Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পৃথিবীর সেরা ভৌতিক গল্প – অনীশ দাস অপু

    লেখক এক পাতা গল্প330 Mins Read0

    ঘাতক

    খুন হয়ে যাচ্ছে, এই ভয়টা যেদিন থেকে পেয়ে বসল ওকে, সাহস করে কথাটা কাউকে বলতে পারেনি। আশঙ্কাটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল গত কয়েকমাস ধরে, ধীরে ধীরে প্রবল হচ্ছিল সন্দেহ, ছোট্ট কয়েকটা ঘটনা সেটাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। গভীর এবং তীব্র এক স্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে সে এই মুহূর্তে, নিচের দিকে প্রচন্ড জোরে কে যেন টানছে ওকে, কালো এবং বিশাল এক গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। অষ্ট, টেনিস বল সাইজের ড্যাবডেবে চোখওয়ালা বিকট চেহারার কী ওটা? গোল গোল, চাকা চাকা দাগ খুঁড়গুলোর, এক সঙ্গে প্রসারিত হলো সবকটা; একটা ঝিলিক দেখল সে শুধু, পরক্ষণে টের পেল হিলহিলে গুঁড়গুলো তাকে বেঁধে ফেলেছে ঠান্ডা, কঠিন নিষ্পেষণে। মুখ হাঁ হয়ে গেল তার, চিৎকার করতে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে…

    ঘরটাকে তার মনে হলো বিশাল এক সমুদ্র, ভেসে আছে সে। কিন্তু চারপাশে ওরা কারা? সাদা মুখোশ পরা, হাতে ধারাল যন্ত্রপাতি, কথা বলছে নিচু স্বরেকে আমি, ভাবার চেষ্টা করল সে; কী নাম আমার?

    অ্যালিস লিবার। বিদ্যুৎ চমকের মতো নিজের নামটা মনে পড়ল তার । ডেভিড লিবারের স্ত্রী। কিন্তু তারপরও অস্বস্তি বোধটা দূর হলো না। নিজেকে ভীষণ একা এবং অসহায় মনে হচ্ছে মুখোশধারী লোকগুলোর মাঝে। প্রচন্ড ব্যথা তার শরীরে, বমি উগরে আসতে চাইছে, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মৃত্যুভয়।

    আমি ওঁদের চোখের সামনে খুন হয়ে যাচ্ছি, ভাবল অ্যালিস। ডাক্তার কিংবা নার্সরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না আমার শরীরে কী ভয়ঙ্কর একটা জিনিস ঘাপটি মেরে আছে। জানে না ডেভিডও। শুধু আমি জানি। আর জানে ওই খুনিটা–খুদে গুপ্তঘাতক।

    মারা যাচ্ছি আমি। কিন্তু কাউকে কথাটা বলতে পারছি না। আমার সন্দেহের কথা শুনলে ওঁরা হাসবেন, বিদ্রূপ করে বলবেন–প্রলাপ বকছি। আমি। কিন্তু খুনিটাকে ওঁরা ঠিকই কোলে তুলে নেবেন, ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করবেন না আমার মৃত্যুর জন্য ওটাই দায়ী। শুধু সবাই শোক প্রকাশ করবে আর আমার খুনীর জন্য সবার দরদ উথলে পড়বে।

    ডেভিড কোথায়? অবাক হলো অ্যালিস। নিশ্চয়ই ওয়েটিং রুমে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে আর ঘড়ির দিকে একঠায় তাকিয়ে অপেক্ষা করছে কখন শুনবে সংবাদটা। অ্যালিসের শরীর হঠাৎ ঘেমে গোসল হয়ে গেল, প্রচন্ড ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ও। এবার! আসছে। ওটা! আমাকে খুন করতে আসছে! চিৎকার শুরু করল সে। কিন্তু আমি মরব না। কিছুতেই মরব না!

    বিশাল এক শূন্যতা গ্রাস করল অ্যালিসকে। খালি খালি লাগল পেট। ব্যথাটা হঠাই চলে গেছে। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগল নিজেকে। অন্ধকারের একটা পর্দা দ্রুত নেমে আসছে চোখের ওপর। হে ঈশ্বর, আঁধারের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবল অ্যালিস, শেষ পর্যন্ত ঘটেছে তাহলে ব্যাপারটা…

    পায়ের শব্দ শুনতে পেল অ্যালিস। আস্তে আস্তে কে যেন হেঁটে আসছে।

    দূরে, একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ওকে এখন ডিস্টার্ব কোরো না।

    পরিচিত শেভিং লোশনের সুঘ্রাণ স্বর্গের শান্তি বইয়ে দিল অ্যালিসের . শরীরে। ডেভিড । ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কণ্ঠটা ডা. জেফারসের।

    চোখ খুলল না অ্যালিস। নরম গলায় বলল, আমি জেগে আছি। অবাক কান্ড। কথা বলছে সে। তার মানে মারা যায়নি!

    অ্যালিস! অনুভব করল ওর হাত দুটো উষ্ণ আবেগে চেপে ধরেছে ডেভিড।

    তুমি খুনিটার সঙ্গে দেখা করতে চাইছ, ডেভিড, ভাবল অ্যালিস। আমি শুনতে পাচ্ছি তুমি ওটাকে দেখতে চাইছ, তাহলে আর আমার কিছুই বলার নেই। চোখ খুলল অ্যালিস। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড। দুর্বল হাতটা বাড়াল অ্যালিস, শুজনিটা সরাল একপাশে।

    ঘাতক তাকাল ডেভিডের দিকে। তার ছোট্ট মুখটা লাল, কালো গভীর চোখ জোড়া শান্ত। ঝিকমিক করছে।

    ইসসিরে! হেসে উঠল ডেভিড। কী সুন্দর আমার সোনাটা! চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকল সে, আস্তিন ধরে টান দিলেন ডা. জেফারস।

    না, না, এখন নয়, পরে, বললেন তিনি। নবজাতক শিশুকে এভাবে চুমু খেতে নেই। তুমি আমার চেম্বারে এসো। কথা আছে।

    যাওয়ার আগে অ্যালিসের হাতে চাপ দিল ডেভিড। কৃতজ্ঞ গলায় বলল, ধন্যবাদ, অ্যালিস। অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ক্লিষ্ট হাসল অ্যালিস। কিছু বলল না।

    ডাক্তারের রুমে ঢুকল ডেভিড । হাত ইশারায় ওকে বসতে বললেন ডা. জেফারস। একটা সিগারেট ধরালেন। গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ চুপচাপ টানলেন ওটা। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। সোজা তাকালেন ডেভিডের চোখে।

    বাচ্চাটাকে তোমার স্ত্রী মেনে নিতে পারছে না, ডেভিড।

    কী!

    ওর জন্য খুব কঠিন সময় গেছে। তোমাকে তখন বলিনি তোমার টেনশন বাড়বে বলে। ডেলিভারি রুমে অ্যালিস হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চিৎকার করে অদ্ভুত সব কথা বলছিল–আমি ওগুলো রিপিট করতে চাইছি না। তবে বুঝতে পারছি বাচ্চাটাকে সে নিজের বলে ভাবতে পারছে না। তবে এর কারণটা আমি তোমাকে দুএকটা প্রশ্ন করে জানতে চাই। সিগারেটে বড় একটা টান দিলেন ডাক্তার, একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললেন, বাচ্চাটা কি ওয়ান্টেড চাইল্ড, ডেভিড?

    একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

    জানাটা খুব জরুরি।

    অবশ্যই সে ওয়ান্টেড চাইল্ড, আমরা একসঙ্গে এ নিয়ে প্ল্যান করেছি। অ্যালিস তখন কত খুশি–

    হুমম–সমস্যাটা তো হয়েছে ওখানেই। যদি বাচ্চাটা আনপ্ল্যানড হত তাহলে ব্যাপারটাকে সাধারণ কেস বলে ধরে নিতাম। অপ্রত্যাশিত শিশুকে বেশিরভাগ মা-ই ঘৃণা করে। কিন্তু অ্যালিসের ক্ষেত্রে এটা ঠিক মিলছে না।

    ডা. জেফারস সিগারেটটা ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে ধরলেন, অন্য হাত দিয়ে চোয়াল ঘষতে ঘষতে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা অন্য কিছু হবে। হয়তো শৈশবের কোনো ভীতিকর স্মৃতি ওর তখন মনে পড়েছে। কিংবা আর সব মায়ের মতোই সন্তান জন্ম দেবার সময় মৃত্যুভয় ওকে কাবু করে ফেলেছিল। যদি এরকম কিছু হয় দিন কয়েকের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে, ডেভিড, একটা কথা–অ্যালিস যদি তোমাকে বাচ্চাটার ব্যাপারে কিছু বলে… মানে… ইয়ে, সে চেয়েছিল বাচ্চাটা মৃত জন্ম নিক, তাহলে কিন্তু শকড হয়ো না। আশা করছি সব ঠিক থাকবে। আর যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ওদেরকে নিয়ে এই ব্যাচেলর বুড়ো ডাক্তারের চেম্বারে চলে এসো, কেমন? তোমাদেরকে এমনিতেও দেখতে পেলে খুবই খুশি হব।

    ঠিক আছে, ড. জেফারস। অ্যালিস একটু সুস্থ হলেই সপরিবারে আপনার বাসায় আবার যাব।

    চমৎকার একটি দিন। মৃদু গুঞ্জন তুলে টয়োটা স্কারলেট ছুটে চলেছে বুলেভার্ডের দিকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ডেভিড। আহা, কি সুন্দর নীল আকাশটার রঙ! কাঁচ নামিয়ে দিল ও। রাস্তার পাশের একটা ফুলের দোকান থেকে সুবাস ঝাঁপটা মারল নাকে। প্রাণভরে গন্ধটা টানল ডেভিড। সিগারেটের আনকোরা প্যাকেটটার সেলোফেন ছিঁড়ে একটা সিগারেট জল ঠোঁটে। টুকটাক কথা বলছে অ্যালিসের সঙ্গে। অ্যালিস হালকাভাবে জবাব দিচ্ছে। বাচ্চাটা ওর কোলে। ডেভিড খেয়াল করল আলগোছে ধরে আছে। সে ছোট্ট মানুষটাকে। মাতৃসুলভ কোনো উষ্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে না অ্যালিসের আচরণে। যেন কোলে শুয়ে আছে চীনে মাটির একটা পুতুল। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল ডেভিড।

    আচ্ছা! শিস দিয়ে উঠল ও। বাচ্চার নাম কী রাখব আমরা?

    অ্যালিস বাইরের সবুজ গাছগাছালি দেখতে দেখতে উদাসীন গলায় বলল, এখনও ঠিক করিনি। তবে একদম আলাদা কোনো নাম রাখতে চাই আমি। এখনই এ নিয়ে গবেষণায় বসতে হবে না। আর দয়া করে বাচ্চার মুখে সিগারেটের ধোয়া ছেড়ো না তো। বলল বটে, কিন্তু এ যেন নিছক বলার জন্যই বলা।

    অ্যালিসের গা ছাড়া ভাব আহত করল ডেভিডকে। সিগারেটটা ফেলে দিল জানালা দিয়ে। দুঃখিত, বলল ও।

    বাচ্চাটা চুপচাপ শুয়ে আছে তার মায়ের কোলে। দ্রুত অপসৃয়মান গাছের ছায়ারা খেলা করছে তার মুখে। কালো চোখ দুটো খোলা। ছোট্ট, গোলাপী, রবারের মতো মুখ হাঁ করে ভেজা শ্বাস ফেলছে।

    অ্যালিস এক পলক তাকাল তার বাচ্চার দিকে। শিউরে উঠল।

    ঠান্ডা লাগছে? জানতে চাইল ডেভিড।

    অল্প। কাঁচটা তুলে দাও। ঠান্ডা গলায় বলল অ্যালিস।

    ডেভিড ধীরে জানালার কাঁচ ওঠাল।

    দুপুর বেলা।

    ডেভিড বাচ্চাটাকে নার্সারী রুম থেকে নিয়ে এসেছে, উঁচু একটা চেয়ারের চারপাশে অনেকগুলো বালিশ রেখে তার মধ্যে শোয়াল ওকে।

    অ্যালিস খাবার দিতে দিতে বলল, ওকে অত উঁচু চেয়ারে শুইয়ো না। পড়ে টরে যাবে।

    আরে না, পড়বে না। দেখো এখানে ও দিব্যি আরামে ঘুমাবে। হাসছে ডেভিড। খুব ভাল লাগছে ওর। দেখো, দেখো, ওর মুখ দিয়ে লালা পড়ে কেমন চিবুক ভিজিয়ে দিয়েছে! তোয়ালে দিয়ে বাচ্চার মুখ মুছে দিল ডেভিড। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করল এদিকে তাকিয়ে নেই অ্যালিস।

    বুঝলাম সন্তান জন্ম নেবার সময়টা খুব সুখকর কিছু নয়, চেয়ারে বসতে বসতে বলল ডেভিড। কিন্তু সব মায়েরই তার বাচ্চার প্রতি কিছু না কিছু মায়া থাকে।

    ঝট করে মুখ তুলল অ্যালিস। ওভাবে বলছ কেন? ওর সামনে এসব কথা কক্ষনো বলবে না। পরে বোলো। যদি তোমার বলার এত ইচ্ছে থাকে।

    কীসের পরে! সংযম হারাল ডেভিড। ওর সামনে বললেই বা কি আর পেছনে বললেই বা কি! হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল ও। ডাক্তারের কথা মনে পড়ে গেছে। অ্যালিসের মানসিক অবস্থা এখন ভাল নয়। ওর সঙ্গে রাগারাগি করা চলবে না। ঢোক গিলল ডেভিড। নিচু গলায় বলল, দুঃখিত, অ্যালিস।

    কোনো কথা বলল না অ্যালিস। প্রায় নিঃশব্দে শেষ হলো ওদের মধ্যাহ্ন ভোজন।

    রাতে ডিনারের পর, ডেভিড বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেল ওপরে। অ্যালিস ওকে কিছু বলেনি। কিন্তু ওর নিরব অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল কাজটা ডেভিডকেই করতে হবে।

    নার্সারীতে বাচ্চাকে রেখে নিচে নেমে এল ডেভিড। রেডিওতে মিউজিক বাজছে, অ্যালিস সম্ভবত শুনছে না। ওর চোখ বন্ধ, আড়ষ্টভাবে শুয়ে আছে বিছানায়। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এল ডেভিড। দাঁড়াল অ্যালিসের পাশে। একটা হাত রাখল চূর্ণ কুন্তলে। চমকে চোখ মেলে চাইল অ্যালিস। স্বামীকে দেখে স্বস্তি ফুটল দুচোখের তারায়। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর শরীরে, জড়িয়ে ধরল সে ডেভিডকে। ডেভিড টের পেল ওর আড়ষ্ট শরীর ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে যাচ্ছে, যেন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল কোনো কারণে, এখন পরম আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে স্বামীর বুকে। ডেভিড ওর ঠোঁট খুঁজল। অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল দুজোড়া অধর।

    তুমি, তুমি খুব ভাল, ডেভিড, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অ্যালিস। কত নিশ্চিন্তে তোমার ওপর ভরসা করতে পারি আমি! এত নির্ভরযোগ্য তুমি!

    হাসল ডেভিড। বাবা বলতেন–পুত্র, মনে রেখো, তোমার সংসারে তুমিই একমাত্র অবলম্বন।

    কালো, উজ্জ্বল কেশরাজি ঘাড় থেকে সরাল অ্যালিস। তোমার বাবার যোগ্য পুত্ৰই হয়েছ বটে। তোমাকে পেয়ে এত সুখী আমি। জানো, প্রায়ই ভাবি এখনও যেন আমরা নবদম্পতিই রয়ে গেছি। আমাদের নিজেদের ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে হচ্ছে না, কারও দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, আমাদের কোনো সন্তান নেই।

    ডেভিডের হাত দুটো নিজের গালে ছোঁয়াল অ্যালিস। হঠাৎ অস্বাভাবিক সাদা হয়ে উঠেছে তার মুখ।

    ওহ, ডেভিড, একটা সময় ছিল যখন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। আমরা পরস্পরকে নিরাপত্তা দিতাম। আর এখন এই বাচ্চাটাকে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে, কিন্তু বদলে তার কাছ থেকে কোনো নিরাপত্তা পাব না। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ? হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আমি কত কিছু চিন্তা করেছি। দুনিয়াটা হচ্ছে একটা মন্দ জায়গা-

    তাই কি?

    হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আইন সকল মন্দ থেকে আমাদের রক্ষা করে। যখন আইন বলে কিছু থাকে না তখন ভালবাসা নিরাপত্তার সন্ধান দেয়। আমি তোমাকে আঘাত করছি, কিন্তু আমার ভালবাসা তোমাকে রক্ষা করছে। যদি ভালবাসা না থাকত তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই অসহায় হয়ে পড়ত। আমি তোমাকে ভয় পাই না। কারণ আমি জানি তুমি আমার ওপর যত রাগ করো, বকা দাও, খারাপ ব্যবহার করো, সব কিছুর ওপর ছাপিয়ে ওঠে আমার প্রতি তোমার গভীর প্রেম, নিবিড় ভালবাসা। কিন্তু বাচ্চাটা? ও এত ছোট যে ভালবাসা কিংবা অন্য কোনো কিছুই সে বুঝবে না যতক্ষণ না আমরা তাকে ব্যাপারটা বোঝাই। যেমন ধর, ও কি এখন বুঝবে কোনটা ডান আর কোনটা বাম?

    এখন বুঝবে না। তবে সময় হলে শিখে নেবে।

    কিন্তু… কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল অ্যালিস, নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ডেভিডের বাহুবন্ধন থেকে।

    কীসের যেন শব্দ শুনলাম!

    ডেভিড চারদিকে চাইল । কই, আমি তো কিছু শুনিনি…। লাইব্রেরি ঘরের দরজার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। অ্যালিস। ওই ওখানে, ফিসফিস করে বলল সে।

    ঘর থেকে বেরুল ডেভিড, খুলল লাইব্রেরি ঘরের দরজা। আলো জ্বেলে এদিক ওদিক চাইল। কিছু চোখে পড়ল না। আলো নিভিয়ে আবার ফিরে এল অ্যালিসের কাছে। নাহ্, কিছু নেই, বলল ও। তুমি আসলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। নাও, এখন শুতে চলো দেখি।

    নিচতলার সব আলো নিভিয়ে ওরা উঠে এল ওপরে। সিঁড়ির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে অ্যালিস বলল, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি, ডেভিড । কিছু মনে কোরো না। আসলেই আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই।

    অ্যালিসের কাঁধে হাত রাখল ডেভিড। কিছু মনে করেনি সে।

    নার্সারী রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল অ্যালিস, ইতস্তত করছে। তারপর হাত বাড়াল পেতলের নবের দিকে, দরজা খুলে পা রাখল ভেতরে। খুব সাবধানে এগিয়ে চলল বাচ্চার দোলনার দিকে। ঝুঁকল অ্যালিস, সঙ্গে সঙ্গে কাঠ হয়ে গেল শরীর। ডেভিড! চিৎকার করল ও।

    দৌড়ে দোলনার কাছে চলে এল ডেভিড।

    .

    বাচ্চাটার মুখ টকটকে লাল, সম্পূর্ণ ভেজা; ছোট্ট হাঁ-টা বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে; চোখ দুটো যেন জ্বলছে রাগে। হাতজোড়া সে তুলে রেখেছে শূন্যে, যেন বাতাস খামচে ধরার চেষ্টা করছে।

    আহারে, দরদ ঝরে পড়ল ডেভিডের গলায়, আমার সোনাটা না জানি কতক্ষণ ধরে কেঁদেছে।

    কেঁদেছে? অ্যালিস দোলনার একটা পাশ আঁকড়ে ধরল ভারসাম্য রক্ষার জন্য। কই কান্নার আওয়াজ তো শুনলাম না।

    দরজা বন্ধ, শুনবে কী করে?

    এজন্যই বোধহয় ওর মুখ এত লাল আর এত জোরে শ্বাস টানছে?

    অবশ্যই। আহারে, আমার সোনা রে । অন্ধকারে একা কেঁদে কেঁদে না জানি কত কষ্টই পেয়েছে। আজ রাতে ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাই, কি বলো? এখানে একা থাকলে আবার যদি কাঁদে।

    আদর দিয়ে দিয়ে তুমিই ওকে নষ্ট করবে, বলল অ্যালিস।

    কোনো কথা না বলে বাচ্চাটাকে দোলনাসহ নিজেদের শোবার ঘরে নিয়ে চলল ডেভিড। টের পেল অ্যালিসের চোখ তাদেরকে অনুসরণ করছে।

    .

    নিঃশব্দে কাপড় ছাড়ল ডেভিড। বসল খাটের এক কোনায়। হঠাৎ কি মনে পড়তে হাতের তালুতে ঘুসি মারল ও।

    ধুত্তুরি! তোমাকে বলতে ভুলেই গেছি। আমাকে সামনের শুক্রবার শিকাগো যেতে হবে।

    আবার শিকাগো কেন?

    যাওয়ার কথা ছিল তো আরও দুমাস আগে। তোমার কথা ভেবে পিছিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওদিকের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে না গেলেই নয়।

    কিন্তু তুমি গেলে যে আমি একদম একা হয়ে পড়ব।

    তোমার জন্য নতুন হাউজকীপার ঠিক করেছি আমি। মহিলা শুক্রবার আসবে। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আমি তো মাত্র অল্প কটা দিন থাকব।

    তবুও আমার ভয় করছে। কেন জানি না এত বড় বাড়িতে একা থাকার কথা ভাবলেই বুকটা কেমন করে ওঠে। আমি যদি তোমাকে সব কথা খুলে বলি তুমি নির্ঘাত আমাকে পাগল ঠাওরাবে। আমার মনে হচ্ছে। আমি পাগল হয়ে যাব।

    বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ডেভিড। ঘরের বাতি নেভানো। অন্ধকারে বিছানার ধারে হেঁটে এল অ্যালিস, ব্ল্যাংকেট তুলল, ঢুকল ভেতরে। ক্রিমের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে এল, রমণীর উষ্ণ শরীর উত্তেজিত করে তুলল ডেভিডকে। সে অ্যালিসকে জড়িয়ে ধরল। তুমি যদি আমাকে আরও কয়েকটা দিন পরে যেতে বলো তাহলে আমি

    না, শরীর থেকে ডেভিডের হাতটাকে আস্তে সরাল অ্যালিস। তুমি যাও। আমি জানি ব্যাপারটা জরুরি। আমি আসলে তোমাকে যে কথাগুলো বললাম তখন সেগুলো সম্পর্কে এখন ভাবছি। কিন্তু বাচ্চাটা- শ্বাস টানল ও। তোমাকে সে কি নিরাপত্তা দেবে, ডেভিড?

    কী বলা যায় ভাবছিল ডেভিড। বলবে যে সে যতসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে অহেতুক চিন্তা করে মরছে? এমন সময় খুট করে বেড সুইচ টিপল অ্যালিস। সাদা আলোয় উদ্ভাসিত হলো বেডরুম।

    দ্যাখো, আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল অ্যালিস।

    বাচ্চাটা শুয়ে আছে দোলনায়। চকচকে কালো চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

    আবার বাতি নেভাল অ্যালিস। সরে এল ডেভিডের দিকে। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর।

    যাকে আমি জন্ম দিয়েছি তাকে এত ভয় পাব কেন, অ্যালিসের ফিসফিসে কণ্ঠ কর্কশ এবং দ্রুত হয়ে উঠল। কারণ ও আমাকে খুন করতে চেয়েছে। ও ওখানে শুয়ে আছে, আমাদের সব কথা শুনছে, সব বুঝতে পারছে। অপেক্ষা করছে কবে তুমি বাইরে যাবে আর সে আবার আমাকে খুন করার চেষ্টা চালাবে। ঈশ্বরের দোহাই বলছি! কান্নায় গলা বুজে এল অ্যালিসের।

    প্লীজ! ওকে থামাতে চেষ্টা করল ডেভিড। কেঁদো না, প্লীজ!

    অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল অ্যালিস অন্ধকারে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে থাকল। আস্তে আস্তে কাঁপুনিটা কমে গেল, নিঃশ্বাস হয়ে উঠল। স্বাভাবিক এবং নিয়মিত। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

    চোখ লেগে এল ডেভিডেরও।

    ঘুমের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে একটা শব্দ শুনল সে।

    ছোট্ট, ভেজা, রবারের ঠোঁট থেকে একটা শব্দ। ঘুমিয়ে পড়ল ডেভিড।

    .

    সকালবেলা ঝরঝরে মন নিয়ে ঘুম থেকে জাগল ওরা। অ্যালিস মধুর হাসল স্বামীর দিকে চেয়ে। হাতঘড়িটা দোলনার ওপর দোলাল ডেভিড, সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল কাঁচ। দেখো, বাবু, দেখো, কি চকমকে, কি সুন্দর! কি চকমকে, কি সুন্দর! সুর করে বলছে সে।

    আবারও হাসল অ্যালিস স্বামীর ছেলেমানুষী দেখে। মনে এখন ওর আর কোনো শঙ্কা নেই। ডেভিড নিশ্চিন্তে তার ব্যবসার কাজে শিকাগো যেতে পারে। ভয় পাবে না অ্যালিস। বাচ্চার যত্ন ঠিকই নিতে পারবে সে।

    শুক্রবার সকালে শিকাগোর উদ্দেশ্যে উড়াল দিল ডেভিড। নীল আকাশ, পেঁজা তুলো মেঘ আর সূর্যের ঝকঝকে সোনালি রশ্মি ছুঁয়ে গেল ওকে। ফ্রেশ মুড নিয়ে শিকাগো এয়ারপোর্টে পা রাখল ও। শেরাটন হোটেলে আগেই রুম বুক করা ছিল। ওখানে উঠেই প্রথমে লং ডিসট্যান্স কলে অ্যালিসকে ফোন করে জানাল সে ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে। তারপর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডেভিড। ইমপোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা ওর। পরবর্তী ছটা দিন ঝড় বয়ে গেল ওর ওপর দিয়ে একটা বিজনেস ডিল করতে গিয়ে। এর মধ্যে একদিন লস এঞ্জেলেসে ফোন করল ও। কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া পেল না। ফোন ডেড। তবে চিন্তিত হলো না ডেভিড। মাঝে মাঝে এভাবে ফোন ডেড হয়ে পড়ে ওদের বাসায়। কাছের এক্সচেঞ্জে কমপ্লেন জানালে আবার ঠিক হয়ে যায়। এবারও ওরকম কিছু একটা হয়েছে ভেবে ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবল না সে। কাজের মধ্যে এত বুঁদ হয়ে গেল সে বাড়ির কথা প্রায় মনেই পড়ল না। সপ্তম দিনে, ব্যাংকোয়েট হলে একটা কনফারেন্স সেরে রুমে ফিরেছে ডেভিড, জামা কাপড় ছাড়ছে বিশ্রাম নেয়ার জন্য, ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল ফোন। অপারেটর জানাল লস এঞ্জেলেস থেকে লং ডিসট্যান্স কল। খুশি হয়ে উঠল ডেভিড। নিশ্চয় অ্যালিস। যাক, তাহলে এবার ওদের ফোনটা তাড়াতাড়িই ঠিক হয়েছে।

    অ্যালিস? আগ্রহ ভরে ডাকল ডেভিড।

    না, ডেভিড। ড. জেফারস বলছি।

    ড. জেফারস!

    একটা খবর দেব। কিন্তু ভেঙে পড়া চলবে না। শোনো, অ্যালিস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার ক্লিনিকে আছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো। ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। ভেব না, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব অ্যালিসের জন্য করব। তবে ওর পাশে এখন তোমাকে খুব দরকার।

    হাত থেকে ফোন খসে পড়ল ডেভিডের। কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, পায়ের তলাটা ফাঁকা ঠেকল। মনে হলো অসীম এক ঘূর্ণির মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে ও। ঘরটা অস্পষ্ট হয়ে উঠল, দুলছে।

    অ্যালিস, আর্তনাদ করে উঠল ডেভিড। অন্ধের মতো এগোল সে দরজার দিকে।

    .

    তোমার স্ত্রী মা হিসেবে খুব চমৎকার, ডেভিড। নিজের কথা সে একটুও ভাবেনি। বাচ্চাটার জন্য চিন্তায় চিন্তায়…

    ড. জেফারসের একটা কথাও শুনছে না ডেভিড। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অ্যালিসের পান্ডুর মুখের দিকে। অ্যালিসের মুখের পেশী বার কয়েক কাঁপল, চোখ মেলে চাইল ও। অস্ফুট একটা হাসি ফুটল ঠোঁটে, তারপর কথা বলতে শুরু করল। আস্তে আস্তে বলছে অ্যালিস। মা হিসেবে বাচ্চার প্রতি একজন তরুণীর কি দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাই বর্ণনা দিচ্ছে সে। ধীরে ধীরে গলা চড়ল ও, ভয় ফুটল কণ্ঠে, তীব্র বিতৃষ্ণা বিষোদগার হলো। ডাক্তারের মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন হলো না, কিন্তু ডেভিড বারবার কেঁপে উঠল। থামাতে চাইল ও অ্যালিসকে, কিন্তু পারল না।

    বাচ্চাটা ঘুমাতে চাইত না। আমি ভেবেছিলাম ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ও দোলনায় শুয়ে থাকত আর শুধু চেয়ে থাকত। আর গভীর রাতে উঠে কাঁদতে শুরু করত, সারারাত। একের পর এক রাত। কত চেষ্টা করেছি থামাতে। পারিনি। আর আমিও ওর কান্নার চোটে একটা রাতও ঘুমাইনি।

    মাথা নাড়লেন ড. জেফারস। ক্লান্তির চরমে পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু এখন ও দ্রুত আরোগ্যের পথে। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে আশা করি।

    অসুস্থ বোধ করছে ডেভিড। বাচ্চা? আমার বাচ্চাটার কী অবস্থা?

    ও ঠিকই আছে।

    ধন্যবাদ, ডক্টর। আপনাকে যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব…

    ওকে ওকে, সান। এমনিতেই খাটো মানুষ আমি। কৃতজ্ঞ করে আরও খাটো কোরো না। বরং ধন্যবাদ প্রাপ্য তোমাদের ওই হাউজকীপারের। অ্যালিস অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বাথরুমে। এমনিতেই ক্লান্ত শরীর, তারপর প্রচন্ড ঠান্ডা। ভাগ্যিস নিউমোনিয়াটা ওকে খুব বেশি কাবু করার আগেই আমি উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। তোমাদের হাউজকীপার যদি বাথরুমের দরজা ভেঙে অ্যালিসকে বের করতে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি করত তাহলে ওকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে উঠত। এনিওয়ে, অ্যালিসকে তুমি শিগগিরই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে। কাজেই চিন্তার কিছু নেই।

    ডাক্তার দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেলেন। অ্যালিস দুর্বল গলায় ডাকল, ডেভিড!

    ঘুরল ডেভিড। জড়িয়ে ধরল অ্যালিসকে। অ্যালিস ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে থাকল। ভীত গলায় বলতে শুরু করল, আমি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলাম। তোমাকে বুঝতে দিইনি হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেও আমি শরীরে পুরো শক্তি ফিরে পাইনি। কিন্তু বাচ্চাটা আমার দুর্বলতা টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই প্রতি রাতে ওটা কাঁদত। কিন্তু যখন কাঁদত না তখন অস্বাভাবিকরকম নিরব থাকত। আমি রাতে ঘরের বাতি জ্বালাতে সাহস পেতাম না। জানতাম আলো জ্বাললেই দেখব ও আমার দিকে একঠায় তাকিয়ে আছে।

    ডেভিড জড়িয়ে ধরে আছে অ্যালিসকে। অ্যালিসের প্রতিটি কথা ও উপলব্ধি করতে পারছে অন্তরে অন্তরে। বাচ্চাটাকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ও, টের পাচ্ছে ওর উপস্থিতি। এই বাচ্চা প্রতিদিন গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে যখন আর সবার বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবে ঘুমায়। এই বাচ্চা জেগে থাকে, যখন কাঁদে না তখন চিন্তা করে। আর তার দোলনা থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। এসব কি হচ্ছে? নিজেকে ভর্ৎসনা করল ডেভিড। এত চমৎকার তুলতুলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসব কী ভাবছে সে। অ্যালিসের দিকে মনোযোগ দিল সে।

    অ্যালিস বলে চলেছে, আমি বাচ্চাটাকে খুন করতে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তাই। তুমি যেদিন শিকাগো গেলে তার পরদিনই আমি ওর ঘরে ঢুকে ঘাড়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু হাত শুধু ঢুকিয়েই থাকলাম। অনেকক্ষণ নড়তেই পারলাম না। ভীষণ ভয় লাগছিল আমার। তারপর বিছানার চাদর দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে, উল্টো অবস্থায় রেখে দৌড়ে পালালাম ঘর থেকে।

    ডেভিড ওকে থামাতে চাইল।

    না, আমাকে আগে শেষ করতে দাও। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফেঁসে গলায় বলল অ্যালিস। ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলাম ঠিক কাজটাই করেছি আমি। বাচ্চারা দোলনায় কাপড় পেঁচিয়ে এভাবে শ্বাসরোধ হয়ে কতই তো মারা যায়। কেউ জানবেই না যে আমিই কাজটা করেছি। কিন্তু ওকে মৃত অবস্থায় দেখব বলে যেই ঘরে ঢুকেছি… ডেভিড, বিশ্বাস করো, দেখি কি ও মরেনি! হ্যাঁ, মরেনি। বেঁচে আছে। তোষকে পিঠ দিয়ে হাসছে আর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। তারপর ওকে আর আমার ধরার সাহসই হলো না। আমি সেই যে ও ঘর থেকে চলে এলাম আর সেদিকে গেলাম না। আমি ওকে খাওয়াতেও যাইনি কিংবা একবার দেখতেও যাইনি। হয়তো হাউজকীপার ওকে খাইয়েছে। ঠিক জানি না। আমি, শুধু জানি সারারাত সে চিৎকার করে কেঁদে আমাকে জাগিয়ে রাখত। আর মনে হতো সমস্ত বাড়িতে ওটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় আমি ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। হাঁপিয়ে উঠছে অ্যালিস। দম নিতে একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, বাচ্চাটা ওখানে সারাদিন শুয়ে থাকে আর খালি আমাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ ও বুঝতে পেরেছে ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছি। ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই; আমাদের মধ্যে কোনো নিরাপত্তার বন্ধন নেই; কোনোদিন হবেও না।

    দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ল অ্যালিস। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। ডেভিড অনেকক্ষণ বসে থাকল ওর শিয়রে, নড়তে ভুলে গেছে যেন। ওর রক্ত জমাট বেঁধে গেছে শরীরে। কোথাও একটা নার্ভও কাজ করছে না। দিন তিনেক পরে অ্যালিসকে বাড়ি নিয়ে এল ডেভিড। সিদ্ধান্ত নিল পুরো ব্যাপারটা সে জানাবে ড. জেফারসকে। তিনি অখন্ড মনোযোগে ডেভিডের সব কথা শুনলেন।

    তারপর বললেন, দেখো, ডেভিড, তুমি ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করো। কখনও কখনও মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘৃণা করেন, এটা এক ধরনের দ্বৈতসত্তা। ভালবাসার মধ্যে ঘৃণা, প্রেমিক-প্রেমিকারা হরহামেশা খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করছে। কয়েকদিন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। বাচ্চারাও তাদের মায়েদের ঘৃণা করে…।

    বাধা দিল ডেভিড, আমার মাকে আমি কখনো ঘৃণা করিনি।

    করেছ। কিন্তু স্বীকার করবে না। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ তার প্রিয়জনদের ঘৃণা করার কথা কখনো স্বীকার করতে চায় না।

    কিন্তু অ্যালিস তার বাচ্চাকে ঘৃণা করার কথা স্পষ্ট করে বলছে!

    বরং বলো সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ঘৃণা এবং ভালবাসার যে স্বাভাবিক দ্বৈতসত্তা রয়েছে, সে ওটা থেকে একটু এগিয়ে গেছে। স্বাভাবিক ডেলিভারির মাধ্যমে ওর বাচ্চার জন্ম। নরক যন্ত্রণা সহ্য করেছে সে সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। এই প্রায় মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এবং নিউমোনিয়ার জন্য অ্যালিস বাচ্চাটাকেই একমাত্র দায়ী মনে করছে। নিজের সমস্যা সে নিজেই সৃষ্টি করছে, কিন্তু দায়ভারটা তুলে দিচ্ছে হাতের কাছে যাকে সবচেয়ে সহজ টার্গেট হিসেবে পাচ্ছে, তার ওপর। আমরা সবাই এটা করি। চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেলে দোষ দিই ফার্নিচারটার । অথচ নিজেরা যে সাবধান নই সেদিকে খেয়াল রাখি না। ব্যবসায় ফেল করলে অভিসম্পাত করি ঈশ্বর, আবহাওয়া কিংবা আমাদের ভাগ্যকে। তোমাকে নতুন করে কিছু বলার নেই। আগেও যা বলেছি আজও তাই বলছি। লাভ হার। ওকে আরও বেশি বেশি ভালবাস। পৃথিবীর সেরা ওষুধ হলো ভালবাসা। ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ওর প্রতি তোমার স্নেহটাকে ফুটিয়ে তোলো, ওর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তোলো। ওকে বোঝাও বাচ্চারা কত নিষ্পাপ আর মোটেও অনিষ্টকারী নয়। বাচ্চাটার মূল্য কারও চেয়ে কম নয় এই অনুভূতি ওর মধ্যে জাগিয়ে তোল। দেখবে কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। মৃত্যুভয় ভুলে যাবে অ্যালিস, ভালবাসতে শুরু করবে তার বাচ্চাকে। যদি আগামী মাসের মধ্যেও ওর কোনো পরিবর্তন না দেখো, তাহলে আমাকে। জানিও। ওকে কোনো ভাল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠাব। এখন তুমি যেতে পার। তবে দয়া করে চেহারা থেকে অসহায় ভাবটা মুছে ফেল।

    .

    শীত ফুরিয়ে বসন্ত এল। বসন্তকে বিদায় দিল গ্রীষ্ম। ডেভিডদের বুলেভার্ডের বাড়িতে সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। ডেভিড তার কাজে ব্যস্ত থাকছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ সময় সে ব্যয় করছে স্ত্রীর জন্য। অ্যালিস এখন অনেকটাই সুস্থ। বিকেলে দুজনে মিলে হাঁটতে যাচ্ছে পার্কে, কখনো সামনের লনে ব্যাডমিন্টনের নেট ঝুলিয়ে পয়েন্ট গুণে খেলছে, ডেভিডকে হারাতে পারলে হাততালি দিয়ে উঠছে বাচ্চাদের মতো। আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে পাচ্ছে অ্যালিস। মনে হচ্ছে ভয়টার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে ও।

    তারপর একদিন রাতে প্রবল ঝড় হলো। আকাশের বুক চিরে সাপের জিভের মতো ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, ভীষণ শব্দে বাজ পড়ল কাছে কোথাও, হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন যেন কাঁপিয়ে দিতে লাগল বাড়িটাকে। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল অ্যালিস। ঘুম ভেঙে জড়িয়ে ধরল স্বামীকে, ওকেও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করল। অ্যালিসকে আদর করতে করতে ডেভিড জানতে চাইল কী হয়েছে।

    ভয়ার্ত গলায় অ্যালিস বলল, কে যেন আমাদের ঘরে ঢুকেছে। লক্ষ করছে আমাদেরকে।

    আলো জ্বালাল ডেভিড। আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ, সস্নেহে বলল সে। এতদিন তো ভালই ছিলে। আবার কী হলো? আলো নেভাল সে।

    অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অ্যালিস। তারপর হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে বুকে চেপে ধরে থাকল ডেভিড, ভাবল তার এই মিষ্টি বউটা কি সামান্য কারণেই না ভয় পায়।

    হঠাৎ ঘুম চটে যাওয়ায় আর ঘুম আসছিল না ডেভিডের। অনেকক্ষণ আগডুম বাগডুম ভাবল সে। শব্দটা হঠাৎ কানে এল। খুলে যাচ্ছে। বেডরুমের দরজা। ইঞ্চিকয়েক খুলে গেল পাল্লা দুটো।

    কেউ নেই ওখানে। বাতাস থেমেছে বহুক্ষণ।

    চুপচাপ শুয়ে থাকল ডেভিড। মনে হলো এক ঘণ্টারও বেশি সময় সে অন্ধকারে শুয়ে আছে।

    তারপর, অকস্মাৎ গোঙানির মতো কান্নার আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। কাঁদছে বাচ্চাটা।

    গোঙানির শব্দটা অন্ধকারের মধ্যে গড়িয়ে এল, ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, যেন প্রতিধ্বনি তুলল দেয়ালে। এই সময় আবার শুরু হলো ঝড়।

    ডেভিড খুব আস্তে আস্তে একশো গুণল। থামছে না বাচ্চা, একভাবে কেঁদেই চলেছে।

    সাবধানে অ্যালিসের বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল ডেভিড, নামল বিছানা থেকে। স্যান্ডেলে পা গলিয়ে এগোল দরজার দিকে।

    ও এখন নিচে, রান্নাঘরে যাবে, ঠিক করল ডেভিড। খানিকটা দুধ গরম করে চলে আসবে ওপরে, তারপর…।

    মিশমিশে অন্ধকারটা যেন মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল সামনের থেকে, পা পিছলে গেছে ডেভিডের। নরম কী একটা জিনিসের ওপর পা-টা পড়েছিল, টের পেল অসীম শূন্যের এক কালো গহ্বরের মধ্যে ছিটকে যাচ্ছে সে।

    উন্মাদের মতো হাত বাড়াল ডেভিড, প্রচন্ড ঝাঁকি খেল কব্জি জোড়া, ধরে ফেলেছে রেলিং। নিজেকে গাল দিল একটা।

    কীসের ওপর পা দিয়ে পিছলে পড়েছিল ডেভিড? জিনিসটা কী বোঝার জন্য হাতড়াতে শুরু করল অন্ধকারে। মাথায় দ্রিম দ্রিম ঢাক বাজছে। হৃৎপিন্ড যেন গলার কাছে এসে ঠেকেছে, প্রচন্ড ব্যথা করছে হাত।

    নরম জিনিসটা খুঁজে পেল ডেভিড। গায়ে আঙুল বুলিয়েই বুঝতে পারল, একটা পুতুল। বিদঘুঁটে চেহারার বড়সড় এই পুতুলটা সে কিনেছিল তার বাচ্চার জন্য।

    হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না ডেভিড। কে যে এভাবে জিনিসপত্র ছড়িয়ে রাখে! নাহ, হাউজকীপারটা দেশের বাড়ি গিয়ে মুশকিলই হলো দেখছি। আরেকটু হলেই ভবলীলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছিল ডেভিডের। অত উঁচু থেকে সরাসরি সিমেন্টের মেঝেতে আছড়ে পড়লে বাঁচত নাকি সে? ভাগ্যিস রেলিংটা ধরে ফেলেছিল।

    পরদিন, নাস্তার টেবিলে কথাটা বলল অ্যালিস। আমি দিন কয়েকের জন্য একটু ভ্যাকেশনে যেতে চাই। তুমি যদি সময় করতে না পারো, আমাকে একাই যেতে দাও, প্লীজ। হাউজকীপার বুধবার আসবে। সে একাই বাচ্চার যত্ন নিতে পারবে। আমি ওকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছি না। আসলে বলতে পারো আমি কয়েকদিনের জন্য ওর কাছ থেকে পালাতে চাইছি। ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা –মানে ভয়টা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু তা আর পারলাম কই? ওর সঙ্গে এক রুমে আর থাকতে পারছি না আমি। ও এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন প্রচন্ড ঘৃণা করে আমাকে। এভাবে আরও কিছুদিন চললে আমি সত্যি পাগল হয়ে যাব। আমার মন বলছে খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সেটা ঘটার আগেই আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে চাই।

    থমথমে মুখে চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল ডেভিড। তোমার আসলে এখন দরকার একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি যদি তোমাকে বাইরে যেতে বলেন তাহলে যেয়ো। কিন্তু এভাবে আর চলে না। তোমার টেনশনেই আমি মরলাম!

    মুখ কালো হয়ে গেল অ্যালিসের। অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর ওর দিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ। আমাকে একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। ঠিক আছে, কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। তুমি যেখানে বলবে সেখানেই আমি যেতে রাজি, ডেভিড।

    ডেভিড ওর ঠোঁটে চুমু খেল। ডোন্ট টেক ইট আদার ওয়ে, ডার্লিং। তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাটা বলিনি। তুমি তো জানোই, তুমি আমার কাছে কতখানি। তোমার সামান্য কষ্ট হলেও আমি দিশেহারা হয়ে যাই।

    মুখ তুলল অ্যালিস। জানি। আমি কিছু মনে করিনি। যাকগে, আজ ফিরবে কখন?

    অন্যান্য দিনের মতোই। কেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?

    এমনিই। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরলে আমি একটু স্বস্তি পাই। চারদিকে এত অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আর যে জোরে গাড়ি চালাও, আমার খুব ভয় করে।

    ও তো আমি সবসময়ই চালাই। অ্যাক্সিডেন্টে মরব না, একশোভাগ গ্যারান্টি দিলাম। অ্যালিসের ফর্সা গাল টিপে দিল সে। হাসতে হাসতে বলল, চলি, দৃঢ় পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ডেভিড। ফ্রেশ মুড নিয়ে।

    .

    অফিসে পৌঁছেই ড. জেফারসকে ফোন করল ডেভিড। জানতে চাইল তাঁর জানাশোনা ভাল কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট আছে কিনা। একজন নির্ভরযোগ্য নিউরোসাইকিয়াট্রিস্টের কথা বললেন ডাক্তার। জানালেন তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখবেন, ডেভিডকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল ডেভিড। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে।

    সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর যখন ফ্রী হলো ডেভিড, অনুভব করল বাসায় যাওয়ার জন্য কী ব্যগ্র হয়ে আছে মন। লিফটে নামার সময় গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ল ওর। অ্যালিসকে আছাড় খাওয়ার কথা বলেনি সে। পুতুলটার কথা বললে সে যদি অন্যভাবে রিয়্যাক্ট করে । থাক, দরকার নেই বলার। অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট।

    সূর্য ডুবে গেছে আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের আড়ালে। টকটকে লাল আভা ছড়িয়ে আছে ওদিকের আকাশে। সিঁদুর রঙা মেঘগুলো আশ্চর্য সব মূর্তি একে রেখেছে আকাশের বুকে। অপূর্ব! একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে ডেভিড।

    গাড়ি বারান্দায় টয়োটা রাখল ডেভিড। অ্যালিসকে নিয়ে এখনই আবার বেরুবে। ঠিক করেছে লং ড্রাইভে যাবে। ফেরার পথে রাতের খাবারটা সেরে নেবে কোনো রেস্টুরেন্টে।

    হাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল ডেভিড। বুক ভরে টেনে নিল তাজা বাতাস। পেছন থেকে মিষ্টি স্বরে ডেকে উঠল একটি পাখি। কলিংবেলে চাপ দিল। পিয়ানোর টুং টাং শব্দ বাজতে শুরু করল দোতলায়। দেড় মিনিট পার হওয়ার পরেও অ্যালিস আসছে না দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠল ওর। ঘুমিয়ে পড়েনি তো অ্যালিস। কিন্তু এ সময় তো ওর ঘুমাবার কথা নয়। দরজার নবে হাত রাখল ডেভিড। মোচড় দিল। ধাক্কা দিতেই খুলে খেল দরজা। কপালে আরও একটা ভাঁজ পড়ল ওর। সদর দরজা কখনো ভোলা রাখে না অ্যালিস। দিনকাল ভাল নয় জানে। তাহলে কী হলো আজ মেয়েটার।

    ঘরে ঢুকেই উঁচু গলায় ডাকল ডেভিড, অ্যালিস! কোনো উত্তর নেই। আবারও ডাকতে গেল, কিন্তু হাঁ হয়েই থাকল মুখ। দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছে সে, ভয়ের তীব্র একটা ঠান্ডা স্রোত জমিয়ে দিল ওকে।

    কিস্তৃত পুতুলটা পড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। কিন্তু পুতুল নয়, ডেভিড তাকিয়ে আছে অ্যালিসের দিকে। অ্যালিসের হালকা পাতলা দেহটা দুমড়ে মুচড়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। যেন একটা ভাঙা পুতুল, আর কোনোদিন খেলা করা যাবে না। কোনোদিন না।

    মারা গেছে অ্যালিস।

    বাড়িটি আশ্চর্যরকম নিঃশব্দ, শুধু ডেভিডের বুকে হাতুড়ির আঘাত পড়ছে দমাদম।

    মারা গেছে অ্যালিস।

    মাথাটা দুহাতে আঁকড়ে ধরল ডেভিড, স্পর্শ করল চম্পক অঙ্গুলি। ভীষণ ঠান্ডা। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে থাকল ডেভিড অ্যালিসকে। কিন্তু ও তো আর বেঁচে উঠবে না, আর কখনও জলতরঙ্গ কণ্ঠে ডাকবে না তার নাম ধরে। বাঁচতে চেয়েছিল অ্যালিস। তার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ ডেভিড বাঁচাতে পারেনি তার প্রিয়তমাকে, পারেনি নিরাপত্তা দিতে।

    উঠে দাঁড়াল ও। ড. জেফারসকে ফোন করতে হবে। কিন্তু নাম্বারটা মনে পড়ছে না। ভূগ্রস্তের মতো উঠে এল ডেভিড দোতলায়। সম্মোহিত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল নার্সারী রুমের দিকে। খুলল দরজা। পা রাখল ভেতরে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল দোলনার দিকে। পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠছে। কোনোকিছু ঠাহর করতে পারছে না ভাল মতো।

    বাচ্চাটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, কিন্তু মুখখানা লাল, ঘামে চকচক করছে, যেন অনেকক্ষণ একভাবে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

    ও মারা গেছে, ফিসফিস করে বলল ডেভিড। মারা গেছে অ্যালিস।

    তারপর সে হঠাৎ হাসতে শুরু করল। নিচু গলায় হাসতেই থাকল। সংবিৎ ফিরে পেল গালে সজোরে চড় খেয়ে। চমকে উঠল ড. জেফারসকে দেখে। তিনি একের পর এক চড় মারছেন ওকে আর চেঁচাচ্ছেন, শান্ত হও, ডেভিড। প্লীজ, কাম ডাউন।

    অ্যালিস মারা গেছে, ড. জেফারসকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলল ডেভিড। পড়ে গেছে ও দোতলা থেকে পা পিছলে। গত রাতে আমিও পুতুলটার গায়ে পা পিছলে প্রায় মারা যাচ্ছিলাম। আর এখন

    ড. জেফারস ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। জানেন, আমি ওর সুন্দর একটা নাম দেব ভেবেছিলাম। এখন কি নাম দেব জানেন? লুসিফার!

    .

    রাত এগারোটা। অ্যালিসকে গোরস্তানে কবর দিয়ে এসেছে ডেভিড । শুকনো মুখে বসে আছে লাইব্রেরি ঘরে। অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল, ভেবেছিলাম অ্যালিসকে ভাল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব। ভেবেছিলাম ওর মাথায় গন্ডগোল হয়েছে। কিন্তু এখন বুঝছি বাচ্চাটাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা অমূলক ছিল না।

    ডাক্তার সশব্দে শ্বাস ফেললেন। অ্যালিসের মতো তুমিও দেখি ছেলেমানুষী শুরু করলে। অসুস্থতার জন্য অ্যালিস বাচ্চাটাকে দোষ দিত আর এখন তুমি ওর মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করছ। খেলনাটার ওপর পা পিছলে দোতলা থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙেছে অ্যালিসের। এজন্য তুমি কোনোভাবেই বাচ্চাটাকে দায়ী করতে পারো না।

    ওটা লুসিফার। চুপ করো! ওই শব্দটা আরও কখনো মুখে আনবে না।

    মাথা নাড়ল ডেভিড। অ্যালিস রাতে অদ্ভুত সব শব্দ শুনত, কে যেন হাঁটছে ঘরে। আপনি জানেন, ড. জেফারস, কে ওই শব্দ করত? বাচ্চাটা। ছয়মাসের একটা বাচ্চা, অন্ধকারে ঘুরে বেড়াত, আমাদের সব কথা শুনত। চেয়ারের হাতল চেপে ধরল ডেভিড। আর আমি যখন আলো জ্বালাতাম, কিছু চোখে পড়ত না। বাচ্চাটা এত ছোট, যে কোনো ফার্নিচারের আড়ালে লুকিয়ে পড়াটা ওর জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না।

    থামবে তুমি! বললেন ডাক্তার।

    না, আমাকে বলতে দিন। সব বলতে না পারলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি গতবার ব্যবসায়ের কাজে শিকাগো গেলাম, তখন কে অ্যালিসকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল, কে তার নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছিল? বাচ্চাটা। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও যখন অ্যালিস মরল না, তখন সে আমাকে খুন করতে চাইল। ব্যাপারটা ছিল স্বাভাবিক; সিঁড়িতে একটা খেলনা ফেলে রাখো, বাপ তোমার জন্য দুধ না নিয়ে আসা পর্যন্ত কাঁদতে থাকো, তারপর সে অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে ঘাড় ভাঙুক। সাধারণ একটা কৌশল, কিন্তু কাজের। আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি। কিন্তু ফাঁদটা অ্যালিসকে শেষ করেছে।

    একটু থামল ডেভিড। হাঁপিয়ে গেছে। তারপর বলল, বহু রাতে আমি আলো জ্বেলে দেখেছি ওটা ঘুমায়নি, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ শিশু ওই সময় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু ও জেগে থাকত, চিন্তা করত।

    বাচ্চারা চিন্তা করতে পারে না।

    ও পারে। আমরা বাচ্চাদের মন সম্পর্কে কতটুকুই বা জানি? অ্যালিসকে ওর ঘৃণা করার কারণও ছিল। অ্যালিস ওকে মোটেও স্বাভাবিক কোনো শিশু ভাবত না। ভাবত অস্বাভাবিক কিছু। ড. জেফারস, আপনি তো জানেনই জন্মের সময় কত বাচ্চা তাদের মায়েদের খুন করে। এই নোংরা পৃথিবীতে জোর করে টেনে আনার ব্যাপারটা কি ওদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে? ডেভিড ক্লান্তভাবে ডাক্তারের দিকে ঝুঁকল। পুরো ব্যাপারটাই এক সুতোয় বাঁধা। মনে করুন, কয়েক লাখ বাচ্চার মধ্যে কয়েকটা জন্মাল অস্বাভাবিক বোধ শক্তি নিয়ে। তারা শুনতে পায়, দেখতে পায়, চিন্তা করতে পারে, পারে হাঁটাচলা করতে। এ যেন পতঙ্গদের মতো। পতঙ্গরা জন্মায় স্বনির্ভরভাবে। জন্মাবার কয়েক হপ্তার মধ্যে বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু সাধারণ বাচ্চাদের কয়েক বছর লেগে যায় হাঁটতে, চলতে, কথা বলা শিখতে।

    কিংবা ধরুন, কোটিতে যদি একটা বাচ্চা অস্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করে? জন্মাল একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মেধা এবং শক্তি নিয়ে। কিন্তু সে ভান করল আর দশটা বাচ্চার মতোই। নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রমাণ করতে চাইল, খিদের সময় তার স্বরে কাঁদল। কিন্তু অন্য সময় অন্ধকার একটা বাড়ির সব জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে সে, শুনছে বাড়ির লোকজনের কথাবার্তা। আর তার পক্ষে সিঁড়ির মাথায় ফাঁদ পেতে রাখা কত সোজা! কত সহজ সারারাত কেঁদে কেঁদে তার মাকে জাগিয়ে রেখে অসুস্থ করে তোলা।

    ফর গডস শেক! দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার, উত্তেজিত। এসব কি উদ্ভট কথা বলছ তুমি!

    উদ্ভট শোনালেও ব্যাপারটা সত্যি, ড. জেফারস। মানুষটা ছোট বলেই আমরা ওকে সন্দেহ করতে পারছি না। কিন্তু এই খুদে সৃষ্টিগুলো ভীষণ রকম আত্মকেন্দ্রিক। কেউ ওদের ভাল না বাসলে ঠিকই টের পেয়ে যায়। তখন তাদের প্রতি ওদের ঘৃণা উথলে ওঠে। আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে স্বার্থপর হচ্ছে শিশুরা?

    ড. জেফারস ভ্রূকুটি করে অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন।

    ডেভিড বলল, আমি বলছি না বাচ্চাটার ওপর কোনো অস্বাভাবিক শক্তি ভর করেছে। কিন্তু সময়ের আগেই যেন ও দ্রুত বেড়ে উঠেছে। আর এই ব্যাপারটাই আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে।

    ঠাট্টা করতে চাইলেন ডাক্তার। ধরো, বাচ্চাটা অ্যালিসকে খুনই করেছে। কিন্তু খুনের তো একটা উদ্দেশ্য থাকে। বাচ্চাটার উদ্দেশ্য কী ছিল?

    জবাবটা তৈরিই ছিল। ত্বরিতগতিতে বলল ডেভিড, যে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেনি তার সবচেয়ে শান্তির জগৎ কোথায়? মায়ের জরায়ু। ওখানে সময় বলে কিছু নেই, আছে শুধু শান্তির অপার সমুদ্র, একমনে গা ভাসিয়ে থাকো। কোনো কোলাহল নেই, নেই দুশ্চিন্তা। কিন্তু তাকে যখন জোর করে টেনে আনা হলো এই মাটির পৃথিবীতে, নিরবচ্ছিন্ন শান্তির জগৎ থেকে মুহূর্তে সে পতিত হলো এক নরকে। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে তাকে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের ভালবাসা আদায় করতে হবে। অথচ যার সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। পরিচিত জগৎ থেকে হঠাৎ এই অপরিচিত দুনিয়ায় এসে নিজেকে সে প্রচন্ড অসহায় ভাবতে থাকে, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার ছোট্ট মগজে তখন শুধু স্বার্থপরতা আর ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু থাকে না। মোহময় জগৎ থেকে কে তাকে এই নিষ্ঠুর পরিবেশে নিয়ে এল, ভাবতে থাকে সে। এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই মা। তার অপরিণত মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে তখন মায়ের প্রতি ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ঘৃণা। বাপও মায়ের চেয়ে ভাল কিছু নয়। সুতরাং তাকেও ঘৃণা করো। খুন করো দুজনকেই।

    বাধা দিলেন ডাক্তার। তুমি যা বললে এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হতো তাহলে পৃথিবীর সব মহিলাই তাদের বাচ্চাদের ভয়াবহ কিছু একটা ভাবত।

    কেন ভাববে না? আমাদের বাচ্চাটা কি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ নয়? হাজার বছরের ডাক্তারী শাস্ত্রের বিশ্বাস তাকে প্রটেক্ট করছে। প্রকৃতিগতভাবে সবার ধারণা সে খুব অসহায়, কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু এই বাচ্চাটা জন্মেইছে বিপুল ঘৃণা নিয়ে। যত দিন যাচ্ছে ততই প্রবল হয়ে উঠছে তার ঘৃণা। সে রাতে শুয়ে থাকে দোলনায়, ফর্সা টুকটুকে মুখখানা ভেজা, শ্বাস ফেলতে পারছে না। অনেকক্ষণ কেঁদেছে বলে এই অবস্থা? অবশ্যই নয়। সে দোলনা থেকে নেমেছে, হামাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়েছে সারা ঘরে। তারপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও আমার অ্যালিসকে খুন করেছে। আমিও ওকে খুন করব।

    ডাক্তার ডেভিডের দিকে এক গ্লাস পানি আর কয়েকটা সাদা বড়ি এগিয়ে দিলেন। তুমি কাউকে খুন করবে না। তুমি এখন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ঘুমাবে। নাও, এগুলো গিলে ফেলল। একটা ভাল ঘুম হলেই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে যাবে।

    ডেভিড পানি দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল ঘুমের বড়িগুলো। ওপরে উঠল ও। কাঁদছে। শুয়ে পড়ল বিছানায়। ড. জেফারস ওর ঘুম আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর চলে গেলেন।

    ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে ডেভিডের এই সময় শব্দটা শুনল।

    কে? অস্পষ্ট গলায় বলল সে।

    কে যেন হলঘরে ঢুকেছে।

    ঘুমিয়ে পড়ল ডেভিড।

    পরদিন খুব ভোরে ডেভিডের বাসায় হাজির হলেন ড. জেফারস। ডেভিডকে নিয়ে খুব টেনশনে আছেন তিনি। ছোটবেলা থেকে ওকে চেনেন। আবেগপ্রবণ, অস্থির। ভাগ্যিস গত রাতে তিনি ওদের বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নইলে ছেলেটা অ্যালিসের শোকে ওভাবে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যেত। অ্যালিসের কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ে! কি চমৎকার সুখের জীবন ছিল ওদের। সব গেল ছারখার হয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। ডেভিডকে তিনি কিছু দিনের জন্য দূরে কোথাও ঘুরে আসতে বলবেন। এভাবে একা থাকলে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটতে পারে। ছেলেটার।

    কলিংবেল বাজালেন ডাক্তার। কোনো উত্তর নেই। তাঁর মনে পড়ল ডেভিড বলেছিল হাউজকীপার দেশের বাড়িতে গেছে। নব ঘোরালেন তিনি। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তারি ব্যাগটা রাখলেন কাছের একটা চেয়ারে।

    সাদামতো কী একটা সরে গেল দোতলার সিঁড়ি থেকে। ড. জেফারস প্রায় খেয়ালই করলেন না। তাঁর নাক কুঁচকে উঠেছে। কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছেন।

    গন্ধটা গ্যাসের!

    বিদ্যুৎ খেলে গেল ডাক্তারের শরীরে, ঝড়ের বেগে সিঁড়ি টপকালেন, ছুটলেন ডেভিডদের বেডরুম লক্ষ্য করে।

    বিছানায় নিশ্চয় পড়ে আছে ডেভিড, সারা রুম ভর্তি গ্যাসে। দরজার পাশের দেয়ালের সঙ্গে লাগানো অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডারের মুখ খোলা। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে আসছে সাদা পদার্থটা। ড. জেফারসের চকিতে মনে পড়ল ডেভিড একবার বলেছিল সে তার বেডরুমে অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার লাগিয়েছে। কারণ তার কোনো এক বন্ধু নাকি বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে নেটের মশারিতে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরার জোগাড় হয়েছিল। ডেভিডেরও শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। অ্যালিসের তাগিদেই নাকি সে নিরাপত্তার জন্য ওই সিলিন্ডার লাগিয়েছে দেয়ালে।

    ড. জেফারস দ্রুত সিলিন্ডারের মুখ বন্ধ করলেন। বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিলেন। তারপর দৌড়ে গেলেন ডেভিডের কাছে।

    ঠান্ডা হয়ে আছে শরীর। অনেক আগেই মারা গেছে ডেভিড।

    কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরোলেন ডাক্তার। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি ঝরছে। ডেভিড কিছুতেই ওই সিলিন্ডারের মুখ খোলেনি। ঘুমের মধ্যে ওর হাঁটার অভ্যাস আছে, বলেছিল অ্যালিস। কিন্তু যে পরিমাণ ঘুমের ওষুধ ডাক্তার ওকে খাইয়েছেন তাতে দুপুর পর্যন্ত ডেভিডের অঘোরে। ঘুমাবার কথা। সুতরাং এটা আত্মহত্যাও হতে পারে না। তাহলে কি…!

    হলঘরে মিনিট পাঁচেক পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন ড. জেফারস। তারপর এগোলেন নার্সারী রুমের দিকে। দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে খুললেন তিনি দরজা। দাঁড়ালেন দোলনার পাশে।

    দোলনাটা খালি।

    অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন ডাক্তার দোলনা ধরে। তারপর অদৃশ্য কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন :

    নার্সারীর দরজাটা বন্ধ ছিল। তাই তুমি তোমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান দোলনাতে ফিরে আসতে পারোনি। তুমি বুঝতে পারোনি যে বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা অমন শক্তভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি এই বাড়ির কোথাও লুকিয়ে আছ। ভান করছ এমন কিছুর, আসলে যা তুমি নও। মাথার চুল খামচে ধরলেন ডাক্তার, বিবর্ণ এক টুকরো হাসি ফুটল মুখে। আমি এখন অ্যালিস আর ডেভিডের মতো কথা বলছি, তাই না? কিন্তু আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। আমি অপার্থিব কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না। তারপরও আমি কোনো ঝুঁকি নেব না।

    নিচে নেমে এলেন ডাক্তার। চেয়ারে রাখা ডাক্তারি ব্যাগ খুলে একটা যন্ত্র বের করলেন।

    হলঘরে ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন ঘষটে ঘষটে আসছে এদিকে। পাঁই করে ঘুরলেন ড. জেফারস।

    আমি তোমাকে এই দুনিয়ায় এনেছি, ভাবলেন তিনি। আর এখন আমিই তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেব…।

    শব্দ লক্ষ্য করে ঠিক ছপা হেঁটে গেলেন ডাক্তার। হাতটা উঁচু করে ধরলেন সূর্যালোকে।

    দেখো বেবি! কি চকমকে, কি সুন্দর!

    সূর্যের আলোতে ঝিকিয়ে উঠল স্কালপেলটা।

    –রে ব্রাডবারি

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅশুভ ছায়া – অনীশ দাস অপু
    Next Article ভূত প্রেত রক্তচোষা – অনীশ দাস অপু

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.