Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পৃথিবীর সেরা ভৌতিক গল্প – অনীশ দাস অপু

    লেখক এক পাতা গল্প330 Mins Read0

    উইলিয়াম উইলসন

    উইলিয়াম উইলসন নামেই এখন আমাকে চিনে রাখুন। আসল নামটা বলব না। আমার সামনেই রয়েছে এক দিস্তে সাদা কাগজ। আসল নামের কালি দিয়ে কাগজগুলোকে আর নোংরা করতে চাই না। যে নাম শুনলে আমার জাত ভাইরা শিউরে ওঠে, ঘৃণায় মুখ বেঁকায়– সে নাম আপনাকে শুনতে হবে না। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক কুৎসিত কদাকার কাজ করে বেরিয়েছি, অনেক অপবাদ হজম করেছি, অনেকের সর্বনাশ করেছি। কেউ আমাকে আর চায় না। আমার মত একঘরে এখন আর কেউ নেই। এত কুকর্মও কেউ করেনি। দুনিয়ার মানুষের সামনে আমি তো এখন মরেই রয়েছি। আমার মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশেছে, আশা-আকাঙ্ক্ষা শূন্যে মিশেছে; এখন যেন একটা ঘন কালো বিষণ্ণ মেঘ ঝুলছে সামনে; হতাশার এই মেঘের বুঝি আর শেষ নেই; আমার সমস্ত ইচ্ছেগুলোকে আড়াল করে রেখেছে এই ভ্রূকুটি কুটিল কৃষ্ণকায় মেঘ। নিঃসীম নিরাশার এ-রকম দমিয়ে দেওয়া চেহারা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারবে না।

    শেষের বছরগুলোর ইতিহাস লিখতে বসিনি। লিখতে পারব কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন। অকথ্য কষ্ট পেয়েছি শেষের দিকে ভাষা দিয়ে সে দুর্ভোগ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আমার নেই। অপরাধের পর অপরাধ করে গেছি– সে-সবের কোনো ক্ষমাও হয় না। আর তার পরেই ঝুঁকে পড়লাম চরম লাম্পট্যের দিকে। কিভাবে তা ঘটল, শুধু সেইটুকুই লিখব বলেই আজ আমি বসেছি কাগজ-কলম নিয়ে।

    মানুষ একটু একটু করে খারাপ হয়। আমি হলাম আচমকা। যা কিছু ভাল ব্যাপার ছিল আমার মধ্যে, সমস্তই টুপ করে খোলসের মতোই খসে পড়ে গেল। অল্প-অল্প খারাপ কাজ করে যাচ্ছিলাম এই ঘটনার আগে; দুম করে শয়তান-শিরোমণি হয়ে যেতেই যেন বিশাল এক লাফ মেরে পৌঁছে। গেলাম নরকের রক্ত-জল করা উপত্যকায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার সুযোগ পেয়েছিলাম একবারই বিশেষ সেই ঘটনাটাই গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করছি। একটু ধৈর্য ধরুন।

    আমি জানি, মৃত্যু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। মৃত্যু যখন এগিয়ে আসে, তখন তার করাল ছায়া পড়ে আগেই। সেই ছায়া পড়েছে আমার ওপর। মন মেজাজ তাই ঝিমিয়ে পড়েছে। নারকীয় সেই উপত্যকার মধ্যে আমি যখন দিশেহারা, তখন পাঁচজনের অনুকম্পা চেয়েছিলাম আকুলভাবে; এক ফোঁটা সহানুভূতি আদায়ের জন্যে নানা ছল চাতুরি করে জাতভাইদের বোঝাতে চেয়েছিলাম, অদ্ভুত কতকগুলো ঘটনা আমাকে টেনে এনেছে এই অবস্থায় আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই; এ-সব ঘটনার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই- এমন ধারণাটাও ঢোকাতে চেয়েছিলাম জাতভাইদের মগজের মধ্যে। ভুল করেছি ঠিকই, ঘটনা পরস্পরার গোলাম হয়ে গিয়ে নরক-কুন্ডে হাবুডুবু খাচ্ছি কিন্তু সবাই মিলে হাত লাগিয়ে যদি আমাকে টেনে তোলে, তাহলে আবার সুখের মুখ দেখতে পাবো, ভুলের মরীচিকা মিলিয়ে যাবে সত্যিকারের মরুদ্যানে পৌঁছে যাব।

    প্রলোভনই মানুষকে অধঃপাতে নিয়ে যায়। কিন্তু আমার মতো অধঃপতন আর কারও হয়নি। এত কষ্টও কেউ পায়নি। ঠিক যেন স্বপ্নের ঘোরে রয়েছি। তিল তিল করে মরছি। অতি বড় দুঃস্বপ্নেও যে বিভীষিকা। আর রহস্যকে কল্পনা করা যায় না– আমি সেই অবিশ্বাস্য আতঙ্ক আর প্রহেলিকার বলি হতে চলেছি নিরতিসীম নিষ্করুণভাবে!

    আমি যে জাতের মানুষদের মধ্যে জন্মেছি, কল্পনাশক্তির বাড়াবাড়ি আর ঝট করে ক্ষেপে ওঠার দুর্নাম তাদের আছে। ছেলেবেলা থেকেই বংশের নাম রেখেছি এই দুই ব্যাপারেই। আমার দুর্বার কল্পনা বাগ মানে না। কিছুতেই; ঠিক তেমনি মাথায় রক্ত চড়ে যায় যখন তখন।

    বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুর্বার হয়ে উঠেছে এই বদ দোষগুলো। তাতে বন্ধুবান্ধবদের অশান্তি বাড়িয়েছি, নিজেরও ক্ষতি করেছি। আমার ইচ্ছের ওপর কারো ইচ্ছেকে মাথা তুলতে দিইনি, অদ্ভুত খেয়াল খুশি নিয়ে মেতে থেকেছি, প্রচন্ড ঝোঁকের মাথায় অনেক কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করেছি। আমার বাবা আর মা-এর মন এবং শরীর তেমন মজবুত নয়; তাই কিছুতেই রাশ টেনে ধরতে পারেননি আমার দুর্দান্তপনার।

    খারাপ কাজে আমার প্রবণতা দিনে দিনে লক্ষমুখ নাগের মতো ফনা মেলে ধরেছে– তাঁরা সামাল দিতে পারেননি নিজেদের ধাত কমজোরি বলে। চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। কিন্তু সে চেষ্টার মধ্যে জোর ছিল না। বজ্জাত ঘোড়াকে লাগাম পরাতে গেলে কায়দা জানা দরকার। ওঁনারা তা জানতেন না। ভুল করেছিলেন বলেই আমাকে ঢিট করতে তো পারলেনই না– উল্টো জিতে গিয়ে আমি আরও উদ্দাম হয়ে উঠলাম। তখন থেকেই কিন্তু আমার ওপর আর কারও কথা বলার সাহস হয়নি। আমি যা বলব, তাই হবে। আমি যা চাই, তাই দিতে হবে। যে বয়েসে ছেলেমেয়েরা বাবা মা-এর চোখে তাকাতে পারত না –সেই বয়স থেকেই আমি হয়ে গেলাম বাড়ির সর্বেসর্বা। আমিই সব। আমার ওপর আর কেউ নেই।

    স্কুলের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা বিরাট বাড়ি। রাণী এলিজাবেথের আমলের প্রাসাদ। ইংল্যান্ডের একটা ছায়ামায়ায় ভরা কুহেলী ঘেরা গ্রাম। সেখানকার গাছপালাগুলো দৈত্যদানবের মতো আকাশছোঁয়া আর ভয়ানক; হাড়গোড় বের করে যেন দাঁত খিঁচিয়েই চলেছে সবসময়ে। সেখানকার সব কটা ইমরাতই বড় বেশি প্রাচীন। স্বপ্ন দেখছি বলে মনে হয়। মনের জ্বালা জুড়িয়ে আসে। এই মুহূর্তে ছায়াস্নিগ্ধ পথগুলো শান্তির ছায়া ফেলছে আমার মনের মধ্যে। পথের দুপাশে ঘন গাছের সারি। ঠান্ডা হাওয়ায় যেন গা জুড়িয়ে আসে। নাকে ভেসে আসছে ঝোঁপঝাড়ের সোঁদা গন্ধ হাজার হাজার ফুলের সৌরভে মনে ঘনাচ্ছে আবেশ। দূরে বাজছে গির্জের ঘণ্টা। গুরুগম্ভীর নিনাদ রোমাঞ্চকর আনন্দের শিহরণ তুলছে। আমার অণু-পরমাণুতে। আমি বিভোর হয়ে যেন স্বপনের ঘোরে দেখছি ঘণ্টায় ঘন্টায় সময়ের বাজনা বাজিয়ে গথিক ভাস্কর্যের বিশাল ওই গির্জে সজাগ প্রহরা দিয়ে চলেছে ধূসর পরিবেশে ঘুমন্ত প্রাসাদের পর প্রাসাদকে।

    মনে পড়েছে স্কুলের ছোট ঘটনাগুলো। এত কষ্টে আছি যে খুঁটিয়ে সব কথা বলতে পারব না। সে ক্ষমতা আর নেই। তবে হ্যাঁ, তখন যে ব্যাপারগুলোকে তুচ্ছ আর হাস্যকর মনে হয়েছিল, পরে বুঝেছিলাম, সেগুলো আমোঘ নিয়তির পূর্ব ছায়া। নিষ্ঠুর নিয়তির সেই ছায়াভাস এখন আমার দিকদিগন্ত জুড়ে রয়েছে। আমি শেষ হতে চলেছি।

    আগেই বলেছি, স্কুল বাড়িটা রীতিমতো বুড়ো। ছিরিছাদের বালাই নেই বাড়ির নকশার মধ্যে। মাঠময়দানের কিন্তু অভাব নেই। নেচেকুঁদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ি আর মাঠ-টাঠগুলোকে ঘিরে রেখেছে খুব উঁচু একটা নিরেট ইটের পাঁচিল। পাঁচিলের মাথায় চুন-সুরকি বালির পুরু পলস্তারা। সেই পলস্তারায় গাঁথা রয়েছে খোঁচা খোঁচা ভাঙা কাঁচ। পুরো তল্লাটটা কেল্লার মতো করে তৈরি। আমাদের কাছে মনে হতো ঠিক যেন একটা পেল্লায় কয়েদখানা। এবং পাঁচিলের ভেতরের অঞ্চল টুকুই ছিল আমাদের জগৎ। হপ্তায় তিনবার দেখতে পেতাম পাচিলের বাইরের জগক্টাকে।

    শনিবার বিকেলে দুজন মাতব্বরের সঙ্গে দল বেঁধে হন হন করে হাঁটতে যেতাম আশপাশের মাঠে। রবিবারে বেরোতাম দুবার একইভাবে মাতব্বর দুজন চরাতে নিয়ে যেত স্কুলের সব্বাইকে।

    একবার বেরোতাম সকালে মাঠে-মাঠে চর্কিপাক দিতে; আর একবার বেরোতাম সন্ধ্যানাগাদ তখন যেতাম গাঁয়ের একমাত্র গির্জের উপাসনায় অংশ নিতে। গির্জার পুরোহিত ছিলেন আমাদেরই স্কুলের অধ্যক্ষ।

    গ্যালারীতে বসে অনেক দূর থেকে দেখতাম তিনি পায়ে পায়ে উঠছেন বেদীর ওপর। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম সেদিকে। কিরকম জানি সব গোলমাল হয়ে যেত মাথার ভেতরটা। দেবদূতের মতো ওঁর চেহারাটা দেখে মনে হতো যেন দেবলোক থেকে নেমে এলেন এইমাত্র। কিন্তু ভাবতেও পারতাম না দেবসুন্দর এই মানুষটাই বেত নাচিয়ে অমন নির্দয় ভাবে কি ভাবে শাসন করেন আমাদের স্কুলে পৌঁছেই।

    চীনের প্রাচীরের মতো টানা লম্বা বিশাল এই পাঁচিলের এক জায়গায় যেন ভুরু কুঁচকে কপালে অজস্র ভাঁজ ফেলে কটমট করে আমাদের দিকে চেয়ে থাকত পাঁচিলের চাইতেও প্রকান্ড একটা ফটক। ফটক না বলে তাকে লোহার পাত আর বন্টু আঁটা একটা বিকট দৈত্য বলা উচিত। কাঁটাওলা দৈত্য বললে আরও ভাল হয়। কেননা, তার সারা গা থেকে ঠেলে বেরিয়ে থাকত খোঁচা খোঁচা বল্লমের ফলা। ভয়ঙ্কর চেহারার এই ফটকটাকে দেখলেই বুক গুর গুর করে উঠত আমার।

    সপ্তাহে তিনবার আমাদের কুচকাওয়াজ করে বের করার জন্যে, তিনবার একই ভাবে ঢোকাবার জন্যে। সেই সময়ে বিশাল কজাগুলোর প্রতিটার কাঁচ কাঁচ আওয়াজ কান পেতে শুনতাম আমি। অদ্ভুত সেই আওয়াজে আমার গা শিরশির করত ঠিকই — তবুও কান খাড়া করে থাকতাম। কেন জানি মনে হতো, কাঁচ কাঁচানিগুলো আসলে কদাকার ওই গেট-দানবের মনের কথা অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে প্রতিটা বিশ্রী শব্দের মধ্যে।

    বেজায় বুড়ো স্কুল বাড়িটার কোথাও যে কোনো ছন্দ ছিল না। পুরো স্কুল চৌহদ্দিটাই ঠিক এরকম ছন্দহীন, বেখাপ্পা, এলোমেলো। এরই মধ্যে। তিন-চারটে বড়-সড় মাঠকে আমরা খেলার মাঠ বানিয়ে নিয়েছিলাম। খুব মিহি কাঁকর দিয়ে সমতল করে রাখা হয়েছিল মাঠগুলোকে। আশ মিটিয়ে লাফ ঝপ করতাম এখানেই। অন্য কোথাও নয়।

    খেলার মাঠগুলো ছিল স্কুল-বাড়ির পেছন দিকে। কাঁকর ছাড়া আর কিছুর বালাই সেখানে ছিল না। গাছ বা বেঞ্চি তো নয়ই। সে তুলনায় বেশ সাজানো-গোছানো ছিল বাড়ির সামনের দিকটা। বাস্কের মধ্যে থাকত ফুলগাছ, ঝোঁপঝাড়গুলোও কেটে ছেটে কায়দা করে রাখা হয়েছিল। কালেভদ্রে এখান দিয়ে যেতাম আমরা।

    যেমন–ধরুন, স্কুলে প্রথম ভর্তি হওয়ার সময়ে, অথবা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে একেবারে চলে যাওয়ার সময়ে, অথবা কারও বাবা-মা কিম্বা বন্ধুবান্ধব এলে। ছুটিছাটার সময়ে অভিভাবকদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময়ে খুশির প্রাণ গড়ের মাঠ হয়ে যেত এক টুকরো সাজানো এই বাগানটার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে।

    মাঠ-ঘাট, পাঁচিল আর ফটককে কিন্তু টেক্কা দিয়েছে খোদ বাড়িটা। আদ্দিকালের এই বাড়ির আগাপাশতলা আজও একটা বিরাট রহস্য হয়ে রয়ে গেছে আমার কাছে। মোট পাঁচটা বছর কাটিয়েছি এই বাড়িতে। পাঁচ বছরেও ভালভাবে চিনে উঠতে পারিনি ঠিক কোন চুলোয় আছে আমার নিজের ঘর, অথবা আরও আঠারো জন ছেলের ঘর। বিদঘুঁটে এই বাড়ি যার। পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে, তার মাথায় গোলমাল ছিল নিশ্চয়। নইলে এত সিঁড়ি বানাতে গেলেন কেন? একটা ঘর থেকে বেরোতে গেলে, অথবা অন্য একটা ঘরে ঢুকতে গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা না করলেই নয়। গলিপথেরও অন্ত নেই। বুড়ো বাড়ির শাখা-প্রশাখার যেমন শেষ নেই, অলিগলিরও তেমনি গোনাগাঁথা নেই।

    কে যে কখন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কোথায় শুরু হয়ে কোথায় শেষ হচ্ছে– তা পাঁচ বছরেও হিসেবের মধ্যে আনতে পারিনি বলেই আজও মনে হয় আদি অন্তহীন অসীমকে কেউ যদি কল্পনায় আনতে চান বুড়ো বিটকেল স্কুল-বাড়িটায় ঢুকে যেন একবার পথ হারিয়ে আসেন। যেমন পথ হারাতাম আমি বহুবার বহুবার!

    বটবৃক্ষের মতন সুপ্রাচীন এই স্কুল-ইমারতের মধ্যে সবচেয়ে বড়ঘর ছিল একটাই– স্কুল-ঘর। আমার তো মনে হয়, তামাম দুনিয়া ঘুড়লেও এতবড় স্কুল-ঘর আর পাওয়া যাবে না। শুধু বড় বলেই নয়- পেল্লায় এই ঘরখানাকে কোনোকালেই ভুলতে পারব না এর হাড়-হিম করা চেহারার জন্যে। ঘরটা খু-উ-উ-ব লম্বা, বেজায় সরু এবং দারুণ নিচু। একটা মাত্র ওক কাঠের কড়িকাঠ ঠেকিয়ে রেখেছে মাথার ওপরকার ছাদ।

    দুপাশের গথিক জানালাগুলো দেখলেই মনে পড়ে যায় সেকালের অসভ্য বর্বর গথ মানুষদের কথা –যাদের নাম থেকে এসেছে গথিক শব্দটা। টানা লম্বা এই তেপান্তর-সম ঘর অনেক দূরে যেখানে একটি মাত্র মোড় নিয়েছে, ঠিক সেইখানে আছে একটা চৌকোনা ঘেরা জায়গা– তার এক-একটা দিক আট থেকে দশ ফুট তো বটেই। পবিত্র এই ঘেরাটোপে বসে গুরুগিরি করার সময়ে চেলাদের সামনে বেত আছড়াতেন আমাদের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডক্টর ব্রান্সবি। ঘেরাটোপের দরজাটাও বিদঘুঁটে –যেমন বিরাট, তেমনি কদাকার। এ-দরজা যখনই খুলে যেত, বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠত আমাদের সবার। দূর থেকে অবশ্য রীতিমতো সমীহ করে চলতাম গুরুমশায়ের এই পবিত্র জায়গাটাকে।

    ভীষণ ভয় হতো প্রায় এই রকমই আরও দুটো ঘেরা জায়গা দেখলে। যে দুজন মাতব্বর আমাদের মার্চ করিয়ে চরাতে নিয়ে যেত মাঠে-ঘাটে, তারা বসত এইখানে। অধ্যক্ষর ঘেরাটোপের অনেক দূরে দূরে এই দুটো ঘেরা জায়গায় একটায় বসত ইংরেজি শেখানোর মাস্টার, আর একটায় অঙ্ক শেখানোর মাস্টার। মাস্টার না বলে রাখাল বলাই উচিত এদের মাঠে চরানোর সময় সেরকমই মনে হতো আমাদের।

    টানা লম্বা ঘরখানার বাকি অংশ জুড়ে রয়েছে রাশিরাশি বেঞ্চি, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড –ভাঙাচোরা এবং বইয়ের পাহাড়। একদিকে বিরাট একটা বালতি ভর্তি জল, আর একটা মান্ধাতার আমলের দানবিক আকৃতির ঘুড়ি। বেঞ্চিগুলোর সারা গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করা কিম্ভুতকিমাকার ছবি আর অদ্ভুত অদ্ভুত নামধাম নিয়ে গবেষণা করতে করতেই সময় কেটে যেত আমাদের।

    এ ঘর থেকেও অলিগলি বেরিয়েছে অসংখ্য –প্রতিটির ভেতরেই পোকায় খাওয়া, রঙজলা বই আর বেঞ্চি। ঝাঁকে ঝাঁকে কত ছেলে এসেছে। এখানে টেবিলে বেঞ্চিতে খোদাই করে গেছে তাদের কীর্তিকাহিনী। বিকট লম্বা এই ঘরের প্রতিটি ধুলোর কণা যেন তাদের আজও মনে রেখেছে, মনে রাখবে ভবিষ্যতে…

    অতিকায় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এইরকম একটা বিদ্যে অর্জন করবার জায়গায় আমার সময় কেটে যেত হু-হুঁ করে। পালাই-পালাই ইচ্ছেটা একেবারেই ছিল না মনের মধ্যে। দিনগুলোকে একঘেয়ে মনে হত না কখনোই, অথবা মেজাজও কখনো খিঁচড়ে থাকত না। এইভাবেই হৈ-চৈ করে এসে পড়লাম তৃতীয় বছরে । ছেলেমানুষের মগজে খেয়াল খুশির শেষ হয় না বলেই দিনগুলো উড়ে যেত প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে।

    বাইরের জগতের হাসি হররার দরকার হতো না মনটাকে ফুর্তির সায়রে ডুবিয়ে রাখার জন্যে। এটা ঠিক যে স্কুলের জীবনে হাজারো বৈচিত্র্যের ঠাঁই নেই। কিন্তু আমি ওই বয়সেই এমন পেকে উঠেছিলাম যে রোজই কিছু না কিছু আনন্দের খোরাক জুটিয়ে নিতাম। তাছাড়া, অপরাধ করার প্রবণতা তখন থেকেই উঁকিঝুঁকি দিতে আরম্ভ করেছিল আমার চলনে-বলনে চাউনিতে।

    আমার সেই দিনগুলোর স্মৃতি সেই কারণেই এত জ্বলজ্বল করছে মনের অ্যালবামে। ছোট বয়সের সব কথা বড় বয়সে অক্ষরে অক্ষরে সচরাচর কারও মনে থাকে না, জড়িয়ে মুড়িয়ে একটা আবছা বাল্যস্মৃতি হয়ে থেকে যায় এবং তা আরো অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে একটু একটু করে চুল-দাড়ি পাকার সঙ্গে সঙ্গে। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। কারণ আমি ছিলাম সৃষ্টিছাড়া। ছিলাম অকালপক্ক।

    কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, রাত নামলেই বিছানায় ঢুকে পড়ার হুটোপাটি, মেপেজপে আবৃত্তি করা, হাফ-হলিডে, খেলার মাঠে দামালপণা, সঙ্গীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র — ঘটনাগুলো নেহাতই একঘেয়ে আর পাঁচজনের কাছে প্রত্যেকটাকে আলাদা করে মনে রাখার কোনো কারণ নেই–মনেও থাকে না– স্মৃতির খাতায় সব একাকার ধূসর ধোঁয়াটে হয়ে যায়। আমি কিন্তু সব কিছুই মনে রেখেছি আজও। কেননা, রোজকার এই সব ঘটনার মধ্যেই মিশিয়ে রেখেছি আমার আবেগ, উত্তেজনা, উন্মাদনাকে। বৈচিত্র্যকে আমি আবিষ্কার করেছি প্রতি মুহূর্তে। গলা টিপে শেষ করে দিয়েছি একঘেয়েমির।

    আমার এই অফুরন্ত উৎসাহই আমাকে আরও আঠারোটা ছেলের মধ্যমণি করে তুলেছিল। আমার কথাবার্তা, চালচলনই বুঝিয়ে দিত, কেউকেটা আমি নই। বয়সে যারা আমার চাইতে বড়, একটু একটু করে তারাও হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছিল আমার চরিত্রটাকে– তাই ঘাটাতে চাইত না। শুধু একজন ছাড়া।

    এই একজন স্কুলেরই একটি ছেলে। তার সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা আমার নেই। অথচ আমার যা নাম, তারও তাই নাম। মায়ের পদবীটা পর্যন্ত। হেঁজিপেঁজি ঘরে জন্ম নয় আমার — সাধারণ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো নামই পাইনি বাবা আর মায়ের কাছ থেকে। তা সত্ত্বেও নামের এই মিলটা এমনই পিলে চমকানো যে ভেবে কুলকিনারা পাওয়া যায় না। এই সব ভেবেই এই কাহিনীতে উইলিয়াম উইলসন নামে আমার পরিচয় দিয়েছি–মনগড়া ঠিকই–তবে আসল নামটা থেকে খুব একটা দূরে নয়।

    যা খুশি করব কে বাধা দেবে আমাকে–আমার এই স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা থেকেই এসেছে দাপুটে স্বভাবটা। স্কুলের অন্য কোনো ছেলে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেত না– রুখে দাঁড়াতো কেবল একজনেই–আশ্চর্যভাবে যার নামে আমার পুরো নাম। কি পড়াশুনায়, কি খেলাধুলায়–আমার জবরদস্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে প্রত্যেকে– এই ছেলেটি ছাড়া। পদে পদে আমার যা-খুশি হুকুমকে ঘোড়াই কেয়ার করেছে।

    হ্যাঁ, সে আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে–কিন্তু প্রকাশ্যে নয়। পাঁচজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে টেক্কা মারতে যায়নি আমাকে। সবার সামনে অপদস্থ করে বাহাদুরি নিতেও কখনো যায়নি। আর শুধু এই একটা কারণেই আমার সঙ্গে তার সম্পর্কটা থেকেছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক –লাঠালাঠির সম্পর্ক নয়।

    উইলসনের বিদ্রোহটা তাই আমার কাছে বড় গোলমেলে ঠেকেছিল। ও যে আমার থেকে সব দিক দিয়েই বড়, তা বুঝতাম বলেই মনে মনে ভয় করতাম। গোটা স্কুলে আমার সমান-সমান হওয়ার ক্ষমতা যে শুধু ওরই আছে, এমনকি আমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও ওর আছে– তো শুধু নজরে এনেছিলাম আমিই –স্কুলে বোকাপাঁঠা বন্ধুগুলো তা খেয়ালই করেনি।

    আমার সঙ্গে টক্কর দিয়েছে, আমাকে বাধা দিয়েছে, আমার বহু ষড়যন্ত্র ভন্ডুল করে দিয়েছে কিন্তু কখনোই তা পাঁচজনের সামনে করেনি। আমি দেখেছি, উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিক দিয়ে আমারই মতো বেপরোয়া, আমার মতনই তার মনবল্পাছেঁড়া বাঁধনহারা। তার খেয়াল খুশির চরমতা আমাকেও চমকে দিয়েছে বারে বারে। অবাকও হয়েছি আমার ওপর ওর একটা চাপা স্নেহ দেখে। সে আমাকে অপমান করেছে, মনে ঘা দিয়েছে, নানা রকমভাবে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করেছে কিন্তু আমার ওপর চাপা স্নেহের ভাবটা সর্বক্ষেত্রেই ফুটে ফুটে বেরিয়েছে। একই সঙ্গে লড়েছে, আবার আগলেও রেখেছে- শায়েস্তা করেছে, আবার জ্বালা জুড়িয়েও দিয়েছে। ওর এই লুকোচুরি খেলাটাই আমার কাছে বিরাট রহস্য হয়ে উঠেছিল। ভেবে পাইনি এটা কী ধরনের আত্ম-প্রবঞ্চনা।

    স্কুলের সকলে কিন্তু ধরে নিয়েছিল আমরা যমজ ভাই। একে তো দুজনেরই নাম হুবহু এক, তার ওপরে ঠিক একই দিনে দুজনেই ভর্তি হয়েছি এই স্কুলে। স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলাম আরও একটা চক্ষুস্থির করার মতো ঘটনা। একই দিনে ভূমিষ্ট হয়েছি আমরা দুজনে– ১৮১৩ সালের জানুয়ারি মাসের বিশেষ একটি দিনে!

    আমার পয়লা নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এই উইলসন। অথচ একটা দিনের জন্যেও দুচক্ষের বালি মনে করতে পারিনি। এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন ঝগড়া হয়নি দুজনের মধ্যে। অথচ কথাবার্তা বন্ধ থাকেনি একটা মুহূর্তের জন্যেও। ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গো-হারান হেরেছি আমি কিন্তু ও টিটকিরি দেয়নি– নীরবে নিঃশব্দে শুধু বুঝিয়ে দিয়েছে শুধু আমাকেই আমি ওর যোগ্য পাল্লাদার নই কোনো মতেই। রেষারেষি ছিল বটে দুজনের মধ্যে কিন্তু শত্রুতা ছিল না।

    মতো সে মেজাজী, দাপুটে, দুর্দান্ত অথচ কখনোই আমার ঘাড় মুচড়ে মাথা নিচু করতে যায়নি। এসব কারণেই ওকে মনে মনে ভয় করতাম, সমীহ করতাম, ওর সম্বন্ধে অগাধ কৌতূহলে ফেটে পড়তাম। সব মিলিয়ে স্কুল জীবনে আমরা দুজনে ছিলাম একটা প্রচন্ড জুটি। প্রবল প্রতাপের মানিকজোড়।

    অথচ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে কখনোই ছাড়েনি আমার এই হুবহু জোড়া-টি। চোট দিয়ে গেছে স্রেফ মজা করার ভঙ্গিমাতে –কিন্তু দাগা দিয়েছে মনের একদম ভেতরে। শত্রুতার ছিটেফোঁটাও থাকত না এসব গাড়োয়ালি ঠাট্টা ইয়ার্কির মধ্যে। আমি কিন্তু পাল্টা ঘা মারতে পারতাম না। ঠিক ওরই কায়দায়। আগেভাগে আঁচ করে নিত উইলসন।

    যত রেখে ঢেকেই ফন্দি আঁটি না কেন– ওর তা অজানা থাকত না কখনো। জন্মসূত্রে কিছু ত্রুটি আছে আমার শরীরের গঠনে ও তা জানত। এগুলোকে নিয়ে মস্করা করাটা ঠিক নয়। কেউ তা করত না। কিন্তু ও ঠিক এসব ব্যাপারেই বেশি উৎসাহ দেখাত- যেমন, চাপা ফিসফিসানির স্বরে কথা বলা আমার স্বভাব। আমার গলার দোষও বলতে পারেন। উইলসন ঠিক এভাবে, চাপা ফিসফিসানির সুরে কথা বলে যেত আমার সঙ্গে।

    শুধু এই নয়, আমাকে খোঁচা মারা আরও অনেক পন্থা উদ্ভাবন করেছিল এই উইলসন। ঠিক আমার মতো কেউ হাঁটুক, কথা বলুক- এটা সহ্য করতে পারতাম না কোনদিন। বিশেষ বিশেষ কিছু শব্দ অন্য কেউ বললে আমার পিত্তি জ্বলে যেত। এগুলো ছিল আমার একেবারেই নিজস্ব। উইলসন অনায়াসে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করত, একই ভঙ্গিতে হাঁটত, একইভাবে কথা বলত। নাম যার এক, একই দিনে যার একই স্কুলে আগমন, সে যদি এভাবে আমাকে নকল করে যায় দিনের পর দিন মাথা কি ঠিক রাখা যায়?

    তখনও জানতাম না –দুজনের বয়সও এক। শুধু দেখতাম, মাথায় দুজনেই সমান ঢ্যাঙা, মুখের চেহারাও বলতে গেলে একই রকম– কথাও বলত আমার কথা বলার ঢঙে চাপা ফিসফিসানির সুরে । ও জানত, এসব ব্যাপারই আমার অপছন্দ, রেগে যাচ্ছি মনে মনে তা সত্ত্বেও খুব সূক্ষ্মভাবে খোঁচা মেরে যেত আমার মনের একদম মধ্যিখানে। তাইতেই ওর তৃপ্তি। তাইতেই ওর শান্তি।

    আমি যে ধরনের জামাকাপড় পরতাম, সেগুলোকে পর্যন্ত নকল করত এই উইলসন। হুবহু আমি হয়ে হাঁটত, হাসত। কথা বলত আমারই ভাঙা গলার অনুকরণে। কাহাতক এই ব্যঙ্গ সহ্য করা যায়?

    অথচ একে ঠিক ব্যঙ্গও বলা যায় না। ও তো পাঁচজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার নকল সাজতে যায়নি। শুধু আমাকে গোপনে বুঝিয়ে দিয়েছে অনায়াসেই ও আমার সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারে আমাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে।

    ব্যাপারে জিতে গিয়ে সবার সামনে নিজেকে জাহির করতে চায়নি– জয়ের পুরস্কার ছিল ওর কাছে পরম তাচ্ছিল্যের ব্যাপার-কিন্তু আড়ালে আমাকে ঘা মেরে বুঝিয়ে দিয়েছে, পদে পদে এভাবেই ও জয়ের মুকুট পরে যাবে আমাকে একধাপ নিচে নামিয়ে রাখবে। তখন দেখেছি ওর ঠোঁটের কোণে অতি মিহি এবং তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের হাসি। আমার মনের ভেতরে ভয়ানক বিষ ছোবল মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিয়ে ও যে কী আনন্দ পেত তা বলে বোঝাতে পারব না।

    আগেই বলেছি আমার সব কাজে বাগড়া দিলেও এই উইলসনই কিন্তু আমাকে বিপদ-আপদ থেকে আগলেও রাখত। যত দিন গেছে, ততই দেখেছি, ওর এই উপদেশ দেওয়ার ঝোঁকটা বেড়েই চলেছে। উপদেশগুলোও হতো নিখাদ বয়েসের অনুপাতে সব দিক দিয়েই অদ্ভুতভাবে অনেক জ্ঞান আর বুদ্ধি মাথার মধ্যে ঠেসে রেখে দিয়েছিল উইলসন।

    তখন জ্ঞানবুদ্ধির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিত আমার ওপর। আজ বুঝতে পারছি, ওর সেই ধারালো বুদ্ধির কথামতো যদি জীবনটাকে চালাতাম, তাহলে এত ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। অনেক সুখে থাকতাম।

    যাহোক উইলসনের এই খবরদারি শেষ পর্যন্ত চরমে উঠল। আর আমি মুখ বুজে সয়ে যেতে পারলাম না। মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে গেছি রোজই। মুখের ওপরেই বলে দিয়েছি, ঔদ্ধত্য সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। স্কুল জীবনের প্রথম দিকে মোটামুটি একটা বনিবনা ছিল দুজনের মধ্যে আগেই তা বলেছি।

    কিন্তু শেষের দিকে ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠল সম্পর্ক। ধীর স্থিরভাবে ও যতই খবরদারি চালিয়ে গেছে আমার ওপর, ততই বিদ্বেষ জমাট হয়েছে আমার মনের মধ্যে। ধীরে ধীরে বিদ্বেষের বিষ ঘৃণার রূপ নিয়েছে। মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শুরু করেছি উইলসনকে। ও তা লক্ষ্য করেছে বিশেষ একটা ঘটনার সময়ে এবং তার পর থেকেই এড়িয়ে থেকেছে আমাকে, অথবা এড়িয়ে থাকার অভিনয় করে গেছে।

    যতদূর মনে পড়ে, প্রায় এই সময়েই, একবার কি একটা ব্যাপারে ভয়ানক কথা কাটাকাটি হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। রেগে গেলে আমি কোনোদিনই মাথা ঠিক রাখতে পারি না সেদিনও পারিনি। কিন্তু রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম উইলসনকেও মাথা গরম করে ফেলতে দেখে। আর ঠিক তখনি ও যেভাবে যে ভাষায় আমার সঙ্গে ঝড়ের বেগে কথা চালিয়ে গেছিল, তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমার একদম ছেলেবেলার দিনগুলোর। ভীষণভাবে চমকে উঠেছিলাম আসলে এই কারণেই।

    ভুলে যাওয়া দিনগুলোয় আমি ঠিক যেরকম ছিলাম, যেভাবে হাত-পা ড়তাম, যেভাবে গলাবাজি করতাম, যেভাবে চোখ পাকাতাম-হুঁবহু সেই ভাবে উইলসনকেও তর্জন গর্জন করতে দেখে আমি হকচকিয়ে গেছিলাম। ছোট্ট বয়সের আমিকেই দেখেছিলাম আমার সামনে পাল্লা দিয়ে যে দাঁত কিড়মিড়িয়ে যাচ্ছে আমারই সঙ্গে! আশ্চর্য! অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য!

    বিশাল কিম্ভুতকিমাকার বাড়িটায় শাখা-প্রশাখা ছিল অগুন্তি — আগেই বলেছি। চারদিকে ডালপালা ছড়িয়ে দেওয়া একটা মহীরুহ বললেই চলে। এক-একটা শাখা আবার মহলের পর মহল জুড়ে এগিয়েই গেছে দূর হতে দূরে। ঘরের পর ঘর। যাতায়াতের রাস্তাও ঘরগুলোর মধ্য দিয়ে। অদরকারী কোণ আর ফাঁকগুলোকেও কাজে লাগিয়েছিলেন মিতব্যয়ী অধ্যক্ষ। প্রতিটায় তৈরি করেছিলেন একটা করে খুপরি-ঘর। এই রকমই একটা পায়রার খোপে থাকত উইলসন। একাই থাকত। এসব ঘরে একজনের বেশি থাকা সম্ভব ছিল না।

    আমি তখন পঞ্চম বছরে পড়ছি। এই সময়েই একদিন তুমুল বচসা হয়ে গেছিল উইলসনের সঙ্গে। মাথায় আগুন ধরে যায় আমার। স্থির থাকতে পারেনি উইলসন নিজেও। ঘটনাটা একটু আগেই বলেছি। রাত ঘনাতেই আমি ঠিক করলাম উইলসনের ঘরে হানা দেব। স্কুলের সব্বাই তখন ঘুমিয়ে কাদা। মটকা মেরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠে পড়লাম।

    একটি মাত্র ল্যাম্প হাতে নিয়ে অলিগলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে পা টিপে টিপে চললাম আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘরের দিকে। অনেক সয়েছি–এবার এক হাত নেবই নেব। ফন্দিটা মাথার মধ্যে ঘুরছিল অনেকদিন ধরেই। সাহসে কুলিয়ে ওঠেনি এতদিন। সেই রাতে মন শক্ত করলাম। বিদ্বেষ-বিষ আমার মধ্যে কতখানি জমেছে, তা ওর জানা দরকার। ছোবল মেরে মেরে অনেক বিষ ঢেলেছে আমার মনের মধ্যে তার কিছুটা উগরে দেবই। এবং তা ভয়ানক ভাবে।

    খুপরি ঘরের সামনে পৌঁছে ল্যাম্পটা রাখলাম বাইরে। কাগজের ঢাকা দিয়ে রাখলাম ওপরে। তারপর ঠিক বেড়ালের মতো এতটুকু শব্দ না করে ঢুকলাম ঘরের ভেতরে।

    একটা পা সামনে ফেলেই কান খাড়া করে শুনেছিলাম ধীর স্থির শান্ত ভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে উইলসন। বুঝলাম, ঘুমোচ্ছে অঘোরে। তাই বেরিয়ে এলাম বাইরে। ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে এগোলাম ওর খাটের দিকে। পর্দা ঝুলছিল বিছানার চারপাশে। ফন্দিমাফিক একহাতে বাতি ধরে, আর এক হাতে একটু একটু করে সরালাম পর্দা। বাতির জোরালো আলো গিয়ে পড়ল ওর ঘুমন্ত মুখের ওপর– একই সঙ্গে আমার চাহনিও আটকে গেল ওর মুখে।

    যা দেখলাম, তা দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন বরফের মতো কনকনে ঠান্ডায় মুহূর্তের মধ্যে অসাড় হয়ে গেল আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ঘন ঘন উঠতে আর নামতে লাগল বুকের খাঁচা। ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগল দুটো হাঁটু। নামহীন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল আমার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে নিমেষের মধ্যে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। খাবি খাচ্ছিলাম। সেই অবস্থাতেই বাতিটা আরও একটু নামিয়ে এনেছিলাম ঘুমন্ত মুখখানার আরও কাছে।

    সারা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সুস্পষ্ট রেখাগুলোর দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়েছিলাম… আর চেয়েছিলাম। মুখাবয়বের পরতে পরতে এই যে এই দাগ আর রেখা– এগুলো কি সত্যিই উইলিয়াম উইলসনের? এত কাছ থেকে চোখের ভুল হতে পারে না।

    স্পষ্ট দেখছি, দাগ আর বিশেষ বিশেষ রেখাগুলো সবই জ্বলজ্বল করছে। ওর মুখ জুড়ে– তবুও ঘোরের মধ্যে মনে হচ্ছে যেন ভুল দেখছি- এই দাগ আর এই রেখা, চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বোঁ বোঁ করতে লাগল মাথা। তবুও চেয়ে রইলাম ফ্যাল ফ্যাল করে–চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেছি।

    এ আমি কি দেখছি! লক্ষ লক্ষ উদ্ভট চিন্তা তালগোল পাকিয়ে ধেই ধেই নাচ শুরু করে দিল মগজের কোষে কোষে। কখনো না…কখনো এই মুখ, এই সব চিহ্ন উইলিয়াম উইলসনের হতে পারে না। জেগে থেকে পদে পদে আমাকে অনুকরণ করার পরিণামই কি এহেন রূপান্তর!

    এক নাম! এক উচ্চতা! মুখের আদল একই রকম! একই দিনে স্কুলে ভর্তি হওয়া! তারপর থেকেই চিনে জেঁকের মতো আমার মতোই হতে চেয়েছে; আমার চলাফেরা, আমার কথা বলা, আমার স্বভাবচরিত্র, আমার গলার স্বর হুবহু নকল করে গেছে শাণিত স্নেহের হাসি হেসে। ও যা হতে চেয়েছে, ঘুমন্ত অবস্থায় অবিকল তাই হয়ে গেছে! কিন্তু তাও কি সম্ভব? জাগ্রত অবস্থায় মন প্রাণ দিয়ে কারও সব কিছু নকল করে গেলেই কি ঘুমন্ত অবস্থায় নকলটা আসল হয়ে যেতে পারে? পার্থিব দুনিয়ায় কি এমনটা হতে পারে? নাকি, আমি নিজেই পাগল হয়ে গেছি! অপার্থিব বিভীষিকা দেখছি বলেও তো মনে হয় না!

    বিষম ত্রাসে শিউরে শিউরে উঠতে লাগল আমার সারা শরীর। বাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম চৌকাঠ এবং আর একটা মিনিটও দেরি না করে তৎক্ষণাৎ চম্পট দিলাম স্কুল থেকে জীবনে আর ফিরে যাইনি সেখানে।

    .

    কয়েকটা মাস স্রেফ শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলাম বাবা আর মায়ের কাছে। সীমাহীন আলসেমি আমাকে কুঁড়ের বাদশা করে তুলেছিল এই সময়ে। তারপর ভর্তি হলাম ইটন শিক্ষামন্দিরে। ডক্টর ব্রান্সবির স্কুলের ছুঁচফোঁটানো স্মৃতিগুলো তদ্দিনে ফিকে হয়ে এসেছে। অথবা বলা যায়, স্মৃতিগুলোকে কল্পনার বাড়াবাড়ি বলেই ধরে নিয়েছি।

    গোড়াতেই বলেছি, মনে মনে তিলকে তাল করে নেওয়ার প্রবণতা আমার রক্তেই রয়েছে। নিশুতি রাতে ল্যাম্পের আলোয় যা দেখেছি, তাকে কল্পনাশক্তি দিয়ে নিশ্চয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিয়ে অযথা ভয়ে মরেছি। দুঃসহ স্মৃতিগুলোর যেটুকু রেশ মনের মধ্যে ইনিয়ে বিনিয়ে রয়ে গেছিল –ইটনে বেপরোয়া জীবযাপন করার ফলে তা একেবারেই ধুয়ে মুছে গেল।

    তিন-তিনটে বছর যেন ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে গেল আমার জীবনের খাতা থেকে। উচ্ছঙ্খলতা কাকে বলে, তা দেখিয়ে দিয়েছি এই তিনটে বছরে। ডুবে থেকেছি পাপ কাজের পাকে। তাতে লাভ কিছুই হয়নি– ক্ষতি ছাড়া শরীরেও ভাঙন ধরেছিল একটু একটু করে।

    শেষের দিকে একটা গোপন আড্ডায় জমায়েত করলাম আমার খারাপ কাজের সঙ্গীদের। আচ্ছা বসল আমারই ঘরে গভীর রাতে। তাসের। জুয়োয় মেতে উঠলাম, মদের নেশায় চুর চুর হলাম। শিরায় উপশিরায় রক্তের মধ্যে যখন তুফান জেগেছে, উন্মাদের অট্টহাসি হেসে ঘরের চার দেওয়ালে প্রায় চৌচির করে দিয়ে আরও মদ, আরও মদ করে চেঁচাচ্ছি ঠিক সেই সময়ে ভয়ানক শব্দে খুলে গেল ঘরের দরজা এবং চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে হেঁকে বলল একজন ভৃত্য –এক্ষুনি আমাকে আসতে হবে নিচের হলঘরে দেখা করার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক–তার আর তর সইছে না।

    আচমকা বাধা পাওয়ায় মোটেই অবাক হইনি–বরং মজা পেয়েছিলাম। মদিরার প্রলয়-নাচান যখন মগজের প্রতিটি কোষকে বেদম বেহেড করে তুলেছে, ঠিক সেই সময়ে কে এই উটকো উৎপাত, তা দেখবার জন্যে তক্ষুনি ছুটে বেরিয়ে গেছিলাম ঘর থেকে।

    টিমটিম করে একটা মাত্র বাতি জ্বলছিল বাইরের গলিপথে। সে আলোয় একহাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। তবে ঘুলঘুলি দিয়ে আসছিল ভোরের আলো। সেই দেখেই বুঝলাম, মদ খেয়ে আর তাস খেলে রাত ভোর করে দিয়েছি।

    নিভুনিভু আলোয় হলঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একজন যুবককে। উচ্চতায় সে আমার মতনই। পরনে যে হালফ্যাশনের সাদা রঙের ফ্রক কোট রয়েছে, সেটাও হুবহু আমার গায়ের ফ্রক-কোটের মতনই। আধো অন্ধকারে শুধু এইটুকুই দেখেছিলাম। তার মুখ দেখতে পাইনি। কেননা, আলো পড়ছিল না মুখে।

    আমাকে দেখেই সে এস্তে ছুটে এল আমার দিকে। অধীর ভাবে খামচে ধরল আমার বাহু। কানের কাছে মুখটা এনে বলল চাপা, ভাঙা গলায় –উইলিয়াম উইলসন।

    পলকের মধ্যে নেশা ছুটে গেল আমার।

    আগন্তুক সেই মুহূর্তে তার তর্জনী তুলে ধরেছে আমার চোখের সামনে। ব্রেনের মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে তার চাপা শাসানি। কিন্তু এ যে সেই গলা, সেই সুর, সেই উচ্চারণ। কেটে কেটে প্রতিটি অক্ষরের ওপর জোর দিয়ে কথা বলার এই ঢঙ তো ভোলবার নয়। চোখের সামনে আঙুল নেড়ে বাহু খামচে ধরে আমার ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার এই পন্থা তো আগেও ঘটেছে। আজ থেকে তিন বছর আগে!

    অনেক উদ্দামতার তলায় চাপা পড়া অতি-ক্ষীণ স্মৃতিগুলো অকস্মাৎ আশ্চর্য রোশনাই ছড়িয়ে ভেসে উঠল আমার মনে। চকিতের জন্যে সম্বিত হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিঃসাড় হয়ে গেছিল আমার সব কটা ইন্দ্রিয়। পরক্ষণেই ধাতস্থ হলাম বটে কিন্তু তাকে আর দেখতে পেলাম না। বাতাসের বেগে উধাও হয়ে গেছে আমার হুঁশ ফেরার আগেই।

    ঘটনাটা প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেল আমাকে। মদে আচ্ছন্ন ছিলাম ঠিকই, পাগলা ঘোড়ার মতোই আমার কল্পনাশক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে, তবে যা দেখেছি আর যা শুনেছি তা ভুল নয়। চোখ বা কানের বিভ্রম নয়।

    কে এই উইলিয়াম উইলসন? আমি যেদিন ডক্টর ব্রান্সবির স্কুল ছেড়ে চম্পট দিইতার পরের দিনই উইলসনও স্কুল ছেড়ে বাড়ি চলে গেছিল ফ্যামিলিতে একটা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে। এইটুকু খবরই শুধু রাখতাম। তারপর সে কোন চুলোয় আছে, কী করে বেড়াচ্ছে– কিসসু খবর পাইনি। রাখবার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু সেদিন রাতভোরে আমি যখন নরক-গুলজার করে চলেছি– ঠিক সেই সময়ে ধূমকেতুর মতো এসে অতীত দিনগুলোর মতো আমার সুবুদ্ধি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেই চকিতে আবার উধাও হয়ে গেল কেন?

    চকিত-ধাক্কা হলেও, নড়ে গেছিল আমার মনের ভিত পর্যন্ত। ইটনের শিক্ষায়তন ছেড়ে দিলাম এর পরেই গেলাম অক্সফোর্ডে। আমার কোনো

    অভিলাষেই অন্তরায় হননি আমার দুর্বলচিত্ত বাবা আর মা। সেবারেও হতে পারলেন না। উল্টো থাকা-খাওয়ার মাসিক ব্যবস্থা করে দিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের আমীর-ওমরাদের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যাওয়ার পথ এই ভাবেই তৈরি করে দিলেন আমার জনক এবং জননী।

    চুটিয়ে কাজে লাগালাম সব কটা সুযোগ-সুবিধেকে। গ্রেট ব্রিটেনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বেলেল্লাপনা হয়নি- যা আমি করে গেছি অক্সফোর্ডে। নষ্টামির নানান ফন্দি রোজই গড়িয়ে উঠত আমার কু-মগজে এবং তার প্রতিটিতে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে আমার নারকীয় সহচরেরা।

    টাকা-পয়সা উড়িয়েছি খোলামকুচির মতো একটার পর একটা পাপ কাজ করে গেছি মনের আশ মিটিয়ে। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে পাঠকের পরিচ্ছন্ন রুচিবোধকে আঘাত দিতে চাই না।

    শুধু এইটুকু বলব যে, এই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতেই পঙ্কিল জীবন যাপনের নরক-আনন্দকে আরও তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই তাসের হাত-সাফাই জুয়োর ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলাম আমি। উকট আনন্দ পেতাম এই নোংরামিতে– সেই সঙ্গে ঝমঝমিয়ে টাকার স্রোত ঢুকে যেত আমার সব কটা পকেটে। টাকার তো আমার অভাব ছিল না।

    আমাকে গুড়ের কলসী মনে করে যে নির্বোধগুলো ভনভনিয়ে ঘুরত আমার চারপাশে, তাসের জুয়োয় জোচ্চুরি করে তাদেরকেই দোহন করতাম। এইভাবেই দিনে দিনে উঁচু হচ্ছিল আমার টাকার পাহাড়। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলাম জোচ্চুরি খেলায় এবং আবিষ্কার করেছিলাম বহুবিধ কসরৎ।

    তাসের ভেল্কী আর নানান পাপাচারে পোক্ত হতে হতেই কেটে গেল দুটো বছর। তারপর ইউনিভার্সিটিতে এল সম্ভ্রান্ত এক যুবাপুরুষ। তার নাম লর্ড গ্লেনডিনিঙ। দেদার টাকার মালিক গুনে গেঁথেও নাকি শেষ করা যায় না। এই খবর কানে আসতেই চনমনে হয়ে উঠল আমার লোভী সত্ত্বা। নতুন কুবেরকে কায়দায় আনবার ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত হলো মগজ। বার কয়েক টেনে আনলাম তাকে আমার তাসের জুয়োয়।

    জুয়ারী কৌশল বিস্তার করে প্রতিবারেই কিছু টাকা জিতিয়েও দিলাম । জুয়া-শিল্পে চৌকস শিল্পীরা এইভাবেই শিকারকে ফাঁদে ফেলে। তারপর যখন দেখলাম জুয়োর নেশা বেশ জমেছে এবং তাস খেলে টাকা উপায় করার শিল্পে নিজেকে বড় শিল্পী বলে মনে করছে গ্লেনডিনিঙ, তখন একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করলাম আমারই এক বন্ধু মিস্টার প্রেসটন-এর বাড়িতে। সেখানে যে শেষকালে তাসখেলা হবে, তা ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলাম না। এমনকি মিস্টার প্রেসটন আমার হরিহর আত্মা বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যাপারটি সম্বন্ধে তাঁকে অন্ধকারেই রেখে দিলাম।

    সবাই জানল, পার্টিতে শুধু খাওয়া-দাওয়া হবে, একটু-আধটু হৈ-হল্লা ফুর্তি হবে তার বেশি কিছু না সাত-আট জন কলেজ-বন্ধুকে নেমন্তন্ন করলাম বটে কিন্তু তাদেরও কেউ জানল না আমার মূল অভিপ্রায়।

    শুধু আমিই জানতাম আমার ক্রুর অভিসন্ধির আগাগোড়া। টাকার কুমীর গ্লেনডিনিঙকে ভেঙে চুরমার করে দেব এই খেলায়।

    খানাপিনা শেষ হওয়ার পর আকণ্ঠ মদিরা-সেবন করলাম প্রত্যেকেই । মাথার মধ্যে রিমঝিম রিমঝিম বাদ্যি শুরু হয়ে যেতেই তাসের নেশা মাথাচাড়া দিল গ্লেনডিনিঙ-এর মগজে। আলগা কথার মধ্য দিয়ে জুয়োর প্রসঙ্গটা আমিই এনে ছিলাম মদের আড্ডায়। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল টাকার কুমীর। শুরু হয়ে গেল সর্বনাশা খেলা।

    শুরু হয়েছিল সবাইকে নিয়েই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ছলচাতুরির জাল বিছিয়ে আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করালাম শুধ গ্লেনডিনিঙ-কেই। দেখলাম, ওর সারা মুখ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মদের নেশা আর খেলার উত্তেজনায়। পর-পর কয়েক দান খেলে গেলাম ঠান্ডা মাথায়। প্রতিবারেই বাজি হারল গ্লেনডিনিঙ এবং গনগনে হয়ে উঠল গোটা মুখ। জেতার নেশায় ও তখন আত্মহারা।

    ওষুধ ধরেছে বুঝলাম এবং আর খেলতে চাইলাম না। সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল ধনকুবের প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি বেঁকে বসলাম খেলব না কিছুতেই। হেরে যাওয়ার এই ঝোঁক কাটিয়ে ওঠা উচিত গ্লেনডিনিঙের।

    ও কিন্তু তার স্বরে বাজি ধরল দ্বিগুণ। আর সবাই অবাক হলেও আমি হলাম না। আমি তো জানি, এ-রোগের এই পরিণতিই হয়। যতই নিঃস্ব হতে চলেছে, ততই রাগ চেপে যাচ্ছে গ্লেনডিনিঙের। যেন নিমরাজী হয়ে তাস ভাগ করলাম। খেলা শুরু করলাম। শেষও করলাম। গো-হারান হেরে গেল গ্লেনডিনিঙ। এবং সেই প্রথম অবাক হলাম ওর মুখের রক্তরাঙা ভাবটা লক্ষ্য করে। একী নিছক মদের রক্তোচ্ছ্বাস, না, ফতুর হওয়ার পূর্বাভাস? আবার তাস সরিয়ে নিলাম কিন্তু গোঁ ধরে বসল ধনকুবের-নন্দন। খেলতেই হবে। এবার আরও দ্বিগুণ বাজি। ঘরশুদ্ধ সবাই হতভম্ব। আমি নিজেও একটু হকচকিয়ে গেলাম গ্লেনডিনিঙের মুখের অকস্মাৎ পান্ডুরাভা লক্ষ্য করে। ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে মুখখানা। ও যে প্রচন্ড বড়লোক, এ খবর নিয়েই তো জালে জড়িয়েছি এত অল্পে ভেঙে পড়বে, তা জানতাম না। এ-খেলাও শেষ হলো আমার হাতের কারসাজি মতোই। সমস্ত রক্ত নেমে গেল গ্লেনডিনিঙের মুখ থেকে।

    ঘর নিস্তব্দ। প্রত্যেকেই নিশ্চুপ। ভর্ৎসনা মিশোনো জোড়া জোড়া চোখ নিবদ্ধ আমার ওপর। অসহ্য উদ্বেগ চেপে বসেছে আমার বুকের মধ্যে। দুঃসহ এই বোঝা ক্ষণিকের জন্যে লঘু হয়ে গেল আচম্বিতে ঘরের ভাবি দরজার পাল্লা দুটো দু-হাট হয়ে খুলে যাওয়ায়।

    দমকা হাওয়ায় একই সঙ্গে নিভে গেল ঘরের সব কটা মোমবাতি। নিভবার মুখেই দেখতে পেলাম খোলা দরজা দিয়ে মূর্তিমান প্রহেলিকার মতোই ঝড়ের বেগে ঘরে আবির্ভূত হয়েছে এক লোক। মাথায় সে আমার সমান। আমার আলখাল্লার মতনই একটা আলখাল্লা দিয়ে ঘিরে রয়েছে অবয়ব। মোমবাতিগুলো ততক্ষণে নিভে গেছে। সলতেগুলোয় মরা আগুন লেগে রয়েছে। সেই আলোতেই নিবিড় তিমির ঘরের মধ্যে চেপে বসতে পারছে না। তাই ঠাহর করেছিলাম আমাদের ঠিক মধ্যিখানে এসে খাড়া হয়ে রয়েছে অন্ধকারের আগন্তুক। নিতান্ত অসভ্যের মতো এহেন অনধিকার প্রবেশের জবাবদিহি চাইবার আগেই শুনতে পেলাম তার কণ্ঠস্বর।

    এ-সেই কণ্ঠস্বর যার ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি একবার শুনলে আর ভোলা যায় না। এ-সেই নিচু খাদের অতি-সুস্পষ্ট চাপা ফিসফিসানি যার প্রতিটি অনুরণন কাঁপালিকের মন্ত্রোচ্চারণের অমোঘ প্রতিক্রিয়ার মতনই হাড় হিম করে দিল আমার। কেটে কেটে অন্তরের গহনতম অন্দরেও বসে গেল এই কটি কথা!

    জেন্টলমেন, অসৌজন্যের জন্যে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এই অভব্য আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি শুধু একটা কর্তব্য পালনের জন্যে। আপনারা জানেন না, কেউই জানেন না –আজ রাতের খেলার নায়কের সত্যিকারের চরিত্রটা কি। অত্যন্ত বিনীতভাবে শুধু এই তথ্যটি পরিবেশন করার জন্যেই আমার আগমন। অনুগ্রহ করে এবং অবসরমতো আপনারা উইলিয়াম উইলসনের বা আস্তিনের ভেতরকার আস্তর পরীক্ষা করে দেখবেন। এমব্রয়ডারী করা আলোয়ানের মধ্যে লুকানো পকেটগুলো দেখতেও ভুলবেন না। চললাম।

    ঘূর্ণিঝড়ের মতোই নিমেষে উধাও হয়ে গেল ক্ষণিকের অতিথি। স্তম্ভিত করে গেল ঘরশুদ্ধ সবাইকে। তারপরেই অবশ্য উচ্চনিনাদী সোরগোলে ফেটে পড়ল ছোট কামরা-খানা। দপ দপ করে জ্বলে উঠল সব কটা মোমবাতি। আমি যখন নিঃসীম আতঙ্কে জবুথবু হয়ে বসে ওরা তখন তল্লাসি চালিয়ে যাচ্ছে আমার কোটের বা আস্তিনের ভেতরের আস্তরে। সেখানকার চোরা পকেট থেকে বের করে ফেলেছে নকল তাস। আলোয়ানের ফুলের কারুকাজের গায়ে গায়ে লুকানো খুপরিগুলো থেকেও বেরিয়েছে জুয়াচোরের জন্য বিশেষ ধরনের তৈরি সব কটা তাস।

    নিঃশব্দ সেই ধিক্কারের চাইতে বুঝি গালিগালাজ অনেক সহনীয় ছিল।

    হেঁট হয়ে নিজের পায়ের কাছ থেকে অত্যন্ত মূল্যবান পশুর লোমের আলখাল্লাটা কুড়িয়ে নিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন গৃহস্বামী মিস্টার প্রেসটন মি. উইলসন, আপনার এই সম্পত্তিটাও নিয়ে যান– জানি না এর ভেতরে আরও কটা খুপরি বানিয়ে রেখেছেন। দয়া করে আপনি অক্সফোর্ড ত্যাগ করবেন কালকেই, এবং তার আগে, এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন এই ঘর থেকে।

    কাঁটছাঁট কথায় এই ভাবে গলাধাক্কা দেওয়ার জবাবটা আমি মুখের ওপরেই ছুঁড়ে দিতাম, যদি না আর একটা অতি অদ্ভুত ব্যাপার আমার নজরে আসত। মিস্টার প্রেসটন যে-আলখাল্লাটা কুড়িয়ে নিয়েছেন ওঁর পায়ের কাছ থেকে, ঠিক ওরকম একটা আলখাল্লা তো আমার হাতেই রয়েছে। হুবহু এক! আমি যে অত্যন্ত খরুচে আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের, তা নিশ্চয় এই কাহিনী পড়ে বোঝা যাচ্ছে। আমার মগজখানাও তত উর্বর কল্পনা আর বিচিত্র খামখেয়ালিপনার একটা মস্ত কারখানা। অতিশয় দুপ্রাপ্য পশুর লোম থেকে তৈরি আশ্চর্য ডিজাইনের এই আলখাল্লা তৈরি হয়েছিল শুধু আমারই ফরমাশ অনুযায়ী। বলাবাহুল্য এ-জিনিসের কপি আর কোথাও থাকতে পারে না। অথচ রাতের আগন্তুক যেখানে এসে দাঁড়িয়ে বচনসুধা শুনিয়ে গেল –ঠিক সেইখান থেকেই অবিকল সেইরকম একটা আলখাল্লা। তুলে বাড়িয়ে ধরেছেন মিঃ প্রেসটন।

    পরপর এতগুলো হাড়-হিম করা কান্ড ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও উপস্থিত বুদ্ধি হারাইনি আমি। ঘরের কাউকে দেখতেও দিলাম না যে ঠিক ওইরকম আলখাল্লা ইতিপূর্বেই অন্যমনস্কভাবে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছি আমি। নীরবে দু-নম্বর আলখাল্লাটা মিঃ প্রেসটনের হাত থেকে টেনে নিয়ে চাপা দিলাম আমার নিজের আলখাল্লাটাকে এবং মুচকি হেসে বেপরোয়া ভঙ্গিমায় গটগট করে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। পরের দিনই ভোরের আলো ফোটবার আগেই অক্সফোর্ড ত্যাগ করলাম চিরতরে এবং বেরিয়ে পড়লাম মহাদেশ সফরে।

    পালালাম কিন্তু বৃথাই। বিভীষিকার উল্কি-আঁকা আমার হৃদয় সেইদিন থেকে ভয়-তরাসে হয়ে থেকেছে প্রতিটি পল-অনুপল-বিপল। যেখানেই গেছি, সেখানেই ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি রূপে হাজির হয়েছে এই উইলিয়াম উইলসন। প্রতিবারেই নাক গলিয়েছে আমার ব্যাপারে –নাটকীয়ভাবে বানচাল করে দিয়েছে আমার সমস্ত পরিকল্পনা। রহস্যময় এই সত্তা আমারই প্রতিচ্ছায়া হয়ে ঘুরছে আমার পেছন পেছন এবং কাজ হাসিলের ঠিক মুহূর্তটিতে উল্কাবেগে উপস্থিত হয়ে চুনকালি দিয়ে গেছে আমার মুখে। আমার অপকর্ম নিয়ে যত মাথাব্যথা যেন শুধু ওরই। প্যারিসে পা দিতে না দিতেই হাড় জ্বালিয়েছে।

    একটার পর একটা বছর গেছে, কিন্তু নিদারুণ বিরক্তিজনক উইলিয়াম উইলসন নিস্কৃতি দেয়নি আমাকে। সীমা পরিসীমা নেই তার শয়তানির, তার নিরন্তর ধূর্ততার। পালিয়ে গেছি রোমে– সেখানেও সে রেহাই দেয়নি আমাকে। কুটিল ইচ্ছাপূরণের ঠিক মুহূর্তটিতে বিনা নোটিসে আচমকা আবির্ভূত হয়ে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে আমার পরিকল্পনা! জাল পেতেছি বার্লিনে–ছিঁড়ে খুঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছে শয়তান শিরোমণি এই উইলিয়াম উইলসন।

    ঠিক একই ভাবে আমার সাজানো খুঁটি বাঁচিয়ে দিয়েছে মস্কোতে। এ হেন পিশাচকে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ থেকে ঘৃণা করেছি, ভয়ও পেয়েছি। জঘন্য পোকামাকড়কেও মানুষ বুঝি এত ঘেন্না এত ভয় করে না। কখন কোন্ মুহূর্তে করাল সেই অপচ্ছায়া দেখা দেবে এই ভয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে পালিয়েছি কিন্তু বৃথা-বৃথা-বৃথা! সে আমার পেছন ছাড়েনি!

    মনকে শুধিয়েছি বহুবার কে এই উইলিয়াম উইলসন? কোথায় তার প্রকৃত নিবাস? কি উদ্দেশ্য নিয়ে মুহূর্মুহূ হানা দিয়ে যাচ্ছে আমার প্রতিটি কুকর্মে? কোনো জবাবই পাইনি। খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছি আমার ওপর তার খবরদারির অভিনব পদ্ধতিগুলোকে। লক্ষ্য করেছি যখনই আমি ভয়ানক ভাবে ফেঁসে যাওয়ার মতো খারাপ কাজ করে চলছি ঠিক তখনই সে না বাগড়া দিলে কিন্তু কুখ্যাতির অতলে তলিয়ে যেতাম নির্ঘাৎ।

    এটাও লক্ষ্য করেছি– খুব ভালভাবেই লক্ষ্য করেছি– হুবহু আমার মতনই জামাকাপড় পড়ে এলেও কোনোবারেই সে আমাকে তার মুখ দেখায়নি। হতে পারে, আলো পড়েনি তার মুখে। কিন্তু প্রতিবারেই কী কৌশলে তার মুখাবয়ব ঢেকে রেখে দিয়েছিল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে সেটাও তো একটা অতলান্ত প্রহেলিকা। :

    ইটনে তর্জনী তুলে শাসিয়ে গেছে কিন্তু মুখ দেখায়নি; অক্সফোর্ডে আমার মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেছে সেখানেও তার অতর্কিত আর্বিভাবের পূর্ব মুহূর্তে নিভে গেছে সব কটা মোমবাতি যেন এক দানবিক ফুকারে; রোমে সে যেন স্বয়ং বস্ত্র হয়ে নেমে এসে ধ্বংস করে গেছে আমার উচ্চকাঙ্ক্ষা, প্যারিসে নিতে দেয়নি প্রতিশোধ, নেপলসে ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমার কপট প্রেমের খেলা, মিশরে টেনে ধরেছে আমার লালসার লাগাম। কিন্তু কোনোবারেই সে তাকে চেনবার সুযোগ দেয়নি। এত বড় ধুরন্ধর প্রতিভাটা যে আমার স্কুল জীবনের পরম প্রতিদ্বন্দ্বী উইলিয়াম উইলসন স্বয়ং একবারও সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার ক্ষীণতম সুযোগও সে আমাকে দেয়নি।

    যাক সে কথা। এবার আসা যাক ঘটনাবহুল এই নাটকের শেষ পর্বে।

    এতক্ষণ পর্যন্ত শুধু লিখে গেলাম আমার ওপর উইলিয়াম উইলসনের বাদশাহী প্রতাপের আঁকালো বর্ণনা। তার দাপটে ভয়ে কেঁচো হয়ে যেতাম প্রতিবার। তার শুভ্র সুন্দর চরিত্র, তার হিমালয় সম প্রজ্ঞা, তার সর্বত্র উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা এবং সর্ববিষয়ে তার অবিশ্বাস্য পারদর্শিতা আমাকে লৌহ-মুরের মতোই ঘা মেরে মেরে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে প্রতিবার। আমার অস্থিমজ্জায় অপরিসীম আতঙ্ক সঞ্চার করে দিয়ে গেছিল সে তার দুর্দম শক্তি দিয়ে আর সীমাহীন দুর্বলতা নিয়ে আমি কেবলই নুয়ে পড়েছি। তার উদ্ধত আকৃতির সামনে, হজম করেছি তার দর্পিত শাসানি।

    বেশি সঙ্কুচিত হয়েছি ততই সে হামলে পড়েছে। তিল তিল করে পরিত্রাণের একটা ক্ষীণ সম্ভাবনাকে সযত্নে লালন করে গেছি মনের মধ্যে। এর ঠিক উল্টোটা ঘটালেই তো হয়! নিজেকে একটু একটু করে দাপুটে আর মরিয়া করে ফেললেই তো সে গুটিয়ে যাবে আমার সামনে ঠিক যে ভাবে। আমাকে তার ইচ্ছার গোলাম বানিয়ে রেখেছে– হুবহু সেই ভাবে আমিও তাকে বানিয়ে ফেলব আমার ইচ্ছার গোলাম।

    মন শক্ত করলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, এইবার তাকে গুঁড়িয়ে দেবই আমার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দিয়ে। ইদানীং বড্ড বেশি সুরা পান করছিলাম। ছেলেবেলা থেকেই আমি চড়া মেজাজী। সুরা তাতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত। তরল আগুনের প্রকোপে পড়েই বলা যায় পৌঁছে গেলাম পথের কাঁটা তুলে ফেলার চরম সিদ্ধান্তে ।

    সুযোগটা পেয়ে গেলাম রোম শহরে। ১৮০০-সালের সেই কার্নিভ্যালের কথা মনে পড়ে? আমি ছিলাম সেখানে। ডিউক ডি-ব্ৰগলিও একটা মস্ত মাসকারেড পার্টির আয়োজন করেছিলেন তাঁর প্রাসাদে। এ পার্টিতে ছদ্মবেশ পরে যেতে হয়। মুখে থাকে মুখোশ। পরনে অদ্ভুত বেশ। স্রেফ মজা করার জন্যে এই ধরনের আসরে ভিড়ও হয় খুব।

    আমার যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল বুড়ো ডিউকের তরুণী ভার্যার সঙ্গে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করা। মেয়েটি পরমাসুন্দরী, কিন্তু পতিভক্তি তেমন নেই। উড়ে উড়ে বেড়াতে চায়। পার্টিতে যেতেই চোখ নাচিয়ে গাঢ় সুরে আমাকে জানিয়ে দিল, একটু ফাঁক পেলেই তার এই বিচিত্র ছদ্মবেশের রহস্যকথা ফাঁস করবে শুধু আমার কাছেই। ইঙ্গিত তাৎপর্যপূর্ণ। মদ খেয়ে যখন চোখ লাল করে ফেলেছি, অদ্ভুত অদ্ভুত পোশাক আর মুখোশ পরা মেয়েপুরুষদের বিরামহীন গুঁতো খেয়ে মেজাজটাকেও ঠিক রাখতে পারছি না–ঠিক এইসময়ে ভিড়ের মধ্য দিয়ে দেখতে পেলাম বৃদ্ধ ওমরাহ-র তরুণী ভার্যাকে। মদির চোখের দারুণ কটাক্ষ আমাকে নিমেষে চুম্বকের মতো টান মারল সেদিকে। তোতির ঠেলায় আমি তখন অস্থির। তবু। অধীর ভাবে যেই পা বাড়িয়েছি মোহিনী অভিমুখে অমনি কে যেন আলতোভাবে হাত রাখল আমার কাঁধে–একই সঙ্গে কানের পর্দায় বর্ষিত হলো চাপা, ভাঙা গলায় সেই পৈশাচিক ফিসফিসানি।

    প্রতিটি রক্তকণিকা তখন উত্তাল হয়ে উঠেছে আমার শিরায়, ধমনীতে, কামিনী-পিপাসা বন্য হস্তীর বল এনে দিয়েছে পেশীতে পেশীতে, ধাবমান শোণিতের সুগম্ভীর গর্জন ধ্বনিত হচ্ছে মাথার মধ্যে–ঠিক এই সময়ে ঘটল এই বিপত্তি।

    বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। খপাৎ করে আঁকড়ে ধরে ছিলাম মূর্তিমান উৎপাতটার কলার। পরণে তার নীল মখমলের স্পেনীয় আলখাল্লা– কোমরে রক্তবর্ণের বেল্ট। সারা মুখ ঢাকা কালো রেশমের মুখোশে। ঠিক এই বেশ আর এই মুখোশই দেখব এই আশা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম সবেগে।

    দারুণ ক্রোধে ফুঁসে উঠেছিলাম একই সঙ্গে। বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষ আগুনের ফুলকির মতোই ছিটকে ছিটকে এসেছিল দাঁতে দাঁত পিষে প্রতিটি অক্ষর উচ্চারণের সময়ে। আমি বলেছিলাম–স্কাউড্রেল! জালিয়াৎ! পিশাচ! কী চাও তুমি? আমার মৃত্যু? সেটি হতে দিচ্ছি না! বলেই, হিড় হিড় করে শয়তান শিরোমণিকে বলরুম থেকে টেনে এনেছিলাম পাশের ছোট্ট ঘরটায়।

    ধাক্কা মেরে দেওয়ালের ওপর আছড়ে ফেলেছিলাম তৎক্ষণাৎ। কপাট টেনে বন্ধ করে দিয়েই কোষমুক্ত করেছিলাম তরবারি। বলেছিলাম সাপের মতোই হিসহিসিয়ে দেখি–এবার কার গায়ে জোর বেশি! বার করো তোমার হাতিয়ার।

    ক্ষণিক দ্বিধা করেছিল সে। তারপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাপ থেকে টেনে বের করেছিল ইস্পাতের তলোয়ার।

    শুরু হয়েছিল দ্বন্দ্বযুদ্ধ। শেষ হয়েছিল অচিরেই। রক্তের ধারা তখন প্রলয় নাচন নেচে চলেছে আমার শিরায় শিরায়। মত্ত ঐরাবতের শক্তি ভর করেছে শরীরে। স্রেফ দানবিক শক্তি দিয়ে মারের পর মার মেরে তাকে আমি কোণঠাসা করেছিলাম চক্ষের নিমেষে এবং কলজে ফুটো করবার এমন সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ছিলাম তৎক্ষণাৎ। একবার নয় বার বার, সর্ব শক্তি দিয়ে তরবারি প্রবেশ করিয়েছিলাম তার বুকের খাঁচায়।

    ঠিক তখনই তুমুল চেঁচামেচি শুনেছিলাম বাইরে–ঘন ঘন ধাক্কায় থরথর করে কেঁপে উঠেছিল দরজার কপাট। মুহূর্তের জন্যে পেছন ফিরে চেয়েছিলাম আমি।

    পরক্ষণেই সামনে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যেন পট পালটে গেছে। আসলে কিছুই পালটায়নি কিন্তু আমার উদ্দাম অলীক কল্পনা দিয়ে আমি মনে করে নিলাম যেখানে দেওয়াল ছিল, সেখানে রয়েছে বিশাল একটা দর্পণ। সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে রয়েছে আমারই অবয়ব। রক্তাক্ত দেহে বিহ্বল মুখে আমি টলতে টলতে এগিয়ে আসছি আমারই দিকে। মুখের মুখোশ আর হাতের তরবারি এখন মেঝেতে নিক্ষিপ্ত। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মুখের ভাঁজ, খজ, রেখা আর তিল। এ যে আমারই প্রতিচ্ছায়া –একই পরমাণু দিয়ে গড়া একই আমি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই আর তিলমাত্র। রক্তমাখা এই আশ্চর্য কায়াকে আমি উইলিয়াম উইলসন নামেই চিনে এসেছি এতগুলো বছর।

    হাহাকারের সুরে শেষ কথাগুলো যখন বলেছিল উইলসন তখন গলা চেপে, গলা ভেঙে ফিসফিস করার চেষ্টা করেনি এতটুকুও। একটা একটা শব্দ বলার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে শূন্যে বিলীন হচ্ছিল ওর প্রাণবায়ু। এবং চমকে চমকে উঠছিলাম আমি আমারই কণ্ঠস্বর ওর কণ্ঠে বর্ণে বর্ণে ধ্বনিত হচ্ছে শুনে। ও বলেছিল :

    জিতে গেলে ঠিকই কিন্তু নিজের প্রাণ দিয়ে জিতলে। কারণ আমিই তোমার সব কিছু। আজ থেকে সমস্ত দুনিয়ার কাছে, সমগ্র স্বর্গলোকের কাছে, যাবতীয় আশার জগতের কাছে নিহত হয়ে রইলে তুমি! দেখছো কি? এত তোমারই ছায়া! ছায়াকে হত্যা করে ডেকে আনলে তোমার নিজেরই মৃত্যু!

    –এডগার অ্যালান পো

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅশুভ ছায়া – অনীশ দাস অপু
    Next Article ভূত প্রেত রক্তচোষা – অনীশ দাস অপু

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.