Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রত্নতত্ত্ব

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প12 Mins Read0

    প্রত্নতত্ত্ব

    আমি এ গল্প আমার বন্ধু সুকুমারবাবুর মুখে শুনেছি।

    ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে যাঁরা কিছু আলোচনা করেছেন, তাঁদের সকলেরই কাছে ডাক্তার সুকুমার সেনের নাম পরিচিত। ডক্টর সেন অনেক দিন গভর্মেন্টের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। পাটনা একসকাভেশন-এর সময় তিনি স্পুনার সাহেবের প্রধান সহকারী ছিলেন। মধ্যে দিন কতক তিনি ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ত্ব-বিভাগের কিউরেটর-ও ছিলেন। বৌদ্ধ ইকোনোগ্রাফি-তেও তিনি সুপণ্ডিত। প্রাগ-গুপ্তযুগের শিল্প ও ভারতীয় মূর্তি-শিল্পের ক্রমবিকাশ নামক তাঁর প্রসিদ্ধ বই দু-খানা ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রে এবং বহু দেশি সাময়িক পত্রিকায় এ বিষয়ে তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন।

    তাঁর পড়বার ঘরটায় নানা স্থানের ভাঙা পুরোনো ইট, ভাঙা কাঠের তক্তি বসানো তুলট কাগজ ও তালপাতার পুথির স্তূপ এবং কালো পাথরের তৈরি দেব-দেবীর মূর্তির ভিড়ে পা দেওয়ার স্থান ছিল না। এইসব মূর্তির শ্রেণিবিভাগ করতে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রম করতেন। কোনো নতুন আনা মূর্তি পেলে তিনি বেশ ভালো করে দেখতেন, পুথি মেলাতেন, তারপর টিকিট আঁটতেন ‘বৌদ্ধমূর্তি তারা’। দিন কতক পরে এ বর্ণনা তাঁর মনঃপূত হত না। তিনি আপন মনে বলতেন— উহুঁ, ওটা ললিতক্ষেপ পজ হল যে, তারা কী করে হবে? তারপর আবার ‘লেন্স’ হাতে মূর্তিটার এ-পিঠ ও-পিঠ ভালো করে দেখতেন। মূর্তিটার যে হাত ভাঙা, সেটার দিকে চেয়ে বলতেন— এ হাতটায় নিশ্চয় পদ্ম ছিল। হুঁ, মানে— বেশ বোঝা যাচ্ছে না কি? তারপর আবার পুরোনো টিকিটের ওপর নতুন টিকিট আঁটতেন— ‘বৌদ্ধমূর্তি জম্ভলা’। তাঁর এ ব্যাপার দেখে আমার হাসি পেত। আমার চেয়েও বিজ্ঞ লোক ঘাড় নেড়ে বলত— হ্যাঁ, ও সব চাকরিবাজি রে বাপু, চাকরিবাজি! নইলে কোথাকার পাটলিপুত্র কোথায় চলে গেল, আজ খোঁড়া ইট-পাথর সাজিয়ে হুবহু বলে দিলেন— এটা অশোকের নাটমন্দিরের গোড়া, ওটা অশোকের আস্তাবলের কোণ; দেখতে দেখতে এক প্রকাণ্ড রাজবাড়ি মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠল! চাকরি তো বজায় রাখা চাই? কিছু নয় রে বাপু, ও সব চাকরিবাজি!

    তবে, এ সব কথার মূল্য বড়োই কম; কারণ জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আমার ও এ সব বিজ্ঞ লোকের চিরদিন ভাসুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক।

    সেদিন দুপুর বেলা ড: সেন যখন তাঁর নিজের লাইব্রেরিতে সেনরাজাদের শাসনকাল নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন, আমি তখন একটা রাষ্ট্রবিপ্লবের মতো সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। খানিকক্ষণ খোশগল্প করে সেখানে সারাদিনের মানসিক পরিশ্রম দূর করতে বুঝলাম তিনি খুব ব্যগ্র হয়ে পড়েছেন। এ-কথা সে-কথার পর ড: সেন বললেন— চা আনাই, একটা গল্প শোনো। এটা আমি কখনো কারুর কাছে বলিনি, তবে স্পুনার সাহেব কিছু কিছু শুনেছেন—

    বাইরে সেদিন খুব শীত পড়েছিল। দরজা বন্ধ করে সুকুমারবাবুর গল্প শুনবার জন্য বসলাম। চা এল, চা খেতে খেতে সুকুমারবাবু তাঁর গল্প বলতে লাগলেন।

    বিক্রমপুরের পুরোনো ভিটের কথা বোধ হয় কিছু কিছু শুনে থাকবে। এটা কতদিনের, তা সেখানকার লোকে কেউ বলতে পারে না। অনেক কাল ধরে ঢিবিটা ওই রকমই দেখে আসছে; এটা কার বা কোন সময়ের তা তারা কিছুই বলতে পারে না।

    ঢাকা মিউজিয়াম থেকে সেবার ওই ঢিবিটা খোঁড়বার কথা উঠল। এর পূর্বে ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ ও ‘ঢাকা সাহিত্য পরিষদ শাখা’ থেকে ওটা কয়েক বার খোঁড়বার প্রস্তাব হয়; কিন্তু টাকার জোগাড় করতে না-পেরে তাঁরা পিছিয়ে যান। আমার কাছে যখন কথা উঠল, তখন আমারও মত ছিল না। কারণ আমার মনে মনে ধারণা ছিল খরচ যা পড়বে তার তুলনায় আমাদের এখন বিশেষ কিছু পাবার আশা নেই। অবশেষে কিন্তু আমার আপত্তি টিকল না। ওটা খোঁড়বার জন্যে টাকা বরাদ্দ হল। আমি বিশেষ অনুরোধে পড়ে তত্ত্বাবধানের ভার নিলাম।

    গিয়ে দেখলাম, যে ঢিবিটা কাটতে হবে তার কাছে আর একটা ঠিক তেমনি ঢিবি আছে। এই ঢিবির কাছে একটা প্রকাণ্ড দিঘি আছে, তা প্রায় মজে এসেছে। ঢিবিদুটো খুব বড়ো বড়ো। ময়না কাঁটার বন আর বড়ো বড়ো আগাছায় পশ্চিম দিকের ঢিবিটার ওপরের অংশ একেবারে দুর্গম। পূর্ব দিকের ঢিবিটা একটু ছোটো, তার পেছনের ঢালু দিকটায় ফাঁকা ঘাসের জমি আছে। স্থানটা কতকটা নির্জন।

    সাধারণত খননকার্য আরম্ভ করবার সময় আমরা প্রথমটা প্ল্যান তৈরি করে নিয়ে কাজ আরম্ভ করি। তারপর কাজ এগিয়ে যাবার সঙ্গেসঙ্গে কতকটা আন্দাজে কতকটা খুব ক্ষীণ সূত্র ধরে আমরা সেই প্ল্যান ক্রমে ক্রমে বদলে চলি। পাটনা একসকেভেশন-এর সময় এতে খুব কাজ হয়েছিল। কিন্তু ছোটো দুটো গ্রাম্য ঢিবি খুঁড়ে তুলতে আমি এসব করবার আবশ্যক দেখলাম না। আমাদের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকার্য চালিয়েছে এমন কোনো লোক ছিল না। তার কারণ এই যে, ওটা খোঁড়া হচ্ছিল ঢাকা পি ডব্লিউ ডি থেকে।

    এই ঢিবিদুটোর বড়োটাকে ওখানকার লোক বলে ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ ও ছোটোটাকে বলে ‘টোলবাটীর ভিটা’। কারুর মতে নাস্তিক পণ্ডিত হলেন বৈষ্ণব ভক্তি শাস্ত্রকার বল্লভাচার্য। তিনি শেষবয়সে বৈষ্ণব ধর্ম ত্যাগ করে শাংকর বেদান্তের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য দেশের লোকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে নারাজ হয়। কেউ কেউ বলেন, বল্লভাচার্য বিক্রমপুরের ত্রিসীমানায়ও জন্মাননি। তাঁদের মতে ওটা ষোড়শ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের ভিটা। যাক সে কথা। আমি কিন্তু জানতে পেরেছি ওখানে কে বাস করতেন। আমি যা জানতে পেরেছি, পূর্বে কেউ কেউ তা আন্দাজ করেছিলেন, কিন্তু জোর করে কিছু বলতে পারেননি। আমি জোর করে বলতে পারি, কিন্তু বলিনি। কেন বলিনি, আর কেমন করে আমি তা জানলাম, সেইটেই বলব।

    কিছুকাল পরে ঢিবির ওপরকার বন কাটানো হল। তারপর প্রকৃতপক্ষে খননকার্য শুরু হল। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু ঢাকা মিউজিয়ামের ক-বাবু ছিলেন। তিনি শুধু প্রত্নতত্ত্বজ্ঞ ছিলেন না, তিনি ছিলেন তার চেয়ে বেশি— প্রত্নতত্ত্বগ্রস্ত। প্রধানত তাঁরই আগ্রহ ও উৎসাহে আমরা এ কাজে হাত দিই। দিনের পর দিন ঢিবিদুটোর সামনে একটা প্রকাণ্ড ঘোড়ানিম গাছের ছায়ায় ক্যাম্প-চেয়ার পেতে আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম। আমার বন্ধুর চোখ-মুখের ভাব ও উৎসাহ দেখে আমার মনে হত, তিনি আশা করেন খুঁড়তে খুঁড়তে একটা পুরোনো আমলের রাজবাড়ি-টাড়ি, বা একটা তালপাতায় লেখা আস্ত বাংলা ইতিহাসের পুথি, অভাবপক্ষে সেই অজ্ঞাত নাস্তিক পণ্ডিতের ফসিল শরীরটাই না মাটির মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়ে।

    খুঁড়তে খুঁড়তে প্রথমে বেরুল একটা মাটির ঘট। ওরকম গড়নের ঘট এখন আর বাংলার কোনো জায়গায় তৈরি হয় কি না জানি না। ঘটের গলার নীচ থেকে তলা পর্যন্ত কার্ভটি যে দিয়েছিল, সে গ্রাম্য কুমোরটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। ঘটটার মধ্যে প্রায় আধ-ঘট কড়ি। হিন্দুরাজত্বে কেনা-বেচার জন্যে কড়ি ব্যবহার হত তা জানো তো? কোন অতীতদিনে গৃহস্বামী ভবিষ্যৎ দুর্দিনের ভয়ে কড়িগুলো সযত্নে ঘটে ভরে মাটির মধ্যে পুঁতে রেখে দিয়েছিলেন, সে ভবিষ্যৎ কত দিন হল সুদূর অতীতে মিলিয়ে গিয়েছে, সঞ্চিত অর্থের আর প্রয়োজন হয়নি। ক্রমে ক্রমে আরও অনেক জিনিস বেরুতে লাগল। আরও মাটির অনেক ভাঙা ঘট, কলসি, একখানা মরিচাধরা লাল রঙের তলোয়ার, একটা প্রদীপ, ভাঙা ইটের কুচো এবং সকলের শেষে বেরুল একটা কালো পাথরের দেবীমূর্তি। এই মূর্তিটিকে নিয়েই আমার গল্প, অতএব এইটাই ভালো করে বলি।

    দেবীমূর্তিটি পাওয়া যায় টোলবাড়ির ভিটায়। মূর্তিটি রাজমহলের কালো পাথরের তৈরি, চকচকে পালিশ করা। বহুদিন মাটির তলায় থেকে সে পালিশ যদিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মোটের ওপর তখনও যা ছিল, তা খুব কম মূর্তিতেই আমি দেখেছি। মূর্তিটি সরস্বতীদেবীর হলেও তাতে বৌদ্ধ ভাস্কর্যের কিছু প্রভাব আছে বলে মনে হয়েছিল। হাতে বীণা না-থাকলে ও দেবী না-হয়ে দেবীমূর্তি হলে, তাকে মঞ্জুশ্রীমূর্তি বলে অনায়াসে ধরে নেওয়া যেতে পারত।

    মূর্তিটা যখন পরিষ্কার করে আমার সামনে আনা হয়েছিল, তখন তার দিকে চেয়েই আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। অনেক মূর্তি গত পনেরো বৎসর ধরে পরীক্ষা করে আসছি, কিন্তু একী? বাটালির মুখে পাথর থেকে হাসি ফুটিয়ে তুলেছে কী করে! খানিকক্ষণ একদৃষ্টে মূর্তিটার দিকে চেয়ে রইলাম। আমি খুব কল্পনাপ্রবণ নই, কিন্তু সেদিন সেই নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় পত্রবিরল ঘোড়ানিম গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমার মনের মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গেল। অল্পক্ষণের জন্যে মনের মধ্যে এক অপূর্ব ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সৌন্দর্যে ঝলমল, চকচকে কালো পাথরের পালিশ করা নিটোল সে দেবীমূর্তির মুখের দৃঢ় রেখাগুলি, তার দেহের গঠনের শিল্পভঙ্গি ও হাতের আঙুলগুলির বিন্যাসের সুন্দর কারুকার্যে এবং সকলের ওপর মূর্তির মুখের সে হাসি-মাখা জীবন্ত এক মায়াবী সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শিল্পের যে প্রভাব কালকে তুচ্ছ করে যুগে যুগে মানুষের প্রাণ স্পর্শ করছে, তার সঙ্গে সত্যিকার পরিচয় সেই আমার প্রথম হল। জয় হোক সে অতীত যুগের অজ্ঞাতনামা শিল্পীর, জয় হোক তার মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভার!

    মূর্তিটাকে বাড়ি নিয়ে এসে আমার লাইব্রেরিতে কাগজ চাপা ধ্যানী বুদ্ধের দলের মধ্যে রেখে দিলাম। রোজ সকালে উঠে দেখতাম, দীর্ঘ ভ্রূ-রেখার নীচে বাঁশপাতার মতো টানা চোখদুটোর কোণ হাসিতে যেন দিন দিন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কয়েক দিন ধরে নানাকথা মনে হতে লাগল। খুঁড়তে খুঁড়তে এমন কোনো জিনস পাইনি, যাতে মূর্তিটার বা ভিটার সময় নিরূপণ করতে পারি। তবে মূর্তিটা যে গুপ্তযুগের পরবর্তী সময়ের এবং পূর্ববঙ্গের শিল্পীর হাতে তৈরি, এটা আমি তার মাথার ওপর ছাতার মতো চিহ্ন দেখে কতকটা আন্দাজ করতাম। পাথরের মূর্তির মাথার ওপর এই গোল ছাতার মতো চিহ্ন পূর্ববঙ্গের ভাস্কর্যের একটা নীতি, এ আমি অন্য অন্য মূর্তিতেও দেখেছি।

    সেদিন রবিবার। সন্ধ্যা বেলাটা আমার এক প্রতিবেশী বন্ধুর সঙ্গে এক বাজি দাবা খেলে সকাল সকাল শুতে গেলাম।

    এইবার যে কথা বলব, সে কেবল তুমি বলেই তোমার কাছে বলছি, অপরের কাছে একথা বলতে আমার বাধে; কারণ তাঁরা আমায় বিশ্বাস করবেন না। অনেক রাতে কী জানি কেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে কীসের অত্যন্ত সুগন্ধ পেলাম। পূজার মন্দিরে যেমন ধূপধুনো গুগগুল, ফুল, ঘি, চন্দন সবসুদ্ধ মিলে একটা স্নিগ্ধ সৌরভ পাওয়া যায়, এটা ঠিক সেই ভাবের। সুগন্ধটা আমার নিদ্রালস মস্তিষ্কের মধ্যে গিয়ে আমায় কেমন একটা নেশায় অতিভূত করে ফেলল। রাত ক-টা হবে ঠিক জানি না, মাথার কাছে ঘড়িটা টিকটিক করছিল। হঠাৎ দেখলাম, খাট থেকে কিছু দূরে ঘরের মেঝেয় কে একজন দাঁড়িয়ে। তাঁর মস্তক মুণ্ডিত, পরনে বৌদ্ধ পুরোহিতের মতো হলদে পরিচ্ছদ; মুখের, হাতের অনাবৃত অংশের রং যেন সাদা আগুনের মতো জ্বলছে। বিস্মিত হয়ে জোর করে চোখ চাইতেই সে মূর্তি কোথায় মিলিয়ে গেল! বিছানায় তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম, ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো। ভালো করে চোখ মুছলাম, ঘরে কেউ কোথাও নেই। ভাবলাম— আরে গেল যা, রাতদুপুরের সময় এ যে দেখছি ছেলেবেলাকার সেই আবু বেন অ্যঢেম (মে হিজ ট্রাইব ইনক্রিজ)! খানিকক্ষণ বিছানায় বসে থাকবার পর ঠিক করে নিলাম, ওটা ঘুমের ঘোরে কীরকম চোখের ধাঁধা দেখে থাকব। তারপর আবার শুয়ে পড়লাম। একটু পরে বেশ ঘুম এল। কতক্ষণ পরে জানি না, আবার কী জানি কেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙবার সঙ্গেসঙ্গে আবার সে সুগন্ধটা পেলাম; আবার সেই নেশা! এবার নেশাটা যেন আমায় পূর্বের চেয়েও বেশি অভিভূত করে ফেললে। তারপরই দেখি, সেই মুণ্ডিত-মস্তক পীতবসন জ্যোতির্ময় বৌদ্ধ-ভিক্ষু আমার খাটের অত্যন্ত কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন।

    তারপর আরও কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটল।

    হঠাৎ আমার ঘরের দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। দেখলাম, এক বিস্তীর্ণ স্থান, কত বাড়ি, শ্বেতপাথরের বাঁধানো কত চত্বর, কত গম্বুজ, দেউল। অনেক মুণ্ডিত-মস্তক বৌদ্ধ-ভিক্ষুর মতো পরিচ্ছদ পরা লোকেরা এদিক-ওদিক যাতায়াত করছেন, অসংখ্য ছাত্র ঘরে ঘরে পাঠরত। এক স্থানে অশোকবৃক্ষের ছায়ায় শ্বেতপাথরের বেদিতে একদল তরুণ যুবক পরিবৃত হয়ে বসে আমার পরিচিত সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু। দেখে মনে হল তিনি অধ্যাপনায় নিরত, এবং যুবকমণ্ডলী তাঁর ছাত্র। অশোককুঞ্জের ঘন-পল্লবের প্রান্তস্থিত রক্তপুষ্পগুচ্ছের ঝরা-পাপড়ি গুরু ও শিষ্যবর্গের মাথার ওপর বর্ষিত হতে লাগল।

    দেখতে দেখতে সে দৃশ্য মিলিয়ে গেল। আমার তন্দ্রালস কানের মধ্যে নানা বাজনার একটা সম্মিলিত সুর বেজে উঠল। এক বিরাট উৎসব সভা। উৎসব বেশে সজ্জিত নরনারীতে সভা ভরে ফেলেছে। সব যেন অজন্তার গুহার চিত্রিত নরনারীরা জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন প্রাচীন যুগের হাবভাব, পোশাক-পরিচ্ছদ। সভার চারিধারে বর্শাহাতে দীর্ঘদেহ সৈনিকরা দাঁড়িয়ে, তেজস্বী যুদ্ধের ঘোড়াগুলো মূল্যবান সাজ পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ঠুকছে। সভার মাঝখানে রক্তাম্বর পরনে চম্পক-গৌরী কে এক মেয়ে, মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল ইস্পাতের বর্ম-আঁটা এক যুবক, তার কোমরে ঝকঝকে ইস্পাতের খাপে বাঁকা তলোয়ার দুলছে, গলায় ফুলের মালা, মুখে বালকের মতো সরল সুকুমার হাসির রেখা। মেয়েটির নিটোল সুন্দর হাতটি ধরে যুবকের দৃঢ় পেশিবহুল হস্তে যিনি স্থাপন করলেন। ভালো করে চেয়ে দেখলাম, তিনি আমার রাতের বিশ্রামের ব্যাঘাতকারী সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু।

    বায়োস্কোপের ছবির মতো বিবাহ সভা মিলিয়ে গেল। হঠাৎ আমার হাত-পা যেন খুব ঠান্ডা হয়ে উঠল। শীতে দাঁতে দাঁত লাগতে লাগল, পায়ের আঙুল যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠল। চোখের সামনে এক বিস্তীর্ণ সাদা বরফের রাজ্য, ওপর থেকে বরফ পড়ছে। তুষার-বাষ্পে চারিধার অস্পষ্ট, সামনে পেছনে সুউচ্চ পর্বতের চূড়া। সামনে এক সংকীর্ণ পথ এঁকেবেঁকে উচ্চ হতে উচ্চতর পার্বত্য প্রদেশে উঠে গিয়েছে। এক দীর্ঘদেহ ভিক্ষু সেই ভীষণ দুর্গম পথ বেয়ে ভীষণতর হিম-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে পথ চলছেন। তাঁর মাথা যেন ক্রমে নুয়ে বুকের ওপর এসে পড়ছে, কিন্তু তবু তিনি না-থেমে ক্রমাগত পথ চলছেন। বহু দূরের এক উত্তুঙ্গ তুষারমণ্ডিত পর্বতচূড়া কীসের আলোয় রক্তাভ হয়ে দৈত্যের হাতের মশালের মতো সে বিশাল তুহিন রাজ্যের দূর প্রান্ত আলোকিত করে ধক ধক করে জ্বলছে।

    তুষার বাষ্প ঘন হতে ঘনতর হয়ে সমস্ত দৃশ্যটা ঢেকে ফেলল। তারপরই চোখের সামনে— এ যে আমারই চিরপরিচিত বাংলাদেশের পাড়া গাঁ! খড়ের ঘরের পেছনে ছায়াগহন বাঁশবনে বিকাল নেমে আসছে। বৈঁচি ঝোপে শালিক পাখির দল কিচকিচ করছে। কাঁঠালতলায় কোনো গৃহস্থের গোরু বাঁধা। মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে এক তরুণ যুবক। তার সামনে আমার খুঁড়ে বার করা সেই দেবীমূর্তি! দেখে মনে হল, যুবকের অনেক, অনেক দিনের স্বপ্ন ওই পাথরের মূর্তিতে সফল হয়েছে। বর্ষা-সন্ধ্যার মেঘ-মেদুর আকাশের নীচে ঘনশ্যাম কেতকী-পল্লবের মতো কালো ভাবগভীর চোখ দু-টি মেলে সে পাথরের মূর্তির মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

    হঠাৎ সে দৃশ্যও মিলিয়ে গেল। দেখি, আমি আমার ঘরে খাটেই শুয়ে আছি, পাশে সেই বৌদ্ধ-ভিক্ষু। এবার তিনি কথা বললেন। তাঁর কথাগুলো আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বললেন— তুমি যে-মূর্তিটি মাটি খুঁড়ে বার করেছ, তারই টানে অনেক দিন পরে আজ আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। নয়-শো বৎসর আগে আমি তোমার মতোই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম। যে স্থান তোমরা খুঁড়েছ, ও-ই আমার বাস্তুভিটা ছিল। তুমি জ্ঞানচর্চায় সমস্ত জীবনযাপন করেছ, এইজন্যই তোমার কাছে আসা আমার সম্ভব হয়েছে; এবং এইজন্যে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমার জীবনের কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনা তোমাকে দেখালাম। আমি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, নয়পালদেবের সময়ে আমি নালন্দা মহাবিদ্যালয়ের সংঘস্থবির ছিলাম। ভগবান তথাগতের অমৃতময়ী বাণীতে আমার মন মুগ্ধ হয়েছিল; সে-জন্যে দেশের হিন্দু সমাজে আমার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়; দেশের টোলের অধ্যাপনা ছেড়ে আমি নালন্দা যাই। বুদ্ধের নির্মল ধর্ম যখন তিব্বতে অনাচারগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল, তখন ভগবান শাক্যশ্রীর পরে আমি তিব্বত যাই সে ধর্ম পুনরুদ্ধারের জন্যে। আমার সময়কার এক গৌরবময় দিনের কথা আজও আমার স্মরণ হয়। আজ অনেক দিন পরে পৃথিবীতে— বাংলায় ফিরে এসে সে-কথা বেশ করে মনে পড়ছে। চেদীরাজ কর্ণ দিগ্বজয়ে বার হয়ে দেশ জয় করতে করতে গৌড়-মগধ-বঙ্গের রাজা নয়পালদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে যেদিন সন্ধি করলেন, আমি তখন নালন্দায় অধ্যাপক। মনে আছে, উৎসাহে সেদিন সারারাত্রি আমার নিদ্রা হয়নি। এই সন্ধির কিছুদিন পরেই কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর সঙ্গে নয়পালদেবের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের যে বিবাহ হয়, আমিই সে বিবাহের পুরোহিত ছিলাম। অল্পবয়সে আমি একজন গ্রাম্য শিল্পীর কাছে পাথরের মূর্তি গড়তে শিখি এবং অবসরমতো আমি তার চর্চা রাখতাম। তারপর আমি যখন পিতামহের টোলে সারস্বত ব্যাকরণের ছাত্র, তখন সমস্ত শক্তি ও কল্পনা ব্যয় করে জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর এক মূর্তি গড়ি। মূর্তিটি আমার বড়ো প্রিয় ছিল। ওই মূর্তিটির টানেই অনেক দিন পরে আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। দেশের লোকে আমাকে নাস্তিক বলত; কারণ, আমি একেই বৌদ্ধ ছিলাম, তার ওপর সাধারণভাবে ধর্মবিশ্বাস আমার ছিল না। যে অরুণচ্ছটারক্ত হিমবান শৃঙ্গ জনহীন তুষার-রাজ্য আলোকিত করেছে, যা তোমায় দেখিয়েছি, তা সত্যের রূপ। সাধারণ লোকের পক্ষে সে সত্য দুরধিগম্য। আমার কথা ধরি না, কারণ আমি নগণ্য। কিন্তু যে বিশাল সংঘারাম আমাদের সময়ে সমস্ত ভারতবর্ষে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল, তার সমস্ত অধ্যাপকই সে উচ্চ দার্শনিক সত্যকে চিরদিন লক্ষ করে চলেছিলেন। আমিও অনেক বিপদ মাথা পেতে নিয়ে, সাধ্যমতো তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম। যেখানে এখন আছি, সেখানে সে-সব যুগপূজ্য জ্ঞান-তপস্বী আমার নিত্য সঙ্গী। তোমরাও অমৃতের পুত্র, সে-লোক তোমাদের জন্যেও নির্দিষ্ট আছে। অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযান জয়যুক্ত হোক।

    বৌদ্ধ-ভিক্ষু কোথায় মিলিয়ে গেলেন। কীসের শব্দে চমক ভেঙে গিয়ে দেখি, ভোর হয়েছে, বাইরের বারান্দায় চাকরের ঝাঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

    ডা. সেন গল্প শেষ করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম— মূর্তিটা কোথায়?

    ডা. সেন বললেন— ঢাকা মিউজিয়ামে।

    ভাদ্র ১৩৩৯, মৌরীফুল

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপৈতৃক ভিটা
    Next Article বউ চণ্ডীর মাঠ

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }