প্রেত-প্রেয়সী – ১.৫
(৫)
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল… আওয়াজটা পরিচিত… সাইরেন। আশপাশের ফ্ল্যাটে দুমদাম শব্দ হচ্ছে দরজা খোলা আর বন্ধ করার। নীচের তলায় ছুটেছে সবাই। অন্ধকার শহরকে তোলপাড় করে সত্যিকারের ডাকিনীর মতো নাকি সুরে কাঁদছে সাইরেন। আঁতকে উঠেছে ভয়ার্ত নাগরিকেরা। ভীতু! পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
পরের দিন সকালে রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে শুনলাম সেই একই খবর—যুদ্ধ, যুদ্ধ, আর যুদ্ধ। সারা পৃথিবী জুড়ে বাজছে রণদামামা। দ্রিমিদ্রিমি শব্দ ভারতের শিয়রে হাজির। হাসি পেল। বোমার ভয়ে শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে। বোম আদৌ পড়বে কি না তারই ঠিক নেই, কিন্তু বাড়ি-ঘরদোর ছেড়ে এর মধ্যেই গ্রামাঞ্চলে পালাতে শুরু করেছে কলকাতার বীরপুরুষরা। খিদে পেয়েছে— চনমন করছে পাকস্থলী। শরীরে ক্লান্তি বলে আর কিছুই নেই। ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। কস্তুরীর। সেই একই সাক্ষাৎস্থান। বেলা দুটো।
সারা সকালটা চটপট কাজ করে গেলাম। মক্কেলদের সঙ্গে দেখা করলাম। টেলিফোনের ঘ্যানঘ্যানানিতেও বিরক্ত হলাম না। সবার স্বরেই সেই একই উত্তেজনা— যে উত্তেজনা রয়েছে আমার নিজের মধ্যেই। বোমার প্যানিক আরও ছড়িয়ে পড়েছে। দুপুর একটার মধ্যে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাওয়া সেরে নিলাম। কফির কাপ নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারলাম কিছুক্ষণ। তারপর পৌঁছলাম বকুলতলায়।
কস্তুরী আগেই এসে গেছিল। কিন্তু এ কোন শাড়ি পরেছে ও? সাদাসিধে বাদামি রঙের সেই তাঁতের শাড়ি… ভয়াবহ সেই দিনটিতে কস্তুরীর অঙ্গে ছিল এই শাড়িটিই… মুহূর্তের জন্যে শক্ত মুঠোয় কস্তুরীর কবজি চেপে ধরি আমি। বলি, ‘শরীরটা আজ বিশেষ ভালো নেই। জাপানিদের ভয়ে অবশ্য নয়। তুমি চালাও।’
কস্তুরীকেও বিশেষ সুস্থ বলে বলে মনে হল না; গাড়ি চলতেই তা বুঝলাম— গিয়ার চেঞ্জ করছে আওয়াজ করে, ব্রেক কষছে আচমকা, স্ট্রিয়ারিংয়ের ওপর পালিশ-করা নখগুলোও খুব স্থির বলে মনে হল না।
শ্যামবাজারের মোড়ে এসে কস্তুরী বললে, ‘চলো, অনেকদূর কোথাও যাই। খুব সম্ভব এই আমাদের শেষ ড্রাইভিং।’
‘কেন?’
‘কী যে হবে, তা বলা মুশকিল। যা-ই হোক না কেন, আমাকে হয়তো কলকাতা ছেড়ে যেতে হবে।’
‘কলকাতা ছেড়ে যাবে কেন? বোমা পড়ার সম্ভাবনা কিন্তু খুবই কম। অনেক দিন ধরেই সাইরেন বাজছে শহরে— কিন্তু বোমা পড়েছে কি?’
কোনও জবাব নেই।
‘তবে কি আমার জন্যেই… আমার জন্যেই তুমি? কস্তুরী, তোমার জীবনে আর শনি হয়ে থাকতে চাই না আমি। দাও… কথা দাও, যে চিঠি তুমি একবার ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে, সে চিঠি যেন আর দ্বিতীয় বারের জন্যে তোমার হাতে লেখা না হয়… কী বলতে চাই তা বুঝছ নিশ্চয়?’
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলে কস্তুরী। হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ওভারটেক করল একটা লরিকে। চিড়িয়ার মোড়ের ওপর দিয়ে খসে-পড়া উল্কার মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। তারপরেই কমে এল গতি।
সামনের রাস্তার ওপর চোখ রেখে উত্তর দিলে কস্তুরী, ‘ও প্রসঙ্গ নিয়ে আর না-ই বা আলোচনা করলে?’ একটু থেমে মিনতি মাখানো গলায় আবার বললে, ‘কিছুক্ষণের জন্যে যুদ্ধ আর বোমাকেও ভুলে যাও।’
‘কিন্তু কস্তুরী, তোমার মনে আনন্দ নেই কেন?’
জোর করে হাসবার চেষ্টা করল কস্তুরী, ফ্যাকাশে হাসি। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে আমার।
‘কিছুই হয়নি আমার— দিব্বি মুডে আছি। সত্যি বলছি। দেখছ না, কীরকম ড্রাইভ করছি? মেজাজ খারাপ থাকলে কি এমনভাবে বেরোনো যায়? এমনিভাবেই যেখানে খুশি যেতে ইচ্ছে যায়, না ভেবেচিন্তে সামনে যে রাস্তা পাওয়া যায়— সেই রাস্তা ধরেই উধাও হয়ে যেতে চায় মনটা। মাঝে মাঝে ভাবি, জানোয়ার হয়ে জন্মালাম না কেন।’
‘বলছ কী কস্তুরী!’
‘একটুও বাড়িয়ে বলছি না। জন্তুদের আমি অনুকম্পা তো করিই না, বরং হিংসে হয় ওদের খুশিমতো চলার স্বাধীনতা দেখে। খায়, ঘুমোয়, ছুটে বেড়ায়— নিষ্পাপ, নিরীহ। অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই।’
‘এ কী জীবনদর্শন!’
‘একে দর্শন বলে কি না, তা জানি না। কিন্তু ওদের দেখলেই ঈর্ষা হয় আমার।’
এরপর টুকরো টুকরো কথা ছাড়া আর কিছু জমল না। পেছনে পড়ে রইল বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, সোদপুর। পথের ঠিক মাঝখান দিয়ে নির্বিকারভাবে যাচ্ছিল একটা মোষ। বেপরোয়াভাবে আচমকা ডানদিকে নেমে গিয়ে পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তার ওপর গাড়ি নামিয়ে দিল কস্তুরী। পরক্ষণেই লাফাতে লাফাতে উঠে পড়ল সড়কে। ঝাঁকুনির চোটে গায়ের ওপর গিয়ে পড়েছিলাম। স্পিডোমিটারের কাঁটাটা থরথর কবে কাঁপছে পঞ্চান্ন থেকে ষাট-এর মধ্যে। কস্তুরীর চোখে-মুখে কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই এ-হেন সর্বনাশা বেগের। চোখের ওপর কয়েকগাছি চুল লেপটে ছিল— থিরথির করে কাঁপছিল দমকা হাওয়ায়— কিন্তু তা সরাবার কোনও প্রচেষ্টাই দেখা যাচ্ছিল না ওর মধ্যে। হুইলের ওপর হাত দুটি রেখে বসেছিল যন্ত্রের মতো। শ্যামনগরের কাছাকাছি ঠেলাগাড়ি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল একজন মুসলমান। বুড়োকে সরে যাওয়ার কোনও সময় না দিয়ে সাঁ করে ডান দিকের একটা সরু পথে নেমে পড়ল কস্তুরী। একটা পরিত্যক্ত ইটের পাঁজা পড়ে রইল পেছনে। সামনে একটা চৌমাথা। ডান দিকেই মোড় নিল কস্তুরী— খুব সম্ভব সেদিকের ঝোপঝাড়ের রাশি রাশি ফুলের আকর্ষণে। বাঁশের বেড়ার ওপাশ থেকে কালো কালো ছোপওয়ালা একটা ধলা গাই বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল নৃত্যপর গাড়িটার দিকে।
এমনভাবে ড্রাইভ করছে কস্তুরী, যেন একটু আস্তে চালালেই দেরি হয়ে যাবে। অথচ তাড়াহুড়ো করার কোনও কারণ নেই। কাঁচা মাটির গর্তের ওপর দিয়ে তাই নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল চার চাকার যন্ত্রযান। ঘড়ির ওপর চোখ নামালাম; এবার গাড়ি থামানো দরকার। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কথার ছলে জেনে নেওয়া যাবে, কেন কস্তুরীর মন আজ এত উতলা। কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছে ও। মনের গহনে এমন একটা জিনিস লুকিয়ে রেখেছে, যা দ্বিতীয় প্রাণীকে বলতে পারেনি। খুব সম্ভব বিয়ের আগে থেকে চলে এসেছে এই গোপনীয়তা। না বলার যাতনার বনিয়াদের ওপরেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ওর যত কিছু অস্বাভাবিক আচরণ। তীব্র অনুতাপের দহনও তো থাকতে পারে মনের গহনে। কস্তুরী অসুস্থ নয়, উন্মাদ নয়, ছলনাময়ী নয়। তা সত্ত্বেও এমন কোন রহস্য আছে ওর অতীত জীবনে যা কাউকে বলা যায় না, এতদিন কাউকে বলতেও পারেনি— স্বামীকেও নয়। যতই এই নিয়ে ভাবতে লাগলাম, ততই চিন্তাধারার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠতে লাগলাম আমি। কিন্তু কোন অপরাধে অপরাধিনী সে? নিশ্চয় গুরুতর কিছু।
‘চেনো ওই বুরুজটা?’ আচমকা প্রশ্ন করে কস্তুরী, ‘কোথায় এসেছি বলো তো?’
‘কোনটা?… ইয়ে… ওই বুরুজ?… না… এদিকে কোনওদিন আসিইনি। এবার থামা যাক, সাড়ে তিনটে বাজল।’
সামনেই একটা চত্বর— এক সময়ে তা পাথরে বাঁধানো ছিল, কিন্তু আজ তা এবড়ো খেবড়ো ঘেসো জমিতে পরিণত হয়েছে। চত্বরের মাঝেই বেজায় উঁচু বুকটা পেছনের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে কেমন-জানি বেমানান ঠেকছিল। পেছনে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে। যে ধ্বংসস্তূপ দেখা যাচ্ছিল, নিশ্চয় তা পরিত্যক্ত নীলকুঠির।
চত্বরের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাল কস্তুরী।
‘অদ্ভুত গড়নটা। হঠাৎ দেখলে মুসলমান আমলের মিনারের মতো, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে মনে হবে ফিরিঙ্গিদের ওয়াচ টাওয়ার। তা-ই না?’ বলে কস্তুরী।
‘বেজায় উঁচুও বটে।
পায়ে পায়ে বুরুজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। কালের শাসনে নীলকুঠি ভেঙে পড়লেও পরবর্তীকালে বহু মেরামতের চিহ্ন সারা অঙ্গে নিয়ে নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বুরুজটা। ভেতরে ঢুকে পড়লাম দু-জনে।
ফিসফিস করে বললে কস্তুরী, ‘কেউ এদিকে আসে না, কিন্তু আগাছাও বিশেষ দেখছি না। বুরুজের বর্তমান মালিকের প্রাণে শখ আছে বটে— পিকনিক করার উপযুক্ত জায়গা।’
তা-ই বটে। ভাঙাচোরা নীলকুঠি, লম্বা লম্বা গাছপালার ঘেসো চত্বর আর পুরোনো বুরুজ— সব মিলিয়ে আইডিয়াল প্লেস। ভেতরে ঢুকলাম অত্যন্ত মন্থর পায়ে। পাথরের বেদীর ওপর সিঁদুর মাখানো একটা কালো শিলার সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কস্তুরী। পরক্ষণেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে চোখ মুদে মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ। বাতাসের ছোঁয়া লেগে গোলাপের পাপড়ি নড়ার মতো অধরোষ্ঠে মৃদু কম্পন দেখে, পাথরের মূর্তির মতো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ কীসের প্রার্থনা? কীসের অনুশোচনা? কোন আত্মগ্লানি? গঙ্গার জলে তলিয়ে গিয়ে কি সেদিন রৌরব পথযাত্রিণী হতে চেয়েছিল রহস্যময়ী কস্তুরী? আর কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, নতজানু হয়ে বসে পড়লাম পাশে, ‘কস্তুরী।’
আস্তে আস্তে মাথা তুলল কস্তুরী; কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে মুখ।
‘কী হয়েছে? কস্তুরী, বলো আমাকে… কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি।’ ফিসফিস করে উঠল কস্তুরী। ‘দুর্লভ, তুমি বিশ্বাস করো, এ দুনিয়ায় কিছুরই শেষ নেই, কিছুই একেবারে শেষ হয়ে যায় না। আমরা মনে করি, এই শেষ… কিন্তু তা নয়…’ বলে অনেকক্ষণ দুই করতলে মুখ লুকিয়ে রইল কস্তুরী। তারপর ভাঙা গলায় বললে, ‘চলো, যাওয়া যাক।’
উঠে দাঁড়িয়ে কালো শিলার উদ্দেশে আর একবার কপালে দু-হাত ঠেকাল ও। কনুই ধরে টান দিলাম আমি।
কোণের দিকে একটা কাঠের তক্তা-মারা দরজা, দরজার পরেই ঘুরপাক-খাওয়া বাংলা-ইটের সিঁড়ি।
‘কস্তুরী, ও দরজা নয়— ও সিঁড়ি ওপরে গেছে।’
‘চারপাশটা একটু দেখতে চাই।’ জবাব দিল কস্তুরী।
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে!’
‘মিনিট খানেকের জন্যে উঠব আমি। বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে দিয়েছিল ও, কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সিঁড়িতে পা দিলাম।
‘অত তাড়াতাড়ি যেও না, কস্তুরী।’
সঙ্কীর্ণ খিলানওয়ালা সিঁড়ি-পথে গমগম করে উঠল আমার কণ্ঠস্বর। কিন্তু শুনেও শুনল না কস্তুরী— দ্রুততর হয়ে উঠল ওর চরণ। ছোট্ট একটা চাতালে পৌঁছে দেওয়ালের ফোকর দিয়ে বাইরে তাকালাম— নীলকুঠির ভাঙা ছাদ দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে তালগাছের সারি, তার ওপাশে মাঠে কাজ করছে কয়েকজন চাষী। এইটুকু উঁচুতে উঠেই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। ফোকর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার পা দিলাম সিঁড়ির ধাপে।
‘কস্তুরী… দাঁড়াও… আমাকে উঠতে দাও।’
বেদম হয়ে পড়েছিলাম আমি। দপদপ করছিল মাথার শিরাগুলো। আর একটা চত্বর; আর একটা ফোকর। এবার হুঁশিয়ার হয়ে গেছি— বাইরে তাকালাম না; চোখ রাখলাম ভেতর দিকে— নীচের দিকেও নয়। খাড়াই ধাপগুলো এমনভাবে গোঁৎ খেয়ে চোখের আড়ালে হারিয়ে গেছে যে, দেখলেই গা শিরশির করে ওঠে। বুরুজের চারপাশে কাকের কর্কশ চিৎকার শুনতে পেলাম। ঝোঁকের মাথায় উঠে তো পড়লাম, নামব কী করে?
‘কস্তুরী!’
উদ্বেগে কী রকম ভাঙা ভাঙা শোনাল নিজের স্বর। শেষকালে কি এই অন্ধকারের মধ্যে ছেলেমানুষের মতো গলা ছেড়ে কেঁদে উঠতে হবে? ফোকরটার মধ্যে দিয়ে আলোর তির্যক রেখা চোখে পড়ছিল। জানি ও-জায়গায় চোখ রাখলে মাথা ঘুরে উঠবে। তবুও ফোকরটার কাছে এসে বাইরে না তাকিয়ে পারলাম না। গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে এসেছি। নীলকুঠি আরও ছোট হয়ে এসেছে। শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বাইরের হাওয়া ফোকর দিয়ে আছড়ে পড়ছে মুখের ওপর। চাতালের সামনেই একটা দরজা। বন্ধ দরজা। ঠেলা দিয়েও খুলতে পারলাম না। এখনও চুড়োটা আসেনি। দরজার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছিল আর এক পাক ঘুরে উঠে গেছে সিঁড়ির সারি। কিন্তু সিঁড়ির পাশে দেওয়াল আর নেই— খোলা আকাশ।
‘কস্তুরী!… দরজা খোলো।’
ক্ষিপ্তের মতো পাল্লার ওপর ঘুঁষি মারতে লাগলাম। মতলব কী কস্তুরীর? কী করতে চায় ও?
‘কস্তুরী… কস্তুরী!’ পাগলের মতো চেঁচাতে থাকি আমি। ‘এ কাজ কোরো না… কোরো না… আমার কথা শোনো!’
ব্যঙ্গ করে উঠল প্রতিধ্বনি। গমগম করে উঠল গোটা বুরুজটা। ক্ষিপ্তের মতো ফিরে দাঁড়ালাম ফোকরটার দিকে। না, ফোকর ঠিক নয়, গবাক্ষ বলা যায়। বেশ বড় আকারের। কষ্টে-সৃষ্টে বেঁকে দুমড়ে একটা মানুষের দেহ বেরিয়ে যেতে পারে। তারপরেই ফুটখানেক চওড়া আলসেটায় পা দিয়ে দেওয়াল আঁকড়ে ঘুরে গেলেই দরজার ওদিকে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছোন যায়। চেষ্টা করলে যাওয়া যায় নিশ্চয়… যে কোনও পুরুষের পক্ষে তা সম্ভব… কিন্তু আমার পক্ষে তা অসম্ভব! গেলেই পড়ব… মাথা ঘুরে পড়ে যাব… না, এ পথে যাওয়া অসম্ভব!
‘কস্তুরী! কস্তুরী!’ বিকট ভাঙা গলায় আবার চেঁচিয়ে উঠলাম। আবার— আবার।
উত্তরে ভেসে এল একটা তীক্ষ্ণ আর্ত-চিৎকার। সাঁ করে ফোকরের সামনে দিয়ে নেমে গেল একটা ছায়া। সজোরে আঙুলের গাঁট কামড়ে ধরে নিঃসীম আতঙ্কে কাঠ হয়ে সময় গুনতে লাগলাম— ছেলেবেলায় এমনিভাবেই বিদ্যুৎ আর বাজের আওয়াজের মাঝের সময় গুনতাম আমি।
ভেসে এল সেই বজ্রনির্ঘোষ… বহু নীচ থেকে একটা ভয়ংকর শব্দ। মৃত্যুপথযাত্রীর মতো দম আটকে-যাওয়া আকুল কণ্ঠে বারবার ককিয়ে উঠলাম—
‘কস্তুরী… কস্তুরী… না… না… না…’
বসে পড়েছিলাম। দাঁড়িয়ে থাকার বিন্দুমাত্র শক্তিও ছিল না হাঁটুতে। মনে হল, এবার জ্ঞান হারাব। না দাঁড়িয়েই বসে বসে একটু একটু করে দেহটাকে টেনে টেনে নামাতে লাগলাম নীচে— এক ধাপ থেকে আর এক ধাপে— এক চাতাল থেকে আর এক চাতালে। শামুকের মতো গতি… কিন্তু এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতাও ছিল না। গোঙাতে লাগলাম আতঙ্কে আর অপরিসীম নিরাশায়। প্রথম চাতালে নেমে একবার ফোকর দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। হাঁটু গেঁড়ে বসে উঁকি দিয়েছিলাম গবাক্ষের মধ্য দিয়ে বাইরে।
অনেক নীচে বাঁ-দিকে ভাঙা পাথরের টুকরো আর ঘাসজমির ওপর, ভীষণভাবে খাড়াই বুরুজের দেওয়ালের প্রায় গা ঘেঁষে পড়েছিল বীভৎসভাবে দোমড়ানো মোচড়ানো আকারহীন কুৎসিত বাদামি কাপড়ের একটা পিণ্ড।
পাথরের ওপর খানিকটা রক্ত, একটা হাঁ-করা ভ্যানিটি ব্যাগ— ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হাতির দাঁতের ফ্রেমে বাঁধানো ছোট্ট একটা আয়না।
অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে গেল সবকিছু। দেহটার কাছে যাওয়ার কথাও আর ভাবতে পারলাম না। কস্তুরী মারা গেছে। সেই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে দুর্লভ সামন্তর।