Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস – বার্ট্রান্ড রাসেল

    বার্ট্রান্ড রাসেল এক পাতা গল্প493 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৯. আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যা

    ১৯. আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যা

    গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো দার্শনিকের লেখা পড়তে হলে, বিশেষ করে আরিস্ততেলেসের লেখা পড়তে হলে সেটা দুভাবে অনুধ্যান করা প্রয়োজন ও তাঁর পূর্বসূরি ও তাঁর উত্তরসূরি- উভয়সাপেক্ষ। প্রথমদের দিক থেকে বিচারে আরিস্ততেলেসের গুণাবলি সুবিশাল এবং পরবর্তীদের দিক থেকে বিচারে তার দোষগুলো একইরকম সুবিশাল। অবশ্য দোষের জন্য তাঁর চাইতে তাঁর উত্তরসূরিদের দায়িত্বই বেশি। তার আবির্ভাব গ্রিক চিন্তাধারার সৃজনশীল যুগের শেষ পর্যায়ে এবং তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় দুহাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেননি যাকে তাঁর সমকক্ষ বলা যেতে পারে। এই সুদীর্ঘ যুগের শেষে তাঁর কর্তৃত্ব প্রায় চার্চের মতো প্রশ্নাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং বিজ্ঞান ও দর্শনে সেই কর্তৃত্ব প্রগতির পথে একটা গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক প্রগতিকে শুরু করতে হয়েছিল আরিস্ততেলেসের কোনো মতবাদকে আক্রমণ করে। যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে আজও এটা সত্যি। কিন্তু তাঁর কোনো পূর্বসূরি (হয়তো দেমক্রিতস বাদে) যদি একই রকম কর্তৃত্ব লাভ করতেন তাহলে সর্বনাশও একইরকম ঘটত। তাঁর সম্পর্কে সুবিচার করতে গেলে প্রথমে আমাদের তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী অতিরিক্ত খ্যাতিকে ভুলতে হবে এবং একইরকমভাবে ভুলতে হবে পরবর্তী অতিরিক্ত নিন্দাকে।

    থ্রাকি (Thrace)-র স্ট্যাগিরা (Stagira)-তে আরিস্ততেলেসের জন্ম, বোধহয় ৩৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তাঁর বাবা মাকেনিয়ার রাজার পারিবারিক চিকিৎসকের পদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। প্রায় আঠারো বছর বয়সে আরিস্ততেলেস আথিনাতে আসেন এবং প্লাতনের ছাত্র হন। ৩৪৮-৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্লাতনের মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় কুড়ি বছর তিনি আকাদেমিতে ছিলেন। এরপর কিছুকাল তিনি ভ্রমণ করেন এবং হারমিয়াস (Hermias) নামে একজন স্বৈরাচারীর হয় ভগিনী কিংবা নিস (niece-মামাতো, খুড়তুতো, পিসতুতো ইত্যাদি বোন)-কে বিবাহ করেন। (অপবাদ ছিল মেয়েটি হারিমিয়াসের কন্যা কিংবা রক্ষিতা ছিলেন কিন্তু তিনি নপুংসক হওয়ায় দুটি নিন্দাই মিথ্যা প্রমাণিত)। ৩৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি আলেকজান্দ্রসের শিক্ষক হন, তখন আলেকজান্দ্রসের বয়স তেরো বছর, ষোলো বছর পর্যন্ত আরিস্ততেলেস এই পদে ছিলেন। এই সময় আলেকজান্দ্রসের পিতা ছেলেকে প্রাপ্ত বয়স্ক ঘোষণা করলে রাজা ফিলিপ-এর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাজপ্রতিনিধিরূপে তিনি নিযুক্ত হন। আরিস্ততেলেস এবং আলেকজান্দ্রসের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে কৌতূহল নিরসন করা সম্ভব নয়, তাঁর আরও কারণ, শীঘ্র এ ব্যাপারে বহু গল্পকথা আবিষ্কৃত হতে লাগল। তাঁদের পারস্পরিক অনেক চিঠিপত্র পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো সাধারণত জাল বলে ধরে নেওয়া হয়। যারা উভয়েই গুণমুগ্ধ তাদের অনুমান-শিক্ষক ছাত্রকে প্রভাবিত করেছেন। হেগেলের ধারণা, আলেকজান্দ্রসের কর্মজীবন দর্শনশাস্ত্রের ব্যবহারিক কার্যকারিতার একটি উদাহরণ। এ সম্পর্কে এ ডব্লু বেন (A.w. Benn) বলেন : দর্শনশাস্ত্রের যদি আলেকজান্দ্রসের চরিত্রের চাইতে ভালো কিছু দেখানো না থাকে তবে সেটা দুর্ভাগ্যজনক হবে….। উদ্ধত, মদ্যপ, নিষ্ঠুর, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং অত্যন্ত কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষটির মধ্যে পার্বত্য সর্দারের দোষাবলি এবং প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচারী রাজার উন্মাদনায় সমাবেশ ঘটেছিল।

    আলেকজান্দ্রসের চরিত্র সম্পর্কে বেন-এর সঙ্গে আমি একমত, তবে যাই হোক, আমার মনে হয় তার কর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত হিতকর হয়েছিল, কারণ, আলেকজান্দ্রস না হলে গ্রিক সভ্যতার ঐতিহ্য বোধহয় সবটাই নষ্ট হয়ে যেত। তার উপর আরিস্ততেলেসের প্রভাব সম্পর্কে আমরা খুশিমতো অনুমান করতে পারি। আমার মনে হয়, এটা ছিল শূন্য। আলেকজান্দ্রস এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তীব্র হৃদয়বৃত্তিসম্পন্ন বালক ছিলেন, পিতার সঙ্গে যার সম্পর্ক ছিল মন্দ এবং সম্ভবত লেখাপড়া করার ধৈর্য তার ছিল না। আরিস্ততেলেসের চিন্তায় ছিল কোনো রাষ্ট্রেই নাগরিকের সংখ্যা এক লক্ষের অধিক হওয়া উচিত নয় এবং তাঁর শিক্ষা ছিল মধ্য পন্থা (golden mean)। তাঁর ছাত্র তাকে একটা নীরস, বৃদ্ধ পণ্ডিত ছাড়া আর কিছু ভাবতেন বলে আমি কল্পনা করতে পারি না। হয়তো ভাবতেন দুষ্টুমি থেকে দূরে রাখতে বাবা বুড়োটাকে তার ঘাড়ে চাপিয়েছেন। এ কথা সত্যি, আলেকজান্দ্রসের আথিনীয় সভ্যতা সম্পর্কে একটা নাক উঁচু শ্ৰদ্ধার ভাব ছিল তবে তাঁদের গোটা বংশেরই এই ধরনের মনোভাব ছিল-তারা প্রমাণ করতে চাইতেন যে, তারা বর্বর নন। এটা অনেকটা ঊনবিংশ শতাব্দির রুশ অভিজাতদের প্যারিস সম্পর্কে মনোভাবের মতো। সুতরাং এ মনোভাবের জন্য আরিস্ততেলেসের প্রভাবকে দায়ী করা যায় না এবং আলেকজান্দ্রসের ভিতরে অন্য আর কিছু এই উৎস থেকে এসেছিল বলে কিন্তু আমার মনে হয় না।

    এটা আরও বিস্ময়কর যে, আলেকজান্দ্রসের উপরে আরিস্ততেলেসের প্রভাব এত স্পল্প ছিল যে, রাজনীতি সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের দূরকল্পন, নগর রাষ্ট্রের যুগ শেষ হয়ে যে সম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন। আমার সন্দেহ হয়-শেষ দিন পর্যন্ত আরিস্ততেলেসের ধারণা ছিল-ছোকরা আলসে আর একগুঁয়ে, সে কোনোদিনই দর্শনশাস্ত্রের কিছু বুঝতে পারেনি। মোটের উপর বলা যায়, এই দুই মহাপুরুষের পারস্পরিক যোগাযোগ এমনই নিষ্ফল হয়েছিল যেন তাঁরা দুজন দুই জগতের মানুষ।

    ৩৩৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত (শেষের উল্লিখিত বছরে আলেজজান্দ্রসের মৃত্যু হয়) আরিস্ততেলেস আথিনাতে বাস করেছিলেন। শেষের এই বারো বছরে তিনি নিজস্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর অধিকাংশ পুস্তক প্রণয়ন করেন। আলেকজান্দ্রসের মৃত্যুর পর আতিনীয়রা বিদ্রোহ করেন এবং তাঁর বন্ধুদের আক্রমণ করা শুরু করেন, আরিস্ততেলেসও বাদ যান না-তাঁর বিরুদ্ধে অধার্মিকতার অভিযোগ ওঠে কিন্তু তিনি সাতেসের মতো আচরণ না করে শাস্তির ভয়ে পালিয়ে যান। পরের বছর (৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) তাঁর মৃত্যু হয়।

    দার্শনিক হিসেবে আরিস্ততেলেসের সঙ্গে তাঁর সমস্ত পূর্বসূরিদের অনেক দিক থেকেই প্রচুর পার্থক্য ছিল। তিনিই প্রথম একজন অধ্যাপকের মতো লিখেছিলেনঃ তার রচনাগুলো ছিল প্রণালীবদ্ধ, আলোচনাগুলো বিভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত, তিনি ছিলেন একজন পেশাদার শিক্ষক, কোনো অনুপ্রাণিত প্রফেট (prophet-ধমণ্ডরু) নন। তাঁর রচনাগুলো সমালোচনামূলক, সযত্বরচিত, সাধারণের বোধগম্য, বাকশীয় উন্মাদনার চিহ্নহীন। প্লাতনের রচনায় প্রাপ্ত অফীয় উপাদানগুলো আরিস্ততেলেসের হাতে মৃদুতর হয়ে শক্তিশালী সহজ বুদ্ধির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়েছে। যেখানে তিনি প্লাতনীয় সেখানে মনে হয় তার স্বাভাবিক প্রকৃতিতে যেন প্রাপ্ত শিক্ষা অভিভূত করেছে। উচ্ছ্বাসপ্রবণ তিনি নন অথবা কোনো গভীর অর্থে ধার্মিকও নন। তাঁর পূর্বসূরিদের ত্রুটিগুলো ছিল প্রাপ্তবয়স্কের-সেগুলো অভ্যাসগত সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তিনি সর্বোত্তম ছিলেন সমালোচনায় ও বিশদ বিচারে; বৃহৎ আকার গঠনে সফল হননি, কারণ, দানবীয় বিরাটত্ব তার নেই, নেই মূলগত স্বচ্ছতা।

    আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যার বিবরণ কোথা থেকে শুরু করা হবে সে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, কিন্তু ধারণাতত্ত্বের সমালোচনা এবং সামান্য সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বিকল্প মতবাদই বোধহয় শ্রেষ্ঠ স্থান। ধারণাতত্ত্বের বিরুদ্ধে তিনি কয়েকটি অতি উত্তম যুক্তি দান করেছেন, তার অধিকাংশই ইতোপূর্বে প্লাতনের পার্মেনিদেস-এ দেখা গেছে। তাঁর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী যুক্তি হলো তৃতীয় মানুষ সম্পর্কে : একটি মানুষের সঙ্গে আদর্শ মানুষের সাদৃশ্য থাকলে যদি তাকে মানুষ বলা হয় তাহলে আদর্শতাঁর আরও একজন মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে যার সঙ্গে সাধারণ ও আদর্শ মানুষ দুইয়েরই সাদৃশ্য রয়েছে। আবার, সক্রাতেস মানুষও বটেন, পশুও বটেন এবং প্রশ্ন হলো আদর্শ মানুষ কি তবে আদর্শ পশু? তাই যদি হয় তাহলে যত জাতের পশু আছে ততগুলো আদর্শ পশুও রয়েছে। এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এই তথ্য আরিস্ততেলেস সুপ্রকাশ করেন যে, কয়েকজন একক ব্যক্তি একটি বিধেয়র অংশীদার হলে সেটা এমন কিছুর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য নয় যা তাদের নিজেদেরই মতো বরং আদর্শতর কিছুর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য। এই পর্যন্ত প্রমাণিত বলে গ্রহণ করা যায় কিন্তু আরিস্ততেলেসের নিজস্ব মতবাদ মোটেই স্পষ্ট নয়। এই স্পষ্টত্বের অভাবই মধ্যযুগে সংজ্ঞাবাদী ও বাস্তববাদীদের ভিতরে দ্বন্দ্বের কারণ।

    মোটামুটি বলা যায় প্লাতনের অধিবিদ্যা সাধারণ বুদ্ধির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পরিণত রূপ পেয়েছে আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যায়। তাঁকে বোঝা শক্ত, কারণ, প্লাতন এবং সাধারণ বুদ্ধি সহজে মেশে না। তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করলে কখনও মনে হবে তিনি দর্শনশাস্ত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞ একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছেন এবং অন্য সময় মনে হবে তিনি নতুন শব্দসম্ভারে প্লাতনবাদ প্রকাশ করছেন। কোনো একক অংশের তার পরিবর্তন কিংবা সংশোধন হতে বাধ্য। মোটের উপর, তাঁর সামান্য বিষয়ক তত্ত্ব ও পদার্থ এবং আকার সম্পর্কীয় তত্ত্ব বোঝবার সহজতম উপায় হলো সাধারণ-বুদ্ধিভিত্তিক মতবাদ প্রথমে বোঝা। আসলে এটা হলো তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির অর্ধেক এবং তারপর বিচার করা যাক আরিস্ততেলেসকৃত প্লাতনীয় পরিবর্তন।

    কিছুদূর পর্যন্ত সামান্য বিষয়ক তত্ত্ব যথেষ্ট সরল। ভাষাতে নামবাচক বিশেষ্য রয়েছে, তাছাড়া বিশেষণ রয়েছে। নামবাচক বিশেষ্যগুলো বস্তু কিংবা ব্যক্তির প্রতি আরোপ করা হয়, এর প্রতিটিই হয় একটিমাত্র ব্যক্তি বা বস্তু যেগুলোর প্রতি আলোচ্য নামটি আরোপ করা হয়। সূর্য, চন্দ্র, ফ্রান্স, নেপোলিয়ন-প্রতিটিই অনন্য, এই নামগুলো আরোপিত হয় এরকম দৃষ্টান্ত একাধিক নেই। অপরদিকে বিড়াল, কুকুর, মানুষ, এর মতো শব্দগুলো বহু বিভিন্ন বস্তুতে আরোপিত হয়। সামান্য বিষয়ক সমস্যা এই সমস্ত শব্দের অর্থের সঙ্গে জড়িত, তাছাড়াও জড়িত শ্বেত, কঠিন, গোল ইত্যাদি বিশেষণগুলোর সঙ্গে। তিনি বলেছেন, আমার কাছে সামান্য শব্দের অর্থ হলো যে, তার চরিত্র এমন হবে যা বহু বাক্যের কর্তার বিধেয় হতে পারে, স্বতন্ত্র (indivudual-প্রাতিস্বিক) শব্দের অর্থ-যার এরকম বিধেয় হয় না।

    একটি নামবাচক বিশেষ্য দিয়ে যা বোঝানোনা হয় সেটা বস্তু আর বিশেষণ বা শ্রেণিবাচক নাম দিয়ে যা বোঝানো হয় সেটা হলো সামান্য যেমন-মানবিক কিংবা মানব। একটি বস্তু হলো এই কিন্তু সামান্য হলো যেমন-এটা একটা সত্যিকারের বিশেষ বস্তুকে বোঝায় না, বোঝায় এক ধরনের বস্তুকে। সামান্যটি একটি বস্তু নয়, কারণ, তা এই নয়। (যারা বোঝে তাদের কাছে প্লাতনের স্বর্গীয় শয্যা হবে এই, এটা এমন একটা ব্যাপার যা নিয়ে আরিস্ততেলেসের সঙ্গে প্লাতনের মতানৈক্য রয়েছে)। আরিস্ততেলেস বলছেন, যে কোনো সামান্য পদ একটা বস্তুর নাম হতে পারবে- এটা অসম্ভব। কারণ …প্রতিটি বস্তুর সত্তা হলো এমনই জিনিস যা তারই বিশেষ্যত্ব, অন্য কোনো বস্তুর নয় কিন্তু সামান্য বলা হয় যা একাধিক বস্তুতে থাকতে পারে। এর সংক্ষিপ্তসার হলো সামান্য নিজে থাকতে পারে না, থাকে শুধুমাত্র বিশেষ বস্তুসমূহে।

    আপাতদৃষ্টিতে আরিস্ততেলেসের মতবাদ যথেষ্ট সরল। ধরুন, আমি বললাম ফুটবল খেলা বলে একটা জিনিস রয়েছে, অধিকাংশ লোকই এটাকে একটা স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেবে। কিন্তু আমার যদি অনুমিতি হয় যে, খেলোয়াড় ছাড়াই ফুটবল হতে পারে তাহলে লোকে নিশ্চয়ই বলবে আমি বাজে কথা বলছি এবং সেটা ঠিকই বলবে। অনুরূপভাবে বলা যায় পিতৃত্ব-মাতৃত্ব রয়েছে কিন্তু তার একমাত্র কারণ পিতামাতার অস্তিত্ব। মিষ্টত্ব বলে একটা জিনিস আছে কিন্তু তার অস্তিত্বের একমাত্র কারণ মিষ্টি জিনিস এবং লোহিতত্ব বলে একটা জিনিস রয়েছে কিন্তু তার একমাত্র কারণ লাল জিনিস। এবং এই নির্ভরতা ব্যতিহারমূলক (reciprocal) নয় বলে ধরে নেওয়া হয়? যারা ফুটবল খেলে তারা কখনো ফুটবল না খেললেও তাদের অস্তিত্ব থাকত, সে জিনিসগুলো সাধারণত মিষ্টি সেগুলো টক হয়ে যেতে পারে এবং আমার মুখচ্ছবি সাধারণত লাল হলেও ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে যদিও মুখচ্ছবিটা আমারই থাকবে। এইভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বলা হচ্ছে যে, বিশেষণ তার অস্তিত্বের জন্য নামবাচক বিশেষ্যের উপর নির্ভরশীল কিন্তু ব্যাপারটা তদ্বিপরীত নয়। আমার মনে হয় আরিস্ততেলেস এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর মতবাদ অন্য অনেক বিষয়ে তার মতবাদের মতো সাধারণ বুদ্ধিজাত সংস্কারমাত্র তবে তা প্রকাশ করা হয়েছে পাণ্ডিত্যের আবরণে।

    কিন্তু এই তত্ত্বের যথাযথ বর্ণনা সহজ নয়। খেলোয়াড় ছাড়া ফুটবল থাকতে পারে না, এ কথা মেনে নিয়ে বলা যায় অমুক কিংবা তমুক খেলোয়াড় না থাকলেও ফুটবলের অস্তিত্ব বেশ থাকতে পারে। এবং কোনো ব্যক্তি ফুটবল না খেলেও বেঁচে থাকতে পারে, এ কথা মেনে নিয়ে বলা যেতে পারে কোনো কিছু না করে সে বেঁচে থাকতে পারে না। লোহিতত্ব গুণের অস্তিত্ব কোনো পাত্র না থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু অমুক কিংবা তমুক পাত্র না থাকলেও এ গুণে অস্তিত্ব থাকতে পারে। অনুরূপভাবে বলা যায় কোনো গুণ ছাড়া একটি পাত্রের অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিন্তু এই কিংবা ঐ গুণ ছাড়া থাকতে পারে। সুতরাং বস্তু তার গুণের ভিতরে পার্থক্য করার জন্য যে যুক্তি অনুমান করা হয়েছে সেটাকে ভ্রমাত্মক মনে হয়।

    পার্থক্যের মূল কারণ আসলে ভাষাতাত্ত্বিক, এটা আহরিত পদান্বয় (syntax) থেকে। নামবাচক বিশেষ্য, বিশেষণ এবং সম্পর্কবাচক শব্দ রয়েছে, আমরা বলতে পারি জন জ্ঞানী, জেমস বোকা, জন জেমসের থেকে লম্বা। এক্ষেত্রে জন এবং জেমস নামবাচক বিশেষ্য, জ্ঞানী এবং বোকা বিশেষণ এবং অধিকতর লম্বা সম্পর্কবাচক শব্দ। আরিস্ততেলেসের পর থেকে অধিবিদ্যাবিদরা পদান্বয়ের ব্যাখ্যা করেছেন অধিবিদ্যার ভিত্তিতেঃ জন এবং জেমস বস্তু। জ্ঞান এবং মূর্খতা হলো সামান্য। (সম্পৰ্কবাচক শব্দগুলোকে অগ্রাহ্য করা হতো কিংবা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হতো)। হতে পারে যে, যথেষ্ট যত্ন নিলে পদান্বয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অধিবিদ্যামূলক পার্থক্য পাওয়া যেতে পারে কিন্তু তা হবে দীর্ঘ কর্মপদ্ধতির সাহায্যে এবং ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে জড়িত থাকবে একটা কৃত্রিম দার্শনিক ভাষা সৃষ্টি। এবং এই ভাষায় জন এবং জেমস এর মতো কোনো নাম থাকবে না, থাকবে না জ্ঞানী কিংবা বোকা-র মতো কোন বিশেষণ। সাধারণ ভাষার সমস্ত শব্দ বিশ্লেষিত হবে এবং তার জায়গায় প্রতিস্থাপিত হবে কম জটিল অর্থবহ শব্দসমূহ। এই পরিশ্রম না করলে সামান্য এবং বিশেষের প্রশ্নের উপযুক্ত আলোচনা সম্ভব নয়। এবং যখন আমরা এটা আলোচনা করার মতো অবস্থায় পৌঁছাব তখন দেখতে পাব, যে বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছি সেটা শুরুতে যা ছিল বলে অনুমান করেছিলাম ব্যাপারটা তার থেকে অনেকটা অন্যরকম।

    সুতরাং যদি আমি আরিস্ততেলেসের সামান্য বিষয়ক তত্ত্ব সুস্পষ্ট করতে না পেরে থাকি, তার কারণ (আমি আবারও বলছি) এই তত্ত্বটাই স্পষ্ট নয়। কিন্তু ধারণাতত্ত্বের তুলনায় এটা নিশ্চিতভাবে একটা অগ্রগতি ও অবশ্যই অকৃত্রিম এবং গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে জড়িত।

    আর একটি পদ আরিস্ততেলেস এবং তার পণ্ডিত অনুগামীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই পদটি হলো সার (essence)। এই পদ কোনক্রমেই সামান্য পদের সমার্থক নয়। তোমার সার হলো তোমর নিজস্ব স্বভাবের দরুন তুমি যা তাই। বলা যেতে পারে, এটা হলো তোমার সেই সমস্ত ধর্ম, যে ধর্মগুলো তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার নিজস্বতা না হারাচ্ছ ততক্ষণ পর্যন্ত হারাতে পার না। শুধুমাত্র স্বতন্ত্র একটি বস্তুর নয়, প্রত্যেকটি প্রজাতিরই একটা সার রয়েছে। একটি প্রজাতির সার তার সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। আরিস্ততেলেসের যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করার সময় আমি সার সম্পর্কে ধারণায় আবার ফিরে আসব। আপাতত শুধুমাত্র দেখছি এটা একটা বুদ্ধিহীনের চিন্তন- যার সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।

    আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যার পরের বিষয় হলো আকার ও বস্তু-র পার্থক্য। (এটা অবশ্যই বুঝতে হবে, যে অর্থে বস্তু এবং আকার বিপরীত সেটা বস্তু এবং মন যে অর্থে বিপরীত- সেরকম নয়)।

    এখানেও আবার আরিস্ততেলেসের তত্ত্বের ভিত্তি সাধারণ বুদ্ধি কিন্তু এক্ষেত্রে প্লাতনীয় পরিবর্তন সামান্যের ক্ষেত্রের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একটা মর্মর মূর্তি নিয়ে শুরু করতে পারি, এক্ষেত্রে মর্মর হলো বস্তু আর ভাস্করের দেওয়া আকৃতি হলো আকার। কিংবা যদি আরিস্ততেলেসের উদাহরণ নেওয়া যায় তাহলে ব্রোঞ্জের গোলক তৈরি করলে ব্রোঞ্জ হলো বস্তু আর গোলকত্ব তার আকার। শান্ত সমুদ্রের ক্ষেত্রে পানি হলো বস্তু এবং মসৃণতা তার আকার। এ পর্যন্ত সবই সরল।

    তারপর তিনি বলছেন, আকারের গুণেই বস্তুটি একটি নির্দিষ্ট নিশ্চিত জিনিস এবং এটাই জিনিসটার সত্তা। আরিস্ততেলেস যা বলছেন, মনে হয় সেটা পরিষ্কার সাধারণ বুদ্ধি। একটি বস্তুর সীমানা থাকবে এবং সীমানাটাই আকার গঠন করবে। ধরুন, একটা বিশেষ পরিমাণ পানিঃ এর যে কোনো অংশকে একটি পাত্রে ঘিরে রাখলে তার অবশিষ্টাংশ থেকে তাকে চিহ্নিত করা যায় এবং তখন এই অংশটি একটা বস্তু হয়ে ওঠে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ অংশটিকে অবশিষ্ট সমসত্ত্ব পদার্থ থেকে পৃথক না করা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা একটা বস্তু নয়। একটি মূর্তি হলো একটি বস্তু এবং যে মর্মর প্রস্তর দিয়ে সেটা গঠিত, সেটা খনিস্থিত বস্তুর অংশ কিংবা একটা পিণ্ডের অংশ- যাই হোক না কেন, এক অর্থে সেটা অপরিবর্তিত। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বলা উচিত নয় যে, আকার সত্তা দান করে কিন্তু তার কারণ পারমাণবিক প্রকল্প আমাদের কল্পনায় বদ্ধমূল হয়ে আছে। যাই হোক, প্রতিটি পরমাণু যদি একটা বস্তু হয় তাহলে তা হয়। প্রতিটি পরমাণু থেকে সীমারেখায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন এবং কোনো একটা অর্থে এর আকার রয়েছে।

    এখন আমরা আলোচনা করব একটা নতুন প্রতিবেদন নিয়ে, প্রথম দর্শনে এটাকে কঠিন বলে মনে হয়। আমাদের বলা হয়েছে-আত্মা হলো দেহের আকার। এখানে এটা স্পষ্ট যে, আকার-এর অর্থ গঠন নয়। কী অর্থে আত্মা দেহের আকার সে বিষয়ে আমি পরে আলোচনা করব, আপাতত শুধুমাত্র লক্ষ্য করব যে, আরিস্ততেলেসের তন্ত্রে আত্মাই দেহকে একটি বস্তুতে পরিণত করে- যার উদ্দেশ্যের ঐক্য আছে এবং যাকে আমরা জীবের (organism) বৈশিষ্ট্য বলি তার সঙ্গে সে বস্তু জড়িত। চোখের উদ্দেশ্য বীক্ষণ কিন্তু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চোখ আর দেখতে পায় না। আসলে, দেখে আত্মা।

    সেই জন্য মনে হয় বস্তুর একটি অংশকে যা ঐক্য প্রদান করে সেটাই আকার এবং এই ঐক্য সবসময় না হলেও প্রায়শই পরম কারণবাদমূলক (teleological)। কিন্তু আকার হয়ে দাঁড়ায় এর অতিরিক্ত কিছু এবং এই অতিরিক্তটা খুবই কঠিন।

    আমাদের বলা হয়েছে একটি বস্তুর আকার তার সার এবং প্রাথমিক সত্তা। আকার সত্তামূলক কিন্তু সামান্য তা নয়। কেউ যদি একটি পিতলের গোলক তৈরি করে, তার বস্তু এবং আকার উভয়েরই পূর্ব অস্তিত্ব আছে, সে শুধুমাত্র দুটিকে একত্র করেছে। সে যেমন আকার সৃষ্টি করেনি তেমনই পিতল সৃষ্টি করেনি। সব বস্তুরই পদার্থ নেই; চিরন্তন বস্তু রয়েছে, তাদের কোনো পদার্থ নেই- শুধু স্থানে চলমান চিরন্তন বস্তু পদার্থবান। আকার গ্রহণ করে বস্তুসমূহ বাস্তবে বৃদ্ধি পায়, আকার ছাড়া পদার্থ শুধুমাত্র একটা সম্ভাবনা।

    আকার হলো এমন বস্তু যে, যেসব পদার্থ দিয়ে তার দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, সেই পদার্থগুলো নিরপেক্ষভাবে আস্তিমান- এই দৃষ্টিভঙ্গি আরিস্ততেলেসকে প্লাতনীয় ধারণার বিরুদ্ধে নিজের যুক্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর ঈপ্সিত বক্তব্য ছিল আকার সামান্যের চাইতে যথেষ্ট পৃথক একটা কিছু কিন্তু এতে একই বৈশিষ্ট্যগুলোর অনেক অংশ বর্তমান। আমাদের বলা হয়েছে, পদার্থ অপেক্ষা আকার অধিকতর বাস্তব, এই বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় ধারণার একমাত্র বাস্তব। স্নাতনের অধিবিদ্যাকে অস্তিত্বশীল বলে তার যতটা প্রতিনিধিত্ব করছেন তার চাইতে কম। এই দৃষ্টিভঙ্গি জেলারের (Zeller), তিনি বস্তু এবং আকারের প্রশ্নে বলেনঃ

    দেখা যাবে এ বিষয়ে আরিস্ততেলেসের স্পষ্টতার অভাবের ব্যাখ্যার উপসংহার কিন্তু পাওয়া যাবে এই তথ্যে যে, তিনি প্লাতনের ধারণাগুলোতে ঈশ্বরত্ব আরোপের (hypostatise) ঝোঁক থেকে নিজেকে শুধুমাত্র অর্ধমুক্ত করেছেন। তার ক্ষেত্রে আকারগুলো ছিল প্লাতনের ক্ষেত্রে ধারণার মতো, এদের ছিল একটা নিজস্ব অধিবিদ্যক অস্তিত্ব, সেটা সমস্ত স্বতন্ত্র বস্তুরই অস্তিত্বের শর্ত। যদিও তিনি অভিজ্ঞতা থেকে ধারণার বৃদ্ধি আগ্রহের সঙ্গে অনুসরণ করছিলেন তবুও এটা মোটের উপর সত্যি যে, এই ধারণাগুলো, বিশেষত যেগুলো অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি থেকে দূরতম, শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হয় মানবচিন্তনের যৌক্তিক ফলাফল থেকে অতিঅনুভূতির জগতে প্রত্যক্ষ উপস্থাপনে এবং সে অর্থে তারা একটা বৌদ্ধিক স্বজ্ঞার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

    এই সমালোচনার উত্তর কী করে আরিস্ততেলেস খুঁজে পেতেন সেটা বুঝতে পারি না।

    একমাত্র যে উত্তর আমার কল্পনায় আসে তা হলো দুটি বস্তুর একই আকার হয় না। কোনো মানুষ যদি দুটি পিতলের গোলক তৈরি করে (আমাদের এইভাবে বলতেই হবে), প্রত্যেকটিরই নিজস্ব গোলকত্ব আছে, তবে ঐ গোলকত্বে সত্তা এবং বিশেষত্ব দুটোই থাকতে পারে। এটা সামান্য গোলকত্বের একটা দৃষ্টান্ত কিন্তু তার সঙ্গে অভিন্ন নয়। আমার মনে হয় না উদ্ধৃত অংশের ভাষা সহজে এই ব্যাখ্যা অনুমোদন করবে। এবং এই আপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে যে, আরিস্ততেলেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ গোলকত্ব হতো জানার অতীত, অথচ তার অধিবিদ্যার সার হলো আকারের বৃদ্ধি এবং বস্তুর হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে জিনিসগুলো ক্রমশ অধিকতর জ্ঞাতব্য হয়। যদি আকারকে বহু বিশেষ বস্তুতে মূর্ত না করা যায় তাহলে তাঁর অবশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। যদি তিনি বলতেন যতগুলো গোলক বস্তু আছে গোলকত্বের দৃষ্টান্তরূপে ততগুলো আকার রয়েছে তাহলে তাঁর দর্শনে মৌলিক পরিবর্তন করতে হতো। উদাহরণস্বরূপ, আকার তার সার-এর সঙ্গে অভিন্ন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি- উপরের পরামর্শ মতো বেরিয়ে আসার পথের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

    আরিস্ততেলেসের দর্শনে বস্তু এবং আকার সম্পর্কে যে মতবাদ আছে সেটা সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার পার্থক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অকৃত্রিম বস্তুকে আকারের সম্ভাবনা বলে কল্পনা করা হয়। সমস্ত পরিবর্তনকে আমাদের বলা উচিত বিবর্তন, এর অর্থ হলো পরিবর্তনের পরে আলোচ্য বস্তুটির আগের চাইতে বেশি আকার রয়েছে। যার আকার অধিকতর তাকে অধিকতর বাস্তব বলে বিচার করা হয়। ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ আকার এবং শুদ্ধ বাস্তবতা, সুতরাং তাঁর কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। দেখা যাবে এই মতবাদ আশাবাদী এবং উদ্দেশ্যবাদীঃ মহাবিশ্ব এবং তার অন্তর্নিহিত সবই অবিচ্ছিন্নভাবে বিকাশলাভ করছে পূর্বের চাইতে উত্তমতর হয়ে।

    সম্ভাবনার ধারণা কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সুবিধাজনক, যদি তা এমনভাবে ব্যবহার করা যায় যাতে আমাদের বিবৃতিকে এমন আকারে ভাষান্তরিত করতে পারি-যার ভিতরে এই ধারণা অনুপস্থিত থাকে। একখণ্ড মর্মর থেকে উপযুক্ত কার্যের দ্বারা একটি মূর্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু সম্ভাব্যতা যখন একটি মূলগত এবং অপরিবর্তনীয় কল্পন হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন তা সবসময়ই চিন্তার বিভ্রান্তি গোপন করে। এর ব্যবহার আরিস্ততেলেসের তন্ত্রের একটি মন্দ দিক।

    আরিস্ততেলেসের ধর্মতত্ত্ব আকর্ষণীয় এবং তার অবশিষ্ট অধিবিদ্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত- আসলে, আমরা যাকে অধিবিদ্যা বলি, আরিস্তেলেস তার যে কটি নাম দিয়েছিলেন ধর্মতত্ত্ব তার মধ্যে একটি। (এ নামে যে বইটাকে আমরা জানি সে নাম আরিস্ততেলেসের দেওয়া নয়)।

    তিনি বলেন, তিন প্রকারের বস্তু আছেঃ কোনোটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং নশ্বর, কোনোটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিন্তু অবিনশ্বর এবং কোনোটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়, নশ্বরও নয়। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে উদ্ভিদ এবং পশু, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে আকাশস্থ বস্তুপিণ্ডগুলো (আরিস্ততেলেসের বিশ্বাস ছিল গতি ছাড়া এগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় না), তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে মানুষের যুক্তিবাদী আত্মা এবং ঈশ্বর।

    ঈশ্বরের সপক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল প্রথম কারণঃ এমন একটা কিছু অবশ্যই থাকতে হবে যা গতি জন্ম দেয় কিন্তু নিজে অনড় এবং তা অবশ্যই হবে চিরন্তন, বস্তু এবং বাস্তবতা। আরিস্ততেলেসের মতে আকাঙ্ক্ষা এবং চিন্তার লক্ষ্যবস্তু এভাবে গতি সৃষ্টি করে কিন্তু নিজেরা থাকে অবিচল। সুতরাং ঈশ্বর ভালোবাসার লক্ষ্যবস্তু হয়ে গতির সৃষ্টি করেন অথচ গতির অন্য সমস্ত কারণই ক্রিয়া করে নিজে গতিশীল হয়ে (বিলিয়ার্ড বলের মতো)। ঈশ্বর হলেন শুদ্ধ চিন্তা, কারণ, চিন্তাই সর্বশ্রেষ্ঠ। জীবনও ঈশ্বরের অধিকারে, কারণ, চিন্তনের বাস্তবতাই জীবন এবং ঈশ্বর সেই বাস্তবতা এবং ঈশ্বরের আত্মনির্ভর বাস্তবতাই সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন জীবন। এবং স্থিতিকাল অবিচ্ছিন্ন এবং চিরন্তন- এগুলো ঈশ্বরের অধিকারে, কারণ, এটাই হলো ঈশ্বর (১০৭২)।

    তাহলে এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, এমন একটা বস্তু আছে যেটা চিরন্তন, অবিচল ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলো থেকে পৃথক। এটা দেখানো হয়েছে যে, এই বস্তুর কোনো বিস্তার থাকতে পারে না। কিন্তু এটা অংশহীন, এটা অবিভাজ্য…। কিন্তু এও দেখানো হয়েছে যে, এটা অনুভূতিহীন এবং অপরিবর্তনীয়, কারণ, অন্য সমস্ত পরিবর্তনই স্থান পরিবর্তনের পরবর্তী (১০৭৩)।

    ঈশ্বরের খ্রিষ্টিয় ভগবানের মতো গুণ নেই, কারণ, তাতে তাঁর নিখুঁত পূর্ণতা খর্ব হবে, যা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয় সে বিষয়ে ভাবা তার পক্ষে অচিন্তনীয় অর্থাৎ তিনি শুধু আত্মচিন্তা করতে পারেন। ঐশ্বরিক চিন্তন শুধুমাত্র নিজের সম্পর্কেই ভাবা (কারণ, সব বস্তুর ভিতরেই এটা সর্বশ্রেষ্ঠ) এবং এর চিন্তন চিন্তা সম্পর্কে চিন্তন (১০৭৪৮)। আমাদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত হবে ঈশ্বর আমাদের চন্দ্রের নিচে অবস্থিত বিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। স্পিনোজার মতো আরিস্ততেলেসও বিশ্বাস করতেন যদিও মানুষদের ঈশ্বরকে ভালোবাসা আবশ্যিক তবুও ঈশ্বরের পক্ষে মানুষকে ভালোবাসা অসম্ভব।

    ঈশ্বর অবিচল চালক রূপে সংজ্ঞিতব্য নন। এর বিপরীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিচারে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে, সাতচল্লিশ জন কিংবা পঞ্চান্ন জন অবিচল চালক আছেন (১০৭৪)। এঁদের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক স্পষ্টভাবে বলা হয়নি, অবশ্য স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হবে সাতচল্লিশ কিংবা পঞ্চান্ন জন দেবতা রয়েছেন। কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে এই রচনাংশগুলোর একটির পর একটি আরিস্ততেলেস বলে চলেছেন : এইরকম বস্তু একটি আছে না একাধিক এ প্রশ্ন অবশ্যই আমাদের অগ্রাহ্য করা উচিত নয় এবং অবিলম্বে এই তর্কে প্রবৃত্ত হন যা নিয়ে যায় সাতচল্লিশ কিংবা পঞ্চান্ন জন অবিচল চালকে।

    অবিচল চালকের ধারণা কঠিন। আধুনিক মনের কাছে মনে হবে একটি পরিবর্তনের কারণ পূর্ববর্তী আর একটি পরিবর্তন এবং মহাবিশ্ব যদি কখনো সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল থাকত তাহলে সেটা অনন্তকাল ঐভাবেই থাকত। আরিস্ততেলেসের বক্তব্যের অর্থ বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে কারণ সম্পর্কে তিনি কী বলেন। তাঁর মতানুসারে চার রকম কারণ আছে, তাদের নাম ক্রমানুসারে বস্তুগত, আকারগত, কার্যকর এবং অন্তিম। আবার ভাস্করের কাছে ফেরা যাক। মূর্তিটির বস্তুগত কারণ মর্মর, আকারগত কারণ-যে মূর্তিটি গড়া হবে তার সার পদার্থ, কার্যকর কারণ-ছেনি ও মর্মর প্রস্তরের সংস্পর্শে এবং অন্তিম কারণ হলো-শেষ পর্যন্ত ভাস্কর যা গড়তে চাইছে তাই। আধুনিক বাঘিধিতে কারণ শব্দটি শুধুমাত্র কার্যকর কারণ সম্পর্কীয় কারণেই আবদ্ধ থাকবে। অবিচল চালককে অন্তিম কারণ ভাবা যেতে পারে? সে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য সরবরাহ করে, সেটা মূলত ঈশ্বরের সঙ্গে সমরে অভিমুখে একটি বিবর্তন।

    বলেছিলাম যে, আরিস্ততেলেস প্রকৃতিগতভাবে পরম ধার্মিক ছিলেন না কিন্তু কথাটি মাত্র আংশিক সত্য। হয়তো তাঁর ধর্মের একটা দিকের ব্যাখ্যা, খানিকটা নিগড়মুক্ত হয়ে দেওয়া যেতে পারে নিম্নরূপে :

    ঈশ্বর অনন্তকাল ধরে শুদ্ধ চিন্তায়, আনন্দে, সম্পূর্ণ আত্মা- পরিপূর্ণতায় অস্তিমান, কোনো অপূর্ণ আকাক্ষা শূন্য হয়ে। এর বিপরীতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্ব নিখুঁত নয় কিন্তু তার আছে জীবন, আকাক্ষা, একধরনের ত্রুটিপূর্ণ চিন্তন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সমস্ত জীবিত প্রাণী কমবেশি পরিমাণে ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন এবং তারা ঈশ্বরপ্রেমে ও ঈশ্বরের গুণমুগ্ধ হয়ে কর্মচঞ্চল হয়। সেইজন্য ঈশ্বর সমস্ত কর্মের অন্তিম কারণ। পদার্থের আকার দানই পরিবর্তন কিন্তু যে সমস্ত ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু জড়িত সেসব ক্ষেত্রে সবসময়ই নিচেন স্তরে খানিকটা বস্তু থেকে যায়। একমাত্র ঈশ্বরেই আছে বস্তুহীন আকার। বিশ্ব অবিচ্ছিন্নভাবে বৃহত্তর পরিমাণ আকারের অভিমুখে বিবর্তিত হচ্ছে এবং সে কারণে ক্রমশই ঈশ্বরের মতো হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না, কারণ পদার্থকে কখনোই সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা যায় না। এ ধর্ম প্রগতি এবং বিবর্তনের কারণ, ঈশ্বরের স্থিতিশীল পূর্ণতা বিশ্বকে চালনা করে একমাত্র প্রেমের দ্বারা, এই প্রেম সীমাবদ্ধ জীবরা ঈশ্বরের প্রতি বোধ করে। প্লাতন ছিলেন গাণিতিক, আরিস্ততেলেস ছিলেন জীববিদ্যাভিত্তিক-এঁদের ধর্মের পার্থক্য এটাই।

    এটা কিন্তু হবে আরিস্ততেলেসের ধর্ম সম্পর্কে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রিকদের স্থিতিশীল নির্ভরতার প্রতি ভালোবাসা এবং কর্মের বদলে চিন্তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব তারও ছিল। আত্মা সম্পর্কে তাঁর মতবাদ তার দর্শনের এই দিকের দৃষ্টান্ত।

    আরিস্ততেলেস কোনোরূপে মরত্ব সম্পর্কে শিক্ষাদান করেছিলেন কিনা- সেটা ছিল টীকাকারদের কাছে বিরক্তিকর একটা প্রশ্ন। আভেরস (Averroes)-এর মত ছিল তিনি এরকম কোনো শিক্ষা দেননি, খ্রিষ্টান দেশগুলোতে আভেরসের অনুগামী ছিল- তাদের ভিতর চরমপন্থীদের নাম ছিল এপিকুরীয় (Epicurean), তাদের সঙ্গে দান্তে (Dante)-র নরকে দেখা হয়েছিল। আসলে আরিস্ততেলেসের মতবাদ জটিল এবং সহজেই তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তার অন দি সোল (On the Soul- আত্মবিষয়ক) বইয়ে তিনি মনে করেন আত্মার সঙ্গে দেহ বন্ধনযুক্ত এবং পুথাগোরীয়দের প্রচারিত আত্মার দেহান্তরকরণকে বিদ্রূপ করেন (৪০৭৮)। মনে হয় দেহের সঙ্গে আত্মার মৃত্যু হয়? নিঃসন্দেহে এ তথ্য আহরণ করা যায় যে, আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। (৪১৩) কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি যোগ করেছেন? কিংবা অন্তত এ কথা বলা যায় দেহের কোনো কোনো অংশকে আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বস্তু আর আকারে যে সম্পর্ক দেহ ও আত্মার সম্পর্কও সেইরকম : যে অর্থে জীবনের সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে একটি বাস্তব বস্তুর আকৃতিতে, সে অর্থে আত্মাও নিশ্চয় একটি বস্তু। কিন্তু বস্তু হলো বাস্তবতা এবং সেইজন্য উপরে যে বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয়েছে সে অনুসারে আত্মাই একটি দেহের বাস্তবতা (৪১২)। আত্মা বস্তু সেই অর্থে যে অর্থে তা একটি বস্তুর সারের নির্দিষ্ট সঙ্কেতের অনুরূপ। এর অর্থ আত্মা একটি বস্তুর মূলগত প্রকারত্ব-সে বস্তুর চরিত্র সদ্য প্রাপ্ত (অর্থাৎ যার জীবন আছে) (৪১২)। স্বাভাবিক দেহ-যার মধ্যে জীবনের সম্ভাবনা আছে, আত্মা তার প্রথম শ্রেণির বাস্তবতা। এভাবে যে দেহের বিবরণ দেওয়া হয়েছে সেটা একটি সংগঠিত দেহ (৪১২)। আত্মা এবং দেহ অভিন্ন কিনা-এ প্রশ্ন করা মোম এবং ছাপ দিয়ে তাকে যে রূপ দেওয়া হয়েছে সেটা অভিন্ন কিনা, সে প্রশ্নের মতোই নিরর্থক (৪১২b)। আত্ম-পুষ্টি সাধন করার ক্ষমতাই উদ্ভিদের একমাত্র মানসিক ক্ষমতা (৪১৩a)। দেহের অন্তিম কারণ হলো আত্মা (৪১৪a)।

    এই বইয়ে তিনি আত্মা এবং মন এর পার্থক্য করেছেন, মনকে তিনি আত্মার উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন এবং দেহের সঙ্গে এর বন্ধন স্বল্পতর। দেহ এবং আত্মার সম্পর্ক সম্বন্ধে বলবার পর তিনি বলেছেন : মনের ব্যাপারটা পৃথক, মনে হয় এটা আত্মায় প্রোথিত অন্য একটি বস্তু এবং মন নশ্বর হতে পারে না (৪০৮b)। আবার ও এ পর্যন্ত মন কিংবা চিন্তনের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো সাক্ষ্য আমাদের নেই, মনে হয় এটা অনেকখানি পৃথক একটি আত্মা- পার্থক্যটা যা চিরন্তন ও যা নশ্বর তার পার্থক্যের মতো। এটাই একমাত্র অন্য সমস্ত মানসিক ক্ষমতা থেকে বিছিন্ন হয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম। আমাদের বিবৃতি থেকে বোঝা যায় কিছু বিপরীত বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও আত্মার অন্য সব অংশের পৃথক অস্তিত্ব অসম্ভব (৪১৩৮)। মন আমাদের সেই অংশ যা গণিত ও দর্শনশাস্ত্র বোঝে, এর লক্ষ্যগুলো কালাতীত এবং সেইজন্য মনে করা হয় এটা স্বকীয়ভাবে কালাতীত। যে বস্তু দেহকে চালনা করে এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলো বোধ করে- সেটাই আত্মা। এর বৈশিষ্ট্য আত্ম-পুষ্টি, অনুভূতি, বোধ এবং চালনাশক্তি (৪১৩b) কিন্তু মনের চিন্তা করার মতো উচ্চতর ক্ষমতা রয়েছে, তার সঙ্গে দেহ কিংবা ইন্দ্রিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। সেইজন্য মন অবিনশ্বর হতে পারে যদিও আত্মার অবশিষ্ট অংশ তা হতে পারে না।

    আত্মা সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের মতবাদ বুঝতে গেলে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে আত্মা দেহের আকার এবং স্থানিক গঠনও এক ধরনের আকার। আত্মা ও গঠন কোথায় মিল? আমার মনে হয় মিল রয়েছে সেখানে, যেখানে এরা একটা বিশেষ পরিমাণ বস্তুতে ঐক্য আরোপ করছে। যে মর্মরের অংশ পরবর্তীকালে একটি মূর্তির রূপ নেয় সেটা তখনও অবশিষ্ট মর্মর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটা তখনও একটা বস্তু নয় এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তার কোনো ঐক্য নেই। ভাস্কর মূর্তি নির্মাণ করলে এর ঐক্যপ্রাপ্তি হয় এবং ঐক্য আহরিত হয় তার গঠন থেকে। আত্মার যে মূলগত চরিত্রের জন্য এটা দেহের আকার, সেটা হলো- এটা দেহকে জৈবিক রূপ দান করে এবং একক হিসেবে তার উদ্দেশ্য থাকে। একক একটি অঙ্গের উদ্দেশ্য তার নিজের বাইরে থাকে; চোখ বিচ্ছন্নভাবে কিছুই দেখতে পায় না। এভাবে অনেক কিছু বলা চলে যেক্ষেত্রে একটি সম্পূর্ণ পশু কিংবা উদ্ভিদ কর্তা কিন্তু কোনো অংশ সম্পর্কে একথা বলা যায় না। এই অর্থে সংগঠন কিংবা আকার বস্তুত্ব আরোপ করে। যা একটি উদ্ভিদ কিংবা পশুতে বস্তুত্ব আরোপ করে আরিস্ততেলেস তার নাম দিয়েছেন আত্মা। কিন্তু মন একটা পৃথক জিনিস, দেহের সঙ্গে তার যোগাযোগের ঘনিষ্ঠতা স্বল্প। হয়তো এটা আত্মারই একটা অংশ কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক জীবেরই মন আছে (৪১৫)। দূরকল্পরূপে মন কখনোই গতির কারণ হতে পারে না, কারণ, সে কখনোই কি সম্ভাব্য তা ভাবে না এবং কখনোই বলে না কাকে এড়িয়ে চলা যায় কিংবা কাকে অনুসরণ করা যায়। (৪৩২b)।

    বাগ্বিধিতে সামান্য পরিবর্তন থাকলেও একই ধরনের মতবাদ পাওয়া যায় নিকোমাখীয় নীতিশাস্ত্রে (Nicomachean Ethics)। আত্মার একটি উপাদান যুক্তিবাদী এবং অপরটি অযৌক্তিক। অযৌক্তিক অংশের দুটি ভাগ : একটি বোধশক্তিহীন (vegetitive)-সমস্ত জীবে এমনকি সমস্ত উদ্ভিদেও এটা পাওয়া যায়, অপরটি ক্ষুধাতৃষ্ণাভিত্তিক (appetitive)-তা শুধু সমস্ত পশুতে বর্তমান (১১০২৮)। যুক্তিবাদী আত্মার জীবন গঠিত চিন্তন দিয়ে-সেটাই মানুষের পূর্ণ আনন্দ যদিও সবসময় পূর্ণরূপে প্রাপ্তব্য নয়। এরকম জীবন মানুষের পক্ষে অত্যধিক উচ্চস্তরের হবে, কারণ, সে মানুষ বলে ঐভাবে থাকবে তা নয়, কারণ, তার ভিতরে ঐশ্বরিক কিছু আছে এবং ঐটুকু দিয়েই সে আমাদের সংযুক্ত চরিত্রের চাইতে শ্রেয়তর, আবার তার জন্য এর ক্রিয়াকর্ম অন্য ধরনের ধর্মপালনের (কার্যকর প্রয়োগীয় ধর্ম) চাইতে উন্নততর। যুক্তি যদি ঐশ্বরিক হয় তাহলে যুক্তিপূর্ণ জীবনও মানুষের জীবনের তুলনায় ঐশ্বরিক। কিন্তু যারা নিজেরা মানুষ হয়ে আমাদের উপদেশ দেন মানবিক জীবন সম্পর্কে ভাবতে এবং নিজেরা নশ্বর হয়ে শুধুমাত্র নশ্বর বস্তুগুলো সম্পর্কেই ভাবতে- তাঁদের আমরা অবশ্যই অনুসরণ করব না বরং আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত যতটা সম্ভব নিজেদের অবিনশ্বর করতে ও প্রতিটি স্নায়ুকে কর্ষণ (strain) করেও আমাদের অন্তরের সর্বোৎকৃষ্ট বস্তু অনুসারে জীবনযাপন করতে। তার কারণ, জিনিসটা পরিমাণে কম হলেও ক্ষমতায় এবং মূল্যে তারা সবকিছুকেই অতিক্রম করে (১১৭৭)।

    এই সমস্ত অংশ থেকে মনে হয় স্বাতন্ত্র অর্থাৎ যা দিয়ে একটি ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির পার্থক্য বোঝা যায়-দেহ এবং অযৌক্তিক আত্তার সঙ্গে যুক্ত করে যুক্তিবাদী আত্মা কিংবা মন হলো ঐশ্বরিক এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ। কেউ ঝিনুক (oysters) খেতে ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসে আনারস- এটা তাদের ভিতরকার পার্থক্য। কিন্তু যখন তারা নামতার কথা ভাবে তখন যদি চিন্তনে ভুল না থাকে তাহলে দুজনের কোনো পার্থক্য থাকবে না। অযৌক্তিকতা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে কিন্তু যুক্তি আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। যেমন যুক্তির কিংবা মনের অমরত্ব একক বিচ্ছিন্ন মানুষের অমরত্ব নয়, ঈশ্বরের অমরত্বের অংশমাত্র। প্রাতন এবং পরবর্তীকালের খ্রিষ্টানরা যেরকম শিক্ষা দিয়েছিলেন আরিস্ততেলেস সেরকম ব্যক্তিগত অমরত্বে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। তিনি শুধুমাত্র বিশ্বাস করতেন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তিবাদী ততক্ষণ পর্যন্ত সে ঈশ্বরের অংশ-যা অবিনশ্বর। নিজের চরিত্রে ঐশ্বরিক উপাদান বৃদ্ধি করার পথ মানুষের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত এবং এই প্রচেষ্টাই মানুষের উচ্চতর ধর্ম। কিন্তু যদি সে সম্পূর্ণ সফল হতো তাহলে পৃথক ব্যক্তি হিসেবে তার অস্তিত্ব মুছে যেত। এটাই হয়তো আরিস্ততেলেসের বক্তব্যের একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা নয় কিন্তু আমার মনে হয়, এটাই সবচাইতে স্বাভাবিক ব্যাখ্যা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা
    Next Article সক্রেটিসের আগে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    Related Articles

    বার্ট্রান্ড রাসেল

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    প্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    বার্ট্রান্ড রাসেল

    সক্রেটিসের আগে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }