Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ১৬

    ১৬

    ছেলেমেয়ে এবং সাংসারিক বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক পত্রালাপ চললেও প্রায় দু’বছর অতিক্রান্ত হবার আগে তাদের সামনে বিদ্যমান অহঙ্কারের পাহাড় তারা অতিক্রম করতে পারে নি। দ্বিতীয় বছরে ছেলেমেয়েরা তাদের স্কুলের ছুটির সময়টা কাটাতে যায় ফ্লোর ডি মারিয়াতে এবং ফারমিনা ডাজা তখন একটা অসম্ভব কাজ করে, তাকে তার নতুন জীবনে বেশ তৃপ্ত মনে হয়। অন্তত তাঁর ছেলের চিঠিপত্র থেকে জুভেনাল উরবিনো ওই সিদ্ধান্তেই উপনীত হন। তাছাড়া ওই সময়ে রিওহাচার বিশপ তাঁর একটা যাজকীয় দায়িত্ব পালন উপলক্ষে ওখানে যান। বাহন ছিল তাঁর বিখ্যাত সাদা খচ্চর, সোনার কারুকাজ সংবলিত চমৎকার গদিতে আসীন তিনি। তাঁর পেছন পেছন চলেছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা তীর্থযাত্রীর দল, অ্যাকর্ডিয়ান বাজানো সঙ্গীত শিল্পীবৃন্দ, খাবার ও তাবিজ বিক্রি করা ফেরিওয়ালারা। তিন দিন ধরে খামারবাড়ি ছিল পঙ্গু ও আশাহীন লোকজনে পূর্ণ তবে প্রকৃতপক্ষে তারা জ্ঞানগর্ভ ধর্মীয় ভাষণ শোনা কিংবা ঢালাও ক্ষমালাভের জন্য সেখানে জড়ো হয় নি, তারা এসেছিল খচ্চরটির কৃপা লাভের আশায়, তারা শুনেছে যে তার প্রভুর দৃষ্টি এড়িয়ে সে নাকি নানা অলৌকিক কাজ করতে পারে। এই বিশপ যখন একজন সাধারণ যাজক ছিলেন সেই সময় থেকেই উরবিনো ডি কল পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে তাঁর প্রায়শ যাতায়াত ছিল। একদিন তিনি সর্বজনীন উৎসবমালা থেকে পালিয়ে হিল্ডাব্রান্ডার খামারবাড়িতে এসে উপস্থিত হন, তাদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজন করবেন। খাবার সময় তারা শুধু জাগতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ফারমিনা ডাজাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে তাঁর কাছে তাকে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী স্বীকারোক্তি করতে বললেন। ফারমিনা নম্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্পষ্ট ভাবে বললো যে অনুতাপ করার মতো তার কিছুই নাই। তার উদ্দেশ্য না থাকলেও, অন্তত সচেতন ভাবে, সে নিশ্চিত জানতো যে তার এই উত্তর যথোচিত জায়গায় ঠিকই পৌঁছে যাবে।

    ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো কিছু হতাশাবাদী সুর মিশিয়ে বলতেন যে তাঁর জীবনের ওই তিক্ত দু’বছরের জন্য তিনি দায়ী ছিলেন না, তার জন্য দায়ী ছিল পরিবারের সদস্যদের তাদের কাপড় ছাড়ার পর ওইসব কাপড়ের গন্ধ শোঁকার ফারমিনার অভ্যাসটি। ফারমিনা তার নিজের ছাড়া-কাপড়েরও গন্ধ শুঁকতো, পরিষ্কার দেখা গেলেও তা ধোয়ার দরকার আছে কিনা সেটা সে পরীক্ষা করে দেখতো। তার অল্প বয়স থেকেই সে এটা করে এসেছে এবং বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী তার এই কাজটি লক্ষ করার পূর্ব পর্যন্ত সে এটা নিয়ে মন্তব্য করার কোন প্রয়োজনীয়তাই বোধ করে নি। তার স্বামী জানতেন যে সে দিনে তিনবার বাথরুমের দরজা বন্ধ করে সেখানে ধূমপান করে কিন্তু এটা তার বিশেষ কোন মনোযোগ আকর্ষণ করে নি কারণ তিনি জানতেন যে তাঁর শ্রেণীর মহিলারা ঘরের দরজা বন্ধ করে দল বেঁধে পুরুষদের কথা বলে এবং ধূমপান করে, মাঝে মাঝে দুই লিটার সুরা পর্যন্ত পান করে মাতাল হয়ে ঘরের মেঝেতে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু সামনে কোন কাপড়-জামা পড়ে থাকতে দেখলেই সেটা নাকের কাছে তুলে নিয়ে শুঁকবার অভ্যাস তাঁর মনে হল শুধু অসঙ্গত নয়, অস্বাস্থ্যকরও। স্বামীর প্রতিক্রিয়াকে সে ঠাট্টা হিসাবে গ্রহণ করলো, যা নিয়ে সে আলোচনা করতে চাইতো না তাকেই সে ওইভাবে গ্রহণ করতো এবং বলতো যে ঈশ্বর শুধু শোভার জন্য তাকে ওরিওল পাখির চক্ষু দান করেন নি। একদিন সকালে সে যখন বাজারে গিয়েছিল, বাড়ির চাকরবাকররা তার তিন বছরের ছেলেকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তার খোঁজে সারা পাড়া সচকিত করে তোলে। বাড়ির কোথাও ছেলেকে পাওয়া গেল না! ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে ফারমিনা বাড়ি ফিরে এসে একটা শিকারি কুকুরের মতো এদিক ওদিক কয়েকবার শুঁকলো, তারপর ছেলেকে আবিষ্কার করলো একটা বর্মের মধ্যে নিদ্রিত অবস্থায়। সে যে ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারে একথা কারো মাথাতেই আসে নি। তার বিস্মিত স্বামী যখন জিজ্ঞাসা করলেন সে কেমন করে তাকে খুঁজে পেল, ফারমিনার জবাব ছিল, ‘কোকোর গন্ধ দিয়ে।‘

    সত্যি কথা বলতে গেলে তার এই গন্ধের অনুভূতি শুধু কাপড়-জামা ধোয়া কিংবা ছেলে মেয়েদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেই নয়, তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক অঙ্গনে, অত্যন্ত সার্থক ভূমিকা পালন করে। জুভেনাল উরবিনো তাঁর সমগ্র বিবাহিত জীবনের আগাগোড়া, বিশেষ করে প্রথম দিকে, এটা লক্ষ করেছেন। ফারমিনা ডাজা এমন একটা পরিবেশে এসে পড়ে যা ছিল তার জন্য তিন শতাব্দীর বৈরী সংস্কারে আচ্ছন্ন, তবু সে তার মধ্য দিয়ে সাবলীল ভাবে এগিয়ে গেছে, চারপাশের তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার ছুরি তাকে স্পর্শ করে নি, কারো সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে নি, ওই জগতকে সে এমন সহজ ভাবে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলে যাকে শুধু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা রূপেই চিহ্নিত করা যায়। এই আতঙ্কজনক ক্ষমতার উৎস হয়তো ছিল যুগ যুগের একটা প্রজ্ঞার মধ্যে, পাথরের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যেমন থাকে, আর ওই ক্ষমতা এক অশুভ রবিবারে, উপাসনা অনুষ্ঠানের ঠিক আগে আগে, তার দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হল। ফারমিনা ডাজা নিতান্ত অভ্যাসের বশে স্বামীর গত রাতে পরা পোশাক নাকের কাছে তুলে শুঁকলো, আর তখনই তার, একটা অস্বাভাবিক অনুভূতি হল, তার স্বামী অন্য একটি পুরুষের সঙ্গে শুয়েছে।

    প্রথমে সে কোট এবং ওয়েস্টকোটের গন্ধ নিল, বোতামঘর থেকে ঘড়ির চেইন খুলে নিল, পকেট থেকে পেন্সিলের খাপ, টাকার ব্যাগ, খুচরা পয়সা সব বের করে ড্রেসিং টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলো, শার্ট থেকে টাইপিন, টোপাজ পাথরের কাফ- লিঙ্কস, সোনার কলারের বোতম খুলে নিয়ে শার্টটা শুঁকলো, তারপর প্যান্ট থেকে এগারোটা চাবিসহ চাবির খাপ ও মুক্তার হাতল দেয়া ছোট পেন্সিলকাটা ছুরি বের করে প্যান্টটা শুঁকলো এবং সব শেষে সে আন্ডারওয়্যার, মোজা আর নামের আদ্যাক্ষর এম্ব্রয়ডারি করা রুমালটার গন্ধ নিল। এই সবগুলি জিনিসের মধ্যে নিঃসন্দেহে এমন একটা গন্ধ পাওয়া গেল যা তাদের এত বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে কখনোই পাওয়া যায় নি, কিন্তু ওই গন্ধকে কিছুতেই সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা গেল না, কারণ ওটা কোন ফুল বা কৃত্রিম সুরভি দ্রব্যের গন্ধ ছিল না, বরং এমন একটা গন্ধ ছিল যা একান্তভাবে মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফারমিনা কিছু বলল না, ওই গন্ধ সে রোজ পেল না, কিন্তু এখন সে আর তার স্বামীর জামাকাপড় ধুতে দেবার প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের জন্য শুঁকতো না, সে ওকাজটা করতো তার অন্তরাত্মা কুরে কুরে খাওয়া এক অসহনীয় দুশ্চিন্তা নিয়ে।

    স্বামীর নিত্য নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে তাঁর কাপড়ে ওই গন্ধের উৎস সে কোথায় খুঁজবে ফারমিনা ডাজা বুঝে উঠতে পারলো না। তাঁর সকালের ক্লাস ও দুপুরের খাওয়ার সময়ের মধ্যে এটা হতে পারে না, কারণ কোন সুস্থ মনের মহিলা দিনের ওই সময়ে প্রেমলীলায় লিপ্ত হতে পারেন বলে ফারমিনার মনে হল না, বিশেষ করে একজন দর্শনার্থীর সঙ্গে, যে সময়ে তখনো বাকি পড়ে থাকে ঘরদোর পরিষ্কার করা, বিছানা করা, বাজার করা, রান্না করা, তাছাড়া হয়তো এর সঙ্গে কোন নতুন দুশ্চিন্তাও যুক্ত হয়, সন্তানদের একজনকে স্কুল থেকে সময়ের আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ তার দিকে পাথর ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, আর সকাল এগারোটায় বাড়ি পৌঁছে সে দেখলো যে তার মা এলোমেলো বিছানায় নগ্ন হয়ে শুয়ে আছেন, আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার, তাঁর উপর পড়ে আছেন এক ডাক্তার। ফারমিনা আরো জানতো যে ডাক্তার সঙ্গমে লিপ্ত হতেন শুধু রাতের বেলায়, পরিপূর্ণ অন্ধকারে হলেই সব চাইতে ভালো, শেষ অবলম্বন হিসাবে প্রাতরাশের আগে আগে, পাখিরা যখন সবেমাত্র কৃজন করতে শুরু করেছে। তিনি বলতেন, এর পরে, দিনের বেলার যৌন-মিলনের মধ্যে আনন্দের চাইতে কাজের ভাগই ছিল বেশি, কাপড় খোলো, তারপর আবার গায়ে চাপাও। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার সময় কিংবা তাঁর দাবা খেলা ও ছায়াছবি দেখার রাত থেকে কিছু মুহূর্ত চুরি করে নেয়া সময়ের মধ্যে তাঁর কাপড়ের এই দূষণ ঘটেছে। এই শেষোক্ত সম্ভাবনা প্রমাণ করা ছিল খুব দুরূহ, কারণ সে তার অন্যান্য বন্ধুদের মতো ছিল না, স্বামীর ওপর গোয়েন্দাগিরি করা কিংবা অন্য কাউকে তা করতে বলা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তার আত্মমর্যাদা ও অহঙ্কারে বাধতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখার সময়টাই ছিল বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য সব চাইতে প্রশস্ত, এবং এটার উপর চোখ রাখাও ছিল সব চাইতে সহজ, কারণ ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তার সময়সূচি, প্রত্যেক রোগীর বিশদ বিবরণ, প্রাপ্ত অর্থের অঙ্ক প্রভৃতি লিখে রাখতেন। তাদের প্রথম দেখতে যাওয়ার দিন থেকে আরম্ভ করে ক্রসের চিহ্ন ও তাদের আত্মার ত্রাণ কামনায় কিছু উক্তি করে শেষ বিদায় জ্ঞাপন করার পূর্ব পর্যন্ত এই লিখিত বিবরণ তিনি রাখতেন।

    পরবর্তী তিন সপ্তাহে ফারমিনা ডাজা কয়েকদিন ধরে স্বামীর জামা-কাপড়ে ওই গন্ধটা পেলো না, তারপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে সে আবার ওই গন্ধ পেলো, আগের চাইতেও উগ্র, সে ওই গন্ধ পেলো পর পর কয়েক দিন, যদিও তার মধ্যে একদিন ছিল রবিবার, সেদিন একটা পারিবারিক সম্মিলন ছিল, আর তারা দুজন এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন হয় নি। তার চিরাচরিত প্রথা এমনকি তার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে এক অপরাহ্নে তার স্বামীর অফিস ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল, যেন সে অন্য একজন মানুষ এবং এমন একটা কাজ করলো যা সে কখনো করতো না, সে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে তার স্বামী বিগত কয়েক মাসে রোগী দেখতে যে সব বাড়ি গেছেন এবং তার জটিল নোট রেখেছেন সেগুলি মনোযোগ দিয়ে দেখলো। এই প্রথম সে একা ওই আপিসে গেছে। ঘরময় আলকাতরাজাত তেলতেলে ক্রিওসোটের গন্ধ, অচেনা জানোয়ারদের চামড়ায় বাঁধানো অজস্র বইপত্র, ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্কুল জীবনের ছবি, সম্মানসূচক ডিগ্রি, গ্রহ-নক্ষত্র দেখার জন্য একটা অ্যাস্ট্রোলেইব যন্ত্র, বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত কারুকাজ করা কয়েকটা ছোরা : একটা গোপন পুণ্যস্থান, তার স্বামীর ব্যক্তিগত জীবনের একমাত্র অংশ যেখানে তার প্রবেশাধিকার নাই, কারণ এখানে ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না, তাই যে অল্প কয়েকবার সে এখানে এসেছে তা ঘটেছে তার স্বামীর সঙ্গে এবং সর্বদাই অল্প সময়ের জন্য। তার মনে হত যে এখানে একা যাবার কোন অধিকার তার নাই, লুকিয়ে কোন কিছু দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আজ সে সেখানেই এসেছে। সত্যটা তাকে আবিষ্কার করতেই হবে। সে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে এবং কী যে জানবে তা ভেবে চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো। তার স্বভাবজ অহঙ্কারের চাইতে প্রবল, এমনকি তার মর্যাদা বোধের চাইতেও প্রবল এক অপ্রতিরোধ্য হাওয়া তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলে : একটা অসম্ভব যন্ত্রণার কুহকজালে সে আচ্ছন্ন হল।

    সে কোন রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না, কারণ তাদের পারস্পরিক বন্ধুবর্গের বাইরে ডাক্তারের রোগীরা ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব ভুবনের অংশ, তারা ছিল পরিচয়হীন মানুষ, তাদের পরিচয় ছিল তাদের চেহারা দিয়ে নয়, তাদের রোগ-যন্ত্রণা দিয়ে, তাদের চোখের রঙ কিংবা হৃদয়ের লুকোচুরি দিয়ে নয়, তাদের যকৃতের আকার, তাদের জিভের ওপর আস্তরণ, তাদের প্রস্রাবে রক্ত-চিনির পরিমাণ, জ্বরাক্রান্ত রজনীতে তাদের দৃষ্টিভ্রম দিয়ে। ওই লোকগুলি তার স্বামীর ওপর আস্থাশীল ছিল, তারা ভাবতো যে তাঁর কারণেই ওরা বেঁচে আছে, যদিও আসলে তারা বেঁচে ছিল তার স্বামীর স্বার্থেই এবং শেষ পর্যন্ত তারা পরিণত হত মেডিক্যাল ফাইলে তার স্বামীর নিজের হাতে লেখা, একেবারে তলার দিকে, একটি বাক্যে : ‘শান্ত হোন, ঈশ্বর দরজায় দাঁড়িয়ে আপনার প্রতীক্ষা করছে।’ দু’ঘণ্টা নিষ্ফল পরিশ্রমের পর ফারমিনা ডাজা ডাক্তারের অফিসঘর ত্যাগ করলো, তার মনে হল সে যেন একটা অশোভনতা দ্বারা নিজেকে প্রলুব্ধ হতে দিয়েছে।

    কল্পনা তাড়িত হয়ে সে তার স্বামীর মধ্যে নানা পরিবর্তন আবিষ্কার করতে শুরু করলো। তার মনে হল স্বামী যেন এড়িয়ে যেতে সচেষ্ট, খাবার টেবিলে এবং শয্যায় যেন তার ক্ষুধা বা জৈব আকাঙ্ক্ষা নাই, অল্পতেই রাগ করছেন, ব্যঙ্গাত্মক উত্তর দিচ্ছেন, আগে বাড়িতে যেমন একজন প্রশান্ত মানুষ ছিলেন এখন তার পরিবর্তে তিনি যেন একটি খাঁচায় আটকানো সিংহ। তাদের বিয়ের পর এই প্রথম সে তার স্বামীকে দেরিতে ঘরে ফিরতে দেখলে তার সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখতে শুরু করলো, সত্যটা বের করবার জন্য তাঁকে মিথ্যা কথা বলতে লাগলো, তারপর স্বামীর কথার মধ্যে স্ববিরোধিতা আবিষ্কার করলে মর্মাহত হতো। এক রাতে ভীষণ চমকে সে ঘুম থেকে জেগে উঠলো, তার মনে হল তার স্বামী যেন তার দিকে চরম ঘৃণার চোখে তাকিয়ে আছেন। সে ভয়ে শিউরে উঠলো। তার যৌবনে সে একবার ওই রকম ভয় পেয়েছিল, তার মনে হয়েছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার খাটের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে তাকে এক দৃষ্টিতে দেখছে, কিন্তু সে-দৃষ্টি ছিল প্রেমে পূর্ণ, ঘৃণায় নয়। তাছাড়া, এবার এটা কোন দৃষ্টি-বিভ্রম ছিল না, ভোর রাত দু’টার দিকে তার স্বামী সত্যিই বিছানায় উঠে বসে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সে যখন ওঁকে জিজ্ঞাসা করলো, কেন, তখন তিনি ব্যাপারটা অস্বীকার করলেন, আবার বালিশে মাথা রেখে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছো।’

    ওই সময়ে, ওই রাতের পর, একাধিকবার একই রকম ঘটনা ঘটে। ফারমিনা ডাজা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারলো না কোনটা বাস্তব কোনটা মায়া কল্পনা, তার অবধারিত ভাবে মনে হল সে বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছে। শেষে তার খেয়াল হল যে তার স্বামী এবার কর্পাস ক্রাইস্টির বৃহস্পতিবার অথবা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলির কোনো রবিবারেই যিশু খ্রিস্টের শেষ ভোজ উপলক্ষে কমিনিউন অনুষ্ঠানে যোগ দেন নি, ধর্মকর্মের জন্য প্রতি বছর তিনি যে কিছু সময়ের জন্য নিয়মিত নির্জন বাসে যেতেন এবার তা করবার সময়ও তিনি পান নি। ফারমিনা যখন তাঁর আত্মিক স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এরকম অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলো তখন তিনি উত্তর এড়িয়ে গেলেন। এর মধ্যেই ছিল চূড়ান্ত সূত্র, কারণ আট বৎসর বয়সে প্রথম কমিনিউন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর থেকে তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ ভোজ দিবসে কমিনিউনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন নি। ফারমিনা বুঝলো যে তার স্বামী একটা মারাত্মক পাপ করেছেন এবং যেহেতু তিনি যাজকের কাছে গিয়ে স্বীকারোক্তি করে তাঁর সাহায্য নিচ্ছেন না অতএব তিনি সেই পাপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। সে কখনো কল্পনা করে নি যে প্রেমের সম্পূর্ণ বিপরীত একটা অনুভূতি থেকে সে কখনো এত যন্ত্রণা পাবে, কিন্তু তাই সে পেতে লাগলো। সে সিদ্ধান্ত নিল, যে সাপের বাসাগুলি তার আত্মাকে বিষিয়ে দিচ্ছে সেগুলি পুড়িয়ে না ফেললে সে বাঁচতে পারবে না। আর তাই সে করলো। একদিন বিকালে সে বারান্দায় বসে মোজা রিফু করছিল, স্বামী তাঁর দিবানিদ্রা শেষে নিত্যনৈমিত্তিক ভাবে একটা বই পড়ছিলেন, হঠাৎ সে তার সেলাই থামিয়ে চশমাটা কপালের উপর ঠেলে দিয়ে, কোন রকম কাঠিন্য ছাড়া, একটা ব্যাখ্যা চাইলো :

    ‘ডাক্তার।’

    ডাক্তার তখন ‘পেঙ্গুইনের দ্বীপ’-এর মধ্যে ডুবে ছিলেন। সে সময় সবাই ওই বইটি পড়ছিলো। তিনি অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিলেন, ‘উঁ।’ ফারমিনা ছেড়ে দিল না, ‘আমার দিকে তাকাও’, সে বললো।

    তিনি তাকালেন, তাঁর পড়ার চশমার ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে তাকে ভালো দেখতে পেলেন না, কিন্তু চশমা না খুলেই তিনি তার চোখের আগুনে যেন পুড়ে গেলেন!

    তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’

    ফারমিনা বললো, ‘সেটা তুমি আমার চাইতে ভালো জানো।’

    আর কিছু বললো না সে। চশমাটা নামিয়ে সে আবার মোজা রিফু করতে থাকলো। ডাক্তার জুভেনাল বুঝলেন যে যন্ত্রণার দীর্ঘ কাল শেষ হতে চলেছে। মুহূর্তটি যেমন হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন তেমন হল না, বুকের মধ্যে ভূমিকম্পের স্পন্দন অনুভব করলেন না তিনি, তার পরিবর্তে এমন একটা আঘাত অনুভব করলেন যা শান্তি এনে দেয়, একটা মুক্তির স্বাদ পেলেন তিনি, আগে হোক বা পরে হোক এটা ঘটতোই, এখন পরের চাইতে আগেই ঘটে গেল এটা : অবশেষে মিস বারবারা লিঞ্চ-এর প্রেতাত্মা তাঁর গৃহে প্রবেশ করলো।

    চার মাস আগে মিসেরিকর্ডিয়া হাসপাতালের ক্লিনিকে তার সঙ্গে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। মহিলা তাঁর ডাক পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ডাক্তার তাকে দেখামাত্র বুঝলেন যে তাঁর নিয়তিতে এই মাত্র মেরামতের অযোগ্য একটা কিছু ঘটে গেল। সে ছিল দীর্ঘাঙ্গী, শোভন ও রুচিশীল, ত্বকের রঙ ও কোমলতা ঝোলা গুড়ের মতো, চওড়া হাড়ের এক বর্ণসঙ্কর রমণী। সেদিন সকালে তার পরনে ছিল গোল গোল সাদা ফুটকি দেয়া লাল একটা জামা, ওই কাপড়েরই একটা চওড়া প্রান্তের টুপি মাথায়, কপাল ঢেকে প্রায় চোখের পাতা পর্যন্ত টুপির প্রান্তটা নামানো। অন্যান্য মানুষের চাইতে তার যৌনতা মনে হল বেশি প্রকট। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ক্লিনিকে রোগী দেখতেন না, তবে তার সামনে দিয়ে যখনই যেতেন তখনই তার ভেতরে ঢুকে তাঁর উচ্চতর পর্বের ছাত্রদের মনে করিয়ে দিতেন যে একটা ভালো রোগ নির্ণয়ের চাইতে উত্তম কোন ওষুধ নাই। তাই সেদিন অনির্ধারিত ওই বর্ণ-সঙ্কর রমণীর পরীক্ষাকার্য চলার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন। তার ছাত্ররা যেন তাঁর কোন ভঙ্গি দ্বারা বুঝতে না পারে যে তিনি এক্ষেত্রে একটা বিশেষ উৎসাহ নিচ্ছেন সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকলেন, রোগিনীর দিকে তিনি প্রায় তাকালেনই না, কিন্তু তার নাম ও ঠিকানা তিনি তাঁর স্মৃতিতে গেঁথে নিলেন। সেদিন বিকালে, নির্ধারিত শেষ রোগীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি তাঁর গাড়িকে ওই রমণীর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। ক্লিনিকে তাঁর অফিস ঘরে মেয়েটি তাঁকে তার ঠিকানা দিয়েছিল। আর সত্যিই তার বাড়ির সামনের চত্বরে তাকে দেখা গেল, ঠাণ্ডার মধ্যে বসে সে আরাম করছে।

    ওটা ছিল একটি আদর্শ অ্যান্টিলীয় বসতবাড়ি। আগাগোড়া হলুদ রঙ করা, টিনের ছাদ পর্যন্ত, জানালায় ক্যানভাসের পর্দা, দোরগোড়ায় কার্নেশন ফুলের কয়েকটা টব, দরজার দু’পাশে ফার্নগাছ ঝুলছে। বাড়িটাকে মালা ক্রিয়াঞ্জার লবণাক্ত জলাভূমির উপর কাঠের পাইলিং দিয়ে বসানো হয়েছে। ঘরের চাল থেকে ঝুলিয়ে দেয়া খাঁচায় বসে একটা ট্রুপিয়াল গান গাইছে। রাস্তার ওপাশে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেখান থেকে ছেলেমেয়েরা হৈ হুল্লা করতে করতে রাস্তায় ছুটে আসছে, তাই গাড়োয়ানকে তার লাগামের ওপর শক্ত হাত রেখে ঘোড়ার গতিকে আস্তে করতে হল, যেন সেটা চমকে না যায়। এটা ছিল সৌভাগ্যজনক, কারণ মিস বারবারা লিঞ্চ ডাক্তারকে চিনবার সময় পায়। সে হাত নেড়ে তাঁকে সম্ভাষণ করলো, যেন তারা অনেক দিনের পুরনো বন্ধু, তারপর হৈহল্লা একটু থিতিয়ে এলে তাঁকে এক পেয়ালা কফি পানের আমন্ত্রণ জানালো। ডাক্তার সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, যদিও তিনি সাধারণত কফি পান করতেন না। মেয়েটি তার কথা বলতে থাকলো আর ডাক্তার সানন্দে তার কথা শুনে গেলেন। সেদিন সকাল থেকে এই রমণীই তার সারা মন জুড়ে ছিল; বিরতিহীন ভাবে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে তাই থাকে। তাঁর বিয়ের অল্প কয়েকদিন পর তাঁর এক বন্ধু ফারমিনার উপস্থিতিতে একটা কথা বলেছিল। আগে হোক কিংবা পরে হোক ডাক্তার একটা তীব্র প্রবল প্রেমের মুখোমুখি হবেন যা তাঁর বিবাহের স্থিতিশীলতা পর্যন্ত বিপন্ন করে ফেলতে পারে। ডাক্তার ভেবেছিলেন যে তিনি নিজেকে ভালো করে চেনেন, তাঁর নৈতিক শিকড়ের শক্তি তাঁর জানা আছে, বন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ওই কথাই সত্য হয়ে দেখা দিল

    ধর্মতত্ত্বে পি.এইচডি. পাওয়া মিস বারবারা লিঞ্চ ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ শীর্ণকায় প্রোটেস্ট্যান্ট যাজক রেভারেন্ড জোনাথান বি. লিঞ্চের একমাত্র সন্তান। রেভারেন্ড লিঞ্চ লবণাক্ত জলাভূমিগুলির দারিদ্র্যপীড়িত বসতিসমূহে একটা খচ্চরের পিঠে চড়ে ধর্মের বাণী প্রচার করে বেড়াতেন। বারবারা ভালো স্প্যানিশ বলতো, বাক্য গঠনে একটু কর্কশতা ছিল, যে সামান্য ভুলচুক হত তা তার আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে দিতো। সামনের ডিসেম্বরে তার বয়স হবে আঠাশ বছর, একজন যাজককে বিয়ে করেছিল সে, ভদ্রলোক তার বাবার ছাত্র ছিল, দু’বছর অসুখী দাম্পত্য জীবন যাপনের পর সে তাকে তালাক দেয় এবং ওই অপরাধ দ্বিতীয় বার করার তার কোন ইচ্ছা নাই। সে বলল, ‘আমার ট্রপিয়াল ছাড়া আমার আর ভালোবাসার কিছু নাই।’ তার ওই উক্তির পেছনে যে কোন গোপন অভিসন্ধি থাকতে পারে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তেমন ভাবেন নি। পক্ষান্তরে, তিনি নিজে বিভ্রান্ত বোধ করলেন, তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, এই ব ঈশ্বর এতোগুলি সুযোগ একত্রিত করে দিচ্ছেন এর মধ্যে কি তাঁর কোন বিভ্রান্তি নেই, এর জন্য নিশ্চয়ই তাঁকে একটা বড়ো মূল্য দিতে হবে, কিন্তু তিনি অবিলম্বে ওই চিন্তাকে তাঁর মনের বিভ্রান্ত অবস্থাপ্রসূত একটা ধর্মতাত্ত্বিক আগড়ম বাগড়ম বলে বাতিল করে দিলেন।

    বিদায় নেবার আগের মুহূর্তে ডাক্তার উরবিনো সেদিন সকালের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পর্কে একটা আকস্মিক মন্তব্য করেন। তিনি জানতেন যে রোগীরা তাদের অসুখ সম্পর্কে আলাপ করার চাইতে আর কোন কিছুতে এতো আনন্দ পায় না। আর সে এতো চমৎকার ভাবে তার অসুখের কথা বলেছিল যে ডাক্তার কথা দিলেন, তাকে আরো ভালো ভাবে পরীক্ষা করার জন্য তিনি আগামীকাল ঠিক চারটার সময় আবার এখানে আসবেন। ওঁর মুখ শুকিয়ে গেল, সে জানতো যে তাঁর মতো নামিদামি ডাক্তারের ফী দেয়ার ক্ষমতা তার নাই, কিন্তু ডাক্তার ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমাদের এই পেশায় আমরা ধনীদের কাছ থেকে গরিবদের খরচটা আদায় করে নেবার চেষ্টা করি।’ তারপর তিনি তাঁর নোট বই-এ টুকে নিলেন, ‘মিস বারবারা লিঞ্চ, মালা ক্রিয়াঞ্জা লবণাক্ত জলাভূমি, শনিবার বিকাল চারটা।’ বেশ কয়েক মাস পরে ফারমিনা ডাজা ওই লেখাটা পড়ে, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার বিশদ তথ্য, রোগের ক্রমবিবর্তন ইত্যাদি। নামটা তার মনোযোগ আকর্ষণ করে, অকস্মাৎ তার মনে হয় ও বোধ নিউ অর্লিয়ান্সের ফলের জাহাজে করে আসা অসচ্চরিত্র শিল্পীদের একজন, কিন্তু ঠিকানাটা দেখে তার ধারণা হল ও নিশ্চয়ই জ্যামেইকা থেকে এসেছে, একটা কালো মেয়ে এবং সে দ্বিতীয় চিন্তা ছাড়াই তার নাম খারিজ করে দিল, কারণ ওই রকম মেয়ে তার স্বামীর পছন্দের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।

    শনিবার দিন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সাক্ষাতের নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে এসে উপস্থিত হল, মিস লিঞ্চ তখনো তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য কাপড়জামা পরে তৈরি হয় নি। ডাক্তার উরবিনো প্রচণ্ড স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিলেন, পারীতে মৌখিক পরীক্ষার জন্য হাজিরা দেবার পর তাঁর আর কখনো এরকম অবস্থা হয় নি। বারবারা তার ক্যানভাস খাটে শুয়ে পড়লো, তার পরনে সিল্কের পাতলা একটা অন্তর্বাস জাতীয় পোশাক, তার সৌন্দর্যের যেন কোন সীমা পরিসীমা নাই। তার সব কিছুই ছিল বড়োসড়ো, তীব্র, তার মোহিনী নারীর ঊরু, তার ধীরে ধীরে আগুন ধরানো ত্বক, তার বিস্ময়কর স্তনযুগল, তার নিখুঁত দন্তপার্টি ও স্বচ্ছ মাড়ি, তার সমগ্র দেহ থেকে যেন সুস্বাস্থ্যের একটা ভাপ বিকীর্ণ হচ্ছিল, আর ফারমিনা ডাজা তার স্বামীর কাপড়ে এই মানুষী গন্ধই আবিষ্কার করেছিল। বারবারা জানালো যে সে ক্লিনিকে গিয়েছিল কারণ তার একটা শারীরিক কষ্ট হচ্ছিল, মধুর ভঙ্গিতে সে তাকে অভিহিত করলো প্যাঁচানো মলাশয়’ বলে। ডাক্তার উরবিনো বললেন যে এ জাতীয় উপসর্গ উপেক্ষা করা অনুচিত। তাই তিনি তাঁর হাত দিয়ে ওর দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গাদি পরীক্ষা করলেন, যতখানি মনোযোগের সঙ্গে তার চাইতে বেশি ইচ্ছার সঙ্গে এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন যে এই প্রাণীটি বাইরে যেমন সুন্দর ভেতরেও তেমনি, তারপর তিনি সোল্লাসে স্পর্শের আনন্দের মধ্যে নিজেকে মুক্ত করে দিলেন, তখন তিনি আর বিস্তীর্ণ ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চলের সব চাইতে যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক নন, তিনি শুধু তাঁর প্রচণ্ড বিশৃঙ্খল স্বজ্ঞাতাড়িত যন্ত্রণাকাতর এক বেচারা পুরুষ মানুষ। তাঁর কঠোর পেশা-জীবনে এর আগে মাত্র একবার এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল এবং সেটা ছিল তাঁর জীবনের একটা চরম লজ্জা, কারণ তাঁর ক্রুদ্ধ রোগী একঝটকায় তাঁর হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানায় উঠে বসে বলেছিল, ‘আপনি যা চাইছেন সেটা হয়তো হতে পারে, কিন্তু এভাবে নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে মিস লিঞ্চ নিজেকে তাঁর হাতে পুরোপুরি সমর্পণ করল এবং যখন সে সুনিশ্চিত হল যে ডাক্তার আর তাঁর বিজ্ঞানের কথা ভাবছেন না তখন সে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল আপনাদের নীতিমালা এসব অনুমোদন করে না।’

    ডাক্তারের সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল তিনি যেন পুরো জামা- কাপড় পরা অবস্থায় কোনো জলাশয় থেকে উঠে এসেছেন। একটা তোয়ালে দিয়ে মুখ-হাত মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘আমাদের নীতিমালা মনে করে যে আমরা কাঠের তৈরি।’ বারবারা বললো, ‘আমার ধারণার অর্থ এই নয় যে আপনি ওটা করতে পারবেন না। আমার মতো এক গরিব কালো মেয়েকে এতো বিখ্যাত একজন লোক লক্ষ করেছেন এ কী ভাবা যায়। ডাক্তার বললেন, ‘তোমার কথা না ভেবে আমার একটি মুহূর্তও কাটে নি।’ এই স্বীকারোক্তি ছিল এতোই কাতর ও কম্পমান যে এটা হয়তো অনুকম্পার উদ্রেক করতে পারতো কিন্তু বারবারা হেসে উঠে সে আঘাতটা কাটিয়ে দিল। তার হাসিতে শোবার ঘরটি আলোকিত হয়ে ওঠে। হাসতে হাসতে সে বললো, ‘আপনাকে হাসপাতালে দেখার পর থেকেই আমি তা জানি, ডাক্তার। আমি কালো হতে পারি কিন্তু বোকা নই।’

    কাজটা সহজ হয় নি। মিস লিঞ্চ চাইলো তার সম্ভ্রম যেন রক্ষিত হয়, সে চাইলো নিরাপত্তা এবং ভালোবাসা, ওই ক্রম অনুসারে, আর তার বিশ্বাস এসব তার প্রাপ্য। সে তাকে প্রলুব্ধ করার সুযোগ দিল ডাক্তার উরবিনোকে, কিন্তু তাকে তার ভেতরের খাস কামরায় ঢুকতে দিল না, এমনকি সে যখন বাড়িতে একা তখনও না। ডাক্তারকে তাঁর নীতিমালা ইচ্ছা মতো লঙ্ঘন করার সুযোগ দিয়ে সে তাঁকে হাতের স্পর্শ দ্বারা ও বুকে কান লাগিয়ে পরীক্ষা কাজ চালাতে দিল, কিন্তু তার কাপড়-জামা না খুলে। ডাক্তারের দিক থেকে, একবার টোপ গেলার পর তিনি আর ছাড়তে পারলেন না, ব্যাপারটা একটা দৈনন্দিন অভিযান হয়ে দাঁড়ালো। বাস্তব কারণেই মিস লিঞ্চের সঙ্গে এই সম্পর্ক অব্যাহত রাখা ডাক্তারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে কিন্তু এটা বন্ধ করার মতো যথেষ্ট শক্তি তিনি পেলেন না, পরবর্তী সময়ে যেমন আরো অগ্রসর হবার মতো শক্তিও তিনি পান নি। এই পর্যন্তই ছিল শেষ সীমারেখা।

    রেভারেন্ড লিঞ্চ অনিয়মিত জীবনযাপন করতেন। তিনি মুহূর্তের তাড়নায় তাঁর খচ্চরে চেপে বেরিয়ে পড়তেন, একদিকে ঝুলিয়ে নিতেন তাঁর বাইবেলগুলি আর ধর্মীয় পুস্তিকাবলী এবং অন্য দিকে কিছু খাদ্যবস্তু, তারপর যখন কেউ তাঁকে প্রত্যাশা করছে না তখন হঠাৎ করে ফিরে আসতেন। আরেকটা অসুবিধা ছিল রাস্তার ওপাশের বিদ্যালয়টি। ছেলেমেয়েরা তাদের পড়া উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করতে করতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতো এবং সব চাইতে পরিষ্কার ভাবে তারা দেখতে পেতো রাস্তার ওপাশের এই বাড়িটি, সকাল ছ’টা থেকে তার দরজা-জানালা হাট করে খোলা; তারা মিস লিঞ্চকে তাঁর পাখির খাঁচাটা ঘরের চালের প্রান্ত থেকে ঝুলিয়ে দিতে দেখতো, পাখিটা যেন ছেলেমেয়েদের ওই আবৃত্তি করা পড়া গলায় তুলে নিতে পারে; তারা দেখতো উজ্জ্বল রঙের একটা পাগড়ি মাথায় জড়িয়ে তিনি তাঁর ঘর-সংসারের কাজ করছেন, তাঁর অসম্ভব সুন্দর ক্যারিবীয় কণ্ঠে তিনিও তাদের পাঠ আবৃত্তি করে চলেছেন; পরে বিকাল বেলায় তারা তাঁকে দেখতো তিনি বারান্দায় বসে গুনগুন করে বাইবেলের স্তুতিগান আবৃত্তি করছেন।

    অতএব তাঁদের এমন একটা সময় বেছে নিতে হত যখন স্কুলের ছেলেমেয়েরা ওখানে থাকবে না। এর জন্য মাত্র দুটো সম্ভাবনা খোলা ছিল : দুপুরের খাবার জন্য বিরতির সময়, বারোটা থেকে দুটার মধ্যে, যেটা ছিল আবার ডাক্তারেরও দ্বিপ্রাহরিক খাওয়ার সময়, আরেকটা ছিল সন্ধ্যার দিকে, ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি চলে যাবার পরে। এই শেষেরটিই ছিল সব চাইতে ভালো সময়, যদিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী দেখা শেষ করে ডাক্তারের হাতে তখন মাত্র অল্প কয়েক মিনিট সময় থাকতো, কারণ ঘরে ফিরে তাঁকে পরিবারের সঙ্গে নৈশাহারে যোগ দিতে হতো। তৃতীয় আরো একটা সমস্যা ছিল, সেটা ছিল তাঁর নিজের পরিস্থিতি নিয়ে। নিজের গাড়ি ছাড়া ওখানে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, আর তাঁর গাড়িটি ছিল অত্যন্ত সুপরিচিত, আর গাড়িটিকে ওর দোরগোড়ায় অপেক্ষা করে থাকতে হত। তিনি কোচোয়ানকে তাঁর সহায়তাকারী করে নিতে পারতেন, তাঁর সোশ্যাল ক্লাবের অনেক বন্ধু তাই করতো, কিন্তু ওরকম করা ছিল তাঁর প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। বস্তুতপক্ষে, মিস লিঞ্চের ওখানে তাঁর যাওয়াটা খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠলে তাঁদের উর্দিপরা পারিবারিক কোচোয়ান একদিন সাহস করে বলেই ফেলে, সে যদি তাঁকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় এবং পরে আবার এখানে এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় তাহলে কি ভালো হয় না, সে ক্ষেত্রে মিস লিঞ্চের বাড়ির সামনে তাঁর গাড়ি এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। ডাক্তার উরবিনো তখন তাঁর স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন কর্কশ ভাষায় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই প্রথম আমি তোমাকে একটা অনুচিত কথা বলতে শুনলাম, ঠিক আছে, আমি ধরে নেবো যে তুমি কিছু বলো নি।’

    তাঁর সমস্যার কোন সমাধান ছিল না। এই শহরের মতো একটা শহরে ডাক্তারের গাড়ি কোন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে অসুখের খবর লুকিয়ে রাখা ছিল অসম্ভব। মাঝে মাঝে, দূরত্ব বেশি না হলে, ডাক্তার নিজেই উদ্যোগী হয়ে পায়ে হেঁটে কিংবা ভাড়াটে গাড়ি করে রোগীর বাড়ি যেতেন যেন রোগটা সম্পর্কে কেউ অকালে কিংবা বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে কোন ধারণা পোষণ না করে। এসব ছলনায় অবশ্য কোন কাজ হত না। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতে ওষুধের দোকান থেকে সত্যটা প্রকাশিত হয়ে পড়তো। রোগীর শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার পবিত্র অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ডাক্তার উরবিনো, তাই, সঠিক ওষুধের পাশাপাশি বেশ কিছু নকল ওষুধের ব্যবস্থাপত্রও দিতেন। একই ভাবে মিস লিঞ্চের বাড়ির সামনে তাঁর গাড়ির অবস্থান তিনি নানা রকম সত্য উক্তি দ্বারাই ব্যাখ্যা করতে পারতেন, কিন্তু অত দীর্ঘ সময়ের জন্য ওটার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটার কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না।

    জগতটা তাঁর জন্য নরক হয়ে উঠলো। তবে এখন প্রাথমিক উন্মত্ততাটা প্রশমিত হয়েছে, ঝুঁকির মাত্রা উভয়েই উপলব্ধি করেছে এবং একটা কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হবার মতো সাহস বা সঙ্কল্প ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর কখনোই ছিল না। কামনার উন্মত্ত মুহূর্তে তিনি সব রকম প্রতিশ্রুতিই দিতেন, কিন্তু সেটা পার হয়ে গেলে তিনি সব কিছুই পেছনে ঠেলে দিতেন পরবর্তী কোন সময়ের জন্য। অন্য দিকে, ওর জন্য তাঁর কামনা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ওকে হারাবার ভয়ও তাঁর বৃদ্ধি পেলো, ফলে তাঁদের মিলন পর্ব হল আরো দ্রুত এবং আরো সমস্যাসঙ্কুল। ডাক্তারের মাথা থেকে আর সব ভাবনা উবে গেল। অসহনীয় আকুলতা নিয়ে তিনি বিকাল হবার জন্য অপেক্ষা করতেন, প্রতিশ্রুতি দেয়া তাঁর অন্যান্য কাজের কথা তিনি ভুলে যেতেন, ওর কথা ছাড়া আর সবই তিনি ভুলে যেতে লাগলেন, কিন্তু মালা ক্রিয়াঞ্জার লবণাক্ত জলাভূমি অঞ্চলে তাঁর গাড়ি যতোই মিস লিঞ্চের বাড়ির নিকটবর্তী হত ততই তিনি ঈশ্বরের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতেন, একটা অপ্রত্যাশিত কোনো বাধা যেন দেখা দেয়, যার ফলে তাঁর গাড়ি ওইখানে না থেমে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মাঝে মাঝে তিনি এতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ওর ওখানে যেতেন যে মোড় ঘুরে বারান্দায় বসা রেভারেন্ড লিঞ্চকে বই পড়তে দেখলে তিনি রীতিমত খুশি হতেন, ওই যে তাঁর মেয়ে বসবার ঘরে পাড়ার ছেলেমেয়েদের বাইবেলের নির্বাচিত অংশ আবৃত্তি করে মুখস্থ করাচ্ছেন, তখন তিনি স্বস্তি ভরে বাড়ি ফিরে যেতেন, ভাগ্যের উদ্দেশ্যে তিনি আরেকবার স্পর্ধা প্রদর্শন করলেন না, কিন্তু তারপর আবার তার মনে হত তিনি যেন কামনার জ্বালায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন, আবার বিকাল পাঁচটা বাজার জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠতেন, আর এমনি চলতো দিনের পর দিন, প্রতিদিন।

    তাই, যখন ডাক্তারের গাড়ি ওর বাড়ির সামনে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষক হয়ে উঠলো তখন তাদের প্রেমলীলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো, আর তিন মাস পর ব্যাপারটা রীতিমত হাস্যকর রূপ নিল। তার উত্তেজিত প্রেমিককে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখা মাত্র মিস লিঞ্চ নিজের শোবার ঘরে চলে যেতো। ডাক্তারকে যেসব দিনে ও প্রত্যাশা করতো সেসব দিনে ও জ্যামেইকা থেকে আনা লাল ফুলের নকশা আঁকা কুঁচি দেয়া একটা চমৎকার লম্বা স্কার্ট পরে থাকতো, কিন্তু নিচে কোনো অন্তর্বাস পরতো না, একেবারে কিচ্ছু না, ভাবতো, এই সুবিধাটুকুর ফলে ডাক্তারের ভয়-ভীতি দূর হবে। কিন্তু তাঁকে খুশি করার জন্য ওর সব উদ্যোগ ডাক্তার নষ্ট করে ফেলতেন। ঘর্মাক্ত কলেবর, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তিনি ওর পেছন পেছন শোবার ঘরে এসে প্রবেশ করতেন, তারপর সব কিছু ছুড়ে ফেলতেন মেঝের উপর, তাঁর হাতের লাঠি, তাঁর ডাক্তারি ব্যাগ, তাঁর পানামা হ্যাট, তারপর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত প্যান্ট নামিয়ে তিনি ভয়-তাড়িত সঙ্গম ক্রিয়াটুকু সমাধা করতেন, তখনো ঊর্ধ্বাঙ্গে কোট চাপানো, তার বোতাম আটকানো যেন কোন বাধার সৃষ্টি না করতে পারে, ওয়েস্টকোটে ঘড়ির সোনার চেইনটাও লাগানো, পায়ে জুতো পরা, সব ধরা-চূড়া ঠিক আছে, আনন্দ লাভের চাইতে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাবার জন্যই যেন তিনি বেশি উদগ্রীব। আর বারবারা লিঞ্চ নিজেকে আবিষ্কার করতো ঝোলানো অবস্থায়, সে তার নিঃসঙ্গতার সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথেও ঠিক মত পৌঁছায় নি, আর ডাক্তার এরই মধ্যে তাঁর প্যান্টের বোতাম লাগিয়ে ফেলেছেন, তাঁকে দেখাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত, যেন জীবন মরণের মধ্যবর্তী রেখায় দাঁড়িয়ে তিনি পরিপূর্ণ ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করেছেন, যদিও আসলে তিনি একটা দৈহিক ক্রিয়ার বেশি কিছুই সম্পন্ন করেন নি, যা প্রেমের কৃতিত্বের একটা অংশ মাত্র। কিন্তু তিনি ঠিক সময়ে শেষ করেছেন, একটা রুটিন ভিজেটে গিয়ে রোগীকে সময় মতো ইঞ্জেকশন দিতে পারবেন। তারপর তিনি বাড়ি ফিরতেন, তাঁর দুর্বলতার জন্য চরম লজ্জিত, মৃত্যুর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতেন, নিজেকে অভিশাপ দিতেন কেন তাঁর এই সাহসটুকু হচ্ছে না, কেন তিনি ফারমিনা ডাজাকে ডেকে বলতে পারছেন না, এসো, আমার প্যান্ট খুলে নিয়ে আমার পাছায় আগুনের ছ্যাঁকা দাও!

    তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলেন, প্রার্থনা করতে লাগলেন বিশ্বাস ছাড়া, শয্যায় শুয়ে থেকে দিবানিদ্রার ভান করলেন, বই পড়লেন, আর তাঁর স্ত্রী শুতে আসার আগে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে সংসারের কাজ শেষ করতে থাকলো। বইয়ের উপর ঢুলতে ঢুলতে তিনি ডুবে যেতে শুরু করতেন মিস লিঞ্চের অবধারিত বনাঞ্চলের জলাভূমিতে, অরণ্যের একটা ফাঁকা জায়গার মতো তার শায়িত পরিমণ্ডলে, তাঁর নিজের মরণ-শয্যায়, আর এর পর তিনি আগামীকাল পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগের অপরাহ্নের কথা ছাড়া আর কোন কিছুর কথাই ভাবতে পারলেন না, ও তাঁর জন্য তার বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছে, ওর পরনে জ্যামাইকা থেকে আনা ওই পাগলী-স্কার্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই, আর ওই স্কার্টের নিচে ওর কালো গুল্মের ক্ষুদ্র স্তূপটি ছাড়া আর কিছুই নেই, শুধু একটা নারকীয় বৃত্ত।

    গত কয়েক বছরে তিনি তাঁর নিজের শরীরের বোঝা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। উপসর্গগুলি তিনি চিনতে পারলেন। পাঠ্যপুস্তকে তিনি এসব সম্পর্কে পড়েছেন, বাস্তব জীবনে তিনি এগুলির প্রমাণ পেয়েছেন। যে বয়স্ক রোগীদের কোনো গুরুতর অসুখের পূর্ব-ইতিহাস নাই তারা হঠাৎ এমন সব নিখুঁত লক্ষণের কথা বলতো, যা মনে হত একবারে সরাসরি চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে আনা, অথচ পরে দেখা যেতো যে সবটাই কাল্পনিক। লা সলপেট্রিয়ারে পড়াশুনা করার সময় তাঁর শিশুরোগের প্রফেসর বিশেষ জ্ঞানার্জনের সব চাইতে সৎ ক্ষেত্র হিসাবে শিশুচিকিৎসার কথা বলেছিলেন, কারণ শিশুরা সত্যিকার অসুস্থ হলেই শুধু অসুস্থ হয়, গতানুগতিক বর্ণনা দিয়ে তারা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, প্রকৃত অসুখের প্রত্যক্ষ উপসর্গের কথাই তারা বলে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, একটা বয়সের পর, রোগ না থাকলেও রোগের উপসর্গের কথা বলে, তার চাইতেও খারাপ, যৌন রোগের উপসর্গের কথা বলে যখন প্রকৃতপক্ষে তারা বেশ গুরুতর রোগে আক্রান্ত। তিনি তাদের রোগ প্রশমনের ওষুধ দিয়ে আশ্বস্ত করতেন, সময় নিয়ে তাদের শেখাতেন তারা যেন রোগযন্ত্রণা অনুভব না করে, যেন বার্ধক্যের জঞ্জাল স্তূপে নিক্ষিপ্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত তাদের রোগ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো কখনো ভাবেন নি যে তাঁর বয়সের একজন চিকিৎসক সত্যিকার অসুস্থ না হয়েও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ওই রকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জয় করতে পারবেন না। তার চাইতেও যা খারাপ, সত্যিকার অসুস্থ হবার পরও, শুধুমাত্র কিছু বৈজ্ঞানিক সংস্কারে বাঁধা পড়ে, ওই অসুস্থতার কথা বিশ্বাস করবেন না। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ তখন তিনি একদিন ক্লাসে কিছুটা কৌতুক করে কিছুটা আন্তরিক ভাবে বলেছিলেন যে, ‘জীবনে তাঁর একটা জিনিসই দরকার, একজন মানুষ যে তাঁকে বুঝবে।’ কিন্তু এখন, নিজেকে মিস লিঞ্চের গোলকধাঁধায় বন্দি দেখার পর, তিনি আর কৌতুক করছিলেন না।

    তাঁর বয়োবৃদ্ধ রোগীদের সকল প্রকৃত অথবা কাল্পনিক উপসর্গ তাঁর নিজের শরীরে দেখা দিল। তিনি তাঁর যকৃতকে এত স্পষ্ট ভাবে অনুভব করলেন যে স্পর্শ না করেই তিনি তার আকার বলে দিতে পারলেন। তিনি তাঁর মূত্রগ্রন্থীর মধ্যে তন্দ্রামগ্ন মার্জারের ঘড়ঘড় শব্দ অনুভব করলেন। তিনি তাঁর ক্ষুদ্র কোষগুলির মধ্যে নানা বর্ণের ঔজ্জ্বল্য অনুভব করলেন। তিনি তাঁর ধমনীর মধ্যে অনুভব করলেন রক্তের গুঞ্জন। মাঝে মাঝে খুব ভোরে তাঁর ঘুম ভেঙে যেতো, তখন তিনি জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতেন। তাঁর হৃৎপিণ্ডে জল জমে গিয়েছিল বলে মনে হল। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার স্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর মনে হল বাচ্চাদের ব্যান্ডের মতো তার লয়-তাল বদলে গেছে, একবার, দ্বিতীয় বার, তারপর ঈশ্বরের অপার কৃপায়, তিনি অনুভব করলেন যে সেটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তিনি তাঁর রোগীদের যেসব রোগ প্রশমনকারী ওষুধ দিতেন নিজের ক্ষেত্রে তা না করে ভয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। তিনি সত্য কথাটিই বলেছিলেন, তাঁর এই আটান্ন বছরেও, জীবনে তাঁর যা দরকার তা হল একজন মানুষ যে তাঁকে বুঝবে। তাই তিনি ফারমিনা ডাজার দিকে মুখ ফেরালেন, যে মানুষটি তাঁকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে, যাকে তিনি এ জগতে সবার চাইতে বেশি ভালোবাসেন এবং যার সঙ্গে তিনি এই মাত্র তাঁর বিবেককে অস্বস্তিমুক্ত করেছেন।

    সেদিন বিকালে ফারমিনা ডাজা যখন তাঁকে তাঁর বই পড়া বন্ধ করে তার দিকে তাকাতে বলে তখনই ব্যাপারটা ঘটে। এই প্রথম বারের মতো তাঁর মনে হল তাঁর নারকীয় বৃত্তটা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু কেমন করে হল তা তিনি বুঝতে পারলেন না। ফারমিনা ডাজা যে শুধু গন্ধ শুঁকে এটা জানতে পেরেছেন তা তাঁর কাছে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। তবে বহুদিন ধরেই গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এই শহরের অবস্থান খুব ভালো জায়গায় ছিল না। বাড়িতে টেলিফোন স্থাপনের অল্প দিনের মধ্যেই গুজব ছড়ানো বেনামি বার্তার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বিয়ে, যা মজবুত ও স্থিতিশীল বলে মনে করা গিয়েছিল, ধ্বংস হয়ে যায়। অনেককটি আতঙ্কিত পরিবার হয় তাদের সংযোগ কেটে দেন কিংবা বহু বছর যাবৎ বাড়িতে টেলিফোন আনলেন না। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তাঁর স্ত্রীকে ভালো করে জানতেন, তার আত্মমর্যাদা বোধ তাকে এই ধরনের টেলিফোন বার্তাকে কোন পাত্তাই দিতে দেবে না। আর কেউ যে স্বনামে এই খবর দিতে সাহস করবে তা তিনি কল্পনা করতে পারলেন না। কিন্তু পুরনো দিনের একটা পন্থা সম্পর্কে তাঁর ভয় হল। অজ্ঞাত কেউ দরজার নিচ দিয়ে একটা চিঠি ঢুকিয়ে দিতে পারে, এই পদ্ধতিতে পত্রদাতা ও পত্রগ্রহণকারী উভয়ের, নামহীনতাই সুরক্ষিত হয়, তাছাড়া এর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে একজন মনে করতে পারে যে এর মধ্যে হয়তো বিধিলিপির রূপরেখার একটা অধিবিদ্যামূলক যোগসূত্র আছে।

    তাঁর সংসারে ঈর্ষার কোন জায়গা ছিল না। ত্রিশ বছরের শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনে তিনি প্রায়ই সকলের সামনে গর্ব করে বলতেন, তিনি হলেন ওই সুইডিশ দেশলাই কাঠির মতো, শুধু তার নিজের বাক্সে ঘষেই তাকে জ্বালানো যায়। আর একথা এই ঘটনার আগ পর্যন্ত সত্যই ছিল। এখন, তাঁর স্ত্রীর মতো অহঙ্কার, মর্যাদাবোধ এবং চারিত্রিক শক্তির অধিকারী এক রমণী বিশ্বাস ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ পাবার পর কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা তিনি জানতেন না। তাই ওর দিকে একবার তাকিয়েই তিনি তাঁর চোখ নামিয়ে নিলেন, নিজের বিব্রত ভাব গোপন করার প্রয়াস পেলেন, ভান করলেন যেন তিনি আল্কা দ্বীপের মধুর আঁকাবাঁকা নদীর মধ্যে হারিয়ে গেছেন। ফারমিনা ডাজা আর কোন কথা বললো না, মোজা রিফু করা শেষ করে সব কিছু, বিশেষ কোন শৃঙ্খলা না মেনে, তার সেলাইর ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, রাতের খাবারের নির্দেশ দেবার জন্য রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, তারপর শোবার ঘরে ঢুকলো।

    তখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো বিকাল পাঁচটায় মিস লিঞ্চের বাসায় না যাবার প্রশংসনীয় সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন। অনন্ত প্রেমের প্রতিশ্রুতি, শুধু তারই জন্য একটি বিচক্ষণ ভবন যেখানে কোন অপ্রত্যাশিত বাধা ছাড়াই তিনি তার সঙ্গে থাকতে পারবেন, যতদিন তাঁরা বাঁচবেন তাড়াহুড়াবর্জিত সুখ আস্বাদন করবেন ততদিন, প্রেমের অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে যা কিছুর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন সব চিরদিনের জন্য বাতিল হয়ে গেল। মিস লিঞ্চ তাঁর কাছ থেকে শেষ যে জিনিসটা পায় তা হল ওষুধের দোকানের কাগজে মোড়া ছোট একটা বাক্সের ভেতর একটা পান্নার টায়রা, কোন বার্তা, কোন মন্তব্য, লিখিত কোন কিছু ছাড়াই তাঁর কোচোয়ান মিস লিঞ্চের হাতে সেটা তুলে দেয়। ডাক্তার উরবিনোর সঙ্গে তার আর কোন দিন দেখা হয় নি, আকস্মিক ভাবেও নয়। এক ঈশ্বর জানেন এই বীরোচিত সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে কী মূল্য দিতে হয়, এই ব্যক্তিগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবার জন্য তালাবদ্ধ শৌচাগারে বসে তাঁকে কত তিক্ত অশ্রু বিসর্জন করতে হয়। সেদিন বিকাল পাঁচটায় ওর কাছে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি তাঁর যাজকের কাছে তাঁর পাপকর্মের জন্য গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করলেন এবং পরের রবিবার গির্জায় গিয়ে কমিনিউন নিলেন।

    ওই রাতে তাঁর দাবি-ত্যাগের পর শয্যাগ্রহণের পূর্বে কাপড়-জামা ছাড়ার সময় তিনি ফারমিনা ডাজার কাছে, প্রার্থনা সঙ্গীতের সুরে, তাঁর যাবতীয় কষ্টের কথা আউড়ে গেলেন, ভোরের দিকে তাঁর অনিদ্রা, ছুরির খোঁচার মত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আকস্মিক ব্যথা, বিকালে তাঁর কেঁদে ওঠার ইচ্ছা, গোপন প্রেমের নানা সাংকেতিক উপসর্গ, তিনি সব এমন ভাবে বলে গেলেন যেন এসব ছিল বার্ধক্যের দুঃখযন্ত্রণা। এসব কথা কাউকে না কাউকে তাঁর বলতেই হত, না হলে তিনি মরে যেতেন, নয়তো তাঁকে সত্য কথাটা বলে দিতে হত, আর তাই উপরের কথাগুলি বলার পর তিনি যে স্বস্তি পেলেন তা গার্হস্থ্য প্রেমের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে একটা পবিত্রতা অর্জন করল। ফারমিনা খুব মনোযোগের সঙ্গে তাঁর কথা শুনলো কিন্তু তাঁর দিকে তাকালো না, একটি কথাও বলল না, স্বামীর পরিত্যক্ত কাপড়-জামা একটা একটা করে তুলে নিল, তার গন্ধ শুঁকলো, কোন ভাবভঙ্গি দ্বারা তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিল না, তারপর কাপড়-জামাগুলি গোল্লা পাকিয়ে ময়লা কাপড়ের বেতের ঝুড়িটায় ছুড়ে ফেলে দিল। সে গন্ধটা পেল না, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, আজকের পরে আগামীকাল আছে। তাঁদের শোবার ঘরের বেদীর সামনে হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করার আগে, যেমন বেদনার্ত তেমনি আন্তরিক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তারপর তাঁর যন্ত্রণার তালিকা শেষ করলেন এই বলে, ‘আমার মনে হয় আমি মরতে চলেছি।’ ফারমিনা বলল, তার চোখের পাতা একটুও কাঁপলো না, ‘সেটাই সব চাইতে ভালো হবে, তাহলে আমরা উভয়েই কিছু শান্তি পাবো।

    কয়েক বছর আগে গুরুতর অসুখে আক্রান্ত হয়ে এক সঙ্কটজনক মুহূর্তে ডাক্তার তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা বললে ফারমিনা এই একই রকম নিষ্ঠুর উত্তর দিয়েছিল। ডাক্তার উরবিনো তখন ভেবেছিলেন যে এর মূলে রয়েছে মেয়েদের স্বাভাবিক কঠিন হৃদয়, যা পৃথিবীকে সূর্যের চারপাশে অব্যাহত ভাবে ঘুরতে দেয়, কারণ তখন তাঁর জানা ছিল না যে নিজের অন্তরের ভীতিকে প্রতিরোধ করার জন্য সে সর্বদা একটা ক্রোধের দেয়াল তৈরি করে রাখতো এবং এক্ষেত্রে এটা ছিল চূড়ান্ত ভীতি, তাঁকে হারাবার ভয়।

    কিন্তু আজ রাতে ফারমিনা ডাজা সর্বান্তঃকরণে তাঁর মৃত্যু কামনা করলো এবং এই নিশ্চিতি তাঁকে ভীতিবিহ্বল করে তুললো। একটু পরে অন্ধকারের মধ্যে তিনি তাঁর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলেন, ফারমিনা বালিশ কামড়ে ধরে কাঁদছে যেন শব্দটা তাঁর কানে না যায়। তিনি বিভ্রান্ত বোধ করলেন, কারণ তিনি জানতেন যে দেহ বা আত্মার কোন যন্ত্রণায় ফারমিনা কখনো কাঁদতো না। সে কাঁদতো শুধু রাগে, বিশেষ করে তার উৎস যদি হত কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধের ভীতি, আর তখন তার কান্না যত বাড়তো রাগও তত বাড়তো, কারণ কান্নার দুর্বলতাকে সে কখনো ক্ষমা করতে পারতো না। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিতে সাহস করলেন না। তিনি জানতেন যে তা হবে বর্শাবিদ্ধ বাঘকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো। তাকে এটা বলবার সাহসও তাঁর হল না যে সেদিন বিকালেই তার কান্নার কারণ অপসারিত হয়েছে, শেকড়শুদ্ধ চিরদিনের জন্য তা উপড়ে ফেলা হয়েছে, তাঁর স্মৃতি থেকে পর্যন্ত।

    কয়েক মিনিটের জন্য তিনি ক্লান্তির কাছে হার মানলেন। যখন জাগলেন তখন দেখলেন যে ফারমিনা খাটের পাশের আলোটা জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, তার দু’চোখ খোলা, কান্না বন্ধ। তাঁর ঘুমের মধ্যে চূড়ান্ত একটা কিছু তার ভেতরে ঘটে গেছে। এত বছর ধরে যে গাদ তার জীবনের তলদেশে জমা হচ্ছিল তা এখন ঈর্ষার দহনে নাড়া খেয়ে উপরে ভেসে উঠেছে। মুহূর্তের মধ্যে এটা তার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মুখের বলিরেখা, তার বিবর্ণ ওষ্ঠ, তার চুলের ধূসরতা দেখে তিনি একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন, তিনি ঝুঁকি নিয়ে তাকে ঘুমাতে চেষ্টা করতে বললেন, রাত দু’টা বেজে গেছে। এবার সে কথা বলল, এখনো তাঁর দিকে না তাকিয়ে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে এখন রাগের কোন চিহ্ন নেই, প্রায় কোমল কণ্ঠে সে বলল, ‘ও কে সেটা জানবার আমার একটা অধিকার আছে।’ তখন তিনি তাকে সব কিছু জানালেন। তাঁর মনে হল তাঁর কাঁধ থেকে যেন পৃথিবীর ভার নেমে যাচ্ছে, কারণ তাঁর স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে ফারমিনা সব কিছু জানে, এখন শুধু বিশদ খুঁটিনাটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে। কিন্তু আসলে ফারমিনা কিছুই জানতো না। ডাক্তারের কথা শুনতে শুনতে সে আবার কাঁদতে শুরু করল, আগের মতো মৃদু ফোঁপানি নয়, এখন তার গাল বেয়ে ঝরতে লাগলো প্রচুর লবনাক্ত চোখের জল, সেই জল যেন তার রাতকামিজ জ্বালিয়ে দিল, আগুন ধরিয়ে দিল তার জীবনে, কারণ সে ব্যাকুল হয়ে স্বামীর কাছ থেকে যা আশা করেছিল তিনি তা করলেন না। ফারমিনা ভেবেছিল তিনি সব কিছু অস্বীকার করবেন, নিজের প্রাণের নামে শপথ নিয়ে বলবেন যে এসব সর্বৈব মিথ্যা, এই মিথ্যা অভিযোগের জন্য ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবেন এবং এই সমাজ যা একটা মানুষের সম্মানকে ধুলায় লুটিয়ে দেয় তাকে চরম অভিশাপ দেবেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গের যাবতীয় জোরালো প্রমাণ উপস্থিত করা হলেও অচঞ্চল থাকবেন তিনি। কিন্তু ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যখন বললেন যে সেদিন বিকালে তিনি তাঁর যাজকের কাছে স্বীকারোক্তি করেছেন, তখন ফারমিনার মনে হল সে বোধ হয় রাগে পাগল হয়ে যাবে। ধর্মীয় বিদ্যালয়ে ছাত্রী থাকার সময় থেকেই তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে গির্জার নারী- পুরুষদের মধ্যে ঈশ্বর-অনুপ্রাণিত কোন পূণ্যবোধ নেই। এটা তাদের সংসারে একটা বেসুরো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তবে কোন রকম বিপর্যয় ছাড়াই তাঁরা এটা উপেক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু তার স্বামী যখন তাঁর ধর্মযাজকের কাছে এমন একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা স্বীকার করলেন যা শুধু তাঁর নিজের একার ব্যাপার নয়, ফারমিনারও, তখন সেটা তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। সে বলল, ‘তুমি এর চাইতে কথাটা বাজারের কোন সাপুড়েকে বলতে পারতে।

    তার মনে হল সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। তার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে তার স্বামী ধর্মযাজকের কাছে তাঁর অনুশোচনামূলক স্বীকারোক্তি শেষ করার আগেই তার সম্ভ্রমের বিষয়টি বাজারে গুজবের বিষয় হয়ে উঠেছিল। স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা তার মধ্যে যে লজ্জা, ক্রোধ এবং অবিচারের বোধের জন্ম দিয়েছিল তার চাইতেও বেশি দুঃসহ মনে হল তার চরম অপমানিত হবার অনুভূতি। আর কী জঘন্য, কী জঘন্য, একটা কালো মেয়ের সঙ্গে। স্বামী তাকে সংশোধন করে দিলেন, “বর্ণসঙ্কর মেয়ের সঙ্গে।’ কিন্তু ততক্ষণে নিখুঁত হবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। ফারমিনা বললো, ‘সমান খারাপ। এখন আমি বুঝতে পারছি, ওই গন্ধ ছিল কৃষ্ণাঙ্গ রমণীর গন্ধ।’

    এই ঘটনা ঘটে এক সোমবার। শুক্রবার দিন সকাল সাতটায় সান হুয়ান ডি লা সিনেগাগামী নিয়মিত জাহাজে ফারমিনা ডাজা একটা মাত্র ট্রাঙ্ক নিয়ে যাত্রা করে। সে তার মুখ ঢেকে রেখেছিল একটা চাদর দিয়ে, তার নিজের বা স্বামী সম্পর্কে প্রশ্ন এড়াতে। সঙ্গী হয় তার ধর্মকন্যা। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো জাহাজঘাটে আসেন নি। এই পদক্ষেপের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তিন দিন ধরে তাঁরা আলোচনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে ঠিক হয় যে ফারমিনা ডাজা ফ্লোর ডি মারিয়াতে তার কাজিন হিল্ডব্রান্ডা সাঞ্চেজের খামার বাড়িতে যাবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে যতদিন দরকার ততদিন ওখানে থাকে। ছেলেমেয়েরা তার এই সফরের আসল কারণ জানলো না, তারা মনে করলো মা অনেকবার যে পরিকল্পিত ভ্রমণ পিছিয়ে দিয়েছিলেন এবার তা বাস্তবায়িত করছেন। অনেক দিন ধরে তারাও চেয়েছে যে তিনি যেন এই সফরে যান। ডাক্তার উরবিনো এমন দক্ষতার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করলেন যে তাঁর দুরাচারী বন্ধুরাও এনিয়ে কোন বিদ্বেষপূর্ণ ধারণার কথা প্রচার করতে পারল না। ফ্লোরিন্টোনো আরিজা যে ফারমিনা ডাজার উধাও হয়ে যাওয়া সম্পর্কে কোন সূত্র খুঁজে পেল না তার কারণ এই নয় যে অনুসন্ধান করার উপায় বা সঙ্গতি তার ছিল না, বরং এই কারণে যে সত্যিই কোন সূত্র ছিল না। ডাক্তারের ধারণা ছিল রাগ পড়ে গেলেই তাঁর স্ত্রী ফিরে আসবে, কিন্তু ফারমিনা বিদায় নেয় এই নিশ্চিত ধারণা নিয়ে যে তার এই রাগ কখনো পড়বে না।

    তবে ফারমিনা ডাজা অল্পদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করল যে তার এই আকস্মিক ও কঠোর সিদ্ধান্তের পেছনে তার ক্ষোভের চাইতেও বেশি ক্রিয়াশীল ছিল তার স্মৃতিকাতরতা। তাদের মধুচন্দ্রিমার পর সে একাধিকবার ইউরোপে গেছে, আনন্দ উপভোগের পরও প্রতিবারই তার হাতে অঢেল সময় থেকেছে। পৃথিবীকে সে চিনেছে, নতুন ভাবে বাঁচতে ও ভাবতে সে শিখেছে, কিন্তু বেলুনে ওই অসম্পূর্ণ ভ্রমণের পর সে আর কখনো হুয়ান ডি লা সিনেগাতে ফিরে যায় নি। তার মনে হল, যত দেরিতেই হোক হিল্ডাব্রান্ডার প্রদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সে একটা মুক্তির স্বাদ পাবে। তার বৈবাহিক জীবনের বিপর্যয়ের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ছিল না, অনেক আগে থেকেই তার মনে এই ধারণা জন্মে। কৈশোরে সে যেসব জায়গায় হরহামেশা ঘুরে বেড়াতো আবার সে তা দেখতে পাবে এই চিন্তাই তার দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে সান্ত্বনার প্রলেপ বুলিয়ে দিল।

    সান হুয়ান ডি লা সিনেগাতে অবতরণের পর সে তার চরিত্রের বিশাল শক্তির সাহায্যে, আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও, শহরটাকে চিনতে পারলো। শহরের সামরিক ও বেসামরিক শাসনকর্তা পূর্বাহ্নেই তার আগমনের খবর পেয়েছিলেন। তিনি সরকারি ভিক্টোরিয়া গাড়িতে করে ফারমিনা ডাজাকে শহর ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। ইতিমধ্যে সান পেড্রো আলেজাড্রিনোগামী রেলগাড়িটি যাত্রার জন্য তৈরি হবে। ফারমিনা ওখানে যেতে চেয়েছে, সবাই যে বলে যে দি লিবারেটর একটা শিশুর মতো ছোট শয্যায় শুয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন সেটা সত্য কিনা সে তা দেখতে চায়। ফারমিনা ডাজা বেলা দু’টার নিদ্রাতুর অপরাহ্ণে তার নিজের শহরকে আবার দেখলো। রাস্তাগুলি দেখালো কাদাজলে পূর্ণ সমুদ্র সৈকতের মতো। সে দেখলো পর্তুগিজদের বিরাট বিরাট ভবনগুলি, প্রবেশপথে বংশমর্যাদাসূচক নকশা আঁকা, জানালায় জালের মতো ব্রোঞ্জের শার্সি, ভেতর থেকে ভেসে আসছে মৃদু কুণ্ঠিত পিয়ানো অনুশীলনের শব্দ, তার সদ্য বিবাহিত মা বিত্তশালী পরিবারের মেয়েদের যা শেখাতেন ঠিক সেই রকম, সালোঁর প্রায়ান্ধকার পরিবেশে তার হুবহু পুনারাবৃত্তি চলছিলো। ফারমিনা দেখলো শহরের নির্জন খোলা চত্বর, সোডিয়াম নাইট্রেট আকীর্ণ উত্তপ্ত এবড়ো-খেবড়ো ভূমিতে কোন গাছ-গাছালি বেড়ে উঠছে না, সারি বেঁধে ঘোড়ার গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে, মাথার ঢাকনি তোলা, শবযাত্রার মতো, ঘোড়াগুলি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তার চোখে পড়লো সান পেড্রো আলেজাড্রিনোগামী হলুদ ট্রেনটি। তারপর নগরীর বৃহত্তম গির্জার পার্শ্ববর্তী, রাস্তার মোড়ে, সবচাইতে সুন্দর ও সব চাইতে সুন্দর বাড়িটি সে দেখতে পেল। সে দেখল সবুজাভ পাথরের খিলানে ঢাকা বাড়ির প্রবেশ পথ, তার বিশাল মঠের দরজা, বাড়ির শোবার ঘরের জানালা, যে ঘরে বহু বছর পরে একদিন আলভেরো জন্মগ্রহণ করেছিল, তারপর সে দেখলো যে আর কিছু মনে করবার মতো স্মৃতিশক্তি তার নাই। তবে পিসী এস্কোলাস্টিকার কথা তার মনে পড়লো, তাঁর খোঁজে সে স্বর্গ-মর্ত্য তোলপাড় করে ফেলেছিল কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, আর তাঁর কথা মনে পড়ায় তার স্মৃতিতে জেগে উঠলো ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ছবি, কেতাবী পোশাক পরা, ছোট পার্কটিতে বাদাম গাছের নিচে কবিতার বই হাতে বসে আছে। ঠিক একই ভাবে তার নিজের একাডেমির নিরানন্দ দিনগুলির কথাও তার মনে পড়লো। সে এখন গাড়িতে করে অনেকক্ষণ ঘুরলো, নিজেদের পুরনো পারিবারিক বাসগৃহটি সে চিনতে পারলো না, ওটা যেখানে ছিল বলে তার মনে হল সেখানে সে দেখলো একটা শুয়োরের খোঁয়াড় আর মোড় ঘুরতেই সে যে রাস্তায় এসে পড়লো সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারবনিতাদের ঘর। দুনিয়ার তাবৎ জায়গা থেকে বেশ্যার দল এখানে এসে জড়ো হয়েছে, দোরগোড়ায় তারা এখন দিবানিদ্রারত, ডাকে তাদের জন্য কোন চিঠি আসে কিনা তার প্রতীক্ষায় তারা বসে আছে। এটা এখন আর তার সেই শহর নাই।

    গাড়িতে ঘুরতে বেরুবার পর ফারমিনা ডাজা তার মুখের নিম্নাংশ চাদরে ঢেকে রেখেছিল, এই অচেনা শহরে কেউ তাকে চিনে ফেলে সে-ভয়ে নয়, এই জন্য যে রেল স্টেশন থেকে শুরু করে সমাধিক্ষেত্র পর্যন্ত সর্বত্র সে দেখতে পেল গরমে ফুলে ওঠা মৃতদেহের পর মৃতদেহ। সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা তাকে জানাল, ‘কলেরা।’ ফারমিনা ডাজা বুঝতে পেরেছিল, মৃতদেহগুলির মুখের কাছে সে সাদা ফেনার গোল্লা দেখতে পায়, কিন্তু বেলুন ভ্রমণের সময় সে তাদের ঘাড়ে যে সদয় আঘাতের চিহ্ন দেখেছিল এক্ষেত্রে তা দেখলো না। সঙ্গের অফিসার বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্য। ঈশ্বরও তাঁর পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেন।’

    সান হুয়ান ডি লা সিনেগা থেকে সান পেড্রো আলেজানড্রিনোর কলা বাগানের দূরত্ব ছিল সাতাশ মাইল মাত্র, কিন্তু হলুদ ট্রেনটি এই দূরত্ব অতিক্রম করতে পুরো দিনটি নিল, কারণ তার ইঞ্জিনিয়ার ছিল এই বাড়ির নিয়মিত যাত্রীদের একান্ত বন্ধু। যাত্রীরা অনবরতই তাঁকে গাড়িটা একটু দাঁড় করাতে অনুরোধ করছিল, তারা কলা- কোম্পানির গলফের মাঠে নেমে একটু পায়চারি করে পায়ের জড়তা ভাঙ্গবে, পুরুষরা পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা স্বচ্ছ শীতল নদীর জলে কাপড়জামা খুলে একটু স্নান করে নেবে, ক্ষিদে পেলে তারা ট্রেন থামিয়ে হৈ হৈ করে নেমে পড়ে পাশের চারণ ক্ষেতে ঘুরে বেড়ানো গরুর দুধ দোহন করবে। এই চললো সারা পথ। ফারমিনা ডাজা যতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছলো ততক্ষণে সে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। সামলে নিয়ে সে গভীর বিস্ময়ে হোমারীয় তেঁতুলগুলি দেখলো, এই গাছে দোলনা-শয্যা খাটিয়ে মুমূর্ষু ত্রাণকর্তা, এদেশের লিবারেটর, মৃত্যুবরণ করেন, ওরা যেমন বলে ঠিক সেই রকম, আর তাঁর শয্যাটি ওই রকম মহান এক ব্যক্তির জন্যই যে মাত্রাতিরিক্ত ছোট ছিল তাই নয়, সাত মাসের শিশুর জন্যও তা ছিল বড় বেশি ছোট। তবে আরেকজন দর্শনার্থী, মনে হল সে বেশ খোঁজখবর রাখে, বলল যে এটা একটা নকল স্মৃতিচিহ্ন, আসলে তাঁর দেশের জনককে ওরা মৃত্যুবরণ করার জন্য মেঝের উপর ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। বাড়ি ছাড়ার পর থেকে ফারমিনা ডাজা যা দেখেছে ও শুনেছে তাতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই তার ব্যাকুলতা সত্ত্বেও সে তার আগের সফরের স্মৃতি থেকে বর্তমান সফরের বাকি সময়টুকুতে কোন আনন্দ লাভে সক্ষম হল না। তার স্মৃতিবিধুরতামণ্ডিত গ্রামগুলি এড়িয়ে গেল সে। এই ভাবে মোহভঙ্গের হাত থেকে সে নিজেকে রক্ষা করলো, আগের স্মৃতিই সে ধরে রাখতে পারলো। তার মোহমুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সে শুনতে পেলো অ্যাকর্ডিয়ানের শব্দ, মোরগ-লড়াই-এর চারপাশে দাঁড়ানো লোকজনের চিৎকার, বন্দুকের গুলির আওয়াজ যা কোন যুদ্ধ জয়ের সঙ্কেত হতে পারে, আবার এর উৎস কোন আনন্দ উৎসবও হতে পারে, তারপর আশ্রয় নেবার মতো সব কিছু যখন শেষ হয়ে গেল তখন একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাবার সময় সে চাদর দিয়ে তার মুখ ঢেকে রাখলো যেন এক সময় এই গ্রাম যেমন ছিল তার স্মৃতি সে তার মনের মধ্যে ধরে রাখতে পারে।

    এই ভাবে অতীতকে বার বার এড়িয়ে, এক রাতে সে হিল্ডাব্রান্ডার খামার বাড়িতে এসে পৌঁছল। সে যখন তাকে দরজার সামনে তার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো তখন তার মূর্ছা যাবার উপক্রম হয়। মোটা ও বয়স্ক এক মহিলা, তাকে ঘিরে আছে তার দুরন্ত সন্তানরা, এদের বাবা সে ব্যক্তি নয় যাকে হিল্ডাব্রান্ডা কোন আশা না থাকলেও এখনো ভালোবাসে। হিল্ডাব্রান্ডার স্বামী এক সৈনিক, পেনসনের টাকায় সংসার চালাচ্ছে, সে হিল্ডাব্রান্ডাকে ভালোবাসে পাগলের মতো। তার ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের আড়ালে হিল্ডাব্রান্ডা কিন্তু আগের মানুষটিই আছে। মাত্র অল্প কয়েক দিনের গ্রামীণ জীবনযাপন ও মধুর স্মৃতির ফলে ফারমিনা ডাজা তার প্রথম মানসিক ধাক্কা সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠে, তবে সে খামার ছেড়ে বাইরে বেরুতো না। শুধু রবিবার রবিবার গির্জায় ম্যাস-এ যোগ দিতে যেতো, সঙ্গে চলতো তার বহুকাল আগের ষড়যন্ত্রকারীদের নাতি-নাতনীবৃন্দ, সুন্দর চমকপ্রদ ঘোড়ার পিঠে আসীন কাউবয়রা, চমৎকার সাজ পোশাক পরা তরুণীরা, এই বয়সে তাদের মা-রা যেমন ছিল ঠিক সেই রকম দেখতে, তারা চলেছে গরুর গাড়িতে চড়ে, উপত্যকার শেষ প্রান্তে মিশন চার্চে পৌঁছা পর্যন্ত তারা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে সারাটা পথ গান করতো। ফারমিনা ডাজা শুধু ফ্লোর ডি মারিয়া গ্রামের ভেতর দিয়ে গেল, গত সফরের সময় সে এই গ্রামের ভেতর দিয়ে যায় নি। তার মনে হয়েছিল এই গ্রাম তার ভালো লাগবে না, কিন্তু এবার যখন সে গ্রামটা দেখলো তখন সে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য কিংবা গ্রামটিরও দুর্ভাগ্য হল এই যে পরবর্তী সময়ে গ্রামটি বাস্তবে যেমন ছিল সেটা সে কখনোই মনে করতে পারে নি, আগে সে তার যে রূপটি কল্পনা করেছিল সেটাই তার স্মৃতিতে আঁকা হয়ে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.