Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ১৫

    ১৫

    স্বামীর অবুঝপনায় ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ফারমিনা তাঁর কাছে একটা ভিন্ন ধরনের জন্মদিনের উপহার চাইলেন, ডাক্তার উরবিনো একদিনের জন্য সংসারের যাবতীয় কাজের ভার নেবেন। মজা পেয়ে ডাক্তার সম্মতি জানালেন এবং সত্যি সত্যিই ভোর থেকে গৃহের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। টেবিলে তিনি চমৎকার প্রাতরাশ পরিবেশন করেন, তবে ভুলে যান যে ডিম-ভাজা তাঁর স্ত্রীর সহ্য হয় না, আর ওই বিশেষ কফিটা তিনি পান করেন না। তারপর তিনি জন্মদিনের দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য নির্দেশ দেন, আটজন অতিথি হবে। তিনি বাড়িঘর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করার নির্দেশ দেন, আর তিনি যে এসব কাজ তাঁর স্ত্রীর চাইতে ভালো ভাবে করতে পারেন তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এত কঠোর প্রয়াস চালান যে দুপুর বারোটার আগেই বিন্দুমাত্র বিব্রত বোধ না করে তিনি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। প্রথম মুহূর্ত থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন যে কোথায় কোন জিনিসটা আছে, বিশেষ করে রান্নাঘরে, সে সম্পর্কে তাঁর ক্ষীণতম ধারণা নাই। একটা জিনিস পাবার জন্য ভৃত্যকুল তাঁকে সব জিনিস ওলট-পাল্ট করতে দিল, কারণ তারাও খেলাটায় অংশ নিচ্ছিল। বেলা দশটা বেজে গেলেও দুপুরের খাবারের ব্যাপারে তখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি, কারণ বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ তখনো চলছিল, শোবার ঘর গোছানো হয় নি, বাথরুম ঘষা-মাজা এখনো বাকি। তিনি নতুন টয়লেট পেপার দেয়া, বিছানার চাদর বদলানো এবং বাচ্চাদের জন্য কোচোয়নকে গাড়ি আনবার কথা বলতে ভুলে যান। চাকর-দাসীদের কার কি কাজ সে ব্যাপারে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, বাবুর্চিকে বললেন বিছানা করতে আর শোবার ঘরের পরিচারিকাকে রান্না করতে। বেলা এগারোটার দিকে, অতিথিবর্গের আসবার সময় হয়ে এলে, বাড়ির চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে সজোরে হাসতে হাসতে ফারমিনা ডাজা সংসারের কর্তৃত্বভার আবার নিজের হাতে তুলে নিল, তবে বিজয়ীর ভঙ্গিতে সে হাসে নি, ইচ্ছা হলেও, বরং গার্হস্থ্য অঙ্গনে স্বামীর অসহায়তা দেখে তাঁর প্রতি তার করুণাই হয়। ডাক্তার উরবিনো একটু তিক্ততার সঙ্গেই সব সময় যে কথা বলতেন এখনও তাই বললেন, “তুমি যদি রোগীকে সারাবার চেষ্টা করতে তাহলে তোমার অবস্থা আমার তুলনায় অনেক বেশি খারাপ হত।” তবে এটা একটা দরকারি শিক্ষা হয়েছিল, আর শুধু ডাক্তারের একার জন্যই নয়। কালের যাত্রার মধ্য দিয়ে তাঁরা উভয়েই ভিন্ন পথে একই প্রাজ্ঞ উপসংহারে উপনীত হন : এভাবে ছাড়া অন্য কোন ভাবে একসঙ্গে বাস করা কিংবা ভালোবাসা সম্ভব নয়, আর এ পৃথিবীতে ভালোবাসার চাইতে দুঃসাধ্য আর কিছুই নেই।

    তার নতুন জীবনের পূর্ণতার মধ্যে ফারমিনা ডাজা বিভিন্ন সর্বজনীন অনুষ্ঠানে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে দেখতে পেতো। সে তার অবস্থার ক্রমোন্নতি ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে এই দেখার পালা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ফারমিনা তাকে একাধিকবার এতো স্বাভাবিক দেখে যে নিজের বিক্ষিপ্ত চিত্তের কারণে সে তাকে সম্বোধন করতে পর্যন্ত ভুলে যায়। ফ্লোরেন্টিনোর কথা সে প্রায়ই শুনতো, কারণ যে রকম সতর্ক কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ভাবে সে আর.সি.সি. কোম্পানিতে উন্নতি করে চলেছিল তা ব্যবসা- বাণিজ্য মহলে একটা নিরন্তর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ফারমিনা লক্ষ করলো যে তার আচার-আচরণের উন্নতি হয়েছে, তার মুখচোরা ভাবকে এখন মনে করা হত এক ধরনের রহস্যময় দূরত্ব, ওজন একটু বেড়েছে কিন্তু সেটা তাকে মানিয়ে যায়, বয়স তার মধ্যে যে ধীরগতি এনে দিয়েছিল সে সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে, আর সে তার মাথাজোড়া টাকের মধ্যেও একটা মর্যাদা মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়। শুধু একটি ক্ষেত্রে সে কাল ও ফ্যাশানকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে, এখনো সর্বদা তার পরনে থাকে অনুজ্জ্বল কালো রঙের পোশাক, সময়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ফ্রককোট, তার অদ্বিতীয় হ্যাট, তার মায়ের টুকিটাকির দোকান থেকে কেনা ফিতাদেয়া কবিদের টাই, আর হাতে তার ঢালের মতো ছাতা। ফারমিনা ডাজা তাকে ভিন্ন চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, আর অবশেষে, যে নিস্তেজ কিশোরকে সে ইভাঞ্জেলস পার্কে হলুদ ঝরা পাতার ঝাপ্টার নিচে বসে তার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছিল তার সঙ্গে সে আর বর্তমানের লোকটিকে সম্পৃক্ত করতে পারলো না। তবে সে কখনো তাকে ঔদাসীন্যের সঙ্গে দেখে নি, তার সম্পর্কে কোন ভালো খবর পেলে সে সব সময় খুশিই হয়েছে, তার ফলে তার অপরাধ বোধ খানিকটা প্রশমিত হতো।

    কিন্তু যখন তার মনে হয় যে সে তাকে তার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে তখনই, অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ও স্থানে, সে অকস্মাৎ উদিত হত তার স্মৃতিবিধুরতার এক অশরীরী মূর্তি রূপে। ওই সময় ফারমিনা বার্ধক্যের আগমনের আভাস পেতে শুরু করেছিল। যখনই সে সৃষ্টির আগে বজ্র গর্জন শুনতো তখনই তার মনে হত যে তার জীবনে অপূরণীয়, কিছু একটা ঘটে গেছে। সিয়েরা ভিলানুয়েভাতে প্রতিদিন অক্টোবর মাসে বিকাল তিনটার সময় বজ্র গর্জন ধ্বনিত হত, আর সেই শব্দ তার মনে একটা নিঃসঙ্গ পাথুরে আরোগ্যাতীত ক্ষতের জন্ম দিত আর কালের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ওই স্মৃতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। খুব সাম্প্রতিক ঘটনা অল্প ক’দিনের মধ্যে ঝাপসা হয়ে যেতো, কিন্তু বহু দিন আগের হিল্ডাব্রান্ডার প্রদেশে তার ঐতিহাসিক ভ্রমণ যাত্রার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে ছিল, যেন মাত্র গতকালের ঘটনা, তার মধ্যে ছিল স্মৃতিকাতরতার এক অযৌক্তিক স্বচ্ছতা। তার মনে পড়তো পাহাড়ি অঞ্চলে মানোরের কথা, একটিমাত্র সোজা সবুজ রাস্তার কথা, তার শুভ সঙ্কেত দেয়া পাখির কথা, আর সেই ভুতুড়ে বাড়ির কথা যেখানে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে সে দেখতো যে তার রাত কামিজ পেট্রা মোরালেসের অন্তহীন অশ্রু জলে ভিজে চুপ চুপ হয়ে গেছে। সে যে খাটে ঘুমাচ্ছিল ওই খাটেই বহু বছর আগে পেট্রা মোরালেস ভালোবাসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। তার মনে পড়তো পেয়ারার স্বাদের কথা, ওই স্বাদ সে আর কখনো পায় নি, তার মনে পড়তো বজ্রের সতর্ক করে দেয়া গর্জনের কথা, ওই ধ্বনি ছিল এতো তীব্র যে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তা তালগোল পাকিয়ে যেতো, তার মনে পড়তো সান হুয়ান ডেল সিজারের উজ্জ্বল হলুদ বিকালের কথা, যখন সে তার চঞ্চল কাজিনকুলের সঙ্গে হাঁটতে বেরুতো আর টেলিগ্রাফ আপিসের কাছে এলেই সে কীভাবে দাঁতে দাঁত টিপে থাকতো, তার ভয় হত এই বুঝি তার হৃৎপিণ্ড বক্ষপঞ্জর ভেদ করে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়বে। তার কৈশোরের বেদনা, বারান্দা থেকে দেখা ছোট হতশ্রী পার্কটির দৃশ্য, তপ্ত রজনীতে গার্ডেনিয়া ফুলের রহস্যময় সুরভি, যেদিন তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় সেই ফেব্রুয়ারির অপরাহ্ণে দেখা এক বৃদ্ধার আতঙ্ক জাগানিয়া মুখের স্মৃতি সে আর সহ্য করতে পারছিল না। তাকে তার পিতৃদত্ত বাড়িটি বিক্রি করে দিতে হল। কিন্তু সে তার স্মৃতিকে যে পথেই পরিচালিত করুক না কেন, এক সময় সে নিজেকে অনিবার্য ভাবে দেখতো ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখোমুখি। তবে এসব যে প্রেম বা অনুশোচনার স্মৃতি নয়, বরং গালের উপর চোখের জলের দাগ রেখে যাওয়া দুঃখের প্রতিমা তা বুঝবার মতো প্রশান্তি তার মধ্যে ছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বহু অসহায় বলির পতনের মূলে যে অনুকম্পার ফাঁদ ক্রিয়াশীল ছিল নিজের অজান্তেই ফারমিনা ডাজা সেই বিপদের মুখোমুখি হল।

    সে তার স্বামীকে আঁকড়ে ধরলো। আর এই সময়ে তাঁরও ফারমিনাকে দরকার হয়ে পড়েছিল সব চাইতে বেশি, বার্ধক্যের কুয়াশার মধ্য দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে একা চলার সময় একটা অসুবিধা সম্পর্কে তিনি সচেতন হলেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর চাইতে দশ বছরের বড়, এর চাইতেও বড় অসুবিধা তিনি পুরুষ এবং ওর চাইতে দুর্বল। শেষ ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনযাপনের পর তাঁরা একে অন্যকে এত ভালোভাবে চিনলেন যে তাঁদের মনে হত তারা বিভক্ত একটি একক সত্তা। ইচ্ছা না থাকলেও তাঁরা পরস্পরের চিন্তাভাবনা এতো পুনঃপুনঃ অনুমান করে ফেলতেন কিংবা লোকজনের সামনে তাঁদের একজন কিছু বলতে উদ্যত হলে অপরজন আগেই যেরকম নির্ভুল ভাবে তা বলে উঠতেন তাতে ব্যাপারটা রীতিমত অস্বস্তিকর হয়ে পড়তো। তাঁরা উভয়ে একসাথে মিলে দৈনন্দিন অনুপলব্ধি, তাৎক্ষণিক ঘৃণা, পারস্পরিক কদর্যতা এবং দাম্পত্য ষড়যন্ত্রের অবিশ্বাস্য ঝলককে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সময়েই তাঁরা পরস্পরকে সব চাইতে উত্তম রূপে ভালোবাসেন, দ্রুততা কিংবা আতিশয্য পরিহার করে। এই সময়েই তাঁরা উভয়েই দুঃখ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে তাঁদের অবিশ্বাস্য বিজয় সম্পর্কে সব চাইতে বেশি সচেতন হন, সব চাইতে বেশি কৃতজ্ঞ বোধ করেন। জীবন, অবশ্যই, এখনো তাঁদেরকে অন্যান্য মারাত্মক পরীক্ষার মুখোমুখি করবে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, তাঁরা অন্য কূলে পৌঁছে গেছেন।

    নতুন শতকের উদ্বোধন উপলক্ষে সর্বজনীন উৎসবমালার জন্য বেশ কয়েকটি নতুন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল, এর মধ্যে সব চাইতে স্মরণীয় ছিল প্রথম বেলুন ভ্রমণ। এটা ছিল ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর অসীম উদ্যমী প্রণোদনার ফসল। জাতীয় পতাকার রঙে পাতলা কড়কড়ে রেশমি কাপড়ে নির্মিত বিশাল বেলুনটির উড্ডয়ন বিস্ময়াবিভূত চোখে দেখার জন্য শহরের অর্ধেক মানুষ আর্সেনাল সমুদ্র সৈকতে এসে জড়ো হয়। এই বেলুনে করে, কাকের মতো সোজা উড়ে গেলে প্রায় একশো মাইল দূরে, সান হুয়ান ডি লা সিনেগাতে আজ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আকাশপথের প্রথম ডাক। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর এবং তাঁর স্ত্রীর, পারীর বিশ্ব মেলার সময়, আকাশে ওড়ার উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁরা দুজন এবার সকলের আগে উপরে উঠে সেলুনের বেতের ঝুড়িতে বসলেন, তারপর উঠলেন বেলুনের পাইলট, আর ছয়জন বিশিষ্ট অতিথি। তাঁরা প্রাদেশিক গভর্নরের কাছ থেকে সান হুয়ান ডি লা সিনেগার পৌর কর্মকর্তাদের কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আকাশপথে এই প্রথম ডাক নিয়ে যাওয়ার প্রামাণিক দলিল লিপিবদ্ধ আছে। কমার্শিয়াল ডেইলি কাগজের জনৈক সাংবাদিক ডাক্তার উরবিনোর কাছে জানতে চাইলো এই দুঃসাহসিক অভিযানে যদি তাঁর মৃত্যু ঘটে তাহলে তাঁর শেষ কথা কি হবে? ডাক্তার একটুও না চিন্তা করে বলেন, ‘আমার মতে একমাত্র আমাদের বাদ দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী আর সবার জন্য বিদায় নিচ্ছে।’ এ উক্তির জন্য ডাক্তার প্রচুর তিরস্কৃত হন।

    বেলুন উপরে উঠে যাচ্ছিল, সরল জনতা জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, হৈচৈর মাধ্য ফ্লোরেন্টিনোর কানে একটা মন্তব্য এসে পৌঁছলো, এরকম অভিযান কোন মহিলার জন্য উপযুক্ত নয়, বিশেষ করে ফারমিনা ডাজার মতো একজন বয়স্ক মহিলার পক্ষে। ফ্লোরেন্টিনো তার সঙ্গে একমত হল। তবে এর মধ্যে বিপদের তেমন কিছু ছিল না। অন্তত যতখানি বিপজ্জনক তার চাইতে বেশি ছিল মন খারাপ করা। অসম্ভব নীল আকাশের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কোন ঘটনা ছাড়াই বেলুনটি তার গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিল। তারা ভালো ভাবে উড়ে যায়, বেশ নিচু দিয়ে, বাতাস ছিল শান্ত ও অনুকূল, প্রথমে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালার পাশ দিয়ে, তারপর বিশাল জলাভূমির বিস্তীর্ণ এলাকার উপর দিয়ে।

    আকাশ থেকে তাঁরা দেখছিলেন, যেমন ঈশ্বর দেখছিলেন তাঁদের, কার্টাজেনা ডি ইন্ডিয়াস-এর অতি প্রাচীন মহান নগরীর ধ্বংসাবশেষ, বিশ্বের সব চাইতে সুন্দর জায়গা, তিন শতাব্দী ধরে ইংরেজদের অবরোধ ও বোম্বেটেদের নৃশংসতা প্রতিহত করার পর কলেরা মহামারীর ভয়ে এ জায়গার অধিবাসীরা এখান থেকে চলে যায়। উপর থেকে তাঁরা দেখলেন যে নগরীর প্রাচীরগুলি এখনো অক্ষত আছে। তাঁদের চোখে পড়লো রাস্তার উপরের কাঁটাগুল্ম, ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিখা, মর্মর প্রাসাদ, সোনালি বেদি আর মহামারীর আক্রমণে বর্মের অভ্যন্তরে পচে যাওয়া ভাইসরয়দের মূর্তি।

    তাঁরা কাটাকায় হ্রদের পার্শ্বস্থিত ট্রোজাসদের বাসভবনের উপর দিয়ে উড়ে গেলেন। ওই বাড়িগুলি ছিল উন্মাতাল রঙে চিত্রিত, উঠানে খাঁচার মধ্যে ইগুয়ানা, খাবার জন্য তাদের পালন করা হচ্ছে, বাগানে সুগন্ধী আপেল আর চকচকে চিরহরিৎ গুল্ম। চারদিকের চেঁচামেচিতে উত্তেজিত শত শত উলঙ্গ বালক-বালিকা জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, বাড়ির জানালার ভেতর দিয়ে, ছাদের উপর থেকে, বিস্ময়কর দক্ষতার সঙ্গে চালানো তাদের ডিঙি নৌকা থেকে। বেলুনে বসা তাঁর ঝুড়ি থেকে পালকের টুপি পরা সুন্দরী মহিলা যে সব জিনিস ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিলেন, কাপড় জামার পুঁটলি, কাশির জন্য মিষ্টি ওষুধের বোতল, উপকারী খাদ্যদ্রব্য, ওরা সেসব উদ্ধার করার জন্য শ্যাড মাছের মতো জলে ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।

    তাঁরা কালো সমুদ্রের মতো বিস্তীর্ণ কলার বাগানগুলির উপর দিয়ে উড়ে গেলেন, বাগানগুলির নীরবতা মারাত্মক বিষবাষ্পের মতো তাদের কাছে এসে পৌঁছল। ফারমিনা ডাজার তার শৈশবের কথা মনে পড়লো, তার বয়স তখন তিন কিংবা চার বছর, মায়ের হাত ধরে ছায়াচ্ছন্ন বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে, মা নিজেও প্রায় একটি বালিকাই, তাদের চারপাশে মসলিনের পোশাক পরা অন্যান্য মহিলা, তার মায়ের মতোই, মাথায় পাতলা কাপড়ের হ্যাট, হাতে সাদা ছাতা। পাইলট একটা ছোট দূরবীন দিয়ে পৃথিবী দেখছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, ‘ওরা মৃত বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি ডাক্তার জুভেনালের হাতে তাঁর দূরবীনটা দিলেন, ডাক্তার দেখলেন চাষ করা জমিতে মোষের গাড়ি, রেলপথের সীমানা-চিহ্ন, ধ্বংসপ্রাপ্ত সেচের নালা, আর যেখানেই তাঁর দৃষ্টি গেল দেখলেন মনুষ্য দেহ। কেউ একজন বলল, বিশাল জলাভূমির গ্রামগুলি কলেরার আক্রমণে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিচের দিকে দেখতে দেখতে ডাক্তার উরবিনো বললেন, তো, এটা নিঃসন্দেহে খুবই বিশেষ এক ধরনের কলেরা, কারণ প্রতিটি মৃতদেহ তার মুক্তি-আঘাত লাভ করেছে তার ঘাড়ের উপর |

    অল্প একটু পরে তাঁরা উড়ে গেলেন উদ্বেল ফেনিল সাগরের উপর দিয়ে, তারপর কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই নামলেন একটা চওড়া উষ্ণ সৈকতের উপর, তার ভূপৃষ্ঠ যবক্ষারপূর্ণ, আগুনের মতো জ্বলছে। সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে শুধু সাধারণ ছাতা, সূর্যের দাবদাহ থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র হাতিয়ার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালক- বালিকারা বাদ্যের তালে তালে ছোট ছোট পতাকা নাড়ছে, সুন্দরীরা ঝলসানো ফুল আর সোনালি কার্ডবোর্ডের তৈরি মুকুট মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সমৃদ্ধশালী শহর গেইরার ব্যান্ড-দল সঙ্গীত পরিবেশন করছে, সে সময় সমগ্র ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলে ওই ব্যান্ডই ছিল সবার সেরা। ফারমিনা ডাজার অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল শুধু আরেকবার তার জন্মস্থান দেখার জন্য, তার সর্বপ্রথম স্মৃতিগুলির মুখোমুখি হবার জন্য, কিন্তু মহামারীর বিপদের আশঙ্কায় কাউকেই ওখানে যাবার অনুমতি দেয়া হল না। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ঐতিহাসিক চিঠিটা হস্তান্তর করলেন, সে-চিঠি পরে নানা কাগজের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায়, কখনোই আর তার সন্ধান মেলে নি। গোটা প্রতিনিধি দল বক্তৃতার ভারে ক্লান্ত, গরমে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হবার অবস্থা। এরপর পাইলট যখন বেলুনটা পুনর্বার আকাশে তুলতে পারলেন না তখন ওদেরকে খচ্চরের পিঠে চড়িয়ে পুয়েরো ভিয়েজোর জাহাজঘাটে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে জলাভূমি এসে মিশেছে সাগরের সঙ্গে। ফারমিনা ডাজার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে সে যখন খুব ছোট তখন তার মায়ের সাথে বলদটানা গাড়িতে চড়ে এখান দিয়ে গিয়েছিল। একটু বড় হবার পর সে এই গল্প কয়েকবারই তার বাবার কাছে করে, কিন্তু ওর বাবা তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জোর দিয়ে বলেন যে এটা হতেই পারে না, ওর স্মৃতিতে এটা থাকা অসম্ভব। তিনি ওকে বলেন, ‘ওই সফরের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, তুমি যা বলছো তা নির্ভুল, কিন্তু এই ঘটনা ঘটেছিল তোমার জন্মের অন্তত পাঁচ বছর আগে।’

    তিন দিন পর বেলুনের অভিযাত্রী দল তাঁদের আদিযাত্রা-বন্দরে ফিরে আসেন, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত, পথে ঝড়- ঝঞ্ঝার কারণে খুব খারাপ রাত কেটেছে তাঁদের, তবে তাঁরা বীরের উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করলেন। ভিড়ের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও ছিল, তার চোখে পড়লো ফারমিনা ডাজার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন, কিন্তু সে দিন বিকালেই সে যখন একটা সাইকেল প্রদর্শনীতে তাকে আবার দেখলো তখন তার মধ্যে আর ক্লান্তির কোন চিহ্নই দেখা গেল না। এই প্রদর্শনীর দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন তার স্বামী। ফারমিনা ডাজা একটা নতুন ধরনের অগতানুগতিক দ্বিচক্রযান চালালো, মনে হল কোন সার্কাস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সামনের চাকা খুব বড়, পেছনের চাকা অতিশয় ছোট, চালককে তা প্রায় কোন অবলম্বনই দিচ্ছিল না। ফারমিনা ডাজার পরনে ছিল ঢোলা পাজামা, প্রান্তদেশ লাল ফিতায় মোড়ানো, এই পোশাক শুধু বয়স্ক মহিলাদের শিষ্টাচার বোধ-কে পীড়িত করলো না, ভদ্রলোকদেরও বিব্রত করলো, কিন্তু তার নৈপুণ্যের প্রতি কেউই উদাসীন থাকতে পারলেন না।

    এই স্মৃতি এবং এই রকম আরো বহু ক্ষণস্থায়ী ছবি এত বছর ধরে হঠাৎ নিয়তির খেয়ালখুশি অনুযায়ী তার সামনে এসে উপস্তিত হত, তারপর ওই রকম আকস্মিক ভাবেই মিলিয়ে যেতো, পেছনে রেখে যেত শুধু তার হৃদয়ের এক তীব্র আকুলতা। এই সব একসঙ্গে মিলে তার জীবন-পথকে চিহ্নিত করেছে, কারণ প্রতিবারই ফারমিনা ডাজাকে দেখার সময় তার অতিক্ষীণ ও সূক্ষ্ম পরিবর্তনের মধ্যে সে কালের যে নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেছে তার নিজের শরীরের ক্ষেত্রে তা সে অনুভব করেনি।

    এক রাতে সে অভিজাত ঔপনিবেশিক রেস্তোরাঁ ডন সাঙ্কোস ইন-এ খেতে যায়। স্বল্পাহারী ফ্লোরেন্টিনো রেস্তোরাঁর সুদূর একটি কোনায় গিয়ে বসে। একা খেতে হলে সে সর্বদা তাই করতো। হঠাৎ পেছনের দেয়ালের একটা বড় আয়নায় সে এক মুহূর্তের জন্য ফারমিনা ডাজাকে দেখতে পেল, তার স্বামী ও অন্য দুই দম্পতিকে নিয়ে সে একটা টেবিলে বসেছে। সে এমন জায়গায় এবং এমন ভাবে বসেছিল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আয়নায় তার প্রতিবিম্বকে দেখলো তার পূর্ণ বিভায় গৌরবোজ্জ্বল। সে ছিল বন্ধনহীন, হেসে হেসে মধুরভাবে সে কথা বলছিল, আতশবাজির মতো তার হাসি ও কথা ফুটছিল, বিশাল অশ্রুবিন্দুর মতো ঝাড়বাতিগুলির নিচে তার সৌন্দর্য অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। অ্যালিস আরেক বার দর্পণের মধ্য দিয়ে চলে যায়।

    নিঃশ্বাস বন্ধ করে সময় নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে লক্ষ করলো। সে তাকে খেতে দেখল, লক্ষ করলো যে সে সুরা প্রায় স্পর্শই করলো না, ডন সাঙ্কোদের চতুর্থ প্রজন্মের সঙ্গে সে ঈষৎ হাসি ঠাট্টা করলো। তার নিঃসঙ্গ টেবিল থেকে ফ্লোরেন্টিনো ফারমিনা ডাজার জীবনের একটি মুহূর্তের অংশীদার হল। সবার চোখের আড়ালে বসে সে এক ঘণ্টার বেশি সময় অলস ভাবে ফারমিনার অন্তরঙ্গ নিষিদ্ধ এলাকায় অবস্থান করলো। সময় কাটাবার জন্য সে আরো চার কাপ কফি পান করলো, তারপর তার সঙ্গীদের নিয়ে ওকে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করতে দেখলো। সে তার এত কাছ দিয়ে গেল যে অন্যান্যদের প্রসাধনীর নানা সুরভির মধ্য থেকে সে ফারমিনার নিজস্ব সুগন্ধি আলাদা করে চিনতে পারলো।

    ওই রাতের পর প্রায় এক বছর ধরে সে রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে নিরন্তর ধরণা দেয়, তিনি যা চান সে তাঁকে তাই দেবে, অর্থ কিংবা কোন অনুগ্রহ, জীবনে যা তাঁর সব চাইতে বেশি কাম্য তাই সে দেবে, তিনি যদি তার কাছে ওই আয়নাটা বিক্রি করেন। কাজটা সহজ হয় নি, কারণ বৃদ্ধ ডন সাঙ্কো প্রচলিত একটি লোককাহিনীতে বিশ্বাস করতেন, এই আয়নার ফ্রেম তৈরি করেছে ভিয়েনার আসবাব নির্মাতারা, এরকম দুটি আয়না আছে, অন্যটির মালিক মেরি আঁতোয়ানেৎ, সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তার হদিস জানে না, ডন সাঙ্কোর এই আয়না অতুলনীয় এক জোড়া রত্নের একটি। অবশেষে তিনি যখন আত্মসমর্পণ করেন, তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সেটা নিজের বাড়িতে এনে স্থাপন করলো, তার পরম সুন্দর ফ্রেমের জন্য নয়, শুধু এই জন্য যে ওই আয়নার মধ্যে দু’ঘণ্টার জন্য অবস্থান করেছিল তার প্রিয়তমার প্রতিবিম্ব।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখনই ফারমিনা ডাজাকে দেখেছে প্রায় সর্বদাই তাকে দেখেছে তার স্বামীর বাহুলগ্না। তারা পথ চলতো নিজেদের স্থানের মধ্য দিয়ে, বিস্ময়কর সাবলীলতার সঙ্গে, অনবদ্য ছন্দ মিলিয়ে, যখন তাকে সম্ভাষণ করার জন্য তারা থামতো শুধু তখনই সেখানে ছেদ পড়তো। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে তার করমর্দন করতেন, কখনো কখনো আলতোভাবে তার পিঠ চাপড়ে দিতেন, কিন্তু ফারমিনা ডাজার আচরণ ছিল আনুষ্ঠানিক ও নৈর্ব্যক্তিক, নিজের কুমারী জীবনে যে তার কোন স্মৃতি আছে সেটা সন্দেহ করার মতো কোনো ভাবভঙ্গি সে কখনো করতো না। তারা দুজন বাস করতো দুটি ভিন্ন জগতে, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন তাদের দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল, ফারমিনা ডাজা তখন চেষ্টা করছিল ঠিক তার বিপরীত কাজটি করার জন্য। অনেক দিন পরে তার মনে হল ওর ঔদাসীন্য বোধ হয় ভীরুতার জন্য একটা ঢাল ছাড়া আর কিছু নয়। অকস্মাৎ এই চিন্তাটা তার মনে আসে। সেদিন স্থানীয় জাহাজ নির্মাণ পোতাশ্রয়ে তাদের প্রথম নতুন ধরনের জাহাজ নির্মিত হবার পর তার নামকরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রথম সরকারি অনুষ্ঠান যেখানে আর. সি. সি. কোম্পানির প্রথম সহ-সভাপতি ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কাকা দ্বাদশ লিওর প্রতিনিধিত্ব করছিল। তার জন্য তাই এ অনুষ্ঠান একটা বিশেষ গুরুত্বে অভিষিক্ত হয়। শহরের সকল উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি এ অনুষ্ঠানে আসেন। এই সময়েই ফ্লোরেন্টিনোর মনে উপরোক্ত সম্ভাবনার কথা অকস্মাৎ উদিত হয়।

    জাহাজের প্রধান অভ্যর্থনা কক্ষে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অতিথিদের দেখাশোনা করছিলো। জাহাজে তখন নতুন রঙ ও আলকাতরার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় জাহাজঘাটা থেকে করতালির শব্দ ভেসে এলো, ব্যান্ড বাজাতে শুরু করলো বিজয়োল্লাসের বাজনা, আর ফ্লোরেন্টিনো তার স্বপ্নের নারীকে স্বামীর বাহুতে বাহু জড়িয়ে এগিয়ে আসতে দেখলো। ওকে প্রথম দেখার সময় তার বুকে যে শিহরণ জেগেছিল এখনো সে ওই একই শিহরণ অনুভব করলো। কুচকাওয়াজের পোশাক পরা একটি দল গার্ড বা অনার দিচ্ছে, চারপাশের জানালা থেকে কাগজের লম্বা সরু ফিতা ও ফুলের পাপড়ি তাদের উপর বর্ষিত হচ্ছে, আর তার মধ্য দিয়ে তার পূর্ণবিকশিত অপরূপ রূপ নিয়ে ভিন্ন কোন কালের রানীর মতো দৃঢ় পদক্ষেপে সে এগিয়ে আসছে। উভয়েই উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনার জবাবে হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে, কিন্তু উঁচু হিলের পাদুকা, মাথায় ঘণ্টাকৃতি হ্যাট, গলায় উজ্জ্বল বর্ণের পশমের গলবস্ত্র জড়ানো ফারমিনা ডাজাকে এতোই দীপ্তিময় দেখাচ্ছিল যে মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে সে বুঝি একা।

    প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জাহাজের সেতুর উপর ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাজনা আর আতশবাজির উচ্চরোলের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে, জাহাজ থেকে তিন বার ভারি তীক্ষ্ণ ভেঁপুর শব্দ ধ্বনিত হল, সমস্ত জাহাজঘাট বাষ্পে ছেয়ে গেল। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো অভ্যর্থনা-সারিতে দাঁড়ানো সদস্যদের সম্ভাষণ করলেন, তাঁর বৈশিষ্ট্যময় স্বাভাবিকতার সঙ্গে, যাতে প্রত্যেকেরই মনে হল ডাক্তার বুঝি তাকে বিশেষ মমতার দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি প্রথমে করমর্দন করলেন পুরো ইউনিফর্ম পরা জাহাজের কাপ্তানের সঙ্গে, তারপর সস্ত্রীক গভর্নর ও মেয়রের সঙ্গে, তারপর সামরিক অধিনায়কের সঙ্গে, তিনি অ্যান্ডিস থেকে এখানে নতুন এসেছেন। এই কর্মকর্তাদের পরে দাঁড়িয়েছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, তার অনুজ্জ্বল গাঢ় রঙের পোশাক পরে, এত সব উচ্চ মর্যাদার মানুষের পাশে প্রায় অদৃশ্যমান হয়ে। সামরিক অধিনায়ককে সম্ভাষণ করার পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার প্রসারিত হাতের সামনে দাঁড়িয়ে ফারমিনা ডাজা একটু ইতস্তত করলো বলে মনে হল। সামরিক ব্যক্তিটি তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হয়ে ফারমিনা ডাজার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন তিনি ওকে চেনেন কিনা। ফারমিনা ডাজা হ্যাঁ-ও বলল না, না-ও বললো না, তবে তার হাত বাড়িয়ে দিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দিকে এবং তাকে একটি রীতিসিদ্ধ হাসি উপহার দিল। ঠিক এই একই ঘটনা আগে আরো দু’বার ঘটেছিল এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এসব পরিস্থিতিতে এমন একটা চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দেয় যা ছিল যথার্থই ফারমিনার ডাজার যোগ্য। কিন্তু তার মোহান্ধ হবার অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে সেদিন বিকালে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল, কে জানে, ওর ওই নির্দয় ঔদাসীন্য হয়তো ওর ভেতরের প্রেমের যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রাখবার একটা কৌশল মাত্ৰ।

    ওই ধারণা সঙ্গে সঙ্গে তার যৌবনদীপ্ত কামনারাশি উদ্দীপিত করে তুললো। ইভাঞ্জেলস পার্কে হাজিরা দেবার দিনগুলিতে সে তার হৃদয়ে যে আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেছিল সেই একই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে আবার ফারমিনা ডাজার বাসভবনের চারপাশে নিরন্তর ঘুরতে লাগলো, কিন্তু এবার তার সুপরিকল্পিত প্রয়াস ছিল ও যেন তাকে দেখতে না পায়, শুধু সে ওকে দেখবে, জানবে যে এই পৃথিবীতে ও এখনো বিরাজ করছে। কিন্তু এই ভাবে নিজেকে দৃষ্টির আড়ালে রাখা সহজসাধ্য ছিল না। লা মাঙ্গা জেলা ছিল অর্ধ-পরিত্যক্ত একটি দ্বীপের উপর অবস্থিত, ঐতিহাসিক নগরীটি থেকে একটা সবুজ জলের খাল দ্বারা পৃথক করা, বুনো জাম গাছের ঝোপে ঢাকা জায়গাগুলি ঔপনিবেশিক যুগে রবিবারের প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিরাপদ আশ্রয় দিত। সাম্প্রতিককালে স্পেনীয়দের নির্মিত পুরনো লোহার সেতুটি ভেঙে তার জায়গায় একটি ইটের সেতু বানানো হয়েছে, খচ্চরটানা নতুন ট্রলিগাড়ি চলাচলের সুবিধার জন্য রাস্তার দু’পাশে সারি বেঁধে আলো বসানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক কারখানাটির নির্মাণ কাজ চলার সময় তারা যে কষ্টকর পরিস্থিতির শিকার হতে পারে লা মাঙ্গার অধিবাসীরা তা আগে থেকে অনুমান করতে পারে নি। নগরীর প্রথম বৈদ্যুতিক কারখানা বাসভবনের এত কাছে অবস্থিত হবার জন্য তার স্পন্দনকে মনে হত একটা সার্বক্ষণিক ভূমিকম্পের মতো। তাঁর সকল মর্যাদা ও প্রতিপত্তি সত্ত্বেও লোকজনকে অসুবিধার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ডাক্তার উরবিনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কারাখানাটি অন্যত্র স্থানান্তর করাতে সক্ষম হলেন না। অবশেষে দৈবশক্তির সঙ্গে যে তাঁর একটা যোগসাজশ আছে তা প্রমাণিত হল, ওই শক্তি তাঁর পক্ষ নিল। একদিন রাতে কারখানার বয়লারটি ভয়ঙ্কর শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়ে নতুন ঘরবাড়িগুলির উপর দিয়ে, অর্ধেক শহর অতিক্রম করে, সেন্ট জুলিয়ান হাসপাতালের প্রাক্তণ মঠের বুকে পড়ে তার বৃহত্তম গ্যালারিটি চুরমার করে দিল। বর্তমান বছরের শুরুতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনটি থেকে লোকজন সরে গিয়েছিল, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় কারাগার থেকে যে চারজন বন্দি পালিয়ে গিয়ে ওখানে গির্জার উপাসনা বেদির কাছে আশ্রয় নিয়েছিল তারা বয়লারের আঘাতে মারা যায়।

    প্রেমের চমৎকার ঐতিহ্যবাহী সুন্দর শান্ত শহরতলিটি কিন্তু বিলাসবহুল পাড়ায় রূপান্তরিত হবার পর প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকদের জন্য জায়গাটা খুব সুবিধাজনক থাকে নি। রাস্তাগুলি গরমের সময় ধুলায় ভরে যায়, শীতে জলাভূমির মতো হয়ে পড়ে, সারা বছর বিষণ্ণ একটি পরিবেশ বিরাজ করে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘর পল্লব আচ্ছাদিত বাগানের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে, সেখানে সামনের দিকে প্রসারিত পুরনো ধরনের বারান্দার পরিবর্তে বানানো হয়েছে মোজাইকের টালির চত্বর, মনে হয় গোপন প্রেমিকদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সচেতনভাবে এটা করা হয়েছে। এই সময় পুরনো ভিক্টোরিয়া শকটকে রূপান্তরিত-করা এক-ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বৈকালিক ভ্রমণের রীতি চালু হয়েছিল। লোকজন ঘোড়াগাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরুতো, একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে থামতো, সেখান থেকে দেখতো অক্টোবরের বুকে কাঁপন জাগানো অপরূপ গোধূলিলগ্ন, ওই দৃশ্য এখান থেকে বাতিঘরের চাইতেও ভালো দেখা যেতো। ওরা আরো দেখতো যাজকদের উপকূলে ওৎ পেতে থাকা সতর্ক হাঙ্গরের দলকে, আর বিশাল সাদা বৃহস্পতিবারের সামুদ্রিক জাহাজটিকে, পোতাশ্রয়ের খাল দিয়ে অগ্রসর হবার সময় তাকে এত কাছে মনে হত যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আপিসে সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করার পর এখানে এসে একটা গাড়ি ভাড়া করতো, তবে আর সবার মতো গাড়ির উপরটা গুটিয়ে নামিয়ে না দিয়ে, গ্রীষ্মের মাসগুলিতে তাই ছিল প্রচলিত রীতি, সে আসনের এক অন্ধকার কোনায় গিয়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে বসে থাকতো, সর্বদাই একা, আর গাড়ির চালকের মনে যেন কোন কু-ধারণার জন্ম না হয় সেজন্য তাকে অপ্রত্যাশিত সব পথে চলার নির্দেশ দিতো। আসলে গাড়িতে চড়ে এই বেড়ানোতে তার উৎসাহ কেন্দ্রীভূত ছিল পত্রপল্লব আচ্ছাদিত কলা ও আম গাছের আড়ালে আধা-লুকানো গোলাপি মার্বেল পাথরে নির্মিত পার্থিনন ধাঁচের একটি বাড়ির উপর। বাড়িটা ছিল লুইসিয়ানার তুলা ক্ষেত অঞ্চলে যেসব সুখস্বপ্নঘেরা বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করা হত তার একটা ব্যর্থ অনুকরণ। বিকাল পাঁচটার সামান্য আগে ফারমিনা ডাজার সন্তানরা বাড়ি ফিরে আসতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওদের পারিবারিক গাড়িতে ওদের বাড়ি পৌঁছতে দেখতো, তারপর সে দেখতো ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার তাঁর নিয়মিত কাজে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরও যে-দৃশ্যটি দেখার জন্য তার সমগ্র চিত্ত ব্যাকুল হয়েছিল তার সামান্য কণাও সে দেখতো পেল না।

    সেদিন জুন মাসের প্রথম বিধ্বংসী বর্ষণ শুরু হয়। তা সত্ত্বেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার নিঃসঙ্গ ভ্রমণে বেরোয়। ঘোড়াটা এক সময় পা পিছলে কাদার মধ্যে পড়ে যায়। ফ্লোরেন্টিনো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লক্ষ করলো যে ঘটনাটা ঘটেছে ফারমিনা ডাজার বাসভবনের ঠিক সামনে। সে গাড়োয়ানকে অস্থির হয়ে তাড়াতাড়ি করতে বললো, খেয়াল করলো না যে তার অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তার গোপন উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যেতে পারে। ফ্লেরেন্টিনো আরিজা গাড়োয়ানকে চেঁচিয়ে বললো, ‘দোহাই তোমার, এখানে না, তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও চলো।’

    তার অস্থিরতায় বিভ্রান্ত হয়ে গোড়োয়ান ঘোড়াকে জোয়ালমুক্ত না করেই ওঠাতে চেষ্টা করলো, যার ফলে গাড়ির অক্ষদণ্ডটি ভেঙে গেল। প্রবল বর্ষণের মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোন রকমে গাড়ি থেকে বেরিয়ে তার বিব্রতকর অবস্থা সহ্য করতে লাগলো। পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির যাত্রীরা তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দিলো। ফ্লোরেন্টিনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় উরবিনো পরিবারের একটি ভৃত্য তাকে দেখতে পায়, কাপড় জামা ভিজে চুপচুপ, এক হাঁটু কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, ভৃত্যটি তার জন্য একটি ছাতা নিয়ে এল যেন সে চত্বরে উঠে আশ্রয় নিতে পারে। তার সব চাইতে বেপরোয়া পাগলামির মধ্যেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এরকম সৌভাগ্যের কথা স্বপ্নেও ভাবে নি, কিন্তু ফারমিনা ডাজার তাকে এই অবস্থায় দেখার চাইতে সে নিজের মৃত্যু কামনা করলো।

    জুভেনাল উরবিনো যখন তাঁর পরিবারবর্গসহ পুরনো শহরে বাস করতেন তখন প্রতি রবিবার সকাল আটটার উপাসনায় যোগ দেবার জন্য তাঁরা বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে ক্যাথিড্রালে যেতেন। তাদের জন্য ওটা যতখানি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল তার চাইতে বেশি ছিল একটা ইহজাগতিক অনুষ্ঠান। তারপর অন্যত্র উঠে যাবার পরও তারা বহু বছর ধরে গাড়িতে করে ওখানে গেছেন এবং মাঝে মধ্যে পার্কের তালগাছগুলির নিচে বসে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করেছেন। কিন্তু লা মাঙ্গায় যাজকদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মন্দির নির্মিত হবার পর, তাদের নিজস্ব সমুদ্র সৈকত ও সমাধিক্ষেত্র তৈরি হবার পর, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন অনুষ্ঠানের সময় ছাড়া তাঁরা আর ওই ক্যাথিড্রালে যেতেন না। এই পরিবর্তনের কথা ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জানতো না। সে রবিবারের পর রবিবার প্যারিস ক্যাফের বারান্দায় বসে তিনটি প্রার্থনার সময়ই ক্যাথিড্রাল থেকে লোকজনের বেরিয়ে আসা লক্ষ করতে থাকে। তারপর তার ভুলটি বুঝবার পর সে নতুন গির্জায় হানা দিল। কয়েক বছর আগেও ওই গির্জায় যাওয়া বেশ কেতাদুরস্ত বলে বিবেচিত হত। ওখানে সে আগস্ট মাসের পর পর চার রবিবারে কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটার সময় তার সন্তানদের নিয়ে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে দেখলো কিন্তু ওদের সঙ্গে ফারমিনা ডাজা ছিল না। এক রবিবার সে গির্জা সংলগ্ন নতুন সমাধিক্ষেত্রটি দেখতে যায়, সেখানে লা মাঙ্গার অধিবাসীরা তাদের জন্য জমকালো সমাধিগৃহ নির্মাণ করছিল। যখন বিরাট বিরাট সীবা গাছের ছায়ার নিচে সব চাইতে জমকালো সমাধিগৃহটি তার চোখে পড়লো তখন মুহূর্তের জন্য যেন তার হৃদস্পন্দন থেমে যায়। ওই সমাধিগৃহে বসানো হয়েছে গথিক ধাঁচের রঙিন কাচের জানালা, মার্বেলের দেবদূত আর গোটা পরিবারের জন্য সোনালি অক্ষরে আঁকা সমাধিফলক। সেখানে দেখা গেল, স্বভাবতই, তার স্বামীর নামের পাশে ডনা ফারমিনা ডাজা ডি উরবিনো ডি লা কল-এর নাম এবং একটা প্রচলিত সমাধিলিপি, ‘প্রভুর শান্তি-ছায়ায় এখনো এক সঙ্গে।’

    ওই বছরের বাকি সময়ে ফারমিনা ডাজা কোন নাগরিক বা সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিল না, বড় দিনের অনুষ্ঠানেও না, যদিও ওই উৎসব অনুষ্ঠানে সে এবং তার স্বামী সর্বদা সসম্মানে প্রধান ভূমিকা নিত। তবে তার অনুপস্থিতি সব চাইতে বেশি চোখে পড়লে অপেরা মৌসুমের প্রথম রজনীতে। বিরতির সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা ছোট দলের মধ্যে গিয়ে পড়ে। নাম উচ্চারণ না করলেও ওরা যে ফারমিনা ডাজা সম্পর্কে কথা বলছিল তা সহজেই বোঝা গেল। ওরা বলছিল যে গত জুনে একজন কানার্ড কোম্পানির জাহাজে করে তাকে পানামার দিকে যেতে দেখেছে। সে ছিল রোগাক্রান্ত, মুখে লজ্জাজনক রোগের আক্রমণের ধ্বংসাত্মক চিহ্ন লুকোবার জন্য সে গাঢ় রঙের একটা ওড়না দিয়ে তার মুখ ঢেকে রেখেছিল। একজন মন্তব্য করলো, অত প্রতিপত্তিশালী মহিলাকে কী এমন সাংঘাতিক রোগ আক্রমণ করতে পারে, যার একটি বদমেজাজী উত্তর সে লাভ করে, ‘ওই রকম বিশিষ্ট মহিলা শুধু একটি রোগ দ্বারাই আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষয় রোগ।’

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জানতো যে তার দেশের বিত্তশালীরা স্বল্পকালীন রোগে আক্রান্ত হয় না। হয় তারা কোন রকম সতর্ক সঙ্কেত না দিয়ে প্রায় সর্বদাই কোন একটা বড় ধরনের ছুটির দিনের আগে পট করে মরে যায়, যার ফলে শোক পালনের জন্য উৎসব অনুষ্ঠানগুলি বাতিল করে দিতে হয়, নয় তারা দীর্ঘ সময় ধরে চরম বিশ্রী রোগভোগের পর ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং তাদের রোগ-ভোগের সময়ের অন্তরঙ্গ খুঁটিনাটি শেষ পর্যন্ত জনসাধারণের সামনে উদঘাটিত হয়ে পড়ে। পানামায় নির্জন বাস বিত্তশালীদের জন্য প্রায় একটা বাধ্যতামূলক প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেখানকার অ্যাডভেনটিস্ট হাসপাতালে তারা ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতো। ওই হাসপাতালটি ছিল ডারিয়েনের প্রাগৈতিহাসিক ধারাবর্ষণের মধ্যে একটি সাদা বিশাল গুদাম, যেখানে রোগীরা যে স্বল্প আয়ুষ্কাল তখনো তাদের বাকি ছিল তার হদিস রাখতে পারতো না, যার ক্যানভাসের জানালাবিশিষ্ট নির্জন ঘরে কার্বলিক অ্যাসিডের গন্ধ স্বাস্থ্যের গন্ধ নাকি মৃত্যুর গন্ধ তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারতো না। যারা সুস্থ হয়ে ফিরতো তারা সঙ্গে নিয়ে আসতো চমৎকার উপহার সামগ্রী, উদার হস্তে সেসব বিতরণ করতো এবং তারা যে তখনো বেঁচে আছে ওই রকম অবিবেচনার জন্য এক ধরনের যন্ত্রণাকাতর ব্যাকুলতার সঙ্গে সবার ক্ষমা ভিক্ষা করতো। কেউ কেউ ফিরে আসতো তাদের তলপেটে বর্বরোচিত সেলাইর আঁকিবুকি দাগ নিয়ে, যেন মুচির শন দিয়ে ওই সেলাই করা হয়েছে। লোকজন দেখা করতে এলে তারা তাদের শার্ট উঁচু করে তুলে তাদের দাগ দেখায়, যারা আনন্দের আতিশয্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে তাদের দাগের সঙ্গে নিজেদের সেলাইর দাগের তুলনা করে। যতদিন বেঁচে থাকবে তারা ততদিন ক্লোরোফর্মের প্রভাবাধীন থাকার সময় যেসব স্বর্গীয় দৃশ্য চোখের সামনে দেখেছে বারবার তার বর্ণনা দেবে। পক্ষান্তরে, যারা ফিরে আসে না তারা কী অলৌকিক দৃশ্য দেখেছে তার কথা কেউ জানতে পারে না, সব চাইতে দুঃখের, যারা যক্ষ্মারোগীদের শিবিরে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তাদের রোগের জটিলতার চাইতেও অন্তহীন বৃষ্টি ধারার বিষণ্নতার কারণে, তাদের কথাও কেউ জানতে পায় না।

    তাকে যদি বাধ্য হয়ে একটা কিছু বেছে নিতে হয় তাহলে ফারমিনা ডাজার জন্য সে কোন নিয়তি বেছে নেবে তা ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঠিক করতে পারলো না। যতই অসহনীয় হোক সে সব চাইতে বেশি চাইলো প্রকৃত অবস্থাটা জানতে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে তা জানতে পারলো না। সে যা শুনেছে তার সমর্থনে সে কোথাও কোনো ইঙ্গিত পাবে না সেটা তার কাছে অকল্পনীয় মনে হল। নৌযানের জগতে, যা ছিল তার জগত, সব রহস্যেরই সমাধান হয়ে যায়, সেখানে কোনো গোপন কথাই গোপন থাকে না। তথাপি কালো ওড়নায় মুখ ঢাকা ওই রমণী সম্পর্কে কেউ কিছুই শোনে নি। যে- শহরে সবাই সব কিছু জেনে ফেলে, ঘটনা ঘটবার আগেই যেখানে অনেক কিছু জনগণের গোচরীভূত হয়ে যায়, বিশেষ করে বিত্তশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, সেখানে এই ঘটনাটি সম্পর্কে কেউ কিছুই জানলো না। ফারমিনা ডাজার উধাও হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কেউ কোন ব্যাখ্যা দিতে পারলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লা মাঙ্গায় পায়চারি করতে থাকলো, যাজকদের গির্জায় ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়াই প্রার্থনা-বাণী শুনতে থাকলো, মনের অন্য রকম অবস্থায় সে যেসব নাগরিক উৎসব-অনুষ্ঠান সম্পর্কে কখনো উৎসাহিত হত না সে সব অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে থাকলো, কিন্তু কালের যাত্রা সে যে গল্প শুনেছে তার বিশ্বাসযোগ্যতাই শুধু বাড়িয়ে তুললো। আর উরবিনোদের সংসারে মায়ের অনুপস্থিতি ছাড়া সব কিছুই মনে হল স্বাভাবিক।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাবার সময় আরো কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে অবহিত হল যা সে আগে জানতো না কিংবা যে সব সম্পর্কে সে আগে কোন খোঁজ নেয় নি। এর মধ্যে একটি হল যে ক্যান্টাব্রিয় গ্রামে লোরেঞ্জা ডাজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানেই তাঁর মৃত্যুবরণের কথা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁকে বহু বছর ধরে প্যারিস ক্যাফের হৈহল্লাপূর্ণ দাবার লড়াইয়ের টেবিলে দেখেছে, অনর্গল কথা বলতে বলতে তাঁর গলা ভেঙে যেতো, দিন দিনই আরো মোটা ও আরো রুক্ষ হয়ে উঠছিলেন তিনি এবং ওই ভাবেই দুর্ভাগ্যজনক এক বার্ধক্যের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছিলেন। গত শতাব্দীতে আনিসেট দিয়ে সেই অপ্রীতিকর প্রাতরাশের পর তারা দুজন একটি বাক্যও বিনিময় করে নি, এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মেয়ের একটা সার্থক বিয়ে দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করার পরও তাকে চরম বিদ্বেষের চোখে দেখতো, সেও যেমন তাকে একই রকম বিদ্বেষের চোখে দেখতো। কিন্তু ফারমিনা ডাজার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য জানবার জন্য সে এতই দৃঢ় সঙ্কল্প ছিল যে ওর বাবার কাছ থেকে সব কিছু জানার জন্য সে আবার প্যারিস ক্যাফেতে গিয়ে হানা দিল। ঠিক ওই সময়েই জেরেমিয়া দ্য সাঁত-আমুর ওখানে একসঙ্গে চল্লিশ জন দাবাড়ুর বিরুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছিলেন। প্যারিস ক্যাফেতেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অবগত হল যে লোরেঞ্জো ডাজা মারা গেছে, আর সে এতে সর্বান্তঃকরণে খুশি হল, যদিও এর ফলে হয়তো সারা জীবন তাকে বেঁচে থাকতে হবে সত্যটা না জেনেই অবশেষে, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের হাসপাতালে যাবার কাহিনীটি সে সত্য বলে গ্রহণ করে। সে তার একমাত্র সান্ত্বনা খুঁজে পায় একটা পুরনো প্রবাদ বাক্যে : ‘অসুস্থ রমণীরা অনন্তকাল বেঁচে থাকে। যেদিন সে বিশেষ হতাশাক্রান্ত হত সেদিন সে নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করতো যে ফারমিনা ডাজার মৃত্যু-সংবাদ, যদি সে মারা যায়, তার কাছে ঠিকই পৌঁছে যাবে, তাকে সে জন্য খোঁজ করতে হবে না।

    ওই খবর তার কাছে কখনো পৌঁছে নি, কারণ ফারমিনা ডাজা জীবিত ছিল, সুস্থ ছিল, বিশ্বসংসার কর্তৃক বিস্মৃত হয়ে সে তার কাজিন হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজের সঙ্গে বাস করছিল ফ্লোর দ্য মারিয়া গ্রাম থেকে মাইল দেড়েক দূরে এক খামার বাড়িতে। স্বামীর সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছে কোনো কেলেঙ্কারি না করে সে চলে আসে।

    এত বছরের স্থিতিশীল দাম্পত্য জীবনের পর তাদের একমাত্র বড় মাত্রার সঙ্কটের সময় তারা উভয়েই দুই কিশোরের মতো সেই সঙ্কটের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। তাদের পূর্ণবিকশিত জীবনের প্রশান্তির মধ্যে ব্যাপারটা তাদের হতকিত করে ফেলে, এমন একটা সময়ে যখন তারা মনে করছিল যে তারা বোধ হয় দুর্ভাগ্যের চোরাগুপ্তা আক্রমণের হাত থেকে মুক্ত, সন্তানরা বড় হয়েছে, ভদ্র হয়েছে, ভবিষ্যৎ এখন তাদের দুজনের জন্য প্রস্তুত, তিক্ততা ছাড়া কিভাবে বুড়ো হতে হয় তারা শুধু তার পাঠ গ্রহণ করবে। তাদের দ্বন্দ্ব এমন আকস্মিক ভাবে দেখা দেয় যে তারা উভয়েই ক্যারিবীয় প্রথানুযায়ী চিৎকার, কান্না ও অপরের মধ্যস্থতার সাহায্যে তা নিরসন করার চেষ্টা না করে ইউরোপীয় প্রজ্ঞার সাহায্যে সেটা নিরসন করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের মধ্যে এত দোদুলচিত্ততা দেখা গেল, তাদের আনুগত্য কি এখানে না ওখানে তা নিয়ে এত সংশয় ও দ্বিধা উপস্থিত হল যে তারা শেষ পর্যন্ত একটা বালকসুলভ পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, যার অবস্থান কোথাও ছিল না। অবশেষে ফারমিনা চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল, কোথায় যাবে, কেন যাচ্ছে তা সে জানে না, কিন্তু তার ক্রোধ ও ক্ষোভ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল, আর ডাক্তার উরবিনো নিজের অপরাধ বোধ দ্বারা প্রতিনিবৃত্ত হয়ে ওকে বাধা দিতে পারলেন না।

    প্রকৃতপক্ষে ফারমিনা ডাজা সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সঙ্গে একটা কালো ওড়নায় মুখ ঢেকে মাঝ রাতে জাহাজে করে শহর ত্যাগ করে, তবে কানার্ড লাইনের জাহাজে করে পানামার উদ্দেশে নয়, সে যাত্রা করে একটি নিয়মিত নৌযানে সান হুয়ান ডি লা সিনেগার উদ্দেশে, যে শহরে সে জন্মগ্রহণ করেছিল, যেখানে কৈশোরকাল পর্যন্ত তার জীবন কেটেছিল, যে স্থানটি দেখার জন্য তার ব্যাকুলতা দিন দিন বাড়ছিল এবং কালের যাত্রার মধ্য দিয়ে এখন সেটা সহ্য করা তার পক্ষে ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। স্বামীর ইচ্ছা এবং সে-যুগের প্রথা উপেক্ষা করে সে শুধু বছর পনেরোর এক মেয়েকে সঙ্গী করে যাত্রা করে। ওই মেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল পরিবারের এক পরিচারিকা রূপে, ফারমিনা ডাজার ধর্মকন্যা হিসাবে। তবে ফারমিনাদের কোন অসুবিধা হয়নি। জাহাজের কাপ্তান ও বন্দর-কর্মচারীরা সর্বত্রই তার সফরসূচি পূর্বাহ্নেই পেয়ে যায়। তার হঠকারি সিদ্ধান্তটি নেবার সময় সে ছেলেমেয়েদের বলে যে সে মাস তিনেকের জন্য জায়গা বদলের উদ্দেশে তাদের মাসি হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজের ওখানে যাচ্ছে, যদিও মনে মনে সে ঠিক করেছিল যে আর ফিরে আসবে না। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো স্ত্রীর চারিত্রিক শক্তি সম্পর্কে খুব ভালো ভাবে জানতেন, নিজের মনের বিচলিত অবস্থায় তিনি ফারমিনার সিদ্ধান্তকে তাঁর নানা পাপের জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি হিসাবে নতমস্তকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু জাহাজের বাতিগুলি চোখের আড়ালে অদৃশ্য হবার আগেই তারা উভয়েই তাদের দুর্বলতার জন্য অনুতাপ বোধ করতে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.