Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ৫ (৫ম খণ্ড)

    পাঁচকড়ি দে এক পাতা গল্প438 Mins Read0

    মৃত্যু-বিভীষিকা – ১

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    প্রাতে গোবিন্দরাম তাঁহার বসিবার ঘরে টেবিলের সম্মুখে একখানি আরাম-কেদারায় অর্দ্ধশায়িত হইয়া ধূমপান করিতেছিলেন। আমি তাঁহার পশ্চাতে কিছুদূরে একখানা মোড়ায় বসিয়া একটা লাঠী পরীক্ষা করিতে ছিলাম। এই লাঠীটি এক ব্যক্তি আমাদের সহিত দেখা করিতে আসিয়া ভুলিয়া ফেলিয়া গিয়াছিলেন, আমরা সে সময় বাড়ীতে না থাকায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। তাঁহার লাঠীটি খুব মোটা বেতের মত—বোধ হয়, চীন দেশের কিম্বা জাপানের বাঁশ হইবে; লাঠীর নীচের দিকে লোহার সাঁপি, মাথার দিক্‌টা রৌপ্যে মণ্ডিত—তাহার উপরে লিখিত, “সি এম সি’র বন্ধুগণের প্রীতি-উপহার, ডাক্তার নলিনাক্ষ বসু এম বি। —১৮৭৪” কোন বহুদর্শী প্রবীণ চিকিৎসকের পক্ষেই এরূপ গুরুভার যষ্টি ব্যবহারই সম্ভব।

    হঠাৎ গোবিন্দরাম বলিলেন, “কি ডাক্তার, লাঠীটা দেখে কি অনুমান কর?”

    তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়া বসিয়াছিলেন; কথাটা বলিবার সময়েও তিনি আমার দিকে চাহিলেন না, নিবিষ্টমনে তামাক টানিতেছিলেন। তিনি যেরূপভাবে বসিয়াছিলেন, তাহাতে আমি কি করিতেছি, তাহা জানিবার তাঁহার কোন সম্ভাবনা ছিল না, তাই বলিলাম, “আমি কি করিতেছি, তুমি কিসে তাহা জানিলে? তোমার মাথার পিছন দিকেও চোখ আছে, দেখিতেছি!”

    এইবার গোবিন্দরাম আমার দিকে ফিরিয়া সহাস্যে বলিলেন, “অন্ততঃ আমার সম্মুখে টেবিলের উপরে একটা খুব উজ্জ্বল পালিস করা চক্‌চকে পানের ডিবা রহিয়াছে, এটা এত পরিষ্কার যে, আর্শির কাজ করে। আমাদের এই ডাক্তারের লাঠী হইতে তুমি কি সিদ্ধান্ত করিতেছ, বল শুনি। দুঃখের বিষয়, কাল তিনি যখন আসিয়াছিলেন, তখন আমরা বাড়ীতে ছিলাম না; কাজেই তিনি কি করিতে আসিয়াছিলেন, তাহা আমরা জানি না; সেইজন্য তাঁহার লাঠী আমাদের কাছে এখন অকিঞ্চিৎকর নহে। লাঠী দেখিয়া তাঁহার সম্বন্ধে তুমি কি সিদ্ধান্ত কর?”

    আমার বন্ধুর প্রথার যতদূর অনুকরণ করা সম্ভব, আমি তাহাই করিয়া বলিলাম, “আমার বোধ হয়, ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু প্রবীণ চিকিৎসক, সকলের মাননীয় ও প্রিয়—তাহা না হইলে তাঁহাকে কেহ এ প্রীতি উপহার দিত না।”

    গোবিন্দরাম রলিলেন, “বেশ—ভাল, তারপর?”

    “আমার বোধ হয়, তিনি কোন পল্লিগ্রামে চিকিৎসা করেন, অধিকাংশ সময়েই হাঁটিয়া রোগী দেখিতে যান।”

    ইহা কিসে বুঝিলে?”

    “এই লাঠীটা যে সৰ্ব্বদা ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা ইহা দেখিলেই বেশ বুঝিতে পারা যায়। ইহার গোড়ার লোহা অনেক ক্ষয়িয়া গিয়াছে—ইহাতে বোঝা যায়, তিনি এই লাঠী লইয়া অনেক হাঁটিয়াছেন।”

    “ঠিক—একথা ঠিক।”

    “তাহার পর ‘সি এম সি’; বোধ হয় কোন সভা বা ক্লাবের নাম, তাহার কোন সভ্যকে তিনি বোধ হয়, চিকিৎসা করিয়া আরোগ্য করিয়া ছিলেন, সেই জন্য তাঁহারা তাঁহাকে এই লাঠী উপহার দিয়াছিলেন।

    “খুব ভাল, ডাক্তার—খুব ভাল।’

    এই বলিয়া গোবিন্দরাম উঠিয়া বসিলেন; বসিয়া বলিলেন, “তুমি এ পর্যন্ত আমার ক্ষমতার কথারই প্রমাণ করিয়া আসিতেছ, আর তোমার নিজের ক্ষমতার কথা কিছুই বল নাই। হতে পারে—তুমি স্বয়ং আলো নও, কিন্তু তোমার ভিতর দিয়া যে একটা আলো বিকীর্ণ হয়, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বলা বাহুল্য, ডাক্তার—আমি তোমার কাছে : ক বিষয়ে ঋণী আছি।”

    গোবিন্দরাম কখনও এই কথা বা এ সম্বন্ধে এত কথা বলেন নাই, তাহাই তাঁহার কথায় আমার প্রাণে ভারি আনন্দ হইল—তিনি কখনও কোন বিষয়ে আনন্দপ্রকাশ করিতেন না— প্রশংসা করিতেন না, আমি তাঁহার কীর্ত্তি জগতে প্রচার করিতেছি, ইহাতে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন; ইহাতে আমি সময়ে সময়ে মনে বড় কষ্ট পাইতাম। আজ তাঁহার এই কথায় আমার মনে প্রকৃতই আনন্দ হইল। তাঁহার প্রথা যে কতকটা আমি আয়ত্ব করিতে পারিয়াছি, ইহা জানিয়া মনে মনে যে একটু অহঙ্কার হইল না, তাহাও নহে।

    তিনি আমার হাত হইতে লাঠীটা লইয়া কিয়ৎক্ষণ তাহা বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর উঠিয়া জানালার নিকটে গিয়া একটী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে লাঠী ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “হাঁ, লাঠী হইতে কতকগুলি অনুমান করা যাইতে পারে—তবে সামান্য, সম্পূর্ণ নহে।”

    আমি বলিলাম, “আমি অনুমান করিতে পারি নাই—এমন কিছু নূতন আছে? বোধ হয়, আবশ্যক কিছুই আমি উপেক্ষা করি নাই।”

    গোবিন্দরাম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “ডাক্তার, তোমার সিদ্ধান্ত সমস্তই ভ্রমাত্মক। এইমাত্র আমি বলিলাম যে, তোমার দ্বারা আমার অনেক সাহায্য হইয়াছে, তাহার মানে তোমার ভুল হইতে আমি অনেক সময়েই ঠিক সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইয়াছি। তবে ইহাও বলিতে চাহি না যে, তুমি এইমাত্র যাহা যাহা বলিলে, তাহা সবই ভুল। এই ডাক্তার যে কোন পল্লিগ্রামের চিকিৎসক, তাহাতে সন্দেহ নাই; ইনি যে অনেক হাঁটিয়া থাকেন, তাহাও নিশ্চিত।”

    “তাহা হইলে আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা ঠিক।”

    “ঐ পৰ্য্যন্তই ঠিক বটে!”

    “ইহা ছাড়া আর কি আছে?”

    “অনেক—ডাক্তার, অনেক—প্রথম তুমি যে বলিলে ‘সি এম সি’ কোন সভা বা ক্লাবের নাম, তাহা ঠিক; আমার বোধ হয়, তাহা কলিকাতা মিউনিসিপাল করপোরেসন। খুব সম্ভব, এই ডাক্তার এখানকার মিউনিসিপালিতে কাজ করিতেন।”

    “হয় ত তুমি যাহা বলিতেছে, তাহাই ঠিক।”

    “তাহাই সম্ভব বলিয়া বোধ হয়। যদি আমাদের অনুমান ঠিক হয়, তাহা হইলে এই ডাক্তার সম্বন্ধে আমরা আরও অনেক সিদ্ধান্তে আসিতে পারি।”

    “আর নূতন এমন কি অনুমান—করা যাইতে পারে?”

    “আর কিছু কি অনুমান করা যায় না? তুমি ত আমার পর্যবেক্ষণের প্রথা জান, সেই প্রথায় ভাবিয়া দেখ।”

    “আমার এইমাত্র মনে হয় যে, লোকটি এখানে ডাক্তারী করিয়া তাহার পর পল্লিগ্রামে গিয়াছেন।”

    “ইহা ছাড়া আমরা আরও একটু অগ্রসর হইতে পারি। আমি যেভাবে বিবেচনা করিতেছি, তুমিও সেইভাবে বিবেচনা কর। কখন তোমার মনে হয় কি যে, তাঁহার ‘সি এম সির’ বন্ধুগণ তাঁহাকে এই প্রীতি উপহার দিতে পারে? কখন তাহাদের উপহার দেওয়া সম্ভব! নিশ্চয়ই যখন নলিনাক্ষবাবু মিউনিসিপালিটীর কাজ ছাড়িয়া স্বাধীনভাবে চিকিৎসা করিতে প্রস্থান করেন—এই কি উপহার দিবার সময় নহে! আমরা জানি, তিনি একজন পল্লিগ্রামের ডাক্তার; তাহাই বুঝিতে হয়, তিনি যখন মিউনিসিপালিটীর কাজ ছাড়িয়া যাইতেছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে এই লাঠিটি উপহার দিয়াছিল।”

    “তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা খুব সম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে।”

    “তাহার পর, বৃদ্ধ বয়সে কেহ চাকরী ছাড়িয়া স্বাধীনভাবে নূতন জীবন আরম্ভ করিতে যায় না; তাহাতেই বুঝিতে হইবে যে, তোমার ডাক্তারের বয়স বেশী নহে—বয়স ছত্রিশের উর্দ্ধ নহে; তবে বিনয়ী, তত উচ্চাভিলাষ নাই, বড়ই অন্যমনষ্ক, একটা কুকুর সর্ব্বদাই তাঁহার সঙ্গে থাকে। তবে সে কুকুরটা খুব বড় বা খুব ছোটও নহে।”

    আমি হাসিয়া উঠিলাম। গোবিন্দরাম আরাম-কেদারায় আড় হইয়া পড়িয়া মুখে নল লাগাইলেন। আমি বলিলাম, “তাঁহার কুকুরের বিষয়টা সম্বন্ধে তোমার কথার প্রতিবাদ করিবার আমার কিছু নাই, ‘তবে তাঁহার বয়স আর ব্যবসায় সম্বন্ধে অনুমান করা শক্ত নহে।”

    গোবিন্দরাম সেলফ্ হইতে একখানা বই টানিয়া লইয়া বলিলেন, “এম বি ডাক্তারের নাম পাওয়া কঠিন নহে। এই লও,—নলিনাক্ষ বসু—১৮৭০ খৃষ্টাব্দে এম বি পাশ—মিউনিসিপালিটীর ফুড-ইনস্পেক্টর; সুতরাং ইঁহার বয়স সম্বন্ধে আমার অনুমান ভুল হয় নাই; তবে বিশেষণগুলি কি বলিয়াছি—বিনয়ী, অন্যমনস্ক, অনুচ্চভিলাষী? বিনয়ী, মিষ্টভাষী না হইলে কেহ কি অপরের প্রিয় হইতে পারে? আর যে অপরের প্রিয় হইতে পারে না, সে কখনই অন্যের নিকট হইতে উপহার পায় না। তাহার পর অন্যমনস্ক? নিতান্ত অন্যমনষ্ক স্বভাব না হইলে প্রীতি-উপহারের লাঠীটা ফেলিয়া যায় না। আর অনুচ্চভিলাষী? তাহা না হইলে কলিকাতা ছাড়িয়া মফঃস্বলে কে চিকিৎসা করিতে যায়?”

    “আর কুকুরটা?”

    “কুকুরটার চিহ্ন লাঠিতেই রহিয়াছে। ভাল করিয়া দেখিলে দেখিতে পাইবে, এই লাঠিতে কুকুরের কামড়ান দাগ রহিয়াছে; সুতরাং বুঝিতে হয়, কুকুরটা সর্ব্বদা ডাক্তারের সঙ্গে থাকে, আর অন্য কাজ না পাইয়া ডাক্তারের লাঠী কামড়াইতে থাকে। দাঁতের দাগ দেখিয়া কুকুরটার আকার বলা কঠিন নহে; নিতান্ত বড় কুকুর হইলে বড় দাঁত হইত, তবে দেশী—না—না— কুকুরটা লম্বা রোঁওয়ালা বিলাতী কুকুর।”

    তিনি উঠিয়া এই সময়ে জানালার কাছে গিয়াছিলেন। আমি হাসিয়া। বলিলাম, “সহসা এত নিশ্চিত হইলে কিরূপে?”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “কারণ সেই কুকুরটাকে আমি আমার দরজায় স্বচক্ষে দেখিতেছি, সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের মালিকও আসিয়াছেন। ডাক্তার, তোমার সমব্যবসায়ী একজন আসিতেছেন, তোমার উপস্থিতি ভারি দরকার। ডাক্তার, বলিতে পার, নলিনাক্ষবাবু—দস্যু-ডাকাতের শত্রু গোবিন্দরামের বাড়ীতে কেন?”

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    আমি পূর্ব্বে নলিনাক্ষবাবুকে একজন রীতিমত পাড়াগেঁয়ে ভাবিয়াছিলাম,—কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। তিনি খুব লম্বা, খুব কৃশ, মুখাকৃতি সুন্দর, নাসিকাটি শুক পাখীর ঠোঁঠের ন্যায় লম্বা ও বাঁকা, চক্ষু উজ্জ্বল, দুই বৃহৎ চসমার কাচের মধ্য হইতে চোখ দুইটি সুস্পষ্ট প্রকাশিত; বয়স ছত্রিশ বৎসরের মধ্যেই হইবে; তবে বয়সানুসারে তিনি গম্ভীর, মুখের ভাব দেখিয়া বিনয়ী, সদাশয়, ভালো লোক বলিয়া বোধ হয়

    তাঁহার দৃষ্টি প্রথমেই গোবিন্দরামের হস্তস্থিত তাঁহার সেই লাঠীর উপরে পড়িল। তিনি ব্যগ্রভাবে অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “লাঠিটা এখানে ফেলিয়া গিয়াছিলাম! যাহা হউক, ভাগ্যক্রমে এখানে ছিল, নতুবা আর পাইতাম না। এ লাঠীটা আমার বন্ধুদের উপহার, হারাইলে মনে বড় কষ্ট পাইতাম।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “কলিকাতা মিউনিসিপালিটী হইতে বন্ধুরা লাঠীটা উপহার দিয়াছিলেন।”

    “হাঁ, কয়েকজন বন্ধু দিয়াছিলেন। আমার বিবাহ উপলক্ষে তাঁহারা আমাকে উপহার দিয়াছিলেন।”

    গোবিন্দরাম মুখখানা অত্যন্ত কদাকার করিয়া ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, “বিবাহ উপলক্ষে উপহার—কি মুস্কিল!”

    এই কথায় নলিনাক্ষবাবু বিস্মিত হইয়া চসমার ভিতর দিয়া গোবিন্দরামের দিকে চাহিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে, বলিলেন, “ইহাতে আবার মুস্কিল হইল কিসে, মহাশয়?”

    গোবিন্দরাম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “আপনি আমাদের অনুমান ওলটপালট করিয়া দিলেন। আপনি এই লাঠী বিবাহের সময় উপহার পাইয়া ছিলেন?”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “হাঁ, সেই সঙ্গে আমার শ্বশুরের কিছু সম্পত্তি পাইয়াছিলাম; তাহা দেখিবার আর কেহ লোক ছিল না, তাহাই সহর ছাড়িয়া পল্লিগ্রামে শ্বশুর বাড়ীতে যাইতে বাধ্য হইলাম।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা হইলে আমাদের বড় বেশী ভুল হয় নাই। এখন মহাশয়–”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “নলিনাক্ষ—আমার নাম নলিনাক্ষ—”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আপনার অনেক পড়া-শোনা আছে, দেখিতেছি।”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “সামান্য — সামান্য; কারণ, যেখানে আছি, সেখানে কোন কাজ-কৰ্ম্ম নাই, কাজেই বই লইয়া থাকি। বোধ হয়, আপনিই গোবিন্দরাম বাবু?”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, আমারই নাম।” বলিয়াই আমাকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “আর ইনি আমার পরম বন্ধু, ডাক্তার বসু।”

    নলিনাক্ষবাবু আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনার সঙ্গে আলাপ হইয়া বড়ই আনন্দ হইল—আপনার বন্ধু গোবিন্দরামবাবুর নামের সঙ্গে আপনারও নাম শোনা আছে।” তাহার পর গোবিন্দরামবাবুর দিকে ফিরিয়া তিনি বলিলেন, “আপনার মস্তকের এরূপ গঠন আমি মনে করি নাই; অত্যাশ্চর্য্য মস্তিষ্ক! অত্যাশ্চৰ্য্য মস্তিষ্ক! আপনার মাথাটা একবার আমায় পরীক্ষা করিতে দিন, এরূপ মাথা আর আমি দেখি নাই।”

    গোবিন্দরাম মৃদু হাসিয়া মাথাটা সরাইয়া লইয়া বলিলেন, “দেখিতেছি; বিজ্ঞান চর্চ্চায় আপনার বিশেষ উৎসাহ আছে। আপনার আঙ্গুল দেখিয়া বুঝিতেছি, আপনি নিজেই সিগারেট পাকাইয়া খান। ঐ বাক্সে সব আছে, লউন।”

    নলিনাক্ষবাবু তাহার দীর্ঘ দীর্ঘ অঙ্গুলি-সাহায্যে অতি শীঘ্র সিগারেট প্রস্তুত করিয়া টানিতে লাগিলেন। আমি দেখিলাম, আমার বন্ধু তাঁহাকে ক্ষণকাল বিশেষরূপে লক্ষ্য করিলেন। অবশেষে তিনি বলিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, বোধ হয়, আপনি আমার মস্তক পরীক্ষার জন্য এখানে আসেন’ নাই। কাল আপনি আসিয়াছিলেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হয় নাই—”

    নলিনাক্ষবাবু ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “না—না,—অন্য কাজ আছে; তবে এরূপ মস্তক পরীক্ষা করিতে পারিলে আমি যে বিশেষ আনন্দিত হইব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। যাহা হউক, আমি অন্য কারণে আপনার কাছে আসিয়াছি আমার সংসার-বুদ্ধি একবারে নাই, আমি কতকগুলা বই লইয়া দুর পল্লিগ্রামে পড়িয়া থাকি। আপনি সংসার-জ্ঞানে অদ্বিতীয়—”

    গোবিন্দরাম অঁহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, “নলিনাক্ষ বাবু আমার প্রশংসা ছাড়িয়া দিয়া যদি আপনি কি জন্য আসিয়াছেন, তাহা সহজ কথায় বলেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হই।”

    নলিনাক্ষ বাবু বলিলেন, “আমার পকেটে একখানা পুঁথি আছে—”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আপনি ঘরে আসিবামাত্রই আমি তাহা দেখিয়াছি।”

    “খুব পুরান পুঁথি।”

    “খুব সম্ভব, দুই শত বৎসরের।”

    “আপনি তাহা কিরূপে জানিলেন?”

    “আপনার পকেটে হইতে অনেকটা বাহির হইয়া রহিয়াছে, তাহাতে অনেকটা লেখা আছে, আমি তাহাই বিশেষ করিয়া দেখিতেছি। পুঁথি নাড়া-চাড়া অভ্যাস একটু আমার আছে, লেখার ধাঁচ, পেট কাটা ব প্রভৃতি পুরান অক্ষর দেখিয়া বুঝিয়াছি যে, পুঁথিখানা দুই শত বৎসরের কম নয়।”

    “আপনি ঠিক বলিয়াছেন। বীরভূম জেলায় নন্দনপুর বলিয়া একটা গ্রাম আছে। এইখানে এক অতি পুরাতন রাজ-পরিবার বাস করেন, এক সময়ে ইহারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেন, কিন্তু এখন সে গৌরব আর নাই; তবে এখনও বেশ জমিদারী আছে। এই পুঁথিখানিতে তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষের একটী বিবরণ লিখিত আছে। অহিভূষণ বাবু, তাঁহাকে আশপাশের সকলেই রাজা বলিয়া ডাকিত, আমরা সকলেও তাঁহাকে রাজা অহিভূষণ বাহাদুর বলিতাম, প্রায় তিন মাস হইল তিনি মারা গিয়াছেন, হঠাৎ মারা যান। আমার সঙ্গে তাঁহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তিনি ভীরু বা দুর্ব্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন, তবুও এই পুঁথিখানিতে যাহা লেখা আছে, তাহা তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়াছিলেন, সেই বিশ্বাস হইতেই তাহার মৃত্যু হইয়াছে।”

    গোবিন্দরাম পুঁথিখানি ডাক্তারের হাত হইতে লইলেন। আমি তাঁহার স্কন্ধের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিলাম, পুঁথির উপর লিখিত রহিয়াছে—”নন্দনপুর রাজ্যের কাহিনী”।

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “এটা দেখিতেছি, কে কি করিয়া যাইতেছেন।”

    ডাক্তার বলিলেন, “হাঁ এই রাজপরিবারে যে চলন চলিত আছে, তাহাই ইহাতে লিখিত হইয়াছে।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “প্রাচীন কথা আমি মনে করিতেছিলাম, আপনি আধুনিক কিছু বলিবার জন্য আসিয়াছেন।”

    নলিনাক্ষ বাবু বলিলেন, “আমি যাহা বলিতে আসিয়াছি, তাহা খুব আধুনিক। কালকের মধ্যেই তাহার একটা শেষ মীমাংসা করিতে হইবে। তবে এই পুঁথিতে যাহা লিখিত আছে, তাহার সহিত সে বিষয় বিশেষ জড়িত, বিষয়টা বড় নহে—অনুমতি করেন তো পড়ি।”

    নলিনাক্ষবাবু অনুমতির অপেক্ষা করিলেন না। পুঁথি খুলিয়াই পাঠে মন দিলেন দেখিয়া গোবিন্দরাম নিজের চেয়ারে ঠেস দিলেন, তাহার পর দুই চক্ষু মুদিত করিলেন। ডাক্তার নলিনাক্ষ বাবু গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া পুঁথি পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    নন্দনপুর রাজ্যের কাহিনী
    (প্রাচীন পুঁথি হইতে উদ্ধৃত)
    স্বীয় পুত্রদ্বয়ের প্রতি রাজা অনিলভূষণের উক্তি।

    “নন্দনপুর রাজ্যের কুকুরের কথা সম্বন্ধে নানা লোকে নানা কথা বলিয়া থাকে; কিন্তু আমি যাহা আমার পিতার কাছে শুনিয়াছিলাম তাহাই লিখিয়া রাখিয়া যাইতেছি। আমার পিতা এই কথা আমার পিতামহের কাছে শুনিয়াছিলেন। বৎসদ্বয়! তোমরা দুই জনে আমার পুত্র, তোমাদের একথা জানা আবশ্যক বলিয়া এ বৃত্তান্ত তোমাদের জন্য লিখিয়া যাইতেছি।

    “যিনি পাপের দণ্ড বিধান করিয়া থাকেন, তিনিই আবার অনুতাপীর প্রতি কৃপা করেন। পাপের দণ্ড যেমনই কঠোর হউক না কেন, অনুতাপ, শান্তি, স্বস্ত্যয়ন, যাগযজ্ঞে নিশ্চয়ই তাহার নিরাকরণ হইয়া থাকে। এই বৃত্তান্ত হইতে কাম ক্রোধ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তির ভয়াবহ ফল দেখিয়া ভীত হও, সতর্ক হও, ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আমাদের বংশে এরূপ কুপ্রবৃত্তি সকল প্রশ্রয় না পায়।

    “যখন মোগল ও পাঠানে মহাযুদ্ধ চলিতেছিল, সেই সময়ে নন্দনপুরের রাজা ছিলেন, শশাঙ্কভূষণ রায়। তাঁহার ন্যায় উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ, ক্রোধী, অত্যাচারী রাজা আমাদের বংশে আর কেহ কখনও হয় নাই। এ প্রদেশে তাঁহার নামে সকলে কাঁপিত।

    “নন্দনপুরের কিছুদূরে এক গ্রামে এক ব্যক্তির এক পরমসুন্দরী যুবতী কন্যা ছিল, একদিন শশাঙ্কভূষণ স্বদলে গিয়া তাহাকে জোর করিয়া নিজের গড়ে আনিল। তাহার পর তাহাকে এক ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিয়া, বন্ধুবান্ধব লইয়া, মদ খাইয়া নৃত্য গীত, চীৎকার হল্লা করিতে লাগিলেন।

    এদিকে সেই যুবতী কোন গতিকে সেই ঘর হইতে পলাইল। তাহার পর বিস্তৃত মাঠের পথে দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটিতে লাগিল।

    কিয়ৎক্ষণ পরে মদোন্মত্ত শশাঙ্কভূষণ কন্যার ঘরে গিয়া, তাহাকে দেখিতে পাইল না, তখন ক্রোধে ক্ষুধার্ত রাক্ষসের ন্যায় ভীষণ মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া বন্ধুদিগের নিকট ফিরিল। ক্রোধ হইলে তাঁহার কোন জ্ঞান থাকিত না, তিনি সম্মুখে যাহা দেখিতে পাইলেন, তাহাই ভাঙ্গিয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিলেন। একে রাত্রি, তাহাতে গড়ের চারিদিকেই বিস্তৃত মাঠ, স্থানে স্থানে অনুচ্চ পাহাড়, এ রাত্রে এ দুর্গম প্রান্তরে বালিকা কোন্ দিকে গিয়াছে, তাহা স্থির করা অসম্ভব। রাজার একজন বন্ধু বলিয়া উঠিলেন, ‘মহারাজ, আপনার কুকুর ছাড়িয়া দিন, সে গন্ধে গন্ধে গিয়া তাহাকে ধরিবে।’

    “এই দুর্বৃত্ত রাজা বাঘের ন্যায় বড় বড় পাঁচ-সাতটা কুকুর পুষিয়াছিল, ইহারা গন্ধ অনুসরণ করিয়া লোক ধরিতে পারিত, ইহাদের কাছে কোন লোকের জুতা, জামা, কাপড় কিছু ফেলিয়া দিবামাত্র ইহারা সেই গন্ধ ধরিয়া যে যেখানেই লুকাইয়া থাকুক না কেন, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিত।

    যুবতী তাহার গায়ের কাপড় ফেলিয়া পলাইয়াছিল। রাজা তাহাই কুকুরদের সম্মুখে ফেলিয়া তাহাদের ছাড়িয়া দিল, তাহার পর নিজে সেই অন্ধকার রাত্রে সেই দুর্গম প্রান্তরে ছুটিল।

    রাজার সঙ্গিগণ কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহারা সকলেই এত মাতাল হইয়াছিল যে, তাহাদের আদৌ জ্ঞান ছিল না; কিন্তু রাজার সহসা এইরূপে বাহির হইয়া যাওয়ায় ক্রমে তাহাদের নেশা একটু কমিল। তখন তাহারা সকলে রাজার অনুসন্ধানে বাহির হইল।

    “তাহারা প্রায় একক্রোশ পথ আসিয়াও রাজাকে দেখিতে পাইল না; কেবল একটা লোক ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিতেছে দেখিতে পাইল; তাহারা তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। লোকটা এত ভয় পাইয়াছিল যে প্রথমে কোন কথা কহিতে পারিল না, অবশেষে সেই রমণীর কথা রাজার কথা পুনঃ পুনঃ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল যে, সে এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে যাইতেছিল, পথে একটি স্ত্রীলোককে ছুটিয়া যাইতে দেখিয়াছে, তাহার পিছনে পিছনে পাঁচ-সাতটা বড় বড় কুকুর ছুটিয়াছে, আর খানিকটা দূরে রাজা যাইতেছে, আবার রাজার পিছনে তাহাকে ধরিবার জন্য একটা প্রকাণ্ড ভয়ানক কাল কুকুর ছুটিয়াছে, সে রকম ভয়ানক জানোয়ার সে আর কখনও দেখে নাই, তাহাই সে ভয় পাইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে এই দিকে ছুটিয়া আসিতেছিল।

    “মদোন্মত্ত রাজ-পারিষদগণ উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল। তাহার পর তাহাকে অকারণ গালি দিতে দিতে অগ্রসর হইল।

    “আরও অর্দ্ধক্রোশে আসিয়া তাহারা দেখিল, রাজার কুকুরগুলা এক ঝোপের মধ্যে ভয়ে জড় সড় হইয়া কাঁপিতেছে, তাহারা এত ভয় পাইয়াছে যে, তাহাদের এখন উঠিবারও ক্ষমতা নাই। এই দৃশ্য দেখিয়া রাজ-পারিষদগণ ভয়ে সেইখানে দাঁড়াইল, আর অগ্রসর হইতে সাহস করিল না। এখন তাহাদের নেশাও অনেক কমিয়া আসিয়াছে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে তিনজন খুব বেশি মাতাল হইয়াছিল, তাহারা ভয় পাইল না; বরং যাহারা ভয় পাইয়াছিল, তাহাদিগকে কটূক্তি ও বিদ্রূপ করিয়া অগ্রসর হইল।

    “এই তিনজন আরও কিছুদূরে গিয়া দেখিল, সেই যুবতীর মৃতদেহ পড়িয়া আছে। ভয়ে তাহার মৃত্যু হইয়াছে—তাহার একটু দূরে রাজা পতিত, তাহার পার্শ্বে এক ভয়াবহ প্রাণী, সেটা কুকুর, অথচ ঠিক কুকুরের মত দেখিতে নহে, ভয়ানক বড়, ভয়ানক কাল; এবং তাহার মুখ চোখে আগুন জ্বলিতেছে। এরূপ ভয়ানক প্রাণী কেহ কখনও দেখে নাই। এই ভয়াবহ কুকুর রাজার কন্ঠের রক্ত শোষণ করিয়া খাইতেছে।

    “তাহারা এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া বিকট চীৎকার করিয়া ছুটিয়া পলাইল। এক জনের সেই রাত্রেই মৃত্যু হইয়াছিল, আর দুই জন চিরজীবনের জন্য উন্মত্ত হইয়া যায়।

    “বৎসদ্বয়, আমাদের বংশে এইরূপে এই ভয়াবহ কুকুর প্রবেশ করিয়াছে, সেই পর্য্যন্ত এই কুকুর আমাদের বংশের এক মহা বিভীষিকা হইয়া রহিয়াছে। এই বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণভাবে শুনিয়া তোমরা ভীত হইবে ভাবিয়া আমি সমস্ত স্পষ্ট লিখিয়া গেলাম, ইহাতে ভয় দূর হওয়াই উচিত।

    “সত্য কথা, আমাদের বংশের অনেকের এইরূপে হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে, মৃত্যুও বড় ভয়ানক রহস্যপূর্ণ, তবে প্রকৃতই যদি আমাদের বংশ কোনরূপে অভিশপ্ত হইয়া থাকে, তবে যাগযজ্ঞ, শান্তি-স্বস্ত্যয়নে নিশ্চয়ই সেই অভিশাপ দূর হইবে।”

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    এই পুঁথি-পাঠ শেষ হইলে ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু তাঁহার সোনার চসমা কপালের দিকে ঠেলিয়া দিয়া গোবিন্দরামের দিকে চাহিলেন। তিনি চক্ষুরুন্মীলন করিয়া, একটা সুদীর্ঘ হাই তুলিয়া বলিলেন, “আচ্ছা—তারপর?”

    ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু বলিলেন, “এটা কি আপনার ভাল লাগিল না?

    গোবিন্দরাম মৃদুহাস্যে কহিলেন, “যাহারা উপকথা ভালবাসে, তাহাদের কাছে খুব ভাল লাগিবে, সন্দেহ নাই।”

    ডাক্তার বাবু পকেট হইতে একখানা খবরের কাগজ বাহির করিয়া বলিলেন, “গোবিন্দরাম ঋবু, এখানি ‘বীরভূম প্রকাশ’। রাজা অহিভূষণের মৃত্যু সম্বন্ধে ইহাতে যাহা লিখিয়াছে, এখন তাহাই পড়িতেছি।”

    এই বলিয়া তিনি আবার চসমাটা নাসিকার নীচের দিকে লাগাইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন;—”নন্দনপুরের রাজা অহিভূষণ এ প্রদেশের মধ্যে একজন বিশেষ সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন, বংশমর্য্যাদায় তাঁহারা এ বীরভূম জেলায় প্রধান আসন অধিকার করিতেন, এতদ্ব্যতীত রাজা অহিভূষণ বড় ভাল লোক ছিলেন, তাঁহার দান-ধর্ম্ম যথেষ্ট ছিল। নন্দনপুরের চারিদিকে বিশ ক্রোশের মধ্যে এমন কেহ নাই যে, তাঁহার নিকটে কোন বিষয়ে ঋণী নহে।

    ‘তাঁহার পুত্র কন্যা ছিল না, স্ত্রীরও বহুকাল পূৰ্ব্বে মৃত্যু হইয়াছিল। তিনি ইচ্ছা করিলে আবার বিবাহ করতে পারিতেন, কিন্তু আর বিবাহ করেন নাই। ইচ্ছা করিলে পোষ্যপুত্রও লইতে পারিতেন, কিন্তু তাহাও লয়েন নাই।

    “তাঁহার দুই ছোট ভাই ছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তাঁহাদের মধ্যে পরস্পর যৌবনসুলভ উষ্ণরক্তের কারণে বিবাদ হয়, তাহাতেই তাঁহারা রাগত হইয়া বাড়ী ছাড়িয়া চলিয়া যান, নন্দনপুরের জমিদারী পূর্ব্ব নিয়মেই চলিয়া আসিতেছে; জমিদারী পিতার বড় ছেলেই পাইবে, বিষয় বিভাগ হইবার উপায় ছিল না। উপায় থকিলে তাহার ভ্রাতারা নিশ্চয়ই মোকদ্দমা করিয়া বিষয় বিভাগ করিয়া লইতেন।

    “সেই পর্যন্ত তাঁহাদের কোন সন্ধান নাই, তাঁহারা কখনও দেশে বা বাড়ীতে পত্র লিখেন নাই, তবে রাজা অহিভূষণ অনুসন্ধানে জানিয়াছিলেন যে, তাহার মেজ ভাই পঞ্জাবে আছেন, এবং তাঁহার এক পুত্র হইয়াছে। ছোট ভাইয়ের কোন সন্ধান তিনি পান নাই।

    “এখন তাঁহার হঠাৎ মৃত্যু সম্বন্ধে যাহা জানা গিয়াছে, তাহাই বলিতেছি;—রাজা এই বৃহৎ বাড়ীতে একাকী থাকিতেন, তাঁহার পুরাতন ভৃত্য অনুপ ও তাহার স্ত্রী সুমঙ্গলা ব্যতীত আর কেহ ছিল না। তাঁহার জমিদারীর কাছারী প্রায় চারিক্রোশ দূরবর্তী শুকদেবপুরে ছিল। সেইখানে দেওয়ান ও অন্যান্য কর্ম্মচারী থাকিতেন। অনুপ জাতিতে কায়স্থ, রাজবংশও কায়স্থ, সুতরাং সুমঙ্গলাই পাককার্য্য করিত।

    “শুকদেবপুর বড় গ্রাম, এই গ্রামের প্রান্তভাগে ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু বাস করিতেন, তিনি শ্বশুরের বিষয়-সম্পত্তি পাইয়া কয়েক বৎসর হইতে এখানে আসিয়া বাস করিতেছেন। ইঁহার সহিত রাজা অহিভূষণের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল, ইনি বলেন, কয় মাস হইতে রাজার শরীর বিশেষরূপে ভগ্ন হইতেছিল।

    “মৃত্যুর ঘটনা এই;—রাজা প্রত্যহ সন্ধার পর বাহিরে আসিয়া গড়ের ধারে কিয়ৎক্ষণ পরিক্রমণ করিতেন, বহু কাল হইতে তাঁহার এ অভ্যাস। অনুপ এ কথা বলিয়াছে। তাঁহার শরীর ভাল নাই বলিয়া রাজা কিছু দিনের জন্য পশ্চিমে থাকিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। জিনিষপত্র ও বাঁধা হইয়াছিল, পরদিন সকালে তিনি রওনা হইবেন, কিন্তু তাঁহার চির-অভ্যাস মত, সন্ধ্যার পর একটা চুরুট টানিতে টানিতে বেড়াইতে বাহির হয়েন। কিন্তু জীবিত ফিরেন নাই।

    “রাত্রি বারটার সময়ও রাজা ফিরিলেন না দেখিয়া, অনুপ লণ্ঠন লইয়া তাঁহার সন্ধানে বাহির হইল। পর্ব্বে একটু বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহাই রাজার পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া যাওয়া তাহার পক্ষে ক্লেশকর হইল না, গড়ের উত্তরের শেষ কোণে গিয়া দেখিল, রাজা পড়িয়া আছেন—তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

    “তাঁহার শরীরে আঘাতের কোন চিহ্ন ছিল না। কিন্তু তাঁহার মুখ এমনই ভয়াবহ ভাবে বিকৃত হইয়াছিল যে, এমন কি তাঁহার বিশেষ বন্ধু ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু পর্য্যন্ত তাঁহার মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহাকে চিনিতে পারেন নাই। পরীক্ষায় অবগত হওয়া গিয়াছে, হৃদরোগে রাজার মৃত্যু হইয়াছে। বহুদিন হইতেই তিনি হৃদরোগে পীড়িত ছিলেন।

    “এই বংশের অনেকেরই এইরূপ হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে, এই জন্য নানা লোকে নানা গল্প বলিয়া থাকে। যাহা হউক, রাজা অহিভূষণের মৃত্যুতে এ প্রদেশের বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে। আশা করা যায়, তাঁহার জমিদারী যিনি পাইবেন, তিনিও নন্দনপুরে বাস করিয়া এ দেশের হিতব্রতে নিযুক্ত রহিবেন। শুনিতে পাওয়া যাইতেছে, রাজা অহিভূষণের এক ভ্রাতুষ্পুত্রমাত্র জীবিত আছেন, এক্ষণে তিনি নন্দনপুরের রাজা।”

    ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু কাগজখানি গুটাইয়া বলিলেন, “সাধারণে রাজার মৃত্যু সম্বন্ধে যাহা জানিয়াছে, ইহাতে তাহাই লিখিত হইয়াছে।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, এই রাজার মৃত্যু সম্বন্ধে আমিও বোধ হয়, পূৰ্ব্বে কাগজে একবার পড়িয়া ছিলাম, তবে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় এ বিষয়ে এত লক্ষ্য করি নাই। আপনি বলিলেন, সাধারণে যাহা জানিতে পারিয়াছে, কাগজে তাহাই লিখিত হইয়াছে, নিশ্চয়ই। তাহা হইলে দেখিতেছি সাধারণে জানে না, এমন কিছু ইহার ভিতরে নাই।

    “হ্যাঁ।”

    “বলুন, তাহাই আমি শুনিতে চাহি,” বলিয়া গোবিন্দরাম আবার চেয়ারে ঠেস দিলেন।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু বলিলেন, “আমি যাহা বলিতে যাইতেছি, তাহা আমি এ পৰ্য্যন্ত সাহস করিয়া কাহাকেও বলি নাই। আমি পূর্ব্বে যে এ কথা প্রকাশ করি নাই, তাহার কারণ আমার ন্যায় শিক্ষিত লোকে যদি একটা কুসংস্কারে, একটা আয়িমার গল্পে বিশ্বাস করে, তবে লোকে বলিবে কি? বিশেষতঃ এ কথা যত প্রকাশ হইবে, ততই নন্দনপুরের গড়ে আর কেহ বাস করিতে পারিবে না। ইহাতে সে প্রদেশের বিশেষ অনিষ্ট। এই সকল ভাবিয়া আমি এ পৰ্য্যন্ত এ কথা কাহাকেও বলি নাই। তবে আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা; আপনার পরামর্শ লইতে আসিয়াছি, সুতরাং আপনার কাছে কোন কথাই গোপন করিব না, সমস্ত কথাই বলিতেছি;-

    “এই প্রদেশটায় লোকজনের বসতি খুব কম, দূরে দূরে গ্রাম, মধ্যে কেবলই মাঠ। নন্দনপুরের চারিদিকেই যে কঙ্করাকীর্ণ বিস্তৃত প্রান্তর আছে, তাহাতে কাহারই বসতি নাই; দুই-তিন ক্রোশের মধ্যে কোন গ্রাম নাই। নিকটে কোন গ্রাম না থাকায়, আমি নন্দনপুর হইতে অনেক দূরে থাকা সত্বেও প্রায়ই নন্দনপুরে রাজার কাছে যাইতাম। এত ঘন ঘন যাইবার কারণ, রাজার শরীর ভাল ছিল না, তিনি মধ্যে মধ্যে আমাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন। আমার বলা ছিল যে, সুবিধা ও সময় পাইলেই আমি তাঁহার বাড়ীতে যাইব।

    “এইরূপ ঘন ঘন যাতায়াতে তাঁহার সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব হইল। রাজা বড় বাহির হইতেন না; লোক-জনের সঙ্গেও বড় মিশিতেন না; বই পড়িতে খুব ভালবাসিতেন; আমার ন্যায় তিনিও সর্ব্বদাই বই লইয়া থাকিতেন।

    “কয় মাস হইতে আমি দেখিলাম যে, রাজার স্নায়ু ক্রমেই অধিকতর দুর্ব্বল হইয়া আসিতেছে; এমন কি আমি বুঝিলাম, এরূপ ভাবে আর কিছুদিন থাকিলে তাঁহাকে শীঘ্র‍ই শয্যাগত হইতে হইবে, এমন কি তাঁহার হঠাৎ মৃত্যুও হইতে পারে। বিশেষতঃ তাঁহার বংশের এই শাপের কথা তিনি মনে মনে পড়ই বিশ্বাস করিয়াছিলেন। এমন কি রাত্রে তিনি কিছুতেই গড়ের বাহির হইতেন না।

    “তিনি সুশিক্ষিত লোক, এইজন্য আপনি হয় ত শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, তিনিও এই ভৌতিক কুকুরের কথা বিশ্বাস করিয়াছিলেন। ভৌতিক কোন কিছু যে সর্ব্বদাই তাঁহার নিকটে আছে, ইহা তিনি সব সময়েই মনে করিতেন। প্রায়ই আমায় জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘ডাক্তার, তুমি ত রাত্রে দিনে—সব সময়েই এখান হইতে বাড়ী যাও, অন্য দূর গ্রামেও যাও, কখন কিছু দেখিয়াছ, কখনও কি কোন কুকুরের বিকট চীৎকার শুনিয়াছ?”

    “আমি পুনঃপুনঃ না বলায়ও তিনি আশ্বস্ত হইতে পারিতেন না, কিছুতেই তাঁহার মন হইতে ভয় দূর হইত না।

    “আমার একখানা ছোট টমটম গাড়ী আছে, আমি সেইখানিতে রোগী দেখিতে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে যাই। একদিন সন্ধ্যার পর আমি রাজবাড়ীতে উপস্থিত হইয়া দেখি, রাজা অহিভূষণ দরজায় দাঁড়াইয়া আছেন। আমি গাড়ী হইতে নামিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিলে তিনি আমার স্কন্ধের উপর হাত দিয়া বাহিরের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বুঝিলাম, তিনি ভয়াবহ একটা কিছু দেখিতেছেন। আমি সত্বর পশ্চাদ্দিকে ফিরিলাম—আমার বোধ হইল, কিছুদূরে অন্ধকারে একটা কাল বাছুর ছুটিয়া চলিয়া গেল। রাজা এত ভীত ও বিচলিত হইয়াছেন দেখিয়া, সেটা কি আমি দেখিতে গেলাম, কিন্তু আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না, কোন জানোয়ার যে নিকটে আছে, তাহা আমার বোধ হইল না। এই কথা রাজাকে আসিয়া বলায় তিনি আরও অভিভূত হইয়া পড়িলেন। আমি তাঁহাকে সুস্থ করিবার জন্য অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত তাঁহার বাড়ীতে রহিলাম। সেইদিন রাত্রে তিনি সমস্ত কথা আমাকে বলিয়া এই পুঁথি আমাকে দিয়াছিলেন।

    “এই বিষয়টা যে আপনাকে বলিলাম, তাহার কারণ তাঁহার মৃত্যুর সহিত ইহার বিশেষ সম্বন্ধ আছে; তখন কিন্তু আমি ইহা কিছুই নহে, মনে করিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলাম।

    “তাহার পর আমিই রাজাকে পশ্চিমে বেড়াইতে যাইতে পরামর্শ দিলাম। আমি ভাবিলাম, কিছুদিন বেড়াইয়া আসিলে তাঁহার শরীর মন দুই-ই ভাল হইবে। সদানন্দবাবুও আমার মতে মত দিলেন। সদানন্দবাবু আমাদের গ্রামের কাছেই থাকেন, বরং তাঁহার বাড়ী গড়ের কাছে— বেশী দূর হইবে না। রাজার সঙ্গে তাঁহারও বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।

    “রাজার পশ্চিমে যাওয়ার সব স্থির, এই সময়ে সহসা তাঁহার মৃত্যু হইল। অনুপ তাঁহার মৃতদেহ দেখিবামাত্র একজন লোক আমার নিকট পাঠাইয়া দেয়, আমিও তখনই ছুটিয়া আসি। আমি রাজার পায়ের দাগ ধরিয়া ধরিয়া যাই। তাঁহার মৃতদেহ যেখানে পড়িয়াছিল, তাহাও ভাল করিয়া দেখিয়াছি; তবে দেখিলাম, অনেকটা দূর তিনি পা টিপিয়া বুড়ো আঙ্গুলের উপর ভর দিয়া গিয়াছেন, এই স্থানে তাঁহার পায়ের সম্পূর্ণ দাগ পড়ে নাই। আমি ইহাও দেখিলাম যে, সেখানে অনুপের পায়ের দাগ ভিন্ন আর কাহারও পায়ের দাগ নাই।

    “আমি যতক্ষণ না উপস্থিত হইয়াছিলাম, ততক্ষণ রাজার দেহ কেহ স্পর্শ করে নাই। আমি দেখিলাম, রাজা মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়া আছেন, তাঁহার দুই হাত দুইদিকে প্রসারিত, নখ মাটির ভিতর বসিয়া গিয়াছে, যেন তিনি নখ দিয়া মাটি খুঁড়িতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন। সেখানে অনেকগুলি নখের আঁচড়ের দাগ পড়িয়াছে। তাঁহার মুখের এমনই ভয়াবাহ ভাব হইয়াছে যে, আমিই প্রথমে তাঁহাকে চিনিতে পারি নাই। পরে দেহ বিশেষ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কোন আঘাতের চিহ্ন নাই। তবে অনুপ একটা বিষয় লক্ষ্য করে নাই, আমি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম। যেখানে দেহটা পড়িয়াছিল, তাহার প্রায় ত্রিশ হাত দূরে কতকগুলি স্পষ্ট দাগ ছিল।”

    গোবিন্দরাম ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কিসের দাগ?”

    ডাক্তার বলিলেন, “পায়ের দাগ।”

    গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসিলেন, “স্ত্রীলোকের না পুরুষের?”

    ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু কেমন একরকম সশঙ্কভাবে আমাদের মুখের দিকে চাহিলেন, পরে অনুচ্চস্বরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “গোবিন্দরামবাবু, স্ত্রীলোক বা পুরুষের পায়ের দাগ নহে— একটা খুব বড় কুকুরের পায়ের দাগ।”

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    এই কথায় আমার শিরায় শিরায় রক্ত যেন জল হইয়া গেল। ডাক্তারের কম্পিত স্বরে বুঝিলাম যে, তিনিও অতিশয় বিচলিত হইয়াছেন। গোবিন্দরামও ব্যগ্রভাবে উঠিয়া বসিলেন, এবং এক মুহূর্তে তাঁহার চক্ষুদ্বয় উৎসাহে ও আগ্রহে অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আপনি ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন?”

    ডাক্তার নলিনাক্ষ বলিলেন, ‘আপনাকে এখন যেরূপ স্বচক্ষে দেখিতেছি ঠিক সেই রকম দেখিয়াছিলাম। স্বপ্ন নহে—কল্পনাও নহে।

    গোবিন্দ। কাহাকেও এ কথা বলেন নাই?

    নলিনাক্ষ। না। বলিয়া লাভ কি?

    গো। আর কেহ এই কুকুরের পায়ের দাগ লক্ষ্য করে নাই কেন?

    ন। যেখানে মৃতদেহ ছিল, সেখান হইতে এই দাগ প্রায় ত্রিশ হাত দূরে ছিল; তাহাই কেহ ইহা লক্ষ্য করে নাই। আমি যদি এই পুঁথির কথা না জানিতাম, তাহা হইলে আমিও হয় ত তাহা লক্ষ্য করিতাম না।

    গো। গড়ে অনেক কুকুর থাকিতে পারে।

    ন। না, একটা কুকুরও ছিল না, কুকুরের উপরে রাজার অতিশয় বিরক্তি ছিল।

    গো। আপনি বলিতেছেন, কুকুরটা খুব বড়।

    ন। খুব বড়।

    গো। রাজার দেহের কাছে কুকুরটা আসে নাই। তাহা হইলে তাহার পায়ের দাগ থাকিত।

    ন। হাঁ, কাছে আসে নাই।

    গো। রাত্রিটা কি রকম সেদিন ছিল?

    ন। মেলা—ঠাণ্ডা।

    গো। বৃষ্টি পড়ে নাই?

    ন। না, আগের দিন একটু বৃষ্টি হইয়াছিল।

    গো। রাজার দেহ যেখানে পড়িয়া ছিল, সেদিক দিয়া মাঠে যাইবার কোন পথ ছিল?

    ন। হাঁ, গড়ের খালের উপর দিয়া একটা ছোট সাঁকো আছে। সেই সাঁকো দিয়া মাঠে যাওয়া যাইতে পারা যায়।

    গো। গড়ে যাইবার আর কোন পথ কি আছে?

    ন। না—আর সম্মুখের বড় পথ।

    গো। তাহা হইলে কাহাকে বাহির হইতে গড়ের মধ্যে যাইতে হইলে হয় সম্মুখের পথ, না হয় এই সাঁকো, এ ছাড়া আর কোন পথে যাইবার উপায় ছিল না?

    ন। না, আর কোন পথ নাই।

    গো। এখন একটা কথা—পথের দুই পাশে নিশ্চয়ই ঘাস ছিল?

    ন। হাঁ, ছিল। পথটা সরু, দুইদিকেই ঘাস জন্মিয়াছিল।

    গো। এই কুকুরের পায়ের দাগ ঘাসের উপর ছিল কি?

    ন। না, ঘাসের উপরে পায়ের দাগ পড়িতে পারে না।

    গো। সাঁকোর দিকে এই দাগ ছিল?

    ন। হাঁ, সাঁকোর দিক্ দিয়াই বোধ হয়, কুকুরটা আসিয়াছিল।

    গো। এদিকে কোন দরজা ছিল?

    ন। হাঁ, সাঁকোর মুখেই একটা দরজা ছিল, সেটা সে রাত্রে তালা দিয়া বন্ধ ছিল।

    গো। তাহা হইলে একটা প্রাচীর ছিল?

    ন। হাঁ, কিন্তু বেশি উঁচু প্রাচীর নয়।

    গো। আপনি আমাকে অত্যন্ত কৌতূহলাক্রান্ত করিয়া তুলিলেন, দেখিতেছি। আচ্ছা বলুন দেখি, কেহ এই প্রাচীর অনায়াসে লাফাইয়া আসিতে পারে কি না

    ন। বেশ পারে।

    গো। এই দরজার কাছে আর কোন দাগ ছিল?

    ন। না, আর বিশেষ কোন দাগ ছিল না।

    গো। কি আশ্চৰ্য্য! কেহ কি ভাল করিয়া দেখে নাই?

    ন। আমি খুব ভাল করিয়া দেখিয়াছিলাম।

    গো। কিছুই দেখিতে পান নাই?

    ন। রাজার পায়ের দাগ ছিল। বোধ হয়, রাজা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিলেন।

    গো। কিসে জানিলেন? :

    ন। তাঁহার চুরুটের ছাই এখানে পড়িয়াছিল।

    গো। খুব ভাল, এত লক্ষ্য কেহ করে না। আপনার সঙ্গে কাজ করিয়া আনন্দ আছে। তাহার পর দাগ সম্বন্ধে কি?

    ন। সেখানে তাঁহারই পায়ের দাগ দেখিতে পাইয়াছিলাম, আর কোন দাগ ছিল না।

    গোবিন্দরাম চেয়ারের হাতায় দুই তিনবার করাঘাত করিয়া, সেই সঙ্গে জিহ্বা ও তালুর সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া বলিলেন, “আমি যদি সেদিন সেখানে ঠিক সেই সময় উপস্থিত থাকিতে পারিতাম! ব্যাপারটা যে বিশেষ কৌতুকাবহ ও রহস্যজনক, তাহাতে সন্দেহ নাই। সেই স্থানটা আমি সে সময়ে দেখিলে হয় ত অনেক কথা জানিতে পারিতাম। যাক্, এখন সেখানে আর কোন দাগই নাই। ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু, পূৰ্ব্বেই আমাকে আপনার সংবাদ দেওয়া উচিত ছিল।”

    ডাক্তার নলিনাক্ষ সঙ্কোচের সহিত কহিলেন, “গোবিন্দরামবাবু, এই অদ্ভুত কুকুরের ব্যাপারটা প্রকাশ করিতে আমার সাহস হয় নাই; তবে যে আপনাকে বলিতেছি, সে কেবল কৰ্ত্তব্যে বাধ্য হইয়া। ইহা প্রমাণ করিলে আমাকে লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হইতে হইত। তাহার. পর—তাহার পর-

    গো। তাহার পর কি? বলিতে ইতস্ততঃ করিতেছেন কেন? বলুন।

    ন। ইহার ভিতরে আরও অনেক গুরুতর ব্যাপার আছে। আমার মনে হয়, খুব সুদক্ষ বহুদর্শী প্রবীণ ডিটেক্‌টিভের দ্বারাও সে সব ব্যাপারের কিছু কিনারা হইতে পারে না।

    গো। তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস, এটা সম্পূর্ণ ভৌতিক ব্যাপার?

    ন। না, আমি ঠিক একথা বলি না।

    গো। কিন্তু না বলিলেও স্বতই আপনি তাহাই ভাবিয়াছেন?

    ন। রাজার মৃত্যুর পর অনেক বিষয় আমার কানে আসিয়াছে, সে সব ভৌতিক ভিন্ন আর কিছু হইবার সম্ভাবনা নাই।

    গো। কি রকম, একটা বলুন, শোনা যাক্

    ন। এই ব্যাপার ঘটিবার পূর্ব্বে, গড়ের বাহিরের মাঠে অনেকে একটা ভয়াবহ কুকুর দেখিয়াছে। যাহারা তাহা দেখিয়াছে, তাহারাই বলে যে সেটা কুকুর নয়,—কুকুর তেমন হয় না, এত বড় এমন কুকুর কেহ কখনও দেখে নাই, তাহার পর রাত্রে তাহার সর্ব্বাঙ্গে আগুন জ্বলিতে থাকে। যাহারা এই ভয়াবহ জানোয়ার দেখিয়াছে, তাহাদের আমি বিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছি, তাহাতে তাহারা যাহা বলে, তাহাতে এই পুঁথির কুকুরের সঙ্গে ঠিক মিলিয়া যায় সেখানকার লোকে এত ভয় পাইয়াছে যে, আর কেহ বাড়ীর বাহির হয় না।

    গো। আপনার ন্যায় সুশিক্ষিত লোকও এটাকে ভূত মনে করিতেছেন?

    ন। আর কি মনে করিব?

    গোবিন্দরাম মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন, “এ পর্যন্ত আমি চোর, জালিয়াৎ, খুনী দস্যুদের ধরিয়া বেড়াইতেছি, তবে ভূত কখনও ধরি নাই; বোধ হয়, ইহা আমার অধিকার ও ক্ষমতার বাহিরে। ডাক্তার বাবু, আপনি কুকুরের যে পায়ের দাগ দেখিয়াছিলেন, সেটা ভৌতিক বা মিথ্যা নহে, এটা ত স্থির?”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “এই পুঁথির কুকুরটা ভৌতিক হইলেও সেই রাজার রক্তপান করিয়াছিল; এরূপস্থলে এ ব্যাপারটাকে ভৌতিক বলিব, কি পৈশাচিক বলিব, কিছুই ভাবিয়া পাই না।”

    গোবিন্দরাম হাসিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, আপনি সম্পূর্ণ ভূত-বিশ্বাসী হইয়া গিয়াছেন। তবে একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞসা করি, যদি আপনার ইহাই বিশ্বাস, তবে আমার কাছে আসিয়াছেন কেন? আপনি বলিতেছেন, রাজা অহিভূষণের মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা বৃথা, আবার সঙ্গে সঙ্গেই উল্টো গাইতেছেন—এই অনুসন্ধান করুন।”

    ন। আমি যে সেইজন্য আপনার কাছে আসিয়াছি, তাহা ত আমি এ পর্যপ্ত আপনাকে বলি নাই। অনুসন্ধানে আর ফল কি?

    গো। তাহা হইলে কি জন্য আসিয়াছেন?

    ন। রাজা মণিভূষণ আর এক ঘণ্টার মধ্যেই হাবড়া ষ্টেশনে পৌঁছিবেন। তাঁহার সম্বন্ধে কি করিব, তাহাই আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি। আপনার পরামর্শে অবশ্যই আমরা উপকৃত হইবার আশা রাখি।

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “মণিভূষণ—ইনিই কি এখন নন্দনপুরের নূতন মালিক হইয়াছেন?”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “হাঁ, রাজা অহিভূষণের মৃত্যুর পর আমরা তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র মণিভূষণের সন্ধান লই। মণিভূষণ পঞ্জাবে ছিলেন, যতদূর সন্ধান পাইয়াছি, তিনি ভাল লোক বলিয়াই জানিতে পারিয়াছি। রাজা অহিভূষণ উইলে আমাকে অভিভাবক করিয়া গিয়াছেন।

    গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “অন্য কেহ কি এ সম্পত্তি দাওয়া করিতে পারে?”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “না, আর কেহ নাই। আমরা এ সম্বন্ধে বিশেষ সন্ধান লইয়াছি। আমি আপনাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, রাজা অহিভূষণের আর দুই ভাই ছিলেন, দুইজনেই তাঁহার সহিত ঝগড়া করিয়া বাড়ী ছাড়িয়া চলিয়া যান। মণিভূষণ তাঁহার মধ্যম ভ্রাতার পুত্র। কনিষ্ঠ ভ্রাতার চরিত্র অতি কদর্য্য ছিল, তাঁহার সন্ধান যতদূর পাওয়া যায়, তাহাতে জানা গিয়াছে, তিনি অবিবাহিত অবস্থায়ই মান্দ্রাজের দিকে কোন স্থানে মারা গিয়াছেন। সুতরাং এই মণিভূষণ ব্যতীত আর নন্দনপুরে কোন মালিক নাই, তাঁহার বয়স এখন ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসর হইয়াছে, তাঁহাকে সংবাদ দেওয়ায় তিনি পঞ্জাব হইতে রওনা হইয়াছেন। একঘন্টা পরেই হাবড়ায় উপস্থিত হইবেন। এখন তাঁহার সম্বন্ধে আপনি কি পরামর্শ দেন?”

    “কি বিষয়ে পরামর্শ বলুন।”

    “তাঁহার নন্দনপুরে যাওয়া উচিত কি না?”

    “তাঁহার নিজের পৈত্রিক বাড়ীতে তিনি যাইবেন না কেন?”

    “এ কথা ঠিক, কিন্তু আপনার ইহাও মনে করা উচিত যে, এই বংশের যিনি নন্দনপুরে বাস করিয়াছেন, তাঁহারই হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে, হয় ত রাজা অহিভূষণের এরূপ হঠাৎ মৃত্যু না হইলে তিনিই আমায় তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নন্দনপুরে আনিতে নিষেধ করিতেন; অথচ এখন মণিভূষণ যদি না সেখানে যান, তবে হাজার ম্যানেজার থাকিলেও তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি দেখে কে? তিনি দেশে আসিলে দেশসুদ্ধ লোকের উপকার। আমি নিজে কিছুই স্থির করিতে পারি নাই বলিয়া, আপনার মত বিচক্ষণ লোকের পরামর্শ লইতে আসিয়াছি।”

    গোবিন্দরাম কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “সহজ কথায়—আমার মতে নন্দনপুরে এমন ভয়ানক কিছু একটা আছে, যাহাতে এই বংশের কেহ তথায় বাস করিলে তাঁহার হঠাৎ মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা।”

    নলিনাক্ষ কহিলেন, “কতকটা তাহার প্রমাণও পাওয়া যাইতেছে।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “ঠিক, তবে আপনার ভৌতিক ব্যাপারই যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই ভূত এই সহরেও দুই নূতন রাজার অনিষ্ট করিতে পারে। আপনার ভূতের ক্ষমতা যে নন্দনপুরের বাহিরে যাইতে পারে না, ইহা কখন সম্ভব নহে।”

    নলিনাক্ষ কহিলেন, “গোবিন্দরাম বাবু, আপনি এই ব্যাপারে যদি লিপ্ত থাকিতেন, তাহা হইলে এ সম্বন্ধে এরূপভাবে কথা কহিতে পারিতেন না। যাহা হউক, তাহা হইলে আপনার মতে রাজা মণিভূষণ সম্পূর্ণ নিরাপদে নন্দনপুরে যাইতে পারেন, এই আপনার পরামর্শ।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমার উপস্থিত পরামর্শ, আপনি এখন একখান গাড়ী ভাড়া করুন—আপনার কুকুরটিকে ডাকিয়া লউন, কুকুরটা ঘরের বাহিরে থাকিয়া কবাট জোড়ার উপরে যে মহা বিক্রম প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহার শব্দ স্পষ্ট আমি শুনিতে পাইতেছি; আমার ইচ্ছা নয়, অসহায় কবাট-জোড়াটি কুকুর মহাশয়ের দন্ত-নখরে অনর্থক ক্ষত-বিক্ষত হয়। যাক্, গাড়ীতে উঠিয়া, আপনি হাবড়া ষ্টেশনে গিয়া এই নূতন রাজার সঙ্গে দেখা করুন।”

    নলিনাক্ষ। তার পর?

    গোবিন্দ। তার পর—এখন আপনি তাঁহাকে কোন কথা বলিবেন না। বিশেষতঃ যতক্ষণ না আমি কিছু স্থির করিতে পারি, ততক্ষণ আপনি এ সম্বন্ধে একেবারে নীরব থাকিবেন।

    ন। কতক্ষণে আপনি স্থির করিতে পারিবেন?

    গো। একদিন। কাল এই সময়ে আসিবেন, সঙ্গে নূতন রাজাকে আনিলে কাজের আরও সুবিধা হইবে।

    ন। কাল ঠিক এই সময়ে আমি রাজাকে লইয়া আপনার এখানে উপস্থিত হইব।

    ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু অন্যমনস্কভাবে গমনে উদ্যত হইলেন। তিনি দরজা পর্য্যন্ত গমন করিলে গোবিন্দরাম তাঁহাকে বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, আর একটা কথা, আপনি বলিলেন না যে, রাজা অহিভূষণের মৃত্যুর পূর্ব্বে অনেকে এই ভৌতিক কুকুর দেখিয়াছিল?”

    “হাঁ, অন্ততঃ তিনজন দেখিয়াছে।”

    “তাঁহার মৃত্যুর পরে কেহ দেখিয়াছে?”

    “না, কই তাহা শুনি নাই।”

    “বেশ, এখন এই পর্যন্ত।”

    গোবিন্দরাম সন্তুষ্টচিত্তে প্রসন্নমুখে চেয়ারে ঠেসান দিয়া বসিলেন। কোন কিছু একটা রহস্যপূর্ণ ব্যাপার তাঁহার হইলে তিনি সর্ব্বদাই এইরূপ সন্তুষ্ট হইতেন। আমাকে উঠিতে দেখিয়া তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি ডাক্তার, যাইতেছ?”

    আমি বলিলাম, “যদি দরকার থাকে বসি।”

    তিনি বলিলেন, “না, উপস্থিত এমন কোন দরকার নাই, তবে কাজের সময়ে আমি সর্ব্বদা তোমার চাই। যাক্, যাইবার সময়ে দোকানীকে বলিয়া যাইও, সে যেন খুব কড়া তামাক একপোয়া আমাকে এখনই পাঠাইয়া দেয়। সন্ধ্যার পর আসিও, তখন দুইজনে এই ব্যাপার সম্বন্ধে আলোচনা করা যাইবে।”

    অষ্টম পরিচ্ছেদ

    আমি জানিতাম, কোন গুরুতর রহস্য হাতে আসিলে গোবিন্দরাম একাকী নির্জ্জনে বসিয়া মনে মনে তাহার আলোচনা করিতে ভালবাসিতেন। সে সময়ে কেহ তাঁহার নিকটে আসিলে তিনি বিরক্ত হইতেন; এইজন্য আমি সমস্ত দিন আর তাঁহার বাড়ীতে গেলাম না; প্রায় রাত্রি আটটার সময়ে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গেলাম।

    তাঁহার বসিবার ঘরের দরজা খুলিলে আমার মনে হইল, সে ঘরে যেন আগুন লাগিয়াছে; ঘর ধূমে, এতই পূর্ণ হইয়াছে যে, আলোটা স্তিমিত হইয়া গিয়াছে, স্পষ্ট দেখা যাইতেছে না। গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া আগুনের ভয় আমার দূর হইল—অতি কড়া তামাকের গন্ধ পাইলাম। এই ধুম নাসিকায় যাওয়ায় আমি কাসি বন্ধ রাখিতে পারিলাম না, কাসিতে লাগিলাম। সেই ধূমের অন্ধকার মধ্যে দেখিলাম, ‘মূৰ্ত্তিমান ব্যোমের’ ন্যায় আমার বন্ধুবর গোবিন্দরাম তাঁহার আরাম-কেদারায় নিশ্চলভাবে বসিয়া আছেন। এত ধূম যে তাঁহাকে পরিষ্কার দেখা যায় না।

    তিনি আমাকে কাসিতে দেখিয়া বলিলেন, “কি ডাক্তার, কোথায় ঠাণ্ডা লাগাইলে? সদির কাসি নাকি?”

    আমি বলিলাম, “না, তোমার চণ্ডালে গুড়ুক তামাকের ধোঁয়া।”

    “ওঃ! হাঁ, তামাকটা একটু কড়া বটে।”

    “একটু কড়া? একেবারে অসহ্য।”

    “জানালাটা খুলিয়া দাও, তাহা হইলেই ধোঁয়া বাহির হইয়া যাইবে। সমস্ত দিন বাড়ীতেই ছিলে?”

    “কিসে জানিলে?”

    তোমার ভাব দেখিয়া। আমি কোথায় ছিলাম মনে কর?”

    “এই বাড়ীতেই।”

    “না, আমি নন্দনপুরে গিয়াছিলাম।”

    আমি হাসিয়া বলিলাম, “কি রকম! যোগবলে?”

    “হাঁ, কতকটা তাহাই বটে, আমার এই দেহখানা এই চেয়ারে পড়িয়া ছিল বটে, কিন্তু আমি নন্দনপুরে গিয়াছিলাম। ইতোমধ্যে আমার অজ্ঞাতসারে আমার এই দেহটা এই অত্যধিক কড়া তামাক প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস করিয়াছে। আমি দোষী নই, ডাক্তার।”

    “ওখানা কি?”

    “বীরভূমের মানচিত্র। সমস্ত দিন আমার আত্মা এই ম্যাপে—বিশেষতঃ নন্দনপুরের কাছে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।”

    “ইহাতে কি, সব আছে?”

    “সব। এই দেখ, এইটা নন্দনপুরের গড়-

    “চারিদিকেই মাঠ।”

    “হাঁ, এই ছোট গ্রাম। খুব সম্ভব, এই গ্রামের প্রান্তে এইখানে আমাদের বন্ধু নলিনাক্ষবাবু বাস করেন। দেখিতেছ, প্রায় দুই-তিন ক্রোশের মধ্যে আর কোন বড় গ্রাম নাই—এই মাঝামাঝি পথে একটা ছোট গ্রাম আছে, বোধ হয়, এইখানেই সদানন্দবাবুর বাস। তাহার পর প্রায় দশ ক্রোশ দূরে সুরি সহর। ইহার মধ্যে বৃক্ষলতাশূন্য কাঁকর ও পাথরে পূর্ণ বিস্তীর্ণ মাঠ, এই মাঠের মধ্যে জন-মানবের বাস নাই।”

    “নিশ্চয়ই, বড়ই মরুর মত জায়গা।”

    “নিশ্চয়ই—যদি ভূত একটু লীলাখেলা করিতে চায়—”

    “তাহা হইলে তুমিও এ ব্যাপার ভৌতিক বলিয়া মনে করিতেছ?”

    “ভূতের চেলাদের রক্ত-মাংসের দেহ হইতে পারে। এখন প্রথমেই দুইটা কথা উঠিতেছে; প্রথম—যথার্থই খুন হইয়াছে কিনা, দ্বিতীয়—যদি খুন হইয়া থাকে, তবে তাহা কিরূপে হইল? যদি ডাক্তার নলিনাক্ষ বাবুর বিশ্বাসই ঠিক হয়, আর ভূতেই এই কাজ করিয়া থাকে, তাহা হইলে আমাদের অনুসন্ধান এখান হইতেই শেষ হইল। তবে অন্যান্য সমস্ত দিক্ দেখিয়া যদি আর কিছু না পাই, তখন অগত্যা এই ভূতের কথায়ই বিশ্বাস করিতে হইবে। ডাক্তার, যদি তোমার আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে জানালাটা বন্ধ করিয়া দাও-ঘরের চারিদিক বন্ধ থাকিলে মনের বেশি একাগ্রতা জন্মে; তাহাই বলিয়া আমি এ পর্য্যন্ত কোন বাক্সের মধ্যে বন্ধ হইয়া মনের অবস্থা পরীক্ষা করিয়া দেখি নাই। যাক্, তুমি এই ভূতের সম্বন্ধে মনে মনে কোন আলোচনা করিয়াছ কি?”

    “আমি সমস্ত দিনই মনে মনে এ বিষয় আলোচনা করিয়াছি।”

    “কি স্থির করিলে?”

    “কিছুই স্থির করিতে পারি নাই; ফাপারটা বড়ই গোলযোগে বলিয়া বোধ হইতেছে।”

    “এ ব্যাপারটায় একটু নূতনত্ব আছে, সন্দেহ নাই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ—রাজার পায়ের দাগের পরিবর্তন। এ সম্বন্ধে তুমি কি মনে কর?”

    “নলিনাক্ষ বাবু বলিলেন যে, রাজা খানিকটা দূর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে ভর দিয়া গিয়াছিলেন।”

    “আমাদের ডাক্তার বাবু কেবল আন্দাজের কথা বলিয়াছেন। কেন লোকটা এক স্থানে এভাবে যাইবে?”

    “তাহা হইলে তুমি কি মনে কর?”

    “ডাক্তার, লোকটা দৌড়িতেছিল, প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া দৌড়িতেছিল, ভয়ে তাহার হৃদপিণ্ডের কাজ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর পড়িয়া মরিয়া গিয়াছিল।”

    “কি জন্য এরূপ ভাবে পলাইতেছিল?”

    “এইটাই সমস্যা। স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, লোকটা প্রাণভয়ে দৌড়িবার পূর্ব্বে ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল।”

    “এ কথা কিসে জানিলে?”

    “আমি অনুমান করিতেছি। তাহার ভয়ের কারণ মাঠ হইতে আসিয়াছিল। তাহা হইলে লোকটা নিতান্ত হতবুদ্ধি না হইয়া গেলে ভয় পাইয়া বাড়ীর দিকে না ছুটিয়া অন্যদিকে ছুটিত না। তাহার পর গড়ের এই নির্জ্জন স্থানে লোকটা সেই রাত্রে কাহারও অপেক্ষা করিতেছিল। তাহার জন্য বাড়ীতে অপেক্ষা না করিয়া এখানে গিয়াছিল কেন?”

    “তাহা হইলে তুমি মনে করিতেছ, এই রাজা কাহারও জন্য অপেক্ষা করিতেছিল?”

    “হাঁ, লোকটার বয়স হইয়াছিল, পীড়িত, রাত্রি ঠাণ্ডা—মেঘলা, এ সময় সে কি ইচ্ছা করিয়া সেই রাত্রে এইখানে বেড়াইতে গিয়াছিল? না, অসম্ভব। ডাক্তার নলিনাক্ষ চুরুটের ছাই দেখিয়া বুঝিয়াছে যে, লোকটা সেখানে অপেক্ষা করিয়াছিল, নিশ্চয়ই তাহাই।”

    “কিন্তু এই রাজা রোজই সন্ধ্যার পর এইরূপ বেড়াইত।”

    “তাহা বলিয়া নিশ্চয়ই সে এই নিৰ্জ্জন সাঁকোর দরজার কাছে রোজ দাঁড়াইয়া চুরুট খাইত না। বরং ডাক্তার নলিনাক্ষের নিকট জানিলাম যে, রাজা প্রাণ থাকিতে মাঠের দিকে যাইত না; কেবল যে দিন সে দেশ ছাড়িয়া পশ্চিমে বেড়াইতে যাইবে, কেবল তাহারই আগের রাত্রে সে এইরূপ এইখানে অপেক্ষা করিতেছিল। ডাক্তার, এখন কতকটা, কিছু অনুমান করিবার উপায় হইতেছে। ডাক্তার, আমার সেতারখানা একবার দাও দেখি, যতক্ষণ ডাক্তার নলিনাক্ষ আর তাঁহার সেই নূতন রাজার সঙ্গে দেখা না হয়, ততক্ষণ একটু সঙ্গীত-বিদ্যার আলোচনা করা যাক্।”

    নবম পরিচ্ছেদ

    পর দিবস, বেলা নয়টার সময় নলিনাক্ষবাবু নূতন রাজাকে সঙ্গে লইয়া গোবিন্দরামের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। গোবিন্দরামের বাড়ীতে আমি সকালেই উপস্থিত হইয়াছিলাম। দেখিলাম, রাজা মণিভূষণ অতি সুন্দর সুপুরুষ যুবক; বেশ বলিষ্ঠ, পঞ্জাবে জন্ম, পঞ্জাবে লালিত-পালিত, তিনি প্রায় একজন বলবান্ তেজস্বী শিখে পরিণত হইয়াছেন।

    ডাক্তার নলিনাক্ষ বাবু বলিলেন, “ইনিই রাজা মণিভূষণ।”

    আগন্তুক উভয়ে বসিলেন। মণিভূষণ বলিলেন, “হ্যাঁ, গোবিন্দরাম বাবু, ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য্যের বিষয় বলিতে হইবে। আমাদের ডাক্তার বাবু আমাকে আপনার কাছে না আনিলে আমি নিজেই আপনার কাছে আসিতাম। আমি শুনিয়াছি, রহস্যোদ্ভেদ করিতে আপনার অসাধারণ ক্ষমতা। আমার নিজের সম্বন্ধে আজ সকালে একটা রহস্যপূর্ণ ব্যাপার ঘটিয়াছে, আমি এ পর্যন্ত তাহার মাথা-মুণ্ড কিছুই স্থির করিতে পারি নাই।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “বলুন, আপনার কথায় বুঝিতেছি যে, আপনি কলিকাতায় পৌঁছিবামাত্র একটা কিছু ঘটিয়াছে।”

    মণিভূষণ বলিলেন, “বিশেষ গুরুতর কিছু নয়, গোবিন্দরাম বাবু; খুব সম্ভব কেবল কৌতুক ঠাট্টা বিদ্রূপ—এই চিঠিখানা আজ সকালে আমি পাইয়াছি।”

    এই বলিয়া তিনি পকেট হইতে একখানা খাম বাহির করিলেন। সাধারণ খাম, উপরে লেখা “রাজা মণিভূষণ—হিন্দু আশ্রম, শিয়ালদহ।” ডাকঘরের দাগ বহুবাজার। গত কল্য পত্রখানি ডাকে দেওয়া হইয়াছিল।”

    গোবিন্দরাম খামখানি খুব ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন, “আপনি যে এই হিন্দু-আশ্রমে থাকিবেন, তাহা কেহ জানিত?”

    মণিভূষণ বলিলেন, “কেহ না, আমি হাওড়া ষ্টেশনে নামিয়া এইখানে থাকা স্থির করিয়াছিলাম।”

    গোবি। নলিনাক্ষবাবু নিশ্চয়ই এইখানেই বাসা লইয়াছিলেন।

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “না, আমি এখানে আসিয়া এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আছি। আমরা যে এই হিন্দু-আশ্রমে থাকিব, তাহা জানিবার কাহারও সম্ভাবনা নাই, কারণ এখানে থাকা পূৰ্ব্বে স্থির ছিল না।”

    গোবিন্দরাম ধীরে ধীরে বলিলেন, “আপনারা কোথায় থাকেন, কি করেন, দেখিতেছি, কেহ সে বিষয়ে বিশেষ নজর রাখিয়াছে।”

    তিনি খাম হইতে একখানা কাগজ বাহির করিলেন। তিনি কাগজখানি খুলিয়া জানুর উপরে রাখিলেন। এই কাগজের মধ্যস্থলে কেবল এক লাইন মাত্র লেখা আছে, তাহাও কেহ কোন ছাপান কাগজ হইতে অক্ষর কাটিয়া লইয়া কাগজে আটা দিয়া জুড়িয়াছে। লেখাটুকু এইঃ—

    “যদি প্রাণের মায়া থাকে—প্রাণ থাকিতে মাঠে যাইও না।”

    রাজা বলিলেন, “গোবিন্দরামবাবু, এখন বলুন, ইহার মানে কি? আর কে-ই বা আমার জন্য এত চিন্তিত?”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “নলিনাক্ষবাবু, আপনি এ সম্বন্ধে কি বলেন? এ পত্রে যে ভৌতিক কিছু নাই, ইহা নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করিবেন।”

    নলিনাক্ষ বলিলেন, “ইহাও হইতে পারে যে, রাজার কোন হিতৈষী প্রজা ভূতের কথা বিশ্বাস করিয়াই এরূপ লিখিয়াছে।”

    রাজা মহা বিস্ময়ভরে বলিয়া উঠিলেন, “ভূত! ভূত কি! দেখিতেছি, আপনারা আমার বিষয় আমার অপেক্ষা অধিক জানেন।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমরা যাহা জানি, আপনিও তাহা সমস্ত জানিতে পারিবেন, এখনই সমস্ত শুনিবেন। উপস্থিত এই অদ্ভুত পত্রখানির বিষয় আলোচনা করা যাক্। নিশ্চয়ই ইহা কাল এইরূপ ভাবে লিখিত হইয়াছে, আর কালই ডাকে দেওয়া হইয়াছে।” বলিয়া গোবিন্দরাম আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “ডাক্তার, ঐখানে এবারকার ‘সোম-প্রকাশ’খানা আছে, দাও দেখি।”

    আমি কাগজখানা দিবামাত্র তিনি ক্ষণেক নিবিষ্ট মনে দেখিয়া এক স্থান হইতে পাঠ করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর পড়িয়া বলিলেন, “বেশ লিখিয়াছে, নয় কি?”

    ডাক্তার ও রাজা উভয়েই বিস্মিতভাবে তাঁহার দিকে চাহিলেন। রাজা বলিলেন, “আমি চিরকাল পঞ্জাবে ছিলাম, এসব বিষয় বড় বুঝি না, তবে আপাততঃ আমার এই পত্রখানার বিষয়ই আমরা আলোচনা করিতেছিলাম।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, ‘তাহা আমি ভুলি নাই, আমিও সেই বিষয়েরই আলোচনা করিতেছি। আমার বন্ধু আমার অনুসন্ধান প্রণালী বেশ অবগত আছেন, তবুও দেখিতেছি, তিনিও এখনও কিছু বুঝিতে পারেন নাই।”

    আমি বলিলাম, “হাঁ, ঠিকই কথা। তবে ‘সোম প্রকাশের’ এই প্রবন্ধের সঙ্গে এই পত্রের কি সম্বন্ধ তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “ডাক্তার, বিশেষ সম্বন্ধ আছে, কারণ এই প্রবন্ধ হইতে কথা কাটিয়া লইয়া এই পত্রখানি প্রস্তুত হইয়াছে। ‘প্রাণের’, ‘মায়া’ ‘প্রাণ থাকিতে’ ‘মাঠে’ সমস্তই এই প্ৰবন্ধ হইতে কাটিয়া লওয়া।”

    রাজা বলিয়া উঠিলেন, “বাঃ—আশ্চর্য্য! আশ্চর্য্য! ঠিক তাহাই ত!”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাঁচকড়ি রচনাবলী ২ – পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ৪ (৪র্থ খণ্ড)

    Related Articles

    পাঁচকড়ি দে

    নীলবসনা সুন্দরী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবিনী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যাকারী কে – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    গোবিন্দরাম – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যা-রহস্য – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }