প্রেত-প্রেয়সী – ২.৪
(৪)
‘লক্ষ্মীটি, আর খেও না, অনেক হল।’
বলেই, আড়চোখে পাশের টেবিলগুলোয় তাকিয়ে নিলে সুলতা। না, কেউ শোনেনি। যে যার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।
ক-দিন ধরে আমিও লক্ষ করছি, আমরা দু-জনেই যেন একটা দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছি। বেশি দৃষ্টি আমার ওপরেই। সুলতা অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু আমি করি না। কাউকেই আর ভয় করি না আমি।
এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে ঠং করে নামিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপর; বললাম, ‘তুমি কি মনে করো এত সহজে বেহেড হব আমি?’
‘না হলেও এত খেলে শরীর খারাপ হবে না?’
‘তা হবে। হলেই বা কার কী? এত মাথাব্যথা কেন? কুমিরের চোখে জল দেখলে লোকে বলবে কী?’
জ্বালা শুধু আমার কথাতেই ছিল না, চোখেও ছিল। চোখে চোখ রাখতে না পেরে মেনু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সুলতা।
ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই হুকুম দিলে ও, ‘বাটার কেক। একটা।’
‘আমার জন্যেও একটা,’ বলি আমি। ওয়েটার এগিয়ে যেতেই ঝুঁকে পড়ে বললাম, ‘তুমি কিন্তু বেশি খেতে না… চার বছর আগে…’ ঠোঁট কেঁপে উঠল আমার; তবুও বললাম, ‘চার বছর আগে কত সাধ্যসাধনা করেও মিষ্টি খাওয়াতে পারিনি তোমাকে।’
‘তার মানে?’
‘মানে আছে… মনে করে দেখো… একটু চেষ্টা করো মনে করতে… ফিরপোতে… তুমি বলতে তুমি শিল্পী…’
‘আবার সেই গল্প!’
‘হ্যাঁ, আবার সেই গল্প। জীবনে একবারই আমার সুখী হওয়ার গল্প।’
দ্রুত নিঃশ্বাস বইছিল আমার। পকেট হাতড়ে সিগারেট আর দেশলাই বার করার সময়েও চোখ সরালাম না আমি সুলতার মুখের ওপর থেকে।
‘এত বেশি সিগারেট খাওয়াও উচিত নয়,’ অস্পষ্ট স্বরে বলে সুলতা।
‘জানি। সিগারেট খেয়ে ক্যান্সারকে নেমন্তন্ন করছি, তা জানি। কিন্তু আমি তো তা-ই চাই। মদ খেয়েই যদি আমি মরি—’ সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটা সুলতার চোখের সামনে নাড়তে নাড়তে বলি, ‘মদ খেয়েই যদি আমি মরি, তাতেই বা কী এসে যায়! তুমিও তো একদিন বলেছিলে আমাকে। বলেছিলে, মরতে আমার ভালো লাগে।’
নিরুত্তর রইল সুলতা।
‘কোথায় বলেছিলে, তাও বলে দিতে পারি পারি আমি। গঙ্গার ধারে, জল থেকে ওপরে এসে…’
বলতে বলতে হেসে উঠেছিলাম। টেবিলের ওপর দুই কনুই রেখে সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা চোখ ছোট করে কথা বলছিলাম। দুটো বাটার কেক টেবিলে রেখে গেল ওয়েটার।
‘দুটোই খেয়ে নাও। আমার হয়ে গেছে!’
মিনতি মাখানো গলায় বলে ওঠে সুলতা, ‘একটু আস্তে বলো। সবাই তাকিয়ে আছে এদিকে।’
‘তাকাক না? আমার খিদে নেই— এ কথাটাও জোর গলায় বলতে পারব না? কী মুশকিল!’
‘আজ তোমার কী হয়েছে বলো তো?’
‘কিস্যু হয়নি… চামচ দিয়ে খাচ্ছ না কেন? আগে তো সেইভাবেই খেতে?’
প্লেটটা সরিয়ে রেখে ব্যাগটা টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সুলতা। ‘অসহ্য!’
সঙ্গে সঙ্গে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সত্যিই, প্রত্যেকেরই কৌতুক উচ্ছ্বসিত দৃষ্টি রয়েছে আমাদের ওপর। কিন্তু তাতে আমার কী? কে কী বলে, কী ভাবে, তা নিয়ে আর মোটেই মাথা ঘামাই না আমি। অহোরাত্র যে বিষের জ্বালায় ছটফট করছি, তার অংশ যখন ওরা নিতে পারবে না, তখন পরোয়া কীসের?
সিঁড়ির গোড়াতেই ধরে ফেললাম সুলতাকে। পাশ দিয়ে একজন ওয়েটার নেমে যেতে যেতে অপাঙ্গে তাকিয়ে গেল আমার দিকে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিলে সুলতা। বড় ভালো লাগল আমার। কাঁদলেই হুবহু কস্তুরী হয়ে ওঠে সুলতা। আর কোনও তফাত থাকে না। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দু-জনে। ঘরে ঢুকে সুলতা বিছানার ওপর ছুড়ে দিলে ব্যাগটা।
‘এভাবে থাকতে পারব না আমরা… দিনে রাতে সর্বক্ষণ এক কথা… যা জানি না তা-ই নিয়ে আমাকে একনাগাড়ে খুঁচোনো সত্যি সত্যিই অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার… কালই চলে যাব আমি… নইলে পাগল করে ছাড়বে তুমি…’
কাঁদছিল সুলতা। অশ্রুর পাতলা স্তরের নীচে চিকমিক করছিল কাজল-কালো দুই চোখ।
বললাম, ‘শ্যামনগরে নীলকুঠির সামনে সেই বুরুজটা মনে পড়ে?… চোখ বুজে হাঁটু গেঁড়ে বসেছিলে তুমি… তারপর যখন উঠে দাঁড়ালে, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল— ঠিক আজকের মতো।’
ধপ করে বিছানার কোণে বসে পড়ল সুলতা। ফিসফিস করে শুধোলে, ‘শ্যামনগর?’
‘হ্যাঁ, শ্যামনগর… মরতে বসেছিলে তুমি?’
‘মরতে বসেছিলাম?… আমি?’
আচম্বিতে শয্যার ওপর মুখ গুঁজড়ে আছড়ে পড়ল সুলতা। কান্নার ধমকে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল তন্বীদেহ। পাশে বসে মাথায় হাত বুলোতে যেতেই সরে গেল ও।
‘ছুঁয়ো না আমাকে,’ কান্নায় ভেজা বিকৃত স্বর।
‘আমাকে ভয়?’
‘হ্যাঁ, তোমাকে, তোমাকে, তোমাকে।’
‘মাতলামির জন্যে?’
‘না।’
‘তবে?’
সব চুপ।
‘আমি উন্মাদ, তা-ই না?’
‘হ্যাঁ।’
উঠে দাঁড়ালাম আমি। কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারিনি। তারপর বলেছিলাম বিড়বিড় করে, ‘অসম্ভব নয়… হলেই বা কী এসে যায়… আচ্ছা, ওই নেকলেসটা… না, না, বলতে দাও আমাকে… নেকলেসটা গলায় দাও না কেন?’
‘ভালো লাগে না বলে— আর কতবার বলতে হবে?’
‘ভালো লাগে না? না, পাছে আমি ধরে ফেলি… কোনটা সত্যি?’
‘ভালো লাগে না।’
‘এক গলা গঙ্গাজলে দাঁড়িয়েও যদি বলো এ কথা…’ জুতো দিয়ে কার্পেটে দাগ টানতে টানতে বলি, ‘নিশিকান্ত শর্মার উপহার, তা-ই না?’
কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে খাটের ওপর দুই পা তুলে নিলে সুলতা। বললে, ‘নিশিকান্তবাবুর কাছে শুনেছিলাম, চায়না টাউনের একটা দোকান থেকে নেকলেসটা কিনেছিলেন উনি।’
‘কত দিন আগে?’
‘তাও বলেছি তোমাকে। বার বার একই কথা কেন বলাচ্ছ বলো তো?’
‘কতদিন আগে?’
‘ছ-মাস।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘মিথ্যে বলে আমার লাভ?’
‘স্বীকার করে নিলেই সব গোল চুকে যায়। তুমিই কস্তুরী কৌশিক।’
‘না। দোহাই তোমার, ও-নাম আর শুনিও না। আমি আর পারছি না। সে মেয়েকে এখনও যদি তুমি এতই ভালোবাসো তো আমাকে রেহাই দাও… কালই বিদায় নেবে আমি… যথেষ্ট হয়েছে, সহ্যের সীমা আমার ছাড়িয়েছে।’
‘সে মেয়ে… মারা গেছে, আর…’
কথা ফুটছিল না গলায়, কাশতে গিয়ে গলা জ্বলে গেল। তবুও বললাম, ‘মারা গেছিল… কিছুদিনের জন্যে… তাও সম্ভব। কী বলো?’
‘না।’ অব্যক্ত বেদনায় যেন গুঙিয়ে ওঠে সুলতা, ‘দোহাই তোমার। থামো।’
আবার আতঙ্কের একটা ফিনফিনে মুখোশ দুলে ওঠে সুলতার আবেগ-থরথর মুখের ওপর।
সরে গেলাম আমি।
বললাম, ‘ভয় পেও না। তুমি তো জানো, তোমাকে আঘাত দিতে আমি চাই না… মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলি বটে, কিন্তু সে তো আমার দোষ নয়… দেখো তো, চিনতে পারো?’
ফস করে পকেট থেকে ঝকমকে আয়নাটা বার করে ছুড়ে দিলাম শয্যার ওপর। যেন সাপ দেখেছে এমনিভাবে ভয়ার্ত চিৎকার করে কুঁচকে সরে গেল সুলতা।
‘দেখো, দেখো… ভালো করে দেখো!… হাত দাও… সাপ-বিছে তো নয়, সামান্য একটা আয়না… কামড়াবে না, ভয় নেই… কী? মনে পড়ছে কিছু?’
‘না।’
‘মিউজিয়ামে যাওয়া?’
‘না।’
‘তোমার লাশের পাশ থেকে তুলে নিয়েছিলাম এই আয়না… অবশ্য তা তোমার মনে পড়বে না।’
চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলাম শেষের কথাগুলো। আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে সুলতা।
‘সরে যাও… সরে যাও সামনে থেকে… একলা থাকতে দাও আমাকে।’
একই সুরে বলি আমি, ‘রেখে দাও— এ জিনিস তোমার।’
অশুভ নক্ষত্রের মতোই দু-জনের মাঝে থেকে চিকমিক করতে লাগল আয়নাটা। ওপাশে সুলতার ভয়করুণ মুখ দেখে অকস্মাৎ বুকটা টনটনিয়ে উঠল আমার। এ কী করছি আমি? মিছিমিছি কেন যন্ত্রণায় নীল করে তুলছি ওর মনকে? কিন্তু সত্যিই কি মিছিমিছি?
দপদপ করে উঠলো রগের শিরাগুলো। সোরাই থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে দিলাম। এখনও শেষ হয়নি প্রশ্নের তূণ… আরও অনেক প্রশ্ন-শর নিক্ষেপ করে ক্ষতবিক্ষত করে তুলতে হবে ওর বিস্মৃত মনকে… তবেই যদি… তবেই যদি… কিন্তু তার আগে আবার সহজ করে তুলতে হবে কস্তুরীকে। ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেছে বেচারি… একটু একটু করে মুছে দিতে হবে ওর আতঙ্ক… তারপর?… তারপর সুলতার রক্ত-মেদ-মজ্জার মধ্যে আবির্ভাব ঘটবে কস্তুরীর। দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলাম আমি।
‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে যেতে দাও!’ ককিয়ে উঠল সুলতা।
‘কোথায় যাবে?’
‘যেদিকে দু-চোখ যায়।’
‘আমি আর তোমাকে ছোঁব না সুলতা, কথা দিচ্ছি… অতীত নিয়ে আর কোনও কথাই বলব না।’
দ্রুত নিঃশ্বাস বইছিল সুলতার। পেছন ফিরে জামা খুলতে খুলতে বেশ বুঝলাম। একদৃষ্টে আমার পানে তাকিয়ে আছে ও।
ফিরে দাঁড়াতেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সুলতা ‘তোমার পায়ে পড়ি— চোখের সামনে থেকে সরাও আয়নাটা।’
‘রাখবে না তুমি?’
‘না। একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে। আমি আর পারছি না… আর পারছি না।’
মমতায় ভরে উঠল সমস্ত মন। পাশে গিয়ে বললাম, ‘কাঁদছ কেন, কস্তুরী? তোমাকে কাঁদানোর সত্যিই কোনও ইচ্ছে নেই আমার।’ আলতো হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে গাঢ়স্বরে বললাম, ‘কেঁদো না কস্তুরী… কেঁদো না… কেন কাঁদছ?’
বুকের মাঝে মাথা টেনে নিলাম ওর। নিবিড় প্রেমে ধীরে ধীরে দোলা দিতে দিতে বলতে লাগলাম ফিসফিস স্বরে, ‘মাঝে মাঝে কী যে করি, নিজেই বুঝি না… ভুলতে না পারার যন্ত্রণা যে কত মর্মান্তিক, তোমাকে বোঝাতে পারব না… পাঁচজনের মতো ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হয়তো এত কষ্ট পেতাম না আমি… হয়তো এতদিনে ভুলেও যেতাম… কিন্তু… আজ তোমাকে বলতে পারি… আত্মহত্যা করেছিল কস্তুরী। বুরুজের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে এ পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিল কস্তুরী। কিন্তু কেন? কেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল… চার বছর ধরে একনাগাড়ে এই একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তরের আশায় পাগল হতে বসেছি আমি।’
উত্তরে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সুলতার বুক ঠেলে।
‘সব কথাই বললাম তোমাকে। তুমি আমার… তুমি আমার… ভালো তাকে আমি এখনও বাসি, বাসব। তোমাকেও বাসি। দুটো ভালোবাসাই যে এক… কোনও তফাত নেই। ভালো আমি একজনকেই বেসেছি— দু-জনকে নয়। তুমি যদি একটু চেষ্টা করো… ওগো, একটু চেষ্টা করো মনে করতে, তাহলেই…’
সুলতার মাথা নড়ে উঠল আমার বুকের ওপর। আরও জোরে চেপে ধরে বললাম, ‘না, না, শেষ করতে দাও… গত ক-দিনে আমি যা অনুভব করেছি, সমস্ত সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করেছি— তা বলবার সুযোগ আমাকে দাও।’
হাত বাড়িয়ে বেডল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম। একান্ত নিবিড় হয়ে বসেছিলাম দু-জনে… ভেসে চলেছিলাম অন্ধকারের নিঃসীম দরিয়ায়… একটু সোজা হয়ে বসতে পারলে ভালো হত… টনটন করছিল হাতটা, কিন্তু নড়তে সাহস হল না আমার… নিরন্ধ্র তমিস্রায় বিলীন হয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে চললাম, ‘মরতে আমি বড় ভয় পাই ছেলেবেলা থেকেই… এই ভয় আমার আছে… অপরকে মরতে দেখলেও আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছি আমি… ছেলেবেলায় রাত্রে হরিবোল চিৎকার শুনে আঁতকে উঠে ঘুমের ঘোরেই জড়িয়ে থাকতাম মা-কে… জীবনে শ্মশানে যাইনি ভয়েতে… কখনও ভেবেছি সব সত্যি… কখনও ভেবেছি সব মিথ্যে… কিন্তু আজ আর কোনও দ্বিধা আমার নেই… তোমার মধ্যেই জেনেছি, কিছুই মিথ্যে নয়, সব সত্যি… ওগো, কথা কও… একটি বারের জন্য তুমি যদি বলো, স্বীকার করো… তাহলে চিরকালের মতো জুড়িয়ে যায় আমার জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে-যাওয়া মনটা।’
অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার দিয়ে গড়া সুলতার মুখে মনে হল কোনও চোখ নেই। শুধু কপাল, গাল আর চিবুকের রেখা দেখা যাচ্ছিল ম্লান আভায়। পরিপূর্ণ ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছিল আমার দগ্ধ অন্তর। একদৃষ্টে শূন্য অক্ষিকোটরের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম বসন্তের বাতাসের চেয়েও হালকা সুরে জবাব দেবে কস্তুরী, বলবে এমন একটি কথা…
ঘন গলায় বললাম, ‘লক্ষ্মীটি, ওভাবে তাকিয়ে থেকো না— কিছু বলো।’
ডান হাতটা অবশ হয়ে গেছিল আমার। শুধু হাত কেন, পুরো ডান দিকটাই অসাড় মনে হচ্ছিল। মনে পড়ল, গঙ্গার বুক থেকে টেনে টেনে কস্তুরীকে তুলে আনার দৃশ্যটি। কিন্তু আজকে আর জীবনের জন্য কোনও সংগ্রাম নয়… আজ আমি চাই নিজেকে নিঃশেষে সঁপে দিতে এমন একজন নারীর হাতে— রহস্যের চাবিকাঠির সন্ধান যে জানে…
ঘুম পাচ্ছে… চিন্তাধারাও আর স্বচ্ছন্দ নয়… এলোমেলো… কথা বলতে চাইলাম… পারলাম না… রাশি রাশি কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল সবকিছু…
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে অনাবিল শান্তি অনুভব করলাম। মনে হল, আর কোনও সমস্যা, যন্ত্রণা আমার নেই। কস্তুরী বড় বড় চোখ মেলে অপলকে তাকিয়েছিল আমার পানে। দেখতে দেখতে অশ্রু টলমল করে উঠল কালো দিঘির মতো দুই চোখের কানায় কানায়।
উঠতে গিয়ে অনুভব করলাম মাথায় যন্ত্রণা। হুইস্কির প্রতিক্রিয়া। কনুইয়ের ওপর আধশোয়া অবস্থায় দেহ ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘সুলতা!’
‘বলো,’ কান্নায় ভেজা স্বর।
‘সত্যিই আমাকে ভালোবাস তুমি?’
কোনও জবাব নেই।
‘আচ্ছা, ঘুমের ঘোরে নিশ্চয় আবোলতাবোল বকেছি আমি, তা-ই নয়?’
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে সুলতা বললে, ‘না, কিছুই বলোনি। কিন্তু কথা পরে, আগে বাথরুম থেকে ঘুরে এসো।’
‘তোমার?’
‘আমার হয়ে গেছে, চুল ভিজে দেখতে পাচ্ছ না?’
স্খলিত চরণে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময়ে দেখি, তখনও আশ্চর্য গভীর দৃষ্টি মেলে আমার পানে তাকিয়ে আছে সুলতা।
কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে দেখি, আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে ও।
চোখ ছোট করে লক্ষ করতে লাগলাম কেশচর্চা। অনেক রোগা মনে হচ্ছে সুলতাকে। তবে কি আমার চাইতেও বেশি নিগ্রহ ভোগ করছে ওর আত্মা? খোঁপা বাঁধতে শুরু করতেই আবার নিজেকে সামলাতে পারলাম না— হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম চিরুনিটা, ‘দাও আমাকে— ওভাবে নয়।’
একটা চেয়ার টেনে বসলাম ঠিক পেছনে।
‘এ খোঁপা মোটেই মানায় না তোমায়— আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’
হালকা সুরে বললেও গলা কেঁপে গেল আমার। অধীর উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল আঙুল। ভারী মিষ্টি একটা সৌরভ উঠছিল চুল থেকে, অজানা সুবাস, কিন্তু নিমেষে হালকা হয়ে যায় মনটা। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দেখি, ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে সুলতা, মুক্তোর মতো দাঁত দিয়ে চেপে ধরেছে অধর। কিন্তু বাধা দিলে না। জানে, বাধা দিয়ে কোনও লাভ নেই, তাই বুঝি নিঃশেষে ছেড়ে দিলে নিজেকে আমার খেয়ালের হাতে। আস্তে আস্তে একপাশে কাঁধের ওপর রূপ পরিগ্রহ করতে লাগল বিচিত্র খোঁপাটা। কাঁটার পর কাঁটা লাগিয়ে চললাম আনাড়ি হাতে। বহু দিবস, বহু রজনীর মধ্যে দিয়ে জাগরুক স্মৃতিপটে আঁকা সেই মুখটিকে ফুটিয়ে তুলতে চাই আমি— শিল্পীর মতো রঙের পর রং চড়িয়ে ক্যানভাসের বুকে আমার মানসীকে— ধ্যানের কস্তুরীকে।
আশ্চর্য। সত্যি সত্যিই ফুটে উঠছে যে সেই মুখ— যে মুখের স্মৃতি নিয়ে উদ্ভ্রান্ত হতে বসেছি আমি। ওই তো সেই চারুললাট, নিখুঁত কর্ণযুগল! শেষ কাঁটাটা গুঁজে দিয়ে ঘাড় কাত করে তন্ময় হয়ে রইলাম আমার সৃষ্টির পানে।
সার্থক আমার প্রচেষ্টা। দর্পণের বুকে সোনালি রোদের মাঝে জলরঙে আঁকা ছবির মতোই স্পষ্ট, নিখুঁত অথচ পাংশু এ মুখের রহস্য আজও আমার কাছে অজ্ঞাত।
‘কস্তুরী!’
অস্ফুট স্বরে অজ্ঞাতসারেই চিৎকার করে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু কস্তুরী তা শুনতেই পেল না। তবে কি দর্পণের বুকে আমি যা দেখছি তা প্রতিবিম্ব নয়, জীবন্ত? না, মরীচিকা, চোখের মায়া? চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘুরে গিয়ে সামনে থেকে দেখলাম আমি। সেই মুখ। না, ঠকিনি আমি— এ সেই কস্তুরীই বটে।
আমার মর্মভেদী, এবং সম্ভবত উদ্ভ্রান্ত, দৃষ্টির সামনে বুকের পাঁজর খালি করে দিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলতা। হাসবার চেষ্টা করল; বলল, ‘আর কিছুক্ষণ পরে তো ঘুমিয়েই পড়তাম।’ তারপর আয়নার বুকে একঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘মন্দ কী, নতুন ফ্যাশান। তবে ক-সেকেন্ড থাকে, সেইটাই প্রশ্ন।’
বলে, মাথার এক ঝাঁকুনিতেই এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ল কাঁটাগুলো, কালো মেঘের মতো চুলের রাশি ছড়িয়ে পড়ল পিঠের ওপর। হাসতে হাসতে আমার গায়ে গড়িয়ে পড়ল সুলতা।
আমিও হাসলাম। হেসে স্বস্তি বোধ করলাম।
সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখনও মাথা টিপে দিচ্ছিল সুলতা। এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টপ করে উঠে পড়ে বলল, ‘চলো।’
সচমকে বললাম, ‘কোথায়?’
মুখ টিপে হেসে জবাব দিলে সুলতা, ‘খেতে হবে না?’
‘তুমি যাও… আচ্ছা, চলো… কিন্তু মাথার যন্ত্রণা…’
শান্ত সুন্দর দৃষ্টি মেলে ধরলে সুলতা, ‘ভয় কীসের, আমি তো চলে যাচ্ছি না… তোমার খেতে ভালো না লাগলে শুয়ে থাকো। এখুনি আসছি আমি।’
আমার অবচেতন শঙ্কার জবাব দিয়েছে সুলতা। শরীরটা সত্যিই ভালো নেই। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা… কিন্তু কস্তুরী যদি না আসে? মিথ্যে ভয়… মরিয়া হয়ে বললাম, ‘না, ভয় কীসের। যাও তুমি, তাড়াতাড়ি এসো।’
‘সত্যি বলছ?’
‘হ্যাঁ, সত্যি। যাও, আমি বলছি যাও।’
দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আবার নিদারুণ উদ্বেগে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম আমি। জানি, বৃথা আমার এই শঙ্কা। ওর সব জিনিসই রয়েছে এ-ঘরে… সব ছেড়ে কি কেউ যেতে পারে? অসম্ভব!
কিন্তু হায়রে অবুঝ মন! সেকেন্ড কয়েক পরেই মনে হল, আমি সব পেয়েও আবার সব হারাতে বসেছি। সঙ্গে সঙ্গে আতীব্র বেদনায় ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আলনা থেকে জামাটা টেনে আর কিছু না ভেবেই তরতর করে নেমে এলাম সিঁড়ি বেয়ে।
খাবার ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম ভেতরে। ধক করে উঠল বুকটা।
সুলতা নেই ভেতরে। উত্তাল হৃৎপিণ্ডটা মনে হল, এইবার বুঝি বিকল হয়ে যাবে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসেছিলাম প্রধান তোরণে।
রাস্তাটা সোজা গিয়ে যেখানে মোড় নিয়েছে ডান দিকে, ঠিক সেইখানে দেখা গেল হনহন করে এগিয়ে চলেছে একটি মূর্তি। বাদামি শাড়িটি আঁটসাট করে জড়ানো তন্বীদেহে। প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে যে হিল্লোল উঠছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত— তার প্রতিটি আমি চিনি। প্রখর সূর্যালোকে দীর্ঘ চার বছর পরে ফিরে আসা কস্তুরী কৌশিক অদৃশ্য হয়ে গেল পথের মোড়ে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার; কুয়াশার পর্দা দুলে দুলে উঠছে চোখের সামনে। আমি কি মূর্ছা যাব? না, না, আমাকে যেতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। পিছু নিতে হবে ওই রহস্যময়ী নারীমূর্তির— জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে দোলকের মতো নিরন্তর রয়েছে যার আসা-যাওয়া।
ছুটে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি রাস্তায়— মোড়ের মাথায় এসেই আবার দেখতে পেয়েছিলাম সেই শরীরী প্রহেলিকাকে। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে সে যেদিকে, সেদিকে এর আগে ওকে আমি কোনওদিন আসতে দেখিনি। কিন্তু পথঘাট তার নখদর্পণে। সমানে লেগে রইলাম পেছনে। পলকের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেছে মাঝের চারটি বছর। পুরোনো দিনে ফিরে গেছি আমি— পিছু নিয়েছি কস্তুরী কৌশিকের। নতুন করে কোষে কোষে অনুভব করলাম সেই অবর্ণনীয় উত্তেজনা আর শিহরণ। কস্তুরী… কস্তুরী… কস্তুরী… স্মৃতির পাতা থেকে উঠে আসা কস্তুরী ওই তো এগিয়ে চলেছে সামনে… অভ্যস্ত চরণে এ-পথ ও-পথ ঘুরে এসে চকিতে অন্তর্হিত হয়ে গেল সে একটা দোতলা বাড়ির মধ্যে।
থমকে দাঁড়ালাম আমি। এক মিনিট… দু-মিনিট… পাঁচ মিনিট কেটে গেল— কিন্তু কাউকেই বাইরে আসতে দেখলাম না।
দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেলাম কাছে— ছোট্ট ফলকটা চোখে পড়ল তখনই— সাদার ওপর কালো হরফে শুধু দুটি শব্দ, ‘দুর্গা হোটেল।’
মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করেছিলাম। তারপরেই লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকলাম ভেতরে— সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম টেবিলের ওপাশে গান্ধী-টুপি-পরা ছোকরার সামনে।
‘এই মাত্র যে ভদ্রমহিলা এলেন, ওঁর নামটা জানতে পারি?’
‘উমা দেবী। কিন্তু কেন বলুন তো?’