Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা – প্রবোধকুমার ভৌমিক

    প্রবোধকুমার ভৌমিক এক পাতা গল্প205 Mins Read0

    ৩. প্রাকৃতিক অবস্থা

    পরিচ্ছেদ – তিন : প্রাকৃতিক অবস্থা

    বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত মেদিনীপুর জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকার গুপ্ত বিদ্যাচর্চাকারীদের কেন্দ্র করেই অনুসন্ধানের কাজ চালান হয়েছিল। বাংলা বা বঙ্গ (Kolian) শব্দের অর্থ থেকেই সম্ভবত বোঙ্গা (Bonga) অর্থাৎ বিদেহী আত্মার (spirit) ধারণা এসে থাকবে। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই বঙ্গভূমিই ছিল আদিম বা প্রাক আর্য গোষ্ঠীর মাতৃভূমি সেজন্য প্রাক আর্য গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখা প্রশাখা আজও মেদিনীপুর জেলার জংলা অঞ্চল ও বাংলার অন্যান্য ভূখন্ডেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এই জেলার কিছু কিছু অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে প্রস্তর যুগের বেশ কিছু সংখ্যক হাতিয়ারের সন্ধান এখনও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং প্রাগৈতিহাসিক কালের সভ্যতার মতই যে একটা সভ্যতা এখানে ছিল, তা এই নিদর্শন থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে।

    বর্ধমান বিভাগের ২১°৩৬’ ও ২২°৫৭’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৬°৩৩’ ও ৪৪°১১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে মেদিনীপুর জেলার অবস্থান। রূপনারায়ণ ও হুগলী এই দুটি নদী মেদিনীপুরকে হাওড়া ও ২৪ পরগণা জেলা থেকে আলাদা করে রেখেছে। দুটি নদীই গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। মেদিনীপুরের দক্ষিণ সীমানা সমুদ্রের উপকূলবর্তী হওয়ার ফলে এর সীমারেখা, ক্রমাগতই সমুদ্রের দিকে বিস্তারিত হয়ে চলেছে বছরের পর বছর, পলি মাটি পড়ে পড়ে। পশ্চিম সীমান্তের বেশীরভাগ অঞ্চলই বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ছোটনাগপুরের মালভূমির সাদৃশ্য খুবই লক্ষ্য করা যায়। মেদিনীপুরের উত্তর সীমানা গিয়ে স্পর্শ করেছে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা দুটিকে।

    প্রাকৃতিক গঠন বা অবস্থানের দিক থেকে মেদিনীপুর জেলাকে যদি উত্তর থেকে দক্ষিণে ভাগ করা যায়, খঙ্গপুরকে মাঝামাঝি রেখে, তাহলে এই জেলাকে দুটি বিশেষ ভাগে বিভক্ত হতে দেখি। পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চল পরিবৃত্ত হয়ে আছে লাল মাটির ছোট ছোট পাহাড় বা টিলায়, এবং তার মাঝে মাঝে কতকগুলো উপত্যকা। সারি সারি এই সব পাহাড়ের গা দিয়ে বেরিয়ে আসা বিস্তর গ্রানাইট শিলা ঢাকা পড়েছে শাল, সেগুন, মহুয়া ও আরো নানা রকমের গাছ গাছড়ার চাপে। অন্য আর একদিকের অংশ হল মোটামুটিভাবে পাললিক সমতল ভূমি যা নাকি সমুদ্রতট পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সমতল ভূমির ওপর দিয়ে বেশ কিছু নদী, নালা, খাল, বিল বয়ে গিয়ে সাগরের ঢেউ এ বিলীন হয়েছে। এই দুই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশই এখানে বিশেষ প্রকৃতির কতকগুলি জাতি ও গোষ্ঠীর আবাস গড়ে তুলেছে ইতিহাসের বংশানুক্রমিক ধারাকে বজায় রেখে, আর সেই সঙ্গে এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কাঠামো এমনভাবেই গড়ে দিয়েছে যাতে তারা প্রকৃতির খাম-খেয়ালের সঙ্গে সব সময় খাপ খাইয়ে চলতে পারে।

    স্বাধীনতার আগে ও পরে এসব অঞ্চলের যদিও কিছু কিছু শ্রীবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্নদিকে, যেমন শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পথঘাট ও শহর বাজারের সঙ্গে নানারকমের লেনদেন ইত্যাদি সুযোগ সুবিধে ও সুব্যবস্থা তথাপি নির্দিষ্ট এই দুটি অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিশেষ ধরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কেউ যদি গভীর মনোযোগ সহকারে এই অঞ্চলের গ্রামীণ মানুষদের সব কিছু লক্ষ্য করতে যায় তাহলে সে স্পষ্ট বুঝতে পারবে যে, উক্ত দুই অঞ্চলের মানুষই তাদের প্রকৃতির দিক থেকে একেবারে ভিন্ন, স্বতন্ত্র। উভয় অঞ্চলের অধিবাসীদের বাসগৃহের গঠন প্রণালী, কারুকার্য, নকশা বা প্যাটার্ন ও বসবাসের রীতি নীতির মধ্যেও আছে অনেক পার্থক্য। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে, সূতাহাটা, নন্দীগ্রাম, খেজুরি, কাঁথি ও রামনগর থানার অন্তর্গত যে সব গ্রাম সেগুলি সবই এক এক ধরণের। এই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের নিয়েই গ্রন্থকারের প্রধান কাজ। প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগের প্রথম দিকে এই সব অঞ্চল সাগরের জলে ডুবে ছিল এবং কালের গতিতে আস্তে আস্তে জল থেকে বেরিয়ে এসে একদিন কঠিন মাটিতে পরিণত হয়; তখন নানান জায়গার মানুষ এখানে এসে বাস করে। অধিকাংশ অঞ্চলেই দেখা যায় ছোট ছোট দুটি গ্রামের মাঝখানে রয়েছে ধানের ক্ষেত এবং তারই আশপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে গ্রামবাসীদের হাঁটা পথ। গ্রামে গ্রামে বিস্তর ছোট বড় পুকুর, দীঘি ইত্যাদি কাটানো হয়েছে, সম্ভবত জমি উঁচু করে ঘরবাড়ী বানানোর জন্যে; আবার বাড়ীর সামনে কিম্বা ভেতরের কিছু পরিমাণ খোলামেলা জায়গা উঠোন বা বাগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়; প্রয়োজনে বড় করে রান্নাঘরও তৈরী হতে পারে। এই সব গ্রামের জন বসতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল চর্তুভুজ আকারের মাটির কুঁড়ে এবং তার মাথায় খুড়ের চাল। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মেঠো রাস্তার দুধারেই সাধারণত কুঁড়ে ঘরের অবস্থান। তবে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ও অনেক দরজা জানলাওলা বাড়ী মানেই রীতিমত অবস্থাপন্ন কোন লোকের আবাস। এই রকম অবস্থাপন্ন লোকেরা বাড়ীর মাঝখানে একটা লম্বা চওড়া উঠোন রেখে চারদিক ঘিরে দুতিন তলা বাড়ী তৈরী করে। ভেতর বাড়ীর উঠোনে মেয়েদের গল্পগুজবের সান্ধ্য আসর বসে এবং বাইরে বাড়ীর খোলা চত্তরে ধান চাল ও নানারকমের শস্য ঝাড়াই মাড়াই এর কাজ চলে। সময় সময় সেখানে গরু ছাগলের আস্তানা থেকে থাকে। তাছাড়া গৃহদেবতার মন্দির, অতিথিশালা, ধানের গোলা মরাই ইত্যাদি তৈরী করে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়, প্রবেশ পথ হিসেবে থাকে মস্ত একটা সদর দরজা। তবে গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু পরিবারে অদ্ভুত একটা জিনিস হল, বাড়ীর উঠানে কিম্বা গৃহদেবতার মন্দিরের প্রায় গা ঘেঁষে মিশরিয় পিরামিডের আকারে বেশ কিছুটা উঁচু একটা মাটির মঞ্চের ওপর একটা তুলসী ও কাঁটাওলী মনসার গাছ পুঁতে পুজো করা হয়। প্রতি সন্ধ্যায় গৃহবধূ কাঁচা কাপড় পড়ে সরষের তেলে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে গাছদুটিকে আরতি করে, গলবস্ত্র হয়ে সেখানে প্রণাম করে একাগ্রচিত্তে। সব শেষে নারায়ণের উদ্দেশ্যে শাঁখ বাজিয়ে তার অনুগ্রহ কামনা করে পরিবারের কল্যাণের জন্যে। জৈষ্ঠ্য কিম্বা শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মণ্ডপের মনসা চারাটিকে কাঁচা গরুর দুধে চান করাতে হয়। চান করানোর দায়িত্ব থাকে বাড়ীর মেয়ে বৌদের ওপর। ভালো করে চান করিয়ে মনসা চারার গায়ে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিতে হয়। তা না হলে মনসা ক্ষুব্ধ হন। পরিবারের সকলেই বিশ্বাস করে যে মনসা গাছকে যত্ন সহকারে দুধে স্নান করানো হলে বাড়ীর আশপাশ থেকে গভীর রাতে নানা সাপ বেরিয়ে এসে ঐ মনসা চারার গা চেটে দুধ পান করে পরম আনন্দে।

    গ্রামের বিদ্যালয়, মন্দির বা অন্যান্য দেবস্থানগুলি গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় সাধারণত প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমাধিক্ষেত্র বা শ্মশান ঘাট গ্রামের বাইরেই নির্দিষ্ট থাকে। সর্ব সাধারণের পানীয় জলের প্রয়োজনে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় পুকুর কাটায় গ্রামেরই সহৃদয় ব্যক্তিবর্গ নিজের খরচে। তবে ধুলো বালি ভর্তি গ্রামের সংকীর্ণ চলাপথ গুলির দুধারে সমানেই জমতে থাকে যত কিছু আবর্জনা ও গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মলমূত্র। আবার অনেক পরিবারের লোক মূত্রত্যাগের জন্যে নিজেদের বাঁশঝাড় ব্যবহার করে। এজন্যেই গ্রামের হওয়া বাতাস দূষিত হয়ে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।

    গ্রামের মাঠঘাট বন বাদাড়ই হল সাপ খোপের আড্ডা। আবার শ্মশানের ধারে কাছে কিম্বা কোন নির্জন পথের মোড়ের মাথায় যদি বড় বটগাছ দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে ঐ গাছ ভূতের আড্ডা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। সূর্য অস্ত যাবার পর ঐসব জায়গায় ভুলেও কেউ মাড়ায় না। সন্ধ্যে হয়ে এলে গ্রামবাসী কোন বড় পুকুরে কোন প্রকারে নামতে চায় না। কারণ তাদের বিশ্বাস যে, বড় পুকুরের গভীর জলই হল ভূত পেত্নী দৈত্য দানবের লুকিয়ে থাকার উপযুক্ত স্থান। লোকের মুখে মুখে হামেশাই গুজব ছড়িয়ে থাকে যে, গ্রামের অমুক বুড়ো, অমুক খুড়ো, নিজের চোখে রংচঙে জামা কাপড় পরা একটা ভূতকে হেঁটে যেতে দেখেছে। গ্রামবাসীরা এই কথা নির্বিচারে ও নির্দ্বিধায় অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে। এরকম গুজব যদি কোন একটা গ্রামে ছড়িয়ে থাকে তাহলে তা আশপাশের গ্রামে প্রচার হতে খুব বেশী দেরী হয় না। গ্রামের পাঁচজনের মুখে মুখে ভূতের চেহারা, চালচলন, ঘোরাফেরার এক সুদীর্ঘ ও বিচিত্র বৃত্তান্ত বিচিত্র ভাবেই প্রকাশ পায়। কারো ক্ষেত্রেই কোনরকম সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ তখন আর থাকে না। কেউ কেউ বলবে ভূতের চেহারাটা পা থেকে গলা অবধি মানুষের মতই কিন্তু মাথাটা নেই, অর্থাৎ গলাকাটা ভূত স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় বুকের ওপর ডবডবে দুটো চোখ নিয়ে। কি বিচিত্র! আবার অন্য কোন সংবাদদাতার বয়ান অনুসারে, ঐ ভূতটা সব সময়ই উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর মাঝে মাঝে নাকি সুরে কতরকমের কথা যে বলে, তা বোঝা দায়। মেয়ে ভূত বা ভূতিনী সম্পর্কেও গ্রামে গ্রামে অনেক রকমের গল্প শোনা যায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় যে, কোন কোন মেয়ে ভূত হল অসামান্য রূপসী। মাথা থেকে হাঁটুর নীচে পর্যন্ত তার একরাশ রুক্ষ চুল সবসময়ই ঝুলতে থাকে, হাওয়ায় উড়তে থাকে। তার চোখ দুটোতে যেন আগুণের ফুলকি। তার সর্বনাশা চাউনি কারো ওপর একবার পড়লে হল, তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু। আবার তাল গাছের ওপরও অনেক রকমের ভূত বাসা বাঁধে। রাত্তির বেলা হঠাৎ শুকনো তালপাতা নাড়িয়ে ভূতেরা পথচারীকে জানান দেয়। তবে রামনামে ও হরিনামে ভূতেরা যে ভীষণ ভয় পায়, সে বিশ্বাস গ্রামবাসীদের জন্মগত। এই পবিত্র নাম জপ করতে করতে গ্রামের অধিকাংশ মেয়ে-পুরুষই তালতলা দিয়ে পেরিয়ে যায় সূর্য ডোবার পর।

    এইসব গ্রামাঞ্চলে ঋতু পরিবর্তনের পালা লক্ষ্য করার সুযোগ খুব ভালোভাবেই মেলে। গরম কালের উৎকট গরমেও যেমন প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তেমনি জল ঝড় ও কালবৈশাখীর দাপটও বড় কম নয়। সাপের উৎপাত যে কিরকম তা বোধ হয় গ্রামবাসীদের চাইতে বেশী কেউ জানে না। যে কোন দিকের এবড়ো খেবড়ো জায়গা খানা, খন্দ, ভাঙাচোরা মেঠো পথঘাট ইত্যাদি পেরিয়ে আসতে গেলেই গোখরো বা যে কোনরকমের বিষাক্ত সাপের মুখে গ্রামের লোক পড়তে পারে; সাপের ছোবলে তার জীবন যেতে পারে ঘন্টা কয়েকের মধ্যে। বর্ষাকালে মাঠে ঘাঠে আলের ধারে, ইঁদুর বা ব্যাঙের গর্তে সাপ বেমালুম সেঁদিয়ে থাকে। এই সব এলাকায় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকালে সাপে কাটার ঘটনা প্রায় দিনই ঘটে থাকে। সেই জন্যে এই সময়ে দেবী মনসার মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করার প্রথা প্রচলিত আছে। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে সাপেরা গভীর গর্তে গিয়ে শীতঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার বসন্ত আগমনে তাদের প্রার্দুভাব ঘটে এবং গায়ের জীর্ণ খোলস ত্যাগ করে নতুন উদ্যমে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়।

    গ্রামের ভূত প্রেত ও পেতনীরা যেখানে সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। বাঁধাধরা জায়গা বা সময় বলে ভূত বা অপদেবতার কিছু নেই। তবে আলোর পক্ষ অর্থাৎ চাঁদের আলোর রাতকে ভূতেরা সব সময় এড়িয়ে চলে, আনাচে কানাচে লুকিয়ে থেকে মানুষ শিকার করে। আবার এমন কিছু গ্রাম ঘরের লোক আছে যারা মন্ত্রের জোরে দুচার রকমের ভূত পোষ মানিয়ে হাতের মুঠোয় রাখে। ঐ সব পোষা ভূতের মাধ্যমে বহু রকমের অসৎ কাজে লিপ্ত হয়ে অন্যের ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু এই সব অপরাধমূলক কাজ করতে গিয়ে যদি কোন মন্ত্রজ্ঞানী কোন গতিকে ধরা পড়ে যায় তাহলে গ্রামবাসীদের হাতে তাকে কঠিন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতি সমাজেও যখন কোন ব্যক্তি বিশেষের সম্পর্কে জানা যায় যে, সে ডাইনী বৃত্তিতে লেগেছে কারো না কারোর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তখন তাকেও সাঁওতাল গ্রাম-মোড়লের হুকুমে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় নীরবে। মৃত্যুর কোলেও সে ঢলে পড়তে পারে দৈহিক নির্যাতনের ফলে।

    এই সমস্ত গ্রামের কাঠামোটাই গড়ে উঠেছে বিচিত্র সব ধ্যানধারণা ও ভূতপ্রেত সংক্রান্ত বিশ্বাসকে ভিত্তি করে। তাই গ্রামবাসীমাত্রেই ভূতপ্রেতের বাস্তব অস্তিত্বে যেমন বিশ্বাস করে তেমনি ঐ সব অশরীরীদের অনিষ্টকর ক্ষমতার ব্যাপারেও গ্রামীণ জণগণের মনে বিন্দুমাত্র সংশয় দেখা যায় না। যে কোন লোককে ভূত যে মুহূর্তের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে সে বিশ্বাস গ্রামের ছেলেবুড়ো প্রায় সকলেরই সমান। বহুকালের পুরোন তেঁতুল গাছ, বট গাছ, অশ্বত্থ গাছ ইত্যাদি যে ভংয়কর ঘূর্ণি ঝড়ে ভেঙে না পড়ে বছরের পর বছর একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তার কারণ গ্রামবাসীদের কাছে একটাই। আর সে কারণ হল, ঐ গাছগুলোর সঙ্গে ভূত প্রেত ও অন্যান্য অপদেবতার নিবিড় সম্পর্ক আছে এবং ঐ গাছ গুলোই যে তাদের প্রধান আশ্রয়স্থল। সুতরাং যত বড় সাহসী বা বুক বলিয়ান তোক হোক না কেন, তার বুকও ভয়ে কাঁপতে থাকে পূর্ণিমার রাতেও ঐ গাছের তলায় পা ফেলতে। জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক, যে কোন পথচারী এই গাছগুলোকে দেখামাত্র একটু থমকে যায়, কারণ ছেলেবেলা থেকেই যে সে গ্রামের বড়দের মুখে শুনে আসছে ভুতুড়ে গাছগুলোর ওপর ভৌতিক কাণ্ডকারখানার ভয়ংকরতার কথা। সমস্ত গ্রামের মানুষের মনে ঐ গাছগুলো এক বিচিত্র সংস্কার বা আবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর পুরুষানুক্রমিক জীবনযাত্রার ধারার সঙ্গে নানান উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, তারই ফলে এই সমস্ত সংস্কার সমানে বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে গ্রামীণ জীবনে। তাই এই সব অঞ্চলের স্থায়ী আধিবাসীদের ইতিবৃত্ত জানতে হলে অদের মধ্যে প্রচলিত নানান সংস্কারের পরীক্ষা নিরীক্ষা একান্তই প্রয়োজন। গ্রাম্য মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার পথে যে সমস্ত মানসিক সংস্কার ও ধর্মীয় প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, সেগুলোর সঠিক বিচার বিশ্লেষণ করতে পারলে নানারকমের রহস্যচর্চা, গুণমন্ত্র ও বিচিত্র ধরণের আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির গভীর তাৎপৰ্য্য নির্ণয় করা সহজ হবে; সেই সঙ্গে ভূতে পাওয়া, ডানে খাওয়া এবং নানা রকমের রোগ ব্যাধি জ্বালা যন্ত্রণা ইত্যাদিতে যাদু চিকিৎসার প্রয়োগ ও বিভিন্ন রকমের শেকড় বাকড়ের গুণাগুণ সম্পর্কেও অবগত হওয়া সম্ভব হয়।

    .

    বর্ণ বিন্যাস

    ভারতীয় হিন্দু সমাজের জাতি বিন্যাসে একজন ব্যক্তি সাধারণত তার জাতি বা বর্ণ কিম্বা জন্মসূত্রেই পরিচিত হয়ে থাকে; এই পরিচয়ের মধ্যে দিয়েই তাকে জানা যায় যে, সে কোন জাতি-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত পরিচয়ের তকমা নিয়েই একজন বেঁচে থাকে যতদিন পর্যন্ত না সে তার সম্প্রদায়ের প্রচলিত রীতিনীতি বা নিয়ম কানুনের বিরুদ্ধাচরণ করছে; কিম্বা সে তার জাতিগত যাবতীয় প্রথা ইচ্ছাকৃত ভাবে লঙ্ঘন করছে। জাতি প্রথার জন্যেই নিজ নিজ গোষ্ঠীর বা জাতির মধ্যে বিবাহের (endogamy) প্রচলন হয়েছে। প্রতিটি গোষ্ঠী বা জাতির নির্দিষ্ট পেশা (guild system) আছে, জীবিকার সঙ্গে পেশার সম্পর্ক এতই নিবিড় যে, অনেক সময় একজনের পেশা শুনে তার বর্ণ নির্ণয় করা যায়। তাছাড়া বংশানুক্রমিক বর্ণ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে এক এক শ্রেণীর মানুষের পরিচয়ও পেয়ে থাকি। সারা ভারতবর্ষে দেখা যায় যে, বিভিন্ন বর্ণের মানুষের তালিকায় ব্রাহ্মণ হল সবার ওপরে এবং সবার নীচে রাখা হয়েছেশূদ্রকে। সমাজের যাবতীয় পবিত্র আচার অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করাই হল ব্রাহ্মণের করনীয় কর্তব্য; যুদ্ধে গমনই হল ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও কর্ম; দেশের ব্যাবসাবাণিজ্য পরিচালনার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে বৈশ্যের ওপর, ঐ ত্রিবর্ণের সেবামূলক কর্মে আত্মনিয়োগ করাই শূদ্রের ধর্ম। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য দ্বিজ বলে বর্ণিত; অর্থাৎ পবিত্র উপনয়ণ অনুষ্ঠানে মন্ত্ৰদীক্ষিত হয়ে যজ্ঞোপবীত গলায় ধারণ করার অর্থই হল দ্বিতীয় জন্ম বা দ্বিজত্ব লাভ করা।

    ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় জাতি প্রথাকে সমাজ বন্ধনেরই এক বিশেষ শক্তির উপাদান বলে চিহ্নিত করা হয়; কারণ, সামাজিক নানান অবস্থা বা পরিস্থিতিতে জাতিপ্রথা সংক্রান্ত বেশ কিছু লৌকিক রীতিনীতি, নিয়ম শৃঙ্খলা, আচার আচরণ পালনের কঠোরতা ও বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ হয় তেমনি তা আবার দৃঢ় ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের বিধানে কর্ম অনুযায়ী বর্ণ বিন্যাস হওয়ার দরুন বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে পবিত্র অপবিত্র ক্রিয়াকর্ম সংক্রান্ত কিছু কিছু ধ্যানধারণার উদ্ভব হয়, এবং সেই সব গোষ্ঠী জীবনের বিভিন্নতাও প্রকাশ পায়। কিন্তু হাজার বিভিন্নতা সত্ত্বেও বিভিন্ন বর্ণের মানুষ পারস্পরিক সাহচর্যে বাস করে আসছে যুগের পর যুগ। সবারই প্রধান লক্ষ্য হল সমাজ জীবনে প্রচলিত আচার আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদি যথাযথ ভাবে মেনে চলা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার একই সূত্রে সকল বর্ণের মানুষকে বেঁধে রাখা। জাতিপ্রথার ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় উদার নীতির প্রয়োগ থেকে থাকলেও প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক দিক থেকে দেখতে গেলে, জাতপাতের বিভেদ যথেষ্টই প্রকট। এ বিভেদ যে কেবল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণেও বিভেদ আছে। লক্ষণীয় যে এক প্রদেশের ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে অন্য আর এক প্রদেশের ব্রাহ্মণ পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্টই ওজোর আপত্তি দেখা দেয়। আমাদের বঙ্গভূমিও এ ব্যাপারে কিছু ব্যতিক্রম নয়। এখানে রাঢ়ী ও বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন খুব সহজে হয় না। আবার রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ পরিবারের পুত্র উৎকলী ব্রাহ্মণ কন্যার পাণিগ্রহণ করেনা বললেই চলে। সুতরাং জাতি প্রথার এই আঞ্চলিক বিভেদ বা বাধা হল অতিশয় সাধারণ ঘটনা। এই ঘটনা বা অবস্থার ফলেই রোধকরি এখানে নানান বর্ণের উদ্ভব ঘটেছে এবং এক এক বর্ণের মানুষ নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছে। তবে বেশীর ভাগ অঞ্চলেই দেখা যায় যে, বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠায় এক সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা খুবই সহজ হয়েছে। এক টেবিলে বসে খানাপিনা করাতেও এখন আর কোন বাধা নেই; বাধা কেবল অসবর্ণ বিবাহে, জাতি প্রথার দিক থেকে, সামাজিক বিধি বিধানের দিক থেকে। রিসলে সাহেব (১৯০১) বাংলা দেশের নানান জাতের মানুষকে নিয়ে যে শ্রেণী বিন্যাস করেছেন তা চার নম্বর সারণিতে উপস্থিত করা হল।

    সারণি চার
    বাংলার বর্ণ বিণ্যাস (১৯০১)

    ক্রমোচ্চ শ্রেণী বিভাগ – জাতি/সম্প্রদায়

    ১) ব্রাহ্মণ।

    ২) বৈদ্য, কায়স্থ, ক্ষত্রিয় এবং রাজপুত

    ৩) জল চল শূদ্র
    গন্ধবণিক, কর্মকার, কাঁসারি, কুমোর, কুড়ি, মধু নাপিত, মোক, মালাকার, নাপিত, সদগোপ, শাঁখারি, তাম্বলি, তাঁতি, তিলি, করণ, মেদিনীপুরের রাজু, রংপুরের খান এবং পূর্ববঙ্গের শূদ্র।

    ৪) ব্রাহ্মণের দৃষ্টিতে জলচল বর্ণ
    চাষী, কৈবর্ত, মাহিষ্য ও গোয়ালা।

    ৫) যে সব নিম্নবর্ণের মানুষের হাতে ব্রাহ্মণেরা জলগ্রহণ করে না (তারা উল্লিখিত ৪ নং বর্ণের নীচে বলে গণ্য)। মানভূম জেলার সারক, স্বর্ণকার, সুবর্ণবণিক, শুঁড়ি, সূত্রধর, যুগী ও বোষ্টমদেরও এই শ্রেণীর মধ্যে ধরা হয়েছে।

    ৬) যে সব নিম্নবর্ণের মানুষ গরু, শূয়োর ও মুরগীর মাংস খায় না তারা হল–বাগদি, বড়ুয়া, ভাস্কর, বেনে, চাষা, খোবা, দোয়াই, গোরান, হাজোং, জেলে, কৈবর্ত, কলু, কান, কাঁপালি, কোটাল, মালো, জুয়ালো, মেছ, নমোশূদ্র, চন্ডাল।

    ৭) অজলচল শূদ্র
    ব্রাহ্মণের সেবা কার্যে যাদের অধিকার নেই তারা হল, ধোপা, নাপিত, বাউড়ি, চামার, ডোম, হাড়ি, ভুঁইমালি, কেওড়া, কোনাই, কোড়া, লোধা, মাল, মুচি, শিয়ালগির।

    আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে প্রস্তুত করা রিসলে সাহেবের এই সারণিটিকে এখন আর যথার্থ বলে ধরা যেতে পারে না। কারণ, বর্তমান সমাজের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায় যে, এই অঞ্চলে বিশেষ করে জাতি প্রথা অনেক বেশী সচল ও গতিময় হয়ে উঠেছে। এই সচলতার প্রধান কারণ হল এই যে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে এই অঞ্চলের বিভিন্ন মানুষ এক মন এক প্রাণ হয়ে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মেদিনীপুর অঞ্চলকে ঘিরে দেখা দিতে থাকে একের পর এক আন্দোলন।  [Bhowmik P. K. (1960) –’Some social movements in Midnapur’ Man in India. Vol 40 No-41] এই সমস্ত আন্দোলনের ফলে জাতিপ্রথা সংক্রান্ত যে সমস্ত কড়াকড়ি বা বাধা নিষেধ বহুকাল যাবৎ এই অঞ্চলে চলে আসছিল তা অনেকাংশেই লোপ পায়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের এই জেলার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী বহুকাল ধরে দেখে এসেছে ইতিহাসের বহুবিচিত্র প্রবাহ ঝড় ঝঞ্ঝা, উত্থান পতন বংশ পরম্পরায়, সেজন্যে এই অঞ্চলের অধিবাসী যে কোন রকমের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটির উত্তর ও উত্তর পূর্ব অঞ্চল ঘিরে আছে, রূপনারায়ণ, নদী আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত ঘিরে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদী। এই সীমান্তে নানা জাতের মানুষ প্রাচীন কাল থেকে যেমন এক সঙ্গে বসবাস করে আসছে তেমনি তারা তাদের প্রাচীন বিশ্বাস ও সংস্কারকে সজোরে ধরে রেখেছে বংশানুক্রমিক ভাবে। যে কোন প্রগতিশীল সমাজের মূলে দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি হল দ্বন্দ্ব বা সংঘাত (Conflict) দ্বিতীয়টি হল, অঙ্গীভূত করা বা হওয়া (assimilation)। এই দুই বৈশিষ্ট্যই নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথ সুগম করে; প্রচলিত পুরোন প্রথার গর্ভে নতুন নতুন দিকের ধ্যানধারণার সংযোজন করে নতুন সংস্কৃতির প্রসার ঘটায়। আবার বিপরীত ভাবেও তা ঘটে থাকে। এইভাবেই এসে থাকে নতুন নতুন সামাজিক সংগঠন, নতুন ধ্যানধারণা ও জীবন দর্শন। একই ভাবে হয়ে থাকে নতুন জাতির উদ্ভব এবং এই সব জাতির মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের দূর দূরান্তে গিয়ে বাসা বাঁধে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের মানুষের মিলন প্রবাহে বাংলার এই অঞ্চল ক্রমেই হয়ে উঠতে থাকে সংস্কৃতি সঙ্গম। ত্রিবেণীর মত সংস্কৃতির প্রধান তিনটি ধারণা সৃষ্টি করে এই সঙ্গম। প্রথমটি পশ্চিম থেকে প্রবাহিত দেশীয় বা আদিম অধিবাসীদের সংস্কৃতি (aboriginal or autochthonous culture from west), দ্বিতীয়টি দক্ষিণ থেকে আগত উৎকল সংস্কৃতি (Utkalculture from south) এবং তৃতীয়টি হচ্ছে উত্তর থেকে বয়ে আসা বঙ্গ সংস্কৃতির ধারা (Bengali culture from north)। তবে এ কথাও ঠিক যে, ইতিহাসের ভাঙা গড়ার কঠিন নিয়মের অধীনে থেকে এখানকার মানুষ প্রচলিত প্রথাকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃসৃত হয়েই গ্রহণ করেছিল বিভিন্ন বর্ণের মিশ্রণে যখন যেরকম পরিবর্তন ঘটেছে তখন তাকে সেরকম ভাবে তারা মেনে নিতেও দ্বিধা করেনি।

    মেদিনীপুর জেলার সীমান্ত অঞ্চল হল প্রধানত মাহিষ্য অধ্যুষিত অঞ্চল। মাহিষ্যরা প্রথম থেকেই ভূমি নির্ভর। চাষবাসই এদের প্রধান জীবিকা। অন্যান্য সব জাতের মানুষের তুলনায় মাহিষ্যদের প্রতাপ ও প্রতিপত্তি সব থেকে বেশী। এই অঞ্চলের নিম্নবর্ণের বহু মানুষই ক্ষত্রিয় বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। জাতি হিসেবে ‘পৌণ্ড্রু’ নীচু বলে গণ্য হয়ে থাকলেও তারা কিন্তু নিজেদের পৌণ্ড্রের ক্ষত্রিয় বলেই মনে করে। কারণ কোন এক সময় তারা বাংলার পৌণ্ড্রু ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরকম আরো কিছু নিম্নবর্ণের মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়। বাগদী ও আগুরি যথাক্রমে ব্যর্থ ও উগ্ৰ ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত; মাহাতোরা নিজেদের মহৎ ক্ষত্রিয় বলে জানে। আবার যে সমস্ত ডোম বাঁশের কাজ করে তারা বংশ ক্ষত্রিয় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এছাড়াও আরো কিছু নিম্নবর্ণের মানুষ আছে যারা নিজেদের পরিচয় এক এক রকম ক্ষত্রিয় বলেই দিয়ে থাকে।

    ———-

    Bhowmik P. K. (1968) Changing societies in Frontier tracts of Bengal; Bulletin of the R. K. Mission Institute of Culture

    .

    বর্ণসমষ্টি

    আঞ্চলিক বর্ণ সমষ্টির (caste groups) দিক থেকে বিচার করলে গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীরা কোন বর্ণ বা জাতের অন্তর্ভুক্ত তা বর্তমান পরিচ্ছেদে বিশেষভাবে দেখান হয়েছে। এ ব্যাপারে সমীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন বর্ণ ও সম্প্রদায়ের সর্ব সাকুল্যে ৪৬২ জন ব্যক্তিকে যথাসাধ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল। তার ফলে এ বিষয়ে একটি সাধারণ চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে যদি আরো গভীর ও ব্যাপক ভাবে অনুসন্ধান করা যায় তাহলে নতুন নতুন তথ্য সংগৃহীত হবার সুযোগ যথেষ্টই আছে; ঐ সমস্ত তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে সমগ্র অবস্থার একখানি পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটিয়ে তোলা খুব কঠিন হয় না। অবশ্য আমাদের এই পরিচ্ছেদে পরিবেশিত তথ্যাদি গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের জাতপাত, বংশানুক্রমিক পেশা সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি কিছুটা আলোকপাত এবিষয়ে করে থাকে। পরবর্তী সারণিতে সংবাদদাতাদের মোট সংখ্যা ও তাদের বংশগত পেশার ধরণ ধারণ বিবৃত করা হয়েছে।

    সারণি পাঁচ
    উপজীবিকা ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস

    ক্রমিক সংখ্যা জাতি/সম্প্রদায় ব্যক্তি সংখ্যা বংশগত পেশা
    ১ ব্রাহ্মণ ৩৪ যাজককর্ম, পৌরোহিত্য
    ২ কায়স্থ ৪০ করণিক, লেখালিখি
    ৩ মাহিষ্য ১৯৬ চাষবাস, জমিজিরেত রক্ষণাবেক্ষণ
    ৪ সদগোপ ৪ চাষবাস, জমিজিরেত রক্ষণাবেক্ষণ
    ৫ করণ ৪ করণিক লেখালিখি, দুধের ব্যবসা
    ৬ গোপ/গোয়ালা ৩ দুধের ব্যবসা
    ৭ মালাকার ১ ফুল ও ফুলের মালা বিক্রয়
     ৮ বারুইজীবি ১ পানপাতা ব্যবসায়ী
    ৯ স্বর্ণকার ২ সোনার অলংকার তৈরী
    ১০ কামার/কর্মকার ৮ লৌহ ব্যবসায়ী
    ১১ নাপিত ৬ ক্ষৌরকর্ম
    ১২ তিলি ৩ তেল প্রস্তুতকারী
    ১৩ তাঁতি ২ তাঁতবোনা ও বস্তুব্যবসায়ী
    ১৪ ধোপা ৪ কাপড় ধোয়া
    ১৫ রাজবংশী/ধীবর ১০ মৎস্য ব্যবসায়ী
    ১৬ পোদ/পৌন্ড্র ২১ চাষবাস
    ১৭ ছুতোর ২ কাঠের জিনিস প্রস্ততকারী
    ১৮ বাগদী/ব্যগ্ৰক্ষত্রিয় ৬ চাষবাস ও মৎস্যশিকার
    ১৯ নমোশূদ্র ১১ কৃষিকাজ
    ২০ জেলে ৮ মাছধরা ও বিক্রি করা
    ২১ দুলে বাগদী/বেহারা ২ পালকি বাহক
    ২২ পাতর/তাঁতি ৮ কাপড়বোনা
    ২৩ কেওড়া ১ চাষবাস
    ২৪ হাড়ি ঝাড়ুদার ৭ ঢোলবাজন ও সদ্যোজাত শিশুর নাড়ী কাটা কাজ
    ২৫ মুচি/চর্মকার ১ নানারকমের চামড়ার কাজ ও জুতো তৈরী
    ২৬ ডোম/ধাঙড় ২ বাঁশের জিনিস তৈরী
    ২৭ মাহাতো/কুরমি ২২ কৃষিকাজ (আদিমগোষ্ঠী)
    ২৮ মাঝি/ধীবর ৩ মৎস্যশিকার
    ২৯ লোধা/শবর ৩ বন্যসামগ্রী সংগ্রহ ও কৃষিকাজ (উপজাতি)
    ৩০ ভূমিজ ১০ কৃষিকাজ (উপজাতি)
    ৩১ সাঁওতাল ৭ কৃষিকাজ (উপজাতি)
    ৩২ মুণ্ডা ৯ কৃষিকাজ (উপজাতি)
    ৩৩ বৈষ্ণব ১২ ভিক্ষা (ধর্মীয় সম্প্রদায়)
    ৩৪ মুসলমান ৯ পশুপালন ও নানা রকমের তেজারতি কারবার

    এখানে যে ৩৪টি বর্ণ বা সম্প্রদায় ও বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তিতে নিযুক্ত মানুষের উল্লেখ করা হল, তার মধ্যে কিছু উচ্চবর্ণের পরিচয়ও পাচ্ছি। এই সব উচ্চবর্ণের মানুষেরা কিন্তু এখনকার সমাজব্যবস্থার দিক থেকে অন্যান্য বর্ণের লোকেদের মতই সব রকমের সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করে থাকে; ক্ষেত্র বিশেষে কিছু তারতম্য হয়ে থাকলেও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভালোমন্দ, রীতিনীতি নিয়ম শৃঙ্খলা ইত্যাদির নিরীখে সকলেই সমান। তবে উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ একেবারেই বন্ধ। এবার নীচের ছ নম্বর সারণিতে সর্বোচ্চ থেকে সর্ব নিম্ন বর্ণ এবং সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে ক্রম অনুসারে পরের পর সাজিয়ে উপস্থিত করা হল।

    সারণি ছয়
    বর্ণ ও গোষ্ঠীর শ্রেণী বিন্যাস

    ক্রমিক সংখ্যা  – পদমর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা – বর্ণ সম্প্রদায়

    ১ – সর্বোচ্চ – ব্রাহ্মণ

    ২ – উচ্চতর – কায়স্থ, করণ, মাহিষ্য, সদগোপ

    ৩ – উচ্চ – তিলি, মালাকার, স্বর্ণকার, বারুইজীবি, নাপিত, কর্মকার, তাঁতি, গোপ/গোয়ালা

    ৪ – নিম্ন – রাজবংশী, পোদ, দুতোর, বাগদী, নমোশূদ্র, ধোপা

    ৫ – নিম্নতর – দুলিয়া/পালকীবেহারা, ধীবর, কেওড়া, পাতর

    ৬ –  সর্বনিম্ন – হাড়ি, মুচি, ডোম

    ৭ – আদিবাসীউদ্ভূত – মাহাতো, কুরমি, মাঝি

    ৮ – উপজাতি – লোধা, মুণ্ডা, ভূমিজ, সাঁওতাল

    ৯ – বর্ণ বা জাতি বহির্ভূত – বৈষ্ণব, মুসলমান

    লক্ষ্যণীয় যে, এই অঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা হল উৎকল শ্রেণীভুক্ত অর্থাৎ এরা মূলতঃ উৎকল বা উড়িষ্যা থেকে এসে এখানে বসত করে। আবার এই অঞ্চলের মধ্যশ্রেণীর বৈদিক ও কুলীন (রাঢ়ী) ব্রাহ্মণেরাও বাস করে। কিন্তু দেখা যায় যে, যারাই গুপ্তবিদ্যাচর্চায় নেমেছে তারা প্রায় সকলেই উৎকলী ব্রাহ্মণ। এই কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ আছে যাদের পতিত বলে ধরা হয়, কারণ তারা নিম্নবর্ণের মানুষের যজমানি গ্রহণ করে। স্বভাবতই তাদের নীচু জাতির মানুষের সঙ্গে সমান করেই দেখা হয়। ব্রাহ্মণ হিসেবে উচ্চবর্ণের লোকের দৃষ্টিতে তাদের মান মর্যাদা বলে কিছু নেই। তবে উচ্চ ও নিম্ন উভয়বর্ণের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উৎসব ইত্যাদিতে পৌরোহিত্য করাই হল উত্তলী ব্রাহ্মণদের পুরুষানুক্রমিক পেশা।

    এই সব অঞ্চলের করণরাও মূলত উড়িষ্যা থেকে এসেছে। কিন্তু পদমর্যাদার দিক থেকে তারা নিজেদের কায়স্থদের সমান বলে দাবী করে। আবার ‘খান’ দৈত্য বর্ণের লোকেরা করণদের মত সমান মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করে। এরা যেহেতু লেখার কালি তৈরীর কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে সেহেতু ‘মসি-খান দৈত্য’ নামেই পরিচিত। এদেরই পাশাপাশি আর এক জাতের লোক অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর কাজ ও সৈনিকের পেশা গ্রহণ করায় এরা ‘অসি খান দৈত্য’ নামে খ্যাত। বর্ধমান জেলায় সং গোপদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুবই বেশী। রাজনৈতিক নানান কারণে সৎ গোপেরা বিপুল সংখ্যায় মেদিনীপুরের এই অঞ্চলে এসে ঘর বাঁধে এবং রাজা জমিদারদের শাসন কার্যের নানান বিভাগে নিযুক্ত হয়। নিম্নবর্ণের লোকেদের মধ্যে ধীবরদের এক স্বতন্ত্র বর্ণের মানুষ বলেই ধরা হয়। এরা হল প্রধানত মৎস্যজীবি। এখানকার রাজবংশীরাও মাছের ব্যবসা করে। কিন্তু তা হলেও ধীবর ও রাজবংশী; দুটি গোষ্ঠীই সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং উভয়ের আচার বিচার রীতিনীতি ইত্যাদিতেও যথেষ্ট পার্থক্য আছে। সেজন্য উভয়ই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চলে। তবে ব্রাহ্মণের সেবা কার্যে ধোপা নাপিতদের যেমন কোন অধিকার নেই রাজবংশী ও ধীবরও তেমনি এ কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত; হাড়ি, মুচি, ডোমরাও একই ভাবে বঞ্চিত, ব্রাহ্মণ বাড়ীর কোন কাজেই তারা উপস্থিত হতে পারে না। এক কথায়, ব্রাহ্মণদের কাছে এরা এখনও অচ্ছুৎ হয়েই আছে। মাহাতো, কুরমিও মাঝি হল এতৎ অঞ্চলের আদিম বাসিন্দা। এই জেলার পশ্চিম প্রান্তের জংলা এলাকাতেই সাধারণত এদের বসত লক্ষ্য করা যায়। মাছ ধরা ও বিক্রি করাই মাঝিদের জাত ব্যবসা হয়ে গেছে। সারা বছরই এরা এই ব্যবসায় মন প্রাণ দিয়ে লেগে থাকে।

    উপজাতি গোষ্ঠীদের জীবনধারণের নির্দিষ্ট রীতি বা style যেমন আছে তেমনি আছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। লোধা, ভূঁইয়া, মুণ্ডা ও সাঁওতাল এই চার উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে লোধা ও ভূঁইয়ারা হল অনেকাংশে হিন্দু ভাবাপন্ন। মুণ্ডারা গরু ও শুয়োরের মাংস খায় না। আবার শুধু সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যেই বিশেষ কটি উপজাতীয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। লোধারা বর্ণ হিন্দুদের খুব কাছাকাছি বাস করে এবং সম্প্রতি তারা বিয়ে খাওয়ার কাজে অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ও পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মে ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব পুরোহিতদের দিয়ে পৌরোহিত্য করাতে শুরু করেছে। ভূঁইয়া ও মুণ্ডারাও ও ব্যাপারে লোধাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। তাছাড়া, এরা প্রয়োজন মত ধোপা ও নাপিতের সাহায্যও নিয়ে থাকে।

    অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতই বৈষ্ণবরাও একটি সম্প্রদায়। বৈষ্ণব মাত্রেই কৃষ্ণভক্ত। এই অঞ্চলে বৈষ্ণবদের উৎপত্তি ও প্রসারের মূলে আছে বিভিন্ন জাতের মানুষের ধর্মান্তরকরণ। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য যখন এই অঞ্চল হয়ে পদব্রজে নবদ্বীপ ধাম থেকে জগন্নাথ ধামে গমন করেন, সেই সময়েই এখানকার অগণিত মানুষ শ্রীচৈতন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বৈষ্ণব ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। এই ধর্মের উদারতা ও নমনীয়তা গুণেই যে কোন জাতের মানুষ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিতে পারে। কিন্তু এখানকার বৈষ্ণবদের মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করার আছে। সেটা হল এই যে, মাহিষ্য বর্ণের একজন বৈষ্ণব নিজেকে সব দিক থেকে উঁচু মনে করে পৌন্ড্র বৈষ্ণব ভায়ের চেয়ে। সুতরাং উচ্চ ও নিম্নবর্ণের যে পার্থক্য বা প্রভেদজ্ঞান তা এ অঞ্চলের বৈষ্ণবদের মধ্যে থেকে এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি; আর তা না হওয়া বৈষ্ণবী আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে বড়ই বিচিত্র বলে বোধহয়। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশেষ চিহ্ন বা পরিচিতি হিসেবে কপালে চন্দনের তিলক কাটতে হয়, গলায় ও বাহুতে নানারকম ভাবে চিত্র করার রীতি প্রচলিত। সমস্ত রকমের আমিষ খাদ্য বর্জন করাই হল বৈষ্ণবের ধর্ম। হরি বা বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করার জন্যে প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা হরিনাম সংকীর্তন করা ধর্মীয় বিধান। পরবর্তী কালে এই অঞ্চল অধিকার করে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিলে মিশে বাস করতে থাকে। মুসলমানরা এখানকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ট ভাবে মিশে গেছে যে, বর্তমানে তাদের মুসলমান বলে চিনতে পারাও কঠিন। তবে খাওয়া দাওয়া ও ধর্মীয় আচার বিচার উৎসব অনুষ্ঠান ও সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে মুসলমানরা নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই চলে।

    এখানকার অমুসলমানরা মুসলমানদের বলে ‘খাঁড়িয়া’ (Khanria)। এই শব্দটা নেড়ে বা নেড়িয়া (Nera or Neria) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকলেও থাকতেও পারে। এর কারণ হয়ত এই যে, বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে হলে যেমন মাথা নেড়া করার ধর্মীয় রীতি আছে, খুব সম্ভব ঐ বৌদ্ধ সম্প্রদায় পরে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়। সেজন্য যে হিন্দু জনগণের কাছে মুসলমানরা নেড়ে বলে অভিহিত হয়ে ছিল তা একরকম ধরে নেওয়া যায়। এই অঞ্চলে বেশ কিছু সংখ্যক খেড়িয়া উপজাতিকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে দেখা যায়, নানান ঐতিহাসিক কারণে, এই সব খেড়িয়া মুসলমানরা আজও এই সমস্ত অঞ্চলে শবর বা সাপুড়ে বলে পরিচিত। খেজুরি থানার অর্ন্তগত বেগুনবাড়ী অঞ্চলে এদের খুব বেশী করে দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের খুব কাছ দিয়ে চলে গেছে নরঘাট-কাঁথি পাকা রাস্তা। এই শবর মুসলিম সম্প্রদায়েরই আর একটা গোষ্ঠীকে দেখা যায় নন্দীগ্রাম থানার অধীন কৃষ্ণনগরে। এরা খেড়িয়া উপজাতির মতই অনেকদিন থেকে আছে এবং পাখী ইত্যাদি শিকার করাই এদের প্রধান কাজ ও জীবিকা অর্জনের একমাত্র পথ বলা যায়। আদিম অধিবাসীদের মত এরা তীরধনুক ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে শিকারের সন্ধানে নানান দিকে ঘুরে বেড়ায়। এরা শবর বা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও মুসলিম সমাজের রীতিনীতি আচার আচরণে বা এক কথায় মুসলিম সংস্কৃতিকে পুরোপুরি আপন করে নিতে পারেনি।

    এই সব বিভিন্ন জাতের মানুষের মধ্যে থেকেই গুণিন বা ওঝা বিশেষজ্ঞ হয় আঞ্চলিক ভিত্তিতে। গুণিন তার নিজের জাতের মানুষের কল্যাণের দিকেই বিশেষ করে নজর রাখে। সাধারণভাবে সমগ্র সমাজের কল্যাণ সাধনেই যে সে ব্রতী হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন দিক থেকে, বিভিন্ন উপায়ে, দলীয় মানুষের তথা সমাজের সেবা করার উদ্দেশ্যেই গুণিন মাত্রেই গুপ্তবিদ্যাচর্চায় আত্মনিয়োগ করে। গুপ্ত চিকিৎসার (occult treatment) নানান পদ্ধতির আবিষ্কার ও সেই সমস্ত পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগই গুণিনের কৃতিত্ব বহন করে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ
    Next Article মহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধকুমার সান্যাল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Our Picks

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.