Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)

    পাঁচকড়ি দে এক পাতা গল্প24 Mins Read0

    সর্বনাশিনী

    সৰ্ব্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে

    ভৌতিক কাহিনী

    তুষারমণ্ডিত অভ্রভেদী হিমালয় দেখিবার ইচ্ছা বহুকাল হইতে আমার হৃদয়ে নিতান্তই বলবতী ছিল, তাই আমার চিরসহচর প্রাণের বন্ধু প্রবোধচন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া আমি একদিন দার্জ্জিলিং রওনা হইলাম।

    আমরা পথে এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিলাম। আমাদের উভয়েরই মত যে, রেলে গেলে হিমালয় প্রকৃতভাবে দেখা হইবে না। রেল যেন উড়িয়া যায়,—তাই রেলে গমন করিলে হিমালয়ের সেই অনির্বচনীয় মহিমাময় সৌন্দর্য্যরাশি প্রকৃত উপলব্ধি করা কোন প্রকারেই সম্ভবপর হইবে না। সুতরাং আমরা উভয়ে স্থির করিলাম যে, আমরা শিলিগুড়ি হইতে পদব্রজে দার্জ্জিলিং রওনা হইব।

    সকালে শিলিগুড়ি উপস্থিত হইলাম। যতক্ষণ দার্জিলিং-এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুন্দর গাড়ীগুলি দৃষ্টিপথে রহিল, ততক্ষণ ষ্টেশনে আমরা তাহার বিচিত্র গতি দেখিতে লাগিলাম। তৎপরে দুইটী কুলীর মস্তকে আমাদের দুইজনের দুই ট্রাঙ্ক চড়াইয়া দিয়া নিজ নিজ হাতে ব্যাগ ঝুলাইয়া বাজারের অভিমুখে চলিলাম।

    পথে দুই একটি বাঙ্গালীর সহিত দেখা হইল। আমরা বাজারেই বাসা লইব স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই তাহা করিতে দিলেন না, জোর করিয়া তাঁহাদের বাসায় লইয়া গেলেন। আমরা যাঁহার বাড়ীতে উঠিলাম, জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তিনি এখানে শালকাঠের ব্যবসা করেন।

    ২

    সে দিন ও সে রাত্রি আমরা শিলিগুড়িতেই কাটাইলাম। সকলেই আমাদিগকে বলিলেন, “পাহাড়ে হাঁটিয়া যাইতে ভারি বোধ হইবে, বরং গরুর গাড়ী করিয়া যান।” আমরা পদব্রজে যাওয়াই মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম। প্রকাশ্য সদর রাস্তা দিয়া যাইতে আমাদের ইচ্ছা ছিল না, কারণ বড় রাস্তায় বহু লোক চলাচল করে, বিস্তর গরুরগাড়ী মাল লইয়া সৰ্ব্বদাই যাতায়াত করিয়া থাকে, অধিকন্তু তাহারই পার্শ্ব দিয়া রেল গিয়াছে। এ রাস্তায় হিমাচলের গুরু-গম্ভীর সৌন্দর্য্য উপভোগের সুবিধা হইবে না ভাবিয়া, আমরা সদর রাস্তা বর্জ্জন করিবারই স্থির করিলাম।

    যে পথে পাহাড়িয়াগণ যাতায়াত করে, সেই ক্ষুদ্র অপরিসর পথ দিয়া আমরা যাইব, তবে পাহাড়ের পথ দুর্গম, তাহাতে আমরা পথ চিনি না, সুতরাং আমাদের একজন পথ-প্রদর্শক নিতান্ত আবশ্যক।

    অর্থে কি না হয়? আমাদের নূতন বন্ধুদিগের অনুগ্রহে আমরা তাঁহাদের একজন বিশ্বাসী বলবান্ ভুটিয়া পথ প্রদর্শক পাইলাম। সে তাহার দুইজন বিশ্বাসী কুলী সংগ্রহ করিল। পরদিবস অতি প্রত্যুষে কুলীর মস্তকে দ্রব্যাদি চাপাইয়া ভগবানের নাম মনে মনে স্মরণ পূর্ব্বক আমরা যাত্রা করিলাম।

    আমাদের অগ্রে অগ্রে কোমরে দুই খুক্রী গুঁজিয়া, হস্তে এক বৃহৎ লগুড় লইয়া, চলিতে লাগিল ভুটিয়া বীর থম্বিমেনা, পশ্চাৎ ব্যাগ হস্তে আমরা দুইবন্ধু, সর্ব্বপশ্চাৎ ট্রাঙ্ক মস্তকে দুই মহাপ্রভু কুলী। এই শোভাযাত্রায় আমরা মহানন্দা নদীর পোল পার হইয়া মাটিয়া খোলার হাট উত্তীর্ণ হইলাম, তৎপরে নক্সালবাড়ীর পথ ধরিয়া চলিলাম।

    পথে এক কাইয়ার দোকান পাইয়া তথায় রন্ধন ও ভোজন কার্য্য সারিয়া লইলাম। দেখিলাম এই দুর্গম গিরিকান্তারেও মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর অভাব নাই, মধ্যে মধ্যেই দোকান, আর দোকানে প্রায় সকলপ্রকার দ্রব্যই ক্রয় করিতে পাওয়া যায়। অদ্ভুত অধ্যবসায়শীল এই মাড়োয়ারী জাতি!

    আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া আবার রওনা হইলাম। হিমালয়ের মহিমময় সৌন্দৰ্য- সম্ভার দেখিতে দেখিতে আমরা অগ্রসর হইতে লাগিলাম। কি সে অপূর্ব, অননুভূতপূর্ব, অনন্তবিসারি মহামহিমান্বিত সৌন্দর্য্যমালা! সে বিচিত্র অভিনব সৌন্দর্য্য বর্ণন করিবার শক্তি আমাদের নাই এবং তাহা আমাদের উদ্দেশ্যও নহে, সুতারং আমরা আর এ কথার পুনরুত্থাপন করিব না।

    এই হিমালয় প্রদেশে প্রায়ই এমন ঘটে যে, কোথায় কিছু নাই, অকস্মাৎ রাশি রাশি কুয়াসা উত্থিত হইয়া চারিদিক্ আচ্ছন্ন ও অন্ধকারময় করিয়া ফেলে। তখন আর কিছুই দেখা যায় না—অতি কষ্টে অতি সাবধানে পথ অতিক্রম করিতে হয়।

    আমরা যে পথে যাইতেছিলাম, তাহা অতি দুর্গম। তাহার একদিকে অতলস্পর্শী গিরি-খাদ, একটিবার পদ-স্খলন হইলেই সহস্র হস্ত নিম্নে পতিত হইয়া অস্থিপঞ্জর চূর্ণ বিচুর্ণিত হইবার পূর্ণ সম্ভাবনা। একজনের অধিক দুইজনে পাশা-পাশি যাইবার উপায় নাই। অনেক সময়ে হামাগুড়ি দিয়া অতি কষ্টে উঠিতে হয়। এই বিপদ-সঙ্কুল পথে অতি কষ্টে ধীরে ধীরে কুয়াসার বিপুল অন্ধকার ঠেলিয়া আমরা পাহাড়ে উঠিতে লাগিলাম।

    সন্ধ্যা আগতপ্রায়, সঙ্গে সঙ্গে দারুণ কনকনে শীত, তাহার উপর বৃষ্টি। এখন একটা মাথা রাখিবার স্থান পাইলেই আমরা তথায় আজিকার মত বিশ্রাম করি। সমস্ত দিন পাদচারে আমরা নিতান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, কুয়াসার ভিতর দিয়া কোন্ দিকে যাইতেছি, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছিলাম না। আমাদের পথ-প্রদর্শক বলিতেছিল যে, নিকটে কাইয়ার দোকান ও বস্তি আছে, কিন্তু আমরা এক ঘণ্টা পৰ্য্যন্ত কষ্টে চলিয়াও কোন পল্লী পাইলাম না।

    হিমালয়ের সন্ধ্যা আমাদের দেশের মত সহজ রকমে হয় না। সন্ধ্যা বলিয়া কোন ব্যাপার এখানে নাই। সহসা না বলিয়া কহিয়া অবাধ্য মেয়ের মত যেন একেবারে তিমিরবসনা নিশা হিমালয়কে নিজের কৃষ্ণাঞ্চলে ঢাকিয়া দেয়। আজ ইহা স্বচক্ষে দেখিলাম, অনুভব করিলাম—সহসা চারিদিক্‌ ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হইল আর কিছু দেখিবার উপায় নাই।

    আমাদের পথ-প্রদর্শক উচৈঃস্বরে নানাবিধ শব্দ করিতে করিতে চলিল, আমরাও তাহার গলার স্বর অনুসরণ করিয়া হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া চলিলাম। একটু পা পিছলাইলেই গিয়াছি আর কি একেবারে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু! এখন আমরা বেশ বুঝিলাম, আমাদের শিলিগুড়ির বন্ধুগণ হিতবাদী বটেন; কিন্তু ‘মরণ কালেতে রোগী ঔষধ না খায়’। গতানুশোচনায় আর ফল কি?

    সহসা পথ-প্রদর্শক দাঁড়াইল, আমরাও স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম! তখন বুঝিলাম, সে নিজেই অন্ধকারে পথ হারাইয়াছে—গ্রামের পথে না গিয়া অন্য পথে আসিয়াছে, দুর্গম গিরিভূগুদেশের অতিদুর্গম স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে—কোন্ দিকে কোথায় যাইবে, স্থির করিতে পারিতেছে না। সে নিজে এ কথা স্বীকার না করিলেও তাহার গলার স্বরে এ কথা আমাদের বেশ উপলব্ধি হইতেছিল।

    তখন আমাদের হৃদয়ের ভিতরে হৃদয় বসিয়া গেল। বুঝিলাম, পাহাড়ের এই দুর্গম কান্তার মধ্যেই আজ রাত্রি কাটাইতে হইবে। তাহাতে বড় কিছু যায় আসে না—তবে পড়িয়া গিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ না হইলেই এক্ষণে ভগবানের অসীম দয়া।

    থম্বিমেনা বলিল, “ফিরিয়া এই পথে খানিকটা নামিয়া গেলেই একটা বস্তি পাইব।”

    অগত্যা তাহাই শ্রেয়ঃ ভাবিয়া আমরা ফিরিলাম। কিন্তু কয়েকপদ যাইবামাত্র আমি একটা গড়ানে স্থানে আসিলাম, তাহার পর কি হইল ঠিক মনে নাই। এইমাত্র বুঝিলাম, আমার লম্বা কোট দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া বন্ধুবর প্রবোধচন্দ্রও ঠিক আমার গতি অনুকরণ করিয়া আমায় অনুসরণ করিতেছে, এবং শব্দে বুঝিলাম, গুণবান্ থম্বিমেনারও একই দশা—সেও গড়াইয়া আসিতেছে।

    সহসা কিসে লাগিয়া আমাদের অধঃপতনের গতিরোধ হইল। স্পর্শে বুঝিলাম, কি একটা কাষ্ঠ- নির্ম্মিত দ্রব্যে আমাদের বেগ নিরোধক হইয়াছে। পকেটে দেশলাই ও বাতি ছিল, জ্বালিলাম।

    সেই সূচিভেদ্য অঞ্জন-গাঢ় অন্ধকার মধ্যে দীপালোকেও ভাল দেখা যায় না।

    আলোটা উচ্চে তুলিয়া দেখিলাম, সেটা একখানা কাষ্ঠনির্ম্মিত ঘর—আমরা তিনজনেই সেই গৃহের কাষ্ঠনির্ম্মিত প্রাচীর পার্শ্বে পতিত। আমরা কষ্টে-সৃষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

    যাহা হউক, প্রাণটা যে একেবারে বাজে খরচ হয় নাই, ইহাই লাভ! সম্ভবতঃ আশ্রয়ও মিলিবে! এই গৃহে যেই থাকুক না কেন, এ অবস্থায় আশ্রয় দিতে কখনও অসম্মত হইবে না। আমরা আলো ধরিয়া ধরিয়া গৃহের দ্বারে আসিলাম। দ্বার রুদ্ধ।

    আমি দরজায় করাঘাত করিলাম—কেহ উত্তর দিল না। আবার আমি আরও বেশি রকম শব্দ করিয়া সবলে করাঘাত করিলাম, তবুও কেহ উত্তর দিল না! তখন দরজা ঠেলিয়া খুলিয়া ফেলিলাম, কড় কড় শব্দ করিয়া দরজা খুলিয়া গেল। ভিতরে বাহির হইতেও অন্ধকার গাঢ়তর।

    আমি আলো লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম—প্রবোধ ও থম্বিমেনা আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল, কিন্তু তারপর এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল—থম্বিমেনা বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল, তৎপরে ছুটিয়া অন্ধকারে কোথায় অন্তর্হিত হইল। আমরা উভয়ে বিস্মিত হইয়া তাহাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলাম, কিন্তু অন্ধকার হইতে কেবল একটা ভীতিব্যঞ্জক আর্ভরব আমাদের কর্ণে প্রবেশ করিল, আমরা কেবলমাত্র সেই শব্দের এইমাত্র বুঝিলাম—

    “সয়তান কা ঔরত।”

    প্রবোধ বলিল, “বোধ হয়, এখানকার লোকের বিশ্বাস, এই বাড়িতে ভূত আছে—পাহাড়ীয়ামাত্রেই ভূত বড় বিশ্বাস করে। যাহাই হউক, খাদে পড়িয়া যে আজ প্রাণটা যায় নাই, এই জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ দিই। শীতে বুক গুর্ গুর্ করিতেছে, এ আশ্রয়ও ভগবান্ মিলাইয়া দিয়াছেন। এখন কাঠকুটা সংগ্রহ করিয়া আগুন জ্বালা যাক্। আলো দেখিলে কুলী দুটো আর গুণবান্ থম্বিমেনা প্রাণের দায়ে এখানে আবার ফিরিয়া আসিতে পথ পাইবে না।

    আমরা আলো লইয়া বাহিরে গিয়া কতকগুলা শুষ্ক ডালপালা সংগ্রহ করিলাম, তৎপর তাহা জ্বালাইয়া গৃহমধ্যে আগুন করিলাম। আগুনে হাত সেঁকিয়া কতকটা প্রকৃতিস্থ হইলাম। আমাদের ব্যাগে সর্ব্বদাই আমরা কিছু না কিছু আহার্য্য রাখিতাম। প্রবোধ তাহাই বাহির করিয়া তাড়াতাড়ি ভোজন আরম্ভ করিল, আমি বলিলাম, “আগে ঘরটা ভাল করিয়া দেখা যাক্।”

    প্রবোধ বলিল, “আগে প্রাণে বাঁচলে ত আর সব, ক্ষুধায় প্রাণ যায় যায়। এই পাহাড়ে শীতে আর এই পাহাড়ে রাস্তায় যেন ক্ষুধা হাজারগুণ বাড়িয়া উঠে।” অগত্যা আমরা উভয়ে সেই আগুনের পাশে বসিয়া কিছু আহার করিয়া লইলাম।

    আহার শেষ হইলে উভয়ে বাতী লইয়া ঘরটি ভাল করিয়া দেখিতে চলিলাম। একটি ঘর নহে, পাশাপাশি দুইটি ঘর। গৃহ মধ্যে নানাবিধ তৈজসপত্র পড়িয়া আছে। দেখিলেই বোধ হয়, শেষে যাহারা এই বাড়ীতে ছিল, তাহারা যে কারণেই হউক, হঠাৎ এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে। তাহাদের অনেক জিনিষপত্র পড়িয়া আছে, লইয়া যাইবার সময় হয় নাই। তাড়াতাড়ি যে চলিয়া গিয়াছে, এই ঘরের অবস্থা দেখিলে সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

    একটা বাক্সও ঘরের কোণে পড়িয়া আছে—দেখিলাম সেটা খোলা; ডালা তুলিয়া দেখি তাহার ভিতর অনেকগুলি বাংলা চিঠী রহিয়াছে।

    এই দুর্গম স্থানে এই নিৰ্জ্জন বাড়ীতে তাহা হইলে পূৰ্ব্বে কোন বাঙ্গালী বাস করিয়াছিল। কে সে! এত স্থান থাকিতে, এখানে আসিয়াছিল কেন? দারুণ কৌতুহলের বশবর্তী হইয়া আমরা বাতীটি সেই বাস্কের উপরে রাখিয়া পত্রগুলি একে একে পাঠ করিতে লাগিলাম। যখন সর্ব্বশেষের পত্রখানি পাঠ শেষ হইল, তখন নিম্ন দেশ হইতে সেই অন্ধকার বিলোড়িত করিয়া এক হৃদয়-বিদারক উচ্চ আৰ্ত্তনাদ উঠিতে লাগিল। সমস্ত রাত্রিই এই ভয়াবহ শব্দ আমাদের কানে আসিতে ছিল। ইহা আমাদের বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা বা কোন মুমুর্ষর আর্তনাদ, তাহা কেবল ভগবান্ বলিতে পারেন। আমরা এইমাত্র বলিতে পারি যে, আমরা সমস্ত রাত্রি সেই গৃহমধ্যে জাগিয়া বসিয়া রহিলাম, ভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিতে সাহস করিলাম না।

    যে সকল পত্র আমরা পাঠ করিলাম, তাহার প্রথমখানি এই–

    প্ৰথম পত্ৰ

    “প্রিয় সুরেশ,

    কলিকাতার সেই সোরগোল অশান্তির মধ্য হইতে পলাইয়া আসিয়া এই নিৰ্জ্জন পাহাড়মধ্যে এই স্থানে আমি যে কি শান্তি অনুভব করিতেছি, তাহা বলিতে পারি না। আর লোকালয়ে থাকিব না, লোকালয়ে থাকিলে আর আরাম হইতে পারিব না, এই জন্য এই দুর্গম স্থানে আশ্রয় লইয়াছি। আমার মস্তিষ্কও যেরূপ উষ্ণ হইয়াছিল—তাহা আর নাই। আমি এখন শান্তচিত্তে চিন্তা করিতে পারিতেছি। আর এই স্থানের ন্যায় চিন্তা করিবার স্থান দ্বিতীয় আর কোথায়?

    আমার এই বাড়ী পর্ব্বতের মাঝামাঝি স্থাপিত। পশ্চাতে স্তরে স্তরে পর্বতশ্রেণী আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়া গিয়াছে, সম্মুখে একটু আগে একেবারে মহাখাদ, প্রায় দুই সহস্র হাত নিম্নে একটি নদী রজতসূত্রের ন্যায় দেখিতে পাওয়া যায়।

    এ বাড়ীখানিতে দুইটিমাত্র, ঘর—ঘর বলিতে চাও, আর যাহা বলিতে চাও, তাহাই ইহাকে বলা যায়। কতকগুলি সালকাঠ জোড়া দিয়া প্রাচীর নির্ম্মিত হইয়াছে—ছাদও ঐ শালকাঠে জোড়া, এখানে শালকাঠের অভাব নাই, চারিদিকেই শালকাঠ—কাটিয়া লইলেই হইল। আমার সঙ্গে চাকর-বাকর নাই, চেষ্টা করিয়াও পাই নাই, প্রায় দুই ক্রোশ দূরে একটা ভুটিয়া বস্তি আছে, সেখানে সপ্তাহে একদিন হাট হয়, হাটের দিন সকালে রওনা হইয়া আমার দরকার মত দ্রব্যাদি লইয়া সন্ধ্যার সময়ে ফিরি।

    সময় কাটাইবার জন্য একখানা খুব বড় উপন্যাস লিখিতেছি। বোধ হয় তাহাতেই আমি জগদ্বিখ্যাত হইব।

    আমি একজন লোক পাইয়াছি। কিন্তু রাত্রিতে সে কিছুতেই এ বাড়ীতে থাকিতে চাহে না; তা না থাকুক, ক্ষতি নাই। দিনেই সমস্ত কাজ-কর্ম্ম সারিয়া চলিয়া যায়, সুতরাং আমার স্ত্রীকে আর পূর্ব্বের ন্যায় খাটিতে হইতেছে না।

    এই নিৰ্জ্জন দুর্গমস্থানে থাকিতে সে সম্পূর্ণ নারাজ হইয়াছিল, আমিই বুঝাইয়া রাখিয়াছি, লোকালয়ে থাকিলে আমার রোগ আরাম হইবার আশা নাই, এই কথা বলায় সে সম্মত হইয়াছে।

    রাত্রে সে পার্শ্বের ঘরে নিদ্রা যায়—আমি সম্মুখের ঘরে বসিয়া অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত সেই প্ৰকাণ্ড উপন্যাসখানা লিখি।

    দ্বিতীয় পত্র

    তোমার মন্মথ।

    (দ্বিতীয় পত্রে কেবল সেই উপন্যাসের কথা এবং সেই উপন্যাসের প্রশংসার ভাগই অধিক)।

    “প্রিয় সুরেশ!

    তৃতীয় পত্র

    তোমাকে দুইখানা পত্র লিখিয়াছি, এইখানা লইয়া তিনখানা হইবে। কিন্তু কোনখানাই এখনও ডাকে দিতে পারি নাই। ডাকঘর প্রায় দশ ক্রোশ দূরে, পত্র তিনখানা ডাকে দিবার জন্য এখনও কোন লোক সংগ্রহ করিতে পারি নাই। তাহার একটা গুরুতর কারণ আছে। সহজে এ বাড়ীর নিকট কেহ আসিতে চাহে না, অধিক পয়সা দিতে চাহিলেও না। আগে ইহার কারণ জানিতে পারি নাই, একদিন এক বৃদ্ধকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সে বৃদ্ধ আমাকে এ রহস্যের বর্ণনা করিল। ব্যাপার এই;–

    সোহো বলিয়া একটি লোক এই কুটীর নির্ম্মাণ করে। সে ভুটয়াদিগের মধ্যে একজন কবি বলিয়া গণ্য ছিল। সে নিৰ্জ্জনে বাস করিবার ইচ্ছা করিয়াই এই দুর্গমস্থানে এই কুটীরখানি নির্ম্মাণ করিয়াছিল। এখানে নিজের সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে লইয়া সে বাস করিত।

    সুখেই তাহাদের দিন কাটিতেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ নিকটস্থ এক বস্তির একটি ভুটিয়া যুবতী সেই নিভৃত নিবাসী কবির প্রেমে আকৃষ্ট হইল। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, এই কুটীরে দুইটি ঘর। যখন গভীর রাত্রে পার্শ্বের গৃহে সোহার যুবতী স্ত্রী নিদ্রা যাইত, সেই সময়ে এই সুন্দরী সোহার পার্শ্বে বসিয়া মৃদুমন্দকণ্ঠে প্রেমালাপ করিত।

    একদিন রাত্রিতে তাহার স্ত্রী সকলই জানিতে পারিল, কিন্তু কোন কথা কহিল না।

    এই যুবতীকে এই কুটীরে আসিতে হইলে একটা কাঠের সাঁকো পার হইয়া আসিতে হইত। এই সাঁকোর প্রায় পাঁচশত হাত নিম্নে এক ঝরণা। সর্ব্বদা প্রবলবেগে সেই ঝরণা দিয়ে জল পড়ে বলিয়া ভুটিয়ারা ইহার নাম “পাগলা ঝোরা” রাখিয়াছে। প্রত্যহ রাত্রিতে এই সাঁকো দিয়া সেই যুবতী যাতায়াত করিত।

    একদিন সোহো গৃহে না থাকায় তাহার স্ত্রী সুবিধা পাইয়া সেই সাঁকোর একদিকের কাঠ টাঙ্গি দিয়া কাটিয়া রাখিয়া আসিল। এমন সামান্যমাত্র সাঁকোর কাঠ পাহাড়ে সংলগ্ন রহিল যে, মনুষ্যভার পড়িলেই তাহা নিশ্চিত পতিত হইবে।

    তাহাই ঘটিল। সে রাত্রিতে পূর্ব্বের ন্যায় সোহো প্রণয়িণীর প্রতীক্ষা করিতেছে। সহসা তাহার কর্ণে এক মৰ্ম্মভেদী আর্তনাদ প্রবেশ করিল, তাহার পরই প্রকাণ্ড কাঠ ও পাথরের পতনের শব্দ আসিল,—তাহার প্রণয়িণী চিরতরে পাঁচ শত হস্ত নিম্নে পাগলা ঝোরায় বিসৰ্জ্জিত হইল।

    কে এ কাজ করিয়াছে, তাহা সোহোর বুঝিতে বিলম্ব হইল না। ইহার ফলে একদিন সোহো ও তাহার স্ত্রী উভয়েই গভীর খাদে পতিত হইল।

    সোহো তাহার স্ত্রীর গলা টিপিয়া তাহাকে হত্যা করিতে চেষ্টা পাইয়াছিল। কিন্তু ভুটিয়া স্ত্রীলোকদিগের দেহে অসীম বল, সোহোর স্ত্রী তাহাকে টানিতে টানিতে খাদের নিকট লইয়া আসে, তথাপি সোহো তাহার গলা হইতে হাত অপসারিত করিল না। তাহার স্ত্রীর চক্ষু কপালে উঠিল, তাহার জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িল, তবুও সে তাহার স্বামীকে ছাড়িল না, তারপর উভয়ে দুই সহস্ৰ হাত নিম্নে গিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইল।

    এতদূর বলিয়া বৃদ্ধ ভুটিয়া বলিল, সেই পর্য্যন্ত সোহোর প্রণয়িণী সোহোর বাড়ীতে প্রত্যহ রাত্রে প্রেতিনী হইয়া আসে। ভিতরে আলো দেখিলে সে দরজায় আঘাত করে। তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করিতে না দেয়, এমন সাধ্য কাহারই নাই। অনেকে এই বাড়ীতে বাস করিতে ইচ্ছা করিয়াছে, কিন্তু এ বাড়ীতে যে রাত্রি বাস করে, তাহারই মৃত্যু হয়।

    এই সোহো-প্রণয়িণী-প্রেতিনীর জন্য কেহ সাহস করিয়া এখানে আসে না। আমার দ্রব্যাদি হাট হইতে আমাকেই নিজে আনিতে হয়, এইজন্যই এ পর্য্যন্ত পত্র ডাকে পাঠাইতে পারি নাই।

    তোমার মন্মথ।”

    চতুর্থ পত্র

    প্রিয় সুরেশ,

    দেশে হইলে এ কথা আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিতাম; বোধ হয়, অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই একথা একেবারে ভুলিয়া যাইতাম। কিন্তু এই নিৰ্জ্জন দুর্গমস্থানে ভূতের কথা সহজে বিস্মৃত হওয়া যায় না।

    রাত্রে—অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত বসিয়া আমার সেই বিরাট উপন্যাসখানা আমি প্রত্যহ লিখিয়া থাকি, কিন্তু বৃদ্ধ ভুটিয়ার নিকটে এই কথা শোনা পর্য্যন্ত রাত্রিতে আমার লেখা একরূপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তুমি শুনিলে নিশ্চয়ই মনে মনে হাসিবে, কিন্তু সত্য গোপন করাও ঠিক নহে—প্রকৃতই সেই দিন হইতে রাত্রে লিখিতে লিখিতে মধ্যে মধ্যে লেখা বন্ধ করিয়া আমি কান পাতিয়া শুনিতাম, দরজায় কেহ মারিতেছে কিনা। যথার্থই কি আমার মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে? ইহারই মধ্যে যেন সোহো প্রণয়িণী আমার স্কন্ধে ভর করিয়াছে—হাসিও না,—এই নিৰ্জ্জন দুর্গম লোকশূন্য স্থানে সকলই সম্ভব! তোমার সেখানে যাহা হাস্যজনক, এখানে তাহা বিষম ভীতিপ্রদ!

    কাল যাহা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমারও যে বুদ্ধিভ্রংশ হইতেছে, মাথা খারাপ হইয়া আসিতেছে, তাহা আমারই নিজের বিশ্বাস হইয়াছে।

    সন্ধ্যার সময়ে আমি কুটীরের বাহিরে বেড়াইতেছি। বেড়াইতে বেড়াইতে সেই সাঁকোর নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলাম। উঁকি মারিয়া সাঁকোর নিম্নস্থ পাগলা ঝোরা দেখিতেছিলাম। মংলা মাথা তুলিয়া দেখিলাম, দূরে সুন্দর বনফুলে সজ্জিত একটি পাহাড়িয়া যুবতী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

    তখন চারিদিক্ ধীরে ধীরে অন্ধকার আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছিল! এখানে এ কুটীরের এত নিকটে এ পৰ্য্যন্ত আমি কোন স্ত্রীলোক বা পুরুষ—এমন কি, জনপ্রাণী পৰ্য্যন্ত দেখিতে পাই নাই। এখান হইতে লোকালয় দুই ক্রোশের নিকটে নহে, রাত্রিতে এই দুর্গম পথ দিয়া কাহারও গমন করা সম্ভব নহে।

    তবে এ তরুণী কে? এ এখনও, এখানে কেন? আমি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কণ্ঠ পরিষ্কারের অব্যক্ত শব্দ করিলাম ঝাপ সে নড়িল না। আমি ডাকিলাম, তবুও সে নড়িল না। এই দুর্গম পর্ব্বতে আমার গলার শব্দ তাহার নিকটে পৌঁছিতেছে না ভাবিয়া, আমি তাহাকে হাত নাড়িয়া ডাকিলাম। তখন সে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশিয়া গেল—আমি গৃহের দিকে ফিরিলাম, আমার শিরায় শিরায় যেন কে হিমানী-প্রবাহ ছাড়িয়া দিল। কেন আমার এ ভাব হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তবে কি এ মানুষ নহে—এই কি সেই সোহো-প্রণয়িনী!

    তোমার মন্মথ।”

    পঞ্চম পত্র

    (পূর্বোক্ত পত্রের এগার দিন পরে লিখিত)

    “প্রিয় সুরেশ,

    যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঠিক তাই ঘটিয়াছে। সে আসিয়াছে। আমি যেদিন সন্ধ্যাকালে তাহাকে পৰ্ব্বতমধ্যে দেখিয়াছিলাম, সেই দিন হইতে হৃদয়ের সহিত বিশ্বাস করিয়াছিলাম, সে নিশ্চয়ই একদিন আসিবে।

    কাল রাত্রে সে আসিয়াছে। আমরা উভয়ে উভয়ের চোখের দিকে চাহিয়া বহুক্ষণ বসিয়াছিলাম তুমি নিশ্চয়ই বলিবে, আমি উন্মত্ত হইয়াছি—আমার রোগ সারে নাই, এখনও সেই জ্বর আছে, তাই সেই জ্বরের প্রকোপে বিকৃত মস্তিষ্কে কল্পনায় আমি এই প্রেতাত্মা দেখিতেছি।

    তুমি বলিবে কেন, আমি নিজেকেই নিজে এ কথা অনেকবার বলিয়াছি। এ সকল সত্য—সে আসিয়াছে। কি সে? রক্ত মাংসের দেহধারিণী নারীমূর্ত্তি অথবা আকাশের প্রাণী—বায়ু-মুৰ্ত্তি—আমার কল্পনার সৃষ্টি। যাহাই হউক, তাহাতে বড় কিছু আসে যায় না। আমার নিকটে ইহা কল্পনা নহে—বায়ু নহে—আকাশ নহে—মিথ্যা নহে—সত্য—অতি সত্য!

    গত রাত্রে সে আসিয়াছিল। আমার স্ত্রী পাশের ঘরে নিদ্রিতা। আমি অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত সম্মুখের ঘরে বসিয়া সেই উপন্যাসখানা লিখিতেছিলাম, এই সময়ে সে আসিয়া উপস্থিত হইল।

    প্রত্যহ রাত্রে আমি তাহার প্রতীক্ষা করিয়াছি—দ্বারে তাহার মৃদু কারাঘাতের শব্দ শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে অপেক্ষা করিয়াছি, তাহার আসিবার আসায় প্রতিক্ষণে ব্যাকুল হইয়াছি। এখন আমি আমার মনের এ অবস্থা বেশ বুঝিতে পারিতেছি।

    আমি সাঁকোর উপরে তাহার পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছি, তিনবার দরজায় আঘাত সুস্পষ্ট শুনিতে পাইয়াছি—তিনবার মাত্র!

    ইহাতে আমার কঙ্কালের ভিতরে যেন তীক্ষ্ণ তুষার ধারা প্রবাহিত হইয়াছে, মস্তিষ্কে একরূপ অব্যক্ত বেদনা অনুভব করিয়াছি, আমি সবলে আমার বুক চাপিয়া ধরিয়াছি, তবুও সেই শব্দ, সেই দ্বারে আঘাত, তিনবার—তিনবার মাত্র! আমি উৎকর্ণ হইয়া তাহা শুনিয়াছি।

    আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম, ধীরে ধীরে গিয়া পার্শ্ববর্ত্তী গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। দ্বারে শিকল টানিয়া দিলাম। তৎপরে উৎকণ্ঠিতহৃদয়ে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। আবার সেই শব্দ—সেই দ্বারে আঘাত, তিনবার—তিনবার মাত্র!

    তখন আমি গিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া দিলাম—অতি শীতল বায়ু প্রবলবেগে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া আমার কাগজপত্র কতক উল্টাইয়া, কতক-গৃহতলে ছড়াইয়া দিল, রমণীও গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল, আমি নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম।

    সে তাহার মস্তক হইতে শাল সরাইয়া স্কন্ধে ফেলিল, কণ্ঠদেশ হইতে একখানা রঙ্গীন রুমাল খুলিয়া পার্শ্বে রাখিল, তাহার পর আমার সম্মুখে আগুনের কাছে আসিয়া বসিল। আমি দেখিলাম, তাহার উন্মুক্ত পা দুখানি তখনও শিশিরসিক্ত রহিয়াছে।

    আমি তাহার সম্মুখে বসিলাম, বিস্ফারিতনয়নে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। সে আমার দিকে চাহিয়া মৃদু মধুর হাসিল—সে হাসি মধুর, অথচ বিস্ময়কর, যেন ধূৰ্ত্ততা, শঠতা তাহাতে মাখা। সেই হাসিতে আমি আত্মহারা হইলাম। আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইল, আমি তাহাকে সৰ্ব্বস্ব দিতে প্রস্তুত—সর্বত্যাগী হইতে প্রস্তুত!

    সে কথা কহিল না, নড়িলও না, আমিও তাহার কথা শুটিবার কোন আবশ্যকতা মনে করিলাম না। সেই বিলোল কটাক্ষ, সেই চপল দৃষ্টি, তাহারাই যেন আমার সহিত কত প্রাণের কথা কহিতে লাগিল। সে আমার দিকে চাহিয়া আছে, আমি তাহার দিকে চাইয়া আছি—তাহার চক্ষু আমার চক্ষুর সহিত আমার চক্ষু তাহার চক্ষুর সহিত পরস্পর সম্মিলিত—সে আনন্দ, সে সুখ—সে যে কি, তাহা বর্ণনা করিবার ক্ষমতা আমার নাই!

    আমি কতক্ষণ এইরূপভাবে বসিয়াছিলাম বলিতে পারি না। সহসা সে নিজের বুকের কাছে একটা হাত তুলিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত কান পাতিয়া কি শুনিতে লাগিল। তখনই পার্শ্বস্থ গৃহ হইতে একটা অতি মৃদু শব্দ কানে আসিল। অমনি সেই অপরিচিতা রামা সত্বর তাহার সেই শালখানা তাহার মাথায় টানিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তৎপরে অতি দ্রুতপদে দরজা খুলিয়া গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল—যাইবার সময় দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া গেল।

    আমি ভিতরের ঘরের শিকল খুলিয়া কান পাতিয়া শুনিলাম—কোন শব্দ নাই। তখন আমি ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম, তাহার পর বোধ হয়, সেই স্থানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।

    ঘুম ভাঙ্গিবামাত্র আমার মনে হইল যে, রাত্রিতে রমণী তাহার রুমালখানি লইয়া যাইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। সে যখানে বসিয়াছিল, তাহার চলিয়া যাইবার পরও আমি তথায় রুমালখানি দেখিয়াছিলাম, তা ঘুম ভাঙিবামাত্র সেখানে লুকাইয়া রাখিব বলিয়া সেইদিকে চাহিলাম। দেখিলাম, রুমাল তথায় নাই—আমার স্ত্রী ঘর ঝাঁট দিয়া সমস্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়াছে, আমার চা-এর জন্য জল গরম করিতেছে। সে আমার দিকে দুই-একবার চাহিল—আমি তাহাকে এমন করিয়া চাহিতে আর কখনও দেখি নাই। কিন্তু সে কোন কথা কহিল না—রুমালের কথাও কিছু বলিল না।

    তাহাতেই আমার মনে হইল যে, আমি স্বপ্ন দেখিয়াছি মাত্র, কাল রাত্রে যাহা সত্য ভাবিয়াছিলাম, তাহা আর কিছু নহে—স্বপ্নমাত্র। কিন্তু অপরাহ্নে আমি একবার বাহির হইতে দেখিলাম আমার স্ত্রী সেই রুমালখানি হাতে লইয়া বিশেষ করিয়া দেখিতেছে। তাহার মুখ অপর দিকে ছিল, সুতরাং সে আমাকে দেখিতে পাইল না—আমি স্পষ্ট দেখিলাম, সে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া রুমালখানা দেখিতেছে।

    আমি কতবার মনে করিলাম যে রুমালখানা আমার স্ত্রীরই। কাল রাত্রে যাহা দেখিয়াছি, তাহা সমস্তই আমার কল্পনা—স্বপ্নমাত্র। আর তাহা যদি না হয়, তবে কাল রাত্রে যে আসিয়াছিল, সে প্রেতাত্মা নহে, প্রকৃতই স্ত্রীলোক।

    কিন্তু মানুষ মানুষে চিনিতে পারে, বুঝিতে পারে। কাল রাত্রে যে আমার সম্মুখে বসিয়াছিল, সে রক্তমাংসের কোন জীব নহে—ইহা আমি বেশ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলাম।

    সম্ভবতঃ সে কোন স্ত্রীলোক হইতে পারে না। এখান হইতে দুই ক্রোশের মধ্যে কোন বস্তি বা লোকালয় নাই। দিনেই এই পার্বত্য পথে চলা-ফেরা বিপজ্জনক—রাত্রে অসম্ভব। কোন্ স্ত্রীলোক অন্ধকার রাত্রে এই ভয়াবহ কঠিন পৰ্ব্বত-পথে আসিতে সাহস করিবে? তাহাতে ঘোর অন্ধকার, দারুণ শীত—কোন স্ত্রীলোকেরই এই দুর্গম স্থানে, এ কুটীরে আগমন একেবারেই অসম্ভব।

    আরও কারণ—কোন্ স্ত্রীলোকর উপস্থিতিতে শিরায় শিরায় অস্থিমজ্জায় গলিত তুষার স্রোতঃ প্রবাহিত হয়?

    যাহাই হউক, সে যেই হউক, সে যদি এবার আসে, তাহা হইলে তাহার সহিত কথা কহিব। আমি হাত বাড়াইয়া তাহাকে ধরিব, তাহা হইলেই দেখিতে পাইব, সে রক্তমাংসের জীব, না বায়ু,—কেবল কল্পনা, কেবল শূন্য, না একটী ছায়ামাত্র।

    তোমার মন্মথ।”

    ষষ্ঠ পত্র

    “প্রিয় সুরেশ,

    এই সকল পত্র কখনও যে তুমি পাইবে, সে আশা আমার নাই। আমি এখান হইতে এ সকল চিঠী তোমাকে পাঠাইব না। তোমার নিকট এ সকল পাগলের পাগলামী—উন্মত্তের প্রলাপ ব্যতীত আর কিছুই বোধ হইবে না। যদি কখনও দেশে ফিরি, তাহা হইলে হয় ত কোন দিন না কোন দিন এই সকল পত্র তোমায় দেখাইতে পারি, তাহাও শীঘ্র নহে। যখন আমরা এই সব লইয়া হাস্য বিদ্রুপ করিতে পারিব, কেবল সেই সময়েই তোমায় এ সকল পত্র দেখাইব। এখন আমি এগুলি লিখিতেছি, আমার মনের যাতনায়; এগুলি এইরূপে না লিখিলে হয় ত এখন আমাকে চীৎকার করিয়া মনের যাতনার লাঘব করিতে হইত।

    সে প্রত্যহ রাত্রে আসে, সেই রকম আগুনের কাছে বসে, সেই রকম আমার দৃষ্টির উপর দৃষ্টি সন্ন্যস্ত করে—সেই কুহকময় মৃদুমধুর হাসি হাসে—আমার মস্তিষ্ক ঘোরতররূপে চঞ্চল হইয়া উঠে, আমি আত্মহারা হই,—আমার অস্তিত্ব যেন তাহার মধ্যে লীন হইয়া যায়।

    এখন আমার লেখা সম্পূর্ণই বন্ধ হইয়া গিয়াছে—লিখিবার চেষ্টাও করি না। আমি সাঁকোর উপরে তাহার শুভাগমনের পদশব্দ—ঘাসের উপর তাহার পদশব্দ—দরজায় তাহার মৃদু করাঘাতের শব্দ শুনিবার জন্য ব্যাকুলচিত্তে উৎকর্ণ হইয়া থাকি।

    সে আসিলে সেই ভাব—আমি আর কথা কহিতে পারি না—আমি আর আমাতে থাকি না—কোন কথাই আর মনে হয় না—সেও কোন কথা কহে না, কেবল সেইরূপভাবে চাহিয়া থাকে, সেইরূপ হাসি হাসে।

    প্রত্যহ আমি মনে করি, আজ সে আসিলে আমি নিশ্চয়ই তাহার সহিত কথা কহিব, নিশ্চয়ই তাহাকে স্পর্শ করিব। কিন্তু সে আসিবামাত্র আমি সকলই ভুলিয়া যাই, আমার অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া যায়। কাল রাত্রে যখন আমি তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিলাম, সেই সময় ক্রমে ক্রমে আমার মন তাহার অপরূপ সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ হইয়া গেল, তাহার ওষ্ঠ ঈষৎ উন্মুক্ত হইল, সে চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আমি পার্শ্ববর্তী কক্ষের গবাক্ষের দিকে চাহিলাম, চাহিবামাত্র বোধ হইল, কে যেন জানালা হইতে সহসা মুখ সরাইয়া লইল। এদিকে নিমেষমধ্যে সে মস্তকে শাল টানিয়া দ্রুতপদে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল।

    আমি আলো লইয়া পার্শ্বের গৃহে গমন করিলাম; দেখিলাম, আমার স্ত্রী নিদ্রিতা রহিয়াছে।

    তোমার মন্মথ।”

    সপ্তম পত্র

    “প্রিয় সুরেশ,

    রাত্রির জন্য আমি ভীত নহি, দিনের জন্যই ভীত। যে স্ত্রীলোককে আমি আমার স্ত্রী বলিয়া আসিতেছি, তাহাকে আমি প্রাণের সহিত এখন ঘৃণা করি। সে ঘৃণার সীমা নাই—ইয়ত্তা নাই—অন্ত নাই। তাহার যত্ন শ্রদ্ধা সোহাগ সমস্তই এখন বিষবৎ বোধ হয়। কি জানি, কেন তাহার চোখের দিকে চাহিলে আমি শিহরিয়া উঠি।

    যে সকলই দেখিয়াছে, সকলই জানিতে পারিয়াছে, আমি ইহা বেশ বুঝিতেছি—তাহাই কি?

    অথচ সে আমাকে এখনও ভালবাসে, যত্ন পূর্ব্ববৎ, অনুরাগ পূর্ব্ববৎ, ভক্তি পূর্ব্ববৎ। তথাপি আমার মনে হইতেছে, সমস্ত জাল, সমস্ত মিথ্যা, সমস্তই ছলনা, সমস্ত প্রতারণা! আমরা পরস্পরে প্রণয়, ভালবাসা জানাইতেছি—অথচ সব জাল, সব মিথ্যা, সব ছলনা। আমি জানি, সে সব দেখিয়াছে, সব জানিয়াছে, তাহার চোখ আমাকে ইহা স্পষ্ট বলিয়া দিতেছে। আমি জানি, সে একটি ভীষণ প্রতিহিংসার আয়োজন করিতেছে।

    তোমার মন্মথ।”

    অষ্টম পত্ৰ

    “প্রিয় সুরেশ,

    আজ সকালে হাটে যাইব বলিয়া আমি বাহির হইলাম। আমার স্ত্রী দরজায় দাঁড়াইয়া রহিল, ক্রমে আমি তাহার দূরবর্ত্তী হইতে লাগিলাম। পরে একবার চাহিয়া দেখি, দূর হইতে আমার স্ত্রীকে একটি ক্ষুদ্র পুত্তলিকার ন্যায় দেখাইতেছে; অবশেষে পর্ব্বত বেষ্টন করায় আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।

    তখন আমি উঠিতে পড়িতে মহাবেগে ছুটিয়া অন্য পথ দিয়া গৃহের দিকে আসিতে লাগিলাম। পাৰ্ব্বত্যপথ সহজ নহে, কত উঠিয়া পড়িয়া তবে অন্যদিক্ দিয়া আমার গৃহের নিকট আসিলাম তথায় এক বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের পার্শ্বে লুক্কায়িত থাকিয়া আমার গৃহ প্রতি সতর্কদৃষ্টি রাখিলাম।

    কিয়ৎক্ষণ পরে দেখিলাম, আমার স্ত্রী এক টাঙ্গি লইয়া কাঠের সাঁকোর নিকট আসিল। আমি যেখানে ছিলাম, তথা হইতে, সে কি করিতেছে, তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। সেই দূর হইতেও আমি তাহার মুখে হাসি লক্ষ্য করিলাম—কিন্তু মনে হইল, সে হাসির ভিতরে প্রতিহিংসার বহ্নিশিখা ধ্বক্ ধ্বক্ জ্বলিতেছে।

    সে গৃহে চলিয়া গেলে আমি আবার হাটের দিকে চলিলাম। হাট হইতে সন্ধ্যার সময় গৃহে ফিরিলাম। সে আমাকে পূর্ব্বের মত সমাদরে গৃহে অভ্যর্থনা করিয়া লইল।

    আমি যে তাহার ভায়াবহ কাৰ্য্য দেখিয়াছি, তাহা ঘুণাক্ষরে তাহাকে জানিতে দিলাম না। তাহার সয়তানী কার্য্য ঐরূপই থাকুক। সে ভাবিয়াছে, কোন স্ত্রীলোক রাত্রে সাঁকো পার হইয়া আমার সহিত প্রেমালাপ করিতে আসে, তাই সে সাঁকো কাটিয়া রাখিয়া আসিয়াছে, আজ সে আসিলে নিম্নস্থিত অতল খাদে পতিত হইবে।

    আমি কিছু বলিলাম না। ইহাতে আজ সপ্রমাণ হইবে যে প্রত্যহ রাত্রে আমার কাছে যে আসে—সে কে। যদি সে প্রেতাত্মা হয়, তাহা হইলে ভগ্নপ্রায় সেতুতে তাহার কোন অনিষ্ট ঘটিবে না আর যদি সে প্রকৃতই কোন স্ত্রীলোক হয়, তাহা হইলে আমি এ চিন্তা মন হইতে দূর করিলাম! ভাবিতেও আমার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল।

    যদি প্রকৃতই মানবী হয়, তাহা হইলে কথা না কহিয়া কেবলই আমার দিকে চাহিয়া থাকে কেন? আমিই বা কেন তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারি না? কেন তাহার সম্মুখে আমার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নষ্ট হইয়া যায়? নিশ্চয়ই মানবী নহে, আমার স্ত্রী তাহার কোন অনিষ্ট করিতে পারিবে না। হতভাগিনী প্রতিহিংসার এই ব্যর্থ চেষ্টায় আরও জ্বলিয়া অস্থির হইবে—বেশ হইবে!

    কিন্তু যদি সে প্রেতালোকবাসিনীই হইবে, তবে আমি তাহার পদশব্দ শুনিতে পাই কেন? কেনই বা তাহার পায়ে স্পষ্ট শিশিরের দাগ দেখিতে পাই—কেনই বা সুস্পষ্ট তাহার পায়ের শব্দ শুনিতে পাই? এ সকল ত প্রেতের চিহ্ন নহে।

    রাত্রি হইয়াছে, পূর্ব্বের ন্যায় পার্শ্বের ঘরে আমার স্ত্রী ঘুমাইতেছে। আমি পূর্ব্বের ন্যায় একান্তমনে বসিয়া উৎকর্ণ হইয়া তাহার পদ-শব্দের প্রতীক্ষা করিতেছি।

    যদি সে প্রেতাত্মা হয় তাহা হইলে সে পূর্ব্বের ন্যায় আজও আমার কাছে আসিবে। আর যদি সে যথার্থই কোন স্ত্রীলোক হয়, তাহা ইহলে নিশ্চয়ই সাঁকো হইতে পড়িবার সময়ে আর্তনাদ শুনিতে পাইব। অথবা কোন্ প্রেতলোকের অজানিত কুহকজালে আমাকে ঘিরিয়া ফেলিতেছে! সহসা একি! একি কোন প্রেতাত্মার বিদ্রুপ!

    আমি শুনিয়াছি—আমি সেই ভয়াবহ আৰ্ত্তনাদ এইমাত্র শুনিয়াছি, হৃদয়ভেদী-গগনভেদী আর্তনাদ আমি শুনিয়াছি।

    আকাশ পাতাল প্রকম্পিত করিয়া, অন্ধকার রাশি বিলোড়িত করিয়া সেই ভয়ানক আর্ত্তনাদ সাঁকোর নিকট হইতে উত্থিত হইল, সেই গভীর খাদের মধ্য হইতে উত্থিত হইয়া পর্ব্বতের শৃঙ্গে শৃঙ্গে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। সে আর্তনাদের বর্ণনা নাই—সে আর্তনাদ এখনও আমার কর্ণপথ দিয়া আমার শিরায় শিরায় শোণিতের সহিত ছুটিতেছে।

    আমি গৃহ হইতে সবেগে বাহির হইলাম, সাঁকোর নিকটে আসিলাম, শুইয়া পড়িয়া হাত বাড়াইয়া দেখিলাম, সাঁকো আর নাই।

    নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, ঘোর অন্ধকার—সেই গভীর গহ্বর ঘোর অন্ধকারে পূর্ণ—কিছুই দেখিবার উপায় নাই!

    প্রবলবেগে বাতাস বহিতেছে। আমি উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া ডাকিলাম। সেই প্রবল বাতাসে আমার উচ্চ প্রবল চীৎকার যেন পৈশাচিক হাস্যকল্লোলের ন্যায় দিগ্বলয় কম্পিত করিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।

    আমি বুঝিতেছি, এতদিন যে উন্মত্ততা ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করিতেছিল, যাহা দূর করিবার জন্য আমি এ পর্য্যন্ত কত চেষ্টা পাইয়াছি, তাহাই আজ আমাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছে, আর কোন উপায় নাই—চেষ্টা বৃথা—বৃথা—বৃথা—

    আমি কতবার মনে মনে বলিতেছি এ কেবল আমার বিকৃত অসুস্থ, পীড়িত, মস্তিষ্কের কল্পনামাত্র—এ আর্তনাদও আমার ল্পনামাত্র—না—না—না—ঐ সেই শব্দ! ঐ সেই আৰ্ত্তনাদ! ঐ সেই মৰ্ম্মভেদী আৰ্ত্তনাদ!

    প্রতিক্ষণে কে যেন গুরুভার লোহার হাতুড়ী দিয়া আমার মস্তিষ্কে নিৰ্দ্দয় আঘাত করিতেছে! আমি বুঝিয়াছি, সে আর আমার কাছে আসিবে না—এই শেষ!

    তোমার মন্মথ।”

    শেষ পত্ৰ

    “প্রিয় সুরেশ,

    আমি একটা বড় খামের ভিতর সমস্ত পত্রগুলি রাখিয়া তোমার ঠিকানা লিখিয়া যাব। যদি কখনও কেহ এইখানে আসে, তাহা হইলে সে হয় ত তোমাকে এই পত্ৰ ঠাইয়া দিতে পারে। আমার লেখাপড়া অনেকদিন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমরা—আমি আর আমার স্ত্রী- তোমাকে বুঝাইবার জন্য যাহাকে এখনও আমার স্ত্রী বলিতে হইতেছে, আমরা উভয়ে মুখোমুখি হইয়া বসিয়া থাকি, কেহ কোন কথা কহি না। এ এক অতি আশ্চর্য্য পরিবর্তন!

    যখন কথা কহি, তখন এরূপভাবে কথা কহি, যেন আমাদের উভয়ের এই প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছে। যে দুই একটা কথা কহি, তাহাও আমাদের পরস্পর মনের ভাব গোপন করিবার জন্য—আমাদের উভয়ের কেহই আর পূর্ব্বের মত নাই। আমি সর্ব্বদাই তাহার মুখে বিদ্রুপের হাসি দেখিতেছি—সে তাহা গোপন করিতে চেষ্টা পায়, কিন্তু আমি ইহা দেখিতেছি। তাহার চেষ্টা বৃথা!

    প্রত্যহ রাত্রে নির্জ্জনে বসিয়া থাকিতে থাকিতে মনে হয়, যেন সে পূর্ব্বের ন্যায় দ্বারে আঘাত করিতেছে, আমি সত্বর গিয়া দরজা খুলিয়া দিই, কিন্তু কই, কেহ নাই, কেবল অন্ধকার—সেই অন্ধকারের ভিতর দিয়া গৃহমধ্যে সশব্দে বাহিরের কতকটা শীতল বাতাস প্রবেশ করে মাত্র—আর কিছুই না।

    এই দুর্গম নিভৃত স্থানে বাস করিয়া আমি দানব হইয়াছি। ভালবাসা ও ঘৃণা দুই-ই ভয়াবহভাবে আমার হৃদয়ে উদ্বেলিত হইয়া আমার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ ছুটাইয়াছে, আমার মস্তকে শত চিতানল জ্বালাইয়া দিয়াছে। আমার লেখাপড়া, শিক্ষা, সদ্‌গুণ সমস্ত এই পাহাড়ের বাতাসে যেন আমার হৃদয় হইতে উড়িয়া গিয়াছে! আমি একটি হিংস্র পশু হইয়াছি!

    কবে ইহার—এই স্ত্রীলোকের, যে এক সময়ে আমার স্ত্রী ছিল, তাহার কুসুম-কোমল সুন্দর কণ্ঠদেশ আমার এই রোগশীর্ণ কঙ্কালসার কঠিন অঙ্গুলি দ্বারা সবলে পেষণ করিব—তাহার বিশ্ববিমোহন চক্ষু ধীরে ধীরে মুদ্রিত হইয়া আসিবে, তাহার ওষ্ঠাধর উন্মুক্ত হইবে—তাহার আরক্ত জিহ্বা লতাইয়া পড়িবে, তবে তাহার গলা ধীরে ধীরে, জোের জোরে, আরও জোরে টিপিতে থাকিব! দেরি নাই—দেরি নাই—দেরি নাই!

    তাহার পর ধীরে ধীরে তাহার গলা ধরিয়া তাহাকে পশ্চাতে ঠেলিতে ঠেলিতে এই কূটীর হইতে লইয়া যাইব—এই বন্ধুর কঠিন পাথরের উপর দিয়া লইয়া যাইব—এই খাদের নিকট আনিব। সে বড় বিদ্রুপের হাসি হাসিয়াছিল বটে—এবার হাসির পালা আমার! হো—হো—হো-

    আমি জোর করিয়া তাহাকে ধীরে ধীরে ঠেলিয়া লইয়া যাইব, ধীরে ধীরে আদর ক’রে—এই খাদের ধারে যখন তাহার পায়ের একটামাত্র অঙ্গুষ্ট পাহাড়ে থাকিবে—সে হেলিয়া পড়িবে, তখন আমি তাহার দিকে অবনত হইয়া তাহার আরক্ত অধর চুম্বন করিব—তাহার পর—নিম্নে–নিম্নে—নিম্নে—কুয়াসার মধ্য দিয়া, লতাপাদপগুল্ম ভেদ করিয়া, পশুপক্ষীকে স্তম্ভিত করিয়া—নিম্নে–নিম্নে—গভীরতর নিম্নে—দুই জনে একত্রে যাইব—যাইব—যাইব—যাইব—যতক্ষণ না তাহার সহিত মিলিত হই—”

    (এই পত্র অসম্পূর্ণ।)

    এই শেষ পত্র—এই ভয়াবহ পত্র কয়েকখানি পাঠ করিয়া আমি প্রবোধের মুখের দিকে চাহিলাম, সেও আমার মুখের দিকে চাহিল। আমি তাহার মুখে যে ভাব দেখিলাম, সে বোধ হয়, আমার মুখেও তাহাই দেখিল। আমি দেখিলাম, প্রবোধের মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গিয়াছে।

    আমরা উভয়ে কেহ কাহারও সহিত কথা কহিতে সাহস করিলাম না। উভয়েরই হৃদয় ঘন ঘন স্পন্দিত হইতেছিল।

    সংসারে এই ভায়বহ ব্যাপার যে ঘটিতে পারে, তাহা আমাদের বিশ্বাস ছিল না। আমাদের পথ- প্রদর্শক থম্বিমেনা “সয়তান কা ঔরত,” বলিয়া যে ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করিয়া পলাইয়াছে, এখন বুঝিলাম, তাহার যথেষ্ট কারণ আছে।

    এতদিন ভূত-প্রেতের কথা বিশ্বাস হয় নাই। ভূত-প্রেত হউক বা না হউক, পত্রলেখক মন্মথ যে এই নিভৃত স্থানে বাস করিয়া ভূতের কথা ভাবিয়া ভাবিয়া ভয়ঙ্কর উন্মত্ত হইয়া গিয়াছিল, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। সেই উন্মত্ততায় হতভাগ্য আপনার স্ত্রীকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিয়াছে, নিজেও মরিয়াছে, তাহার প্রমাণ এই সকল পত্র।

    ভোর হইতে না হইতে আমরা সে স্থান হইতে পলাইলাম। রামচন্দ্র! আর সেখানে এক মিনিট থাকে! বস্তিতে আসিয়া আমাদের দুই কুলী ও থম্বিমেনাকে পাইলাম। আমরা যে সেই গৃহে রাত্রিযাপন করিয়া এখনও জীবিত আছি ইহা দেখিয়া তাহারা বিস্মিত হইয়া আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    আমরা দার্জ্জিলিং পৌঁছিয়া পত্রগুলি সমস্ত কমিশনার সাহেবকে দিলাম। শুনিয়াছি, তাঁহার আজ্ঞায় এই ভয়াবহ কুঠিটী একদিন জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমনোরমা – পাঁচকড়ি দে
    Next Article সহধর্মিণী – পাঁচকড়ি দে

    Related Articles

    পাঁচকড়ি দে

    নীলবসনা সুন্দরী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবিনী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যাকারী কে – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    গোবিন্দরাম – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যা-রহস্য – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }