Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প736 Mins Read0

    চুটকি

    সমালোচকেরা আমার রচনার এই একটি দোষ ধরেন যে, আমি কথায়-কথায় বলি ‘হচ্ছে। এটি যে একটি মহাদোষ সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই, কেননা ও কথা বলায় সত্যের অপলাপ করা হয়। সত্য কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলায় কিছু ‘হচ্ছে না’। এ দেশের কর্মজগতে যে কিছু হচ্ছে না, সে তো প্রত্যক্ষ; কিন্তু মনোজগতেও যে কিছু হচ্ছে না. তার প্রমাণ বর্ধমানের গত সাহিত্যসম্মিলন।

    উক্ত মহাসভার পঞ্চ সভাপতি সমস্বরে বলেছেন যে, বাংলায় কিছু হচ্ছে না—না দর্শন, না বিজ্ঞান, না সাহিত্য, না ইতিহাস।

    শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়ের প্রধান বক্তব্য এই যে, আমরা না পাই সত্যের সাক্ষাৎ, না করি সত্যাসত্যের বিচার। আমরা সত্যের স্রষ্টাও নই, দ্রষ্টাও নই; কাজেই আমাদের দর্শনচর্চা রিয়ালও নয়, ক্রিটিকালও নয়।

    অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, কি মূর্ত-বিজ্ঞান, কি অমূর্ত-বিজ্ঞান, এ দুয়ের কোনোটিই বাঙালি অদ্যাবধি আত্মসাৎ করতে পারে নি। অর্থাৎ বিজ্ঞানের যন্ত্রভাগও আমাদের হাতে পড়ে নি, তার তন্ত্রভাগও আমাদের মনে ধরে নি। আমরা শুধু বিজ্ঞানের স্থূল সূত্রগুলি কণ্ঠস্থ করেছি, এবং তার পরিভাষার নামতা মুখস্থ করেছি। যে বিদ্যা প্রয়োগপ্রধান, কেবলমাত্র তার মন্ত্রের শ্রবণে এবং উচ্চারণে বাঙালি জাতির মোক্ষলাভ হবে না। এক কথায়, আমাদের বিজ্ঞানচর্চা রিয়াল নয়।

    শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার মহাশয়ের মতে ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য সত্যের আবিষ্কার এবং উদ্ধার; এ সত্য নিত্য এবং গুপ্ত সত্য নয়, অনিত্য এবং লুপ্ত সত্য। অতএব এ সত্যের দর্শনলাভের জন্য বিজ্ঞানের সাহায্য আবশ্যক। অতীতের জ্ঞান লাভ করবার জন্য হীরেন্দ্রবাবুর বর্ণিত বোধির (intuition) প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আছে শুধু শিক্ষিত বুদ্ধির। অতীতের অন্ধকারের উপর বুদ্ধির আলো ফেলাই হচ্ছে ঐতিহাসিকের একমাত্র কর্তব্য, সে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া নয়। অথচ আমরা সে অন্ধকারে শুধু ঢিল নয়, পাথর ছুঁড়ছি। ফলে পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের ঐতিহাসিকদের দেহ পরস্পরের শিলাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছে। এক কথায়, আমাদের ইতিহাসচর্চা ক্রিটিকাল নয়।

    অতএব দেখা গেল যে, সম্মিলনের সকল শাখাপতি এ বিষয়ে একমত যে, কিছু হচ্ছে না। কিন্তু কি যে হচ্ছে, সে কথা বলেছেন স্বয়ং সভাপতি। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্যে যা হচ্ছে, তার নাম চুটকি। এ কথা লাখ কথার এক কথা। সকলেই জানেন যে, যখন আমরা ঠিক কথাটি ধরতে না পারি তখনই আমরা লাখ কথা বলি। এই চুটকি নামক বিশেষণটি খুঁজে না পাওয়ায় আমরা বঙ্গসরস্বতীর গায়ে ‘বিজাতীয়’ ‘অভিজাতীয়’ ‘অবাস্তব’ ‘অবান্তর’ প্রভৃতি নানা নামের ছাপ মেরেছি, অথচ তার প্রকৃত পরিচয় দিতে পারি নি।

    তার কারণ, এ-সকল ছোটো ছোটো বিশেষণের অর্থ কি, তার ব্যাখ্যা করতে বড়ো বড়ো প্রবন্ধ লিখতে হয়। কিন্তু চুটকি যে কি পদার্থ, তা যে আমরা সকলেই জানি, তার প্রমাণ হাতে- হাতেই দেওয়া যায়।

    শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র রায় মহাশয়ের অভিভাষণ যে চুটকি নয়, এ কথা স্বয়ং শাস্ত্রীমহাশয়ও স্বীকার করতে বাধ্য। কেননা এ কথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভাবে ও ভাষায় এর চাইতে ভারী অঙ্গের গদ্যবন্ধ জর্মানির বাইরে পাওয়া দুষ্কর।

    হীরেন্দ্রবাবুর অভিভাষণও চুটকি নয়। তবে শাস্ত্রীমহাশয় এ মতে সায় দেবেন কি না জানি নে। কেননা হীরেন্দ্রবাবুর প্রবন্ধ একে সংক্ষিপ্ত, তার উপর আবার সহজবোধ্য, অর্থাৎ সকল দেশের সকল যুগের সকল দার্শনিক তত্ত্ব যে পরিমাণে বোঝা যায়, হীরেন্দ্রবাবুর দার্শনিক তত্ত্বও ঠিক সেই পরিমাণে বোঝা যায়, তার কমও নয় বেশিও নয়। শাস্ত্রীমহাশয়ের মতে, যে কাব্য মহাকায় তাই হচ্ছে মহাকাব্য। গজমাপে যদি সাহিত্যের মর্যাদা নির্ণয় করতে হয়, তা হলে হীরেন্দ্রবাবুর রচনা অবশ্য চুটকি। কেননা, তার ওজন যতই হোক-না কেন, তার আকার ছোটো।

    অপরপক্ষে শাস্ত্রীমহাশয়ের অভিভাষণযুগল যে চুটকি-অঙ্গের, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

    শাস্ত্রীমহাশয়ের নিজের কথা এই,

    একখানা বই পড়িলাম, অমনি আমার মনের ভাব আমূল পরিবর্তন হইয়া গেল, যতদিন বাঁচিব ততদিন সেই বইয়ের কথাই মনে পড়িবে, এবং সেই আনন্দেই বিভোর হইয়া থাকিব।

    এরকম যাতে হয় না, তারই নাম চুটকি। এ কথা যদি সত্য হয়, তা হলে জিজ্ঞাসা করি, বাংলায় এরকম ক’জন পাঠক আছেন যাঁরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে, শাস্ত্রীমহাশয়ের প্রবন্ধ পড়ে তাঁদের ভিতরটা সব ওলটপালট হয়ে গেছে?

    শাস্ত্রীমহাশয় বাংলা সাহিত্যে চুটকির চেয়ে কিছু বড়ো জিনিস চান। বড়ো বইয়ের যদি ধর্মই এই হয় যে, তা পড়বামাত্র আমাদের মনের ভাবের আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে, তা হলে সেরকম বই যত কম লেখা হয় ততই ভালো। কারণ দিনে একবার করে যদি পাঠকের অন্তরাত্মার আমূল পরিবর্তন ঘটে, তা হলে বড়ো বই লেখবার লোক যেমন বাড়বে, পড়বার লোকও তেমনি কমে আসবে। তিনি চুটকির সম্বন্ধে যে দুটি ভালো কথা বলেন নি, তা নয়; কিন্তু সে অতি মুরুব্বিয়ানা করে। ইংরেজেরা বলেন, স্বল্পস্তুতির অর্থ অতিনিন্দা। সুতরাং আত্মরক্ষার্থ চুটকি সম্বন্ধে তাঁর মতামত আমাদের পক্ষে একটু যাচিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন,

    চুটকির একটি দোষ আছে, যখনকার তখনই, বেশি দিন থাকে না।

    এ কথা যে ঠিক নয় তা তাঁর উক্তি থেকেই প্রমাণ করা যায়। সংস্কৃত অভিধানে চুটকি শব্দ নেই, কিন্তু ও বস্তু যে সংস্কৃত সাহিত্যে আছে সে কথা শাস্ত্রীমহাশয়ই আমাদের বলে দিয়েছেন। তাঁর মতে-

    কালিদাস ও ভবভূতির পর চুটকি আরম্ভ হইয়াছিল, কেননা শতক দশক অষ্টক সপ্তশতী এই-সব তো চুটকি-সংগ্রহ ছাড়া কিছুই নয়।

    তথাস্তু। শাস্ত্রীমহাশয়ের বর্ণিত সংস্কৃত চুটকির দুটি-একটি নমুনার সাহায্যেই দেখানো যেতে পারে যে, আর্যযুগেও চুটকি কাব্যাচার্যদিগের নিকট অতি উপাদেয় ও মহার্হ বস্তু বলেই প্রতিপন্ন হত। ভর্তৃহরির শতক-তিনটি সকলের নিকটই সুপরিচিত, এবং গাথাসপ্তশতীও বাংলাদেশে একেবারে অপরিচিত নয়। ভর্তৃহরি ভবভূতির পূর্ববর্তী কবি, কেননা জনরব এই যে তিনি কালিদাসের ভ্রাতা, এবং ইতিহাসের অভাবে কিংবদন্তীই প্রামাণিক। সে যাই হোক, গাথাসপ্তশতী যে কালিদাসের জন্মের অন্তত দু-তিনশো বছর পূর্বে সংগৃহীত হয়েছিল, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। তা হলে দাঁড়াল এই যে, আগে আসে চুটকি তার পর আসে মহাকাব্য এবং মহানাটক। অভিব্যক্তির নৈসর্গিক নিয়মই এই যে, এ জগতে সব জিনিসই ছোটো থেকে ক্রমে বড়ো হয়। সাহিত্যও ঐ একই নিয়মের অধীন। তার পর পূর্বোক্ত শতকত্রয় এবং পূর্বোক্ত সপ্তশতী যখনকার তখনকারই নয়, চিরদিনকারই। এ মত আমার নয়, বাণভট্টের। গাথাসপ্তশতী শুধু চুটকি নয়, একেবারে প্রাকৃত-চুটকি, তথাপি শ্রীহর্ষচরিতকারের মতে—

    অবিনাশিনমগ্রাম্যমকরোৎসাতবাহনঃ।
    বিশুদ্ধজাতিভিঃ কোশং রতৈরিব সুভাষিতৈঃ।।

    তার পর ভর্তৃহরি যে এক-ন’র পান্না, এক-ন’র চুনি এবং এক-ন’র নীলা, এই তিন-ন’র রত্নমালা সরস্বতীর কণ্ঠে পরিয়ে গেছেন, তার প্রতি রত্নটি যে বিশুদ্ধজাতীয় এবং অবিনাশী, তার আর সন্দেহ নেই। যাবচ্চন্দ্রদিবাকর এই তিন শত বর্ণোজ্জ্বল শ্লোক সরস্বতীর মন্দির অহর্নিশি আলোকিত করে রাখবে।

    আসল কথা, চুটকি যদি হেয় হয়, তা হলে কাব্যের চুটকিত্ব তার আকারের উপর নয়, তার প্রকারের অথবা বিকারের উপর নির্ভর করে, নচেৎ সমগ্র সংস্কৃত কাব্যকে চুটকি বলতে হয়। কেননা সংস্কৃত ভাষায় চার ছত্রের বেশি কবিতা নেই, কাব্যেও নয় নাটকেও নয়। শুধু কাব্য কেন, হাতে-বহরে বেদও চুটকির অন্তর্ভূত হয়ে পড়ে। শাস্ত্রীমহাশয় বলেন যে, বাঙালি ব্রাহ্মণ বুদ্ধিমান বলে বেদাভ্যাস করেন না। কর্ণবেধের জন্য যতটুকু বেদ দরকার, ততটুকুই এ দেশে ব্রাহ্মণসন্তানের করায়ত্ত। অথচ বাঙালি বেদপাঠ না করেও এ কথা জানে যে, ঋক্ হচ্ছে ছোটো কবিতা এবং সাম গান। সুতরাং আমরা যখন ছোটো কবিতা ও গান রচনা করি, তখন আমরা ভারতবর্ষের কাব্যরচনার সনাতন রীতিই অনুসরণ করি 1

    শাস্ত্রীমহাশয় মুখে যাই বলুন, কাজে তিনি চুটকিরই পক্ষপাতী। তিনি আজীবন চুটকিতেই গলা সেধেছেন, চুটকিতেই হাত তৈরি করেছেন, সুতরাং কি লেখায়, কি বক্তৃতায় আমরা তাঁর এই অভ্যস্ত বিদ্যারই পরিচয় পাই। তিনি বাঙালির যে বিংশপর্ব মহাগৌরব রচনা করেছেন তা ঐতিহাসিক চুটকি বই আর কিছুই নয়, অন্তত সে রচনাকে শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার মহাশয় অন্য- কোনো নামে অভিহিত করবেন না।

    এ কথা নিশ্চিত যে, তিনি সরকারমহাশয়ের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন নি, সম্ভবত এই বিশ্বাসে যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসারে আবিষ্কৃত সত্য বাঙালির পক্ষে পুষ্টিকর হতে পারে, কিন্তু রুচিকর হবে না। সরকারমহাশয় বলেন যে, এ দেশের ইতিহাসের সত্য যতই অপ্রিয় হোক বাঙালিকে তা বলতেও হবে শুনতেও হবে। অপরপক্ষে শাস্ত্রীমহাশয়ের উদ্দেশ্য তাঁর রচনা লোকের মুখরোচক করা, এবং সেই উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য তিনি নানারকম সত্য ও কল্পনা একসঙ্গে মিলিয়ে ঐতিহাসিক সাড়ে-বত্রিশ ভাজার সৃষ্টি করেছেন। ফলে এ রচনায় যে মাল আছে, তাও মসলা থেকে পৃথক্ করে নেওয়া যায় না। শাস্ত্রীমহাশয়ের কথিত বাংলার পুরাবৃত্তের কোনো ভিত্তি আছে কি না বলা কঠিন। তবে এ ইতিহাসের যে গোড়াপত্তন করা হয় নি, সে বিষয়ে আর দ্বিমত নেই। ইতিহাসের ছবি আঁকতে হলে প্রথমে ভূগোলের জমি করতে হয়। কোনো একটি দেশের সীমার মধ্যে কালকে আবদ্ধ না করতে পারলে সে কালের পরিচয় দেওয়া যায় না। অসীম আকাশের জিয়োগ্রাফি নেই, অনন্ত কালেরও হিস্টরি নেই। কিন্তু শাস্ত্রীমহাশয় সেকালের বাঙালির পরিচয় দিতে গিয়ে সেকালের বাংলার পরিচয় দেন নি; ফলে গৌরবটা উত্তরাধিকারীস্বত্বে আমাদের কি অপরের প্রাপ্য, এ বিষয়েও সন্দেহ থেকে যায়। শাস্ত্রীমহাশয়ের শক্ত হাতে পড়ে দেখতে পাচ্ছি অঙ্গ ভয়ে বঙ্গের ভিতর সেঁধিয়েছে। কেননা যে ‘হস্ত্যায়ুর্বেদ’ আমাদের সর্বপ্রথম গৌরব, সে শাস্ত্র অঙ্গরাজ্যে রচিত হয়েছিল। বাংলার লম্বাচৌড়া অতীতের গুণবর্ণনা করতে হলে বাংলাদেশটাকেও একটু লম্বাচৌড়া করে নিতে হয়। সম্ভবত সেইজন্য শাস্ত্রীমহাশয় আমাদের পূর্বপুরুষদের হয়ে অঙ্গকেও বেদখল করে বসেছেন। তাই যদি হয়, তা হলে বরেন্দ্রভূমিকে ছেঁটে দেওয়া হল কেন? শুনতে পাই, বাংলার অসংখ্য প্রত্নরাশি বরেন্দ্রভূমি নিজের বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে। বাংলার পূর্বগৌরবের পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলার যে-ভূমি সবচেয়ে প্রত্নগর্ভা, সে প্রদেশের নাম পর্যন্ত উল্লেখ না করবার কারণ কি? যদি এই হয় যে, পূর্বে উত্তরবঙ্গের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এবং থাকলেও সে দেশ বঙ্গের বহির্ভূত ছিল, তা হলে সে কথাটাও বলে দেওয়া উচিত। নচেৎ বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি আমাদের মনে একটা ভুল ধারণা এমনি বদ্ধমূল করে দেবে যে, তার ‘আমূল পরিবর্তন’ কোনো চুটকি ইতিহাসের দ্বারা সাধিত হবে না।

    শাস্ত্রীমহাশয় যে তাম্রশাসনে শাসিত নন, তার প্রমাণ তিনি পাতায় পাতায় বলেন ‘আমি বলি’ ‘আমার মতে’ এই সত্য। এর থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শাস্ত্রীমহাশয়ের ইতিহাস বস্তুতন্ত্রতার ধার ধারে না, অর্থাৎ এক কথায় তা কাব্য; এবং যখন তা কাব্য তখন তা যে চুটকি হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি।

    শাস্ত্রীমহাশয়ের, দেখতে পাই আর-একটি এই অভ্যাস আছে যে, তিনি নামের সাদৃশ্য থেকে পৃথক্ পৃথক্ বস্তু এবং ব্যক্তির ঐক্য প্রমাণ করেন। একীকরণের এ পদ্ধতি অবশ্য বৈজ্ঞানিক নয়। কৃষ্ট এবং খৃস্ট, এ-দুটি নামের যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও ও-দুটি অবতারের প্রভেদ শুধু বর্ণগত নয়, বর্গগতও বটে। কিন্তু শাস্ত্রীমহাশয়ের অবলম্বিত পদ্ধতির এই একটি মহাগুণ যে, ঐ উপায়ে অনেক পূর্বগৌরব আমাদের হাতে আসে, যা বৈজ্ঞানিক হিসাবে ন্যায়ত অপরের প্রাপ্য। কিন্তু উক্ত উপায়ে অতীতকে হস্তান্তর করার ভিতর বিপদও আছে। এক দিকে যেমন গৌরব আসে, অপরদিকে তেমনি অগৌরবও আসতে পারে। অগৌরব শুধু যে আসতে পারে তাই নয়, বস্তুত এসেওছে।

    স্বয়ং শাস্ত্রীমহাশয় ঐতরেয় আরণ্যক হতে এই সত্য উদ্ধার করেছেন যে, প্রাচীন আর্যেরা বাঙালি জাতিকে পাখি বলে গালি দিতেন। সে বচনটি এই—

    বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা

    প্রথম-পরিচয়ে আর্যেরা যে বাঙালি জাতির সম্বন্ধে অনেক অকথা কুকথা বলেন, তার পরিচয় আমরা এ যুগেও পেয়েছি vide Macaulay। সুতরাং প্রাচীন আর্যেরাও যে প্রথম-পরিচয়ে বাঙালিদের প্রতি নানারূপ কটুকাটব্য প্রয়োগ করেছিলেন, এ কথা সহজেই বিশ্বাস হয়। তবে এ ক্ষেত্রে এই সন্দেহ উপস্থিত হয় যে, যদি গালি দেওয়াই তাঁদের অভিপ্রায় ছিল, তা হলে আর্যেরা আমাদের পাখি বললেন কেন। পাখি বলে গাল দেবার প্রথা তো কোনো সভ্যসমাজে প্রচলিত দেখা যায় না। বরং বুলবুল ময়না প্রভৃতি এ দেশে আদরের ডাক বলেই গণ্য, এবং ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হলে আমরা তাকে ঘুঘু উপাধি দানে সম্মানিত করি। অপমান করবার উদ্দেশ্যে মানুষকে যে-সব প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে তারা প্রায়শই ভূচর এবং চতুষ্পদ, দ্বিপদ এবং খেচর নয়। পাখি বলে নিন্দা করবার একটিমাত্র শাস্ত্রীয় উদাহরণ আমার জানা আছে। বাণভট্ট তাঁর সমসাময়িক কুকবিদের কোকিল বলে ভর্ৎসনা করেছেন; কেননা তারা বাচাল, কামকারী, এবং তাদের ‘দৃষ্টি রাগাধিষ্ঠিত’ অর্থাৎ তাদের চক্ষু রক্তবর্ণ। গাল হিসেবে এ যে যথেষ্ট হল না সে কথা বাণভট্টও বুঝেছিলেন, কেননা পরবর্তী শ্লোকেই তিনি বলেছেন যে, কুকুরের মতো কবি ঘরে ঘরে অসংখ্য মেলে, কিন্তু শরভের মতো কবি মেলাই দুর্ঘট। এ স্থলে কবিকে প্রশংসাচ্ছলে কেন শরভ বলা হল, এ কথা যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন তার উত্তর শরভ জানোয়ার হলেও চতুষ্পদ নয়, অষ্টপদ; এবং তার অতিরিক্ত চারখানি পা ভূচর নয়, খেচর।

    এই-সব কারণে কেবলমাত্র শব্দের সাদৃশ্য থেকে এ অনুমান করা সংগত হবে না যে, আর্য ঋষিরা অপর এত কড়া কড়া গাল থাকতে আমাদের পূর্বপুরুষদের কেবলমাত্র পাখি বলে গাল দিয়েছেন। শাস্ত্রীমহাশয়ের মতে আমাদের সঙ্গে মাগধ এবং চের জাতিও এ গালির ভাগ পেয়েছে। কেননা, তাঁর মতে, বঙ্গা হচ্ছে বাঙালি, বগধা হচ্ছে মগধা এবং চেরপাদা হচ্ছে চের নামক অসভ্য জাতি। ‘চেরপাদা’ যে কি করে ‘চের’তে দাঁড়াল, তা বোঝা কঠিন। বাক্যের পদচ্ছেদের অর্থ পা কেটে ফেলা নয়। অথচ শাস্ত্রীমহাশয় ‘চেরপাদা’র পা-দুখানি কেটে ফেলেই ‘চের’ খাড়া করেছেন। ‘বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’–এই যুক্তপদের, শুনতে পাই, সেকেলে পণ্ডিতেরা এইরূপ পদচ্ছেদ করেন—বঙ্গা+অবগধা+চ+ইরপাদা।

    ইরপাদা অর্থে সাপ। তা হলে দাঁড়াল এই যে, বাঙালি ও বেহারিকে প্রথমে পাখি এবং পরে সাপ বলা হয়েছে। উক্ত বৈদিক নিন্দার ভাগ আমি বেহারিদের দিতে পারি নে। অবগধা মানে যে মাগধ, এর কোনো প্রমাণ নেই। অতএব শাস্ত্রীমহাশয় যেমন ‘চেরপাদা’র শেষ দুই বর্ণ ছেঁটে দিয়ে ‘চের’ লাভ করেছেন আমিও তেমনি ‘অবগধা’ শব্দের প্রথম দুটি বর্ণ বাদ দিয়ে পাই ‘গধা’। এইরূপ বর্ণবিচ্ছেদের ফলে উক্ত বচনের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আর্য ঋষিদের মতে বাঙালি আদিতে পক্ষী, অন্তে সর্প, এবং ইতিমধ্যে গর্দভ।

    ‘অবগধা’কে ‘গধা’য় রূপান্তরিত করা সম্বন্ধে কেউ কেউ এই আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন যে, সেকালে যে গাধা ছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। শাস্ত্রীমহাশয় বাঙালির প্রথম গৌরবের কারণ দেখিয়েছেন যে, পুরাকালে বাংলায় হাতি ছিল, কিন্তু বাঙালির দ্বিতীয় গৌরবের এ কারণ দেখান নি যে, সেকালে এ দেশে গাধাও ছিল। কিন্তু গাধা যে ছিল, এ অনুমান করা অসংগত হবে না। কেননা যদি সেকালে গাধা না থাকত তো একালে এ দেশে এত গাধা এল কোথা থেকে? ঘোড়া

    যে বিদেশ থেকে এসেছে তার পরিচয় ঘোড়ার নামেই পাওয়া যায়, যথা, পগেয়া ভুটিয়া তাজি আরবি ইত্যাদি। কিন্তু গর্দভদের এরূপ কোনো নামরূপের প্রভেদ দেখা যায় না। এবং ও-জাতি যে যে-কোনো অর্বাচীন যুগে বঙ্গদেশে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তারও কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, রাসভকুল অপর সকল দেশের ন্যায় এ দেশে এখনো আছে, পূর্বেও ছিল। তবে একমাত্র নামের সাদৃশ্য থেকে এরূপ অনুমান করা অসংগত হবে যে আর্য ঋষিরা পুরাকালের বাঙালিদের এরূপ তিরস্কারে পুরস্কৃত করেছেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘বঙ্গ’ শব্দের অর্থ বৃক্ষ। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আরণ্যক-শাস্ত্রে বৃক্ষ পক্ষী সর্প প্রভৃতি আরণ্য জীবজন্তুরই উল্লেখ করা হয়েছে, বাঙালির নামও করা হয় নি। অতএব আমাদের অতীত অতি-গৌরবেরও বস্তু নয়, অতি-অগৌরবেরও বস্তু নয়।

    আর-একটি কথা। হীরেন্দ্রবাবু, দর্শন শব্দের এবং যোগেশবাবু বিজ্ঞান শব্দের নিরুক্তের আলোচনা করেছেন, কিন্তু যদুবাবু ইতিহাসের নিরুক্ত সম্বন্ধে নীরব। ইতিহাস শব্দ সম্ভবত হস্ ধাতু হতে উৎপন্ন, অন্তত শাস্ত্রীমহাশয়ের ইতিহাস যে হাস্যরসের উদ্রেক করে, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। এমন-কি, আমার সময়ে সময়ে মনে হয় যে শাস্ত্রীমহাশয় পুরাতত্ত্বের ছলে আত্মশ্লাঘাপরায়ণ বাঙালি জাতির সঙ্গে একটি মস্ত রসিকতা করেছেন।

    জ্যৈষ্ঠ ১৩২২

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.