প্রেত-প্রেয়সী – ২.৩
(৩)
হোটেল কসমোপলিটান ছেড়ে নতুন হোটেলে এসেছিলাম শুধু খরচ কমানোর জন্যেই নয়। নিশিকান্ত শর্মার শ্যেন দৃষ্টিও এড়ানো গিয়েছিল অনায়াসে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে প্রসাধন করছিল সুলতা। লম্বা লম্বা কুচকুচে কালো চুলের রাশির দিকে তাকিয়ে আনমনে একটা সিগারেট লাগালাম ঠোঁটের কোণে।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললাম, ‘তোমার এ খোঁপা বিশ্রী লাগে আমার। অন্যভাবে বাঁধতে পারো না?’
‘কীভাবে?’
‘ধরো বাঁ দিকের ঘাড়ের ওপরে সামান্য হেলিয়ে?’
ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছিলাম কথাটা। রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর। নতুন করে ঝগড়া বাধিয়ে কী লাভ? আজ ক-টা দিন ধরেই তো চলছে কথা কাটাকাটি, আর রাগারাগি। শুধু ঘুমের সময়টুকু ছাড়া দিবারাত্র খাঁচার বন্দি জন্তুর মতোই গজরাতে গজরাতে লড়ে চলেছি দু-জনে। বিরাম নেই থাবা আর দাঁত দেখানোর। কেন আবার নতুন করে সূত্রপাত করা সেই একই বাদানুবাদের?
তাড়াতাড়ি বললাম, ‘নীচে আছি। তাড়াতাড়ি এসো।’
হুইস্কির আমেজে রিমঝিম করছিল মাথার কোষগুলো। মদ খেতে আর বাধা কী? আর তো কোনও সংশয় নেই। সুলতা মিত্র দিব্বি গেলে বলতে পারে কস্তুরী তার নাম নয়— কিন্তু আমি তো জানি সে কে। আকাশের ওই ধ্রুবতারা যদি সত্য হয়, তা হলে আমি যা জেনেছি তাও সত্য। শুধু অনুভূতি দিয়ে নয়, অনুমান দিয়ে, দেহের সমস্ত অণুপরমাণু দিয়ে জেনেছি সেই সত্যকে। মাঝে মাঝে ভেবেছি, রক্ষিতা না হলেই কি চলত না কস্তুরীর? দৈহিক সুখ দেওয়ার জন্য কস্তুরীর ব্যগ্রতা দেখে কষ্ট পেয়েছি।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে সুলতা। চাপা ঠোঁটে নীরব বিদ্রোহ। শাড়ির রংটা মোটেই ভালো লাগল না আমার। শুধু শাড়ি কেন, ব্লাউজের রংটাও যেন বড্ড বেশি ঝকঝকে। বুক পেট বার করা অসভ্য ছাঁট। পায়ে চপ্পলের বদলে হাই হিল জুতোই ছিল ভালো। মুখটাতেও একটু অদলবদলের দরকার। গাল দুটো যেন আরও বসে গিয়ে উদ্ধত করে তুলেছে হনু দুটোকে। ভুরুতে পেন্সিলের দাগ অতটা না হলেও চলত। পালটায়নি শুধু চোখদুটি— শান্ত, সুন্দর, গভীর। একমাত্র অকাট্য প্রমাণ এই চোখ। নেমে এসেছিল সুলতা। হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরি, বুকে টেনে নিই… আর… আর নিবিড় বাহুবন্ধনে শ্বাসরোধ করে দিই।
‘খুব দেরি করিনি, কী বলো?’ বলে সুলতা।
অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার সুর সুলতার কণ্ঠে। ঠিক সে রকমটি নয়। পরিবেশমতো মানানসই শব্দ চয়ন করতেও ভুলেছে কস্তুরী। আমার হাত ধরেছিল ও। ভীরু হাতে নিঃশেষে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত… দুর্লভ নয় মোটেই। আর আছে ভয়… সে ভয় আমার প্রতি। অসহ্য। বিরক্তিকর। নিঃশব্দে পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা। ভাবছিলাম, মাসখানেক আগেও যদি কেউ এসে বলত, কস্তুরীকে তুমি ফিরে পাবে এইভাবে, তাহলে আনন্দের আর সীমা পরিসীমা থাকত না।
কিন্তু আজ? চেয়ে পাওয়ায় যে এরকম বেদনা আছে, তা তো জানতাম না।
থরে থরে জিনিস সাজানো দোকানগুলোর কাচের জানলার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সুলতা। এইতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার।
একটু রুক্ষস্বরেই বললাম, ‘যুদ্ধের দিন ক-টা খুব অভাবের মধ্যেই কেটেছে— তা-ই না?’
‘সত্যিই তা-ই।’
উচ্চারণে দারিদ্রের সুর অন্তর স্পর্শ করল আমার।
শুধোলাম, ‘তারপরেই নিশিকান্ত শর্মা এল— যেটুকু ছিল, তাও গেল, কী বলো?’ জানতাম, আঘাত পাবে সুলতা। তবুও না বলে পারলাম না।
‘আমার কপাল ভালো তাই পেয়েছিলাম ভদ্রলোককে।’
এবার আঘাত পাওয়ার পালা আমার। এই তো চলেছে। আঘাত দেওয়া নেওয়ায় বিচিত্র খেলা। আমি কিন্তু সহ্য করতে পারলাম না।
‘দেখো…’ শুরু করেই থেমে গেলাম। কী লাভ? টানতে টানতে সুলতাকে নিয়ে এলাম শহরের মধ্যে।
অনুযোগের সুরে বলে উঠল সুলতা, ‘দৌড়চ্ছ কেন? বেড়াতে বেরিয়ে এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কোনও মানে আছে?’
জবাব দিলাম না। এবার দোকানের কাচের জানলা লক্ষ করার পালা আমার। অচিরেই দেখতে পেলাম যা চাইছিলাম।
কাউন্টারের সামনে এসে সংক্ষেপে বললাম, ‘শাড়ি ব্লাউজ।’
‘দোতলায় যান।’
মন স্থির করে ফেলেছি আমি। একটা তীব্র আনন্দ চিনচিন করছিল মনের মধ্যে। এবার স্বীকার করতেই হবে ওকে! জোর করে স্বীকার করাব…
‘কী করছ?’ ফিসফিস করে বলে সুলতা।
‘চুপ করো।’
হুকুম দিলাম দোতলার কাউন্টারে, ‘কিছু শাড়ি আর ব্লাউজ দেখান। সেরা জিনিস দেখাবেন।’
একটা টুলে বসে পড়লাম। যেন অনেকটা পথ একটানা দৌড়ে আসায় দম ফুরিয়ে গেছে— এমনিভাবে হাঁপাচ্ছিলাম আমি। পর পর কয়েকটা মূল্যবান শাড়ি নামানো হল কাউন্টারে। কিন্তু সুলতা দেখবার আগেই পছন্দ শেষ হয়ে গেল আমার। একটা কালো শাড়ি আর হলদে ব্লাউজ নিয়ে সুলতার হাতে দিয়ে হুকুম করলাম, ‘দুটোই নাও। পরে দেখো— কীরকম মানায় দেখতে চাই আমি।’
দ্বিধা ফুটে উঠেছিল সুলতার মুখে। কিন্তু প্রতিবাদের সাহস হল না। তাই বোবার মতো পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ছোট্ট ঘেরা জায়গাটির দিকে। টুল ছেড়ে উঠে পড়ে পায়চারি করতে শুরু করলাম আমি। পুরোনো দিনের সেই উত্তেজনা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। কস্তুরী আসবে— প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বুকের খাঁচা। মনে হচ্ছে যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আবার আগেকার জীবন ফিরে পেয়েছি। পকেটের মধ্যে চেপে ধরলাম আয়নাটা। অসহ্য হয়ে উঠেছে সাসপেন্স। এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা বাদামি রঙের শাড়ি। একটা নয়। অনেকগুলো। কিন্তু কোনওটাই ঠিক সে রকম নয়। হুবহু কী রকম, তাও মনে করা সম্ভব নয়। স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতা নয় তো?
খুলে গেল কিউবিক্যাল-এর দরজা। বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়েই নিদারুণ চমকে উঠলাম আমি।
সামনে দাঁড়িয়ে সেই অপরূপা নারীমূর্তি… কস্তুরী আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কস্তুরী! সত্যিই কস্তুরী। আমাকে চিনতে পেরেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছিল নারীমূর্তি। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কাছে… আরও কাছে… ফ্যাকাশে মুখ… রহস্যঘেরা কাজলকালো চোখ… আগের মতোই… কোনও তফাত নেই। না, না। এখনও তফাত আছে। সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কানের ওই দুল দুটোর জন্যে।
চাপা গলায় গর্জে উঠলাম, ‘খুলে ফেলো।’
সুলতা বুঝতে পারেনি তখনও, তাই নিজের হাতেই জোর করে টানাটানি করে খুলে ফেললাম দুল দুটো। তারপর পিছিয়ে ঘাড় কাত করে আপাদমস্তক চোখ বুলোলাম চিত্রশিল্পীর দৃষ্টি নিয়ে। কোথায় যেন একটা খুঁত থেকে যাচ্ছে।
‘ঠিক আছে। ওই বাদামি শাড়িটাও নাও। এ সবই কস্তুরীর। জুতোর ডিপার্টমেন্ট কোনদিকে? এসো।’
বাধা দিল না সুলতা। কোনও জুতোই পছন্দ হচ্ছিল না আমার। দেখতে দেখতে জুতোর পাহাড় জমে গেল পাশে। সুলতা কি বুঝেছে কী চাই আমি? খুব সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত পেলাম চকচকে ছোট্ট জুতোজোড়া। সুলতার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললাম, ‘পরে দেখো। ঠিক আছে। হাঁটো।’
আঁটসাঁট কালো শাড়ি হলদে ব্লাউজ আর হাইহিল জুতোয় সুলতাকে মনে হল ইথার দিয়ে গড়া এক অশরীরী মূর্তি।
হাঁ করে কাউন্টারের ছোকরা তাকিয়েছিল আমার পানে। ক্যাশমেমো করতে বলে সুলতাকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম প্রমাণ সাইজ আয়নার সামনে।
‘দেখো। কস্তুরী, দেখো নিজেকে। ভালো করে দেখো।’
‘এ কী হচ্ছে!’ অনুনয়ের সুর।
‘থাক! মনে করে দেখো… চেষ্টা করো… আয়নার ওই ভদ্রমহিলা আর যে-ই হোক— সুলতা মিত্র নয়। চেষ্টা করো!’
প্রবল উত্তেজনায় জোরে জোরে ওঠানামা করছিল সুলতার বুক। ভয়ে পাংশু হয়ে গিয়েছিল মুখ।
এখনও শেষ হয়নি। টানতে টানতে সুলতাকে নিয়ে নেমে এলাম নীচে। খোঁপার কায়দা নিয়ে পরে মাথা ঘামানো যাবে-খন। আপাতত দরকার সেই সুগন্ধি। চকিতে মনকে অতীতের পৃষ্ঠায় নিয়ে যেতে অদ্বিতীয় সেই কস্তুরীকে এখন দরকার। দেখাই যাক কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। ফলাফল নিয়ে আর মাথা ঘামাই না আমি।
কিন্তু বৃথাই অনেক বোঝালাম, ঝরাফুল গন্ধের সঙ্গে তুলনা করলাম— কেউ বললে বুঝতে পারছি না, কেউ বললে যুদ্ধের আগে পাওয়া যেত। আজকাল আমদানী বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু সে সুবাস না পাওয়া গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে অতীতের পুনরুজ্জীবন!
কনুইতে টান দিয়ে ফিসফিস করে উঠল সুলতা, ‘এই, কী ব্যাপার বলো তো?’
‘কী ব্যাপার? কিছুই কি এখনও বুঝতে পারছ না?’
চুপ করে শান্ত দুই চোখ মেলে দাঁড়িয়ে রইল সুলতা।
ক্যাশে টাকা মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম দু-জনে। দু-জনেই নিশ্চুপ।
কিছুক্ষণ পরে কথার খেই টেনে নিয়ে বললাম, ‘আমি চাই তোমার মধ্যেই তোমাকে আবিষ্কার করতে, আমি চাই যা সত্য, তা জানতে।’
কোনও জবাব দিল না সুলতা। আমার মুঠোর মধ্যে ওর নরম হাতের স্পর্শে উপলব্ধি করছিলাম আমার প্রতি ওর ভয় আর বিদ্বেষ। শক্ত করলাম মুঠি— আর ওকে পালাতে দেব না। কোনও মতেই না।
গলার স্বর খাদে নামিয়ে এনে বললাম, ‘তুমি সুলতা মিত্র নও। কখনওই ছিলে না।’
প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুলতা।
চকিতে মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার। এই প্রথম নয়, যতবারই ওকে এইভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুনেছি, ততবারই মেজাজ খিঁচড়ে গেছে আমার। অসহ্য!
‘জানি, জানি, কী বলবে তুমি, আমি জানি। সুলতা মিত্র তোমার নাম, বোম্বাই তোমার জন্মস্থান। বাবার নাম বিরুপাক্ষ মিত্র, মায়ের নাম আয়েষা মিত্র।… অনেক… অনেকবার তো শুনলাম এই বৃত্তান্ত! কিন্তু… কিন্তু তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে, সব ভুল… সমস্ত ভুল… মারাত্মক ভুল!’
‘দোহাই তোমার। আবার কি গোড়া থেকে শুরু করবে নাকি?’
‘চেষ্টা করো… একটু চেষ্টা করো মনে করতে। মনে করে দেখো, তুমি আসলে কে? কী তোমার আসল নাম।… আচ্ছা, কখনও কঠিন অসুখ করেছিল তোমার?’
‘তেমন কিছু না—’
‘অনেক সময়ে অসুখের পর এ-রকম হয়।’
‘সেরকম কিছুই হয়নি আমার। বছর দশেক বয়েসে একবার হাম হয়েছিল।’
‘না, না, তা নয়।’
‘আমি আর পারছি না, রেহাই দাও আমাকে।’
ধৈর্য হারালে চলবে না। সহিষ্ণুতাই এখন আমার একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু কস্তুরীর জেদও তো বড় কম নয়— রাগ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
হাঁটতে হাঁটতে একটা কিউরিও শপের সামনে এসে পড়েছিলাম আমরা। শো-কেসে বিস্তর কাশ্মীরি শৌখিন জিনিস, মোরাদাবাদি পাত্র, প্রায়-জীবন্ত নেউল আর সাপ সাজানো দেখেই মাথায় একটা মতলব এল, সুলতাকে টেনে নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
ঢুকেই বুঝলাম ভুল করেছি।
পরপর চারটি ঘরে সাজানো ছিল মস্ত মস্ত অয়েল পেন্টিং, পাথরের অপরূপ সুন্দর মূর্তি, বিচিত্র ঝাড়লণ্ঠন, হাতির দাঁতের অদ্ভুত বাক্স আর পোর্সেলিনের খেলনা। মেঝেতে পুরু গালিচা পাতা। এ-ঘরে সে-ঘরে নেই কোনও শব্দ। থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে আচম্বিতে সুলতারও কণ্ঠ নেমে এসেছে খাদে— আর চকিতে যেন ভোজবাজির মতোই পালটে গেল সমস্ত পরিবেশটা। মনে হল, সেদিনের মতোই আমরা পাশাপাশি নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি জাদুঘরের কক্ষে কক্ষে— আমার পাশেই হাতে হাত দিয়ে হাঁটছে রহস্যময়ী কস্তুরী কৌশিক— সুলতা মিত্র নয়।
প্রচণ্ড বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল বুকটা। অব্যক্ত যাতনায় বোধহয় মুঠি আরও শক্ত হয়ে উঠেছিল— সুলতা অস্ফুট শব্দ করে উঠতেই পলকের মধ্যে সামলে নিলাম নিজেকে। সোনালি কারুকাজ-করা ফ্রেমে বাঁধানো একটা তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে শুধোলাম, ‘এ-ধরনের ছবি তোমার ভালো লাগে?’
‘না; ছবির সম্বন্ধে কিছুই বুঝি না আমি।’
এবার আমারই বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। পাশের ঘরে ঝুলছিল, সারি সারি শো-কেসে অজস্র জন্তুর চামড়া। বন্য আবহাওয়ায় দাঁড়িয়ে একটু রুক্ষ স্বরেই শুধোলাম, ‘এবার বলো।’
‘কী বলব?’
‘সমস্ত; কে তুমি? কী করেছিলে তুমি? কেন করেছিলে তা?’
‘উফ, ভগবান! কতবার আর বলব?’
‘কলকাতায় কোনদিন যাওনি?’
‘সাতদিনের জন্যে একবার গিয়েছিলাম।’
কী আশ্চর্য! এমনভাবে জেরা করছি সুলতাকে যেন মহা অপরাধে অপরাধিনী সে। এ ঠিক হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে আবার তিক্ততায় ভরে উঠল মমটা। দিশেহারা হয়ে এ কী করছি আমি?
পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। আবার রোদ, আর গাড়ি-ঘোড়ার নির্ঘোষের মধ্যে এসে যেন বাঁচলাম। আর নয়, অনেকক্ষণ ধরে নির্যাতন করা হয়েছে বেচারি কস্তুরীর ওপর— এবার ও একলা থাকুক। আমারও একলা থাকা দরকার… অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে।
‘এ-ভাবে বেড়াতে ভালো লাগছে না তোমার, তা-ই না? এই নাও… যা তোমার দরকার, তা-ই নাও।’ কয়েকটা দশ টাকার নোট সুলতার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘একলা একলা যতটা পারো ফুর্তি করে নাও… তারপর আবার দেখা হবে হোটেলে।’
নির্ভাষ চোখ মেলে নোটগুলি নিলে সুলতা; মুখে বললে, ‘বেশি দেরি কোরো না।’
আবার রাগ হয়ে গেল নিজের ওপর, আবার ভুল করলাম আমি! কেন? কেন আমি রক্ষিতার মর্যাদা দিয়ে রাখছি সুলতাকে? এত পরিশ্রম একেবারেই বরবাদ হয়ে গেল সামান্য একটি ভুলে? নির্বোধের মতো আমিই তো তাকে না-সুলতা না-কস্তুরী বানিয়ে রাখছি।
বিশ-তিরিশ গজও যায়নি সুলতা, আচমকা নিঃসীম শঙ্কায় দুলে দুলে উঠল মনটা। রোদ্দুর ঝকমকে ফুটপাতের ওপর ওর চলার ভঙ্গিমা, কাঁধের দোলন, আর প্রতিবার পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তন্বীদেহে ছোট ছোট হিল্লোলের সঙ্গে তো আমার আজকের পরিচয় নয়! এ যে চেনা… বড় চেনা… কতদিন দেখেছি এইভাবে তাকে চলে যেতে… ওই তো ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে ও… রাস্তা পেরোচ্ছে… সর্বনাশ! আর যদি ফিরে না আসে?
দু-হাত বাড়িয়ে কিছুটা ছুটে যাই আমি।
পরক্ষণেই থমকে দাঁড়িয়ে যাই। মূর্খ! আর পালাবে না কস্তুরী… কোনও ভয় নেই… এত বোকা নয় ও… আমার মতো স্বর্ণহংসকে ফেলে অকারণে গা ঢাকা দেওয়ার মতো আহাম্মকি ও করবে না।
কিন্তু কেন এত দেরি হচ্ছে? কেন এত সময় নিচ্ছে কস্তুরী নিজেকে জাগিয়ে তুলতে? দুই সত্তায় দ্বন্দ্ব লেগেছে কি? এমনও হতে পারে তো, শেষ পর্যন্ত কস্তুরী আর ফিরে আসবে না… সুলতা মিত্ৰই হবে চিরস্থায়ী?
আচ্ছা, তা-ই যদি হয়, তবে কেন আমি সুলতা মিত্রকেই ভালোবেসে সুখী হতে পারছি না? কেন মিছিমিছি একটা অলীক কল্পনার পেছনে ছুটতে গিয়ে বিরামবিহীনভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিষিয়ে তুলছি পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটুকু?… শেষ পর্যন্ত যদি আমার নিরন্তর সন্দেহ, বদমেজাজ, নির্যাতন আর বকাবকি সহ্য করতে না পেরে আবার উধাও হয়ে যায় কস্তুরী? হঠাৎ একদিন যদি সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায়?
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো মুহূর্তের মধ্যে অসাড় হয়ে গেল আমার পা-দুটো। সামনের ল্যাম্পপোস্টটা ধরে সামলে না নিলে পড়েই যেতাম ফুটপাতের ওপর। দুঃসহ এই সম্ভাবনার চিন্তাটুকুই যেন শ্বাসরোধ করে আনছিল আমার।
অনেকক্ষণ পর হৃদরোগীর মতো ধুকতে ধুকতে আবার পথ চলতে লাগলাম আমি। বেচারি কস্তুরী!… অযথা নির্যাতন করে নিষ্ঠুর আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছি বার বার… কিন্তু কেন… কেন কথা বলতে চাইছে না ও?
যদি হঠাৎ বলে? হঠাৎ যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখের ওপর বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, আমি মরে গিয়েছিলাম। শ্মশান থেকে উঠে এসেছি আমি। এই কালো চোখ দিয়ে আমি দেখেছি…’
সঙ্গে সঙ্গে কি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো আছড়ে পড়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে না আমার দেহ?
সত্যি সত্যি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি? কিন্তু যুক্তিকে মেনে নিলে এসব পাগলামো ছাড়া আর কী?
অনেকক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে হোটেলের পথ ধরলাম। কাছাকাছি এসে ফুলের দোকান থেকে একটা গোলাপের তোড়া কিনলাম। ঘরের পরিবেশ খানিকটা পালটাবে ফুলের আর্বিভাবে। সুলতাও নিজেকে আর বন্দিনী মনে করতে পারবে না। গোলাপের তেজালো সুবাস মনকে মুহূর্তের মধ্যে উধাও করে নিয়ে গেল আর একটি দিনে… বিশ্বাসহন্তার মতোই ফিরে এল পুরোনো স্মৃতি। ঘরের দরজা খুলেই মনটা আবার তেতো হয়ে উঠল। খাটের ওপর শুয়ে রয়েছে সুলতা। পাশের টিপয়ের ওপর আছড়ে ফেলে দিলাম তোড়াটা।
‘ভালো তো?’ শুধোই আমি।
না, ভালো নেই সুলতা। কাঁদছিল ও… নিঃশব্দে জল ঝরছিল গাল বেয়ে বালিশের ওপর।
দুই মুঠি শক্ত করে ছুটে গেলাম সামনে, ‘কী হয়েছে? বলো কী হয়েছে?’
নিরুত্তরে তবুও কাঁদতে লাগল সুলতা।
আস্তে আস্তে নিচু হয়ে ওর মুখটি আলতো হাতে ধরে ঘুরিয়ে দিলাম আলোর দিকে।
কস্তুরীকে কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি আমি। তবে জলে-ভেজা মুখ একদিন দেখেছিলাম— গঙ্গার তীরে— জল থেকে উদ্ধার করার পর।
দুই চোখ মুদে বিড়বিড় করে উঠি অবরুদ্ধ কণ্ঠে, ‘চুপ করো! থামাও কান্না! জানো না, তোমার কান্না আমাকে কতখানি কষ্ট…’
তারপরেই আচমকা রেগে গিয়ে মেঝের ওপর লাথি মেরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, ‘চুপ করো! থামো!’
ধড়মড় করে উঠে বসেছিল সুলতা; আস্তে আস্তে বুকের কাছে টেনে নিলাম ওকে। মিনিটখানেক নিবিড়ভাবে বসে রইলাম দু-জনে। তারপর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মাফ করো, আমার নার্ভ ঠিক নেই। ক্ষমা করো… আমি যে তোমায় ভালোবাসি… বড় ভালোবাসি!’
ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে লাগল দিনের আলো। নীচে রাস্তায় ক্যাঁচ করে ব্রেক কষল একটা মোটর। চাঁদের আলো খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে এসে পড়ল ওপাশের দেয়ালে। গোলাপের সুবাস ভাসছে ঘরের বাতাসে। সুলতাকে বুকে নিয়ে শান্ত হয়ে এসেছিলাম আমি। কী হবে অন্তহীন অনুসন্ধানে? একে নিয়েই তো সুখী আমি? কস্তুরীকে পেলে আরও ভালো হত? কিন্তু এই চাঁদের আলোয় পাশে শায়িতা নারীমূর্তিকে কস্তুরী বলে কল্পনা করাও কঠিন। কস্তুরী হারিয়ে গেছে… চিরতরে বিদায় নিয়েছে।
‘চলো, খেয়ে আসি।’ ফিসফিস করে বলল সুলতা।
‘না, থাক। খিদে নেই আমার।’
বড় ভালো লাগছিল এই বিশ্রামটুকু। এইভাবেই সারাটা রাত আমার পাশে শুয়ে থাকবে সুলতা… ভোরের আলো না ওঠা পর্যন্ত কাঁধের ওপর মাথা দিয়ে আমার বাহুবন্ধনে নিজেকে ছেড়ে দেবে ও… কস্তুরী… না… কস্তুরী নেই… ও দুটো নাম এক নয়… কোনওকালেই ছিল না… খামোকা দুইকে এক করার আর কোনও দরকার নেই, আর আমার ভয় নেই।
‘আর আমার ভয় নেই।’ বিড়বিড় করে বলেছিলাম আমি।
কপালে আলতো টোকা দিলে সুলতা। গালের ওপর উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। বাতাসে গোলাপের সৌরভ যেন আরও গাঢ়, আরও মদির হয়ে উঠছে, কোমল তন্বী দেহের উত্তাপ যেন আমার শরীরে প্রবেশ করছিল। চোখে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করছিল যে-হাত, অন্ধকারে মুঠির মধ্যে ধরলাম সেই হাতটি।
‘এসো।’
আরও পাশে সরে এল তন্বীদেহ। হাতটা তখনও আমার মুঠির মধ্যে। তুলতুলে নরম আঙুল। এবার আমি চিনেছি… সেই হাড় বার-করা সরু কবজি, খাটো বুড়ো আঙুল, গোল গোল নখ। আমি যে ভুলতে পারছি না… কোনওদিনই পারব না… হু-হু করে মনটা পিছিয়ে গেল সেই দিনটিতে… চলন্ত গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে মানিকিউ করা হাত রেখেছে কস্তুরী… সেই একই হাত দিয়ে কাঁপা কাঁপা আঙুলে খুলছে আয়নার সুদৃশ্য মোড়ক… চোখ খুললাম আমি। পাশেই শুয়ে রয়েছে অনড় মূর্তি। মুহূর্তের জন্যে কান পেতে শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনলাম আমি। তারপর কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে ঝুঁকে পড়লাম অদৃশ্য মুখটির ওপর। আমার ঠোটের ছোঁয়ায় সামান্য কেঁপে উঠল অদৃশ্য চক্ষুপল্লব।
‘কেন বলছ না তুমি কে?’ বেদনাঘন কণ্ঠে শুধোই, ‘সত্যিই কি তুমি বলবে না, তুমি কে?’
চোখ উপচে আবার গড়িয়ে পড়ল উষ্ণ অশ্রুধারা… নোনা-স্বাদে কি এত দুঃখ জমেছিল? রুমালটা কই? বালিশের নীচে নেই।
‘দাঁড়াও আসছি।’
খাট থেকে নেমে বাথরুমে গেলাম। ড্রেসিং টেবিলে অন্যান্য কসমেটিকস-এর মধ্যে সুলতার ভ্যানিটি ব্যাগ থাকে। ব্যাগ খুলে ভেতরে হাত চালালাম— নেই রুমালটা। রুমালের বদলে আঙুলে ঠেকল গোল গোল কয়েকটা দানা— নেকলেস। হ্যাঁ, নেকলেসই বটে। জানলার সামনে তুলে ধরতেই ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে চাঁদের মরা-আলো এসে পড়ল নেকলেসটার ওপর। মূল্যবান পাথরগুলো ওই ফ্যাকাশে আলোতেই জ্বলছে। হাত কাঁপতে লাগল আমার। সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই— এ নেকলেস উমা দেবীর।