Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প736 Mins Read0

    বর্ষার দিন

    বর্ষার দিন

    আজ ঘুম থেকে উঠে চোখ চেয়ে দেখি আকাশে আলো নেই। আকাশের চেহারা দেখে অধস লোক ঠিক বুঝতে পারে না যে, সময়টা সকাল না সধে। এ ভুল হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক, কারণ সকাল বিকাল দুই কালই হচ্ছে রাত্রি-দিনের সন্ধিস্থল। তার পর যখন দেখা যায় যে, উপর থেকে যা নিঃশব্দে ঝরে পড়েছে তা সর্যের মদ, কিরণ নয় জলের সক্ষম ধারা, তখন জ্ঞান হয় যে এটা দিন বটে, কিন্তু বর্ষার দিন।

    এমন দিনে কাব্য-ব্যসনী লোকদের মনে নানারকম পবস্মতি জেগে ওঠে। বর্ষার যে রূপ ও যে গুণের কথা পর্ব-কবিরা আমাদের জাতীয় স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রেখে গিয়েছেন তা আবার মনশ্চক্ষে আবির্ভূত হয়।

    অনেকে বলেন যে, কবির উক্তি আমাদের জ্ঞানের বাধাধরপ। যা চোখে দেখবার জিনিস, শোনা কথা নাকি সে জিনিসের ও চোখের ভিতর একটা পর্দা ফেলে দেয়। এ পৃথিবীতে সব জিনিসকেই নিজের চোখ দিয়ে দেখবার সংকপটা অতি সাধ! কিন্তু স্মৃতি যে প্রত্যক্ষের অন্তরায় এ কথাটা সত্য নয়। আমরা যা-কিছু প্রত্যক্ষ করি তার ভিতর অনেকখানি স্মৃতি আছে, এতখানি যে প্রত্যক্ষ করবার ভিতর চোখই কম ও মনই বেশি। এ কথা যাঁরা মানতে রাজি নন তাঁরা বের্গস’র Matter and Memory নামক গ্রন্থখানি পড়ে দেখলেই ইন্দ্রিয়গোচর বিষয়ের সঙ্গে স্মৃতিগত বিষয়ের অঙ্গাঙ্গিসম্বন্ধটা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। সে যাই হোক, কবির হয়ে শুধু এই কথাটা আমি বলতে চাই যে, কবির উক্তি আমাদের অনেকেরই বোজা চোখকে খুলে দেয়, কারো ভোলা চোখকে বুজিয়ে দেয় না। কবিতা পড়তে পড়তে অনেকের অবশ্য চোখ ঢলে আসে, কিন্তু তার কারণ স্বতন্ত্র।

    সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে যাঁর কিছুমাত্র পরিচয় আছে তিনিই জানেন যে ও-সাহিত্য বর্ষার কথায় মুখরিত। বর্ষা যে পর্ব-কবিদের এতদর প্রিয় ছিল তার কারণ সেকালেও বর্ষা দেখা দিত গ্রীষ্মের পিঠ পিঠ। ইংরেজ কবিরা যে শতমুখে বসতের গণগান করেন তার কারণ সে দেশে বসন্ত আসে শীতের পিঠ পিঠ। ফলে সে দেশে শীতে মিয়মাণ প্রকৃতি বসতে আবার নবজীবন লাভ করে। বিলেতি শীতের কঠোরতা যিনি রক্তমাংসে অনুভব করেছেন, যেমন আমি করেছি, তিনিই সে দেশে বসন্তঋতু-স্পর্শে প্রকৃতি কি আনন্দে বেঁচে ওঠে তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। সে দেশ ও ঋতু প্রকৃতির ফুলসজ্জা।

    সংকৃত কবিরা যে দেশের লোক সে দেশে গ্রীষ্ম বিলেতি শীতের চাইতেও ভীষণ ও মারাত্মক। বাণভট্টের শ্রীহর্ষচরিতে গ্রামের একটি লম্বা বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা পড়লেও আমাদের গায়ে জ্বর আসে। এ বর্ণনা প্রকৃতির ঘরে আগুন লাগবার বর্ণনা। যে ঋতুতে বাতাস আসে আগুনের হলকার মতো, যে ঋতুতে আলোক অগ্নির রূপ ধারণ করে, যে ঋতুতে পত্র পুষ্প সব জ্বলে পড়ে ছাই হয়ে যায়, আর বৃক্ষলতা সব কঙ্কালসার হয়ে ওঠে, সে ঋতুর অতে বর্ষার আগমন, প্রকৃতির ঘরে নবজীবনের আগমন। কালিদাস একটি লোকে সেকালের কবিদেব মনের আসল কথা বলে দিয়েছে–

    বহুগুণরমণীয়ঃ কামিনীচিত্তহারী
    তরুরিটপলতানাং বান্ধবো নির্বিকার।
    জলদসময় এষ প্রাণিনাং প্রাণভূতো
    দিশতু তব হিতানি প্রায়শো বাঞ্ছিতানি।।

    পৃথিবীতে যে বস্তুই ‘প্রাণিনাং প্রাণভূতো’ সেই বস্তুই শুধু কামিনী-চিত্তহারী নয় কবি-চিত্তহারীও। আর কালিদাস যে বলেছেন ‘কামিনী-চিত্তহারী’ তার অর্থ–যা সর্বমানবের চিত্তহারী তা স্বীজাতিরও চিত্তহারী হবার কথা, কেননা শ্ৰীলোকও মানুষ। উপরন্তু শ্রীজাতির সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ঠ। এত ঘনিষ্ঠ যে অনেকের ধারণা নারী ও প্রকৃতি একই বস্তু, ও-দুয়ের মধ্যে পুরুষ শুধু প্রক্ষিপ্ত।

    ৩.

    আমাদের দেশে গ্রীষ্মের পরে বর্ষার আবির্ভাব প্রকৃতির একটা অপরূপ এবং অদ্ভুত বদল। গ্রীষ্ম অন্তত এ দেশে ধীরে ধীরে অলক্ষিতে বর্ষায় পরিণত হয় না। এ পরিবর্তন হ্রাসও নয় বৃদ্ধিও নয়, একেবারে বিপর্যয়। বর্ষা গ্রীষ্মের evolution নয়, আমূল revolution। সুতরাং বর্ষার আগমন কানারও চোখে পড়ে, কালারও কানে বাজে। কালিদাস বর্ষাঋতুর বর্ণনা এই বলে আরম্ভ করেছেন

    সশীকরাম্ভোধরমত্তকুঞ্জর-
    স্তড়িৎপতাকোহশনিশব্দমদলঃ।
    সমাগতো রাজবদুদ্ধতদ্যুতি–
    ঘর্নাগমঃ কামিজনপ্রিয়ঃ প্রিয়ে।।

    বর্ষার এতাদৃশ রূপবর্ণনা ইউরোপীয় সাহিত্যে নেই। কারণ এ ঋতু ও-বেশে সে দেশে প্রবেশ করে না। ইংলন্ডে দেখেছি, সেখানে বৃষ্টি আছে কিন্তু বর্ষা নেই। বিলিতি প্রকৃতি সদাসর্বদা মুখ ভার করে থাকেন এবং যখন তখন কাঁদতে শুরু করেন, আর সে কান্না হচ্ছে নাকে-কান্না, তা দেখে প্রকৃতির উপর মায়া হয় না, রাগ ধরে। সে দেশে বিদ্যুৎ রণপতাকা নয়–পিদিমের সলতে, তার মুখের আলো প্রকৃতির অট্টহাস্য নয়—রোগীর মুখের কষ্টহাসি। আর সে দেশের মেঘের ডাক অশনিশব্দমর্দল নয়, গাব-চটা বাঁয়ার বকচাপা গ্যাঁঙরানি। এক কথায় বিলেতের বর্ষা থিয়েটারের বর্ষা। ও গোলাপপাশের বৃষ্টিতে কারো গা ভেজে না, ও টিনের বজ্ৰধ্বনিতে কারো কান কালা হয় না, ও মেকি বিদ্যতের আলোতে কারো চোখ কানা হয় না। বিলেতের বর্ষার ভিতর চমকও নেই চটকও নেই। ওরকম ধ্যানমঘনে প্যানপেনে জিনিস কবির মনকে স্পর্শ করে না, তাই বিলেতি সাহিত্যে বর্ষার কোনো রূপবর্ণনা নেই। যার রূপ নেই তার রূপবর্ণনা কতকটা যার মাথা নেই তার মাথাব্যথার মতো। শেলির মন অবশ্য পর্বতশঙ্গে মেঘলোকে বিচরণ করত। কিন্তু সে মেঘ হচ্ছে কুয়াশা, তার কোনো পরিচ্ছিন্ন মতি নেই। সুতরাং তাঁর আঁকা প্রকৃতির ছবি কোনো ফ্রেমে আঁটা যায় না, যেমন West Windকে বাঁশির ভিতর পোরা যায় না। ফ্রেম কথাটা শুনে সেই-সব লোক চমকে উঠবেন যাঁরা বলেন যে, অসীমকে নিয়েই কবির কারবার। অবশ্য তাই। জ্ঞানের অসীম সীমার বাইরে, কিন্তু আর্টের অসীম সীমার ভিতর।

    ৪.

    বর্ষা যে রাজার মতো হাতিতে চড়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে নিশান উড়িয়ে ধুমধড়ক্কা ক’রে আসে, এ ঘটনা এ দেশে চিরপুরাতন ও চিরনবীন। সুতরাং যুগ যুগ ধরে কবিরা বর্ষার এই দিগবিজয়ী রাজরপ দেখে এসেছে এবং সে-রপ ভাষায় অকিত করে অপরের চোখের সম্মুখে ধরে দিয়েছে। আমাদের দেশে বর্ষার রূপের মতো আমাদের কাব্যসাহিত্যে তার বর্ণনাও চিরপুরাতন ও চিরনবীন। মানুষের পনেরক্তি প্রকৃতির পুনরুক্তির অনুবাদ মাত্র।

    কালিদাসের বহুপরবর্তী কবি বর্ষাঋতুর ঐ রাজরূপ দর্শন করেছেন, সবাই সেই রূপেরই বর্ণনা করেছেন। এমন-কি, হিন্দি কবিরা ও-ছবি তাদের গানে আজও ফুর্তি করে আঁকছে

    দবোধন বেশে বাদর আওয়ল

    এ পদটি মল্লার রাগের একটি প্রসিদ্ধ পদের প্রথম পদ। ও গান যখন প্রথম শনি তখন আমার চোখের সম্মুখে বিদ্যৎ ঝলকে উঠেছিল, কানের কাছে মর্দগের গুরুগম্ভীর অবিরল পরং বেজে উঠেছিল।

    এ গান শুনে যদি কেউ বলেন যে, উক্ত হিন্দি গানের রচয়িতা কালিদাসের কবিতা চুরি করেছেন তা হলে বলতে হয় যে, রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন–

    বাদল মেঘে মাদল বাজে

    সে কথাও অশনিশব্দমর্দলের বাংলা কথায় অনুবাদ। সাহিত্যে এরূপ চুরিধরা বিদ্যে বাতুলতার না হোক বালিশতার পরিচায়ক। কারণ এ বিদ্যার বলে এও প্রমাণ করা যায় যে, কালিদাস তাঁর পর্ববতী কবিদের বর্ণনা বেমালুম আত্মসাৎ করেছিলেন। মৃচ্ছকটিক-প্রকরণে বিট বসন্তসেনাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন–

    পশ্য পশ্য। অয়মপরঃ—
    পবনচপলবেগঃ স্থূলধারাশরৌঘঃ।
    স্তনিতপটহনাদঃ স্পষ্টবিদ্যুৎপতাকঃ।
    হরতি করসমূহং খে শশাঙ্কস্য মেঘো
    নৃপ ইব পুরমধ্যে মন্দবীর্যস্য শত্রোঃ।।

    উক্ত লোকের ভিতর স্পষ্ট বিদ্যৎপতাকা আছে, পটহনিনাদ আছে, নৃপ আছে। অর্থাৎ কালিদাসের শোকের মালমসলা সবই আছে। আর মৃচ্ছকটিক হচ্ছে দরিদ্র চারুদত্তের রাজসংস্করণ, কারণ তা হচ্ছে রাজা শূদ্রকের সংকরণ। দরিদ্র চারুদত্ত ভাসের লেখা; আর ভাস যে কালিদাসের পূর্ববর্তী কবি তা স্বয়ং কালিদাস নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। এর থেকে প্রমাণ হয় শুধু এই মাত্র যে, বর্ষার রূপ এ দেশে সনাতন, তাই তার বর্ণনাও সনাতন। আর শাস্ত্রে বলে, যা সনাতন তাই অপৌরুষেয়।

    ৫.

    স্মৃতি প্রত্যক্ষের পরিপন্থী নয়, কিন্তু শ্রুতি অনেক ক্ষেত্রে দর্শনের প্রতিবন্ধক। অনেকের দেহে কান চোখের প্রতিযোগী। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে নাম রূপের প্রতিদ্বন্দী। আমরা যদি কোনো বিষয়ের কথা শুনে নিশ্চিত থাকি তা হলে সে বিষয়ের দিকে চোখ চেয়ে দেখবার আমাদের প্রবত্তি থাকে না। কথা যখন কিংবদন্তী হয়ে ওঠে তখন অনেকের কাছে তা বেদবাক্য হিসেবে গ্রাহ্য হয়। একটা সর্বলোকবিদিত উদাহরণ নেওয়া যাক।

    বহুকাল থেকে শুনে এসেছি যে অনেকে বিবাস করেন যে, পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামতে বাধ্য, কেননা কালিদাস বলেছেন, “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে দেশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

    কালিদাস শুধু বড়ো কবি নন, সেইসঙ্গে তিনি যে বড়ো জিয়োগ্রাফার এবং বড়ো অনিথলজিস্ট তা জানি, কিন্তু উপরন্তু তিনি যে একজন অভ্রান্ত মেটিয়রলজিস্ট তা বিশ্বাস করা কঠিন। মেঘদূতকে মেটিয়রলজিকাল অফিসের রিপোর্ট হিসেবে গ্রাহ্য করতে আমি কুণ্ঠিত। কারণ মেঘদূত আর যাই হোক মেঘলোক সঘধে ছেলেভুলানো সংবাদের প্রচারক নয়। মেঘকে দূত করতে হলে তাকে বর্ষাঋতুতেই যাত্রা করাতে হয়। আর কোন পথ দিয়ে উড়ে অলকায় যেতে হবে সে বিষয়েও কালিদাস উক্ত দতকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপদেশ দিয়েছেন। কালিদাস খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে–

    মার্গং তাবচ্ছ্‌ণু কথয়তস্ত্বৎপ্রয়াণানপং
    সন্দেশং মে তদন, জলদ শ্রোষ্যসি শ্রোত্রপ্রেয়ম।

    অর্থাৎ আগে পথের কথা শোনো, তার পর অলকায় গিয়ে কার কাছে কি বলতে হবে সে কথা পরে শুনো। এ কারণ পূর্বমেঘ আগাগোড়াই পথের কথা।

    ৬.

    এ পথ ভারতবর্ষের উত্তরাপথ। বাংলা থেকে অন্তত দেড় হাজার মাইল দূরে। সুতরাং সে দেশে কখন বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়, তার থেকে বাংলায় কোন দিন বৃষ্টি নামবে তা বলা যায় না, অন্তত ন্যায়শারে এমন কোনো নিয়ম নেই যার বলে রামগিরি থেকে এক লক্ষে কলকাতায় অবতীর্ণ হওয়া যায়।

    কিন্তু আসল কথা এই যে, কালিদাস এমন কথা বলেন নি যে পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামে। তাঁর কথা এই যে–

    তস্মিন্নদ্রৌ কতিচিদবলাবিপ্রযুক্তঃ স কামী
    নীত্বা মাসান্‌ কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।
    আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
    বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ৷৷

    সমস্ত শ্লোকটা উদ্‌ধৃত করে দিলাম এইজন্যে যে সকলেই দেখতে পাবেন যে, এর ভিতর বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। যক্ষ যা দেখেছিলেন তা হচ্ছে ‘মেঘমাশ্লিষ্টসানুং’ অর্থাৎ পাহাড়ের গায়ে নেপটে-লাগা মেঘ। এরকম মেঘ বাংলাদেশে কখনো চোখে পড়ে না, দেখা যায় শুধু পাহাড়ে পর্বতে। যক্ষ যে তা দেখেছিলেন তাও অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই, কেননা তিনি বাস করতেন তস্মিন্নদ্রৌ–সেই পাহাড়ে। সুতরাং বাংলাদেশে যাঁরা পয়লা আষাঢ়ে সেইরকম উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, যথা—

    চাতকিনী কুতুকিনী ঘনদরশনে

    তাঁরা সেই শ্রেণীর লোক যাঁরা কথার মোহে ইন্দ্রিয়ের মাথা খেয়ে বসে আছেন। শুনতে পাই বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেছেন যে, কথার অর্থ ভুল বোঝা থেকেই mythএর জন্ম হয়। বৈজ্ঞানিকদের এ মতের সত্যতার প্রমাণ .তো হাতে-হাতেই পাওয়া গেল।

    ৭.

    আষাঢ় সম্বন্ধে বাংলাদেশে আর-একটি কিংবদন্তী আছে, যা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে এবং চিরকাল লেগেছে। কথায় বলে ‘আষাঢ়ে গল্প’, কিন্তু গল্পের সঙ্গে আষাঢ়ের কি নৈসর্গিক যোগাযোগ আছে তা আমি ভেবে পাই নে।

    আমার বিশ্বাস, গপের অনকল ঋতু হচ্ছে শীত, বর্ষা নয়। কেননা গল্প লোকে রাত্তিরেই বলে। তাই পৃথিবীর অফুরন্ত গল্পরাশি একাধিক সহস্র রজনীতেই বলা হয়েছিল। শীতকাল যে গল্প বলার ও গল্প শোনার উপযুক্ত সময় তার কারণ শীতকালে রাত বড়ো দিন ছোটো। অপর পক্ষে আষাঢ়ের দিনরাতের হিসেব শীতের ঠিক উলটো; একালের দিন বড়ো, রাত ছোটো। দিনের আলোতে গল্পের আলাদিনের প্রদীপ জ্বালানো যায় না।

    তবে যে লোকে মনে করে যে, আষাঢ়ের দিন গল্পের পক্ষে প্রশস্ত দিন, তার একমাত্র কারণ আষাঢ়ের দিন প্রশস্ত। কোনো বস্তুর পরিমাণ থেকে তার গুণ নির্ণয় করবার প্রবত্তি মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ, পরিমাণ জিনিসটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর গুণ মনোগ্রাহ্য। আর সাধারণত আমাদের পক্ষে মনকে খাটানোর চাইতে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করা ঢের সহজ। তবে একদল লোক, অর্থাৎ হেগেলের শিষ্যরা, আমার কথা শুনে হাসবেন। তাঁদের গর, বলেছেন যে কোয়ানটিটি বাড়লেই তা কোয়ালিটি হয়ে ওঠে। এই কারণেই সমাজ হচ্ছে গুণনিধি আর ব্যক্তি নির্গুণ; আর সেই জাতিই অতিমানুষের জাত যে জাত অর্ধেক পৃথিবীর মাটির মালিক।

    এ দার্শনিক মতের প্রতিবাদ করবার আমার সাহসও নেই ইচ্ছেও নেই। কেননা দেখতে পাই এ দেশেও বেশির ভাগ লোক হেগেল না পড়েও হেগেলের মতাবলম্বী হয়েছেন। ভিড়ে মিশে যাওয়ার নামই যে পরম পরষার্থ, এ জ্ঞান এখন সর্বসাধারণ হয়েছে। গোলে হরিবোল দেওয়াই যে দেশ-উদ্ধারের একমাত্র উপায়, এই হচ্ছে বর্তমান হট্টমত। এ জর্মান-মত সম্বন্ধে যাঁর মনে দ্বিধা আছে তাঁকে আগে একটি মহাসমস্যার মীমাংসা করে পরে মুখ খুলতে হবে। সে সমস্যা এই : কোয়ানটিটি কোয়ালিটির অবনতি, না, কোয়ালিটি কোয়ান, টিটির পরিণতি? এ বিচারের উপযুক্ত সময় হচ্ছে নিদাঘ, বর্ষা নয়। কারণ উক্ত সমস্যার মীমাংসার জন্য তার উপর প্রচণ্ড আলো ফেলতে হবে, যে আলো এই মেঘলা দিনে আকাশেও নেই, মনেও নেই। আজকের দিনে এই গা-ঢাকা আলোর ভিতর বাজে কথা বলাই মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। কালিদাস বলেছেন–

    মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ

    সুতরাং আমার মনও যে অন্যথাবৃত্তি অর্থাৎ অদার্শনিক হয়ে পড়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

    ৮.

    এখন পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া যাক। ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটার সৃষ্টি হল কি সূত্রে তারই এখন অনুসন্ধান করা যাক, কিন্তু সে সূত্ৰ খুঁজতে হলে আমাকে আরএক শাস্ত্রের দ্বারস্থ হতে হবেযে শাস্ত্রের ভিতর প্রবেশ করবার অধিকার আমার নেই, সে শাস্ত্রের নাম শব্দতত্ত্ব। অপর পক্ষে, এই বর্ষার দিনে স্বাধিকারপ্রমত্ত হবার অধিকার সকলেরই আছে, এই বিশ্বাসের বলেই আমি অনধিকারচর্চা করতে ব্ৰতী হচ্ছি।

    আমি পূর্বে বলেছি যে, নিরককারদের মতে যে কথার মানে আমরা জানি নে অথচ বলি, সেই কথা থেকেই কিংবদন্তী জন্মলাভ করে। আমার বিশ্বাস ‘আষাঢ়ে গল্প’-রপ কিংবদন্তীর জন্মকথাও তাই।

    আমাদের বাঙাল দেশে লোকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে না, বলে ‘আজাড়ে গল্প’। এখন এই ‘আজাড়ে’ শব্দটি কি ‘আষাঢ়ে’র অপভ্রংশ? ‘আজাড়’ শব্দের সাক্ষাৎ সংস্কৃতকোষের ভিতর পাওয়া যায় না। এর থেকে অনুমান করছি যে এটি হয় ফারসি নয় আরবি শব্দ। আর ও-কথার মানে আমরা সবাই জানি, অন্য সূত্রে। আমরা যখন বলি মাঠ উজাড় করে দিলে তখন আমরা বুঝি যে উজাড় মানে নির্মূল। কারণ ‘জড়’ মানে যে মূল তা বাংলার চাষীরাও জানে। সুতরাং ‘আজাড়ে গল্পে’র অর্থ যে অমূলক গল্প এরূপ অনুমান করা অসংগত নয়। এই ‘আজাড়’ কথাটার শুদ্ধি করে নিয়ে আমরা তাকে ‘আষাঢ়’ বানিয়েছি। এ কারণ আরব্য-উপন্যাসের সব গল্পই অজাড়ে গল্প, হিন্দু জবানে ‘আষাঢ়ে গল্প’; যদিও আরবদেশে আষাঢ়ও নেই, শ্রাবণও নেই।

    সুতরাং এ কিংবদন্তীর অলীকতা ধরতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব যে, বৃষ্টির জল পেয়ে গল্প গজায় না, জন্মায় শুধু কবিতা। বর্ষাকাল কবির স্বদেশ, ঔপন্যাসিকের বিদেশ।

    ৯.

    বর্ষা যে গল্পের ঋতু নয় গানের ঋতু-তার প্রমাণ বাংলা সাহিত্যে আষাঢ়ে গল্প নেই, কিন্তু মেঘরাগের অগণ্য গান আছে।

    বাংলার আদিকবি জয়দেবের আদিকে কার মনে নেই? সকলেরই মনে আছে এই কারণ যে–

    মেঘৈর্মেদরমম্বরং বনভূবশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ

    এ পদ যার একবার কর্ণগোচর হয়েছে তাঁর কানে তা চিরদিন লেগে থাকবার কথা। চিরদিন যে লেগে থাকে তার কারণ A thing of beauty is a joy for ever। এর সৌন্দর্য কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব দেবার জো নেই। পোয়েট্রি অথবা বিউটি যে-ভাষায় আমাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করে, তা অপর কোনো ভাষায় অনুবাদ করা অসম্ভব। আর আমরা যাকে ভাষা বলি, সে তো হয় কর্মের, নয় জ্ঞানের ভাষা। তবে ঐ ক’টি কথায় জয়দেব আমাদের চোখের সম্মুখে যে-রপ ধরে দিয়েছেন তা একটু নিরীক্ষণ করে দেখা যাক। কবিতা মাত্রেরই ভিতর ছবি থাকে; অতএব দেখা যাক কবি এ ঋলে কি ছবি এঁকেছেন। বর্ষার যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন এ সে-ছবি নয়। এর ভিতর বজ্র নেই বিদ্যুৎ নেই বৃষ্টি নেই–অর্থাৎ যে-সব জিনিস মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপর হঠাৎ চড়াও হয় এবং মানুষের মনকে চমকিত করে সে-সব জিনিসের বিন্দুবিসর্গও উক্ত পদে নেই। কবি শুধু দুটি কথা বলেছেন, আকাশ মেঘে কোমল ও বনতমালে শ্যাম; তিনি তুলির দুটি টানে একসঙ্গে আকাশের ও পৃথিবীর চেহারা এঁকেছেন। এ চিত্রের ভিতরে কোনো রেখা নেই, আছে শুধু রঙ; আর সে রঙ নানাজাতীয় নয়; একই রঙ-শ্যাম, উপরে একটু ফিকে নীচে একটু গাঢ়। এ বর্ণনা হচ্ছে–চিত্রকররা যাকে বলে—ল্যাণ্ডকেপ পেন্টিং। তুলির দু টানে জয়দেব বর্ষার নির্জনতার, নীরবতার, তার নিবিড় শ্যামশ্রীর কি সমগ্র কি সুন্দর ছবি এঁকেছেন। এ ছবি যার চোখে একবার পড়েছে তার মনে এ ছবির দাগ চিরদিনের মতো থেকে যায়। বাইরে যা ক্ষণিকের, মনে তা চিরস্থায়ী হয়। যা অনিত্য তাকে নিত্য করাই তো কবির ধর্ম।

    ১০.

    এর থেকে মনে পড়ে গেল যে, কবিতা বস্তু কি? এ প্রশ্ন মানুষে আবহমানকাল জিজ্ঞাসা ক’রে এসেছে, আর যথাশক্তি তার উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে। এ সমস্যার মীমাংসায় ইউরোপীয় সাহিত্য ভরপুর। আরিস্টটলের যুগ থেকে এ আলোচনা পরে হয়েছে আর আজও থামে নি, বরং সটান চলছে। এর চুড়ান্ত মীমাংসা যে আজ পর্যন্ত হয় নি তার কারণ, যুগে যুগে মানুষের মন বদলায় এবং তার ফলে পুরনো মীমাংসা সব নতুন সমস্যা হয়ে ওঠে। যখন মানুষের মনে কোনো সমস্যা থাকবে না তখনই তার চুড়ান্ত মীমাংসা হবে। যাক বিদেশের কথা। কাব্যজিজ্ঞাসা যে এ দেশের লোকের মনেও উদয় হয়েছিল তার পরিচয় যিনি পেতে চান, তিনি ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ সম্বন্ধে আমার বন্ধু, শ্ৰীঅতুলচন্দ্র গুপ্তের বিস্তৃত আলোচনা পড়ে দেখুন। আমাদের দেশের দার্শনিকরা ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’র যে উত্তর দিয়েছেন ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’রও সেই একই উত্তর দিয়েছেন। সে উত্তর হচ্ছে নেতি নেতি, অর্থাৎ কাব্যের প্রাণ রীতিও নয়, নীতিও নয়, ভাষাও নয় ভাবও নয়। এক কথায় কাব্যের প্রাণ হচ্ছে একটি mystery। প্রাণ জিনিসটা mystery, এ সত্য জেনেও মানুষে দেহের ভিতর প্রাণের সধান করেছে, আর তা কতকটা পেয়েছে। সুতরাং কবিতার দেহতত্ত্বের আলোচনা করলে আমরা তার প্রাণের সন্ধান পেতে পারি। দার্শনিকের সঙ্গে কবির প্রভেদই এই যে, দার্শনিকের কাছে দেহ ও মন, ভাষা আর ভাব দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তু; কিন্তু কবির কাছে ও-দই এক। তাঁর কাছে ভাষাই ভাব, আর ভাবই ভাষা। কাব্যবস্তু যে ভাষার অতিরিক্ত তার কারণ ভাষার প্রতি পরমাণুর ভিতর ভাব আছে, এবং তা যে ভাবের অতিরিক্ত, তার কারণ প্রতি ভাবকণার ভিতর ভাষা আছে। এই কারণে বলতে সাহসী হচ্ছি যে, জয়দেবের উত্ত পদ যে আমাদের মুগ্ধ করে তার একটি কারণ তার music, আর এ musicএর মূলে আছে অনুপ্রাস। অনুপ্রাস জিনিসটে কতদূর বিরক্তিকর হতে পারে তার পরিচয় বাংলার অনেক যাত্রাওয়ালা ও কবিওয়ালার গানে পাওয়া যায়। কিন্তু কবির হাতে পড়লে অনুপ্রাস যে কবিতাতে প্রাণসঞ্চার করে তার পরিচয় অপর ভাষার অপর কবিদের মুখেও পাওয়া যায়। শেকসপীয়রের full fathom five thy father lies, এবং কোলরিজের five miles meandering with a mazy motion-এ দুটি পদ যে মনের দুয়ারে ঘা দেয় এ কথা কোন সহৃদয় লোক অস্বীকার করবে? এ দুটি লাইনের সৌন্দর্য যে অনুপ্রাস-নিরপেক্ষ নয় সে তো প্রত্যক্ষ সত্য। জয়দেবের বর্ষার রূপবর্ণনা অনুপ্রাসের গুণে ভাবঘন হয়ে উঠেছে, আর এই একই কবির বসন্তবর্ণনা অনুপ্রাসের দোষে নিরর্থক হয়েছে–

    ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলনকোমলমলয়সমীরে

    শুধু শব্দঘটা মাত্র, ছবিও নয়, গানও নয়। ও-পদের ভিতর সে ধ্বনিও নেই, সে আলোকও নেই, যা আমাদের ভিতরের বাইরের রূপলোককে আলোকিত ও প্রতি ধ্বনিত করে।

    ১১.

    কাব্যবস্তুর স্বরূপ বর্ণনা করতে হলে যে নেতি নেতি বলতে হয়—এ কথা আমিও জানি, আমিও মানি। কিন্তু এ নেতি নেতির অর্থ এই যে, রচনার যে গুণকে অথবা রূপকে আমরা কাব্য বলি তা শব্দালংকার অর্থালংকার প্রভৃতি সবরকম অলংকারের অতিরিক্ত। তবে কাব্য অলংকার-অতিরিক্ত বলে অলংকার-রিক্ত নয়। কাব্যের সর্বপ্রকার অলংকারের মধ্যে যে অলংকার সবচেয়ে সস্তা সেই অলংকার অর্থাং অনুপ্রাসও যে আমাদের মনে কাব্যের সুর সঞ্চার করতে পারে, এ কথা মেনে নিলে বহু কবিতার রস উপভোগ করা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে আসে, কারণ এ বিষয়ে আমাদের মন অনেক ভুল আইডিয়ার বাধামুক্ত হয়। ভালোকথা, ভাবেরও কি অনুপ্রাস নেই? সেই অনুপ্রাসই কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে না, যে অনুপ্রাসের ভিতর অনুভাষ নেই; যেমন সে সংগীত মানুষের মনের দুয়োর খুলতে পারে না, যে সংগীতের অন্তরে অনুরণন নেই।

    অনুপ্রাস সম্বন্ধে এত কথা বলোম এইজন্য যে, আজকের দিনে যে-সব বাংলা গান মনের ভিতর গুনগুন করছে তারা সবই অনুপ্রাসে প্রাণবন্ত। বাংলার পুরনো কবিদের দুটি পুরনো গান রবীন্দ্রনাথ আমাদের নতুন করে শুনিয়েছেন। বিদ্যাপতি কোম্‌ অতীত বর্ষার দিনে গেয়ে উঠেছিলেন–

    এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
    শূন্য মন্দির মোর।

    কিন্তু তার পরেই তিনি যা বলেছেন তার ভিতর কাব্যরস এক ফোঁটাও নেই–

    কুলিশ শত শত পাত মোদিত
    ময়ূর নাচত মাতিয়া

    এ হচ্ছে সংস্কৃত কবিদের বাঁধিগৎ। তাই ও কবিতা থেকে ঐ প্রথম দুটি পদ বাদ দিলে বিদ্যাপতির বাদবাকি কথা কাব্য হত না। বরং সত্য কথা বলতে গেলে ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’ এই কথা-ক’টিই সমগ্র কবিতাটিকে রূপ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। ভরা বাদর মাহ ভাদরের সর যার কানে বেজেছে, সেই মুহূর্তে সে অনুভব করেছে যে ‘শূন্য মন্দির মোর’। যে মুহূর্তে আমরা শুন্যতার রূপ প্রত্যক্ষ করি, সে মুহূর্তে যে ভাব আমাদের মনকে পেয়ে বসে তার নাম মুক্তির আনন্দ। কাব্যজ আনন্দকেও আলংকারিকরা মুক্তির আনন্দ বলেছেন। আলংকারিকদের এ কথা মিছে নয়।

    ১২

    অপর কবিতাটি এই–

    রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া-গরজন
    রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
    পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
    নিন্দ যাই মনের হরিষে॥

    এ কবিতা যাঁর কানে ও প্রাণে একসঙ্গে না বাজে তাঁর কাছে কবিতা সম্বন্ধে বো করে কোনো ফল নেই। আলংকারিকরা বলেন—

    তয়া কবিতয়া কিংবা তয়া বনিতয়া চ কিম্‌।
    পদবিন্যাস মাত্রেন বয়া নাপহৃতং মনঃ।।

    উক্ত কবিতা পদবিন্যাস মাত্র যাঁর মন হরণ করে, তিনিই যথার্থ কাব্যরসিক। আর যাঁদের করে না, ভগবান তাদের মঙ্গল করুন।

    উপরে যে দু-চারিটি নমুনা দিলম তার থেকেই দেখা যায় যে, বাঙালি কবির বর্ষবর্ণনা ছবিপ্রধান নয়, গানপ্রধান। বাঙালি কবিরা বর্ষার বাহ্যরূপের তেমন খুঁটিয়ে বর্ণনা করেন না যেমন প্রকাশ করেন বর্ষাগমে নিজেদের মনের রপান্তরের। শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার চাইতে শব্দ দিয়ে সংগীত রচনা করবার দিকেই বাঙালি কবির ঝোঁক বেশি। তাই তাঁদের কবিতায় উপমার চাইতে অনুপ্রাস প্রবল।

    সংস্কৃত কবির চোখ আর বাঙালি কবির কান এ দুইই তাদের পণ অভিব্যক্তি লাভ করেছে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে। সকলেই জানেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্ষার বিষয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ফলে ও-ঋতুর বিচিত্র রূপের প্রতি রূপের চিত্র তাঁর কাব্যে ছন্দোবধে আবদ্ধ হয়েছে। এ ঋতু সম্বন্ধে তাঁর কবিতাবলীকে একটি বিচিত্র পিকচার গ্যালারি বললে অসংগত কথা বলা হয় না। অপর পক্ষে বর্ষার সরে মনের ভিতর যে সুর বেজে ওঠে সেই অপার্থিব সুরের দিব্যরূপ পর্ণেমাত্রায় পরিস্ফুট হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ষার কবিতায়, সে কবিতার প্রথম পদ হচ্ছে–

    এমন দিনে তারে বলা যায়
    এমন ঘনঘোর বরিষায়।

    যে কবিতার ভাষা ও ভাব মিলে এক হয়ে যায় সেই কবিতাই যদি perfect কবিতা হয় তা হলে আমি জোর করে বলতে পারি এর তুল্য perfect কবিতা বাংলাতেও নেই, সংস্কৃতেও নেই। ও-কবিতা শুনে–

    সমাজসংসার মিছে সব
    মিছে এ জীবনের কলরব

    এ কথা যিনি ক্ষণিকের জন্যও হৃদয়ঙ্গম না করেন তাঁর এই বর্ষার দেশে জন্মগ্রহণ করাটা কর্মভোগ মাত্র।

    ভাদ্র ১৩৩৪

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.