এরা আমাকে ঝি-এর মতো খাটায়। বিয়ে দিলে যার হাতে দেবে তার ঘরেও ঝি-এর মতো খাটতে হবে। আমার দিদির কেমন বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। পায়ের উপর পা দিয়ে বসে থাকে, কিচ্ছু করতে হয় না। সব কাজ করে দেয় এক কুড়ি ঝি-চাকর। দিদির বাড়ির কুকুর-বেড়ালও আমাদের চেয়ে ভালো খায়, ভালো পরে। তাদেরও গরমজামা আছে, শীতকালে গায়ে দেয়। পরি, দিদির আমার এক-গা গয়না। সিন্দুকে আরও কত আছে তার লেখাজোখা নেই। আর আমার দেখছ তো? এই পারসি মাকড়ি আর সরু সরু চুড়ি। পরি, আমার তিনখানা মাত্র শাড়ি, বাইরে বেরোব কী পরে? একখানাও কি রেশমের! আর ওদিকে দেখো গিয়ে দিদির কত বড়ো বড়ো আলমারি আর তোরঙ্গ শুধু শাড়িতে পোশাকে ঠাসা। পরি, দিদির ছেলে-মেয়েদের দেখলে তোমার চোখ জুড়িয়ে যাবে। যখন যা চায় তখন তা পায়—ক্ষীর, সর, ননী, মাখন, সন্দেশ, রসগোল্লা। আর আমার যদি ছেলে হয় সেকি এক ফোঁটা দুধ খেতে পাবে ভেবেছ?’

    পরি হেসে বলল, ‘তাহলে তুমি কী চাও তাই বলো।’

    রঙ্গন বলল, ‘কী-না চাই! সব চাই। বর চাই ঘর চাই ধন চাই। কিন্তু সকলের আগে চাই রূপ, দিদির মতো রূপ। তোমার পায়ে পড়ি, ঠাকুর আমাকে যা দিলেন না তুমি আমাকে তা দাও। রূপ দাও। বর দাও। ঘর দাও। ধন দাও। জন দাও। সুখ দাও।’

    পরি বলল, ‘তুমি যে আমাকে মহা বিপদে ফেললে রঙ্গন। আমি কি ভগবান না ভগবানের সমান! আমি তোমাকে সব কিছু দেব কী করে? দিলে দিতে পারি একটি জিনিস। সেটি কোন জিনিস তা তুমি ভেবেচিন্তে বলো। মনে রেখো, একটির বেশি নয়। ওই একটি নিয়ে তোমাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। আর আমাকে ডাকতে পারবে না।’

    রঙ্গন বলল, ‘বেশ, তবে আমাকে রূপ দাও। দিদির মতো রূপ।’

    পরি বলল, ‘তথাস্তু।’ এই বলে আকাশে মিলিয়ে গেল।

    রঙ্গন জেগে দেখল, কেউ কোথাও নেই। ওটা নেহাতই একটা স্বপ্ন। স্বপ্ন কি সত্যি হতে পারে! সে একটু একটু করে ভুলে গেল স্বপ্নের সব কথা।

    মাস কয়েক পরে তার পিসি পশ্চিম থেকে এলেন ভাইয়ের অসুখ শুনে। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমেই বললেন, ‘ও কে! কাঞ্চন! তুই কবে এলি? তোর শাশুড়ি আসতে দিল? কিন্তু ও কী! তোর সিঁথিতে সিঁদুর নেই কেন?’

    রঙ্গন প্রণাম করে বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না পিসিমা? আমি যে রঙ্গন।’

    পিসি বিশ্বাস করলেন না। রঙ্গন কখনো এত সুন্দর হতে পারে! ভিতরে গিয়ে বললেন, ‘রঙ্গনকে দেখছিনে কেন? আয় রে রঙ্গন, তোর জন্যে কী এনেছি দ্যাখ।’

    এমন সময় রঙ্গনের মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, সত্যিই তো! কাঞ্চন! আরও কাছে গিয়ে চিবুকটি তুলে ধরলেন। না কাঞ্চন নয়, কিন্তু কাঞ্চনের দোসর। ‘ওমা, আমার কী হবে গো! ঠাকুরঝি তুমি জাদু জান? আমার রঙ্গন কেমন করে কাঞ্চন হল? তোমরা কে কোথায় আছ গো, দেখবে এসো।’

    অসুস্থ শরীরে উঠে এলেন ব্রজদুর্লভ। ঠাকুরঘর থেকে ছুটে এলেন তাঁর মা। বাড়ির ছেলেরা যে যেখানে ছিল হইচই করে এল। সবাই দেখল রঙ্গন কেমন করে কাঞ্চন হয়ে গেছে। অবশ্য বেমালুম এক নয়। বোঝা যায় এ রঙ্গন। এর বয়স কম, এ কুমারী।

    তখন সে যে কী উল্লাস তা বলবার নয়। ঠাকুমা বললেন, ‘আমিই তোদের সকলের আগে লক্ষ করেছি! করেছি অনেক দিন। ও যা হয়েছে একদিনে হয়নি। তাহলেও মানতে হবে এমনটি আমার জীবনে আমি দেখিনি।’

    পিসিমা বললেন, ‘এ যেন গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি।’

    মা বললেন, ‘থাক থাক, বলতে নেই। মেয়ের যা কপাল, সইলে হয়!’

    বাপ বললেন, ‘ওকে আমি কলকাতা নিয়ে যেতে চাই। ওর উপযুক্ত বর এখানে বসে থেকে মিলবে না। ছুটির দরখাস্ত লিখে দিচ্ছি। ওরে, একটা টেলিগ্রামের ফর্ম নিয়ে আয় তো রে!’

    কলকাতায় রঙ্গনের জন্যে চেষ্টা চলতে লাগল। একদিন খুব মজা হল। কাঞ্চন তাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেছে। সে তার দিদির খোকাখুকুদের সঙ্গে খেলা করছে। এমন সময় জামাইবাবু এসে ডাকলেন, ‘কাঞ্চি, শোনো তো।’

    রঙ্গন বলল, ‘বা! আমি কাঞ্চি হতে গেলুম কবে! আমি যে রঙ্গন।’

    জামাইবাবু বললেন, ‘রঙ্গন! কী আশ্চয্যি! আমারই চিনতে ভুল হয়!’

