প্রেত-প্রেয়সী – ১.৩
(৩)
বর্ধমানের মহারাজার প্রাসাদ পেরিয়ে গেল কস্তুরী। বেয়নেটধারী ভোজপুরী দারোয়ান বারেক ফিরে তাকাল ওর সুঠাম দেহের দিকে। কস্তুরীর কিন্তু কোনও দিকে দৃষ্টি নেই। আজ কিন্তু গাড়িতে নয়, হেঁটে। অস্বাভাবিক দ্রুত হাঁটছিল ও। যেন জরুরি এনগেজমেন্ট রক্ষা করার জন্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ও চলেছে কোথায়? আজকে একেবারেই অন্যভাবে সেজেছে কস্তুরী। আঁটসাট যৌবনোদ্ধত পোশাকের বদলে সাদাসিধে বাদামি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গ। সাপের মতো বেণী এলিয়ে পড়েছে পিঠের ওপর।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কস্তুরী। মাথা নিচু করে কী ভাবলে। তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল সামনে। কোনও দ্বিধা না করে উঠে পড়ল সামনের ট্যাক্সিটায়।
স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক পেছনের ট্যাক্সিটায় উঠে বসলাম আমি।
চিতপুরের একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সামনের ট্যাক্সিটা। এই বাড়িটার কথাই মহেন্দ্র বলেছিল না? ওই তো একতলায় কিউরিও শপ রয়েছে। কোনওরকম ইতস্তত না করে সিধে ভেতরে ঢুকে গেল কস্তুরী। মহেন্দ্রর বর্ণনার সঙ্গে শুধু একটি জিনিস মিলল না। একতলা বাদে দোতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত সবটাই একটা হোটেল। বড় বড় বাংলা অক্ষরে লেখা:
‘পরিবার বাসা’
বাইরে থেকে দেখে যা মনে হল খানদশেকের বেশি ঘর নেই ‘পরিবার বাসা’-য়। অফিসে ঢুকে পড়ি আমি। থান পরনে একজন মোটাসোটা বিধবা মহিলা বসে উল বুনছিল।
ভণিতা না করে বলে উঠি, ‘ঘর নিতে আসিনি। এইমাত্র যে ভদ্রমহিলাটি ভেতরে গেলেন, তাঁর নাম কী?’
‘কে আপনি?’
পকেট থেকে একটা পুরোনো আইডেন্টিটি কার্ড বার করে এগিয়ে দিলাম। ডিটেকটিভ থাকাকালীন এই কার্ডটি যত কাজে না-লাগুক, এখন তা লাগল। পুরোনো পাইপ, কাগজ, বিলের সঙ্গে কার্ডটিও রেখে দিয়েছিলাম মানিব্যাগে। কোনও দরকারে আসবে না জেনেও কেন জানি এরকম বহু পুরোনো জিনিসকে ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু এই নির্বোধ অভ্যাসই আজ অনেক সহজ করে তুললে আমার গোপন তদন্তকে।
চোখ তুলে বললে বিধবা, ‘কস্তুরী কৌশিক।’
‘নিশ্চয় এই প্রথমবার দেখছেন না ওঁকে?’
‘প্রায়ই আসেন উনি।’
‘কারও সঙ্গে দেখা করতে আসেন কি?’
‘উনি ভদ্রঘরের মেয়ে।’
‘বন্ধু-বান্ধব, অথবা অন্য কেউই কি ওঁর সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসেন না?’
‘না। আজ পর্যন্ত আপনি ছাড়া আর কেউ আসেনি।’
‘তাহলে এখানে উনি করেন কী?’
‘জানি না; ও কাজ আমার নয়।’
‘ওঁর ঘরের নাম্বার কত?’
‘উনিশ। তিনতলা।’
‘এ হোটেলের সব চাইতে ভালো ঘর নিশ্চয়?’
‘না; তবে ভালো ভালো ফার্নিচার আছে। বারো নম্বর ঘর দিতে চেয়েছিলাম, উনি নেননি। ওই ঘরটিই উনি চান।’
‘কেন?’
‘তা বলেননি। খুব সম্ভব ঘরটার বেশি রোদ্দুর পড়ে— তাই।’
‘পার্মানেন্টলি নিয়েছেন নিশ্চয়?’
‘একমাসের জন্য নিয়েছেন।’
‘কবে এসেছেন?’
উলের কাঁটা টেবিলের ওপর রেখে রেজিস্টারের পাতা ওলটালে বিধবা মহিলা।
‘হপ্তা তিনেক হল বলেই তো মনে হয়। হ্যাঁ, এই তো ৬ এপ্রিল।’
কতক্ষণ থাকেন ঘরের মধ্যে? অনেকক্ষণ নিশ্চয়?’
‘কখনও ঘণ্টাখাটেক, কখনও ঘণ্টাদুয়েক।’
‘সঙ্গে মালপত্র আছে তো?’
‘না, কোনও লাগেজ নেই।’
‘নিশ্চয়ই প্রতিদিন আসেন না, তা-ই না?’
‘না, হপ্তায় দু-দিন কি তিনদিন।’
‘ভদ্রমহিলার হাবভাব একটু অদ্ভুত নয় কি? এ সম্বন্ধে কিছু ভেবেছেন এর আগে?’
কপালের ওপর সুতো বাঁধা চশমাটা ঠেলে তুলে দিয়ে প্রৌঢ়া চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, ‘পাঁচরকম লোক এখানে আসছে তো, ওরকম খাপছাড়া স্বভাব সবারই একটু-আধটু থাকে। হোটেলে কাজ করলে এরকম প্রশ্ন করতেই পারতেন না।’
‘আপনাদের টেলিফোন আছে দেখছি। উনি ফোন করেন কাউকে?’
‘না।’
‘ফোন আসে না?’
‘না।’
‘কত বছর হল হোটেল বানানো হয়েছে এ-বাড়িতে, তা জানেন কি?’
‘জানি। বছর পঞ্চাশ হল।’
‘তার আগে?’
‘গেরস্থবাড়ি ছিল। অন্তত আমার তো তা-ই মনে হয়।’
‘উমা দেবী বলে কারও নাম শুনেছেন কি?’
‘না। রেজিস্টার দেখব কি?’
‘দরকার নেই।’
ভাবলেশহীন মুখে আবার উলের কাঁটার দিকে চোখ নামাল বিধবা প্রৌঢ়া। আর আমি সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
তিনতলার এই বিশেষ ঘরটিতে কীসের সন্ধান পেয়েছে কস্তুরী? কী আছে ও-ঘরে? উমা দেবীর শোবার ঘর ছিল কি? কোন রহস্যময় আকর্ষণে এত দূরে এই বিশেষ বাড়ির বিশেষ ঘরটিতে এসে উঠেছে কস্তুরী কৌশিক? অনেক কথাই ভিড় করে এল মনে… অতীন্দ্রিয় শক্তি নয় তো?
ফুটপাতের ভিড়ের মধ্যে আপন মনে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। কস্তুরী নেমে এসেছে রাস্তায়। প্রায় আধঘণ্টার মতো হোটেলে ছিল ও। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চোখে পড়ল একটা ট্যাক্সি। সঙ্গে সঙ্গে হাতের ইঙ্গিতে ট্যাক্সি থামিয়ে উঠে পড়ল ভেতরে।
চিতপুরের মতো রাস্তায় চাইলেই তো আর ট্যাক্সি পাওয়া না। কিন্তু আমার কপাল ভালো। ঠিক পেছনেই আর একটা খালি ট্যাক্সি। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলাম ভেতরে।
ভাঙাচোরা লোহালক্কড়ের স্তূপের পাশে দাঁড়াল সামনের ট্যাক্সি। নেমে দাঁড়াল কস্তুরী। অলস মন্থর চরণে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনে। স্তূপীকৃত মরচে-ধরা লোহা, পাইপ আর নোঙরের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে এমন এলোমেলোভাবে হাঁটতে লাগল যেন গন্তব্যস্থান কী, তা-ই সে জানে না। যেন নিছক বেড়ানোই উদ্দেশ্য— আর কিছু নয়। চিতপুরের জনবহুল অঞ্চলের হোটেল ‘পরিবার বাসা’ আর গঙ্গার ধারের এই জনবিরল অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্রটা যে কোথায়, তা-ই ভেবে পেলাম না। ইচ্ছে হল, কস্তুরীকে পেরিয়ে যাই। কোনও কথা নয়, আলাপ নয়, শুধু হেঁটে যাই পাশাপাশি। কথার দরকার কি, নদীর বুকে ভাসমান বয়াগুলোর ওপর চোখ রেখে পাশাপাশি হাঁটুক দুটি নির্বাক মূর্তি। কিন্তু না, তা সম্ভব নয়। কাজেই এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভনকে সামাল দেওয়ার জন্যেই একেবারেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। অনেকখানি এগিয়ে গেছে কস্তুরী। মনে হল বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু পিছু নেওয়ার মধ্যে এমন একটা মাদকতা আছে, যা শুরু করলে আর শেষ করা যায় না। তাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আরও সামনে।
কোথাও জড়ো করা রয়েছে দড়ির গাদা, কোথাও ভাঙা ইট। কোথাও খোয়া, কোথাও বালি, কোথাও পিপে, আবার কোথাও ভাঙা প্যাকিং কেস। মরচে ধরা রেললাইনও দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে… ওদিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে একটা ক্রেন… গঙ্গার ওপারে জুটমিলের চিমনি দেখা যাচ্ছে… বিষন্ন এই শহরতলীতে কীসের আকর্ষণে ছুটে এল কস্তুরী? আমরা দু-জন ছাড়া আর কেউ নেই এদিকে। কিছুই খেয়াল নেই কস্তুরীর— আপন মনে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। আমাকে লক্ষ করা তো দূরের কথা, আমার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সজাগ থাকারও কোনও লক্ষণ দেখা গেল না ওর চলাফেরায়।
একটু একটু করে একটা অস্পষ্ট ভয় ঘিরে ধরে আমাকে। নদীর ধারে হাওয়া খেতে আসেনি কস্তুরী। বিকৃত মস্তিষ্করা যেভাবে সব কিছুর সান্নিধ্য ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে চায় অনেক দূরে— এ কি তবে তা-ই? না, নিছক স্মৃতিহীনতার ঘোর? আবার জোরে জোরে পা চালাই আমি।
একটা নিরালা গুদোমের দিকে এগিয়ে চলেছে কস্তুরী। ইটের গাঁথনির ওপরে টিনের শেড… সামনে একটা ছোট ঘর, সম্ভবত দারোয়ানের আস্তানা। বড় বড় কতকগুলো প্যাকিং-কেস পড়েছিল সামনে। একটার ওপর বসে পড়ল কস্তুরী।
একটু দূরে কয়েকটা বড় পিপের আড়ালে থেকে সজাগ দৃষ্টি মেলে রইলাম আমি। কী জানি কেন, এক মুহূর্তের জন্যেও ওই অদ্ভুত মেয়েটি ওপর থেকে নজর সরিয়ে আনার সাহস হল না আমার।
হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করল কস্তুরী। হাতের উলটো পিঠ বুলিয়ে দেখে নিলে প্যাকিং-কেসের ওপরটা ভিজে কি শুকনো। তারপর ফাউন্টেন পেন বার করে ঝুঁকে পড়ল কাগজের ওপর। সামান্য আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুঠাম দেহবল্লবী।
ভাবলাম, এই হল প্রিয়তমের জন্য শবরীর প্রতীক্ষা।
নিছক অনুমান। কতটুকুই বা তার মূল্য। দয়িতকে চিঠি লেখার দরকার হলে এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে এতদূরে আসার কোনও প্রয়োজন আছে কি? এমন গোপনীয় চিঠি তো বাড়ির মধ্যেই পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে লেখা যেত— গঙ্গার এই বিজন তীরে আসার দরকারটা কী?
সমানে লিখে চলেছে কস্তুরী। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে ঝরনা-কলম। সমস্ত চিঠিটাই যেন মনে মনে আগে থেকেই সাজিয়ে নিয়েছে ও; চিতপুরের হোটেলে আধঘণ্টা কেটেছে হয়তো এই চিঠির বিষয় ভাবতেই।
আবার অনুমান! কী মুশকিল, অনুমান ছাড়া তো আঁকড়ে ধরার মতোও কিছু নেই। আচ্ছা, মহেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক-ছেদের সূচনা নয় তো? বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথম অধ্যায়?… তাহলে অবশ্য ওর এই অস্থির মনের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু পাওয়া যায় না উমা দেবীর সমাধি দর্শনের কোনও মোটিভ।
দারোয়ানের ছোট্ট ঘর থেকে তখনও কেউ বাইরে এল না। হয়তো কেউ নেই ভেতরে— থাকলেও নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত!
চিঠিটা সন্তর্পণে ভাঁজ করল কস্তুরী; ধীরেসুস্থে খামের মধ্যে ভরে ফেলল। এবার কী করবে ও? যে-পথে এসেছে, সেই পথেই ফিরবে নিশ্চয়। খামের ওপর ঠিকানা লেখা হয়ে গেল ওর। জিভ বুলিয়ে মুখটা সেঁটে দিল ভালো করে। তারপর আশপাশে তাকিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। সামান্য দ্বিধা ফুটে উঠল ভাবে ভঙ্গিমায়।
দুর্নিবার হয়ে উঠল আমার কৌতূহল, খামের ওপর লেখা ওই নাম-ঠিকানায় একবারটি চোখ বোলাতে চাই— বিনিময়ে সর্বস্ব দিতেও রাজি আছি আমি।
তখনও দ্বিধা কাটেনি কস্তুরীর। ফিরবে কি ফিরবে না, এমনি দোনামোনা ভাব নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ভাঙাচোরা পাটাতনের পাশে। অদূরেই পিপের গাদার আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। এত কাছে এসে দাঁড়াল কস্তুরী যে, একটা অদ্ভুত সুবাস ঝোড়ো ঝাপটার মতোই এসে লাগল নাকে। অল্প অল্প বাতাস বইছে গঙ্গার দিক থেকে। শাড়িটা মৃদু শব্দ করে উড়ছে পেছনে। খুব, খুব শান্ত ওর মুখচ্ছবি, অন্তত পাশের দিকে থেকে যতটুকু দেখা যায়। কোনও তরঙ্গ নেই সেই মুখে, যদিও বা থাকে কিছু, তবে তা হতাশার অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। চোখ নামাল কস্তুরী, উলটে দেখল খামটা, তারপর আচমকা দু-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। চার টুকরো। আরও কুচি। আরও। আরও। শেষে ছোট ছোট কাগজের টুকরোগুলো উড়িয়ে দিলে বাতাসে। কিছু নদীর জলে পড়ল, কিছু ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল ঘাসের ওপর। পাথরের মতো মুখে জলের ওপর ভাসমান কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল ও। শূন্যগর্ভ দৃষ্টি। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা একবার রগড়ালে ডান হাতের চেটোয়— যেন কোনও অপ্রিয় অদৃশ্য বস্তুকে মুছে ফেলতে চাইছে তালু থেকে। জুতোর ডগা দিয়ে ঘাসের ওপর থেকে কয়েকটা কাগজের কুচিকে খুঁটে ঠেলে দিলে জলের দিকে। তারপর প্রশান্ত মুখে পা বাড়ালে সামনে।
ঘাসের ওপরেও ছলকে উঠল খানিকটা জল।
‘কস্তুরী!’
এক মুহূর্ত স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। কয়েক টুকরো কাগজ ছাড়া বাকি সবই জলে পড়েছে। ছন্নছাড়া মতো উড়ে বেড়াচ্ছে এই কয়েকটা কুচো।
‘কস্তুরী!’
বুশশার্টটা একটানে খুলে ফেলে ছুটে এলাম কিনারায়। বলয়াকারে ছড়িয়ে পড়ছে নদীর জল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপ দিলাম জলে। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ক্ষিপ্তের মতো হাতড়াতে লাগলাম সামনে। দেহের অণুপরমাণু থেকে কেবলমাত্র একটি নামই ক্রমাগত ঠেলে উঠে আসতে লাগল ঠোটের ডগায়: ‘কস্তুরী! কস্তুরী!’
কিনারার কাছে নোংরা ঘোলাটে জলে খুব জোর সেকেন্ড দুয়েক রইলাম। পরক্ষণেই ভেসে উঠলাম ওপরে। স্রোতের টানে বেশ কয়েক গজ ভেসে গেছে কস্তুরী। চিত হয়ে ভাসছে ও, ডুবে যাওয়া মানুষের মতোই শিথিল সর্বাঙ্গ। কাছাকাছি পৌঁছতে না-পৌঁছতেই দেখি, একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে কস্তুরী। ঠিক যেন একতাল নরম ঠান্ডা মাংসের দলা— প্রাণের চিহ্ন নেই বললেই চলে। হাঁপাচ্ছিলাম আমি। কমজোরি হাপরের মতোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফুসফুস জোড়া। হাত-পাগুলো ভারী হয়ে উঠেছিল লোহার মতো। হাত বাড়িয়ে কস্তুরীর ঘাড়ের কাছটা আঁকড়ে ধরলাম। যেভাবেই হোক, মাথাকে তুলে রাখতে হবে জলের ওপর। অপর হাতে জল টেনে এগিয়ে চললাম তীরের দিকে। শক্তি খরচের অনুপাতে কাজ হল খুব অল্প। তীর অনেক দূরে। কী অসম্ভব ভারী কস্তুরী! এর মধ্যেই যেন গঙ্গার মাটির মধ্যে গেঁথে যেতে শুরু করেছে তনুলতা! বয়াগুলো বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, স্রোতের টানে হু-হু করে ভেসে চলেছি দু-জনে। আর বেশি দূর নেই। কিন্তু আর তো পারছি না আমি। ফুসফুসে আর জোর নেই। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্যে কোনওদিন মাথা ঘামাইনি। হাঁ করে বুকভরা বাতাস নিতে গিয়ে বেশ খানিকটা গঙ্গাজল গিলে ফেলি এবার।
কয়েকটা ধাপ… একটা ঘাট দেখা যাচ্ছে। পাশেই একটা নৌকো বাঁধা। ওই দড়িটা… ওই দড়িটা যেভাবেই হোক ধরতে হবে আমাকে। ধাপ ক-টায় একবার উঠে দাঁড়াতে পারলে… এসে গেছে… অনেকটা কাছে এসে গেছে… হাত বাড়িয়ে কোনওমতে দড়িটা ধরে ফেললাম… টেনে আনলাম নিজেকে… পাওয়া গেছে পায়ের তলায় সিঁড়ির ধাপ।
এবার কস্তুরীকে তোলার পালা। এক-একটা ধাপ টেনে তুলে বেদম হয়ে হাঁপাতে থাকি কিছুক্ষণ। বৃষ্টির মতো জল ঝরে পড়ছে দু-জনের দেহ থেকে। জল থেকে ঠিক ওপরের ধাপটায় সংজ্ঞাহীন দেহটা তুলে এনে শুইয়ে দিলাম। এক মিনিট। জল একটু ঝরে গেলেই নিশ্চয় অনেকটা হালকা হয়ে যাবে কস্তুরী। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার নিচু হলাম আমি। খানিকটা তুলে ধরে, খানিকটা হিঁচড়ে টেনে পৌঁছলাম সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপে। পরের মুহূর্তেই ভেঙে পড়লাম নিজে। শরীরের শেষ শক্তি-বিন্দুটুকুও গেছে ফুরিয়ে। কস্তুরীই সবার আগে নড়ে উঠল। কী করুণ সেই ছবি! গালের ওপর লেপটে রয়েছে কালো কুন্তল। গালের রক্তাভা জলের মধ্যেই মিলিয়ে গেছে। চোখের পাতা খোলা, বেদনাঘন দৃষ্টিজাল আকাশের পানে মেলে ধরে কী যেন চেনবার চেষ্টা করছে সে।
‘এখনও মরেননি আপনি।’ ছোট্ট করে বললাম আমি।
চোখের মণিদুটো আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে স্থির হয়ে রইল আমার পানে— যেন অন্য এক জগৎ থেকে এই পৃথিবীর মানুষের পানে অবাক চাহনি মেলে ধরেছে কস্তুরী কৌশিক। বলল ফিসফিস সুরে, ‘মরতে আমার ভালো লাগে।’
‘খুব হয়েছে, এবার দয়া করে উঠে বসুন।’
কিন্তু তখনও উঠে বসার মতো অবস্থায় আসতে পারেনি কস্তুরী। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার বিহ্বলতা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, তাই আমিই ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম। দারোয়ানের ছোট্ট ঘরটা ঘাট থেকেই দেখা যাচ্ছিল; বেশি দূরে নয়। গুরুভার নিয়ে অবসন্ন পা-দুটোকে টানতে টানতে যেন একযুগ পরে এসে দাঁড়ালাম ঘরটার সামনে।
‘কৌন হ্যায়?’
কোনও সাড়া নেই। চৌকাঠের ওপর পা রাখতেই ছেঁড়া চটের পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন হিন্দুস্থানী বউ; কোলে নবজাত শিশু। খুব সম্ভব রসুই নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
ভিজে কাকের মতো চেহারা দেখেই চমকে উঠল বউটি, ‘কেয়া হুয়া বাবুজী?’
‘বিপদ, ভারী বিপদ। ইনি জলে ডুবে গিয়েছিলেন; শুকনো কাপড়-চোপড় আছে?’
‘জরুর। আইয়ে, অন্দরমে আইয়ে।’ কোলের শিশু কেঁদে উঠল। বউটি তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে খাটিয়ায় পাতা মলিন চাদরটা এক হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, ‘বৈঠিয়ে, হিঁয়া বৈঠিয়ে।’
আমি আর বসলাম না। আলতো করে কস্তুরীকে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পিপেগুলোর আড়ালে বুশশার্টটা ফেলে এসেছি, টাকাকড়িও রয়েছে শার্টের পকেটেই।
যথাস্থানেই পড়েছিল শার্টটা। মানিব্যাগও খোয়া যায়নি।
এইমাত্র যে ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেল, তার কোনও চিহ্ন ছিল না গঙ্গার ঘোলাজলে। অথচ কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না সেই দৃশ্য— কিনারা পেরিয়ে শূন্যে একটা পা এগিয়ে দিয়েছে কস্তুরী, শান্ত, সুন্দর মুখচ্ছবি… উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই সে-মুখে… জলে পড়েও ধীর স্থির তার দেহ। হাত-পা ছোড়া নেই, মৃত্যুর সিংহদরজা দেখেও শিউরে উঠে হাঁকপাঁক করা নেই— অচঞ্চল মুখে জলের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার সেই ভয়াবহ দৃশ্য কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না আমি। মৃত্যুর কোলে এমনি করে কি কেউ নিজেকে নিঃশেষে সঁপে দিতে পারে? না, না, এ মেয়েকে কিছুতেই চোখের আড়াল করা চলে না, কখনওই না। ছুটতে ছুটতে ফিরে আসি আমি। বর্তন থেকে দুটো গেলাসে গরম দুধ ঢালছিল হিন্দুস্থানী বউটি।
‘কোথায় গেলেন উনি?’
ইঙ্গিতে পর্দার ওদিকে দেখিয়ে দিল মেয়েটি। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কস্তুরী। পরনে একটা সস্তার ফুলকাটা ছাপা শাড়ি। ভিজে চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে সারা পিঠে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। বিধাতা যাকে রূপ দেন, তাকে এমনি অকৃপণ হাতেই সাজিয়ে দেন। বসনে দরিদ্র হয়েও তাই অপরূপ মনে হল কস্তুরীকে।
একটা ধুতি আর কামিজ এগিয়ে ধরেছিল বউটি। বেঢপ হলেই বা আর উপায় কী। গজগজ করতে করতে তা-ই নিয়ে পর্দার আড়ালে গিয়ে জামাকাপড় পালটে নিলাম। কামিজটা পরলাম না। বুশশার্টটা গায়ে দিলাম শুকনো ধুতির ওপর। দারুণ রাগ হয়ে গেল মহেন্দ্রের ওপর। দুটো দশ টাকার নোট বউটির হাতে গুঁজে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
দরজার ঠিক বাইরে বিচিত্র বেশে দাঁড়িয়েছিল কস্তুরী। কোলে দিগম্বর শিশুটি। ‘চলুন, যাওয়া যাক।’ রুক্ষ স্বরে বলি আমি।
‘চুপ,’ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠল কস্তুরী। ‘ঘুম ভেঙে যাবে।’ বলে, সন্তর্পণে শিশুটিকে তুলে দিলে মায়ের কোলে। ভিজে পোশাকগুলো দলা পাকিয়ে হাতে তুলে দিল বউটি।
যেতে যেতে নিরুত্তাপ স্বরে শুধালাম, ‘কোথায় পৌঁছে দেব আপনাকে?’
‘প্রথমে আপনার বাড়িতেই যাওয়া যাক। ময়লা ধুতিটা না ছাড়া পর্যন্ত আপনার মেজাজ ঠান্ডা হবে না, তা-ই না?’
‘কোথায় থাকেন আপনি?’
‘নিউ আলিপুরে… আমার নাম কস্তুরী কৌশিক… স্বামী মহেন্দ্র কৌশিক… নিমতায় কারখানা আছে।’
‘আমি দুর্লভ সামন্ত। পেশায় ব্যবহারজীবী, অর্থাৎ উকিল।’
একটু চুপ। তারপর, ‘আপনি আমার ওপর ভীষণ রেগেছেন,’ বলল কস্তুরী, ‘কিন্তু কী হয়েছে বলুন তো? বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না।’
‘আত্মহত্যা করতে গেছিলেন আপনি।’
আশা করেছিলাম এবার কিছু বলবে কস্তুরী। কিন্তু নির্বিকার মুখে কোনও ভাব-পরিবর্তন না দেখে আবার বললাম, ‘আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন… জানি আপনার অনেক দুঃখ… কোনও শক যদি পেয়ে থাকেন…’
‘না,’ মৃদু স্বরে বলল কস্তুরী, ‘যা ভাবছেন, তা নয়।’
সঙ্গে সঙ্গে ঘোষপাড়ার দেখা কস্তুরী ফিরে এল আমার পাশে, হুবহু সেই রহস্যময় ভাবতন্ময়তা ফুটে উঠল কুচকুচে কালো চাহনিতে।
বলল, ‘গঙ্গার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু কেন, তা জানি না।’
‘বটে। তাহলে চিঠিটা কার নামে শুনি?’
লাল হয়ে উঠল কস্তুরী।
‘স্বামীকে লিখেছিলাম। কিন্তু যা বোঝাতে চেয়েছিলাম চিঠির মধ্যে, তা এমনই অস্বাভাবিক যে শেষকালে—’ বলে, মুখ তুলে হাতের ওপর হাত রেখে শুধোল, ‘আবার বেঁচে থাকা কি সম্ভব হবে আমার পক্ষে?… মানে… মৃত্যুর… পর… আর কেউ হয়ে বেঁচে থাকা কি সম্ভব?… আপনিও এড়িয়ে যাচ্ছেন, উত্তর দিতে চাইছেন না। ভাবছেন, আমি পাগল।’
‘শুনুন—’
‘আমি পাগল নই, বিশ্বাস করুন, আমি পাগল নই… কিন্তু আমার অতীত যে অনেক, অনেক দূর ছড়িয়ে আছে, ছেলেবেলার স্মৃতিরও অনেক ওপারে— এই অনুভূতিটাকে আমি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারি না মন থেকে। মনে পড়ে, ছোট্ট থাকার আগেও আমার একটা জীবন আছে। মানে— ছিল, আস্তে আস্তে তার সবকিছুই আমার মনে পড়ছে… কিন্তু এসব কথা আপনাকে বলছি কেন, বুঝছি না।’
‘বলুন, বলে যান।’
‘যেসব জিনিস কোনওদিন দেখিনি, তাও মনে করতে পারি আমি। মাঝে মাঝে মনে পড়ে অনেক মুখ— কখনও দৃশ্যের পর দৃশ্য। মধ্যে মধ্যে সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করি, আমি তরুণী নয়, বুড়ি, অনেক বেশি আমার বয়স।’
আচ্ছন্নের মতো কথা বলে চলেছিল কস্তুরী। গাঢ় হয়ে এসেছিল স্বর। দ্রুত নয়, থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট অথচ ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে চলেছিল সে। আড়ষ্ট হয়ে শুনতে লাগলাম আমি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কস্তুরী, ‘নিশ্চয় কোনও অসুখে ভুগছি আমি। যদি তা-ই হয়, তাহলে যা কিছু আমার মনে পড়ে, সবই অস্পষ্ট, আবছা হওয়াই উচিত ছিল, নয় কি? এত স্পষ্ট হবে কেন মুখগুলো?’
‘কিন্তু আজ আপনি ঝোঁকের মাথায় যে কাজটা করলেন, তা কি আগে থেকে মোটেই ভাবেননি?’
‘মনে তো হয় ভেবেচিন্তেই করেছি। দিনে দিনে একটা অনুভূতি জোরাল হয়ে উঠছে আমার মধ্যে। আমি এখানে আগন্তুক, আমার প্রকৃত জীবন রয়েছে আমার পেছনে। যদি তা-ই হয়, এই মেকি জীবনকে টেনে নিয়ে গিয়ে লাভ কী?… সবার কাছেই… জীবন হল মৃত্যুর ঠিক বিপরীত… আর, আমার কাছে…’
‘এ ভাবে কথা বলাটা ঠিক নয়। স্বামীর কথা ভাবুন।’
‘বেচারা! ও যদি জানতে পারে—’
‘না, উনি জানবেন না। আমাদের দু-জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক আপনার জীবনের এই রহস্য।’
শেষের দিকে আপনা হতেই কোমল হয়ে এসেছিল আমার স্বর। চোখ তুলে হাসল কস্তুরী। যেন সোনালি আভা দেখা দিল ছেঁড়া মেঘের আড়ালে।
‘ঠিক বলেছেন। এ রহস্য সিক্রেট হয়েই থাকুক আমাদের মধ্যে। আমার কপাল ভালো, এই সময়ে এখানে হাজির ছিলেন আপনি।’
‘তা ছিলাম। এই যে ট্যাক্সি— ট্যাক্সি।’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠি আমি। এ অঞ্চলে এ সময়ে ট্যাক্সি পাওয়া আর ভগবান পাওয়া একই জিনিস।
উঠে বসি দু-জনে। টপ গিয়ারে উড়ে চলে ট্যাক্সি। হাওয়ায় উড়তে থাকে ভিজে চুল। খাদে স্বর নামিয়ে আপন মনেই বলে কস্তুরী, ‘এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতাম আমি।’
ট্যাক্সি থামে।
দরজা খুলে দিই আমি, ‘আসুন, ঘরে আসুন। আমি ব্যাচেলর, কাজেই ঘরটাও তত ঝকঝকে নয়, তাহলেও এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না।’
ভাগ্য ভালো, হলঘরে বা সিঁড়িতে কারও সঙ্গে মুখোমুখি হলাম না। এই রকম পোশাক পরা অবস্থায় সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে ব্যাচেলরকে বাড়ি ফিরতে দেখলেই গুজব ছুটবে হাওয়ার আগে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল টেলিফোনের শব্দ। সোফাসেটে কস্তুরীকে বসিয়ে দৌড়ে গেলাম পাশের ঘরে। ‘হ্যালো!’
মহেন্দ্রর স্বর। ‘এর আগে দু-দু-বার ফোন করেও পাইনি তোমায়। একটা জিনিস হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার, তোমাকে তা বলাই হয়নি… উমা দেবীর আত্মহত্যার ব্যাপারটা… জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন উনি। জানি না, খবরটা তোমার কোনও কাজে আসবে কি না। তোমার রিপোর্ট কী? খবর আছে?’
‘দেখা হলে বলব। এখন ছাড়ছি। মক্কেল রয়েছে।’