Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পৃথিবীর ইতিহাস ২ – সুসান ওয়াইজ বাউয়ার

    ইশতিয়াক খান এক পাতা গল্প641 Mins Read0

    ৩২. দেবতাদের সংঘর্ষ

    অধ্যায় ৩২ – দেবতাদের সংঘর্ষ

    খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮৬ থেকে ১৩৪০ সালের মধ্যে একজন ফারাও বেশকিছু কৌশলগত জোট তৈরি করলেন। এরপর মিশরীয়দের ধর্ম পরিবর্তিত হল এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিব্রুরা মরুভূমিতে বিলীন হয়ে গেল।

    মিতান্নি রাজকন্যা ও মিশরের ফারাও তুথমোসিস চতুর্থ যে জোট তৈরি করেছিলেন, তা সাফল্যের মুখ দেখেছিল। তাদের সন্তান আমেনহোটেপ পরবর্তী ফারাও হন।

    ১৩৮৬ সালের দিকে আমেনহোটেপ তৃতীয় যখন শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন তার বয়স ২০-এর কোঠায় ছিল। তার শাসনামলে মিশরের শহরগুলোতে শান্তি বিরাজ করেছে এবং সেগুলো আগের তুলনায় আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে আমেনহোটেপ তৃতীয়র আমলের শিলালিপিগুলোতে যুদ্ধের বর্ণনা নেই বললেই চলে। সেখানে আছে এমন এক রাজার গল্প, যার হাতে আমোদ, ফূর্তি ও বিনোদনের জন্য প্রচুর সময় ছিল।

    এক বর্ণনায় জানা যায়, তিনি তার শাসনামলের প্রথম ১০ বছরে ১০২টি সিংহ শিকার করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন মিশরীয় রাজাদের প্রিয় বিনোদন ছিল সিংহ-শিকার। আরেকটি শিলালিপিতে ১ দিনে ৫৬টি বন্যষাঁড় মারার বীরত্বপূর্ণ কীর্তির জন্য তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনায় জানা গেছে, ষাঁড়গুলোকে একটি গোলাকার আবদ্ধ জায়গায় প্রথমে জড়ো করা হয়েছিল যাতে ফারাও সেগুলোকে খুব সহজে হত্যা করতে পারেন।

    মিশরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এক চরম উৎকর্ষে পৌঁছে যায়। মাইসেনীতে বিভিন্ন মিশরীয় পণ্যে আমেনহোটেপ তৃতীয়র নাম খোদাই করা অবস্থায় পাওয়া যায়।

    এক বর্ণনায় জানা যায়, রাজা আমেনহোটেপ নুবিয়াতে যেয়ে একটি বিদ্রোহ দমন করতে বাধ্য হন। তবে এই যুদ্ধের কলেবর খুবই ছোট ছিল। রাজপ্রাসাদ থেকে দেওয়া যুদ্ধের বিবৃতিতে জানা যায়, ‘আমেনহোটেপ, রা দেবতার বংশধর, রা-এর সন্তান, রা-এর অতি প্রিয়, জাঁহাপনা আমাদেরকে বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন; এটাই উনার প্রথম যুদ্ধ যাত্রা এবং বিজয়।’

    মজার ব্যাপার হল, আমেনহোটেপের পুরো শাসনামলে, এটাই একমাত্র যুদ্ধের বর্ণনা।

    তিনি নিজের উপাধি হিসেবে বেছে নেন ‘স্মাইটার অব দ্যা এশিয়াটিকস’, অর্থাৎ তিনি এমন একজন শাসক ছিলেন, যিনি নিয়মিত এশিয়াটিকদের (প্রাচীন এশিয়া থেকে আগত যাযাবর) ওপর হামলা চালিয়েছেন। তবে এ উপাধি শুধুই নামসর্বস্ব এবং জনসংযোগের উদ্দেশে নেওয়া; তিনি তার জীবদ্দশায় একজন এশিয়াটিককেও আঘাত করেছেন বলে জানা যায়নি। তার বাবা ও দাদা আগেই তার জন্য রাজত্ব কায়েম করে রেখে গেছেন।

    যুদ্ধের পরিবর্তে তিনি নির্মাণকাজে মনোনিবেশ করেন।

    তিনি প্রায় ১ মাইল লম্বা একটা হ্রদ খনন করেছিলেন, যাতে তার প্রথম স্ত্রী আরামে নৌকাভ্রমণে যেতে পারেন। তিনি স্ত্রীর জন্য সূর্যদেবতার নাম অনুসারে ‘আতেন স্পার্কলস’ নামের একটি রাজকীয় নৌকা নির্মাণ করেন। এছাড়াও, তিনি তার নিজের ব্যবহারের জন্য একটি বড় প্রাসাদ নির্মাণ করেন। পাশাপাশি কার্নাক শহরে আমুন দেবতার মন্দিরের পরিবর্ধন করেন।

    তিনি নিকটবর্তী শহর লুক্সোরে সূর্যদেবতার উদ্দেশে একটি মন্দির তৈরি করেন। পরিশেষে, নিজের জন্য একটি মরচুয়ারি মন্দির (মৃত্যুর পরেও যাতে তার স্তুতি থেমে না যায়) তৈরি করেন। এই মন্দিরের দুইপাশে তার নিজের অবয়বে তৈরি দুইটি বিশাল আকারের মূর্তি ছিল।

    প্রাচীন প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী ডানপাশের মূর্তিটি ভোরে এবং সন্ধ্যায় সজোরে আর্তনাদ করে উঠত। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের ব্যাখ্যা দেন, সূর্যের রশ্মি মূর্তির গায়ে এসে পড়লে নাকি ব্যথা ও বেদনায় তারা এরকম আর্তনাদ করে উঠত।

    আমেনহোটেপ তৃতীয় পাথর আহরণের জন্য নতুন খনি তৈরি করেন এবং মেমফিসে নিজের জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এছাড়াও দেশের আরও দক্ষিণে নীলনদের তীর ঘেঁষে বেশ কয়েকটি জায়গায় মিনার তৈরি করেন।

    আরও একটি গুণ ছিল এই শান্তিপ্রিয়(!) ফারাওর। চোখের সামনে কোনো সুন্দরী রাজকন্যা দেখলেই তাকে তিনি বিয়ে করে ফেলতেন। মেসোপটেমিয়া ও পশ্চিমের সেমাইটদের ভূমির বিভিন্ন কম-গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের কমপক্ষে ৭ জন রাজকন্যা আমেনহোটেপের স্ত্রী হিসেবে রাজপ্রাসাদে আসেন।

    এর পেছনে রাজনৈতিক কারণের চেয়ে ফারাও রাজের ব্যক্তিগত পছন্দের ভূমিকাই বেশি বড় ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। গাজার (নেশাজাতীয় দ্ৰব্য নয়, একটি স্থান) গভর্নরের কাছে পাঠানো এক ট্যাবলেটে ফারাও মন্তব্য করেন, “আমি এই বার্তা দিয়েছি এটা জানাতে যে আমি সুন্দরী রমণী সংগ্রহ করার জন্য রাজসভার এক কর্মচারীকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। মোট ৪০ জন রমণী পাঠাবেন আর প্রত্যেকের জন্য ৪০ রৌপ্যমুদ্রা করে ব্যয় করবেন। নিশ্চিত করবেন তারা যেন সবাই সুন্দরী হয়। সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখবেন যেন তাদের কারো কণ্ঠ কর্কশ না হয়। শুধুমাত্র সেক্ষেত্রে আপনার রাজা, আপনার অধিপতি আপনাকে জানাবেন, ‘খুব ভালো হয়েছে।”

    পিতার মতো আমেনহোটেপ তৃতীয়ও মিটান্নি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার চেষ্টা করেন। তখনও মিটান্নিরা উত্তরদিক থেকে আসা শক্তিশালী ও ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকা হুমকি হিসেবে বিবেচিত। আমেনহোটেপের আপন নানা ও মিটানিদের রাজা আরটাডামার মৃত্যুর পর তার ছেলে সুডার্না দ্বিতীয় সিংহাসনের ভার নেন। যতদিনে আমেনহোটেপ তৃতীয় ক্ষমতা হাতে পান, ততদিনে সম্পর্কে মামা সুডানা ১০-১২ বছর ধরে মিটান্নি সাম্রাজ্য শাসন করে ফেলেছেন।

    আমেনহোটেপ তৃতীয় তার মামার কাছে একটি বউ চেয়ে পাঠালেন প্রত্যুত্তরে তার কাছে একজন রাজকন্যাকে পাঠানো হল, যে ছিল সম্ভবত তারই দূর-সম্পর্কের বোন। তিনি তার নিজের সাম্রাজ্যের গুরুত্বের চিহ্নস্বরূপ সঙ্গে করে ৩১৭ জন ভৃত্য নিয়ে এলেন। তবে তাতে খুব একটা লাভ হয়নি, তিনি আমেনহোটেপের দ্বিতীয় সারির স্ত্রীর কাতারে নাম লেখাতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর সুডার্না তার ছেলে টুশরাট্টার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। টুশরাট্টা ছিলেন আমেনহোটেপের কাছে পাঠানো সেই রাজকন্যার আপন ভাই।

    টুশরাট্টার অভিষেকের পরপরই আমেনহোটেপ তার কাছে আরেকজন স্ত্রী চেয়ে বার্তা পাঠালেন। এবার মিটান্নি ও মিশরীয় ফারাওদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনকে আরও দৃঢ় করার জন্য তিনি তার নিজের মেয়েকে দক্ষিণে পাঠিয়ে দিলেন। ফলে তার বোন ও কন্যা, দুজনই স্থান পেলেন মিশরীয় ফারাও রাজার হারেমে এবং তিনি একইসঙ্গে আমেনহোটেপের শ্বশুর, শালা ও মামাতো ভাইয়ের ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করলেন।

    ফলে অব্যাহত থেকে গেল প্রাচীন মিশরীয়দের আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য জিনতাত্ত্বিক যোগসূত্র।

    তবে আমেনহোটেপকে যতটা শান্তিকামী ও নিরীহ মনে হয়, তিনি ততটা ছিলেন না। তিনি তার মামাতো ভাই/শ্বশুর/শালা ও আর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নীরব চক্রান্তে লিপ্ত হলেন। তিনি আসসুর শহর থেকে আসা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। সেসময় আসসুর ও তার প্রতিনিধি রাজা আসসুরনাদিন আহহে দ্বিতীয় মিটানিদের শাসনাধীনে ছিল। আপাতদৃষ্টিতে ধরে নেওয়া যায়, আমেনহোটেপ লোকচক্ষুর অন্তরালে মিটানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ইন্ধন জোগাচ্ছিলেন।

    সেসময়ের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, আমেনহোটেপের সঙ্গে আসসুরের কূটনৈতিকদের কোনো ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করার কথা ছিল না। মিটাি প্রতিনিধি রাজা বা ভ্যাসেলদের বিদেশি শক্তির সঙ্গে আলোচনা বা চুক্তি করার এখতিয়ার ছিল না, কারণ তারা স্বাধীন ছিলেন না। তবে এক্ষেত্রে কুচক্রী ফারাও আমেনহোটেপ দুহাত বাড়িয়ে এই দূতদের গ্রহণ করলেন। আলোচনা শেষে তাদেরকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে ফেরত পাঠালেন। সঙ্গে পেলেন আসসুরের ধন্যবাদ __ থেকে আসা যেকোনো সম্ভাব্য আক্রমণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।

    একই সময়ে, আমেনহোটেপ মিটান্নিদের জাতশত্রু হিট্টিটদের নতুন রাজার সঙ্গেও একটি গোপন চুক্তি করলেন। সুপ্পিলুলিউমা নামের এই তরুণ, উদ্যমী রাজার পূর্বপুরুষরা কেউই তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনিও মিটানিদের ক্রমশ বাড়তে থাকা শক্তিমত্তাকে ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে, আমেনহোটেপ তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে তা গ্রহণ করতে একবিন্দুও দ্বিধা করেননি তিনি।

    তবে এখানেই থেমে থাকেনি আমেনহোটেপের কূটনৈতিক তৎপরতা। তিনি একইসঙ্গে ব্যাবিলনের বর্ষীয়ান কাসসাইট রাজার মেয়েকে বিয়ে করলেন। সে রাজার ছেলে সিংহাসনে আরোহণের পর তার মেয়েকেও বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন

    একই প্রক্রিয়ায় তিনি মিটান্নির রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

    কিন্তু এবার এক বিচিত্র ঘটনা ঘটল। বিয়ের প্রস্তাবে সরাসরি রাজি না হয়ে ব্যাবিলনের নতুন রাজা চিঠিতে জানালেন, তিনি বহুবছর তার বোনের কোনো খবর পান না। তিনি বলেন, ‘আপনি বিবাহের জন্য আমার মেয়ের হাত চাইছেন। কিন্তু আমার বোন, যাকে আমার পিতা আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তিনি ইতোমধ্যে আপনার সঙ্গে আছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কেউ তাকে দেখেনি। কেউ জানেও না সে বেঁচে আছে না মারা গেছে।’

    আমেনহোটেপ তৃতীয় ফিরতি চিঠিতে কিছুটা বিরক্তি সহকারে জানতে চাইলেন : আপনি কি কখনো কোনো দূত পাঠিয়েছেন, যিনি তাকে ভালো করে চেনেন এবং যার সঙ্গে দেখা হলে তার ভালোমন্দ খবর আপনার কানে পৌঁছাবে? পরিবর্তে আপনারা আমার কাছে দূতের নামে অজানা, অচেনা গদর্ভপালক পাঠিয়েছেন!

    তারপর তিনি ব্যাবিলনের রাজার (সুপ্পিলুলিউমার পিতা) অর্থের বিনিময়ে নিজের মেয়েদের খুশিমনে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার তথাকথিত সুনামের(!) দিকে ইঙ্গিত করেন।

    তবে তার পিতার প্রতি করা এই রুঢ় ইঙ্গিতে একেবারেই গায়ে মাখলেন না ব্যাবিলনের নতুন রাজা। ধারণা করা হয়, তিনি আশাও করেননি যে মিশরীয়দের কাছ থেকে ভদ্র কোনো উত্তর পাবেন। পরবর্তী চিঠিতে তিনি হঠকারিতার সঙ্গে অনুরোধ করে বসেন, তার মেয়েকে ফারাওর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার বদলে বরং তার সঙ্গে মিশরের রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হোক। স্বভাবতই এই দাবি আমেনহোটেপকে একেবারেই খুশি করতে পারেনি।

    দম্ভের সঙ্গে তিনি জানালেন, ‘বিস্মরণকাল থেকে আজ অবধি, মিশরের রাজার কোনো মেয়েকে অন্য দেশের কারও কাছে বিয়ে দেওয়া হয়নি।’

    আমেনহোটেপ অন্যদের সঙ্গে আলোচনা ও চক্রান্ত করতেন, তাদেরকে শত্রু থেকে মিত্রতে রূপান্তরিত করার জন্য বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করতেন; কিন্তু কখনোই তিনি মিত্রদের তার সমকক্ষের মর্যাদা দেননি। তিনি তাদেরকে মূলত নিম্নশ্রেণির মানব হিসেবে বিবেচনা করতেন।

    শাসনামলের ৩০তম বছর এগিয়ে এলে আমেনহোটেপ এই বিশেষ বার্ষিকী উদ্‌যাপনের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। ঐতিহ্যবাহী হেব সেড়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজের শক্তিমত্তাকে পুনরুজ্জীবিত করবেন বলে ঠিক করলেন।

    তবে এই বার্ষিকীর সময় খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন না আমেনহোটেপ। কারণ, দুই দৈব উপকরণ, নীলনদের পানি ও সূর্য, উভয়ই কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। তাদের উপস্থিতির পরিমাণ ছিল প্রত্যাশার চেয়ে কম।

    ইতোমধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি, সূর্যদেবতা ‘রাত মিশরের সবচেয়ে পুরনো ঈশ্বর। আমেনহোটেপ তৃতীয়, রা-এর প্রতি বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি তার একটি রাজকীয় নাম হিসেবে ‘সত্যের অধীশ্বর রা’ ধারণ করেন। বিভিন্ন শিলালিপিতে আমেনহোটেপকে ‘রা-এর বংশধর’, ‘রা-এর পছন্দের মানুষ’ ও ‘দুই ভুবনে রা-এর ভাবমূর্তির প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

    আমেনহোটেপের বিয়ের মতো তার এই ভক্তিও ব্যক্তিগত পছন্দ ও রাজনৈতিক তীক্ষ্ণধীর সমন্বয়। পঞ্চম রাজবংশ ক্ষমতায় আসার পর রা’র পূজারিদের শক্তি কিছুটা খর্ব হয়ে যায়। প্রাচীন পিতৃসম দেবতা আমুনের দিকে অনেকে ঝুঁকে পড়ে এবং আমুনের পূজারিদের শক্তি বাড়তে থাকে। আমুন সবসময়ই এক রহস্যময় দেবতা ছিলেন। তার একটি রূপ ছিল ‘অদৃশ্য’ রূপ। তার ডাকনাম ছিল ‘দ্য হিডেন ওয়ান’, বা ‘যিনি লুকিয়ে থাকেন’। সাময়িকভাবে অন্যদের পরিচয় ও ক্ষমতা চুরি করে ব্যবহারের সুনাম ছিল তার, যা আমাদেরকে নর্স মিথোলজির এক প্রসিদ্ধ চরিত্রর কথা মনে করিয়ে দেয়। এ সবকিছুই তার রহস্যময় ভাবমূর্তিকে আরও দৃঢ় করতে সহায়তা করত এবং প্রকারান্তরে আমুনের পূজারিদের ক্ষমতাও এতে আরও বেড়ে যেত। হাতহেপশুটের উজিরের বিভিন্ন উপাধি থেকে আমরা জানতে পারি, আমুনের পূজারি হওয়ার অর্থ ছিল বস্তুত মিশরের সবধরনের ঐশ্বর্যের ওপর মালিকানা পেয়ে যাওয়া।

    রা-কে তার ব্যক্তিগত ও একমাত্র উপাস্য নির্ধারণ করে আমেনহোটেপ তৃতীয় নিজেকে ও নিজের শাসনামলকে আমুনের পূজারিদের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। এই কৌশল অবলম্বন করে তিনি আমুনের মন্দিরের উদ্দেশে ভূমি ও সম্পদ দেওয়ার হাত থেকেও বেঁচে যান।

    ইতিহাসবিদের দাবি, সূর্যদেবতা রা আমেনহোটেপকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকেও দেবতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসার আমন্ত্রণ জানান। হেব সেট উৎসবের সময় আঁকা এক ছবিতে দেখা যায় আমেনহোটেপের ছেলে তার বাবাকে কুর্নিশ করে সম্মান জানাচ্ছেন ও তার উপাসনা করছেন। এবং আমেনহোটেপকে দেখা যায় সূর্যের জায়গায় চতুর্দিকে আলো ছড়াতে।

    এটা কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল, কারণ রাজার ছেলে আমেনহোটেপ চতুর্থর কথা বা তার কোনো ছবি তার পিতার উদ্দেশে নির্মিত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা মিনারে দেখা যায়নি এবং কোনো শিলালিপিতে তার উল্লেখ করা হয়নি বললেই চলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হত, আমেনহোটেপ তৃতীয় চাননি তার ছেলে ক্ষমতায় আসার আগে পাদপ্রদীপের আলোয় আসুক বা তার ভবিষ্যৎ প্রজাদের কাছে পরিচিত মুখে পরিণত হোক। তিনি ইতোমধ্যে ছেলেকে কুশ সাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। নুবিয়ার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত এই অঞ্চল রাজধানী থেকে বেশ দূরে ছিল। নিজের ছেলে, বা প্রকারান্তরে, তার মসনদের পরবর্তী দাবিদারকে এত দূরে রাখা একটি বিষয়কেই প্রমাণ করে, যা হচ্ছে, আমেনহোটেপ তৃতীয় যত বেশিদিন সম্ভব ততদিন শাসকের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চাইতেন।

    কিন্তু অবশ্যম্ভাবী সত্যকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। ৩৭ বছর রাজত্ব করার পর মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন পরাক্রমশালী রাজা আমেনহোটেপ তৃতীয়। বহুবছর পর খুঁজে পাওয়া মমিতে দেখা যায় আমেনহোটেপের দাঁতের অবস্থা খুবই সঙ্গিন। খুব সম্ভবত এই ক্ষয় হয়ে যাওয়া দাঁতে (প্রকৃতপক্ষে মাড়িতে প্রচণ্ড ব্যথা তাকে সর্বক্ষণ কষ্ট দিয়েছে। পরবর্তীতে মাড়ি থেকে সারাশরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার কারণেই খুব সম্ভবত তিনি মারা যান। তার মিটান্নি মামাতো ভাই/শ্বশুর/ভায়রা ভাই টুশরাট্টা তার জন্য দৈব সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। আসসুর থেকে দীর্ঘদিন আগে উদ্ধার করা দেবী ইশতারের একটি মূর্তি পাঠান টুশরাট্টা। আমেনহোটেপ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠান, কিন্তু অনুমান করা যায়, মেসোপটেমীয় দেবী মিশরে এসে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ইশতার এসে পৌঁছানোর সত্ত্বেও অল্পদিনের মাঝেই আমেনহোটেপ তৃতীয়’র বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে।

    আমেনহোটেপ তৃতীয় একটি দীর্ঘ ও অসামান্য রাজত্বকাল পার করেছিলেন। তার আমলে মিশর এক নজিরবিহীন শান্তি ও সমৃদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই পুরোটা সময়জুড়ে কার্যত নির্বাসনে ছিলেন তার ছেলে আমেনহোটেপ চতুর্থ। পিতার মৃত্যুর পর সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নেন। তার সামনে ছিল পিতার রেখে যাওয়া কাজের পর্বতসম উদাহরণ। আমেনহোটেপ চতুর্থ ঠিক করলেন তার ধর্মকর্মের দিক দিয়ে বাবাকে ছাড়িয়ে যাবেন। বাবা উপাসনা করতেন সূর্যদেবতা রা’র, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ নতুন এক ধর্মের প্রচলন করলেন—সরাসরি সূর্যের উপাসনা।

    চাকতির মতো দেখতে সূর্যকে ‘দ্য আতেন’ বলা হতো এবং আগেও এর ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত এটি শুধুমাত্র সূর্য দেবতা রা’র একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হত। তবে আমেনহোটেপ চতুর্থ’র আমলে এসে এই সূর্য-চাকতি (সান ডিস্ক) উপাস্য হিসেবে এক নতুন পরিচয় পায়।

    ওসাইরিস, হোরাস ও রা ছিল মানুষের মতো দেখতে উপাস্য বা দেবতা। কিন্তু সূর্য-চাকতিকে ঈশ্বরের প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে দেখানো হয়। সূর্যকেই ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা করতে লাগল মিশরীয়রা। অন্য সব দেবদেবীর ক্ষমতা খর্ব হয়ে সকল দৈব ক্ষমতার একমাত্র উৎস হিসেবে সূর্যকে সবার সামনে উপস্থাপন করলেন নতুন ফারাও। এ সময় সূর্য শুধু ক্ষমতার মূল উৎস নয়, বরং একমাত্র ক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। মিশরের প্রাচীন দেবতাদের স্ত্রী ও উপপত্নী থাকত। কিন্তু আতেন ছিলেন একক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। মিশরের দেবতাদের মরণশীল মানুষের মতো চেহারা ছিল, কিন্তু আতেন ছিল নিরাকার। দেবতাদের নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল, কিন্তু আতেনের কোনো গল্প ছিল না।

    স্পষ্টতই, স্রোতের বিপরীতে যেয়ে আমেনহোটেপ চতুর্থ একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকছিলেন।

    তার রাজত্বের ৫ম বর্ষে আমেনহোটেপ পূজারি ও সভাসদদের উদ্দেশে ঘোষণা দিলেন, তিনি এক স্বর্গীয় বার্তা পেয়েছেন। আতেন তাকে এমন একটি জায়গার কথা বলেছেন, যেখানে এর আগে কখনো কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়নি। সেখানেই ঈশ্বরের সম্মানে নতুন রাজধানী শহরের গোড়াপত্তন করতে হবে।

    তার দেখানো জায়গাটি ছিল শুষ্ক, বালু ও আবর্জনায় ভরা সমতলভূমি। এটি নীলনদের পূর্বদিকে, অর্ধচন্দ্রাকারে সজ্জিত পাহাড়-পর্বত দিয়ে ঘেরা একটুকরো ভূমি, যার চারপাশে তেমন কোনো চাষাবাদযোগ্য উর্বর ভূমি ছিল না বললেই চলে। জাগোটি খুবই গরম ছিল, কারণ এর চারপাশে থাকা পাথরের দেয়ালগুলো সূর্যের তাপ সঞ্চয় করত আর পাহাড়গুলো কোনো ধরনের ঠাণ্ডা বাতাসের প্রবাহ ঠেকিয়ে দিত। এরকম এক বৈরী পরিবেশে আমেনহোটেপ নতুন রাজধানী আখেত-আতেন নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন।

    নির্মাণকাজ শুরুর পর তিনি নিজের নামও পরিবর্তন করে নিলেন। তার শাসনামলের ৯ম বছর থেকে প্রায় সবখানে তাকে আমেনহোটেপ চতুর্থের পরিবর্তে ‘আখেন-আতেন” (আখেনাতেন) বা সূর্যের উপাসনাকারী হিসেবে অভিহিত করা শুরু হয়।

    সে মুহূর্ত থেকে মিশরের শাসক আর শুধু ‘রা-এর প্রিয় ব্যক্তি থাকলেন না। তিনি আতেনের সন্তান ও সূর্যের পুত্রে পরিণত হলেন। আতেনের আগে কোনো ঈশ্বর ছিল না। ফারাও রাজা ঈশ্বরের একমাত্র জাগতিক প্রতিনিধি ও প্রতিবিম্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আখেনাতেনের নিজস্ব ক্ষমতা সরাসরি একমাত্র উপাস্যের কাছ থেকে এল। তিনি এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য একটি বয়ান দেন, যেটা তিনি নিজেই রচনা করেন :

    হে আতেনের জীবন্ত রূপ, জীবনের সূচনাকারী! আপনি স্বর্গের দিগন্তে জেগে উঠেছেন…

    আপনি যখন দিগন্তরেখার কাছে ডুবে যান, তখন পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, যেন তার মৃত্যু হয়েছে।

    আবার আপনি যখন দিগন্ত থেকে উঠে আসেন, তখন সমগ্র পৃথিবী আলোকে উদ্ভাসিত হয়।

    কত বিস্তৃত আপনার কীর্তি! সেগুলো মানুষের দৃষ্টি থেকে লুকানো। শুধুমাত্র পবিত্রজনেরা, যাদের সঙ্গে আপনার মুখাবয়বের মিল রয়েছে, শুধু তারাই আপনাকে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে।

    কেননা, আপনার পুত্র আখেনাতেন ছাড়া আর কেউ নেই, যে আপনাকে ঠিকভাবে চেনে। আপনার পরিকল্পনা ও ক্ষমতার জ্ঞান তাকে বিজ্ঞ বানিয়েছে। নতুন শহরে থিতু হয়ে আখেনাতেন সব শিলালিপি থেকে আমুনের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। কর্মীদের বলা হয় লেখাগুলোর ওপর প্লাস্টারের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিয়ে সেগুলোতে আতেনের নাম লিখতে। আখেনাতেন দাবি করেন, আমুন কোনো প্রকৃত ঈশ্বর ছিল না। সে ছিল ঈশ্বরের বিকৃত ও কলুষিত রূপ। ফলে আমুনের ক্ষমতাবান পূজারিদের কপাল পুড়ল। এই সর্বাত্মক ধংসযজ্ঞ এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, অল্পদিনের মধ্যে আমুনের নামগন্ধও আর কোথাও পাওয়া গেল না।

    বাকি দেবতাদের পরিস্থিতিও বিশেষ সুবিধার রইল না। আখেনেতেন আতেনের উদ্দেশে নিবেদিত নতুন মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিলেন। প্রতিটি মন্দিরে খোলা জায়গা থাকত, যাতে সেখানে সূর্যের আলো ঠিকমতো পড়তে পারে। অন্যান্য মন্দিরগুলো বন্ধ করে পূজারিদের বিদেয় করে দেওয়া হল এবং বলিদান নিষিদ্ধ করা হল পুরোপুরি। আতেনের কোনো পূজারির প্রয়োজন ছিল না। এই ফারাও রাজের উচ্চাভিলাষের পথে কোনো ধরনের ধর্মীয় আমলাতন্ত্র বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। এক্ষেত্রে ঈশ্বর কিংবা তার প্রতিনিধি, কেউই কারও সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।

    তবে নাম পরিবর্তন করা সত্ত্বেও আখেনেতেন ছিলেন তার পিতার আদর্শ ও প্ৰকৃত সন্তান।

    আখেনেতেনের ১০০ বছরের রাজত্বের কোনো একপর্যায়ে আরেকটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। আবরাহামের বংশধররা মিশর থেকে পালানোর সময় এ ঘটনা ঘটে।

    পেন্টাটিউখ (মোশির পঞ্চপুস্তক) বা তোরাহ (তাওরাত) ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, ততদিনে আবরাহামের বংশধররা বংশবৃদ্ধি করে একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে, যারা হিব্রু নামে পরিচিত। হিব্রুরা পশ্চিমের সেমাইটিক ভূমিতে মেষপালক ও যাযাবরের জীবন যাপন করছিলেন। তারপর একটি দুর্ভিক্ষ এসে তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। তারা সেখান থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে মিশরের উত্তরাঞ্চলে অভিযোজন করে। সেখানে পানির অভাব না-থাকায় তারা খুব কম সময়ের মধ্যে একটি সমৃদ্ধিশালী জাতিতে পরিণত হয়।

    বাইবেলে বর্ণিত কাহিনিতে এই প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ‘উর্বর’ জাতিকে নিয়ে মিশরীয়দের বিব্রত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা মিশরের প্রাচীরের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মিশরীয়রা সবসময়ই উত্তর থেকে আসা ‘ঘৃণ্য এশিয়াটিকদের অপছন্দ করত। তারা তখনো ভুলেনি; এর অল্পদিন আগেই পশ্চিমের সেমাইটরা, অর্থাৎ হিকসোসরা মিশর দখল করে নিয়েছিল। তারাও হিব্রুদের মতোই কয়েক দশক চুপচাপ মিশরে বসবাস করার পর স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, একই ধরনের আরও একটি সমৃদ্ধিশালী যাযাবর, অভিবাসী জাতি মিশরীয়দের শঙ্কিত করে তুলছিল।

    বাইবেলের দ্বিতীয় গ্রন্থ, দ্য বুক অব এক্সোডাসে বলা হয়েছে, মিশরের ফারাও হিব্রুদের ধরে ধরে তার বিভিন্ন নির্মাণপ্রকল্পের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। তাতেও যখন এই যাযাবর জাতি মরে সাফ হলো না, তখন তিনি নির্দেশ দিলেন সকল পুরুষ-শিশুদের নদীতে নিক্ষেপ করতে। এরকম একটি ছেলেসন্তানের মা জন্মের পর তাকে ৩ মাস লুকিয়ে রেখেছিলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন তার সন্তান অনেক বেশি শব্দ করছে এবং তাকে লুকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেছে, তখন তিনি একটি প্যাপিরাসের ঝুড়ি তৈরি করলেন। তারপর সে ঝুড়িতে শিশুটিকে ঢুকিয়ে বাইরে দিয়ে আলকাতরা দিয়ে ঢাকনাটি সিল করে দিলেন। তারপর তিনি তার সন্তানকে রাজপ্রাসাদের কাছে, নীলনদে ভাসিয়ে দেন। নলখাগড়ার মধ্যে দিয়ে ভেসে সে ভাগ্যবান শিশুটি এসে হাজির হয় রাজকন্যাদের গোসলের জায়গায়। সেখানে এক মিশরীয় রাজকন্যা একদল পরিচারিকাসহ গোসল করতে এসেছিলেন। তিনি শিশুটিকে উদ্ধার করেন। বাচ্চাটিকে হিব্রুসন্তান হিসেবে শনাক্ত করতে পারলেও তাকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সে শিশুটি মোজেস নামে রাজপ্রাসাদে বেড়ে উঠতে শুরু করে।

    বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, একজন রাজকন্যার একটি হিব্রু শিশুকে দত্তক নেওয়ার বিষয়টি এই বৈরী পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। তবে আমরা জানি যে টুথমোসিস চতুর্থ’র আমল থেকেই মিশরের ফারাওরা প্রাচ্যের রাজবংশের মেয়েদের সঙ্গে নিয়মিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন। যার অর্থ, এই রাজকন্যার দেহে পশ্চিমের সেমাইটদের রক্ত থাকার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো তিনি পূর্বে-উল্লেখিত সার্গনের গল্পটিও জানতেন, যেখানে ইউফ্রেটিস নদের বুকে একটি শিশুকে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল :

    আমার মা আমাকে গোপনে গর্ভধারণ করেন।
    তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে আমাকে জন্ম দেন।
    তিনি আমাকে নলখাগড়ার ঝুড়িতে বসান।
    তিনি ঝুড়ির ঢাকনা আলকাতরা দিয়ে সিল করেন।
    তিনি আমাকে নদীতে ভাসিয়ে দেন, কিন্তু সেটি আমাকে গ্রাস করেনি।

    সার্গনের জন্ম-উপাখ্যানটি ছিল তার ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ। নিশ্চিতভাবেই, হিব্রু সন্তানের মা এই গল্পটি জানতেন।

    এমনও হতে পারে, যে তিনি মরিয়া হয়ে সার্গনের জন্ম-উপাখ্যানের মতো আরেকটি গল্প ফেঁদেছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি তার সন্তানকে ঈশ্বরের নিজহাতে পছন্দ-করা মানুষ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালান।

    মোজেস বড় হয়ে মিশর ছেড়ে যান। পরবর্তীতে তিনি আবরাহামের ঈশ্বরের কাছ থেকে নির্দেশ পান। তাকে মিশরে ফিরে যেতে হবে এবং সকল হিব্রু জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। এছাড়াও, আবরাহামের বংশধরদের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমির দখলও তাকে নিতে বলা হয়। তিনি এই দাবি নিয়ে ফারাওর দরবারে হাজির হন। ফারাও তাকে চিনতে পারেন; এই সেই দত্তক নেওয়া হিব্রু সন্তান, যে রাজপ্রাসাদে বড় হয়েছে।

    ফারাও তার দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। আবারও দাবি জানান মোজেস।

    যতবার ফারাও দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করেন, ততবারই ভয়াবহ পর্যায়ের ঐশ্বরিক তাণ্ডব নেমে আসে মিশরে। পরপর ১০টি মহামারিতে আক্রান্ত হন মিশরীয়রা, যার একটার চেয়ে আরেকটা বেশি মারাত্মক। অবশেষে মিশরীয়দের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং ফারাও রাজি হন হিব্রুদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে।

    এই এক্সোডাস বা মুক্তিলাভের ঘটনাটি হিব্রুদের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়-ঘোরানো ঘটনা। এ ঘটনাকে ঘিরেই ইহুদি রাষ্ট্রটির ভিত্তিমূল স্থাপিত। কিন্তু মজার বিষয় হল, মিশরীয় ইতিহাসে এর কোনো উল্লেখ নেই।

    তবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। হিব্রুদের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের বিষয়টি শুধুমাত্র ফারাও ও তাদের রাজসভার ক্ষমতাকেই খর্ব করেনি, এটি একইসঙ্গে মিশরীয় দেবতা ও ঈশ্বরকেও ছোট করেছে। মহামারি বা প্লেগের মাধ্যমে মিশরীয় দেবতাদের অথর্বতা প্রমাণিত হয়। নীলনদের প্রবাহ ছিল ওসাইরিসের ধমনিতে প্রবাহিত রক্তধারার মতো। এই নদের পানিতেই সমগ্ৰ মিশরীয় অর্থনীতি ও জীবনব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল। একের পর এক মহামারিতে সে নদীর পানি রক্তাক্ত ও বিষাক্ত হয়ে যায়। ওসাইরিসের পবিত্র বাণীর বাহক হিসেবে পরিচিত ব্যাঙের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে, তারাও মহামারির জীবাণু বাহকে পরিণত হয়। অন্ধকারে ঢেকে যায় সূর্য। রা এবং আতেন, উভয়ই অসহায় ও অকার্যকর হয়ে পড়েন। এ-ধরনের দুর্যোগের বর্ণনা কোনো মিশরীয় ফারাওর বিজয়গাথায় স্থান করে নিতে পারেনি।

    এক্সোডাসের সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এক বর্ণনায় এ ঘটনার সময়কাল বলা হয়েছে ১৪৪৬ সাল, যার অর্থ, এ ঘটনা ঘটেছে আমেনহোটেপ দ্বিতীয়’র আমলে, যিনি ছিলেন আখেনাতেনের প্রপিতামহ। অন্যেরা এ ঘটনাকে আরও ১০০ বছর পরের ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ বলেছেন আখেনাতেনের রাজত্বের ১০০ বছর পরের ঘটনা এটি। ফলে একদল মানুষ দাবি করছেন এক্সোডাস বলে আলাদা করে কোনো ঘটনা ঘটেনি, কয়েকশো বছর ধরে ধীরে ধীরে মিশরের সব হিব্রুরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পান। খুবই ক্ষুদ্র একদল ইতিহাসবিদের দাবি, এক্সোডাস বলে কিছুর অস্তিত্বই ছিল না।

    তবে আমাদের এই বইয়ের প্রয়োজনে, এটুকু ধরে নেওয়াই যথেষ্ট যে, হিব্রুরা মরুভূমিতে হারিয়ে যায় এবং কয়েক শতকের জন্য আন্তর্জাতিক পটভূমিকা থেকে অনুপস্থিত থাকে। এই সময়টা ইতিহাসের পাতায় তারা প্রায় অদৃশ্য, কিন্তু ধর্মগ্রন্থে তারা কেন্দ্রীয় ভূমিকা ধারণ করেছেন। এই মরুভূমিতেই তাদের পবিত্র গ্রন্থের জন্ম, যে গ্রন্থে হিব্রুদের ঈশ্বর কোনো ধরনের সহযোগী ছাড়া একমাত্র উপাস্য হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিই একমাত্র ঈশ্বর, সবকিছুর মালিক এবং তার নামেই প্রাণের সৃষ্টি।

    হিব্রুদের ঈশ্বরের সঙ্গে মিশরের আতেনের কোনোদিক দিয়েই কোনো মিল নেই। হিব্রুদের ঈশ্বর মানুষের মতো দেখতে না হলেও তিনি একজন ব্যক্তি। আতেন একটি ক্ষমতা বা শক্তি। আতেন হচ্ছে ‘সূর্য’, কিন্তু হিব্রু ঈশ্বরের সঙ্গে পার্থিব কোনো বস্তুর কোনো যোগসূত্র নেই।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপদ্মজা – ইলমা বেহরোজ
    Next Article পৃথিবীর ইতিহাস ১ – সুসান ওয়াইজ বাউয়ার

    Related Articles

    ইশতিয়াক খান

    পৃথিবীর ইতিহাস ১ – সুসান ওয়াইজ বাউয়ার

    July 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.