    তারপর কাঞ্চন এসে পড়ল। তখন জামাইবাবু ওর সামনেই ওর বোনকে আদর করে বললেন, ‘ছোটোগিন্নি।’ রসিকতা করে বললেন, ‘বড়োগিন্নি না থাকলে বড়োগিন্নির কাজ ছোটোগিন্নি চালাতে পারবে।’

    এরপরে আপনার স্বার্থে কাঞ্চনের কর্তব্য হল বোনকে পাত্রস্থ করা। চেষ্টা করতে করতে মনের মতো বর পাওয়া গেল ক্ষৌণীশচন্দ্রকে। উঁচু পায়াওয়ালা সরকারি কর্মচারী। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে প্রমোশনের সাধনায়। তবে তাঁকে দেখলে চল্লিশ বলে মনে হয় না। আর হলেই-বা কী আসে-যায়! রঙ্গনও তো ডাগর হয়েছে। বাঙালির মেয়ে কি অত লম্বা হয়! যে-ই দেখবে সে-ই বলবে পাঞ্জাবি কি কাশ্মীরি। পাতলা ছিপছিপে হালকা ফুরফুরে। রজনিগন্ধা। গোলাপ। আঙুর। খয়ের। সেইসব উপমানের সঙ্গে উপমেয়।

    ক্ষৌণীশচন্দ্র মনের মতো বউ পেয়ে গেলেন। তিনি যে এতদিন অবিবাহিত ছিলেন এ যেন রঙ্গনেরই প্রতীক্ষায়। যে তাঁর মানসী বধূ। যাকে তিনি কোথাও খুঁজে পাননি। পেলেন এতদিন পরে। আকস্মিক ভাবে।

    বিয়ের পর রঙ্গন তার স্বামীর সঙ্গে পুনা চলে যায়। এমনিতেই সে গৃহকর্মনিপুণা, তার ঘরসংসার সে অল্পদিনের মধ্যে বুঝে নিল। চাকরগুলো দু-হাতে লুট করছিল। বাজারখরচ নাকি দিনে দশ টাকা। দশ টাকার নোটের একটা টাকাও বাজার থেকে ফিরত না। রঙ্গন সেটাকে চোখ বুজে করে দিল পাঁচ টাকা। তার থেকেও ফিরতে লাগল বারো-তেরো আনা। নইলে নোকরি ছুটে যাবে। দেখাশোনা করত রঙ্গন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। তাই রান্নার স্বাদ বদলে গেল। ক্ষৌণীশ বললেন, ‘মা বেঁচে থাকতে খেয়েছিলুম মনে পড়ে। তারপর এই খাচ্ছি। মাঝখানের পনেরো বছর অনাহারে কেটেছে।’

    কিন্তু পড়াশুনো তো সে সামান্যই করেছে। অত বড়ো সরকারি আমলার ঘরে মানাবে কেন? তাই তার জন্যে গভর্নেস বহাল হল। খাস ইংরেজ মেমসাহেব। বুদ্ধিমতী মেয়ে। চটপট শিখে নেয় আর মনে রাখে। বছর দুই যেতে না যেতে দেখা গেল সে ইংরেজের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলছে। কোথাও এতটুকু বাধছে না। কী চমৎকার উচ্চারণ! তবে সে বিদ্বানদের সঙ্গ পারতপক্ষে এড়ায়। তর্কবিতর্কের ধার দিয়ে যায় না। অতিথিরা গম্ভীরভাবে আলোচনা করছেন দেখলে সেলাইয়ের কাজ হাতে নিয়ে বসে। চোখ তুলে তাকায় না।

    তারপর স্বামীর সঙ্গে একবার বিলেত ঘুরে আসতেই তার আদিপর্ব সাত সমুদ্রের জলে ভেসে গেল। যে সমাজে সে মিশত সে-সমাজ তাকে জাতে তুলে নিল। সে না হলে পার্টি জমবে না। তাই নিত্য নিমন্ত্রণ। সে না হলে নাচ জমবে না। তাই অবিরাম সাধ্যসাধনা। বিস্তর খোশামোদ শুনতে হয় তাকে। তাতে যে তার মাথা ঘুরে যায় না এর কারণ সে তার দীনহীন অবস্থার দিনগুলি ভোলেনি, তাই অহংকারী হয়নি।

    তার একটা মস্ত গুণ সে সাধারণ গৃহস্থের পরিবারে আসা-যাওয়া করে, অসুখের সময় ফলমূল কিনে দেয়, সুখের দিনে ফুল কিনে উপহার দেয়। সকলের সঙ্গেই সহৃদয় ব্যবহার করে, হোক-না কেন গরিব কেরানি। শরদিন্দুকে সে বিয়ে করেনি বটে, কিন্তু তার মতো মানুষই-বা ক-টা দেখেছে বা দেখছে! মনুষ্যত্ব তার নতুন সমাজে বিরল।

    মাঝে মাঝে তার ভীষণ মন কেমন করত মা-বাবার জন্যে। ঠাকুরমার জন্যে। ভাইগুলির জন্যে। কিন্তু ফিরে যাবার পথ খোলা ছিল না। সে গেলে তারা ওকে রাখবে কোথায়? অত বড়ো লোকের রানিকে! তারাও যে আসবে তা নয়। পুনা অনেক দূর। খেটে-খাওয়া লোকের অত সময় কোথায়? আর খরচাই-বা জামাইয়ের সংসার থেকে নেবে কেন?

    একমাত্র কাঞ্চনের সঙ্গেই তার সমতা। কিন্তু কাঞ্চন কিছুতেই তাকে ডাকবে না, ছোটোগিন্নির ওপর কর্তার যা নেকনজর…! সেও কাঞ্চনকে আসতে বলবে না। ভিতরে ভিতরে বেশ একটু রেষারেষির ভাব। দিদির বোন বলেই তুলনায় রূপহীন দেখাত, নইলে কি কেউ কখনো মা-বাপ তুলে মন্তব্য করত? ডানাকাটা পরির সঙ্গে না দেখলে কেউ কখনো মিল দিয়ে বলত না যে ডানাকাটা বানরী। এখন অবশ্য সেও সমান সুন্দরী, সমান উচ্চ। তাহলেও কাজ কী দিদিকে ডেকে এনে? এ যেন খাল কেটে কুমিরকে ডেকে আনা। এদিকে কর্তারই হয়তো আফশোস হবে কী ভুলই করেছি বড়োগিন্নিকে বিয়ে না করে!

    কিন্তু একদিন এক অঘটন ঘটল। স্বামী কার সঙ্গে বিলেত পালিয়ে যাচ্ছে বলে বম্বে পর্যন্ত ধাওয়া করে এল কাঞ্চন। ট্রেন থেকে টেলিগ্রাম করল রঙ্গনকে ক্ষৌণীশকে। এরা দুজনে জোরসে মোটর ছুটিয়ে দিল। ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে খাড়া থাকল ক্যালকাটা মেল কখন আসে। কাঞ্চন নামল, তার কোলের ছেলেটি নামল, আয়া নামল, বেয়ারা নামল। কিন্তু পাখি দুটি উড়ে গেছে, ওদের ‘কূপ’ খালি। বনবন করে ফ্যান ঘুরছে। বার্থের গায়ে কার্ড আঁটা—মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস আর সি রায়।

    বেচারি কাঞ্চন! মণিহারা ফণী। পায়ে লুটিয়ে পড়তে চায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপর হাজার হাজার অচেনা লোকের সামনে। রঙ্গন তাড়াতাড়ি স্বামীর সঙ্গে কী পরামর্শ করল। স্বামী তৎক্ষণাৎ মোটরে করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। গন্তব্য পুলিশ হেডকোয়ার্টাস। দুই বোনে সদলবলে চলল তাজমহল হোটেলে।

    তিন

    এতক্ষণ যা বলা হল তা গৌরচন্দ্রিকা। এরপরে আসছে আসল গল্প।

    ক্ষৌণীশকে অনেক পেট্রোল পোড়াতে হল। পুলিশকেও তাঁর খাতিরে কম নয়। জুহুতে ওদের আবিষ্কার করা হল। কিন্তু গ্রেপ্তার করবে যে—কী অপরাধে?

    পাসপোর্ট চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল মিসেস রায়ের চেহারা মিসেস রায়েরই মতো। অর্থাৎ রায়ের সঙ্গে যিনি ছিলেন তাঁরই ফোটো আঁটা।

    ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কি মিসেস কাঞ্চনমালা রায়?’ পুলিশের প্রশ্ন।

    ‘আমিই।’ ভদ্রমহিলার উত্তর।

    এর উপর আর কথা চলে না। পুলিশ তো ভিজে বেড়ালের মতো পাসপোর্টখানা ফেরত দিয়ে তোবা তোবা করে সরে পড়ল। ক্ষৌণীশ ধরা পড়ে গেলেন। রমেশ শাসিয়ে বলল, ‘দেখে নেব। আমার স্ত্রীকে পুলিশ ডেকে এনে আমার স্ত্রী নয় বলে অপমান!’

    সত্যি, কাজটা ঠিক হয়নি। ক্ষৌণীশ বোকা বনে গেলেন। রমেশ যে অত বড়ো পাষন্ড হবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে যার ফোটো দাখিল করেছে সে কোনোকালেই কাঞ্চনমালা নয়। সে কাঁকনমালা। কাঞ্চনমালার দাসী। দু-পাতা ইংরেজি পড়েছে, সাজগোজ করতে শিখেছে, চেহারায় রস আছে। এখন বিলেত গিয়ে অম্লাবদনে কাঞ্চনমালা রায় বলে পরিচয় দেবে, ব্যাঙ্কের কাগজপত্র সই করবে, একরাশ দলিল সৃষ্টি করবে। পরে এই নিয়ে আইন আদালত করতে হবে। কোর্টে দাঁড়াতে হবে দুই নারীকে। কে যে কাঞ্চনমালা আর কে যে কাঁকনমালা সাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে সাব্যস্ত করতে হবে বিচারপতিকে। আর একটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা।

    জাহাজ ছেড়ে দিল। কেউ আটকাতে সাহস পেল না। জাহাজঘাটে যাবে বলে জেদ ধরেছিল কাঞ্চন। সে নাকি সাহেবকে বুঝিয়ে বলবে যে সে-ই সত্যিকার কাঞ্চনমালা। ওটা মিথ্যেকার কাঁকনমালা। ওর প্রকৃত নাম বিল্বদা। বাঁকুড়া জেলায় বাড়ি। সাহেব যে কোন সাহেব তা সে জানে না, কিন্তু সাহেব যখন-তখন নিশ্চয় সুবিচার করবে, সাহেব জাতটার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।

    ক্ষৌণীশ তাকে কোনোমতে নিরস্ত করতে না পেরে শুধু এই কথাটুকু বললেন, ‘সাহেব যদি দাবি করে যে ক্যাবিন যখন রিজার্ভ হয়েছে তখন যার নাম কাঞ্চনমালা তাকেই জাহাজে করে বিলেত যেতে হবে, তো উঠবেন আপনি জাহাজে?’

    ‘না না, আমার বাছাদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না।’ কেঁদে ফেলল কাঞ্চন। সে কী কান্না! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ফুলে হাত পা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কান্না।

    ‘আপনি না গেলে আপনার জায়গায় যেতে হয় আর একজনকে। কাঞ্চন সাজতে হয় রমেশের সহযাত্রিণী হতে। ও বোধহয় একা যেতে ভয় পায়।’

    রঙ্গন চোখ টিপে স্বামীকে নিরস্ত করল। ভদ্রলোকের আড্ডা দেওয়া অভ্যাস। আমুদে লোক বলে সর্বত্র জনপ্রিয়। প্রোমোশনের সেটাও একটা সংকেত।

    বম্বে থেকে ওরা পুনা গেল সবাই মিলে। কাঞ্চনের বুক ভেঙে গেছে। এবং রঙ্গন লক্ষ করে অবাক হল যে রূপ উবে গেছে।

    ‘দিদি, তোর রূপ গেল কোথায়?’

    ‘আমার রূপ! আমার রূপ আমি সাত ভাগ করে সাত ছেলে-মেয়েকে দিয়েছি আর দিয়েছি তাদের বাপকে। ও কার্তিক ছিল। কন্দর্প ছিল না। আমার রূপ নিয়ে হয়েছে কন্দর্প। ও এখন আমার দেওয়া রূপ দেবে কাঁকনকে—আমার বাঁদিকে। দিনে দিনে সুন্দর হবে কাঁকন। আমার ছোঁয়া দিয়ে সুন্দর। যে ছিল দাসী সে হবে রানি। যে ছিল রানি সে হবে দাসী।’

    রঙ্গনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করল এই উক্তি। মেয়েরা বিজ্ঞ হয় মেয়েদেরই অভিজ্ঞতা শুনে। পুরুষের পুথি পড়ে নয়।

    মাত্র সাতাশ বছর বয়সে কাঞ্চনের সব সুখ ফুরিয়ে গেল। এখন তাকে বাঁচতে হবে তার বাছাদের মুখ চেয়ে। নইলে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ত, গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ত, বাজার থেকে আফিং কিনে এনে খেত, কেরোসিন মেখে আগুন ধরিয়ে দিত, বিছানার চাদর ছিঁড়ে গলায় দড়ি দিত। বাঁদি হবে রানি। রানি হবে বাঁদি। ও হো হো!

    ‘রানি, আমার কী বুদ্ধি ছিল! রূপ থাকলে কী হবে, বুদ্ধি না থাকলে কিছুই থাকে না। না স্বামী, না সম্মান, না সম্পদ। আমি সোজা মানুষ। আমার ধারণা ছিল স্বামীকে যতগুলি সন্তান দেব তত বেশি ভালোবাসা পাব। সাতটি সন্তান দিয়ে সাত পাকে জড়াব। কই, তা তো হল না রে! গেল আমার রূপ। সেইসঙ্গে স্বামীর ভালোবাসা। ও হো হো!’

    দিদিকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে রঙ্গন ভাষা খুঁজে পেল না। গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। আর ভাবতে লাগল নিজের ভবিষ্যৎ।

    ‘এমন হবে যদি জানতুম তাহলে কি আমি সাধ করে মা হতে যাই। হলে হতুম এক বার কি দু-বার। আজকাল শুনি কতরকম নতুন নতুন উপায় বেরিয়েছে। দিদিমাদের মতো সাপখোপ খেতে হয় না। আমার শ্বশুরবাড়িতেই ক-টি বুড়ি পাগল। কী-সব খাওয়া হয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে। আমাকেও সিঁদুরের মতো লাল লাল কী একটা এনে দিয়েছিল, খাইনি। এনে দিয়েছিল ওই কাঁকন। ওই বিল্বদা। খেলে বাঁচতুম না রে!’

    রঙ্গন এর মধ্যে রঙিন হয়েছিল। বলল, ‘আমাকে চিঠি লিখিসনি কেন? আমার গভর্নেস আমাকে প্রথম থেকেই সাবধান হতে শিখিয়েছে। আমার তো হয় না।’

    তাই তো। এটা কোনোদিন কাঞ্চনের মাথায় আসেনি। তার ধারণা ছিল রঙ্গন ঠাকুরদেবতা মানে না বলেই তার হয় না। মা ষষ্ঠীর রোষ।

    ‘তা বলে কি একেবারেই হবে না রে?’

    ‘হবে বই কী। আগে তো জীবনটাকে উপভোগ করি। পঁচিশ বছর মাত্র বয়স। এ বয়সে মা হলে আমার ডানা কাটা পড়বে যে।’

    ‘ও, তুই বুঝি ডানাওয়ালা পরি?’

    ‘কেন? হতে দোষ কী? পরিদের ডানা থাকে কে না জানে? সেইটেই তো স্বাভাবিক। ডানাকাটা পরি শুনে শুনে তোর মাথা ঘুরে গেছে, তাই তুই বুঝতে পারিসনে যে ওতে পুরুষদেরই সুবিধে। ডানা দুটি কেটে রেখে তোকে ওড়বার অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। নইলে ওর সঙ্গে এক জাহাজে বিলেত যাবার কথা তো সত্যিকার কাঞ্চনেরই। তুই উড়তে জানিসনে তো উড়োপাখির সঙ্গে উড়বি কী করে! পুরুষ তো উড়োপাখি এটাও কি জানতিসনে?’

    কাঞ্চন ধিক্কার দিয়ে বলল, ‘বিল্বদা উড়ল। উড়বে বলেই বুঝি তিন-তিন বার মা হতে হতে মা হল না। আমি পারতুম না রে! আমার ডানাকাটা বলে আমার দুঃখ ছিল না। তবু তো পরি ছিলুম লোকের চোখে। এখন যে বানরী! ও হো হো!’

    তা নেহাত ভুল বলেনি দিদি। রঙ্গনের মনের কথাটা কেমন করে দিদির মুখে এসেছে। এতকাল পরে শোধবোধ হল ইস্কুলের সেই ডানাকাটা পরি ও ডানাকাটা বানরী বলে অন্যায় তুলনার। ওরে তোরা আয় রে ইস্কুলের ছুঁড়িরা, দেখে যা কে পরি, কে বানরী। এখন যে পরি সে ডানাওয়ালা পরি। আরও এক কাঠি সরেস।

    কাঞ্চন তার আর-সব খোকা-খুকুদের কলকাতায় ফেলে এসেছিল। কোলেরটিকে নিয়ে আর কদিন ভুলে থাকা যায়! ওরা চিঠি লিখেছে, মা, তুমি জলদি এসো। তোমার জন্যে মন কেমন করছে। তা পড়ে কাঞ্চনের চোখে কোটালের বান ডাকল। আরব্য উপন্যাসের মায়া সতরঞ্চ পেলে সে দু-দিন দু-রাত্রের পথ দু-দন্ডে পার হত। তা যখন নেই তখন রেলগাড়িতেই উঠে বসতে হল।

    দিদিকে বিদায় দিয়ে এসে রঙ্গনের প্রথম কাজ হল মেডকে নোটিস দেওয়া। মেড কথাটা ইংরেজি হলেও মানুষটি কোঙ্কনি। সবরকম গৃহকর্মে সাহায্য করত। রঙ্গনের প্রসাধনের পশ্চাতে থাকত তারই অদৃশ্য হস্ত। বয়স হয়েছে, বিয়ে হয়েছিল স্বামী মারা গেছে। নিঃসন্তান। এতদিন তাকে সন্দেহ করেনি, সন্দেহের উপলক্ষ্য ঘটেনি। এই প্রথম মনে হল যে সন্দেহ না করাটাই ভালোমানুষি। একদিন সে-ই হয়তো সাজবে রঙ্গনমালা দাস।

    রঙ্গন তাকে বুঝিয়ে বলল যে আর্থিক অবস্থা মেড রাখতে অনুমতি দিচ্ছে না, মেড বলে কেউ থাকবে না, পদটাই ছাঁটাই হবে। যাঁরা মেড রাখতে পারেন তাঁদের নামে চিঠি লিখে দেওয়া হচ্ছে সুপারিশ করে। লেডি কারসেটজি একবার জানতে চেয়েছিলেন কে অমন সুচারুরূপে সাজায়। তিনি হয়তো সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দেবেন। ভয় নেই। ধন্যবাদ।

    মেড চলে যাবার পর মনটা ফাঁকা হয়ে গেল। ছিল একটি সঙ্গিনী, যার সঙ্গে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলাবলি হত। এখন এমন একটিও মেয়েমানুষ রইল না যে অসুখেবিসুখে সেবা করবে বা কাছে বসবে। বান্ধবীরা যদি দয়া করে আসে তবে সেটা হবে দয়ার দান! তার ওপর নির্ভর করা যায় কি? দূর সম্পর্কের কোনো এক বিধবা আত্মীয়াকে আনিয়ে নিলে মন্দ হত না। কিন্তু বয়স্ক হওয়া চাই। স্বামীর চেয়েও বয়স্ক।

    এই সূত্র ধরে পিসি এসে পড়লেন। থাকতেই এলেন। সঙ্গে একটি ছেলে। চাকরির খোঁজ করবে তা করুক। মেয়ে তো নয়। অরক্ষণীয়া কন্যা হয়ে থাকলে পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করা হত। অত ভালোমানুষি ভালো নয়। দু-চার হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে দেওয়া তার চেয়ে ভালো। আর্থিক অবস্থা অনুমতি দিতে পারে।

    চার

    মারাঠা মেয়েদের মতো মাথায় কাপড় নেই, খোঁপায় ফুলের মালা জড়ানো। আর-সব বাঙালি মেয়ের মতো, ওরই নাম রঙ্গন। ওর সঙ্গে ওর স্বামী ক্ষৌণীশ। সাহেবদের মতো ডিনার পোশাক পরা। ফিরছিল দুজনে বিলিমোরিয়াদের সঙ্গে ডিনার খেয়ে। আধ মাইলটাক রাস্তা, তাই মোটর ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাঁটছিল যাতে খানা হজম হয়। চাঁদনি রাত, তেমন শীত নেই। পথ প্রায় ফাঁকা।

    ‘শুনলে তো কী বলছিল বিলিমোরিয়া তার মিসেসকে?’

    ‘কী বলছিল?’

    ‘বলছিল…’

    ‘চুপ করে গেলে যে? বলো।’

    ‘বলছিল তোমাকে লক্ষ করে নয়, মিসেস গুপ্তকে লক্ষ করে।’

    ‘কী বলছিল বলো-না?’

    বলছিল, ‘দেখছ তো মিসেস গুপ্তকে। কেমন গ্রেসফুল ফিগার। কেমন ভরাট গড়ন। কেমন পরিপূর্ণ নারীত্ব।’

    রঙ্গন উপহাস করে বলল, ‘পরস্ত্রীর প্রশংসা করতে পঞ্চমুখ কি শুধু বিলিমোরিয়া? না তার জবানিতে আর কোনো পুরুষ?’

    ‘আরে না না, এ কি আমার উক্তি? আমি কি বানিয়ে বলছি? সাক্ষাৎ ঘোড়ার মুখ থেকে শোনা। বিলিমোরিয়া তার স্ত্রীকে বলছিল, শুনে এসে আমি আমার স্ত্রীকে বলছি। কেন বলছি তার একটু রহস্য আছে।’

    ‘রহস্য! শুনি কী রহস্য!’

    ‘বাকিটুকু বললে আপনি বুঝতে পারবেন। বিলিমোরিয়ার বক্তব্য হল, যে-নারী মা হয়েছে সে-ই অমন পরিপূর্ণা হতে পারে। কটাক্ষটা মাতৃত্ববিমুখ রূপসিদের বিরুদ্ধে, যেমন মিসেস বিলিমোরিয়া। এ অঞ্চলের সেরা সুন্দরী…’ এই পর্যন্ত বলে ক্ষৌণীশ তৎক্ষণাৎ কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে জুড়ে দিলেন, ‘নন যদিও।’

    রঙ্গন কটমট করে তাকাল। ‘সরি। আমার ধারণা ছিল তুমি পরস্ত্রীর দিকে চেয়ে দেখ না। মিসেস বিলিমোরিয়া নাকি সেরা সুন্দরী! মিসেস গুপ্ত নাকি পরিপূর্ণা নারী। গ্রেসফুল বলছিলে। না, আমি বলি ডিসগ্রেসফুল।’

    দাম্পত্যকলহ শয়নকক্ষে নয়, রাজপথে। ক্ষৌণীশ সেই যে চুপ মেরে গেলেন, আর একটি কথাও মুখ থেকে বার করলেন না। আর রঙ্গন সেই যে বকম বকম শুরু করল তা চড়া গলায় না হলেও স্বামীর কানে হাতুড়ি পেটার মতো পটহবিদারক।

    ক্ষৌণীশ বেচারার বয়স হল ছেচল্লিশ কি সাতচল্লিশ। আর আট-নবছর বাদে রিটায়ারমেন্ট। ছেলে হলে তাকে মানুষ করবেন কবে? সেইজন্যে তিনি কখনো উচ্চবাচ্য করতেন না। মনের খেদ মনে চেপে রাখতেন। কথাটা আজকেও তুলতেন না। বিলিমোরিয়া তুলেছিল বলে তিনি ও-প্রসঙ্গ স্ত্রীর কানে পৌঁছে দিলেন সংবাদদাতার মতো।

    বিছানায় গিয়ে রঙ্গন কান্নাকাটি করল। কেন কাঁদছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিল না। মুখ ফিরিয়ে থাকল। ক্ষৌণীশ বার বার মাফ চাইলেন। নাকে কানে খত দিলেন। কিছু হল না। শেষে তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে কপট নিদ্রায় নাক ডাকাতে লাগলেন।

    রঙ্গন বলল, ‘ওগো শুনছ?’

    উত্তরে নাক ডেকে উঠল—ঘ-র-র-র।

    ‘শুনবে?’

    ঘ-র-র-র।

    ‘ওগো শোনো।’ ভারি মোলায়েম সুর।

    ক্ষৌণীশ বললেন, ‘কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে। মিসেস বিলিমোরিয়া সুন্দরী নন। মিসেস গুপ্ত গ্রেসফুল নন। মিসেস দাস মিস ইন্ডিয়া। কেমন, হল তো?’

    রঙ্গন অনুতপ্ত হয়ে বলল, ‘সত্যি, আমি খুব দুঃখিত। তোমার মনে কী ছিল আমি কেমন করে জানতুম? কোনোদিন তো আভাস দাওনি। তুমি কি চাও যে আমাদের একটি খোকা হয়?’

    ‘না না, আমি চাইব কেন? আমার কি আর চাইবার বয়স আছে? চাইলে তুমি চাইবে। চাও তো আর দেরি কোরো না। মানুষের সন্তানকে মানুষ করতে কমপক্ষে ষোলো বছর লাগে। আমাদের স্তরে আরও চার বছর কি ছ-বছর।’

    রঙ্গন অত জানত না। জানলেও বুঝত না। কখনো ভেবে দেখেনি। তার একমাত্র ভাবনা তার রূপ তাজা থাকবে না শুকিয়ে যাবে? মা হলে কি সে এমনি তন্বী থাকবে না তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে? পরি তাকে যে বর দিয়েছে সে-বরের দৌলতেই-না সে এ বর পেয়েছে। যদি রূপহীনা হয় তাহলে পতির প্রেম চলে গেলে এ জীবনে আর কী থাকে? কী নিয়ে বাঁচবে?

    তা বলে কি সে কোনো দিন মা হবে না? কোনো দিন না?

    হবে না এমন ধনুর্ভঙ্গ পণও সে করেনি। করার উপলক্ষ্য ঘটেনি। স্রেফ গড়িমসি করছে। মাতৃত্বকে বছরের পর বছর পেছিয়ে দিয়েছে। মাত্র পঁচিশ বছর তার বয়স। আরও দশ বছর অপেক্ষা করলে কী এমন ক্ষতি! ততদিন তো স্বামীর ভালোবাসা নিশ্চিতরূপে পাবে। তারপরে ও-ভদ্রলোকেরও অপর প্রেমের বয়স উত্তীর্ণ হয়ে যাবে।

    মনটাকে তৈরি করতে সময় লাগে। বিশেষ করে এত বড়ো গুরুতর একটা পদক্ষেপের পূর্বে। অন্য কেউ হলে সেই রাত্রেই মনস্থির করে ফেলত। কিন্তু রঙ্গনের অতীত জীবন রূপহীনতার জ্বালায় জর্জর। আর তার দিদির নজির তো তার চোখের সুমুখে বর্তমান। দেখেছে তো কাঞ্চনের মতো পরিকে মাতৃত্বের পাকচক্রে পড়ে রূপরিক্তা হতে, পতিপরিত্যক্তা হতে। ডানাকাটা পরির সমস্যা যদি অত কঠিন হয়ে থাকে তবে ডানাওয়ালা পরির সমস্যা কি আরও কঠিন নয়? তার গতিবিধি বন্ধ হয়ে যাবে না? সে কি পারবে বাইরে কোথাও বেরোতে? শিশু তাকে বাড়িতে কয়েদ করে রাখবে না? শিশুর বাপ কিন্তু ওদিকে অবাধে ফুর্তি করে বেড়াবেন। আমুদে মানুষ, আমোদ করা তাঁর চাই-ই। আমোদ করতে করতে প্রমোদ। প্রমোদ করতে করতে প্রমাদ।

    অবশেষে একদিন মহিলামহলে কানাঘুসো চলল যে রঙ্গন ধরা পড়েছে। কেউ বললেন, প্রকৃতির সঙ্গে জারিজুরি খাটে না। রেখে দাও তোমার পদ্ধতি প্রক্রিয়া। কেউ বললেন, এইবার ওর পায়ে বেড়ি পড়ল। উড়নচন্ডী এখন ঘরে অন্তরিন। কেউ বললেন, আহা! বেচারির অমন রূপ পরে ছায়া হয়ে যাবে।

    রঙ্গনের বান্ধবীরা তার সঙ্গে দেখা করে রসিকতা করলেন—‘এটা একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা। এই যেমন মোটর অ্যাক্সিডেন্ট। তুমি চেয়েছিলে প্লেজার ট্রিপ। হয়ে গেল ল্যাণ্ড স্লিপ!’

    এটা সত্য নয়। রঙ্গন চেয়েছিল স্বামীকে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত সন্তান দিতে। সে তাঁকে বাজিয়ে দেখেছিল যে তিনি গত ছ-বছর কাল এই দিনটির জন্যে প্রতিক্ষা করছেন। তবু মুখ ফুটে জানাবেন না, পাছে রঙ্গন তার স্বাধীন ইচ্ছায় না হয়ে অনিচ্ছায় মা হয়।

    সেকালে নাকি খোকারা আকাশ থেকে নেমে আসত। একালে কেন তা হয় না? তাহলে তো মায়েদের অশেষ কষ্ট বাঁচত, রূপ নষ্ট হত না। রূপ চলে গেলে যা হয়, স্বামীর প্রেম চলে যেত না। রঙ্গন বুঝতে পারে না কেন তাকে দশ মাস অসুস্থ হতে হবে। কেন তার প্রাণ বিপন্ন হবে। বিধাতার এটা কোনদেশি বিচার? খোকা খোকা বলে ডাক দিলুম আর অমনি আকাশ থেকে খোকা নেমে এল আমার কোলে। কী মজা! তা নয়, অসহ্য দুর্ভোগ আর অসীম দুর্ভাবনা একটি শিশুর জন্যে।

    যথাকালে সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। খোকা নয়, খুকু। ক্ষৌণীশ তো কোলে তুলে নিয়ে নাচতে চাইলেন। নার্স তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মায়ের কাছে দিল। মা তখন ভাবছে শিশুর জন্যে নয়, নিজের জন্যে। রূপ তার পাত্রান্তরিত হয়েছে। অবশিষ্ট যা আছে তা গর্ব করবার মতো নয়। মিলিয়ে দেখলে ক্ষৌণীশ যেমনকে তেমন নয়। পরি থেকে বানরীর বিবর্তনমার্গে এক কদম এগিয়ে।

    পাঁচ

    পুরুষ যেমনকে তেমন। নারী যেমনকে তেমন নয়। এক যাত্রায় পৃথক ফল। কী অন্যায়! কী অবিচার! ভগবানের রাজত্বে এমন অধর্ম! তাহলে ভগবানকে ডেকে কী হবে! তিনি পুরুষের দিকেই ঢলবেন।

    রঙ্গন আবার পরিকে ডাকতে আরম্ভ করল। সেই দয়াময়ী পরিকে, তার রূপদা সুখদা বরদা প্রেমদা পরিকে। পরির জন্যেই তো সব।

    রঙ্গন একমনে ডাকতে থাকল পরিকে। আকুল হয়ে। ব্যাকুল হয়ে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। অবশেষে পরির আসন টলল। পরি আবার দেখা দিল স্বপ্নে।

    পরি বলল, ‘রঙ্গন, কী হয়েছে বাছা?’

    রঙ্গন বলল, ‘পরি, আমার বড়ো দুঃখ। রূপ চলে যাবে বলে আমি মা হতে চাইনি। কী করি, স্বামীর মনে আফশোস। ওঁকে সুখী করতে গিয়ে আমার সর্বস্ব যেতে বসেছে। আমার রূপই তো আমার সর্বস্ব। আমার রূপ না থাকলে আমি কী! ডানাকাটা বানরী! হায়, হায়! আমার কপালে শেষকালে এই ছিল। বরং সুন্দরী না হওয়া ভালো তবু একবার সুন্দরী হয়ে তারপরে অসুন্দর হওয়া ভালো নয়। এখন যে দুনিয়া হাসবে। পরি, তোমাকে বলতে আমার লজ্জা করে, কিন্তু না বললে কি তুমি বুঝবে? আমার তলপেট এতদিনেও সমান হল না। একটুখানি ফুলে রয়েছে। ওই একটুখানির জন্যেই আমার ফিগার মাটি হল। কী দিয়ে ঢাকা দিই, বলো তো? বিজ্ঞান এখানে নিরুপায়। তারপর আমার বুক এখন বিশাল আর ভারী আর ক্ষীর দিয়ে ভরা। শিশুর ভাগ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু জননীর দুর্ভাগ্য। আমি তো ভয়ে মাই দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। দিলে বেশ আরাম, কিন্তু টেনে টেনে শেপ নষ্ট করে দেবে। যা দুরন্ত মেয়ে! পরি, আমার মেয়েকে আমি খুবই ভালোবাসি। তার জন্যে না-পারি এমন কাজ নেই। কিন্তু সে কি তা বলে আমার সর্বনাশ করবে? পিসি বলছে এটাই নিয়ম। আমি বলছি, এই যদি নিয়ম হয় তবে বাপ কেন এ নিয়মের আমলে আসে না? বাপ তো যেমনকে তেমন। এ লোকটি সত্যি বড়ো ভালো, পত্নীগত প্রাণ। কিন্তু পড়বে তো দু-বছর পরে কোনো ডাকিনীর পাল্লায়। অমন আমি ঢের দেখেছি। বউয়ের যতদিন মৌ থাকে ততদিন বউ বউ বউ। মৌ ফুরোলে দৌড়। পিসি বলছে, এর কোনো পেরতিকার নেই। আমি বলছি, প্রতিকার থাকতে বাধ্য। পরি, সেইজন্যেই তোমাকে ডেকেছি।’

    পরি বলল, ‘প্রকৃতির নিয়ম উলটে দিতে পারি সে-ক্ষমতা কি আমার আছে? আমি প্রকৃতির আনুকূল্য করতে পারি, প্রতিকূলতা করতে পারিনে। তোমার স্বামীকে তুমি প্রেম দিয়ে জয় করো। তাহলে তোমার কোনো দুঃখ থাকবে না। রঙ্গন, তোমার কন্যাকেও তুমি স্নেহ দিয়ে জয় করবে। এই তার সুযোগ।’

    রঙ্গন রাগ করে বলল, ‘পরি, তুমি ইচ্ছা করলে সব পার, তবু করবে না। আমার যে কী দুঃখ তোমাকে বলা বৃথা। তুমি তো মানুষ নও। তোমার হৃদয় নেই।’

    পরি হেসে বলল, ‘আচ্ছা গো আচ্ছা। তোমার কী চাই এককথায় বলো দেখি।’

    রঙ্গন বলল, ‘যেমনকে তেমন। আমি চাই যেমনকে তেমন হতে। যেমনকে তেমন থাকতে। মা হয়েও যেমনকে তেমন। তেমনি সুন্দরী, তেমনি সুমধ্যমা, তেমনি সুরক্ষা।’

    পরি বলল, ‘কিন্তু এর একটা বিপদ আছে। তোমাকে সতর্ক করে দিই। এ জগতে জীবন্ত বলতে যা-কিছু আছে তার বিকাশ আছে, বিকাশ নেই যার সে সজীব নয়। তোমাদের বাড়িতে যে ছবি আছে সে-ছবি চিরদিন একইরকম থাকবে, কারণ সে নির্জীব। তুমিও কি তোমার স্বামীর গৃহে ছবির মতো শোভা পেতে চাও। তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা? রঙ্গন, কে তোমাকে ভালোবাসবে? কোন জীবনময় পুরুষ?’

    রঙ্গন বলল, ‘সে ঝুঁকি আমার। তুমি তো আমাকে যেমনকে তেমন করে দাও।’

    পরি বলল, ‘তথাস্তু।’ এই বলে মিলিয়ে গেল।

    ঘুম থেকে জেগে রঙ্গন যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল তখন তার মুখে হাসি ধরে না। সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরির দয়া হলে কী-না সম্ভব!

    তখন সে পিসির কাছে খুকুকে দিয়ে আগের মতো আবার বাইরে যেতে শুরু করল। সবাই দেখে অবাক। মা হয়েছে কিন্তু তার কোনো ছাপ নেই তার চেহারায়, তার গড়নে, তার চলনে। রঙ্গন তো রঙ্গন। যেমনকে তেমন। তাকে নিয়ে একটা লেজেণ্ড সৃষ্টি হল। একটা কিংবদন্তি। সে কিন্তু কাউকে বলল না তার কী কৌশল বা রহস্য।

    মেয়েটাকে মাই দেবে না, ফিডিং বটল ধরিয়ে দেবে। কাছে রাখবে না, পিসির কোলে দেবে। রাত্রে নিজের ঘরে শোয়াবে না, পিসির ঘরে শোয়াবে। কাঁদলে জাগবে না, অঘোরে ঘুমোবে। যেন এ মেয়ে তার নয়, তার পিসির।

    ক্ষৌণীশের মনে খটকা বাঁধল। এ কীরকম মা! এ কীরকম নারী! যে-রূপ তাঁকে একদা মুগ্ধ করেছিল সেই রূপই তাঁকে এখন প্রশ্নে প্রশ্নে কণ্টকিত করল। এমন রূপ কি একটা আশীর্বাদ না একটা অভিশাপ!

    এ নিয়ে একদিন দিলখোলা কথাবার্তা হয়ে গেল। রঙ্গন বলল, ‘আমার রূপ গেলে আমার দশা হবে আমার দিদির মতো। সেটা কি ভালো না এটা ভালো?’

    ক্ষৌণীশ বললেন, ‘আমি কি রমেশের মতো কুপুরুষ?’

    রঙ্গন বলল, ‘কুপুরুষ নও। কিন্তু পুরুষ তো। কোনদিন কাকে দেখে ভুলবে! আমি কি সেরকম ঝুঁকি নিতে পারি?’

    এ তর্কের অন্ত নেই। বার বার তর্কের অবতারণায় কোনো পক্ষের উৎসাহ ছিল না। রঙ্গন বহির্মুখী হল আর ক্ষৌণীশ হলেন ঘরমুখো। এত যে বাইরে যেতে ভালোবাসতেন, না গেলে হাঁপিয়ে উঠতেন, তার চিহ্ন রইল না। আপিস থেকে সকাল সকাল বাড়ি আসেন আর মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকেন। একশো বার তার কৌপীন বদলে দেন নিজের হাতে। রাত্রে মেয়েকে নিয়ে শুতে যান। তাঁর খাটের পাশে মেয়ের খুদে খাটটি। সকালেও মেয়ে আর মেয়ে আর মেয়ে। বেলা না হলে আপিসে যাবার নাম নেই।

    মেয়ের কান্নায় ঘুম মাটি হয় বলে রঙ্গন অন্য ঘরে শোয়। রাত জাগলে তার চোখের কোলে কালি পড়বে, চোখের পাতা ফুলবে। পাউডার মেখে তা ঢাকা পড়ে না। তা ছাড়া শরীর তো একটা কল। কল বিগড়ে গেলে রূপ এলিয়ে পড়বে। রঙ্গন সেরকম ঝুঁকি নেবে না। মেয়ের জন্য সে বড়ো কম ভোগেনি। দারুণ যন্ত্রণা পেয়েছে। বাপ একটু ভুগলই-বা। দুর্ভোগের ভিতর দিয়ে সাম্য আসবে।

    মেয়েকে চোখে চোখে রাখবেন বলে ক্ষৌণীশ সকাল সকাল পেনশন নিলেন। যা দুর্দান্ত মেয়ে, কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। হয়তো রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে গাড়িচাপা পড়বে। রঙ্গন তো আয়া রাখবে না। পিসির কি রাস্তায় যাওয়া ভালো দেখাবে?

    পেনশন যখন হল তখন আর পুনায় বসে থাকা কেন? ক্ষৌণীশ কলকাতায় বাড়ি কিনলেন, গড়িয়াহাট অঞ্চলে। সেখানে তাঁর প্রধান কাজ হল মেয়ের ঠেলাগাড়ি ঠেলে লেকের চারধারে বেড়ানো। অনেকটা আইসক্রিমওয়ালার মতো। যে দেখে সে-ই কোলে নিতে চায়। এমন পরির মতো মেয়ে, কোনদিন কে চুরি করে সেই ভয়ে তিনি সদা সন্ত্রস্ত। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করেন না।

    মেয়ের মা কিন্তু নিরুদবেগে আপিস করে। হ্যাঁ, আপিস। স্বামীর পেনশনে কুলোবে কেন? দায়ে পড়ে একটা চাকরি জোটাতে হয়েছে। সিভিল সাপ্লাই বিভাগ থাকতে চাকরির ভাবনা কী! রঙ্গন দশটা-পাঁচটা আপিস করে, তারপরে সামাজিকতা করে। তার মনে পরম শান্তি। স্বামীকে সে খাঁচায় পুরেছে, উড়োপাখি আর উড়বে না।

    কিন্তু দুজনে দুজনের কাছে অচেনা অজানা প্রতিবেশীর মতো, তার বেশি নয়। শিষ্টাচার ও সদব্যবহার পদে পদে। দয়ামায়া প্রচুর। এর নাম যদি ভালোবাসা হয় তো ভালোবাসার অকুলান নেই। পরি যে সতর্ক করে দিয়েছিল সে কি তবে খামোকা? রঙ্গন কি ছবি নয়? ক্ষৌণীশ কি জীবনময়? কে জানে! কে জানে!

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleযৌবনজ্বালা
    Next Article সোনার ঠাকুর মাটির পা

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }