প্রেত-প্রেয়সী – ২.২
(২)
না, কস্তুরী নয়… তক্ষুনি উঠে গিয়ে পরের শো-র একটা টিকিট কিনে আনলাম। শো শেষ হয়ে যাওয়ার পর উঠে গেলাম নতুন সিটে। পরের শো-র শুরুতেই নিউজ-রিল— উত্তেজনায় ধকধক করছিল বুকটা। যে মুখ দেখার জন্যে এই প্রতীক্ষা, তাকে এবার শুধু দেখা নয়, মনের পটে মুদ্রিত করে রাখতে চেয়েছিলাম আমি। তাই ওই দু-এক সেকেন্ডের মধ্যেই যতটা সম্ভব দেখে নিয়েছিলাম। বছর তিরিশ বয়স মেয়েটির; খুব ছিপছিপে নয়। মুখটা হুবহু সেরকম নয়— তবুও বিস্ময়কর সেই সাদৃশ্য। বিশেষ করে চোখ দুটি তো অবিকল তারই মতো। মনের সমস্ত শক্তি এক করে স্মৃতিতে আঁকা মুখটির সঙ্গে পর্দায় দেখা মুখটি মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছিটিয়ে পড়া কিছু কিছু রং ছাড়া আর রইল না কিছুই— জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি।
পরের দিন পুরী যাওয়া বাতিল করলাম। ম্যাটিনি শো-তে গিয়ে আর একবার দেখে এলাম সেই মুখ। এবার আরও খুঁটিয়ে… দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে চোখে পড়ল তখনই। মেয়েটির ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে একজন সুবেশ পুরুষ। পরনে বিলিতি পোশাক। সুদৃশ্য পিন দিয়ে আটকানো নেকটাই। আলগোছে মেয়েটির হাত ধরেছিল সে। মেয়েটির গায়ে আলস্টার, ফারের কলার।
রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল আরও অনেক কিছু। ভিড়ের ওপর দেখা যাচ্ছিল একটা মস্ত সাইনবোর্ড— হোটেল কসমোপলিটান। অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল নামটা, তবুও নজর এড়ায়নি আমার। খুব সম্ভব হোটেলে ডেরা নিয়েছিল দু-জনে— শোভাযাত্রা দেখে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল ক্যামেরার সামনে।
হাসি পেল। এক সময়ে গোয়েন্দাগিরি করেছি বলে কি এখনও এই সামান্য দৃশ্য থেকে এত কিছু ভাবতে হবে?
সামনেই বার। সামলাতে পারলাম না; একটা হুইস্কি শেষ করে আর একটার অর্ডার দিয়ে ঝিম মেরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।
ব্র্যান্ডিতে আর শানায় না। হুইস্কি অনেক ভালো— অনেক তেজালো। স্নায়ুর দুর্বলতা চকিতে মুছে দিতে অদ্বিতীয়। দুই মুখের আদল এক হতে পারে, কিন্তু তাতে কী? যা শেষ হয়ে গেছে, তা নিয়ে আবার ভাবা কেন? সুদূর কটক শহরে হুবহু তারই মতো দেখতে একটি মেয়েকে নিয়ে সুখে ঘর বেঁধেছে একজন পুরুষ— তা দেখে কেন এই অব্যক্ত বেদনায় ছটফটিয়ে মরব আমি? না, আর কোনও দ্বিধা নয়, দুর্বলতা নয়। কালই পুরী রওনা হব। সমুদ্রের হাওয়ায় শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাকেও চাঙ্গা করে তুলতে হবে। চিরতরে স্তব্ধ করতে হবে এই দুঃসহ স্মৃতির রোমন্থন।
পরদিন যথাসময়ে রওনা হয়েও কিন্তু পুরী পৌঁছোন আর হল না। কটকে পৌঁছেই হঠাৎ সুটকেস নিয়ে স্টেশনে নেমে পড়লাম। মনের সঙ্গে অনেক লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত আর সামলাতে পারলাম না। একটা দিন কটকে থেকে গেলে ক্ষতি কী?
স্টেশন থেকে সিধে হোটেল কসমোপলিটান। ঘর একখানা আছে বটে, তবে রেট বেশি। লাগোয়া বাথরুম। কুছ পরোয়া নেহি। এরকম উদ্ভ্রান্ত অস্থির অবস্থায় একটু বিলাসিতাই পছন্দ করছিলাম আমি।
‘গান্ধীজী কবে এসেছিলেন এখানে?’ কথায় কথায় হঠাৎ ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করি আমি।
‘তা প্রায় মাসখানেক আগে তো বটেই।’
মাসখানেক! অনেকগুলো দিন কেটে গেছে এর মধ্যে!
‘স্যুটপরা মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক উঠেছিলেন এখানে? টাইপিন লাগাতেন নেকটাইতে?’
নিতান্ত বোকার মতো প্রশ্ন শুনে ম্যানেজার মনে মনে হাসলেন কি না বোঝা গেল না, মুখে বললেন, ‘তা তো বলা মুশকিল। ওরকম তো কত লোকই আসছে-যাচ্ছে।’
তা তো বটেই। কিন্তু কার আশায় এত দূর ছুটে এসেছি আমি? বিকৃত কল্পনাকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে কোনও লাভ আছে কি? কিন্তু না। আর বিতর্ক নয়। একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক। কালকের সারাদিনটা তো রয়েছেই।
সকালে উঠে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে নিলাম। নেমে এলাম খাবার ঘরে। বেশ বড় হোটেল। বার রয়েছে একদিকে। ওপাশে রেস্তোরাঁ। ব্রেকফাস্ট সামনে নিয়ে বসে রয়েছে স্বদেশি বিদেশি কত যুগ্ম মূর্তি। আমিই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি, যার সঙ্গী নেই। ওদিকের টেবিলে চোখে পড়ল একজন মোটা লোককে… স্বপ্ন দেখছি নাকি আমি?… নেকটাইতে টাইপিন…
জয় ভগবান! এই কি সেই? বছর পঞ্চাশ বয়স, পরিপাটি বেশ। সামনের চেয়ারে-বসা তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওমলেট খাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মেয়েটি আমার দিকে পেছন ফিরে বসেছিল, মুখ দেখা যাচ্ছিল না। একমাথা কুচকুচে কালো চুল। আলস্টারের ফার কলারে ঢাকা পড়ে গেছে খোঁপার খানিকটা। মুখ দেখতে হলে হলের ওদিকে যেতে হবে… যাব। একটু পরেই যাব। এই মুহূর্তে আবার অসংযত হয়ে উঠেছে স্নায়ুগুলো। আঙুল কাঁপছে। কাঁপা আঙুলেই একটা সিগারেট তুলে নিয়ে পরক্ষণেই যথাস্থানে রেখে দিলাম। ব্রেকফাস্টের আগে সিগারেট খাব না।
চেষ্টা করে স্বাভাবিক গলায় কাউন্টারের ওয়েটারকে শুধোলাম, ‘ওই যে ভদ্রলোক… মাথার সামনের দিকে টাক পড়েছে… সামনে বসে ওই যে আলস্টার গায়ে ভদ্রমহিলা… ওঁদের নাম কী?’
‘ভদ্রলোকের নাম নিশিকান্ত শর্মা।’
‘নিশিকান্ত শর্মা!… কী করেন?’
‘কী করেন না বলুন? চাকরি বাদে এমন কিছু নেই যা করেন না। টাকার কুমির।’
‘উনি ওঁর স্ত্রী?’
‘উঁহু, কোনও মেয়েকেই বেশিদিন সহ্য করতে পারেন না উনি।’
‘বটে। টাইম টেবলটা আছে নাকি?… ঠিক আছে।’
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টাইম টেবলের পাতা ওলটাতে লাগলাম। কিন্তু চোখ রইল সামনে। মেয়েটি সামান্য ঘুরে বসেছে। আরও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে মুখশ্রী। আচম্বিতে লাফিয়ে ওঠে হৃদযন্ত্রটা। কস্তুরী! মনকে যে আর চোখ ঠাউরানো যাচ্ছে না। অনেক পালটে গেছে ও। আগের চাইতে মুখটা একটু ভারী হয়েছে। মুখের সে কাঁচা ভাবটিও আর তেমন নেই। এ আর এক কস্তুরী… কিন্তু সেই কস্তুরীই বটে… হুবহু এক!
আস্তে আস্তে চেয়ারে এলিয়ে পড়ি আমি। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘামটুকু মুছে নেওয়ার শক্তিও যেন নেই আমার। হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে চিন্তাধারাও যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু আর ভাবতে পারছি না। চোখ বুজেও কস্তুরীর মূর্তিকে মুছে ফেলতে পারিনি মস্তিষ্কের প্রতিটি বেদনাময় কোষ থেকে।
‘কস্তুরী! কস্তুরী! কস্তুরী!’ ঠক করে হাত থেকে টাইম টেবলটা পড়ে গেল মেঝের ওপর।
অনেক চেষ্টায় অনেকক্ষণ পরে সামলে নিলাম নিজেকে। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। না, কস্তুরীর মতো নয়— তবুও কস্তুরীই বটে। কিন্তু এটা নিশ্চিত হচ্ছি কী কারণে। সামনেই সুবেশ পুরুষটির সামনে ওই যে সুন্দরী, সে যে কস্তুরীই— সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। স্বপ্ন নয়, সত্য। আমি যেমন স্বপ্ন নয়, সামনের ওই রহস্যময়ী নারীটিও তেমনি স্বপ্ন নয়। এ কী নিষ্ঠুর সত্য! সত্য কি এত বেদনাদায়ক হয়? ওই সত্যকে মেনে নিই কী করে? নিজের চোখে দেখেছি যে তাকে মরতে?
কস্তুরী মৃতা। কিন্তু কস্তুরী জীবিতা। ওই সেই কস্তুরী।
মেয়েটির হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে নিশিকান্ত শর্মা। এগিয়ে আসছে এই দিকেই। চট করে টাইম টেবল তুলে ধরে মুখ আড়াল করলাম। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে চোখে পড়ল শুধু মূল্যবান ট্রাউজারের নীচে একজোড়া ঝকমকে স্যু, আর নীল শাড়ির তলায় একজোড়া সাদা চপ্পল।
লিফট-এর দরজা বন্ধ হয়ে ওপরে উঠে যেতেই টাইম টেবল রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বুকটা আবার টনটন করছে। পুরোনো ক্ষতের বেদনা। অনেকদিন আগেকার ভালোবাসা অসহ্য যাতনা নিয়ে আবার জেগে উঠছে। মেয়েটি কি আমাকে দেখেছে?
‘আজ যাচ্ছেন নাকি?’ শুধোয় কাউন্টারের ক্লার্ক।
‘না, না, বলতে পারছি না কবে যাব।’
সারাটা সকাল হুইস্কি খেয়ে রোদে রোদে ঘুরে বেড়ালাম। লাশটা শুধু আমি একাই দেখিনি— দেখেছে মহেন্দ্র, দেখেছে বুড়ি— আরও অনেকে। পুলিশও নিশ্চয় আহাম্মকের মতো তদন্ত করেনি, অন্ততপক্ষে জনদশেক লোক সাক্ষী দিতে পারে যে কস্তুরী মৃতা। তা-ই যদি হয়, তাহলে নিশিকান্ত শর্মার সঙ্গে যে মেয়েটিকে এইমাত্র দেখে এলাম, সে আর কস্তুরী এক মেয়ে নয়। হতে পারে না। ব্যস, আর কোনও উদ্ভট কল্পনাকে মাথায় স্থান দেওয়া হবে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। কস্তুরী মারা গেছে… বুরুজের নীচে পড়েছিল তার লাশ… উমা দেবী… কিন্তু সামনে যে…
আর একটু হুইস্কি চাই… হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে যায় কস্তুরীর সেই কথা ক-টি:
‘এর আগেও এখানে এসেছি আমি। অনেক… অনেকদিন আগে। আমার পাশে ছিল আর একজন পুরুষ… কালো চাপদাড়ি ছিল তার গালে…’
বোকা! বোকা! একদম বোকা আমি। এই সহজ কথাগুলোর অর্থ ধরেও ধরতে পারিনি এতদিন। যে কস্তুরীকে জেনেছি, তার সত্তা হঠাৎ একদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল উমা দেবীর আবির্ভাবে। আর আজকে ওই যে মেয়েটি— ওর সত্তাকেও কি ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায় না কস্তুরীর আবির্ভাব দিয়ে?
রাত্রে আবার ডাইনিং রুমে মেয়েটিকে দেখলাম। নিচু গলায় ওয়েটারকে কী যেন বলছেন নিশিকান্ত শর্মা। আর হাতের ওপর থুতনি রেখে যেন স্বপ্ন দেখছে মেয়েটি। একটা হুইস্কি নিয়ে এসে বসলাম। ভাগ্যের কী পরিহাস! কোনও অভাবই ছিল না কস্তুরীর। আজ তারই সম্পত্তি ভোগ করছে অন্যজন, আর সে কিনা কণ্ঠলগ্না হয়ে রয়েছে নিশিকান্ত শর্মার মতো নারীমাংসলোলুপ একজন পুরুষের। মেয়েটির বিষণ্ণ চোখ দুটি উতলা করে তোলে আমার মনকে। কানের দুল দুটি অতি সাধারণ এবং বদরুচির পরিচায়ক। মুক্তোর রঙে পালিশ করা থাকত যে নখ— আজ তা শ্রীহীন। আর এক কস্তুরীর সুষমার সঙ্গে কী বিপুল প্রভেদ এই কস্তুরীর শ্রীহীনতার। এ যেন একটা সুন্দব ছবির অত্যন্ত খারাপ নকল। টুকটুক করে খাচ্ছিল মেয়েটি। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ কী মনে পড়তে উঠে দাঁড়াল নিশিকান্ত শর্মা। সিধে হল থেকে বেরিয়ে গিয়ে উঠল লিফটে। দ্বিতীয় কস্তুরী বসে রইল চেয়ারে।
এই সুযোগ! নিশ্চয় কোনও কাজে ঘরে গেছে নিশিকান্ত। এ সুযোগকে কাজে লাগতে পারব কি আমি? এত সাহস কি হবে?
এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে দিয়ে গটগট করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম মেয়েটির সামনে।
খুব আস্তে আস্তে চোখ তুলল সে; একটু বিরক্তি মিশোনো দৃষ্টি মেলে ধরল আমার মুখের ওপর।
বুকটা দমে গেল; তবুও জোর করে হেসে বললাম, ‘বসতে পারি?’
অনিচ্ছার সঙ্গে নীরবে ঘাড় হেলিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলে মেয়েটি।
সময় নষ্ট করলাম না; বললাম, ‘আমার নাম দুর্লভ সামন্ত। মনে পড়ছে?’
কপাল কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল মেয়েটি। তারপর বলল, ‘না তো… মাফ করবেন।’
‘আপনার নাম?’
‘সুলতা মিত্র।’
প্রতিবাদ করতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। সত্যিই তো, নাম তো এখন পালটে গেছে। পাশ থেকে আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুখটা দেখতে লাগলাম। কপাল, চোখের রং, নাকের রেখা, উঁচু হনু— সব আগের মতো। স্মৃতির কোঠায় তুলে রাখা ছবির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। চোখ বুজলে মনে হয় যেন জাদুঘরেই বসে রয়েছি— সামনে রয়েছে কস্তুরী। কিন্তু অমিলও আছে— খোঁপা বাঁধার কায়দা সেরকম নয়, লিপস্টিক সত্ত্বেও অধরোষ্ঠে নেই সেই শাণিত রেখা।
‘আগে কলকাতায় থাকতেন?’
‘না, বর্ধমানে।’
‘ঠিক করে বলুন! ছবি আঁকতেন না?’
‘না।’
‘শ্যামনগরে কোনওদিন গেছেন?’
‘সে কোথায়?’
‘কেন মিথ্যে বলছেন?’
ভাসা ভাসা শূন্য দুটি চোখ মেলে ধরলে মেয়েটি। বললে, ‘মাফ করবেন, মিথ্যে বলিনি।’
‘আজ সকালেই এ-ঘরে আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন আপনি। এখন এমন ভান করছেন যে—’
ভুরু কুঁচকে বলে মেয়েটি, ‘কী বলতে চান?’
দোষ নেই ওর। মনে মনেই বলি। অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর কস্তুরী জেনেছিল সে উমা দেবী। আর আজকে এত সহজেই কি সুলতার মনে পড়বে নিজেকে? মনে পড়বে যে সে কস্তুরী, আর কেউ নয়?
‘নেশা করেছি আমি, কিছু মনে করবেন না।’ বিড়বিড় করে বলি আমি, ‘আমার রুম নাম্বার সতেরো; দরকার হলে চলে আসবেন।’
লিফট থেকে নিশিকান্তকে পা বাড়াতে দেখেই কথা শেষ করে এনেছিলাম, এখন চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেলাম বারের দিকে। এক চুমুকে একটা হুইস্কি শেষ করে দিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। রাতের খাওয়ার কথা আর মনেই ছিল না।
রুম-নাম্বার লেখা বোর্ডটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম— নিশিকান্ত শর্মা; এগারো নম্বর ঘর।
মাথার মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। ভয়! কিন্তু কীসের ভয়? নিশ্চয় চিনতে পেরেছে ও! আর যদি না চিনে থাকে, তাহলে এ-রহস্যের উত্তর থাকে তিনটি: হয় ভান করছে, না হয় স্মৃতিহীনতা, অথবা কস্তুরীই নয়।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই আবার সব মনে পড়ে গেল। উন্মাদ— মদের ঝোঁকে গত রাতে কী সব আবোল-তাবোল ভেবেছি। কটকে আর নয়; আগে স্বাস্থ্য— তারপর আসুক সুলতা মিত্র— রূপে যে দ্বিতীয় কস্তুরী!
বারান্দায় বেরিয়ে এসে টুথব্রাশ ঘষতে ঘষতে হঠাৎ চমকে উঠলাম, হনহন করে ফটক পেরিয়ে যাচ্ছে কে? নিশিকান্ত শর্মা না? সঙ্গে তো সুলতা মিত্র নেই!
তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে এগারো নম্বর ঘরের দরজায় টোকা দিলাম— চেনা জনের আলতো টোকা।
‘কে?’
‘দুর্লভ।’
দরজা খুলে গেল; লাল চোখ— চোখের পাতা ফুলে উঠেছে। বেশবাস আলুথালু।
‘কী ব্যাপার সুলতা?’
আবার কেঁদে উঠল সুলতা।
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ‘কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?’
‘আমাকে আর ভালো লাগছে না, তাই চলে গেল।’
একটুও উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে অপলক চোখে অশ্রুসিক্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কস্তুরী— হ্যাঁ, সেই কস্তুরী… যে অভিনয় করেছে আমার সঙ্গে, হয়তো আরও অনেকের সঙ্গে। ট্রাউজারের পকেটে দুই হাতের মুঠি শক্ত হয়ে ওঠে আমার। সামান্য বেঁকে যায় ঠোঁটের হাসি।
‘এই জন্যে এত কান্নাকাটি? ওকে তোমার যে-জন্যে দরকার, সে-জন্যে তার জায়গায় আমি তো এসেছি?’
আগের চাইতেও দরদরধারে ঝরে পড়ল সুলতার অশ্রু। ‘না… না… তুমি না!’
‘কেন নয়?’ আলতো করে চিবুকটি তুলে ধরে শুধোলাম আমি।