প্রেত-প্রেয়সী – ১.৪
(৪)
নোট বইয়ের পাতা উলটোলাম। মে ৬। বিরাগ মিশোনো চোখে তাকাই অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলোর দিকে। সবসুদ্ধ তিনটে কেস। তার মধ্যে একটা বিবাহবিচ্ছেদ। দু-মুঠো ভাত জোটাতে গিয়ে না জানি আরও কতদিন এইভাবে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করতে হবে আমাকে।
টেবিলে বসে ফাইলটা টেনে নিলাম। ওপরে কোণে ঝরঝরে অক্ষরে ইংরাজিতে টাইপ করা “কৌশিক কেস”, শেষ কয়েক দিনের পাতাগুলো অলস ভঙ্গিমায় উলটে চললাম। এপ্রিল ২৭। গঙ্গার ধারে বেড়ানো। ২৮। লাইট হাউস সিনেমা। ২৯। মোটরে জি. টি. রোডে বর্ধমান পর্যন্ত। ৩০। ফিরপোতে চা-পান। অনেকক্ষণ হাসি ঠাট্টা। মে ১। ব্যারাকপুর লাটসাহেবের বাগানে। চমৎকার ড্রাইভ করে কস্তুরী। ২। চন্দননগরে গঙ্গার তীরে। ৩। দেখা হয়নি। ৪। লেকের ধারে রাত আটটা পর্যন্ত। ৫। আবার ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে টানা ড্রাইভিং…
আর আজকে মে ৬। আজ দিনের শেষে লিখব কস্তুরীকে আমি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। আজ থেকে প্রতিটি দিনের গ্রন্থনা শুরু হবে এই তথ্যের ভিত্তিতেই। একটি পরিত্যক্ত অন্তরে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে বিষণ্ণ প্রেম। ভাবগতিক দেখে মনে হয়, কস্তুরীর মনে কোনও সন্দেহ জাগেনি। বন্ধুর মতোই মিশেছে আমার সঙ্গে, বন্ধুর মতো মন খুলে কথা বলতে পারে যার সঙ্গে, এমনি একটি পুরুষের সাহচর্য পেয়েই সে খুশি। এর চাইতে অধিক কিছু তার কল্পনাতেই এখনও আসেনি। সেই কারণে বোধহয় স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার কোনও তাগিদ অনুভব করেনি। আর, সুকৌশলে নিজের অংশ অভিনয় করে চলেছি আমি। আইনবিদের গোয়েন্দাগিরি আর অসামান্যা রূপসী যুবতীর সঙ্গ-সুখ। দিনগুলো কাটছে ভালোই।
ফাইলটা বন্ধ করে সরিয়ে দিয়ে পা টান-টান করে ছড়িয়ে দিলাম টেবিলের তলায়… মাথা এলিয়ে দিলাম চেয়ারের পিঠে… কস্তুরীর ব্যাধি। কস্তুরী সুস্থ; অসুস্থ নয় মোটেই। তবুও কোথাও যেন একটা গলদ থেকে গেছে।
ঠিক বলেছে মহেন্দ্র। আনন্দে-হুল্লোড়ে ওকে মাতিয়ে দিয়ে আলোময় এই জীবনের অংশে ওকে ধরে রাখা কোনওক্রমে বন্ধ হলেই অদ্ভুত এক তন্ময়তায় আবিল হয়ে ওঠে ওর দুই চোখ।
একদিন চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বলেছিলাম, ‘আপনাকে দেখলেই জনার কথা মনে পড়ে যায়।’
ভুরু কুঁচকে শুধিয়েছিল কস্তুরী, ‘কে সে মহাপুরুষ?’
‘পুরুষ নয়, মহিলা। মাহিষ্মতীরাজ নীলধ্বজেব স্ত্রী।’
‘বটে।’
‘জনা খুব গঙ্গাভক্ত ছিলেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে কৃষ্ণ না থাকলে সবাই পুড়ে ছাই হয়ে যেত তাঁর তেজে। পুত্রশোকে কাতর হয়ে তিনি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।’
‘ওঃ।’
‘আপনাকে জনা বলেই ডাকব। জনা না বলে ঘৃতাচী বললেই বোধহয় বেশি মানাত, কিন্তু—’
‘আপনার পৌরাণিক নামের ধাক্কায় আমার মাথা ঘুরছে।’ চুকচুক করে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বলেছিল কস্তুরী, ‘জনা নামটা অবশ্য মন্দ নয়। গঙ্গার বুক থেকে আপনিই আমায় ফিরিয়ে এনেছেন, এই তো?’
সেই দিন থেকে জনা নাম ধরেই ঠাট্টাচ্ছলে কস্তুরীকে ডেকেছি আমি। কস্তুরী নামে ডাকার সাহসও ছিল না আমার। তা ছাড়া, কস্তুরী বিবাহিতা মহিলা— অপর পুরুষের ঘরনী। কিন্তু জনা তো আমারই, একান্তভাবে আমার। জলের মধ্যে, মুখের পরতে পরতে মৃত্যুর ছায়া নিয়ে ডুবন্ত কস্তুরীকে আমিই তো দু-হাতে জাপটে ধরে টেনে এনেছি জীবনের আঙিনায়…
কিন্তু এ কী বোকামো করেছি আমি… শূন্যে কল্পনার সৌধ গড়ে তুলে আশা-নিরাশার নিরন্তর দ্বন্দ্বে কেন ক্ষতবিক্ষত করছি মনকে? কিন্তু তাতে কী আসে যায়! বেদনা-দরিয়ার নিতলে আছে শান্তি; অনাবিল সুখ আর অফুরন্ত আনন্দের সত্যলোক। আশা-নিরাশার জাল বুনে বরং তার উপকারই হয়েছে। ব্যর্থতার তিক্ততায় সম্প্রতি যে নৈরাশ্য দেখা দিয়েছিল আমার অন্তর প্রকৃতিতে, তা আর নেই। সে ভয় নেই। অনুশোচনা নেই। না জানি কত দীর্ঘ বছর প্রতীক্ষায় থেকেছে আমার নিঃসঙ্গ সত্তা, এই অপরূপা নারীর জন্যে। সম্ভবত বারো বছর বয়স থেকেই শুরু হয়েছিল শবরীর প্রতীক্ষা। পম্পা তীরে মতঙ্গ ঋষির আশ্রমে জটাবতী চির-অজিন-ধারিণী শবরী রামের আগমন প্রতীক্ষায় থেকেছে দীর্ঘকাল। আর ছেলেবেলা থেকেই পাহাড়ের গুহায়, ছায়ায়, অন্ধকারে ঘুরঘুর করে, মৃত্যু-স্তব্ধতার মধ্যে থেকে অশরীরী কল্পনায় বিভোর হয়ে দিন গুণেছি আমি।
ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোনের ঘণ্টা। ঝট করে তুলে নিলাম রিসিভারটা।
‘হ্যালো… আপনি?… হাতে কাজ নেই? হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারব বলেই মনে হয়। কাজ আছে অনেক, কিন্তু কোনওটাই জরুরি নয়… আপনি হুকুম করলে অবশ্য… চমৎকার; কিন্তু পাঁচটার আগেই ফিরে আসতে চাই… কোথায় যাবে? ঠিক আছে, মিউজিয়াম? মার্বেল প্যালেস? না, পরেশনাথ মন্দিরে হাওয়া খাওয়া?… না, না, এখনও দেখার জিনিসের অভাব নেই— তাহলে দুটোর সময়ে।’
আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলাম রিসিভারটা। এমনভাবে রাখলাম যেন এখনও কস্তুরীর বীণাকণ্ঠের শেষ অনুরণন রিমঝিম রিমঝিম সুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যন্ত্রটির মধ্যে।
জামাটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মক্কেলরা এসে ফিরে যাক আরও একদিন— একেবারে না এলেই তো পারে! কী এসে যায় তাতে। যুদ্ধের দামামা বাজছে ভারতের বাইরে। রণ-প্রস্তুতি বাংলার মাটিতেও। বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় কত রকম প্রস্তুতিই চলছে শহরের বুকে। বসন্তের লালিমা বুকে নিয়ে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে সবুজ ঘাসপাতা। প্রেমের সুষমা যেন সূর্যের সোনাগলা কিরণের মধ্য দিয়েই ঝরে ঝরে পড়ছে। এসপ্ল্যানেডের দিকে পা চালালাম আমি।
মনের দিক দিয়ে আমি সত্যিই নিঃশেষিত হয়ে গেছি। তাই অবসন্ন মনে এদিকে ওদিকে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম স্নায়ুগুলোকে আবার সতেজ করে তোলার চেষ্টায়। চিন্তার স্রোতে ছেড়ে দিয়েছিলাম নিজেকে। অবাধ্য, দুরন্ত চিন্তা, মগজকে শাসনের রক্তচক্ষু দেখিয়ে কোনও লাভই নেই… তার চাইতে বরং এই ভালো। হঠাৎ চমক ভাঙল একটা সাজানো দোকানের সামনে এসে। নিউ মার্কেটের দোকান। হরেকরকম বিচিত্র পণ্য থরেথরে সাজানো কাচের ওদিকে। একটা ছোট্ট আয়নায় চোখ পড়ল। রোজউডের ওপর হাতির দাঁতের কাজ-করা ফ্রেমে বাঁধানো এতটুকু আয়না— মুঠোর মধ্যে ধরা যায়, এত ছোট। কস্তুরীকে উপহার দিতে হবে সামান্য এই জিনিসটা। আজই দেব। জনার লাবণ্যকে প্রতিফলিত করার যোগ্যতা তো সব দর্পণের নেই। নীল ফিতে দিয়ে বাঁধা মোড়কে আয়নাটাকে পকেটে রেখে হাসিমুখে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। কস্তুরী, কস্তুরী, প্রিয়তমা কস্তুরী!
দুটোর সময়ে ময়দানে সেই বিশেষ বকুলগাছটার নীচে এসে দাঁড়ালাম। সময়ের হিসেবে কস্তুরীও কম যায় না। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে-ও এসে পৌঁছোল বকুলতলায়।
আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অবাক হয়ে যাই আমি, ‘কী ব্যাপার, আজ যে আগাগোড়া কালোর সমারোহ!’
‘কালোকে আমি ভালোবাসি। কালোই হল আমার আঁধারের বাতি। ‘পররুচি পরনা’ প্রবাদের অস্তিত্ব না থাকলে কালো ছাড়া আর কিছুই পরতাম না আমি।’
‘কিন্তু রংটায় শোকের ছায়া রয়েছে, তা-ই নয় কি?’
‘নিশ্চয় নয়। বরং উলটোটাই বলা যায়। জীবনের সব কিছু মধ্যেই একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায় এই কালো রঙের মাধ্যমে। এই রং আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে মানুষের চিন্তাকে, জীবন-দর্শন হয়ে ওঠে গম্ভীর ও গভীর।’
‘আর যদি নীল কি সবুজ রং পরেন?’
‘জানি না, তখন কী ভাবব। হয়তো নিজেকে মনে করব অকালের ওই উড়ন্ত টিয়াপাখি, অথবা এই বকুলগাছটার মতোই সৌরভ বিতরণই আমার কাজ… বিভিন্ন রঙের কতকগুলো রহস্যময় ধর্ম আছে, খুব ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম আমি। বোধহয় সেই কারণেই ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম।’
‘আমিও ছবি আঁকতাম। কিন্তু আমার ড্রইং এতই দুর্বল যে শেষ পর্যন্ত—’
‘তাতে কী? রংটাই তো আসল।’
‘আপনার আঁকা ছবি দেখাবেন?’
‘দেখার মতো কিছু নয়। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবেন না আপনি। নিছক স্বপ্নকে তুলির ডগায় আনতে চেষ্টা করেছি… স্বপ্নের রং… আচ্ছা, স্বপ্নের মধ্যে অনেক রকম রং দেখেন না আপনি?’
‘না। সমস্ত ধুলোর মতো ধূসর, অথবা ফোটোগ্রাফের মতো।’
‘তাহলে আপনি বুঝবেন না, আপনি অন্ধ!’ বলে হেসে উঠল কস্তুরী। আলতো করে আমার হাতটা টিপে দিয়ে জানিয়ে দিল এ শুধু পরিহাস, আর কিছু নয়। তারপর বলল, ‘স্বপ্ন বাস্তবের চাইতেও অনেক বেশি সুন্দর। কল্পনা করুন, অনেকগুলো অদ্ভুত সুন্দর রং এক জায়গায় মিলেমিশে অপরূপ সুষমা নিয়ে এসে পড়ছে আপনার চোখে… আপনার গোটা মনটা ভরে উঠবে রঙের সাগরে… তখন নিজেকে মনে হবে মেকি… ওই রংই আসল। প্রত্যেক রাত্রে স্বপ্ন দেখি আমি… আরেক দেশের স্বপ্ন।’
‘তা-ই নাকি?’
ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটতে থাকি দু-জনে গাছের ছায়ায় ছায়ায়। জানি না কোথায় চলেছি, জানার ইচ্ছেও নেই। এই তো ভালো, আমেজে অবশ পদযুগল যেদিকে যায় যাক। বড় ভালো লাগে কস্তুরীর আজকের নিবিড় সাহচর্য। কিন্তু কর্তব্য ভুলি না। বলি, ‘ছেলেবেলায় অজানা জগতের চিন্তা আমাকেও পেয়ে বসেছিল। কাছে ম্যাপ থাকলে দেখিয়ে দিতাম ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছে সে দেশের।’
‘এ দেশ, সে দেশ নয়।’
‘তা তো নয়ই। আমার স্বপ্নের শেষে আছে অন্ধকার, আর আপনার স্বপ্নের শেষে আছে রঙের বাহার। কিন্তু দুটো স্বপ্নই মিলেছে একই জায়গায়, একই দেশে।’
‘তখন আপনি ছেলেমানুষ ছিলেন। এখন আর তা বিশ্বাস করেন না। করেন কি?’
‘করি… আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে করছি।’
নীরবে কিছুক্ষণ হাঁটি দু-জনে। সমবেত সঙ্গীতের মতোই ছন্দে ছন্দে তালে তালে দু-জনের পা পড়তে থাকে ঘাসজমির ওপর। চিন্তাধারাও এগিয়ে চলে একই সুরে। মিউজিয়ামের সামনে এসে থমকে দাঁড়াই। তারপর রাস্তা পেরিয়ে বিশাল তোরণের নীচ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি দু-জনে।
বড় বড় পাথরের মূর্তিগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে কস্তুরী বলে, ‘এটা বিশ্বাসের ব্যাপার। আমি জানি… স্বপ্নে দেখা সেই দেশ হুবহু এই দেশের মতো নয়। কিন্তু তবুও কাউকে তা বলা যায় না।’
বড় বড় শূন্য দৃষ্টি মেলে পাথরের মূর্তিগুলো তাকিয়ে রইল আমাদের পানে। পাথরের ব্লকে কত দুর্বোধ্য হরফ, বহু বছর আগেকার দেব-দেবী দানব-দানবী পশুপক্ষীর বিচিত্র প্রস্তর-আলেখ্যগুলোও সেদিন নীরব সাক্ষী থাকে কস্তুরীর গোপন রহস্যের।
‘এর আগেও এখানে এসেছি আমি। অনেক… অনেকদিন আগে। আমার পাশে ছিল আরেকজন পুরুষ… কালো চাপদাড়ি ছিল তার গালে।’ বিড়বিড় করে বলে কস্তুরী।
‘ওটা মনের ভুল। অনেকের ক্ষেত্রেই এরকম ‘আগে দেখেছি’ ভাব দেখা গেছে। ও কিছু নয়, খুবই সাধারণ ব্যাপার।’
‘না, মনের ভুল নয়। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আমি আপনাকে শোনাতে পারি— প্রত্যেকটা দৃশ্য ছবির মতো ভাসছে আমার চোখের সামনে। যেমন ধরুন না কেন, এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভাসছে ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামটার নাম বলতে পারব না; বাংলাদেশে কি না তাও বলতে পারবে না। প্রায় স্বপ্নের মধ্যে দেখি, এই গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি… ছোট্ট একটা নদী এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে গাঁয়ের ঠিক পাশ দিয়ে… ডান পারে আছে একটা অনেক পুরোনো শিবমন্দির… বাঁ পারে সারি সারি তালগাছ… তালগাছের ওপাশে আমবনে ঘুরছে কয়েকটা ছাগল… তার ওপাশে একটা ভাঙা কেল্লা… আধখানা বুরুজ দেখা যাচ্ছে আমবনের মাথার ওপরে…’
‘কিন্তু… এ গাঁ তো আমার চেনা। গাঁয়ের নাম রতনপুর। নদীর নাম মন্দাকিনী।’
‘তা হবে।’
‘কিন্তু এখন গেলে ভাঙা কেল্লার বিশেষ কিছু আর দেখা যাবে না। বুরুজটাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তালগাছগুলো সাফ হয়ে গেছে।’
‘তখন ছিল গাছগুলো… আমার সময়ে ছিল… আর সেই বটগাছটা?… যে গাছের শেকড় বালিশের তলায় রেখে বন্ধ্যা বউরা ঘুমোত?
‘ভীমা বট।’
‘দেখলেন তো?’
আরও কতকগুলো বড় ঘর পেরিয়ে এলাম। দু-জনেই নীরব। ডাইনোসরের মস্ত কঙ্কালটাও কারও মনে বিস্ময় জাগাতে পারলে না।
‘কী নাম বললেন?’ শুধোল কস্তুরী।
‘গাঁয়ের নাম? রতনপুর।’
‘একসময়ে নিশ্চয় সেখানে থাকতাম আমি।’
‘যখন খুব ছোট ছিলেন।’
‘না,’ শান্ত সুরে বললে কস্তুরী, ‘গত জন্মে।’
কিছুক্ষণ সব চুপ।
তারপর, ‘জায়গাটা আপনি চিনলেন কী করে?’ শুধোল কস্তুরী।
‘আমি জন্মেছি সেই গ্রামে। এখনও মাঝে মাঝে যাই।’
বড় বড় আলমারিগুলোর ওপর শূন্য দৃষ্টি রেখে শুধোই— ‘ছেলেবেলা থেকেই আপনি এই স্বপ্ন দেখছেন?’
‘না। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই ছিলাম আমি। তবে অল্প কথা বলতাম, একা থাকতে ভালোবাসতাম।’
‘তাহলে… শুরু হল কখন?’
‘হঠাৎ! বেশিদিন আগে নয়… আচমকা একদিন মনে হল আমি যেন আমার বাড়িতে নেই, একজন অচেনা লোকের সঙ্গে রয়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে অচেনা জায়গায় নিজেকে দেখে মানুষ যেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে, এও অনেকটা তেমনি।’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব। যদি রাগ না করেন তো, বলি।’
‘আমার কোনও গোপন কথা নেই,’ শান্ত স্বরে বলল কস্তুরী।
‘তাহলে জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘নিশ্চয়।’
‘আপনি কি… মানে, আবার শেষ-যাওয়ার কথা চিন্তা করেন?’
থমকে দাঁড়িয়ে গেল কস্তুরী। ভাসা ভাসা মায়াময় দুই চোখে মেলে তাকাল আমার পানে।
‘আপনি বুঝতে পারলেন না আমাকে।’ বলল ফিসফিস করে।
‘ওটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না।’
খনিজ আকরের একটা শো-কেসের চারধারে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল অনেকগুলো মেয়ে আর ছেলে। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি।
কস্তুরী বলল, ‘উত্তরের জন্যে চাপ দেওয়াটা ঠিক নয়।’
‘আমি দেব। দেব শুধু আপনার স্বার্থে নয়, আমারও স্বার্থে।’
‘প্লিজ…’
এত নরম সুরে বলল কস্তুরী যে বাতাসের মতোই তা ভেসে এল কানে। মনটা হঠাৎ কী রকম হয়ে গেল। এক হাত দিয়ে কস্তুরীকে ঘিরে ধরে নিজের কাছে টেনে আনলাম। বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। কেউ নেই। বললাম গাঢ় স্বরে, ‘তুমি কি অন্ধ? দেখতে পাচ্ছ না আমি তোমায় ভালোবাসি? তোমাকে হারানোর শোক যে আমি সহ্য করতে পারব না কস্তুরী।’
যন্ত্রচালিত মানব-মানবীর মতো পাশাপাশি হেঁটে চললাম দু-জনে।
কতক্ষণ পরে কানের কাছে মুখ এনে বললাম ফিসফিস স্বরে, ‘তোমাকে আমার চাই… তোমাকে আমার দরকার… আমার এই তুচ্ছ বেঁচে থাকাকে ঘৃণা করার শিক্ষা তোমার কাছ থেকেই পেতে চাই আমি…’
‘চলুন যাওয়া যাক।’
ঘরের পর ঘর পেরিয়ে এলাম। একদম গা ঘেঁষে অত্যন্ত নিবিড় হয়ে হাঁটছিল কস্তুরী। আগেই চাইতে উষ্ণ সেই সান্নিধ্য। সিঁড়ির ওপর পা দিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।
‘এইমাত্র কী বললাম তোমাকে, তা মনে আছে নিশ্চয়?’
‘আছে।’
‘আবার যদি তা বলি, রাগ করবে কি?’
‘না।’
‘জনা, আমার জনা!… আরও কিছুক্ষণ হাঁটলে হয় না? অনেক কথাই বলার রয়েছে দু-জনের।’
‘আজ থাক। আমি ক্লান্ত। এখন বাড়ি যাই।’
বাস্তবিকই একটু ফ্যাকাশে আর শঙ্কিত মনে হল কস্তুরীকে।
‘ট্যাক্সি ডাকছি। তার আগে আমার একটা ছোট উপহার আছে।’
‘কী?’
‘খুলে দেখো। আমার সামনেই খোলো।’
মোড়কটা খুলে ফেলল কস্তুরী। ছোট্ট অথচ সুন্দর আয়নাটার। বুকে নিজের প্রতিবিম্বর ওপর ক্ষণেক চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুতোয় ঝোলানো কার্ডটা তুলে ধরলে। শুধু তিনটে শব্দ লেখা ছিল কার্ডে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কস্তুরী।
বলল, ‘চলুন।’
‘আগামীকাল দেখা হচ্ছে তো?’
মাথা কাত করে সায় দিল কস্তুরী।
‘কলকাতার বাইরে যাওয়া যাবে’খন… না, না, আর কোনও কথা নয়। আজকের বিকেলের এই স্মৃতিটুকু নিয়ে আমাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে শান্তিতে থাকতে দাও… এই যে ট্যাক্সি… আর একটা কথা… অতীতের দিকে আর ফিরে চেও না।’ বলে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
অবসাদের ছোঁয়া আমার মনেও লেগেছিল। এ অবসাদ অনাবিল প্রশান্তির… ক্লান্তির নয়।