Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পাখসাট – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প24 Mins Read0

    ১-২. কুসুমের বয়স

    কুসুমের বয়স যখন তার মেয়ে সল্লির বর্তমান বয়েসের সমান ছিল, তখন সল্লিও ছিল কুসুমের একমাত্র মেয়ে। আজকের জলপিপির-ই মতন বয়সি।

    চার বছরের জলপিপি। খুব পাকা-পাকা কথা বলে। মাথাভরতি কোঁকড়া চুল। গ্ল্যাক্সো বেবির প্রাইজ পেয়েছিল। একা বাড়িতে শেষবসন্তর দুপুরে বসে এইসব ভাবছিলেন কুসুম।

    তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে একবার-ই আলোড়ন উঠেছিল। একজন এসেছিলেন।

    অবিবাহিত পুরুষকে কি পরপুরুষ বলে? কে জানে! অত ভালো বাংলা জানেন না উনি। একজন-ই এসেছিল বটে কিন্তু সেই সম্পর্কের মাধুর্যের মধ্যে যে, গভীর এবং তীব্র দুঃখ মেশানো ছিল তা আজও কুসুম ভুলতে পারেনি। সেই মানুষটিকে একদিন দুঃখ দিয়ে এবং নিজেও দুঃখ পেয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর জীবন থেকে। সেই অপরাধবোধে আজও তিনি ক্লিষ্ট। কুসুম জানেন যে, প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ, প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।

    তাঁদের প্রজন্মের মানুষেরা, বিশেষ করে মেয়েরা, বড়ো গোঁড়া ছিলেন। তাঁর মেয়ে সল্লিদের প্রজন্ম অনেক অন্যরকম। অসতী না হয়েও যে, সুস্থভাবে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষদের সঙ্গে অবাধে মেশা যায়– তা ওদের দেখে বোঝেন এবং নিজেদের ঘেরাটোপের মধ্যের দানা-খাওয়া ময়নার জীবনের কথা ভেবে একধরনের দুঃখবোধও করেন। কিন্তু যে-দিন গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না।

    সেই মানুষটি তাঁর স্বামী শিরীষের বন্ধুস্থানীয়ই ছিলেন। তিনি শিরীষের-ই মতন অধ্যাপনাই করতেন। মাঝ-জীবনে বহরমপুর কলেজে, ওদের দুজনেরই অধ্যাপক জীবনের এক অধ্যায়ে একে অন্যের কাছাকাছি এসেছিলেন। আজ অবধি, কুসুমের জীবনে সেই প্রসাদ ঘোষ একাই। একমাত্র প্রসাদ।

    অকৃতদার প্রসাদও শিরীষের-ই মতন এখন অবসর নিয়েছেন কলকাতার একটি কলেজ থেকে। শিরীষের কাছে শুনেছিলন কুসুম যে, বিহারের কোডারমা শহরের কাছে ঝুমরিতিলাইয়াতে প্রসাদ জমি কিনে রেখেছিলেন প্রথম যৌবনেই। সস্তার সময় ছিল। দু-বিঘা জমি। জলের দামে। তাতে তখন থেকেই অনেক গাছগাছালিও লাগিয়েছিলেন তিনি। গাছপালা-ফুল-পাখি, খুব-ই ভালোবাসতেন মানুষটি। হয়তো নারীও। জমির চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া ছিল এবং জমি কেনার পরে পরেই সমবয়েসি একটি কাহার ছেলেকে কেয়ারটেকার রেখেছিলেন জমি এবং বাগানের। তার বাড়ি ছিল ডোমচাঁচে। কোডারমার কাছেই। তখন মাটির তৈরি এক-কামরার ঘর ছিল। শুধু একটিই। গোবর-লেপা। এখনও নাকি সেই কাহার-ই তাঁর জমি-বাড়ি এবং তাঁর নিজেরও দেখভাল করে। সেই খিদমদগারেরও চুল পেকে গেছে।

    রিটায়ার করার পরে ছোট্ট পাকাবাড়ি করেছে প্রসাদ দু-কামরার, সেই ফুল-ফলন্ত জমির ওপরে। শুনেছেন কুসুম। শিরীষের কাছে লেখা প্রসাদের চিঠিতেও জেনেছেন। বসার ও খাওয়ার ঘর অবশ্য আলাদা। মানে শোয়ার-ঘর দু-টির একপাশে। চারদিকে বারান্দা। আর বাড়ির সেই কেয়ারটেকারের জন্যেও হাতার-ই অন্যপ্রান্তে বাড়ি করে দিয়েছেন। তার ছেলেকে লেখাপড়াও শিখিয়েছেন প্রসাদ। তখনকার দিনের অনেক অধ্যাপকেরাই অধ্যাপনাকে জীবনের ব্রত হিসেবে দেখতেন, নিছক-ই একটি ‘জীবিকা হিসেবে নয়।

    কেয়ারটেকার-এর ছেলে লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে এখন হাজারিবাগের স্টেট ব্যাঙ্কে ভালো কাজ করে। তপশিলিদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে সহজেই কাজ পেয়ে গেছে। বিয়েও দিয়েছেন কেয়ারটেকার-এর ছেলের। তার একটি দামাল ছেলে আছে নাকি, বছর চারেকের। কুসুমের নিজের ছেলে ছিল না বলেই, একটি নাতির শখ ছিল খুব-ই। যাক, নাতনি নিয়েও তিনি অখুশি নন।

    প্রসাদ সংসার করেননি বটে, কিন্তু সেই কেয়ারটেকার সময়েই করেছিল।

    সেই সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্বও প্রসাদ-ই নিয়েছেন।

    তাই ফুল-ফলের সঙ্গে পরজাত ছেলে-বউ এবং নাতিও ফুটেছে সেই লালমাটির জমিতে সবুজ গাছগাছালির মধ্যে। প্রসাদের কোনো দুঃখ নেই। বলেন, কুসুমের স্বামী শিরীষ।

    কিছু মানুষ এই সংসারে চিরদিন-ই থাকেন, সব বয়েসি, যাঁদের নিজেদের নিজস্ব দায় কিছু না থাকলেও, অন্য দায়-দায়িত্ব তাঁদের চুম্বকের মতন-ই আকর্ষণ করে।

    শিরীষ, প্রসাদের সেই ঝুমরি-তিলাইয়াতেই বেড়াতে গিয়েছিলেন এবারে। একা। বহুদিনের এবং পৌনঃপুনিক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কুসুমকে অনেকবার বলা সত্ত্বেও কুসুম যাননি।

    দুপুরবেলায় অবসরে শুয়ে শুয়ে কুসুম এইসব কথাই ভাবছিলেন। সল্লির কথা, বাজ-এর কথা, জলপিপির কথা। তাঁর পর্ণমোচী জীবনের কথা। শুধু তাঁর জীবন-ই কেন, হয়তো প্রত্যেক মানুষের জীবন-ই পর্ণমোচী। তবে শীতার্ত গাছের পাতা ঝরালেও পরের বসন্তে আবার নতুন, কচি-কলাপাতা-রঙা চিকন পাতাতে নবীকৃত হয়। শুধু পর্ণমোচী মানুষের-ই নবীকরণ হয় না কোনো। ভাবলে মন খারাপ লাগে।

    ঠিক এমন-ই সময়ে ডোর-বেলটা বাজল, তাঁর তন্দ্রা ভাঙিয়ে দিয়ে।

    কে এল এই অসময়ে কে জানে!

    কুসুম উঠে বাইরের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে বললেন, কে?

    আমি। আমি। আর কে আসবে, তোমার কাছে এই রোদে-তাতা গরমের দুপুরে? তোমার একমাত্র স্বামী ছাড়া?

    বিরক্তির সঙ্গে ঠাট্টা মিশিয়ে বললেন শিরীষ।

    দরজা খুলতে খুলতে কুসুম ভাবলেন, কে যে, কার কাছে আসে, কখন আসে, আর কেন আসে, তা কি কেউ বলতে পারে! স্ত্রী বলেই, পুরোনো বলেই, এমন হেলা করতে নেই। যে কেউই যখন তখন এসে পড়তে পারে একজনের জীবনে। এসে পড়ার আগে-পর্যন্ত বোঝা যায় না।

    কুসুম দরজা খোলার পরে, ওভারনাইটারটি নিয়ে ভেতরে ঢুকেই শিরীষ বললেন, ট্রেন পাঁচ ঘণ্টা লেট ছিল। বুঝলে!

    খাবে কিছু?

    না, না, চা খাব শুধু এককাপ। খবর তো দেওয়া ছিল না তোমাকে, তাই হাওড়া স্টেশনের রেস্তরাঁতেই খেয়ে নিয়েছি ভাত আর মাংস।

    পাঁঠার মাংস? আবারও খেলে! তোমার কোলেস্টেরলটা-না বেড়েছে! পূর্ণিমা-অমাবস্যাঁতে হাঁটুর আর কোমরের বাতে ‘কোঁ কোঁ করেও শিক্ষা হয় না?

    পাঁঠার মাংস ছাড়া অন্য কোনো মাংস খাবার যোগ্যতা নিয়ে তো আসিনি। নারী-মাংস বা বুদ্ধিমানের মাংস আর পাচ্ছি কই? পাঁঠার মাংস মাঝে-মধ্যে খেলে কিছু হবে না।

    কুসুম তাঁর কামুক-চড়াই স্বামীর কথার উত্তর না দিয়ে, উঠে চা করতে গেলেন।

    জামা-কাপড় ছেড়ে চা খাওয়ার পরে শিরীষ শুধু প্রসাদ আর ঝুমরি-তিলাইয়ার গল্পই করে চলেছেন। কত যে গল্প! তার আর শুরু-শেষ নেই।

    উঃ! সত্যি কুসুম। কী আদর-যত্নটাই না করল প্রসাদটা!

    তারপর বললেন, জানো, ওর বাড়িতে ওর পরলোকগতা মা ও বাবার দু-টি বড়োফোটো আছে। সবচেয়ে মজার কথা এই যে, আর একটিমাত্র আছে ফোটো।

    কার?

    কার বলো তো?

    ঢং! আমি কী করে বলব?

    আমাদের তিনজনের।

    আমাদের মানে?

    ধ্বকধ্বক করে উঠেছিল কুসুমের বুক।

    শিরীষ বললেন, মধ্যিখানে তুমি আর দু-পাশে আমি আর প্রসাদ। মনে নেই? সেই একবার, বেড়াতে গেছিলাম আমরা একসঙ্গে। তখন সল্লি বছর চারেকের হবে। আরে সেই দার্জিলিং-এ গো! বাতাসিয়া লুপ-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা আর দার্জিলিং হিমালয়ান রেইলওয়েজের টয়-ট্রেনটা চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে লুপটিকে বেড় দিচ্ছে সাপের মতন। আশ্চর্য! সেই ছবিটিতে কিন্তু সল্লি নেই। শুধু আমরা তিনজন। কতদিনের কথা।

    তারপরেই বললেন, আচ্ছা সল্লি নেই কেন? ওকেও তো নিয়ে গেছিলাম।

    ছবিটা কে তুলেছিল, মনে আছে তোমার?

    কুসুম শিরীষের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

    না। কে?

    দার্জিলিং-এর নেপালি ট্যাক্সি-ড্রাইভার। তার নাম ছিল গুরুং। নইলে তুলত কে? আমরা তিনজনেই তো ফোটোতে আছি।

    ঠিক। কিন্তু এতবছর আগের কথা, তোমার ট্যাক্সি-ড্রাইভারের নামও মনে আছে? আশ্চর্য তো!

    কুসুম না-বলে বললেন, আছে। মনে যা-থাকার, তা ঠিক-ই মনে থাকে। সময় কোনো ব্যাপার নয়।

    তারপর মুখে বললেন, সল্লিকে যে, শিখামাসিমার কাছে রেখে গেছিলাম লুইস জুবিলি স্যানাটোরিয়ামে। ভুলে গেলে? তাই সল্লি নেই ছবিতে।

    আমার কিছু মনে থাকে না।

    শিরীষ বলেছিলেন।

    তারপর স্বগতোক্তির মতন বলেছিলেন, ভাবলেও ভালো লাগে যে, আমাদের ছবিও বড়ো করে বাঁধিয়ে কেউ অত যত্ন করে রেখেছে। সত্যি!

    তারপর-ই উজ্জ্বল মুখে বলেছিলেন, প্রসাদটা কিন্তু ট্যাক্সি-ভাড়া বাবদ আমাদের একপয়সাও দার্জিলিং-এ খরচ করতে দেয়নি। সে-কথা কিন্তু মনে আছে আমার আজও।

    কুসুম বলেছিলেন, আমার মনে আছে, আমি একটা হলুদ-জমি কালো-পাড়ের মুরশিদাবাদি সিল্ক-এর শাড়ি পরেছিলাম। আর কালো ব্লাউজ। সিল্কের-ই। আমার ওই একটিমাত্রই ছিল তখন সিল্ক-শাড়ি। ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশান তো তখনও অধ্যাপকদের আজকের মতন, এমন বড়োলোক করে দেয়নি। আমাদের বিয়ের সময়ে তোমাদের বহরমপুর কলেজের প্রিন্সিপালসাহেব ওই শাড়িটি দিয়েছিলেন। ভারি ভালো, ভোলা-ভালা মানুষ ছিলেন। ভদ্রলোক। শাড়ি-ব্লাউজের ওপরে হলুদ-কালো চেক-চেক একটা মলিদা। পাশের বাড়ির বড়োলোক এবং বড়োমনের রিনি-বউদি ধার দিয়েছিলেন।

    তাই? তা ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট ফোটো তো। শাড়ির রং বোঝা যায় না। দেখলাম তো, শুধু সাদা-কালোই শুধু।

    তারপর-ই বললেন শিরীষ, সত্যি! তোমরা মেয়েরা কিছু মনেও রাখতে পারো ডিটেইলস এ। কবেকার কথা!

    বলেই, বলেছিলেন, আশ্চর্য! ওর চলে-যাওয়া, বাবা-মায়ের ছবির পাশেই আমাদের তিন জনের ছবি একসঙ্গে কেন বাঁধিয়ে রেখেছে বলো তো প্রসাদটা? আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে বলেই কি?

    বলেই হাসলেন শিরীষ।

    কুসুম বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, কী করে বলব? জীবনে সহকর্মীর এই স্ত্রী ছাড়া আর কোনো মেয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়াবার সুযোগ হয়নি হয়তো তোমার বন্ধুর। তখনকার দিনের আমরা তো ওইরকম-ই ছিলাম। আমাদের দিন তো আজকের মতন ছিল না।

    তারপরেই বললেন, মানুষটি বড়ো ভীতু ছিলেন। পুরুষমানুষ ভীতু হলে ভালো লাগে না। অন্তত আমার কোনোদিনও ভালো লাগেনি।

    তা তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে কি প্রসাদ বীরপুরুষ বলে গণ্য হত? কে জানে! হত হয়তো।

    তা কী করে বলব! নিয়ে পালালে তবেই না বুঝতাম। খুব রোমান্টিক আর অ্যাডভেঞ্চারাস হত ব্যাপারটা। কত মানুষের বুক ফেটে যেত ঈর্ষায়, কত নারী-পুরুষ, যা-নয়-তা করে গালমন্দ করত আমাকে আর তোমার বন্ধুকে। আর তাতে আমাদের সুখ-ই বাড়ত। এই পানাপুকুরের জীবনে একটা তোলপাড় হত। মাছরাঙারা চিৎকার করত, ডাহুক ডেকে উঠত, জল ছিটকে উঠে রোদের কণাতে হিরের ফুল হয়ে যেত। আহা! বেশ হত কিন্তু।

    বলেছিলেন, উদাস গলাতে কুসুম। শিরীষ বললেন, এইজন্যেই বলে, ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ’।

    একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, জানো, আমার না…

    কী? কী তোমার?

    আমার একটা জিনিস খুব অবাক লেগেছিল। মানে, লাগছে এখনও।

    কী? তা বলবে তো।

    আমি প্রসাদের ঝুমরি-তিলাইয়ার বাড়ির এত প্রশংসা করছিলাম, ওর আদর-যত্নর, অথচ ও কিন্তু একবারও বলল না, তোমাকে একবার সেখানে নিয়ে যেতে।

    একবারও বলল না?

    কুসুম জিজ্ঞেস করলেন।

    তারপর বললেন, নাইবা বলল, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই।

    সত্যি! শুধু সেই বাঁধানো ফোটোটার দিকে চেয়ে, মিষ্টি মিষ্টি হাসত শুধু। মাঝে মাঝে বলত, যে-দিনগুলো চলে যায় সেগুলোই সবচেয়ে সুন্দর দিন। বুঝেছিস, শিরীষ? একদিন বিকেলে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিল, কুসুম কি এখনও তেমন-ই সুন্দরী ও প্রাণোচ্ছল আছে? দেখিনি প্রায় পঁচিশ বছর। তাইনা?

    হয়তো বেশিই হবে।

    শিরীষ বলেছিলেন।

    ফোটোটা সত্যি হয়ে রয়েছে। বর্তমান হয়ে জীবন্ত।

    প্রসাদ বলেছিল।

    শিরীষ স্বগতোক্তির মতন বললেন, জানো, কুসুম…তারপর একদিন, মানে, এক শেষ বিকেলে…

    কী?

    কুসুম চোখ তুলে শুধিয়েছিলেন।

    আকাশ খুব কালো করে এল। মোরব্বখেতে ঘন ঘন তিতির ডাকছিল। আমি কী জানতাম নাকি যে, ওই ঝোঁপগুলোর নাম ‘মোরব্বা’ আর ওই পাখিগুলোর নাম ‘তিতির’? প্রসাদ-ই চিনিয়ে দিল। তারপরেই কী বৃষ্টি যে, নামল। কিন্তু অঝোরধারে কিছুক্ষণ ঝরেই থেমে গেল। বিহারের বৃষ্টি তো! আমি আর ও বারান্দাতে বসেছিলাম। রোদ্দুরে-পোড়া মাটিতে প্রথম বৃষ্টির জল পড়ায় ‘সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠে ভেসে যাচ্ছিল বাতাসে, তারসঙ্গে নানা ফুল-পাতার গায়ের গন্ধও। তারপর হঠাৎ-ই প্রসাদ গান ধরল নীচু গলায়। আশ্চর্য! এখনও ওর গলা শুনলে মনে হয় যেন ও যুবক-ই আছে। এমন-ই তারুণ্যের দীপ্তি ওর গলাতে।

    তারওপরে হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যাওয়াতে শিরীষ বললেন, মনে আছে, বহরমপুরে তোমরা দু-জনে প্রতিশনিবার বটুকবাবুদের লালদিঘির পারের বাড়িতে গান গাইতে? রিমি, শান্তি, মৃগেনরাও সব আসত।

    আঃ, কী গান? কী গান গাইল সেটা বলো-না?

    আরে আমি আবার গান-টান জানি নাকি? আমার মনে থাকে না। গান-টান তোমাদের ব্যাপার।

    কুসুম শিরীষের চোখে চোখ রেখে, কেটে কেটে অতীত রোমন্থন করে বলেছিলেন, আমার মা ছোটোবেলা থেকেই বলতেন, দেখ কুসুম! সব সময়েই মনে রাখবি যে, আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। উচ্চবিত্ত এবং অত্যন্ত নিম্নবিত্তদের সমাজে সবকিছুই মানিয়ে যায়। আমরা এই দুই আর্থিক শ্রেণির মধ্যে জাঁতাকলে-পড়া ইঁদুরের-ই মতন আটকে আছি। আমাদের বাড়িতে চাল-ডাল না থাকলেও ছেঁড়া শাড়ি পরে বাইরে যাওয়া বারণ। সবতাতেই আমাদের বারণ।

    একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, ওঁর গলার স্বর গাঢ় হয়ে এল, মা বলতেন, এই জীবনে, যত বেশি ভুলতে পারবি কুসুম, তোর সংসার ততই সুন্দর হবে।

    তারপর শিরীষের দিকে ফিরে বললেন, যাই বলো আর তাই বলো, আমরা এই মধ্যবিত্তরা অধিকাংশই কিন্তু ভন্ড। জানি না, তুমি স্বীকার করবে কি না!

    ধ্যাৎ।

    বিরক্ত হলেন শিরীষ।

    বললেন, আমি কী বললাম আর তুমি কী বুঝলে। বড়ো হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা বলো তুমি আজকাল। আর বড়ো তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গান্তরেও চলে যাও।

    চিরদিন-ই বলতাম। তুমিই কোনোদিন বুঝতে পারোনি। তেমন করে শোনোওনি হয়তো।

    তারপরেই বললেন, তা গানটা কী গাইল, মানে কোন গান, তা-ই তো বললে না।

    আরে ওই তো। সব গান-ই তো সমান। বিশেষ করে তোমাদের রবীন্দ্রসংগীত।

    তা বটে! রবীন্দ্রনাথের গানকে অপমান করতে এখন কত নতুন নতুন অবতারের আবির্ভাব ঘটেছে। এইচ-এম-ভি’-র রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেটের বিজ্ঞাপন দ্যাখো-না? সেই মহাজনেরা কেটে-হেঁটে টেনেটুনে রবীন্দ্রনাথের সব গানকে ‘সাইজ করে দিয়েছেন, তোমাকে আর তাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে দলভারী করতে হবে না। কত রথী-মহারথী গায়ক।

    সেইসব গায়কেরা কারা?

    নাম বলে কী হবে? তুমি কাকেই বা চেনো? গানটা কী গাইলে তোমার বন্ধু, বলবে কি দয়া করে?

    কুসুম বিরক্তির গলাতে বললেন।

    ওই যে! আরে, দাঁড়াও মনে করি।

    অনেক কষ্টে গানটি মনে করে ফেলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন শিরীষ। ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলার-ই মতন হঠাৎ গলা তুলে বললেন, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে।

    কী গান?

    ও গান গাসনে গাসনে…

    কুসুম মনে মনে না গেয়েই গাইলেন গানটা!

    ও গান আর গাস নে, গাস নে, গাস নে।

    যে দিন গিয়েছে সে আর ফিরিবে না—

    তবে ও গান গাস নে।

    হৃদয়ে যে কথা লুকানো রয়েছে সে আর জাগাস নে।।

    ভাবছিলেন কুসুম, ভুলেই গেছেন একেবারেই যে, তাঁরও একদিন যৌবন ছিল, অতীত বলে কিছু একটা ছিল। দাম্পত্যর অভ্যেসের বাইরেও একটি প্রেম ছিল। ভাগ্যিস শিরীষ তাঁর বন্ধু প্রসাদের কাছে গিয়েছিলেন! নইলে…। কুসুম তো ভুলেই গিয়েছিলেন যে, একদিন তিনিও মোটামুটি ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। শিরীষের মা ও কাকিমা তাঁর রূপ দেখে যত-না পছন্দ করেছিলেন কুসুমকে, তাঁর গান শুনে পছন্দ করেছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি।

    কুসুম ভাবছিলেন, আজ বড়োই বিস্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি, বন্ধুর কাছ থেকে ফিরে-আসা শিরীষের ঝুমরি-তিলাইয়ার গল্প শুনে।

    আকাশে মেঘ ঘনাচ্ছে। কলকাতাতেও বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে আজ। হলেও কী! বেরসিক শিরীষের মুখে ঝুমরি-তিলাইয়ার বৃষ্টির যে-বর্ণনা শুনলেন তাতে, মন বড় উদাস হয়ে গেছে কুসুমের। কলকাতায় বৃষ্টি তো তেমন হবে না। এখানে মোরব্বা-খেত নেই, তিতিরপাখিরা ডাকবে না এখানে, পোড়া লালমাটিতে প্রথম বৃষ্টির জল পড়ে সোঁদা গন্ধ উঠবে না, বৃষ্টিশেষে নানা ফুল ও পাতার গন্ধ বয়ে নিয়ে হাওয়াটাও ছুটোছুটি করবে না। এখানে কিছুই নেই।

    প্রসাদ তো নেই-ই!

    .

    ০২.

    কুসুম আর শিরীষের একমাত্র মেয়ে সল্লির বিয়ে হয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর হল।

    অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বামী। নিজেও একটা স্কুলে পড়াতেন। ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আর তেমন কিছুই করেন না। জীবনময় অবসর-ই থাকার কথা ছিল কুসুমের। কিন্তু এখন অন্য সবকিছুই কম কম হলেও, আছে। শুধু অবসর-ই নেই। আজ শিরীষ পেনশন তুলতে গেছেন। প্রতিমাসের প্রথমেই যেতে হয়।

    এমনিতে প্রতিদিনই দুপুর দুটোর পরেই একটু অবসর পান কুসুম। দুটো থেকে চারটে। ঠিক চারটেতে উঠে শিরীষকে চা করে দিতে হয়। আজ অবশ্য করতে হবে না কারণ শিরীষের ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। ও-পাড়াতে গেলে পুরোনো অফিসে, একবার ঘুরে আসেন, এর ঘর তার ঘরে একটু আড্ডা মেরে চা খেয়ে অবসরপ্রাপ্ত জীবনের একঘেয়েমি আর অনন্ত অবসরকে ভুলে থাকেন কিছুক্ষণ।

    দুপুর দুটো থেকে চারটে। এই দুটি ঘণ্টাও কুসুম যে, ঘুমোন তা নয়। তিনি ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত সাহিত্যমনস্ক। যে-গভীর আনন্দ তিনি সাহিত্য পড়ে পান, সে উপন্যাস বা গল্প সংকলন-ই হোক, কী মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা অথবা পাক্ষিক, তা অন্য দশজন মহিলার মতো টিভি দেখে বা পরনিন্দা-পরচর্চা করে কখনো পাননি।

    ‘দেশ’ পড়ছেন, তিনি যখন পনেরো বছরের মেয়ে তখন থেকেই। বিয়ের পরও দেখেছেন শ্বশুরবাড়িতে শিরীষদের তিনভাই এবং বাবা-মাও সাহিত্যমনস্ক। তাঁরা ‘দেশ’, পরিচয়, অমৃত’, নবকল্লোল’ ইত্যাদি রাখতেন। অনুষ্টুপ, বিভাব, প্রমা, ধ্রুবপদ ইত্যাদি কিছু ভালো লিটল ম্যাগও রাখতেন। তবে ‘দেশ’-এর আলাদা দাম ছিল। কিন্তু বছর দশেক আগে থেকেই হঠাৎ-ই ‘দেশ’-এর চরিত্রই বদলে গেল। বিজ্ঞাপনবহুল এবং প্রায় ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ সংস্কৃতির একটি কাগজ হয়ে উঠল। ওই পাক্ষিক পত্রিকার জন্যে, মাসে ত্রিশ টাকা নষ্ট করার মতন সামর্থ্য আজ অবসরপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁদের আর নেই। দেশ’ বন্ধ করে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন প্রতিপক্ষর গোড়াতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কাগজওয়ালাকে বলতেই হয় যে, কাল একটা ‘দেশ’ দিয়ে যেয়ো। একেই বোধ হয় বলে, Old habits die hard।

    শিরীষ অবসর নিয়েছেন আজ চার বছর হয়ে গেল। চাকরির শেষদিকে অধ্যাপনা করতেন কলকাতার-ই একটি কলেজে। রিটায়ার করার আগেই তাঁদের একমাত্র মেয়ে সল্লির বিয়ে দিয়ে, যা-সামান্য সঞ্চয়, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড এবং গ্র্যাচুইটি জমেছিল তার সিংহভাগ-ই খরচ করে ফেলেছেন। এখন যতটুকু বাকি আছে, তার-ই সুদে সংসার চলে। পেনশনেও। বছরে অবশ্য একটি করে পাঠ্যপুস্তক লেখেন শিরীষ সারাবছর পরিশ্রম করে। খররৌদ্রে ছাতা হাতে ভবানীপুরের এই ছায়াচ্ছন্ন গলির জরাজীর্ণ ভাড়া-বাড়ি থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যেতে হয় অনেকদিন-ই। ফাঁকি’তে তিনি কোনোদিনও বিশ্বাস করেননি। তবে রয়্যালটি-টয়্যালটি পান না তেমন কিছু। হিসেব-টিসেবও নয়। যা দেন, প্রকাশক শিরীষকে তা একবার-ই দেন। থোক। তাতে যেন একটু দয়ার গন্ধও থাকে। তবে, তা দিয়ে পুজো আর নববর্ষের দেওয়া থোওয়াটা হয়ে যায়, নিজেদের বিছানার চাদর, বেডকভার, পাপোশ, তাঁর গোটা চারেক শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ, শিরীষের দু-জোড়া করে গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পায়জামা। আরও রোজগার শিরীষ সহজেই করতে পারতেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক অধ্যাপক-ই কোচিং ক্লাস করে বাড়ি-গাড়িও করে ফেলেছেন। কিন্তু শিরীষ বলেন, অবসর নিয়েছি মানে অবসর-ই নিয়েছি। টাকার প্রয়োজন কোনোদিনও মিটবে না। জীবিকার জন্যে জীবন তো নয়, জীবনের জন্যেই জীবিকা। একেবারে শান্ত, নিরুপদ্রব জীবন কাটাব। কষ্ট একটু হবে, তা হোক।

    এখন তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো আনন্দ, সবচেয়ে বড়ো অবলম্বন, তাঁদের মেয়ে সল্লি আর জামাই বাজ-এর একমাত্র সন্তান, তাদের নাতনি জলপিপি। আসলের চেয়ে সুদ বড়ো –একথাটি শুনে এসেছিলেন ছোটোবেলা থেকে কিন্তু কথাটি যে, এতখানি সত্যি তা জানতেন না। চার বছর বয়স এখন জলপিপির। সল্লি একহাতে সংসার সামলাতে হিমসিম খায়। যদিও একটি কাজের মেয়ে আছে। হাসি। সমস্তক্ষণ-ই খাটে। কিন্তু তাঁদের জামাই বাজ তো সপ্তাহের প্রায় পুরোটাই ওয়ার্ক-সাইটেই থাকে। সে ইঞ্জিনিয়ার। তাদের কোম্পানির কী একটা কাজ হচ্ছে, বীরভূমে সিউড়ির কাছে। সিউড়ি-কীর্ণাহার-দুবরাজপুরে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। শনিবার শেষবিকেলে ফিরেই সে, আবার সোমবার ভোরের বাসেই চলে যায়। কখনো-কখনো কোম্পানির গাড়িতেও।

    সল্লিদের গড়পারের ভাড়াবাড়িতে কুসুমের পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব হয় না, এই ভিড়ের বাসে মারামারি করে। শরীরও তো আর আগের মতো শক্ত নেই। তবুও যেতে ইচ্ছে করে খুব-ই। ঘনঘন যেতে পারেন না বলেই ফোন করে নাতনির সঙ্গে কথা বলেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। ভাগ্যিস ফোনটা ছিল। আজকে রিং হতেই জলপিপিই ফোনটা ধরল।

    কুসুম বললেন, কে বলছি বলো তো?

    দানি, দানি, দিদা, আমি দলপিপি বলতি।

    সে তো আমি জানিই! আমার জলপিপি ছাড়া, কার আর গলার স্বর এমন মিষ্টি হবে?

    কুসুম বললেন।

    দানো দিদা, আমাদের দানলার ধারের নিমগাতে একতা কাক-মা, না ডিম পেলেচে। কাকতা কালো কুতকুতে। কিন্তু ডিমতা পর্সা। আবার একতু নীলতে-নীলতে আতে। হাথিদিদি কাপড় কাতার থময়ে থাদা কাপড়ে নীল দিলে, দেমন দেকতে হয়, তেমন। আর দানো, হাথিদিদিকে না, পাথের বালির মদনদাদা বলেতে যে, ওই ডিম ভেঙে ওমলেট ভেদে কাওয়াবে হার্থিদিদিকে। দানো?

    ওমা। তাই?

    কুসুম বললেন, হাসিকে তাই বলেছে বুঝি?

    হ্যাঁ। তো। আমি বলেতি, তা দদি কায় তো আমি কককনো কতা বলব না হাথিদিদির থঙ্গে।

    কিন্তু মদনদাদাটা কে? চিনলাম না তো।

    কুসুম জিজ্ঞেস করলেন।

    ওই দে, পাথের বালির মিনামাসিদের মালুতি গাড়ি তালায়-না, থে! দাইভার। ও-ও বুঝেছি। এমন সময়ে জলপিপির মা সল্লি কোথা থেকে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, ভারি পাকা মেয়ে তো! কতবার বলেছি না, তুমি ফোন ধরবে না। কার সঙ্গে এত গল্প হচ্ছে? আমার ফোন তো, আমাকে ডেকে দিতে পারো না? হাসিদিদিই বা গেল কোথায়?

    বাঃ লেঃ! তোমাল ফোন কোতায়? দিদা আমাল থঙ্গেই কতা বলতিল।

    কুসুম সল্লিকে বকে বললেন, তোকে আমার দরকার নেই, ওকে দে। একটু ওর গলার স্বর শোনার জন্যেই বুকটা উথাল-পাতাল করে। বিশ্বাস করবি না সল্লি, জলপিপিই এখন আমাদের জীবনের একমাত্র আনন্দ। তোর তো বাজ আছে, যৌবন আছে, এখন হাসবি, খেলবি, মজা করবি কতরকম। কিন্তু আমাদের ওই নাতনিটি ছাড়া কে আর কীই বা আছে বল! তোর বাবার মতন সর্বক্ষণ লেখাপড়া করা গুরুগম্ভীর মানুষেরও দিনে-রাতে চারবার জলপিপির খোঁজ না নিলে চলে না। নতুন লিচু উঠেছে। বলছিলেন যে, জলপিপির জন্যে লিচু নিয়ে যাবেন। আর তার জামাই বাজ সিঁদুরে আম খেতে ভালোবাসে, তার জন্যে সিঁদুরে আমও শিগগির নিয়ে যাবেন একদিন।

    তোমরা কেমন আছ বলা মা? বাবাকে চোখের ডাক্তার কী বললেন? গ্লকোমা-টুকোমা হয়নি তো?

    সল্লি কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল মাকে।

    না, না। সেসব কিছু হয়নি। আমাদের আবার থাকা-না-থাকা। বাজ কেমন আছে? এই বর্ষার পচা গরমে সিউড়িতে কত কষ্টই না করতে হয় বেচারাকে। নাকি এখন দুবরাজপুরে আছে? ইঞ্জিনিয়ার জামাই চেয়েছিলাম, তা তুই তো ভালোবাসলি ইঞ্জিনিয়রকেই, সম্বন্ধও তো করতে হল না কিন্তু সিউড়ি-দুবরাজপুর–দুবরাজপুর-সিউড়ি করে করে ছেলেটার শরীরে যেন, কালি ঢেলে দিয়েছে। আহা! এবারে তো জামাইষষ্ঠীতেও আসতে পারবে না বলল। কীরকম কাজ জানি না বাবা।

    শাশুড়িদের চোখ-ই অমন মা। আর জামাইমাত্রর-ই শরীর যেন, ননির-ই শরীর। ভোরের রোদ লাগলেও গলে যায়।

    কুসুমের গলাতে বিরক্তি ঝরল। বললেন, মোটেই তা নয়। আমাদের জামাই তো আর অন্যদের মতন নয়। সাক্ষাৎ কন্দর্প। ওইরকম ফর্সা রং ক-জন বাঙালির আছে?

    তারপর বললেন, উইক-এণ্ডে যখন আসে তখন, ভালো করে যত্ন-আত্তি, খাওয়ানো টাওয়ানো, আদর-টাদর করিস তো?

    সল্লি চুপ করে রইল। জবাব দিল না কোনো কথার।

    কী রে?

    হুঁ

    তোর বাবা তো ঝুমরি-তিলাইয়াতে তোর প্রসাদকাকার কাছে গিয়ে ক-দিন খুব মজা করে এল।

    কবে ফিরল বাবা?

    গতকাল। এ-সপ্তাহে বাজ যদি আসে, তোরা দু-জনে জলপিপিকে নিয়ে এই শনিবার রাতেই আয়। দুপুরে পটলপোস্ত করব, কাঁচা কলাই-এর ডাল, বাজ ভালোবাসে। আর জলপিপির জন্যে পটল ভাজা, আর বাজ-এর জন্যে কুমড়োফুল ভাজা। ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসিস তুই, তাও করব পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা-কালোজিরে দিয়ে। মাখা-মাখা করে। আসবি তো? বিকেল বিকেল-ই চলে আসিস। আর রাতে ময়দা করব। খুরশেদ-এর দোকানের কচি পাঁঠার কষা মাংস, লুচি আর পায়েস।

    তারপরেই বললেন, জলপিপিকে তো দু-একদিন আমাদের কাছে রেখেও যেতে পারিস। নাকি, দাদু-দিদার কাছে দু-একদিন থাকলেই মেয়ে অমানুষ হয়ে যাবে, ইংরেজি বলার অভ্যেস চলে যাবে, কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের আন্টি বিরক্ত হবেন।

    তারপর-ই স্বগতোক্তির মতন বললেন, কী জানি বাবা! আমাদের ছেলেমেয়েরা তো আর মানুষ হয়নি।

    সল্লি চুপ করেই রইল ফোনের ও-প্রান্তে।

    কী রে? কথা বলছিস না যে!

    দেখি মা, ও যদি আসে।

    ও মানে?

    মানে, তোমার জামাই।

    মানে? তোর কথার মানে বুঝলাম না। যদি আসে’ মানে কী? ও কি, আজকাল সপ্তাহান্তেও আসছে না নাকি?

    গত তিনসপ্তাহ তো আসেনি।

    সে কী রে? অসুখ-বিসুখ করেনি তো? খোঁজ নিয়েছিস? ফোন করেছিলি? কত যেন কোড নাম্বারটা 03642? তাইনা?

    হুঁ।

    তুই না করে থাকলে আমিই করব। ভালো আছে তো? সে-খবরটা পেয়েছিস?

    হ্যাঁ।

    তবে আসছে না কেন?

    কাজ পড়ে গেছে।

    কী এমন কাজ থাকে যে, এত আদরের, ভালোবাসার, সুন্দরী যুবতী স্ত্রী আর চার বছরের সোনামণি মেয়েকে শনি-রবিবারেও দেখে যেতে, মন চায় না কাজ ফেলে?

    থাকে মা। কতরকম কাজ থাকে। ও-ই তো প্রোজেক্ট-ম্যানেজার কিনা!

    তা তো জানিই। তোর কথাও তো ভাবব। আমারও তো একদিন তোর বয়স ছিল! হেলিকপ্টার তো আর আমাকে এই প্রৌঢ়ত্বের বারাণসীতে আচমকা নামিয়ে দিয়ে যায়নি! কী ভাবিস তোরা? সত্যি!

    তারপর-ই বললেন, আমি তোর বাবাকে বলছি–আজ-ই রাতে বাজকে ফোন করবে দুবরাজপুরে। নাকি সিউড়িতেই আছে এখন? রাতে তো কোয়ার্টারে থাকবেই?

    না মা। পয়সা নষ্ট কোরো না।

    মানে?

    মানে, কোয়ার্টারে হয়তো পাবে না তাকে! যদি-বা থাকেও তবুও কোরো না।

    তোর এই হেঁয়ালি-হেঁয়ালি কথার কোনো মানে বুঝছি না।

    মাথাটা হঠাৎ-ই ঘুরে গেল কুসুমের।

    হেঁয়ালি কোথায় দেখলে এরমধ্যে? এ তো অফিসের হোয়াইট-কলার্ড কাজ নয় মা! কত রাত কোয়ার্টারেই ফিরতে পারে না।

    কিন্তু সে-খবরটা তো রাখা দরকার। তুইও জানিস না?

    না। জেনে আমার দরকার নেই। বেশি ঔৎসুক্য আর অভব্যতা তো এক-ই। তুমিই না শিখিয়েছিলে?

    আশ্চর্য! তবে কে জানে?

    তাও বলতে পারব না। আমি ভাবছি, আগামী শনিবারে নিজেই একবার যাব, জলপিপিকে তোমাদের কাছে রেখে।

    তুই কী যাবি? একা যুবতী মেয়ে, ওয়ার্ক-সাইটে। কুলি-মজুর, ধুলো-বালি। তোর বাবাকেই পাঠাব।

    তারপরে কী ভেবে বললেন, তুইও তো একাই থাকিস। তেমন বুঝলে এসে থাকিস এখানে মেয়েকে নিয়ে। নইলে, আমিই বাসা বন্ধ করে গিয়ে, তোর ওখানে থাকব এখন। তোর বাবা গিয়ে থাকবেন না-হয়, ক-দিন কাকার বাড়িতে।

    তা হয় না মা।

    কেন? হয় না কেন?

    আঃ! পিপির স্কুল নেই। এ-বছরেই তো অ্যাডমিশন টেস্ট। আগামী শুক্রবার ক্লাস হয়ে স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভরতি হতে না পারলে তো জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।

    কুসুম ভাবছিল, জীবন সার্থক হওয়ার সঙ্গে ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলের সম্পর্ক যে, কতটুকু সে-সম্বন্ধে গভীর সংশয় আছে। আসলে সল্লিরা, এই স্বাধীনোত্তর ভারতের মানুষেরা সম্ভবত জীবন আর জীবিকা গুলিয়ে ফেলেছে।

    পরক্ষণেই সল্লি গম্ভীর গলাতে বলল, মা।

    কুসুমের বুকের মধ্যেটা যেন, কেমন করে উঠল। স্কুলের ছাত্রী সল্লি পরীক্ষা খারাপ দিয়ে এসে স্কুল থেকে ফিরে যেমন করে ‘মা’ ডাক ডাকত, তার ভরসাস্থল মাকে, আশ্রয়দাত্রী মাকে, বহুবছর পর তেমন করেই যেন ডাকল, সে তার মাকে। ছেলে-মেয়েরা ছোটো থেকে বড়ো হয়, কিন্তু মা যুবতীই হন কী বৃদ্ধা, চিরদিন মা-ই থেকে যান। যতদিন বাঁচেন।

    কী?

    তোমরা তো আমাকে সম্বন্ধ করে বিয়ে দাওনি। আমার পছন্দ মতন-ই তো আমি বিয়ে করেছিলাম। আমার বিয়ে দিলে, কত জিনিসপত্র, গয়নাগাটি দিয়ে। তোমার সব গয়নাই তো দিয়ে দিয়েছিলে আমাকে। কতবার মানা করলাম, শুনলে না। লোক-খাওয়াতেই বাবার জীবনের সব সঞ্চয়শেষ করে ফেললে তোমরা। বাবা বলল, প্রত্যেকের আশীর্বাদ চাই। নইলে জীবনে সুখী হবি কী করে! হুঁঃ! যাদের খাওয়ালে, কত যেন, শুভার্থী তারা! আঁচাতে না আঁচাতেই তো নিন্দে করতে করতে গেল। তোমাদের যা করার সব-ই করেছ। এখন এ বিয়ের ভালো-মন্দ আমাকেই বুঝতে দাও।

    বাজেকথা বলিস না।

    কুসুম অত্যন্ত ভীত, নীচু গলায় বললেন।

    পরক্ষণেই ভয়টা উত্তেজনা হয়ে গেল। গলা চড়িয়ে বললেন, আমরা এখনও মরে যাইনি। তা ছাড়া, তুই নিশ্চয়ই বাজে ভাবনা ভাবছিস। আসলে আজকাল বাজ-এর মতন ছেলেই হয় না। আমরা সম্বন্ধ করে দিলেও কি অমন ছেলে পেতাম রে? তোর নজরটাই আলাদা। ছেলেবেলা থেকেই। হিরের টুকরো ছেলে সে। দেখ, কাজে এমন আটকে পড়েছে–রাত কাটাচ্ছে হয়তো সাইটেই–বিরাট বিরাট যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ তাদের। ‘রিগ’ না কী বলে যেন?

    হুঁঃ। যতই কাজ থাকুক একটা ফোনও কী করতে পারত না? কারোকে পাঠাতেও কী পারত না? আজকালকার ছেলেরা পুরোনো দিনের ছেলেদের চেয়ে অনেক-ই অন্যরকম। তুমি বলে সবসময়ে বাজ-এর প্রশংসা করো। আসলে তুমি জানো না মা, তারা কতখানি অন্যরকম। ভালোই হোক, কী মন্দ!

    তোকে কাজের চাপেই মনে পড়ে না। না-হয় মেনেই নিলাম যে, তোকে তার আর ভালোও লাগে না। কিন্তু পিপিকেও কী মনে পড়ে না? এমন পাথর কী কেউ হতে পারে? যত্তসব আজেবাজে ভাবনা ভাবছিস তুই। তিলকে তাল করছিস।

    একটু চুপ করে সল্লি বলল, আমি নানাজনের কাছ থেকে নানাকথা শুনতে পাচ্ছি মা।

    সেই নানাজনেরা কারা?

    এই যেমন নীলকমল। ওর কলিগ। ও তো কলকাতার অফিসেই আছে। প্রায়-ই খোঁজখবর করে। ওদিকের খবর আমাকে দেয়। আমাদের খবর ওদিকে পাঠায়। ওদের অফিসে ফ্যাক্স মেশিন আছে তো সুবিধে খুব-ই।

    তা, নীলকমল কী বলেছে তোকে?

    সে-কথা থাক মা।

    ওই ছেলেটা ভালো নয়।

    কুসুম বললেন।

    কে?

    ওই নীলকমল। তোর ওপর ওর খারাপ নজর আছে। আমি যেদিন ওকে, প্রথমবার দেখি সেদিন ওর চোখের দৃষ্টি থেকেই বুঝেছিলাম।

    হয়তো আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসাটা কি খারাপ নজর মা?

    না তো কী? ভালোবাসতে হয় তো নিজে বিয়ে করে নিজের বউকেই ভালোবাসুক। তার ই হাতের রান্না খেয়ে তারিফ করুক। তোর কাছে ‘হ্যাংলামি’ করতে আসে কেন? বিশেষ করে, যখন বাজ কলকাতাতে থাকে না?

    তারপর একটু চুপ করে থেকে উত্মার সঙ্গে বললেন, হুঁভালোবাসা! পুরুষের ভালোবাসার রকম আমাকে তোর কাছ থেকে শিখতে হবে না।

    একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সল্লি বলল, মা, কার কাছে কে কেন আসে, কাকে কার কেন ভালো লাগে, তা বোঝা কি অতসহজ? কেন ভালো লাগে না বোঝাও যেমন সহজ নয়, কেন ভালো লাগে, তা বোঝাও নয়।

    কথা তো অনেক-ই শিখেছিস। আমি তোর পেটে হয়েছি, না তুই আমার পেটে? অবাক করলি! তোর মতো অত কি আমি বুঝি?

    কী যে, বলো মা! তোমার জামাই-ই তো নীলকমলকে পাঠায় আমাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্যে। এই তো সেদিন বাজ-এর জন্যে তোমার পাঠানো কুলের আচার নিয়ে গেল। আর এক দিন, থোকার ডালনা বেঁধেছিলাম, নিজেই আগ্রহ করে টিফিন-ক্যারিয়ারে করে সবটুকু নিয়ে গেল। বলল, ফতে সিং ড্রাইভার আজ-ই বেরোবে গাড়ি নিয়ে একটু পরে। নতুন করে গরম করে আমার হট-কেস-এ করে পাঠিয়ে দেব। রাতে বাজ, গরম গরম খেতে পারবে ভাত দিয়ে। তুমি আবার বেঁধে নিয়ো সল্লি।

    যেদিন রাঁধব সেদিন, আপনাকেও খবর দেব। আপনি খাবেন এসে।

    আমি বলেছিলাম।

    নীলকমল উত্তরে কী বলেছিল, জান?

    বলেছিল, অত বাড়াবাড়ি কোরো না। দূরে দূরে থাকাই ভালো। সর্দি লাগার মতন কখন যে, প্রেম হয়ে যায় কার সঙ্গে কার, কেউই বলতে পারে না।

    তাতে কী? ধোকা খেতেই তো আসবেন। ধোঁকা খেতে তো নয়।

    আমি বলেছিলাম।

    নীলকমল তার উত্তরে কী বলেছিল, তা তার মাকে আর বলল না সল্লি, কিন্তু মনে পড়ে গেল ঠিক-ই।

    নীলকমল বলেছিল, না না, সেজন্য নয়। তোমার সঙ্গে খুব-ই কম মিশেছি বলেই, তোমার উজ্জ্বল চোখের একটুখানি চাওয়া, তোমার গলার স্বরের গাঢ়তা, চান-করে ওঠা সমস্ত ‘তুমি’র সুগন্ধ-ফুলেল তেল-মাখা ভেজা চুল, পাউডার, পারফিউম, পাট-ভাঙা শাড়ির। খসখসানির শব্দ সব মিলেমিশে আমাকে খুবই দুর্বল করে দেয়। বিশ্বাস করো। বড়োই দুর্বল করে দেয়। বাজ যে আমার বন্ধু, সে যে, আমাকে বিশ্বাস করে।

    ভারি সুন্দর কথা বলে নীলকমল। তাই চাই না যেতে।

    নীলকমল ওকে বলে যে, একা একা, মানে যখন বাজ না থাকে, তখন আমাদের দেখা না হওয়াই ভালো। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বড়দাদা টিউশনি করে অনেক কষ্টে আমাকে ইঞ্জিনিয়ার করেছেন, দিদির বিয়ে দিয়েছেন, রুমি আমার ছোটোবোন, তাকে তো তুমি দেখেইছ, তার বিয়ে দিতে হবে আমায়, তারপর দাদারও একটা বিয়ে জোর করেই। এই হচ্ছে নীলকমল ঘোষের ভবিষ্যতের ছক। অতিসাদামাটা ডাহুক-ডাকা কচুরিপানার ফুল আর সজনে গাছের ছায়ার জীবন আমার। সেখানে সোনালি সল্লি হাঁসকে আটানো যাবে না। তোমার সঙ্গে আমার হঠাৎ প্রেম হয়ে গেলে সে ভীষণ-ই অন্যায় হবে।

    তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সল্লি বলেছিল, তার মা কুসুমকে—

    নীলকমল বলেছিল, জানো সল্লি মধ্যবিত্তর বিবেক পাড়ার দিশি কুকুরদের মতন। বেপাড়ার কুকুর তো ছাড়, পাড়ার বেড়াল দেখলেও হল্লা তোলে বুকের ভেতর। চিৎকারে চিৎকারে পাড়া মাত করে দেয়। আমার কোনো লাভ হবে না, উলটে ক্ষতি হবে তোমার-ই। আমি যা বলি তাই শুনবে। ফোনেই খবরাখবর দেবে-নেবে। আমার সঙ্গে তুমি ভালো ব্যবহারও কোরো না কখনো। অধিকাংশ পুরষেরাই বড়ো বোকা। ভালো ব্যবহারকেই ‘ভালোবাসা’ বলে ভুল করে ফেলে তারা। বিশেষ করে আমার মতন, মেয়েদের সঙ্গে যারা বেশি মেশার সুযোগ পায়নি।

    এই হঠাৎ প্রেম’ কথাটা নীলকমলের মুখে প্রথমবার শুনে হাসি পেয়েছিল সল্লির। প্রেম তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে হঠাৎ-ই হয়ে যায়। ধীরে ধীরেও যে, হয় না, তা নয়। তবে হঠাৎ প্রেমের অভিঘাত-ই আলাদা। তারমধ্যে কোনো হিসেব নেই, অঙ্ক নেই। সে বড়ো সর্বনেশে প্রেম। বাজ-এর সঙ্গেও তো তার হঠাৎ-প্রেমই হয়েছিল। মা-বাবার কোনো বারণ তো সে শোনেনি! কুসুম চুপ করে তাঁর একমাত্র সন্তান সল্লির একটানা কথা শুনতে শুনতে খুব-ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। নীলকমলের কথা বলতে গিয়ে সল্লির কণ্ঠস্বরে যে, উষ্ণ উচ্ছ্বাস লক্ষ করলেন তা তাঁর মোটেই ভালো লাগল না।

    কুসুম বললেন, তোরা বড়ো হয়েছিস। আমাদের চেয়েও বেশি বুঝিস এখন। আমি আর কী বলব। ওই নীলকমল যেমন করে কথা বলে, মানে, তোর কাছে যা-শুনলাম, তাতে তো মনে হয় যে, নাটক-টাটক করে। কবিতা লেখে নাকি? এই কথার জালেই তো তুই অজানিতে জড়িয়ে যাবি। এ আবার কী? বিবাহিতা মেয়ে, মেয়ের মা, এখনও এত প্রেম প্রেম। বাতিক কীসের? তোদের মতি বোঝা ভার। বিয়েও তো করলি বাজকে ভালোবেসেই। তোদের ভালোবাসা তো নয়, মুসলমানের ‘মুরগি পোষা।

    সল্লি বলল, বেচারা! না, না, নীলকমল ভারি ভালো ছেলে। ওকে কোনোরকম দোষ দিয়ো না।

    ফোনটা ছেড়ে দিয়ে বিছানাতে এসে শুলেন কুসুম। শিরীষ বাড়িতে নেই। থাকলেও কিছু বলতেন না কুসুম শিরীষকে। অধিকাংশ পুরুষ-ই এসব ব্যাপারে মাথা-মোটা। খামোকা হই চই বাধাবেন। কাজ করতে গিয়ে অকাজ করবেন। শুয়ে শুয়ে অনেক কথাই ভাবছিলেন কুসুম।

    আজকে সল্লির কাছে নীলকমল ভালো তো হবেই। ক-বছর আগে বাজ যেমন, ভালো ছিল। ওঃ কী ভালো কী ভালো! অমন ভালো আর হয়-ই না। মেয়ে একেবারে পাগল ছিল তার জন্যে। ভালো থাকলেই ভালো। ভালো যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন-ই ভালোত্ব খারাপত্বর পরীক্ষা আসে।

    কেন জানেন না, তাঁর মেয়ের মুখে নীলকমলের কথা শুনে কুসুমের প্রসাদের কথা মনে আসতে লাগল ভিড় করে। কত কথা। শিরীষ কতটুকুই বা জানে। ভালোবাসা ব্যাপারটা যে, কী? সে-সম্বন্ধে শিরীষের কোনো ধারণাই নেই। ভালোবাসার চেয়ে মোগল পিরিয়ডের ইতিহাস অনেক-ইভালো বোঝেন শিরীষ। সত্যি। সংসারে কতরকম মানুষ-ই থাকেন। অথচ তাঁর স্বামী শিরীষ মানুষটি অতিভালো। এত ভালো না হয়ে একটু খারাপ হলে মানুষটি অনেক-ই বেশি ইন্টারেস্টিং হতেন হয়তো। স্ত্রীকে শিরীষ আজীবন ভালোবেসে এসেছেন তাঁর সর্বস্ব দিয়ে। ভালোবাসার সংজ্ঞাই আলাদা। একজনের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্যজনের সংজ্ঞা মেলে বলেই যত গোলমাল। গোল বাধে এই সংসারে। শিরীষের ভালোবাসা একটি সরলরেখার মতন। উঠোনে কাঁচা-কাপড় শুকোতে দেওয়ার বাঁশের-ই মতন। তাতে কাঁচা-পায়জামাও যেমন ঝোলে, ঝোলে শায়া-সালোয়ার কামিজ, তেমন তার ওপরে, কখনো আবার কারো এসে বসে, পচা মাছের কানকো-ঠোকরানো ঠোঁট তাতে ঘষে ঘষে ধার তোলে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপুষ্পমঞ্জরি – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article পাখসাট – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }