প্রেত-প্রেয়সী – ১.২
(২)
ঘাড়টা একটু ঘোরালেই চোখে পড়ে মহেন্দ্রকে। বক্সের কিনারায় দু-হাত ভাঁজ করে বসেছিল ও। ঠিক পিছনেই কস্তুরী। ছিপছিপে একহারা চেহারা, হাতির দাঁতের মতো ধবধবে মুখশ্রী। দূর থেকে চোখমুখ স্পষ্ট না দেখা গেলেও একটুকরো মিষ্টি রূপ যে সেখানে বসে রয়েছে, তা বুঝতে দেরি হয় না। একমাথা কালো চুলের মাঝে ফুরফুরে পাতলা মুখটি মেঘের বুকে বিদ্যুতের মতোই তীক্ষ্ণ, প্রদীপ্ত। আশ্চর্য, এমন গরিমা মাখানো আভিজাত্যে মোড়া রূপসী মেয়েকে বধূরূপে পেল কী করে মহেন্দ্র?
শুরু হল ছবি, প্রাণ পেল রুপোলি পর্দা— আমার মন কিন্তু নিমেষে অন্তর্হিত হল সেই পুরোনো দিনগুলিতে। আমি আর মহেন্দ্র দু-জনেই ছিলাম টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। লাজুক আর আড়ষ্ট। সহপাঠিনীরা ঠাট্টা করত, মুখ বুজে সহ্য করতাম দু-জনে। কাছে সরে আসতে পেরেছিলাম বোধহয় সেই কারণেই!
আর আজ?— আমি যা ছিলাম, তার চাইতে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছি। আর মহেন্দ্র…
কিন্তু এত সাহস পেল কোত্থেকে ও? আর কস্তুরী? হঠাৎ সমবেদনায় মন ভরে ওঠে আমার। মনে হল, যেন একটা অদৃশ্য প্রাচীরের একদিকে রয়েছে মহেন্দ্র। অপরদিকে আমি আর কস্তুরী।
আচ্ছা, সি ভিউ হোটেলে যদি মহেন্দ্রের বদলে আমার সঙ্গেই আলাপ হত কস্তুরীর? সারি সারি সুখময় কল্পনা ভেসে ওঠে মনের পটে… একসঙ্গে খাওয়া… বেড়ানো… হাত ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা…
চোখ খুলে নড়েচড়ে বসলাম কুশন-আঁটা চেয়ারে। হল ছেড়ে এখুনি বেরিয়ে পড়তে পারলে ভালো হত। কিন্তু সে সাহসও আমার নেই। এতগুলো লোককে বিরক্ত করে বেরোনোর চাইতে বরং… ঘাড় ফেরাতেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই চোখের কোণ দিয়ে দেখি, একইভাবে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো স্থির হয়ে বসে রয়েছে কস্তুরী। আলো চমকাচ্ছে কান আর গলার রত্নখচিত আভরণে। বুঝি চোখেও। মাথা কাত করে নিষ্কম্প দেহে বসেছিল যেন পাথরের ভেনাস। ভারী খোঁপাটা রয়েছে একদিকে কাঁধের ওপর— পিঠের ওপর নয়। বিচিত্র ফ্যাশন!
ঘাড়টা বোধ করি একটু বেশিই ঘুরিয়ে ফেলেছিলাম। পাশের ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে তাকাতেই এতটুকু হয়ে গেলাম আমি। আর না, এবার বেরোতে পারলেই বাঁচি।
আচ্ছা, যে মেয়ে বিয়ে করে অসুখী, সে যদি সুখের সন্ধানে অন্য প্রণয়ী খোঁজে তাতে দোষের কী? কস্তুরীর কাছেও হয়তো এটা একটা ব্যসন। তা-ই যদি হয়, তাহলে… ভাবতেই মনটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে।
আগের মতোই রোশনাই ছড়াচ্ছে কস্তুরীর রত্নখচিত ইয়ার রিং। যেন একটি অপরূপ সুন্দর ফোটোগ্রাফ। অভাব শুধু এককোণে একটি স্বাক্ষরের। মনের চোখে এবার সইটাকেও দেখতে পাই দুর্লভ সামন্ত।
নাঃ, বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মনকে আমি বাঁধি কী করে? পেরেছি কি সেই ঢালু ছাদ, ভিজে টালি আর অনেক নীচে যানবাহনের গুমগুম ধ্বনিকে ভুলতে? অস্থির হয়ে ওঠে আঙুলগুলো— অনেকটা মহেন্দ্রের মতোই।…
মনের অলিন্দে আনাগোনা করল আরও কত লাগামছেঁড়া উদ্ভট চিন্তা। তারপরেই দপ করে জ্বলে উঠল আলো। ছবি শেষ।
ভিড়ের মধ্যে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছলাম দরজার কাছে। সিঁড়িতে লোক জমে গেছে। বক্স থেকে বেরিয়ে এল সস্ত্রীক মহেন্দ্র। কস্তুরীর একদম গা ঘেঁষে এগিয়ে গেলাম আমি। খুব কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম চোখ-মুখ-কান-নাক।
ব্ল্যাক আউট রাত। যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা। অন্ধকারের ঘোমটা নামিয়ে ভয়ার্ত নগরী অপেক্ষা করছে শত্রুপক্ষের বিমান বহরের। মাথা নিচু করে হেঁটে চললাম আমি।
কস্তুরী— মৃগনাভির মতোই যার সৌরভ শত যোজন দূর থেকে আকুল করে তোলে সৌন্দর্যপিয়াসীর হিয়াকে। যার ভ্রমরকৃষ্ণ চাহনিতে মেঘ-মল্লারের সব মিড়গুলো আর্ত হয়ে ওঠে পথহারা— সেই কস্তুরী সত্যই কি মহেন্দ্রের স্থূল সাহচর্যে সুখী হতে পেরেছে? এমন মেয়ের পেছনে ফেউয়ের মতো না লেগে থেকে যদি পারতাম হাতে হাত দিয়ে—
কিন্তু এ কী! আবার সেই চিন্তা! শেষে কি বিশ্বাসহন্তার মতো বন্ধুস্ত্রীর প্রেমে ডুবতে হবে!
মন খারাপ হয়ে যায় বিরক্তি আর গ্লানিতে। দ্রুত পা চালাই ফ্ল্যাটের দিকে।
নাঃ, কালকেই মহেন্দ্রকে ফোনে জানিয়ে দিতে হবে, এ কাজ আমার দ্বারা হবে না। পনেরো বছর যার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই ছিল না, তার কাসুন্দি ঘাঁটতে গিয়ে খামোকা অশান্তি ডেকে আনতে আমি চাই না।
ভালো ঘুম হল না রাত্রে। সকালে উঠেই মনে পড়ল আজ কস্তুরীর পিছু নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে হালকা হয়ে যায় মনটা। এ কী বিপদ! কিছুতেই কি রেহাই নেই এই উটকো চিন্তার খপ্পর থেকে? জোর করে ঘুরিয়ে দিলাম রেডিয়োর নবটা। যুদ্ধের খবর। সারা পৃথিবীতে বাজছে রণদামামা। টুথব্রাশ নিয়ে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে।
দুপুরেই হাজির হলাম মহেন্দ্রের প্রাসাদপ্রতিম বাড়ির সামনে। ব্যাফেল ওয়ালের গা ঘেঁষে বেঞ্চি পেতে চা-রসের দোকান খুলেছিল এক উড়িয়ানন্দন। একটি ভাঁড়ের অর্ডার দিয়ে চোখের সামনে কাগজ মেলে বসে পড়লাম আমি।
কিছুক্ষণ পরেই গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল কালো গাড়িটা। মহেন্দ্র নেই। এবার আসবে কস্তুরী।
কিন্তু সে যে আজকে আসবেই, তা আমি জানছি কী করে? উত্তরে, মন বলে উঠল, হ্যাঁ, সে আসবে। আসবে শুধু আমার জন্যেই। সূর্যের আলোয় নীলার মতো জ্বলন্ত এই ঘাসপাতা মাড়িয়ে আসবে সে আমারই সামনে।
তারপরেই, আচমকা দেখলাম তাকে। মার্বেলের সিঁড়ির ওপর মার্বেল সুন্দরীর মতোই দাঁড়িয়ে আছে সে। মরকতমণির মতো উজ্জ্বল একটা শাড়ি একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘিরে রয়েছে দেহবল্লরীকে।
ইচ্ছে হল, তুলির কয়েক টানে ধরে রাখি সেই অপরূপ মূর্তি। কিন্তু হায়রে, সেখানেও আমি অক্ষম। প্রথম যৌবনে নিছক খেয়ালের বশে এঁকেছিলাম কয়েকটি ছবি। বন্ধুরা তা দেখে যা মন্তব্য করেছিল, তা জীবনে ভুলবার নয়।
ছোট ছোট পা ফেলে নেমে এল কস্তুরী। খুট করে দরজা খুলে উঠে পড়ল স্টিয়ারিং হুইলের সামনে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন।
অদূরে দাঁড় করানো আমার মরিস মাইনরে উঠে বসলাম আমি। শুরু হল পিছু নেওয়া।
কালো গাড়ির যেন কোনও তাড়াই নেই। ধীরে সুস্থে এসে পৌঁছল ময়দানের পাশে, সেখান থেকে মিউজিয়ামের সামনে।
নেমে দাঁড়াল কস্তুরী। দরজা বন্ধ করে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল প্রবেশ পথের দিকে। যেন দ্বিধায় পড়েছে সে, যাব কি যাব না। একবার এক-পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে এল। বেশ কিছু দূরে গাড়ি থামিয়ে সকৌতুকে দেখতে লাগলাম মরকতমূর্তির দোনামোনা মনোভাব। তারপর মনস্থির করে ফেলল কস্তুরী। আবার স্টিয়ারিং হুইলের সামনে বসে স্টার্ট দিল গাড়িতে। নিশ্চয় মিউজিয়াম দেখার চাইতেও মূল্যবান কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে পড়েছে।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আগের চাইতে দ্রুত ড্রাইভ করছে কস্তুরী। হঠাৎ যেন কীসের আকর্ষণে বেগবান হয়ে উঠেছে ওর মন, তাই আর তর সইছে না। সমান গতিতে পেছনে ছুটে চলল মরিস মাইনর।
নগরীর সীমা ছাড়িয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল সামনের কালো গাড়িখানা।
মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ড দেখেই জায়গাটার নাম জানলাম— ঘোষপাড়া।
মহেন্দ্রের মুখে শোনা কাহিনিটা মনে পড়ে গেল। শুধু কাহিনি না বলে কিংবদন্তিই বলা উচিত। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদের লীলাভূমি এই ঘোষপাড়া। যেখানকার হিমসাগর দিঘির মাটি ছুঁইয়ে ‘সতীমা’-কে আবার বাঁচিয়ে তুলেছিলেন তিনি, সেই পুণ্যভূমিতেই প্রবেশ করেছে কস্তুরীর প্রকাণ্ড কালো গাড়ি।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল কস্তুরী। মরকত রঙের শাড়িখানা হাওয়ায় উড়ছিল অল্প অল্প। কাঁধের ওপর বিচিত্র কায়দায় হেলানো কবরী থেকে কয়েকটি চুল খুলে এসে উড়ছিল মুখের দু-পাশে। অনন্যমনা হয়ে হাঁটছিল ও। সহজ গতিতে ওর পথ চলার ধরন দেখে মনে হল যেন রাস্তায় প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি খোয়া আর গর্তের সঙ্গে ওর অনেক দিনের পরিচয়।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ ঝিকমিক করে উঠল জলের ওপর সূর্যের রোশনাই। এক নক্ষত্র শত নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে হিমসাগরের জলের আয়নায়। কস্তুরী কিন্তু দিঘির পাড়ে গেল না। এগিয়ে এল ঝোপঝাড় থেকে বিচ্ছিন্ন একটা কুঞ্জের দিকে।
এককালে যা কুঞ্জ ছিল, আজ তা অযত্নে ঝোপেরই সামিল হয়ে উঠেছে। ফুলবনের সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছে আগাছার জঙ্গল। এরই মধ্যে একটা ক্ষীণ পায়ে চলা পথ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল কস্তুরী।
কখনও গাছের আড়ালে, কখনও ঝোপের আড়ালে থেকে একবারও চোখের আড়াল করিনি সামনের মূর্তিকে। দুর্নিবার হয়ে উঠেছিল কৌতূহল। শহরের মেয়ে শহর থেকে এত দূরে এসে এমন সহজ ভঙ্গিতে ঝোপের মধ্যে যখন অন্তর্হিত হয়েছে, তখন আমার অনুমানই ঠিক। প্রিয় মিলনেই এতদূর ছুটে এসেছে কস্তুরী।
এ অবস্থায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকাই উচিত। কিন্তু না, দেখে যেতে হবে, নিজের চোখে দেখে যেতে হবে মাকড়শার মতো কোন রহস্যের জাল বুনে চলেছে বন্ধুবরের রূপসী ভার্যা।
সন্তর্পণে উঁকি দিলাম। ওই তো বসে রয়েছে কস্তুরী। একা, আর তো কেউ নেই কুঞ্জের মধ্যে। চারধারে বৃত্তাকারের ফুলঝোপের ঠিক কেন্দ্রে একটা জীর্ণ সমাধি। চুনবালির পলস্তারা খসে গিয়ে অনেক জায়গায় বেরিয়ে পড়ছে পাতলা পাতলা সেকেলে বাংলা ইটের গাঁথনি। মানুষ-প্রমাণ উঁচু এই প্রাচীন সমাধির ভেতরে একটা চ্যাটালো পাথরের ওপর বড় বড় অক্ষরে তেল-সিঁদুরে লেখা—
উমা দেবী
ঘাসের ওপর হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে স্থির হয়ে বসেছিল কস্তুরী। দৃষ্টি ঘাসের ওপর। নিষ্পাপ সেই দেহের মধ্যে প্রাণ আছে বলে মনে হয় না।
অনেক… অনেকক্ষণ এইভাবে বসে রইল কস্তুরী। তারপর একটা মস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকালে সামনের সমাধির পানে। হাতের মুঠি খুলে ঝোপ থেকে তুলে আনা কয়েকটি ফুল সমাধির প্রান্তে রেখে উঠে দাঁড়াল।
সরে এলাম আমি। অভিভূতের মতো পালিয়ে এসে গা-ঢাকা দিলাম একটা জামগাছের আড়ালে। মহেন্দ্রের মুখে শোনা রোমাঞ্চকর কাহিনির পটভূমিকায় দেখা এই দৃশ্য যেন সাময়িকভাবে আমার চিন্তাশক্তিকেও অবশ করে তুলেছিল। অদ্ভুত ওর বসে থাকার ভঙ্গিমা। এ যেন প্রিয়জনের সমাধির সামনে বসে থাকা নয়, দীর্ঘদিন দূরে থাকার পর স্বগৃহে ফিরে এসে আত্মবিভোর হয়ে যাওয়া। সত্যই আশ্চর্য কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে কস্তুরীর সৃষ্টিছাড়া ধরনধারণের মধ্যে।
ওই তো বেরিয়ে আসছে কস্তুরী। হাতে একটা ফুল… রক্তগোলাপ… পাতাসমেত ফুলটাকে গালের কাছে ধরে মাটির দিক চোখ নামিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে হিমসাগর দিঘির দিকে। অল্প অল্প হাওয়ায় চূর্ণকুন্তল এলিয়ে পড়ছে কাশ্মীরি আপেলের মতো কপালে। যন্ত্রমানুষের মতোই দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়াল কস্তুরী। কিছুক্ষণ আপন-মনে অত্যন্ত মন্থর চরণে পায়চারি করল… পাড়-বরাবর এদিক থেকে ওদিকে— আবার ওদিক থেকে এদিকে। তারপর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জলের দিকে তাকিয়ে। ঘড়ি দেখলাম— পাঁচ মিনিট। সমাধির সামনেও এমনিভাবে পুরো বারো মিনিট বসে ছিল সে। হঠাৎ একটু ঝুঁকে পড়ল কস্তুরী। ক্লান্তি, না কারও প্রতীক্ষায় থাকার অসহিষ্ণুতা?… রক্তগোলাপটাকে চোখের সামনে ধরল… আবার তাকাল জলের পানে… লক্ষ সূর্য জ্বলছে দিঘির জলে… ঠিকরে পড়া আলো ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলছে কস্তুরীর হাতির দাঁতের মতো ধবধবে সাদা মুখের ওপর… আঁটসাট পরিধেয়র মধ্যে দিয়ে উদ্ধত হয়ে উঠেছে ওর যৌবনশ্রী… রামধনুর মতো ঝলমল করছে মরকত শাড়ি… রক্তগোলাপের একটি একটি পাপড়ি ছিঁড়ে দিঘির জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে কস্তুরী। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুলে দুলে ওঠা পাপড়িগুলোর দিকে। ভালো করে দেখার জন্যে এগিয়ে গেলাম… হাত দশেক দূরেই উড়ছে কস্তুরীর শাড়ির অঞ্চল। কিন্তু আশ্চর্য, তবুও তন্ময়তা ভাঙল না ভাববিহ্বল সেই নারী-মূর্তির। এবার পাতাগুলিও উড়ে গিয়ে পড়ল হিমসাগরের জলে… খুব কাছে দাঁড়িয়েছিলাম… তাই স্পষ্ট দেখতে পেলাম সুচারু অধরের প্রান্তে কুয়াশা-ঢাকা পঞ্চমীর চাঁদের মতো ম্লান হাসিটুকু।
পিছিয়ে এলাম আমি। ফিরে আসছে কস্তুরী। একই রকম অলস চলনভঙ্গি। তাড়াহুড়োর লেশমাত্র নেই। আশ্চর্য এই ভাবের ধ্যান। এ-ধ্যানের রহস্য আমাকে জানতে হবেই।
শ্যামবাজারের মোড়ে একটা রেস্তরাঁ থেকে ফোন করলাম মহেন্দ্রকে।
‘হ্যালো! মহেন্দ্র? দুর্লভ কথা বলছি— মিনিট খানেক সময় ব্যয় করবে আমার জন্যে?— না, না, আমিই যাচ্ছি তোমার অফিসে… কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই… ঠিক আছে, এই এলাম বলে।’
অফিস দেখে তাক লেগে গেল। একটা পেল্লায় বাড়ির পুরো একতলায় উগ্র সাহেবী কায়দায় সাজানো অফিস। আয়নার মতো ঝকঝকে ফ্লাশ-ডোরের ওদিকে ততোধিক চকচকে একটি প্রাণোচ্ছল তরুণ বসেছিল। মহেন্দ্রর খোঁজ করতেই বলে উঠল, ‘আপনাকে তো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে— উনি এখন কনফারেন্সে।’
সুসজ্জিত ওয়েটিংরুমে পালকের মতো নরম কুশনে গা এলিয়ে দিলাম। একটু পরে কাচের ভেতর দিয়ে দেখলাম, হোমরা-চোমরা কয়েকজন পুরুষকে নিয়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল মহেন্দ্র।
ফিরে এল একটু পরেই। রিসেপসনিস্ট-এর সামনে উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে গম্ভীর মুখে বললে, ‘এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্যে দুঃখিত। বড় ব্যস্ত ছিলাম আজ। এসো, আমার কামরায়।’
নিখুঁতভাবে মার্কিনি কায়দায় সাজানো মহেন্দ্রর ঘর। ফাইলিং, ক্যাবিনেট, ইস্পাতের নলচে-চেয়ার, ক্রোমিয়াম পেডেস্ট্যালের ওপর ছাইদানি আর ঘরের দেওয়ালে একটা প্রকাণ্ড ভারতবর্ষের ম্যাপ। পাশে বোর্ডের ওপর ব্যবসা বৃদ্ধির গ্রাফ।
‘দেখা হল কস্তুরীর সঙ্গে?’
‘পিছু নিয়েছিলাম।’
‘কী কী দেখলে?’
‘সমাধির সামনে গিয়ে বসেছিল।’
‘ঘোষপাড়া? যাঁর কথা তোমায় বলেছি, তাঁরই সমাধিতে…’
‘হ্যাঁ।’
‘দেখলে তো!… বলেছিলাম না তোমাকে?’
অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিলের একপ্রান্তে দুগ্ধধবল টেলিফোনের ঠিক প্রান্তেই রুপোর ফ্রেমে বাঁধানো কস্তুরীর ছবিটার পানে তাকিয়ে ছিলাম আমি। ছবির ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই শুধোলাম, ‘সমাধির ওপর শুধু একটা নামই দেখলাম। পূর্বপুরুষরা—’
‘তাঁদের সমাধি ওই অঞ্চলেই আছে, তবে অন্যত্র। কী রকম মনে হল তোমার? ভাবগতিক দেখে অলৌকিক সন্দেহ হচ্ছে নাকি? তা ছাড়া ও জায়গায় যে ওর এই প্রথম যাওয়া নয়, তা নিশ্চয় বুঝেছ?’
‘রকমসকম দেখে তো তাই মনে হল। কাউকে পথঘাটের হদিশ জিজ্ঞেস না করেই যেতে দেখলাম। অন্যমনস্ক ছিল আগাগোড়া, তবুও কোথায় যেতে হবে সে-সম্বন্ধে জ্ঞানটা টনটনে ছিল বলেই মনে হল আমার।’
‘ঠিকই মনে হয়েছে তোমার। ওকে উমা দেবীতে পেয়েছে।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটু পায়চারি করে নিল মহেন্দ্র। চর্বির দলা ঠেলে উঠল কড়া ইস্ত্রি-করা কলারের ওপর। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠতেই বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় রিসিভারটা তুলে নিয়ে হাত দিয়ে মাউথপিসটা চাপা দিয়ে বললে, ‘কস্তুরীর ধারণা ও নাকি উমা দেবী। কাজেই কেন আমার এত উদ্বেগ, তা নিশ্চয় বুঝতে পারবে এবার।’
চাপা-গলা শোনা গেল ইয়ার ফোনে। চট করে মাউথপিসটা মুখের কাছে তুলে বললে মহেন্দ্র, ‘হ্যালো… স্পিকিং…’
একদৃষ্টে আমি তাকিয়ে রইলাম কস্তুরীর ছবির পানে। পাথরের মূর্তির মতো মুখ, চোখের তারায় জীবনের রং আছে কি নেই, তা বোঝা ভার। দমাস করে রিসিভার রেখে দিল মহেন্দ্র। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার— না এলেই ভালো হত। মনে হল, কস্তুরীর রহস্য শুধু কস্তুরীকে ঘিরে থাকলেই ভালো ছিল। মহেন্দ্র যেন আরও জলটা ঘুলিয়ে দিতে চাইছে। অদ্ভুত একটা আইডিয়া মাথায় আসে। ধরা যাক, উমা দেবীর আত্মা—
রাগত সুরে বলে মহেন্দ্র, ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের মতো মরছি, তার ওপর যত্ত ঝামেলা—’
‘বিয়ের আগে তোমার স্ত্রীর পদবী কী ছিল?’
‘সেন। কস্তুরী সেন। শ্বশুরমশাই কোটিপতি— এই সেদিন মারা গেলেন। অনেকগুলো পেপার মিলের মালিক ছিলেন। আদি ব্যবসা পত্তন করেছিলেন ওর ঠাকুরদা। উনি ঘোষপাড়া থেকেই এসেছিলেন বোম্বাইতে ভাগ্যান্বেষণে।’
‘কিন্তু তোমার স্ত্রী হোটেলে থাকতেন?’
টেবিলের ওপর ব্লটার দিয়ে টরেটক্কা করতে করতে মহেন্দ্র বলল, ‘শখ হয়েছিল বলে… আমার শাশুড়ি কিন্তু একদিন চিতপুরে পাথুরিয়াঘাটার কাছে একটা পুরোনো বাড়ি দেখিয়ে বলেছিলেন, উমা দেবী নাকি এককালে এখানে থাকতেন… একতলায় একটা কিউরিও শপ আছে… যাকগে সে কথা, কস্তুরীকে আজ দেখে তোমার কী মনে হল বলো।’
হাত উলটে দুর্লভ বলল, ‘বলার মতো কিছু নেই।’
‘কিন্তু ওর ধরনধারণ যে স্বাভাবিক নয়, তা তো মানো?’
‘মনে হয়… আচ্ছা, ছবি আঁকা কি উনি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন?’
‘একদম। স্টুডিয়োর যা ছিরি হয়েছে, পা ফেলা যায় না।’
‘কেন?’
‘কী কেন?’
‘ছবি আঁকা ছাড়লেন কেন?’
‘কী করে তা বলি?… অবশ্য ওর মাথা আছে, ছবি আঁকা ছাড়াও আরও অনেক গুণ ভগবান ওকে দিয়েছেন… তা ছাড়া বিয়ের পর মেয়েদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে তো—’
উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘আর নয়, অনেকটা সময় নষ্ট করলে আমার জন্যে।’
‘না, না, সে কী কথা, অমনভাবে কথা বোলো না। কস্তুরীর এই অবস্থা, আর আমার সময়… আচ্ছা, অনেস্টলি বলো তো, কস্তুরীকে উন্মাদ বলে মনে হয় কি?’
‘মোটেই তা নয়। খুব পড়াশুনার বাই আছে কি ওঁর?’
‘না। তুমি যেরকম বলছ, সেরকম নয়। মাঝে মাঝে সময় কাটানোর জন্যে দু-চারটে হালকা পপুলার ম্যাগাজিন পড়ুয়া সব ঘরেই পাওয়া যায়।’
‘বিশেষ কোনও হবি?’
‘তেমন কিছু মনে পড়ছে না।’
‘ঠিক আছে। দেখি কী করতে পারি।’
‘মনে হচ্ছে, তোমার উৎসাহ কমে এসেছে?’
‘কেন জানি না, বারবার মনে হচ্ছে মিছিমিছি সময় নষ্ট করছি আমি।’
আসল কথাটা চেপে গেলাম। মনে মনে যে হপ্তার পর হপ্তা কস্তুরীকে ধাওয়া করার সংকল্প গ্রহণ করেছি, তা আর মহেন্দ্রকে জানানো দরকার মনে করলাম না। এ রহস্যের কিনারা করা না পর্যন্ত শান্তি পাব না আমি, কিন্তু সেকথা বলে লাভ কী?
মহেন্দ্র বলল, ‘এ ঝামেলায় তোমাকে টেনে আনার জন্যে আমি কুণ্ঠিত। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ, আমার অবস্থাটা। যাক, নতুন খবরটবর পেলে টেলিফোন কোরো।’
‘করব।’
রাস্তায় বিকেল ছ-টায় ভিড় শুরু হয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে কেরানিকুল ছুটেছে নিজের নিজের সুইট হোমের দিকে। হোম নেই শুধু আমার… হয়তো একটা আছে… কিন্তু তাকে সুইট বলা চলে না কোনওমতেই… কস্তুরী… কস্তুরী… কস্তুরী… একটা শরবতের দোকানে বসে পড়ে লস্যির অর্ডার দিলাম… উমা দেবীর সমাধির সামনে স্বপ্ন দেখছে কস্তুরী… বাড়ির জন্যে, মন কেমন করছে! বাড়ির জন্যে না, ওই সমাধির জন্যে! না, না, এসব কী অবাস্তব কথা ভাবছি আমি। কিন্তু কোনটা অসম্ভব, আর কোনটা সম্ভব, তা-ই বা সঠিক জানছে কে?
ফ্ল্যাটে ফিরলাম অনেক রাতে। রগের দু-পাশে টিপটিপ করছে। খাওয়ার পাট হোটেলেই চুকিয়ে এসেছিলাম। তাই জুতোসুদ্ধই কিছুক্ষণ চিৎপাত হয়ে শুয়ে রইলাম বিছানায়। তারপর উঠে পড়ে জামাকাপড় পালটে অ্যাসপিরিনের বড়ি গিলে নিভিয়ে দিলাম আলোটা।