Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রতিঘাত – অনীশ দেব

    লেখক এক পাতা গল্প346 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪. রোশনের গায়ে সকালের রোদ

    রোশনের গায়ে সকালের রোদ এসে পড়েছিল। বেলা বাড়ছে। সেদিন থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময়েও রোশন রোদে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের রোদ আর আজকের রোদ যেন দু-দিনের দুটো মুহূর্তকে স্কেল দিয়ে সরলরেখা টেনে জুড়ে দিল। আর রোশনের মন সেই সরলরেখা-সরণি ধরে সামনে-পিছনে যাতায়াত করতে লাগল।

    আশাপুরকে রোশনের ভালো লেগে গেছে। আশাপুরের গন্ধ, আশাপুরের রোদের রং, উষ্ণতা আশাপুরের প্রকৃতির ছবি কী করে যেন ছেলেটার প্রাণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

    রোশন বড় করে শ্বাস টানল। আশাপুরের বাতাস টেনে নিল বুকের ভেতরে। এই বাতাসে প্রাণের ছোঁয়া আছে। কিন্তু তার মধ্যে মিশে আছে বিষ—পলান নস্করের বিষ।

    বলটা হাতে নিয়ে রোশন সাবধানে বাকি রাস্তাটা পার হল। তারপর বলটা ছুড়ে দিল বাচ্চাদের দঙ্গলের মাঝে। ওদের শট প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গেল আবার।

    একটু পরেই বলে একটা জোরালো শট মারল একটা ছেলে। ছেলেটা মাথায় বেশ লম্বা। ওর নাম বোধহয় পটকা।

    বলটা দুবার ড্রপ খেয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল আবার সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে।

    ব্যাংকের সামনে ফুটদেড়েক উঁচু একটা রোয়াক মতন। তার অনেকটা অংশ মোটা গ্রিল দিয়ে খাঁচার মতন ঘেরা। সেই গ্রিলের মধ্যে রয়েছে প্রমাণ মাপের একটা দরজা। এই দরজা দিয়েই কাস্টমাররা ব্যাংকে ঢোকে। ব্যাংক বন্ধ হলে এই দরজাটায় তালা পড়ে যায়।

    এখন সিকিওরিটি গার্ডের পোশাক পরা একজন লোক সেই দরজার তালা খুলছে। কারণ, সকাল সাড়ে ন’টা বাজে। ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’-র আশাপুর ব্রাঞ্চ রোজ সাড়ে ন’টাতেই খোলে।

    গ্রিলের দরজার বাইরে ব্যাংকের দুজন কাস্টমার দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের হাতে ব্যাংকের পাশবই আর কয়েকটা কাগজপত্র।

    রোশন ফুটবলটা নিয়ে আসার জন্য আবার রাস্তার কাছে গেল। ওর সামনে গাড়ি, সাইকেল, সাইকেল-রিকশা আর মোটরবাইকের চঞ্চল স্রোত। ও রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আশাপুর ছোট টাউন হলেও এখানে যানবাহন নেহাত কম নয়।

    সিকিওরিটি গার্ডের পোশাক পরা লোকটি ততক্ষণে গ্রিলের দরজা খুলে দিয়ে দুজন কাস্টমারকে ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র দিয়েছে।

    একজন কাস্টমার বলল, ‘ভাই, এখন ন’টা বত্রিশ বাজে! আজ খুলতে দু-মিনিট লেট হল।’

    উত্তরে সিকিওরিটি গার্ড ছেলেটি পান খাওয়া লালচে দাঁত দেখিয়ে হাসল : ‘তাড়াতাড়ি ঢুকেই বা কী করতেন, স্যার। এখন লোডশেডিং চলছে। জেনারেটার চালু করতে হবে…।’

    ‘ও ব্বাবা! লোডশেডিং! সাতসকালেই?’ একজন বলল।

    ‘তাড়াতাড়ি জেনারেটার চালু করো, ভাই। আমার একটু তাড়া আছে…।’

    ‘চালাচ্ছি। পাঁচটা মিনিট টাইম দিন, স্যার—।’ এ-কথা বলে সিকিওরিটি গার্ড চটপট ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে গেল—বোধহয় জেনারেটার নিয়ে আসতে।

    রোশন রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে ব্যাংকের ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করছিল। কারণ, ফুটবলটা পড়ে আছে ব্যাংকের গ্রিলের গা ঘেঁষে। বলটা নজরে রাখতে গিয়েই ব্যাংকের ব্যাপারটা ওর চোখে পড়ছিল।

    একটু পরেই সিকিওরিটির ছেলেটি জেনারেটার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। চাকা লাগানো স্ট্যান্ডে বসানো মাঝারি মাপের লাল রঙের জেনারেটার। গ্রিলের গায়ে ঝোলানো রয়েছে একটা সুইচবোর্ড। জেনারেটারের প্লাগ টপটা সেখানে গুঁজে দিয়ে মেশিনটা অন করে দিল ছেলেটি। তারপর একটা শিকল দিয়ে জেনারেটারের স্ট্যান্ডটা গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে শিকলে তালা এঁটে দিল। তারপর ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে গেল।

    আধুনিক জেনারেটার। ‘ধকধক’ করে চাপা শব্দ তুলে মেশিনটা চলতে লাগল। ব্যাংকের ভেতরের ঘরে আলো জ্বলে উঠল, ফ্যান ঘুরতে লাগল। টুকটাক করে শুরু হয়ে গেল ব্যাংকের কাজ।

    ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে, ব্যাংকের কথা ভাবতে-ভাবতে, রোশনের নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। কীভাবে ব্যাংকের একটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল ও। তখন ও ট্যাক্সি চালাত।

    গাড়ি ইত্যাদির স্রোতের মাঝে একটা ফাঁক পেয়ে গেল রোশন। চট করে রাস্তা পার হয়ে ও চলে এল ব্যাংকের সামনে। গ্রিলের কাছ থেকে ফুটবলটা হাতে তুলে নিল।

    ঠিক তখনই একটা ধুলোমাখা মোটরবাইক এসে দাঁড়াল ব্যাংকের গ্রিলের দরজার একেবারে মুখে। বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল দুজন ছেলে। দুজনকেই রোশন চেনে : কাটা নগেন আর নোনতা। পলানের দলের ছেলে। ‘জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনে নোনতার সঙ্গে একবার টক্কর হয়েছিল রোশনের। ববিনের সামনে গালাগালি দেওয়ার জন্য নোনতাকে একটু সবক শিখিয়েছিল ও।

    নোনতার মাথার চুলের কিছুটা অংশে লাল রং লাগানো। চোখে কেমন একটা ঢুলুঢুলু দৃষ্টি।

    কিন্তু এই সাতসকালে এরা দুজন ব্যাংকে কী করতে এসেছে? পলানের টাকা তুলতে? কিন্তু ওদের হাতে তো পাশবই, চেকবই বা কোনও কাগজপত্র চোখে পড়ছে না!

    বরং যেটা চোখে পড়ল সেটা একটা ওয়ান শটার পিস্তল।

    তা হলে কি নোনতা আর নগেন ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’-য় ডাকাতি করতে এসেছে? কিন্তু ওদের হাতে টাকা ভরতি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য থলে বা ব্যাগ কোথায়?

    রোশন কৌতূহলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।

    নগেন আর নোনতা ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে পড়েছে। ওরা কেউই রোশনকে খেয়াল করেনি।

    নগেনের গায়ে সাদা ফুলশার্ট আর সাদা প্যান্ট—যদিও রংটা ময়লা হয়ে গেছে।

    নোনতার গায়ে হালকা সবুজ হাফশার্ট আর কালো প্যান্ট।

    দুজনেরই পায়ে সস্তার চটি।

    গ্রিলের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কাটা নগেন হাঁক পাড়ল, ‘ম্যানেজার! অ্যাই সালা ম্যানেজার! জলদি বাইরে আয়…।’

    কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল। কেউই বাইরে এল না।

    কাটা নগেন আবার চিৎকার করে উঠল, ‘আবে, ম্যানেজার! অ্যাই সালা ম্যানেজারের বাচ্চা! কুইক কাম আউটসাইড! কুইক!’

    এই চিৎকারের পরেও কেউ বাইরে এল না। শুধু সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটা একবার ভেতর থেকে উঁকি মেরেই আবার ভেতরে সেধিঁয়ে গেল।

    নোনতা একটা গালাগাল দিয়ে জেনারেটারের কাছে গেল। এবং ওটার থ্রো সুইচটা একটানে অফ করে দিল। জেনারেটার থেমে গেল।

    কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই মোটাসোটা একজন লোক ব্যাংকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। মানুষটি উচ্চতায় খাটো, মাথায় টাক, চোখে চশমা। ডোরাকাটা ফুল স্লিভ শার্ট ছাইরঙা প্যান্টের ভেতরে ইন করে পরেছেন। কোমরে সরু বেল্ট। বেল্টের ওপর দিয়ে মাঝারি মাপের ভুঁড়ি উপচে পড়ছে।

    ‘কী হয়েছে, ভাই? কী হয়েছে? জেনারেটার অফ করল কে?’

    নোনতা ভদ্রলোকের নাকের ডগায় ওয়ান শটারটা নেড়ে বলল, ‘কেন, কী হয়েছে? আমি অফ করেছি…।’

    পিস্তলটা চোখে পড়ামাত্রই ভদ্রলোক মুখে একটা কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে কান ছোঁয়া হাসি। নোনতার দিকে তাকিয়ে অনুগত চাকরের বক্তব্য পেশ করার ঢঙে বললেন, ‘না, কিছু হয়নি। তোমার তো ভাই, শক লেগে যেতে পারত—সেই দুশ্চিন্তায় বলছি।’

    নোনতা আর নগেন সরু নজরে ভদ্রলোকের চেহারার ইনস্পেকশন সেরে নিল। তারপর কাটা নগেন জিগ্যেস করল, ‘ইউ ব্যাংক ম্যানেজার?’

    ভদ্রলোক থতোমতো খেয়ে মিহি গলায় বললেন, ‘ইয়েস ইয়েস ইয়েস ইয়েস ইয়েস…।’

    ‘পাঁচবার বলতে হবে না—ওয়ান টাইম এনাফ।’ গম্ভীর গলায় বলল নগেন, ‘এ ব্রাঞ্চে কদ্দিন ম্যানেজারি করছেন?’

    ‘তা আ-আড়াই মাস হবে—।’

    ‘আড়াই মাস ধরে এখানে সারভিস করছেন আর আশাপুরের রুল জানেন না?’

    ‘ক-ক-কী রুল, ভাই?’

    ‘পলানদার রুল। জেনারেটারের রুল।’

    ম্যানেজারসাহেব হাত দিয়ে কপাল আর গালের ঘাম মুছলেন। ভ্যাবাচ্যাকা মুখে নগেনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

    ‘জেনারেটারের রুল!’ ম্যানেজারসাহেবের এবার মাথা চুলকোনোর পালা। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন নগেনের মুখের দিকে।

    এইসব কথাবার্তার মধ্যেই ব্যাংকের কয়েকজন কর্মী বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাদেরই একজন ম্যানেজারসাহেবকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল, ‘মিস্টার জানা, জেনারেটার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন?’

    কাস্টমাররাও গরমে ভেতরে টিকতে পারেনি—চলে এসেছে বাইরে। তারাও ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইছে, ‘জেনারেটার চলছে না কেন? কাস্টমারদের ওপরে আপনারা আর কত টরচার করবেন?’

    ম্যানেজারবাবু দু-হাত ওপরে তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন।

    ‘আমাকে প্লিজ পাঁচটা মিনিট সময় দিন। আমি ইস্যুটা এই দুজন ভাইয়ের সঙ্গে ডিসকাস করে এখুনি সেটল করে নিচ্ছি। জাস্ট পাঁচটা মিনিট আমাকে টাইম দিন।’

    নগেন ম্যানেজারের থুতনিতে হাত দিয়ে ওঁর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল : ‘আমার কথাটা মাইন্ড লাগিয়ে শুনুন…।’

    ম্যানেজারবাবু পুতুলের মতো স্থির চোখে নগেনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওঁর মুখ এখনও সামান্য হাঁ করা।

    ‘এই জেনারেটার আপনি কোত্থেকে পেয়েছেন?’

    ‘কি-কিনেছি। আমাদের রিজিওন্যাল অফিস ফান্ড স্যাংশান করেছে— তারপর টেন্ডার ডেকে কিনেছি…।’

    ‘হুম।’ গম্ভীরভাবে বলল নগেন, ‘এখানেই পলানদার রুল ব্রেক হয়ে গেছে। এই আশাপুরে যত দোকান আর অফিস-টফিস আছে সব জায়গায় ভাড়া করা জেনারেটার লাগানো আছে। পলানদার থেকে রেন্ট-এ নেওয়া জেনারেটার। পলানদা খুব রিজনেবল মান্থলি রেন্ট-এ সবাইকে জেনারেটার ভাড়া দেয়। আমি আর নোনতা এই জেনারেটার বিজনেসের দেখভাল করি। নাউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’

    ম্যানেজার মিস্টার জানা ওপর-নীচে কয়েকবার মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, কাটা নগেনের কথা তিনি ‘আন্ডারস্ট্যান্ড করেছেন।’

    ওঁদের ঘিরে জড়ো হওয়া ব্যাংক কর্মী আর কাস্টমারের দল নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল, নানান মন্তব্য করছিল। আর সেই জটলা দেখে গ্রিলের বাইরে রাস্তার দিকটায় বেশ কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল।

    ব্যাপারটা বড়সড় চেহারা নিতে পারে ভেবে নগেন নোনতাকে ইশারা করল। বলল, ‘মেশিন শো করে ব্যাংকের লোকজনকে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকিয়ে দে। নইলে পরে ক্যাচাল হতে পারে…।’

    নোনতা ওয়ান শটার উঁচিয়ে ধরে বাতাসে এপাশ-ওপাশ নাড়ল।

    ‘আপনারা সব ব্যাংকের ভেতরে ঢুকুন। জেনারেটার এখুনি ফটাফট চালু হয়ে যাবে। যান, ভেতরে যান সবাই…।’

    মুহূর্তে সব কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা থেমে গেল। ব্যাংক কর্মী আর কাস্টমাররা সুড়সুড় করে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে গেল।

    নগেন নোনতাকে বলল, ‘নে, মালটা এবার চালু করে দে—।’ জেনারেটারের দিকে ইশারা করল নগেন।

    নোনতা ওর বাঁ-হাতটা লম্বা করে বাড়াল। জেনারেটারের থ্রো সুইচটা ঠেলে ওপরদিকে তুলে দিল। তারপর জেনারেটারের সেলফ স্টার্টার টিপে মেশিনটা চালু করে দিল। জেনারেটার ‘ধকধক’ করে চলতে শুরু করল। ওটার লাল রঙের বডি থরথর করে কাঁপতে লাগল।

    কাটা নগেন ম্যানেজারবাবুর গালে একটু হাত বুলিয়ে দিল।

    ‘দেখুন মিস্টার ম্যানেজার, আপনার কেসটা সলভ করার দুটো ওয়ে আছে। একটা হচ্ছে, পলানদার কাছে স্ট্রেটকাট সাইলেন্ডার করা। এই জেনারেটারটা বেচেবুচে দিয়ে পলানদার কাছ থেকে জেনারেটার ভাড়া নেওয়া। আর সেকেন্ড ওয়ে হচ্ছে, আমার কথা না শোনা অ্যান্ড রামক্যালানি খেয়ে এই জেনারেটারের ওপরে কেলিয়ে পড়ে থাকা। হুইচ ওয়ে, বলুন?’

    ম্যানেজারসাহেব কাটা নগেনের সামনে রীতিমতো হাত কচলাতে শুরু করলেন। ভদ্রলোকের গালে কপালে বিনবিনে ঘামের ফোঁটা।

    ‘আ-আমাকে কী করতে হবে ব-বলুন।’ কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন।

    নগেন খেয়াল করল, গ্রিলের গা ঘেঁষে জটলা ক্রমশ আয়তনে বাড়ছে। বড়সড় ক্যাচাল হয়ে গেলে পলানদার কাছে ঝাড় খেতে হবে। তাই ও নোনতাকে ইশারা করল, বলল, ‘অ্যাই, লোহাটা পকেটে ছুপে নে। ভিড় বাড়ছে, তাড়াতাড়ি কেস সালটে চ’ ফুটে যাই…।’

    নোনতা ঘাড় নাড়ল। পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে চারপাশে তাকাল।

    নগেন মিস্টার জানার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘এই জেনারেটারটা আপনি হাটিয়ে দিন। তার বদলে আমরা আপনাকে সেকেন্ড হ্যান্ড একটা জেনারেটার দিয়ে যাব। আপনি মাসে-মাসে তার ভাড়া দেবেন—ফোর হান্ড্রেড পার মান্থ..।’

    ম্যানেজারসাহেব করুণ গলায় বললেন, ‘সে কেমন করে হয়? প্রতি মাসে আমি ভাড়ার টাকা কোন অ্যাকাউন্ট থেকে দেব? তা ছাড়া নিজেদের কেনা জেনারেটার থাকতে…ব্যাংক তো আমাকে শো-কজ করবে!’

    ‘শো-কজ!’ হাসল কাটা নগেন : ‘যদি আমার প্রোপোজালে আপনি এগ্রি না করেন তা হলে পলানদা তো আপনাকে শো-কজ করবে!’

    রোশন জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে ঝামেলাটা দেখছিল। এ তো একেবারে দিনে ডাকাতি!

    ও আশপাশে তাকাল। গন্ডগোলের আঁচ পেয়ে দু-চারজন লোক জড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু আরও যাদের জড়ো হওয়ার ইচ্ছে ছিল তারা নোনতা আর কাটা নগেনকে চিনতে পারামাত্রই নিজের-নিজের কাজের তাড়ায় সরে পড়েছে। রোশন পলানের এই দু-পিস চ্যালাকে চেনে, কিন্তু ওর সরে পড়তে ইচ্ছে করেনি।

    নগেন তখন মিস্টার জানাকে বলছিল, ‘অবশ্য আর-একটা ওয়ে আছে। এই লালু জেনারেটারটা…’ আঙুল দিয়ে জেনারেটারটা দেখাল নগেন : ‘…আপনি পলানদাকে বেচে দিন। আর এভরি মান্থে পলানদা আপনাকে ই.এম.আই. দিয়ে যাবে। অ্যান্ড আপনি পলানদাকে মান্থলি রেন্ট দিয়ে যাবেন। যদি আপনি চান তা হলে ই.এম.আই আর রেন্ট-এ প্রতি মাসে কাটাকুটি করে শোধবোধ করতে পারেন—সেটা আপনার ব্যাপার। তারপর আপনার ই. এম. আই. পেইড হয়ে গেলে এই লাল মালটা আমরা তুলে নিয়ে যাব। ক্লিয়ার?’ মিস্টার জানার দিকে আঙুল উঁচিয়ে শেষ প্রশ্নটা ছুড়ে দিল নগেন।

    ম্যানেজারসাহেব হতভম্ব হয়ে নগেনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নগেনের বিচিত্র ই.এম.আই.-এর প্রস্তাব শুনে ওঁর মাথা ঘুরছিল।

    মাথা ঘুরে গিয়েছিল রোশনেরও। নগেনের প্রস্তাবটা নিছকই জেনারেটারটা বিনাপয়সায় হাতিয়ে নেওয়ার স্কিম। এরকম ইকনমিক্স কাটা নগেন কোথায় শিখল কে জানে!

    রোশন ভাবছিল, ব্যাপারটা অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে—এবারে কিছু একটা করা দরকার। ফুটবলটা হাতে নিয়েই ও গ্রিলের দরজার দিকে এগোল।

    ম্যানেজারসাহেব তখন কাতর গলায় নগেনকে বলছেন, ‘আপনি কী বলছেন সেটা একবার ভেবে দেখেছেন! এসব কাজ করলে তো আমার চাকরি চলে যাবে! আমার ফ্যামিলি না খেতে পেয়ে মারা যাবে! আমার..।’

    ম্যানেজারের কথা শেষ হওয়ার আগেই নগেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে খিস্তির ফোয়ারা ছোটাল। এবং মিস্টার জানার ডানহাতের পাতাটা চেপে ধরে একটানে সেটাকে জেনারেটারের ইঞ্জিনের গরম বডিতে চেপে ধরল।

    জানা অসহ্য যন্ত্রণায় ভয়ংকর চিৎকার করে উঠলেন। ওঁর দু-গালে একরাশ রক্ত ছুটে এল।

    জটলার দু-তিনজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছেন! কী করছেন! ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন!’

    উত্তরে কাটা নগেন দাঁত বের করে হাসছিল। যে হাসির মানে : ‘পলানদার কথা না শুনলে কী হয় দেখে নাও সব্বাই।’

    রোশনের সারা শরীর জ্বালা করছিল। এতগুলো মানুষের চোখের সামনে নগেন এরকম অন্যায় করার সাহস পাচ্ছে কেমন করে?

    অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় সামনে দুটো স্টেপ ফেলল রোশন। দু-হাতে ধরা ফুটবলটা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে হিট করল নগেনের মাথায়।

    নগেন পলকে কাত হয়ে গেল। ওর মাথাটা বেশ জোরে বাড়ি খেল গ্রিলের দেওয়ালে। মিস্টার জানার হাতটা ছেড়ে গেল ওর হাত থেকে।

    জানা ওঁর বাঁ-হাত দিয়ে ডানহাতের পাতাটা চেপে ধরে যন্ত্রণায় ‘উঁ-উঁ-উঁ’ করতে লাগলেন।

    রাস্তার ওপার থেকে নিতুয়া ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওখানে লোকের জটলা কেন? কীসের ঝামেলা চলছে ওখানে?

    নিতুয়ার আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ববিন, রেমো, পটকা, পিনু আর মুনিয়া রোশনকাকু ওদের ফুটবলটা নিয়ে এখনও ফিরে আসছে না দেখে ওরা খুব অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সামান্য বলটা নিয়ে ফিরে আসতে কাকুর এতক্ষণ লাগছে কেন? দু-চারজন লোক ব্যাংকের সামনেটায় জড়ো হয়ে থাকায় বাচ্চাগুলো ওদের কাকুকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল না। তাই ওরা মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়িয়ে রোশনকে দেখার চেষ্টা করছিল।

    নিতু হঠাৎই রোশনকে একঝলক দেখতে পেল। মনে হল যেন, ওর সঙ্গে কারও হাতাহাতি চলছে।

    নিতু আর দেরি করেনি। লরির খালাসিগোছের একজন লোক বালির স্তূপের কাছটায় বসেছিল। তাকে নিজের সাইকেলটা দেখিয়ে নিতু বলল, ‘ভাই আমার গাড়িটা একটু দেখিস তো—।’

    তারপর ও রাস্তা পার হওয়ার জন্য রাস্তার কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওর আশেপাশে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাঁচটা ছোট ছেলে। ওরা রোশনকাকুর কাছে যাবে বলে নাছোড় বায়না ধরেছে।

    মিস্টার জানার যন্ত্রণার চিৎকারে লোকজন একটু বেশিই জড়ো হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের ভেতর থেকে কর্মী আর কাস্টমাররাও বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ততক্ষণে কাটা নগেন নিজেকে সামলে নিয়েছে। এবং ও আর নোনতা খিস্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে এক-সঙ্গে রোশনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওকে এলোপাতাড়ি ঘুসি আর লাথি মেরে চলেছে। রোশনের হাত থেকে ফুটবলটা ছিটকে পড়ে গেছে মেঝেতে।

    নিতু পাঁচটা বাচ্চাকে সঙ্গে করে রাস্তা পার হয়ে চলে এল ব্যাংকের কাছে।

    গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ওরা দেখতে পেল, দুটো ছেলে ওদের ‘কাকু’-কে ধরে মারছে। অন্য কয়েকজন লোক কাছাকাছি থাকলেও তারা ছেলে দুটোকে আটকাচ্ছে না।

    নিতু খুব একটা অবাক হল না। পলানের দলবলের কাছে আশাপুরের মানুষ বহুদিন থেকেই পোষা ভেড়া হয়ে গেছে।

    নোনতা এবং কাটা নগেনের মুখ দুটো জটলা করে থাকা মানুষদের অনেকেরই চেনা। তাই তারা মুখে কিছু-কিছু মন্তব্য করলেও ওই পর্যন্তই— কাজে কিছু করছিল না।

    নিতুয়ার খুব খারাপ লাগছিল। রোশন ছেলেটা এত উপকারী, নিতুয়ার কত উপকার করেছে—অথচ ওর বিপদে নিতুয়া কিছু করে উঠতে পারছে না। নিতুয়ার শরীরে যদি সেই শক্তি থাকত তা হলে এই গুন্ডাদুটোকে ও মেরে পাট-পাট করে দিত।

    একটা নিস্ফলা রাগ নিতুয়ার ভেতরে টগবগ করে ফুটছিল। মাথা খুঁড়ে মরছিল। ওর রগের কাছটা দপদপ করে উঠল, তার সঙ্গে একটা ব্যথা শুরু হল।

    হঠাৎই নিতুয়ার চোখের সামনে একটা অবাক কাণ্ড ঘটে গেল। ওর সঙ্গী পাঁচটা বাচ্চা ‘অ্যাই, কাকুকে মারছ কেন? কাকুকে মারছ কেন?’ বলে প্রবল চেঁচাতে শুরু করল। এবং ভিড় ঠেলে বুলেটের মতো ছুট্টে ঢুকে গেল গ্রিল ঘেরা জায়গাটার ভেতরে।

    তারপর ববিন, পটকা, পিনুর দল ঝাঁপিয়ে পড়ল নোনতা আর কাটা নগেনের ওপরে।

    পাঁচটা বাচ্চার কাণ্ড দেখে নিতু থ’ হয়ে গিয়েছিল। পলানের যে-সাঙ্গপাঙ্গদের আশাপুরের জোয়ান-মদ্দরা পর্যন্ত সমঝে চলে, এড়িয়ে চলে, পাঁচটা বাচ্চা কোনও কিছুর পরোয়া না করে সেরকম দুজন খতরনাক সাঙ্গপাঙ্গর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে!

    বাচ্চাগুলো শুধু ঝাঁপিয়ে পড়েই থেমে থাকেনি, একইসঙ্গে নগেন এবং নোনতাকে খিমচে দেওয়া এবং কামড় দেওয়ার কাজটাও করে চলেছে। আর মাঝে-মাঝে বলে চলেছে, ‘অ্যাই, ছেড়ে দাও কাকুকে! কাকুকে মারছ কেন?’

    নিতুয়ার নিজেকে অসহায় ক্লীব বলে মনে হচ্ছিল। এই পাঁচটা খুচরো পয়সা বাচ্চা যা পারছে ও সেটা করতে পারছে না! হোক না নিতুয়ার বয়েস হয়েছে, হোক না ও সামান্য একটু প্রতিবন্ধী, তা বলে কি প্রতিবাদ করা যায় না!

    নিতুয়া ভিড়ের স্তর ঠেলে সরিয়ে নগেন আর নোনতার কাছে পৌঁছে গেল। লম্বা হাত বাড়িয়ে খপাত করে নোনতার লাল রং করা চুলের মুঠি চেপে ধরল। দু-চারটে গালিগালাজ বেরিয়ে এল নিতুয়ার মুখ থেকে। ওর শরীরের মধ্যে ঘেন্না আর রাগ টগবগিয়ে উঠল। নোনতার চুলের মুঠি ধরে নিতুয়া প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকাতে লাগল। ওর ভেতরে শক্তিও যেন চলে এল কোথা থেকে।

    পাঁচটা ছোট বাচ্চা পাঁচটা ছটফটে কাঁকড়াবিছের মতো নোনতা আর নগেনের গায়ে চুম্বকের মতো সেঁটে গিয়েছিল। আর একইসঙ্গে ওদের আঁচড়-কামড়ের কাজ চলছিল।

    এইসব কাণ্ড দেখে কয়েকজন পাবলিকও হাত লাগাল। বাচ্চাগুলোর সাহস ওদের সাহস জুগিয়েছে। নগেন আর নোনতার হাতে অনেক হেনস্থা ওরা সহ্য করেছে—কিন্তু আর না। এবার জবাব দেওয়ার সময় এসেছে।

    পাবলিকের হাত চলতে লাগল। কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে রোশন নোনতা আর নগেনের কবজা থেকে ছাড়া পেয়ে গেল। কিন্তু ওর হাতে, গালে, কপালে দু-চার জায়গায় কেটে-ছড়ে গেছে।

    ব্যাংকের ঘটনাটা অনেকক্ষণ ধরে যারা দেখছিল তাদের ধৈর্য ক্রমশ কমছিল। কিন্তু নোনতা, নগেনের কুখ্যাতি এবং ওদের বসের গুন্ডারাজের হিংস্রতার থাবার ভয় তাদের এতক্ষণ থামিয়ে রেখেছিল।

    কিন্তু পাঁচটা ছোট বাচ্চা সব হিসেব ওলট-পালট করে দিল।

    আচমকা পাবলিকের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।

    গ্রিলের বাইরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা নগেন আর নোনতার মোটরবাইকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রবল এক ধাক্কায় বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। তারপর সেটাকে নিয়ে যে যা খুশি করতে লাগল। কেউ থান ইট দিয়ে বাইকের ইঞ্জিনটাকে পেটাতে লাগল। কেউ চাকার হাওয়া বের করে দিল। কেউ বা বাইকের কাত হয়ে থাকা চাকার ওপরে উঠে ধেইধেই করে নাচতে লাগল।

    পাবলিকের এই হুটোপাটির পাশাপাশি চলছিল ভয়ংকর চেঁচামেচি আর চিৎকার।

    গ্রিল ঘেরা জায়গাটার ভেতরের দৃশ্যের চরিত্রও ছিল প্রায় একইরকম। বেশ কয়েকজন লোক মিলে নোনতা আর নগেনের ওপরে হাত চালাচ্ছিল। রোশন একটু পাশে সরে এসেছে। বাচ্চাগুলো ওকে ঘিরে ‘কাকু! কাকু!’ করছে। চারপাশ থেকে লোকজনের নানান মন্তব্য আর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। কেউ বলল, ‘এই নোনতা ব্যাটা মাসের পর মাস আমার মুদিখানা থেকে ধারে মাল নেয়—আজ পর্যন্ত একটা পয়সা শোধ দেয়নি। আজ সব ধার গায়ে গায়ে শোধ করে নেব…।’

    আর-একজন বলল, ‘ওই নগেন ছোঁড়াটা আমার বউয়ের সোনার চেন ছিনতাই করেছিল। আমি কত করে বললুম, ”তুমি আমি একই পাড়ার লোক। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? ভালো করে দ্যাখো—।” তাতে এই শয়তানটা বলেছিল, ”না বে, চিনতে পারছি না। রাস্তায় আলো বড্ড কম…।” তারপরই আমার ওয়াইফের গলা থেকে চেনটা ছিঁড়ে নিল। শালা, আজ যাবি কোথায়।’

    উত্তেজিত পাবলিক দুটো গুন্ডাকে মারতে-মারতে টেনে নিয়ে এল খোলা রাস্তায়। ওদের মুখের মারমুখী ছবি দেখে রোশনের মনে হল ওরা বহুদিনের চাপা ক্ষোভ আজ আগ্নেয়গিরির মতো উগরে দিচ্ছে।

    পাঁচটা বাচ্চাকে সামলে নিয়ে রোশন আর নিতু চলে এল রাস্তায়। মিস্টার জানা তখন কয়েকজনকে উত্তেজিতভাবে ওঁর ওপর টরচারের কাহিনি শোনাচ্ছেন। ব্যাংকের সামনেটা ভিড় জমে গেছে। অনেকেই মোবাইল ফোন উঁচিয়ে ধরে ঘটনার ফটো কিংবা ভিডিয়ো তুলছে।

    ব্যাংকের সামনে ঝামেলাটা এখন মাপে এতটাই বড় হয়ে গেছে যে, রাস্তায় যানজট শুরু হয়ে গেছে।

    নোনতা কিংবা নগেন—ওরা কেউই কখনও পাবলিকের ধোলাই খায়নি। তা ছাড়া ওরা বুঝতে পারেনি, জেনারেটারের ব্যাপারটা ছোট থেকে পট করে এতটা বড় হয়ে যাবে। নগেনের মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। পলানদা জানতে পারলে হয়তো ঝাড় খেতে হবে। নগেনের মাঝে-মাঝে পলান নস্কর হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। কারণ, পলান জানে কোথায় থামতে হয়—নগেন সেটা জানে না, সেইজন্যই ও নোনতাকে ওয়ান শটার বের করতে বলেছিল। কারণ, ওর ধারণা, পাবলিকের ওপরে ভয়ের চাদর সবসময় বিছিয়ে রাখতে পারলেই মাস্তানরাজ ঠিকঠাক কায়েম থাকে। কিন্তু মেশিনটা শো করাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। কোথায় থামতে হবে নগেন সেটা বুঝতে পারেনি।

    নোনতা মাস্তানির লাইনে নগেনের চেয়ে জুনিয়ার। তাই ও পলানদার কাছে ঝাড় খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। নগেনকেই পুরো কেসটার জবাবদিহি করতে হবে। দিনের আলোয় রাস্তার ওপরে পাবলিকের হাতে ওদের দুজনের হেনস্থা হওয়ার মানে পলানদার হেনস্থা হওয়া।

    কিন্তু এখন এই বিগড়ে যাওয়া সিচুয়েশানটাকে সামাল দেওয়া যায় কেমন করে?

    নগেনকে ঘিরে এখনও পাবলিকের জটলা। সপাটে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল নগেনের গালে। তারপরই নাকের ওপরে একটা জোরালো ঘুসি। তার পাশাপাশি কার একটা লাথি এসে পড়ল তলপেটে।

    নগেনের দম বন্ধ হয়ে এল। নাকে অসহ্য ব্যথা। ঠোঁটের কোণে নোনা স্বাদ। নাক থেকে বোধহয় রক্ত পড়ছে।

    নোনা স্বাদ থেকে নোনতার কথা মনে পড়ল। ও কোথায় গেল?

    লোকজনের শরীর আর মাথার ফাঁক দিয়ে আর-একটা জটলা একঝলক নগেনের চোখে পড়ল। লোকগুলো কাকে যেন গালিগালাজ করছে, ওদের আক্রমণের হাত উঠছে নামছে।

    নগেনের শরীর আর নিতে পারছিল না। গণধোলাইয়ের চাপ নেওয়া খুব সহজ নয়। ওর মাথায় সাংঘাতিক ব্যথা। কোথায় যেন একটা শিরা টনটন করছে। তলপেট দপদপ করছে। তারই মধ্যে চোয়ালে একটা ঘুসি এসে পড়ল।

    নোনতার অবস্থাও নগেনের চেয়ে কিছু ভালো নয়। ও পাবলিকের মার খাচ্ছিল। তারই মধ্যে দুটো হাত মুখের সামনে রেখে মুখটাকে যথাসম্ভব বাঁচাতে চেষ্টা করছিল। পকেটে যে ওয়ান শটারটা রয়েছে সেটা নোনতার ভালো করেই মনে ছিল। কিন্তু ও সেটাকে বের করার কথা একটিবারের জন্যও ভাবেনি। কারণ, ওটা বের করলে যে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে সেটা নোনতা বুঝতে পেরেছিল।

    ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’-র সামনে রাস্তার ওপরে দিনের আলোয় যে-ঘটনা ঘটছিল সেটা ভিড়ের মধ্যে হাজির বহু মানুষই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আশাপুরের সাধারণ মানুষ পলানের দলের দুটো গুন্ডাকে তেড়ে পেটাচ্ছে! ওদের বাইক ভাঙচুর করে ‘দ’ করে দিয়েছে!

    গন্ডগোলটা মাপে ক্রমশ বড় চেহারা নিচ্ছে দেখে রোশন পটকা, পিনু, ববিনদের জন্য একটু চিন্তায় পড়ে গেল। ও নিতুয়াকে বলল বাচ্চাগুলোকে নিয়ে স্পট থেকে চলে যেতে। ওদের বাড়ি পৌঁছে দিতে।

    তখন নিতুয়া জিগ্যেস করল, ‘আর তুমি? তুমি বাড়ি যাবে না?’

    ‘না, আমি এখন যাব না। তা ছাড়া সবাই মিলে ছেলেদুটোকে এভাবে মারছে…এটা ঠিক হচ্ছে না…।’

    নিতুয়া অবাক হয়ে রোশনের মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটা বলে কী! ও কি জানে না, পলানের গুন্ডাবাহিনী আশাপুরের মানুষের ওপরে কী ধরনের সন্ত্রাস-রাজ কায়েম করে রেখেছে! তার মধ্যে কাটা নগেন আর নোনতা পলানের দুজন কুখ্যাত চ্যালা। আশাপুরের পাবলিকের ওপরে কী টরচারটাই না করেছে এরা! আজ পাবলিক খেপে গিয়ে তার শোধ নেওয়ার পালা শুরু করেছে। তাতে রোশন বলছে, নোনতা আর নগেনকে এভাবে মারাটা ঠিক হচ্ছে না। ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এই দেড়-দু-মাসে আশাপুরের প্রায় সবকিছুই তো রোশন জেনে গেছে। তা হলে এই দুটো গুন্ডার জন্য ও…?

    রোশন নিতুকে তাড়া দিল : ‘নিতুদা, তুমি ববিনদের নিয়ে শিগগির, চলে যাও—আর দেরি কোরো না। বাচ্চাগুলোর বাড়ির লোকজন চিন্তা করবে…। দিদি আমাকে পাঁচকথা শুনিয়ে দেবে।’ দিদি মানে ববিনের পিসি, সাবিত্রী।

    নিতু আর কিছু বলতে পারল না। রোশনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও ববিনদের তাড়া দিল : ‘অ্যাই, চল চল, সব বাড়ি যাবি চল…।’

    ওদের নিয়ে আবার রাস্তা পার হল নিতু। সাইকেলটা মাঠ থেকে নিতে হবে।

    নিতু বাচ্চাদের নিয়ে সরে যেতেই রোশন ভিড়ের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেল।

    ‘একটু দেখি…প্লিজ, একটু যেতে দিন…ভেতরে যেতে দিন…।’ বলতে-বলতে ভিড়ের ভেতরে ঢুকল রোশন।

    তখনই নগেনকে ও দেখতে পেল।

    মুখের নানান জায়গায় কেটে গেছে। ডানদিকের ভুরুর কাছটা অনেকটা ফুলে উঠেছে, ফলে ডান চোখটা ছোট হয়ে গেছে। নগেনকে ভালো করে চেনা যাচ্ছে না। ওর জামায় রক্তের দাগ।

    পাবলিক তখনও ওর ওপরে হাত চালাচ্ছিল। নগেন সামনে হাত তুলে সেই আক্রমণগুলোকে ঠেকাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওর শরীরে আর শক্তি নেই—ও রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছে। এখনই হয়তো টলে পড়ে যাবে।

    নগেনকে দেখে রোশনের খুব খারাপ লাগল। এরকম শাস্তির কথা ও কখনও ভাবেনি। এখনও যদি এই গণধোলাই না থামানো যায় তা হলে শেষ পর্যন্ত হয়তো…।

    ‘ওকে আর মারবেন না। ওকে আর মারবেন না।’ রোশন চিৎকার করতে শুরু করল, ‘ও যদি মরে যায় তা হলে আপনাদের সবার নামে পুলিশ-কেস হবে। প্লিজ, থামুন! থামুন! ওকে আর মারবেন না…!’

    ‘পুলিশ-কেস’ কথাটা শোনামাত্রই অনেকের হাত চালানো থেমে গেল। কেউ-কেউ জটলার কাছ থেকে চটপট সরে গেল। ভিড় পাতলা হতে শুরু করল।

    রোশনের আশপাশ থেকে দু-চারজন বয়স্ক মানুষ তখন বলছিলেন যে, এরকমভাবে মারাটা ঠিক হচ্ছে না। সবাই মিলে একজনকে ধরে মারছে—এটা তো আরও অন্যায় হচ্ছে!

    রোশন ভিড় ঠেলে নগেনের কাছে গেল। ওর হাত ধরে চেঁচিয়ে সবাইকে বলল, ‘প্লিজ, আপনারা যে যার কাজে যান। এখনই পুলিশ এখানে এসে পড়বে। যান, যে যার কাজে যান…।’

    নগেন তখন রোশনের একটা হাত আঁকড়ে ধরেছে। রোশন টের পেল, নগেনের শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। রোগা, বেঁটে ছেলেটা রোশনের গায়ে নিজের ওজন ছেড়ে দিয়েছে।

    পাশেই নোনতার ওপরে পালিশের অপারেশন চলছিল। রোশনের কথায় আর চিৎকারে অপারেশনের তেজ কমে এসেছিল। কেউ-কেউ আর মারধোর করতে বারণও করছিল।

    নগেনকে সামলে নেওয়ার পর রোশন একটা হাত নোনতার দিকে দেখিয়ে আবার চিৎকার করতে লাগল, ‘ছেড়ে দিন! ওকে ছেড়ে দিন! ছেলেটা এবার মরে যাবে!…প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন!’

    পাবলিক এবার অনেকটাই দমে গেল, থমকে গেল।

    রোশন নগেনকে নিয়ে নোনতার কাছে এগিয়ে গেল। পাবলিকের মারে ছেলেটার মুখ-চোখ একেবারে ফেটেফুটে গেছে। পাবলিক যে এতটা খেপে যাবে সেটা রোশন ভাবতে পারেনি। আসলে অনেকদিনের ঘেন্না, রাগ, আর কিছু করতে না পারার ক্ষোভ, একসঙ্গে দলা পাকিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

    রাস্তার যানজট এর মধ্যে আরও জট পাকিয়ে গেছে। গাড়ি, সাইকেল, সাইকেল-রিকশা যে যেমন খুশি হর্ন দিচ্ছে। রোশন রাস্তা থেকে ভিড় সরানোর জন্য সবাইকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল। তারই মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে নোনতার দখল নিল।

    নোনতার অবস্থা ভালো নয়—মাতালের মতো এদিক-ওদিক টলছে।

    রোশন আশপাশের লোকজনকে দুটো সাইকেল-রিকশা ধরে দিতে বলল। তারপর ব্যাংকের দিকে তাকিয়ে দেখল, ম্যানেজার মিস্টার জানা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে রাস্তার ঝামেলার দিকে তাকিয়ে আছেন।

    রোশন নগেন আর নোনতাকে দু-হাতে শক্ত করে ধরে ব্যাংকের গ্রিলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল, ‘ম্যানেজারসাহেব, একটা রিকোয়েস্ট ছিল…।’

    ‘কী?’ জেনারেটারের আওয়াজ ছাপিয়ে গ্রিলের পিছন থেকে মিস্টার জানা জিগ্যেস করলেন। ওঁর গলায় যন্ত্রণার ছাপ। বাঁ-হাত দিয়ে এখনও ডানহাতটার নার্সিং করে চলেছেন।

    ‘আপনি এই দুজনের নামে প্লিজ পুলিশে কোনও রিপোর্ট করবেন না। এরা এর মধ্যেই অনেক শাস্তি পেয়ে গেছে। দেখুন, ওদের কী হাল হয়েছে…!’

    ম্যানেজার নগেন আর নোনতার ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘ঠিক আছে…আপনি যখন বলছেন…।’ ওঁর মুখ দেখে মনে হল, শাস্তি নিয়ে যে-মন্তব্য রোশন করেছে তার সঙ্গে তিনি একমত।

    দুটো সাইকেল-রিকশা রোশনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তারই একটায় রোশন নগেনকে তুলল—তারপর নিজেও উঠল। অন্য রিকশাটায় নোনতাকে তুলে বসানোর জন্য জমায়েত জনতাকে অনুরোধ করল ও। আরও বলল, চোট পাওয়া মানুষটাকে আগলে ধরে কেউ একজন যেন ওর পাশে বসে।

    সঙ্গে-সঙ্গে কাজ হল। রোগাপাতলা একটা কালো মতন ছেলে টপ করে নোনতাকে চাগিয়ে তুলে রিকশায় বসিয়ে দিল। তারপর একলাফে নোনতার পাশে বসে পড়ে রোশনকে জিগ্যেস করল, ‘দাদা, একে কোথায় নিয়ে গিয়ে আনলোড করব?’

    ‘ডাক্তার সুধীর পাঠকের চেম্বার। ”সুনিরাময়”। এখনই এই দুজনের ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার। হেভি চোট পেয়েছে…।’

    ‘যা বলেছ, দাদা—’ কালোমতন ছেলেটা বলল, ‘একেবারে কেলিয়ে কালাচাঁদ হয়ে গেছে—।’ কথাটা বলতে-বলতে ছেলেটা নোনতাকে আরও ভালো করে জাপটে ধরল, যাতে নোনতা কাত হয়ে পড়ে না যায়।

    রোশন দেখল, ছেলেটার হলদে টি-শার্টে নোনতার রক্তের ছোপ লেগে গেছে।

    নিজের টি-শার্টের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল রোশন। হ্যাঁ, ওটারও একই অবস্থা—কাটা নগেনের রক্ত লেগে আছে সেখানে।

    সাইকেল-রিকশা দুটোকে জনতার ভিড় ঘিরে ছিল। রিকশাদুটো হর্ন বাজিয়ে চাকা গড়ানো শুরু করতেই ভিড় দুপাশে সরে গিয়ে পথ তৈরি করে দিল। রোশন রিকশাওয়ালা দুজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ভাই, সুধীরডাক্তারবাবুর চেম্বারে যাব। ”সুনিরাময়”।’

    রিকশাদুটো চলতে শুরু করল। পিছনে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’ আর পাবলিকের ভিড় পড়ে রইল। জনগণ নানান আলোচনা করছিল। তারই মধ্যে কয়েকজন বলছিল, এতক্ষণ ধরে এখানে ঝামেলা চলল, অথচ পুলিশের টিকি পর্যন্ত দেখা গেল না।

    আরও তিনজন বেশ অবাক হয়েই বলল, ‘হ্যাঁ। আবার দ্যাখো, এত বামাল হল, বাট পলানদা কিংবা ওর চ্যালাচামুণ্ডারাও কেউ স্পটে শো হল না। ব্যাপারটা পিকিউলিয়ার লাগছে না?’

    নগেন যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিল। রোশন ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘আর দশমিনিট—তারপরই আমরা ডাক্তারবাবুর চেম্বারে পৌঁছে যাব। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর-একটু সহ্য করো…।’

    রিকশা হর্ন দিচ্ছিল, গর্তে ভরা এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে বাহন দুটোর চাকা গড়িয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার লোকজন—যাদের রিকশাদুটোর দিকে নজর পড়ছিল—অবাক হয়ে রিকশার যাত্রীদের দেখছিল। কেউ-কেউ রোশনকে চিনতে পারল, আবার কেউ-কেউ কাটা নগেন আর নোনতাকে চিনতে পারল।

    আকাশের দিকে তাকাল রোশন। রোদের ওপরে মেঘের সর পড়েছে। তার ফাঁক দিয়ে ডিমের কুসুমের মতো সূর্য চোখে পড়ছে।

    রোশনের চারপাশে আশাপুর শান্তভাবে বিছিয়ে রয়েছে। ব্যস্ত মানুষজন, গাড়ি, রিকশা, সাইকেল। গাছপালা, পুকুর, বুলবুলি, শালিখ, কাক, চড়ুই, আর মাথার ওপরে আকাশ। এসবই রোশন দেখতে পাচ্ছে। সেইজন্যই হয়তো এসবের সঙ্গে রোশনের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। ঠিক নিতুয়া, সাবিত্রী, ববিনের মতো। এ ছাড়া কথাবার্তা মানুষের সম্পর্ককে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। দু-মাস আগেও এরা সব রোশনের কেউ ছিল না। রোশন শুধু নিজেকে নিয়ে ছিল, একা। একা থাকবে বলেই ও অচেনা অজানা এই আশাপুরে হুট করে বাস থেকে নেমে পড়েছিল।

    কিন্তু তার পর?

    তারপর কী করে যেন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। দমকা বাতাসের মতো নতুন-নতুন সম্পর্ক রোশনকে ছুঁয়ে যেতে লাগল। বাতাসকে আমরা চোখে দেখতে পাই না, ছুঁতে পারি না। কিন্তু বাতাস অনায়াসে আমাদের ছুঁয়ে ফেলতে পারে…হয়তো দেখতেও পায়।

    আহত কাটা নগেনকে আঁকড়ে ধরে রোশন এসব কথা ভাবছিল।

    ঠিক তখনই নগেনের পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল। একটা চটুল হিন্দি গানের রিং টোন রোশনের কানে ধাক্কা মারল।

    নগেন রোশনের ঊরুতে চাপ দিল। রোশন ওর দিকে তাকাতেই ও কোনওরকমে বলল, ‘ফোনটা…পকেট থেকে…বার করে…দাও…।’

    গোঙাচ্ছিল বলে নগেনের কথা বুঝতে বেশ কষ্ট হল।

    নগেন ওর শরীরটাকে বাঁ-দিকে খানিকটা হেলিয়ে দিল। রোশন ওর ডানপকেট থেকে ফোনটা বের করে নগেনের হাতে দিল। ফোনের পরদায় কলারের নাম ফুটে উঠেছে : ‘পলানদা’।

    নগেন ‘অ্যাকসেপ্ট’ বোতাম টিপে মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরল।

    ‘হ্যাঁ, পলানদা—বলো…।’ কোনওরকমে বলল নগেন। ওর চোয়াল নাড়তে অসহ্য কষ্ট হচ্ছিল।

    ‘তোর ওখানে ক্যাচাল মিটেছে?’ পলানের গলা বেশ রুক্ষ, বিরক্ত।

    ‘হ্যাঁ—।’

    ‘এখনও ঠেকে ফিরছিস না কেন? কোথায় আছিস তুই?’

    ‘আমি ডাক্তারখানায় যাচ্ছি। পাবলিক আমাকে হেভি কেলিয়েছে।’ নগেন কুঁতিয়ে-কুঁতিয়ে বলল, ‘হেভি ইনজিয়োরড। একেবারে ফেটেফুটে গেছে…।’ কথার শেষে নগেন হাপরের মতো হাঁপাতে লাগল।

    ‘নোনতা কোথায়?’

    ‘ফ্রন্টের রিশকায়…।’

    ‘মানে?’ পলানের বিরক্ত প্রশ্ন শোনা গেল।

    ‘আওয়ার মোটরবাইক…ভাঙচুর হয়ে গেছে। ব্যাংকের সামনে পড়ে আছে। তুমি ওটা তোলানোর অ্যারেঞ্জমেন্ট করো। এখন রোশন আমাদের রিশকা করে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছে…।’

    ‘কে নিয়ে যাচ্ছে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল পলান।

    ‘রোশন।’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল কাটা নগেন, ‘এই তো…আমার সাইড বাই সাইড বসে আছে…।’

    রোশন নগেন আর নোনতাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছে! রোশন!

    কী হচ্ছে এসব! কী করে হচ্ছে?

    ফোন কেটে দিল পলান।

    নগেন আর নোনতা গণধোলাই খেল! ওদের বাইক ভাঙচুর হল! এই আশাপুরে!

    আশ্চর্য! পলান এসব ভাবতেই পারছে না।

    ব্যাংকের সামনে গোলমালের খবর পলান আগেই পেয়েছিল। ব্যাংকের কাছে হাজির থাকা মানুষজনের দুজন পলানকে ফোন করে খবরটা দিয়েছে। আশাপুরে এমন মানুষও বেশ কিছু আছে যারা পলানের বলতে গেলে গুপ্তচর। তারা পলানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে, খবরাখবর দেয়।

    পলান বুঝতে পেরেছিল কেসটা ঘোরালো হয়ে জট পাকিয়ে গেছে। তাই ও স্পটে যায়নি। ঝড়ঝাপটা যা যাওয়ার নগেন আর নোনতার ওপর দিয়েই যাক। তা ছাড়া খবরটা পেয়েই সাব-ইনস্পেক্টর সুরেন দাসের সঙ্গে পলান ফোনে কথা বলে নিয়েছে। দিনেরবেলায় মেন রোডের ওপরে ব্যাংকের জেনারেটার নিয়ে ক্যাচাল। এটা অনেক দূর গড়াতে পারে। তাই সুরেনদাকে পলান রিকোয়েস্ট করেছে, খবর পেলেও সুরেনদা যেন স্পটে পুলিশ-টুলিশ না পাঠায়। কেসটা নিজে থেকেই একটু থিতিয়ে যাক। পরে কিছু যদি হয় তখন সালটে নেওয়া যাবে।

    পলানের কথায় সুরেন দাস শুধু হেসে বলেছেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না, পলানদা। আমার ওপরে ভরসা রাখুন…।’

    কিন্তু এর মধ্যে রোশন ছেলেটা ঢুকে পড়েই সব গোলমাল করে দিল।

    নগেন আর নোনতাকে ও ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছে!

    ব্যাপারটা পলান কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

    ***

    রোশন সাইকেল নিয়ে আশাপুরের রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

    সন্ধে নামতেই ও ববিনকে পড়াতে গিয়েছিল। প্রতিদিন সন্ধেবেলা এটাই ওর রুটিন। ববিনের কোনও সময় পড়ায় মন নেই।

    সুযোগ পেলেই শুধু বল নিয়ে খেলা। কিন্তু একটু-আধটু তো লেখাপড়া করতে হবে! লেখাপড়া না করলে যে কী অসুবিধে সেটা রোশন নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারে। ওর লেখাপড়ার খিদে থাকলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা ছিল না। ববিনদের অবস্থা তার চেয়েও অনেক খারাপ। কিন্তু যতটুকু লেখাপড়া করা যায় সেটুকু তো করা দরকার!

    রোশন রোজ সে-কথাই বোঝায় ববিনকে। সাবিত্রীও লেখাপড়া করা নিয়ে ববিনকে সবসময় বকাঝকা করে।

    ববিনকে পড়ানোর পাট চুকিয়ে রোশন যখন সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামল তখন সন্ধে সাতটা।

    এখন ওর কাজ হল, সাইকেল চালিয়ে আশাপুরটা ঘুরে-ঘুরে দেখা। সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে যেদিকে মন চায় সেদিকে সাইকেল চালিয়ে দিলেই হল। তারপর খিদে পেলে কিংবা চায়ে চুমুক দিতে মন চাইলে পথচলতি কোনও দোকান ঘেঁষে সাইকেল দাঁড় করিয়ে দিলেই ব্যস।

    রোশনকে এখন আশাপুরের বহু মানুষ চিনে গেছে। তারা অনেকেই রোশনের নাম জানে না, কিন্তু ওকে চেনে। তারা জানে, এই ভদ্র-সভ্য ভবঘুরে ছেলেটা আশাপুরের যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়—কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও সাইকেলে। ছেলেটা আশাপুরের খবর রাখে, খেয়াল রাখে। ছেলেটা বলতে গেলে আশাপুর পাহারা দেয়।

    সত্যি, ছেলেটা খুব মিস্টিরিয়াস। কোথা থেকে উড়ে এসে ও জুড়ে বসেছে আশাপুরে। আর তারপর…আশাপুরকে ধীরে-ধীরে ভালোবেসে ফেলেছে। আশাপুরের ভালোমন্দের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।

    তা যদি না-ই হবে, তা হলে ও কেন পলানের সব দু-নম্বরি কাণ্ডকারখানা দেখে বাধা দেয়, প্রোটেস্ট করে? পলান আর ওর দলবল আশাপুরে যে-হুকুমত কায়েম করেছে সেটা আশাপুরের মানুষজন মুখ বুজে মেনে নিলেও রোশন সেটা মানতে পারছে না। তাই বারবার ও বিপদে পড়ছে, আর পলানের কাছে ও অসহ্য হয়ে উঠেছে।

    না, আশাপুরের লোকজন তো পলানের খারাপ কাজগুলো মুখ বুজে মেনে নেয়নি! রোশন যখন সেসব কাজের প্রতিবাদ করেছে তখন তো তাদের অনেকেই রোশনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে!

    এই পাশে এসে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে সংখ্যায় বাড়াতে হবে।

    সন্ধের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল রোশন। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির আলো তেমন নেই, তবে রাস্তার ওপরের ছোটখাটো দোকানপাটগুলো তাদের আলো দিয়ে সেই ঘাটতি মিটিয়ে দিয়েছে। একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। বর্ষার বৃষ্টি। রাস্তার নানান জায়গায় জল জমে আছে। রাস্তার সেই জলে দু-একটা বালব বা টিউবলাইটের ছায়া দেখা যাচ্ছে। জলের মধ্যে কিছু একটা ছিটকে এসে পড়লেই সেইসব আলোর ছায়াগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছে।

    অলসভাবে সাইকেল চালাতে-চালাতে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল। আধা গ্রাম আধা টাউনের সন্ধেবেলার পরিবেশ যেমনটি হয়, ঠিক তেমনটিই বলা যায়। তবে একটা তফাত রোশনের নজরে পড়েছে। সন্ধের পর ইয়াং ছেলেদের যেসব আড্ডা সাধারণত চোখে পড়ে সেসব জটলা বা আড্ডা রোশনের চোখে পড়েনি। আশাপুরের বেশ একটা বড় এলাকা জুড়ে একমাত্র আড্ডার উদাহরণ হল পলানের ঠেক—’জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর সামনের ফুটপাথে।

    ব্যাপারটা রোশনকে বেশ অবাক করেছিল, কারণ, সন্ধের পর আড্ডা জিনিসটা গ্রাম বা শহরের রোজকার জীবনযাত্রার একটা স্বাভাবিক কম্পোনেন্ট। আশাপুরের জীবনযাত্রায় সেই জিনিসটার অভাব সত্যিই চোখে পড়ার মতো।

    একটা মাস আশাপুরে কাটতে না কাটতেই ব্যাপারটা ওর নজরে পড়েছিল। আর এটাও নজরে পড়েছিল যে, বেশ কয়েকটা দোকানের সামনে বা কোনও পাকা বাড়ির রোয়াকে প্রৌঢ় বা বৃদ্ধদের হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা দিব্যি চলছে।

    একদিন সন্ধেবেলা গেস্টহাউসে বসে বিশ্বরূপদার সঙ্গে গল্প করতে-করতে কথাটা জিগ্যেস করেছিল রোশন।

    বিশ্বরূপ তখন একটা প্লাস্টিকের বাটিতে মুড়ি নিয়ে খাচ্ছিলেন। তেল দিয়ে মাখা মুড়ি, সঙ্গে কুচো পেঁয়াজ আর লঙ্কা। বিশ্বরূপের চোখেমুখে তৃপ্তি ফুটে উঠেছিল। আঃ! এর চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না।

    রোশন বিশ্বরূপ জোয়ারদারের কাছে এসে বসামাত্রই বিশ্বরূপ ওকে তেল-মুড়ি শেয়ার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

    তাই ওঁরা দুজনে এ-কথা সে-কথা বলছিলেন আর মাঝে-মাঝে মুড়ির বাটিতে হাত ডোবাচ্ছিলেন।

    কথায়-কথায় রোশন হঠাৎই জিগ্যেস করে বসল, ‘আচ্ছা, বিশ্বরূপদা, একটা কথা বলুন তো। আমি এই যে রোজ আশাপুরে ঘুরে বেড়াই, কোথাও ইয়ং ছেলের দলবলকে আড্ডা-ফাড্ডা মারতে দেখি না তো!’ একমুঠো মুড়ি মুখে ঢোকাল রোশন, চিবোতে-চিবোতে বলল, ‘অবশ্য পলানদাদের গ্যাংটা ছাড়া। ওরা তো রোজই সকাল-সন্ধে ওই ”জনপ্রিয়” মিষ্টির দোকানের সামনে বসে গ্যাঁজায়, গুলতানি মারে…।’

    বিশ্বরূপ জোয়ারদার মুখের মধ্যে ঠাসা মুড়িকে চিবিয়ে ম্যানেজ করছিলেন। সেই অবস্থাতেই মুখটা হাসি-হাসি করার চেষ্টা করে ইশারায় একটু সময় চাইলেন।

    একটু পরে মুড়িটা কবজা করে বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই খেয়াল করেছ। আশাপুরে বুড়োদের আড্ডা চোখে পড়লেও অল্পবয়েসি ছেলেপিলেদের আড্ডা তোমার চোখে পড়বে না। ছেলেরা সকালে স্কুল-কলেজে যায়, বিকেলে খেলাধুলো করে—তারপর যে-যার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। নো আড্ডা। ওরা বাড়িতে বসে এর-তার সঙ্গে ফোনে কথা-টথা বলতে পারে, কিন্তু সামনাসামনি আড্ডা অ্যালাউ না…।’

    ‘অ্যালাউ না মানে?’ রোশন বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নটা করেছিল।

    ‘অ্যালাউ না মানে পলান নস্করের অর্ডার।’ কথাটা বলে বিশ্বরূপ মুড়ির বাটিতে হাত ডোবালেন। রোশন তখনও চোখে প্রশ্ন নিয়ে বিশ্বরূপ জোয়ারদারের মুখের দিকে তাকিয়ে।

    কয়েক গাল মুড়ি খেয়ে বিশ্বরূপ একটু সময় নিয়ে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আশাপুরে ছেলেপিলেদের আড্ডা যেমন অ্যালাউ না, তেমনই কোনও ক্লাবও অ্যালাউ না। কারণ, ক্লাব মানেই আড্ডা। আমাদের এখানে তাই একটাই ক্লাব : ”আশাপুর উন্নয়ন সংঘ”। পলানের ক্লাব। ওর তোলাবাজিকে অফিশিয়াল চেহারা দেওয়ার জন্যে যেমন ”আশাপুর উন্নয়ন সমিতি”, তেমনই অন্যান্য কাজকর্ম পলান করে এই ”আশাপুর উন্নয়ন সংঘ”-এর কভারে। আশাপুরের যত প্রোগ্রাম হয়, সব করে পলান নস্করের এই ক্লাব।

    ‘পলান লেখাপড়া তেমন না শিখলেও ওর কূটবুদ্ধি মারাত্মক ধারালো। ও এমনিতে প্রচার করে বেড়ায় যে, যেসব ছেলেরা স্টুডেন্ট, পড়াশোনা নিয়ে আছে, আড্ডা জিনিসটা তাদের পক্ষে ভালো নয়। ওরা মন দিয়ে লেখাপড়া করুক, যাতে রেজাল্ট ভালো হয়। এতে আশাপুরের নাম বাড়বে, মুখ উজ্জ্বল হবে…।’

    ‘পলান বলছে এইসব কথা!’ রোশনের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।

    ‘হ্যাঁ, পলান বলছে…’ হাসলেন বিশ্বরূপ : ‘আরও কী বলছে জানো? ও আশাপুরের সিনিয়র লোকদের এ-কথাও বলে বেড়ায়, ও লেখাপড়া করতে পারেনি বলে লেখাপড়ার মর্ম ও আরও বেশি করে বোঝে। ও চায় আশাপুরে আর কেউ যেন ওর মতন না হয়।’

    রোশন একমুঠো মুড়ি মুখে দিল। খেতে-খেতে বলল, ‘এ তো পুরো মহাত্মা গান্ধী আর রাজা রামমোহন রায়ের মতো কথা…!’

    ‘তাই না তাই বটে!’ হেসে বললেন বিশ্বরূপ, ‘আসলে এসব কথার একটা ইনার মিনিং আছে—।’

    ‘ইনার মিনিং?’

    ‘হ্যাঁ, ইনার মিনিং।’ বিশ্বরূপ ধীরে-ধীরে বলতে লাগলেন, ‘রোশন, মানুষ যখন খোলা হালকা মনে আড্ডা মারে তখন সে সবসময় মনের কথা বলে, নিজের কথা বলে, তার ভাবনার কথা বলে। তাই আড্ডাতে এর ভাবনা ওর কাছে যায়, ওর ভাবনা এর কাছে আসে। নানান মতামত ঘোরাফেরা করে। তারপর কমন মত বা ভাবনাগুলো জোট বাঁধে।

    ‘এবার ধরো, গোটা আশাপুর জুড়ে নানান জায়গায় আড্ডা চলছে। পলানের অরগানাইজ করা গোডাউন ফাইট নিয়ে কথা উঠছে, আলোচনা হচ্ছে। পলানের তোলাবাজি নিয়ে অনেকে আপত্তি তুলছে, সেসব বন্ধ করার কথা বলছে। এইরকম আরও অনেক কিছু…।

    ‘ধরো, এইরকম সব আড্ডা হতে-হতে ধীরে-ধীরে পলানের এগেইনস্টে একটা জোট তৈরি হল। তখন সেই জোটটা পলানের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, আশাপুরের ইয়ং ছেলেমেয়েরা আশাপুরের ভালোর জন্যে পলানের এগেইনস্টে একটা ফোর্স তৈরি করবে।

    ‘সেই ব্যাপারটাই পলান চায় না। তাই পড়াশোনার ক্ষতি হবে এই অজুহাতে আশাপুরের ইয়ং জেনারেশনের আড্ডা গুলতানি বন্ধ। আর নতুন কোনও ক্লাব-টাব তৈরি করাও বন্ধ। এবার বুঝলে ব্যাপারটা?’

    রোশন খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল। মনে-মনে সেদিন পলানের কূটবুদ্ধির তারিফও করেছিল ও।

    সাইকেল চালাতে-চালাতে রোশন এসব কথাই ভাবছিল। ভাবছিল আশাপুরের কথা, আশাপুরের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা।

    গত কয়েকমাসে পলান নস্করের সঙ্গে যতবারই ওর রাস্তা কাটাকাটি হয়েছে ততবারই একটা ঝঞ্ঝাট বেধেছে। আর এইসব ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা থেকেই আশাপুরের বহু মানুষ রোশনকে চিনে গেছে। অনেকে ওর নাম জানে, আবার অনেকে জানে না। কিন্তু লোকের মুখে-মুখে ‘রোশন’ নামটা ছড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ব্যাংকের ওই জেনারেটার নিয়ে ঝামেলার পর রোশনের নামটা চাউর হয়েছে আরও বেশি। একইসঙ্গে পলানের দু-নম্বরি কাজকর্ম আর দুর্নীতি নিয়ে লোকজন হাটেবাজারে, দোকানে, রাস্তাঘাটে খোলাখুলি কথা বলছে। আগে তারা এসব কথা আড়ালে-আবডালে নীচু গলায় বলত।

    কিছুদিন ধরে একটা কথা রোশনের মনে হচ্ছিল : আশাপুরে একটা কোনও অনুষ্ঠান করতে পারলে বেশ হয়। এখানে যত অনুষ্ঠান হয় সবই পলানদারা করে। আশাপুরের নাম দিয়ে অনুষ্ঠানগুলো হলেও তাতে পলানদেরই মাতব্বরি থাকে। আশাপুরের লোকজন সেগুলোকে ঠিক নিজেদের অনুষ্ঠান বলে মেনে নিতে পারে না। বরং বেশিরভাগ মানুষই সেসব অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে চলে।

    শুধু যে বিশ্বরূপ জোয়ারদার রোশনকে এসব কথা বলেছেন তা নয়। সাইকেলের দোকানের বাবুনদা, নিতুদা, রতনমণি মাঝি, সুধীর ডাক্তারবাবু, সবাই একই কথা বলেছে ওকে।

    আশাপুরের সর্বজনীন দুর্গাপুজো, কালীপুজো সবই চলে গেছে পলানের হাতে। একমাত্র স্কুলের ছেলেমেয়েদের সরস্বতীপুজো করার ছোট-ছোট চেষ্টাগুলোকে পলান ছাড় দিয়েছে। সেসব পুজোয় পলান দু-পাঁচশো টাকা করে ডোনেশানও দেয়।

    রোশনকে রতনমণি বলেছেন, ‘আমাদের এখানে দুর্গাপুজো, কালীপুজো খুব জাঁকজমক করে হয়, কিন্তু তুমি পুজো প্যান্ডেলে আশাপুরের মানুষজনকে খুব একটা দেখতে পাবে না। আর যারা প্যান্ডেলে যায় তাদের ফিলিংটা এমন থাকে যেন তারা বাইরের লোক, গেস্ট—অন্য পাড়ার পুজো দেখতে এসেছে…।’

    ‘কিন্তু, রতনদা, পলানদা এই বারোয়ারি পুজোগুলোকে হাতে নিয়েছে কেন? এতে তো হাজাররকম ঝক্কিঝঞ্ঝাট—তাতে পলানদার লাভ কী?’

    প্রশ্নটা শুনে রতনমণি মাঝি হেসেছিলেন।

    ‘কী লাভ? শোনো, বুঝিয়ে বলছি। সবথেকে বড় লাভ হল টাকাপয়সা। আর তার পরের লাভ হল নিজের নাম ফাটানো। আশাপুর বা তার আশপাশের অঞ্চলের লোকজন আমাদের সর্বজনীন পুজোগুলোকে বলে পলান নস্করের দুর্গাপুজো, পলান নস্করের কালীপুজো। এইভাবে নিজের প্রচার বাড়াতে-বাড়াতে এমন একটা স্টেজ এসে গেছে যে, আশাপুরের সংস্কৃতি মানেই লোকে এখন পলানকে বোঝে। আর ”আশাপুর উন্নয়ন সংঘ”-এর চিরস্থায়ী সেক্রেটারি হল পলান—অর্থাৎ, আমাদের এলাকার উন্নয়ন মানেই পলান। এইভাবে দিনে-দিনে ও এই অঞ্চলের সমাজসেবী হয়ে উঠেছে। তারপর…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসেছেন রতনমণি মাঝি : ‘তারপর আর কী! নেক্সট ইলেকশানে পলান হয়তো রুলিং পার্টির ক্যান্ডিডেট হয়ে দাঁড়াবে।’

    আশাপুরের এরকম একটা ভবিষ্যৎ রোশন ভাবতে পারছিল না। তবে ও ভালো করেই জানে, ও ভাবতে পারছে না বলে সেটা হবে না, এমনটা কখনও নয়। পলান নস্করের একমাত্র টার্গেট পয়সা ইনকাম করা—তা সে যেভাবেই হোক। এলাকার সর্বজনীন পুজোর দখল, জগন্ময়ী কালী মন্দিরের ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্স, ব্লাইন্ড ফাইট, এলাকায় তোলাবাজি—সবকিছু তো একই দিকে ইশারা করছে!

    নাঃ, কিছু একটা করা দরকার। একটা অন্তত অনুষ্ঠান যেটার পরিচালনায় থাকবে আশাপুরের সাধারণ মানুষ। সেই অনুষ্ঠানে পলান নস্কর আর তার গুন্ডাবাহিনীর দলবল থাকবে নেহাতই দর্শকের ভূমিকায়। কিংবা ‘গেস্ট’। মানুষ জানুক, পলানকে বাদ দিয়েও আশাপুরে কোনও অনুষ্ঠান করা যায়।

    এইসব কথা ভাবতে-ভাবতেই রোশনের মনে হয়েছিল স্বাধীনতা দিবসের কথা।

    জুলাই মাস শেষ হতে আর দিনদশেক বাকি আছে। যদি স্বাধীনতা দিবসে একটা প্রোগ্রামের কথা ভাবা যায় তা হলে তার জন্য তৈরি হওয়ার এখনও অনেক সময় আছে। তা ছাড়া আরও একটা কথা রোশনের মনে হল। আশাপুরে এমন বহু মানুষ আছে যারা পলান আর তার দঙ্গলকে পছন্দ করে না বলে পলানের কোনও ফাংশানে যায় না। এরকম বেশ কয়েকজন মানুষের কথা রোশনের মনে পড়ছে। যেমন, রতনমণি মাঝি, সুধীর ডাক্তারবাবু, বিশ্বরূপ জোয়ারদার, এ ছাড়া আরও কয়েকজজন। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ তো পলানের কুকীর্তির স্পষ্ট সমালোচনা করেন।

    বিশ্বরূপদা ভিতু মানুষ, তাই আড়ালে রোশনের কাছে পলানের ব্যাপারে নিজের চাপা ক্ষোভ উগরে দেন। কিন্তু সুধীর ডাক্তারবাবু তো প্রকাশ্যেই বলেন। জগন্ময়ী কালীমন্দিরে সুবুর ছুরি খেয়ে রোশন যখন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়েছিল তখন ডাক্তারবাবু তো পাঁচজনের সামনেই স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘পলানটা বড্ড বেড়েছে।’ কথাটা রোশনের এখনও মনে আছে।

    তা হলে স্বাধীনতা দিবসে একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? আশাপুরের সব সাধারণ মানুষ আসবে সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটা যদি সাকসেসফুল হয় তা হলে পলানদাকে একটা জবাব দেওয়া যাবে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান তো রোশনের পক্ষে অরগ্যানাইজ করা সম্ভব নয়। বেস্ট হচ্ছে, ডাক্তার সুধীর পাঠকের মতো একজন মান্যগণ্য মানুষকে একেবারে সামনে রেখে এর আয়োজন করা। তা হলে এলাকার সিনিয়ার মানুষদের পাশে পাওয়া যাবে।

    লাস্ট ক’দিন ধরে এই আইডিয়াটাই রোশনের মাথায় ঘুরছিল।

    বিশ্বরূপ জোয়ারদারের কাছে রোশন শুনেছে, স্বাধীনতা দিবসে আশাপুর চিলড্রেন্স পার্কে পলান বেশ বড় করে স্টেজ-ফেজ তৈরি করে ‘আশাপুর উন্নয়ন সংঘ’-এর ব্যানারে একটা প্রোগ্রাম করে। পার্কে পারমানেন্ট একটা ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড রয়েছে। প্রোগ্রামের দিন ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, দড়ি, ফুল সবকিছু দিয়ে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডটাকে রেডি করা হয়। তারপর সকাল দশটায় সেখানে সব মান্যগণ্য লোকজন হাজির হন। তাঁদের মধ্যে মাননীয় লোকাল এম. এল. এ., ওয়ার্ডের কমিশনার থাকেন। আরও থাকেন তাঁদের সঙ্গী বেশ কিছু মানুষ। এ ছাড়া থাকে পলান। সব ব্যবস্থা ঠিকঠাকভাবে করা হয়েছে কিনা পলান তার তদারকি করে আর গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর চারদিকে ঘুরে-ঘুরে একনিষ্ঠভাবে চরম মোসাহেবি করে। ওর লেজ নেই তাই, থাকলে হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে এপাশ-ওপাশ নড়ত।

    তারপর ফ্ল্যাগ তোলা হয়। স্থানীয় বিধায়ক পতাকা তোলেন। উত্তোলিত পতাকা থেকে ফুল ঝরে পড়ে। চারপাশে ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’ জিগির আর হাততালির ফোয়ারা ছোটে। বিধায়ক মহাশয় পতাকার দিকে মুখ তুলে ‘জয় হিন্দ’ বলে স্যালুট করেন। তাঁর কাছাকাছি আরও অনেকে সেই জিগিরের প্রতিধ্বনি তুলে স্যালুট করেন। পতাকা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পলানের চ্যালারা মোবাইল ফোনে পটাপট ছবি তুলতে থাকে।

    পরের পর্ব হল বক্তৃতা-পর্ব। মাননীয় অতিথিরা স্টেজে ওঠেন। স্টেজে সাজিয়ে রাখা অনেক চেয়ার। পলান প্রত্যেককে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

    প্রথমে ফুলের মালা দিয়ে বরণ। তারপর বক্তৃতা শুরু। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, মাননীয় অতিথিদের বক্তৃতার পর সবার শেষে শুরু হয় পলান নস্করের বক্তৃতা।

    পলানের বক্তৃতার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বরূপদা কিছুতেই আর হাসি চাপতে পারছিলেন না।

    ‘তোমাকে কী বলব, রোশন—পলান একে তো আকাট মুখ্যু, তার ওপর স-স উচ্চারণ। ওর বক্তৃতার কিছু স্ট্যান্ডার্ড লাইন হল : ”মঞ্চে উপস্থিত সম্মানিত গেস্টদের নমস্কার আর প্রণাম জানাই। ভারত যেমন পনেরো আগস্ট স্বাধীনতা পেয়েছে, তেমনই আমাদের জন্মভূমি আসাপুরও পনেরো আগস্ট স্বাধীনতা পেয়েছে। আমাদের সম্মানীয় বিধায়ক মহাসয় ও কমিসনার মহাসয়ের অনুপপেরণায় আমি সেই সুরু থেকে আসাপুরের উন্নয়ন করে চলেছি…।” তারপর আরও সব হাবিজাবি কথা…।’

    অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে যে-গোটা পঞ্চাশেক চেয়ার পাতা থাকে তাতে সামনের সারিতে পলানের দলের লুম্পেনগুলোই বসে থাকে। এ ছাড়া থাকে লোকাল কিছু ছেলেমেয়ে আর বাচ্চাকাচ্চা।

    পনেরোই আগস্ট রাতে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে পলান। তাতে ওদের দলবল হাজির থাকে। আর থাকে লোকাল চার-ছ’জন ব্যবসায়ী যাদের সঙ্গে পলানের দু-নম্বরি কানেকশান আছে। এই লোকগুলোই এলাকার খুঁটিনাটি খবরাখবর রেগুলার বেসিসে পলানকে সাপ্লাই করে।

    মোট কথা, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে পলান বেশ ভালো টাকা খরচ করে।

    রোশন এরকম একটা অনুষ্ঠান নিয়ে নানান কথা ভাবছিল। ভাবছিল আর এ-পথে সে-পথে ঘুরছিল। ঘুরতে-ঘুরতে কখন যেন ও সুধীর পাঠকের ‘সুনিরাময়’-এর সামনে এসে দাঁড়াল।

    ডাক্তারবাবুর চেম্বার ‘বন্ধ’ হয় সাতটায়, কিন্তু তার দরজা বন্ধ হয় না। সাতটার পর সুধীরডাক্তারের চেম্বারে আড্ডা বসে। ডাক্তারবাবুর টেবিলে খবরের কাগজ পেতে তার ওপরে ঢেলে দেওয়া হয় মুড়ি। সেই মুড়িতে মিশিয়ে দেওয়া হয় বাদাম, চানাচুর আর কিছুটা মুড়কি। পাশে একটা প্লেটে থাকে পেঁয়াজকুচি আর কাঁচালঙ্কা। এর পাশাপাশি ডাক্তারবাবু আনিয়ে নেন একডজন আলুর চপ, বেগুনি আর পেঁয়াজি। সবমিলিয়ে একেবারে রাজকীয় খাবার।

    ডাক্তারবাবু চেয়ারে বসে আছেন। আর তাঁর দুপাশে দুটো বেঞ্চিতে চারজন ভদ্রলোক বসে আছেন। একটা বেঞ্চির একপাশে পড়ে রয়েছে চারভাঁজ করা একটা লাটঘাট খাওয়া খবরের কাগজ। তার ওপরে রাখা দু-প্যাকেট তাস। কারণ, কখনও-কখনও এই আড্ডায় অকশন ব্রিজের আসর বসে।

    এখন তাসখেলা বন্ধ হয়ে আড্ডা চলছিল, আর তার সঙ্গে মুড়ি-তেলেভাজা।

    সাইকেলটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রোশন সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠল। ডাক্তারবাবু ছাড়া বাকি চারজনের মধ্যে একমাত্র রতনমণি মাঝিকে চিনতে পারল ও।

    বর্ষার বাতাসে রোশনের চুল উড়ছিল। অন্ধকার আকাশে চাপ-চাপ মেঘ। মনে হচ্ছিল, এই বাতাস বোধহয় মেঘগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে ফুরিয়ে দেবে। ডাক্তারবাবুর চেম্বারের একটু দূরেই বুনো ঝোপ। তার আশেপাশে জল জমে আছে। দু-একফালি আলো এদিক-ওদিক থেকে ছিটকে গিয়ে পড়েছে সেখানে। বোধহয় সেই জমা জলের দিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে।

    রোশনকে দেখেই রতনমণি প্রথম জিগ্যেস করলেন, ‘কী, রোশন, কী খবর?’

    রোশন আগে কখনও সুধীরডাক্তারের চেম্বারের এই আড্ডায় আসেনি।

    ডাক্তারবাবু রোশনকে দেখে দিলখোলা আওয়াজে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হে, তোমার পেট কেমন আছে?’

    ‘একেবারে সেরে গেছে, ডাক্তারবাবু…।’ রোশন চটপট বলল।

    ‘গুড, ভেরি গুড। তবে একটু সাবধানে থাকবে। পলান তো এলিমেন্ট ভালো না। রাতের দিকে আশাপুরের এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি কোরো না…।’

    রোশন ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল। একইসঙ্গে ও ভাবছিল স্বাধীনতা দিবসের কথাটা ও কীভাবে পাড়বে। এই চারজন সিনিয়ার যদি রোশনের আইডিয়াটায় রাজি হয়ে যান তা হলে পায়ের নীচে শক্ত মাটি পাওয়া যাবে।

    ওর চোখেমুখে ইতস্তত ভাবটা রতনমণি মাঝি খেয়াল করলেন। তাই আত্মীয়ের গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘রোশন, তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?’

    ‘একটা…একটা কথা ছিল…।’ ইতস্তত করে বলল।

    ‘কী-কথা?’

    সুধীর ডাক্তারবাবু রোশনকে সহজ করার জন্য হেসে বললেন, ‘আরে অত নার্ভাস হচ্ছ কেন? ইয়াংম্যানরা এরকম নার্ভাস হলে চলে! নার্ভাস তো হব আমরা! তুমি আগে বোসো—ওই বেঞ্চিটায় বোসো তো…বসে একটু মুড়ি-তেলেভাজা খাও—।’

    রোশন একটা বেঞ্চির একপাশে বসল।

    ‘নাও, এবার বলো…।’ রতনমণি ভরসা জোগানোর সুরে বললেন।

    রোশন তখন মুখ খুলল, : ‘ডাক্তারবাবু…রতনদা…’ দুজনের মুখের দিকে একবার করে তাকাল রোশন : ‘ক’দিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, আশাপুরে একটা প্রোগ্রাম করলে হয়। এই প্রোগ্রামটা আশাপুরের সবার জন্যে। প্রোগ্রামটার সামনের সারিতে থাকবেন আপনারা। আর আমরা ছোটরা আপনাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট দেব। আপনারা গাইড করবেন, আমরা কাজ করব…।’ রোশনের চোখেমুখে আবেগের ছায়া পড়ছিল। ও হাত নেড়ে বলল, ‘আমি শুনেছি, আশাপুরের যে-কোনও প্রোগ্রাম নাকি পলান নস্কর করে। ও একাই বারবার নানান প্রোগ্রামের বন্দোবস্ত করে। আর আশাপুরের বাকি মানুষরা চুপচাপ সেসব দ্যাখে, সহ্য করে।’ রতনমণির দিকে তাকাল : ‘রতনদা, আপনি প্রথম আলাপের দিন আমাকে বলেছিলেন না, ”…আমরা সহ্য করার ট্রেনিং নিয়ে-নিয়ে অসহ্য জিনিসও সহ্য করতে শিখে গেছি।” আমি চাই আমাদের সহ্য করার অভ্যেসটা এবার অসহ্য হোক…।’

    রতনমণি মাঝি, ডাক্তার সুধীর পাঠক আর বাকি তিনজন বয়স্ক মানুষ রোশনের কথা শুনছিলেন। শেষের তিনজন রোশনকে আগে কখনও দেখেননি, তবে ওর নাম শুনেছেন। জগন্ময়ী কালীমন্দিরের ‘মহাপ্রণামী’-র বাক্সের ঘটনার কথা ওঁরা জানেন। ব্যাংকের জেনারেটারের এপিসোডটাও ওঁরা বিশদে শুনেছেন। তিনজনের মধ্যে দুজন শুনেছেন যে, পাঁচটা ছোট-ছোট বাচ্চা ওদের ‘রোশনকাকু’-কে বাঁচাতে পলানের দুজন সশস্ত্র গুন্ডার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

    রোশনের কথা শুনে রতনমণি মাঝি কী বলবেন ভাবছিলেন। সুধীরডাক্তারের ফরসা কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে।

    তিনজন বয়স্ক মানুষের মধ্যে একজনের বয়েস প্রায় পঁচাত্তর কি ছিয়াত্তর হবে। রোগা চেহারা। পরনে আধময়লা ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। লেন্সের মধ্যে দিয়ে তাকালে চোখগুলো বড়-বড় দেখায়। গায়ের রং ঘোর কালো। মাথার চুল ধবধবে সাদা। ভদ্রলোকের নাম অবনীনাথ পাত্র। একটা সময়ে স্কুলে পড়াতেন। এখন বাড়িতে একটা কোচিং ক্লাস চালান। এলাকার সকলে ওঁকে ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাকেন। খুব বয়স্ক দু-চারজনের কাছে তিনি ‘অবনীমাস্টার।’

    তিনি হঠাৎ মুখ খুললেন, ‘এ তো অতি উত্তম প্রোপোজাল। স্বাধীনতা দিবসটা ঠিকঠাক করে সেলিব্রেট করলে আমরা যে স্বাধীন সেটা ভালো করে টের পাওয়া যায়। কী বলো, সুধীর? কী বলো, রতন?’

    রতনমণি মাঝি একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘একই এলাকায় দু-দুটো ইনডিপেনডেন্স ডে-র প্রোগ্রাম…ব্যাপারটা কি ভালো দেখাবে? মানে…।’

    অবনীমাস্টার একটা হালকা গালাগাল দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কেন ভালো দেখাবে না, রতন? স্বাধীনতা দিবস কি পলান নস্করের বাপের সম্পত্তি নাকি?’

    মাস্টারমশাইয়ের কথা বলার ঢঙে রোশন হেসে ফেলল। খুশিও হল মনে-মনে।

    সুধীরডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ, ইনডিপেনডেন্স ডে-টা সেলিব্রেট করাটা খুব জরুরি। পলানকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে, আশাপুরের মানুষরা স্বাধীন।’

    রতনমণি মাঝি আর বাকি দুজন বয়স্ক মানুষও কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর সুধীরডাক্তারের কথায় সায় দিলেন।

    রোশনের মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি ফুটে উঠল।

    ঠিক তখনই কালো আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল।

    ***

    আজ ১০ আগস্ট। তারিখটা রোশনের মনখারাপ-করে-দেওয়া তারিখ। কারণ, আজকের দিনটাতে কুশান চলে গিয়েছিল। সকালে রোজকার মতো পুজোয় বসার পর থেকে কুশান যেন ওর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর একইসঙ্গে নানান কথা বলছে।

    মাঝে-মাঝেই চোখে জল এসে যাচ্ছিল রোশনের—কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না। কোনও কাজেই আজ মন লাগছিল না ওর। বারবার মনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।

    আজ সকাল থেকেই আকাশে মেঘ। কখনও-কখনও টুপটাপ কি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। থামছে, আবার হচ্ছে।

    রোশনের কোনও ছাতা নেই, তাই ছাতা নিয়ে বেরোনোর কোনও প্রশ্নই নেই। ন’টার আশেপাশে বৃষ্টি যখন ধরেছিল তখন ও সাইকেল নিয়ে লজ থেকে বেরিয়েছিল। প্রথমে ও ‘মোহন সুইটস’-এ গিয়েছিল। সেখানে রোজকার মতো লুচি-তরকারি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে। খেতে-খেতে ও হঠাৎ খেয়াল করল এ-কথা সে-কথা ভাবতে-ভাবতে কখন যেন ও কুশানের কাছে পৌঁছে গেছে এবং কুশানের কথা ভাবতে শুরু করেছে। আজ সকাল থেকে বারবার এই ব্যাপারটাই হচ্ছে : যে-কোনও ভাবনার সূত্র ধরে কুশানে ফিরে আসা। ওর মনে হচ্ছিল, কুশান এখনও যেন ওর সঙ্গে-সঙ্গে রয়েছে। সাইকেল চালানোর সময় কেরিয়ারে কুশানের ওজন টের পাচ্ছে ও। কুশানের কথাও শুনতে পাচ্ছে।

    ‘মোহন সুইটস’ থেকে বেরিয়ে বাবুনদার সাইকেলের দোকানের দিকে রওনা হল রোশন। বাবুনদাকে সাইকেলের ভাড়ার টাকা দেওয়া বাকি আছে। তা ছাড়া ওর নিজের জন্য গাড়ি চালানোর কাজ যদি একটা পাওয়া যায়, সে-কথাও বলবে। একটা কাজ-টাজ করে কিছু টাকা হাতে আসা দরকার।

    তিনটে ছেলে উলটোদিক থেকে হেঁটে আসছিল। বয়েস কুড়ি-বাইশ গোছের হবে। একটি ছেলে মাথায় বেশ লম্বা—সামনের তিনটে দাঁত উঁচু, বাকি দুজন মাঝারি হাইটের। তিনজনেরই গায়ের রং ময়লা।

    লম্বা ছেলেটি হাতের ইশারায় রোশনকে সাইকেল থামাতে বলল। একইসঙ্গে ‘রোশনদা—’ বলে ডাকল।

    রোশন সাইকেল থামাল। একটা পা রাস্তায় ঠেকাল, অন্য পা-টা প্যাডেলে। লম্বা ছেলেটার মুখটা ওর যেন একটু চেনা-চেনা লাগল।

    ছেলে তিনটে ওর সাইকেলের কাছে এসে দাঁড়াল। লম্বা ছেলেটা প্রথম কথা বলল, ‘অ্যাই রোশনদা, তুমি কিন্তু ব্যাংকের কেসটায় পলানদাকে হেভি ঝটকা দিয়েছ…।’ তারিফ করার একগাল হাসি মুখময় ছড়িয়ে দিল ছেলেটা।

    রোশন ভুরু সামান্য উঁচিয়ে বলল, ‘ঝটকা মানে? কীসের ঝটকা?’

    লম্বা ছেলেটা কোনও জবাব দেওয়ার আগেই দ্বিতীয় একজন বলে উঠল, ‘ওই যে, ”সেন্ট্রাল ব্যাংক”-এর জেনারেটারের কেসটা নিয়ে কিছুদিন আগে যে-ক্যাচালটা হল! তুমি রোশনদা পলানদাকে একেবারে সাইজ করে দিয়েছ।’

    রোশন কথাগুলো শুনে মোটেই খুশি হল না। ও পলানকে ঝটকাও দেয়নি, সাইজও করেনি। ও শুধু একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস করে রুখে দাঁড়িয়েছে। ওর ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে, আশাপুরের অনেক মানুষ সেই সময়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকী পাঁচটা ছোট বাচ্চা ছেলেও।

    ও শান্ত গলায় বলল, ‘তোমরা ভুল বুঝেছ—আমি পলানদাকে কিছুই করিনি। ওর ছেলে দুটো ওখানে অন্যায় করছিল বলে প্রোটেস্ট করেছিলাম। আমি তো শুধু শুরুটা করেছিলাম—তারপর তো তোমরা সবাই মিলে যা করার করেছ…।’

    লম্বা ছেলেটার মুখে গর্বের ছাপ ফুটে উঠল। ও বলল, ‘হ্যাঁ, রোশনদা, আমি সেদিন স্পটে ছিলাম…।’

    ছেলেটার মুখটা এবার হালকাভাবে মনে পড়ল রোশনের। ও পিছনের সারির কৌতূহলী জনগণের মধ্যে ছিল, কিন্তু সাহস করে সামনের সারিতে এগিয়ে এসে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেনি।

    ছেলেটি সে-কথা বলল না। রোশনের বলা ‘তোমরা সবাই মিলে’-র মধ্যে মনে-মনে নিজেকে সামিল করে নিল। ওর সঙ্গী দুজনও একই ভাবনা ভাবছিল। কিন্তু ওরা সেদিন স্পটে ছিল না—ছিল না বলে এই মুহূর্তে ওদের আপশোশ হল।

    রোশন বলল, ‘অন্যায় দেখলে প্রোটেস্ট করা দরকার। সবসময় সবাই প্রোটেস্ট করতে পারে না, কারণ অনেক সময় প্রোটেস্ট করতে গেলে মনের ভেতরে ভয় কাজ করে। ওই ভয়টাকে হারাতে পারাটাই হচ্ছে আসল…।’

    জগন্ময়ী কালীমন্দিরের গন্ডগোলের ঘটনাটা যেমন খুব তাড়াতাড়ি গোটা আশাপুরে ছড়িয়ে পড়েছিল তেমনই ব্যাংকের গোলমালের ঘটনাটাও লোকের মুখে-মুখে চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। গত দু-সপ্তাহে রোশন এটা খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছে।

    রোশন লম্বা ছেলেটিকে জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের কি মনে হয় পলান নস্কর আশাপুরে যা করছে ঠিক করছে?’

    ছেলে তিনটে বেশ এক্সাইটেড হয়ে পড়ল। তিনজনেই একসঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে কথাগুলো হিজিবিজি হয়ে গেল। তারপর নিজেদের সামলে-সুমলে লম্বা ছেলেটি কথা বলল। কথাগুলো ওর একার নয়, ওদের তিনজনেরই কথা।

    পলান ওদের কোনও ক্লাব তৈরি করতে দেয় না। পার্কে বা রোয়াকে বসে আড্ডা মারতে দেয় না। ওরা আলাদা করে কোনও ফাংশান করতে পারে না। হ্যাঁ, এ ব্যাপারে ওদের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ আছে।

    রোশন তখন বলল, ‘সবকিছু পালটে যাবে—যদি আমরা সবাই একজোট হয়ে একসঙ্গে ভাবি…।’

    ওদের তিনজনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওদের মুখ দেখে বোঝা গেল রোশনের কথাটা ওরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে।

    ‘শুনেছ তো, ফিফটিনথ আগস্ট আমরা সবাই মিলে ফ্ল্যাগ তুলছি। ”সেন্ট্রাল ব্যাংক”-এর উলটোদিকের মাঠটায়—মানে, প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আমাদের প্রোগ্রাম হবে। আমাদের মানে আশাপুরের সবার। অবনী মাস্টারমশাই আর সুধীর ডাক্তারবাবু এই প্রোগ্রামটার দায়িত্ব নিয়েছেন। সঙ্গে আমরা সবাই আছি—তোমরাও আছ। সেদিন সকাল ন’টায় মাঠে আসবে কিন্তু!’

    ওদের একজন জিগ্যেস করল, ‘কেন, এবার পলানদার প্রোগ্রাম হচ্ছে না? চিলড্রেন্স পার্কে?’

    ‘সেটা বলতে পারব না, তবে আমাদেরটা হচ্ছে। তোমরা খবরটা মুখে-মুখে ছড়িয়ে দিয়ো। কেউ আরও খবর জানতে চাইলে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে সাতটার পর যেতে বোলো…নয়তো মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে।’

    ছেলে তিনজন খুশি-খুশি মুখ নিয়ে রোশনের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের মুখ দেখে রোশনের ভালো লাগল। একইসঙ্গে ও কুশানের মুখটা দেখতে পেল। কুশান হাসছে। বলছে, ‘দাদা, দেখিস, প্রোগ্রামটা হেব্বি হবে!’

    আনন্দে রোশনের চোখে জল এল। ও আকাশের দিকে তাকাল। সেখানে চাপ-চাপ মেঘ। কালো-কালো একঝাঁক বাচ্চা ছেলে যেন কারও বকুনি খেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এখুনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে।

    রোশন সাইকেল নিয়ে আবার রওনা হল। এবার বাবুনদার দোকান।

    স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটার কথা আলোচনা করে রোশনের একটু ভালো লাগছিল। অনুষ্ঠানটা নিয়ে কুশানের উৎসাহও ও যেন টের পেল মনে-মনে। আকাশের গালফোলা বাচ্চাগুলোর দিকে আবার তাকাল। ফিসফিস করে বলল, ‘তোরা কাঁদিস না। জানিস না, দুঃখের পেছনে সবসময় সুখ লুকিয়ে থাকে!’

    এই কথাটা বাবা সবসময় বলতেন। তখন ওরা বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি দিনই অভাব আর কষ্টের মধ্যে কাটাত। কিন্তু তারই মাঝে বাবা নানান মজা করে ওদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতেন। সত্যি, মানুষটার মনের জোর ছিল অসাধারণ! বাবার কথা ভেবে মনটাকে ঠিকঠাক করতে চাইল রোশন।

    বাবার কথা ভাবতে-ভাবতে সুধীরডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ল। তারপর মনে পড়ল রতনমণি মাঝি আর অবনীমাস্টারমশাইয়ের কথা। ওঁরা সিনিয়াররা পাঁচ-সাতজন মিলে ঠিক করেছেন পনেরোই আগস্টের অনুষ্ঠানটা হবে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে—যে-মাঠে রোশন ববিন, পিনু, মুনিয়াদের ফুটবল প্র্যাকটিস করায়। অনুষ্ঠানের খরচ চালাতে ডাক্তারবাবু তিনহাজার টাকা ডোনেশন দিয়েছেন। অবনীনাথ আর রতনমণি দিয়েছেন একহাজার টাকা করে। আলোচনা করে এটা ঠিক হয়েছে যে, কারও কাছ থেকে চাঁদা চাওয়া হবে না—নিজের ইচ্ছেয় যে যা দেবে তাই নেওয়া হবে। রোশন নিজে দুশো টাকা ডোনেট করেছে। ডাক্তারবাবু ওর টাকাটা নিতে চাননি কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোশনের জেদের কাছে হেরে গেছেন।

    রোশন এই প্রোগ্রামটার কথা সবাইকে জানাচ্ছিল। আলোচনা করে সুধীর ডাক্তারবাবুরা এটা ঠিক করেছেন যে, এই অনুষ্ঠানটার কথা মুখে-মুখে সকলের কাছে প্রচার করতে হবে, সবাইকে পনেরোই আগস্ট সকাল ন’টায় প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আসার জন্য বলতে হবে। তবে পলান বা তার দলবলকে এ-বিষয়ে কিছুই বলা হবে না।

    ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’-এর মতো রোশনদের অনুষ্ঠানের প্রচার চলছিল। রোশনের মুখ থেকে এই অনুষ্ঠানটার কথা শুনে অনেকেই যেচে চাঁদা দিয়েছেন। যেমন, হাইরোডের চায়ের দোকানের যোগেনদা পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন। ‘আশাপুর লজ’-এর বিশ্বরূপ জোয়ারদার পাঁচশো টাকা দিয়েছেন। তারপর বাবুনদা, ‘মোহন সুইটস’-এর মালিক ওঁরাও দুশো টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। বারোনম্বর বস্তির অনেকেই দশ টাকা করে চাঁদা দিয়েছে। নিতুদা দিয়েছে কুড়ি টাকা। রোশনের মনে হচ্ছিল, চাঁদা দিয়ে আশাপুরের সাধারণ মানুষ তাদের মনের চাপা ইচ্ছেটাকে জানান দিচ্ছিল।

    অনুষ্ঠানটার কথা শুনে সবাই যে নিজের থেকে চাঁদা দিচ্ছিল এটা রোশনের ভালো লাগছিল। ওর ভেতরে একটা খুশির ঢেউ উথলে উঠছিল। সাইকেল চালিয়ে যেতে-যেতে কুশানের দুঃখ কিছুটা যেন কমে গেল বলে মনে হল ওর।

    একসময় বাবুনদার দোকানে পৌঁছে গেল রোশন। প্রথমে সাইকেলের ভাড়ার টাকা মেটাল। তারপর বাবুনদাকে গাড়ি চালানোর কাজের কথা বলল। আগেও বাবুনদাকে কাজের কথা বলেছে ও, কিন্তু বাবুনদা সেরকম কোনও পজিটিভ খবর দিতে পারেননি। পেলে বিশ্বরূপ জোয়ারদারের মোবাইলে নিশ্চয়ই ফোন করে জানাতেন।

    বাবুনদার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর রোশন রওনা হল রতনমণি মাঝির স্টেশনারি দোকানের দিকে। সেখানে রতনদার সঙ্গে কথা বলার পর ও যাবে অবনীনাথ পাত্রের বাড়িতে। সেখানে কথাবার্তা সেরে ও যাবে সোজা সুধীর ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। অর্থাৎ, এই সিনিয়ার মানুষগুলোর মধ্যে রোশনই হল ‘জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা’। পনেরোই আগস্টের অনুষ্ঠানের জন্য যতরকম আয়োজন তার পরিকল্পনা সিনিয়াররা করলেও আয়োজন আর তদারকির পুরোভাগে রয়েছে রোশন, ওর সঙ্গে রয়েছে বারো নম্বর বস্তির নিতুদা, ‘আশাপুর লজ’-এর বিশ্বরূপ জোয়ারদার, এ ছাড়া আরও আছে এলাকার দু-চারজন অল্পবয়েসি ছেলে—যারা পলানের কাজ পছন্দ করে না।

    যেমন করে হোক, এই অনুষ্ঠানটাকে সাকসেসফুল করতেই হবে।

    রোশনের বুকের ভেতর থেকে কুশান যেন বলে উঠল, ‘দাদা, তুই পারবি—।’

    ***

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাড়িটায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দেব
    Next Article আতঙ্ক একাদশ – অনুষ্টুপ শেঠ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }