Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পিঞ্জরে বসিয়া শুক – কমলকুমার মজুমদার

    কমলকুমার মজুমদার এক পাতা গল্প209 Mins Read0

    ৭. স্নেহশীলা মনিব-পত্নী

    আর আর পরিচারকবর্গের কথায় স্নেহশীলা মনিব-পত্নী ইদানীং যারপরনাই চিন্তিত; সত্যই সুঘরাই ক্রমশ এক অদ্ভুত অন্ধকার হইয়া উঠিতেছিল, যেমন সে এক চরিত্র! যে সে, বৈদ্যনাথ যাওয়ার দিনের যত ব্যবধান বর্ধিত হইতে আছে, ততই যেন হন্যে, খাঁচার কাগজের ফুলের গন্ধ আর অনুপ্রাণিত নহে, বাগানের ফুল তাহাতে সঠিক স্বর শব্দ জাগায় নাই, খাঁচা সাজাইবার অভিনব উদ্ভাবনশক্তির জন্য সে উন্মত্ত আছে।

    অতএব তিনি যখন শুনিয়াছিলেন যে সুঘরাই রাত্রে ঘুমের মধ্যে কি এক, কোন এক ডাক, আজকাল তুলিয়া থাকে, তখন তিনি সুঘরাইকে শুধু বলিয়াছিলেন,–মুখপোড়া রাতে হাত পা বেশ ভাল করে ধুয়ে তবে শুবি! অবশেষে মোহিলিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মোহিলি তাঁহারে আশ্বাস দিল, যে সে বিহিত করিবে।

    সুঘরাইএর সম্বন্ধে বিবিধ খবরের পর যখন বিশেষত কয়েক দিন বাদে শুনিলেন, যে, ঘুমের মধ্যেই সে দাঁড়াইয়াছে, হাতে তাহার লণ্ঠন, এবং সে ধ্বনি তুলিতেছে! এবং যে তাহার মুখে মৃদু হাসি ছিল, যে সে পুনঃপুনঃ নাসিকা কুঞ্চিত করিয়াছে! এবং সে মাদুরে বসিয়া পার্শ্বস্থিত খাঁচাটিতে কি যেন করে! সে যেন কি বলিতে থাকে পাখীটিরে!

    আদতে যাহা সুঘরাই তখন বলিয়াছে, তাহা এই যে, মা ঠাকরুণের নিকট যে কাগজের গুচ্ছ আছে তন্মধ্যে হরিৎ কাগজের পরেই যে কাগজ (যেহেতু সে ঐ রঙের নাম জানে না) সেই কাগজের ফুল করিতে মা ঠাকরুণকে বলিব, এবং সেই ফুল দিয়া সাজাইব, কেন না এখনই সেই ধ্বনি তুলিতেই আমি দেখিলাম বিবাহ-যাত্রার সেই সাজানতে সেই রঙ।

    কল্যই আমি ঠাকুর ঘরের নর্দ্দমা পুনরায় শুকিব, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার সমগ্র ঐশ্বৰ্য্য মনে পড়িবে, আজই নিশ্চয় হইত, হঠাৎ শনিচারোয়া আপন যদি না আসিয়া উপস্থিত হইত!

    .

    যে সুঘরাই, এখন দ্বিপ্রহর, প্রায় নিঝুম ঠাকুর ঘরের বাহিরের দিকের, নর্দ্দমায় আঘ্রাণ করিতে ছিল; সেখানে নানাবিধ গন্ধদ্রব্যের জল নিষ্কাশিত হয়, ধূম নির্গত হয়, সেখানে ফুলের পাপড়ী ছিন্ন, কখনও কখনও মৃদু পাখীরা জল পান করে। এখানেও যে চমৎকারিত্ব আছে, যে সুঘরাই তাহা জানিত!

    শুদ্ধচারিণী মনিব-পত্নী যখনই উহা পরিষ্কার করিয়াছেন তখন সুঘরাই বাহিরে থাকিয়া পয়ঃনালীর মুখ হইতে দূরে রহিয়া কাজ সঠিক হইয়াছে কিনা তদারক করিয়াছে এবং এই সময়ে পবিত্রতার কাছে থাকিতে সে যেমন শঙ্কিত হইয়াছে–এখন ঐ নর্দ্দমায় কিছু ভীতি ছিল যে সে ডোম,তবু এখন যখন সে আঘ্রাণে ক্রমে ভরপুর এবং মুখমণ্ডল আরক্তিম, কোন একভাবে তীর্থস্থানের অপূৰ্ব্ব ধ্বনি ফুকারিতে চেষ্টান্বিত, ঠিক তেমন সময় শনিচারোয়া উপস্থিত, কহিল,–হে রে ঐখানে কি করিতেছ!

    সুঘরাই থতমত, চকিতে আপন খাঁচাটি যাহা এখানে ছিল তাহা অন্যপাশে স্থাপিত করিল ও ফুল আর কিছু সুতা এবং ছুরিটি এবার হাতে লইয়া কহিল,নর্দ্দমায় ময়লা আছে কি না দেখিতেছি…!

    কি দেখিতেছ? দেখিলাম, তুমি ফের সেইরূপ চীৎকার করিতেছিলে।…আমি দেখিলাম! আমি দেখিলাম!…বল এবার যে লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ নর্দ্দমাকে, লড়াইএর মন্ত্র শিখাইতেছ…!

    যে সুঘরাই মাথা উন্নত করিতে চাহিলেও পারে নাই, কেননা নিকটের পিচ গাছ, কেন না পশ্চাতের ফলসা গাছ, ইহারা সাক্ষ্য দিতেছিল; তাহা সত্যই ঐ শনিচারোয়া উল্লেখিত যাহা, এখন তাহার যুক্তি নিরর্থক, যাহা অবলীলাক্রমে তদীয় জিহ্বায় আসিয়াছিল। সে তেমন স্বর লাগাইবে সিরিয়ার পিছনের মাঠে যেমত ঘটিল,–সেখানে সে খাঁচা সাজানর সরঞ্জাম রাখিয়া খাঁচাটি একহাতে লইয়া দাঁড়াইয়া, কেননা উপবিষ্ট ভঙ্গিতে সে জোর নাই ভাবিয়া, আপন সমগ্র আবেগ সৎসাহস সঞ্চয় করত সেই ধ্বনি তুলিতে থাকে।

    সে ছোট্ট পাহাড়টির পাশে আছে। আজ তাহার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, সে সেই শ্রুত শব্দটি পূর্ণ উচ্চারণ করিতে পারিবে! সে নিজেকে শাসাইয়াছে পৰ্য্যন্ত, যে, আজ যদি না ঠিক পার ত পাঁচ চড়! যে। এবং সে তারস্বরে, হাওয়ার বিপরীতে, সেই ধ্বনি অনুকরণে দিক সকল বিদীর্ণ করিয়াছে। তাহার নির্ধারিত অনেকগুলি তিনবার পার হইয়াও–তিনবার উচ্চারণ করিয়াও সে সফলকাম নহে।

    কাগজের ফলসমূহে হাওয়া ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে, ঝটিতি মনে হইয়াছে সন্ন্যাসী সাধকদের কণ্ঠস্বর সেখানে ফুলেতে দিব্য হইতেছে, হইয়া আছে; আর যে সে তিলমাত্র কালক্ষয় না করিয়া সেই সেই ফুলগুলি তুলিয়া কানের পাশেই ধরিয়াছে, এমত আশায় যে যদি ঐ সম্যক স্বর শুনিয়া নিজ কণ্ঠে তুলিতে পারে, তবেই তাহার সমক্ষে সেই বিবাহ-যাত্রা শোভা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উদ্ভাসিত হইবে।

    আর যে সে তেমনভাবে পক্ষীর খাঁচাটি সাজাইবে!

