Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    পোকা-মাকড় – জগদানন্দ রায়

    জগদানন্দ রায় এক পাতা গল্প239 Mins Read0

    ৬.১.৩ কঠিনবর্ম্মী : পতঙ্গ

    পতঙ্গ

    চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়ার কথা বলা হইল। এখন আমরা পতঙ্গদের কথা বলিব।

    ষষ্ঠ শাখার প্রাণীদের মধ্যে পতঙ্গেরই সংখ্যা বেশি। হাজার হাজার রকমের পতঙ্গ সর্ব্বদাই আমাদের নজরে পড়ে এবং যাহারা আমাদের নজরে পড়ে না, তাহাদের সংখ্যা আরো বেশি। আরসুলা মশা মাছি প্রজাপতি এবং নানা রকম গোব্‌রে-পোকা সকলেই পতঙ্গের দলের প্রাণী। তা’ছাড়া পিঁপ্‌ড়ে, উই, ছারপোকারাও এই দলে পড়ে।

    পিঁপ্‌ড়ে গোবরে-পোকা বা ফড়িং ধরিয়া তোমরা যদি পরীক্ষা করিয়া দেখ, তাহা হইলে সকলের দেহের মধ্যে বেশ একটা মিল দেখিতে পাইবে। ইহাদের কেবল আকৃতিতেই যে মিল আছে, তাহা নয়। দেহের ভিতরকায় যন্ত্রাদিতে এবং সেই সকল যন্ত্রের কাজেও খুব মিল ধরা পড়ে।

    এই মিল আছে বলিয়াই আমরা প্রথমে একটি মাত্র পতঙ্গের দেহ-যন্ত্রাদির কথা তোমাদিগকে বলিব। ইহা বুঝিলে, তোমরা যে-কোনো পতঙ্গের দেহের কাজ বুঝিয়া লইতে পারিবে। মানুষের আকৃতির মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। মোঙ্গলীয় চীনবাসী বর্ম্মাবাসী ও জাপানীদের রঙ্ কতকটা হল্‌দে রকমের, তাহাদের নাক খাঁদা। আফ্রিকার অধিবাসীদের গায়ের রঙ্ ঘোর কালো, ওষ্ঠ ভয়ানক পুরু। আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের রঙ্ তামার মত লাল। আকৃতির এই রকম অমিল থাকিলেও, ইহাদের সকলেই মানুষ এবং সকলেরি শরীরে এক রকম যন্ত্র আছে এবং সকলের দেহের যন্ত্র এক রকমেই চলে। সুতরাং যদি কোনো একটি মানুষের শরীরের যন্ত্রের কথা তোমরা জানিয়া লইতে পার, তবে বাঙালী, ইংরেজ, কাফ্রি বা আমেরিকান্ সকলেরি শরীরের কথা জানা হয় না কি? এই জন্যই বলিতেছি, নানা জাতি পতঙ্গের আকৃতির মধ্যে অমিল থাকিলেও তোমরা যদি একটিমাত্র পতঙ্গের শরীরের কাজ জানিয়া রাখিতে পার, তবে পৃথিবীর সমস্ত রকম পতঙ্গের দেহে কি প্রকারে জীবনের কাজ চলে, তাহা বলিয়া দিতে পারিবে।

    আমরা পর-পৃষ্ঠায় একটি পতঙ্গের ছবি দিলাম। আমরা আগেই বলিয়াছি পতঙ্গদের শরীরে মাথা, বুক ও লেজ এই তিনটি মোটামুটি ভাগ আছে এবং ইহাদের প্রায় সকলেরি ছয়খানা করিয়া পা থাকে। ছবিতে তোমরা ছয়খানি পা এবং দেহের ভাগ স্পষ্ট দেখিতে পাইবে। ছবিতে পাঁচটি ভাগ আছে। ইহার প্রথম ভাগটি মাথা; তাহার পরের তিনটি ভাগ লইয়া বুক এবং শেষের ভাগ লেজ।

    আমাদের মাথা এবং দেহের মাঝে একটা সরু অংশ থাকে। ইহাই আমাদের গলা। অনেক পতঙ্গেরই মাথা ও বুক ঐ রকমে জোড়া থাকে। তার পরে বুক ও লেজও আবার ঐ রকম সরু অংশ দিয়া জোড়া দেখা যায়। তোমরা কাঁচপোকা বা বোল্‌তার শরীর পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ো। ইহাদের মাথা বুক ও লেজ পরস্পর তারের ন্যায় সরু অংশ দিয়া জোড়া দেখিতে পাইবে। এই রকমে জোড়া থাকে বলিয়াই পতঙ্গেরা মাথা বুক ও লেজকে পৃথক্ পৃথক্ ভাবে ইচ্ছামত ঘুরাইতে পারে।

    যাহা হউক, এখন আবার ছবিখানিকে দেখ। আংটির মত যে সব গাঁট দিয়া পতঙ্গের দেহ প্রস্তুত, তাহার মধ্যে তিনটি গাঁট লইয়া ইহাদের বুকের সৃষ্টি হইয়াছে এবং এই গাঁটগুলির প্রত্যেকটি হইতে এক এক জোড়া পা বাহির হইয়াছে। কাজেই পতঙ্গদের মোট পায়ের সংখ্যা ছয়।

    পতঙ্গের ডানা

    পতঙ্গের যে ছবিখানি দেখিতেছ তাহাতে চারিখানি ডানা আছে। এগুলিও গাঁটের গা হইতে বাহির হইয়াছে।

    প্রথম ডানা জোড়াটি হাড়ের মত শক্ত জিনিস দিয়া প্রস্তুত এবং বেশ মোট৷। দ্বিতীয় ডানা জোড়াটি খুব পাত্‌লা। হঠাৎ দেখিলে মনে হয় ইহা যেন ঘন-বুনানি-করা জাল। গাছের পাতায় যেমন শিরা-উপশিরার বুনানি থাকে, ইহাতেও সেই রকম আছে। একটা মাছি বা অপর যে-কোনো পতঙ্গের ডানা লইয়া পরীক্ষা করিলে তোমরা ইহা দেখিতে পাইবে। এই পাত্‌লা ডানাই ইহাদের উড়িতে সাহায্য করে। গোব্‌রে-পোকা প্রভৃতি পতঙ্গেরা যখন মাটির উপরে বেড়ায় তখন তাহার পাত্‌লা ডানা ঐ হাড়ের ডানার মধ্যে লুকানো থাকে। এই জন্য বাহির হইতে সামান্য আঘাত লাগিলে উড়িবার পাত্‌লা ডানা নষ্ট হয় না এবং ভিতরেও সেই আঘাত পৌঁছায় না।

    ইহা হইতে তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ—পতঙ্গদের আসল ডানা ছাড়া যে হাড়ের দুখানা ডানা আছে, তাহা উড়িবার জন্য নয়। হাড়ের ডানাই, পাত্‌লা ডানা এবং সমস্ত দেহটিকে ঢাকিয়া রাখে; ইহাতে সামান্য আঘাত লাগিলে দেহের কোনো ক্ষতি করিতে পারে না। এক দিন একটা গোব্‌রে পোকা রাত্রিতে আমার আলোর চারিদিকে ঘুরিয়া ভয়ানক উৎপাত আরম্ভ করিয়াছিল। জুতা দিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছিলাম,—কিন্তু ইহাতে সে মরে নাই। তাহার সমস্ত শরীরের উপরে যে হাড়ের ডানা ছিল, তাহাই উহাকে রক্ষা করিয়াছিল।

    কিন্তু তাই বলিয়া সকল পতঙ্গের দেহেই যে হাড়ের ডানা আছে, ইহা তোমরা মনে করিয়ো না। গোব্‌রে পোকা জাতীয় পতঙ্গের দেহেই ইহা থাকে। মাছি, প্রজাপতি, মশা প্রভৃতির দেহে হাড়ের ডানা নাই। ইহাদের কাহারো দেহে দুখানা চারিখানা করিয়া পাত্‌লা ডানা দেখা যায়। আবার এ রকম পতঙ্গও অনেক আছে, যাহাদের দেহে ডানার লেশমাত্র নাই। পুরানো বইয়ের মধ্যে যে কাগজ-কাটা সাদা সাদা লম্বা পোকা দেখা যায়, তাহাদের ডানা নাই এবং উকুন ও ছারপোকাদেরও ডানা নাই, কিন্তু তথাপি ইহারা পতঙ্গ।

    গোব্‌রে পোকার মাথা কি রকম তাহা পরীক্ষা করিলে, মাথার নীচে চিংড়ি মাছের দাড়ার মত অনেক অংশ তোমাদের নজরে পড়িবে। এইগুলি লইয়াই গোব্‌রে পোকাদের মুখ প্রস্তুত হইয়াছে। অন্য পতঙ্গদের মুখও প্রায় ঐ-রকম। উপরের ওষ্ঠ, নীচের ওষ্ঠ, খাদ্য চিবাইবার চোয়াল এবং খাদ্য আট্‌কাইবার চোয়াল,—এই চারিটিই মুখের প্রধান অংশ। নীচের ওষ্ঠ ও খাদ্য আট্‌কাইবার চোয়াল, এক-একটা আঙুলের মত অংশ মাত্র। খাদ্য চিবাইবার চোয়াল বড় অদ্ভুত জিনিস। ইহার গায়ে করাতের মত দাঁত-কাটা থাকে, পতঙ্গেরা তাহা দিয়া খাদ্য চিবায়। আমরা প্রায়ই চোয়াল উপর-নীচে নাড়াইয়া খাদ্য চিবাই, পতঙ্গেরা এই রকমে চোয়াল নড়াইতে পারে না। ইহারা চিংড়ি মাছের মত চোয়াল পাশাপাশি চালাইয়া খাদ্য চিবায়।

    প্রজাপতি ও অন্য যে-সকল পতঙ্গ মধু চুষিয়া খায়, তাহাদের মুখের আকৃতি একটু স্বতন্ত্র। আমরা যখন প্রজাপতিদের কথা বলিব, তখন উহাদের মুখের বিবরণ দিব।

    লেজের গঠন প্রায় সকল পতঙ্গেরই এক রকম। পাঁচটা হইতে এগারোটা পর্য্যন্ত আংটি অর্থাৎ গাঁট্ জোড়া দিয়া ইহা প্রস্তুত এবং আংটিগুলি একটার উপরে আর একটা লাগানো থাকে। দূরবীণের নল যেমন একটা আর একটার ভিতরে থাকে, ইহাও যেন সেই রকম। তাই পতঙ্গেরা ইচ্ছা করিলে লেজ ফাঁপাইতে পারে।

    পতঙ্গের শুঁয়ো

    চিংড়ির মাথায় যেমন শুঁয়ো থাকে, পতঙ্গদের মাথায় সেই রকম শুঁড় বা শুঁয়ো আছে। কোলো পতঙ্গের শুঁয়ো লম্বা কোনোটির আবার খুব ছোট। শুঁয়োর আকৃতিও নানা রকম হয়। যাহা হউক, পতঙ্গদের শুঁয়োর আগাগোড়া অখণ্ড জিনিস নয়। অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গাঁট্ জোড়া দিয়া এক একটি শুঁয়ো তৈয়ারি হয়। তাই পতঙ্গেরা যে দিকে খুসি শুঁয়ো হেলাইতে পারে।

    তোমরা বোধ হয় লক্ষ্য কর নাই, পতঙ্গেরা যখন গাছের ডালে বা পাতায় বসিয়া বিশ্রাম করে, তখন তাহারা শুঁয়ে৷ দুটিকে পিঠের উপরে ফেলিয়া রাখে। কোনো জিনিস সম্মুখে পাইলে, আমরা যেমন হাত দিয়া ছুঁইয়া তাহা ঠাণ্ডা, গরম কি শক্ত বুরিয়া লই, পতঙ্গেরা শুঁয়ো দিয়া ছুঁইয়া তাহার ঐরকম পরিচয় গ্রহণ করে। যদি আরসুলার লম্বা শুঁয়োতে হঠাৎ তোমার হাত লাগে, তবে সেই মৃদু স্পর্শও জানিতে পারিয়া আরসুলা পলাইয়া যায়। অনেক পতঙ্গের দেহে নাকের সন্ধান পাওয়া যায় না। সম্ভবত ইহারা শুঁয়ো দিয়াই নাকের কাজ চালায়। যাহাই হউক, শুঁয়ো যে পতঙ্গদের বিশেষ দরকারি ইন্দ্রিয় তাহাতে আর একটুও সন্দেহ নাই। দুইটি পিঁপ্‌ড়ে চলিতে চলিতে মুখোমুখি হইলে কি করে তোমরা দেখ নাই কি? তাহারা শুঁয়ো দিয়া পরস্পরকে ছুঁইতে থাকে, দেখিলে মনে হয় যেন, তাহারা পরস্পর কি বলাবলি করিতেছে।

    পতঙ্গের কান

    কাছে শব্দ হইলে পতঙ্গেরা চারিদিকে ছুটাছুটি আরম্ভ করে এবং হাততালি দিলে পলাইয়া যায়। ইহা দেখিলে বুঝা যায়, শব্দ শুনার জন্য অপর প্রাণীদের ন্যায় পতঙ্গদের কানও আছে। বড় প্রাণীদের কান মাথার উপরে লাগানো থাকে। কিন্তু পতঙ্গের কান শরীরের একই নির্দ্দিষ্ট জায়গায় দেখা যায় না। ফড়িঙের কান তাহাদের পায়ে উপরে লাগানো থাকে।

    পতঙ্গের চোখ

    পতঙ্গদের চোখ বড় আশ্চর্য্যজনক জিনিস। মাছির মাথার দুই পাশে যে দুটা বড় চোখ থাকে, তাহা তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। অনেক পতঙ্গেরই এই রকম চোখ আছে। ইহা ছাড়া বড় চোখ দুটির মাঝামাঝি জায়গায় তাহাদের আরো গোটা তিনেক চোখ থাকে। ছোট চোখ আমাদেরি চোখের মত। কিন্তু বড় চোখ দুটি বড় মজার জিনিস। ইহাদের প্রত্যেকটিতে হাজার হাজার ছোট চোখ জটলা পাকাইয়া থাকে। তাহা হইলে বলিতে হয়, হাজার হাজার ছোট চোখে মিলিয়া পতঙ্গদের একএকটি চোখের সৃষ্টি করে।

    এখানে পতঙ্গের একটা চোখের ছবি দিলাম। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া দেখিলে চোখটিকে যে রকম দেখায়, ছবিতে তাহাই আঁকা আছে। দেখ, মৌমাছির ঘরের মত হাজার হাজার চোখ একত্র হইয়া রহিয়াছে। মাছির মাথায় এই রকম চারি হাজার চোখ থাকে। প্রজাপতিদের চোখের সংখ্যা আরো বেশি। ইহাদের এক-একটি চোখে সতের হাজার ছোট চোখ থাকে। কিন্তু গোব্‌রে পোকারা এ বিষয়ে সকলকেই হারাইয়াছে,—তাহাদের একএকটির মাথায় প্রায় পঁচিশ হাজার চোখ আছে।

    তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, আমাদের দুইটা চোখেই বেশ কাজ চলিয়া যায়; পতঙ্গেরা এতগুলো চোখ লইয়া কি করে? এই কথাটা সত্যই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। যাঁহারা বহুকাল ধরিয়া পোকা-মাকড়ের জীবনের কাজ পরীক্ষা করিয়াছেন, পতঙ্গের এতগুলো চোখের ব্যবহার কি, তাহা তাঁহারাও ঠিক করিতে পারেন নাই। কেহ কেহ বলেন, কোন্ জিনিস উজ্জ্বল এবং কোন্ জিনিস অনুজ্জ্বল, পতঙ্গেরা ঐ-সকল চোখ দিয়া কেবল তাহাই বুঝিতে পারে। এগুলি ছাড়া মাথার উপরে যে পৃথক্ চোখ থাকে তাহা দিয়াই উহারা সব জিনিস স্পষ্ট দেখিতে পায়। স্পষ্ট দেখিলেও পতঙ্গদের দৃষ্টিশক্তি খুব বেশি নয়। কাক, চিল, শকুনি বা অপর প্রাণীরা দুটি ছোট চোখ দিয়া যেমন দেখিতে পায়, পতঙ্গেরা হাজার হাজার চোখ দিয়াও সে-রকম দেখিতে পায় না।

    পতঙ্গের পা

    আমাদের পায়ে মোটামুটি কতগুলি অংশ আছে মনে করিয়া দেখ। কুঁচ্‌কি হইতে হাঁটু পর্য্যন্ত একটা অংশ আছে। তার পরে হাঁটু হইতে পায়ের গোছ পর্য্যন্ত আর একটা অংশ রহিয়াছে। সর্ব্বশেষে আঙ্গুল লইয়া পায়ের পাতা আছে। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, তিনটি বড় অংশ লইয়াই আমাদের পায়ের সৃষ্টি হইয়াছে। আঙুল ইত্যাদিতে অনেক জোড় আছে সত্য, কিন্তু বড় জোড় ঐ তিনটি। পতঙ্গদের পায়ে মোটামুটি ঐ-রকম তিনটি অংশ আছে। আমাদের পায়ের পাতায় যেমন অনেক জোড় থাকে, পতঙ্গদের পায়ের পাতায় সেই রকম জোড় আছে। এই জোড়ের সংখ্যা দুই হইতে পাঁচ পর্য্যন্ত দেখা যায়। এই সকল জোড়ের গায়ে নখের মত অংশ বাহির করা থাকে। কিন্তু সব পতঙ্গের ছয়খানা পা সমান লম্বা নয়। যে-সব পোকা লাফাইয়া চলে, তাহাদের পিছনের দুখানা পা খুব লম্বা হয়। বুড়ো মানুষ শীতের সময়ে যেমন হাঁটু মুড়িয়া বসে, ঐ সকল পোকাদের পিছনের পা স্বভাবতই সেই রকম মোড়া থাকে। ফড়িং ও উচ্চিংড়ের পিছনের পা খুব লম্বা এবং ঐ-রকমে মোড়া আছে দেখিবে। যে-সব পতঙ্গ জলে সাঁতার দিতে পারে, তাহাদের পায়ের পাতা বেশ চওড়া থাকে। দাঁড় টানিয়া যেমন নৌকা চালানো হয়, দাঁড়ের মত চওড়া পায়ে জল কাটিয়া তাহারা সাঁতার দেয়। মাছিরা কি-রকমে চলে, তাহা তোমরা দেখিয়াছ। তাহারা ফড়িঙের মত লাফায় না। বেশ ভদ্রভাবে পা ফেলিয়া চলে, আবার খাড়া দেওয়ালের গায়ের উপর দিয়া বেশ চলিয়া বেড়ায়। দেওয়ালের গা হইতে কেন পড়িয়া যায় না,—ইহা তোমাদের কাছে আশ্চর্য্য বলিয়া বোধ হয় না কি? আমি ছেলেবেলায় ভাবিতাম, আমরা দেওয়ালের গায়ে পা দিয়া চলিতে পারি না, তবে কেন পিঁপ্‌ড়ে ও মাছিরা দেওয়ালের গায়ে পা লাগাইয়া ছুটাছুটি করে?

    তোমাদিগকে প্রথমে একটা খুব সাধারণ কথা বলিব। ইহা বুঝিতে পারিলে, টিক্‌টিকি প্রভৃতি প্রাণীরা মাটিতে না পড়িয়া কি-রকমে দেওয়ালের গায়ে হাঁটিয়া বেড়ায়, তাহা বুঝিতে পারিবে। চাবির যে দিক্‌টায় ছিদ্র থাকে, সেটা মুখের মধ্যে দিয়া ভিতরকার বাতাস টানিয়া লইলে কি হয়, তোমরা দেখ নাই কি? আমরা ছেলেবেলায় একটা চাবি পাইলেই মুখে দিয়া তাহার ছিদ্রের ভিতরকার বাতাস টানিয়া লইতাম। এই অবস্থায় চাবিটার মুখ জোরে জিভে বা ওষ্ঠে লাগিয়া যাইত। তোমরা একবার এই রকম পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ো। চাবির ছিদ্রে বাতাস থাকে না, তাই বাহিরের বাতাসের চাপে চাবি জিভে বা ওষ্ঠে আট্‌কাইয়া যায়। টিক্‌টিকি প্রভৃতির পায়ের পাতায় কতকটা ঐ-রকম ব্যবস্থা আছে। পায়ের তলা হইতে উহারা বাতাস বাহির করিতে পারে। এই জন্য বাহিরের বাতাসের চাপে পা দেওয়ালের গায়ে জোরে আট্‌কাইয়া যায়। কিন্তু মাছিরা যে-রকমে দেওয়ালে পা আট্‌কাইয়া চলা-ফেরা করে, তাহা স্বতন্ত্র। আমরা যখন মাছির কথা বলিব, তখন এই বিষয়টি ভালো করিয়া বুঝাইব।

    গঙ্গা ফড়িঙের সম্মুখের দু’টা পা খুব বড় এবং মোটা। সেগুলির গায়ে আবার করাতের মত দাঁত-কাটা। ইহারা এই দুটি পা অস্ত্রের মত ব্যবহার করে। প্রজাপতির পা আবার অন্য রকমের। পিছনের পা এত ছোট যে, তাহা নাই বলিলেই হয়। সাম্‌নের পায়েই উহাদের কাজ চলিয়া যায়। যে-সব পতঙ্গ মাটির তলে গর্ত্তে বাস করে, তাহাদের পা মাটি খোড়া এবং তাহা সরাইয়া ফেলিবার উপযুক্ত করিয়া প্রস্তুত হইয়াছে; সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, পতঙ্গের যে-রকমটি দরকার পায়ের আকৃতি প্রকৃতি ঠিক সেই রকম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা খুব আশ্চর্য্য ব্যাপার নয় কি?

    পতঙ্গের দেহের ভিতরকার কথা

    পতঙ্গের দেহের উপরকার অনেক কথা বলা হইল; এখন ইহাদের পাকাশয় ইত্যাদি ভিতরকার খবর মোটামুটি বলিব। এখানে একটা ছবি দিলাম, ইহাতে পতঙ্গের শরীরের ভিতরকার নাড়িভুঁড়ি আঁকা আছে।

    আমাদের মুখের ভিতরটা সর্ব্বদাই ভিজে থাকে। ইহার উপরে যদি খাদ্য মুখে পড়ে, তবে লালা বাহির হইয়া মুখের খাদ্যকে ভিজাইয়া ফেলে। এই লালা কোথা হইতে আসিয়া মুখে জমা হয়, তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। আমাদের মুখের মধ্যে চারি পাঁচ জায়গায় ছোট রসুন বা পেঁয়াজের কোষের মত মাংসগ্রন্থি আছে। লালা সঞ্চয় করিবার জন্যই এগুলির সৃষ্টি। তাই গ্রন্থিগুলিতে আপনা হইতেই লালা জমা হয় এবং তাহা প্রয়োজন-অনুসারে সরু নল দিয়া মুখের সর্ব্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। একটু তেঁতুল বা লেবুর টুক্‌রা মুখে রাখিয়া তোমরা পরীক্ষা করিয়ো; স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে জিভের গোড়া এবং নীচেকার চোয়ালের কাছ হইতে লালা আসিয়া মুখে জমিতেছে। মুখের ঐ-সব জায়গাতে লালার গ্রন্থি আছে। এইগুলি মাংসের মধ্যে বসানো থাকে; সুতরাং মুখে আঙুল দিয়া বা আয়নায় মুখের ছবি দেখিয়া সেগুলিকে দেখিতে পাইবে না। কেবল মানুষেরই মুখে যে লালা-গ্রন্থি আছে, তাহা নয়; পতঙ্গদের মুখেও উহা দেখা যায়। ফড়িং-জাতীয় পতঙ্গের মুখে ঐ-রকম গ্রন্থি দুই তিন জায়গায় আছে। খাইবার সময়ে ইহারা ঘাস পাতা বা অপর খাদ্য লালা দিয়া ভিজাইয়া গিলিয়া ফেলে।

    ছবিতে প্রথমেই পতঙ্গের মাথা ও শুঁয়ো রহিয়াছে দেখিবে। তার পরেই গলার নল; এই নল দিয়া খাদ্য নামিয়া পল-কাটা থলিতে পৌঁছে। এখানে খাদ্য পরিপাক হয় না,—জমা থাকে মাত্র। ইচ্ছা করিলে অনেক পতঙ্গ ঐ থলি হইতে খাবার উগ্‌লাইয়া বাহির করিতে পারে। পিঁপ্‌ড়েরা খাদ্য এই রকমে উগ্‌লাইয়া নিজেদের বাচ্চাকে খাইতে দেয়; পাখীরাও তাহা করে। ইহার পরে যে থলিটি দেখিতেছ; তাহা বড় মজার। ইহার মধ্যে হাড়ের মত শক্ত জিনিসে প্রস্তুত অনেক দাঁত সাজানো আছে। পতঙ্গেরা ভালো করিয়া খাদ্য চিবাইয়া খায় না; কিন্তু খাদ্য না চিবাইলে হজমও হয় না। পেটের ভিতরে গিয়া খাদ্য যাহাতে চিবানো হয় তাহার জন্যই এই থলিতে দাঁত বসানো আছে। খাদ্য এখানে পৌঁছিলেই দাঁতের ধারে লম্বা লম্বা পাতা ও ঘাস ছোট ছোট টুক্‌রাতে বিভক্ত হইয়া যায়।

    যাহা হউক ছবিতে এই দাঁত-ওয়ালা থলির পরেই যে মোটা থলিটি রহিয়াছে, তাহাই পতঙ্গদের পেট বা উদর। এখানে খাদ্য হজম হয়। ইহার সঙ্গে যে নল লাগানো আছে তাহা দিয়া সেই হজম-করা খাদ্য দেহের শেষ পর্য্যন্ত পৌঁছায়, এবং যাহা অনাবশ্যক তাহা বিষ্ঠার আকারে চিত্রের তলাকার অংশ দিয়া বাহির হইয়া যায়।

    ছবির দুই পাশে যে সূতার মত সরু নল জটলা করিয়া রহিয়াছে, তাহা হইতে নানা রকম রস বাহির হয়, এবং সেই রসে খাদ্য হজম হয়। ছবির শেষে দুই পাশে যে, আরো দুটি থলি ও ফুলের মত অংশ দেখিতেছ, এগুলি হইতেও কয়েক রকম রস বাহির হয়। কিন্তু ইহা হজমের কাজে লাগে না। মৌমাছি, পিঁপ্‌ড়ে এবং কাঁক্‌ড়া বিছের হুলে বিষ থাকে ইহা তোমরা জান। এই বিষ-রস ঐ-সকল যন্ত্রে উৎপন্ন হয়।

    পতঙ্গের শ্বাস-প্রশ্বাস

    পতঙ্গদের নিশ্বাস টানার ও নিশ্বাস ফেলার যন্ত্রটি অতি চমৎকার। শ্বাস-প্রশ্বাসের এ-রকম যন্ত্র পতঙ্গ ছাড়া আর কোনো প্রাণীতে দেখা যায় না।

    এখানে একটা পোকার লেজের কতকটার ছবি দিলাম। ছবির চারিধারে মালার মত যে জিনিসটা দেখিতেছ, উহা ফাঁপা নল। পতঙ্গেরা বাহিরের বাতাস লেজের তলার এই সকল নলের ভিতর দিয়া লইয়া শরীরের সর্ব্বত্র চালাইয়া দেয়। এই ব্যবস্থায় বাতাসের অক্সিজেন্ টানিয়া লইয়া পতঙ্গদের দেহের রক্ত পরিষ্কৃত হয়। কাজেই নলের ভিতরে বাতাসের চলাচলই নিশ্বাসের কাজ করে।

    নল খুব বেশি লম্বা হইলে অনেক গোলমালে পড়িতে হয়। লম্বা নল প্রায়ই মাঝে তুব্‌ড়াইয়া যায় এবং তুব্‌ড়াইয়া গেলে নলের ছিদ্র বন্ধ হইয়া যায়;—তখন তাহা দিয়া আর কাজ চলে না। বড় বড় সহরের রাস্তায় যে-সকল লম্বা নল দিয়া জল ছিটানো হয়, সেগুলি যাহাতে তুব্‌ড়াইয়া না যায়, তাহার জন্য কি-রকম ব্যবস্থা আছে, তোমরা দেখ নাই কি? নলের গায়ে এবং কখনো কখনো নলের ভিতরে লোহা বা অপর কোনো ধাতুর মোটা তার জড়াইয়া রাখা হয়। ইহাতে নলের ছিদ্র তুব্‌ড়াইয়া বন্ধ হয় না। নিশ্বাস টানিবার জন্য পতঙ্গের দেহের যে নল তাহা কম লম্বা নয়। কাজেই মাঝে মাঝে ইহার ছিদ্র বন্ধ হইবার আশঙ্কা থাকে এবং তাহাতে পতঙ্গের মৃত্যু হইবার ভয়ও থাকে। এই আশঙ্কা নিবারণ করিবার জন্য ইহাদের দেহের নলের ভিতরে লোহার ইস্প্রিঙের মত সরু তার লাগানো থাকে। যে হাড়ের মত শক্ত জিনিসে পতঙ্গের দেহ ঢাকা থাকে, সেই জিনিস দিয়াই ঐ-সকল নল প্রস্তুত। কাজেই ঐ জড়ানো তার ভিতরে থাকিয়া নলগুলিকে সর্ব্বদা ফাঁপাইয়া রাখে; ইহাতে নল তুব্‌ড়াইতে পারে না।

    এখন তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, পতঙ্গের দেহের নলে বাহিরের বাতাস প্রবেশের পথ কোথায়? আমরা যেমন নাক মুখ দিয়া বাতাস টানিয়া ফুস্‌ফুসে প্রবেশ করাই, পতঙ্গেরা নিশ্বাস টানার কাজে নাক বা মুখের ব্যবহার করে না। উহাদের লেজের উপরকার প্রত্যেক আংটির পাশে দুইটা করিয়া ছিদ্র থাকে; বাহিরের বাতাস এই সকল ছিদ্র দিয়া নলে প্রবেশ করে। ছবিতে লেজের দুই পাশে যে কালো দাগগুলি দেখিতেছ, তাহাই বাতাস আসা-যাওয়ার পথ।

    তোমরা যদি বোল্‌তা ফড়িং বা অপর পতঙ্গের লেজের অংশ ভালো করিয়া পরীক্ষা কর, তবে দেখিবে, ইহাদের লেজের দিক্‌টা সর্ব্বদা তালে তালে উঠানামা করিতেছে। আমরা নিশ্বাস টানিবার সময়ে বুক্ ফুলাই এবং নিশ্বাস ফেলিবার সময় বুক সঙ্কুচিত করি, কাজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের বুক্ তালে তালে উঠা-নামা করে। পতঙ্গেরা লেজটাকে ফুলাইয়া এবং সঙ্কুচিত করিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালায়।

    পতঙ্গদের নিশ্বাস লওয়া ও নিশ্বাস ছাড়ার কাজ খুব ঘন ঘন চলে। এইজন্য প্রাণরক্ষার জন্য ইহাদের অনেক বাতাসের দরকার হয়। আবদ্ধ ছোট জায়গায় আট্‌কাইয়া রাখিলে, ভালো বাতাসের অভাবে ইহারা মড়ার মত হইয়া যায়, কিন্তু একেবারে মরে না। তার পরে সেগুলিকে যদি কিছুক্ষণ ভালো বাতাসে রাখা যায় তবে আবার সুস্থ হইয়া উঠে।

    বাতাসের অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করিলে প্রাণীরা পুষ্ট হয় এবং তাহাদের লাফালাফি ও চলা-ফেরা করিবার শক্তি বাড়ে। পতঙ্গদের দেহের অনেক জায়গায় নিশ্বাস টানিবার নল লাগানো থাকায় তাহারা অনেক অক্সিজেন পায়। এই জন্যই পতঙ্গেরা এত ছুটাছুটি ও লাফালাফি করিয়াও সহজে ক্লান্ত হয় না।

    পতঙ্গের রক্ত-চলাচল

    পতঙ্গের শরীরে কি-রকমে রক্ত চলাচল করে, এখন তোমাদিগকে তাহারি কথা বলিব।

    রক্ত কথাটা শুনিলে লাল রঙের কথা মনে পড়ে, কারণ সকল বড় প্রাণীরই রক্ত লাল। চিংড়ি মাছের রক্ত লাল নয় ইহা তোমরা আগে শুনিয়াছ। পতঙ্গদের রক্তও লাল নয়; ইহা বর্ণহীন রসের মত।

    শরীরের সকল অংশকে পুষ্ট করিবার জন্য প্রাণীদের দেহের সর্ব্বত্র রক্তের যাওয়া-আসা দরকার। বড় প্রাণীদের হৃৎপিণ্ড আছে, তাহাই পম্পের মত চলিয়া শরীরে রক্তের স্রোত চালায়; কত শিরা-উপশিরা দিয়া সেই রক্তের ধারা চলে। পতঙ্গদের দেহেও হৃৎপিণ্ড আছে। লম্বা নলের মত এই যন্ত্রটি পতঙ্গের ঠিক পিঠের নীচে থাকে; এবং শরীরের কোনো জায়গায় শিরারও খোঁজ পাওয়া যায়।

    পতঙ্গের স্নায়ুমণ্ডলী

    এ-পর্য্যন্ত যাহা বলিলাম, তাহা হইতে বুঝা যায়, বড় প্রাণীদের শরীরে যে-সব ব্যবস্থা আছে, অনেক স্থলে তাহারি উল্‌টা ব্যবস্থা পতঙ্গদের শরীরে দেখা যায়। আমাদের দেহে যেমন হাড় আছে, পতঙ্গের শরীরেও সেই রকম হাড় আছে। কিন্তু তাহা মাংসের ভিতরে থাকে না, পতঙ্গের হাড় চাম্‌ড়ার মত সমস্ত দেহকে ঢাকিয়া রাখে। আমাদের দেহের সমস্ত যন্ত্র শরীরের সম্মুখভাগে থাকে, পতঙ্গদের শরীর-যন্ত্র পিঠের উপরে থাকে। আমাদের কেবল দুইটি মাত্র চোখ, কিন্তু পতঙ্গদের চোখের সংখ্যা দশ হাজার বিশ হাজারের কম নয়। নাক কান প্রভৃতি ইন্দ্রিয় আমাদের শরীরের একএকটা নির্দ্দিষ্ট জায়গায় থাকে। কিন্তু যাহাদের কান পায়ের গোড়ায় এবং নাক শুঁয়োর আগায়, এরকম পতঙ্গও অনেক পাওয়া যায়। আবার এ-রকম পতঙ্গ অনেক আছে, যাহাদের নাক বা কান শরীরের কোন্ জায়গায় লুকাইয়া রহিয়াছে, তাহার সন্ধানই পাওয়া যায় না; অথচ তাহারা আমাদেরি মত শব্দ শুনিতে পায় এবং গন্ধ শুঁকিয়া খাবার সংগ্রহ করে।

    পতঙ্গদের স্নায়ুমণ্ডলীও আমাদের স্নায়ুমণ্ডলীর তুলনায় দেহে উল্‌টা রকমে সাজানো আছে। মেরুদণ্ড-যুক্ত প্রাণীদের প্রধান স্নায়ুর তারগুলি শাখা-প্রশাখা ছড়াইয়া পিঠের দিকে থাকে, কিন্তু পতঙ্গের স্নায়ু শরীরের নীচের দিকে ছড়ানো দেখা যায়। চিংড়ির স্নায়ুর কথা তোমরা আগেই শুনিয়াছ। পতঙ্গের স্নায়ু চিংড়ির স্নায়ুরই মত। দুইটা মোটা স্নায়ুর সূতা ইহাদের দেহের তল দিয়া আগাগোড়া বিস্তৃত থাকে এবং এই সূতার প্রত্যেকটি হইতে অনেক ছোট সূতা বাহির হইয়া দেহে ছড়াইয়া পড়ে। আবার মাঝে মাঝে ঐ-সকল স্নায়ুর সূতা জটলা পাকাইয়া স্নায়ুর কেন্দ্রের সৃষ্টি করে। এই সকল কেন্দ্র দিয়া কতকটা মস্তিষ্কের কাজ চলে। পতঙ্গদের মাথার আসল মস্তিষ্ক খুব ছোট। দেহের তলার সেই মোটা স্নায়ুর সূতা হইতে কয়েকটি সরু সূতা বাহির হইয়া মাথার এক জায়গায় একত্র হয় এবং তাহাই কোনো রকমে মস্তিষ্কের কাজ চালায়। পতঙ্গের শুঁয়ো ও চোখ এই মস্তিষ্কের সহিত যুক্ত থাকে।

    পিঁপ্‌ড়ে ও মৌমাছিরা খুব উন্নত প্রাণী। ইহার দলবদ্ধ হইয়া সমাজের সৃষ্টি করিতে জানে এবং সমাজের উন্নতির জন্য বুদ্ধিমান্ প্রাণীর মত অনেক বুদ্ধি খরচ করিয়া সমাজের কাজ চালায়। ইহাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ু-মণ্ডলী অনেকটা উন্নত ও জটিল।

    তোমরা বোধ হয় দেখিয়াছ, বোল্‌তা, ফড়িং প্রভৃতির মাথা কাটিয়া ফেলিলে, ইহাদের কাটা মাথা ও দেহ অনেকক্ষণ জীবিত থাকে। কিন্তু মাথা কাটা গেলে মানুষ গরু ভেড়া অল্প ক্ষণেই মারা যায়। পতঙ্গদের মস্তিষ্ক নিতান্ত ছোট এবং তাহাদের দেহের জায়গায় জায়গায় মস্তিষ্কের মত স্নায়ু-কেন্দ্র ছড়াইয়া আছে, সেই জন্য মাথা কাটা গেলেও তাহাদিগকে অনেকক্ষণ বাঁচিয়া থাকিতে দেখা যায়।

    বড় প্রাণীদের দেহে স্নায়ু বেশি এবং পতঙ্গদের শরীরে স্নায়ু অল্প। এইজন্য আঘাত পাইলে বড় প্রাণীরা পতঙ্গদের চেয়ে বেশি বেদনা বোধ করে। আমাদের একটা আঙুলের ডগায় ছুরির খোঁচা লাগিলে, কত বেদনা হয়, তাহা মনে করিয়া দেখ। কত জলপটি, কত ওষুধ না দিলে বেদনা কমে না, হয় ত রাত্রে ঘুমই হয় না। আমাদের দেহের প্রায় সকল জায়গায় অনেক স্নায়ু আছে বলিয়া এই বেদনা বোধ করি। আবার শরীরের যে-সব জায়গায় খুব বেশি স্নায়ু আছে, সেখানে আঘাত লাগিলে বেদনাও খুব বেশি হয়। কিন্তু একটা আরসুলার যদি মাথাটা থেঁত্‌লাইয়া যায়, বা একখানা পা ভাঙিয়া যায়, সে এই আঘাত হঠাৎ গ্রাহ্য করে না—খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে ঘরের কোণের দিকে ছুটিয়া পালায়। শরীরে বেশি স্নায়ু নাই বলিয়াই ইহারা ঐরকম আঘাতের বেদনা বুঝিতে পারে না,—এইজন্য আঘাতে আমাদের যত কাতর করে, পোকা-মাকড়দের তত কাতর করিতে পারে না। প্রতিদিনই আমাদের পায়ের চাপে কত পিঁপ্‌ড়ে, কত পোকা আঘাত পায়, তাহা একবার ভাবিয়া দেখ। তা ছাড়া আরো কত কারণে কত পতঙ্গ যে প্রতি-মুহূর্ত্তে খোঁড়া হইতেছে এবং অঙ্গহীন হইতেছে, তাহা গুণিয়া ঠিক করা যায় না। ইহাদের বেদনা-বোধের শক্তি যদি আমাদেরি মত হইত, তবে তাহারা কত কষ্ট পাইত, একবার ভাবিয়া দেখ। উহারা যদি আমাদের মত চেঁচাইয়া কাঁদিতে জানিত, তবে মশা, মাছি, পিঁপ্‌ড়ে আরসুলা প্রভৃতি পতঙ্গের কান্নার রোলে কান-পাতা যাইত না। ভগবান্ দয়া করিয়া উহাদের দেহে স্নায়ুর পরিমাণ অল্প রাখিয়াছেন বলিয়া উহাদের কষ্ট অনেক কমিয়া গিয়াছে। ভগবানের কেমন সুব্যবস্থা একবার ভাবিয়া দেখ।

    পতঙ্গের দেহে কি-রকমে স্নায়ুর সূতা ছড়ানো আছে, এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম। ইহাদের শরীরে স্নায়ুর পরিমাণ কত অল্প, ছবি দেখিলেই তোমরা তাহা বুঝিতে পারিবে।

    পতঙ্গের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ

    পতঙ্গদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের ভেদ আছে। ইহাদের কতক স্ত্রী এবং কতক পুরুষ হইয়া জন্মে। জোনাক-পোকা-জাতীয় কয়েকটি পতঙ্গের স্ত্রী ও পুরুষের চেহারা সম্পূর্ণ পৃথক। অন্যান্য পোকা-মাকড়ের স্ত্রী ও পুরুষ প্রায়ই ছোট বা বড় হইয়া জন্মে। মৌমাছিদের স্ত্রী খুব বড়। প্রায় সমস্ত পতঙ্গই ডিম পাড়ে এবং তাহা হইতে বাচ্চা হয়। প্রথমেই বাচ্চা প্রসব করে এমন পতঙ্গও আছে; কিন্তু ইহাদের সংখ্যা খুবই অল্প।

    যে-রকমে পতঙ্গেরা ডিম প্রসব করে, তাহা বড় মজার। ইহাদের লেজের শেষে ছিদ্রযুক্ত এক রকম ছুঁচের মত অস্ত্র থাকে। পাতার গায়ে, গাছের ছালে বা মাটিতে সেই অস্ত্র দিয়া ইহারা ছোট গর্ত্ত করে এবং পরে অস্ত্রের মুখের সেই ছিদ্র দিয়া গর্ত্তে ডিম পাড়ে। আবার এ-রকম পতঙ্গও অনেক আছে, যাহারা লতাপাতার গায়ে লালার মত জিনিস দিয়া ডিম আট্‌কাইয়া রাখে। ইহারা পাতায় ছিদ্র করে না। ডিম পাড়িবার সময়ে পতঙ্গেরা বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ-সম্বন্ধে অনেক বিবেচনা করে। ডিম হইতে বাহির হইয়াই বাচ্চারা যেখানে অনেক খাবার মুখের গোড়ায় পাইবে, সেই রকম জায়গাতেই উহাদিগকে ডিম পাড়িতে দেখা যায়। ইহা আশ্চর্য্য নয় কি? তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, পতঙ্গদের বুদ্ধি বুঝি মানুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু তা নয়,—ভগবান্ তাহাদের মনে এমন একটা সংস্কার করিয়া দিয়াছেন যে, তাহারা কলের মত চলিয়া উপযুক্ত জায়গায় ডিম পাড়ে। আমরা যেমন অনেক চিন্তা এবং অনেক বিচার করিয়া কাজ করি, তাহারা সে-রকম করে না; অন্ধ সংস্কারের তাড়ায় সকল কাজ-কর্ম্ম করে। বাহির হইতে দেখিলে মনে হয়, তাহারা অনেক বুদ্ধি খরচ করিয়া কাজ করিতেছে।

    পতঙ্গের আকৃতি-পরিবর্ত্তন

    গোরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি বড় জন্তুদিগকে যদি জন্মের পর হইতে মৃত্যু পর্য্যন্ত পরীক্ষা করা যায়, তবে বয়সের সঙ্গে তাহাদের আকৃতির খুব বেশি পরিবর্ত্তন দেখা যায় না। বাছুর ও বুড়ো গাইয়ের চেহারায় বিশেষ তফাৎ নাই। বাছুর আকারে ছোট এবং বুড়ো গাই আকারে বড়, হয় ত তাহার শিং লম্বা,—ইহাই একমাত্র তফাৎ। মানুষের অবস্থাও তাই। জন্মিবার সময়ে মানুষের যে দুই হাত, দুই পা, একটা মাথা ইত্যাদি থাকে, বুড়ো বয়স পর্য্যন্ত ঠিক্ তাহাই থাকে। কেবল পুরুষদের মুখে দাড়ি গজায় মাত্র। বয়সের সঙ্গে মানুষের দুখানা হাত কখনই চারিখানা হয় না এবং দুটা চোখ কখনই তিনটা চোখ হইয়া দাঁড়ায় না।

    আমরা গোরু ও ছাগল-সম্বন্ধে যে কথাগুলি বলিলাম, মাছ পাখী সাপ ব্যাঙ্ সম্বন্ধে কিন্তু সে-কথা বলা চলে না। মাতার দেহ হইতে বাহির হইয়া তাহারা প্রথমে ডিমের ভিতরে থাকে, তার পরে সম্পূর্ণ আকার লইয়া ডিম হইতে বাহির হয়। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, মাছ ও পাখীরা মাতার দেহ ছাড়িয়া দুই রকম অবস্থায় থাকে।

    পতঙ্গেরা ডিম হইতে জন্মে তাহা তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি। কিন্তু ডিম হইতে বাহির হইয়াই ইহারা মাছ বা পাখীদের মত সম্পূর্ণ পতঙ্গের চেহারা পায় না। ডিম হইতে বাহির হইলে ইহাদের যে চেহারা হয়, তাহা দুইবার বদ্‌লাইয়া শেষে সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকৃতি পায়। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে—বয়স-অনুসারে একই পতঙ্গ তিন রকম চেহারা পায়। শেষ চেহারাটিই পতঙ্গদের সম্পূর্ণ আকৃতি।

    বিষয়টা একটু খোলসা করিয়া বলা যাউক। আজ যে প্রজাপতিটিকে বা মাছিটিকে তোমরা সম্মুখে উড়িয়া বেড়াইতে দেখিতেছ—সে ডিম হইতে বাহির হইয়াই প্রজাপতির আকার পায় নাই। ইহার জীবনের ইতিহাস খোঁজ করিলে জানিতে পারিবে, কয়েক মাস পূর্ব্বে ইহারি মত একটি প্রজাপতি কোনো গাছের পাতায় অনেক ডিম প্রসব করিয়া রাখিয়াছিল এবং সেই ডিমের মধ্যে একটি হইতে তোমার সম্মুখের প্রজাপতিটি জন্মিয়াছে। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, পাখীরা যেমন ডিম হইতে চোখ মুখ ঠোঁট লইয়া বাহির হয়, প্রজাপতিও বুঝি সেই রকমে চোখ মুখ ডানা লইয়া বাহির হইয়াছে। কিন্তু তাহা নয়। ডিম হইতে প্রজাপতি কখনই প্রজাপতির আকারে বাহির হয় না। বাগানের গাছে, ঘাসে, লতাপাতায় তোমরা নিশ্চয়ই অনেক সময়ে শুঁয়ো-পোকা দেখিয়াছ। ইহাদের কাহারো রঙ্ সাদা, কাহারো রঙ্ পাটকিলে, কেহ সবুজ, কাহারো গায়ে আবার নানা রঙের ডোরা কাটা, কাহারো গা আবার লোমে ঢাকা। ইহাদের অনেকেই সম্মুখে তিন জোড়ায় ছয়খানা পা এবং পিছনে আরো অনেক পা থাকে এবং সম্মুখের ছয়খানা পায়ে কাহারো কাহারো নখও লাগানো থাকে। নখ দিয়া গাছের পাতা বা কচি ডাল ধরিয়া তাহারা ডালে ডালে পাতায় পাতায় চলিয়া বেড়ায়। গাছের কচি পাতা বা মরা ও পচা জীবজন্তুর দেহ ইহাদের খাদ্য। ছোট গাছে শুঁয়ো-পোকা ধরিলে গাছের কি রকম ক্ষতি হয়, তোমরা দেখ নাই কি? তাহারা গাছের কচি পাতা খাইতে আরম্ভ করে, ইহাতে গাছ মরিয়া যায়। পাখীরা খুঁজিয়া খুঁজিয়া গাছ হইতে শুঁয়ো পোকা বাহির করিয়া খাইয়া ফেলে। কিন্তু সব পোকা পাখীর খাদ্য নয়, যাহাদের গা চুলের মত লোম দিয়া ঢাকা থাকে, তাহাদিগকে পাখীরা খায় না। তা ছাড়া গায়ের রঙ্ দেখিয়াও কোন্ শুঁয়ো-পোকা খাদ্য এবং কোন্‌টা অখাদ্য, তাহা পাখীরা বুঝিয়া লইতে পারে। যাহা হউক, এই শুঁয়োপোকার দল কোথা হইতে কি-রকমে জন্মে, তোমরা খোঁজ করিয়া দেখিয়াছ কি? এইগুলিই প্রজাপতির এবং অন্য পতঙ্গদের বাচ্চা। ডিম ফুটিলেই এই রকম আকারে পতঙ্গেরা বাহির হয়। গোব্‌রে-পোকা, মশা, মাছি, সকলেই ডিম হইতে বাহির হইয়া এই রকম আকৃতি পায়।

    তোমরা যদি একটি শুঁয়ো-পোকা ধরিয়া পরীক্ষা কর, তবে দেখিবে, ইহার গায়ে তেরোটি আংটির মত দাগ কাটা রহিয়াছে। অনেক শুঁয়ো-পোকারই শরীরে এই রকম তেরোটি দাগ থাকে। কাহারো কাহারো আবার মাথায় চোখ থাকে, কিন্তু এই চোখ সাধারণ পতঙ্গের মত হাজার হাজার চোখের সমষ্টি নয়,—ইহা আমাদেরি চোখের মত সাদাসিদে ধরণের। তার পরে, আরো ভালো করিয়া পরীক্ষা করিলে ইহাদের মুখে দাঁতের মত অংশ দেখিতে পাইবে,—ইহা খাবার সংগ্রহের সাহায্য করে, আবার গাছের পাতা কামড়াইয়া চলাফেরারও সুবিধা করাইয়া দেয়।

    প্রজাপতি বা অপর পতঙ্গের বাচ্চা শুঁয়ো-পোকার আকারে কতদিন থাকে, তোমরা বোধ হয় ইহাই এখন জানিতে চাহিতেছ। কিন্তু ইহার উত্তর দেওয়া বড় কঠিন। তোমাদের ফুলের বাগানে কত রঙ্‌বেরঙের প্রজাপতি এবং আরো কত পতঙ্গ উড়িয়া বেড়ায় দেখ নাই কি? ইহাদের প্রত্যেকেই ভিন্ন জাতীয় পতঙ্গ। জাতি-অনুসারে ইহাদের বাচ্চারা শুঁয়ো-পোকার আকারে কেহ বিশ দিন, কেহ অল্প দিন থাকে। কোনো কোনো পতঙ্গকে এক বৎসর দুই বংসর এমন কি পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত শুঁয়ো-পোকার আকারে থাকিতে দেখা গিয়াছে। আমেরিকায় এক রকম পতঙ্গ আছে, যাহারা সতেরো বৎসর এই আকারে থাকে। আবার এক রকম পতঙ্গও আছে, যাহাদের বাচ্চারা শুঁয়ো-পোকার আকারে পাঁচ-ছয় দিন বা তাহা অপেক্ষাও অল্প দিন থাকে। কাজেই এ-সম্বন্ধে ঠিক কথা বলা যায় না।

    পাখীরা তাহাদের বাসায় ডিম পাড়ে, ডিমের উপরে বসিয়া তা দেয়, তার পরে ডিম ফুটিয়া বাচ্চা বাহির হয়। ইহার পরেও পাখীরা বাচ্চাদের জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করে। যতদিন উড়িতে না শিখে, ততদিন পাখীরা নানা জায়গা হইতে পোকা-মাকড় ধরিয়া আনিয়া ছানাদের খাওয়ায়। পতঙ্গেরা কিন্তু বাচ্চাদের মোটেই যত্ন করে না। যেখানে বাচ্চাদের খাবার আছে, এমন জায়গায় ডিম পাড়িয়াই তাহারা খালাস। ইহার পরে পতঙ্গদের সঙ্গে বাচ্চাদের কোনো সম্পর্কই থাকে না। জন্মে আর একটিবার দেখা-শুনাও হয় না; অনেক পতঙ্গ ডিম পাড়িয়াই মারা যায়।

    তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, মায়ের আদর না পাইয়া পতঙ্গের বাচ্চাদের বুঝি খুবই কষ্ট হয়। কিন্তু তাহা হয় না। ডিম হইতে শুঁয়ো-পোকার আকারে বাহির হইয়াই সম্মুখের লতাপাতায় তাহারা অনেক খাদ্য পায় এবং একটু বিশ্রাম না করিয়াই সেই সকল খাবার অবিরাম খাইতে থাকে। কাহারো কাহারো মাথার উপরে চোখ থাকে, কিন্তু তাহা বেশি কাজে লাগে না। অন্ধ লোকেরা যেমন হাত-পা দিয়া কাছের জিনিস ছুঁইতে ছুঁইতে রাস্তা ঠিক করে, ইহারাও তেমনি শরীরের স্পর্শ দিয়া নিজের খাদ্য ও খাদ্যের কাছে যাইবার রাস্তা বাহির করে।

    পেটুক লোক যখন ভোজ খাইতে বসে, তখন সে কি রকমে গ্রাসে গ্রাসে খাদ্য মুখে দেয়, তোমরা দেখ নাই কি? তখন তাহারা নিশ্বাস লইবার জন্য মাঝে মাঝে থামে, আবার রাক্ষসের মত খাইতে আরম্ভ করে। পেটে যতক্ষণ একটুও জায়গা থাকে, ততক্ষণ খাওয়া বন্ধ করে না। কিছু জিজ্ঞাসা করিলে জবাব দেয় না,—মুখ খাবারে পূর্ণ—জবাব দিবে কি করিয়া? শুঁয়ো-পোকারা পেটুক লোকের মত একান্ত মনে আহার করে। দিবারাত্রি খাওয়া চলে, নিশ্বাস লইবার জন্যও খাওয়া ছাড়ে না। ইহাদের দেহের যে সরু নলের কথা আগে বলিয়াছি, তাহার ভিতর দিয়া আপনা হইতেই বাতাস যাওয়া-আসা করিয়া নিশ্বাসের কাজ চালায়।

    প্রয়োজন মত খাদ্য হজম করিতে পারিলে, প্রাণীর দেহ পুষ্ট হয়। শুঁয়ো-পোকারা যেমন খায়, তেমনি হজম করে। কাজেই শীঘ্র শীঘ্র তাহারা আকারে বড় হইয়া উঠে। চিংড়িমাছেরা যখন আকারে বাড়িতে থাকে, তখন তাহারা কি করে আগেই শুনিয়াছ। তাহারা গায়ের সেই কঠিন খোলা বদ্‌লাইয়া ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ছোট খোলার জায়গায় গায়ে বড় খোলা আপনা হইতেই উৎপন্ন হয়। খাইয়া মোটা হইলে পতঙ্গদের বাচ্চা অর্থাৎ শুঁয়ো-পোকারাও তাহাই করে, তখন তাহাদের গায়ের চামড়া ফাটিয়া বসিয়া পড়ে এবং পুরানো চামড়ার জায়গায় নূতন চামড়া জন্মে। চামড়া বদ্‌লাইবার কয়েক দিন আগে এবং পরে উহাদিগকে একটু অসুস্থ হইতে দেখা যায়। তখন তাহারা ভালো করিয়া খায় না, কয়েক দিন চুপ-চাপ কাটাইয়া দেয়। শুঁয়ো-পোকারা এই রকমে তিন চারিবার খোলস্ ছাড়ে; কোনো কোনো পোকা সাত-আটবার পর্য্যন্তও চামড়া বদ্‌লায়।

    ক্রমাগত আহার করিয়া গায়ের চামড়া বদ্‌লাইতে বদ্‌লাইতে শুঁয়ো-পোকারা যখন খুব বড় হয়, তখন তাহাদের আর এক পরিবর্ত্তনের সময় উপস্থিত হয়। এই সময়ে শুঁয়ো-পোকারা খাওয়া বন্ধ করিয়া খুব চঞ্চল হইয়া চলা-ফেরা করে। এবং শেষে একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজিয়া সেখানে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে। এই সময়ে ইহাদের গায়ের চামড়া শুকাইয়া উঠে এবং তাহা কৌটার মত হইয়া পোকাকে ভিতরে রাখিয়া দেয়। আবার কয়েক জাতীয় পোকার মুখ হইতে ঐ-সময়ে আঠার মত লালা বাহির হয় এবং তাহা শুকাইলে রেশমী সূতা হইয়া দাঁড়ায়। ঐ পোকারা ঐ-সকল সূতা দিয়া গুটি বাঁধিয়া তাহার ভিতরে নিশ্চিন্ত হইয়া বাস করে।

    তোমরা যে রেশমী কাপড় ব্যবহার কর, তাহা এই রকম এক শুঁয়ো-পোকার গুটির সূতা দিয়া প্রস্তুত। আমরা যেমন গোরু ছাগল ইত্যাদি পালন করি, যাহারা রেশমের ব্যবসায় করে, তাহারাও সেই রকমে রেশমের প্রজাপতি পালন করে। প্রজাপতিরা ডিম পাড়ে এবং পরে সেই ডিম হইতে শুঁয়ো-পোকা বাহির হয়। ব্যবসায়ীরা খুব যত্নে তাহাদিগকে কচি পাতা খাওয়ায়। তার পরে সময় উপস্থিত হইলে, সেই পোকাগুলিরই প্রত্যেকে মুখ হইতে রেশমী সূতা বাহির করিয়া এক-একটি গুটি বাঁধে। রেশমের ব্যবসায়ীরা এই সকল গুটির সূতা সংগ্রহ করিয়া বিক্রয় করে। রেশমের কাপড় শুঁয়ো-পোকার এই রকম সূতা দিয়াই প্রস্তুত হয়।

    তাই বলিয়া সকল পতঙ্গ বা সকল প্রজাপতির বাচ্চারা যে রেশমী গুটি বাঁধে তাহা নয়। গোবরে-পোকার বাচ্চারা রেশমী গুটি বাঁধে না। তোমরা পথে-ঘাটে সর্ব্বদা যে-সব প্রজাপতি ও মাছিকে উড়িয়া বেড়াইতে দেখিতে পাও, তাহারাও রেশমী গুটি বাঁধে না। অনেক শুঁয়ো-পোকা শেষবারে গায়ের যে চামড়া বদ্‌লায়, তাহা গা হইতে ফেলিয়া দেয় না। পরে সেই আল্‌গা চামড়াতে তাহারা মুখের লালা মিশাইয়া শক্ত গুটি প্রস্তুত করে এবং তাহার মধ্যে বাস করে। কোনো কোনো পতঙ্গের শুঁয়ো-পোকারা শুক্‌নো পাতায় মুখের লালা মিশাইয়া গুটির মত ঘর প্রস্তুত করে। যাহা হউক, প্রজাপতি বা অন্য পতঙ্গের শুঁয়ো-পোকারা যখন গুটির মধ্যে চুপ-চাপ থাকে, তখন ইহাদের দেহের আর একটা পরিবর্ত্তন হয়। এই অবস্থাকে পুত্তলি-অবস্থা বলে। তখন তাহারা মড়ার মত হইয়া এমন ভাবে গুটির মধ্যে থাকে যে, দেখিলে কষ্ট হয়। গুটি ছিঁড়িয়া গায়ে হাত দিলে বা শরীরে আঘাত করিলে তাহাদের সাড়া পাওয়া যায় না। তখন তাহাদের দেহে রক্তের চলাচল এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পর্য্যন্ত অনেক কমিয়া আসে।

    তোমরা হয় ত ভাবিতেছ পতঙ্গেরা পুত্তলির অবস্থায় দুই চারিদিন থাকিয়াই বুঝি গুটি কাটিয়া বাহির হয়। কিন্তু তাহা হয় না। কোনো কোনো পতঙ্গের শুঁয়ো-পোকারা প্রায় নয় দশ মাস পর্য্যন্ত এই রকমে মড়ার মত পড়িয়া থাকে। আবার কোনো পতঙ্গ শীঘ্রই পুত্তলি-অবস্থা ত্যাগ করে। পিঁপ্‌ড়ে ও মৌমাছিরা আট দশ দিনের বেশি এই অবস্থায় থাকে না।

    এক দিন কিছু না খাইলে মানুষ দুর্ব্বল হইয়া পড়ে। তিন-চারি দিন কিছু না খাইলে মানুষের বাঁচিয়া থাক দায় হয়। কিন্তু পতঙ্গের পুত্তলিরা আট-দশ মাস কিছু না খাইয়া কি রকমে বাঁচে, তাহা আমরা হঠাৎ বুঝিতে পারি না।

    একটা উদাহরণ দিলে এই কথাটা তোমরা বুঝিতে পারিবে। মনে কর, আমরা আগুন জ্বালাইতে যাইতেছি। কাঠ খড় তেল কয়লা জোগাড় করিয়া তাহাতে আগুন দিলাম। আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিল, এবং কাঠ খড় পুড়িয়া গেলে তাহা নিবিয়া গেল। প্রাণীর জীবন এই আগুনেরই মত নয় কি? আগুন জ্বালাইতে গেলে যেমন কাঠ বা খড়ের প্রয়োজন, তেমনি জীবনের কাজ চালাইতে গেলে খাবারের প্রয়োজন। এই খাবার শরীরে গিয়া যে শক্তির উৎপত্তি করে, তাহারি জোরে আমরা হাঁটিয়া বেড়াই, কাজকর্ম্ম করি ও শরীরকে পুষ্ট করি। কাজেই যদি আাহার বন্ধ করা যায়, তবে কাঠের অভাবে যেমন আগুন নিভিয়া যায়, সেই রকম অনাহারে আমাদের মৃত্যু ঘটে। শুঁয়ো-পোকারা পুত্তলি হইয়া চলা-ফেরা একবারে বন্ধ করে, এমন কি শ্বাস-প্রশ্বাস পর্য্যন্ত রোধ করিয়া ফেলে। কাজেই জীবন-ধারণের জন্য তাহাদের অতি অল্প শক্তিরই প্রয়োজন হয়। এই জন্যই পতঙ্গেরা পুত্তলি-অবস্থায় অনাহারে অনেক দিন কাটাইতে পারে।

    খুব ভালো খাবার খাইয়া শরীর মোটা করিলে দেহের ভিতরে মাংস চর্ব্বি প্রভৃতি অনেক সারবান্ জিনিস জমা হয়। যখন বাহির হইতে খাবার পাওয়া যায় না, মোটা প্রাণীরা তখন নিজেদের দেহের সেই মাংস ও চর্ব্বি খরচ করিয়া অনেক দিন অনাহারে বাঁচিতে পারে। শুঁয়ো-পোকারা দিবারাত্রি আহার করিয়া কি-রকম মোটা হয়, তাহা আগে বলিয়াছি। কাজেই শরীরে যে মাংস ও চর্ব্বি জমা থাকে, তাহাও পুত্তলিদিগকে অনেক দিন বাঁচাইয়া রাখিতে পারে।

    পুত্তলি-অবস্থায় মড়ার মত গুটির মধ্যে পড়িয়া থাকিলেও এই সময়ে শুঁয়ো-পোকাদের দেহে একটা বড় রকমের পরিবর্ত্তন হয়। আমরা কাদা দিয়া পুতুল গড়িয়া, পরে তাহা ভাঙিয়া যেমন আর একটি নূতন পুতুল গড়িয়া থাকি,—বিধাতা ঐ-সময়ে গুটির মধ্যের শুঁয়ো-পোকাগুলিকে ভাঙিয়া-চুরিয়া সেই রকমে তাহাদিগকে সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকারে পরিণত করেন। শুঁয়ো-পোকার ডানা থাকে না, অনেকের পা থাকে না, এবং সেই বড় বড় চোখও থাকে না৷ গুটির মধ্যে উহারা যখন অজ্ঞাতবাস করে, তখনই তাহাদের মাথা, পা, ডানা, চোখ প্রভৃতি সকল অঙ্গেরই সৃষ্টি হয় এবং শেষে এক দিন সেই শুঁয়ো-পোকাই সুন্দর প্রজাপতি বা সম্পূর্ণ পোকার আকার পাইয়া গুটি কাটিয়া বাহির হয়। ইহাই পতঙ্গদের জীবনের তৃতীয় অবস্থা।

    আমরা ক্রমে ক্রমে পতঙ্গদের চারিখানি ছবি দিয়াছি। এইগুলি দেখিলে পতঙ্গদের তিন অবস্থার কথা তোমরা ভালো করিয়া বুবিবে।

    ডিম হইতে বাহির হইয়া শুঁয়ো-পোকা কি রকমে গাছের পাতায় বেড়াইতেছে, তাহা প্রথম ছবিতে আঁকা আছে। দ্বিতীয় চিত্রটি তাহারি পুত্তলি-অবস্থার ছবি। গায়ের চাম্‌ড়ায় লালা মিশাইয়া শুঁয়ো-পোকাটি কেমন গুটি পাকাইয়াছে এবং গুটির মধ্যে কেমন মড়ার মত পড়িয়া আছে, এই ছবিতে তাহা আঁকা হইয়াছে। তৃতীয় ছবিখানি সেই পোকারই গুটি কাটিয়া বাহির হওয়ার চিত্র। সম্পূর্ণ প্রজাপতির আকার পাইয়া সেই শুঁয়ো-পোকাই গুটি হইতে বাহির হইয়াছে, কিন্তু এখনো ডানা মেলিয়া উড়িতে পারিতেছে না। সেই প্রজাপতিই কি-রকমে ডানা মেলিয়া উড়িবার উপক্রম করিতেছে, তাহা চতুর্থ চিত্রে আঁকা রহিয়াছে।

    এখন বোধ হয় তোমরা বুঝিতে পারিয়াছ—পতঙ্গেরা মায়ের দেহ হইতে সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকারে বাহির হয় না। প্রথমে তাহারা ডিম হইতে শুঁয়ো-পোকার আকারে বাহির হয়। তার পরে উহারা মড়ার মত গুটির মধ্যে বাস করে এবং শেষে তাহারা গুটি কাটিয়া সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকারে বাহির হইয়া পড়ে। ইহাই পতঙ্গদের জীবনের তিন অবস্থা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল – চিত্রা দেব
    Next Article অসাধু সিদ্ধার্থ – জগদীশ গুপ্ত
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }