Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা – প্রবোধকুমার ভৌমিক

    প্রবোধকুমার ভৌমিক এক পাতা গল্প205 Mins Read0

    ৭. পরিশিষ্ট : ধর্মবিশ্বাসের পটভূমিকায় আচার অনুষ্ঠান

    পরিশিষ্ট : ধর্মবিশ্বাসের পটভূমিকায় আচার অনুষ্ঠান

    [বক্তব্য : বৈশাখ ১৩৭৩ হইতে পুর্ণমুদ্রিত।]

    মানব সমাজের শৈশব হতে বর্তমানে যুগ পর্যন্ত এক নিরন্তর সংগ্রামের মহড়া চলছে। কখনও সেই সংগ্রাম স্বীয় জীবন রক্ষার জন্য, কোথাও বা ব্যষ্টি সমষ্টিগত অধিকার ও আক্রমণের উন্মাদনায় মুখর। প্রাগৈতিহাসিক যুগে, মানুষের আদিম বংশধরদের নানা দুশ্চিন্তায় সন্ত্রস্ত থাকতে হতো। কেননা সেদিনের পৃথিবী ও তার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। একদিকে মুহূর্মুহূ ভূকম্পন, জলপ্লাবন, তুষার বন্যা, আবার অন্যদিকে ম্যামথ, সিংহ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি অতিকায় হিংস্র জন্তুর দাপাদাপি তখনকার মানুষের জীবনযাত্রার বিরাট বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। আবার খাদ্য বস্তুর অপর্যাপ্ততা, ব্যবহারিক দ্রব্যসম্ভারের দীনতা ও অপ্রচুরতা তাদের অর্থনৈতিক পরিবেশকে অনিশ্চয়তায় ঘিরে রেখেছিল। সেই সংগে রোগব্যাধি, মহামারির নৃশংসতার অভাব ছিলনা। এই ভীতি ও শংকা, ঝড়ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি ও তুষারপাত, দিবারাত্রি, ঋতুভেদ, জন্ম ও মৃত্যু, নিদ্রা ও স্বপ্নের বিকার সেদিনের অজ্ঞ মানুষের মনের মণিকোঠায় নানা বিশ্বাসের, নানা শক্তি-কল্পনার এক ইঙ্গিত দিয়েছিল। সেই অজ্ঞানতা, অসামর্থ্য ও বিশ্বাস দৈবশক্তি বা অশরীরী অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনায় নিবিষ্ট হতে হয়েছিল। আদিম শিকারজীবী ভবঘুরে মানুষের জীবনযাত্রার ঘটল পরিবর্তন। নব্য প্রস্তরযুগের সূচনায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপকরণ বা সম্পদসৃষ্টির মাদকতায় মানুষের সংস্কৃতির অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটল–পরিবর্তন হল তার পরিবেশ পরিমণ্ডলের। প্রকৃতি-নির্ভর মানুষ ধীরেধীরে প্রকৃতির উপর শাসন সুরু করল অগ্নির প্রজ্বলনে, কৃষি বা শিল্পের সূচনায়। তার সেই প্রাচীন অসংলগ্ন সমাজজীবনের গতিপথ গেল পাল্টে–তার রীতি নীতি কর্মানুসরণের নানা দিক প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। তখনকার বিস্ময়াবিষ্ট মানুষ আবার নতুনভাবে সমূহ ক্রিয়াকাণ্ডকে, বিশ্বাসকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা পেল– চলল তার নতুন বিশ্লেষণের পালা। সেই বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোজগতে ধর্মবিশ্বাস বা শক্তি উপাসনার এক বিশেষ দিক সূচিত হল। সাধারণভাবে বিচার করলে দেখা যাবে মানুষ তার অনিশ্চয়তাকে, বিফলতাকে অথবা জীবন-সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তকে ভাবী জয়পরাজয়ের আশঙ্কায় এক বিশ্বাসের মধ্যে টেনে নিয়ে ক্রিয়াকাণ্ড ও আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্ণ সার্থকতা বা অখণ্ড শান্তি বা নিরাপত্তার যে পন্থা গ্রহণ করল, তাই হল আদি মানুষের ধর্মবিশ্বাসের গোড়ার কথা। সেদিনও মানুষ বুঝেছিল জীবন ক্ষণস্থায়ী, শক্তি সীমাবদ্ধ, জীবনের বহু কামনাও অপূর্ণ থেকে যায়। স্বাস্থ্যবান সুন্দর দেহ রোগব্যাধির কবলে জীর্ণ হয়ে যায়। স্বামীস্ত্রীর অকৃত্রিম ভালবাসা, বিবাহ বন্ধনের কঠোর সামাজিকতা, বিচ্ছেদের করুণসুরে মূর্ত হয়ে উঠে, নিশ্চিত কৃতকার্যতা বিফলতার বন্যায় প্লাবিত হয়। তবুও মানুষ সব হারানোর দুর্ভাবনার অবসরে, তার মৃত্যুজয়ী কল্পনাকে মনের মধ্যে চির জাগরূক রাখার প্রবল চেষ্টা পায়। এই পাওয়া না পাওয়া শংকাবিপদকে এক অশরীরী শক্তির প্রকাশ বলে সেই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারই সংগে হয়েছে এই সকল প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অলৌকিক ক্ষমতার বিভিন্ন বিকাশ, দেবশক্তি প্রেতশক্তির আনাগোনা। জীবন সংগ্রামের নানা অধ্যায়ের এ এক অভিনব অভিযোজন, সংস্কৃতির নিত্য পরিবর্তনের বিকাশের এক ইঙ্গিত বা মূৰ্ছনা।

    এই ধর্মবিশ্বাসের মূলে রয়েছে যে কোন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা। আমািনুষ প্রতিটি কার্যের বা ঘটনার এক সূত্র খুঁজে নিয়েছে আর তার কারণকে ব্যাখ্যা করে একান্তভাবে স্বীকার করার চেষ্টা পেয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় যখন কার্যকারণ সংযোগ ঠিকমত সাধিত করা যায়নি তখনই তাকে বিভিন্ন শক্তির খেলা বলে ধরে নিয়ে ইন্দ্রজাল বা মায়াবী কৌশল দিয়ে তাকে বশ করার চেষ্টা পেয়েছে। যেমন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের বিশ্বাস, ঝড়-ঝঞ্জার দেবতা হল বিলিকু। তিনি কোন কারণে ক্ষিপ্ত হলেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঝড়-ঝঞ্ঝার মাধ্যমে। ওরা ঐ দেবতাকে বশীভূত করার জন্য তীর ধনুক নিয়ে ভয় দেখায়। আবার যেখানে শক্তি প্রয়োগের ব্যর্থতা প্রকটিত হয়ে উঠে সেখানে ঐ কাল্পনিক অতিপ্রাকৃত অশরীরী শক্তিকে পূজা, স্তুতি, প্রার্থনা, অর্চনা, উপহার, বলিদান, কখনও আত্মশ্লাঘার মাধ্যমে ঐ শক্তির কাছে নতিস্বীকার দ্বারা মানুষ অভীষ্ট পূরণ করার চেষ্টা পেয়েছে। ধর্মাচরণের মাধ্যমে এইভাবে জীবন সংগ্রামের ব্যর্থতাকে প্রতিহত করার এক সুকৌশল অভিব্যক্তি নিহিত হয়ে রয়েছে। বলা বাহুল্য এই ধর্মবিশ্বাস বা ইন্দ্রজালের পশ্চাতে রয়েছে একান্ত বিশ্বাস আর আচরণ।

    অনেক সমাজ-বিজ্ঞানীর ধারণা আদি মানুষের ধর্মসম্পর্কে সু-চিন্তিত অভিমত গঠিত হবার প্রাক্কালে ঐন্দ্রজালিক শক্তি ও প্রক্রিয়াতে তাদের স্বাভাবিক বিশ্বাস ছিল। পরে যখন মানুষের ধন বন্টন ও উৎপাদন ব্যবস্থার সংগে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের এক দাবি সূচিত হল তখন ধর্মনিবাসের ধারার ধীর পরিবর্তন হতে থাকে এবং সেই ব্যক্তি মানুষের বলিষ্ঠতা, তেজস্বিতার সংগে ধর্মের ব্যাখ্যার নতুন সূচনা পরিলক্ষিত হয়। এর সংগে রয়েছে স্থান কাল পাত্র ভেদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনের প্রভাব, জাতীয় চরিত্রের ঘৃণা, লোভ ও মানসিক উচ্ছ্বাসের অঙ্গাঙ্গী মিলন। মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক কার্যের বা প্রয়োজনের সঙ্গে কষ্ট-কল্পিত অতিপ্রাকৃত শক্তির সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একান্ত নির্ভরতা বা নিরাপত্তার ইঙ্গিত— যা অনগ্রসর গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জীবনে এখনও মুখর হয়ে রয়েছে।

    যাদুতন্ত্র বা ইন্দ্রজাল (Magic): ইন্দ্রজাল এক রকমের মায়াবী কৌশল যাতে নানা ঘটনার এক প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান, যার জন্যে কোন কৌশলের বা ফলপ্রদ বিদ্যার অথবা অবাস্তব শক্তি-কল্পনার প্রয়োজন হয়। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় ইন্দ্রজালের সাহায্যে বাস্তব ঘটনাকে বশ করার এক ধোঁকা সৃষ্টি করা হয় মাত্র। অনুকরণের (Sympathetic) প্রয়াসে ইন্দ্রজালের সৃষ্টি। তাই অনেক আদিবাসীর মধ্যে বৃষ্টির প্রয়োজন মেটাবার পূর্বে মুখে জল দিয়ে বৃষ্টির অনুকরণ করার প্রয়াস দেখা যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে অস্থিনির্মিত অস্ত্রে পর্বতকন্দর কিংবা গিরিগুহার নানা জীবজন্তুর প্রতিচ্ছবি এই যাদুরই পরিচয় বহন করে। বৈজ্ঞানিকগণ যাদুকে মোট দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল অনুকারী বা সদৃশ (lmitative or Homeopathic) যাদু, আর একটি হল সংযুক্তকারী বা যোজক (Contagious) যাদু। অনুকারী যাদুর প্রচেষ্টায় বা অনুকরণে অনুরূপ কাজের অনুসরণ (like products like) থাকে। সমধর্মী জিনিষের বা ঘটনার যে এক পারস্পরিক রহস্যপূর্ণ সম্বন্ধ আছে এ হল তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। কোন শত্রুকে নিধন বা আহত করতে হলে তার পুত্তলী তৈরী করে তার অংগে নানারকম আঘাত অথবা তুকতাকের দ্বারা তাকে বাণবিদ্ধ করা হয়। এই উদ্দেশ্যে যে, প্রকৃত ব্যক্তি অনুরূপ আহত হবে বা মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ইংলণ্ডের কোন কোন স্থানে এবং বাংলাদেশে এইরকমের তুকতাক যাকে সাধারণ ভাষায় বাণ মারা বলা হয় তা হল এই রকম, যাদুর উদাহরণ।

    আর সংযুক্ত বা যোজক মাধ্যমে কোন ব্যক্তির শরীরের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমন কি চুল, নখ বা ব্যবহৃত দ্রব্যসম্ভারে ঐন্দ্রজালিক বিশেষ ইচ্ছাসহ প্রভাবান্বিত করে। যার ফলে অভীষ্ট উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। ইংলণ্ডের কোন কোন অঞ্চলের মহিলারা নাকি প্রেমাস্পদ হতে বঞ্চিতা হলে সেই সব ব্যক্তিদের চুলের গোছার কিছুটা গরম জলে ফুটিয়ে নেয়। যখন ফুটন্ত জলে ঐ চুলগুলো নড়বে তখন প্রেমাস্পদ অধীর যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। বাংলাদেশেও ঐ রকমের যাদুর অভাব নাই। কঠিন দীর্ঘমেয়াদী রোগভোগের পর যখন রোগীকে ভাল করার আর কোন পথ থাকে না তখন একজন বিশেষ ঐন্দ্রজালিক রোগীকে কোন রাস্তার তেমাথা বা চৌমাথাতে গভীর রাত্রে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্নান করায়। স্নানের শেষে তার ব্যবহৃত কাপড় ঐখানে ফেলে দেওয়া হয় যা অন্য ব্যক্তির স্পর্শে তাকে আক্রান্ত করবে আর রোগীটি হয়ত রোগমুক্তির আরোগ্য লাভ করবে। উপজাতি সমাজে কোন ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যসম্ভার অতি সাবধানে রাখা হয়। বিশেষ ভাবে নবজাতকের সংগে যে নাভি প্রভৃতি অংশ পরিত্যক্ত হয় সেগুলি কোন কোন উপজাতি সদর বাড়ীর চৌকাটের কাছে অথবা রান্নাঘরের মেঝেতে প্রক্ষিপ্ত করে দেয়।

    ইন্দ্রজালের সাফল্যের জন্য চাই সুচারুরূপে ক্রিয়াকাণ্ডের অনুষ্ঠান। যদি যাদুকর তার কাজে বিফল হয় তবে এই বোঝায় যে সে ঠিকমত অনুষ্ঠানসূচী পালন করতে পারেনি। হো, ওরাঁও, লোধা প্রভৃতি সমাজে নানারকমের ইন্দ্রজালের বা যাদুবিদ্যার প্রচলন আছে। কোন কোন ইন্দ্রজাল সমষ্টিগতভাবে সমাজের মঙ্গলের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। কোনটি আবার ব্যক্তিগত মঙ্গলার্থে অপরের ক্ষতির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে নানাবিধ অসুখ সারানোর রীতি বা নিরাময়ের পদ্ধতি আমাদের দেশের উপজাতি সমাজে প্রচলিত।

    তুকতাক বা মন্ত্র (Spell): আর এক ধরণের ইন্দ্রজালের প্রচেষ্টা। বিভিন্ন অঞ্চলের পারদশী যাদুকরেরা নির্দিষ্ট কতকগুলি শব্দকে অঙ্গভঙ্গী সহকারে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত করে। গ্রামাঞ্চলে এই ধরণের পারদর্শী ব্যক্তির অভাব নাই। হঠাৎ জ্বর হলে, আপদ-বিপদ হলে অথবা ফিক ব্যথা লাগলে ঐসকল পারদশী ব্যক্তি নানা মন্ত্র বলে কাণের মধ্যে ফুঁ দেয় অথবা শিরে পিঠে হাত বুলায়। কোথাও কোথাও পানীয় জলকে মন্ত্রপূত করে তা পানের ব্যবস্থা থাকে। সেই মন্ত্রপূত জলের প্রভাবে হঠাৎ ব্যাধি সেরে যায়। সাঁওতাল ওরাঁও উপজাতিরা শিকারে যাবার পূর্বে নানা রকমের মন্ত্র আওড়ায়। দূরপাল্লার রাস্তা পার হবার আগে অনেক উপজাতি নানা রকম মন্ত্র বলে নেয় যাতে তার কোন বিপদ আপদ না ঘটে। তাদের মতে এগুলি কেবল তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ সমষ্টি নয়। এর মধ্যে রয়েছে অতিপ্রাকৃত শক্তি।

    ভবিষ্যৎ কথন (Divination): প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ তার ভবিষ্যৎকে জানার চেষ্টা করেছে তার জীবনের যাত্রাপথকে সুগম করার জন্য। এই ভবিষ্যৎকে জানার আগ্রহ কেবল যে আদিবাসী জীবনে সীমাবদ্ধ তা নয়, বর্তমানের শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এর রেওয়াজ রয়েছে। মণিপুর অঞ্চলের আদিবাসী কুকি সমাজের পুরোহিতকে ‘মাকে বলা হয়। বিবাহের প্রারম্ভে মাকে বিবাহ কিরকম হবে, সুখের কিংবা দুঃখের, তা জানার চেষ্টা করে। এইজন্যে সে একটা মোরগ বলি দেয়। সেই মোরগ যদি পা দুটো জোড়া করে পড়ে তবে বিবাহ সুখের এবং স্থায়ী হবে বলে বিশ্বাস করা হয়। পা ছড়িয়ে পড়লে সেই বিবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    বাংলাদেশের বুনা সমাজে চাউল বা কোন ভক্ষ্য বস্তু রেখে নতুন ঘর তৈরীর জায়গা ঠিক করা হয়। বাড়ী তৈরীর আগে তুকতাক করার পর একটা পাত্রে চাল রেখে আসা হয়। যদি সেই সব বস্তু রাত্রে কোন প্রাণী, বিশেষ করে ইঁদুর বা আরশুলা বা অন্য কোন পোকামাকড়ে, না খেয়ে ফেলে তবে স্থানটি উত্তম বিবেচিত হয়। মেদিনীপুর অঞ্চলের লোধা উপজাতির মধ্যে তেলখড়ি’ বা ‘তেল পাজা করে ভবিষ্যৎ গণনার রীতি রয়েছে গুণি আসে, তুকতাক করে একটা শালপাতায় মন্ত্র পড়ার পর কয়েক ফোঁটা তেল দেয়। ধীরে ধীরে মন্ত্র পড়া চলে। তারপর তেল ফোঁটাগুলোর অবস্থা লক্ষ্য করা হয়। যদি তেল ফোঁটা অবিকৃত থাকে তবে গণনার ফল বা অনুমান নির্ভুল বলে ধরা হয়। লোধারা তীরধনুক দিয়েও ভবিষ্যৎ গণনার চেষ্টা করে। রোগ ব্যাধির কারণ, ডাইনি ভূতের উৎপাত জানতে হলে ভবিষ্যৎ কথনের সাহায্য নেয়।

    ধর্মীয় নিষেধ (Taboo): অতিপ্রাকৃত শক্তিকে মানুষ ভয় করে। তাই বিশেষ ব্যাপারে বিধিনিষেধ মেনে চলে। অনেকের বিশ্বাস এইসব বিধিনিষেধ মানার ফলে অনেক নিশ্চিত বিপদের আশঙ্কাকে এড়ান যেতে পারে। আন্দামানের আদিবাসীরা কোনদিন মৌমাছির চাক পোড়ায় না। তাদের ধারণা মৌচাক পোড়ালে ঝঞ্ঝার দেবতা বিলিকু ক্রুদ্ধ হবেন, আবার ইনি কষ্ট হলে নানা প্রকার প্রলয় ঘটাতে পারেন। লোধাদের সমাজে অনেক ‘কুল’ (clan) রয়েছে। প্রত্যেক কুল-এর লোকেরা এক একটা বিশেষ বস্তুকে কুলদেবতা বা টোটেম’ (totem) বলে মনে করে। ভক্তাগোত্রের লোকেরা ‘চিরকা আলু’ (একরকমের জংলী আলু বা yam) খায়না। অবশ্য অন্য কুল বা গোত্রের লোকেরা অনায়াসে ঐ আলু খেতে পারে। ভক্তাগোত্রের লোকের বিশ্বাস তারা যদি চিরকা আলু খায় তবে সেই পরিবারে অপমৃত্যু ঘটবে ও কুলদেবতা কষ্ট হবেন। আরও অনেক রকমের বাধা নিষেধ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সমাজে মেনে চলে। যেমন ঐ লোধাদের পোয়াতিরা ধুনীতে আটকান মাছ খায়না। তাদের বিশ্বাস পোয়াতি অবস্থায় ঘুনীতে আটকান মাছ খেলে পেটের সন্তান এইরকম কষ্ট পেতে পারে। এইরকমের কত যে বাধা নিষেধের গণ্ডী এক-একটা সমাজে রয়েছে তার আর ঠিক নেই।

    ধর্মীয় নিষেধের উদ্দেশ্য সাধারণতঃ তিন প্রকারের হয়। (১) ফলপ্রদ (productive), (২) রক্ষাপ্রদ (protective) এবং (৩) নিষেধক (prohibitive)। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের এক সমতা রয়েছে যা ধর্মীয় নিষেধের মাধ্যমে অনেক পরিমাণে রক্ষা করা চলে। এই বিশ্বাসের মূলে অনেক অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা রয়েছে। ধর্মীয় নিষেধের দ্বারা ঐ সকল শক্তি প্রশমিত থাকে। যাদুমন্ত্র (charm), মাদুলী (amulct), কবচ বা তাবিচ (talisman) ইত্যাদির সাহায্যে মানুষ অনেক সময় নানা বিপদ-আপদকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আর এই সকল বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার অন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কার্যে সুনিশ্চিত সাফল্যের জন্য অথবা অভীষ্ট পূরণের জন্য ভিন্ন লোক ভিন্ন পথ গ্রহণ করে। আমাদের দেশে বসন্তের প্রকোপ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য হরিতকী বীজ হাতে বেঁধে নেওয়ার রেয়াজ আছে। যাই হোকনা কেন মানুষ যুগের পর যুগ ধরে নানা বিপদকে পরিহার করার চেষ্টার কখন কখন অতিপ্রাকৃত বা অশরীরী শক্তিকে সম্মোহিত করার প্রয়াসে ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী হয়ে একটা বিধান মেনে নিতে চেয়েছে।

    মানুষ মাত্রেই সমান নয়। বিশেষ ক্ষমতা, স্বকীয়তা, ধীশক্তি মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রকাশ পায়। সেই কারণে গোষ্ঠীর উপর ব্যক্তির নেতৃত্ব স্বাভাবিক ভাবে এসে পড়ে অথবা ব্যক্তিপ্রতিভার দীপ্ত বিকাশ অনেককেই আকৃষ্ট করে। আদিম সমাজের ইতিহাস অথবা বর্তমানের উপজাতি সমাজের সমাজ-জীবন পর্যালোচনা করলে এই রকম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের নজির মিলে। কিন্তু উপজাতিদের মধ্যে ধারণা এই, বিশেষ ব্যক্তিত্ব একরকম ঐশী শক্তি (mana) ছাড়া আর কিছু নয়। নইলে সাধারণ মনুষের সংগে তার এই রকম ব্যতিক্রম কেন হবে? তারা এই ঐশী শক্তিকে অতিপ্রাকৃত বা অশরীরী শক্তির এক বিকাশ বলে ধরে নিয়েছে। পলিনেশীয়দের কাছে এই শক্তি অনেকটা বিদ্যুতের মত। এই শক্তির প্রভাবে প্রাণী বা বস্তু প্রভাবাম্বিত হয়, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়। কৃতকার্যতা, দক্ষতা, সবকিছুরই মূলে রয়েছে এই শক্তি। পরাজয়ের ব্যর্থতার পশ্চাতে বয়েছে এই শক্তির নিদারুণ অভাব। সৈনিক শক্তি নিধন করে তাদের সমূহ ঐশী শক্তিকে নিজের মধ্যে আহৃত করে নেয় এবং উত্তম যোদ্ধারূপে পরিগণিত হয়। মাওরী (Maori) উপজাতিদের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল। কোন কোন আমেরিকান ইণ্ডিয়ানরা এই শক্তিতে বিশ্বাস করে। ইরাকোয়া (Irquoa) উপজাতি গোষ্ঠী এই শক্তি বা প্রভাবকে অরেণ্ডা (Orenda) বলে অভিহিত করে। কোন কোন নৃতত্ত্ববিদ ছোটনাগপুরের হো উপজাতি ‘বঙ্গা-বিশ্বাসকে ঐ ঐশী শক্তির নামান্তর বলে স্বীকার করেন। পলিনেশীয় উপজাতিদের ধারণা এই শক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়। মানুষের ঐশী শক্তি, দ্রব্য সম্ভার (artefacts) এর সংস্পর্শে, অথবা আচার-অনুষ্ঠানের দক্ষতার মাধ্যমে সঞ্জীবিত করে রাখা যায়।

    সর্বপ্রাণবাদ (Animism) : সাধারণ মানুষ অথবা বেশীরভাগ উপজাতি-গোষ্ঠী প্রত্যেক জীবের মধ্যে আত্মার কল্পনা করে। এই আত্মার জন্যই প্রাণী জীবন্ত থাকে আর এর অভাবে জড় পদার্থে পরিণত হয়। আত্মা অপ্রতীয়মান ও অদৃশ্য, এক কায়াহীন ছায়া বা বাষ্পের মত। মানুষের অতীন্দ্রিয়ের সাহায্যে এর অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। ত্বরিৎ গতিতে ভিন্নস্থানে পরিভ্রমণ আত্মার এক বৈশিষ্ট্য। যে কোন অবস্থায় এক প্রাণীর দেহ হতে অন্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করতে আত্মার কোন অসুবিধা হয় না। আত্মা অমর। অনেকের ধারণা মানুষ যখন ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন দেখে–আর সেই স্বপ্নের মাধ্যমে তার অনেক অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করে–তখন সেই ব্যক্তির বাহ্যিক কোন পরিবর্তন হয় না– কেবল অভিজ্ঞতাটুকু উপলব্ধি করা যায় মাত্র। কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার আত্মা স্থায়ীভাবে সেই দেহ পরিত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এই সর্বপ্রাণবাদ ধারণার মাধ্যমে কায়াহীন আত্মার অস্তিত্ব ও নানা শক্তির আকারে এর পরিবর্তনকে স্বীকার করা হয়। আত্মার বিশ্বাস হল আদিম ধর্মবিশ্বাসের মূল ধারণা। টাইলর (Tylor) প্রমুখ নৃবিজ্ঞানীর মতে স্বপ্ন ইত্যাদির অভিজ্ঞতায় মানব সমাজে সর্বপ্রাণবাদের সূচনা হয়েছে। ধীরে ধীরে আত্মার বিভিন্ন বিকাশের সংগে মানুষের মনে কুলদেবতা, ভূত-প্রেত, যক্ষ-রক্ষ, দেবদেবী বা পরব্রহ্মের কল্পনা এসেছে। এই আত্মা জাগতিক সুখ-দুঃখকে মানুষের মাঝে মাঝে থেকে অনুভব করতে পারে। আদিম বর্বর মানুষের সমাজ দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল জীবনের নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। উপজাতি সমাজে আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে নানা অদ্ভুত ধারণা রয়েছে নাগাদের ধারণা হৃৎপিণ্ড হল আত্মার স্থিতিকেন্দ্র। সেমা-নাগাদের বিশ্বাস মানুষের অনেকগুলি আত্মা আছে– মানুষ যখন নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়ে তখন তার কতকগুলি আত্মা বাইরে বেরিয়ে যায়। যদি কোন সময় ঐ আত্মা ডাইনী-ভূতের কবলে আটকা পড়ে আর ফিরে আসতে না পারে তবে তখন তার নানা রকম অসুখ হয়। ওড়িশার খন্দ উপজাতির ধারণা মানুষের মোট চারিটি আত্মা রয়েছে; খেড়িয়া উপজাতিদের ধারণা মানুষের দুটি আত্মা– একটি ভাল আর একটি মন্দ। এইভাবে উপজাতিদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই আত্মায় বিশ্বাস হল সর্বপ্রাণবাদের ভিত্তি। এই আত্মায় বিশ্বাসের সূত্র ধরে ভৌতিক, আধিভৌতিক বা দৈবী শক্তিকে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে এবং পূজাপদ্ধতি বা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের নানা রূপান্তর ঘটেছে।

    জড়-প্রাণবাদ (Animatism): এক রকমের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মাধ্যমে কোন জড় পদার্থকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বা বোধক্ষম বলে কল্পনা করা হয়। এতে কোন জটিল ধর্মানুশাসনের বা পূজাপদ্ধতির অনুষ্ঠান করা হয় না। সর্বপ্রাণবাদ বিশ্বাসের সংগে এর তফাৎ অনেক। এই বিশ্বাসে কল্পনা করা হয় যে কোন শক্তি যে কোন বস্তুতে বিরাজমান থেকে সাধারণ মানুষের ভীতি বা শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে। যেমন কোন জলাশয়ে ঐ রকম শক্তি আছে। সে হয়ত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে এক ভীতির সঞ্চার করেছে– ফলে মানুষ তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা পায়। কিন্তু সর্বপ্রাণবাদে শক্তির উপাসনা বা প্রীতিরই বেশী চেষ্টা করা হয়। জড় প্রাণবাদের আর এক উদাহরণ হল, কালিফার্নিয়ার ইণ্ডিয়ান উপজাতিদের বিশ্বাস কোন জলাশয় বা গাছ মানুষের জীবনে বিঘ্ন বা উৎপাত আনছে। সুতরাং ঐ শক্তির কবলে যাতে অযথা না পড়তে হয় তার জন্য ঐ সমস্ত স্থানকে পরিহার করা বিধেয়।

    অতিপ্রাকৃত শক্তি বলতে আমরা অনেক স্তরের বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিকে বুঝি। পৃথিবীর সর্বস্তরের আদিবাসী মানুষের মনের মধ্যে এই সকল শক্তির কল্পনা এখনও জীবন্ত। তাদের ধারণা, এই সকল শক্তির অনেকে দেব-দেবীর পূর্ণ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। যাঁদের খেয়াল খুশিমত বিশ্বপ্রকৃতি প্রাণিজগৎ নিয়ন্ত্রিত হয়– তাঁদের অনেকেই অনেক কিছুরই স্রষ্টা। আবার দেবদেবীর (deities, gods and goddesses) চাইতে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীনশক্তি(spirits) রয়েছে। মানুষের অনেক শুভাশুভ এদের প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এদের অনেকে আছেন চির মঙ্গলময় (benificent), আর কেউ বা আছেন অনর্থকারী (malevolent)। আর কেউ কেউ রয়েছেন একেবারে নিরপেক্ষ (neutral)। মর্যাদা ও যোগ্যতা অনুসারে এদের আস্তানার তারতম্য লক্ষিত হয়। সেই সংগে উপাসনা বা সন্তুষ্ট করার বিধিব্যবস্থারও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মৃত ব্যক্তির আত্মাও মৃত্যুর পর শক্তিতে পরিণত হয়– এও একরকমের অতিপ্রাকৃত শক্তি। জড় দেহের অবসান হলেও মানুষের অতৃপ্ত আশা আকাঙ্গুলির চরিতার্থতার জন্য নানা প্রকার ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে এদের প্রকাশ সম্ভব হয়। অন্যান্য উচ্চস্তরের শক্তির সংগে এদের প্রভাব অতি সহজেই নজরে পড়ে। শুধু মানুষ নয়, মনুষ্যেতর প্রাণীর অকালমৃত্যুও অনেক সময় তাকে ভিন্ন গুণের অতিপ্রাকৃত শক্তিতে রূপান্তরিত করে বলে অনেকের বিশ্বাস। গাভীর অকালমৃত্যু ‘গোমুয়া’ ভূতের রূপান্তর। ঠিক তেমনি করে বাঘের কবলে মানুষ মারা পড়লে বাগোয়া ভূত হয়। ভারতের অনেক উপজাতির জীবনে এই বাগোয়া ভূতের কল্পনা রয়েছে।

    ঈশ্বর (Supreme Being or High God): অনেক উপজাতি সমাজে ঈশ্বর বা ভগবানের কল্পনা রয়েছে। তারা ঈশ্বরকে বিশ্বস্রষ্টা বা বিশ্বনিয়ন্তা হিসাবে স্বীকার করে। তাঁর স্থিতি পৃথিবীর উর্ধ্বে কোন স্বর্গরাজ্য যে স্বর্গরাজ্য অনেকটা আকাশলোকের কাছাকাছি। ভগবানের আরাধনার জন্য কোন নিত্য-পূজার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয় না এইজন্য যে তিনি চির মঙ্গলময়। দক্ষিণ আন্দামানী অথবা অস্ট্রেলীয় উপজাতিদের ধারণা মানুষের পাপে ও কদাচারে তিনি এই মর্তজগৎ ছেড়ে স্বর্গরাজ্যে চলে গেছেন। বিদ্যুৎ বজ্র ইত্যাদি হল তাঁর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। মেদিনীপুর জেলার লোধাদের ধর্মদেবতা, ছোটনাগপুরের ওরাওঁ উপজাতিদের ধরমেশ’, খেড়িয়াদের ধর্মদেবতা’ হো-দের ‘সিংবোঙ্গা’, মুণ্ডাদের ‘বুরু বোঙ্গা’ ইত্যাদি হল ভগবানের স্বরূপ। পরব্রহ্মের নানা গুণ ও বিকাশ আছে। তিনি অমর, সর্ব-বিরাজমান। তিনি সকলের অলক্ষ্যে দোষগুণ দেখতে পান অথবা উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি মঙ্গলময় ও ন্যায়ময়। তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বসৃষ্টিকর্তা। যে কোন পূজা পদ্ধতি অথবা বিবাহ ইত্যাদি শুভ কার্যের আরম্ভে এই সব সর্বশক্তিমানকে মাঙ্গলিকের অঙ্গ হিসাবে উপাসনা করা হয়।

    দেবশক্তি (Deities or divinitics): শীতলা, চণ্ডী, মনসা প্রভৃতি ক্ষমতাসম্পন্ন দেবীদের উপজাতি মাত্রেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সংগে উপাসনা করে থাকে। শুধু উপাসনা নয় এদের প্রীতির জন্য নানা প্রকার বলি বা উপহার ত আছেই। এদের পুজোর বিধান অনুসারে যথাসময়ে পূজার উদযাপন হয় এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাই কেবল পূজানুষ্ঠানের অধিকার রাখে। মানুষের সমাজকে নানা প্রকার অঘটন ও আকস্মিক বিপদ থেকে মুক্ত করার জন্য এই সকল দেবদেবীকে বৎসরের নানা সময়ে সামাজিক বা সম্প্রদায়গত ভাবে পূজার্চনা করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সমাজের আরও কিছু কিছু দেবদেবী রয়েছেন যারা গ্রামের শুভাশুভ দেখে থাকেন যেমন ওঁরাওঁ উপজাতিদের ‘সরণ বুড়িয়া’–তিনি গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। প্রতি গ্রামের প্রাচীনতম বৃক্ষের নিকট তাঁর কুঞ্জ বা আস্তানা থাকে। দেবীর মাথায় চুল শনের মত সাদা। বসন্তের চন্দ্রালোকে দেবীকে গ্রামের অলিগলিতে ঘুড়ে বেড়াতে ওঁরাওঁ সম্প্রদায়ের অনেকে দেখেছে। গ্রামে কোন আকস্মিক বিপদের অথবা দুর্ঘটনার ইঙ্গিত ‘সরণ বুড়িয়ার কাছ থেকে পাওয়া যায়। লোধা, ভূমিজ বা মুণ্ডাদের গ্রামে এই রকমের ‘গরাম’ বা ‘গ্রাম দেবতা’ বা ‘বড়াম’ ঠাকুর রয়েছেন। লোধাদের বড়াম পুরুষঠাকুর। তার আস্তানা বিরাট কোন গাছের ছায়ায়। রাত্রের অন্ধকারে তিনিও বিচরণ করেন। বড়ামের হাতে থাকে সুতীক্ষ্ণ টাঙি। তিনি টাঙি নিয়ে আর গোঁফজোড়া ফুলিয়ে রাস্তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ান। জংগলে গভীর রাত্রে কাঠ কাটার শব্দে বড়ামের গতি জানা যায়।

    ভূত ও প্রেতশক্তি (Ghosts and Evil Spirits); আকস্মিক মৃত্যুতে মানুষের অনেক বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়- সেইজন্য তার আত্মার আর মুক্তি হয়না বা নরদেহে তার পূনর্জন্ম হয় না। তখন স্বাভাবিক ভাবে এই মৃতের আত্মা দুষ্ট আত্মা বা ভূতে পরিণত হয়। উপজাতি সমাজে এইরকম প্রেত বা ভূত শক্তির পরিকল্পনা রয়েছে। জলে ডোবা, বাঘের কবলে পড়া, সাপের চোট বা আগুনে পোড়া হল। আকস্মিক মৃত্যুর কারণ– আর এতে মৃত্যু হলে তাকে নিঃসন্দেহে ভূত হতেই হবে। কোন গভিনী যদি প্রসবের সময় অথবা গর্ভাবস্থায় মারা যায় লোধাদের মতে সে ‘চিরগুণ’ ভূতে পরিণত হবে। এই সকল ভূত বা প্রেত শক্তি শ্মশান অথবা লোকালয়ের বহির্ভূত অঞ্চলে থাকে। এ সমস্ত রূপান্তরিত আত্মা ছাড়া আরও অনেক রকমের দুষ্ট ভূত আছে। ‘ব্রহ্মদৈত্য’, ‘কালপুরুষ’, ওঁরাওঁ সমাজের ‘মহাদানিয়া’, ‘কুনন্দ্রা’ বা ‘চণ্ডভূত’ প্রভৃতি অনেকেরই পরিচিত। এই সকল খল স্বভাবের ভূত কারণে অকারণে মানুষের ক্ষতি করে থাকে। জলেও একরকমের খল ভূত থাকে তাদের নাম জঁকা (Water-Spirit)। এই জল-ভূতেরা কখনও বা কাঠের গুঁড়ি বা পিঁড়ির আকারে ভেসে বেড়ায়। ভাদ্র মাসের কোন কোন সময়ে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাঁধকে ভেঙে দিয়ে বন্যাপ্লাবিত করে।

    কোন কোন জড় পদার্থকে এই সকল শক্তির আধার বলে গণ্য করা হয়। তখন এই শক্তির আধারকে নানা ভাবে প্রীতি করা হয়। তাকে জড়-অর্চনা (Fetishism) বলা হয়। এই জড়-অর্চনা আফ্রিকা মহাদেশে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। কোন অশরীরী শক্তির পীঠস্থান (scat) বা প্রতিমূর্তি (idol)-এর কল্পনা এর মধ্যে নাই। কেবল শক্তির বাহন বা প্রতীক হিসাবে যে কোন পার্থিব বস্তুই অর্চিত হয়ে থাকে। Fetish হল পর্তুগীজ শব্দ।

    পিতৃপুরুষ পূজা (Ancestor Worship): এই পূজা অর্থে আদিম উপজাতি সমাজে পরিবারের বা গোষ্ঠীর আদি পিতার পূজা বোঝায়। মৃত্যুর পর আত্মা বা দেহাতীত শক্তির স্বীয় গোষ্ঠীর প্রতি যে অনবদ্য প্রীতির সংযোগ থাকে এবং বংশধরগণ সেই কুল-পুরুষ বা বংশপিতাকে তুষ্ট করায় যে বিধান পালন করেন তাই পিতৃপুরুষ পূজা নামে পরিচিত। স্পেনসর (Spencer) প্রমুখ নৃবিজ্ঞানীর মতে আদি পিতা বা পিতৃপুরুষের পূজাই হল ধর্মাচরনের মূল ভিত্তি। এ থেকে ধীরে ধীরে নানারকম মূর্তি, এমন কি জীবজন্তু পূজারও প্রচলন হয়েছে। আদিম সমাজে বিশেষ ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ বা ক্ষমতাশালী লোককে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতো। মৃত্যুর পরও তার আত্মার প্রীতিসাধন, গোষ্ঠী ও সমাজ জীবনে যে অপরিহার্য তা তারা ভুলতে পারেনি। তাই এইরকম পিতৃপুরুষ পূজা প্রচলিত হয়ে আসছে। পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলে কোন কোন পরিবারে ‘মুনিশ ঠাকুরের’ পূজার প্রচলন আছে। এই মুনিশ ঠাকুরকে পরিবারের লোকেরা বিশেষ কোন রাত্রে জলচৌকির সামনে এক ঘটি জল, গামছা ও এক ঘটি দুধ, কলা ও ভাঙ উপহার দিয়ে থাকেন। পরের দিন ভোরে সকলে সমবেত ভাবে ঐ প্রসাদ গ্রহণ করে থাকে। এ হল পিতৃপুরুষ বা আদিপিতা পূজার নিয়ম।

    ক্রিয়াকাণ্ড ও লোকাচার (Rituals): জীবন সংগ্রামের পটভূমিকায় মানুষের সংগে পারিপার্শ্বিক নানা প্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তির নিত্যনিয়ত এক বোঝাপড়া চলছে। এই অপার্থিব জগতের কল্পিত শক্তি নিচয়ের সংগে চিরশান্তি বা অভয়ের যে বিশেষ বিশেষ খাপ খাওয়ানোর পদ্ধতি বা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা তার বিভিন্ন বিকাশ হল পূজাপদ্ধতি, বলিদান, অর্ঘ, প্রার্থনা ও স্তবস্তুতি। বিভিন্ন দেবদেবী ও শক্তির বিভিন্ন রূপ বা কার্যক্রম অনুসারে স্তবস্তুতি বা পূজার্চনার ধরণ পৃথক হয়। তাছাড়া মানুষের জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলিতে এক আচার অনুষ্ঠান ক্রিয়াকাণ্ডের ফাঁকে বিভিন্নরূপে সেগুলোকে বিঘ্ননাশক বিবাহ-জন্ম-মৃত্যুর লগ্নে বিভিন্ন জাতি উপজাতি নানা ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রয়াসী হয়। মোট কথা সবকিছুরই মূলে রয়েছে অশরীরী বা অলৌকিক ক্ষমতার সংগে মানুষের জ্ঞানের অনতিক্রম্য অপার্থিব অবস্থার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা।

    প্রার্থনা, স্তব-স্তুতি (Prayer & Hymn): অশরীরী বা দৈবশক্তির কাছে দুর্বল, অক্ষম মানুষের করুণ আবেদন ও শক্তি ভিক্ষা, প্রার্থনা বা স্তব-স্তুতির আকারে প্রতীয়মান হয়। এতে দৈবশক্তির অসীমত্বের কাছে মানুষের ক্ষদ্রত্ব কল্পনা করা হয়, আকারে ইঙ্গিতে আত্মনিন্দার মাধ্যমে এই ক্ষুদ্রত্ব প্রকট করে বিরাটত্বের কাছে শক্তি প্রার্থনা বা যাচ্ঞা হল এর বিষয়বস্তু। কোথাও স্বাভাবিক ভাষায় বিশেষ ভাবে বিভিন্ন উপজাতি তাদের নিজস্ব ভাব ব্যক্ত করে, কোথাও বা বিরাট শক্তির প্রশংসাই হল স্তুতির নামান্তর। আর্য প্রভাবান্বিত ভারতীয় সমাজে সংস্কৃত আদি ভাষায় এই সকল প্রার্থনা বা স্তব-স্তুতি রচিত হয়েছে।

    দান ও অর্ঘ (offerings): মানুষের ক্রমে ক্রমে বিশ্বাস হয়েছে কেবলমাত্র স্তব-স্তুতি দ্বারা ঐশী শক্তিকে বশীভূত করা যায় না। ব্যক্তি মানুষের কল্পনা নিয়ে যখন ঐ সকল শক্তিতে নরত্ব আরোপ করা হত তখন আদি মানুষের স্বভাবতঃ কল্পনায় এসেছিল যে, সাধারণ মানুষেণ মত এদেরও নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজন বা কামনা পূরণ করলে এরাও প্রীত হবেন। তাই নানাবিধ উপচারে, কখনও ভক্ষ্যবস্তু দিয়ে, শক্তিকে প্রীত করার চেষ্টা দেখা গিয়েছে। এসবের মাধ্যমে রয়েছে কিছু দিয়ে কিছু পাবার চেষ্টা। দান ও উপাচারের বদলে অভয় প্রার্থনা।

    বলিদান (Sacrifice): বহু উপজাতি সমাজে ক্ষেত্রের উৎপন্ন প্রথম ফসল উৎসর্গ করার ব্যবস্থা বিদ্যমান। নানা প্রকার ফলছাড়াও অন্যান্য ভক্ষ্যবস্তু বা জীব-জন্তু, কোথাও বা নরবলি দেওয়ার বিধান রয়েছে। কোন স্কুলে আত্মবলি দেওয়া হত। ওড়িশার খন্দ উপজাতির মধ্যে নরবলি দেবার প্রথা দীর্ঘদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। অস্তগামী সূর্যের উত্তাপ বৃদ্ধি বা শক্তি কামনায় মানুষের জীবন্ত হৃৎপিণ্ডের উপহার এক বিশেষ প্রথা হিসাবে প্রচলিত ছিল। ভূমির শস্যোৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যার রাত্রে ওঁরাওঁ উপজাতি এখনও পথিক মানুষকে বিনা দ্বিধায় বলি দেয়। লোধা, সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি উপজাতির লোকেরা ছাগল, মুরগী, পায়রা, হাঁস প্রভৃতি নানা দেবদেবীর তুষ্টি সাধনের জন্য বলি দেয়। কোথাও বা মৃন্ময় হাতী বা ঘোটক উপহার দেওয়া হয়। এছাড়া নানাবিধ লোকাচার বা স্ত্রীআচার বহু সমাজে প্রচলিত। যেগুলির সংগে জীবনের এক বিশেষ ঘটনার সম্পর্ক বিদ্যমান। কোথাও কোথাও প্রাগ যৌবনোন্মেষের অনুষ্ঠান (Puberty ritual) প্রচলিত। বয়োবৃদ্ধির সংগে সংগে দৈহিক পরিবর্তন ও মানুষের স্বাভাবিক কল্পনার অনেক জিজ্ঞাসা এসেছে। কেরল দেশের কাদার (Kadar) উপজাতির মধ্যে যৌবনের অভিষেক সম্মুখস্থ দন্তদ্বয় সূচল করার প্রথায় পর্যবসিত। প্রস্তর খণ্ড দিয়ে ঘসে ঘসে দাঁতকে সূচল করা এই রীতির অঙ্গীভূত অনুষ্ঠান। আন্দামানী নারীদের এই অনুষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। কোথাও বা নারীকে প্রথম রক্তস্রাবের দিনগুলি একান্ত সঙ্গীহীনা অবস্থায় কালাতিপাত করতে হয়। আদিবাসী ক্লামাথ (Klamath) সমাজে এক বিস্তৃত স্ত্রী-আচার রয়েছে। প্রথম ঋতুস্রাবের পাঁচদিন পর্যন্ত নারীকে একটা ঝোঁপের মধ্যে কাটাতে হবে। ঐ পাঁচদিন সে পূর্বদিকে মুখ করে নাচবে, নিরামিষ খাবে আর দেহ কয়নের প্রয়োজন হলে বিশেষ এক প্রকার কাঠি দিয়ে তা সমাধান করবে। পাঁচদিন শেষে তাকে তার ব্যবহৃত কাপড় পুড়িয়ে নতুন কাপড় পরে বাড়ী ফিরতে হবে। ঐসব স্ত্রী-আচারের সংগে কেবল যে যৌবনের কাপড় পুড়িয়ে নতুন কাপড় পরে বাড়ী ফিরতে হবে। ঐসব স্ত্রী-আচারের সংগে কেবল যে যৌবনের অভিষেক হয় তা নয় ভাবী জীবনের প্রস্তুতি চলে। লোধা সমাজে বিবাহের পর প্রথম ঋতুস্রাবের দিনটাতে পাঁচ রংয়ের ফুল দিয়ে স্বামীস্ত্রীর এক অনুষ্ঠান চলে। নীলগিরি পাহাড়ের টোডা উপজাতির মধ্যে এই দিনটি পর-পুরুষের সংগে মিলনের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে।

    ঔর্ধ্ব দৈহিক বা মৃতানুষ্ঠান (Mortuary Rites): মৃত্যুকে সকল মানুষ ভয় পায়। মৃত্যু পার্থিব জগতের সংগে চির-ব্যবধান সৃষ্টি করে। তাই মৃত্যুর সংগে সংগে বহু জাতি উপজাতি নানা প্রকার অনুষ্ঠান করে। আন্দামানীরা দীর্ঘ ক্রন্দনের পর মৃতের দেহে সাদা ও লাল রংএর প্রলেপ দেয়। গারোরা মৃতের পায়ের আঙুলে মোরগ বেঁধে দেয়- কেন না এই মোরগ তার আত্মাকে সত্বর স্বর্গরাজ্যে বয়ে নিয়ে যাবে। মৃতের হাতে পথখরচা পয়সা দেবারও ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ওঁরাওঁদের পোয়াতি মারা গেলে তার চোখে ফনিমনসার কাঁটা বিঁধে দেওয়া হয়; পায়ের তলাতেও ঐ কাঁটা ফুটান থাকে। হাত পায়ের গাঁট ভেঙে চুর্ণ করার রীতিও ঐ সমাজে প্রচলিত। তাদের ধারণা তার আত্মাকে একটা দুষ্ট ভূতে পরিণত হবে; তখন সে কবর ভেঙে বের হয়ে আসতে পারবে না। এ ছাড়া নানা প্রকারের সৎকারের ব্যবস্থা রয়েছে।

    রোগ-ব্যাধির ধারণা ও প্রতিকার (Concept and treatment of disease): রোগ ব্যাধির ধারণার সংগে নানা শক্তির কল্পনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মানুষ নিরাময় থাকার চেষ্টায় ঐ সকল শক্তিকে নানাভাবে প্রশমিত করার চেষ্টা পায়। অসুখ-বিসুখের কারণ সম্পর্কে তিনটি ধারণা আদিবাসী সমাজে বদ্ধমূল। সেগুলি হল : (১) অতিপ্রাকৃত শক্তির উপদ্রব (supernatural agency), (২) মানুষের তুকতাক বা নজর (human agency), ও (৩) স্বাভাবিক কারণ (natural causes). কলেরা বসন্ত হাম প্রভৃতি রোগগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে শীতলা দেবীর অপ্রসন্নতার কারণ বলে অনুমান করা হয়। লোধাদের মতে চণ্ডী হলেন দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধির মালিক। তাছাড়া আরও অনেক ছোট খাট দেবদেবীর সংগে নানা প্রকার ব্যধির কারণও সংযুক্ত রয়েছে। কোন কোন আদিবাসী সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস হল দেহের আত্মা বাইরে এসে আটকা পড়লে আত্মার বিলুপ্তি (soul loss) ঘটে। তখন নানাপ্রকার রোগ-ব্যাধি বা উপসর্গ দেখা যায়। আবার অনেক উপজাতির বিশ্বাস অপরের কোন ভ্রাম্যমান আত্মা হঠাৎ যদি কারুর দেহে ঢুকে পড়ে তখন তার দেহ ব্যাধিকবলিত হয়। আবার মানুষের চারদিকে নানা প্রকার খল শক্তি বা প্রেত শক্তি রয়েছে। তারা কখনও কখনও কায়া পরিবর্তিত করে মানুষের দেহে রোগের বীজানু ছড়িয়ে যায়। এই সকল শক্তির প্রভাবে দেহের উত্তাপ বেড়ে যায়, চোখ রক্তবর্ণ হয়, আর কেউ কেউ বিকারের ঘোরে ভুল বকতে থাকে। অনেকের বিশ্বাস ধর্মীয় নিষেধ লঙ্ঘন করলে (breach of taboo) নানাবিধ অসুখ হতে পারে। কাদার, ভেদ্দা প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠীর ধারণা, ভূত বা পিশাচ শক্তিই নানা রোগ মানুষের সমাজে ছড়ায়। তাই তারা রোগীকে ঘিরে প্রচণ্ড নাচগান করে থাকে–তাদের বিশ্বাস এইরকম নাচগান বা সংকীর্তনের মাধ্যমে রাক্ষুসে পিশাচ শক্তি দূরে সরে যাবে। সাঁওতাল, টোডা, লোধা, মুণ্ডা প্রভৃতি সমাজের লোকেরা ডাইনী বা যাদুকরদের ভয়ানক ভয় করে। ওদের মতে ডাইনীরা ছোট ছেলেদের রক্ত শুষে খেতে ভালোবাসে। তাই যদি কোন ছোট ছেলে হঠাৎ শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করে তবে তাদের ধারণা এরদিকে ডাইনীর নজর পড়েছে। ঐ সকল ডাইনীর নজরকে ঠেকাবার জন্য অনেক গুণীন বা যাদুকর রয়েছে–তারা তুকতাক করে, ঝাড়ফুক দেয়, মাদুলী দিয়ে ডাইনীদের নজরকে ঠেকিয়ে রাখে। আমাদের সমাজে ছোট ছেলেরা আকষনীয় লাল পোষাক পরলে তার কপালে কাজলের কালো টিপ পরিয়ে দেওয়া হয়। অনেকের বিশ্বাস নজর টজরে পেটের অসুখ হয়। নজর টজরের আক্রমণ থেকে মানুষের দেহ নয় শাক-সজী বা আলু ফসলের ক্ষেতেরও পরিত্রানের কোন পথ নাই। এই কারণে অনেক সময় পুরনো হাড়িতে চুনের দাগ দেয়, অথবা গরুর মাথা বা ছেঁড়া জুতা ক্ষেতের মাঝে আটকে দেয় যাতে কারুর নজরে কোন ক্ষতি না হয়।

    মৃতের সংকার (Disposal of the dead): এর পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে মৃত্যুর কারণ সর্বত্র সমান নয়। নানা অশরীরী শক্তি বা ক্ষমতার জন্য মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। তাই মৃত্যুর পর তার দেহ কিভাবে সমাধিস্থ করা হবে বা কিভাবে তার সৎকার করা হবে এ নিয়ে নানা প্রকার ধারণা প্রচলিত। মৃতদেহ সৎকারের পূর্বে মৃত্যুর কারণ, মৃতের বয়স ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য রেখে একই সমাজে নানা রকমের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলের বাথুরীরা (Bathuri) স্বাভাবিক ভাবে মৃতদেহকে উন্মুক্ত স্থানে নিক্ষেপ করে। ভেদা উপজাতিরা মৃতের বুকে পাথর চাপিয়ে সে স্থান চিরকালের মত ত্যাগ করে। আন্দামানীরা একটা খোলা জায়গায় চ্যাঙাড়ী তৈরী করে সেখানে মৃতদেহকে শায়িত করে দেয়। কোথাও কোথাও কুষ্ঠ রোগীকে অথবা কলেরা বসন্ত প্রভৃতি রোগে মৃত ব্যক্তির দেহকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ফেলে দেয়। সুতরাং উন্মুক্ত স্থানে মৃতের দেহ বিসর্জন এক প্রাচীনতম সৎকার প্রথা।

    ভূনিম্নে প্রোথিত বা সমাধিস্থ করার নিয়ম অনেক উপজাতি সমাজে রয়েছে। শবর-লোধা প্রভৃতির মধ্যে কবর দেবার রীতি রয়েছে। ওঁরাওঁরা গর্ভিনীর মৃতদেহকে কবর দেয়। আবার আন্দামানী উপজাতির মধ্যে পূর্বদিকে মাথা রেখে কবর দেবার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।

    ছোটনাগপুরের ওঁরাওঁ উপজাতিদের আর একরকমের সৎকারের নিয়ম প্রচলিত ছিল। একটি মৃতকে বছরের কিছুদিন কবর করে রাখা হয়। পরে ‘হাড়বোরা’ পরবের দিন সেই কবর থেকে মৃতদেহকে উদ্ধার করে চিতা সাজিয়ে দাহ করা হয়। দাহের পর তার শেষ দগ্ধাস্থি সংগৃহীত করা হয় একটা মাটির ভাঁড়ে। পরে সেই ভড়কে কুলের (clan) কুণ্ডতে প্রক্ষিপ্ত করা হয়। বর্তমানে কোন কোন অঞ্চলে এই রকমের সৎকার-বিধির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

    দাহ (Cremation): শবদাহের রীতি আদিবাসী সমাজে নতুন নয়। সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা মৃতকে দাহ করে। টোডারা পাথরের বিরাট চাকড়া দিয়ে মণ্ডল তৈরী করে এবং মৃতকে দাহ করার পূর্বে একটা মহিষকে নাক মুখ টিপে নৃশংসভাবে হত্যা করে। অনেক সময় মৃতের চিতায় ঘী ছড়িয়ে দেয়। সাঁওতালেরা মৃতের দগ্ধাস্থি দামোদর নিক্ষেপ করে।

    কোথাও কোথাও বিশেষভাবে মমীর মাধ্যমে মৃতদেহকে অবিকৃত রাখা হয়। আফ্রিকা মহাদেশে এই প্রথা প্রচলিত। মহেনজোদারোতে মাটির বিরাট ভঁড়ে (urn) মৃতের সমাধি রচনার প্রয়াস দেখা যায়। আসামের কোন কোন আদিবাসী মৃতকে বেশ কিছুদিন শুকিয়ে নেয়, তারপর তার স্থায়ী সৎকার করে। মৃত্যুর পর মৃতের পরিবারে শোক চলে। বিভিন্ন সমাজে এই অশৌচকালের সময় দীর্ঘ হয়। আন্দামানীরা মৃতের মাথার খুলি, চোয়াল ইত্যাদি সমুদ্রের জলে ধুয়ে গলায় বেঁধে রাখে। এ হল তাদের শোকের চিহ্ন। কোন কোন সমাজে নিরামিষ খাওয়া চুল নখ না কাটা হল শোকের চিহ্ন। নির্দিষ্ট অশৌচকালে নানা আচার অনুষ্ঠান করা হয়। তাতে মৃতের উদ্দেশ্যে নানা প্রকার উপহার দেওয়া হয়। ওঁরাওঁ বা মুণ্ডাদের মধ্যে মৃতের আত্মাকে আমন্ত্রণ করে বাড়ীতে আনার বিধি আছে। ঐসময় নানা অনুষ্ঠান বিশেষভাবে মোরগ বলি দেওয়া হয়। মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রস্তর ফলক প্রোথিত করা হয়। নব্য প্রস্তর যুগের সমাজ সংস্কৃতিতে এই রীতির নানাধরণের বিকাশ দেখা যায়। ভারতবর্ষে খাসিয়া, মুণ্ডা, হে প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠীর নোক মৃতের উদ্দেশ্যে ফলক স্থাপন করে, তার স্মৃতিকে জাগরূক রাখার চেষ্টা পায়।

    অনুষ্ঠান বিশেষজ্ঞ : যাজক: শক্তি-কল্পনা বা তার বিশ্লেষণের জন্য চাই বিশেষ এক বিশেষজ্ঞ আবার নানা প্রকার ক্রিয়াকাণ্ডকে সার্থক করে তুলতে হলে বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। সে অভিজ্ঞতা একদিনে হয় না। তার জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাণবিশী। আবার প্রত্যেক মানুষ সকল প্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশ করতে বা তাদের তুষ্টি সাধন করতে পারে না। যে সকল বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে পারদশী, তাদের মধ্যে পুরোহিত, (Priest), ভেঙ্কী পুরুত (Shaman), ঐন্দ্রজালিক (Magician), ডাইনি (Witch), ওঝা (Sorcerer)-রা হল প্রধান।

    পুরোহিতরা দেবদেবী ও নানাবিধ দৈবশক্তির সংগে সাধারণ মানুষের এক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এরা দৈবশক্তিকে সন্তুষ্ট রেখে নানা রকম মন্ত্র, স্তুতি কখনও বা বলিদান ইত্যাদির মাধ্যমে নৈষ্টিক ও শুদ্ধি আচরণের দ্বারা সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে থাকে। লোধা সমাজের পুরোহিতেরা ‘দেহেরী’ নামে পরিচিত। ওঁরাওঁদের পুরোহিতরা ‘পাহান’ বা ‘বাইগা’ বলে অভিহিত হয়। সাঁওতালদের পুরোহিতরা ‘নায়েকে’ এবং কড়া গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের পুরোহিতকে ‘মাঝি’ বলে অভিহিত করে। এই সব পুরোহিতকে সাহায্য করার জন্য ‘হন্তকার’, ‘টালিয়া’, ‘পূজার’ ইত্যাদি সহকারী পুরোহিত রয়েছে যারা প্রধান পুরোহিতকে নানা বিষয়ে সাহায্য করে থাকে।

    ভেল্কী পুরুত (Shaman)-রা দেবদেবী বা বিভিন্ন শক্তির সংগে অথবা নানা প্রকার অপার্থিব শক্তির সংগে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ স্থাপিত করে। তাদের কোন বাঁধধরা পূজা-অর্চনার মধ্যে যেতে হয়না। যদি কোন শক্তি বা দেবদেবী তাদের উপর ভর করে থাকে তখন তারা হঠাৎ উৎকট চীৎকার করতে থাকে–হাত পা অত্যন্ত জোরে ছুঁড়তে থাকে–তাদের চীৎকারে তাদের মুখ থেকে অনর্গল ফেনা বার হয়। কখনও বা রাস্তার মোড় পর্যন্ত দৌড় দেয়। মাথা নেড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে। ভেক্ষী পুরুতের মুখ দিয়ে অশরীরী শক্তি কথা বলে। লোধা সমাজের ‘ব্যকড়া’ হল এই রকম ভেঙ্কী পুরুত।

    এছাড়া ঐন্দ্রজালিক, ডাইনী, ওঝা বা ভোজ-বিদ্যাকারীরা প্রত্যেক সমাজে কিছু না কিছু রয়েছে। ভবিষ্যৎ কথনের লোকও রয়েছে। তাদের অনেক মেহনতী করে এই সব বিদ্যা আয়ত্তে আনতে হয়। পরে গুরুর কৃপালাভে সমর্থ হলে প্রতিপত্তি লাভ করে থাকে।

    বাস্তবতার দৃষ্টিতে বিভিন্ন সমাজের ধর্মবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে নিঃসন্দেহে ধর্মবিশ্বাসের ভিন্ন পথগুলির কথা আমাদের মনে পড়বে। ধর্মবিশ্বাস মানব সভ্যতার বিশেষ এক সংস্কার। এ বিশ্বাস অনাদিকাল হতে নানাভাবে ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনকে প্রভাবম্বিত করেছে। কঠোর বাস্তব ঘেরা পরিবেশের বাইরে মানুষের বুদ্ধির অনধিগম্য যে অতিপ্রাকৃত জগৎ আছে, তার সংগে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস মানুষের সমাজ জীবনে ধর্মবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয় মাত্র। সুকৌশলী মানুষ প্রভূত পার্থিব সম্পদের অধিকারী হওয়ার পর তাকে নিরাপদে আয়ত্তে রাখার জন্য নানা ধ্যান ধারণার কল্পনার অনেক রঙিন মতবাদ ঢুকিয়ে সাধারণ মানুষকে বারবার ক্রিয়াকাণ্ডের কঠিন জালে বাঁধার চেষ্টা পেয়েছে, ধর্মবিশ্বাসের অনুষ্ঠানে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এই সকলের গভীর অনুশীলনে নিঃসন্দেহে বহুধা বিভক্ত মানব সমাজের সমন্বয়ী সংস্কৃতির বিচিত্র রূপরেখার অখণ্ড-উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅলৌকিক নয়, লৌকিক – 8র্থ খণ্ড – (জাতিস্মর, আত্মা, অধ্যাত্মবাদ) – প্রবীর ঘোষ
    Next Article মহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধকুমার সান্যাল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Our Picks

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.