Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ৫ (৫ম খণ্ড)

    পাঁচকড়ি দে এক পাতা গল্প438 Mins Read0

    মৃত্যু-বিভীষিকা – ৩০

    ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    দ্বিতীয় পত্র—শেষাংশ।

    তখন আমরা দুই জনে আবার দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া চলিলাম। কখনও সেই আলোটা দেখিতে পাইতেছি, কখনও দেখিতে পাইতেছি না, কখনও যেন বোধ হইতেছে যে, আলোটা খুব নিকটে, কখনও মনে হইতেছে, যেন বহু দূরে।

    যাহাই হউক, আমরা পথের কাঁকর বালি ভাঙ্গিয়া অবশেষে আলোটার অতি নিকটে উপস্থিত হইলাম। একটা ক্ষুদ্র পাহাড়ের গহ্বরের ভিতর হইতে এই আলো দেখিতে পাওয়া যাইতেছিল। কোন দিকে কেহ নাই—চারিদিকে ঘোর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিতেছে—চারিদিকে ঘোর অন্ধকার,—আর সেই বিরাট অন্ধকারের মধ্যে সেই ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে, এই দৃশ্যে আমাদের উভয়ের মনেই এক অভূতপূর্ব্ব ভাবের উদয় হইল।

    মণিভূষণ আমার কানে কানে বলিলেন, “এখন কি করা যায়?”

    আমিও অতি মৃদুস্বরে বলিলাম, “এইখানেই অপেক্ষা করা যাক—নিশ্চয়ই সে তাহার আলোর কাছে আছে—দেখা যাক উঁকি মেরে।”

    এই সময়ে সেই পাহাড়ের গহ্বর হইতে এক ভয়াবহ মুখ বাহির হইল। এরূপ মুখ আমি আর কখনও জীবনে দেখি নাই। কোন হিংস্র বন্য পশুর মুখও বোধ হয় এরূপ ভয়ঙ্কর হয় না। লোকের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে যে মুখেরও পরিবর্ত্তন হয়, তাহার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আমি এই হারু ডাকাতে প্রত্যক্ষ করিলাম।

    কোন কারণে যে সে সন্দেহ করিয়াছে, আমি তাহার মুখে সে ভাব স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। বোধ হয়, অনুপ এখানে খাবার দিতে আসিলে সে কোনরূপ সাঙ্কেতিক শব্দ করিত; আজ সেই শব্দ না শুনিতে পাইয়া হারু সন্দিহান হইয়াছিল। মুহূর্ত মধ্যে সে আমাদের দেখিয়া একখণ্ড বৃহৎ প্রস্তর তুলিয়া লইয়া আমাদের দিকে নিক্ষেপ করিল; প্রস্তরের আঘাতে আমাদের আলোটা নিবিয়া গেল।

    আমরা লম্ফ দিয়া সরিয়া না দাঁড়াইলে সেই পাথরে গুরুতর আহত হইতাম।

    কিন্তু ইহাতে আমরা ভীত হইলাম না, আমি তাহাকে ধরিবার জন্য গহ্বর মধ্যে পড়িলাম। মণিভূষণও আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন, কিন্তু ততক্ষণে হারু সেই গর্ভ হইতে বাহির হইয়া মাঠ দিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতেছিল, এই সময়ে চাঁদ মেঘান্তরাল হইতে বাহির হওয়ায় একটু জ্যোৎস্নার আলোও হইয়াছিল, সেই আলোয় দেখিলাম, হারু প্রাণপণে ছুটিয়াছে, হয়ত আমি তাহাকে গুলি করিয়া আহত করিতে পারিতাম, কিন্তু নিরস্ত্র পলাতককে সহসা গুলি করিতে আমার আদৌ আগ্রহ হইল না।

    আমরা দুই জনও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া ছিলাম, কিন্তু দেখিলাম, তাহাকে ছুটিয়া গিয়া ধরা অসম্ভব। তখন আমরা দুই জনে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দাঁড়াইলাম, তখনও আমরা দূরে তাহাকে দেখিতে পাইলাম, সে তখনও উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতেছিল।

    আর অনুসরণ বৃথা, আমরা একটু বিশ্রাম করি বার জন্য এক প্রকাণ্ড প্রস্তর খণ্ডের উপরে বসিলাম, হারুও দৃষ্টির বাহির হইয়া গেল।

    এই সময়ে আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল। দেখিলাম, দূরে একজন লোক একটা প্রস্তর স্তূপের উপর পাষাণমূর্তির ন্যায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে; আমরা দুই জনই এই মূৰ্ত্তি চন্দ্রালোকে বেশ সুস্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। এই নির্জ্জন প্রান্তর মধ্যে এই মূর্ত্তি কাহার, কে এই গভীর রাত্রে এখানে এভাবে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে?

    আমরা যে ভুল দেখি নাই, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আমরা দুই জনেই ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছিলাম—লোকটা একটু পা ফাঁক করিয়া দণ্ডায়মান ছিল, সে যে হারু ডাকাত নহে, তাহা বেশ বলিতে পারি। হারু খর্ব্বাকৃতি, কিন্তু এ ব্যক্তি দীর্ঘাকৃতি ও কৃশ। লোকটি যেমন হঠাৎ আবির্ভূত হইয়াছিল, তেমনই হঠাৎ অন্তর্হিত হইয়া গেল।

    আমার ইচ্ছা হইল, লোকটা কে দেখি, কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম, তথা হইতে লোকটা যেখানে আবির্ভূত হইয়াছিল, তাহা অনেক দূরে, বিশেষতঃ মণিভূষণও আর এই রাত্রে এই ভয়াবহ মাঠে থাকিতে সম্মত নহেন। সেই শব্দ শুনিয়া পর্যন্ত তাঁহার মনের অর্দ্ধেক সাহস লোপ পাইয়াছে। তিনি বলিলেন, “হারুকে ধরিবার জন্য মাঠের নানা স্থানে লোক আছে, বোধ হয়, তাহাদেরই একজন।”

    হয়ত তাঁহার কথাটাই ঠিক,—যাহাই হউক আমি কালই সুরিতে গিয়া পুলিশে সংবাদ দিব মনে মনে স্থির করিলাম। ডাকাতটাকে নিজের হাতে ধরিয়া পুলিসের হাতে দিতে পারিলে খুব বাহাদুরী হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু উপায় নাই, সে এক রকম মুঠোর মধ্যে হইতে পলাইল।

    তাহার পলায়নে আমি যে কেবল দুঃখিত হইলাম, তাহা নহে, কিছু সন্তুষ্টও হইলাম। সন্তুষ্ট সুমঙ্গলার জন্য, তাহার ভাই যে ভয়াবহ ডাকাতে পরিণত হইয়াছে, সেজন্য তাহার অপরাধ কি? কাল রাত্রে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তোমায় সমস্ত লিখিলাম। অনেক বাজে কথা লিখিলাম, তবে যাহা কিছু ঘটে সমস্তই তুমি আমাকে লিখিতে বলিয়াছিলে, সেজন্য সমস্তই লিখিলাম। এখন ইহার মধ্যে কোনটী আবশ্যক, আর কোনটী অনাবশ্যক তাহা তুমি বাছিয়া লইও।

    একেবারে যে আমরা কিছু করিতে পারি নাই, তাহা নহে। অনুপ ও তাহার স্ত্রীর কাৰ্য্যকলাপ সম্বন্ধে যে সন্দেহ হইয়াছিল, তাহা এখন দূর হইয়াছে। তাহারা যে রাজার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করিবে তাহা বোধ হয় না।

    এ ছাড়া আর কোন কিছুই বিশেষ জানিতে পারা যায় নাই। মাঠের সেই ভীষণ শব্দের কোন কারণ আজ পর্য্যন্ত স্থির করিতে পারি নাই। বোধ হয়, পরের পত্রে আরও কিছু নূতন খবর দিতে পারিব। তবে আমার মতে এ সময় তোমার একবার এখানে আসিলে ভাল হয়।

    একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    গোবিন্দরামকে আমি-যে সকল পত্র লিখিয়াছিলাম, তাহার কয়েকখানা উদ্ধৃত করিয়াছি, তবে আর কোন পত্র খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। সুতরাং সে সময় যে প্রাত্যহিক কার্য্যের রোজনামচা রাখিয়াছিলাম, তাহা হইতেও এখন কতক কতক তুলিতে বাধ্য হইতেছি। যেদিন হারু ডাকাত পলাইল, তাহার পরদিনের কথা বলিতেছি।

    তাহার পর দিন হইতে আমার দৈনন্দিন-লিপিতে যাহা লিখিয়াছিলাম, তাহাই এখানে উদ্ধৃত করিতেছি।

    দিনলিপি হইতে উদ্ধৃত।

    ১৬ই আশ্বিন—বেশ শীত পড়িয়াছে, রোজ সকালে খুব কুজ্ঝটিকা হইতেছে। ইহাতে এই নির্জ্জন বিভীষিকাপূর্ণ স্থান আরও বিভীষিকাময় হইয়া উঠিয়াছে। কেন জানি না-সৰ্ব্বদাই আমার মনে হইতেছে, যেন শীঘ্র কি একটা দুর্ঘটনা ঘটিবে। কেন আমার মনে এইরূপ হইতেছে, তাহা আমি নিজেই বলিতে পারি না।

    এরূপ মনে হইবার কোনই কারণ আমি অনুসন্ধান করিয়া পাইতেছি না; অথচ এখানে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা আলোচনা করিলে আমার মনে যে এরূপ ভাব উদিত হইবে, তাহাতে বিশেষ বিস্মিত হইবার কারণ নাই।

    এখানকার ভূতপূর্ব রাজা অহিভূষণের হঠাৎ মৃত্যু সম্বন্ধে এই বংশে যে গল্প চিরকাল চলিয়া আসিতেছে, ভাবিয়া দেখিলে তাহার মৃত্যু যে সেই কারণেই ঘটিয়াছে, তাহা কতকটা অযুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। তাহার পর এখানকার লোকেরা সর্ব্বদাই বলিয়া থাকে যে, তাহারা মাঠে এই অত্যদ্ভুত কুকুরের ডাক শুনিয়াছে, এমন কি কেহ কেহ এই ভৌতিক কুকুরকে দেখিয়াছে। আমরা সেই কুকুর দেখি নাই সত্য, কিন্তু আমি দুই দিন তাহার ভয়ঙ্কর চীৎকার শুনিয়াছি। আমার সঙ্গে রাজা মণিভূষণও নিজে একদিন শুনিয়াছেন, কিন্তু যদিও এ কথা বিশ্বাস কার যায় না—বিশ্বাস করা একেবারে অসম্ভব, কারণ কুকুরটা যদি যথার্থই ভূত হয়, তাহা হইলে তাহার পায়ের দাগ কখনও মাটিতে পড়িতে পারে না, তাহার ডাকও কখনও মাঠে প্রতিধ্বনিত হইতে পারে না। সদানন্দ ও নলিনাক্ষ এই ভূতের কথা কিরূপে বিশ্বাস করিলেন, বুঝিতে পারি না। কিন্তু আমি কখনই এ কথা বিশ্বাস করিতে পারি না। এ কথা বিশ্বাস করিলে এই সকল মূর্খ চাষাদের সহিত আমার আর পার্থক্য থাকিল কি? গোবিন্দরাম কখনই এই সকল পাগলামীতে আস্থা স্থাপন করিতেন না। আমাকে তিনিই এখানে পাঠাইয়াছেন, আমি যদি এই পাগলামী বিশ্বাস করি, তাহা হইলে তিনি বলিবেন কি?

    তবে সত্যকথা গোপন করাও অসম্ভব—আমি দুই দিন এই কুকুরের ভয়াবহ চীৎকার শুনিয়াছি, যে সে কুকুরের ডাক, তাহাতে সন্দেহ নাই। অথচ সে সাধারণ কুকুরের চীৎকার নহে। মাঠের কোথা হইতে এই ভয়াবহ শব্দ উঠে, তাহাও স্থির করিবার উপায় নাই। আর এই জনমানবসমাগমশূন্য প্রান্তরে কুকুরই বা কোথায় থাকিবে? থাকিলেও সে কিরূপে আহার পাইতেছে? চারি ক্রোশের মধ্যে এই মাঠে জনপ্রাণীর বাস নাই। সুতরাং এ রহস্য বুঝিতে পারা যে কঠিন, তাহা স্বভাবতই স্বীকার করিতে হইবে।

    ইহা ছাড়া, এই কুকুর ভূতের কথা বাদ দিলেও কোন লোক যে মণিভূষণের অনিষ্ট করিতে চেষ্টা পাইতেছে, তাহাও বেশ স্পষ্ট জানিতে পারা যায়। বিনা কারণে কেহ কলিকাতায় গিয়া মণিভূষণকে সাবধান করিয়া দেয় না, এখানে আসিতে বারণ করে না, ইহা ভূতের কাজ নহে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, তবে ইহা শত্রু ও মিত্র উভয়ের কাজই হইতে পারে। যদি সে মিত্র হয়, তবে সে এখন কোথায়? আর যদি সে শত্রু হয়, তবে সে কে? এখনই বা সে কোথায়? সে কি কলিকাতায়ই আছে, না মণিভূষণের সঙ্গে সঙ্গে এইখানে আসিয়াছে? যাহাকে মাঠের মধ্যে আমি রাত্রে দেখিয়াছিলাম, সে লোক কি সেই—না অপর কেহ?

    যদিও আমি সে লোকটাকে ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই, তবুও এটা বলিতে পারি যে, সে এখানকার কেহ নহে। এই এতদিন এখানে থাকিয়া আমি এখানকার চারিদিকের সমস্ত লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়াছি, তাহাদের সকলকেই চিনিয়াছি—সকলকেই দেখিয়াছি; এই লোক যে তাহাদের কেহ নহে, তাহা আমি জোর করিয়া বলিতে পারি। তাহা হইলে বুঝিতে পারা যায় যে, কোন অপরিচিত লোক এখানেই মণিভূষণের উপর নজর রাখিতেছে, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এখানে আসিয়াছে, যদি এই লোকটিকে কোন গতিকে ধরিতে পারি, তাহা হইলে হয় ত সমস্তই গূঢ় রহস্য’ভেদ হইয়া যায়। সে জন্য মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, কে আমাদের অনুসরণ করিতেছে, তাহাই আমি প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিব।

    প্রথমে আমি মনে করিয়াছিলাম যে, আমার মনের ভাব সমস্তই মণিভূষণকে বলির, কিন্তু পরে ভাবিলাম, তাঁহাকে এখন কিছু বলিয়া কোন ফল নাই; আমি আমার মনের কথা মনে রাখিয়া গোপনে গোপনে অনুসন্ধান করিব। আমি অনর্থক তাঁহাকে আরও ব্যতিব্যস্ত করিতে ইচ্ছা করিলাম না। সেই রাত্রি হইতে মণিভূষণ প্রায় কথা কহেন না, তাঁহার যে এক ঘোরতর পরিবর্তন হইয়াছে, তাহা বুঝিতে আমার বিলম্ব হইল না, এ অবস্থায় তাঁহাকে কোন কথা বলিলে তাহাকে কেবল আরও ভীত করা হইবে।

    আজ সকালে অনুপের সঙ্গে মণিভূষণের বেশ এক বাগ্বিতণ্ডা হইয়াছে। আমি পাশের ঘরে ছিলাম, অনুপের সঙ্গে মণিভূষণ যে খুব চীৎকার করিয়া কথা কহিতেছিলেন, তাহা আমি পাশের ঘর হইতে শুনিতে পাইলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে মণিভূষণ—আমি যে ঘরে বসিয়াছিলাম, সেই ঘরে প্রবেশ করিলেন। আসিয়া বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, অনুপ বলিতেছে যে, তাহার শ্যালককে ধরিতে যাওয়া আমাদের অতিশয় নির্দয়তা হইয়াছে।”

    এই সময় অনুপ আসিয়া বিনীতভাবে বলিল, “আমি হয় ত রাগের মাথায় কি বলিয়া ফেলিয়াছি, সেজন্য আমায় মাপ করিবেন। আমরাই ত হারুর কথা আপনাদের বলিয়াছিলাম, তাহাতে কি তাহাকে ধরিতে যাওয়া আপনাদের ভাল হইয়াছে? সে ত এমনই অনেক ভুগিতেছে।”

    মণিভূষণ কহিলেন, “তুমি সহজে কিছুই বল নাই, তাহা বলিলে হয়ত আমরা তাহার সন্ধানে যাইতাম না।”

    অনুপ কহিল, “ গরিবের উপর অত্যাচার করিয়া লাভ কি?”

    মণিভূষণ কহিলেন, “হারু ভয়ানক ডাকাত, সে সুবিধা পাইলেই আরও অনেকের সর্ব্বনাশ করিত, এই সদানন্দবাবু একা মাঠের উপর থাকেন—কে বলিতে পারে যে, একদিন সে তাঁহাকে ও তাঁহার ভগিনীকে খুন করিবে না! সে যতদিন ছাড়া আছে, ততদিন কেহই নিরাপদ নহে।”

    অনুপ বলিল, “আমি বলিতেছি, সে আর এখানে কাহারও বাড়ীতে ডাকাতি করিবে না, সে যাহাতে এ দেশ হইতে পলাইতে পারে, আমরা তাহার বন্দোবস্ত করিয়াছি, দুই-একদিনের মধ্যেই সে চলিয়া যাইবে। পুলিস এখন আর তাহার অনুসন্ধান করিতেছে না, অথচ যদি তাহারা কোনরূপে জানিতে পারে যে, আমি আর আমার স্ত্রী হারুর সাহায্য করিতেছি, তাহা হইলে আমরা দুই জনেই জেলে যাইব। পুলিসে সংবাদ দিলে আমরা মারা যাইব।”

    মণিভূষণ আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি বলেন ডাক্তার বাবু?”

    আমি বলিলাম, “সে যদি এদেশ থেকে যায়, তাহা হইলেই ভাল।।”

    মণিভূষণ কহিলেন, “আর তার মধ্যেই যদি সে এখানে কোনখানে ডাকাতি করে?”

    অনুপ বলিল, “সে এমন পাগল হয় নাই যে, এখন এমন একটা কাজ করিবে। এখন কিছু করিতে গেলেই সে কোথায় লুকাইয়া আছে, তাহা পুলিস তখনই জানিতে পারিবে।”

    মণিভূষণ বলিলেন, “কথাটা ঠিক।

    অনুপ ব্যগ্রভাবে বলিল, “আমি জানি আপনি পুলিসে খবর দিবেন না, তাহা হইলে আমার স্ত্রী মারা যাইবে।”

    অনুপকে “হাঁ যাও” বলিয়া মণিভূষণ আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, এ বিষয়ে আর কোন উপায় নাই।”

    আমি কোন উত্তর করিবার পূর্ব্বে মণিভূষণ সে গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, এই সময়ে অনুপ বলিল, “আপনি আমাদের যাহা করিলেন, তাহাতে আমরা আপনার কাছে কেনা হইয়া রহিলাম। সেইজন্য একটা কথা বলিতে চাই, আগে আপনাকে আমার বলা উচিত ছিল, কিন্তু বড় রাজার মরিবার অনেক পরে আমি একথা জানিতে পারিয়াছিলাম।”

    এই কথায় আমরা উভয়েই ব্যগ্রভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। তবে কি এতদিন পরে রাজা অহিভূষণের মৃত্যু-রহস্য প্রকাশ পাইবে।

    মণিভূষণ অতি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহা হইলে রাজা কিসে মরিয়াছিলেন, তাহা তুমি জান?”

    অনুপ বলিল, “তাহা আমি জানি না।”

    মণি। তাহা হইলে কি জান? কি বলিতে চাহিতেছিলে?

    অনুপ। তিনি অত রাত্রে বাড়ীর বাহির হইয়াছিলেন কেন, তাহা আমি জানি।

    ম। কেন—কেন—কি জন্য গিয়াছিলেন?

    অ। একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিতে।

    ম। স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা করিতে—সে কি? কে সে?

    অ। আমি তাহার নাম জানি না, তবে বোধ হয়, তাহার নাম নবদুর্গা।

    ম। কেমন করিয়া জানিলে?

    অ। বড় রাজা সেইদিন সকালে একখানা পত্র পাইয়াছিলেন। তিনি অনেককেই বিপদাপদে সাহায্য করিতেন, সেজন্য অনেকেই তাঁহাকে পত্র লিখিত, তবে সেদিন এই পত্রখানা ছাড়া আর কোন পত্র আসে নাই, তাহাই আমি পত্রখানা ভাল করিয়া দেখিয়াছিলাম। পত্রখানা দেবগ্রাম থেকে এসেছিল।

    ম। তাহার পর?

    অ। এই পত্রের কথা আমার বড় মনে ছিল না। রাজার মৃত্যুর পরে আমার স্ত্রী তাঁহার ঘর পরিষ্কার করিতে গিয়া একখানা পোড়া চিঠী পাইয়াছিল। চিঠীখানার প্রায় সবই পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছিল, কেবল খানিকটা ছিল তাহাতে লেখা ছিল, ‘অনুগ্রহ করিয়া পত্রখানা পুড়াইয়া ফেলিবেন, আর দয়া করিয়া আজ অবশ্য রাত্রি দশটার সময় সাঁকোর দরজায় থাকিবেন।’ এই এক ছত্রের নীচে নবদুর্গা নাম লেখা ছিল।

    ম। সেই কাগজটুকু আছে?

    অ। না—সেটুকুও আধপোড়া হইয়া গিয়াছিল, তুলিতে গিয়া নষ্ট হইয়া গেল।

    ম। রাজা সেদিন আর কোন পত্র পাইয়াছিলেন?

    অ। না, আর কোন পত্র সেদিন আসে নাই।

    ম। এই হাতে লেখা আর কোন পত্র রাজার কাছে আর কখনও আসিয়াছিল?

    অ। না—তবে রাজার পত্র আমি কখনও ভাল করিয়া দেখিতাম না।

    ম। এই পত্র নবদুর্গা লিখিয়াছিল, কেমন করিয়া জানিলে?

    অ। চিঠীখানা মেয়েমানুষের হাতের লেখা, আর নীচে নামও লেখা ছিল।

    ম। অনুপ, এ কথা তুমি এতদিন বল নাই কেন?

    অ। রাজার মৃত্যুর অনেকদিন পরে এই চিঠী দেখিতে পাই, তখন পত্রের কথা প্রকাশ করিয়া একটা অনর্থক গোল করা ভাল মনে করি নাই।

    ম। লোকে রাজার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহ করিতে পারে তুমি এইরূপ মনে করিয়াছিলে?

    অ। এ কথা প্রকাশ করিলে কোনই লাভ নাই, তাহাই ভাবিয়াছিলাম। পরে আপনাকে বলা উচিত বলিয়া মনে করিলাম।

    ম। বেশ—এখন তুমি যাও।

    অনুপ চলিয়া গেলে মণিভূষণ আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন; “কি, ডাক্তারবাবু, এ সম্বন্ধে আপনি কি বিবেচনা করেন?”

    আমি বলিলাম, “ইহাতে রহস্যভেদ না হইয়া আরও যে জটিল হইল!”

    মণিভূষণ বলিলেন, “আমারও তাহাই মনে হয়। এখন এই স্ত্রীলোককে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলে রহস্যটা অনেক হাল্কা হইবার সম্ভাবনা। এখন এটা স্থির হইল যে বিনা কারণে এত রাত্রে জ্যেঠামহাশয় বাড়ী হইতে বাহির হন নাই, তিনি একজনের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন, খুব সম্ভব সে তাঁহার মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিল, আর কিসে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল, তাহা সে জানে, সুতরাং তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলে আমরা অনেক কথাই জানিতে পারিব। এখন তাহা হইলে আমাদের কি করা উচিত মনে করেন?”

    আমি বলিলাম, “আমার মতে গোবিন্দরামকে সমস্ত লিখিয়া পাঠান উচিত। ইহাতে তিনি যে সূত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন, তাহাই পাইবেন; খুব সম্ভব—তিনি এ কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ এখানে আসিয়া উপস্থিত হইবেন।”

    এই কথাই স্থির হইল, আমি তৎক্ষণাৎ সমস্ত কথা গোবিন্দরামকে লিখিয়া পাঠাইলাম। কয়দিন হইতে গোবিন্দরামের পত্রাদি বড় পাইতেছিলাম না, পাইলেও তাহা দুই-এক লাইন মাত্র; তাহাই বুঝিলাম, তিনি অপর কোন একটা অনুসন্ধানে বিশেষ ব্যস্ত আছেন, আমাদের নন্দনপুরের ব্যাপারে বড় মনোনিবেশ করিতে পারিতেছেন না। যাহাই হউক, আমরা এখন যে নূতন সংবাদ দিতেছি, তাহাতে নিশ্চয়ই তাঁহার মন এইবার আমাদের এই ব্যাপারে আকৃষ্ট হইবে।

    দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    (দিনলিপি হইতে উদ্ধৃত)

    ১৭ই আশ্বিন;—আজ সমস্ত দিন বৃষ্টি হইতেছে। এই বৃষ্টিতে ভীষণ মাঠে হারু ডাকাত কোথায় আশ্রয় লইয়াছে, তাহাই পুনঃ পুনঃ আমার মনে হইতে লাগিল। যে রকম মাঠ তাহাতে সেখানে এই দুৰ্য্যোগে কোনখানে আশ্রয় গ্রহণ সম্পূর্ণ অসম্ভব।

    বৈকালে বৃষ্টি একটু থামিলে আমি গড় হইতে বাহির হইলাম; সমস্ত মাঠটা যেন এক অকূল সমুদ্রে পরিণত হইয়াছে, চারিদিকেই কল কল শব্দে জল ছুটিতেছে, আমি মাঠের ভিতর কতকটা আসিলাম—এখন নিরাপদে দুই পা যাইবার সম্ভাবনা নাই, এই ভয়াবহ প্রান্তর যেন আরও শতগুণ ভয়াবহ হইয়াছে।

    আমি গড়ের দিকে ফিরিতেছিলাম, এই সময়ে নলিনাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা হইল; তিনি প্রায় প্রত্যহই গড়ে আসিয়া আমাদের সংবাদ লইয়া যাইতেন। তিনি দূরে কোনখানে রোগী দেখিতে গিয়াছিলেন, তাঁহার সেই টমটম গাড়ীতে বাড়ী ফিরিতেছিলেন, আমায় দেখিয়া বলিলেন, “আসুন,গড়ে পৌঁছাইয়া দিয়া যাই।”

    সুবিধা বিবেচনা করিয়া আমি তাঁহার গাড়ীতে উঠিলাম। তিনি তাঁহার কুকুরটির জন্য বড়ই দুঃখিত ও বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছিলেন, দুইদিন হইতে তাঁহার কুকুরটী হারাইয়া গিয়াছে। সর্ব্বদাই তাঁহার কুকুর মাঠে আসিত; দূরে যেরূপ চোরা বালি আছে, আর আমি স্বচক্ষে একটা গরুকে যে রকম মরিতে দেখিয়াছিলাম, তাহাতে তাঁহার কুকুরটিরও যে সেই অবস্থা হইতে পারে, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? কিন্তু ইহাতে নলিনাক্ষ বাবুর প্রাণে আরও বেদনা লাগিবে ভাবিয়া আমি কোন কথা বলিলাম না।

    কিয়দ্দুর আসিয়া আমি বলিলাম, “নলিনাক্ষবাবু, এখানকার সকলকেই আপনি বোধ হয় চিনেন?”

    তিনি বলিলেন, “খুব চিনি, চিকিৎসার দরুণ আমি চিনি না এমন লোক এখানে কেহ নাই।”

    “নবদুর্গা নামে কোন স্ত্রীলোক এখানে আছে?

    নলিনাক্ষ বাবু কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন, তৎপরে বলিলেন, “হাঁ—হাঁ—আছে—নবদুর্গা, হাঁ—ভূতনাথের মেয়ের নাম নবদুর্গা—দেবগ্রামে থাকে।”

    “সে কে? ভূতনাথ—যে কেবল মোকদ্দমা করিয়া বেড়ায়?”

    “হাঁ, নবদুর্গার স্বামী তাহাকে নেয় না—সে অতি বদলোক, নবদুর্গা সেইজন্য বড়ই কষ্টে আছে, তাহার কৃপণ বাপও তাহাকে দেখে না, সে আলাহিদা আছে, খুব কষ্টে আছে, তাহা আমি জানি।”

    “কেমন করিয়া তাহার চলে?”

    “সে সেলাইয়ের কাজ করিয়া কিছু পায়, তাহার উপর সদানন্দ বাবু আর রাজা অহিভূষণও মধ্যে মধ্যে তাহার সাহায্য করিতেন। আমিও মধ্যে মধ্যে তাহাকে যৎসামান্য দিয়াছি।”

    তাহার পর আমি তাহার কথা কেন জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহা নলিনাক্ষবাবু জানিতে চাহিলেন; কিন্তু এখন তাঁহাকে কোন কথা বলা উচিত নহে, ভাবিয়া আমি অন্য কথা তুলিলাম; মনে মনে স্থির করিলাম, কাল কোন গতিকে এই নবদুর্গার সহিত সাক্ষাৎ করিব। অন্যান্য অবান্তর কথায় সে কথা চাপা দিয়া নলিনাক্ষ বাবুর হাত হইতে রক্ষা পাইলাম। এতদিন গোবিন্দরামের সহিত আসিয়া আর কিছু না হউক, আমি অপরের চক্ষে ধূলি দিবার ক্ষমতাটা লাভ করিয়াছি।

    আজ আর অধিক কিছু লিখিবার নাই, তবে অনুপের সঙ্গে কথা কহিয়া আর একটা কথা জানিতে পারিয়াছি, সময়ে তাহা হইতে কাজ হইবার সম্ভাবনা আছে।

    আমি অনুপকে গোপনে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হে, তোমার গুণধর শ্যালকটি যে সরিয়া পড়িয়াছে!”

    সে বলিল, “তাহা জানি না, সে গেলেই আমি বাঁচি, সে এখানে আসিয়া পৰ্য্যন্ত আমাদের নানা বিপদ আর গোলযোগ ঘটিতেছে, তিন দিন হইল, তাহার খাবার দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহার পর এই তিন দিন আর তাহার কোন সন্ধান পাই নাই।”

    আমি জিজ্ঞাসিলাম, “সেদিন তাহার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল?”

    “না—তাহাকে দেখিতে পাই নাই, তবে পরদিন গিয়া দেখিলাম যে, খাবার আর নাই।”

    “তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই সেখানে ছিল?”

    “এই রকম বোধ হয়; তবে অন্য আর এক জন লোক সেখানে আছে, সে যদি খাইয়া থাকে, তবে বলিতে পারি না।”

    আমি বিস্মিত হইয়া অনুপের মুখের দিকে চাহিলাম, ধীরে ধীরে বলিলাম, “তাহা হইলে তুমি জান যে সেখানে—মাঠে আর এক জন লোকও আছে?”

    “হাঁ, আর একজন লোকও মাঠে আছে।”

    “তাহাকে তুমি দেখিয়াছ?”

    “না, তাহাকে আমি দেখি নাই।”

    “তবে তাহার কথা কেমন করিয়া জানিলে?”

    “পাঁচ-সাতদিন হইল, হারু আমাকে তাহার কথা বলিয়াছিল; সে লুকাইয়া আছে, তবে সে কয়েদ-খালাসী কিনা, তাহা সে জানে না। যাহাই হউক, ডাক্তার বাবু, এ সকলের কিছুই আমার ভাল লাগে না।”

    আমি বলিলাম, “অনুপ, আমার কথা বিশেষ সাবধানে শোন, দেখ—তোমার মনিবের স্বার্থ ব্যতীত আমার নিজের কোন স্বার্থ নাই। আমি তাঁহাকে সাহায্য করিবার জন্যই এখানে আসিয়াছি, আমার নিজের কোন কাজই এখানে নাই। তাহাই আমি জিজ্ঞাসা করি, আমায় স্পষ্ট বল যে, তোমার এই সকলের কি ভালে লাগে না।”

    অনুপ কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ করিল, তাহার পর বলিল, “মাঠে যাহা হইতেছে, তাহার আমি কিছুই বুঝিতে পারি না। তবে একটা যে কিছু ঘটিতেছে, তাহা আমি বেশ বুঝিতেছি, তবে তাহা যে কি, আমি কিছুই নিজে বুঝিতে পারিতেছি না। রাজা এখন কলিকাতায় ফিরিয়া গেলেই আমি খুসি হই।”

    “তুমি কিসের ভয় করিতেছ?”

    “কি ভয় করিতেছি, তাহা জানি না। এই দেখুন, বড় রাজার মৃত্যু—তাহার পর মাঠে মাঝে মাঝে সেই ভয়ানক শব্দ, রাত্রে এ দেশের কেহ মাঠে ভয়ে যায় না। তাহার পর এই কে একটা লোক এই মাঠে লুকাইয়া আছে। সে কি জন্য এই রকম ভাবে এখানে কেন লুকাইয়া আছে, তাহা কেহ জানে না। ইহাতেই আমার মনে হয় যে, রাজার ইহাতে কোন বিপদ্ হইতে পারে, এইজন্য ভয় করিতেছি—রাজা এখান হইতে চলিয়া গেলেই আমি নিশ্চিন্ত হই।”

    আমি আরও সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে লোকটা এই মাঠে লুকাইয়া আছে, তাহার বিষয় তুমি আর কিছু জান? হারু তাহার সম্বন্ধে কি বলে? সে কোথায় লুকাইয়া আছে, তাহা কি সে জানে?”

    অনুপ। না, সে তাহাকে দুই-একবার দেখিয়াছিল, কিন্তু লোকটা এত সাবধান যে, সে কোথায় লুকাইয়া আছে, তাহা সে কিছুতেই জানিতে পারে নাই। হারু প্রথম মনে করিয়াছিল, সে পুলিসের লোক, কিন্তু তাহার পরই বুঝিতে পারিয়াছিল যে, সে পুলিসের লোক নহে, তাহার নিজের কোন উদ্দেশ্যে মাঠে লুকাইয়া আছে। হারু তাহাকে যতদূর দেখিয়াছে, তাহাতে তাহার বোধ হইয়াছে যে, লোকটা ভদ্রলোক, তবে সে যে কি করিতেছে, তাহার যে কি উদ্দেশ্য, তাহা সে জানিতে পারে নাই।

    আমি। মাঠের কোথায় সে আছে, সে সম্বন্ধে সে কি বলে?

    অ। তাহা ঠিক সে বলিতে পারে না—তবে পাহাড়ের কোনখানে যে সে লুকাইয়া আছে, তাহা সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল।

    আমি। যদি তাহাই হয়, তবে সে খাবার কোথায় পাইত?

    অ। হারু বলে, একটা ছোঁড়া গ্রাম হইতে তাহার খাবার আনিয়া মাঠে দিয়া আসিত, সে আর কিছু জানিতে পারে নাই।

    আমি। অনুপ, এখন এই পর্য্যন্ত থাক্, এ সম্বন্ধে পরে তোমার সঙ্গে কথা কহিব।

    সে চলিয়া গেলে আমি জানালায় গিয়া মাঠের দিকে চাহিলাম, সেই নির্জ্জনতায় সেই বিভীষিকাপূর্ণ ভাব—এমন স্থানে যে ব্যক্তি আছে, সে যে অতি কষ্টে জীবনাতিপাত করিতেছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। নিতান্ত বাধ্য না হইলে কেহ এরূপ স্থানে বাস করে না; তবে কি উদ্দেশ্যে সে এখানে এইরূপ ভাবে লুকাইয়া আছে? তাহার এমন কি রাগ যে, সে এত কষ্টে কেবল রাজা মণিভূষণের অনিষ্টের জন্য এই ভয়াবহ মাঠে বাস করিতেছে?

    ক্রমেই যেন রহস্য আরও গভীর ও ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে। যাহা হউক, মনুষ্যের সাধ্যায়ত্বের মধ্যে যদি হয়, তবে আমি দুই-একদিনের মধ্যে এ রহস্য ভেদ করিব।

    ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    পূর্ব্বে আমার দিনলিপি হইতে যাহা আমি উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহার পর আর তাহাতে অধিক কিছু লিখিবার আমার সময় হয় নাই। যে ভয়বাহ কাণ্ডে এই ব্যাপার শেষ হইল, তাহা এতই দ্রুতবেগে ঘটিতে লাগিল যে, আমি অধিক কিছুই লিখিবার অবসর পাইলাম না। তবে এই সকল ঘটনা আমার মনে এমন ভাবে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল যে, আমি তাহার একটি ঘটনাও এ পৰ্য্যন্ত ভুলিতে পারি নাই।

    এই সময়ে আমি দুইটী বিষয়ে স্থির-নিশ্চিন্ত হইয়াছিলাম; প্রথমতঃ ভূতনাথের মেয়ে নবদুর্গাই রাজা অহিভূষণকে পত্র লিখিয়াছিল, আর রাজা রাত্রে তাহার সহিত দেখা করিবার জন্যই বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিলেন, আর তাহাতেই তাঁহার জীবনের শেষ হইয়াছিল।

    দ্বিতীয়তঃ—যে লোকটাকে রাত্রে আমি দেখিয়াছিলাম, আর যে লোককে হারু ডাকাত দেখিয়াছে, সে নিশ্চয়ই মাঠে লুক্কায়িত আছে, সুতরাং তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইবে না, তাহাকে না পাইলেও সে কেন এরূপ ভাবে এখানে লুক্কায়িত আছে, তাহা কতকটা জানিতে পারা যাইবে। যখন এই দুইটী ব্যাপার আমি জানিতে পারিয়াছি, তখন এ সম্বন্ধে সকল কথা যদি আমি জানিতে না পারি, তাহা হইলে সে কেবল আমার বুদ্ধির দোষই বলিতে হইবে।

    আমি নবদুর্গা সম্বন্ধে মণিভূষণকে পূৰ্ব্বে কিছু বলিতে পারি নাই। এখন সুবিধা পাইয়া নবদুর্গা সম্বন্ধে আমি যাহা কিছু জানিতে পারিয়াছিলাম, সকলই তাঁহাকে বলিলাম। তিনি প্রথমে আমার সঙ্গে নবদুর্গার সহিত দেখা করিতে যাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়াছিলেন, কিন্তু পরে উভয়ে এ সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া স্থির করিলাম যে, আমার একা যাওয়াই কৰ্ত্তব্য, তাহাতে নবদুর্গার নিকট হইতে যত সত্য কথা বাহির হইবার সম্ভাবনা, আমরা দুই জন একসঙ্গে গেলে তেমন সম্ভাবনা খুব কম, সেজন্য আমি মণিভূষণকে গড়ে রাখিয়া একাকীই নবদুর্গার সহিত দেখা করিবার জন্য দেবগ্রামের দিকে রওনা হইলাম।

    নবদুর্গাকে খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন হইল না, সে তাহার পিতার নিকট থাকিত না, নিজে একা থাকিত, একটী গ্রামের বৃদ্ধাকে সঙ্গে লইয়া এক ক্ষুদ্র চালাঘরে বাস করিত, আমি মনে করিয়াছিলাম, সে আমার সঙ্গে দেখা করিবে না, কিন্তু দেখিলাম, সে সম্বন্ধে সে তত লজ্জা করিল না, সহরের স্ত্রীলোকগণ অপরিচিত ব্যক্তির সহিত কথা কহিতে যতটা অনিচ্ছুক, পাড়াগাঁয়ে তেমন নহে

    অমি দেখিলাম, নবদুর্গার বয়ঃক্রম সপ্তবিংশতি বৎসরের অধিক নহে, সে এখনও খুব সুন্দরী, সে ঘরের সম্মুখেই বসিয়াছিল, আমায় দেখিয়া কপালের উপর একটু ঘোমটা টানিয়া দিল, এবং আমি তাহার বাড়ীতে কি করিতে আসিয়াছি, জানিবার জন্য আমার মুখের দিকে চাহিল।

    আমি বলিলাম, “আপনার বাপের সঙ্গে আমার আলাপ আছে।”

    সে ঘোমটার ভিতর হইতে মৃদুস্বরে বলিল, “আমার বাপের সঙ্গে আমার বনিবনাও নাই, তিনি আমাকে বাড়ী থেকে বার করে দিয়েছেন। গড়ের রাজা না থাকিলে হয়ত আমি না খাইয়া মরিতাম।”

    আমি বলিলাম, “গড়ের রাজার সম্বন্ধেই কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমি তোমার কাছে আসিয়াছি।”

    “নূতন রাজাকে আমি জানি না।”

    “নূতন রাজা নহে, পুরাণ রাজার জন্যই আসিয়াছি।”

    এই কথা শুনিয়া মুহূর্ত্তের জন্য নবদুর্গার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, তাহার পর সে মৃদুস্বরে বলিল, “আমি তাঁহার সম্বন্ধে কি জানি?”

    “তুমি তাহাকে চিনিতে?”

    তিনি আমাকে সাহায্য করিতেন, সুতরাং নবদুর্গার কথায় অন্যায় কিছুই ছিল না, আমি বুঝিলাম, সে সত্যকথাই বলিয়াছে।

    আমি আর বাজে কথা না কহিয়া একেবারেই কাজের কথা তুলিলাম, জিজ্ঞাসা করিলাম, “রাজাকে তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য তুমি কখনও তাঁহাকে কোন পত্র লিখিয়াছিলে?”

    এই কথায় নবদুর্গা রাগিয়া উঠিল, বলিল, “আপনি কে জানি না, আপনাকে চিনি না, আপনি এখানে আসিয়াছেন কেন?’

    আমি তৎক্ষণাৎ বলিলাম, “আমি কেন আসিয়াছি দুইবার তোমায় বলিয়াছি, আমি যে কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহা আবার তোমায় জিজ্ঞাসা করিতেছি; তুমি তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য কখনও রাজাকে পত্র লিখিয়াছিলে কি না?”

    সে রুষ্টভাবে বলিল, “না—কখনও না, তাঁহাকে আমি পত্র লিখিব কেন?”

    চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    আমি নবদুর্গার দিকে ভীষণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলাম, “যে দিন রাজার মৃত্যু হয়, সেদিন তুমি তাঁহাকে পত্র লেখ নাই, এ কথা তুমি সত্য বলিতেছ?”

    এই কথায় এক নিমেষে তাহার মুখ শুকাইয়া গেল, সে আমার কথার উত্তর দিবার চেষ্টা পাইয়াও উত্তর দিতে পারিল না। স্তম্ভিত হইয়া দণ্ডায়মান রহিল।

    আমি কিছু নরম হইয়া বলিলাম, “বোধ হয়, তোমার মনে হইতেছে না। তোমার চিঠির খানিকটা তোমায় বলিতেও পারি, তাহা হইলে তোমার মনে হইবে। তুমি লিখিয়াছিলে;—দয়া করিয়া অবশ্য অবশ্য পত্রখানি পুড়াইয়া ফেলিবেন—আর অবশ্য অবশ্য সাঁকোর ধারে রাত্রি দশটার সময় দেখা করিবেন।’ এখন মনে হয়?”

    আমার বোধ হইল যে, তাহার সংজ্ঞা লোপ হইয়াছে—সে অতি কষ্টে বলিল, “তাহা হইলে—তাহা হইলে —” আর বলিতে পারিল না।

    আমি বলিলাম, “রাজা তোমার পত্র পুড়াইয়া ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু অনেক সময় পত্র পুড়াইলেও পড়া যাইতে পারে। তাহা হইলে তুমি এখন স্বীকার করিতেছ যে, তুমি রাজাকে সেদিন পত্র লিখিয়াছিলে?”

    সে এবার কিছুমাত্র ইতস্ততঃ না করিয়া বলিল, “হাঁ আমি তাঁহাকে পত্র লিখিয়াছিলাম, না বলিব কেন? আমি কোন দোষ করি নাই, তখন আমার টাকার বড়ই অভাব হইয়াছিল, সেজন্য তাঁহাকে পত্র লিখিয়াছিলাম, ভাবিয়া ছিলাম, তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিলে তিনি ‘না’ বলিতে পারিবেন না।”

    “এমন অসময়ে এত রাত্রে দেখাটা করা কেন?”

    “আমি শুনিয়াছিলাম যে তিনি পরদিন সকালেই পশ্চিমে বেড়াইতে যাইবেন, তাহা হইলে তাঁহার সঙ্গে আর অনেক দিন দেখা হইবে না। তাহার পর রাত্রি ভিন্ন আমার যাইবার উপায় ছিল না।”

    “এত রাত্রে অপর একজন পুরুষের সঙ্গে দেখা করা কি তোমার উচিত হইয়াছিল?”

    “কিন্তু তা ছাড়া উপায় ছিল না।”

    “যাহাই হউক, তুমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গেলে কি ঘটিয়াছিল, তাহাই বল।”

    “আমি মোটেই তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাই নাই।”

    ‘যাই নাই। সে কি? কেন যাও নাই?”

    “কোন কারণে যাইবার দরকার হয় নাই।”

    সে কারণ কি?”

    “আপনাকে এত কথা বলিব কেন?”

    “না বল পরে গোলে পড়িবে। তুমি স্বীকার করিতেছ যে, তুমি রাজাকে দেখা করিবার জন্য পত্র লিখিয়াছিলে, তাহার পর বলিতেছ যে, তুমি দেখা করিতে যাও নাই।”

    “সত্য কথাই বলিতেছি।”

    আমি পুনঃ পুনঃ এই কথা জিজ্ঞাসা করা সত্বেও সে আর কিছুতেই কোন কথা বলিতে চাহিল না, তখন আমি উঠিয়া অতি গম্ভীরভাবে বলিলাম, “দেখ, রাজার মৃত্যু সম্বন্ধে সন্দেহ হইয়াছে, আমরা তাঁহার মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতেছি,—তুমি যাহা জান, সমস্ত আমায় খুলিয়া বলা তোমার উচিত ছিল, না হইলে পরে পুলিস তোমার লইয়া টানাটানি করিবে। যদি তুমি নিদোষী হইবে, তবে তুমি যে রাজাকে সেদিন পত্র লিখিয়াছিলে, তাহা অস্বীকার করিতেছিলে কেন?”

    সে একটু নীরবে থাকিয়া বলিল, “লোকে আমার নামে মিথ্যা কলঙ্ক রটাইবে, সেই ভয়ে বলি নাই।”

    “রাজাকে পত্রখানি পুড়াইয়া ফেলিতে এত অনুরোধ করিয়াছিলে কেন?”

    “যদি আপনি পত্রখানি পড়িয়া থাকেন, তবে তাহার কারণও জানেন।”

    “আমি সমস্ত পত্র পড়ি নাই।”

    “তবে খানিকটা কেমন করিয়া জানিলেন?”

    ‘পত্রের সমস্তই পুড়িয়া গিয়াছিল, ঐটুকুই কেবল পুড়ে নাই। যাহাই হউক, আমি শুনিতে চাহি, কেন তুমি পত্রখানি পুড়াইতে বলিয়াছিলে।”

    “তাহা আমি বলিব না।”

    “পুলিসের সম্মুখে বলিতে হইবে।”

    নবদুর্গা কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর বলিল, “আপনাকে সবই বলিতেছি, তাহার পর আপনার ধর্ম্ম।”

    “আমার দ্বারা তোমার কোন অনিষ্ট হইবে না।”

    “আপনি হয় ত আমার বিষর সব শুনিয়াছেন।”

    “হাঁ, কতক কতক শুনিয়াছি।”

    “এই সময়ে আমার ভারি অনটন হইয়াছিল, তাহাই ভাবিয়াছিলাম, রাজার সঙ্গে দেখা করিয়া সকল কথা বালিতে পারিলে, তিনি নিশ্চয়ই আমায় সাহায্য করিবেন; তাহাই পত্ৰ লিখিয়াছিলাম।”

    “তবে দেখা করিতে গেলে না কেন?”

    “আমি সেইদিন অন্য কারও কাছে টাকা পাইয়াছিলাম।”

    “তাহা হইলে তুমি রাজাকে সে কথা লিখিয়া পাঠাও নাই কেন?”

    “তাহার পরদিন তাঁহাকে সে কথা লিখিয়া পাঠাইব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু পর দিন সকালেই শুনিলাম, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।”

    এই স্ত্রীলোক যাহা বলিল, তাহা সত্য বলিয়াই মনে হইল। আমি পুনঃ পুনঃ নানা ভাবে তাহাকে জেরা করিয়া দেখিলাম, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল, সে যে কথা বলিতেছে তাহা মিথ্যা নহে, সত্য সত্যই সে রাত্রে সে রাজার সঙ্গে দেখা করিতে যায় নাই।

    তাহার নিকট হইতে আর কিছুই জানিবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া আমি তথা হইতে গড়ের দিকে চলিলাম।

    পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    আমি এই সকল বিষয় মনোমধ্যে আন্দোলন করিতে করিতে গড়ের দিকে চলিলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম এই স্ত্রীলোকটীর সহিত দেখা হইলে রাজার মৃত্যু সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারিব, কিন্তু এখন সে বিষয়ে সম্পূর্ণ হতাশ হইলাম। আমি যে অনুসন্ধানের জন্য আসিয়াছি, সে সম্বন্ধে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিতেছি না। গোবিন্দরাম বলিবেন কি?

    অথচ এই স্ত্রীলোকের মুখের ভাব, কথার ধরণ এবং তাহার ভয় ও সঙ্কোচের কথা যতই আমি ভাবিয়া দেখিতে লাগিলাম, ততই আমার মনে হইতে লাগিল, এই স্ত্রীলোক নিশ্চয়ই সকল কথা আমায় বলে নাই, কিছু না কিছু গোপন করিয়াছে। আমার কথায় তাহার মুখ শুকাইয়া গেল কেন? কেন সে ইচ্ছা করিয়া কোন কথা বলিল না? যাহা বলিয়াছে, সমস্তই নিতান্ত অনিচ্ছার সহিত বলিয়াছে, তাহার এরূপ করিবার অর্থ কি? কেন রাজার মৃত্যুর পর সে তাহার চিঠীর কথা গোপন করিয়াছিল? আমি এই সকল বিষয় যতই ভাবিতে লাগিলাম, ততই আমার মনে হইতে লাগিল, এই স্ত্রীলোক রাজার মৃত্যুতে কোন-না-কোন রূপে জড়িত আছে, কিন্তু সে কি ভাবে জড়িত আছে, তাহা আমি কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না, উপস্থিত এ সম্বন্ধে কিরূপ ভাবে অনুসন্ধান করা উচিত, তাহাও স্থির করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, এ বিষয়ে এখন থাক, পরে দেখা যাইবে, এক্ষণে মাঠে যে লোকটা লুকাইয়া আছে, তাহার অনুসন্ধান করা যাউক। হয় ত তাহা হইলে নূতন কিছু-না-কিছু জানিতে পারিব।

    আমার ধ্রুব বিশ্বাস হইয়াছিল যে, আমি মাঠে যে লোকটাকে সেদিন রাত্রে দেখিয়াছিলাম, যাহার কথা অনুপ হারু ডাকাতের নিকট শুনিয়াছিল, সেই লোকই কলিকাতায় গাড়ী করিয়া মণিভূষণের পিছু লইয়াছিল, সে-ই নিশ্চয় এখান পর্য্যন্ত তাঁহার অনুসণ করিয়াছে এবং একটা ঘোরতর দুরভিসন্ধি লইয়া এই নিৰ্জ্জন মাঠে লুকাইয়া আছে।

    তবে এই বিস্তৃত মাঠে আমি কোথায় তাহাকে খুঁজিয়া পাইব? কিন্তু যেখানে আমি রাত্রে তাহাকে দেখিয়াছিলাম, সেখানটা আমার বেশ মনে আছে, সে নিশ্চয়ই তথায় কোন স্থানে কোন পাহাড়ের গহ্বরে লুকাইয়া আছে। যাহাই হউক, আমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম, সমস্ত মাঠও যদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিতে হয়, তবে তাহাও খুঁজিব-কলিকাতায় সে আমাদের চক্ষে ধুলি দিয়া পলাইয়াছিল, এখানে পারিবে না; যদি পিস্তল ব্যবহার করিতে হয়, তবে তাহাও করিব, কেন সে আমাদের পিছু লইয়াছে, তাহা জানিব, তাহাকে কিছুতেই ছাড়িব না, আর যদি ইহাতে সফল হই, তাহা হইলে আমার গৌরবও যথেষ্ট হইবে, যাহা গোবিন্দরাম পারেন নাই, আমি তাহাই করিতে সক্ষম হইব।

    এ পর্য্যন্ত সৌভাগ্য দেবী আমার বিরুদ্ধেই ছিলেন, আজ সহসা তিনি আমার প্রতি সুপ্রসন্না হইলেন। আমি ভূতনাথের বাড়ীর সম্মুখ দিয়া যাইতে ছিলাম, দেখিলাম ভূতনাথ দরজায় বসিয়া তামাক খাইতেছে, আমায় দেখিয়া বলিল, “এই যে ডাক্তার বাবু, আসুম, তামাক খেয়ে যান।”

    ভূতনাথের উপর আমার বড় ভক্তি ছিল না, তবুও তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতে বাধ্য হইলাম, তাহার দ্বারে দাঁড়াইলাম, সে ভাল হুঁকা আনিয়া আমায় তামাক দিল। তাহার পর বলিল, “ডাক্তার বাবু, আজ আমার বড় আনন্দের দিন—বড় আনন্দের দিন।”

    আমি বলিলাম, “আজ এত আনন্দ কিসে হইলে?”

    “দু-দুটো মোকদ্দমায় জিৎ হয়েছে। বেটারা ভূতনাথকে চেনে না, ভূতনাথের সঙ্গে মোকদ্দমা করতে আসে—দুটো মোকদ্দমায়ই হেরে গেছে! আমি এ দেশের সব শালাকে দেখিয়ে দেব যে, আইন-কানুন কাকে বলে। এবার পুলিসকেও কিছু শিক্ষা দিয়ে দেব, বেটারা আমার কথা যেমন শুনেনি, তেমনি হয়েছে।”

    “কেন—কি রকমে?”

    “তারা যে সব জানার জন্যে ক্ষেপে বেড়াচ্ছে, ইচ্ছে করলে আমি তাদের তা বলে দিতে পারি, কিন্তু কিছুতেই আমি বদমাইসদের সে কথা বলছি না।”

    আমি ভূতনাথের হাত এড়াইয়া পলাইবার উপায় ভাবিতেছিলাম, সহসা তাহার এই কথায় আমি উদ্বিগ্নভাবে তাহার কথা শুনিতে লাগিলাম, কিন্তু কিছু বলিলাম না। আমি জানিতাম, তাহার কোন কথা শুনিবার জন্য ব্যগ্র হইলে, সে আর কিছুতেই সে কথা বলিবে না, অন্য কথা বলিয়া বিরক্ত করিয়া তুলিবে। এই কয় দিনের তাহার চরিত্র আমি বেশ বুঝিয়াছিলাম।

    সেজন্য আমি অতি অন্যমনস্ক ভাব দেখাইয়া বলিলাম, “কেন—কোন চোরের কথা নাকি?”

    সে হাসিয়া উঠিল, “হা-হা-হা, ডাক্তারবাবু, চোর নয়—চোর নয়—আরও কিছু বড় মাঠে যে হারু ডাকাত লুকাইয়া আছে, সে চোরের বাবা।”

    আমি বিস্মিত ভাব দেখাইয়া বলিলাম, “তাহা হইলে তুমি জান সে কোথায় লুকাইয়া আছে?”

    “ঠিক কোথায় লুকাইয়া আছে, তাহা হয় ত জানি না, তবে আমি ইচ্ছা করিলে পুলিশ তাহাকে ধরিতে পারে, অনায়াসে পারে। ডাক্তারবাবু, ঐ মাঠে কেহ খাবার না পাইলে বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। সে কোথা হইতে খাবার পায়, তাহা জানিতে পারিলে তাহাকে ধরা শক্ত কি?”

    আমি ভাবিলাম, ভূতনাথ ঠিক কথায়ই বলিয়াছে, আসল কথা তাহারই মনে উদিত হইয়াছে। আমি বলিলাম, “হাঁ, একথা ঠিক, কিন্তু তুমি কেমন করিয়া জানিলে সে এখনও মাঠে লুকাইয়া আছে?”

    কেমন করিয়া জানিলাম? এইজন্য জানিলাম যে তাহাকে খাবার দিতে যায়, তাহাকে আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি।”

    এই সময়ে অনুপের বিষয় ভাবিয়া আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। এই মামলাবাজ লোকের হাতে পড়িলে কাহারই রক্ষা পাইবার উপায় নাই। যথার্থই যদি ভূতনাথ অনুপকে হারুর খাবার লইয়া মাঠে যাইতে দেখিয়া থাকে, তবে তাহার আর রক্ষা নাই। তবে তাহার পর সে যাহা বলিল—তাহাতে অনুপের জন্য আমি যতটা ভয় পাইয়াছিলাম, ততটা ভয় আর রহিল না।

    সে বলিল, “একটা ছোঁড়া তাহার খাবার লইয়া যায়। ঠিক সময়ে এক পথ দিয়া এ ছোঁড়া রোজ খাবার লইয়া মাঠে যায়। যদি সে খাবার হারু ডাকাতের জন্য না হয়, তাহা হইলে আর কাহার জন্য হইবে।”

    এটা হঠাৎ সৌভাগ্য বটে—যদিও আমার মন নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইয়াছিল, তবুও আমি আমার মনের ভাব গোপন করিয়া লইলাম। আমি বুঝিলাম, ভূতনাথ যাহার কথা বলিতেছে, সে হারুর খাবার লইয়া যায় না। যে অন্য লোক মাঠে লুকাইয়া আছে, সে যে তাহার জন্য খাবার লইয়া যায়, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। এখন সেই ছেলেটা কোন্ পথে কখন কোথায় খাবার লইয়া যায়, তাহা জানিতে পাইলে, আমার পরিশ্রমের অনেকটা লাঘব হইবে, এবং সেই লোকটাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে আমার আর কেষ্ট পাইতে হইবে না।

    আমি বলিলাম, “আমার বোধ হয় কোন রাখালের খাবার লইয়া তাহার ছেলে মাঠে যায়, অনেকেই তো মাঠে গরু চরাইতে যায়!”

    কথার প্রতিবাদ করিলে ভূতনাথের রাগ প্রজ্বলিত হইত, সে বলিয়া উঠিল, “বটেই তো, ঐ দূরে পাহাড়টা দেখছেন, ওখানটা গরু চরাবার জায়গাই বটে, ওখানে সব পাথর-পাথর আর কাঁকড়, ওখানে একটা ঘাসও জন্মায় না, মশাই বলিলেই ত আর গরু বাছুর কাঁকড় পাথর খেতে আরম্ভ করিবে না।”

    আমি বিনীত ভাবে বলিলাম, “আমার ভূল হইয়াছে, আমি মাঠের সব জায়গা দেখি নাই।”

    ভূতনাথ বলিল “আমি ভাল করে না জেনে কোন কথা বলি না, এখন, নিজের চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভাঙ্গুন, ঠিক এই সময় সে খাবার নিয়ে যায়। আসুন, আমার ধানের গোলার উপর, এখনই দেখতে পাবেন।”

    সে একরূপ আমাকে টানিয়া লইয়া মই দিয়া এক বড় ধানের গোলার উপর তুলিল, তাহার পর কিয়ৎক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাঠের দিকে চাহিয়া বলিল, ঐ দেখুন, ঐ যে যাচ্ছে।”

    আমিও সেইদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলাম, নিকটে নহে—বহুদুরে—প্রায় অৰ্দ্ধ ক্রোশ দূরে দেখিলাম, যথার্থই একটা ছোট বালক হাতে ঝুলাইয়া কি লইয়া যাইতেছে, দূর হইতে তাহার বয়স স্থির করা অসম্ভব, তাহাকে একটা ছোট পুতুলের মত দেখাইতেছিল। সে একস্থানে পাহাড়ে উঠিয়া দাঁড়াইল, ভীত ভাবে চারিদিকে চাহিল, তাহার পর পাহাড়ের মধ্যে অন্তর্হিত হইল।

    ভূতনাথ বলিল, “এখন কি বলেন?”

    “হাঁ, একটা ছোঁড়া কি লইয়া যাইতেছে বটে।”

    “খাবার—খাবার—হারু ডাকাতের খাবার। পুলিসকে একথা বলিতেছি না, বেটারা ভারী পাজী, আপনিও যেন কিছুতেই বলিবেন না।”

    আর এখানে থাকিয়া অনর্থক সময় নষ্ট করিয়া বিশেষ কোন লাভ নাই দেখিয়া আমি ভূতনাথের হাত এড়াইয়া চলিয়া আসিলাম।

    ষট্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    আমি তখন গড়ে ফিরিবার উদ্দেশ্য পরিত্যাগ করিলাম। যতক্ষণ ভূতনাথকে দেখা গেল, ততক্ষণ সোজা গড়ের পথে চলিলাম, তাহার পরই মাঠে নামিয়া পড়িলাম। এই লোক কে, কাহার নিকট এই বালক যায়, তাহা না দেখিয়া আমি কিছুতেই নিশ্চিন্ত হইব না। এরূপ সুবিধা পাইয়াও তাহাকে যদি ধরিতে না পারি, তবে সে দোষ আমার—অপরের নহে। আর এমন অবস্থায়ও যদি অকৃতকাৰ্য্য হই, তাহা হইলে গোবিন্দরাম শুনিয়া কি বলিবেন?

    আমি সেই নিৰ্জ্জন প্রান্তর পথে চলিলাম, চলিতে ভারি কষ্ট হইতে লাগিল, পথ অত্যন্ত বন্ধুর, পথের প্রস্তরখণ্ড কঙ্করে, স্থানে স্থানে নাতিগভীর গহ্বরে আমার পদস্খলন হইতে লাগিল। চারিদিক্ নিস্তব্ধ—কেহ কোথায় নাই। এমন কি একটা পাখীও দেখিতে পাইলাম না — পরক্ষণে মনে হইতে লাগিল, যেন এই বিশ্বপৃথিবীর মধ্যে আমি একামাত্র।

    প্রায় দুই ঘণ্টা চলিয়া আমি যেখানে সেই বালককে দেখিয়াছিলাম, সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম, কিন্তু তাহাকে কোথাও দেখিতে পাইলাম না।

    আমি তখন চারিদিক অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, অদূরে একটা ক্ষুদ্র পথ দেখিলাম, এই পথের দুইদিকেই পাথর, ক্রমে পথ আরও নীচু হইয়া খাদের মত হইয়া গিয়াছে। সহসা আমার মুখ হইতে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বাহির হইবার মত হইতেছিল, আমি কষ্টে তাহা সংবরণ করিলাম; আমার সম্মুখে মানুষের পদচিহ্ন। চিহ্নগুলি বড়—অবশ্যই সে বালকের নহে।

    এই নিৰ্জ্জন ভয়াবহ নিৰ্জ্জন স্থানে লোক আছে, নিশ্চয়ই কোন লোক এখানে আসিয়াছে, নতুবা মানুষের পায়ের দাগ এখানে থাকিবে কিরূপে? আমার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল, আমি এক প্রকার নিশ্বাস বন্ধ করিয়া হাতে পিস্তল লইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া নিঃশব্দে অগ্রসর হইলাম।

    কিয়দ্দুর আসিয়া একটা গহ্বর দেখিতে পাইলাম, গহ্বরের সম্মুখে একখানা প্রকাণ্ড প্রস্তর খণ্ড, সেই পাথরের একপার্শ্বে দিয়া একটা খুব সঙ্কীর্ণ পথ আছে, তাহার ভিতর দিয়া এক ব্যক্তি কষ্টে গহ্বর মধ্যে যাইতে পারে। আমি গহ্বর মধ্যে উকি মারিয়া দেখিলাম, সেখানে কেহ নাই।

    তবে এইখানে যে কোন লোক বাস করে, তাহাতে আমার আর কোনই সন্দেহ রহিল না। গহ্বরের মধ্যে কয়েকটী জিনিস পড়িয়া আছে, এক স্থানে এক কলসী জল ও একটা ঘটি রহিয়াছে, গৃহের এক কোণে একখানা তোয়ালেতে বাঁধা কি রহিয়াছে। আমি গৃহমধ্যে গিয়া তোয়ালে খুলিলাম; দেখিলাম, ভিতরে এক থালা ভাত, কয়েকখানা রুটী ও তিন-চার রকম তরকারী রহিয়াছে, সেগুলির নীচে কিছু আছে কি না, আমি দেখিবার জন্য সেগুলি সরাইলাম, দেখি—তাহার নীচে একখানা কাগজ।

    আমি ব্যগ্রভাবে কাগজখানা তুলিয়া লইলাম, তাহাতে যাহা লিখিত দেখিলাম, তাহাতে আমি বিস্ময়ে আপাদমস্তক স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।

    লিখিত আছে;—

    “আজ ডাক্তারবাবু নবদুর্গার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছেন।”

    কয়েক মুহূৰ্ত্ত আমি স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম, তাহার পর আবার আমার চিন্তাশক্তি ফিরিয়া আসিল। আমি ভাবিলাম, “দেখিতেছি, তাহা হইলে এই লোকটা মণিভূষণের পিছু লয় নাই, আমারই পিছু লইয়াছে, নিজে আমার অনুসরণ না করিয়া অন্যকে এ কাজে নিযুক্ত করিয়াছে। এই বালকই তাহা হইলে আমার অনুসরণ করিতেছে। আমি এখানে আসিয়া পৰ্য্যন্ত যাহা কিছু করিয়াছি, তাহার সমস্ত খবরই এই লোক পাইয়াছে, অলক্ষ্যে থাকিয়া সে যে আমাদের চারিদিকে জটিল জাল বিস্তৃত করিতেছিল, তাহা আমরা কিছুই জানিতে পারি নাই। এই লোকই কিছুদিন পূর্ব্বে নিশ্চয়ই ছদ্ম শ্মশ্রু গুল্ফ ধারণ করিয়া কলিকাতায় মণিভূষণের অনুসরণ করিয়াছিল।

    আরও কোন কাগজ-পত্র এই গহ্বরে আছে কি না, আমি তাহারই সন্ধান করিতে লাগিলাম, কিন্তু আর কিছু পাইলাম না। লোকটী কে—কিরূপ চরিত্রের, তাহা যদি কোনরূপে জানিতে পারি, এজন্য সেই গহ্বরে যাহা কিছু ছিল, সমস্তই তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলাম; কিন্তু এইমাত্র বুঝিলাম যে, লোকটা অতি কষ্টেই এখানে বাস করিতেছে। গুরুতর কিছু উদ্দেশ্য না থাকিলে কেহ কখনই এত কষ্টে থাকিতে পারে না।

    লোকটা আমাদের শত্রু না মিত্র? আমাদের হানি করিবার জন্য এখানে এইরূপে বাস করিতেছে, না আমাদের শত্রু হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য এখানে আছে? যাহাই হউক, আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম—ইহার একটা হেস্তনেস্ত না করিয়া আমি এখান হইতে নড়িব না। এ সুযোগ ছাড়িলে গোবিন্দরাম শুনিয়া বলিবেন কি-লজ্জায় যে আমি তাঁহার সম্মুখীন হইতেই পারিব না।

    তখন বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। গহ্বরের মুখ পশ্চিমদিকে; সেইজন্য তখন বাহির হইতে দিনান্তের ম্লান আলো আসিয়া গহ্বরের ভিতরে সম্মুখভাগে কতকটা স্থান আলোকিত রাখিয়াছিল, এবং ভিতরের অন্ধকার তেমন নিবিড় হইতে পারে নাই। আমি পিস্তল হস্তে নীরবে সেই অর্দ্ধান্ধকার গহ্বরমধ্যে বসিয়া রহিলাম। ঘোরতর ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া বসিলাম, তাহাকে না দেখিয়া এখান হইতে কিছুতেই নড়িব না। ইহাতে বিপদ আছে, তাহা বেশ বুঝিলাম, বিপদের ভয় করিলে কোন কার্য্যোদ্ধারই হয় না। আর আমার নিকটওে পিস্তল আছে।

    প্রায় এক ঘণ্টা পরে বাহিরে দূরে কাহার পদশব্দ শুনিলাম, অমনই আমি গহ্বরের অন্ধকার কোণে লুকাইলাম, দুই হস্তে দুই পিস্তল সুদৃঢ়ভাবে ধরিলাম। তাহাকে প্রথমে না দেখিয়া কিছুতেই তাহাকে ধরা দিব না।

    পদশব্দ আরও নিকটস্থ হইল, তাহার পর নীরব হইল; প্রায় দশ মিনিট আর কোন শব্দ নাই—তাহার পরে আবার শব্দ হইল, ক্রমে পদশব্দ গহ্বরের দ্বারে আসিল। এক ব্যক্তির সুদীর্ঘ ছায়া গহ্বরমধ্যে প্রসারিত হইল, তাহার পর একজন বলিল, “ডাক্তার, গর্ভের মধ্যে একা অন্ধকারে কষ্ট পাও কেন? বাহিরে এস!”

    সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    একি রহস্য। আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। কয়েক মুহূর্ত্ত আমি আমার কানকে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না—এ কে? এ কাহার কণ্ঠস্বর? এ যে—কি আশ্চৰ্য্য!

    আমি ব্যস্ত ও উদ্‌গ্রীব হইয়া গহ্বরের বাহিরে ছুটিয়া আসিলাম; বলিলাম, “গোবিন্দরাম— তুমি—তুমি?”

    গোন্দিরাম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “এইদিকে এস, ডাক্তার, সাবধান—তোমার পিস্তল, দেখিও অপঘাত মৃত্যু ঘটাইও না।”

    আমি অগ্রসর হইয়া দেখিলাম, গোবিন্দরাম এক প্রস্তর-খণ্ডের উপরে বসিয়া মৃদুহাস্য করিতেছেন। তিনি যেন আরও রোগা হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার চোখের জ্যোতিঃ যেন দ্বিগুণিত হইয়াছে। আমার বিস্মিত ভাব দেখিয়া তিনি আরও হাসিতে লাগিলেন।

    আমি বলিলাম, “সত্যকথা বলিতে কি, তোমায় দেখিয়া যে আনন্দ হইয়াছে, তেমন জীবনে আমার আর কখনও হয় নাই।”

    তিনি হাসিয়া বলিলেন, “বরং আশ্চর্য্য বল—কেমন নয়?”

    “হাঁ, তাহাও অস্বীকার করি না।”

    “তবে ইহাও বলি যে, কেবল তুমিই যে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছ, তাহা নহে। তোমার এখানে দেখিয়া আমিও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছি। আমি জানিতাম না, তুমি আমার গুপ্ত-আশ্রমের সন্ধান পাইয়াছ, আরও জানিতাম না যে, তুমি এখন আমার আশ্রমে লুকাইয়া আছ—এই পাহাড়ের কাছে আসিয়া জানিলাম, তুমি এখানে আছ।”

    “আমার পায়ের দাগ দেখিয়া বুঝিয়াছিলে, নিশ্চয়।”

    “না, ডাক্তার, তোমার পায়ের দাগের বিশেষ কোন বিশেষত্ব নাই; তবে তোমার জানা শক্ত নহে। তোমার চুরুট কোথায় যাইবে? একটু দূরেই তোমার চুরুটের গোড়া পড়িয়া আছে; বোধ হয় যখন পিস্তল হাতে এই গর্ভে প্রবেশ করিতেছিলে, সেই সময়ে চুরুটটা তাড়াতাড়ি ফেলিয়া দিয়াছিলে।”

    “হাঁ, এখন মনে পড়িল।”

    “আমি তাহাতেই বুঝিলাম যে, তুমি পিস্তল হাতে এইখানে বসিয়া আছ। তুমি মনে করিয়াছিলে, আমিই হারু ডাকাত।”

    “না, তা ঠিক মনে করি নাই, তবে এই লোকটা যে কে তাহা দেখিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়াছিলাম।”

    “খুব ভাল—ডাক্তার, খুব ভাল। তবে আমি যে এখানে আছি, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে? হয় ত যেদিন তোমরা ডাকাত ধরিতে বাহির হইয়াছিলে, সেইদিন আমায় দেখিতে পাইয়াছিলে।”

    “হাঁ, সেদিন আমি দূরে তোমায় দেখিতে পাইয়াছিলাম।”

    “তাহার পর এ লোকটা কে দেখিতে আমার জন্য সমস্ত মাঠটা খুঁজিয়া ছিলে নিশ্চয়?”

    “না—যে ছোকরা তোমার খাবার লইয়া আসে, তাহাকে দেখিতে পাইয়াই এখানে আসিয়ছিলাম।”

    “তুমি তাহাকে প্রথমে দেখ নাই; বোধ হয় এটা ভূতনাথের কাজ, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই সন্দেহ করিয়াছিলাম। এই যে গঙ্গারাম কিছু খাবার রাখিয়া গিয়াছে।”

    গোবিন্দরাম সেই গহ্বরে প্রবেশ করিয়া কাগজখানা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “এই যে আরও দেখিতেছি, তুমি নবদুর্গার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলে?”

    “হাঁ, আজ সকালেই তাহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম।”

    “খুব ভাল। দেখিতেছি, আমি যে ধরনের অনুসন্ধান করিতেছি, তুমিও সেই ধরনের অনুসন্ধান করিতেছ। এখন আমরা আমাদের সন্ধানের ফল পরস্পরে মিলাইলে কতকটা স্থির সিদ্ধান্তে আসিতে পারিব। এস ডাক্তার, বসো।”

    অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ

    তখন আমরা দুইজনে সেই নির্জ্জন প্রান্তরমধ্যে প্রস্তরখণ্ডের উপরে বসিলাম। আমি বলিলাম, “তুমি এখানে আসিয়াছে, তাহাতে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। এখানকার এই সকল গুরুতর রহস্য আমি কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কেবল ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিতেছিলাম। যাহাই হউক, তুমি কবে এখানে আসিলে, কতদিন এখানে এভাবে আছ, আমরা তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই; আমি জানি, তুমি নিশ্চিন্তভাবে কলিকাতায়ই আছ।”

    “যাহাতে তোমরা তাহাই ভাব, সেইরূপ উদ্দেশ্যই আমার ছিল।”

    “তাহা হইলে দেখিতেছি, তুমি আমায় আদৌ বিশ্বাস কর না।”

    “ডাক্তার, রাগ করিও না, তুমি কি জান না যে, আমার সমস্ত অনুসন্ধানেই তুমি আমার প্রধান সহায়। তোমায় না জানাইয়া যে এখানে লুকাইয়া আছি, তাহার কারণ ত তুমি। আমি জানি, তুমি এখানে আসিয়া সর্ব্বদাই গুরুতর বিপদে পড়িতে পার, তাহাই আমি কলিকাতায় নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারিলাম না। যদি আমি তোমাদের সঙ্গে গড়ে মণিভূষণের বাড়ী আসিতাম, তাহা হইলে তোমরা এ সম্বন্ধে যাহা ভাবিতেছ,” আমিও সেইরূপ ভাবিতাম। আর আমার প্রকাশ্যভাবে এখানে আসায় অপর লোক সাবধান হইয়া যাইত। এই রকম লুকাইয়া এখানে উপস্থিত থাকায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সন্ধান করিবার সুবিধা পাইয়াছি। এখন প্রয়োজনমত আবির্ভূত হইতে পারিব।

    “কিন্তু আমাকে এরূপ অন্ধকারে রাখিতেছ কেন?”

    “তোমার জানাইলে তাহাতে আমাদের কাজের কোনই সুবিধা হইত না, অথচ হয় এখানকার সকল লোকেই আমার কথা জানিতে পারিত। আমি গঙ্গারামকে সঙ্গে আনিয়াছি, তুমি ত জান, সে কি রকম চালাক ছেলে। সে গ্রামে থাকে, সেখান থেকে লুকাইয়া আমার খাবার এখানে দিয়া যায়, সেখানে কোথায় কে কি করিতেছে, তাহার সন্ধানও তাহার কাছে পাই। দেখিলে ত তোমারও সকল খবর সে আমাকে দিয়াছে। অনেক দূর হইতে তুমি গঙ্গারামকে দেখিয়াছিলে বলিয়া চিনিতে পার নাই।”

    “আর আমি তোমাকে যে সকল পত্র লিখিয়াছি, তাহা সমস্তই পশুশ্রম হইয়াছে।”

    “গোবিন্দরাম হাসিয়া পকেট হইতে একতাড়া পত্র লইয়া বলিলেন, “এই লও ডাক্তার, তোমার সব পত্র—সব পত্রই কলিকাতা হইতে ঘুরিয়া আমার হাতে আসিয়াছে। তুমি যে রকম চেষ্টা করিয়া এই বিষয়ের চেষ্টা করিয়া এই বিষয়ের সন্ধান লইয়াছ, তাহাতে আমি তোমার প্রশংসা করি।”

    আমি প্রথমে গোবিন্দরামের উপর একটু বিরক্ত হইয়াছিলাম, এখন তাঁহার কথা শুনিয়া বুঝিলাম যে, তিনি যাহা করিয়াছেন, ভালর জন্যই করিয়াছেন। কাহারা মণিভূষণের অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা আমরা জানি না। তবে এটা জানিয়াছি যে, তাহারা আমাদের সকল খবরই রাখিতেছে, সুতরাং গোবিন্দরাম এখানে আসিয়াছেন জানিতে পারিলে, তাহারা নিশ্চয়ই খুব সাবধান হইয়া পড়িত, আমরা তাহাদের কার্য্যকলাপ কিছুই জানিতে পারিতাম না।

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “এখন নবদুর্গার সঙ্গে দেখা করিয়া কি জানিতে পারিলে তাহাই শুনি। আমি এটা জানিয়াছি, রাজা অহিভূষণের মৃত্যু সম্বন্ধে সে ইচ্ছা করিলে কোন-না-কোন কথা বলিতে পারে। তুমি নবদুর্গার সঙ্গে দেখা না করিলে আমি নিজেই তাহার সঙ্গে দেখা করিতাম।”

    তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল, আমরা দুইজনে আহার করিতে করিতে সেই নির্জ্জন মাঠে বসিয়া নবদুর্গার কথা আলোচনা করিতে লাগিলাম। নবদুর্গা আমাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহার সঙ্গে যে সকল কথা হইয়াছিল, আমি সকলই গোবিন্দরামকে বলিলাম। তিনি নীরবে অতি মনোযোগের সহিত সকল কথা শুনিলেন; আমার কথা শেষ হইলে বলিলেন, “এই গোলযোগের ব্যাপারের যে অংশটা ভাল বুঝিতে পারিতেছিলাম না, তাহা এখন অনেকটা পরিষ্কার হইল। বোধ হয় তুমি জান যে, এই নবদুর্গার সঙ্গে সদানন্দের খুব ভাব আছে।”

    “তাহা শুনি নাই। জানা-শুনা থাকিতে পারে।”

    “কেবল জানা-শুনা নয়, বিশেষ ঘনিষ্টতা আছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। নিশ্চয়ই ইহাদের দুইজনে গোপনে দেখা হয়, গোপনে চিঠী-পত্র চলে। ইহাতে আমাদের বিশেষ কাজ হইতে পারে। যদি এই সদানন্দের স্ত্রীকে কোনরূপে হাত করা যায়—”

    “সদানন্দের স্ত্রী! সে কে?”

    “তুমি যাহা জান না, আমি তোমায় এখন তাহাই বলিতেছি। মঞ্জরী তাহার ভগিনী নহে— তাহার স্ত্রী।

    আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “ভগিনী নয়—স্ত্রী—সে কি? আর মণিভূষণের ইহার জন্য টান।”

    “তাহাতে মণিভূষণের ক্ষতি ব্যতীত আর কাহারও ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই। যাহা হউক এটা স্থির যে, মঞ্জরী সদানন্দের স্ত্রী।”

    “এ রকম বিশ্রী প্রবঞ্চনার মানে কি?”

    “মানে এই যে, ভগিনী বলিয়া—বিধবা ভগিনী বলিয়া তাহার পরিচয় দিলে তাহার কাজের সুবিধা হইবে।”

    আমি গোবিন্দরামের কথায় কোনই অর্থ বুঝিতে পারিলাম না। সদানন্দকে অতি ভাল মানুষ—শিক্ষিত লোক বলিয়া বোধ হয়; সে কেন নিজের স্ত্রীকে ভগিনী বলিয়া পরিচয় দিয়া সকল লোককে এরূপ ভাবে ঠকাইতেছে! তবে ত সে অতি ভয়ানক লোক! আমি বলিয়া উঠিলাম, “তবে সেই এই সকল বদমাইসী করিতেছে—সেই কলিকাতায় আমাদের পিছু লইয়াছিল।”

    “খুব সম্ভব।”

    “তাহা হইলে এই মঞ্জরীই মণিভূষণকে সাবধান করিয়া দিয়াছিল?”

    “নিশ্চয়ই।”

    “এই লোকটাই এই সকল ভয়াবহ কাণ্ড করিতেছে, অথচ আমি ইহাকে একবারও সন্দেহ করি নাই। কি ভয়ানক! সদানন্দের এই সকল করিবার উদ্দেশ্য কি? মণিভূষণ বা অহিভূষণের সর্ব্বনাশ করিয়া তাহার লাভ কি?”

    ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

    আমি এত বিস্মিত হইয়াছিলাম যে, কিয়ৎক্ষণ কোন কথা কহিতে পারিলাম না, তাহার পর বলিলাম, “তুমি এ সকল কিরূপে জানিলে?”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “এই লোকটার গত জীবনের দিকে একটু অনুসন্ধান লইয়াছিলাম। প্রথমে মনে একটা প্রশ্নোদয় হইল, লোকটা এরূপ ভাবে এখানে আছে কেন? পরে অনুসন্ধানে জানিলাম যে, বাঁকুড়ায় একজন লোকের একটা স্কুল ছিল, সে আর তাহার স্ত্রী অন্য কোন স্থান হইতে আসিয়া এইখানে এক স্কুল খুলিয়াছিল; ক্রমে অনুসন্ধান করিয়া আরও জানিলাম, নানা কারণে সেই মহাত্মা একদিন স্ত্রী লইয়া বাঁকুড়া হইতে পলায়ন করেন; সে কোথায় পলাইল, তাহা সন্ধান করিয়া করিয়া অবশেষে তাহাকে এই নিৰ্জ্জন মাঠে পাইলাম।”

    “কি ভয়ানক লোক—যদি স্ত্রীলোকটা সত্যসত্যই তাহার স্ত্রী হয়! কিন্তু নবদুর্গার সঙ্গে তাহার সম্পর্ক কি?”

    “তুমি তাহার সহিত কথা কহিয়া যাহা জানিতে পারিয়াছ, তাহাতেই এ বিষয়টাও কতকটা পরিষ্কার হইয়াছে। প্রেম—ডাক্তার, প্রেম—প্রেম বড় কঠোর সামগ্রী। নবদুর্গা জানে—মঞ্জরী সদানন্দের ভগিনী।”,

    “তাহা হইলে সে যখন শুনিবে যে, মঞ্জরী তাহার ভগিনী নয় তখন রাগে নবদুর্গা সব কথা বলিয়া দিতে পারে।”

    “নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই। সেই চালই চালিতে হইবে। ডাক্তার মণিভূষণকে ছাড়িয়া তুমি অনেকক্ষণ রহিয়াছ, নয় কি? তোমার গড়ে সৰ্ব্বদা থাকাই উচিত।”

    এই কথা শুনিয়া আমি তখনই উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বলিলাম, “আমি এখনই যাইতেছি, তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, অবশ্যই আমাকে তোমার কিছু গোপন করিবার নাই।”

    “নিশ্চয়ই নয়।”

    “তবে এ লোকটার উদ্দেশ্য কি?”

    গোবিন্দরাম অতি গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “খুন—ডাক্তার, খুন—বৈজ্ঞানিক ভাবে বজ্জাতির চূড়ান্ত উপায়ে খুন। সে যেমন মণিভূষণকে ফাঁদে ফেলিবার জন্য গোপনে চেষ্টা করিতেছে, আমিও তেমনই ভাবে তাহাকে নিজের জালে আটকাইতে চেষ্টা করিতেছি; বোধ হয়, দুই তিন দিনেই আমি তাহার লীলাখেলার অবসান করিতে পারিব, তবে এই কয় দিন মণিভূষণকে খুব সাবধানে রাখ—খুব সাবধান—ডাক্তার, খুব সাবধান। আমার মনে হয় এতক্ষণ তাহাকে ছাড়িয়া থাকা তোমার উচিত হয় নাই—(চকিত হইয়া) এ কি—এ কি—কি ব্যাপার!”

    সহসা এক ভয়াবহ আর্তনাদে সেই সমগ্র প্রান্তর প্রতিধ্বনিত হইল। কি সে কাতরকণ্ঠ- ভীতিব্যঞ্জক—মৰ্ম্মভেদী! এরূপ আর্তরব আমি আর কখনও শুনি নাই; তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল, সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই ভয়াবহ শব্দ আরও ভয়াবহ বলিয়া বোধ হইল, আমি চমকিয়া বলিয়া উঠিলাম, “একি? একি?”

    এই শব্দ শুনিয়া গোবিন্দরামও লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; তিনি অন্ধকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “চুপ্—চুপ্—”

    প্রথমে আর্তনাদ দূরে বোধ হইয়াছিল, এক্ষণে তাহা স্পষ্ট আমাদের নিকটে বোধ হইল, কে যেন প্রাণভয়ে আকুল আর্ত্তনাদ করিতে করিতে আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে।

    গোবিন্দরাম কম্পিত স্বরে বলিলেন, “কোথায়—কোথায় ডাক্তার?”

    আমি ঠিক সম্মুখদিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলাম, “ঐ—ঐ দিকে।”

    তিনি বলিলেন, “না—এই দিকে।”

    তখন সেই আৰ্ত্তনাদ আমাদের আরও নিকটবর্ত্তী হইয়াছে, সেই আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ভয়াবহ গৰ্জ্জনও আমরা শুনিতে পাইলাম—গোবিন্দরাম বলিয়া উঠিলেন, “কুকুর- কুকুর—কি ভয়ানক! এস—এস—শীঘ্র এস।”

    আমরা দুই জনে মাঠের উপর দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলাম, তখন আমাদের নিকটেই কোন স্থান হইতে সেই লোমহর্ষণ আৰ্ত্তনাদ হইতে লাগিল। তাহার পর একটা শব্দে বোধ হইল, কে যেন কোথায় পড়িয়া গেল।

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “ডাক্তার লোকটা আমাদের হারাইয়াছে, আমরা তাহাকে রক্ষা করিতে পারিলাম না।”

    আমি বলিয়া উঠিলাম, “না না—ও কথা বলিও না। কি ভয়ানক! “

    “আমি এ কয়দিন নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া থাকিবার জন্যই আজ এই দুর্ঘটনা ঘটিল, আর তুমিও তাহাকে ছাড়িয়া আসিবার জন্য কি ঘটিল, দেখ। ডাক্তার—সর্ব্বনাশ, তীরে আসিয়া তরী ডুবিল!”

    আমরা সেই অন্ধকারে—যেখানে শব্দ হইতে শুনিয়াছিলাম, সেইদিকে ছুটিলাম। চারিদিকেই খাদ ও গর্ভ, আমরা কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “কিছু দেখিতে পাইতেছ?”

    আমি বলিলাম, “কিছু না।”

    “শোন, এ আবার কি!”

    কে যেন গোঙাইতেছে, অপরিস্ফুট শব্দ, সেইদিকে একটা বড় গর্ত্ত, আমরা উভয়ে গিয়া ব্যগ্র হইয়া সেই গর্তের ভিতর চাহিয়া দেখিলাম অন্ধকারে সেই গর্ভের মধ্যে একজন লোক পড়িয়া আছে। লোকটার মস্তক বুকের ভিতর গুঁজড়াইয়া গিয়াছে, তাহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, সে কারণে সে দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতেছিল, তাহার পর এই প্রকাণ্ড গর্ভের ভিতর পড়ায় তাহার মৃত্যু হইয়াছে!

    গোবিন্দরাম পকেট হইতে দিয়াশলাই জ্বালিলেন, সেই আলোতে আমরা সেই লোকটাকে ভাল করিয়া দেখিলাম, তাহার মাথা ফাটিয়া গিয়াছে, এবং সেই ক্ষতস্থান হইতে অজস্র শোণিতধারা বহিতেছে, তবে তাহার পর আমরা যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হইয়া গেল, আমরা দেখিলাম, সেই মৃতদেহ রাজা মণিভূষণের

    আমরা দিয়াশলাইয়ের আলোকে এক মুহূর্ত্তের জন্য মণিভূষণকে দেখিলাম, কিন্তু মণিভূষণ সৰ্ব্বদাই যে জামা কাপড় পরিতেন, তাহা আমাদের ভুল হইবার সম্ভাবনা ছিল না।

    গোবিন্দরাম ক্রোধভরে গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। আমি ব্যাকুলভাবে বলিলাম, “কি ভয়ানক—কি ভয়ানক! আমি হয় ত তাঁহাকে না ছাড়িয়া আসিলে এ সর্ব্বনাশ হইত না।”

    গোবিন্দরাম বিষণ্ণস্বরে বলিলেন, “ডাক্তার, তোমার চেয়ে আমার দোষ অনেক বেশী। ভাল করিয়া লোকটার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করিতে গিয়া আমি একজনের প্রাণ নষ্ট করিলাম। দুই দিন আগে লোকটাকে গ্রেপ্তার করিলে সে আর আজ এ সর্ব্বনাশ করিতে পারিত না। তবে তবে—আমি মণিভূষণকে বারংবার নিষেধ করিয়াছিলাম যে, রাত্রে মাঠে কিছুতেই না বাহির হয়, কেনই বা একা বাহিরে আসিয়াছিল?”

    আমি বলিলাম, “কি ভয়ানক আৰ্ত্তনাদ! নিতান্তই একটা কিছু ভয়াবহ না দেখিলে কেহ এমন আর্তনাদ করে না। কুকুরটা কোথায় গেল? আমরা স্পষ্ট তাহার ডাক শুনিয়াছি—কুকুরটা কোথায়? নিশ্চয়ই এইখানে কোথায় আছে। সদানন্দই বা কোথায়? সে-ও নিশ্চয় এখানে কোথায়ও লুকাইয়া আছে। এখন এস দেখা যাক্, সে যেন আর না পলাইতে পারে।”

    গোবিন্দরাম বলিলেন, “আর পলাইতে পারিবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাক। রাজা অহিভূষণ ও মণিভূষণ দুই জনেই খুন হইল। অহিভূষণ কুকুর ভূত ভাবিয়া ভয়েই মরিয়া ছিলেন। আর এই বেচারা সেই কুকুরের হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এই গর্তের মধ্যে পড়িয়া মারা গেল। এখন এই সদানন্দটার সঙ্গে কুকুরটার কি সম্পর্ক, তাহাই প্রমাণ করিতে হইবে, নতুবা আইনানুসারে তাহাকে দোষী সাব্যস্ত করিতে পারা যাইবে না। আর আমরা কুকুরটা দেখি নাই, কেবল তাহার ডাক শুনিয়াছি মাত্র, কুকুরটা যথার্থ আছে কি না, তাহাও আমরা ঠিক বলিতে পারি না। সুতরাং ইহাতে এই মাত্র প্রমাণ হইবে যে, মণিভূষণ গর্ভে পড়িয়া মারা গিয়াছেন। সামানন্দ যতই দুর্বৃত্ত হউক, আমি তাহাকে আমার জালে টানিয়া তুলিবই তুলিব।

    তখন আমরা দুই জনে কি করিব স্থির করিতে না পারিয়া সেই নিৰ্জ্জন মাঠে, এই ভয়াবহ মৃতদেহের নিকটে নীরবে দণ্ডায়মাণ রহিলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাঁচকড়ি রচনাবলী ২ – পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ৪ (৪র্থ খণ্ড)

    Related Articles

    পাঁচকড়ি দে

    নীলবসনা সুন্দরী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবিনী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যাকারী কে – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    গোবিন্দরাম – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    মায়াবী – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    পাঁচকড়ি দে

    হত্যা-রহস্য – পাঁচকড়ি দে

    September 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }