Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পেন্ডুলাম – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প342 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১০. ভালো লাগার অনুভূতি

    অধ্যায় ১১

    নিজের ঘরে ফিরে এলে চারুর মধ্যে সব সময়ই ভালো লাগার একটি অনুভূতি তৈরি হয়। বিশেষ করে যখন দেখে তার রুমমেট নেই। কিংবা থাকলেও তার কোনো গেস্ট আসেনি।

    দীর্ঘকাল একা থাকতে থাকতে তার এমনই অভ্যেস হয়ে গেছে যে, ঘরে অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতি একদমই সহ্য হয় না। মাঝেমধ্যে পাশের রুমের বন্ধু আশফাঁকের কাছে দুয়েকজন গেস্ট আসে, তখন মেহমানকে নিয়ে আড্ডা দিতে, তাস খেলতে চলে আসে তার ঘরে। চারু হাসিমুখে মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে অখুশিই থাকে।

    তবে খুব জলদি এই অবস্থা পাল্টে যাবে। তাকে আর কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। তার রুমমেট আশফাঁক সামনের মাস থেকে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিচ্ছে। বিরাট বড় এক কপোরেট অফিসে ভালো বেতনের চাকরি করে সে। কয়েক মাস আগে বিয়েও করে ফেলেছে, তবে তার স্ত্রী চট্টগ্রাম মেডিকেলে ইন্টার্নশিপ করছে বলে এখনও একসাথে সংসার শুরু করতে পারেনি। এ বছরের শেষের দিকে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে তারা।

    ডক্টরের অদ্ভুত চাকরিটা পাবার আগে ভেবেছিলো আশফাঁকের বদলে অন্য আরেকজনকে তুলবে ফ্ল্যাটে, কিন্তু সেটার কোনো দরকার দেখছে না এখন। সে একা থাকতে চেয়েছে সব সময় কিন্তু সাধ্যে কুলায়নি বলে ফ্ল্যাটটা শেয়ার করেছে। পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে, টুকটাক আউটসোর্সিং করে যেটুকু আয়রোজগার করে তা দিয়ে মাসে পনেরো হাজার টাকূার একটি ফ্ল্যাট একা ব্যবহার করা সম্ভব ছিলো না। এখন সেটা অনায়াসে করতে পারে।

    ডক্টরের বিশাল বাড়িতে থাকার সুযোগও আছে তার। ইচ্ছে করলে এই পনেরো হাজার টাকাও বাঁচানো যায়, কিন্তু অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকার কথা ভাবতে পারে না সে। প্রাইভেসি জিনিসটা তার ভীষণ দরকার। অন্যের বাড়িতে সেটা পুরোপুরি আশা করা বোকামি।

    দ্রুত জামা-কাপড় পাল্টে ডোসিয়ারটা নিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে দু-তিনবার পড়ে ফেলল। আজফার হুসেন নিশ্চয় অন্য কাউকে দিয়ে এসব তথ্য জোগাড় করে চমৎকারভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তৈরি করেছেন। প্রচুর তথ্য ছাড়াও পুলিশি তদন্তের অনেক কিছুই দেয়া আছে ডোসিয়ারে।

    ডক্টরের বাড়ি থেকে বের হবার আগে মায়ার সাথে এ নিয়ে অল্প একটু কথা হয়েছে তার। মেয়েটা জানতে চেয়েছিলো কিভাবে কাজ শুরু করবে তারা। সে ভেবেছিলো তথাকথিত সাইকি ক্ষমতার অধিকারিনী এসব তদন্ত ফদন্ত নিয়ে আগ্রহি হবে না। কারণ বিশ্বাসিরা তদন্ত করে না, খতিয়েও দেখতে চায় না। এটা করে তার মতো যুক্তিবাদিরা।

    “যেকোনো তদন্ত শুরু করতে হলে একদম শুরু থেকে শুরু করতে হয়। সুতরাং আমাদেরকে সবার আগে গাজীপুরে যেতে হবে,” মেয়েটার প্রশ্নে বলেছিলো চারু।

    “কিন্তু এতদিন পর ঐ জায়গাটা কি ক্রাইম-সিন হিসেবে আছে? ওখানে কিছু পাওয়া যাবে?”

    “আপনি ফরেনসিক এভিডেন্সের কথা বলছেন…আমাদের তদন্তে ওসবের দরকার হবে না।”

    “তাহলে ক্রাইম-সিনে যাচ্ছি কেন?” অবাক হয়েছিলো সাবেক আরজে।

    “কারণ, শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই। আমরা এই কেসের যতটুকু জানি সবটাই ডক্টরের দেয়া ইনফর্মেশন থেকে। ওগুলো চোখবন্ধ করে বিশাস করা যাবে না। সবকিছু খতিয়ে দেখতে হবে।”

    “আপনি ডক্টরের দেয়া সবগুলো তথ্য চেক করে দেখতে চাইছেন?”

    “অবশ্যই,” জোর দিয়ে বলেছিলো চারু। “তদন্ত শুরু করতে হলে একেবারে প্রথম থেকে সবকিছু খতিয়ে দেখতে হবে।”

    “ডক্টরের ইনফর্মেশনের উপর আপনার আস্থা নেই, তাই না?”

    কথাটা শুনে বিরক্ত হয়েছিলো সে। ডক্টরের ডোসিয়ারকে বাইবেল মনে করার কোনো কারণ নেই। ভুতুরে আর অলৌকিক ব্যাপারগুলো তদন্ত করতে গিয়ে সে দেখেছে, শোনা কথা, বর্ণনা আর অন্যের মুখ থেকে শোনা গালগল্প বিভ্রান্তিতে ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।

    “আস্থা, বিশ্বাস…এই শব্দগুলো তদন্তের সময় কোনো উপকারে আসে না, বরং ভুলপথে নিয়ে যায়।” একটু থেমে আবার বলেছিলো মেয়েটাকে, “ভুতের গল্পগুলো কেন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বলেছিলো, “কারণ ওগুলো সব সময় সেকেন্ডহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সড। কেউ স্বচক্ষে দেখে না। সব সময়ই শুনবেন, অমুকে দেখেছে, তমুকে বলেছে। শোনা কথার উপরেই মানুষ বিশ্বাস করে বসে থাকে। খতিয়ে দেখতে যায় না কেউ।

    “কেউ খতিয়ে দেখে না সেটা নিশ্চয়ই বলতে পারেন না,” মায়া বলেছিলো তাকে, “আপনি তো দেখেন…এরকম অনেকেই নিশ্চয়ই করে?”

    “হুম, তা করি। করতে গিয়ে কি দেখি, জানেন? নিজর চোখে ভুত দেখেছে এরকম কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।”

    “কাউকেই পাওয়া যায় না?” অবিশ্বাসের সুরে বলেছিলো মায়া।

    “যায়…তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।”

    “এরকম কম সংখ্যক মানুষজন যখন পেয়ে যান তখন কি জানতে পারেন?”

    “তারা বেশ জোর দিয়ে বলে নিজের চোখে ভুত দেখেছে। এর বেশি কিছু বলতে পারে না।”

    “আর আপনি সেসব কথা বিশ্বাস করেন না, কারণ তাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না, তাই তো?”

    চারুর কাছে মনে হচ্ছিলো এই মেয়ে দিন দিন এরকম আরো অনেক বিষয় নিয়ে তর্ক করবে, শক্ত প্রমাণও চাইবে তার কাছে। অথচ নিজেদের বিশাসের সপক্ষে যে কোনো প্রমাণ দিতে হয় না সেটা বেমালুম ভুলে থাকে। বিশ্বাসিদের চরিত্র এমনই হয়।

    “কি ভাবছেন?”

    সম্বিত ফিরে পেয়ে চারু বলেছিলো, “যা বলছিলাম, অনেক সময় আমি বুঝতে পারি তারা আসলেই নিজের চোখে ভুত দেখেছে, কিন্তু এটাই একমাত্র সত্য নয়। আসলে তারা যেটা দেখেছে সেটা হয় দৃষ্টিবিভ্রম নয়তো কারোর সাজানো ভুত।”

    “সাজানো ভুত?”

    “হুম। কিছু মানুষ ভুত সেজে ভুতের ভয় সৃষ্টি করে। এরকম কয়েকজনকে আমি চিনিও।”

    “তারা এ কাজটা কেন করে? তাদের কী লাভ?”

    “কেউ কেউ নিজেদের ব্যবসার অংশ হিসেবে এটা করে থাকে। এ যুগেও ওঝা, প্রেতসাধক আর বাবাদের ব্যবসা আছে। তাদের ব্যবসার একমাত্র পুঁজি হলো ভুতের অস্তিত্বে বিশাসি মানুষজন। সোজা কথায় ভুত বিশ্বস। তো, মাঝেমধ্যে যদি ভুতদর্শন না ঘটে এই বিশ্বাস কিভাবে টিকে থাকবে?”

    “তারা এই বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য ভুত সেজে ঘুরে বেড়ায়?”

    “সহজভাবে বলতে গেলে সেটাই। ওঝারা টাকা দিয়ে কিছু লোককে ভাড়া করে, ওদেরকে ভুত সাজিয়ে নিজেদের এলাকার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর কাজ দিয়ে থাকে। এ কাজটা করা হয় গভীর রাতে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলো মায়া।

    “দুনিয়ার সব মানুষ তো আর রাতে ঘুমিয়ে থাকে না। নিশাচর আছে, দরকারি কাজে বাইরে যাওয়া লোকজন আছে, দেরি করে রাতে ফেরা জুয়ারি কিংবা মাতালও থাকে। চোর-ডাকাতের কথা না-হয় বাদই দিলাম। তাদের কারোর না কারোর চোখে এরকম সাজানো ভুত ধরা পড়েই, আর তাতেই কাজ হয়ে যায়। তাদের মুখ থেকে এইসব ‘ভুতদর্শন’-এর গল্প ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে।” একটু থেমে আবার বলেছিলো, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেউ হয়তো মজা করার জন্যেও ভুতের ভয়ও দেখায়, এমন ঘটনাও কিন্তু আছে।”

    “হুম, বুঝেছি।” আস্তে করে বলেছিলো মায়া। “এখন কাজের কথায় আসি। আমাদেরকে গাজীপুরে যেতে হবে।”

    “কিন্তু সেটা কিভাবে করবেন? মিসকাতের মা নিশ্চয় ওখানে যাবার অনুমতি দেবে না আমাদেরকে?”

    “তা তো দেবেই না।”

    “তাহলে কি ডক্টরের হেল্প নেবেন? উনার কিন্তু অনেক ক্ষমতা। রিসোর্সফুল একজন পারসন।”।

    “না।” মায়ার প্রস্তাবটা সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছিলো সে। তদন্তের শুরুতেই ডক্টরের কাছে হেল্প চাওয়ার অর্থ নিজের অক্ষমতা অযোগ্যতা প্রকাশ করা। চারু নিজেও কম রিসোর্সফুল নয়, তবে সেটা মুখ ফুটে বলেনি। “ওটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে মায়া বলেছিলো, “তাহলে কক্সে যাচ্ছি। ওখানে?”

    “সম্ভবত পরশু।”

    “ঠিক আছে। সেটাই ভালো হয়। আমার আবার মাইগ্রেনের পেইন শুরু হয়েছে। ভাবছি, কাল সারাটা দিন বিশ্রাম নের্বা।”

    “তাহলে কাল ডক্টরের বাড়িতে যাচ্ছে না?”

    “না।”

    “ঠিক আছে। গাজীপুরে যাবার ব্যবস্থা করতে পারলে আপনাকে জানাবো।”

    “গাজীপুর থেকে আসার পর কি ওদের সঙ্গে কথা বলবেন?”

    “হুম। নিহত মিসকাতের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।”

    চারু জানে, এই অ্যাসাইনমেন্টের সবচেয়ে কঠিন অংশই হলো হ্যালোউইন পার্টিতে অংশ নেয়া মিসকাতের বন্ধুবান্ধবদের নাগাল পাওয়া, তাদের সঙ্গে কথা বলা।

    পুরো ডোসিয়ারটা আরেকবার মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর এখন বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সে।

    একদল ধনীর সন্তান পশ্চিমের অনুকরণে হ্যালোউইন পার্টি করতে গেলো গাজীপুরের বিরান এক বাড়িতে। তারপর ওখানে তাদের একজন খুন হলো। সম্ভাব্য খুনি তাদেরই কোনো বন্ধু। সংখ্যাটা একাধিকও হতে পারে। খুনের পর পরই ওদের একজন লাপাত্তা হয়ে গেলো, ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া গেলো ঢাকার একটি হাসপাতালে। খুন হবার বহু আগেই সে বাইক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছিলো। তার এক পায়ে অপারেশন করতে হয়েছে। মাথার আঘাতটিও গুরুতর ছিলো। ওই ছেলের পক্ষে গাজীপুরে গিয়ে খুন করা তো দূরের কথা নার্সের সাহায্য ছাড়া শৌচকর্ম করাও তখন সম্ভব ছিলো না।

    ডোসিয়ারে যে তথ্য আছে সেটা বলছে, মিসকাত খুন হবার সময় অ্যাকসিডেন্টে আহত বাবু নামের ছেলেটি অপারেশন থিয়েটারে ছিলো। সুতরাং এটা নিশ্চিত, বাইকার বাবু খুনটা করেনি। তবে খুনটা যে করেছে তার সাথে বাবুর সম্পর্ক থাকতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় তেমনটাই মনে হচ্ছে।

    নিশ্চয় হ্যালোউইন পার্টির বহু আগেই ওদের বন্ধুমহলে কিছু একটা ঘটেছিলো। কোনোকিছু নিয়ে নিহত মিসকাতের সাথে কারোর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিলো, কিংবা মিসকাতের সাথে কারোর গোপন শত্রুতা থেকে থাকবে হয়তো। সেই সুযোগটাই নেয়া হয়েছে হ্যালোউইন-নাইটে।

    এইসব ধনী ছেলেমেয়েদের সাথে এ নিয়ে কথা বলাটা যে মোটেও সহজ কিছু হবে না সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারছে। খুনি ওদের মধ্যেই কেউ একজন। কিংবা একাধিক। আবার যারা খুন করেনি, অথবা এ কাজের সাথে মোটেও জড়িত নয় তারাও অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে কথা বলতে চাইবে না।

    বাইকার বাবুকে যেহেতু এই খুনের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে দেখা হয়েছিলো, তার সাথে যোগাযোগ করাটা হবে আরো বেশি কঠিন কাজ।

    ঘটনার প্রায় এগারো মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ডোসিয়ার বলছে, নিহত মিসকাত আর বাবুকে বাদ দিলে বাকি যারা থাকে তাদের মধ্যে কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে দুটো ছেলে। সম্ভবত ওদের বাবা-মা ঝামেলা এড়াতে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবেছে। ঐ দু-জন ছেলের মধ্যে যদি সত্যিকারের খুনি থেকে থাকে তাহলে এই অ্যাসাইনমেন্টের অবস্থাও হবে পুলিশের তদন্তের মতো।

    গতমাসে আবার ওই দলের এক মেয়ে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। সুতরাং বাকি থাকে ন-জন। যেভাবেই হোক তাদের নাগাল পেতে হবে। চারু মনে মনে আশা করলো, এই নয়জনের মধ্যেই যেন খুনি থেকে থাকে।

    তবে গাজীপুরে মিসকাতের দাদার বাড়িতে কিভাবে যাওয়া যায় ভাবতেই একজনের কথা মনে পড়ে গেলো তার। ঐ লোক শুধু তাদেরকে গাজীপুরে যাওয়ারও ব্যবস্থাই করে দিতে পারবে না, এই কেসের ব্যাপারেও অনেক সাহায্য করতে পারবে।

    .

    অধ্যায় ১২

    পরদিন সকালে সবার আগে ব্যাশনালিস্ট সোসাইটিতে গেলে চারু।

    তার সংগঠনকে জানালো সে একটা চাকরি পেয়েছে। যদিও অদ্ভুত এই চাকরি ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানালো না কাউকে। র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির সদস্যরা এতে একটু অবাকই হয়েছে, তবে এ নিয়ে কেউ চাপাচাপি করেনি।

    কিছুক্ষণ সোসাইটিতে সময় কাটিয়ে সোজা চলে গেলো মিন্টো রোডে অবস্থিত ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের অফিসে। মিসকাতের কেস তদন্ত করছে ডিবির যে লোকটা সেই মুর্তজা আহমেদের সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয় না থাকলেও এক সাংবাদিক বন্ধুর সহায়তা নিয়েছে সে। মহাকাল-এর ক্রাইম-রিপোর্টার আবেদুর রহমান তার বেশ ঘনিষ্ঠ, তাদের যুক্তিবাদি সমিতির একজন সদস্য সে। তারচেয়েও বড় কথা, তার সঙ্গে সম্পর্কটা দারুণ। কখনও তার কাছে সাহায্য চেয়ে বিমুখ হয়নি চারু। মহাকাল-এর মতো প্রথমশ্রেণীর সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের ক্রাইম-রিপোর্টার হিসেবে প্রশাসনের অনেক উঁচুতলার লোকজনের সাথে তার খাতির রয়েছে। আবেদুর রহমান জরুরি একটা অ্যাসাইনমেন্টের কারণে ঢাকার বাইরে আছে। তার সাথে চারুর ফোনে কথা হয়েছে একটু আগে, সে বলেছে, চারু যেন সরাসরি ডিবি অফিসে চলে যায়। মুর্তজাকে তার নাম বললেই হবে।

    চারুর ধারণা, ওখানে পৌঁছানোর আগেই তদন্তকারি কর্মকর্তাকে ফোন করে তার আসার কথা বলে দেবে আবেদুর।

    তার ভাগ্য ভালো, নিজের অফিসেই আছে গোয়েন্দা ভদ্রলোক। রুমে ঢুকে আবেদুরের পরিচয় দিতেই হাসিমুখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ডিবি অফিসার।

    “আবেদ আমারে ফোন দিছিলো একটু আগে,” আন্তরিকভাবেই বলল মিসকাত হত্যার তদন্তকারি কর্মকর্তা। “বসেন বসেন।” ডেস্কের সামনে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল সে।

    চারু বসে পড়লো।

    “চা খাইবেন?”

    “থ্যাঙ্কস। আমি একটু আগেই খেয়েছি।”

    হাসি দিলো মুর্তজা। “তাইলে বলেন, সমস্যাটা কি?”

    সরাসরি কাজের কথায় চলে আসায় স্বস্তি বোধ করলো চারু। “একটা কেসের ব্যাপারে জানতে চাইছিলাম। আপনিই কেসটা তদন্ত করছেন।”

    “কোন্ কেসের কথা বলছেন?”

    ভদ্রলোকের ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তাকে সম্ভবত তদবিরকারি বলে মনে করছে। “গাজীপুরে হ্যালোউইন পার্টির কেসটা। এমপির ছেলে মিসকাত খুন হয়েছিলো।”

    “ওহ,” সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে বলে উঠলো অফিসার। “ঐ আজব কেসটার কথা বলতাছেন?”

    “জি।”

    “আপনি কি ভিক্টিমের পরিচিত, নাকি সাসপেক্টের?”

    “ওদের কারো সাথে আমার পরিচয় নেই। আমি যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। অলৌকিক দাবি করা হয় এমন বিষয়গুলো নিয়ে কেস স্টাডি করে থাকি। মিসকাতের ঘটনাটা নিয়ে সে-রকম কিছু করতে চাচ্ছি আমরা।”

    “ও, আচ্ছা, একটু চুপ থেকে আবার বলল মুর্তজা, “আবেদ অবশ্য আমারে ডিটেইল কিছু বলে নাই। খালি বলল আপনেরে যেন একটু হেল্প করি। আপনি তার ক্লোজ ফ্রেন্ড। তো, বলেন কি জানতে চান?”

    “ঐ কেসটা কি অবস্থায় আছে এখন?”

    “কোনো অবস্থায় নাই, জ্যামে আটকা পড়ছে। পুলিশ যেখানে গিয়া থামছিলো আমরাও সেইখানে গিয়া আটকা পড়ছি। এমপি চাপ দিলে মাঝেমইদ্যে একটু নড়াচড়া করি, আর কিছু না।”

    “বাইকার বাবু কি এখনও প্রাইম সাসপেক্ট হিসেবে আছে আপনাদের তদন্তে?”

    ঠোঁট উল্টালো মুর্তজা আহমেদ। “না। ওরে কেমনে সাসপেক্ট লিস্টে রাখি, বলেন? ঘটনার বহুত আগেই তো ঠ্যাং ভাইঙ্গা হাসপাতালে,” খামোখাই দাঁত বের করে হাসলো অফিসার, “ও তখন হাগামুতাও করতো বেডে শুইয়া শুইয়া, খুনখারাবি করবো কেমনে, তা-ও আবার গাজীপুরে গিয়া।”

    “তা ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু “আপনারা কি বাবু ছেলেটার মোবাইলফোন আর ব্যাগ হারানোর ঘটনাটা তদন্ত করে কিছু পাননি? এই চুরির সাথে খুনের সরাসরি সম্পর্ক আছে কিন্তু।”

    “এই চুরির ব্যাপারটা পুলিশ ঐ সময়েই তদন্ত করছিলো, কিছু পায় নাই। আমরাও কিছু বাইর করতে পারি নাই। তয় এইটা শিওর, যেই সিএনজি ড্রাইভার পোলাটারে হাসপাতালে নিয়া আসছিলো কামটা সে-ই করছে। পোলাটারে হাসপাতালে দিয়াই চম্পট মারছে হারামজাদা।”

    “আপনাদের কি মনে হয়নি ব্যাগ আর ফোনটা যে চুরি করেছে সে-ই খুনি হতে পারে?”

    মাথা দোলাল ডিবি অফিসার। “ঐ সিএনজি ড্রাইভার চোর হইতে পারে কিন্তু খুনি কেমনে হয়? সে হয়তো লোভ সামলাইতে না পাইরা চুরিটা করছে কিন্তু মিসকাতরে সে কেন খুন করতে যাইবো গাজীপুরে? আর বাবু পোলাটা যে মিসকাতের বন্ধু সেইটা সে কেমনে জানবো?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “আমি এজন্যে বলছিলাম, কারণ ঐ ব্যাকপ্যাকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ আর পোশাকটা ছিলো…যেটা পরে খুনি খুনটা করেছে।”

    “ওরা কে কি সাজবো সেইটা তো আগে থেইকা সবাই জানতো, এইটা গোপন কিছু ছিলো না। আমি ওগোরে পুছতাছ করছি। ওরাও স্বীকার করছে এইটা। বুঝবারই পারতাছেন, খুব সহজেই অন্য কেউ সুযোগটা নিবার পারে।”

    “তাহলে কি ওদের মধ্যে কেউ জড়িত বলে সন্দেহ করছেন?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো অফিসার। “হুম।”

    “আপনারা কি বাবুকে সন্দেহের মধ্যে রাখছেন? মানে, সরাসরি না হোক, অন্য কোনোভাবে জড়িত ছিলো হয়তো?”

    “না।” জোর দিয়ে বলল মুর্তজা। “মনে রাইখেন, যে-ই কামটা করছে। তার লগে খালি ভিক্টিমেরই না, বাবু পোলাটারও সম্পর্ক ভালো আছিলো না।”

    চারু নড়েচড়ে উঠলো। “আপনার কেন এটা মনে হলো?”

    মুর্তজা বিজ্ঞের মতো হাসি দিলো। “খুনির ইনটেনশন ছিলো বাবুরে ফাঁসানো!”

    “তাই নাকি?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো তদন্তকারি কর্মকর্তা। “হুম। কিন্তু লাভ হয় নাই। খুনি কি করছে জানেন?” চারুর জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, “এমুন আলামত রাইখা দিছিলো যে বাবুরে আমরা সন্দেহ করি।”

    “কি রকম?”

    “ঘটনার পর পুলিশ গাজীপুরের ঐ বাগানবাড়ির বাইরের রাস্তায় বাবুর জুতা খুঁইজ্যা পাইছিলো। জুতাটা সুন্দর কইরা রাস্তার উপর রাখা ছিলো।”

    চারুর কাছে যে ডোসিয়ার আছে তাতে এ তথ্যটা দেয়া নেই। “পুলিশ এটা আলামত হিসেবে জব্দ করেছে?”

    “পুলিশরে আপনারা এত ইনকম্পিটেন্ট ভাবেন কেন বুঝি না।”

    “আমি কিন্তু পুলিশকে ওরকম ভাবি না। তারা অনেক জটিল কেস সভ করতে পারে।”

    ডিবি অফিসার খুশি হলো কথাটা শুনে। “তয় আলামতটা জব্দ করলেও কোনো কাজে আসে নাই। বাবু পুলিশের কাছে স্বীকার করছে ওইটা ওর জুতা।”

    “তাহলে তো এটা সন্দেহজনক ব্যাপার না?”

    চারুকে হতাশ করে দিয়ে মাথা দোলাল ডিবির কর্মকর্তা। “হাসপাতালে যখন বাবুরে নিয়া আসা হয় তখন ওর পায়ে কোনো জুতা আছিলো না। ব্যাগ আর ফোনের সাথে এইটাও চুরি হইছিলো।”

    “ওহ্,” চারু এবার বুঝতে পারলো। এই পয়েন্টগুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। সে ভেবেছিলো বাইকার বাবু নিজে খুন না করলেও এসবের সাথে হয়তো জড়িত। কিন্তু এখন একজোড়া জুতো বলে দিচ্ছে অন্য কথা। ধুনটা যে-ই করেছে সে নিশ্চয় তার পার্টনারকে ফাঁসানোর জন্য এমন কাজ করবে না। আবার বাবুকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যটাও পরিস্কার নয়। তার জুতোটা ওভাবে রেখে দিয়ে তাকে খুনি হিসেবে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়ার যে চেষ্টা সেটা নিতান্তই বালখিল্য ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।

    “কুনো ক্রিমিনাল কিন্তু এইভাবে আলামত ডিসপ্লে করবো না।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান।

    “তাছাড়া, আমাগো ফরেনসিক এক্সপার্টরা ডেডবডির সুরতহাল রিপোর্ট আর ইনজুরিগুলান দেইখা বলছে, খুনি বাউয়া…মানে, বামহাতি।”

    চারু মনোযোগ দিয়ে শুনে গেলো তদন্তকারির কথা।

    “ভিক্টিমরে প্রথমে পিছন থেইকা স্টেইব করছে কয়েকটা। ওইসব ইনজুরির হাইট, ভিক্টিমের হাইট থিকা আমরা আন্দাজ করবার পারছি খুনির হাইট পাঁচফুট চাইর-পাঁচ ইঞ্চির মতো হইবো। কিন্তু বাবুর হাইট তো পাঁচফুট না। আর সে বাউয়াও না।” ডিবি অফিসার তৃপ্তির হাসি দিলো। “এই কেসের সবকিছু আমার মুখস্ত হইয়া গেছে, কেউ এই বিষয়ে পরীক্ষা নিলে আমি একশ’তে একশ’ পামু।”

    মুচকি হাসলো চারু। “আচ্ছা, আমি গাজীপুরের ঐ বাড়িতে একটু যেতে চাইছি, সেটা কি সম্ভব?”

    একটু ভাবনায় পড়ে গেলো অফিসার।

    “শুধু একটু ঘুরে দেখবো। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবো না। শুনেছি, ওখানে এক কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউ থাকে না। পুরো বাড়িটা খালিই পড়ে আছে। সেজন্যেই বলছিলাম, আপনি যেহেতু তদন্ত কর্মকর্তা, আপনি চাইলে এটা ম্যানেজ করতে পারবেন।”

    “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো মুর্তজা। “আমি ওইখানকার থানারে বইলা দিলে কোনো সমস্যা হইবো না মনে হয়। কবে যাইবার চান?”

    “আগামিকাল?”

    অফিসার একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে, আমি থানারে বইলা দিমুনে।”

    “থ্যাঙ্কস, ভাই।” চারু দন্তবিকশিত হাসি দিলো এবার। অন্য প্রসঙ্গে চলে এলো সে। “আপনি নিজে কি মনে করছেন কেসটার ব্যাপারে? মানে, খুনটা কে করতে পারে?”

    কাঁধ তুললো অফিসার। “এইটা বলা খুব কঠিন। এইরকম আজব কেস আমি বাপের জনমেও দেখি নাই। পুরা সিনেমার মতো। মাঝেমইেদ্যে আমার কি মনে হয়, জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, “খুনটা ওরা সবাই মিইল্যা করছে।”

    অফিসারের কথায় চমকে উঠলো যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। “সবাই মিলে?

    হেসে ফেলল মুর্তজা। “কলেজে থাকতে একটা ডিটেক্টিভ নভেলে পড়ছিলাম, নামটা মনে করবার পারতাছি না। চলন্ত ট্রেনের মইদ্যে একটা খুন হয়…ট্রেনেরই কেউ খুনটা করছে, কিন্তু কে-সেইটা কেউ জানে না। পরে দেখা গেলো সবাই মিল্যা করছে।”

    অফিসার যে আগাথা ক্রিস্টির একটি উপন্যাসের কথা বলছে সেটা বুঝতে পারলো চারু।

    “মনে হইতে পারে পুরাই আজগুবি, কিন্তু এমন কইলাম হইবারও পারে, পারে না?”

    “হুম…তা তো হতেই পারে।”

    “আমার হিসাব খুব সোজা, বুঝলেন। বারো-তেরোটা পোলা-মাইয়া পার্টির নামে ফুর্তি করতে গেছিলো, মদ-গাঞ্জাসহ আজিব আজিব সব নিশাপানি করছে ওরা, হুঁশ-জ্ঞান কিছু আছিলো না। ওগোর মইদ্যে কেউ এইটা করছে। বাবু পোলাটার অ্যাকসিডেন্টের খবর পাইয়া চান্স নিছে।”

    “ওখান থেকে কি মাদকও রিকভারি করেছিলো পুলিশ?”

    দাঁত বের করে হাসলো ভদ্রলোক। “গাঞ্জা, মদ, বিয়ার, সিগারেট, ইয়াবা আর কনডম।” শেষ কথাটা বলার সময় ইঙ্গিতপূর্ণভাবে চোখ টিপে দিলো অফিসার। “ইউজড-আনইউজড…দুই রকরমেরই।”

    মুখ টিপে হাসলো চারু।

    “কিন্তু এইসব জিনিস কইলাম সিজার লিস্টে নাই।”

    ডিবি অফিসারের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। “কেন?”

    “আপনে কুটি কুটি ট্যাকা খরচ কইরা এমপি হইবেন আর এইটুকু সুবিধা পাইবেন না, তা কি হয়?”

    “এমপি চাননি এইসব জিনিসের কথা কেউ জানুক?”

    সায় দিলো অফিসার। “একে তো জোয়ান পোলাটা মরছে, এরপর যদি এইসব কুকীর্তির কথা জানাজানি হয়া যায় তাইলে পোলাটার অসম্মান হইবো না? খারাপ ভাববো না?”

    “হুম, বুঝলাম। কিন্তু এর ফলে মামলায় সমস্যা হতে পারে, সেটা উনার বোঝা উচিত ছিলো। সিজার লিস্টে যদি এমন কিছু না থাকে তাহলে পরবর্তিতে দরকার হলে আদালতে এসব জিনিসের প্রমাণই দেয়া যাবে না। এমনও হতে পারে, এই সামান্য জিনিসের কারণে পুরো মামলাটা অন্য রকম হয়ে গেলো।”

    “আপনের কি ধারণা এমপি মামলা নিয়া ভাবতাছে?” দাঁত বের হাসলো ডিবি অফিসার। সেই হাসি যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ।

    ভুরু কুচকে ফেলল চারু।

    “উনি যদি খালি একবার জানবার পারেন খুনটা কে করছে তারপর কি আইন-আদালতের জন্য বইসা থাকবেন?” মাখা দোলাল, সে “বিচারের জন্য উনি বইসা থাকবেন না।”

    “তাহলে কি করবেন?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো চারু।

    “কি করবেন সেইটা আমি কেমনে কই। তার ভাবসাব দেইখা মনে হইছে বিচারের জন্য বইসা থাকবেন না।” নিঃশব্দে হাসি দিলো অফিসার। যেন বাকি কথাটা চারু তার আক্কেল দিয়ে বুঝে নেয়। “যাউকগা, যেটা কইতাছিলাম,” ডিবি অফিসার আবার বলতে শুরু করলো, “এইরকম একটা পার্টির মাঝ-রাইতে ওগোর একজন খুন হইছে, খুনটা হইছে বাড়ির মইদ্যেই…যে চাকুটা দিয়া খুন করা হইছে ওইটাও পোলাপানগুলা ঢাকা থেইকা নিয়া গেছিলো। ঐ বাড়ির কেয়ারটেকারুরে আমি নিজে পুছতাছ করছি, সে বলছে, খুনের পর চেক কইরা দেখছে, মেইনগেটটা তালা মারাই ছিলো।”

    খুব মনোযোগ দিয়ে ডিবি অফিসারের কথাগুলো শুনে গেলো চারু।

    “কামটা আসলে করছে ঐ এগারোজনের মইদ্যে কেউ…আমার ধারনা খুনি একজনের বেশি হইবার পারে।”

    “তাহলে আপনি ওদের উপর কনসার্নট্রেইট করছেন না কেন? ওদেরকে ভালোমতো জিজ্ঞাসাবাদ করলে কিছু একটা নিশ্চয় জানা যেতো?”

    “কী যে বলেন না…কাউরে বাকি রাখছি? ঠ্যাং ভাঙ্গা পোলাটারেও দুই তিনবার ইন্টেরোগেট করছি আমি নিজে। বাকি পোলা-মাইয়াগুলানও তো

    সব বড়লোকের, খালি ভিক্টিমের মা এমপি বইলা ওগোরে ইন্টেরোগেট করবার পারছি, নাইলে কি পারতাম?”

    “ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু পাননি?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কর্মকর্তা। “বেশিরভাগ তো ড্রাঙ্ক আছিলো, কোনো কিছুই ঠিকঠাক কইতে পারে না। খালি এক কথা-ই কয়…কেমনে যে কী হইয়া গেলো তারা নাকি কিছু বুঝবার পারে নাই।”

    “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে যে ছেলেটা ওখানে গেছিলো তার মুখটা কি ওদের কেউ দেখেছিলো?”

    মাথা দোলাল মুর্তজা আহমেদ। “না। ওরা বলছে, পোলাটা নাকি আজিব কিসিমের আচরণ করতাছিলো। কারো সাথে কথা কয় নাই। থম মাইরা আছিলো। কিন্তু পোলাপানগুলা এতো বেশি ড্রাঙ্ক আছিলো যে, এইটা নিয়া মাথা-ই ঘামায় নাই। হেরা মওজ-ফুর্তি করতেই মশগুল আছিলো।”

    “বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ওদের কথাবার্তায় কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পাননি?”

    “পাইছি,” সোজাসুজি বলে দিলো তদন্তকারি কর্মকর্তা। “কিন্তু এইটা তো বিরাট কোনো বিষয় না। বার বার পুছতাছ করলে একটু এদিক ওদিক হইতেই পারে। দেখতে হইবো, বড়সর কোনো ফারাক আছে কি-না। সেইরকম কিছু পাই নাই।”

    কথাটা শুনে হতাশ হলো চারু। তারপরও এই অফিসারের সাথে কথা বলে মূল্যবান তথ্য সে পেয়েছে-বাবুর জুতো জোড়া বাগানবাড়ির বাইরে পাওয়া গেছে। আর খুনের পর পর কেয়ারটেকার-কাম দারোয়ান মেইনগেট চেক করে দেখেছে ওটা ভেতর থেকে তালা মারা ছিলো। চাবি ছিলো তার কাছেই। সুতরাং বাইরে থেকে এসে কেউ খুনটা করেনি।

    “আপনি কি গাজিপুরের ঐ বাড়িতে গিয়েছিলেন?”

    “দুইবার গেছি।”

    “ওখানকার বাউন্ডারি ওয়াল কতো উঁচু?”

    “দশফুটের মতো হইবো। চোখের আন্দাজে বলতাছি আর কি, মাইপা টাইপা তো দেখি নাই।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “তাহলে তো সহজেই দেয়াল টপকানোর কথা নয়।”

    “ভেতর থেইকা ওইখানকার দেয়াল টপকানো কঠিন কামও হইবো না। দেয়াল ঘেইষা অনেক গাছগাছালি আছে।”

    “ও।” কথাটা বলেই একটু ভেবে নিলো চারু। “আচ্ছা, খুনি, মানে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে যে গেছিলো সে কিসে করে গাজীপুরে গেছিলো?”

    অফিসার একটু কাচুমাচু খেলো। যেন পরীক্ষার হলে একটা প্রশ্ন কমন পড়েনি। “কিসে কইরা গেছে সেইটা তো জানা যায় নাই। কেয়ারটেকার গেইট খুইল্লা খালি মুখোশ পরা একজনরে দেখছিলো…আর কিছু দেখে নাই।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। এটা খুবই দরকারি একটা তথ্য যেটা ডিবি এখনও বের করতে পারেনি। ঐ রাতে খুনি কিভাবে গাজীপুরে গেলো সেটা জানতে পারলে অনেক কিছু অনুমাণ করা যেত, বোঝা যেত।

    চারুকে চুপ থাকতে দেখে মুর্তজা বলল, “আসলে এই কেসটা পুরাই গোলকধাঁধা… বুঝলেন? আজিব একখান কেস!”

    “হুম।” ছোট্ট করে বলল চারু আহসান। গোলকধাঁধাই বটে! তবে সেটা কেউ তৈরি করেছে।

    .

    অধ্যায় ১৩

    পুরো একটা দিন বিশ্রাম নেবার পর মায়ার মাইগ্রেন ঠিক হয়ে যাবার কথা কিন্তু সেটা হয়নি, তার কারণ আমেরিকা প্রবাসি তার ছোট বোন স্নেহ।

    মায়ার এই ছোটবোন শৈশব থেকেই স্বার্থপর। তার স্বার্থপরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। আপন বোন হলেও এই মেয়ের ফোনকল পেলে মায়ার মেজাজ বিগড়ে যায়। তার কথাবার্তা সব সময়ই উন্নাসিক। খোঁচা দিয়ে কথা বলার অভ্যেস। অহঙ্কারি, আর মায়ার ভাষায় ‘ইনসেনসিটিভ একটা মেয়ে। স্নেহের মধ্যে আসলেই মায়ার অভাব প্রকট!

    গতকাল রাত বারোটার পর এই বোনের কল পেয়ে তার মাইগ্রেনের যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেছে। বিপরীত গোলার্ধে থাকে সে। নিজের সুবিধামতো সময়ে ফোন দেয় সব সময়। বুঝতেও চায় না, যাকে ফোন দিচ্ছে সে হয়তো সারাদিনের পর একটু ঘুমুতে গেছে।

    যাই হোক, স্নেহের ফোনকলে তার কাঁচাঘুম ভাঙলেও দুঃখ ছিলো না, তার দুঃখ বোনটা দিন দিন আরো বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠছে। সে কখনও অন্যের দিকটা ভেবেও দেখে না। নিজের ভালো ছাড়া আর কোনো চিন্তা তার মাথায় থাকে না কখনও।

    মায়ার এই ছোটবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই এক ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়ে। খুব দ্রুত বিয়েও করে ফেলে তার মায়ের অমতে। মা চাননি বড়মেয়েকে রেখে ছোটমেয়ে বিয়ে করুক। কিন্তু তার বোন এমন কথা শুনে নিজের যুক্তি দিয়েছিলো : মায়াকে তো কেউ আটকে রাখেনি বিয়ে করার জন্য, সে কেন করছে না? তার কি বিয়ের বয়স হয়নি? যে

    কথাটা মায়ার কানে গেলে সে তার মাকে জানিয়ে দেয়, বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। সুতরাং তার জন্য অপেক্ষা করার দরকারও নেই। হে বিয়ে করতে চাইলে মা যেন বাধা না দেন।।

    এরপর ছোটবোনটা বিয়ে করলো, ছয়মাসের মাথায় আমেরিকায় চলে গেলো স্বামির সঙ্গে। মায়া আর তার মায়ের ছোট্ট সংসার ভালোই চলছিলো। মডেলিং ছেড়ে রেডিও’র চাকরিটা উপভোগ করছিলো ভীষণ। কিন্তু তার এই সুখ দীর্ঘস্থায়ি হলো না। বছর যেতে না যেতেই স্নেহ আবারও বাগড়া দিলো। তার বাচ্চা হবে, এ মুহূর্তে মাকে খুব দরকার। মায়াও সায় দিয়েছিলো এতে। তার মতো স্বাবলম্বি মেয়ে কিছুটা দিন একা একা থাকতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না। তার মা চলে গেলেন আমেরিকায়। মেহর বাচ্চা হলো। ছয়-সাত মাস পার হয়ে গেলেও মায়ের ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। স্নেহ কিছু মনে করবে বলে মায়া জিজ্ঞেসও করতে না মা কবে দেশে ফিরে আসবেন।

    এখন তার বোন নতুন বায়না ধরেছে। গতরাতে ফোন করে সে বলেছে, তার ছোটবাচ্চাটার দেখভাল করার জন্য মাকে আরো কিছুটা দিন থাকতে হবে তার সঙ্গে। এত ছোটবাচ্চা রেখে স্বামি-স্ত্রী কাজে যাবে কিভাবে? তারা তো আর বাংলাদেশে থাকে না যে, ঘরে বসে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবে। আমেরিকা খুব কঠিন জায়গা। ওখানে সবাইকে কাজ করতে হয়।

    মায়া ভালো করেই জানে তার বোন আসলে বিনে পয়সায় একজন ‘বেবিসিটার-কাম-হাউজমেইড’কে হাতছাড়া করতে চাইছে না। ছোটবোনের এমন স্বার্থপরতায় আরেকবার কষ্ট পেয়েছে সে, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, তার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। মাকে যতোদিন ইচ্ছে নিজের কাছে রাখতে পারে হে।

    এ কথার পরও যদি ফোনটা রেখে দিতে তার মাইগ্রেন হয়তো এতটা বেড়ে যেত না কিন্তু ফোন রাখার আগে একগাঁদা উপদেশ দিয়েছে তাকে। সে কেন একা থাকে? এভাবে আর ক-দিন? ঢাকা শহরে এভাবে একা থাকা কি ঠিক হচ্ছে? বিয়ের বয়সও তো হয়েছে। কবে বিয়ে করবে?

    এসব কথা শুনে মায়ার মাইগ্রেন আরো বেড়ে যায়। তার খুব ইচ্ছে করছিলো মুখের উপর বলে দিতে, মাকে তোর প্রয়োজনে আমেরিকায় নিয়ে রেখেছিস, নইলে কি আমি একা থাকি? আর আমার বিয়ে নিয়ে, তোকে ভাবতে হবে না। ওটা করা না করা আমার মর্জি।

    কিন্তু মায়া এসব বলতে পারেনি। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে পারে না সে। এমনকি সেটা সত্যি হলেও।

    তো, সারারাত মাইগ্রেনের সমস্যায় কাবু হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠেই চারুর ফোন পায়-আজ দুপুরের দিকে গাজীপুরে যাচ্ছে তারা। মায়া যেন রেডি থাকে।

    চলন্ত গাড়ির দুলুনি খেতে খেতে গতরাতের কথাগুলো ভেবে যাচ্ছিলো মায়া। গাড়িটা ঝাঁকি খেলে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো। তার পাশে বসে আছে চারু। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

    এই গাড়িটা ডক্টর আজফারের। বলামাত্রই নিজের প্রাইভেটকার আর ড্রাইভারকে দিয়ে দিয়েছেন ওদের জন্য। ভদ্রলোক আজ সারাটাদিন বাড়িতেই থাকবেন। বিদেশ থেকে একটা ইন্টারেস্টিং বই নাকি এসেছে তার কাছে, ওটা পড়েই কাটিয়ে দেবেন পুরো একটা দিন।

    তাদের আজকের গাজীপুর সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ডিবির মুর্তজা। তবে ব্যাপারটা মিসকাতের মা যেন বুঝতে না পারে তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানিয় থানায় ফোন করে সে বলে দিয়েছে ঢাকা থেকে ডিবির দু-জন ‘ইনভেস্টিগেটিভ কনসালটেন্ট’ যাবে এমপিসাহেবার বাড়িতে, তাদেরকে যেন ওখানে ঘুরে ফিরে দেখার ব্যবস্থা করা হয়।

    ইনভেস্টিগেটিভ কনসালটেন্ট!

    আইডিয়াটা খারাপ না। কেয়ারটেকার-কাম-দারোয়ান মনে করবে এটা মিসাতের মামলার তদন্তেরই একটা অংশ। বার কয়েক পুলিশ সেখানে গেছে, সুতরাং এ নিয়ে কোনো সন্দেহই করবে না। হয়তো এমপিকেও জানাবে না সেটা। আর যদি জানায়, মিসকাতের মা এ নিয়ে মাখা ঘামাবেন না। ভদ্রমহিলা জানেন, তদন্তের প্রয়োজনে যেকোনো সময় সেখানে পুলিশ-ডিবি যেতেই পারে।

    জ্যামের কারণে একটু দেরি করে গাজীপুরে পৌঁছাল তারা। এরপর আগে থেকে বলে রাখা লোকাল থানার এক এসআইকে থানা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে মিসকাতের দাদার বাড়িতে ঢুকলো। তাদেরকে দেখে সম্ভ্রমের সাথে সালাম ঠুকলো মাঝবয়সি কেয়ারটেকার শামসু মিয়া।

    মিসকাত খুন হবার পর থেকে মনে হয় না এই বাড়িতে কেউ থাকতে এসেছিলো। মেইনরোড থেকে দীর্ঘ একটি পথের শেষে এই বিশাল বাড়িটার চারপাশে শুধু ক্ষেতি জমি। দূরে লোকালয় থাকলেও বাড়ির সীমানা ঘেষে কোনো জনবসতি নেই। সম্ভবত আশেপাশের নিচু জমি আর ক্ষেতিগুলোও মিসকাতের বাপ-দাদাদের।

    বাড়িটার প্রবেশমুখ উত্তরদিকে। সামনের অংশ বিরাট একটি মাঠের মতোই। চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। উচ্চতায় আট-দশফুটের নিচে হবে না। একতলা একটি পুরনো দালান দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির দক্ষিণ দিকে। দু-পাশে ইটবিছানো সরু দুটো পথ চলে গেছে বাড়ির পেছনে। তবে ডানদিকের পথটি ব্যবহার না করার কারণে ঝোঁপঝাড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। বামদিকের পথটির দু-পাশে আবার কিছু আম-কাঁঠাল আর নাম-না-জানা গাছের সারি। বৃক্ষশোভিত একটি গ্রামীন পথ যেন।

    লোকাল থানার এসআইকে বাইরে রেখে কেয়ারটেকার শামসু মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে চারু আর মায়া ঢুকে পড়লো বাড়ির অন্দর মহলে। ঘুরে ঘুরে সবগুলো ঘর দেখে নিলো তারা।

    মোট চারটা বড় ঘর, একটা ডাইনিং আর কিচেন দেখতে পেলো। ঘরগুলো পুরনো আসবাবে সাজানো। খুন হবার আগে মিসকাত যে ঘরে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ছিলো সেখানে চলে এলো এই বাড়ির কেয়ারটেকারকে নিয়ে।

    একটা বিশাল শোবার ঘর। আজকাল এরকম আয়তনের ঘর দেখা যায়। পুরনো দিনের বিশাল নক্সা করা একটি পালঙ্ক, কারুকাজ করা আলমিরা, আলনা, সিন্দুক, আরামকেদারা, কফি টেবিল, এক সেট সোফাসহ আরো কিছু আসবাব আছে।

    ঘরের উত্তর দিকে আরেকটা দরজা দেখতে পেলো। কেয়ারটেকার তাদেরকে সেই দরজা দিয়ে সরু একটি হলওয়ের শেষমাথায় বাথরুমে নিয়ে এলো।

    এখানেই মিসকাতকে খুন করা হয়েছিলো।

    পুরনো দিনের বাড়ি, অ্যাটাচড বাথরুমের কথা তখনও কেউ চিন্তাও করতো না। ঘর-বাড়ি থেকে যতোটা দূরে এসব ‘পঙ্কিল’ আর ‘নোংরা’ জিনিস রাখা যায় ততোই ভালো-এমনই ছিলো তখনকার দিনের রীতি।

    বাথরুমের পুরনো মডেলের বেসিন, কমোড আর ট্যাপ-শাওয়ার দেখে চারু ধারণা করলো, মূল বাড়িটা বানানোর আরো পরে এটা বানানো হয়েছে। হয়তো শোবার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা কামড়া ছিলো চাকরবাকরদের জন্য, সেটাকে বাথরুমে বদলে ফেলা হয়েছে।

    বাথরুমটার আকার কম করে হলেও দশ বাই বারো ফুটের হবে। দরজাটা এখনকার দিনের মতো পিভিসি শিটের নয়, নক্সা করা ভারি কাঠের তৈরি। হাইপ্যান-লোপ্যান দুটোই আছে পাশাপাশি। পুরনো দিনের বাথরুমে পুরনো দিনের লালচে বাল্ব। একদম মানানসই। আয়নাটা বেশ মলিন আর নোংরা হয়ে আছে।

    এখানেই মিসকাতকে একা পেয়ে যায়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরূপি খুনি। মিসকাত যদি চিৎকার দিয়েও থাকে, শোবার ঘরে বেঘোরে পড়ে থাকা তার বান্ধবির কানে সেটা পৌঁছায়নি। এই সুযোগে খুনি ইচ্ছেমতো চাকুটা ব্যবহার করে জিঘাংসা মিটিয়েছে। তারপর কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই চলে যেতে পেরেছে বাড়ি থেকে।

    বাথরুম থেকে বের হয়ে মায়া আর চারু বাড়ির পেছন দিককার অংশে চলে এলো। সামনের অংশের চেয়ে পেছনের অংশ অনেক বেশি বড় আর বৈচিত্র্যময়। বিশাল একটি পুকুর, ওষুধি বাগান আর পুকুরের অন্যপাশে ছোট্ট টিনশেডের ঘর। পুকুরের এক পাশে তিন-চারটা পাকা কবরও দেখতে পেলো। সম্ভবত মিসকাতের পূর্ব-পুরুষদের।

    সারা বাড়িতে প্রচুর গাছপালা। এটা বাড়ির সীমানা প্রাচীর থেকেই শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড গরমেও ঝিরিঝিরি বাতাসের কারণে ভালো লাগছে মায়ার। এরকম পরিবেশে এলে সব সময়ই তার ভালো লাগে। একটা গাছের নিচ থেকে মার্বেল আকৃতির ছোট্ট একটা ফল কুড়িয়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে শুরু করলো সে।

    “কি এটা?” জিজ্ঞেস করলো চারু।

    “লটকন,” জবাবে বলল মেয়েটি। “খাবেন?”

    হাত নেড়ে না করে দিলো। সে এখানে লটকন খেতে আসেনি, ঘটনার জট খুলতে এসেছে। চারুর দৃষ্টিতে তদন্তকারির তীক্ষ্ণতা থাকলেও মায়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাইছে ক্ষণিকের জন্যে।

    পুরো বাড়িটা এক পাক ঘুরে এসে আবারো মেইন গেটের সামনে চলে এলো তারা। সীমানা প্রাচীরের দিকে ভালো করে তাকালো চারু। আট-দশ ফুটের মতো উঁচু প্রাচীর ঘেষে বিভিন্ন ধরণর গাছ-গাছালি। মেইনগেটের ডানদিকে, দশ-বারো গজ পরে একটা না-না-জানা গাছ চোখে পড়লো। গোড়া থেকে একটু বেঁকে এমনভাবে উঠে গেছে যে, খুব সহজেই গাছে চড়তে অভ্যস্ত মানুষ সেটা বেয়ে সীমানা প্রাচীর ডিঙাতে পারবে।

    যদিও চারুর এমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তারপরও চেষ্টা করে দেখলো। একটু বেগ পেলেও প্রাচীরের উপরে ওঠার মতো উঁচুতে উঠতে পারলো সে। কেয়ারটেকার আর লোকাল থানার এসআই হা করে চেয়ে রইলো তার দিকে।

    “এভাবে তো দেয়াল টপকানো সম্ভব,” গাছ থেকে নেমে দু-হাত ঝাড়া দিয়ে আলগা ময়লা পরিস্কার করতে করতে চারু বলল।

    “হ, যাইবো তো,” শামসু মিয়া সায় দিলো।

    “তাহলে খুনি এভাবেই দেয়াল টপকে চলে গেছে, অনেকটা আপন মনে বলে উঠলো সে।

    কথাটা শুনে কেয়ারটেকার আর এসআই একে অন্যের দিকে তাকালো।

    “ঐ দিন পার্টিতে সবার শেষে যে ছেলেটা এসেছিলো সে কিসে করে এখানে এসেছিলো? তুমিই তো গেট খুলে তাকে ঢুকতে দিয়েছিলে, তাই না?” কেয়ারটেকারের কাছে জানতে চাইলে চারু।

    “এইটা তো আমি দেহি নাই,” বলল শামসু মিয়া। “গেট খুইল্যা দেহি একটা ভুত খাড়ায়া আছে। আমি তো পারলে চিকুরই দিয়া দিতাম কিন্তু রাইতে মিসকাতভাই আর তার বন্ধুবান্ধবগো ভুত সাজতে দেখছিলাম বইলা না ডরাই নাই।”

    “ঐ ছেলেটা মুখোশ পরেই ঢুকেছিল তাহলে?” চারু আরেকটু নিশ্চিত হতে চাইলো।

    “হ।”

    “কিন্তু সে কিসে করে এখানে এসেছিল তুমি সেটা দেখোনি?”

    “না।”

    চারু জানে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়াটা খুব জরুরি। কিন্তু কেয়ারটেকার যদি এটা না জেনে থাকে তাহলে অন্য কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ঐদিন কিভাবে এখানে এসে পৌঁছালো।

    চারুকে চুপ থাকতে দেখে কেয়ারটেকার বলল, “এইহানে ভুতের আছর আছে…জায়গাটা খারাপ। ঐ ঘটনার পর থিকা তো আমার চক্ষে ঘুম নাই। রাইত-বিরাইতে মানুষের পায়ের আওয়াজ পাই। মনে অয় কেউ হাটতাছে বাগানে। মিসকাত ভায়ের আত্মা মনে অয়।”

    এ নিয়ে কেয়ারটেকারের সথে কোনো তর্ক করলো না চারু। যেখানে শিক্ষিতেরাই অশরীরি আত্মায় বিশ্বাস করে সেখানে শামসু মিয়াদের মতো স্বল্পশিক্ষিত একজনকে দোষ দেয়া যায় না।

    “সবার শেষে যে ছেলেটা ঢুকেছিলো তার সাথে তোমার কোনো কথা হয়নি?”

    “না। হে তো দরজায় জোরে জোরে বাড়ি মারছে খালি। আমি গেটের ফুটা দিয়া দেহি একটা ভুত খাড়ায়া আছে। মিসকাতভাই আগেই কইছিলো, হে গো আরেকজন বন্ধু আইবো।”

    “তাহলে তুমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই ভেতরে ঢুকতে দিয়ে দিলে?”

    চারুর এমন কথায় লোকটার কেয়ারটেকারসত্তায় আঘাত লাগলো। “জিগামু না ক্যান, জিগাইছি তো,” জোর দিয়ে বলল সে। “হে কুনো জওয়াব দেয় নাই। মিসকাত ভায়ের এক বন্ধু আইসা আমারে কইলো এইটা তাগোর বন্ধু, তাই আমি আর কিছু না জিগায়া গেট খুইল্যা দিসি।”

    “কোন বন্ধুর কথা বলছো তুমি?”

    কেয়ারটেকার একটু লজ্জা পেলো মনে হয়। “ঐ যে…ইয়ের মতো…মাইগা টাইপের একটা পোলা আছে না?”

    চারু বুঝতে পারলো কার কথা বলছে। অ্যাঞ্জেল। “তারপর তুমি কি করলে?”

    “আর কি করমু…গেটে তালা দিয়া সোজা আমার ঘরে আইসা শুইয়া পড়ছি।”

    “খুনের আগপর্যন্ত তুমি তোমার ঘরেই ছিলে?”

    “হ। যহন আমার চোখ লাইগ্যা আইছে তহন হেগোর চিল্লাচিল্লি শুইন্যা ঘুম ভাঙছে।”

    “ঠিক আছে।” কথাটা বলে মায়ার দিকে তাকালো সে। “আপনার কিছু জানার নেই? ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

    “না। আমার কিছু জানার নেই,” মায়া উদাস হয়ে বাড়ির চারপাশটা দেখতে দেখতে জবাব দিলো।

    বাঁকাহাসি দিলো চারু আহসান। তদন্ত করা এ মেয়ের কাজ নয়। এসআই আর কেয়ারটেকারকে রেখে তারা দুজন হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে এলো। মায়া এখনও লটকন না ফটকন মুখে দিয়ে চিবিয়ে যাচ্ছে।

    তার দৃষ্টিতে কোনো কৌতূহল নেই।

    “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে যে-ই ঢুকে থাকুক তাকে অ্যাঞ্জেল সহায়তা করেছে।”

    মায়া অবাক হয়ে তাকালো চারুর দিকে। “আপনার ধারণা অ্যাঞ্জেল এই খুনের সাথে জড়িত?”

    “হুম। অনুমাণ করছি আর কি।”

    “আমার অবশ্য সে-রকম মনে হচ্ছে না।”

    “মনে হচ্ছে না!মায়ার কথাটা পুণরুক্তি করলো যুক্তিবাদি। “তদন্তের সময় মনে হয় জাতীয় কথা বলবেন না। মন একটা বোগাস জিনিস। সেই বোগাস জিনিসের উপরে বেশি নির্ভর করলে পস্তাতে হবে।”

    চারুর খোঁচাটা এবার হজম করলো না মায়া। “মন বোগাস, অলৌকিকত্ব বোগাস! দারুণ! সবই বোগাস। আমরা তাহলে বোগাস একটা দুনিয়াতে বোগাস বোগাস সব জিনিস নিয়ে বাস করছি।”

    মেয়েটার তীর্যক কথায় চ্যালেঞ্জের গন্ধ পেলো চারু। “মন আসলেই পুরোপুরি বোগাস জিনিস। বোগাস বু কবিতাটা পড়েছেন? মন হলো সবচাইতে বড় বোগাস বু।”

    “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, মনের কোনো অস্তিত্ব নেই?”

    মায়ার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলল চারু, “না, নেই।”

    “তাহলে মানুষ হলো হৃদয়হীন একটি প্রাণী?”

    “মন আর হৃদয় এক জিনিস না। একটা আছে, আরেকটা নেই।”

    “বুঝলাম না,” মায়া সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। “আমি এতদিন জানতাম আপনাদের মতো লোকজন আত্মায় বিশ্বাস করে না…এখন দেখছি মনেও বিশ্বাস নেই!”

    আত্মবিশ্বাসি হাসি দিলো চারু।

    “তাহলে আমাদের কিভাবে মনে হয়?…মন খারাপই বা হয় কিভাবে?”

    “আপনি যেটার কথা বলছেন তা আসলে অন্য জিনিস…মন না।”

    “একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

    চারু খুব উৎসাহি হয়ে বলল, “আপনি কখনও পান খেয়েছেন?”

    একটু অবাকই হলো মায়া। এই জিনিসটা সে প্রায়ই খায়। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করাটা তার অনেক অদ্ভুত বাতিকের একটি। তবে স্বাস্থ্যকর নয় বলে মাঝেমধ্যে শখেরবশে কাজটা করে। তার গৃহকর্মি মেয়েটা প্রায়ই আয়েশ করে পান খায়। তার কাছ থেকে নিয়ে মাঝেমধ্যে সে-ও পরখ করে দেখে। “হুম, খাই তো।”

    “পান খেলে লাল রঙটা পাওয়া যায়, তাই না?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। এই সহজ সত্যটা কে না জানে।

    “কিন্তু পান, সুপারি আর চুনে কি লাল রঙটার অস্তিত্ব আছে?”

    মাথা দোলাল সাবেক রেডিও জকি। নেই।

    “তাহলে লাল রঙটা কোত্থেকে এলো?”

    “পান, সুপারি আর চুনের মিশ্রণের ফলে লালটা আসে, ঝটপট জবাব দিলো মায়া।

    “ঠিক।” চারুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “সেভাবেই, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রিয়ার ফলে মৰসামক একটি বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে। আসলে ওটার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই।”

    “আচ্ছা, তাহলে মন সম্পর্কে আপনার এই ধারণা!”

    “এটা আমার ধারণা নয়, হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশের একটি দার্শনিক গোষ্ঠির ধারণা।”

    “কথা বলবেন নাকি সিগারেট কিনবেন?”

    “দুটোই।” মুচকি হাসি টঙ দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো সে। মিসকাতের দাদার বাড়ির সীমানার পরে, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে একটা টঙ দোকান আছে। মাটি থেকে দুই-তিনফুট উঁচুতে কাঠ দিয়ে বানানো ছোট্ট একটি দোকান। সামনের এক চিলতে ভোলা জায়গা, বাঁশ কাঠ দিয়ে দোকানের দু-পাশে দুটো বেঞ্চি বসানো আছে। পড়ন্ত দুপুরে বেঞ্চিগুলো ফাঁকা, কোনো কাস্টমার নেই।

    চারুকে আসতে দেখে অলসভাবে বসে থাকা দোকানি নড়েচড়ে বসলো।

    “বেনসন আছে?”

    “কয়টা লাগবো?” দাঁত বের করে হেসে বলল লোকটা। “একটা।”

    দোকানির মুখ অনুজ্জ্বল হয়ে গেলো। হয়তো ভেবেছিলো এক প্যাকেট বিক্রি করবে এই শহুরে কাস্টমারের কাছে। এমপির বাড়িতে যারা আসে তাদের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশা করতেই পারে, তাই বিরসমুখে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলো সে।

    সিগারেটটা হাতে নিয়ে চারু বলল, “রাত ক-টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন?”

    এমন প্রশ্নে দোকানি একটু অবাক হলো। “ঠিক নাই। কোনোদিন দশটা, কোনোদিন এগারোটা।”

    পকেট থেকে টাকা বের করে দোকানির দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এমপির বাড়িতে যে-রাতে খুন হলো সেদিন কয়টার দিকে বন্ধ করেছিলেন?”

    চারু আশা করেছিলো দোকানি একটু সতর্ক হয়ে উঠবে, কিন্তু লোকটা যেন কথা বলার মানুষ পেয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো, “অনেকদিন আগের কথা তো…” একটু মনে করার চেষ্টা করলো। “মনে হয় এগারোটার আগেই।”

    হতাশ হলো চারু। এখানে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এসেছিলো আরো পরে। তবুও জানতে চাইলো সে, “ঐদিন রাতে শেষ গাড়িটা কখন এসেছিলো দেখেছেন?”

    “মেলা রাইতে আইছিলো…ঘড়ি তো দেহি নাই তাই কইতে পারুম না কয়টা বাজে আইছিলো।”

    দোকানির কথা শুনে অবাকই হলো সে। “আপনি তখনও দোকানে ছিলেন? এগারোটার আগেই না বন্ধ করে দেন?”

    “আমি তো রাইতে এই দোকানেই থাকি।”

    “ও,” চারু বলল।

    “ঐদিন রাইতে আমি ঘুমাইতে ছিলাম, শামসু মিয়া আইসা আমার ঘুম ভাঙাইছে। হে কইলো তালেবর মিয়া, সিগারেট লাগবো। আমি কইলাম, এত রাইতে জাইগা আছো ক্যান…তুমি তো তাড়াতাড়ি ঘুমায়া পড়ো? সে কইলো, এমপির পোলায় ইয়ার-দোস্ত লইয়া পারুটি করতাছে, তার ডিউটি বাইরা গেছে। আইজকা ঘুমাইতে অনেক দেরি হইবো।”

    চারু বুঝতে পারলো লোকটা গপ্পোবাজ। “তারপর?”

    “তারপর আর কি, ঘুম থেইকা উইঠা হেরে সিগারেট দিলাম। কাঁচা ঘুম ভাঙলে কি আর ঘুম আসে সহজে, কন?”

    মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো চারু। আড়চোখে ডানদিকে তাকালো। বেশ কিছুটা দূরে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে মায়া উৎসুক চোখে চেয়ে আছে তাদের দিকে।

    “হের মইদ্যে আবার ধরলো পেশাব। আমি আবার দোকানের পিছনে কাম সারি। পেশাব করার টাইমেই গাড়ির আওয়াজ পাইয়া দোকানের পিছন থেইকা ফুচকি দিয়া দেহি একটা সিএনজি আইসা থামছে আমার দোকানের সামনে।”

    “ঠিক এখানে?”

    “এই তো…এইখানে…” দোকান থেকে আট-দশ হাত দূরে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল। “আমি তো তাজ্জব…এত রাইতে সিএনজি ক্যান! এমপির বাড়িতে তো সিএনজি আসে না। এরা বিরাট বড়লোক, বিরাট বিরাট গাড়িতে কইরা লোকজন আসে এখানে।”

    “আপনি কি করে বুঝলেন সিএনজিটা এমপির বাড়িতে এসেছিলো? ওটা তো ঐ বাড়ির সামনে থমেনি, অন্য কারোর বাড়িতেও তো আসতে পারে?”

    “এই বাড়ির পর আর কোনো বাড়ি নাই, সহজ-সরল জবাব দিলো দোকানি।

    “ওহ্,” বাড়িটার দিকে তাকালো চারু। সত্যি, বাড়িটার পরে পিচের রাস্তা শেষ হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ক্ষেতিজমির দিকে।

    “দোকান দিবার পর একবারই এইখানে সিএনজি ঢুকতে দেখছি…শামসু মিয়া কী জানি একটা জরুরি কামে ঢাকায় গেছিলো এমপির বাড়িতে, মেলা রাইতে একটা সিএনজি নিয়া ঢাকা থিকা ফিরা আইছিলো সে।”

    “এটা কবেকার ঘটনা? মিসকাতের খুনের আগে না পরে?”

    দোকানি মনে করার চেষ্টা করলো। খুনের ঘটনার আগেই…”

    “আচ্ছা, এবার ঐ সিএনজিটার কথা বলেন। ঐ যে, আপনার দোকানের সামনে এসে থামলো…তারপর কি হলো?”

    “আমি দোকানের পিছন থেইকা দেখলাম একজন নাইমা হাটা ধরলো। এমপির বাড়ির দিকে।”

    “লোকটার চেহারা কেমন ছিলো?” উদগ্রিব হয়ে জানতে চাইলো চারু।

    “ঘুট ঘুইটা আন্ধার…চেহারা কেমনে দেখুম! ঠাওর করবার পারছি এক ব্যাটা নাইমা বাড়ির দিকে গেলো।”

    “আর সিএনজিটা?”

    “ঐটা দোকানের সামনেই আছিলো…ব্যাটা নাইমা যাওনের পর গাড়িটা ঘুরায়া রাখছে ডেরাইবার।”

    কথাটা শুনে নড়েচড়ে উঠলো চারু আহসান। “একজনকে নামিয়ে দেবার পর গাড়িটা ঘুরিয়ে রেখেছে?”

    “হ।”

    তার মানে দু-জন এসেছিলো! মনে মনে বলল চারু।

    “তারপর আমি দোকানে ঢুইক্যা দিলাম ঘুম,” দোকানি বলে যাচ্ছে, “চিল্লাচিল্লি শুইন্যা ঘুম ভাঙলো আমার। উইঠ্যা দেখি ঘটনা তো প্যাঁচ লাইগা গেছে। এমপির পোলায় নাকি মাডার হইছে।”

    “তখন কি সিএনজিটা আপনার দোকানের সামনে ছিলো?”

    একটু ভেবে বলল দোকানি, “না। গাড়িটা তো তখন দেখি নাই।”

    কিছু একটা ভেবে যেতে লাগলো চারু। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ পরে ভেতরে ঢুকেছিলো খুনি, আর বাইরে সিএনজি নিয়ে অপেক্ষা করেছে ড্রাইভার। কাজ শেষ হলে ঐ সিএনজিটা নিয়েই সটকে পড়ে।

    সিএনজি ড্রাইভারকে সে সন্দেহের বাইরেই রাখছে আপাতত। লোকটা নিছক ভাড়া নিয়ে একজন প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিতে এসেছিলো। তার প্যাসেঞ্জার হয়তো আপ-ডাউন হিসেবে ভাড়া করেছিলো গাড়িটা। কাজ সেরে আবার একই সিএনজিতে করে ফিরে গেছে। নইলে অতো রাতে ফিরে যেতে সমস্যায় পড়তে হতো খুনিকে।

    “কি ভাবছেন?”

    চারুর চিন্তা-ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলে উঠলো মায়া। দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকে কথা বলতে দেখে অবশেষে মেয়েটা টঙ দোকানে চলে এসেছে।

    “না, কিছু না,” চারু আহসান বলল। দোকানির দিকে ফিরে তাকালো। “আচ্ছা, এমপির ছেলের খুনের ব্যাপারে পুলিশ কখনও আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?”

    “না। হেরা আমার দোকানে আইসা চা-সিগরেট খাইছে…গপসপ করছে, কিছু জিগায় নাই।”

    চারু বুঝতে পারলো পুলিশ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, অর্থাৎ বাবুর ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিলো যে, এসব ছোটখাটো বিষয় খতিয়ে দেখেনি।

    “জিগাইলে আমি যা দেখছি তা-ই কইতাম। এই যে, আপনেরে যা কইলাম, এইটাই কইয়া দিতাম পুলিশরে।”

    দোকানির কথা শুনে মনে হলো পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করেনি বলে এক ধরণের আফসোস রয়ে গেছে।

    “ঠিক আছে, ভালো থাকবেন।” কথাটা বলে মায়ার দিকে ফিরলো সে। “চলুন, ফিরে যাওয়া যাক। এখানকার কাজ শেষ।”

    তারা দু-জন চুপচাপ গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।

    .

    অধ্যায় ১৪

    মিসকাতের বন্ধুদের সাথে কথা বলাটা জরুরি হলেও খুবই কঠিন একটি কাজ। এর মধ্যে বাইকার বাবুর সাথে কথা বলাটা আরো বেশি কঠিন, কারণ সে মিসকাত হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন আসামি ছিলো। তার পক্ষে শক্তিশালি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও খুনের রহস্য সমাধান হবার আগ পর্যন্ত পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হতে পারবে না সে।

    এরকম একজন নিশ্চয় চারুর মতো অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে রাজি হবে না। তবে মায়া তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলো, এ নিয়ে ভাবতে হবে না। রেডিও মুক্তিতে তার এক কলিগের সাথে বাবুর বেশ সখ্যতা রয়েছে। এর মাধ্যমে চেষ্টা করলে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা হয়তো করা যাবে।

    কথাটা শুনে খুশি হয়েছিলো চারু। এই মেয়েটাকে সে ভেবেছিলো লেজের মতো পেছন পেছন থাকবে আর তার কাজে বাগড়া দেবে, কিন্তু পশুপাখির লেজের মতো এটারও যে ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারেনি।

    কথামতোই মায়া খুব দ্রুত তার কলিগের মাধ্যমে বাবুর সাথে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে ফেলে। এখন বাবুর সাথে দেখা করার জন্য তারা দু জন চলে এসেছে ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে। ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করছে। একটু আগে ফোন করে মায়া নিশ্চিত হয়েছে, বাবু তার বাবার অফিস থেকে বের হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

    .

    পাঁচমিনিট পর রবীন্দ্র সরোবরে একটা প্রাইভেটকার এসে থামলো। গাড়ি থেকে স্টাইলিস ক্রাচ হাতে বের হয়ে এলো বাবু। প্রায় এক বছর পরও তার পা-টা পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। এই সময়ের মধ্যে বাইকের হ্যান্ডেল ধরেও দেখতে পারেনি সে। এটা তার জন্য চরমতম দুঃখের ঘটনা। ভেবেছিলো মাসখানেকের মধ্যেই পা-টা ভালো হয়ে যাবে কিন্তু সেটা হয়নি। গতমাসে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়ে এসেছে। সেখানকার ডাক্তার বলেছে আরেকটা অপারেশন করতে হবে, তবেই পুরোপুরি আগের মতো হাটাচলা করতে পারবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনের মাসেই দ্বিতীয়বারের মতো সিঙ্গাপুরে যাবে।

    আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

    রবীন্দ্র সরোবরে এ সময়ে খুব বেশি মানুষজন থাকে না। মাত্র এক ঘন্টা আগে লাঞ্চ-আওয়ার শেষ হয়েছে। বিকেল হলেই লোক সমাগম বাড়বে এখানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো বেশ মেঘাচ্ছন্ন। নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। গতকাল তার ভার্সিটি-ফ্রেন্ড অপু ফোন করে জানায়, আরজে মায়া তার সঙ্গে কী একটা বিষয় নিয়ে দেখা করতে চাইছে। পারলে সে যেন লাঞ্চের পর একটু সময় দেয়। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, তার ধানমণ্ডির অফিস থেকে খুব কাছে, রবীন্দ্র সরোবরে আসলেই হবে। কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলো বাবু।

    আজ থেকে বছর তিনেক আগে র‍্যাম্পে দেখে মায়ার উপর ক্রাশ খেয়েছিলো সে। মেয়েটার সাথে সামনাসামনি একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে মন্দ হয় না। আজকাল তার জীবন বড্ড একঘেয়ে আর রুটিনমাফিক হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং ধানমণ্ডিতে বাবার বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হেড-অফিসে বসতে হচ্ছে তাকে। কাজ বলতে কিছুই করে না, শুধু দেখে আর মোবাইলে ফেসবুকিং করে টাইমপাস করে। তার বাবার ধারণা, কিছু না-করলেও নিয়মিত অফিসে বসলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ছেলে অনেক কিছুই শিখতে পারবে। নইলে এয়িরা মনে মনে অবজ্ঞা করবে। বাবার জোরে অফিসের বিরাট পদ জুটিয়ে নেয় যারা তাদেরকে কোনো কর্মচারিই সুনজরে দেখে না।

    বাবু নিজেও চায় না হুট করে উত্তরাধিকারী সূত্রে বাবার অফিসে গিয়ে চেয়ারে বসতে। তবে কোনোভাবেই অফিসে মন বসাতে পারছে না সে। খুব যে চেষ্টা করছে তা-ও নয়। আসলে খোঁড়া পা নিয়ে এক ধরণের হীনমন্যতায় ভোগে। যদিও ডাক্তার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে তারপরও তার মনে একটি আশংকা উঁকি মারে প্রতিনিয়ত-আর কখনও যদি পা-টা আগের অবস্থায় ফিরে না যায় তাহলে?

    মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সুনশান লেকের দিকে তাকালো। এ জায়গাটায় সচরাচর আসা হয় না তার। ধানমণ্ডিতে অফিস করলেও সে থাকে বারিধারায়। গুলশান-বনানী আর বারিধারার সবই তার নখদর্পনে, ধানমণ্ডির বেশিরভাগ এলাকা তার কাছে অপরিচিত বলে মনে হয়।

    “সরি…একটু লেট করে ফেলেছি।”

    নারী কণ্ঠটা শুনে পেছন ফিরে তাকালো বাবু। আর.জে মায়ার বেশভুষা দেখে একটু ভিমরিই খেলো। এ মেয়েকে মডেলিং আর র‍্যাম্পে দেখেছে কয়েকবার, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি বাস্তবেও সে এমন অদ্ভুত সাজ পোশাকে ঘুরে বেড়ায়।

    চওড়া একটা হাসি দিলো বাবু। “ইটস ওকে, আমিও এইমাত্র এসেছি,” এরপরই তার চোখ গেলো মায়ার পেছনে এক যুবক ধীরপায়ে হেঁটে আসছে।

    “আমি মায়া,” হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল সাবেক আর.জে।

    “চৌধুরি ইবনুল আহসান…বাবু, মেয়েটার সাথে করমর্দন করে মাপা হাসি দিয়ে নিজের পরিচয়টা দিলো। অফিসে বসার পর থেকে তার বাবার কঠিন আদেশ, সে যেন পরিচয় দেবার সময় তার আসল নামটি বলে। আমি বাবু-এটা কোনো পরিচয় হতে পারে না। একদম নন-সেন্স!

    তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে মায়া পেছন ফিরে তাকালো ঐ যুবকের দিকে। প্যান্টের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। “আসো…” পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ডাকলো মায়া। তারপর বাবুর দিকে ফিরে বলল, “আমার কাজিন…চারু।”

    বাবু একটু হতাশই হলো। সে ভেবেছিলো মেয়েটা তার সাথে একাই দেখা করতে আসবে, সাথে করে যে একটা লেজ নিয়ে আসবে কল্পনাও করেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চারুর সাথে হাত মেলালো সে।

    “ও আমার নতুন প্রজেক্টে হেল্প করছে,” সুন্দর করে বানিয়ে বলল মায়া।

    “নাইস টু মিট ইউ,” বলল চারু।

    মাপাহাসি দিলো বাবু।

    “চলো…ওখানে গিয়ে একটু বসি, একটু দূরে লেকের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির মতো ধাপগুলো দেখিয়ে বলল। ইচ্ছে করেই সে তুমি করে সম্বোধন করছে। সমবয়সি কলিগের বন্ধু, তাই কমিউনিকেশনে অভিজ্ঞ মায়া এমন সুযোগ হাতছাড়া করলো না।

    তারা তিনজন চুপচাপ ইট দিয়ে বাঁধানো ধাপের উপর গিয়ে বসলো। বাবুর পাশে বসলো মায়া, তার পাশে চারু।

    “আমি আপনাকে আগেই বলে দেই–”

    “অ্যাই,” বাবুর কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলে উঠলো মায়া। “আমি তোমাকে তুমি করে বলছি…তুমি কেন আমাকে আপনি করে বলছো? স্ট্রেইঞ্জ। আমরা কিন্তু সমবয়সি।”

    বোকার মতো হেসে ফেলল বাবু। “সরি।” তারপর কথার খেইটা খুঁজে নিয়ে আবার বলল, “তোমাকে আগেই বলে দেই, ঐ ঘটনাটা নিয়ে তোমাদের রেডিও’র প্রোগ্রামে কিন্তু আমি পার্টিসিপেট করতে পারবো না। আব্দুর কঠিন নিষেধ আছে। তাছাড়া কেসটা এখনও তদন্ত হচ্ছে। পুলিশও এটা ভালো চোখে দেখবে না।”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মায়া তাকে আশ্বস্ত করলো। “আই নো…আই নো, বাবু।” একটু থেমে আবার বলল সে, “তোমাকে কোনো প্রোগ্রামে পার্টিসিপেট করতে হবে না। তুমি শুধু ঐ দিনের ঘটনাটা আমাকে বলো।”

    ভুরু কুচকে তাকালো ছেলেটা। “তুমি কি এটা নিয়ে রেডিওতে প্রোগ্রাম করবে?”

    “না। সে-রকম কিছু না।”

    “তাহলে এটা জানতে চাইছো কেন?” কথাটা বলেই আড়চোখে মায়ার পেছনে বসে থাকা চারুর দিকে তাকালো।

    “আমি আসলে নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। এটার সাথে রেডিওর কোনো সম্পর্ক নেই।” মায়া যে এখন রেডিও’তে নেই সেটা চেপে গেলো ইচ্ছে করেই।

    “কি প্রজেক্ট?” কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলো বাবু।

    “আমি এখন সুপারন্যাচারাল ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করছি। ইচ্ছে আছে একটা বই লেখার, আমার এই কাজিন আমাকে বইটা লিখতে সাহায্য করছে। ওর লেখার হাত খুব ভালো।” একনাগারে কথাগুলো বলে গেলো মায়া। সে ভালো করেই জানে, বাবুর মতো ধনী পরিবারের সন্তানেরা আর যাই-হোক বাঙলা বই নেড়েও দেখে না। এটা তার কলিগ অপুও নিশ্চিত করেছে। বাইকার বাবুর হাতে অ্যাকাডেমিক বই ছাড়া কখনও অন্য কোনো বই দেখেনি।সুতরাং চারুর আসল পরিচয়টা তার জানার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

    ঠোঁট ওল্টালো বাবু। “ওয়াও, সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং টু মি।”

    মায়া কেবল হাসলো। “তোমাদের ঐ ঘটনাটা আমাকে খুবই অ্যাট্রাক্ট করেছে।”

    “বুঝতেই পারছো আমাদের প্যারেন্টস্ চায় না এ নিয়ে মিডিয়ার সামনে কিছু বলি।”

    “হুম। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের জায়গায় আমি হলেও একই কাজ করতাম হয়তো।”

    বাবু কিছু বলল না।

    “তবে এখন ঘটনাটা আমার কাছে শেয়ার করতে তো আর সে-রকম কোনো সমস্যা নেই?”

    “না, তা নেই, কিন্তু…” একটু দ্বিধা দেখা গেলো বাবুর মধ্যে। “মানে, বইতে কি আমাদের নাম-”

    “আমি তোমাদের কারোর নাম-পরিচয় উল্লেখ করবো না,” কথার মাঝখানে বলে উঠলো সে। “শুধু ঘটনাটা…আর কিছু না। আমি আসলে জানতে চাইছি, ঐ দিন কি হয়েছিলো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবু। “ওকে। যদি এরকম হয় তাহলে আমার বলতে অসুবিধা নেই। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। মানে, কোত্থেকে শুরু করবো? আমি তো পার্টিতে যেতেই পারিনি, তার আগেই অ্যাকসিডেন্ট করে ফেললাম। সো, পার্টির কথা আমি কিছুই বলতে পারবো না।”

    “হুম, তা জানি। তুমি তোমার পার্টটাই বলো। আমি ওটা-ই বেশি শুনতে চাচ্ছি।”

    একটু চুপ মেরে গেলো বাবু। সে বুঝতে পারছে না কিভাবে বলবে। যদিও ঘটনা ঘটার পর প্রায় চার-পাঁচবার এই গল্পটা বলতে হয়েছে বিভিন্নজনকে। বিশেষ করে পুলিশ আর গোয়েন্দারা তার কাছ থেকে সব শুনে এমন ভঙ্গি করেছিলো, যেন আষাঢ়ে গল্প বলছে সে। তবে সবচাইতে বিব্রতকর ছিলো মিসকাতের মায়ের জেরা করার ভঙ্গিটি। দারোগার মতো দাপট নিয়ে আন্টি তাকে রীতিমতো ধমকের সুরে বলেছিলেন, তার বানোয়াট গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভদ্রমহিলার সমস্ত দাপট অবশ্য চুপসে গেছিলো ডাক্তারদের স্টেটমেন্টের পর।

    “ঐ দিন আমি সারাটা দিনই ব্যস্ত ছিলাম কস্টিউম জোগাড় করতে,” অবশেষে বলল বাইকার-বাবু। “কে কি সাজবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিলো। আমি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সাজবো ঠিক করি। মিসকাতও বলেছিলো সেটাই ভালো হবে। কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ জোগাড় করতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। শপিংমলে গিয়ে যেসব মুখোশ দেখলাম সেগুলো একদমই বাচ্চাদের। দেখতেও খুব হাস্যকর…” একটু থামলো সে। “অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে পরিচিত এক ছোটোভায়ের কাছে পেলাম মুখোশটা।”

    “তাকে কি আপনি বলেছিলেন ওই মুখোশটা কেন খুঁজছেন?” চারু জিজ্ঞেস করলো। “মানে, আপনাদের হ্যালোউইন পার্টির কথা কি তাকে বলেছিলেন?”

    মাথা দোলাল বাবু। “না, ওকে ওসব জানাইনি। বলেছিলাম, একজনকে ভয় দেখাবো, তাই একটু বেশি রিয়েলিস্টিক মুখোশ চাইছি।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।

    “এরমধ্যে আবার আমার গার্লফ্রেন্ডের দাদি মারা গেলো বিকেলের একটু আগে, ফলে ও আর পার্টিতে যেতে পারেনি। ওরা সপরিবারে চলে যায় গ্রামের বাড়িতে। যাবার আগে আমার সাথে দেখা করে গেছিলো। এসব কারণে সবার সাথে গাজীপুরে যেতে পারিনি আমি।”

    ‘মুখোশ আর কস্টিউমটা কখন কালেক্ট করতে পারলে তুমি?” মায়া জানতে চাইলো।

    “উমমম…সন্ধ্যার দিকে ঐ ছোটোভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে মুখোশটা নিয়ে আসি।”

    “তারপর?”

    “কস্টিউমটা আমি দুপুরের আগেই জোগাড় করে রেখেছিলাম। তো, মুখোশ আর কস্টিউমটা ব্যাকপ্যাকে ভরে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম সন্ধ্যার পর পর। ঐদিন বিকেল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। সন্ধ্যার পর বেশ জোরে নামতে শুরু করে। ফুলার রোডে ভাস্কর্যের চত্বরটার কাছে মোড় নিতে গিয়ে আমার বাইক পিছলে গেলো। আমি খুব জোরে চালাচ্ছিলাম টাইম কাভার করার জন্য, বাঁক নেবার সময় তাই কন্ট্রোল করতে পারিনি…বাইকসহ ছিটকে পড়ি রাস্তার পাশে।”

    “ফুলার রোডে কেন গেছিলে?” মায়া জানতে চাইলো।

    “যে ছেলেটার কাছ থেকে মুখোশটা নিয়েছিলাম সে থাকে পুরনো ঢাকার চাঁনখার পুলে।”

    “তারপর কি হলো বলো।”

    “আমার মাথায় হেলমেট ছিলো, নইলে যে কী হতো কে জানে। অ্যাকসিডেন্ট হবার পর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে পাবার পর দেখি আমি হাসপাতালে…ডান-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।”

    “আপনাকে হাসপাতালে কে নিয়ে গেছিলো সেটা কি মনে আছে?” চারু জানতে চাইলো।

    কাঁধ তুললো বাবু। “অ্যাকসিডেন্টের পর আমার আসলে সেন্সই ছিলো না। তবে একটা সিএনজিতে তোলা হয়েছিলো, এটুকু মনে আছে। কিন্তু কারা তুলেছিলো সেটা মনে নেই।”

    “আপনার বাড়িতে খবর দিলো কে?

    “এটাও আমি জানি না। আম্মু বলেছে আমার মোবাইলফোন থেকে কেউ একজন কল করে আমার অ্যাকসিডেন্টের খবরটা দিয়েছিলো।”

    “আপনার জুতো জোড়া নাকি গাজীপুরে মিসকাতদের বাড়ির সামনে পাওয়া গেছিলো?”

    চারুর এমন প্রশ্নে বাবু অবাক হলো না তবে মায়া চেয়ে রইলো বিস্ময়ে। সে এটা জানতো না।

    “পরদিন পুলিশ এটা আমাকে বলেছিলো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো অলৌকিক বলে কিছু নেই বইয়ের লেখক।

    কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতা ভাঙলো মায়া।

    “তুমি বলছো হ্যালোউইন পার্টির কথা কাউকে বলোনি…কিন্তু বাকিরা? ওরা-ও কি কাউকে বলেনি? আমার তো মনে হয় ওদের মধ্যে কেউ বাইরের কাউকে এটা বলেছে।”

    “হতে পারে, তবে আমি কাউকে কিছু বলিনি।” একটু থেমে আবার বলল বাবু, “যদি কেউ বলেও থাকে তাহলেই বা কি? আমাদের সার্কেলের বাইরে কেউ জানলে কি আমার অ্যাকসিডেন্টের সুযোগ নিয়ে খুনটা করে আসবে? সে কিভাবে জানবে আমি কখন, কোথায়, কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট করবো?”

    “হুম…তা ঠিক। তোমার অ্যাকসিডেন্টটা তো আর অন্য কোনো গাড়ির সাথে হয়নি। তুমি নিজেই কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলে, সুতরাং কন্সপিরেসির ব্যাপারটা ধোপে টেকে না।”

    “ঐ ঘটনার আগে দিয়ে আপনাদের বন্ধুমহলে কি কোনো ঝামেলা হয়েছিলো?” জানতে চাইলো চারু।

    মাথা দোলাল বাবু। “না। আমাদের মধ্যে এমন কোনো ঘটনা কখনও ঘটেনি। টুকটাক মনোমালিন্য বলতে যা বোঝায় তা-ও হোতো না। আমরা সবাই বেশ ক্লোজ ছিলাম। আড্ডাতে হয়তো কাউকে পচাতাম, খুব পিঞ্চিং করতাম কিন্তু সেটা আমাদের হ্যাঁঙ্গ-আউটের পার্ট ছিলো। ওসব নিয়ে কেউ কোনোদিন কল্পেইন করেনি।”

    শেষ কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলল বাবু।

    “মিসকাতের সাথে কি কারোর কোনো ঝামেলা ছিলো? মানে, আপনাদের গ্রুপের বাইরের কারোর সাথে?”

    চারুর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো বাবু। তারপর আস্তে করে মাথা দোলাল। “নাহ্।”

    “ইয়ে, কিছু মনে কোরো না,” মায়া বলল, “তোমাদের গ্রুপে তো বেশকিছু মেয়ে ছিলো, ওদের নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি কখনও? হয় না, এমন তো হয়-ই।”

    মাথা দোলাল বাবু। “আমাদের গ্রুপ ওসব নিয়ে কোনো ঝামেলা হতো না। একদমই না।”

    “হতো না মানে?” বলে উঠলো চারু। “আপনাদের গ্রুপটা কি এখন আর নেই?”

    বাবুর চোখেমুখে বিমর্ষ ভাব ফুটে উঠলো। “ঐ ঘটনার পর আমাদের গ্রুপটা ভেঙে গেছে,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

    “ওদের কারোর সাথে তোমার যোগাযোগ হয় না?”

    “কয়েক জনের সাথে হয়, তা-ও ফেসবুকে কিন্তু হ্যাঙ-আউট করা আর হয় না।”

    মায়া কিছু বলতে যাবে এমন সময় বাবুর ফোনটা বেজে উঠলো।

    “হ্যাঁ, বাবা?” কলটা রিসিভ করেই বলল সে। মায়া আর চারু একে অন্যের দিকে তাকালো। “না…আমি চলে যাইনি…ধানমণ্ডিতে এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছি…ঠিক আছে, এক্ষুণি আসছি।”

    মায়ার দিকে চেয়ে কাষ্ঠহাসি দিলো বাবু। “বাবা…আমাকে এখনই অফিসে ব্যাক করতে হবে,” ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

    মায়া আর চারুও উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সাবেক আর.জে। “থ্যাঙ্কস…আমাকে সময় দেবার জন্য অনেক থ্যাঙ্কস।”

    মেয়েটার সাথে হাত মেলাতে মেলাতে বলল বাবু, “ইটস ওকে।”

    তারপর চারুর সাথে হাত না মিলিয়ে কেবল সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, ক্রাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেলো খোলা পার্কিং এরিয়ার দিকে।

    .

    অধ্যায় ১৫

    “আপনি আমাকে জুতোর কথাটা বলেননি কেন?” বাবু চলে যেতেই অভিযোগের সুরে জানতে চাইলো মায়া।

    “বলার সুযোগ পেলাম কোথায়…মাত্র গত পরশু জেনেছি।”

    এ কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না সাবেক আর.জে। “কাল প্রায় সারাটাদিন আমরা একসাথে ছিলাম কিন্তু?”

    বিরক্ত হলো যুক্তিবাদি সমিতির নেতা। “খেয়াল ছিলো না, ভুলে গেছিলাম।”

    “হাহ্!” কথাটা বিশ্বাসই করলো না মায়া। “সামান্য একটা বিষয় নিয়ে আপসেট হবার কোনো মানে হয় না।”

    “ঠিক আছে। ইটস ওকে,” হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো মেয়েটি। “এখন বলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে?”

    “কিসের কথা বলছেন?”

    “এই যে, বাবুর কথা শুনলেন…ওর কথা শুনে কি মনে হচ্ছে?”

    কাঁধ তুললো চারু। “ডোসিয়ারে যেরকমটি বলা আছে বাবু তার বাইরে কিছু বলেনি। আরো কিছু বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। অন্যদের সাথেও কথা বলতে হবে।”

    “হুম। কিন্তু কাকে দিয়ে শুরু করবেন?”

    “সেটাই ভাবছি।”

    হঠাৎ বলে উঠলো মায়া, “কফি খাবেন? ঐ যে টেম্পোরারি ফুডকোর্টগুলো দেখছেন, ওরা চা-কফি ভালোই বানায়।”

    সায় দিলো চারু, “হুম…খাওয়া যায়।”

    মায়া আর কিছু না বলে সামনের একটি ফুডকোর্টের দিকে এগোলো। “বাবুর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে কাজটা আপনার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে।”

    মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল চারু, “যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার কথা বলছেন তো?”

    “হুম,” সামনের দিকে তাকিয়েই বলল সাবেক আর.জে।

    “বিশ্বাসের চেয়ে যুক্তি সব সময়ই কঠিন…এটা নিয়ে আমি ভাবছি না। মাত্র কাজে নামলাম…একটু অপেক্ষা করুন, দেখেন কি বেরিয়ে আসে।”

    ফুডকোর্টের সাজানো চেয়ার-টেবিলগুলোর একটাতে গিয়ে বসলো ওরা দু-জন।

    “আমার কাছে মনে হচ্ছে ঘটনাটা খুবই অস্বাভাবিক।”

    বাঁকাহাসি হাসলো চারু। শুরুতে অনেক ঘটনাই অস্বাভাবিক, রহস্যময় আর ভুতুরে বলে মনে হতে পারে।”

    তার কণ্ঠে বিদ্রুপের সুরটা ধরতে পারলো মায়া। “আর শেষে? সব ঘটনার কি ব্যাখ্যা মেলে? সব সময় মেলে?”

    মেয়েটার দিকে তাকালো চারু। বামচোখের নিচে টিয়ারড্রপ ট্যাটুর কারণে কাজল দেয়া মায়াবি চোখদুটো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এই মেয়ের সান্নিধ্যে যুক্তির মতো বিষয়টাকে খুবই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে এখন। পড়ন্ত দুপুরে নিরিবিলি লেকের পাশে বসে এর সাথে তর্ক করার কোনো মানেই হয় না।

    “সব সময় ব্যাখ্যা দেয়া যায় এ কথা আমি কখনও বলিনি, অবশেষে বলল সে। “এটা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপরে।”

    “ওয়েট,” বলেই ছেলেদের মতো তুড়ি বাজিয়ে ফুডকোর্টের এক লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করলো মায়া। দুই আঙুল তুলে বলল, “দুটো কাপুচিনো।” তারপর চারুর দিকে ফিরলো, “হুম…এবার বলুন।”

    “যে ব্যাখ্যা করছে তার জ্ঞান, মেধা, বিষয়টার উপরে তার দখল, এসব কিছুর উপরে নির্ভর করে। আবার সময়ের উপরেও নির্ভর করে। আজকে হয়তো ব্যাখ্যা করা গেলো না কিন্তু ভবিষ্যতে ঠিকই করা যাবে। এরকম আরো অনেক কিছু আছে।”

    “হুম।”

    “যাদের কাছে ব্যাখ্যা করা হবে তাদের উপরেও এটা নির্ভর করে। তারা কতোটা বিজ্ঞান বোঝে, যুক্তি মানে সেটাও দেখা দরকার।”

    “যেমন?”

    “আপনি হয়তো একটা রহস্যময় অতিপ্রাকৃত ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিলেন, এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপনাকে বিজ্ঞানের অনেক নিয়ম আর সূত্রের সহায়তা নিতে হলো, কিন্তু দেখা গেলো যাদের কাছে এসব ব্যাখা করছেন তারা এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না। তখন কি হবে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া।

    “তাদেরকে আপনি কোনোভাবেই এটা বোঝাতে পারবেন না।”

    “এরকম ঘটনা আপনার বেলায় অনেক ঘটেছে মনে হয়?”

    মুচকি হাসলো সে। “হুম…প্রায়ই এমনটা হয়।”

    এমন সময় দু-মগ কফি চলে এলো তাদের টেবিলে।

    “গণেশের মূর্তি দুধ পান করে-এই ঘটনাটার কথা আপনার নিশ্চয় মনে আছে?” নিজের মগটা তুলে নিয়ে বলল চারু।

    “হুম,” মায়াও তার মগটা তুলে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিলো। “প্রথমে ভারতে শুরু হয়েছিলো এটা, তারপর এখানেও শুরু হয়ে যায়।”

    “আমি তখন এসএসসি দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, বেশ হাউ-কাউ শুরু হয়ে গেলো এটা নিয়ে। টিভিতেও দেখানো হলো কিভাবে গণেশের মূর্তি দুধ পান করছে চামচ থেকে। আমি ছুটে গেলাম বাড়ির কাছে এক মন্দিরে, কয়েক শ’ লোকের লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে নিজের চোখে দেখলাম গণেশ চামচ থেকে সত্যি সত্যি দুধ শুষে নিচ্ছে!”

    মায়ার ভুরু কুচকে গেলো। “আপনি ঐ বয়স থেকেই এসব করে বেড়াচ্ছেন?”

    দাঁত বের করে কৃত্রিম হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল চারু, “জি, ম্যাডাম।”

    “তারপর…বলেন?” কফিতে চুমুক দিলো মেয়েটি। বেশ আগ্রহ বোধ করছে সে।

    “বাড়ি ফিরে এসে আমি নাওয়া-খাওয়া ভুলে এটা নিয়ে পড়ে থাকলাম। গণেশের মূর্তি কি করে দুধ শুষে নিচ্ছে চামচ থেকে মাথায় কিছুই ঢুকলো না। কোনোভাবেই আমি এটার ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। দু দিন ধরে ভেবে গেলাম কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পেলাম না। বয়স আর অভিজ্ঞতা দুটোই অনেক কম ছিলো, তারপরও হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম না আমি। ঐ দু-দিন মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো-গণেশ কিভাবে তার শুয়ে দিয়ে দুধগুলো শুষে নিলো চামচ থেকে।”

    “দু-দিন পর কি হলো?”

    মায়ার দিকে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিলো সে। “দ্বিতীয় দিন বিকেলে শুয়ে শুয়ে এটা নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আমি জানালার পাশে শুয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম, হঠাৎ করে আমার চোখ গেলো ছাদের কার্নিশের দিকে। বৃষ্টির পানি কার্নিশের নিচের পৃষ্ঠ দিয়ে ক্ষীণ ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে।”

    “বুঝলাম না…” মায়া বলল।

    “পানিসহ সবকিছু মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে উপর থেকে নিচের দিকে পড়ে কিন্তু কার্নিশের নিচের দিকে পানির ধারাকে বিবেচনায় নিলে ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যায় না?”

    “হুম।”

    পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ আর কলম বের করে দ্রুত কিছু এঁকে দেখালো চারু আহসান।

    “এই যে…দেখেন, এরকমটা হতে দেখেছেন কখনও?”

    চারুর ঝটপট আঁকা দেখে মুগ্ধই হলো মায়া। “আপনার আঁকার হাত তো বেশ ভালো।”

    “থ্যাঙ্কস,” হেসে বলল যুক্তিবাদি। “এটা কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের একটি নিয়ম। সারফেস টেনশন বলে একে। সারফেস টেনশনের কারণে পানির কণাগুলো আটকে যায়, ফলে পানির ধারা নিচের দিকে না পড়ে একটু ভিন্ন আচরণ করে।”

    “এ থেকে আপনি বুঝে গেলেন গণেশের দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা কিভাবে হয়?”

    “হুম,” কফিটা পুরোপুরি শেষ করে ফেলল সে। আবারো ঝটপট একটা চিত্র এঁকে ফেলল কাগজে। সম্ভবত মায়ার প্রশংসা তাকে উৎসাহি করে তুলেছে। “এই যে…দেখেন এটা।”

    মায়া দেখতে পেলোলা একটা গণেশের মাথা আর চামচ এঁকেছে চারু। যথারীতি এবারও তার আঁকা বেশ ভালো। বিশেষ করে সময়ের হিসেব করলে এত দ্রুত এমন ছবি আঁকা নিশ্চয় গুণের মধ্যে পড়ে।

    “হুম…ছবিটা দেখে বুঝতে পারছি।”

    যুক্তিবাদি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো, “গণেশের বাঁকানো শুড়ের কাছে দুধের চামচ একটু কাত করে ধরলেই সরফেস টেনশনের কারণে শুড় বেয়ে দুধ কিংবা যেকোনো লিকুইড নিচে পড়ে যায়, তবে সেটা কেউ খেয়াল করে না, কারণ সবার নজর থাকে চামচের দিকে, আর চিকন একটি ধারায় দুধগুলো পড়ে বলে ভালো করে না দেখলে সেটা চোখে ধরা পড়ে না। শুধু দেখা যায় চামচের তরল আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

    “ওয়াও!” মায়ার চোখেমুখে প্রশংসা।

    “মজার ব্যাপার কি জানেন, চামচটা কায়দা করে না ধরলে কিন্তু এই কেরামতিটাও দেখানো সম্ভব হবে না। একটু আস্তে করে চামচটা কাত করলেই বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি হয়।”

    বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো মায়া। “আপনি এটা প্রমাণ করলেন ঐ বয়সেই?”

    মিটিমিটি হেসে মাথা দোলাল চারু। “হ্যাঁ। আমি তাদেরকে দেখালাম, ওভাবে গণেশ শুধু দুধই খাবে না মদও খাবে, সব ধরণের তরলই খাবে! এ কথা শুনে তারা তো পারলে আমাকে মারতেই আসে।”

    “কিন্তু পত্রিকায় এ নিয়ে কোনো খবর দেখিনি কেন?”

    “পত্রিকাগুলো সেনসেশন নিউজ ছাপাতে আগ্রহি। রহস্যের সমাধান অতোটা সেনসেশন বলে মনে হয় না ওদের কাছে।”

    “যাদেরকে ব্যাখ্যা করেছিলেন তারা আপনার কথা বিশ্বাস করেনি কেন?”

    “ওরা বিজ্ঞানের এসব নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ওদেরকে সারফেস টেনশন বোঝাতে গিয়েই টেনশনে পড়ে গেছিলাম!”

    হেসে ফেলল মায়া। কফির মগ খালি করে টেবিলে রেখে দিলো সে। “ভালোই বলেছেন।”

    “সুতরাং যাদের কাছে ব্যাখ্যা করবেন তাদের জ্ঞানের পরিধির উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মেয়েটি। “দেখা যাক হ্যালোউইনে খুনের ঘটনাটাও আপনি এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন কিনা।”

    মেয়েটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো চারু। “ব্যাখ্যা আমি ঠিকই দেবো, কিন্তু যাদের দেবো তারা আদৌ সেটা বুঝতে পারবে কিনা জানি না। আর বুঝতে পারলেও মানতে পারবে কিনা সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।”

    আলতো করে মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো মায়া। অপলক চোখে চেয়ে রইলো চারু। মেয়েটার কপট অভিমান আরো বেশি মোহনীয় লাগছে তার কাছে।

    .

    অধ্যায় ১৬

    ডক্টর আজফার হুসেন নিজের সুবিশাল ড্রইংরুমে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ত্রিশ বছরের পুরনো টার্নওভারের উপর মৃদু টাল খেয়ে অলস ভঙ্গিতে ঘুরছে কালো রঙের একটি ভিনাইল লং-প্লে। ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে রবি শঙ্করের সেতারে রাগ মিশ্র ভৈরবি।

    নির্দিষ্ট রাগ শোনার নির্দিষ্ট সময়-ক্ষণ আছে কিন্তু আজফার হুসেন সে সব মানেন না। তার কাছে এগুলো বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। মানুষের মন মেজাজই হলো আসল নিয়ামক। দিনের কোন সময়ে কি শুনতে হবে তার চেয়ে কখন কোন্ মুড থাকবে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার যখন মিশ্র ভৈরবি শুনতে ইচ্ছে করবে শুনবেন। হোক না সেটা দিনের যে-কোনো সময়ে।

    একটু আগে নাস্তা করে এখানে এসে বসেছেন। তাকে দেখে মনে হতে পারে ফিটফাট হয়ে বাইরে কোথাও যাবেন, আদতে নাস্তা করার পর এভাবে পরিপাটি হয়ে থাকেন তিনি। আর পছন্দের গান শুনে দিনের শুরু করতে পারলে বেশ ভালো লাগে।

    বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে তাকালেন ডক্টর। টোটা দাঁড়িয়ে আছে। দরজার সামনে। সোফার পাশে সাইড-টেবিল থেকে রিমোটটা তুলে ভলিউম কমিয়ে দিয়ে বামনটাকে শুধু বললেন, “এখানে নিয়ে আসো।”

    কিছুক্ষণ পর টোটার সাথে ঘরে ঢুকলো মায়া আর চারু।

    “গুড মনিং, ডক্টর,” সুললিত কণ্ঠে বলল মায়া।

    “গুড মর্নিং,” বেশ আমোদের সাথে জবাব দিলেন ডক্টর

    চারু অবশ্য এসবের ধার ধারলো না, শুধু সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়লো।

    “কেমন আছো তোমরা?”

    “ভালো,” জবাব দিলো মায়া।

    “কি খাবে, চা না কফি?”

    “আমি কফি।”

    চারুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডক্টর।

    “চা।” ছোট্ট করে বলল সে।

    চওড়া হাসি দিয়ে টোটার দিকে তাকালেন আজফার হুসেন। বামন কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো। “এখন বলো, কি খবর? কাজে নেমে পড়েছো নাকি?”

    “হুম,” মায়া বলল, “শুরু করে দিয়েছি।”

    “বাহ্…দারুণ।”

    “আপনি কি বেরুচ্ছেন?”

    মেয়েটার প্রশ্নে মুচকি হাসলেন ডক্টর। “ননা, ডিয়ার। ব্রেকফাস্টের পর আমি সব সময় এরকম ফিটফাট হয়েই থাকি।”

    “ওয়াও!” সাবেক রেডিও-জকি এমনভাবে বলল যেন সত্যি সত্যি সে মুগ্ধ হয়েছে। “আই লাইক দ্যাট।”

    “থ্যাঙ্কস।” প্রসন্নভাবে হাসি দিলেন ডক্টর। “বাই দ্য ওয়ে…তোমাদের কাজ কেমন চলছে?”

    “আমরা শুরু করেছি মাত্র,” এবার সচেতনভাবেই আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করলো চারু। “প্রথমে নিজেরা খতিয়ে দেখবো সবকিছু, তারপর সিদ্ধান্ত নেবো তদন্তের পরবর্তি ধাপ কোনটা হবে।”

    “গুড।”

    “ওদের সাথে কন্ট্যাক্ট করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,” আস্তে করে বলল মায়া। “ওদের বাবা-মা’রা ওভার প্রটেক্টিভ হয়ে গেছে।”

    “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “তবে তোমাদের দুজনের উপরে আমার বিশ্বাস আছে, তোমরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে।”

    কথাটা শুনে মায়া খুব খুশি হলেও চারু নির্বিকার রইলো।

    “আমার বাড়িতে একটা লাইব্রেরি আছে। তোমরা এখনও সেটা দেখোনি। মোটামুটি ভালো কালেকশানই আছে। চাইলে ওটা যখন তখন ব্যবহার করতে পারো। আর তোমাদের যদি কিছু লাগে টোটাকে বলবে, ও সব ব্যবস্থা করে দেবে।”

    কথাটা শুনে চারু একটু আগ্রহি হয়ে উঠলো। “রিকয়্যারমেন্টে আমরা কি স্পাই গেজেট দিতে পারবো?”

    মায়া অবাক হলো কথাটা শুনে।

    ভুরু কপালে তুলে ডক্টর বললেন, “স্পাই গেজেট?”

    “হুম।”

    একটু ভেবে নিলেন তিনি। “শিওর। লোকাল মার্কেটে যদি পাওয়া যায় তাহলে কোনো সমস্যা নেই, নইলে বাইরে থেকে আনাতে হবে। তোমরা অনলাইনশপিং করতে পারো। আমার ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিটকার্ড আছে…আই ক্যান বাই দেম ফর ইউ।”

    “থ্যাঙ্কস,” আস্তে করে বলল চারু।

    মায়া তার দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। “আমরা কি কারো পেছনে স্পাইং করবো?”

    “দরকার হলে করতে হবে।”

    ডক্টরের দিকে তাকালো মায়া কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। যেন ব্যাপারটায় তার সায় আছে।

    “ভুলে যাবেন না, এটা ক্রিমিনাল কেস,” চারু মনে করিয়ে দিলো তাকে। “একজনকে খুন করা হয়েছে, তবে সেটা যে-ই করেছে অ্যালিবাই হিসেবে ভুতুরে একটা কাহিনী কেঁদেছে।”

    “হুম,” গম্ভির কণ্ঠে বললেন ডক্টর। “ওর কথায় কিন্তু যুক্তি আছে।”

    “আমরা গতকাল সন্দেহভাজন খুনির সাথে কথা বলেছি,” মায়া বলল খুব উৎসাহি হয়ে।

    “আচ্ছা!” আগ্রহি হয়ে উঠলেন ডক্টর।

    চারু অবশ্য কথাটা এখনই বলার পক্ষে ছিলো না, কিন্তু মায়া যখন বলেই ফেলেছে তখন আর কী করা।

    “তার সাথে কথা বলে মনে হয়েছে আর যা-ই হোক, খুনের সাথে সে জড়িত নয়।”

    “এটা বলার সময় এখনও আসেনি,” আস্তে করে বলল চারু আহসান। “ইটস টু আর্লি টু সে।”

    মায়া আর ডক্টর তার দিকে তাকালো।

    “সে খুনটা করেনি, শুধু এটুকু বলা যেতে পারে কিন্তু খুনের সাথে সে জড়িত নয় এ মুহূর্তে এটা বলা যাচ্ছে না।”

    মায়া খুব অবাক হলো। “আপনি বলতে চাইছেন ও নিজে না করলেও খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে? হাউ কাম?!”

    “সেটা তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে,” বেশ আত্মবিশ্বাসি কণ্ঠে জবাব দিলো চারু।

    ডক্টর তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ আমোদিত হলেন যেন।

    “ও জড়িত থাকলে নিজেকে জড়ানোর জন্য জুতো জোড়া খুলে রেখে আসততা?”

    মায়ার কথায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডক্টর হুসেন। “জুতো?”

    “এটা আপনার ডোসিয়ারে ছিলো না,” বলল চারু। “আমি আমার এক সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। পরে বাইকার বাবু নিজেও এটা স্বীকার করেছে।”

    “জুতোর ব্যাপারটা কি?” ডক্টর আজফার প্রশ্নটা না করে পারলেন না।

    “মিসকাতের খুনের পর গাজিপুরের ঐ বাড়ির বাইরে বাবুর জুতো জোড়া পাওয়া গেছিলো। সুন্দর করে রাস্তার উপরে রেখে দেয়া ছিলো ওটা।”

    “স্ট্রেইঞ্জ!”

    “সেজন্যেই আমার মনে হচ্ছে কাজটা করেছে অন্য কেউ,” বলল মায়া।

    “অন্য কেউ মানে?” কপালে ভাঁজ ফেলে বলল চারু।

    “মানে, ওদের কেউ না…অন্য কেউ।”

    “আপনার এটা মনে হচ্ছে?”

    মায়া কয়েক মুহূর্ত স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। সে জানে তার সামনে বসে থাকা যুক্তিবাদি মানুষটি এই ‘মনে হওয়া’কে কিভাবে দেখে। “হুম,” অবশেষে ছোট্ট করে বলল সে।

    কিছুটা আক্ষেপে মাথা দোলাল চারু। “বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই তদন্তে ‘মনে হচ্ছে’ জাতীয় কথার কোনো জায়গা নেই। এটা একটা সিরিয়াস ক্রাইমের ঘটনা। যে বা যারা কাজটা করেছে তারা বোঝাতে চেয়েছে ঘটনাটি সুপারন্যাচারাল, অতিপ্রাকৃত কিছু। এটা তাদের কাভার-আপ।”

    “তোমার কথায় যুক্তি আছে,” বললেন ডক্টর। “কিন্তু ওর মনে হওয়াটা কিন্তু আর দশজনের মতো করে দেখলে হবে না।”

    ডক্টর আজফার হুসেনের দিকে তাকালো চারু। মায়া চুপ মেরে আছে, কিছু বলছে না।

    “ওর একটা সাইকি ক্ষমতা আছে, সেটা তুমি হয়তো মানতে চাইবে না, তবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। এক সময় হয়তো তুমিও এটা টের পাবে।”

    দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল চারু। “কি ধরণের সাইকি ক্ষমতার কথা বলছেন?” এরকম ক্ষমতার অধিকারি অনেক ভণ্ডের মুখোশ খুলে দেবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

    “কখনও কখনও ও এমন কিছু দেখতে পায়, অনুভব করতে পারে, যেটা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।”

    মায়া আস্তে করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

    চারু আহসানের কপালে ভাঁজ পড়লেও ঠোঁটে ফুটে উঠলো প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের হাসি। “তাই নাকি?”

    “হুম। অন্তত একটার কথা আমি বলতে পারি তোমাকে।”

    অন্য দিকে তাকিয়ে থাকা মায়াকে চকিতে দেখে ডক্টরের দিকে ফিরলো চারু। “বলেন,..শুনি।”

    “ইন্টারভিউয়ের সময় আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার সম্পর্কে ওর অনুভূতি কি…ও বলেছিলো, আমার সঙ্গে সব সময় অন্য একজন থাকে!” শেষ কথাটা বলার সময় ডক্টরের কণ্ঠ কেমন গম্ভির হয়ে উঠলো।

    “তো?” কাঁধ তুললো চারু। “এরকম হেয়ালিপূর্ণ কথা দিয়ে কী বোঝায়?”

    এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। কপালের ডানপাশটা একটু চুলকে নিলেন তিনি। “তোমরা হয়তো জানো না, আমি সিয়ামিজ টুইন হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম।”

    চারুর কপালে আবারো ভাঁজ পড়লো। যেসব জমজ শারীরিকভাবে সংযুক্ত থাকে তাদেরকে সিয়ামিজ টুইন বলে। ব্যাপারটা জমজদের জন্য মোটেও সুখকর কিছু নয়।

    “তবে সুখের ব্যাপার হলো আমাদের দুজনের কেবল একটা হাত সামান্য জোড়া লাগানো অবস্থায় ছিলো। আমাদেরকে আলাদা করার জন্য। ঐ সময়কার ডাক্তারদের খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হয়নি। জন্মের পর দ্বিতীয় সপ্তাহেই আমাদেরকে আলাদা করে দেয়া হয়। আমার বামহাতে এখনও সেই দাগ রয়েছে।”

    “এটা নিশ্চয় অনেকে জানে?”

    চারুর কথায় মুচকি হাসলেন আজফার হুসেন। “আমার বাবা-মা ছাড়া দাদা-দাদিসহ হাতেগোনা পাঁচ-ছয়জন লোক এটা জানতো, তাদের কেউই এখন বেঁচে নেই। সত্যি বলতে, এই মেয়ের জন্মের বহু আগেই তারা মারা গেছে। আর আমিও আজকের আগে কারো কাছে এটা বলিনি।”

    “তাদের কেউ কথাটা কাউকে বলেনি এটা আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।” চারু নাছোরবান্দা। “নিশ্চয় কাউকে না কাউকে তারা এটা বলেছে। কথাটা একদম গোপন থাকবে সেটা আপনি আশা করতে পারেন না।”

    “হুম…তা অবশ্য পারি না। কিন্তু মায়ার ঐ কথাটা আমার জমজ নিয়ে ছিলো না।”

    কিছুটা আৎকে উঠলো চারু। “তাহলে?”

    ডক্টরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। “আমার ঐ ভাই সাতবছর বয়সে মারা যায়,” কথাটা বলেই চুপ মেরে গেলেন আজফার হুসেন। “ব্যাপারটা আমার জন্য ছিলো প্রচণ্ড শকের মতো।”

    চারু দেখলো মায়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে, যেন ডক্টরের আবেগের সাথে, গভির দুঃখবোধের সাথে একাত্ম হবার চেষ্টা করছে।

    “আমার মনে হতো আমার ভাইটি বেঁচে আছে!”

    চারু আহসান কিছু না বলে চেয়ে রইলো কেবল।

    “আমি তার সাথে কথা বলতাম, খেলতাম। এখনও আমার মনে হয়, আমার ঐ মৃত ভাইটি সব সময় আমার সাথেই থাকে! অদৃশ্য, অশরীরি কেউ আমাকে সব সময় ছায়ার মতো অনুসরণ করে!”

    “এটা এক ধরণের ডিলুশন। অনেকের বেলায় এমনটা হয়।”

    যুক্তিবাদির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ডক্টরের অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন হলো না। সেটা নিয়ে আমি তোমার সাথে তর্ক করবো না…কিন্তু ও এটা কিভাবে জানলো?”

    মায়ার দিকে তাকালো চারু। “আপনি এটা কিভাবে বললেন?”

    ছেলেটার কথার মধ্যে যে শ্লেষ আছে সেটা ধরতে পারলেও নিজেকে শান্ত রাখলো সে। “আমি জানি না। এটা আমি কাউকে বোঝাতেও পারবো না।” একটু চুপ থেকে আবার বলল, “এটা এক ধরণের অনুভূতি, এক ধরণের ভাবনা, আমার ভেতরে একটা কণ্ঠ যেন কথা বলে ওঠে। এর বেশি আমি নিজেও জানি না।”

    চারু সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো। এমন জবাবে সে সন্তুষ্ট নয়। হওয়ার কথাও না।

    “আমি জানি আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না,” আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া আবার বলল, “আমার মা-বাবাও প্রথমে বিশ্বাস করেনি।”

    “আপনার মা-বাবা?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো চারু।

    ছেলেটার দিকে তাকালো সে। “এটা আপনি বিশ্বাস করবেন না।”

    “কিন্তু আমি শুনতে চাচ্ছি।”

    “আমিও,” ডক্টরও আগ্রহ দেখালেন।

    গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো মায়া। “আমার বয়স তখন বারো। বাবা তার ব্যবসার প্রয়োজনে প্রচুর টুর করতেন। প্রায়ই সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড যেতেন। তো, এরকম এক টুরের আগে আমি স্বপ্ন দেখলাম বাবার প্লেনটা সাগরে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে!”

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু আহসান।

    “ঘুম থেকে জেগে উঠে খুব কান্নাকাটি করলাম, মাকে সব বললাম। আমার কথা শুনে মা অবাক হলেও সেটা বুঝতে দিলো না। আমাকে বোঝালো, এটা নিছক স্বপ্ন…দুঃস্বপ্ন। সত্যি নয়।”

    আজফার হুসেন উদাস হয়ে গেলেন।

    “বাবাকে আমার স্বপ্নের কথাটা বলল মা, বাবা সেটা হেসেই উড়িয়ে দিলো। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে বোঝালো এটা দুঃস্বপ্ন। মানুষ তার প্রিয়জনকে নিয়ে এরকম আশঙ্কা আর দুঃস্বপ্ন দেখে থাকে, এটা নিয়ে চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমি নাছোরবান্দার মতো আব্দার করে বসলাম, বাবা যেন এই টুরটা বাতিল করে।”

    “তারপর কি হলো?”

    চারুর দিকে তাকিয়ে আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটি। “বারো বছরের বাচ্চামেয়ের কথায় কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো বাবা বিদেশ টুর বাতিল করবে, এমনটা আপনি আশা করতে পারেন না।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।

    “বাবা কোনোভাবেই আমার কথায় টুর বাতিল করলো না। আমি অনেক কান্নাকাটি করেও তাকে বোঝাতে পারলাম না, তার প্লেনটা ক্রাশ করবে।”

    “তাহলে তিনি টুরে গেলেন?” বলে উঠলো চারু।

    “না। ফ্লাইটের ঠিক আগে দিয়ে আমি বাবার প্লেনের টিকেটটা ছিঁড়ে ফেলি।”

    ডক্টরের মুখ হা হয়ে গেলো। কিন্তু চারু মাথা দোলাল আক্ষেপে। যেন বারো বছরের নাদান বাচ্চার ছেলেমানুষি ছিলো ওটা।

    “শুধু তা-ই না…বাবা যে ব্রিফকেসটা নিয়ে টুরে যাবে সেটাও লুকিয়ে ফেললাম।”

    “তাহলে আপনার বাবা আর টুরে যেতে পারেননি?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। “বাবা খুব রেগে গেলো…খুব…” একটু থেমে আবার বলল সে, “আমার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে, আমি না বুঝে কতো বড় ক্ষতি করে ফেললাম সেটা যদি বুঝতাম…এরকম অনেক কথা বলল সারাটা দিন। খুব মুষড়ে পড়েছিলো বাবা। মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে শান্ত করে।”

    “তারপর?” ডক্টর আজফার উদগ্রিব হয়ে জানতে চাইলেন।

    “রাতে সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে বাবার বিজনেস অ্যাসোসিয়েটরা জানায় ঐ প্লেনটা সত্যি সত্যি সাগরে ক্রাশ করেছে।”

    ডক্টর আজফার মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকলেও চারুর মধ্যে সেরকম কিছু দেখা গেলো না। আপাতত নিরবতাকেই বেছে নিলো সে।

    “খবরটা শোনার পর আমার শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।”

    ভুরু কুচকে ফেললেন ডক্টর। “কেন?”

    “ঐ সময়ে বুঝিনি। পরে দেখলাম, যখনই এমন হয়…মানে, আমি আগেভাগে কিছু বলে দেই কি ঘটবে, তার পর পরই শরীর খারাপ হয়ে যায়। গুরুতর কিছু না, মাথাব্যথা, শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, বমি-বমি ভাব…এরকম কিছু।”

    “ডাক্তার দেখাও না তখন?”

    “আগে দেখাতাম, এখন আর দেখাই না।”

    “কেন?”

    “ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না, একটা দিন পরই সব ঠিক হয়ে যায়।”

    “তাহলে ঐ ঘটনার পর…তোমার বাবার প্লেনটা ক্রাশের পর আরো অনেকবারই এমন ভবিষ্যত্বাণী করেছো?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া।

    “সবগুলোই মিলে গেছিলো?”

    “হুম।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আজফার হুসেন। “সাতানব্বই সালে গুয়াতেমালায় গেছিলাম কানাডার একটি এক্সিপিডিশান টিমের সাথে, ওখানে এক রেডইন্ডিয়ান মেয়ে মেদার সাথে আমাদের দেখা হয়, তখন ওর বয়স তোমার মতোই ছিলো…ঐ মেয়েটাও ঠিক এভাবে অনেক কিছু আগেভাগে বলে দিতে পারতো। ওদের গ্রামে, মানে হেসিয়ান্দায় তিনদিন থাকার পর আমরা যখন গভীর জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো তখন মেদা আমাকে বলেছিলো আমি যেন ওখানে না যাই। আমার জন্য নাকি অমঙ্গল অপেক্ষা করছে।”

    মায়া স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডক্টরের দিকে।

    “মেয়েটার কথা পাত্তাই দিলাম না। অশিক্ষিত এক রেডইন্ডিয়ান মেয়ে, কী সব আবোল-তাবোল বলছে। তার কথা শুনে আমি এতোদূর এসে থেমে যাবো?” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। “আমি আমার টিমের সাথে ঢুকে পড়লাম গুয়াতেমালার গভীর আর আদিম বনে। গল্পটা অনেক লম্বা। শুধু জেনে রাখো, মেয়েটার কথাই সত্যি হয়েছিলো। আমি আমার একটা পা হারাই ঐ জঙ্গলে। সেটাকেও চরম ভাগ্য বলতে পারো, অন্তত জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।”

    চারুর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো কে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। “অ্যাকসিডেন্টটা কি ছিল?”

    “মারাত্মক বিষাক্ত একটি সাপ আমার পায়ে ছোবল দিয়েছিল। ওটার কামড় খেলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। ওখানকার সবাই তাই বলতো। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিলো, সঙ্গে থাকা এক অভিজ্ঞ রেড ইন্ডিয়ান আমার হাটুর উপরে শক্তভাবে বেধে দিয়ে কিছু ভেষজ পাতা লাগিয়ে দেয়।”

    “কিন্তু পা-টা কেটে ফেলতে হলো কেন?”

    চারুর দিকে চেয়ে রইলেন ডক্টর। “জঙ্গল থেকে হেইসিন্দায় ফিরে যেতে আটঘন্টার মতো লেগেছিল। এই সময়ের মধ্যে হাটুর নিচের অংশ বিষের প্রভাবে পচে যায়। মেদা যদি পা-টা কেটে ফেলে না দিতো তাহলে আমি মারাই যেতাম।”

    “ঐ মেয়েটাই আপনার পা কাটলো?” বিস্মিত হলো চারু।

    মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর আজফার। “হেইসিন্দার চারশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো হাসপাতাল ছিলো না। সেই চারশ’ কিলোমিটার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে কমপক্ষে দু-দিন লাগতো। তাই মেদা-ই আমার চিকিৎসা করেছিলো। তখনই জানতে পারলাম, মেয়েটা ওদের হেসিয়ান্দার একজন ডাক্তার…মানে বৈদ্য। রেডইন্ডিয়ানদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, মেদা সে-সব বিদ্যায় পারদর্শি ছিল।”

    চারু আর কিছু বলল না।

    একটু চুপ থেকে ডক্টর আবার বলে উঠলেন, “মজার ব্যাপার কি জানো? স্থানীয়রা ওকে মেদা নামে ডাকতো কিন্তু আসলে ওর নাম ছিলো চিহানুকা। মেদা’র অর্থ নারী-পয়গম্বর।’ “ হাতের ছরিটা তুলে ধরলেন তিনি। “এই যে এটা…আমাজনের হাজার বছরের প্রাচীন গাছ থেকে তৈরি। মেদা নিজহাতে বানিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। ও আবার কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র বানাতেও পারদর্শি ছিলো।” ডক্টর যেন নস্টালিজ হয়ে পড়েছেন। “সাময়িক ব্যবহারের জন্য একটা কাঠের পা-ও বানিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটি।”

    ডক্টর এবার মায়ার দিকে তাকালেন।

    “ওখানকার লোকজন আমাকে বলেছে, এরকম ভবিষ্যত্বাণী করার পর মেদার শরীরও তোমার মতোই খারাপ হয়ে যেতো। সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা,..এইসব।”

    চোখ বন্ধ করে ফেলল মায়া। তারপর কাউকে কিছু না বলে ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে।

    ডক্টর আর চারু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না।

    “তোমার মতো আমিও রহস্য শব্দটা পছন্দ করি না। তবে এ জগতে অব্যাখ্যাত অনেক ঘটনা ঘটে। যুক্তি দিয়ে ওগুলো সব সময় ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না।”

    ডক্টরও আস্তে করে উঠে বড় একটি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরের লনে মায়া খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চোখেমুখে শিশুর সারল্য।

    “তুমি যেসব ভণ্ডদের মুখোশ উন্মাচন করো এই মেয়েটি সে-রকম কেউ,” কথাটা বলেই চারুর দিকে তাকালেন।

    ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো চারু আহসান।

    “ধরো, এক লোক দাবি করলো সে জ্ঞানী। কিন্তু লোকটা যে সত্যিকারের জ্ঞানী নয় সেটা প্রমাণ করে ছাড়লে তুমি। তার মানে কী দাঁড়ালো, পৃথিবীতে সত্যিকারের জ্ঞানী নেই? সবাই ভণ্ড?”

    চারু এরকম যুক্তির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে বুঝতে পারছে ডক্টর আজফারকে খাটো করে দেখেছে। লোকটা আসলে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।

    “আমার অভিজ্ঞতা বলে, সত্যিকারের জ্ঞানীদের মতোই যাদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে তারা এটা দাবি করে না। এটা ব্যবহার করে ফায়দাও লোটে না।” একটু থেমে আবার বললেন, “ঠিক আমাদের মায়ার মতো।”

    চারু চুপ মেরে রইলো।

    .

    অধ্যায় ১৭

    ঘুম থেকে ওঠার পর বেলকনিতে বসে পত্রিকা হাতে নিয়ে চা খাচ্ছে মায়া। কফি তার যতোই প্রিয় হোক, সকালবেলা তার চাই এক কাপ চা। দিনের শুরুটা নরম আর হালকাভাবে করতে পারলে ভালো লাগে। চায়ের তুলনায় কফি অনেক বেশি কড়া। সকাল সকাল কড়া কিছু দিয়ে শুরু করার ঘোর বিরোধি সে।

    কিন্তু কড়া শুধু কফিই নয়, পত্রিকাও এরমধ্যে পড়ে। প্রথম পৃষ্ঠায় বিভৎস ছবিসহ তিনটি খুনের সংবাদ অনায়াসে দিনটা বাজেভাবে শুরু করে দিতে পারে। অবশ্য সূক্ষ্ম রুচিবোধসম্পন্ন কারোর বেলায়।

    মায়া পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে রেখে দিয়ে বাইরে তাকালো। একটু পরই বৃষ্টি নামবে। আকাশ কালচে হতে শুরু করেছে, বাতাসের বেগ বাড়ছে ক্রমশ। চৌদ্দতলার উপরে বসে ভালোই টের পাচ্ছে সে। উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখলো, বেশ দূরে, সম্ভবত শহরের শেষ সীমায় বৃষ্টি হচ্ছে। ওখান থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসা বাতাসেও রয়েছে বৃষ্টির গন্ধ।

    “আপা, দুপুরে কি খাবেন?”

    পাশ ফিরে তাকালো মায়া। কাজের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলকনির স্লাইডিংডোরের সামনে। “দুপুরে বাইরে খাবো। তুই তোর জন্য রান্না করিস।”

    মেয়েটা কিছু না বলে চলে গেলো।

    এ ব্যাপারটা মায়ার খুব ভালো লাগে। এই মেয়ে কখনও প্রয়োজনের চেয়ে একটা কথাও বেশি বলে না। এর কারণ অবশ্য মেয়েটার দুঃখময় অতীত। তার পাষণ্ড স্বামি তাকে ঢাকায় এনে শহরটা ঘুরিয়ে দেখানোর নাম করে এক দেহব্যবসায়ি দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটার ভাগ্য ভালো, লোভি খদ্দেরের কাছে পড়ার আগেই একটি এনজিও’র তৎপরতায় উদ্ধার পেয়ে যায়। ঐ এনজিওটি জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত মেয়েদের উদ্ধার করে থাকে। এনজিও’র একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতো মায়া। তো সোহেলিকে উদ্ধার করার পর দেখা গেলো তার আসলে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। মেয়েটা কোনোভাবে তার গ্রামে ফিরে যেতে চাইছিলো না। বাবা-মা নেই। তার চাচা যেনতেন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে। এখন কোথায় ফিরে যাবে?-মায়া তখন এগিয়ে আসে, মেয়েটাকে নিয়ে আসে তার বাড়িতে। সেই থেকে তার ছোট্ট সংসারের অংশ হয়ে আছে মেয়েটি।

    বেলকনিতে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এসে পড়ায় মায়ার চিন্তায় ব্যঘাত ঘটলো, খুশি হয়ে উঠলো সে। এতোটা দ্রুত বৃষ্টি নামবে আশা করেনি। তার ইচ্ছে করছে বেলকনিতে বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে যাবে তখনই শুনতে পেলো তার ফোনটা বাজছে। চেয়ারের উপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো মায়া।

    “হ্যালো?” ওপাশ থেকে বলল চারু।

    “হাই…কেমন আছেন?”

    “এই তো…ভালো।”

    “বাইরে নাকি?”

    “না তো।”

    “অনেক নয়েজ হচ্ছে।”

    “আমি বেলকনিতে…বৃষ্টি দেখছি।”

    “ও,” চারু বলল। “শুনুন, আমার মনে হয়, ঐদিন পার্টিতে যারা। ছিলো তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলা দরকার এখন। ডোসিয়ারে দেখলাম মিসকীতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো অ্যাঞ্জেল, তার সাথে কথা। বলতে হবে।”

    “হুম।” মায়ার দৃষ্টি বাইরের বৃষ্টির দিকে।

    “ওর সাথে একটা মিটিং ম্যানেজ করতে পারবেন?”

    “না।”

    “না?” অবাক হলো চারু।

    “শুনুন, এটা আপনি করলেই বেশি ভালো হবে। হাজার হলেও চিজটা অ্যাঞ্জেল…বুঝলেন?”

    “কি!”

    “আরে বাবা, ও তো একটু ইয়ে…মানে, আপনারা যাকে বলেন ফিফটি-ফিফটি।”

    “হুম। সেটা ডোসিয়ারে বলা ছিলো।”

    “আমি সিরিয়াসলি বলছি, আপনি ট্রাই করে দেখুন…কাজ হবে।”

    “কিভাবে করবো? ডোসিয়ারে কেবল ওর ফোন নাম্বার দেয়া আছে। আমি কি ওকে ফোন করবো? আমার তো মনে হয় না এতে কাজ হবে।”

    “না, প্রথমে ফোন করার দরকার নেই। আপনি ফেসবুকে ওর সাথে হাই-হ্যালো করেন, একটু ভাব জমান, তাতেই কাজ হবে।”

    “আজব। আপনি কী করে ধরে নিলেন, ও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে?”

    “আপনার কি ধারণা আমি না জেনে এটা বলছি?”

    মায়ার এমন কথায় অবাকই হলো সে। “আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ও কেন থাকবে?!”

    “সেটা আমি কী করে বলবো। হতে পারে ও আপনার ফ্যান।”

    “শুনুন, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাঞ্জেল নামে কেউ নেই।”

    “ফেসবুকে সবাই নিজের নাম ব্যবহার করে এটা আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন?”

    মায়ার কথায় টনক নড়লো তার। সত্যিই তো, ফেসবুক মানে ভুরি ভুরি ফেইক আইডি, ছদ্মনাম। “আপনি বলতে চাচ্ছেন অ্যাঞ্জেল অন্য নামে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে?”

    “হুম।”

    “এটা আপনি জানলেন কিভাবে?” তার কণ্ঠে ঘোরতর সন্দেহ।

    “আপনার কি ধারণা আপনি একাই গুগল করে অন্যের হাঁড়ির খবর বের করেন? শুনুন, তথ্য খোঁজার জন্য গুগল ঠিক আছে কিন্তু মানুষজন খুঁজতে হলে ফেসবুকের চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না।”

    চারু কিছু বলল না।

    “আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে ‘আমি বনলতা’ নামের একটা আইডি আছে না?”

    “মনে হয় আছে।” সত্যি বলতে চারু আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত এ নামে একজন আছে। মাঝেমধ্যে চ্যাটও হয় সেই ‘আমি বনলতার’ সাথে।

    “ওটাই অ্যাঞ্জেলের আইডি।”

    “কী বলেন!? কোত্থেকে এসব খবর পান? আপনি কিভাবে জানলেন, একটু বলবেন?” চারুর কণ্ঠে অবিশ্বাস।

    গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো মায়া। “আমি অ্যাঞ্জেলের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে পরিচিত একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম ও ‘আমি বনলতা’ নামের আইডি ব্যবহার করে ফেসবুকে। অ্যাঞ্জেল নামে ওর কোনো আইডি নেই। তো, সেই আইডিতে ঢুকে দেখলাম ও আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে।”

    “ওহ্।” চারু এবার বুঝতে পারলো। “ওই আইডির প্রোফাইল পিকচারে চোখ ধাঁধানো সুন্দরি একটি মেয়ের ছবি দেয়া আছে। সম্ভবত ওটা ফেইক ছবি।”

    “না। ওটা ওরই ছবি। বাস্তবে তো বেচারা সাজুগুজু করতে পারে না তাই প্রোফাইল পিকচারে মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজুগুজু করে ছবি তুলে দিয়েছে…হ্যান্ডসাম পুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে। তার উদ্দেশ্যটা অবশ্য সফল হয়েছে বলেই মনে হয়। নামি-দামি লেখকেরাও তার ফ্রেন্ড!”

    টিটকারিটা গায়ে মাখলো না চারু। “থ্যাঙ্কস।”

    “কিসের জন্যে?”

    “ওর ব্যাপারে এসব জানানোর জন্য। আমি তো জানতামই না ঐ চিজটা বনলতা হয়ে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আগে থেকেই ঢুকে আছে।”

    “আপনার পাঁচহাজার ফ্রেন্ড, বিশ হাজার ফলোয়ার। তার মধ্যে কাকতালিয়ভাবে অ্যাঞ্জেলের থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। জানেনই তো, দুনিয়াটা আসলে খুবই ছোটো।”

    চারু জানে তার তুলনায় মায়ার ফ্রেন্ডলিস্ট অনেক বেশি সমৃদ্ধ। শুধুমাত্র মেয়ে হবার কারণেই ফেসবুকে হাজার-হাজার ফ্রেন্ডস আর ফলোয়ার জুটে যায়। মায়ার মতো আর.জে হলে তো কথাই নেই। এই মেয়ের ফলোয়ারের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি।

    “আপনি দেখি বই-টই লিখে আসলেই বিখ্যাত হয়ে গেছেন। যাক, যেটা বলছিলাম। আপনার ঐ বনলতা…চোখ ধাঁধানো সুন্দরি ফ্যানকে আপনিই হ্যান্ডেল করুন, ঠিক আছে?”

    “হুম, দেখি কী করা যায়। তবে আমাকে বিখ্যাত বলে টিটকারি মারার দরকার ছিলো না। লেখালেখি করার কারণে কিছু পাঠক আছে আমার, এর বেশি কিছু না।”

    “যাই হোক, আপনি কি আজ ডক্টরের বাড়িতে যাচ্ছেন?”

    “যদি আপনি যান তো যেতে পারি।”

    “আমি আজ যেতে পারবো না। দুপুরে একটা ইনভাইটেশন আছে। কাল সকালে যাবো, ঠিক আছে?”

    “ওকে, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে।”

    “বাই।”

    ফোনটা রেখে মায়া মুখ টিপে হাসলো। বাইরে এখন প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এতো উপর থেকে শহরের উপর আছড়ে পড়া বৃষ্টির দৃশ্য দেখতে দারুণ লাগে। মনে হয় আকাশ করুণা করে নোংরা শহরকে পরিস্কার করে দিচ্ছে।

    বেলকনির রেলিংয়ের সামনে চলে গেলো সে। বৃষ্টির ঝাঁপটায় ভিজতে শুরু করলো।

    .

    অধ্যায় ১৮

    মায়ার সাথে কথা শেষ করে ল্যাপটপটা ওপেন করলো চারু। তার মেজাজ সামান্য বিগড়ে আছে। আমি বনলতা’ নামের এই ভক্তের সাথে মাঝেমধ্যে চ্যাট হয়। এতোদিন তার ধারণা ছিলো মেয়েটা সম্ভবত তার বিশাল ভক্ত। এখন আসল সত্যটা জানার পর বিবমিষা লাগছে।

    যথেষ্ট উদার আর যুক্তিবাদি হওয়া সত্ত্বেও অ্যাঞ্জেলদের মতো মানুষজনদের সাথে সে খুব সহজে মিশতে পারে না। কেন পারে না সেটারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে গত বছর যখন তাদের যুক্তিবাদি সমিতি সিদ্ধান্ত নিলো সমকামি বিয়েতে সমর্থ দেবে তখন চারু বেঁকে বসেছিলো। এ নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে ছোটখাটো একটি তর্কও করেছিলো সে। তার যুক্তি ছিলো, সমকামিতা আসলে অসুখ। এক ধরণের মানসিক বৈকল্য। কথাটা শুনে র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হতবাক হয়ে গেছিলেন। তার মতো যুক্তিবাদি আর উদার ছেলের কাছ থেকে তিনি নাকি এটা আশা করেননি। তবে চারু যুক্তি দিয়ে বলেছিলো, সমকামিতা যদি অসুখ না-হয়ে থাকে তাহলে পেইডোফিলিয়াও অসুখ নয়। সমকামিদের পাশাপাশি পেডেরাস্টদেরকেও স্বীকৃতি দেয়া উচিত!

    তিন সন্তানের জনক প্রেসিডেন্ট কয়েক মুহূর্ত গম্ভির হয়ে ভেবে বলেছিলেন, সমকামিদের নিয়ে আপাতত মাথা না ঘামানোই ভালো। তাদের সোসাইটির আসল কাজ বাদ দিয়ে খামোখা এসব নিয়ে গৃহবিবাদ সৃষ্টি করার কোনো মানে হয় না।

    যাই হোক, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেসবুকে লগ-ইন করেই ‘আমি বনলতা’ আইডিতে প্রবেশ করলো চারু। সব খারাপ জিনিসেরই ভালো একটা দিক থাকে, তেমনি বনলতার আইডিটির মালিক অ্যাঞ্জেল হওয়াতে একটু সুবিধা হয়ে গেলো তার জন্য। এজন্যে ফেসবুককে ধন্যবাদ দেয়া যেতেই পারে। দুনিয়াটা আসলেই ছোট। আর ফেসবুক আসার পর সেটা আরো ছোট হয়ে উঠেছে। একেবারে আঙুলের ডগায় চলে এসেছে এখন।

    চারু দেখতে পেলো অ্যাঞ্জেলের ছদ্ম-আইডিটি অফলাইনে আছে এখন। দ্রুত একটি মেসেজ লিখে ফেলল সে :

    ‘হ্যালো অ্যাঞ্জেল। কেমন আছো? 😊
    তুমি হয়তো জানো না, আমি তোমার আসল পরিচয় বহু আগে থেকেই জানতাম। যদিও এই বিষয়টা নিয়ে তোমাকে কখনও কোনো প্রশ্ন করিনি, কারণ তোমার ফেসবুকের নামটা আমার খুবই ভালো লাগে। জীবনান্দ দাশ আমার খুবই প্রিয় কবি। তার বনলতাও আমার কাছে সমানভাবে প্রিয়। বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়। 😊
    এবার কাজের কথায় আসি। তুমি জানো আমি যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সামনের সপ্তাহে আমরা কমন-জেন্ডারদের সামাজিক-মানবিক অধিকার নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করতে যাচ্ছি। এই ইসুটার উপরে একটি প্রবন্ধ লিখবো, সেজন্যে তোমার সাথে। একান্তে কথা বলতে চাই। আমি আমার কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা দিয়ে দিলাম, আশা করি তুমি খুব জলদি আমার সাথে যোগাযোগ করবে। :😊 ’

    মেসেজের শেষে ফোন নাম্বারটা লিখে সেন্ড করে দিলো সে। তার ধারণা অ্যাঞ্জেল খুব দ্রুতই সাড়া দেবে। হয়তো কাল-পরশুর মধ্যে কথা বলা যাবে তার সাথে।

    ল্যাপটপের সামনে থেকে উঠে পাশের রান্নাঘরে গেলো চারু। তার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে। রেস্টুরেন্ট আর রাস্তার পাশে টঙের চা খেয়ে তৃপ্তি পায় না, তাই ঘরে থাকলে নিজেই বানিয়ে নেয়।

    কেটলিতে পানি ভরে চুলায় বসাতেই শুনতে পেলো তার ফোনটা বাজছে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেবার আগেই রিং টোন বন্ধ হয়ে গেলো। ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখলো অপরিচিত একটি নাম্বার। সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করলো সে।

    “হ্যালো, কে?” কলটা রিসিভ করা হলে বলল।

    “চারু আহসান বলছেন?” ন্যাকা-ন্যাকা একটি কণ্ঠ বলে উঠলো। কণ্ঠস্বরই বলে দিলো ফোনের ওপাশে যে আছে সে না-পুরুষ না-মহিলা।

    অ্যাঞ্জেল! এতো তাড়াতাড়ি? অবাক হলো সে। “হুম…চারু আহসান বলছি।”

    “ওয়েল…আমি সেই বনলতা!”

    .

    একটা অস্বস্তি জেঁকে বসেছে চারুর মধ্যে, আর সেটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে লোকজনের চোরা চাহনির কারণে। সে যতোই উদার মনোভাবাপন্ন, মানবিক আর যুক্তিবাদি হোক না কেন, এরকম একজনের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করছে। ছেলেটা (?) যদি প্রাক করা ভুরু না নাচাতো, ‘ওদের’ মতো হাত নেড়ে নেড়ে কথা না বলতো তাহলে কোনো সমস্যা ছিলো না।

    চোখ ধাঁধানো সুন্দরি মেয়েদের মতোই দেখতে সে। ঠোঁটে সম্ভবত হালকা গোলাপি লিপস্টিকও দিয়েছে। সর্বনাশের চূড়ান্ত আর কী!

    বিকেলের শুরুতে রেস্টুরেন্টে খুব একটা লোকজন নেই, তারপরও যে কয়জন আছে তাদের সবার দৃষ্টি অ্যাঞ্জেলের দিকে।

    “রাইটার কোনো কথা বলছে না কেন?” ভাববাচ্যে বলল অ্যাঞ্জেল।

    মুখে কৃত্রিম হাসি এঁটে চারু বলল, “না, মানে…কি খাবে?”

    “তেমন কিছু না…জাস্ট সফট ড্রিঙ্কস হলেই চলবে।”

    “ফ্রেঞ্চ ফ্রাই?”

    ভুরু আর চোখ নাচিয়ে একটু ভেবে বলল, “ও-কে।”

    ওয়েটারকে ডেকে ঝটপট অর্ডার দিয়ে দিলো চারু। খেয়াল করলো ওয়েটার ছেলেটা পর্যন্ত অ্যাঞ্জেলের দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে।

    “হাউ ডিড ইউ নো দ্যাট, ম্যান? মানে, আমিই যে অ্যাঞ্জেল সেটা কিভাবে বুঝলেন?”

    “ওহ্,” আবারো মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে দ্রুত ভেবে নিলো সে। “বাইকার বাবু বলেছে।”

    বিস্মিত হলো মেয়েলি স্বভাবের ছেলেটা। “বাবু?!”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “ওকে আমি চিনি। ও-ই বলল, তুমি নাকি অলরেডি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে।”

    “ওহ্..নাউ আই গট ইট।”

    “বাবুর সাথে কি তোমার যোগাযোগ হয় না আজকাল?”

    “খুব একটা না। আগে খুব হতো…খুব ক্লোজ ছিলাম আমরা।”

    “মিসকাত মারা যাবার পর থেকে তোমাদের সার্কেলটা বোধহয় ভেঙে গেছে, তাই না?”

    “হুম, ঠিক বলেছেন। ওই ঘটনার পর থেকে সব কেমন যেন হয়ে গেলো। রিকি আর রাফা বিদেশে চলে গেলো। আনিকার বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। আর যাকে ঘিরে আমাদের সব আড্ডা হতো সে…” কথাটা শেষ করতে পারলো না, আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বাবুকে যখন চেনেন তখন নিশ্চয় জানেন মিসকাতের মাডারের কথাটা?”

    “হ্যাঁ। ঘটনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং।”

    “ইটস হরিবল, ম্যান।”

    “হুম। শুনলে মনে হয় ভৌতিক সিনেমার গল্প।”

    “জানেন, ঐ দিনের কথা মনে পড়লে এখনও আমার গা ছমছম করে ওঠে।” অ্যাঞ্জেল সত্যি সত্যি শরীর কাঁপানোর ভঙ্গি করলো, বাদ গেলো না তার চোখ-মুখও।

    “মিসকাতের মা একজন এমপি হবার পরও পুলিশ এখনও সভ করতে পারেনি কেসটা…খুবই প্যাথেটিক ব্যাপার, তাই না?”

    “লিসেন, পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আই থিঙ্ক, শালোক হোমকে নিয়ে এলেও এটা আনসভই থেকে যাবে। ইটস লাইক, নাইটমেয়ার অন এলম স্ট্রিট। পুরাই ভৌতিক ঘটনা।”

    “তোমরা সবাই কি তা-ই বিশ্বাস করো নাকি?”

    “ওয়েল, এছাড়া আর কী বলবো, বলুন? বাবু এটা করেনি…দ্যাটস ফর শিওর। ও তখন অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে।”

    “হুম, খুবই ইন্টারেস্টিং একটি ঘটনা। যে খুন করলো সে ঘটনার অনেক আগে থেকেই হাসপাতালে ভর্তি।”

    এমন সময় ওয়েটার ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই আর সফটড্রিঙ্কস নিয়ে এলো।

    “প্লিজ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল চারু আহসান। “ঘটনা যে ইন্টারেস্টিং সেটা নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। তবে আমার মনে হয় না ব্যাপারটা ভুতুরে।”

    “ভুতুরে না-হলে এটা কিভাবে হলো, হুম? হাউ ডিড ইট হ্যাঁপেন, ম্যান?” একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলে নিয়ে বলল অ্যাঞ্জেল। লিপস্টিক দেয়া মেয়েরা যে-রকম সর্তকতার সাথে কোনো কিছু মুখে দেয় ঠিক সেভাবে মুখে পুরলো সে।

    চারুও একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলে নিলো। “অনেকভাবেই হতে পারে। যে বা যারা কাজটা করেছে তারাই আসলে ভালো বলতে পারবে।”

    “এরকম কাজ কে করতে যাবে?” অবাক হয়ে বলল অ্যাঞ্জেল, “মিসকাতের সাথে তো কারো কোনো ঝামেলা ছিলো না। নাথিং অ্যাট

    “মিসকাতের সাথে কারো কোনো ঝামেলা ছিলো না, তুমি কি এ ব্যাপারে পুরোপুরি শিওর?”।

    “হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিও। ওরকম কোনো শত্রু থাকলে আমরা জানবো? স্পেশালি, আমি তো জানবোই।”

    মুচকি হাসলো চারু। সফট ড্রিঙ্কটা হাতে তুলে নিলো, একটু গলা ভেজানো দরকার। “তা ঠিক। মিসকাতের সাথে তোমার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো…বাবু আমাকে বলেছে।”

    “রাইট ইউ আর, ভুরু নাচিয়ে বলল অ্যাঞ্জেল, “ওর সব গোপন ব্যাপার আমি জানতাম। স-অ-অ-ব!” শেষ কথাটা কেমন করে টেনে আর ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলল।

    চারু কিছু না বলে অপেক্ষা করলো আরো কি বলে শোনার জন্য।

    “ইভেন, ওসব ব্যাপারও,” বলেই চোখদুটো নাচালো। সফট ড্রিঙ্কটা তুলে নিয়ে আলতো করে চুমুক দিলো তাতে।

    মাথা দোলাল অলৌকিক বলে কিছু নেই বইয়ের লেখক। “এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। প্রতিটি মানুষেরই শত্রু আছে। কখনও সেটা প্রকাশ্য কখনও সেটা গোপন। শত্রু ছাড়া মানুষ হয় না, অ্যাঞ্জেল। সম্ভবত তুমি জানো না এমন কোনো শত্রু ছিলো মিসকাতের। নইলে সে এভাবে খুন হতে পারে না।”

    “লিসেন,” একটু রেগেই বলল সে, “আমি ওর সব জানতাম। আপনি হয়তো এটা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট। বাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, ও আরো ভালো বলতে পারবে।”

    “তুমি বলতে চাইছো, মিসকাতের সাথে কারো কোনোদিন কোনো রকম ঝামেলা হয়নি? সামান্যতমও নয়?”

    চারুর দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো অ্যাঞ্জেল।

    “যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে ওকে এরকম নৃশংসভাবে খুন করতে যাবে কে?” একটু থেমে আবার বলল, “একটা নয় দুটোয় দশ-বারোটা স্টেইব…ভাবা যায়, কী রকম প্রতিহিংসাপরায়ন ছিলো খুনি?”

    “কি জানি, বাবা…আমি যতোটুকু জানি মিসকির কোনো শত্রু ছিলো না। দ্যাটস অল আই ক্যান সে ইউ।”

    অ্যাঞ্জেলের দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু। মানুষের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। বিশেষ করে মিথ্যে বলার সময় মানুষ কেমন আচরণ করে সেটা সে জানে। তার কাছে মনে হচ্ছে এইমাত্র অ্যাঞ্জেল মিথ্যে বলেছে।

    “আমি কিন্তু আগেই সন্দেহ করেছিলম…ইউ নো?”

    “কীসের কথা বলছো?” কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলো চারু।

    “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ঐদিন খুবই উইয়ার্ড বিহেইভ করছিলো, কারো সাথে কথা বলছিলো না। কিন্তু আমাদের বাবু তো ওরকম ছেলে না। খুবই হাসিখুশি আর চঞ্চল একটা ছেলে।”

    মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে চারু।

    “সবাই তখন পার্টিতে এতোটাই মশগুল যে এটা খেয়ালই করেনি। কিন্তু আমার চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিলো।”

    “তুমি তাকে কিছু বলোনি, কেন সে এমন আচরণ করছে?”

    “বলেছি তো…কিন্তু কোনো রেসপন্স করেনি। আমি ভাবলাম, মিসকির মতো সে-ও বুঝি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।”

    “মিসকাতের সাথে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কথা হয়নি?”

    “ও আসার অনেক আগেই তো মিসকি তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেছিলো। ওর সাথে কথা হবে কেমনে?”

    “তাহলে মিসকাত কোন্ ঘরে আছে, কার সাথে আছে সেটা সে জানলো কিভাবে?”

    নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো অ্যাঞ্জেল। সম্ভবত আমাদের কথাবাতা থেকে এটা জানতে পেরেছিলো।”

    “কি রকম?”

    “ইয়ে…মানে, আমরা তো ওর সামনে এটা ওটা নিয়ে অনেক কথা বলছিলাম…তখন হয়তো মিসকির ব্যাপারেও বলেছিলাম। আমি ঠিক শিওর না। ঐদিনের সবকিছু আমার মনেও নেই।”

    চারু বুঝতে পারলো। এরা সবাই মদ্যপানসহ নেশা-টেশা করে বেসামাল ছিলো। মনে না থাকারই কথা। “হতে পারে, তোমরা হয়তো নিজেদের মধ্যে মিসকাতকে নিয়ে কথা বলছিলে, সেখান থেকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জেনে গেছে ব্যাপারটা।”

    “হুম। আমারও তাই মনে হচ্ছে। ও খুব অদ্ভুত আচরণ করলেও আমাদের আশেপাশেই ছিলো। আমাদের কথাবার্তা অবশ্যই শুনেছে।”

    এরপর কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে পেলো না।

    “বাই দ্য ওয়ে!” যেন হুট করেই একটা কথা মনে পড়েছে এমনভাবে বলে উঠলো অ্যাঞ্জেল, “আপনি না আমাকে বলেছিলেন কমন-জেন্ডার ইসু নিয়ে কথা বলতে চান? আমি তো ভুলেই গেছিলাম!” ওকে খুবই অবাক দেখালো।

    এতোক্ষণ যে এই প্রসঙ্গটা ভুলে ছিলো সেটা চারুর জন্য বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে। এটার পুরোপুরি ফায়দা লুটেছে সে।

    “হুম…তাই তো,” চারুও অবাক হবার ভান করলো। আমিও তোমার মতো ভুলে বসেছি।” একটু থেমে আবার বলল, “আসলে মিসকাতের খুনের ঘটনাটা আমার কাছে এতোটাই ইন্টারেস্টিং মনে হয় যে, তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলে ও-ই প্রসঙ্গটাই চলে আসে।”

    “ইটস কোয়াইট ন্যাচারাল,” অ্যাঞ্জেল বলল। “আপনি তো আবার এরকম ইন্টারেস্টিং ঘটনা নিয়েই বই-টই লেখেন।”

    সৌজন্যমূলক হাসি দিলো সে। “আসলে আমরা…মানে, বাংলাদেশ র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটি চাইছি আগামি মাসে কমন জেন্ডার ইসুটা নিয়ে যে কনফারেন্স করবো সেখানে তুমি অতিথি হিসেবে থাকবে। একটা লেকচার দেবে।”

    “হোয়াট!” ভয় পাবার ভঙ্গি করলো অ্যাঞ্জেল। “আর ইউ গন ম্যাড?” মাথা দোলাল জোরে জোরে। “আমার ফ্যামিলি জানলে আমাকে…উফ! আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা কি রকম রি-অ্যাক্ট করবে।” হাত নেড়ে মাথা দুলিয়ে বলল সে, “এটা আমি করতে পারবো না। নো ওয়ে।”

    চারু হতাশ হবার ভান করলো। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশা করেছিলাম, তুমি আমাদের একজন গেস্ট হবে।”

    “আই কান্ট। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড,” হাতজোড় করে বলল সে।

    কাঁধ তুললো যুক্তিবাদি। “তাহলে কী আর করা। তোমাকে গেস্ট করতে পারলে ভালো হতো। আমরা সমাজের সব শ্রেণি থেকে রিপ্রেজেন্টিটিভ চাচ্ছিলাম। এই ইসুটা কে কিভাবে হ্যান্ডেল করে সেটা সবার জানা দরকার ছিলো।”

    “সরি, ম্যান…” দুঃখি দুঃখি ভাব করে বলল অ্যাঞ্জেল।

    “ইটস ওকে,” মন খারাপ করা অভিব্যক্তি দিলো চারু। “আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।”

    “থ্যাঙ্কস অ্যা লট।”

    “কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে।”

    “কি?!” অ্যাঞ্জেল অবাক হয়ে চেয়ে রইলো চারুর দিকে।

    “মিসকাতের খুনটার রহস্য নিয়ে আমি একটা প্রাইভেট-ইনভেস্টিগেশন শুরু করবো ক-দিন পর, তোমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। কারোর কোনো নাম উল্লেখ করবো না।”

    “তাই?” আবারো অবাক হলো অ্যাঞ্জেল।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান। শুধু কাহিনীটা জানতে চাই। তোমাদের সবার নাম-পরিচয় বদলে দেবো…এমনকি মিসকাতেরও।”

    “দেন ইট ওন্ট বি অ্যা প্রবলেম, মিষ্টি করে হেসে বলল অ্যাঞ্জেল। “ইউ নো, আমাদের প্যারেন্টগ্রা চায় না এসব নিয়ে কারো সাথে কথা বলি।”

    “হুম, জানি। সেজন্যেই নাম-পরিচয় সব বদলে দেবো।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর হঠাৎ করে অ্যাঞ্জেলের ভাবভঙ্গি অন্যরকম হয়ে উঠলো। আদুরে গলায় বলল সে, “অ্যাই যে…মি. রাইটার?”

    “কি?” অবাক হয়ে গেলো চারু।

    “আপনার সাথে কি একটা সেল্‌ফি তুলতে পারি?” ষাটের দশকের চলচ্চিত্রের নায়িকাদের মতো দ্রুত চোখের পলক ফেলছে সে।

    মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো চারুর চেহারা।

    .

    অধ্যায় ১৯

    একা একা হেসে চলেছে মায়া। এই ফ্ল্যাটে এমন কেউ নেই যে নিজের হাসি চেপে রাখতে হবে।

    রাতে শোবার আগে বিছানায় বসে ঘণ্টাখানেক ফেসবুকে ঢু মারাটা তার অনেকদিনের অভ্যোস। এই মুহূর্তে অ্যাঞ্জেলের ওয়ালে যে ছবিটা দেখছে সেটাই তার হাসির কারণ। চারু আহসানের সাথে একটা সেল্ফি তুলে পোস্ট দিয়েছে সে। দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনো ফাস্টফুডে বসে ছবিটা তোলা হয়েছে।

    অ্যাঞ্জেলের দৃষ্টিকটু ডাকফেস সেফি দেখে হাসির পাবার কথা কিন্তু তার হাসি পাচ্ছে চারুর অভিব্যক্তি দেখে।

    বেচারা!

    মনে মনে সমবেদনা অনুভব করলো তার জন্য। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে চারু কতোটা অপছন্দ করছে এভাবে ছবি তুলতে কিন্তু না-তুলেও বোধহয় কোনো উপায় ছিলো না।

    মায়া এখন পরে আছে টি-শার্ট আর স্তর ট্রাউজার। অনেকক্ষণ ছবিটা দেখে বিনোদন পাবার পর অবশেষে ঠিক করলো কমেন্ট করবে। আমি বনলতা নামের আড়ালে থাকা অ্যাঞ্জেলের ফ্রেন্ড এখন সে। গতকাল রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো, রাতের মধ্যেই অ্যাকসেপ্ট করেছে।

    ‘হ্যাপি কাপল’ কমেন্টটা লেখার পর তার মনে হলো একটু বেশি হয়ে যায়। ডিলিট করে নতুন একটা কমেন্ট লিখলো আবার : ‘কংগ্র্যাটস।’

    এটুকুই যথেষ্ট। মুখ টিপে হেসে কমেন্টটা পোস্ট করে দিলো সে।

    তিন-চার মিনিট পরই মায়ার ফোনটা বেজে উঠলো। ডিসপ্লে না দেখেও আন্দাজ করতে পারলো চারু কল করেছে। আর এতো রাতে কেন ফোন করেছে সেটা ভালো করেই জানে। কলটা রিসিভ করে খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলল সে।

    “হ্যালো…কি খবর?”

    “ক্যাটস বললেন কেন? এসবের মানে কি? কংগ্র্যাটস দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, অ্যাঁ?” ওপাশ থেকে রেগেমেগে একনাগারে বলে গেলো চারু।

    “আরে, আপনি তো দেখি ক্ষেপে যাচ্ছেন? এমন কী লিখেছি?”

    “কি লিখেছেন আপনি জানেন না?”

    “আশ্চর্য, শুধু লিখেছি ‘কংগ্ৰাটস’…আর তো কিছু লিখিনি।”

    “আরো কিছু লেখার ইচ্ছে ছিলো নাকি?” রেগেমেগে বলল চারু।

    “হুম। অনেক কষ্টে লোভ সামলিয়েছি। প্রথমে তো লিখলাম হ্যাপি কাল…পরে দেখলাম এমন কমেন্ট করা ঠিক হবে না। হাজার হলেও আমরা একই টিমে কাজ করি।”

    “হ্যাপি কাপল!” রেগেমেগে বলে উঠলো চারু। “আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”

    “আশ্চর্য, এটা বুঝতে আপনার এতো দেরি হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না।”

    ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।

    “সত্যি কথা হলো, আপনাদের কিন্তু খুব মানিয়েছে।”

    “রাখেন আপনার মানামানি! আপনি ভালো করেই জানেন কী বিপদে পড়ে এটা আমি করেছি।”

    “হুম…তা-ও অবশ্য ঠিক।” টিটকারি মারার ভঙ্গিতে বলল মায়া, “আমার আসলে বেচারা’ লেখা উচিত ছিলো।”

    “আপনার আসলে কিছুই লেখা উচিত ছিলো না!”

    “হা-হা-হা,” হেসে উঠলো সে। “আরে, বাদ দিন তো…ফেসবুকের কমেন্ট এমন কোনো সিরিয়াস বিষয় নয়। কাজের কথা বলুন। আপনার বনলতা কি বলল? ওর কাছ থেকে কোনো কু পেলেন?”

    “আমার বনলতা!” ঝাঁঝের সাথে বলল চারু।

    “উফ! আপনি না…” কপট অভিমান দেখালো মায়া, “ও কি বলল সেটা বলুন?”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর ফোনের ওপাশ থেকে বলল চারু আহসান, “মনে হচ্ছে ওদের মুখ থেকে কথা বের করাটা খুব কঠিনই হবে। সবাই একই কথা বলে। পুলিশ রিপোর্টে যা আছে তার বাইরে কিছু বলে না।”

    “তাহলে কি করবেন?”

    “মিসাতের অন্য বন্ধুদের সাথে একটু কথা বলতে চাইছি। পার্টিতে যারা ছিলো তাদের সবার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সেটা তো মনে হয় সম্ভব হবে না। তারপরও কয়েকজনের সাথে কথা বলতেই হবে।”

    “ওকে…আমি অ্যাঞ্জেলের ফেসবুক থেকে বাকিদের খোঁজ করছি। দেখি, ওদের প্রোফাইলে কি কি ইনফর্মেশন আছে।”

    “কাল সকালে ডক্টরের ওখানে দেখা হচ্ছে তাহলে।”

    “হুম। দশটার পরে।”

    “বাই।”

    ফোনটা রেখে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকালো মায়া। মেয়েরা কেনজানি সেল্ফি তুলতে গেলেই ডাকফেস করে ফেলে। কিন্তু ছবিতে অ্যাঞ্জেল যেটা করেছে সেটা আরো বেশি প্রকট!

    তবে ওকে দেখে মনে হচ্ছে দারুণ খুশি। অন্যদিকে তার পাশে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে চারু।

    বেচারা!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article নেক্সট (বেগ-বাস্টার্ড – ৬) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }