প্রেত-প্রেয়সী – ২.৬
(৬)
যন্ত্রচালিতের মতো চাবি ঘুরিয়ে খুলে ফেললাম দরজা। এই সেই স্বীকারোক্তি, যার প্রতীক্ষায় দীর্ঘ চার বছর কী অপরিসীম কষ্টই না ভোগ করতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু কই, রহস্যের জট সরল হওয়া দূরে থাকুক, এ যে আরও জটিল হয়ে উঠল। এ কি সত্যিই স্বীকারোক্তি? এমন সহজভাবে বলল কস্তুরী! হয়তো আমাকে খুশি করার জন্যই বানিয়ে বলেছে— শান্তিতে থাকার শেষ প্রচেষ্টা।
দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে শুধোলাম, ‘প্রমাণ?’
‘চাই নাকি?’
‘না… কিন্তু…’
ঘাবড়ে গেলাম আমি। হায় ভগবান! ভয় কি আমার স্নায়ুমণ্ডলীতে মৌরসী পাট্টা গেঁড়েছে! এত দুর্বল কেন আমি!
‘আলোটা নিভিয়ে দাও!’ মিনতি করে বলে কস্তুরী।
খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ল ঘরের দেয়ালে, সিলিংয়ে। রাস্তার ল্যাম্পের আলো। ফাঁক ফাঁক আলো আর অন্ধকারের গরাদ। গরাদ! তা-ই বটে! খাঁচায় বন্দি— দু-জনেই! খাটের ওপর এলিয়ে পড়ি আমি।
‘একথা আগে বলোনি কেন? কীসের ভয়?’
দেখতে পাচ্ছিলাম না কস্তুরীকে— অন্ধকারের মধ্যে শুনলাম বাথরুমের মধ্যে ওর নড়াচড়ার শব্দ।
‘উত্তর দাও, কার ভয়ে মুখবন্ধ করেছিলে এতদিন?’
নিরুত্তর রইল কস্তুরী।
‘সেদিন হোটেলে আমাকে দেখেই তুমি চিনতে পেরেছিলে, তা-ই নয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘তক্ষুনি সব স্বীকার করলেই গোল চুকে যেত, এত ছলনার কী দরকার ছিল! এ-রকম আহাম্মকি করলে কেন?’
প্রবল ঘুষিতে ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠল খাটের স্প্রিং।
‘কী বোকা!… এ বয়সে এ-রকম উজবুকি শোভা পায়?… তার ওপর ওই চিঠিটা!… সোজাসুজি না বলে চিঠি লেখার প্রয়োজন হল কেন?’
পাশে এসে বসল কস্তুরী।
‘তোমাকে কোনওদিনই একথা জানতে দিতে চাইনি আমি।’
‘কিন্তু আমি তো আগাগোড়াই জানতাম যে…’
‘শোনো… খুলে বলতে দাও আমাকে… বলতে কষ্ট হচ্ছে… তবুও বলতে দাও।’
হাত যেন পুড়ে যাচ্ছে কস্তুরীর! আড়ষ্ট হয়ে রইলাম আমি। দেহের সমস্ত মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। এবার শুনব সেই ভয়াবহ তথ্য… যে গূঢ় রহস্যের জন্যে… কিন্তু ভয়ে শিউরে উঠছি কেন আমি?
‘কলকাতায় যে মেয়েটিকে তুমি চিনতে, নিউ এম্পায়ারে তোমার বন্ধু মহেন্দ্রর সঙ্গে যাকে দেখেছিলে, যার পিছু নিয়েছিলে তুমি দিনের পর দিন, যাকে তুমি টেনে তুলেছিলে জলের মধ্যে থেকে— সে মরেনি… কোনওদিনই মরেনি। বুঝেছ? আমি কোনওদিনই মরিনি।’
হাসি পেল আমার। বললাম, ‘না, তুমি মরোনি… শুধু যা রাতারাতি সুলতা মিত্র হয়ে গেলে।’
‘না গো না… তাহলে ভালোই হত! কিন্তু আমি সুলতা মিত্র হইনি, চিরকালই ছিলাম। আমার আসল নাম, সুলতা মিত্র। আর এই সুলতা মিত্ৰকেই আগাগোড়া ভালোবেসে এসেছ তুমি।’
‘কী বলতে চাও তুমি?’
কস্তুরী কৌশিককে তুমি কোনওদিনই দেখোনি। আমিই তার ভূমিকায় অভিনয় করেছি। আমি ছিলাম মহেন্দ্র কৌশিকের দুষ্কর্মের সঙ্গিনী… ওগো, যদি পারো ক্ষমা কোরো! জানো, এজন্যে কী কষ্ট পেতে হচ্ছে আমাকে?’
সজোরে কস্তুরীর কবজি চেপে ধরলাম আমি।
‘বুরুজের নীচে যে দেহ আছড়ে পড়েছিল, তুমি বলতে চাও তা…’
‘হ্যাঁ, কস্তুরী কৌশিকের। একটু আগেই স্বামীর হাতে খুন হয়েছিল সে… মরেছে শুধু কস্তুরী কৌশিকই… বেঁচে রয়েছি আমি… বুঝেছো!’
‘মিথ্যে কথা, বিশ্বাস করি না আমি। বলাটা খুবই সহজ, বিশেষ করে মহেন্দ্র আর বেঁচে নেই যে এসে তোমার এই গালগল্পের সত্যতা যাচাই করবে। তুমি তাহলে মহেন্দ্রর রক্ষিতা ছিলে, কেমন? বেচারার বউকে মারার জন্যে গোটা প্লটটা তোমার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। কিন্তু কেন?’
‘ওর টাকা ছিল বলে আমরা বিলেত যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম।’
‘চমৎকার! তা-ই যদি হয়, তবে বউকে নজরে রাখার জন্যে মহেন্দ্র আমাকে সাধাসাধি করেছিল কেন?’
‘উত্তেজিত হয়ো না।’
‘আমি হইনি; জীবনে এত শান্তভাবে কথা বলিনি আমি। বলো কেন?’
‘সন্দেহকে বিপথে চালিয়ে দেওয়ার জন্যে; আত্মহত্যা করার কোনও যুক্তিযুক্ত কারণই ছিল না মহেন্দ্র কৌশিকের স্ত্রীর। কাজেই এমন একজনকে খুঁজছিলেন ভদ্রলোক, যে কিনা সময় হলেই এগিয়ে এসে বলতে পারবে, হ্যাঁ, উদ্ভট ভাবনা-চিন্তা গজগজ করত কস্তুরী কৌশিকের মাথায়, মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত সে পূর্বজন্মের সবকিছুই তার নখদর্পণে, মৃত্যু তার কাছে খুব একটা বড় ব্যাপার নয়— খেলার মতোই; এমন একজনকেই দরকার ছিল, যে বলতে পারবে, হ্যাঁ, আমি দেখেছি, কস্তুরী কৌশিককে এর আগে আর একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে… তুমি উকিল মানুষ… তা ছাড়া তোমার নাড়িনক্ষত্র তাঁর জানা… গোটা গল্পটাই যে তুমি অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করবে, তা জানতেন তিনি।’
‘বটে! আমার মতোই একটা নিরেট গর্দভকে খুঁজছিল সে! শুধু নিরেট কেন, স্ক্রু আলগা থাকাও দরকার ছিল, কেমন? কী নিখুঁত প্ল্যান! তাহলে থিয়েটারে যাকে দেখেছিলাম, সে তুমি; উমা দেবীর সমাধির সামনে যে গিয়েছিল, সে-ও তুমি; মহেন্দ্রর ঘরে যার ফোটোগ্রাফ দেখেছিলাম, তা-ও তোমার?’
‘হ্যাঁ।’
‘এরপর নিশ্চয় বলবে, উমা দেবী বলে কস্মিনকালে কেউ ছিল না?’
‘ছিল।’
‘ও! অর্থাৎ এটুকু আর উড়িয়ে দেওয়া গেল না।’
‘প্লিজ, একটু বোঝবার চেষ্টা করো।’ দীর্ঘশ্বাস শুনলাম।
‘বেশ বুঝছি আমি, জলের মতো বুঝছি। এও বুঝছি যে এমন খাসা একটা গল্পকে কাঁচিয়ে দিচ্ছে একা উমা দেবীই।’
‘গল্প হলে তো বাঁচতাম,’ বিড়বিড় করে বলে কস্তুরী, ‘উমা দেবী সত্যি সত্যিই কস্তুরী কৌশিকেরই পূর্বপুরুষ। সত্যি কথা বলতে কি, উমা দেবীর কাহিনি শুনেই মতলবটা তোমার বন্ধুর মাথায় এসেছিল। পূর্বপুরুষের আত্মার ভর হওয়া, সমাধিস্থানে বার বার যাওয়া, উমা দেবীও তো জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন— তাই আত্মহত্যার অভিনয়…’
‘অভিনয়?’
‘তা ছাড়া আর কী? জল থেকে তুমি আমাকে না তুললেও আমি ডুবতাম না। সাঁতারে আমি বরাবরই ভালো।’
হাত নিশপিশ করে উঠল আমার— পাছে কিছু একটা করে ফেলি সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি খামচে ধরলাম বিছানায় চাদর।
কিন্তু রোষ চাপা রইল না কণ্ঠে, ‘সাবাস মহেন্দ্র, খুব ঘুঘুর খেল দেখালে! কিছুই ভাবতে বাকি রাখোনি! আচ্ছা, তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্যে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করার সময়ে মহেন্দ্র নিশ্চয় জানত যে আমি যাব না?’
‘ঠিক তা-ই। তুমি যেতে চাইলে না। পরে আমিও তোমাকে বাড়িতে ফোন করতে বারণ করে দিলাম।’
‘তা মন্দ নয়… চমৎকার… কিন্তু ওই বুরুজ? আমরা যে ওই বুরুজে যাবে, তা ও জানল কী করে? বুঝেছি… ড্রাইভ করেছিলে তুমি, শ্যামনগরের নির্জন নীলকুঠি আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিল, ঠিক কখন গিয়ে পৌঁছবে, তাও নিখুঁতভাবে হিসেব করেছিলে… মহেন্দ্র শুধু নিজের বৌকে ঠিক তোমার মতোই সাজিয়ে আগে থেকেই হাজির ছিল বুরুজের চুড়োয়… সমস্তই মিলে যাচ্ছে… তবুও আমি বিশ্বাস করি না… একটা কথাও বিশ্বাস করি না তোমার… মহেন্দ্র খুনি নয়… কখনওই নয়।’
‘তিনিই খুনি। খুন না করে উপায়ও ছিল না। বিয়ে করে সুখী হননি ভদ্রলোক। কস্তুরী সত্যি সত্যিই রুগ্ন ছিল… বুঝতেই পারছ রোগটা কীসের… অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন তোমার বন্ধু, ফল হয়নি কিছুই… কারও বিধানই সঠিক হয়নি… অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন মহেন্দ্রবাবু…’
‘এবার সব পরিষ্কার হয়ে আসছে! বুরুজ নিয়ে আর কোনও সমস্যা নেই। আগে থেকেই চুড়োয় উঠে বসেছিল মহেন্দ্র, বউকে খুন করে মুখখানা এমন বিকৃত করে রেখেছিল যাতে কেউই চিনতে না পারে— তারপরেই গাড়ি হাঁকিয়ে পৌঁছে গেলে তুমি। মহেন্দ্র জানত আমার ব্যায়রাম, উঁচুতে উঠতে পারি না… দরজাটা সেই কারণেই পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে… আমাকে কেটে ফেললেও আলসে দিয়ে যেতে পারতাম না… ইতিমধ্যে তুমি উঠে গেলে ওপরে… ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মরা বউকে বাইরে ঠেলে ফেলে দিলে মহেন্দ্র, তুমিও বুকফাটা গলায় চেঁচিয়ে উঠলে। তারপর? তারপর তোমরা ঝুঁকে দেখতে লাগলে কীভাবে টলতে টলতে আমি এগিয়ে গেলাম লাশটার দিকে। হুবহু তোমার মতোই শাড়ি-ব্লাউজ পরে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা, চুলও বেঁধেছিলেন একই ঢঙে!… দেখছ, তুমি বলবার আগেই সব বলে দিচ্ছি আমি! আমাকে আচ্ছন্নের মতো চলে যেতে দেখে তোমরা…’
হাঁপাচ্ছিলাম আমি। স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাহিনিটা সেঁধিয়ে যাচ্ছে মগজের মধ্যে… অজস্র খুঁটিনাটিগুলোও খাঁজে খাঁজে বসে গিয়ে ধাপে ধাপে ক্লাইমাক্সের দিকে নিয়ে চলেছে ভয়ংকর বিয়োগান্তক নাটকটিকে।
‘আমার উচিত ছিল চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করে পুলিশ ডাকা। মহেন্দ্রও তাই হিসেব করে রেখেছিল— পুলিশের কাছে আত্মহত্যার একটা জমকালো বিবরণ দেব। এই আশাই সে করেছিল আমার কাছে। গ্রামে লোকজন ডাকতে যাওয়ার সময়ে তোমরা নেমে এসে সরে পড়তে— কেমন তা-ই নয়? খাসা মতলব! কিন্তু সব ভণ্ডুল করে দিলাম আমি। চেঁচামেচির ধার দিয়েও গেলাম না। নিজে জ্বলে পুড়ে মরছি শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে, একটু আগে একটা মেয়েকেও মরবার সুযোগ করে দিয়েছি— সেই দুর্বলতাকে ঢাক পিটিয়ে দুনিয়ার সামনে জাহির করতে চাইনি আমি। ফেঁসে গেল মহেন্দ্রর পরিকল্পনা। ও কল্পনাই করতে পারেনি একদম বোবা হয়ে যাব আমি— যে লোক এর আগেও একবার নিজের জায়গায় আর একজনকে মরতে দিয়েছে, তার পক্ষে এই আত্মযন্ত্রণা আর নীরবতা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু…’
না, কোনও ভুলই হয়নি আমার, এই একটি জায়গাতেই কেঁচে গেল অমন চমৎকার প্ল্যানটা। মনে পড়ল সেই ভয়াবহ রাতে মহেন্দ্রর প্রাসাদে গিয়ে কী পরিমাণ আতঙ্ক দেখেছিলাম বন্ধুর চোখে মুখে, কিছু বলতে পারেনি সে, বলার উপায়ও ছিল না। পরের দিন সকালে ফোন করেছিল মহেন্দ্র, ‘যা ভয় করেছিলাম, কস্তুরী আত্মহত্যা করেছে… পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে… যাই হোক, আমার সঙ্গে তুমি থাকলে স্বস্তি পেতাম…’
মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করেছিল মহেন্দ্র যাতে নাটকের শেষ অংশটুকু আবার আমি অভিনয় করি। ঠিক। আমার নীরবতাই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ছকটার। তারপরেই পুলিশ মহেন্দ্রকে নিয়ে পড়েছে। কেননা, আত্মহত্যার কোনও কারণ ছিল না মিসেস কৌশিকের, অগাধ সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি, তাঁর মৃত্যুতে সব টাকাই পাচ্ছে মহেন্দ্র, কাজেই পুলিশের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, তার ওপর গাঁয়ের লোকেরা সস্ত্রীক মহেন্দ্রকে গাড়ি করে যেতেও দেখেছে সত্যিই, খুব বেকায়দায় পড়েছিল বেচারি। তারপরেই স্ত্রী-হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করে গেল মোটর অ্যাকসিডেন্টে নিজে মরে।
বালিশে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছিল সুলতা। আচম্বিতে উপলব্ধি করলাম, সব যন্ত্রণার অন্তে পৌঁছেছি আমি। শেষ, শেষ, সব শেষ। দু-চোখ খুলে এতদিন আমি দুঃস্বপ্নের ঘরে দিন যাপন করেছি… শয্যাসঙ্গিনী এই স্ত্রীলোকটিই তাহলে সুলতা… মহেন্দ্রর সঙ্গেও বোধ করি এই বাড়িতে রাত কাটিয়েছে সে, তখনই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল দু-জনে… দুর্বল মুহূর্তে মত দিয়েছে মহেন্দ্রর মতলবে, রাজি হয়েছে ছকমাফিক নাটকে অভিনয়ে, দীর্ঘ চার বছর পরে আবার আর এক দুর্বল মুহূর্তে এই অভিশপ্ত গৃহেই স্বীকার করল সে সব কিছু, উজার করে ঢেলে দিল সঞ্চিত দুঃখ, পাপ আর অন্যায়বোধের স্তূপ… এক হতভাগ্য নির্বোধ অসুস্থ উকিলকে ফাঁদে ফেলার করুণ কাহিনি, তাকে সং সাজানোর হাস্যকর কাহিনি… না… না… আমি বিশ্বাস করি না… এক বর্ণও বিশ্বাস করি না… কখনওই করি না… সমস্ত মিথ্যে… আমার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে আগাগোড়া বানিয়ে বলেছে মায়াবিনী কুহকিনী… আমাকে ভালোবাসে না সুলতা… কস্তুরী… কোনওদিনই বাসেনি… চার বছর আগেও না… পরেও না…
‘কস্তুরী!’ তীব্র চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে উঠেছিলাম।
চোখ মুছে মাথা তুলে মুখের ওপর থেকে পেছনে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে জবাব দিলে ও, ‘আমি কস্তুরী নই।’
পর মুহূর্তেই দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত মুঠিতে টিপে ধরলাম কস্তুরীর গলা।
যেন একটা পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ নিঃসীম আক্রোশে গর্জে উঠেছিল আমার কণ্ঠে। ভয়াল দামামা বেজে উঠেছিল মস্তিষ্কের কোষে কোষে, লক্ষ লক্ষ অগ্নিশিখা নৃত্য করে উঠেছিল প্রতিটি রক্ত কণিকায়।
‘মিথ্যেবাদী… আগাগোড়া মিথ্যে বলে আসছ তুমি… কিন্তু দেখতে পাচ্ছ না, বুঝতে পারছ না, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরকাল বেসেছি— উমা দেবী, সমাধি আর তোমার ওই স্বপ্নছাওয়া পাগল করা চোখের জন্যে সেই প্রথম দিনটি থেকে তোমাকে আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবেসে এসেছি। একটা সুন্দর ফুলকে, তার সৌরভকে মানুষ যেমন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, আমার এই ভালোবাসাও তেমনি নিখাদ নির্লোভ… যেদিন থেকে তোমাকে দেখেছি, তোমাকে স্পর্শ করেছি, সেই দিন থেকেই জেনেছি, তুমিই আমার জীবনের একমাত্র নারী… আর কেউ নেই… ছিল না… থাকবে না… কস্তুরী… মনে পড়ে মিউজিয়ামে যাওয়া? বিটি রোড বরাবর গাড়ি চালানো?… দুধসাগরের পাড়ে… ফুল… গঙ্গার তীর… স্বপ্নে দেখা সেই গ্রাম… কস্তুরী। দোহাই তোমার, সত্যি বলো।’
নিথর হয়ে রইল কস্তুরী। অসীম যন্ত্রণায় গলা থেকে আঙুল সরিয়ে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে আলো জ্বেলে দিলাম।
পরক্ষণেই আমার বিকট আর্ত-চিৎকারে হোটেলের সব ক-টা ঘর খালি করে লোকজন ছুটে এল দরজার সামনে।
অনেক আগেই কান্না বন্ধ হয়ে গেছিল আমার। একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম শয্যার পানে। হাতকড়ি না থাকলেও বুকের ওপর দু-হাত ভাঁজ করে রাখতাম আমি। পুরীতে বন্ধুর কাছে লেখা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মল্লিকের চিঠিখানা সবে পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন পুলিশ ইন্সপেক্টর।
‘চলুন।’
লোক গিজগিজ করছিল ঘরের ভেতরে— কারও মুখে এতটুকু শব্দ নেই।
বিড়বিড় করে বলেছিলাম, ‘কস্তুরীর কাছে একবার যেতে পারি?’
নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিলেন ইন্সপেক্টর। মেপে মেপে পা ফেলে খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। নিষ্প্রাণ তন্বী দেহে আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ্য, মুখে অপরিসীম প্রশান্তি। ভয় হল, পাছে ওর ঘুম ভেঙে যায়। তাই আলতো করে অধরের ছোঁয়া দিলাম… আইভরির মতো শুভ্র ললাটে।
বললাম গাঢ় স্নিগ্ধ কণ্ঠে, ‘আবার দেখা হবে।’
সমাপ্ত