Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেমের গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প79 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    পাথর

    পাথর

    চিত্রা মা, চা-টা উপরে দিয়ে আয়তো।

    চিত্ৰা বারান্দায় বসে নখ কাটছিল। বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলের একটা নখ ভেঙ্গেছে, ভাঙ্গা নখ রিপেয়ার করা সহজ ব্যাপার না। তার সমস্ত মনযোগ সেই নখে। নখটা এমনভাবে কাটতে হবে যেন ভাঙ্গাটা চোখে না পড়ে। চিত্রা মার দিকে না তাকিয়েই বলল, দেখছ না মা একটা কাজ করছি।

    সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, কাজটা এক মিনিট পরে করলে হয় না?

    চিত্রা বলল, হয় না। উপরে চা নিয়ে যাওয়ার চেয়ে আমার কাজটা অনেক বেশি জরুরী। তা ছাড়া উপরে চা নিয়ে যেতে আমার ভাল লাগে না।

    সুরমা অবাক হয়ে বললেন, কেন?

    জোবেদ চাচা সারাক্ষণ জ্ঞানের কথা বলেন। পড়া জিজ্ঞেস করেন। ইংলিশ ট্রানস্লেশন জিজ্ঞেস করেন। আমার অসহ্য লাগে।

    তুইতো তার সঙ্গে বেশ হাসিমুখেই কথা বলিস।

    আমি সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলি। অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে আরো বেশি হাসি মুখে বলি, যাতে তারা বুঝতে না পারে আমি খুব চমৎকার অভিনেত্রী। যাদের সঙ্গে আমি খারাপভাবে কথা বলি বুঝতে হবে তাদের আমি খুব পছন্দ করি। যেমন তুমি।

    সুরমা বিরক্ত মুখে চায়ের কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছেন। সকাল বেলার এই কাজের সময়ে চিত্রার বকবকানি শোনার কোন অর্থ হয় না। মেয়েটার কথাবার্তা কাজ কর্মের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। বারান্দায় বসে নখ কাটছে। কাটা নখ ছড়িয়ে থাকবে— সে উঠে চলে যাবে।

    চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। সুরমা উপরে পাঠানোর কোন ব্যবস্থা করতে পারছেন না। কাজের মেয়েটার জ্বর এসেছে। সে কাথামুড়ি দিয়ে কে কেঁ করছে। রশীদকে পাঠিয়েছেন বাজারে। এক কাপ চা উপরে পাঠানোর লোকের অভাবে নষ্ট হবে? তাঁর মনটা খুঁত খুঁত করছে। অপচয় তার একেবারেই সহ্য হয় না। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চা তাঁর পছন্দের পানীয় না। চা খাবার পর মুখ মিষ্টি হয়ে থাকে। মিষ্টি ভাবটা কিছুতেই যায় না।

    চিত্রার নখ কাটা শেষ হয়েছে। তার মুখ হাসি হাসি। তার অভিনয়টা ভাল হয়েছে। মা সত্যি সত্যি ধরে নিয়েছেন সে জোবেদ চাচাকে খুবই অপছন্দ করে। সামান্য এক কাপ চাও সে উপরে নিয়ে যেতে রাজি না। অথচ সে ছটফট করছে কারণ এগারোটা প্রায় বাজে এখনো অদ্ভুত মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। এখন সে নিশ্চিন্ত মনে চা নিয়ে উপরে যেতে পারবে। খুব কম করে হলেও এক ঘন্টা কথা বলতে পারবে। চিত্রা রান্নাঘরে ঢুকল। বিরক্ত বিরক্ত মুখ করে বলল–

    মা চা দাও। নিয়ে যাচ্ছি।

    সুরমা গম্ভীর গলায় বললেন, তোকে নিতে হবে না।

    অন্য একজনের চা তুমি চুক চুক করে খেয়ে ফেলছ আশ্চর্য!

    শুধু শুধু কথা বলিস নাতো।

    চিত্রা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, মা শোন, আমি এক ঘন্টার জন্যে ছাদে যাচ্ছি। ছাদে হাঁটাহাঁটি করব। এই এক ঘন্টায় কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। আর শোন তুমি আরেক কাপ চা বানিয়ে দাও—আমি জ্ঞানী চাচার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি।

    তোকে চা দিয়ে আসতে হবে না।

    অবশ্যই হবে। না দেয়া পর্যন্ত আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। সারাক্ষণ মনে হবে আহা আমার জন্যে বেচারা চা খাওয়া থেকে বঞ্চিত হল। অপরাধবোধ থেকে হবে গিল্ট কমপ্লেক্স। সেখান থেকে জটিল জটিল সব মনের রোগ তৈরি হবে। তারপর একদিন দেখা যাবে আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছি। আমার মাথার ঘিলু চারদিকে ছিটকে পরে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তুই সারাক্ষণ এত কথা বলিস কিভাবে? ছোট বেলায় তো এ রকম ছিলি না?

    ছোটবেলায় কি রকম ছিলাম, হাবা টাইপের?

    আর কথা বলিস না তো।

    তুমি আমার সামনে থেকে সরেতো মা। আমি চা বানাব। আমার নিজেরো চা খেতে ইচ্ছে করছে। জ্ঞানী চাচার জন্যেও এক কাপ নিয়ে যাব। অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হব। ভাল কথা মা–আমার হাতের কাটা নখগুলি সারা বারান্দায় ছড়ানো—কাউকে দিয়ে পরিস্কার করিও নয়ত তুমিই আমার সঙ্গে খাছ খ্যাচ করবে।

    চুপ করতো। চিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠল। সে চায়ের কাপে চা ঢালছিল। হাসির কারণে চা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। ধমক দেয়ার বদলে সুরমা মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এত সুন্দর! পিঠময় চুল ছড়িয়ে সে বসে আছে ঘর আলো হয়ে আছে। সুরমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এত সুন্দর হওয়া ভাল না।

    মা।

    কি?

    তোমার কি ধারণা—আমাদের জ্ঞানী চাচা বোকা না বুদ্ধিমান?

    বোকা হবে কেন? এসব কি ধরনের কথা?

    একমাত্র বোকারাই সারাক্ষণ জ্ঞানীর মত কথা বলে। এই জন্যেই আমার ধারণা তিনি বেশ বোকা।

    শুধু চা নিয়ে যাচ্ছিস কেন বিসকিট নিয়ে যা।

    আমি কিসকিট ফিসকিট নিতে পারব না।

    চিত্রা চা নিয়ে উঠে চলে গেল! সুরমা গেলেন বারান্দায় ছড়িয়ে থাকা নখ পরিস্কার করতে।

    বারান্দা ঝকঝকে পরিস্কার। নখের একটা কণাও কোথাও পড়ে নেই। মেয়েটা কি যে করে। মায়ের সঙ্গেও ফাজলামী। রশীদ বাজার নিয়ে এসেছে। তিনি বাজার তুলতে গেলেন। রশীদকে দিয়ে একটা প্লেটে করে কয়েকটা বিসকিটও উপরে পাঠাতে হবে। কথাটা মনে থাকলে হয়। তার কিছুই মনে থাকে না। বাজার তুলতে তুলতে আসল কথাটাই ভুলে যাবেন। পুঁই শাকের বড় বড় পাতা আনতে বলেছিলেন। এনেছে কি না কে জানে? হয়ত ভুলে বসে আছে। চিত্রার বাবা ইলিশপাতুরি খেতে চেয়েছিলেন। সরিষাও আনা দরকার ছিল। পুরানো সরিষায় তিতকুট ভাব হয়। পাতুরি বানালে জোবেদ সাহেবকে পাঠাতে হবে। ভাল মন্দ রান্নার সময় ভদ্রলোকের কথা মনে হয়— শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয় না। আসল সময়ে ভুলে যান। সুরমার মনে হল ডায়াবেটিসের সঙ্গে জরুরী বিষয় ভুলে যাবার একটা সম্পর্ক আছে। ডায়াবেটিস ধরা পরার পর থেকে এ রকম হচ্ছে। না আজ জোবেদ সাহেবকে খাবার পাঠাতেই হবে।

    জোবেদ আলি সুরমাদের তিন তলা বাড়ির ছাদে থাকেন। ছাদে চিত্রার বাবা আজীজ সাহেব বাথরুমসহ একটা ঘর বানিয়ে ছিলেন। গেষ্ট রুম। গেষ্ট এলে ছাদে থাকবে মূল বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না। মাঝে মাঝে নিজেরাও থাকবেন। বৃষ্টি বাদলার দিনে ছাদের চিলেকোঠায় থাকতে ভালই লাগে। সেই পরিকল্পনা কাজে লাগলো না। আজীজ সাহেবের মাথায় অর্থকরী পরিকল্পনা খেলা করতে লাগল। ছাদের ঘরটা ভাড়া দিলে কেমন হয়। নিঝনঝট টাইপের ভাড়াটে পাওয়া গেলে প্রতি মাসে হেসে খেলে দুহাজার টাকা পাওয়া যাবে বছরে চব্বিশ। হাজার, দশ বছরে দুইলাখ চল্লিশ হাজার। আজীজ সাহেব এক রুম ভাড়া হবে এমন একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বর্তমান ভাড়াটে জোবেদ আলি সেই বিজ্ঞাপনের ফসল। ভদ্রলোকের বয়স তিপ্পান্ন। ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। ভাল না লাগায় ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে বই পড়া এবং লেখালেখি ছাড়া কিছুই করেন না। এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলেন, যেভাবে বেঁচে আছি এইভাবে আরো দশ বছর বেঁচে থাকার মত অর্থ আমার আছে। দশ বছরের বেশি বেঁচে থাকব বলে মনে হয় না। যদি বেঁচে থাকি তখন দেখা যাবে।

    আদর্শ ভাড়াটে বলে যদি পৃথিবীতে কিছু থেকে থাকে জোবেদ আলি তাই। তিনি কোথাও যান না, কেউ তাঁর কাছে আসে না। দুপুর বা মধ্যরাতে হঠাৎ টেলিফোন করে কেউ বলে না—আপনাদের ছাদে যে ভদ্রলোক থাকেন জোবেদ আলি তাকে একটু ডেকে দিন না। শুরুতে আজীজ সাহেব বলে দিয়েছিলেন— ভাই মাসের দু তারিখে ভাড়া দিয়ে দেবেন। এক বছর হয়ে গেল জোবেদ আলি তাই করছেন খামে ভর্তি করে কুড়িটা একশ টাকার নোট দিচ্ছেন। প্রতিটি নোট নতুন। কোন ময়লা নোট বা স্কচটেপ লাগানো নোট তার মধ্যে নেই। ভাড়াটের নানান অভিযোগ থাকে—এই ভদ্রলোকের কোন অভিযোগও নেই। একবার পানির মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিন দিন পানি ছিল না। তিনি কাউকে কিছু বলেন নি। একতলা থেকে বালতি করে পানি এনেছেন। সুরমা দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, একি আপনি পানি তুলবেন কেন? আমার ঘরে তিনটা কাজের মানুষ, বললেই পানি তুলে দেয়। জোবেদ আলি বলেছিলেন–ভাবী, আমি নিজেও একজন কাজের মানুষ। সামান্য এক বালতি পানি উপরে তোলার সামর্থ আমার আছে। যেদিন থাকবে না সেদিন আপনাকে বলব।

    আজীজ সাহেব পৃথিবীর কোন মানুষকে বিশ্বাস করেন না, পছন্দও করেন না। তার ধারণা আল্লাহতালা মানুষকে বদ হিসেবে বানিয়েছেন। ভাল যা হয় নিজের চেষ্টায় হয়— কিছুদিন ভাল থাকার পর আবার নিজের বদ ফরমে ফিরে যায়। সেই আজীজ সাহেবেরও ধারণা—জোবেদ আলি মানুষটা খারাপ না। সুরমা পৃথিবীর সব মানুষকে বিশ্বাস করেন। তার ধারণা জোবেদ আলি মানুষ হিসেবে শুধু ভাল না, অসাধারণ ভাল। শুধু একটু দুঃখি। তাতো হবেই ভাল মানুষরা দুঃখি দুঃখি হয়। ভদ্রলোকের একটা মাত্র মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে চলে গেল ভার্জিনিয়া। বাবা একা পরে রইল দেশে। বাবা এবং মেয়ের আর দেখা হবে কিনা কে জানে? সুরমা একবার কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলেন— আচ্ছা ভাই স্ত্রী মারা যাবার পর আপনি আবার বিয়ে করলেন না কেন? বিয়ে করলে তো আর এই কষ্টটা হত না। একা একা পড়ে আছেন ভাবতেই খারাপ লাগে।

    ভদ্রলোক হাসিমুখে বলেছেন–ভাবী এটা একটা বড় ধরনের বোকামী হয়েছে। ব্যাপারটা আপনাকে বলি–আমার মেয়ের জন্মের পরপর স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থ অবস্থায় এক রাতে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, শোন তুমি আমাকে একটা কথা দাও, যদি আমি মরে টরে যাই তুমি কিন্তু বিয়ে করতে পারবে না। আমি ঘুমের ঘোরে ছিলাম বলে ফেললাম, আচ্ছা। বলেই ফেঁসে গেছি। বেচারী তার মাসখানিক পর মারা গেল আমি ঝুলে গেলাম। হা হা হা।

    সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, হাসছেন কেন? এর মধ্যে হাসির কি আছে?

    ঘুমের ঘোরে একটা কথা বলে কেমন ফেঁসে গেলাম দেখেন না। এই জন্যই হাসছি।

    ভাই আপনি বড়ই আশ্চর্য লোক।

    আমি মোটেই আশ্চর্য লোক না ভাবী, আমি খুবই সাধারণ লোক। বেশি সাধারণ বলেই বোধহয় আশ্চর্য মনে হয়।

    আপনার স্ত্রী কি খুব সুন্দরী ছিলেন?

    সুন্দরী ছিল কিনা বলতে পারছি না, তবে অপুষ্টিজনিত কারণে বাঙ্গালী মেয়েদের চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব থাকে। সেই মায়া ভাবটা ডবল পরিমাণে ছিল এইটুকু বলতে পারি।

    তাঁর ছবি আছে আপনার কাছে?

    আমার কাছে নেই। আমার মেয়ের কাছে আছে। মার সব ছবি তার কাছে।

    জোবেদ আলির প্রতি মায়ায় সুরমার হৃদয় দ্রবীভূত হল। বার মনে হল ইস মানুষটার জন্যে কিছু যদি করা যেত। যতই দিন যাচ্ছে সেই যা বাড়ছে।

    চিত্রা চায়ের কাপ হাতে জোবেদ আলি সাহেবের ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার নিচের ঠোটটা কামড়ে ধরে আছে। তার কপালে ঘাম। সে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করছে যে অস্থিরতার কারণটাও তার কাছে ঠিক স্পষ্ট নয়। জোবেদ আলি চৌকিতে বসে আছেন। তার পিঠ দেয়ালে। পরণে লুঙ্গি ও ফুল হাতা সার্ট। ভদ্রলোকের অনেক বিচিত্র অভ্যাসের একটি হচ্ছে ফুলহাতা শার্ট ছাড়া তিনি পরেন না। চিত্রার মনে হল-ইস ইনাকে কি সুন্দর লাগছে। এটা মনে হবার জন্যে সে লজ্জিতও হল না, অপ্রস্তুতও বোধ করল না।

    অথচ প্রথমদিন মানুষটাকে দেখে খুব রাগ লেগেছিল। বাইরের উটকো একজন মানুষ ছাদের ঘরে পড়ে থাকবে। যখন তখন ছাদে আসা যাবে না। বৃষ্টিতে ছাদে গোসল করা যাবে না। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে তর্ক করা যাবে না। বাবা কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে বলবেন, যা বোঝ না তা নিয়ে তর্ক করবে না। তোমার অভ্যাস হয়েছে তোমার মার মত না বোঝে তর্ক।

    চিত্রা বাবাকে বলেনি জোবেদ নামের মানুষটাকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে গেছে। কঠিন কথাও ঠিক না— অবহেলা সূচক কিছু কথা। যা থেকে মানুষটা ধরে নেবে—এখানে তার বাস সুখকর কিছু হবে না।

    লোকটা চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল এবং পা নাচাচ্ছিল। চিত্রাকে দেখে পা নাচানোও বন্ধ করল না, বই থেকেও চোখ তুললনা। গম্ভীর গলায় বলল, কেমন আছ চিত্রা?

    লোকটার পক্ষে তার নাম জানা বিচিত্র কিছু না। নামতো জানতেই পারে। হয়ত কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে। তারপরেও প্রথম আলাপেই পরিচিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করা, কেমন আছ চিত্রা, খুবই আশ্চর্যজনক।

    এসো ভেতরে এসো। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই অলক্ষণ।

    অলক্ষণ কেন?

    প্রাচীন বাংলার বিশ্বাস–যে মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তার ঘরে সুজন ঢুকে না।

    চিত্রা দরজা ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকল। এবং বেশ সহজ ভাবেই চৌকির উপর বসল। জোবেদ আলি নরম গলায় বললেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

    ভাল, শুধু ইংরেজীটা খারাপ হয়েছে।

    ইংরেজী এ খারাপ হলে কিছু যায় আসে না। ইংরেজী বিদেশী ভাষা। বাংলাটা ভাল হলেই ইল। ইংরেজি খারাপ হওয়া ক্ষমা করা যায়। বাংলা খারাপ হওয়া ক্ষমার অযোগ্য।

    আমার বাংলাও খারাপ হয়েছে।

    সেকি?

    আসলে আমার সব পরীক্ষাই খারাপ হয়েছে। তবে বাসায় কাউকে কিছু বলি নি। বাসার সবাই জানে আমার সব স্ত্রীক্ষা ভাল হয়েছে। শুধু ইংরেজীটা একটু খারাপ হয়েছে। আমি যা বলি সবাই আবার তা বিশ্বাস করে। কারণ আমি হচ্ছি খুব ভাল অভিনেত্রী।

    তাই নাকি?

    জ্বি।

    মাঝে মাঝে আমার নিজের অভিনয় দেখে মনে হয় আমি সুবর্ণা মুস্তফার চেয়েও ভাল অভিনয় করি। আমার চেহারাটা যদি আরেকটু মিষ্টি হত তাহলে টিভিতে যেতাম।

    তোমার চেহারা মিষ্টি না?

    জ্বি না।

    বুঝলে কি করে চেহারা মিষ্টি না?

    আমাকে রাতে কখনো পিপড়ায় কামড়ায় না। আমি মিষ্টি হলে রাতে নিশ্চয়ই পিপড়ায় কামড়াতো।

    জোবেদ আলি হো হো করে হেসে ফেললেন। হাসির উচ্ছাসে তার হাত থেকে বই পড়ে গেল। চিত্রা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামান্য রসিকতায় একটা মানুষ এত হাসতে পারে সে কল্পনাও করেনি। চিত্রা বলল, চাচা আমি যাই। জোবেদ আলি বললেন, অসম্ভব তুমি এখন যেতেই পারবে না। তোমাকে কম করে হলেও আরো পাঁচ মিনিট থাকতে হবে। আসলে আজ সকাল থেকে আমার মনটা খুব খারাপ ছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলে মনটা ভাল হয়েছে। আরেকটু ভাল করে দিয়ে যাও।

    চিত্রা বলল, আমি কারোর মন ভাল করতে পারি না। আমি যা পারি তা হচ্ছে মন রাগিয়ে দেয়। যেই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে সেই রেগে যায়।

    আচ্ছা বেশ তুমি আমাকে রাগিয়ে দিয়ে যাও দেখি কেমন রাগাতে পার। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হল

    চিত্রা পাঁচ মিনিটের জন্যে বসে শেষ পর্যন্ত পুরো এক ঘন্টা থাকল। সে আরো কিছুক্ষণ থাকতো কিন্তু সুরমা রশীদকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, এতক্ষণ কি করছিলি?

    চিত্রা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, মা শোন কাকে আমাদের বাড়িতে এনে ঢুকিয়েছ?

    সুরমা বললেন, কেন?

    আমি ভদ্রতা করে দেখা করতে গেলাম উনি আমাকে ইংরেজী ট্রানস্লেশন ধরলেন। তারপর উপদেশ আর বক্ততা। অসহ্য। বাবাকে বলে উনাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করবো মা! ঐ লোকের জন্য আমার ছাদে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল।

    তুই তোর মত ছাদে যাবি।

    অসম্ভব! আমি আর ভুলেও ছাদে যাব না।

    আসলে এক অর্থে চিত্রার ছাদে যাওয়ার সেদিন থেকেই শুরু। তারপর এক রাতে সে আশ্চর্য সুন্দর এবং একই সঙ্গে খুবই ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখল। সে দেখল সে হাঁটছে, ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে। সেই বাচ্চা মেয়েটা জাপানী পুতুলের মত সুন্দর। জোবেদ আলি নামের মানুষটা বাচ্চা মেয়ের অন্য হাত ধরে আছে। সেই মানুষটা বাচ্চা মেয়েটার বাবা, এবং সে মেয়েটার মা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা। কি লজ্জা। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারারাত সে জেগে রইল।

    নিজেকে মনে হচ্ছিল কুৎসিত একটা পোকা। সারারাত সে একটা পোকার মতই শরীর গুটিয়ে শুয়েছিল। শুয়ে শুয়েই সে ফজরের আজান শুনল। তার মা ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলছেন তাও বুঝল। এবং প্রথমবারের মত মনে হল— মা রোজ এত ভোরে উঠে আশ্চর্যতো। সে নিজেও বিছানা ছেড়ে নামল। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখে বারান্দার জলচৌকিতে সুরমা নামাজ পড়ছেন। বারান্দার এই অংশটা চিকের পর্দায় ঢাকা। খুব নিরিবিলি।

    সুরমা নামাজ শেষ করে বিস্মিত হয়ে বললেন, কি হয়েছে? চিত্রা বলল, কিছু হয়নি। ঘুম ভেঙ্গে গেছে।

    এত সকালে ঘুম ভাঙ্গল কেন?

    তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন সকালে ঘুম ভাঙ্গাটা অপরাধ।

    অপরাধ হবে কেন? সকালে ঘুম ভাঙ্গাটাতে খুব ভাল কথা। ফজরের দুরাকাত নামাজ পড়ে ফেলিস দেখবি সারাটা দিন কত ভাল যাবে। শরীর থাকবে ফ্রেস। আজ থেকে শুরু কর না।

    সব সময় উপদেশ দিও নাতো মা। অসহ্য লাগে। আজ ভোরবেলায় উঠেছি বলে কি রোজ ভোরবেলায় উঠব? কাল থেকে আবার আগের মত দশটার সময় ঘুম ভাঙ্গব।

    তুই যাচ্ছিস কোথায়?

    ছাদে। মর্নিং ওয়ার্ক করব।

    তোর চোখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেন?

    ভোরবেলা সবার চোখই লাল দেখায়। তোমার চোখও লাল। বাম চোখটা বেশি। ডানটা কম।

    চিত্রা ছাদে উঠে গেল।

    আশ্চর্য জোবেদ আলি সাহেব ছাদে হাঁটছেন। তাঁর পরণে ফুল হাতা সার্ট। ধবধবে সাদা লুঙ্গী। সার্টের রঙ খয়েরী। খয়েরী রঙের খানিকটা মুখে এসে পড়েছে। তাকে কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

    চিত্রা খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, ছাদে কি করছেন?

    জোবেদ আলি বললেন, হাঁটছি।

    আপনি রোজ এত ভোরে উঠেন?

    না। আজ বাধ্য হয়ে উঠেছি। দাঁতের ব্যথায় রাতে ঘুম হয়নি। দেখ গাল ফুলে কি হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সের অনেক যন্ত্রণা।

    দাঁতের ব্যথাটা কি খুব বেশি?

    এখন একটু কম। সব ব্যথাই দিনে কমে যায়। রাতে বাড়ে! তুমি কি রোজ এত ভোরে ওঠ?

    আমি সকাল দশটার আগে কখনো বিছানা থেকে নামি না।

    আজ নামলে যে?

    চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, কাল রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। এখন ঘুম পাচ্ছে। ঠিক করেছি ছাদে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শুয়ে পড়ব।

    কাল রাতে ঘুম হয়নি কেন?

    সত্যি জানতে চান?

    জানতে চাই এইটুকু বলতে পারি। সত্যি জানতে চাই, না মিথ্যা জানতে চাই তা বলতে পারি না।

    কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি কারণ কাল রাতে আমি টের পেলাম একজন মানুষকে আমি প্রচণ্ড রকম ভালবাসি। আপনি কি আমার কথায় অস্বস্তি বোধ করছেন?

    অস্বস্তি বোধ করব কেন? তোমার বর্তমান সময়টা প্রেমে পরার জন্যে আদর্শ সময়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয়ে গেছে, কিছু করার নেই–এই সময় প্রেমে পরবে নাতো কখন পরবে? প্রেমে কি একা একা পরেছ না দুজন মিলে পরেছ?

    আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন প্রেমে পরাটা খালে পরে যাবার মত।

    অনেকটা সে রকমই। কেউ কেউ এমন খালে পরে সেখানে হাঁটুপানি। সমস্যা হয় না। খাল থেকে উঠে আসতে পারে। আবার কোন কোন খালে অতলান্তিক পানি। উঠার উপায় নেই। সাঁতার জানলেও লাভ হয় না। কতক্ষণ আর সাঁতার কাটবে? এক সময় না এক সময় ডুবতে হবেই।

    চিত্রা বলল, আবার কোন খালে পানি নেই। শুধুই কাদা। সেই খালে পরা মানে নোংরা কাদায় মাখামাখি হওয়া।

    ভাল বলেছ। খুব গুছিয়ে বলছ।

    আপনার সঙ্গে থেকে আর কিছু শিখি বা না শিখি গুছিয়ে কথা বলা শিখেছি।

    তাওতো কিছু শিখলে। ভালটা মানুষ সহজে শিখতে পারে না। মন্দটা শিখে ফেলে। আমার মন্দ কিছু শেখনি?

    আপনার মন্দ কি আছে?

    অসংখ্য। প্রথম হল আলস্য। আমার মত অলস মানুষ তুমি তিন ভূবনে পাবে।

    অলস কোথায়? আপনি দিন রাত বই পড়ছেন। লিখছেন।

    আলস্যটাকে আড়াল রাখার এ হচ্ছে হাস্যকর একটা চেষ্টা। লোকে ভাববে অনেক কাজ করা হচ্ছে আসলে লবডঙ্গা।

    লবডঙ্গা কি?

    লবডঙ্গা হচ্ছে নব উংকা শব্দের অপভ্রংশ। নব ডংকা মানেতো জানই নতুন ঢোল। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না প্রচন্ড ঢোলের শব্দ হচ্ছে, সবাই ভাবছে না জানি কত কাজ হচ্ছে আসলে ঢোল বাজছে।

    আমি এখন যাচ্ছি।

    কি করবে ঘুমুবে?

    আমার মাথা ধরে আছে। প্রথমে কড়া এক কাপ চা খেয়ে মাথা ধরাটা কমাব তারপর দুটা ঘুমের অসুধ খেয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবব কি করা যায়।

    কি করা যায় মানে?

    একটা মানুষকে যে আমি প্রচন্ড রকম পছন্দ করি তাকে কি করে সেই খবরটা দেয়া যায় তাই ভাবব। আপনিতো খুব জ্ঞানী মানুষ আপনার কি কোন সাজেশন আছে?

    তাকে চিঠি লিখ। সুন্দর করে গুছিয়ে চিঠি লেখ।

    অসম্ভব। আমি চিঠি লিখতে পারব না!–আমার লজ্জা লাগবে।

    মুখে বলা কি সম্ভব ধর টেলিফোনে জানিয়ে দিলে।

    না।

    আমিতো আর কোন পথ দেখছি না।

    আপনার ধারণা চিঠি লিখে জানানোই সবচে ভাল।

    হ্যাঁ।

    তারপর সে যদি সেই চিঠি সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায় তখন কি হবে?

    খানিকটা রিস্কতো নিতেই হবে।

    আমি চিঠি লিখতে পারি না। আমি ভাল আছি তুমি কেমন আছ এই দুলাইন লেখার পর আমার চিঠি শেষ হয়ে যায়।

    তাহলে এক কাজ কর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ধার নাও। রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা কয়েক লাইন লিখে পাঠিয়ে দাও। এমন কিছু লাইন বের কর যাতে তোমার মনের ভাব প্রকাশিত হয়।

    আমি পারব না। আপনি বের করে দিন।

    লেখ—

    প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস
    তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।

    লেখার সময় খেয়াল রাখবে যেন বানান ভুল না হয়। প্রেমপত্রে বানান ভুল থাকা অমার্জনীয় অপরাধ।

    বানান ভুল হবে না। চিঠি লিখতে না পারলেও আমি বানান খুব ভাল জানি।

    চিত্রা ছাদ থেকে নেমে নিজেই চা বানিয়ে খেল। মাকে গিয়ে বলল–মা শোন, আমি এখন চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুম দেব। খবর্দার আমাকে নাশতা খাবার জন্যে ডাকাডাকি করবে না। আমি একেবারে দুপুরবেলা উঠে ভাত খাব।

    সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে হবে কেন?

    চিত্রা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি ঠিক করেছি একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে মারা যাব। আজ তার একটা রিহার্সেল।

    তুই সব সময় এমন পাগলের মত কথা বলিস না।

    আমি শুধু পাগলের মত কথাই বলি না, পাগলের মত কাজও করি। মা রশীদকে তুমি আমার ঘরে একটু পাঠাওতো।

    কেন?

    কাজ আছে।

    চিত্রা নিজের ঘরে ঢুকে চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খেল। তারপর ড্রয়ার থেকে কলম বের করে গোটা গোটা হরফে লিখল

    প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস।
    তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।

    কাগজটা ভাজ করে রশীদের হাতে দিয়ে বলল–রশীদ তুই এ কাগজটা জোবেদ চাচার হাতে দিয়ে আয়। এক্ষুনী যা! কাগজটা দিয়ে এসে আমাকে খবর দিবি কাগজ দিয়ে এসেছিস। হাবার মত এরকম হা করে থাকবি না। মুখ বন্ধ কর।

    চায়ের কাপ হাতে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছে? পাঁচ মিনিট? দশ মিনিট? নাকি তার চেয়েও বেশী। চা সম্ভবত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডাই ভাল। জোবেদ চাচা ঠাণ্ডা চা খান। চিত্রা তার জীবনে এই প্রথম একটা মানুষ পেল যে চা ঠাণ্ডা করে খায়। চিত্রা টুক টুক করে দরজায় দুবার টোকা দিল।

    জোবেদ আলি বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, ভেতরে এসো। সাত মিনিট দেরী হল যে?

    দেরী মানে?

    আমি জানতাম তুমি আমার ঘরে ঠিক এগারোটার সময় চা নিয়ে আসবে। এখন বাজছে এগারোটা সাত। কাজেই তুমি সাত মিনিট দেরী করেছ?

    আমি ঠিক এগারোটার সময় আসব আপনাকে কে বলল?

    আমার সিক্সথ সেন্স বলেছে।

    উফ কেন যে মিথ্যা কথা বলেন। আপনি কি ভেবেছেন আপনার মিথ্যা কথা শুনে আমি খুশি হব?

    আমি যে কথাটা বললাম সেটা যে মিথ্যা না তা কিন্তু আমি প্রমাণ করে দিতে পারি।

    বেশতো প্রমাণ করুন।

    টেবিলের উপরে দেখ একটা বই আছে জীবনানন্দ দাসের কবিতাসমগ্র। বইটার নিচে একটা কাগজ আছে। কাগজটায় কি লেখা আছে পড়ে।

    চিত্রা কাগজটা নিয়ে পড়ল। কাগজে লেখা- আমার সিক্সথ সেন্স বলছে চিত্রা ঠিক এগারোটায় আমার জন্যে চা নিয়ে আসবে। আমি চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি।

    পড়েছ?

    হ্যাঁ।

    আজকের তারিখ দেয়া আছে দেখেছ?

    হ্যাঁ।

    অবাক হয়েছ?

    হ্যাঁ।

    কতটুক অবাক হয়েছ?

    চিত্রা চাপা গলায় বলল, খুব অবাক হয়েছি।

    বিস্ময় অভিভূত?

    হ্যাঁ।

    জোবেদ আলি চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাসি মুখে বললেন, এত অল্পতে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে না। পরে সমস্যায় পরবে। সিক্সথ সেন্স টেন্স কিছু না। আমি যা করেছি তা হচ্ছে খুব সাধারণ একটা ট্রিকস। অনেকগুলি কাগজে এই জিনিস লিখেছি শুধু সময়টা একেক কাগজে একেক রকম। তুমি যদি বারটার সময় চা নিয়ে আসতে তাহলে বলতাম জানালার কাছে যে পিরিচটা আছে সেই পিরিচের নিচের কাগজটা দেখ। সেই কাগজে লেখা চিত্রা ঠিক বারটার সময় আমার জন্যে চা নিয়ে আসবে। এখন বুঝতে পারছ?

    এটা কেন করলেন?

    তোমার বিষ্ময়ে অভিভূত করে দেবার জন্যে করলাম।

    কৌশলটা পরে বলে ফেললেন–বিষ্ময়টাতো আর রইল না।

    কৌশলটা স্বীকার করায় বিস্ময় আরো দীর্ঘস্থায়ী হল। বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্ত হল মজা। তাই না?

    হ্যাঁ।

    গম্ভীর হয়ে আছ কেন?

    রাগ লাগছে।

    রাগ লাগছে কেন?

    আপনার এত বুদ্ধি আর আমার এত কম। বুদ্ধি এই জন্যে রাগ লাগছে।

    তোমার বুদ্ধি কম কে বলল?

    আমি জানি আমার বুদ্ধি কম। আমি মোটর সাইকেলের মত ফটফট করে কথা বলতে পারি কিন্তু আমার বুদ্ধি কম। আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে কাউকে বোকা বানাতে পারি না। শুধু মাকে পারি।

    উনাকে বোকা বানাও?

    হ্যাঁ মার ধারণা আপনাকে আমার একেবারেই পছন্দ না।

    তাই বুঝি?

    হ্যাঁ। আমার বুদ্ধি কম হলেও আমি আবার ভাল অভিনয় জানি। আমি নানান ধরনের অভিনয় করে মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখি। মার ধারণা আমি আপনাকে দেখতে পারি না।

    আসলে পার?

    চিত্রা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। জোবেদ আলি টের পাচ্ছেন মেয়েটি রেগে যাচ্ছে। তিনি রাগ কমানোর চেষ্টা করলেন না। মাথা নীচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন। চিত্রা বলল, আপনার বই লেখা কেমন এগুচ্ছে?

    ভাল।

    এখন কি লিখছেন?

    সৌন্দর্য কি? এই বিষয়ে একটা লেখা?

    সৌন্দর্য কি?

    জোবেদ আলি হাসি মুখে বললেন, তাতো জানি না।

    যা জানেন না তার উপর লিখছেন কি ভাবে?

    সৌন্দর্য কি তা যে আমি জানি না সেটাই লেখার চেষ্টা করছি।

    আপনার কথা বুঝলাম না।

    সব কথা যে বুঝতেই হবে এমন তো না। কথা না বোঝার মধ্যেও আনন্দ আছে।

    আমি এখন চলে যাব।

    আচ্ছা।

    আমার মনটা খুব খারাপ আপনি আমার মন ভাল করে দিন।

    মন কি ভাবে ভাল করব তাতো বুঝতে পারছি না। প্রবন্ধ যেটা লিখছি সেটা পড়ে শুনাব?

    না।

    চিত্রা ওঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে বলল, আমি যাচ্ছি। জোবেদ আলি বললেন, এমন রাগী রাগী ভাব করে চলে যেও না তারপর দেখবে নিজেরই খারাপ লাগবে। খানিকক্ষণ বসে মনটা ভাল করে তারপর যাও।

    আমার মন ভাল হবে না।

    মন ভাল হবার ব্যবস্থা করছি।

    কি ব্যবস্থা?

    তোমাকে একটা উপহার দিচ্ছি। উপহার পেলে মেয়েদের মন ভাল হয়।

    খুব ভুল কথা বলেছেন। মেয়েদের এত ছোট করে দেখবেন না। মেয়েরা উপহারের কাঙ্গাল না।

    আমি যে উপহার দেব তা পেয়ে তুমি অসম্ভব খুশি হবে তা আমি লিখে দিতে পারি।

    উপহারটা কি?

    জোবেদ আলি উঠলেন। টেবিলের ড্রয়ার খুলে বেশ বড় সাইজের একটা পাথর বের করে আনলেন। বিশেষত্বহীন পাথর। এইসব পাথর ভেঙ্গেই রেল লাইনে দেয়া হয়। দালান কোঠা তৈরীতে ব্যবহার হয়। এর বেশী কিছু না। চিত্রা আগ্রহী গলায় বলল, এই আপনার উপহার?

    হ্যাঁ।

    আপনার ধারণা এই পাথর পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা হব?

    হ্যাঁ হবে। কারণ এই পাথরে কিছু লেখা আছে।

    কি লেখা?

    চিত্রা গভীর আগ্রহে পাথর হাতে নিল। কোন লেখা দেখতে পেল না। সারা পাথরের গায়ে বল পয়েন্টে অসংখ্য গুণ চিহ্ন আঁকা।

    এই গুণ চিহ্নের মানে কি?

    জোবেদ আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে হাসি মুখে বললেন, একটা গুণ চিহ্ন আঁকতে দুটা দাগ দিতে হয়। দুটা দাগ মানে দুজন মানুষ। দুটা দাগ দুদিকে— তার মানে মানুষ দুজন ভিন্ন প্রকৃতির। একটা জায়গায় দাগ দুটি মিলেছে— তার মানে হল দুটি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ একটা জায়গায় মিলেছে। অর্থাৎ একটি ক্ষেত্রে তারা এক ও অভিন্ন। এরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে।

    চিত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। জোবেদ আলি বললেন, উপহার পছন্দ হয়েছে?

    চিত্রা গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ।

    জোবেদ আলি বললেন, তুমি বেশ কিছুদিন আগে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলে আমি ভেবেছিলাম কোনদিন সেই চিঠির জবাব দেব না। আজ এই পাথর দিয়ে জবাব দিলাম।

    চিত্রা ধরা গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু। আমি খুব খুশী হয়েছি।

    বেশ তাহলে এখন যাও। আমি এখন সৌন্দর্য বিষয়ে আমার অজ্ঞতা প্রসঙ্গে লেখাটা শেষ করব।

    চিত্রা পাথর নিয়ে বের হয়ে এল। সিড়ি দিয়ে নামার সময় পাথরটা সে গালে চেপে রাখল। তার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে আসছে।

     

    ২.

    তোর কোলে এটা কি?

    চিত্রা মার দিকে না তাকিয়ে সহজ গলায় বলল, পাথর। এর ইংরেজী নাম Stone.

    সুরমা বিস্মিত গলায় বললেন, পাথর কোলে নিয়ে বসে আছিস কেন?

    চিত্রা এবার মার দিকে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, বাংলাদেশ সংবিধানে এমন কোন ধারা আছে যে পাথর কোলে নিয়ে বসে থাকা যাবে না?

    সব কথায় তুই এমন পাচালো জবাব দিস কেন? সরাসরি জবাব দিতে অসুবিধা কি? রশীদ আমাকে বলল, তুই নাকি সারাক্ষণ একটা পাথর নিয়ে ঘুরিস। আমি তার কথা বিশ্বাসই করিনি। এখন দেখছি সত্যি।

     

    পাথর নিয়ে ঘোরা কোন বড় অপরাধের মধ্যে পড়ে না মা। পাথর ছুঁড়ে করো মাথার ঘিলু বের করে দিলে বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় মামলা হবে। পাথরতো আমি ছুঁড়ে মারছি না। কোলে নিয়ে বসে আছি।

    শুধু শুধু পাথর কোলে নিয়ে বসে আছিসই বা কেন?

    আচ্ছা যাও আমি পাথর রেখে আসছি, অকারণে চেঁচিওনাতো মা।

    চিত্রা পাথর নিয়ে তার ঘরে ঢুকে পড়ল। সুরমা শংকিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শংকিত হবার তার যথেষ্ট কারণ আছে। পাথর নিয়ে চিত্রার বাড়াবাড়িটা আজ না অনেক আগেই তার চোখে পড়েছে। তিনি কিছু বলেন নি। ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করেছেন। সুরমা এই সংসারে বেকার একটা ভাব ধরে থাকেন। সংসার পরিচালনায় এতে তাঁর খুব লাভ হয়। বোকাদের সাথে কথা বলার ব্যাপারে সবাই অসাবধানে থাকে। তাতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।

    চিত্রা যে জোবেদ আলি নামের আধবুড়ো মানুষটার জন্যে পাগল হয়ে আছে তা তিনি বুঝেছেন চিত্রার বোঝার আগেই। কিন্তু যেহেতু সংসারে তিনি বোকা সেজে থাকেন সেহেতু চিত্রাকে কিছু বুঝতে দেন নি। চিত্রা তাঁকে ভুলার জন্যে নানান ধরনের অভিনয় করছে। খুব কাঁচা অভিনয়। যখন তাকে বলা হয় যাতে জোবেদ সাহেবকে এক কাপ চা দিয়ে আয় কিংবা এই হালুয়াটা দিয়ে আয় সে বলবে— আমি পারব না মা। আমার উপরে যেতে ইচ্ছা করে না। তিনি যতই জুড়াজুড়ি করবেন সে ততই না করবে শেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে যাবে। ফিরবে এক থেকে দুঘন্টা পর।

    এইসব লক্ষণ খুবই খারাপ। অল্প বয়সের ভালবাসা অন্ধ গভারের মত শুধুই একদিকে যায়। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, আদর দিয়ে এই গন্ডার সামলানো যায় না। সুরমা আতংকে অস্থির হয়ে আছেন। আতংকট প্রকাশ করছেন না। পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। সমস্যাটা ভালমত বুঝতে পারলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যাবে। সমস্যাটা ভালমত বুঝতেও পারছেন না।

    জোবেদ আলি সাহেবের ভূমিকার্ট এখানে কি? ভদ্রলোক অতি বুদ্ধিমান। চিত্রার সমস্যাটা তাঁর বুঝতে না পারার কথা না। তিনি কি মেয়েটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? না সমস্যাটা সামলাবার চেষ্টা করছেন? একজন দায়িত্বশীল বিচক্ষণ ভদ্রলোক এইসব ব্যাপার কখনো প্রশ্রয় দেবেন না। তাঁর বড় মেয়ের বয়স চিত্রার চেয়ে বেশী। প্রশ্রয় দিতে গেলে এই কথাটা তাঁর অবশ্যই মনে পড়বে। তবে ভদ্রলোকের নিজের মনেও যদি কোন রকম দুর্বলতা জমে থাকে তাহলে তিনিও অন্ধ গন্ডারের মত আচরণ করবেন। পাথরের যে দেবত সেও পূজা গ্রহণ করে, মানুষ কেন করবে না?

    এখন যা করতে হবে তা হল ভদ্রলোককে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এই কাজটা তিনি করতে পারবেন না, চিত্রার বাবাকে দিয়ে করাতে হবে। তবে চিত্রার বাবাকে আসল কথা কিছুই বলা যাবে না। মেয়ের পাগলামী মানুষটার কানে গেলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। সুরমা তাঁর সংসারে ভয়ংকর কিছু চান না।

    সুরমা রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে চিত্রার ঘরে গেলেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করবেন। গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জোবেদ আলি সম্পর্কে কিছু কথা বলে দেখবেন মেয়ের মুখের ভাব বদলায় কিনা। দরকার হলে আজ রাতে মেয়ের ঘরে ঘুমুবেন।

    চিত্রা মশারী খাটিয়ে শুয়ে পরার আয়েজন করছিল। চিত্রা মাকে দেখে বলল, কি হয়েছে মা?

    সুরমা হাই তুলতে তুলতে বললেন, আজ তোর সঙ্গে ঘুমুবরে মা।

    আমার সঙ্গে ঘুমুবে কেন?

    তোর বাবার সঙ্গে ঝগড়ার মত হয়েছে। এই জন্যে।

    অসম্ভব। মা তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে পারবে না। তোমার গা থেকে মশলার গন্ধ আসে।

    কি বলিস তুই, গা থেকে মশলার গন্ধ আসবে কেন?

    সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে থাক মশলার গন্ধতে আসবেই–এখন আসছে হলুদ অরি পেয়াজের গন্ধ। তাছাড়া মা তিনজনের এক বিছানায় জায়গাও হবে না। বিছানা ছোট।

    সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, তিনজন কোথায়?

    আমি, তুমি আর পাথর। পাথরটা রাতে আমার সাথে ঘুমায়।

    পাথর রাতে তার সঙ্গে ঘুমায়?

    হ্যাঁ।

    আমারতো মনে হয় তুই পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছিল।

    পাগল হব কেন? পাথর সঙ্গে নিয়ে ঘুমালেই মানুষ পাগল হয়ে যায় না। তুমি কি পুতুল সঙ্গে নিয়ে ছোটবেলায় ঘুমুতে না? পাথরটা হচ্ছে আমার পুতুল।

    পাথরটাকে তুই গোসল দিসঃ রশীদ আমাকে বলছিল।

    রশীদতো দেখি বিরাট বড় ভাই হয়েছে। কি করি না করি সব রিপোর্ট করছে।

    পাথরটাকে তুই গোসল দিস কি-না সেটা বল।

    হুঁ দেই।

    কেন?

    এম্নি দেই মা। এই একটা খেলা। মজার খেলা। আমারতো খেলার কেউ নেই কাজেই পাথর নিয়ে খেলা। তুমিতো আর আমার সঙ্গে খেলবে না।

    সুরমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিত্রার মশারি খাটানো শেষ হয়েছে। সে তার পড়ার টেবিল থেকে পাথরটা নিয়ে বালিশে শুইয়ে দিয়ে মার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল, এসো ঘুমুতে এসো মা। রাত প্রায় বারোটা বাজে।

    তুই সত্যি সত্যি পাথর নিয়ে ঘুমুবি?

    হুঁ।

    পাথরটা তোকে কে দিয়েছে জোবেদ সাহেব?

    ইয়েস মাদার।

    তিনি তোকে খুব স্নেহ করেন?

    সেই করেন না হাতী। স্নেহ করলে কেউ কাউকে পাথর দেয়? দামী গিফট টিফট দিতে পারে। আড়ং এর সেলোয়ার বা পাথর বসানো নেকলেস।

    পাথরটা দিলেন কেন?

    উফ মা চুপ করতো। তোমার বকবকানীর কারণে পাথর বেচারা ঘুমুতে পারছে না। ও ডিস্টারবেন্স এক্কেবারে সহ্য করতে পারে না। এই শেষবারের মত আমি তোমাকে আমার ঘরে ঘুমুতে দিলাম আর না।

    চিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার একটা হাত পাথরের উপর রাখা। সুরমা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন ঘুমের মধ্যেই চিত্রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। পাথরটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে নিল। একি সর্বনাশ! সুরমা সারা রাত জেগে রইলেন।

     

    ৩.

    জোবেদ আলি বললেন, তোমার কি খবর?

    চিত্র হাসিমুখে বলল, আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি।

    খুব ভাল কথা বিরক্ত কর।

    জ্ঞানের কিছু কথা জানিয়ে দিনতো।

    জ্ঞানের কথা জানতে চাও?

    হু চাই। জ্ঞানের কথা বলতে বলতে আপনি যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন কিছুক্ষণ ভালবাসার কথা বলতে পারেন।

    ভালবাসার কথাও শুনতে চাও?

    হুঁ চাই। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব অসভ্য মেয়ে ভাবছেন। ভাবলে ভাববেন। আমি কেয়ার করি না।

    তাই বুঝি?

    হ্যাঁ তাই। এখন থেকে আমি ঠিক করেছি যখনই আমার জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছা করবে তখনি আমি চলে আসব। সেটা সকাল হতে পারে, দুপুর হতে পারে আবার রাত তিনটাও হতে পারে। কাজেই কখনো যদি রাত তিনটায় আপনার দরজায় টুক টুক শব্দ হয় তাহলে ভূতটুত ভেবে বসবেন না। এখন বলুন আপনার জ্ঞানের কথা।

    জ্ঞানের কথা শুনবে?

    হুঁ।

    ফেরাউনদের সময়কার হিরেললাগ্রাফি দিয়ে একটা গল্প বলব?

    বলুন।

    কাগজ কলম দাও গল্প বলি।

    গল্প বলতে কাগজ কলম লাগে?

    এই গল্পে লাগে। গল্পটা হচ্ছে আদি ও মৌলিক গল্প। গল্পের মজাটা হল চিত্র লিপিতে, গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে কি ছবি আঁকা হচ্ছে তা খেয়াল রাখবে।

    এক দেশে এক রাজা ছিল।

    রাজার এক রাণী ছিল।

    রাজ্জা ও রাণী সুখে বাস করত

    এক সময় রাণী গর্ভবতী হলেন

    তখন হঠাৎ রাজা মারা গেলেন

    যথাসময়ে রাণীর এক সন্তান হল

    এক সময় রাণীও মারা গেলেন

    বেঁচে রইল শুধু রাজকুমার।

    এবং রাজকুমারের মধ্যে রাজবংশের ভবিষ্যৎ বীজ।

    চিত্রকথায় পুরো গল্পটা হবে

    গল্পটা কেমন লাগল?

    চিত্র। ক্ষীণ গলায় বলল, অদ্ভুত। জোবেদ আলি বললেন, ছবি এঁকে একে বান্ধবীদের সঙ্গে এই গল্পটা করবে দেখবে ওরা খুব মজা পাবে।

    চিত্রা গম্ভীর মুখে বলল, আমার কোন বান্ধবী নেই। বান্ধবী থাকলে অবশ্যই এই গল্পটা বলতাম। আচ্ছা আপনি কি হাত দেখতে পারেন?

    না।

    আমার মনে হচ্ছে পারেন। প্লীজ আমার হাত দেখে দিন।

    এস্ট্রলজির দুএকটা বই টই পড়েছি–কিন্তু হাত দেখার উপর কোন বই পড়ি নি।

    চিত্রা বলল, আমি হাত দেখার উপর কোন বই পড়ি নি-কিন্তু আমি হাত দেখতে জানি। একজনের কাছ থেকে শিখেছি–দেখি আপনার হাতটা দিন-আমি দেখে দেই।

    এই বয়সে তুমি আমার হাতে কিছু পাবে না। মৃত্যু রেখা পেতে পার। মৃত্যু রেখার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই।

    আপনার না থাকলেও আমার আছে।

    জোবেদ আলি গম্ভীর গলায় বললেন–হাত দেখা টেখা কিছু না, তুমি আসলে আমার হাত ধরার একটা অজুহাত খুঁজছ।

    আপনার তো বেশী বুদ্ধি এইজন্যে সব আগে ভাগে বুঝে ফেলেন। আপনার হাত ধরতে চাইলে আমি সরাসরিই হাত ধরতাম, ভনিতা করতাম না।

    হাত ধরতে চাও না?

    চিত্রা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গঢ়ি গলায় বলল, চাই।

    জোবেদ আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন।

    সুরমা ছাদে এসেছিলেন শুকনা কাপড় নিতে। শুকনা কাপড় নেয়াটা তাঁর অজুহাত তিনি আসলে এসেছেন চিত্র কি করছে তা দেখার জন্যে। কাপড় তুলতে তুলতে নিঃশব্দে দেখে চলে যাবেন এই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। তিনি খোলা জানালায় যে দৃশ্য দেখলেন তা দেখার জন্যে তাঁর কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি দেখলেন চিত্রা দুহাতে জোবেদ আলির হাত চেপে ধরে আছে এবং ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। জোবেদ আলি মূর্তির ভঙ্গিমায় বসে আছেন।

    সুরমা সম্বিৎ ফিরে পেয়েই দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। সারা বিকাল তাঁর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সন্ধ্যায় প্রচন্ড মাথা ধরল। রাতে তিনি কিছু খেতে পারলেন না। আজীজ সাহেব রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমুতে এলে সুরমা বললেন–জোবেদ সাহেবত্তে অনেকদিন থাকলেন এখন চলে যেতে বললে কেমন হয়?

    আজীজ সাহেব চোখ সরু করে তাকালেন। স্ত্রীর সব কথাতেই তিনি চোখ সরু করেন। এবার যেন আরো বেশী সরু করলেন।

    বোকার মত কথা বলবে না। একজন ভদ্রলোককে খামাখা চলে যেতে বলব কেন? অসুবিধাটা কি? মাসে মাসে দু হাজার টাকা পাচ্ছ? এটা সহ্য হচ্ছে না? তুমি হুঁড়ি পাতিল নিয়ে আছ হাঁড়ি পাতিল নিয়ে থাক।

    সুরমা তারপরেও ক্ষীণ গলায় বললেন, একজন পুরুষ মানুষ ছাদে থাকেমেয়েরা ছাদে কাপড় শুকুতে যায়।

    তাতে হয়েছে কি?

    না কিছু হয় নি।

    কাকে ভাড়া দেব কাকে দেব না এইসব চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। চিন্তার মানুষ আছে।

    আচ্ছা।

    বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে আস।

    সুরমা বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন ঠিকই তার এক ফোটা ঘুম হল না। এক রাতে চারবার চিত্রার শোবার ঘরে গেলেন দেখার জন্যে চিত্রা ঘরে আছে কি-না। তাঁর মনে হল বাকি জীবনে তিনি আর কখনোই রাতে ঘুমুতে পারবেন না।

    চিত্রার ঘরের বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বেলে সে কি করছে? দরজায় টোকা দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন? চিত্রা রেগে যাবেনাতো? সে আজকাল অল্পতেই রেগে অাগুন হচ্ছে। অকারণেই রাগছে। তিনি মেয়ের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। টোকার শব্দ শুনেই চিত্রা বলল, কি চাও মা?

    ঘুমাচ্ছিস না?

    না।

    না কেন? ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে কাজেই আমিও জেগে আছি। গল্প করছি।

    কার সঙ্গে গল্প করছিস?

    পাথরটার সঙ্গে।

    মা দরজাটা একটু খুলতে।

    সুরমা ভেবেছিলেন মেয়ে দরজা খুলবে না। রাগ করবে। সে রকম হল না। চিত্রা দরজা খুলল। তার এক হাতে পাথর। মেয়ে কি সারাক্ষণই পাথর হাতে বসে থাকে। সুরমা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তুই পাথরের সঙ্গে গল্প করছিলি?

    হুঁ।

    পাথর কখা বলতে পারে?

    পাথর কি কথা বলবে? পাথর কি মানুষ না-কি? আমি কথা বলি ও শুনে।

    তুই ঘুমুতে যাস কখন?

    আমি ঘুমুতে যাই না। রাতে আমার ঘুম হয় না মা। আগে ঘুমের অষুধ খেলে ঘুম হত এখন তাও হয় না। আজ পাঁচটা ঘুমের অষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম। ঠিক এক ঘন্টা পর জেগে উঠেছি।

    তুই একজন ভাল ডাক্তার দেখা।

    শুধু শুধু ডাক্তার দেখাব কেন? আমার জ্বর হয়নি। মাথা ব্যথা হচ্ছে না। দিব্যি আরামে আছি। মা তুমি এখন যাও তার সঙ্গে আমার খুব গোপন কিছু কথা আছে। তোমারে সামনে বলা যাবে না।

    তুই শুয়ে থাক আমি তোর চুলে বিলি দিয়ে দি।

    তুমি আমাকে অনেক বিরক্ত করেছ। এখন যাও আর না।

    তিনি বের হয়ে এসে জায়নামাজে বসলেন। ফজর ওয়াক্ত পর্যন্ত দোরুদ পাঠ করলেন। দরুদে শেফা।

    ফজরের নামাজ শেষ করেই তিনি খতমে ইউনুস শুরু করলেন। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার পড়তে হবে দোয়া ইউনুস। ইউনুস নবী এই দোয়া পড়ে মাছের পেট থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। সুরমা যে বিপদে পড়েছেন—মাছের পেটে বাস করা তার কাছে কিছুই না। কিছু কিছু বিপদ থাকে মাকড়সার জালের মত সূক্ষ্মচোখে পর্যন্ত দেখা যায় না, কিন্তু মাকড়শার জালের মত হালকা না। এই ধরনের বিপদ আপদ থেকে সচরাচর উদ্ধার পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের অসীম দয়াতেই উদ্ধার সম্ভব। তিনিতো কোন পাপ করেন নি। আল্লাহ পাক কি তাকে দয়? করবেন না?

    আল্লাহ পাক সুরমাকে দয়া করলেন—এক রোববার ভোরে আজীজ সাহেবের বাড়ির উঠান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। উঠানে জোবেদ আলি হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন—তাঁর মাথা থ্যাতলানো। ঘিলু বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষটা খুব ভোরবেলা তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গেছে?

    আজীজ সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর লাভের গুড় পিপড়া খেয়ে ফেলল। ঘটনা সামলাবার জন্যে পুলিশকে ষাট হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। পুলিশ ইচ্ছা করলে কৃষ্ণপক্ষের রাতকে চৈত্রমাসের দিন করে ফেলতে পারে। সামান্য আত্মহতাকে মার্ডার বলতে তাদের আটকাবে না। সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাকে জেল হাজতে পঁচতে হবে।

    পুলিশের সমস্যা সামাল দিলেও আজীজ সাহেব ঘরের সমস্যা সামাল দিতে পারলেন না। চিত্রার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল। তার কথা অস্পষ্ট হয়ে গেল। কাকে কি বলে না বলে কিছু বোঝা যায় না। তার খাওয়ার ঠিক নেই, নাওয়ার ঠিক নেই। সারাদিন তার কোলে থাকে পাথর। সে নিজে গোসল করে না, পাথরটাকে রোজ গোসল দেয়। গুণগুণ করে পাথরকে কি যেন বলে।

    আজীজ সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, এর কি হয়েছে? এ রকম করে কেন?

    সুরমা বললেন, কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে মাথাতো খানিকটা এলোমেলো হবেই।

    কারো মাথা এলোমেলো হল না, তারটা হল কেন?

    বাচ্চা মানুষ। ঠিক হয়ে যাবে।

    পাথর নিয়ে এইসব কি করছে?

    বললামতো ঠিক হয়ে যাবে কয়েকটা দিন যাক।

    ব্যাপারটা কি ঠিকমত গুছিয়ে বলতো।

    ব্যাপার কিছু না, জোবেদ ভাই চিত্রাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সারাক্ষণ মা মা ডাকতেন। চিত্রা দেখতেও তাঁর মেয়ের মত। নিজের মেয়েকে দেখেন না সেই জন্যে —–।

    তিনি চিত্রাকে স্নেহ করতেন বলে চিত্রাকে একটা পাথর গালে লাগিয়ে বসে থাকতে হবে? আমিতো কিছু বুঝছি না–ঐ হারামজাদার সঙ্গে আমার মেয়ের কি হয়েছে?

    তুমি মাথা গরম করো না। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।

    ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।

    চিকিৎসা করাব, কয়েকটা দিন যাক।

    চিত্রার অসুখ সারতে দীর্ঘদিন লাগল।

    এক সকালে সে তার স্যুটকেসে পাথর ভরে রেখে সহজ গলায় মাকে ৰূলল, মা নাশতা দাও ক্ষিধে লেগেছে।

    সুরমা মনের আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তার দুবছর পর চিত্রার বিয়ে হয়ে গেল এক ডাক্তার ছেলের সঙ্গে। শ্যামলা হলেও ছেলেটি সুপুরুষ। খুব হাসি খুশি, সারাক্ষণ মজা করছে। চিত্রার তার স্বামীকে খুব পছন্দ হল। পছন্দ হবার মতই ছেলে। চিত্রা মণিপুরী পাড়ায় তার স্বামীর পৈত্রিক বাড়িতে বাস করতে গেল। তার জীবন শুভ খাদে বইতে শুরু করল।

    তের বছর পরের কথা।

    চিত্র তার মেয়েকে নিয়ে কিছুদিন বাবার বাড়িতে থাকতে এসেছে। চিত্রার স্বামী গিয়েছে ভিয়েনায় ডাক্তারদের কি একটা সম্মেলনে। চিত্রারও যাবার কথা ছিল, টিকিট ভিসা সব হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা ফ্লাইট, ভোরবেলা ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটল। চিত্রার মেয়ে রুনি সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে সামনের একটা পঁাত ভেঙ্গে ফেলল। এমন কোন বড় দুর্ঘটনা না। কিছু রক্ত পড়েছে, ঠোট কার্টার জন্যে ফুলে গেছে। এতেই চিত্রা অস্থির হয়ে গেল। সে কিছুতেই মেয়েকে ফেলে যাবে না। সে থেকে যাবে। রুনি যতবারই বলে, তুমি যাওতো মা ঘুরে আস। তুমি না গেলে বাবা মনে খুব কষ্ট পাবে। ততবারই চিত্রা বলে, তুই মাতব্বরি করবি নাতো। তোর মাতাব্বরি অসহা লাগে।

    বাবা এত আগ্রহ করে তোমাকে নিতে চাচ্ছে তাঁর কত রকম প্লান।

    যথেষ্ট বক বক করেছিস। আর না। তোকে ফেলে রেখে আমি যাব না। এটা আমার ফাইন্যাল কথা।

    মার বাড়িতে এসে চিত্রার খুব ভাল লাগছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু কিছু জিনিস বদলায় না। সেই কিছু কিছু জিনিসের একটি হচ্ছে মার বাড়ি। মা বদলে গেছেন। একটা চোখে কিছুই দেখেন না। হাত কঁপা রোগ হয়েছে— পারকিনসনস ডিজিজ। সারাক্ষণই হাত কাঁপে। কিন্তু মনের দিক থেকে আগের মতই আছেন। খানিকটা পরিবর্তন অবশ্যি হয়েছে–আগে বোকার অব ধরে থাকতেন এখন থাকেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর বোকা ভাব ধরে থাকার প্রয়েজন সম্ভবত ফুরিয়েছে। ভাড়াটে, স্বামীর ব্যবসা, দোকান সব তিনি নিজে চালান এবং ভালই চালান। আজীজ সাহেব তার বোকা স্ত্রীর কর্মক্ষমতা দেখে যেতে পারেনি। দেখে গেলে বিষ্মিত হতেন।

    চিত্রা বেশির ভাগ সময় তার মায়ের সঙ্গে গল্প করে কাটায়। তার সব গল্পই স্বামী এবং কন্যাকে কেন্দ্র করে।

    রুনির খুব বুদ্ধি হয়েছে মা। ওর বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে ভয় লাগে।

    বুদ্ধিতে ভাল জিনিস! বুদ্ধি দেখলে ভয় লাগবে কেন?

    অতিরিক্ত বুদ্ধির মানুষ অসুখী হয় এই জন্যেই ভয়। যার মোটামুটি বুদ্ধি সে থাকে সুখে। এই যে আমাকে দেখ আমি সুখে আছি।

    সুখে আছিস?

    খুব সুখে আছি। স্বামীর ভালবাসা পুরোপুরি পেয়েছিস?

    হুঁ। ও আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না। একদিন কি হয়েছে মা শোন, ওর স্কুল জীবনের এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিনে গিয়েছে। আমারো যাবার কথা—ভাইরাস জ্বরে ধরেছে বলে যাইনি। ও একা গিয়েছে। রাত আটটায় তার টেলিফোন। টেলিফোনে বলল, চিত্রা আমার বন্ধু খুব ধরেছে বাসায় খেয়ে আসতে। খেয়ে আসব? আমি বললাম, এ কি রকম কথা? বন্ধু খেতে বলেছে খেয়ে আসিবে এর মধ্যে জিজ্ঞেস করা করির কি আছে। অবশ্যিই খেয়ে আসবে। টেলিফোনটা যে করেছে তারো ইতিহাস আছে। বন্ধুর বাসায় টেলিফোন নেই, কাৰ্ডফোন থেকে করেছে।

    সুরমা হাসি মুখে বললেন, গৃহপালিত স্বামী।

    চিত্রা আনন্দিত গলায় বলল, আমার গৃহপালিত স্বামীই ভাল।

    পোষ মানাতে পারলে সব স্বামীই গৃহপালিত হয়। তুই পোষ মানানোর কায়দা জানিস। আমি জানতাম না।

    তুমিও জানতে। তুমি সেই কায়দা ব্যবহার করনি। বোকা টাইপের স্ত্রীর স্বামীকে গৃহপালিত করে ফেলতে চায়–যাদের খুব বেশি বুদ্ধি তারা চায় না। ঠিক বলিনি মা?

    মনে হয় ঠিকই বলেছিস।

    ও দশদিনের জন্যে ভিয়েনা গিয়েছে। কিন্তু মা আমি নিশ্চিত ও চারদিনের মাথায় ফিরে আসবে। এই নিয়ে আমি এক লক্ষ টাকা বাজি ধরতে পারি। বাজি ধরবে?

    পাগল হয়েছিস বাজি ধরলেই আমি হারব।

    মনের আনন্দে চিত্রা হাসতে লাগল। সেই হাসি দেখে সুরমার মন ভরে গেল। তিনিও অনেকদিন পর মন খুলে হাসলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এমন আনন্দময় সময় তাঁর জীবনে আসেনি।

     

    রাতে শোবার সময় রুনি রহস্যময় গলায় বলল, মা দেখ কি পেয়েছি। এই তাকাও একটু।

    কি পেয়েছিস?

    একটা পাথর। এই দেখ মা— পাথরটার গাটা কি স্মুথ।

    চিত্রা তাকাল। তার শরীর মনে হল জমে গেছে। শরীরের ভেতরটা জমে গেলেও হাত পা কাঁপছে। রুনি বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে মা?

    চিত্রা জড়ানো গলায় বলল, পাথর কোথায় পেয়েছিস?

    খাটের নিচে। তুমি এ রকম করছ কেন?

    চিত্রার মাথা যেন কেমন করছে। সে এসে খাটে বসল।

    রুনি বলল, পানি খাবে মা? পানি এনে দেব?

    হুঁ।

    রুনি পানির গ্লাস হাতে এসে দেখে তার মা পাথর কোলে নিয়ে বসে আছে। মার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখ রক্তশূন্য। যেন অনেকদিন কঠিন রোগ ভোগ করে উঠেছে।

    মা পানি নাও।

    চিত্রা আগের মতই জড়ানো গলায় বলল, পানিটা খাইয়ে দাও মা। কথা অস্পষ্ট শুনাল আবার তার পুরানো অসুখটা কি ফিরে আসছে?

    পাথরটা কোলে নিয়ে বসে আছ কেন মা?

    ছোটবেলায় আমি এই পাথর নিয়ে খেলতাম।

    এতবড় পাথর নিয়ে কি খেলতে?

    পাথরটাকে গোসল করাতাম। আদর করতাম। ঘুমুর্বার সময় সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতাম। চুমু খেতাম।

    কেন?

    তখন আমার একটা অসুখ হয়েছিল।

    অসুখটা কি এখনো আছে?

    না।

    ঘুমুবে না মা?

    হ্যাঁ ঘুমাব।

    চিত্রা পাথর সঙ্গে নিয়ে ঘুমুতে গেল। রুনি দেখল কিন্তু কিছুই বলল না। মাকে তার এখন খুবই অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে মা অপরিচিত একটা মেয়ে যাকে সে চিনতে পারছে না, মাও তাকে চিনছে না। রুনি ভয়ে ভয়ে ডাকল, মা মা।

    চিত্রা মেয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে অন্য পাশে ফিরল। তার হাতে পাথরটা ধরা। রুনি আবার ডাকল, মা মা, একটু এদিকে ফের।

    চিত্রা ফিরল না বা জবাবও দিল না। রাত বাড়তে লাগল। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও চিত্রা ঘুমুতে পারছে না। ঘুম না হবার জন্যে তার কষ্ট হচ্ছে না। ঘর অন্ধকার। পাশেই তার মেয়ে ঘুমুচ্ছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বারান্দার বাতির খানিকটা আলো এসে পড়েছে বিছানায়। চিত্রা ঘুমুচ্ছে তার পরিচিত খাটে। এই ঘরের প্রতিটি জিনিস তার চেন তারপরও সব কেমন অচেনা হয়ে গেছে। মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে। মনে হচ্ছে সে একগাদা ঘুমের অমুধ খেয়েছে।

    চিত্রা।

    চিত্রা বলল, হুঁ।

    তুমি কেমন আছ?

    ভাল।

    পাশে যে ঘুমচ্ছে সে কি তোমার মেয়ে?

    হুঁ।

    কেউ একজন তাকে প্রশ্ন করছে। সেই কেউটা কে? পাথরটা কি প্রশ্ন করছে? হ্যাঁ তাইতো পাথরটাতো কথা বলছে। চিত্রা বিষ্মিত হল না। পাথরটা তার সঙ্গে কথা বলছে এটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সে জবাব দিচ্ছে এটাও স্বাভাবিক। কেন সে জবাব দেবে না?

    চিত্রা!

    হুঁ।

    তোমার সুন্দর সংসার হয়েছে এটা দেখেও আমার ভাল লাগছে।

    হুঁ।

    আমি জানতাম তোমার সুন্দর সংসার হবে।

    আপনি মরে গেলেন কেন?

    মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয় কি?

    এভাবে মরলেন কেন?

    যে ভাবেই মরি, মৃত্যু হচ্ছে মৃত্যু।

    জ্ঞানের কথা ভাল লাগছে না!

    পৃথিবীর সব কথাই জ্ঞানের কথা।

    আপনি মরে গেলেন কেন?

    কেউ একজন ভেবেছিল আমার মৃত্যুতে তোমার সমস্যা সমাধান হবে। হয়েছেও তাই। তোমার এখন আর কোন সমস্যা নেই।

    আপনাকে কি কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল?

    হুঁ।

    আমার তাই মনে হয়েছে। আপনার ডেড বডি উঠোনে পড়েছিল— আমি দেখতে যাই নি।

    ভাল করেছ। দৃশ্যটা অসুন্দর। অসুন্দর কিছু না দেখাই ভাল।

    কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল?

    যেই ফেলুক। তার উপর আমার কোন রাগ নেই?

    আমারো নেই। তারপরেও জানতে ইচ্ছে করে কে। আমি যখন অসুস্থ ছিলাম তখন সব সময় মনে হত আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা বলুনতো আমি কি ফেলেছি?

    না–তোমার মা ফেলেছিলেন।

    ও আচ্ছা।

    তোমার মার উপর আমার কোন রাগ নেই চিত্রা।

    আমিতো আপনাকে আগেই বলেছি আমারো রাগ নেই।

    তোমার মেয়েটি খুব সুন্দর হয়েছে ওর নাম কি?

    ওর নাম রেনু – ভাল নাম রেহনুমা।

    সুন্দর নাম।

    ওর খুব বুদ্ধি।

    শুনে ভাল লাগছে চিত্রা।

    কতদিন পর কথা বলছেন আমার অসম্ভব ভাল লাগছে।

    তোমার ভাল লাগছে শুনে আমারো ভাল লাগছে। আমি সারারাত কথা বলব তোমাকে কিন্তু তারপর ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে।

    আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনি যদি আমাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বলেন আমি লাফিয়ে পড়ব। আপনি বলে দেখুন।

    তোমাকে এইসব কিছু করতে হবে না।

    কি করতে হবে বলুন।

    ভোরবেলা তুমি ছাদে উঠবে, পারবে না?

    পারব।

    হাতে থাকবে পাথরটা।

    আচ্ছা।

    তারপর পাথরটা ছুড়ে ফেলবে ঠিক আমি যে জায়গায় পড়েছিলাম সেই জায়গায়।

    কেন?

    আমি পাথরের ভেতর বন্দি হয়ে আছি। পাথরটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেলেই আমি মুক্তি পাব।

    আমার এখন জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে, আপনি জ্ঞানের কথা বলুন।

    I often see flowers from a passing car
    That are gone before I can tell what they are.

    এর মানে কি?

    রবার্ট ফ্রস্টের একটা বিখ্যাত কবিতার প্রথম দুটি লাইন।

    জ্ঞানের কথা শুনতে ভাল লাগছে না, অন্য কিছু বলুন ….. ভালবাসার কথা বলুন! আচ্ছা ভালবাসা কি?

    রাত শেষ হয়ে আসছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চিত্রা পাথর হাতে খুব সাবধানে খাট থেকে নামল।

    সুরমা ফজরের নামাজে বসেছিলেন। বিকট শব্দে তিনি নামাজ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। ভারী কিছু যেন ছাদ থেকে পড়ল।

    কে পড়ল? তার বুধ ধ্বক ধ্বক করছে। সেই ধ্বক ধ্বকানি তীব্র হবার আগেই চিত্রা ঢুকল। সুরমা স্বাভাবিক হলেন। সহজ গলায় বললেন, কিসের শব্দ?

    চিত্রা খুব সহজ গলায় বলল, আমার যে একটা পাথর ছিল সেই পাথরটা টুকরা টুকরা করে ভাঙ্গলাম। ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলেছি— এক্কেবারে শত খও হয়েছে।

    সুরমা তাকিয়ে রইলেন।

    চিত্রা বলল, চা খাবে মা? চা বানিয়ে নিয়ে আসি তারপর এসো দুজনে মিলে চুকচুক করে চা খাই। ও আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি–তুমি জোবেদ চাচাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলে তাই না মা?

    সুরমা তাকিয়েই রইলেন কোন জবাব দিলেন না। চিত্রা হালকা গলায় বলল, ভালই করেছ মা। তোমার চায়ে চিনি দেব? তুমি চায়ে চিনি খাওতো?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেয়াল – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article অদ্ভুত সব গল্প – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }