প্রেত-প্রেয়সী – ১.১
(১)
‘দুর্লভ, আমার স্ত্রীকে কিছুদিন চোখে চোখে রাখতে পারবে?’ হঠাৎ গম্ভীর গলায় শুধোলে মহেন্দ্র।
‘কেন বলো তো, পাখা গজিয়েছে নাকি?’ চোখ নাচিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম আমি।
‘বুঝলাম না।’
‘মানে, এদিক ওদিক ওড়বার সখ হয়েছে বুঝি?’
‘যা ভাবছ, তা নয়।’
‘তবে কী?’
‘বুঝিয়ে বলা শক্ত… কীরকম যেন হয়ে গেছে কস্তুরী।’
‘কী মুশকিল, কীরকম হয়েছে, তা তো বলবে?’
তবুও দ্বিধা করতে লাগল মহেন্দ্র। চোখ দেখে অনুমান করলাম, পাছে ঠাট্টা করি, এই ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করছে না বন্ধুবর।
অথচ পনেরো বছর আগেকার কলেজ সহপাঠী মহেন্দ্রের সঙ্গে আজকের মহেন্দ্রের বিশেষ কোনও তফাৎ নেই। ওপরে ওপরে খুব মিশুকে হলেও ভেতরটা ছিল একেবারে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। আত্মকেন্দ্রিক আর লাজুক। একমাত্র আমিই চিনেছিলাম ওকে। সেই কারণেই দীর্ঘ পনেরো বছর পরে আমাকে পেয়ে ওর উল্লাস দেখে মোটেই অবাক হইনি।
এইভাবেই চিরকাল উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে মহেন্দ্র। কিন্তু কোথায় যেন একটা খোঁচা থেকে গেছে ওর আজকের উচ্ছ্বাসে।
অন্তত, আমার তো তা-ই মনে হল। মনে হল, যেন বেশ কয়েকবার মহড়া দেওয়ার পর স্টেজে নেমেছে মহেন্দ্র। ক্লাইমাক্সে পৌঁছে যেন একটু অতি-অভিনয় করে ফেলেছে। তাই ছটফট করছে, আঙুল মটকাচ্ছে অস্থির হাতে, হাসছে অস্বাভাবিক জোরে। কিছুতেই যেন সহজ হয়ে উঠতে পারছে না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছে মাঝের পনেরোটা বছর— কিন্তু পারছে কই?
কালের ছোঁয়া লেগেছে মহেন্দ্রের চেহারায়। মাথাজোড়া টাকের মরুভূমিতে লজ্জায় মুষড়ে পড়তে চাইছে কয়েকগাছি চুল। মাংসল ভারী থুতনিতে সে ধার আর নেই। ধোঁয়াটে ভুরু। নাকের পাশে অনেক অভিজ্ঞতার ক্ষীণ রেখা।
আর আমি? শুধু রোগাই হইনি। সেই বিপদটার পর থেকে একটু ঝুঁকে চলাটাও অভ্যাসে এসে গেছে। অস্বস্তি লাগছিল আরও একটা কথা মনে পড়ায়। আইন পড়েছিলাম স্রেফ পুলিশি কাজের জন্যে। অথচ কেন যে স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিশ শুরু করেছি, এই প্রশ্নই যদি ফস করে জিজ্ঞেস করে বসে মহেন্দ্র, তাহলেই গেছি।
আমার কথার তক্ষুনি কোনও জবাব না দিয়ে সুদৃশ্য সিগার কেসটা এগিয়ে ধরলে মহেন্দ্র। বৈভবের ছাপ শুধু সিগার কেসে নয়, রয়েছে ওর মূল্যবান সুট আর আঙুলের একাধিক আংটির মধ্যেও।
গাল তুবড়ে আস্তে আস্তে মেজাজি ধোঁয়া ছেড়ে বললে, ‘মুশকিল কিছু নয়, তবে এ হচ্ছে অ্যাটমস্ফিয়ারের প্রশ্ন।’
নাঃ, অনেক পালটে গেছে মহেন্দ্র। ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যে মোড়া এ-চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই মনে হয়— এ সেই মানুষ, বোর্ড অব ডাইরেক্টরস মিটিং-এ যাকে প্রধান আসন অলংকৃত করতে হয়, উঁচু মহলের রাঘব-বোয়ালের সঙ্গে যার দহরম মহরম অনেকের ঈর্ষার বস্তু, যার কৃপার ওপর নির্ভর করছে বহুশত পরিবারের অন্ন।
কিন্তু তবুও, আজ তার দৃষ্টি অস্থির, হাত চঞ্চল।
কণ্ঠে একবিন্দু শ্লেষ ঢেলে শুধোলাম, ‘অ্যাটমস্ফিয়ার?’
‘হ্যাঁ, অ্যাটমস্ফিয়ার। আপাতত এব চাইতে লাগসই শব্দ মাথায় আসছে না। না, না, সত্যিই আমার ওয়াইফ খুব সুখী। চার বছর হল বিয়ে হয়েছে আমাদের, সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে গেলে যা-যা থাকা দরকার, তার কোনওটারই অভাব নেই। নিমতা গ্রামের নাম শুনেছ?’
‘না তো।’
‘বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের নাম তো শুনেছ?’
‘তা শুনেছি।’
‘তারই মহিমা নিয়ে “বাঘ মঙ্গল” কাব্য লিখে যিনি যশস্বী হয়েছেন, নিমতা গ্রাম সেই কবিকৃষ্ণ দাসের জন্মস্থান। কিন্তু আজকের দিনে নিমতার নামডাক আমার ফ্যাক্টরির জন্যে। সুতরাং, আমার অভাবটা কোথায় বল?’
‘ছেলেপুলে?’
‘নেই। সে জন্যে কোনও দুঃখও নেই। শুধু এইটুকু বাদ দিলে মেয়েরা যা পেলে সুখী হয়, তার সবই পেয়েছে কস্তুরী। তা সত্ত্বেও বেশ বুঝছি কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে।’
‘খুব গোমড়া স্বভাবের মেয়ে বুঝি?’
‘মোটেই না। কখনও খুশিতে ডগমগ, আবার পরের মুহূর্তেই হয়তো মুখ কালো করে বসে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক কথায় মেজাজি। গত ক-মাসে আরও যাচ্ছেতাই হয়ে উঠেছে এই মেজাজ।’
‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’
‘একবার নয়, অনেকবার। কিন্তু সবাই এক রায়।’
‘কী?’
‘কিছুই হয়নি কস্তুরীর।’
‘কিছু না হওয়াটা শুধু দেহের, না মনের?’
‘দুয়েরই। বেয়াড়া কোনও লক্ষণ ধরা পড়েনি। অন্তত…’
বলতে বলতে অস্থির হাতে মটমট করে আঙুল মটকাল মহেন্দ্র। অকারণে কোটের ওপর থেকে চুরুটের ছাই ঝাড়ল কিছুক্ষণ।
তারপর বলল, ‘ডাক্তার যা-ই বলুক না কেন, আমি জানি কিছু একটা হয়েছে ওর। প্রথম প্রথম আমিও ভেবেছিলাম, শৈশবের কোনও বিভীষিকা থেকে এখনও হয়তো মুক্ত হতে পারেনি ওর নরম মন— তাই কোনও ভয় মৌরসী পাট্টা গেঁড়েছে নির্জ্ঞান মনে। লক্ষ করেছি, কথা বলতে বলতে আচমকা বোবা হয়ে গেছে কস্তুরী। এমনভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, যেন নিজের মধ্যে আর নিজে নেই। সত্যিই অদ্ভুত। একনাগাড়ে বকবক করেছি কানের পাশে, একবর্ণও শোনেনি। কখনও কখনও সাধারণ এক-একটা জিনিসের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় বড় চোখ মেলে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন বিশ্বদর্শন করছে। একটা কথা বলি, হেসো না। এক-একবার মনে হয়েছে, এমন কিছু ও দেখতে পাচ্ছে, যা আমার চোখে অদৃশ্য। অনেকক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে হতভম্ব চোখে তাকায় আশপাশে… যেন স্বামী, সংসারকে চিনি-চিনি করেও চিনতে পারছে না…’
সিগারটা নিভে গেছিল। ফস করে কাঠি জ্বালিয়ে আবার একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল মহেন্দ্র। নীল-নীল ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল আমার পানে। এ দৃষ্টি আমি চিনি। শক্ত অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাতে বসে ঠিক এমনিভাবেই সামনের বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকত মহেন্দ্র।
বললাম, ‘শরীর আর মন, দুই যদি সুস্থ থাকে, তাহলে, কিছু মনে কোরো না মহেন্দ্র, যা শুনলাম তা ন্যাকামো ছাড়া আর কিছু নয়। মেয়েদের ছলাকলার তো অভাব নেই, নিশ্চয় কোনও মতলব—’
সিগার সমেত হাত তুলে মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিলে মহেন্দ্র।
বললে, ‘তা-ও ভেবেছি আমি। বেশ কিছুদিন চোখে চোখেও রেখেছিলাম। একদিন ও মোটর হাঁকিয়ে গেল কলকাতার বাইরে… ঘোষপাড়ায়…’
‘ঘোষপাড়া আবার কোথায়?’
‘কাঁচড়াপাড়া থেকে মাইল পাঁচেক দূরে।’
‘তারপর?’
‘ঘোষপাড়ায় হিমসাগর নামে একটা দিঘি আছে। দিঘির পাড়ে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে জলের দিকে তাকিয়ে অবিকল পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল কস্তুরী।’
‘দিঘির পাড়ে বসে থাকাটা কি অন্যায়?’
‘অন্যায় নয়, তবে স্বাভাবিকও নয়। বলে বোঝাতে পারব না দুর্লভ। দিঘির পাড়ে আঘাটায় বসতে না বসতেই যেন পলকের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে গেছিল ও। ভোলবার নয় সেই অসাধারণ গাম্ভীর্য আর তন্ময়তা… হঠাৎ যেন ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গুরুত্ব ভেসে উঠেছিল পদ্মপাতায় ঢাকা দিঘির জলে… ঘাটে মেয়েরা এসেছে, জল নিয়েছে, গা ধুয়েছে, কাপড় কেচেছে, কিন্তু ধ্যান ভাঙেনি কস্তুরীর। ওর তন্ময় দৃষ্টিতে এমন কিছু ধরা পড়েছে যা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে।’
‘রাবিশ!’
‘আমিও ভেবেছিলাম রাবিশ। কিন্তু প্রবাদটা তো ভাই ভুলতে পারছি না।’
‘প্রবাদ? এর মধ্যে আবার প্রবাদ এল কোত্থেকে!’
একতাল নীলচে ধোঁয়া ছাড়ল মহেন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলে না। কিলবিলে ধোঁয়ার জটের মধ্যে মুখটাও গলে গলে মিশে যাওয়ার উপক্রম হল।
‘কী হল? চুপচাপ কেন?’ শুধোই আমি।
‘বিশ্বাস করবে না, তাই বলতে ভরসা পাচ্ছি না।’
‘করব, করব, করব। শোনাও তোমার প্ৰবাদ-কাহিনি।’
থেমে থেমে বলল, ‘প্রবাদ, লোকে বলে হিমসাগরের জলে এক আশ্চর্য শক্তি আছে। এ জল চোখে দিয়ে একবার একজন অন্ধ দৃষ্টিলাভ করেছিল।’
‘তাতে তোমার কী?’
‘কস্তুরীও কি… মানে, তৃতীয় নয়ন বলে একটা কথা আছে তো…’
‘বুঝি না, কী করে এসব উদ্ভট কল্পনা তোমার মতো শিক্ষিত লোকের মাথায় আসে।’ বিরক্তি আর চাপতে পারি না আমি, ‘ওসব বাজে কথা ছেড়ে বল দিকি তারপর কী হল?
‘সেইদিন রাতেই কস্তুরীকে জিজ্ঞেস করলাম হিমসাগর দিঘিতে কেন গেছিল সে। জবাব শুনে বুঝলাম অবস্থা আরও গোলমেলে। সেদিন নাকি বাড়ির বাইরেই বেরোয়নি কস্তুরী। মুখ দেখে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না যে কথাটা মিথ্যে।’
নাঃ, সেই মহেন্দ্রই বটে। মনের পর্দায় কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে যেতে গিয়েও আবার স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল পুরোনো বন্ধুর ছবি। গল্পটাও জমেছে বেশ।
মুখে বললাম, ‘আমার মনে হয়, সৃষ্টির শুরু থেকে যে খেলা খেলে এসেছে কুহকিনী মেয়েরা, তোমার স্ত্রীও তার স্বাদ পেয়েছে। অর্থাৎ, রঙ্গমঞ্চে আরও একজন পুরুষ রয়েছে।’
তর্জনির টোকা দিয়ে লম্বা চোঙার মতো সাদা ছাইটাকে ছাইদানির গহ্বরে নিক্ষেপ করে ম্লান হেসে বলল মহেন্দ্র, ‘আমি যা-যা ভেবেছিলাম, তুমি তার কোনওটিই বাদ দিচ্ছ না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, কস্তুরীর পক্ষে এরকম নোংরা কাজ সম্ভব। তা ছাড়া, স্রেফ মজা করার জন্যে নিশ্চয় কেউ কলকাতার বাইরে গিয়ে সেকেলে দিঘির পাড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের দিকে তাকিয়ে থাকে না।’
‘স্ত্রীর সঙ্গে এ সম্পর্কে কোনও কথা হয়নি?’
‘হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, হঠাৎ স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যাওয়ার সময়ে ঠিক কী ধরনের অনুভূতি মনে আসে।’
‘কী বললেন উনি?’
‘এ নিয়ে নাকি মিছিমিছি মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই। স্বপ্ন নয়— মাঝে মাঝে এটা-সেটা ভাবে।’
‘তোমার ধারণা কী?’
‘অনেকদিন আগে কলেজ পালিয়ে একটা ইটালিয়ান ছবি দেখেছিলাম, মনে আছে তোমার?’
‘কী ছবি বলো তো?’
‘নামটা মনে নেই। প্রেততত্ত্ব নিয়ে তোলা ছবি। মিডিয়াম মেয়েটির ওপর প্রেতাত্মার ভর হয়েই গবগব করে অনেক কথা বলত। কিন্তু পরে আর কিছুই মনে থাকত না। কস্তুরীর মুখ দেখে সেই ইটালিয়ান অ্যাকট্রেসের মুখটি মনে পড়ে গেছিল আমার। অবিকল সেই রকম ভাব ফুটে উঠতে দেখেছি কস্তুরীর মুখেও। ফ্যালফেলে চাউনি— অনেকটা নেশায় বুঁদ মাতালের মতো।’
‘আমার তো মনে হচ্ছে, নেশাটা তুমিই করেছ। এবার কি ভূতে পাওয়ার গল্প শুরু হবে?’
‘জানতাম, এই কথাই বলবে তুমি। মনের সঙ্গে আমিও কম লড়িনি। কিন্তু—’
‘পুজো-আচার অভ্যেস আছে তোমার স্ত্রীর?’
‘আছে, তবে তেমন বাড়াবাড়ি কিছু নয়।’
‘হাত দেখানোর বাতিক?’
‘কস্মিকালেও নেই। দুর্লভ, যা ভাবছ, তা নয়। অতীন্দ্রিয় অতি-অনুভূতি নিয়ে পিটার হারকোস জমজমাট আত্মজীবনী লিখতে পারেন— কিন্তু এ ব্যাপার সেরকম কিছু নয়। মাঝে মাঝে কী যে হয়, হঠাৎ যেন পটটাই পালটে যায় চোখের সামনে।’
‘পরিবর্তনটা ইচ্ছায়, কি অনিচ্ছায় তা—’
‘লক্ষ করেছি। ইচ্ছার কোনও হাতই নেই বেচারির। অনেকদিন ধরে এ জিনিস দেখেছি বলেই এতটা জোরের সঙ্গে বলতে পারছি। স্বপ্নের ঘোরটা যখন আসতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে কস্তুরী তা টের পায়… দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে… অন্য কোনও কাজ বা কথা নিয়ে মনটা ভরিয়ে রাখতে চায়… কখনও কখনও জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, জানলা খুলে দিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়… ঠিক সেই সময়টিতে যদি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াই, তাহলেই যেন হাতে স্বর্গ পায় বেচারি। বুঝতে পারি, ঝোঁকটা কাটিয়ে উঠতে চাইছে ও। শেষ পর্যন্ত পারেও। কিন্তু যদি ইচ্ছে করে ওর দিকে মন না দিই, তাহলে আর সামলাতে পারে না নিজেকে।’
‘তারপর।’
‘বেসামাল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ-মুখের চেহারাও পালটে যায়। সমস্ত শরীর শক্ত করে একদৃষ্টে এমন কিছু দেখতে থাকে, যা স্থির নয়, যা ক্রমাগত সরে সরে যাচ্ছে একদিক থেকে আর একদিকে… সেই সঙ্গে ওর চোখেও ঘুরতে থাকে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুক-ভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেয়। তারপর পাঁচ মিনিট থেকে দশ মিনিট পর্যন্ত যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে চলাফেরা করে।’
‘অর্থাৎ ঘুমিয়ে হাঁটা?’
‘ঘুমের ঘোরে হাঁটতে আমি কাউকে দেখিনি… কাজেই… তবে কস্তুরীকে দেখে মনে হয় না যে ঘুমিয়ে আছে। মনে হয় যেন কস্তুরীর মধ্যে আর কস্তুরী নেই… আর কেউ এসে ওর হাত-পা নাড়াচ্ছে, ওরই চোখ দিয়ে দেখছে। ভাবলেও হাসি পায়… কিন্তু… ঠিক… সেই মুহূর্তে কস্তুরী যেন আর একজন হয়ে যায়… আর একজন মানুষ… কস্তুরী নয়!’
সত্যি সত্যি উৎকণ্ঠার মেঘ ঘনিয়ে ওঠে মহেন্দ্রের চোখে।
একটু ধমকের সুরেই এবার বলি, ‘আর একজন মানুষ! লোকে বুজরুক ঠাউরাবে যে!’
‘জানতাম। তুমি যে বিশ্বাস করবে না, তা জানতাম। কিন্তু এমন অনেক জিনিস, মানে, কতকগুলো অলৌকিক প্রভাব আছে যা…’
কথাটা শেষ করতে পারল না মহেন্দ্র। ছাইদানির কিনারায় সিগারটা নামিয়ে রেখে অস্থিরভাবে এমন জোরে আঙুল দিয়ে আঙুল জড়িয়ে ধরলে যে গাঁটগুলোসুদ্ধ রক্তশূন্য হয়ে গেল।
বলি-বলি করেও এতক্ষণ যা মুখে মানতে পারছিল না মহেন্দ্র, এবার আর তা বাধা মানল না, ‘দুর্লভ, শুরু যখন করেছি, তখন সব খুলেই বলি। কস্তুরীর পূর্বপুরুষদের মধ্যে উমা দেবী নামে একজন রহস্যময়ী মহিলা ছিলেন। তেরো-চোদ্দো বছর বয়স থেকেই ইনি শূন্যের সঙ্গে কথা বলতেন, গরগর করে অতীত-ভবিষ্যৎ বলে যেতেন, এমনকী শুধু হাত বুলিয়ে নাকি অনেকের পুরোনো ব্যারামও সারিয়ে দিতেন।’
‘কোন সালের কথা বলছ?’
‘ষোড়শ শতাব্দীর। সালটা মনে নেই। উমা দেবীর এই আশ্চর্য ক্ষমতার কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সাধু-সন্ন্যাসীও আসতেন তাঁর কাছে। মেয়ের মতিগতি দেখে বাড়ির লোকেরা তো মহাচিন্তায় পড়লেন। শেষকালে উমা দেবীও সন্ন্যাসিনী না হয়ে যান। উনি নিজেও সে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন— তার কারণও ছিল। ত্রিকালদ্রষ্টা হিসেবে ওঁর অদ্ভুত ক্ষমতার গল্প ডালপালা মেলে ছড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে দেবীর মতো শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন উনি। এদিকে বিয়ের বাজারে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলেন অভিভাবকেরা। শেষ পর্যন্ত সবাই হাল ছেড়ে দেওয়ার পর অপ্রত্যাশিতভাবে উমা দেবীকে জীবন-সঙ্গিনী রূপে গ্রহণ করলেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের এক গৃহী-সন্ন্যাসী। বিয়ের পর একটা বাচ্চাও হয়েছিল। তারপরেই কী এক অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেন উমা দেবী।’
এসব কাহিনি আমার ভালোই লাগে। মহেন্দ্র থামতেই শুধোলাম, ‘কর্তাভজা সম্প্রদায়টা আবার কী হে?’
‘আউলচাঁদ নামে এক সাধু এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। শ্রীচৈতন্যদেব পুরীধামে অন্তর্ধান করার বহুকাল পরে নাকি আবার আউলচাঁদ রূপে আত্মপ্রকাশ করে, ‘গুরু সত্য’, এই মহামন্ত্র প্রচার করেন। এ সম্বন্ধে ভারী ইন্টারেস্টিং একটা কিংবদন্তি আছে। তোমার ধৈর্য থাকলে শোনাতে পারি।’
নড়ে চড়ে বসে বললাম, ‘শোনাও।’
‘কস্তুরীর এই সব উপসর্গ দেখা-যাওয়ার পর থেকেই এ সম্বন্ধে আমি অনেক খোঁজখবর নিয়ে এত কথা জেনেছি। জনশ্রুতি যে, উলা অর্থাৎ বীরনগর নিবাসী মহাদেব নামে জনৈক বারুজীবী ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ফাল্গুন মাসের প্রথম শুক্রবার তাঁর পানের বরজের মধ্যে এক অজ্ঞাতকুলশীল সুদর্শন বালককে দেখতে পান। মহাদেব তাকে ঘরে এনে ছেলের মতোই মানুষ করেন— নাম রাখেন পূর্ণচন্দ্র। মহাদেবের যত্নে পূর্ণচন্দ্ৰ হরিহর নামে জনৈক বৈষ্ণবের কাছে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা আর ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিশ বছর বয়েসে শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ায় গিয়ে বলরাম দাসের কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। তখন থেকেই তার নাম হয় আউলচাঁদ। কর্তাভজাদেরকে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটা শাখা বলতে পারো। নিজের ধর্মকে এঁরা সত্যধর্ম বা সহজ ধর্ম বলে থাকেন। এঁদের মতে কর্তা বা ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা। আর, গুরুই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। গুরুদেরকে বলা হয় ‘মহাশয়’, শিষ্যদের ‘বরাতি’। সম্প্রদানের সাধন বিষয়ে কতকগুলো গুঢ়-রহস্য আছে, যা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।
‘লোকে বলে, আউলচাঁদের বাইশ জন শিষ্য ছিল। তাদের মধ্যে রামশরণ পাল আউলচাঁদের মৃত্যুর পর গুরুর পদ পান। এখনও তাঁর বংশধরেরাই ঘোষপাড়ায় থেকে এই সম্প্রদায় পরিচালনা করেন। রামশরণের স্ত্রী খুব ধর্মপরায়ণা ছিলেন। শিষ্যরা তাঁকে ‘সতীমা’ বলে ডাকত। একবার নাকি কঠিন অসুখে মারা গিয়েছিলেন তিনি। তখন আউলচাঁদ কাছের একটা পুকুর থেকে খানিকটা মাটি নিয়ে তাঁর গায়ে মাখিয়ে দিতেই তিনি বেঁচে উঠেছিলেন।’
তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। মহেন্দ্র থামতেই শুধোলাম, ‘রিয়ালি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু এর সঙ্গে উমা দেবীর কী সম্পর্ক? আর, উমা দেবীর সঙ্গেই বা তোমার স্ত্রীর সন্দেহজনক গতিবিধির কী সম্বন্ধ?’
‘সম্পর্ক আছে ভাই, না থাকলে কি এত কথা বলি তোমাকে? ঘোষপাড়া ডালিম তলায় ‘সতীমা’-র সমাধিস্থান আজও একটা দেখবার মতো জায়গা। রামশরণেরই এক শিষ্যকে বিয়ে করেছিলেন উমা দেবী। আত্মহত্যার পর তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে এই ঘোষপাড়ায় হিমসাগর দিঘির পাড়ে— যে দিঘির মাটি মাখিয়ে ‘সতীমা’-কে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন আউলচাঁদ।’
বন্দুকের বুলেটের মতোই শেষের কথাগুলো গেঁথে গেল মনের মধ্যে। কোনও কথাই বলতে পারলাম না আমি।
ফিসফিস করে মহেন্দ্র বললে, ‘দুর্লভ, পঁচিশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন উমা দেবী। একটু থেমে, ‘কস্তুরীর বয়স এখন পঁচিশ বছর!’
হঠাৎ ঘরের ঘড়িটাও বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে যায়। থমথমে হয়ে ওঠে ঘরের বাতাস। দু-জনেই নিশ্চুপ। মনে মনে সমস্ত কাহিনিটা সাজিয়ে নিয়ে শুধোলাম, ‘তোমায় স্ত্রী নিশ্চয় জানেন… মানে, উমা দেবীর কাহিনি নিশ্চয় তাঁর অজানা নয়?’
‘না, ও জানে না। এ ইতিহাস আমি শুনি শাশুড়ির মুখে। বিয়ের পরেই উনি বলেছিলেন। তখন অবশ্য কোনও গুরুত্ব দিইনি এসব কথায়… না শুনলে মনে কষ্ট পাবেন, তাই মন দিয়ে সবই শুনেছিলাম। শাশুড়ি মারা গেছেন অনেকদিন।’
‘একটা প্রশ্ন। শাশুড়ির অন্য কোনও মতলব ছিল কি না জানো?’
‘কথায় কথায় হঠাৎ এ প্রসঙ্গ উঠেছিল। তবে উনি বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন আমায়— এ ইতিহাস আমি যেন কোনওদিন কস্তুরীকে না শোনাই। মেয়েকে তিনি চিনেছিলেন। হাড়ে হাড়ে— মনের সুস্থতা সম্বন্ধেও বোধহয় সন্দেহ একটু ছিল।’
‘কিন্তু যাঁর এত হাঁড়ির খবর রাখা হয়েছে, তাঁর আত্মহত্যার কারণ অজানা রইল, এটা কেমনতরো কথা।’
‘কারণ নাকি কেউ খুঁজে পায়নি। বাইরে থেকে যতদূর মনে হয়, খুবই সুখে ছিলেন তিনি। ছেলের মা হয়েছিলেন মাত্র মাস কয়েক আগে। তারপরেই আচমকা একদিন…’
‘সবাই বুঝলাম। কিন্তু তোমার স্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারের সম্পর্কটা যে কোথায়, তা তো মাথায় আসছে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহেন্দ্র। বলল, ‘সম্পর্কটা এখুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি। মায়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে বহু অলঙ্কার পেয়েছিল কস্তুরী। পুরুষানুক্রমে পাওয়া এই সব জড়োয়া গয়নার মধ্যে আছে একটা পদ্মরাগ মণির নেকলেস।’
‘পদ্মরাগ মণির নেকলেস?’
‘হ্যাঁ, খুবই মূল্যবান জিনিস। তার চেয়েও বেশি এর পারিবারিক গুরুত্ব। নেকলেসটি উমা দেবীর। কী কারণে এক জমিদার গৃহিণী কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে। নেকলেসের প্রতিটি পদ্মরাগ মণির মধ্যে কস্তুরী কী দেখেছে জানি না, দিন নেই, রাত নেই, একদৃষ্টে মণিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে ও। উমা দেবীর একটা পুরোনো অয়েল পেন্টিংও আছে বাড়িতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই ছবির সামনে চুপচাপ বসে থেকেছে কস্তুরী। শুধু তা-ই নয়, একবার তো চমকে উঠেছিলাম ওর কাণ্ড দেখে। আয়নার পাশেই ছবিটা খাড়া করে রেখে পদ্মরাগ নেকলেস গলায় ঝুলিয়ে উমা দেবীর মতোই বিশেষ কায়দায় খোঁপা বাঁধছিল…’
কুয়াশা ঘনিয়ে ওঠে মহেন্দ্রের উদ্বেগ আঁকা চোখে। থেমে থেমে শেষ করে ও, ‘তারপর থেকেই ওই একই কায়দায় খোঁপা বেঁধে আসছে কস্তুরী। পিঠের ওপর নয়, এ খোঁপা ঝুলতে থাকে বাঁ দিকের কাঁধের ওপর।’
‘উমা দেবীর সঙ্গে ওঁর চেহরার কোনও মিল আছে?’
মিল… তা একটু আছে… খুঁটিয়ে দেখলে ধরা যায়। খুবই অস্পষ্ট।’
‘তাহলে আর একটা প্রশ্ন করি, তোমার আসল ভয়টা কীসের। তা বলবে কি?’
সিগারটা তুলে নিয়ে অন্ধকার-মুখে ছাই-জমা ডগার দিকে তাকিয়ে রইল মহেন্দ্র।
বলল, ‘স্পষ্ট করে বলা মুশকিল… তবুও বলব, একটা জিনিস খুবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুর্লভ, কস্তুরী আর আগের মতো নেই… আর… আর মাঝে মাঝে কেবলই মনে হয়—’
‘কী?’
‘যে মেয়েটির সঙ্গে ঘর করছি, সে কস্তুরী নয়।’
সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম, ‘ধীরে, বন্ধু ধীরে! যদি স্ত্রী-ই না হন, তবে কে উনি? উমা দেবী? মাই ডিয়ার মহেন্দ্র, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?… ড্রিঙ্ক করো নিশ্চয়? কী খাবে? হুইস্কি? রাম? জিন? না, না, যা ভাবছ, তা নয়। পাঁড় মাতাল আমি নই। তবে মাঝে মাঝে সুরাস্বাদ গ্রহণ করাকে দোষের মনে করি না।’
‘জিন উইথ লাইম।’
পাশের ঘরে কাবার্ডের সামনে দাঁড়িয়েছি, পেছন থেকে শুধোলে মহেন্দ্র, ‘নিজের গাওনা গাইতে গিয়ে তোমার খবরই জিজ্ঞেস করা হয়নি। বিয়েশাদি করেছ?’
‘না।’
‘কেন?’
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে শুধোলাম, ‘গভর্নমেন্টের ওয়ার কনট্রাক্ট ধরেছ নিশ্চয়?’
‘হ্যাঁ। ইস্পাতের।’
দুটো গেলাস ভরে নিয়ে বললাম, ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ! কান ঝালাপালা হয়ে গেল যুদ্ধের পাঁয়তারা শুনতে শুনতে। ওদিকে তো সুভাষ বোস উঠে পড়ে লেগেছেন আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়তে… হিয়ার ইজ লাক, মহেন্দ্র।’
‘অল দ্য বেস্ট, দুর্লভ।’
গেলাস তুলে দু-জনে তাকালাম দু-জনের চোখের পানে। মাথায় একটু খাটো হলেও গায়ে-গতরে দিব্বি ভারী হয়েছে মহেন্দ্র। হবেই বা না কেন, টাকায় গড়াগড়ি দিলে চামচিকেও হাতি হতে পারে। এই যুদ্ধেই কোটিপতি হয়ে যাবে মহেন্দ্র… কিন্তু আমার মনে ঈর্ষা কেন?
গেলাসটা নামিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপর।
শুধোলাম, ‘এমনও তো হতে পারে যে কোনও নিকট আত্মীয়ের হাতে সম্পত্তি যাওয়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন তোমার স্ত্রী?’
‘দূর সম্পর্কের কয়েকজন ভাইটাই আছে বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ হয় না আমাদের।’
‘তোমাদের বিয়েটা হল কীভাবে?’
‘অ্যাকসিডেন্টালি, খুবই রোমন্টিকভাবে।’
‘কীরকম?’
‘কারবার সূত্রে বোম্বাই গিয়েছিলাম। আলাপ হয়েছিল হোটেলে।’
‘কোন হোটেলে?’
‘সি ভিউ।’
‘বোম্বাইতে উনি গিয়েছিলেন কেন?’
‘ছবি আঁকা শিখতে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট।’
‘চাকরির মতলব ছিল বুঝি?’
‘না, না। বড়লোকের মেয়ের অনেক খেয়াল থাকে, এও তা-ই। আঠারো বছর বয়সে নিজের নামে যে গাড়ি কেনে, তার কি চাকরির দরকার হয়? আমার শ্বশুর তো নামকরা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।’
কথা বলতে বলতে গেলাস হাতে পায়চারি করছিল মহেন্দ্র। পা ফেলা আর কথা বলার মধ্যে ফুটে উঠছে গভীর আত্মবিশ্বাস যা তার কোনওদিনই ছিল না। ছাত্রজীবনে আড়ষ্ট চলাফেরা আর মাঝে মাঝে তোতলামোর জন্য কতই না টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছে। আজ আর সে-সবের চিহ্নমাত্র নেই। সত্যিই, বিয়ে করে কপাল ফিরিয়ে ফেলেছে মহেন্দ্র।
জিজ্ঞেস করি, ‘ঝগড়াটগড়া কিছু হয়েছিল? অথবা কোনও খারাপ খবর? মেয়েদের মন তো খুব নরম, হয়তো…’
‘না। অনেক ভেবেছি, সেরকম কিছুই পাইনি। তবে…’
‘তবে কী?’
‘হপ্তার বেশির ভাগ দিনই তো নিমতায় থাকতে হয় আমাকে। কাজেই—’
‘আচ্ছা, বাড়ির বাইরে থাকো বলেই কি এই সব লক্ষণ?’
‘আমার তা মনে হয় না। প্রথম অ্যাটাকের পরেই তা বুঝেছিলাম। সেদিন ছিল শনিবার। বাড়ি ফিবে দিব্বি হাসি খুশি মেজাজে দেখলাম কস্তুরীকে। কিন্তু রাতের দিকে মেজাজ দেখে খটকা লাগল।’
‘তার আগে?’
‘মাঝে মাঝে একটু মুডি থাকত বটে— তবে তা আর পাঁচজনের মতোই— বাড়াবাড়ি কিছু নয়।’
‘কিন্তু সেই শনিবারে খটকা লাগল নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেছিলে বলে?’
‘ঠিক সেরকম কিছু না হলেও স্বাভাবিক মনে হয়নি ওকে।’
‘তুমি থাকো কোথায়?’
অবাক হয়ে তাকাল মহেন্দ্র। তারপর হেসে ফেলল।
‘ভুলেই গেছিলাম যে, দেড় যুগ পরে দেখা হল আমাদের। নিউ আলিপুরে বাড়ি করেছি। এই নাও কার্ড। কিন্তু তুমি বিয়ে করছ না কেন দুর্লভ? হীরামন পাখি না পেলে বিয়ে করব না টাইপের কোনও পণ-টন নেই তো?’
কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেই শনিবারে বাড়ি আসার পর কী-কী হয়েছিল, সব বলো।’
‘বাড়ি ফিরেছিলাম সকাল দশটায়। খেয়েদেয়ে টেনে ঘুম দিলাম। দুপুর তিনটে নাগাদ বেরোলাম দু-জনে। সেক্রেটারিয়েটে আমার একটু দরকার ছিল; সেখান থেকে গেলাম চৌরঙ্গী। ফিরপোতে কিছুক্ষণ বসার পর… এক কথায়, এমন একটা মিষ্টি বিকেল— বিয়ে না করা পর্যন্ত যার স্বাদ তুমি বুঝবে না।’
‘অসঙ্গতিটা লক্ষ করলে কখন?’
‘রাত্রে— খাবার পর।’
‘তারিখটা মনে আছে?’
‘সে কী হে! তা-ই কি কারও থাকে?’
তবুও ক্যালেন্ডারের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল মহেন্দ্র, ‘মাসটা যে ফেব্রুয়ারি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারিখটা ছিল মাসের শেষের দিকে… এই তো শনিবার… ছাব্বিশ তারিখ।’
মহেন্দ্রের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে শুধোলাম, ‘এত লোক থাকতে আমার কাছে আসার কারণ কী?’
আবার হাত কচলাতে শুরু করল মহেন্দ্র। সেই পুরোনো বদভ্যাস। সব গেছে— এটাই শুধু যায়নি।
বিড়বিড় করে বলল মহেন্দ্র, ‘ছাত্রজীবনে তুমি ছিলে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা ছাড়া, আমি তো জানি, সাইকোলজি তোমার বিশেষ সাবজেক্ট। আর, এ-ব্যাপার নিয়ে পুলিশের কাছে কি যাওয়া যায়?’
আমি ভুরু কুঁচকোতেই তাড়াতাড়ি শেষ করলে মহেন্দ্র, ‘পুলিশের কাজ তুমি ছেড়ে দিয়েছ শুনেই ছুটে এলাম তোমার কাছে।’
সোফার পিঠে টোকা মারতে মারতে বললাম, ‘সত্যিই ছেড়ে দিয়েছি… কিন্তু কেন জানো?’
‘না।’
‘আজ হোক, কাল হোক, জানতে পারবে। এসব কথা তো ধামাচাপা থাকে না।’
একটু হাসতে পারলে বাঁচতাম। মনের ওপর জোর যে কতখানি, তা দেখানোর জন্যেই এখন একটু ফিকে হাসির দরকার ছিল। কিন্তু পারলাম কই? শেষের ওই ক-টি শব্দের মধ্যেই তো বেজে উঠল তিক্ত সুর।
বললাম, ‘এক ব্যাটা জালিয়াতের সঙ্গে… একটু জিন দিই?’
‘না। থ্যাঙ্ক ইউ।’
‘বস্তাপচা গল্প। আমি ছিলাম ডিটেকটিভ। ডিগ্রি থাকুক আর না-থাকুক, পুলিশের খাতায় নাম লেখালে হেন কাজ নেই যা করতে হয় না। কোনওদিনই ভালো লাগেনি কাজটা। বাবা উন্নতি করেছিলেন এ-লাইনে— কাজেই আমাকেও ঘাড় মুচড়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যাক গে সে কথা… বাগবাজারের এক জালিয়াতকে অ্যারেস্ট করার ভার পড়েছিল আমাদের দু-জনের ওপর। অনেক কষ্টে হদিশ বার করলাম আমি আর ইসমাইল। পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছিল। সে ব্যাটা ওপর তলার ঢালু টালির ছাদের একদম শেষে একটা খুঁটি আঁকড়ে বসেছিল… এমন জায়গায় বসেছিল যে… ইসমাইল ছেলেটিও বড় ভালো ছিল… ওরকম ছেলে…’
এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রাখলাম। ঝাপসা হয়ে এল দৃষ্টি। খুকখুক করে কেশে নিয়ে শুরু করলাম আবার, ‘দেখলে তো? যতবারই বলি এই গল্প, ততবারই এই রকম হয়। মনে হয় যেন, পা-পিছলে পড়ে যাচ্ছি আমি… ঢালু টালির ছাদের একদম কিনারায় খুঁটি আঁকড়ে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছিল সে। অনেক নীচে বড় রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। তা ছাড়া খুব বিপজ্জনকও ছিল না লোকটা। কাজেই, একটু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে টেনে আনলেই ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু আমি তা পারলাম না… কিছুতেই পারলাম না।’
‘মনে পড়েছে,’ বললে মহেন্দ্র, ‘ছোটবেলা থেকেই খুব উঁচুতে উঠলে মাথা ঘুরত তোমার— নীচের দিকে তাকাতেই পারতে না।’
‘আমার ওই অবস্থা দেখে ইসমাইলই এগিয়ে গেল। হঠাৎ একটু পা পিছলে যেতেই আর সামলাতে পারলে না… আছড়ে পড়ল বড় রাস্তায়।’
‘ইশ!’
কার্পেটের ওপর চোখ নামিয়ে বসে রইল মহেন্দ্র। মুখ দেখে বুঝলাম না, ওর মনের ভাবটা কী।
‘আমি—’
‘এরকম অবস্থায় নার্ভ ফেল করা স্বাভাবিক।’ মুখ তুলে বললে মহেন্দ্র।
কিছুক্ষণ সব চুপ।
তারপর, ‘কিন্তু বন্ধুর পা পিছলে যাওয়ার জন্যে তো তুমি দায়ী হতে পারো না।’
প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ধরো।’
প্রত্যেকবারই এইরকম না-উপলব্ধি-করা অবিশ্বাসের সামনে পড়তে হয়েছে আমাকে, কেউ গুরুত্ব নিয়ে শোনেনি। কিন্তু কী করে শোনাই সেই ভয়ংকর চিৎকার? শূন্যের মধ্যে দিয়ে ওলোট-পালোট খেয়ে সবেগে নেমে চলেছে ইসমাইলের দেহ… বুকফাটা অন্তিম চিৎকারে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে আকাশ বাতাস… ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে রক্ত-হিম-করা সেই বিকট আর্তধ্বনি… তারপরেই পাষাণের বুকে অস্থি-মাংস-মেদ-মজ্জা আছড়ে পড়ার প্রচণ্ড শব্দ।… হয়তো, হয়তো মহেন্দ্রের স্ত্রীও এই ধরনের কুরে কুরে খাওয়া কোনও বিভীষিকা নিয়ে ভুগছেন… উনিও কি স্বপ্নে সেই রকম রক্ত-জমানো চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন?
‘তাহলে তোমার হেল্প পাচ্ছি?’ শুধোয় মহেন্দ্র।
‘কী করতে হবে আমাকে?’
‘বউয়ের ওপর একটু নজর রাখতে হবে। তার চাইতেও বড় কথা, এ-সম্পর্কে তোমার কী অভিমত, তা শুনতে চাই।’
‘কিন্তু আমাকে দিয়ে কোনও সাহায্য কি হবে?’
‘সে চিন্তা আমার… আজ রাতে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’
‘আছে। কেন?’
‘ভেবেছিলাম, রাত্রে খাবার নেমন্তন্ন করব। যাক, আর একদিন হবে।’
‘না, না, আমি চাই না আমাকে চিনে ফেলেন উনি, তাতে অসুবিধে হবে কাজের।’
‘কিন্তু ওকে তুমি চিনবে কী করে?’
‘সিনেমায় নিয়ে যাও।’
‘মতলব ভালোই। কাল আমরা নিউ-এম্প্যায়ারে যাচ্ছি। বক্সে। ইভিনিং শো।’
‘ঠিক আছে। আমিও যাব।’
‘দুর্লভ,’ দু-হাতে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললে মহেন্দ্র, ‘তুমি যে, কী উপকার করতে চলেছ আমার, তা ভাষায় কোনওদিন প্রকাশ করতে পারব না।’ তারপর পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে, ‘তোমাকে অফেন্ড করতে চাই না, কিন্তু সম্মান-দক্ষিণা নিয়ে এখনও কোনও কথা হয়নি। অবশ্য তুমি যা করবে, তার তুলনায়—’
‘এখন থাকুক,’ বলি আমি, ‘কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কোথাও একটা মিল রয়েছে। তাই জল-ঘুলিয়ে আমি দেখতে চাই, কী লুকোতে চাইছেন উনি।’
‘কিছুই লুকোচ্ছে না।’
‘দেখা যাক।’
সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল মহেন্দ্র। নামতে নামতে পেছন ফিরে হাসি-মুখে বিদায় অভিবাদন জানালে দু-বার। ঘরে ফিরে এলাম আমি। জানলার পাল্লা খুলে দিয়ে নীচে তাকাতেই চোখে পড়ল গাড়িটা। মস্ত গাড়ি। কুচকুচে কালো রং। কী গাড়ি? জাগুয়ার? প্লিমাউথ? উপর থেকে বোঝা মুশকিল। নিঃশব্দে যেন তেলের ওপর দিয়ে পিছলে গিয়ে রাস্তার মোড়ে উধাও হয়ে গেল বিশাল যন্ত্রযান… কস্তুরী… নামটা ভারী মিষ্টি। খুব নরম সঙ্গীতের মতো… হালকা ছন্দ লুকোনো আছে এ-নামে। কিন্তু কাঠখোট্টা এই লোকটাকে দেখে এ-মেয়ে মজলো কী করে? আশ্চর্য? ভেতরটা যার একেবারেই ফোঁপড়া… না আছে পৌরুষ, না আছে জ্ঞান-চকমিকির ঝিকিমিকি… তাকে দেখে এমন সুন্দর নামের মেয়েও প্রেমে পড়ে? অন্য কারও সঙ্গে তলে তলে মন দেওয়া-নেওয়া ছিল নিশ্চয়, তা না হলে মাঝে মাঝে উন্মনা হয়ে যাওয়ার মানেটা কী?… ঠিক হয়েছে… ঐশ্বর্যের ছটা তার চলনে-বলনে… এমনি শাস্তিই তার প্রাপ্য। লোক-দেখানো এত আত্মবিশ্বাসওয়ালা লোকদের কী জানি কেন সহ্য করতে পারি না আমি… হয়তো আমার তা নেই বলেই।
খিঁচড়ে গেছিল মেজাজটা। দড়াম করে জানলা বন্ধ করে ফিরে এলাম ঘরে। টিন থেকে কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে চিবুতে চিবুতে আরও একটু জিন ঢেলে নিলাম গেলাসে। রেডিয়ো চালিয়ে দিয়ে এসে বসলাম চেয়ারে। খবর বলার সময় হয়েছে… সেই একই খবর, হিটলারের পদভারে মেদিনী কম্পিত। ঘর অন্ধকার করে মাঝে মাঝে আরও একটা খবর আমি শুনতাম… আইএনএ রেডিয়ো থেকে প্রচারিত খবর…
কয়েক ফোঁটা বিটার ঢেলে দিয়ে চুমুক দিলাম গেলাসে। পুলিশের কাজে ব্যর্থ হলেও চাকরির জন্যে দরজায় দরজায় ঘুরিনি আমি। অথচ… ড্রয়ার টেনে একটা লাল লেফাফা বার করে ডান দিকের ওপরের কোণে ছোট করে লিখলাম, ‘ডোসিয়ার, মহেন্দ্র কৌশিক’।