    কিন্তু যতবার সে মনঃসংযোগ করে, ততবারই বেচারী প্রতারিত, সে বিড়ম্বিত! যে এখন কাগজের পাপড়ীতে বাঁচার-জন্য হাস্যকর আওয়াজ সেখানে, টিকটিকি ধৃত পতঙ্গ যেমন বা। যে সেই ফুলগুলির উপর আক্রোশ তাহার হয় নাই–যদিও সে বালকমাত্র–ইহারা তাহার তিতির নহে, এখন সে তাহা হৃক্ষেপ না করিয়া আবার একাগ্র হইয়াছে, যে ক্রমাগত মুখোনি প্রতিনিয়ত এক বিশেষ উচ্চারণে খেলাইতে চাহিয়াছিল।

    ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সঙ্কল্প তাহাতে থাকিয়া থাকিয়া উৎচকিত হইয়াছে, যে সে ব্রাহ্মণ (পাণ্ডা) বাড়ীতে চুরি করিবে, বামাল বেচিবে ও পরক্ষণেই অদ্ভুত কাল্পনিক দৃশ্য উদঘাটিত হইয়াছে যে সে বামাল বেচিয়া মহুয়া কিনিল, ও তাহার ভগনীপতি মহুয়া খাইয়া শুয়োর ছানা কোলে লইয়া খুব নাচিতেছে!

    কিন্তু ঐ সঙ্কল্প, ঐ দৃশ্য তাহাকে অবাক কিম্বা থ পৰ্য্যন্ত করে না এবং ইহাও সম্ভবত যে-একারণ যে, এখন সে সম্মুখে দেখিয়াছিল কয়েকটি উলঙ্গ বালক প্রায়-উলঙ্গ বালিকা নিকটে আসিল, যাহারা রাখাল ইহারা তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, যে বালক কাঁড়ার (মহিষ) পিঠে আরূঢ়, যে কাঁড়ারের গললগ্নি ঘন্টি বাজে, কহিল,–তোমার কি হইয়াছে, তুমি এরূপ চীৎকার কর কেন?

    যে এবং এই সঙ্গে আর আর নগ্নতা সকল হইতেও ঐ একই প্রশ্ন হইল।

    সুঘরাই একদা আপনকার হস্তধৃত খাঁচার দিকে চাহিল, দেখিল, ফুল আর টুঙী; এবং দেখিল, আপন প্রিয় পক্ষী ঘাবড়াইয়া আছে; আর যে নিখোঁচ কণ্ঠে উত্তর দিল,আমি ইহাকে সাহসী করিতেছি, ইহাকে নির্ভীক…ইহাকে দুর্দান্ত করিতেছি…লড়াই তাহার কাছে শুনা ডাল ভাঙার মত যাহাতে সহজ হয়!…যাহা শুনিয়াছ তাহা এক দারুণ মন্ত্র, ইহাতে তিতির দামাল হয়।

    যে নগ্ন অল্পবয়সীরা ইহা শ্রবণে নিজেদের মধ্যে তর্ক করিল, নিজেদের দেহের বিবিধ স্থানে হাত দিল, কেহ চুলকাইল; সিদ্ধান্ত করিল, আরেঃ বাববা! এক হাট ভৰ্ত্তি জমিদারের বাবার বাবার বাবা, উহার মনিব, কত কত ধনী…এরূপ মন্ত্র নিশ্চয় আছে…আমরা ডিগরিয়া জানি, ত্রিকূট জানি…কত কি জানি না!…আঃ খাঁচাটি কি সুন্দর!…ঐ গোল মত ফল কেমন যেন দেখিতে, আ আমরা কিছুই জানি না; উহাকে কি বলে? কি অপরূপ সে যাহার এরূপ খাঁচা আছে…সে খুব খুব!

    এবং ঐ ধ্বনির কারণ রূপে সুঘরাই সকলকেই ঐ যুক্তি দিয়াছিল। এখন সে নিঃসম্বল দৃষ্টিতে নর্দ্দমাটি দেখিতে থাকে।

    শনিচারোয়া যোগ দিল,–এখন…মালীর বৌ সবই দেখিয়াছে.যে তুমি নিত্য মাঠে যাও সেই তুমি বাহির-এ পাইখানায় গিয়াছিলে…তোমার ছাড়া কাপড় সিঁড়ির পাশে আতা গাছে ছিল (এই বাড়ীর আচার অনুযায়ী) তোমার খাঁচা সিঁড়ির তলায় ছিল…তুমি উলঙ্গ অবস্থায় আসিয়া সাজান-তে ঠিক দাও…পাখীটিরে খোঁচাও…সেখানে চীৎকার ঠিক কর নাই, চাপা স্বরে কর…তুমি বিড়ি খাও না অথচ তাহাকে বলিয়াছ উহা চন্দনী বিড়ি…সে যখন জিজ্ঞাসা করে এত ধূপের মত গন্ধ কেন…ইহার অর্থ কি?

    সুঘরাই এবম্প্রকার প্রশ্নে আশ্চৰ্য্য যে একটুকু বিচাল্যমান নহে, সত্যই যে সে একটি ধূপ জ্বালাইয়া বারম্বার সেই ধ্বনি তুলিতে আপ্রাণ করিয়াছে, মাঠে ঘাটে ঈদৃশী চেষ্টা হাওয়ার নিমিত্ত বৃথা হইয়াছে। তজ্জন্যই, মল্লিক লজের পশ্চাতে একমাত্র ছাদহীন বাড়ীতে সে যায় নাই।

    কারণ সেখানে স্ত্রী-লোকরা বহুসময় যায়! তাই ঐ স্থান, যেখানে সম্মুখের নোনা ধরা দেওয়ালে বিরাট মাকড়সা, ও পাশের দেওয়ালের গায়ে বিশ্রীদর্শন টিকটিকি…আর যে ইতিমধ্যে সে–প্রজ্জ্বলিত ধূপ হস্তে সে পবিত্র ধূমায়িত, সে খানিক চোখ বুজাইতে শঙ্কিত, তথাপি সে নিজেকে সোজা দৃঢ় করিয়াছে এবং সে সেই বিবাহ-যাত্রার সন্ন্যাসী সাধককৃত অভিনন্দন ধ্বনি তুলিয়াছে, ফলে তাহার শরীর কেমন যেমন বেসামাল হইল, তন্ময় হইল, যেন তাহার অন্তরীক্ষে কোথাও মনিব মহাশয়ের বিছানার মত বিছানা–সে শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিল–কি ব্রণ-বিরহিত শুভ্রতা! এখন এবং সে দৃপ্তস্বরে মালীকে কহিল,–সে বিড়ি খাইতেছিল।

    আবার মিথ্যা!…পাপ হইবে…অবশ্য তোমরা ডোম, পাপের কি জান বটে।

    আবার আমাকে ডোম বলিতেছ…দাঁড়াও মাকে বলিব…।

    …কোথায় ডোম বলিলাম? ও…ও…উহা আমার মুখ হইতে…আপনি…। এবং শনিচারোয়া অসহায়ভাবে থামিয়াই আরম্ভিল,কতবার বলিলাম মোহিলিকে আবার ডাকিতে…এখনই সুরাহা হইত!…আমরা ভাবি তোমার কি হইল…!

    সুঘরাই শনিচারোয়ার এই ডোম সম্বোধনে চোরা-হৃষ্ট ছিল। কিন্তু মোহিলির উল্লেখে অল্প বিমর্ষ, অবশ্য মমতাময়ী মনিব পত্নী এখনও, পরিচারিকাবর্গের অনুরোধে কর্ণপাত করেন নাই, এমনও যে স্বল্পভাষী মরদ মিয়া সে-ও এবং অনেকে তাহাকে সুঘরাইকে মাঠে মহাধ্বনি তুলিতে দেখিয়া বলিয়াছিল, ইহা এরূপ কাণ্ড ভাবিবার কথা মা!

    কিন্তু তিনি মৃদু হাসিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন উহা সুঘরাইএর উল্লাস মাত্র খাঁচাটি যেহেতু মনোরম দেখিতে হইয়াছে! কিন্তু ইদানীং সুঘরাই বেশ অনুভব করে যেন তাঁহার সেই-পরিচিত ভাব–যাহা প্রশান্ত প্রসন্নময়ক্রমে অন্তর্হিত হইতেছে; বিশেষত গতকাল সে লক্ষ্য করিল, যে তিনি পাখীটির ঘা বৃদ্ধি দেখিয়া ঔষধ দিতে থাকিয়া কহিয়াছেন,–ফের যদি দেখি খুঁচিয়েছ তাহা হইলে কিন্তু ভাল হবে না…আমি কিন্তু…।

    সুঘরাই এক নূতন স্বরে কহিল,–উহা ঐ পাখী নিজের ঠোঁটেই…বিশ্বাস করুন…খুঁচাইয়া মানে…ঔষধ পৰ্য্যন্ত খাইয়া ফেলে…তাই…।

    ও সব কথা থাক…খবরদার প্রাণী হত্যা হয় যদি তাহলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন…আমি বুঝি না…ও অজ্ঞান…নড়বে চড়বে কোথায়…অত যদি তাহলে পায় দড়ি বেঁধে রাখ…সাজানর চোটে বেচারীর জল খাবার বাটিটা পর্যন্ত সরিয়েছিস, ডোম না হলে এমন নির্মম বুদ্ধি হয়।…চোখ নেই, বেচারী প্রায় ঐখানটিতে বসে থাকে…।

    যে এবং তিনি পাখীটারে সোহাগ জানাইতে কালেই পুনরায় বলিলেন,–তো চন্নামেত্তর খাওয়া কেন? আমারই ভীমরতি!…তুই যে মুখপোড়া বলিস ওকে একবার মারলে আমি নিজে দশবার খাই…কৈ দেখি কোথায় তোর এমন ঘা…বজ্জাত…ঠাকুর, মাগো, এত লোককে তুমি সুমতি দাও, এই ডোম হারামজাদাকে একটু দিতে পার না…পাপ হয় জানিস না…ফের যদি খোঁচাবি!…

    আমি তাহারে ভালবাসি যে!

    কিয়ৎ দূরেই সুঘরাই এই সতর্ক-আজ্ঞা মানিতে অবশ্যই প্রস্তুত হইলেও ইহাও সে জ্ঞাত করিতে উদগ্রীব, কেননা হস্তে-অঙ্কিত বিছা সে দেখে, যে শুধু তাহার দ্বারা বা কোন কিছুর দ্বারাই উহার ক্ষতিসাধন সম্ভব নহে, এ কারণ যে উহাতে এক রহস্যের গোড়া লাগিয়াছে! সুতরাং তাহার মুখে এক নির্ভাবনা অস্পষ্ট হইয়া রহে, কিন্তু ইহা কতক্ষণ, অবিলম্বেই সে বুঝিয়াছিল যে তিনি, মনিবপত্নীও তাহার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাইয়াছিলেন। যাহাতে তাহার অন্তঃস্থল পর্য্যন্ত উদঘাটিত, আর যেমন সে ত্রস্ত ছিল।

    .

    যে ইহা সত্যই, তাহাকে তিনি অনেকবারই ঐ ধ্বনি সম্পর্কে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করিয়াছেন; কিন্তু সুঘরাই কোন সময়ই মূল কারণ প্রকাশিতে সৎসাহস পায় নাই। মধ্যে মধ্যে অদ্ভুত কথা মনে আসিয়াছে, যে একদিন তুমুল বৃষ্টি হয় তখন বলিব, একদিন সাগরি পাখী বাজের দ্বারা তাড়িত হইয়া কুয়োর ভিতরকার বট গাছে বসে তবে–তখন বলিব, একদিন আমার খুব জ্বর হইবে–তখন বলিব।

    মোহিলি বলিয়াছে,-যতদূর মনে হয় দেওঘরে যাওয়াটাই অঘটন হইয়াছে…ডোমের ছেলে…নিশ্চয়ই কোন ফুল বা প্রসাদী কিছু মাড়াইয়াছে…কিম্বা কিছু ছুঁইয়াছে, কোন দেবস্থান চুঁইয়াছে। বা…ভূত হইলে অনেকবিধ জ্বালাতন করিত, তবে সে হয়ত এইরূপে ধীরে ধীরে পাগল হইবে…তবে এখনই সব বুঝা যাইবে… সুঘরাই কোথায়!

    সত্ত্বগুণশালিনী মনিব পত্নীর ডাকে সুঘরাই আসিল, ভৃত্যবৎসলা রমণী সুঘরাইকে আপন কক্ষে লইয়া বলিলেন,বলবি ত বল, না হলে পাখী খোঁচানর আদত কথা মোহিলি তোকে এইসা মতোর দেবে যে…।

    এই পর্যন্ত শুনিয়াই যে সে মোহিলিকে একবার দেখিতেই তাহার আপনার দৃষ্টি যেন কোথাও বা নিবদ্ধ হইয়াছিল–সমক্ষে আয়না ছিল, সে ওষ্ঠদ্বয় জিহ্বার দ্বারা ঈষৎ বুলাইয়া কহিল,–আমি সেই চীৎকার যে কেন করি তাহা বলিতেছি…আমি পাগল নই…আমাতে কোনও প্রেতাত্মা ভর করে না…আমি বহুজন্মের পুণ্য (!)…তাই এই বাড়ীর দাস…এখানে আমি গেঞ্জী পরিয়াছি…বালিশ পাইয়াছি…এমন কি বৰ্ত্তনে খাই…বহু জন্মের পুণ্যবল আমার…তাই মাঠাকরুণ আপনি আমারে বৈদ্যনাথ লইয়া যান…আমি এক উৎকৃষ্ট রত্নসামগ্রী মণ্ডিত, শোভাযাত্রা দেখি! যাহা ভগবান বৈদ্যনাথের কাছে যাইতেছিল!

    আঃ অলৌকিকত্ব! ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী নিশ্চয় ইহা বলিয়া করজোড় করিয়াছিলেন।

    চৌকোণা ছত্র-এর তলে অলোকসামান্য বালিকা, হস্তে ধান্যমঞ্জরী!

    আঃ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ী কাব্যবীজ! সম্পূর্ণ চিত্র মনিব পত্নীর সমক্ষে ভাস্বর হইল!

    সেই নববধূ চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার নাসাথে চাহিলেন, তাহাতে সকলেই করজোড়ে কহিল, আমরা সুখী, সুখী! মুক্তি মুক্তি! আঃ সৌন্দৰ্য্য!

    এবং সাধক সন্ন্যাসীবর্গ নববধূর ত্রিনয়ন দর্শনে নানারূপ ধ্বনি তুলিয়াছিল, এই বলিয়া সে বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি করিতে থাকে।

    আঃ আধ্যাত্মিকতা! বলিতে সময় শুদ্ধা ভক্তিমতী মনিব পত্নীর দেহ পূত রোমাঞ্চে ভরিয়া উঠিল। তাঁহার আয়ত বিশাল নয়নে অশ্রু সঞ্চারিত হইল। ক্রমে যে তিনি নিস্পলক শিখাবৎ তিনি তাঁহাদের প্রিয় নীচকুলোদ্ভব ভৃত্যের প্রতি অতীব শ্রদ্ধায় চাহিয়া আছেন। আশ্চৰ্য- সে পূজা হওয়া ফুল সকল খাইয়াছে।

    যে তখন সুঘরাই কহিতেছিল, আমার খাঁচাটিরে তদ্রূপ আমি সাজাইতে অভিলাষী, আমার কেন কি জানি সমগ্র সজ্জা আমার এক কালে মনে পড়ে না…তাই আমি সেই সন্ন্যাসীবর্গের মত উদাত্ত স্বরে ধ্বনি তুলিয়া থাকি, কথাগুলি আমার যদিও মনে নাই, ধ্বনি তুলিলেই আমার কিছু কিছু প্রত্যক্ষ ঘটে, আমি খাঁচাটিরে সাজাইতে চাই…সেই ছত্র, সেই বিবিধ রত্ন সমুজ্জ্বলতা সেই সামগ্ৰী সমন্বিত!

    মোহিলি দেখিল ঐ ত মৃত্যু! এবং সে মন্ত্রর ধ্বনি হাঁকিল, বালকও দমে নাই–দুজনে নানা ধ্বনি তুলিতে লাগিল।

    পরম বিবেকী মনিব পত্নী আশ্চর্যান্বিত হওয়ত তখনও আত্মস্থ, একদা মনে হইল, এই বালক অপরিমিত! পরক্ষণেই খাঁচার দিকে নেত্রপাত করিলেন, বুঝিলেন যে কেন সুঘরাই খাঁচার অভ্যন্তর ইদানীং সাজাইয়া থাকে, হায় সে যদি পক্ষীটিকে সাজাইতে পারিত–সঠিক থামের মত প্রলম্বিত ফুল রেখা…পূর্বে যেখানে সাজান, খাঁচার বহির্দেশই, প্রতিসম ছিল, উত্তর প্রতি-উত্তর ছিল এখন সেখানে ভেদ উপস্থিত, এক কেন্দ্র ধরিয়া নির্মাণ সঙ্ঘটিত, এক বিস্ময়! এবং তৎকালেই তিনি পক্ষীটিরে নিরীক্ষণ করিলেন, যাহা শ্রান্ত যাহা অপ্রাকৃতিক যাহা বেচারী! যে এবং তিনি অমোঘ স্বরে বলিলেন, ইহা পুরুষ! হায় তাঁহারও ভগবতীতনুর কথা মনে আসিল না!

    সুঘরাই মনিব পত্নী উত্থাপিত এবম্ভূত সত্যের সমক্ষে তথাপি সমগ্র আবেগ দিয়া মহা ধ্বনি তুলিয়া সলজ্জ কণ্ঠে শুধু জানাইল, হয়ত নিশ্চয় সেই কথা এইরূপ! অবশ্য এই ধ্বনি এখন শেষের অক্ষর অর্থাৎ–’রী’ সুস্পষ্ট অভিধানে শুত হইল!

    ধর্ম্মপ্রাণা মনিব পত্নী কহিলেন,–এতদিন কেন বলিসনি…আমি তেমন তেমন সাজিয়ে দেব, যা হোক এখন ডাক্তারকে আমি আসতে বলেছি, পাখীটা কেমন ধুকছে!…বুঝতে পারছি না হঠাৎ কেন এমন হল! খুব খুঁচিয়েছিস বুঝি? একে ত তাজা করতে হবে…না হলে সব বৃথা…।

    সুঘরাই কহিল,–আপনি ভাবিবেন না কাল শনিবার…আমি ড়াডুপোকা উহাকে খাওয়াইব, আমাদের ঘরের পাশে ফণীমনসা হইতে পাতা চয়ন করিব…কেননা তদ্বারা ডাডু ধরা বিধেয়…ডাভু পোকা খাইলে উহার আরোগ্য হইবে…আপনি নিশ্চিন্ত হউন।

    .

    ডাক্তারবাবু পাখীর খাঁচাটি দেখিয়া অভিভূত, যে তিনি খুব সন্তর্পণেই তাহা অবলোকন করিতে থাকিয়া প্রশংসায় কহিলেন,–অভিনব! এরূপ কখনও দেখি নাই…সার্থক!

    সুঘরাই আপনার নিন্দাকে কজা করিয়া টেবিলের একান্তে দণ্ডায়মান যে সে এমন কি খাঁচাটির দিকে। নজর করিতে সক্ষম নহে! সে আপন পাখীটির গায়ে এখন হাত বুলাইতে আছে।

    ডাক্তারবাবু পুনরায় প্রকাশিলেন,–নিশ্চয়…ইহাতে আপনার লক্ষ্মী-শ্রীযুক্ত হাত, নিশ্চয়ই হলপ না। করিয়া বলা যায় যে, আছে…আহা ইহা এই খাঁচা যেন অলকাপুরীকে হার মানাইয়াছে!

    এতাদৃশ গুণকীর্ত্তনে ধীর সৎস্বভাবা মনিব পত্নী কুণ্ঠায়ে বলিলেন,–আমি না, ছোঁড়াই অষ্টপ্রহর ঐ। নিয়ে আছে…উনি বলেন ছোঁড়ার টেষ্ট আছে…খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে কিনে…ফুলগুনো বটে আমি করে দিয়েছি…ছোঁড়ার কত সখ তাজা ফুলের মত গন্ধ হোক, তাই একটু পারফিউম দিয়েছি, তাজা ফুলে পোকা থাকে, পাখী ঠোকরায় দেখে, মানে ওনার সাজান নষ্ট হয় দেখে, উনি খোঁচান ত…তাই বললুম…ও কি মানুষ!…সেই খুঁচিয়েই ত ঘা…এখন আবার আর এক জ্বালা পাখীটা মদ্দিখানে না থাকলে… খোঁচাবে দেখুন দিকি…। এই পর্যন্ত ব্যক্ত করিয়া মনিব পত্নী সুঘরাইএর প্রেরণা, বাস্তবতা, অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে কহিয়া অনুরোধ জানাইলেন,–এখন দেখুন ত ঘা-টা–নিম-ঘি এটা-সেটা সবই ত দিলুম…এ সবই জানেন ওঁর জন্যেই ওঁর আহ্লাদেই হয়েছে…উনি কিছুই বলেন না…!

    .

    যে মনিব পত্নী বহুবারই তাঁহার স্বামীকে সুঘরাইএর এই স্বভাব জ্ঞাত করিয়াছিলেন; তদুত্তরে মনিব মহাশয় তখন বলিয়াছেন,–দেখ…তুমি উহাকে কোন জ্ঞান দিবার আদেশ লইয়া আস নাই…উহারে কুড়াইয়া খাওয়া পাপ অস্বাস্থ্যকর বলিয়া যেমন অনেকে ক্ষান্ত হয়…আমরা তাহা নই। আর যে উহারা এত দুঃস্থ এত নিঃসহায়…পাপ কোথায়…বেচারীর নিয়তি পৰ্য্যন্ত নাই। সে দেহ সচেতন মাত্র নহে…দেখ না হাঁ করিয়া মুখ দিয়া মাছি ধরে…! আমাদের ভক্তির জোর থাকিলে উহার পাপও থাকিবে না…। উহার পাপ আমরা লইব…! কেননা উহা তাহার নহে…! ঠাকুর ভিন্ন গতি নাই…। আমরা কেহ কিছু নই!

    .

    এখন ডাক্তারবাবুর সমক্ষে, স্নেহময়ী মনিব পত্নী এবং সুঘরাইকে আজ্ঞা করিলেন, মুখপোড়া ওকে…পাখীটাকে, উল্টে ধর না…আলতো করে ধর! আমি টর্চ ফেলছি…।

    ডাক্তারবাবু পাখীর দিকে তাকাইয়া কুঞ্চিত করত মন্তব্য করিলেন,–এখন থাক, এ কি পাখী এমন ঝিমাইয়া পড়ে কেন…যেন নিস্তেজ…উল্টাও ত…বুকটা চিতাইয়া ধর…একটা এসেন্সের গন্ধ যেন!

    ঘা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরুচ্ছিল, তাই আমি একটু পারফিউম দিলুম, অন্যায় হয়েছে…।

    তাহা নহে…তবে গন্ধক মানে…।

    গন্ধক…গন্ধক!…এ বাড়ীতে? অবশ্য প্রথম আসার আগে গন্ধক ধোঁয়া দেওয়া হয়…ছোঁড়া গন্ধক কোথায় পেলি…ও বুঝেছি, বন্দুকের টোটা তৈরীর কলে বারুদে…তাই বা…।

    মানে মলম…হ্যাঁ নিশ্চয় কোন মলম এই দেখুন…নিশ্চয় এই মলম পাখী খাইয়াছে…!

    কোথায় পেলি আমি ত দিই নি…তুই কি সেই ফেলে-দেওয়া টিউবটা থেকে…তাতে ত কিছু ছিল না…সেটা বিষ লেখা থাকলেও এত কি…নিশ্চয় তুই সেটা দিয়েছিলি…?

    না…তাতে এমন কিছু হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না…তবে সাময়িক একটু কাজ করিয়াছে…তুমি ত বাপু বড় নিষ্ঠুর,…তুমি ত বড় তামসিক হে…দেখ কি করিয়াছ–শোৎ! পুঁজ, ছি ছি খাঁচাটিরে এরূপ সাজাইতে যখন তোমার মন আছে…তখন…ইহার জন্যই ত বাপু সাজান ছিছি…যতবারই আমার খাঁচার প্রতি দৃষ্টি যাইতেছে ততবারই জানেন আমার মন হইতেছে যে এতেক মনোরমত্ব বুদ্ধি উহাতে যে আছে তাহা আমার কল্পনাতীত…যাহাদের ছটাক জমি পর্য্যন্ত নাই–যাহাদের তাল ও কাঁঠাল আর ব্যাঙের ছাতা খাইয়া জীবনধারণ…গরুর জন্য রক্ষিত ফেন বৈ অন্য কিছু যাহারা চুরি করিতে সাহসী নহে…পাণ্ডা বাড়ীর গাছের শুকনা উড়ন্ত পাতা স্পর্শ করিতে যাহারা ত্রস্ত হয়, তাহাদেরই একজন এই বালক…তাহাতে এত সূক্ষ্মতা!…এই নিষ্ঠুরতা তোমায় পরিত্যাগ করিতে হইবে…পরিত্যাগ কর…তোমার কি মন চাহে না যে পাখীটিরে সকলে দেখিয়া সুখী হয়…! দেখ ত কি বিশ্রী গন্ধ বাহির হইতেছে…।

    যে সুঘরাই, ইহা বলার কথা নহে, ঐ উৎকট ঘেমো গন্ধ কখনও কখনও শুকিতে থাকিয়া, লোকচরাচরের চারিদিকে অপটু দৃষ্টিতে চোখ ফিরাইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে ঘেন্না নাই ও সে ভীত নহে; যে ঐ গন্ধ কুৎসিত ইহা তাহার দ্বারা বিচারিত হয় না, এবং ইহাও নির্ঘাত যে তাহাতে ক্কচিৎ আভাসিতও হয় নাই যে চন্দনাদি গন্ধ দ্রব্যের নিমিত্ত উন্মত্ততা তাহার অন্তরে আছে।

    ঠাকুর করুন তোমাতে মায়ামমতা দেখা দিক! ডাক্তারবাবু যেন প্রার্থনা করিলেন।

    ড়াডুপোকা ফণীমনসার পাতা দিয়া ধরিয়া তিতিরকে খাওয়াইবার বিধিমতে সে লুড়িয়া গ্রামের ঝাঁকাল ফণীমনসা হইতে পত্ৰসংগ্রহ করিতে যায় এবং সেখান হইতে খাঁচাটি হাতে সুঘরাই যখন তাহার ভগনীপতির ঘরের সামনে, তখন হাওয়াতে বৃক্ষের ডালসকল নুইয়া অদ্ভুত রূপ ধারণ করিল, অদূরে কাতার দিয়া লুড়িয়া গ্রামের অনেক উলঙ্গ শিশু–ইহারা পড়িমরি করিয়া সুঘরাইকে অনুসরণে এখানে আসিল, ইহারা খাঁচাটি অবলোকনে সম্মোহিত।

    সুঘরাই হৃষ্টমনে চারিদিকে নেত্রপাত করিল; সে সেই চির-অভ্যস্ত ঘেমো গন্ধ পাইল, কিন্তু খাঁচাটি টলে নাই, যে নিশ্চয় ঐ গন্ধে সে নাসিকা কুঞ্চিত করিবার মুহূর্ত পায় না, যে অথবা অবশ্যই এখনও কোথাও তাহার স্বভাবে সেই গন্ধ সহজ স্বাভাবিক রহিয়া থাকে। কোথাও সে কিস্তৃত হাড়ী, ঘরের কোথাও ছেঁড়া ছেঁড়া চটের থলি এতদিন তরাসে যাহা লক্ষ্য হয় না, অদ্য স্পষ্ট এ সকল তাহার দ্বারা লক্ষিত হইল; ভগনীপতি তাহাকে দেখিয়া, তাহার খাঁচা অবলোকনে এক কোদাল-হা হইয়াছে, সে খুসীতে কখনও কহিল, খুব…খুব…খুব বহুদিবস পরে আত্মীয় দেখিলে…এক পাতা চিড়া দধি দেখিলে, যে আমোদ সেই আমোদ হইল, তোমাকে ও তোমার খাঁচাটি ও পাখীটি দর্শনে বটে আমোদ হইল।

    ঐ লোক আপন রক্ষিতা ও পোষ্য শুয়োরটিকে বারম্বার আজ্ঞা করিল,…দেখ দেখ। এইরূপে এতই সন্তোষ প্রকাশ করে যে তাহা অবর্ণনীয়, যে সে আপন ঊরুদেশে, আপন বাহুতে, কখনও বা বৃক্ষের কাণ্ডে চাপড় মারিল, তাহার শুয়োরটি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিয়া পলাইয়াছিল, ক্রমে সে এতেক গর্বিত যেমন যে, তাহার বসিয়া খাইবার পুঁজি আছে। সুঘরাই ইহাতে স্ফীত অসম্ভব, এতদিন পর ভগনীপতিকে আর মন্দ প্রকৃতির বলিয়া বোধ হয় নাই।

    ভগনীপতি আরও প্রকাশিল যে, লোকমুখে শুনিয়াছি তোমার পাখী ও খাঁচার প্রশংসার…কতবার উহা দেখিতে সাধ হইয়াছে…তুমি ভয়ে আন নাই…আমি কথা দিতেছি কখনও ইহা আমি কাটিয়া খাইবার কথা মুখে আনিব না…আহা খাঁচাটি যেন বিবিধ অলঙ্কার-ভূষিতা রমণীসদৃশ,…না না উহাকে তাড়া দিও না…ঐ বিশ্রীদর্শন কুকুর দেখিয়া, এখানে নূতন লোক দেখিয়া ভড়কাইয়াছে…বাহির করিও না উড়িয়া যাইবে…উহাকে লড়াই শিখাইতেছ ত? হ্যাঁ উহা মস্ত জঙ্গী হইবে…লড়াই লড়াই…এবং সকলেই তোমার পাখী দর্শনে চক্ষু সার্থক করুক, সকলেই গ্রামগ্রামান্তরে এই সংবাদ লইয়া যাক যে রিখিয়ার অন্তঃপাতি লুড়িয়া গ্রামের…হাড়িয়াল ডোমের শালার এক রূপবান পাখী আছে…একি তুমি ভ্রকুঞ্চিত করিয়া আছ কেন…আহা উহারে শাসাইও না…ছি ছি! আঃ খাঁচাটি যে…।

    ইতিমধ্যে পাখীর ব্যবহারে সুঘরাই আরও অপদস্থ, এবং যে তাহাতে এবম্প্রকার বৈচিত্র্য আসিতেছিল যে তন্মহূর্তেই পাখীটিরে আক্রমণ করে, যে সে তীব্র কুপিত, মনে মনে সে বড় আপন এই প্রিয়স্পদের উদ্দেশে মুখ খারাপ করে এবং অনেক গঞ্জনা অনেক আপশোষ তাহাতে বিস্ফারিত, যে যেমন…শালা তোমারে এত শিখাইয়া পড়িয়া আনিলাম…ডাক্তারবাবুর ঔষধই তোমার কাল হইল…বেশ ত ছিলে…সারা দ্বিপ্রহর ধরিয়া আমার সাজানকে বানচাল করিলে…আমার মাথায় তেল দেওয়া বৃথা। গেঞ্জী পরা বৃথা হইল…আমি বাড়ি গিয়াই (মনিব বাড়ী) খাঁচা হইতে তোমাকে বহিষ্কৃত করিব…হুলাড়ে রাত্রযোগে তোমার টুটি ধরিবে…!

    .

    এখনও মায়ামমতাহীন রোষে সে যখন গৰ্জাইতে আছে, তৎকালে ঝটিতি যে মনিব মহাশয়ের স্বর তাহার কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, যে এবং মনিব পত্নীকে সাক্ষাৎ দেখিল, ফলে সমস্ত মানসিকতা পরিবর্তিত, এখন সে কাপুরুষ! আপন সপক্ষে এইটুকু যুক্তি পাখীটিরে দিয়াছে, যে…আমি কি সাধ করিয়া রাগিতেছি…তোমার জন্যই ত সাজানরে, মূঢ়! তুমি যদি, তাহাতে বিশৃঙ্খলতা আনয়ন কর, তাহা হইলে কোন মানুষ না বিরক্ত হয়, আমি তো ডোম…তুমি জংলী, সাজান আমার প্রাণ…আমার সঙ্গ করিয়াও তুমি এখনও ভূত…আমারে দেখিয়া শিখিতে পার না…জান না, সাজানর মধ্যে আমি কি দেখি, আমিও চাই সকলেই তাহা দেখুক!.আর নড়া চড়া করিও না, যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে!

    সত্যই খাঁচাটি সাজানতে তদীয় বিস্ময় নিভাঁজ নিখুঁত পূর্ণ মাত্রায় ঝমরিয়া উঠিয়াছে; ইহাতে তাহার ডোমজ সৰ্ব্বাঙ্গ বিশাল হইল। এমনও যে মহুয়া গাছটিতে টানান হাটতলার যে লাল পোস্টবক্স না-ছুঁইতে-পারার আঁট-হাটতলার ঐ পোস্টবক্স প্রত্যক্ষে সে ঝটিতি তাহারা হয় যে তাহারা সাক্ষাৎ পাপ!ব্যতীত পৃথিবীর পরেও যে আর এক সত্য আছে যে যাহা সুঘরাইতে উদ্ভিন্ন!

    সে খাঁচাটি লইয়া মন্থরগতিতে চলিতে আছে, এখন তাহাতে ইতস্ততর মাত্রা আর নাই! খানিক পথ। অতিক্রম করিতেই এখন এমন হইল যে,–তাহাদের গ্রাম ও রিখিয়ার রাস্তার মধ্যে নলিনীবাবুর বাড়ীর পিছনে (অর্থাৎ আমাদের বাড়ীর) যে বিরাট প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ আছে, সেখানে অনেক জনসমাবেশ, অনেক খাঁটিয়া, অনেক হুঁকা, অনেক ধোঁয়া, অনেক কাশির শব্দ, অনেক কথাবার্তা; এক বৃহৎ চক্র দিয়া বহু লোক উপবিষ্ট!

    ইহা ছোট না-জলচল জাতির সম্মেলন, মনুষ্যচক্রের কেন্দ্রে, মধ্যখানে, এক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত; তন্নিকটে এক যুবতী আসীনা–সে কেঁদে, তৎসহ এবং হুঁকা খাইতে আছে–এই সেই যুবতী, একদা মধ্যরাত্রে তদীয় স্বামীকে হত্যা করে শ্বশুরালয়েই, এবং যে, সেই রাত্রেই সেইখান হইতে একটি মস্ত কাঁঠাল লইয়া প্রায় চার ক্রোশ পথ ভাঙ্গিয়া রিখিয়ায় পিত্রালয়ে পালাইয়া আইসে। এই যুবতাঁকে লইয়া মারাত্মক তর্ক, অন্যান্য জাতির লোকও এখানে উপস্থিত তাহারা দুরে দাঁড়াইয়া আছে।

    মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এখানে আছে–যাহারা অনাহূত তবু তাহারাও মাঝে মধ্যে যুক্তি সরবরাহ করিতেছিল!

    এবং যেইমাত্র ঐ ঐ লোকেদের, সমবেতদের, সুঘরাইকে দৃষ্টিগোচর হয় সেই ক্ষণেই এই বিজ্ঞ সম্মেলন প্রায় ছত্রাকার, যে, ঈদৃশ রোল উঠিল যে, ঐ সে বালক যাহার সুন্দর তিতির আছে, ঐ সেই বালক যাহার খাঁচাটি দেখিতে মহারাণী সমান, ঐ সেই বালক যে এখন খাঁচা লইয়া যায়! যে এবং অজস্র হাতছানি ওতপ্রোত হইল।

    ইহাতে সুঘরাই গৰ্ব্বমিশ্র অস্বস্তিতে আপনার স্কন্ধস্থিত গামছায় ক্কচিৎ যত্ন দিল, তাহার এক পার্শ্বে রৌদ্র, পাখীর খাঁচা সমেত ছায়া তাহারই পদপ্রান্তে, ও যে তাহার পিছনে অনেক গ্রামের শিশু সকল! এবং সমগ্র সভার অনুরোধেতে সে সকলের প্রীতি সম্পাদন পরতন্ত্র খাঁচা হাতে ধীর হস্তীগমনে অগ্রসর হইল।

    প্রাচীন যাহারা তাহাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী, যাহারা ঘেরিয়া বসিয়াছে তাহাদের সকলকে–ইহারা প্রায়ই দূরাগত ভিন্নগ্রামের লোক সুঘরাই পক্ষী দেখাইতে পরিক্রমণ করে, যাহা দেখিতে কালে বিবিধ বিস্ময়সূচক আ আ শব্দের মধ্যেই সুঘরাই শুনিতেছিল, তুমি তোমার রুগ্ন পুরুষের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করিয়াছ এবং অবশেষে তাহারে, প্রমাণ না থাকিলেও, সকলেই বুঝে, হত্যা করিয়াছ, এখন ঐ অগ্নির দিকে চাহিয়া বল, সেই সকালে…, এই দোষারোপ এক প্রাচীন কর্তৃক সেই যুবতী উদ্দেশে ব্যক্ত, ইহাতে সুঘরাই সেই যুবতাঁকে তির্যক দৃষ্টিতে পর্য্যবেক্ষণ করে, যে তাহার মন ঘৃণায় বিষাইয়া উঠিল।

    ক্রমে সে খাঁটিয়া আসীন প্রাচীনদিগের সমক্ষে আসিল, যাহাদের চক্ষু যেমন, কেমন কঠোর, তাহারা এখনও তন্ময় হইতে পারে, ভাবে আবিষ্ট হওয়ত এই অদৃষ্টপূৰ্ব্ব খাঁচা দেখিতে নিয়ত মস্তক ঘুরাইতে থাকিয়াও, খাঁচার অন্তর্বর্তী পাখীর লক্ষণ সকল ইহারা উচিতরূপে ঠাওরে অসমর্থ, সুতরাং কেহ খাঁচাটিতে অঙ্গুলি দ্বারা টোকা দিতে যত্নবান, যাহাতে পাখী সজাগ হয়, যে এবং কেহ ফোড়ন কাটিল, পাখীটি নির্ঘাত মাদি…যদি তাহা নহে তবে এতেক ভীতু কেন? কেহ বলিল,–কেমন যেন করিতেছে?

    বালক সুঘরাই ইহাতে অত্যধিক অপমানিত,–ঐ পরিহাস অসহ্য, যে এবং তৎকালেই সে দেখিল, পাখী তাহার সকল সংস্থান বিধ্বস্ত করত চঞ্চল, যে পক্ষীর এহেন স্বেচ্ছাচারিতার কোন ক্ষমা সুঘরাইএর কোমলতার বাহিরে,–সে মানিতে প্রস্তুত না, যে তাহার রোগগ্রস্ত কাহিল তিতির আতঙ্কিত হইয়াই। স্থলিত পদেই কিয়ৎ স্পন্দিত মাত্র, আর যে সুঘরাই স্থানকাল ভুলিয়া পাখীটিরে আক্রমণে উদ্যত, তৎক্ষণাৎ প্রাচীনমণ্ডলী হইতে তীব্র প্রতিবাদসূচক, সাবধান করা সূচক, গঞ্জনাসূচক নিন্দাবাচক রকমারি শব্দ ছুটিয়া আসিল।

    অতএব সুঘরাই নিবৃত্ত বটেই, তবু যে সে মর্মাহত থাকিয়া ক্রোধে ফুলিতে আছিল, প্রধানত এই কারণে যে, সে কখনও ভাবে নাই, অর্থাৎ এ যাবৎ তাহার অজ্ঞতাই ছিল যাহা, যে,–তদীয় তিতিরকে কেহ তাচ্ছিল্য করিবে; এখনই এই সূত্র হঠাৎ আভাসিত যে, গত হাটের দিন, কোন পথচারীরা–তাহারা কাঁধের বাঁক লইয়া থামে–একে অন্যকে, তাহারই তিতির বিষয়ে, অনেক সাধুবাদের পর মধুর স্বরে কহিল, ইহা দারুণ মরদ, হাঁ হাঁ অদ্যও ইহারই স্মৃতি জাগরণ নিমিত্ত মেঘ হয় বৃষ্টি আইসে; ইহা দারুণ মরদ, যদি এখন বনাঞ্চলে যায় ইহারই চলনভঙ্গিতে বনস্থলীর মাদি কুকুট সকল অত্যাশ্চর্য্য সংকেত ভাষায় কণ্ঠ উন্নত করিয়া আমন্ত্রণ জানাইত পশ্চাদ্দেশ স্ফীত করত উঁচাইয়া মাটিতে বসিবে, ইহা দারুণ মরদ, ইহার প্রখর সকাম চাহনিতে মনুষ্যসমাজের যুবতীজনের জঙ্ঘা ভারাক্রান্ত হয়!

    এখন এই বিজাতীয় সভাতে বিমূঢ় বালক খানিক স্তব্ধভাবে অপ্রতিভ হইয়া যাপনের পরেই, যে আপনকার এক স্কন্ধ হইতে অন্যতে গামছা স্থাপনের পরেই, সদম্ভে ঘোষণা করিল, ইহা দারুণ মরদানা, ইহার কাঁটি সাক্ষাৎ যম, ইহা রমণী-তিতিরগণের আশ্রয়স্থল, ইহা নর-তিতির সকলের কালসদৃশ, ইহার সংহারমূৰ্ত্তি ভয়ঙ্কর…পক্ষাঘাত রোগ পর্যন্ত পলায়ন করে।–যে এবং ইহা ব্যাখ্যানে সে এতই আবেগে এতই উত্তেজনাতে ছিল যে আরও যোগ দিল,…ইহা বহুরূপ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছে, ভুখারির বানর হইতেও যথেষ্ট ইহা দক্ষ…গ্রামের অনেক বালক ইহার কসরৎ দেখিয়াছে, ইহার ক্রীড়ানৈপুণ্যে মদীয়। প্রভুরা চমৎকৃত হইয়া থাকেন…ইহা এক হাত হইতে অন্যটিতেও মস্তকেও ইঙ্গিতমাত্র যায়, বিশুষ্ক পেয়ারা কাঠে ইহার কাঁটি বসে…লড়াইএ ইহা মজবুত! ইহা দারুণ মরদ!–এই আস্ফালনের পরক্ষণেই সুঘরাইএর গাত্রে ঘাম দেখা দিল। পরেই সে স্থবির!

    তখনই সভার চারিদিক হইতে, যাহাদের তিতির আছে–তাহাদের নিকট হইতে চ্যালেঞ্জ আসিল, তাহারা পরস্পর আপন আপন গ্রামের নাম কহিল, যথা সালোয়া, ধরমসী, রতনপুর, বড়কোয়া, শিমবারি ইত্যাদি…এবং তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়া আপনকার উরুদেশ উন্মোচন করিল–চর্মরোগ বিক্ষুব্ধ ক্লিষ্ট যাহা, সদর্পে তথায় চাপড় মারিল একের পর এক! আর যে ঐ একের পর এক-কে অবিলম্বেই নির্ভীক সুঘরাই আপন ছোট ঊরু মেলিয়া রাবণিক ঔদ্ধত্যে চাপড়ে জবাব করিল! কিন্তু অন্যেরা যাহাদের তিতির নাই তাহারা কসরৎ দেখিতে আগ্রহী; নির্বোধ উপায়রহিত সুঘরাই তিতিরটিকে বাহির করিয়া আপন হস্তে বসাইতেই সে মাটিতে পড়িয়া দু’একবার পক্ষ আন্দোলনের পর বসিয়া চুপ!

    যুগপৎ তুমুল হাস্যধ্বনি ও আলোড়ন উৎক্ষিপ্ত হইল; ইহা কি লড়িবে, ইহাকে ঘৃতমিশ্রিত মাংসের ছাঁট খাওয়াও, ইহা মাদি নিশ্চিত–ইত্যাকার রব উঠিল। অন্যপক্ষে সুঘরাই যদিও তিতিরটিকে পদাঘাত করিতে পাশবিক, কিন্তু যে তাহাতে সাড় ছিল না। একদা নির্যাতিত আহতদৃষ্টিতে তিতিরের প্রতি অবলোকন করত কহিল, বেশ বেশ, কল্যই কাহার গ্রামে যাইব বল–যাহা নিকটে তাহা বল!–তাহার কানে দু’একটি নাম বিদ্রুপাত্মক হাস্যভেদ ভাসিয়া আসিল, অতঃপর সে কোনক্রমে মস্তক সটান রাখিয়া ঐ স্থান ত্যাগ করিয়াছে!

    সুঘরাইএর গাত্র অসম্ভব উষ্ণ, সে মতিচ্ছন্ন প্রায় যে সমগ্র খাঁচার সাজ হওয়াতে এবং চলার জন্য নিজ বস্ত্রের শব্দ, বড় হাস্যকর, সভার উপহাস তাহারে দগ্ধ করিতে আছে, ও আপশোষ পরস্পরাতে তাহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত। সে এক আধবার শুধুমাত্র গামছাখানিক এক কাঁধ হইতে অন্যত্রে লইয়াছে, কিন্তু বুঝায় যে সে তখনও এলাইয়া পড়ে নাই, যে সে হাটের পথে, টিলার দিকে, ডাঙু পোকা সংগ্রহে, যেহেতু যায়।

    এমত সময় একদল চেঞ্জার তাহার পথ রোধ করিয়াছিল; খাঁচা দর্শনে তাহারা মহা উচ্ছ্বাসে, এ্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড বলিয়া সুঘরাইএর প্রশংসাতে (এখানকার ধারা বশম্বদ কাহাকেও কালচারড রূপে সনাক্ত করে না) প্রকাশিল, সত্যিই ছেলেটি আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…মোটেই আনকালচারড নহে!…একেবারে আমাদের মতন মডার্ন, না?

    ইহাতে সুঘরাই যথাযথ ভদ্র-অভিব্যক্তিতে কিছু বিনয়ী হইতে কঠিন হইয়া রহে, যে সে অন্যত্রে দৃষ্টি সঞ্চার করিল, দেখিল, লাল পোস্টবক্সটি যাহা গাছের কাণ্ডে সংলগ্ন, তদ্দণ্ডে সে যেন জ্বলিয়া উঠিয়াছে! চেঞ্জাররা তাহারে অতিক্রম করিয়া এখন চলিয়া গিয়াছিল। সুঘরাই আপনকার বস্ত্রের শব্দ শুনিতে থাকে, যে সে এতই উৎক্ষিপ্ত যে মনে হইল পোস্টবক্স বিনষ্ট করে!

    যদি বিচার তাহার দ্বারা সম্ভব হইত, সে মীমাংসা করিতে পারিত না এ ক্রোধ কেন, যেহেতু এতাবৎ তাহাদের জাত পোস্টবক্স ছুঁইত না, তবে দুই এক হাট পূৰ্ব্বে এই সংস্কারের বিরুদ্ধে তেঁড়া দেওয়া হইয়াছে!–এখন সেই পুরাতন প্রথা কেন নির্মূল করা হইল, ইহাই তাহার রোষ–যেন একটি অধিকার বিনষ্ট হইয়াছে, যেন একটি বিদ্বেষ তাহার খোয়া গিয়াছে–এই স্বাধীনতায়ে পুঞ্জীভূত অভিমান তাহাতে চক্র দিয়া উঠিল–অথচ সাধারণত সুঘরাইএর অর্থাৎ তাহাদের জীবনে কোথাও ব্যর্থতা নাই!

    .

    এখন সে হিরণার টিলায় উপস্থিত, খাঁচাটি রাখিতে গিয়া আশ্চর্য্য যে সে যেমত ছুঁড়িয়া ফেলিতে উদ্যত, যে সে অবাক, এমন ক্ষেত্রে সহসা আপনার হাতের উল্কীর প্রতি নজর গিয়াছিল, যে সে যেমন। বা কিস্তৃত ঘোরে, আপনার অঙ্গুলির তথা হাতের স্বাদ গ্রহণ করিতে চাহিল–যে কিন্তু তখনই তাহা এড়াইতে, এই বিশাল সুপ্রসারিত এলোমেলো স্থানসমূহের দিকে সে অবলোকন করিল। এখন দেখিল তাহার ঘর্মসিক্ত গেঞ্জী যেন রোদ, সে যেন ঠাণ্ডা হাওয়া খুঁজিতে আছে। যে সুঘরাই একটি অতীব জটিল শ্বাস ত্যাগ করিল!

    এ শ্বাস তাহার বৰ্তনে খাওয়া হইতে গঠিত।

    সে আপনকার ট্যাঁক হইতে ফণীমনসার পাতাগুলি বাহির করিতেছে সময়েই শুনিল, কে যেমন বা ‘আ তিতি’ উচ্চারণ করিতেছে–যাহা তাহাদের দুজনকার, তাহার আর তিতিরের একমাত্র ভাষা, আরও যে যুগপৎ সে প্রত্যক্ষ করিল যে তাহার আপনকার অঙ্গুলি দিয়া সে জমিতে ঘর্ষণ করিতে আছে। ইহাতে সে বিস্মিত হইয়াছিল। এবার সে পক্ষীর দিকে তাকাইল, দেখিল তাহা কোনমতে দণ্ডায়মান থাকিতে চেষ্টা করিয়াই বসিয়া পড়িল, দেখিল টুঙীগুলি দুলিতেছে কাগজের ফুল সকল শব্দিত! তৎক্ষণাৎ সুঘরাইএর চক্ষু আরক্তিম হইল।

    ইহাতে সে খাঁচার দরজা সন্তর্পণে খুলিয়া পাখীটিরে অনুপ্রবিষ্ট করাইবার প্রয়াস পাইল, এবং যে সে কপট আদরে তিতি শব্দ করিতেই নিজেই উৎকর্ণ হয়, এ যেন মনিব পত্নীর অভিজাত স্বর, এ কারণে তাহার আপনার গ্রীবা কিছু উন্নত যে সে নিজেই তিতির; কিন্তু সম্মুখে রাজসিক সজ্জার অন্তঃস্থিত পাখীটিতে সে তখনই সচেতন, বুঝিল তাহার প্রিয় পক্ষীটি খানিক গ্রীবা তুলিয়া নামাইয়া লইল।

    সুঘরাই আপনাকে সংযত করিয়া কয়েকটি ডাডু পোকা ফণীমনসার পাতায় রাখিয়া উহার সামনে ধরিয়াছে, এবং পুনরায় তাহাকে আহ্বান করিয়াছে, পাখীটি কোনমতে একটি পোকা খাইয়াই যেন ঢলিয়া। পড়িতে চাহিল। সুঘরাই উহার রকমে ক্রমশ ক্রুদ্ধ, অমানুষিকতাতে তাহার হাতে ভারী হইয়া উঠিল, তথাপি সে আপনাকে রুখিয়াছে!

    এই টিলার উপরে তিতিরটি যেন তাহার অপরিচিত, যেন তাহার কেহ নহে, কেমন ন্যাংটা, সে সত্বর পক্ষীটিকে তুলিয়া খাঁচার মধ্যে স্থাপিত করিয়া আপনার অভিপ্রেত সংস্থানে ভিড়াইয়া তাহারে চিনিতে ভালবাসিতে ব্যগ্র, আশ্চর্য্য যে এখন বেচারী তিতিরটি খাড়া দাঁড়াইল, আশপাশে সবুজ নীল টুঙী চারিদিকে ফুলশোভা, মধ্যে মধ্যে আকাশ উল্লেখিল!

    ইহা দর্শনে সুঘরাই যেন লাফাইয়া উঠিল, কিছুদূর হইতে এই বৈচিত্র্য উপভোগ উদ্দেশ্যে সে ঝটিতি দূরে টিলার উাইতে খানিক নামিয়া চক্ষু ফিরাইতেই স্পষ্টই দেখিল তাহার তিতিরটি বিকটভাবে চঞ্চু পৃথক করত কেমন এক ভাব করিতেছে–ধীরে উহার দেহভার এক পায়ের উপর ন্যস্ত হইল এখন তাহার দক্ষিণের ডানা ক্রমে ক্রমে প্রসারিত হইতেই সুঘরাইএর সাজান নষ্টপ্রায়।

    কুরমতি সুঘরাই সবেগে ছুটিয়া আসিল। পাখী যেন তৃষ্ণায় অথবা অন্য কিছুর জন্য তেমনই চঞ্চু ব্যাদানে আছে, ইহা তাহার চোখে পড়িলেও সে গ্রাহ্য করে নাই–সে মহা উম্মায় পাখীটি বাহির করিতেই যে রহস্য গোড়া বাঁধিয়াছিল তাহাই তাহার হাতে সাপের মত উঠিতে ক্রিয়াশীল! সে অবশ্যই বিভীষিত; পূৰ্ব্ব হইতে বিদ্বেষে তাহার চক্ষুতে অগ্নি ক্ষরিতেছিল–এখন সে তপ্রবর্ত্তীত আপনার প্রিয় পাখীটিকে যারপরনাই জোরে আছাড় মারিল।

    পাখীটি গড়াইয়া উৎরাই বহিয়া খানিক তফাতে, ক্ষণেক নিশ্চলতার পরই মনসা পাতাতে ড়াড়ু পোকা লইয়া সে ধাবমান–তিতিরের নিকট পৌঁছে, তাহা ঐ পক্ষী, এক কুৎসিত, তাহা এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য হইয়া আছে!

    সে উহা পক্ষীটিকে তুলিতেই উহার লম্বমান সুশ্রী গ্রীবা শিথিল নেতাইয়া ঝুলিতেছে, সুঘরাই দমিল, পক্ষী গাত্র হইতে আগত ম্লান বিদেশী পারফিউমের গন্ধে তাহারে কোন মানসিকতা দিল না, বরং তাহার চক্ষুর্ধয় কেমন যেমন বিকারগ্রস্ত, হঠাৎ তাহার হাতে পক্ষীর ক্ষতের রস যাহা আঠাল তাহা লাগিতেই সে এক পা সরিয়াছে মাত্র–যেখানে সরিয়াছে তাহা তাহার পলায়নের জগত; নিশ্চয়ই এবং যুগপৎ সে সেই আঠা প্রথমে সচকিতে ও পরক্ষণেই গভীরভাবে শুকিয়াছে!

    ঐ গন্ধ বড় পরিচিত তাহাদের, এবং হঠাৎ ইহাতে তিনবার বলিয়াছে যে আমরা ডোম–যে সে জানে নাই যে, ইহা সে বলে এবং যে তদীয় হস্ত অস্থির ও সে ভূতচালিতের প্রায় পাখীর বক্ষদেশ হইতে অজস্র পালক পৌরাণিক দুৰ্ম্মতিতে উৎপাটিত করিতে কালে অচিরাৎ তাহার দেহের অভ্যন্তরে এক প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার ঘনিয়া উঠিল, অন্যপক্ষে পালক উৎপাটনে বেচারী পক্ষীটির অনেকটা ক্ষতই ওতপ্রোত হইল–এবং সুঘরাইএর ইহা ‘আমরা’ বলাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করিল।

    সত্রাসে সুঘরাই ঐ পক্ষী দূরে নিক্ষেপ করত–ঝটিতি যে সে উন্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিতে থাকিল, যাহা আতঙ্ক, যাহা বেদনা, যাহা আনন্দ, যাহা আহ্বান, যাহা মিলনকামী প্রত্যাশার ডাক, এমনও যে ইহা তাহা নহে। মনোরম খাঁচাটি সে অতীব ক্ষিপ্রতায় হাতে লইতেই চীৎকার যেন আরও দুৰ্ম্মদ আরও খ্যাপাটে, যাহা তীর্থযাত্রায় তধ্বনির বিকৃতি! উড়ন্ত পালকে সে আরও কুটিল হইল।

    ইহা চমৎকার যে সে সুঘরাই এইরূপে মিথ্যারে স্মরণ করিতে চাহিয়াছিল–আ-আধুনিকতা! যে এবং শনৈঃ সে দৃঢ়তায়ে হিরণার টিলায় যেখানে সাড়ু পোকার নিবাস, দাঁড়াইয়া খাঁচাটির প্রতি লুব্ধ নয়নে চাহিয়া আপনার চীৎকারকে আপনা হইতেই ছন্দিত করিল, যেমন সে ছন্দবিধি জানিয়াছে।

    যে এবং এখন কে যেমন বা গীত গাহিতে আছে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা
    Next Article অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদার

    Related Articles

    কমলকুমার মজুমদার

    গোলাপ সুন্দরী – কমলকুমার মজুমদার

    July 17, 2025
    কমলকুমার মজুমদার

    কিচির মিচির – কমলকুমার মজুমদার

    July 17, 2025
    কমলকুমার মজুমদার

    অন্তর্জলী যাত্রা – কমলকুমার মজুমদার

    July 17, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.