Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ১৭

    ১৭

    রিওহাচার বিশপের কাছ থেকে একটা প্রতিবেদন পাওয়ার পর ডক্টর জুভেনাল উরবিনো তাঁর স্ত্রীকে আনবার জন্য সান হুয়ান ডি লা সিনেগা যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশপের ধারণায় ফারমিনা যে এখানে এত দীর্ঘকাল থাকছেন তার কারণ তার ফিরে যাবার অনিচ্ছা নয়, তার কারণ তিনি তাঁর অহঙ্কারকে পরাজিত করার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। অতএব ফারমিনাকে খবর না দিয়ে, হিল্ডাব্রান্ডার সঙ্গে পত্রের আদান-প্রদান করে, ডাক্তার সেখানে গেলেন। হিল্ডাবান্ডার চিঠিতে সে জানায় যে তাঁর স্ত্রী বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। সকাল এগারোটায় তিনি যখন উপস্থিত হন ফারমিনা ডাজা তখন রান্নাঘরে বেগুনের একটা সুস্বাদু তরকারি রান্না করছিল। ওই সময় সে শুনতে পেল দারোয়ানদের চেঁচামেচি, ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, আকাশ পানে ছোড়া বন্দুকের গুলির শব্দ, আঙিনায় একটা দৃঢ় পদক্ষেপের আওয়াজ আর তারপর তার পুরুষ মানুষটার কণ্ঠস্বর : ‘নিমন্ত্রিত হবার আগেই ঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হওয়াটা বেশি ভালো।’

    ফারমিনা ডাজার মনে হল সে খুশিতে মরে যাবে। সে অসচেতন ভাবে ভালো করে তার হাত ধুলো আর বিড়বিড় করে বললো, ‘তোমাকে ধন্যবাদ, ঈশ্বর, তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি কী ভালো’, তার খেয়াল হল কে দুপুরে খেতে আসছে তাকে সে সম্পর্কে কিছু না বলে হিল্ডাব্রান্ডা তাকে ভালো করে বেগুনের একটা ভালো পদ রান্না করতে বলেছে, আর এই হতচ্ছাড়া বেগুনের জন্য এখনো তার স্নান করা হয় নি, তার মনে হল তাকে বিশ্রী দেখাচ্ছে, একটা বুড়ির মতো, রোদে পুড়ে তার মুখের রঙ জ্বলে গেছে, তাকে এই চেহারার দেখতে পেয়ে ডাক্তার ভাববেন, না এলেই ভালো হত। যতটা ভালো ভাবে পারা যায় সে তার অ্যাপ্রনে হাত দুটি মুছে নিল, চেহারাটা যথাসাধ্য ঠিকঠাক করলো, তারপর যে অহঙ্কার নিয়ে সে জন্মেছে তার সবটুকু নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে সে তার উথালপাতাল করা অন্তরকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তারপর সে তার মধুর হরিণীর চলনে তার পুরুষ মানুষটার মুখোমুখি হবার জন্য এগিয়ে গেল, মাথা উঁচু, চোখ দুটি উজ্জ্বল, যুদ্ধের জন্য তার নাসিকা প্রস্তুত, গৃহে প্রত্যাবর্তনের বিপুল স্বস্তির কথা ভেবে নিয়তির প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু তিনি তাকে যতটা নমনীয় হবে বলে ভাবছেন অবশ্যই সে ওরকম হবে না, সে নিঃসন্দেহে সানন্দে তাঁর সঙ্গে ফিরে যাবে, কিন্তু তিনি তাকে যে যন্ত্রণা দিয়েছেন, যেভাবে তার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেজন্য তার নীরবতা দিয়ে সে তার স্বামীকে উপযুক্ত মূল্য দিতে বাধ্য করবে এ বিষয়ে সে ছিল সঙ্কল্পবদ্ধ।

    ফারমিনা ডাজা উধাও হয়ে যাবার প্রায় দু’বছর পর একদিন একটা অসম্ভব আকস্মিক যোগাযোগ ঘটলো। এ জাতীয় ঘটনাকে ট্রান্সিটো আরিজা ঈশ্বরের একটা কৌতুক বলে অভিহিত করতেন। ততদিনে এখানে ছায়াছবির প্রচলন হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এর মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু দেখে নি, কিন্তু লিওনা কাসিয়ানি একদিন তাকে ‘কাবিরিয়া’-র উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে নিয়ে যায়, সে আপত্তি করে নি। কবি গেব্রিয়েল দান্যুসিও কাবিরিয়ার সংলাপ রচনা করেছিলেন, সেজন্যই ওটা বিখ্যাত হয়। ডন গ্যালিলিওর বিশাল খোলা উঠানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভিড় করে আসতো, তবে কোন কোন রাতে পর্দায় নির্বাক প্রেমের দৃশ্য দেখার চাইতে তারা বেশি মুগ্ধ হয়ে দেখতো নক্ষত্রখচিত আকাশের সৌন্দর্য। আজ লিওনা কাসিয়ানি জটিল কাহিনীটা তন্ময় হয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে অনুসরণ করছিল, কিন্তু নাটকটির বিরক্তিকর একঘেয়েমি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চোখে ঘুম এনে দেয়, তার মাথা ঢুলে ঢুলে পড়তে থাকে। এমন সময় তার পেছনের আসন থেকে একটি কণ্ঠ তার মনোভাবের প্রতিধ্বনি করে উঠলো, ‘হা ঈশ্বর, এ যে দুঃখ-যন্ত্রণার চাইতেও দীর্ঘতর!’

    সে শুধু ওটুকুই বললো, হয়তো অন্ধকারের মধ্যে তার কণ্ঠস্বরের অনুরণন তাকে একটু অবদমিত করেছিল। নির্বাক ছায়াছবি চলাকালে তখনো এখানে তার সঙ্গে পিয়ানো বাদনের প্রথা চালু হয় নি। অন্ধকারের মধ্যে শুধু শোনা যেতে বৃষ্টিপাতের মতো প্রোজেক্টরের মর্মরধ্বনি। চরমতম পরিস্থিতিতে না পড়লে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঈশ্বরের কথা ভাবতো না, কিন্তু এখন সে সারা অন্তর দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল। একশো বিশ ফুট মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকলেও সে ওই ঈষৎ শুষ্ক কণ্ঠস্বর নির্ভুল ভাবে চিনতে পারতো। বহু যুগ আগে এক অপরাহ্ণে হলুদ পাতার ঘূর্ণির মধ্যে নির্জন একটি পার্কে সে এই কণ্ঠস্বর শুনেছিল, ‘এখন যাও, আমি না বলা পর্যন্ত আর এখানে ফিরে আসবে না’, তখন থেকে সেই ওই কণ্ঠস্বর তার বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ফ্লোরেন্টিনো বুঝতে পারছিল যে ও তার ঠিক পেছনের আসনে বসে আছে, তার অবশ্যম্ভাবী স্বামীর পাশে, সে অনুভব করলো ওর উষ্ণ নিয়মিত নিঃশ্বাসের শব্দ, আর সে ওর স্বাস্থ্যকর নিঃশ্বাস দ্বারা পরিশ্রুত বাতাস নিজের বুকে ভালোবাসার সঙ্গে টেনে নিল। নিকট অতীতের বিষণ্ণ কয়েক মাস ধরে সে ভেবেছে মৃত্যুর কীট ফারমিনা ডাজাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, কিন্তু এখন সে ওর ওই চিত্র কল্পনা করার পরিবর্তে স্মরণ করলো তার উজ্জ্বল আনন্দিত বয়সের ছবি, মিনার্ভার মতো পোশাকের নিচে তার পেট বর্তুলাকার হয়ে উঠেছে, তার প্রথম সন্তান সেখানে বেড়ে উঠছে। ছবির পর্দায় নানা ঐতিহাসিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে, ফ্লোরেন্টিনো নিজেকে তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে, তার কল্পনায় ওকে দেখার জন্য তার মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাবার কোন প্রয়োজন নাই। তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অতীতের যে কাঠবাদামের গন্ধ তার কাছে ভেসে ভেসে আসছে তা তাকে গভীর আনন্দ দিল। চলচ্চিত্রে মেয়েদের কি ভাবে প্রেমে পড়া উচিত, যেন বাস্তব জীবনের যন্ত্রণা থেকে তারা রেহাই পেতে পারে, এ সম্পর্কে ও কি ভাবে সেটা জানতে ফ্লোরেন্টিনোর খুব কৌতূহল হল। চলচ্চিত্রটি শেষ হবার ঠিক আগের মুহূর্তে একটা সানন্দ বিদ্যুৎ ঝলকের মত তার খেয়াল হল যে তার পরম ভালোবাসার মানুষটির এতো কাছে এতো দীর্ঘ সময় সে ইতিপূর্বে কখনো কাটায় নি 1

    আলো জ্বলবার পর সে অন্যদের উঠে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করলো। তার পর সে উঠে দাঁড়ালো, তাড়াহুড়া করল না, বিক্ষিপ্ত চিত্তে তার কোটের বোতাম লাগালো, সব অনুষ্ঠানের সময়ই সে তার কোটের বোতামগুলি খুলে রাখতো, তারপর তারা চারজন নিজেদেরকে পরস্পরের এতো কাছাকাছি আবিষ্কার করলো যে তাদের মধ্যে একজন যদি নাও চাইতো তবু তাদের পারস্পরিক সম্ভাষণ বিনিময় না করে কোন উপায় ছিল না। প্রথমে জুভেনাল উরবিনো লিওনা কাসিয়ানিকে সম্ভাষণ করলেন, তিনি তাকে ভালোভাবে চিনতেন। তারপর তিনি তাঁর স্বাভাবিক উদার ভঙ্গিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার করমর্দন করলেন। ফারমিনা ডাজা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসলো, শুধুই সৌজন্যের তবু সে হাসি ছিল এমন একজনের

    যে ওদের মাঝে মাঝেই দেখেছে, তারা কে সেকথা যার জানা এবং তাই তাদের একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নাই। লিওনা কাসিয়ানি তার বর্ণসঙ্করীয় মাধুর্য নিয়ে প্রতিসম্ভাষণ করলো, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কি করবে ভেবে পেলো না, ওকে দেখে সে বিমূঢ়-বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল।

    ও ভিন্ন এক মানুষ রূপান্তরিত হয়েছে। যে সাংঘাতিক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তার কোন চিহ্ন ওর মুখে নাই, কোন রোগের চিহ্নই নাই, ওর দেহ ওর সুন্দর সময়ের ক্ষীণত্ব ও অনুপাত অক্ষুণ্ণ রেখেছে, তবু এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে বিগত দুটি বছর তার জীবনের কঠিন দশ বছরের চাইতেও বেশি কঠোর ছিল। ছোট করে কাটা চুল তাকে ভালো মানিয়ে ছিল, দুটি গুচ্ছ বাঁকা হয়ে দু’গালের ওপর পড়েছে, কিন্তু তার রঙ আর এখন মধুর মতো নয়, বরং অ্যালুমিনিয়মের মতো, আর তার দাদি-নানির চশমার আড়ালে তার সুন্দর চোখ দুটি তাদের অর্ধজীবনের উজ্জ্বল আলো হারিয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা থিয়েটার থেকে প্রস্থানরত ভিড়ের মধ্যে তাকে দেখলো, স্বামীর বাহু বন্ধন থেকে নিজের হাত খুলে নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরের লোকজনের মধ্যে তাকে সাধারণ মেয়েদের মতো চাদর জড়ানো এবং ঘরের চটি পায়ে দেখে সে বিস্মিত হল। কিন্তু সে যখন দেখলো যে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাকে সাহায্য করার জন্য তার স্বামীকে তার হাত ধরতে হল তখন সে খুব বিচলিত বোধ করলো। হাত ধরা সত্ত্বেও ফারমিনা ডাজা শেষ সিঁড়িটার উচ্চতা ঠিক মতো আন্দাজ করে নি এবং দরজার কাছে সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল।

    বয়সের দুর্বলতা ও স্খলিত পদক্ষেপ সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তার যুবা বয়সে পার্কে বসে কবিতা পড়ার সময়ও সে প্রায়ই পড়া বন্ধ করে বেশি বয়সের দম্পতিদের রাস্তা পেরুবার সময় একে-অন্যকে সাহায্য করার ব্যাপারটা লক্ষ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে তার নিজের বয়স বাড়ার প্রক্রিয়া চিহ্নিত করতে তার জীবনে এটা বিশেষ শিক্ষাপ্রদ হয়েছে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর জীবনের ওই পর্যায়ে, ছায়াছবি দেখার ওই রজনীতে, পুরুষদের দেখে মনে হল তারা যেন এক ধরনের শারদীয় যৌবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তাদের মাথার প্রথম পাকা চুলগুলি তাদের একটা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে, তাদের মনে হচ্ছিল বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রলুব্ধকারী, বিশেষ করে তরুণীদের চোখে। অন্য দিকে তাদের বিবর্ণ স্ত্রীদের আঁকড়ে ধরতে হচ্ছিল স্বামীদের বাহু, নিজেদের ছায়ার উপরেই তারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায়। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা যেতো যে কোন রকম সতর্ক সঙ্কেত না দিয়েই স্বামীরাই দেহে ও আত্মায় লজ্জাজনক ভাবে জড়িয়ে গেছে, আর তাদের স্ত্রীরা সেরে উঠেছে, এখন তারাই স্বামীদের হাত ধরে পথ দেখাচ্ছে, স্বামীরা যেন করুণার পাত্র অন্ধজন, তাদের পুরুষালি অহঙ্কারে যেন ঘা না লাগে সে জন্য স্ত্রীরা তাদের কানে ফিসফিস করে বলছে, সাবধান, দুটো নয়, তিনটা ধাপ আছে এখানে, রাস্তার মাঝখানে এখানে কাদাজল জমে আছে, ফুটপাতের ওই ছায়াটা একটা ভিক্ষুকের মৃতদেহ, বহু কষ্টে তারা স্বামীদের রাস্তা পার করাচ্ছে, যেন রাস্তা নয়, শেষ জীবননদীর অগভীর জল মাত্র। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আয়নায় নিজেকে এতো বার দেখেছে যে সে আর মৃত্যু ভয়ে কখনো এতোটা ভীত হয় না যতটা হয় লজ্জাজনক ওই বয়সে পৌঁছবার কথা ভেবে যখন একজন মহিলার বাহু আঁকড়ে ধরে তাকে পথ চলতে হবে। সেই দিন, শুধু সেই দিনই, সে বুঝবে যে ফারমিনা ডাজার আশা তাকে ত্যাগ করতে হবে।

    ওই সাক্ষাৎ তার ঘুম কেড়ে নিল। লিওনা কাসিয়ানিকে গাড়ি করে তার বাড়ি পৌঁছে দেবার বদলে সে তাকে নিয়ে পুরনো শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো। খোয়া বাঁধানো রাস্তায় তাদের পদধ্বনি ঘোড়ার খুরের মতো আওয়াজ তুললো। মাঝে মাঝে কোনো বাড়ির খোলা বারান্দা থেকে প্রেম গুঞ্জনের শব্দ ভেসে আসছে, শোবার ঘরের নিভৃত গোপন কথা একটু একটু শোনা যাচ্ছে, ভালোবাসার ফোঁপানি কান্না কোনো বাড়ির বিশেষ শ্রুতিগুণের জন্য বর্ধিত হয়ে সজোরে কানে এসে বাজছে, আর সরু ঘুমন্ত রাস্তায় পাওয়া যাচ্ছে চাঁপা ফুলের উষ্ণ সুরভি। আরেক বার ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে তার মনের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হল যেন লিওনা কাসিয়ানির কাছে সে তার অবদমিত ভালোবাসার কথা প্রকাশ না করে ফেলে। তারা দুজন একসঙ্গে মাপা পায়ে হাঁটলো, তাড়াহুড়া বর্জিত পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকার মতো পরস্পরকে ভালোবাসলো, লিওনার মন জুড়ে থাকলো কাবিরিয়ার জাদু, আর ফ্লোরেন্টিনো ভাবতে লাগলো নিজের দুর্ভাগ্যের কথা। শুল্ক ভবন চত্বরের এক বারান্দায় একজন গান গাইছে, তার গানের ধুয়া গোটা অঞ্চলে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : ‘যখন আমি ভেসে চলেছিলাম সমুদ্রের তরঙ্গরাশির উপর দিয়ে।’ সেইন্টস অব স্টোন স্ট্রিস্টে লিওনার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে শুভরাত্রি জানাবার আগের মুহূর্তে সে হঠাৎ বলল, আমাকে একটা ব্র্যান্ডি পান করার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে না? অনুরূপ এক পরিস্থিতিতে সে আরেকবার এই একই কথা বলেছিল, সেটা ছিল দশ বছর আগে, আর তখন লিওনা বলেছিল, ‘এই সময়ে যদি তুমি আসো তাহলে তোমাকে চিরদিনের জন্য থেকে যেতে হবে।’ সে আর ভেতরে ঢোকে নি, কিন্তু আজ ঢুকবে, যদি পরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে হয় তবু। কিন্তু আজ লিওনা কাসিয়ানি কোন রকম প্রতিশ্রুতি দান ছাড়াই তাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালো।

    এই ভাবেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজেকে ভালোবাসার এক পবিত্র আশ্রয়স্থলে আবিষ্কার করলো, যে-ভালোবাসার আগুন জ্বলে উঠবার আগেই নিভে গিয়েছিল। লিওনার বাবা-মা বেঁচে নেই, একমাত্র ভাই কুরাকাও-এ বেশ টাকা-পয়সা করেছে, এই পুরনো পৈতৃক বাড়িতে সে একা বাস করছে। বহু বছর আগে সে যখন লিওনাকে তার প্রণয়িনী করার আশা ত্যাগ করে নি তখন লিওনার মা-বাবার অনুমতি নিয়ে সে প্রতি রবিবার ওর সঙ্গে দেখা করতে ওর বাসায় যেতো, মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে থাকতোও। ওই সংসারে তার এতো বেশি অবদান ছিল যে সে ওটাকে প্রায় নিজের বলে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আজ রাতে ছায়াছবির পর তার মনে হল এই ড্রয়িংরুম যেন তার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেছে। আসবাবপত্রের জায়গা বদল করা হয়েছে, দেয়ালে নতুন ছবি ঝুলছে, সর্বত্র এত বেশি হৃদয়হীন পরিবর্তন আনা হয়েছে যে মনে হয় সে যে কখনো এখানে থেকেছে সেই স্মৃতি তার মন থেকে নিশ্চিত ভাবে মুছে দেবার ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। বেড়ালটা তাকে চিনতে পারলো না। বিস্মৃতির নিষ্ঠুরতায় মর্মাহত হয়ে সে বলল, ‘বেড়ালটা আমাকে চিনতে পারছে না।’ গ্লাসে পানীয় মেশাতে মেশাতে লিওনা মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এজন্য যদি তোমার মন খারাপ লাগে তাহলে শোনো, বেড়ালরা কখনোই কাউকে মনে রাখে না।’

    ওরা সোফায় হেলান দিয়ে ঘন হয়ে বসলো, নিজেদের কথা বললো, সেই বিকালে কত দিন আগে কে জানে, খচ্চরটানা ট্রলি গাড়িতে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কে কি ছিল তাই নিয়ে তারা আলাপ করলো। তাদের জীবন কেটেছে, তারপর, দপ্তরের পাশাপাশি দুটি কক্ষে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এই মুহূর্তের আগে তারা তাদের দৈনন্দিন কাজের কথা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কথা বলে নি। কথা বলতে বলতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর উরুতে হাত রাখলো, তারপর অভিজ্ঞ প্রলুব্ধকারীর কোমল স্পর্শ দিয়ে ওখানে তার হাত বুলাতে লাগলো। ও তাকে বাধা দিলো না, সাড়াও দিলো না, সৌজন্যের খাতিরে একটু কেঁপে পর্যন্ত উঠলো না। শুধু সে যখন আরেকটু অগ্রসর হবার চেষ্টা করলো তখন তার অনুসন্ধানী হাত চেপে ধরে তার করতলে একটি চুমু খেয়ে সে বলল, ‘এই, কী হচ্ছে! আমি অনেক দিন আগেই জেনেছি, আমি যে পুরুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছি তুমি সে নও।’

    তখনো তার বয়স খুব অল্প, একদিন একজন বলিষ্ঠ সক্ষম লোক, তার মুখ সে কখনো দেখে নি, অতর্কিতে তাকে জাপ্টে ধরে জাহাজঘাটের মাটিতে ঠেসে ধরে, এক টানে তার কাপড় খুলে ফেলে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে উন্মত্ত সঙ্গমে লিপ্ত হয়। সে শুয়ে ছিলো কাঁকর বালির উপর, শরীর জায়গা-জায়গায় কেটে গেছে, কালশিরে পড়েছে, তবু তার মনে হয়েছিল লোকটি যেন চিরকাল তার সঙ্গে থাকে, সে যেন প্রেমের প্লাবনে ভেসে গিয়ে তার বাহুবন্ধনের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারে। সে তার মুখ দেখে নি, তার গলা শোনে নি, কিন্তু তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে হাজার লোকের ভিড়ের মধ্যেও সে তার গঠন ও আকৃতি ও তার প্রেম করার ধরন দেখে তাকে নির্ভুলভাবে চিনতে পারবে। ওই ঘটনার পর থেকে যে কেউ তার কথা শুনতে রাজি হয়েছে তাকেই সে বলেছে, ‘দেখুন, আপনি যদি কখনো একজন বড়সড়ো শক্তিশালী মানুষের কথা শোনেন যে পনেরোই অক্টোবর তারিখে রাত প্রায় সাড়ে- এগারোটায় একটি অসহায় কালো মেয়েকে জাহাজঘাটায় ধর্ষণ করেছিল তখন সে কোথায় আমার দেখা পাবে তাকে তা বলে দেবেন।’ সে এতো লোককে এই কথা বলেছে যে এখন আর এ ব্যাপারে তার কোনো আশা নাই, তবু অভ্যাসের বশে সে বলে চলতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও বহুবার এ কাহিনী শুনেছে। রাত দুটো নাগাদ তারা প্রত্যেকে তিন তিনটা ব্র্যান্ডি পান করে ফেলে এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা উপলব্ধি করে যে, সত্যিই, লিওনা কাসিয়ানি যে লোকটির জন্য অপেক্ষা করছে সে ওই লোক নয়। আর এই উপলব্ধি তাকে আনন্দিত করলো।

    বিদায় নেবার সময় সে বলল, ‘ব্র্যাভো, সিংহ কন্যা, আমরা আজ ব্যাঘ্রটিকে সংহার করেছি।’

    ওই রাতে শুধু এই জিনিসটিই শেষ হয় নি। যক্ষ্মা রোগীদের চত্বর সম্পর্কিত কুৎসিৎ মিথ্যা তার ঘুম হরণ করে নিয়েছিল, কারণ তা তার মনে একটা অকল্পনীয় ধারণা সঞ্চারিত করেছিল, ফারমিনা ডাজা মরণশীল এবং স্বামীর আগেই সে মারা যেতে পারে। কিন্তু সেদিন থিয়েটারের দরজার কাছে তাকে হুমড়ি খেতে দেখে ফ্লোরেন্টিনো নিজের ইচ্ছাশক্তিতে সেই অতল খাদের দিকে আরেক পা অগ্রসর হল, তার মনে হল ফারমিনা ডাজা নয়, সেই হয়তো আগে মারা যাবে। তার এই পূর্বানুভূতি ছিল ভয়াবহ, কারণ তা ছিল বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বছরের পর বছরের নিশ্চল প্রতীক্ষা, সৌভাগ্যের অন্তহীন প্রত্যাশা, এসব সে পেছনে ফেলে এসেছে, কিন্তু দিগবলয়ে এখন সে নানা কাল্পনিক ব্যাধির অনতিক্রম্য সমুদ্র আর নির্ঘুম রাতে বিন্দু বিন্দু করে প্রস্রাব ত্যাগ আর ঊষার মৃদু আলোয় প্রতিদিন নিশ্চিত মৃত্যুবরণ ছাড়া আর কিছুই দেখতো না। তার মনে হল দিনের প্রতিটি মুহূর্ত, যারা এক সময় ছিল তার মিত্র এবং পরীক্ষিত সহযোগী, তারা এখন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছে। কয়েক বছর আগে সে একদিন একটা বিপজ্জনক গোপন মিলন স্থলে গিয়েছিল, কি যে ঘটতে পারে সেই আতঙ্কে তার হৃদয় ছিল ভারাক্রান্ত, সে গিয়ে দেখলো যে বাড়ির দরজায় তালা দেয়া নাই, কব্জাগুলি অতি সম্প্রতি তেল দিয়ে মসৃণ করে রাখা হয়েছে যেন সে নিঃশব্দে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার অনুতাপ বোধ হল, এক ভদ্র বিবাহিতা রমণীর শয্যায় সে যদি মারা যায় তাহলে ভদ্রমহিলার অপূরণীয় ক্ষতি হবে। সেক্ষেত্রে যে রমণীকে সে এই ধরণীতে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে, যার জন্য সে মোহভঙ্গের একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস না ফেলেও এক শতাব্দী অতিক্রম করে পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, সেই রমণী যে তার হাত ধরে চাঁদের সমাধি-ঢিবি ও বাত্যা-তাড়িত পপি ফুল আকীর্ণ রাস্তা পার করে তাকে নিরাপদে মৃত্যুর অপর তীরে পৌঁছে দেবার সুযোগ নাও পেতে পারে, এরকম ভাবনা তার মনে জেগে ওঠা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ছিল।

    সত্য কথা হল তার সময়ের মানদণ্ডে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিল। বয়স ছাপ্পান্ন হয়েছে, শরীর সুসংরক্ষিত, জীবন তার বিবেচনায় ভালোই কেটেছে, কারণ ওই জীবন ছিল প্রেমে পরিপূর্ণ। কিন্তু ওই যুগে নিজেকে তরুণ দেখিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ সহ্য করার মত সাহস তার এ বয়সে হত না, আর বিগত শতাব্দীতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য আজো সে গোপনে কাঁদে একথা স্বীকার করার মতো সাহসও তার ছিল না। তরুণ হবার জন্য সময়টা ছিল খারাপ। প্রতি বয়সেরই কাপড়-জামার একটা বিশেষ ঢং থাকে, কিন্তু বার্ধক্যের ঢংটি কৈশোর অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় আর চলতে থাকে মৃত্যু পর্যন্ত। বয়সের চাইতেও ব্যাপারটা ছিল সামাজিক মর্যাদার। তরুণরা পোশাক পরতো তাদের পিতামহদের মতো, সময়ের আগেই চশমা লাগিয়ে তারা নিজেদের অধিকতর শ্রদ্ধাভাজন করে তুলতো, আর বয়স ত্রিশ বছর পেরুলেই তারা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতো। মেয়েদের জন্য ছিল মাত্র দুটি বয়স : বিয়ে করার বয়স, যা বাইশের উপর যেতো না, আর স্থায়ী কুমারিত্বের বয়স। অন্যরা, বিবাহিতা মহিলারা, জননীরা, বিধবারা, পিতামহী, মাতামহীরা, তারা ছিল ভিন্ন একটা জাতি, তারা ক’বছর বেঁচেছে তা দিয়ে তাদের বয়সের হিসাব রাখতো না, মৃত্যুবরণ করার পূর্বে আরো ক’বছর তাদের হাতে আছে সেটা দিয়ে তারা তাদের বয়সের হিসাব করতো।

    পক্ষান্তরে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বার্ধক্যের ছলনাময় ফাঁদগুলির মুখোমুখি হত বন্য হঠকারিতার সঙ্গে, যদিও সে জানতো যে বালক বয়স থেকেই তাকে দেখাতো একজন বুড়ো মানুষের মতো, তাই ছিল তার নিয়তি। প্রথমে এর পেছনে ছিল প্রয়োজনের বাধ্যবাধকতা। তার বাবা নিজের যেসব কাপড়-জামা ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিতেন ট্রান্সিটো আরিজা সেগুলির সেলাই খুলে ফেলে তার জন্য নতুন করে সেলাই করে দিতেন। তাই সে যেসব ফ্রককোট পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতো সেখানে বসবার পর তার কোটের প্রান্তদেশ মাটিতে লুটাতো, আর সে মাথায় দিতো যাজকীয় টুপি, ছোট করার জন্য ভেতর দিকে তুলা গুঁজে দিলেও তার প্রান্তদেশ তার কান ঢেকে নিচে নেমে আসতো। ক্ষীণদৃষ্টির জন্য পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে চশমা পরতো, তার মাথার চুল ছিল তার মায়ের চুলের মতো, রুক্ষ, স্পষ্ট বোঝা যেতো না। সৌভাগ্যবশত বিভিন্ন ভাবে আরোপিত অনেকগুলি গৃহযুদ্ধের ফলে সরকারি কর্মকাণ্ডে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে আগে যে উচ্চ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছিল তা শিথিল করতে হয়, যার ফলে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে নানা পটভূমি ও সামাজিক অবস্থানের শিক্ষার্থীরা এসে একটা তালগোল পাকানো অবস্থা সৃষ্টি করে। অনেকে সরাসরি অবরুদ্ধ স্থান থেকে ক্লাসে এসে হাজির হত, তাদের শরীরে তখনো বারুদের গন্ধ, পরনে বিদ্রোহী অফিসারদের ইউনিফর্ম, ওই সব অফিসার সিদ্ধান্তহীন যুদ্ধে বন্দুকের মুখে বন্দি হয়েছিল, আর এই ছাত্ররা স্পষ্ট দৃশ্যমান ভাবে তাদের অস্ত্র কোমরে সেঁটে রাখতো। খেলার মাঠে মতপার্থক্য ঘটলে তারা একে অন্যকে গুলি করতো, পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে শিক্ষককে ভয় প্রদর্শন করতো এবং একবার এদেরই একজন, লা সাল অ্যাকাডেমির তৃতীয় বর্ষের একটি ছাত্র, জনৈক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দানের ক্লাসে ব্রাদার হুয়ান এরেমিটার একটি উক্তির জন্য তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ব্রাদার এরেমিটা বলেছিলেন যে ঈশ্বর হলেন রক্ষণশীল দলের একজন পূর্ণ সদস্য।

    অন্যদিকে, ক্ষয়িষ্ণু নামিদামি পরিবারের ছেলেরা পরতো পুরনো ঢং-এর যুবরাজদের মতো কাপড়-জামা, আর খুব গরিব ছেলেরা ক্লাসে আসতো খালি পায়ে। এত বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ভূত এতসব অদ্ভুত পরিবেশে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে অন্যতম অদ্ভুত একটি ছাত্র ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো অতটা অদ্ভুত সে ছিল না। একদিন রাস্তায় তাকে উদ্দেশ করে কে একজন চেঁচিয়ে বলেছিল, কুশ্রী আর গরিব হলে একজন শুধু আরো বেশি চাইতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এর চাইতে রূঢ় কোনো কথা শোনে নি। যাই হোক, প্রয়োজনের তাগিদে তাকে যে পোশাক পরতে হয়, তখন এবং তার বাকি জীবন ধরে, সে পোশাকই ছিল তার রহস্যময় স্বভাব এবং গম্ভীর চরিত্রের জন্য সব চাইতে বেশি মানানসই। যখন আর.সি.সি.তে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদোন্নতি ঘটলো তখন সে রীতিমত দর্জি দিয়ে তার পোশাক বানালো, ঠিক তার বাবার মতো করে। বাবাকে তার মনে পড়ে একজন বুড়ো মানুষ হিসাবে। তিনি মারা গিয়েছিলেন যিশু খ্রিস্টের পরম পূজনীয় তেত্রিশ বৎসর বয়সে। তাই ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে সর্বদাই তার বয়সের চাইতে বুড়ো দেখাতো। বস্তুতপক্ষে, তার এক মুখ– পাতলা স্বল্পকালীন প্রণয়িনী, ব্রিজিটা জুলেটা, তাকে প্রথম দিনই বলেছিল যে কাপড় জামা পরা অবস্থার চাইতে নগ্ন মূর্তিতেই সে তাকে দেখতে বেশি ভালোবাসে, কারণ তখন তাকে বিশ বৎসরের কম বয়েসী দেখায়। কিন্তু এর প্রতিকার তার জানা ছিল না, কারণ প্রথমত, তার ব্যক্তিগত রুচি তাকে অন্য কোন রকম পোশাক পরতে দেয় নি, দ্বিতীয়ত, বিশ বৎসরের একজন যুবককে কিভাবে আরো অল্প বয়সের দেখানো যাবে তা সে জানতো না, যদি না সে দেরাজ খুলে তার হাফ-প্যান্ট ও নাবিকদের টুপিটা বের করে আবার তা ব্যবহার করতো। অন্যদিকে, তার সময়ে বার্ধক্যের যে ধারণা প্রচলিত ছিল তার হাত থেকে সে মুক্তি পেল না, আর তাই সেদিন থিয়েটারের দরজার কাছে ফারমিনা ডাজাকে হুমড়ি খেতে দেখে সে যে বজ্রপাতের মতো তীব্র ভয়ে বিচলিত হয়ে উঠবে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তার মনে হল, মরণ, হারামির বাচ্চা, তার ভালোবাসার প্রচণ্ড যুদ্ধে নিশ্চিত বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছে।

    এ পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে সে তার সব চাইতে বড় যে যুদ্ধ চালিয়েছিল তা ছিল তার টাক মাথার বিরুদ্ধে, আর ওই যুদ্ধে সে বরণ করেছিল শোচনীয় পরাজয়। প্রথম যেদিন সে তার চিরুনিতে কয়েকটা চুল পেঁচিয়ে থাকতে দেখলো তখনই সে বুঝলো সে এক নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে পতিত হয়েছে, সে যে কী যন্ত্রণা তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো বোঝার সাধ্য নাই। অনেক বছর ধরে সে সংগ্রাম করে যায়। ওই বিপর্যয়ের হাত থেকে তার মাথার প্রতিটি ইঞ্চি বাঁচাবার জন্য এমন কোন তেল বা ক্রিম নেই যা সে ব্যবহার করে দেখে নি। সে একবার কোথাও শুনেছিল যে চুলের বেড়ে ওঠার সঙ্গে ফসল কাটার চক্রের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, তাই সে ব্রিস্টল অ্যালমানাকে প্রকাশিত যাবতীয় কৃষি বিষয়ক তথ্য মুখস্থ করে ফেলেছিল। সারা জীবন সে যে সম্পূর্ণ টেকো নাপিতের কাছে চুল কাটিয়েছে তাকে ত্যাগ করে সে এক বিদেশী নবাগত নাপিতের কাছে যেতে শুরু করে। এই নতুন নরসুন্দর চুল কাটতো শুধু চাঁদের চতুর্থ দিনে। এই নতুন নরসুন্দর তার উর্বর হাতের প্রমাণ যখন সবে রাখতে শুরু করে তখন খবর পাওয়া গেল যে শিক্ষানবিশদের ধর্ষণ করায় অভিযোগে অ্যান্টিলীয় পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাতকড়া পরিয়ে তাকে একদিন নিয়ে যাওয়া হয়।

    ততদিনে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ক্যারিবীয় অঞ্চলের খবরের কাগজগুলিতে টাক সম্পর্কে যে সব বিজ্ঞাপন বেরুতো, যেখানে একই লোকের পাশাপাশি দুটি ছবি মুদ্রিত হত, প্রথমটিতে মাথায় তরমুজের মতো টাক, দ্বিতীয়টিতে সিংহের মতো কেশরাশি, অব্যর্থ প্রতিষেধক মাখার আগে ও পরে, সেই সব বিজ্ঞাপন কেটে রেখেছিল। ছয় বছরে সে ওই রকম একশো বাহাত্তরটি তেল ও ক্রিম পরীক্ষা করে দেখে, উপরন্তু বোতলের গায়ে যে সব সৌজন্যমূলক বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা লেখা থাকতো তার সুযোগ সে গ্রহণ করে, এর ফলে সে অর্জন করলো শুধু তার মাথার ত্বকে একটা চুলকানি, বিশ্রী গন্ধ ছড়ানো একটা চর্মরোগ, যাকে মার্টিনিকের চিকিৎসকরা বোরিয়ালিস দাদ নাম দেয়, কারণ তার ওই একজিমা অন্ধকারের মধ্যে একটা মৃদু আলো ছড়াতো। শেষ উপায় হিসাবে সে সাধারণ বাজারে ইন্ডিয়ানরা যেসব লতাপাতা ফেরি করে বেড়াতো তার আশ্রয় নিল, লেখক চত্বরে যেসব প্রাচ্যদেশীয় ঐন্দ্রজালিক ওষুধ বিক্রি হত তাও ব্যবহার করে দেখলো, তারপর যখন সে বুঝলো যে তাকে ভীষণ ভাবে ঠকানো হয়েছে ততদিনে তার মাথা একজন সন্তের মুড়ানো মাথায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে যখন হাজার বছরের গৃহযুদ্ধে’র ফলে দেশ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত তখন এক ইতালীয় এই শহরে এসে উপস্থিত হয়, সে ব্যক্তিগত ভাবে টেকো মাথাদের জন্য সত্যিকার মানুষের চুল দিয়ে পরচুলা বানিয়ে দিতো। দাম নিতো আকাশ ছোঁয়া, তিন মাস ব্যবহারের পর তার কোনো দায়-দায়িত্বও প্রস্তুতকারক নিতো না, তবু সঙ্গতিপন্ন কোনো টাকমাথাওয়ালাই এই প্রলোভনের সামনে নতিস্বীকার না করে পারে নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল প্রথম দিকের একজন। সে হুবহু তার চুলের মতো দেখতে একটা পরচুলা মাথায় চাপিয়ে পরীক্ষা করলো, নিজের প্রকৃত চুলের সঙ্গে সে ওটার এতো বেশি মিল লক্ষ করলো যে তার মনে হল তার মেজাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই পরচুলার চুলও বোধ হয় খাড়া হয়ে উঠবে, কিন্তু এক মৃত ব্যক্তির চুল নিজের মাথায় ধারণ করার ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারলো না। তার দ্রুত বর্ধমান টাকের মধ্যে সে একটা সান্ত্বনাই খুঁজে পেল, তার চুল পেকে যাচ্ছে এটা তাকে দেখতে হবে না। একদিন এক দিলদরিয়া মাতাল তাকে তার দপ্তর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি উৎসাহের সঙ্গে জাহাজঘাটের ওপর তাকে আলিঙ্গন করলো, তারপর কুলিদের হাস্যরোলের মাঝে তার টুপিটা খুলে নিয়ে সে তার মাথার ওপর একটা সশব্দ চুম্বন দিলো। তারপর চিৎকার করে সে বললো, ‘চুলহীন বিস্ময়!’

    সেদিন রাতে, আটচল্লিশ বছর বয়সে, যে কয়েক গাছা কোমল চুল তার কপালের দু’পাশে ও ঘাড়ের কাছে তখনো অবশিষ্ট ছিল তা কেটে ফেলে সে তার নির্ভেজাল টেকোত্বের নিয়তিকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নিয়েছিল। প্রতি দিন সকালে স্নানের পূর্বে সে শুধু তার গালেই সাবান মাখাতো না, মাথার যেসব জায়গায় খোঁচা খোঁচা চুল উঠতে শুরু করেছে সেখানেও সাবান ঘষতো, তারপর একটা নাপিতের ক্ষুর দিয়ে তার গোটা মাথা. এমন মসৃণভাবে কামিয়ে ফেলতো যে মনে হত কোনো শিশুর পশ্চাদদেশ। তখন পর্যন্ত সে আপিসেও তার মাথার টুপি নামিয়ে রাখতো না, তার টাক মাথা তার মধ্যে একটা অশোভন নগ্নতার অনুভূতি এনে দিতো। কিন্তু যখন সে তার টেকোত্বকে সমগ্র অন্তর দিয়ে গ্রহণ করলো তখন সে তার মধ্যে নানা পুরুষালী গুণ আরোপ করলো। আগেও সে এসব কথা শুনেছিল কিন্তু তখন ভাবতো ওসব বুঝি টেকো বৃদ্ধদের মায়া- কল্পনা। আরো পরে সে তার ডান দিকের সিঁথি থেকে তার লম্বা চুলগুলি মাথা ঢেকে টেনে আড়াতে শুরু করে এবং এ অভ্যাস সে কখনো ত্যাগ করে নি। কিন্তু এটা সত্ত্বেও সে তার টুপি পরতে থাকে, সর্বদা ওই একই শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ভঙ্গিতে। পরে যখন শোলার টুপি চালু হয় তখনো সে তার নিজস্ব ঢং-এর টুপি বিসর্জন দেয় নি।

    অন্য দিকে, তার দাঁত খোয়ানোর ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন রকম। তার মূলে কোন স্বাভাবিক বিপর্যয় ছিল না। এক ভ্রাম্যমাণ দাঁতের ডাক্তার তার দাঁতের সামান্য সংক্রমণ সারাবার জন্য চরম পন্থা গ্রহণ করে আর তার অদক্ষ চিকিৎসার পরিণতিতেই তার ওই দুর্ভোগ ঘটে। দাঁতের উপর তুরপুনের ব্যবহারকে ফ্লোরেন্টিনো ভীষণ ভয় করতো, তাই সে কোনো দন্ত চিকিৎসকের কাছে যেতো না। শেষে ব্যথা অসহ্য হয়ে ওঠে। এক রাতে পাশের ঘরে শোয়া মা তার কাতরানি শুনে ভয় পেয়ে যান। বিস্মৃতির কুয়াশায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া পুত্রের অনেক দিন আগের কাতরানির কথা মায়ের মনে পড়লো, কিন্তু কোথায় প্রেম তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে তা দেখার জন্য তিনি যখন ওর হাঁ করা মুখের ভেতর দৃষ্টিপাত করলেন তখন দেখলেন যে ওর মুখের মধ্যে ঘা হয়ে গেছে।

    কাকা দ্বাদশ লিও ওকে ডাক্তার ফ্রান্সিস অ্যাডোনের কাছে পাঠালেন, এক কৃষ্ণাঙ্গ দৈত্য, একটা ব্যাগে তার দন্ত চিকিৎসার সব জিনিসপত্র নিয়ে সে নৌযানগুলিতে নিয়মিত সফর করতো, যেন কোনো ভ্রাম্যমাণ পণ্য বিক্রেতা। নদীর কিনারের গ্রামগুলিতে সে ছিল এক আতঙ্ক বিশেষ। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখের ভেতর এক নজর তাকিয়েই সে সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে ভবিষ্যতের আরো দুর্ভাগ্য থেকে স্থায়ীভাবে বাঁচাবার জন্য মাঢ়ির দাঁতসহ তার সব ভালো দাঁতগুলিও তুলে ফেলতে হবে। টাকের ক্ষেত্রের বিপরীতে দাঁতের এই চরম চিকিৎসায় সে ভীত হল না, তবে অনুভূতি বিলোপ না করে কাজটা করলে যে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে পারে সেই স্বাভাবিক ভয় তো ছিলই। নকল দাঁতের ধারণাও তাকে বিচলিত করলো না। প্রথমত, ছেলেবেলার এক পরম প্রিয় স্মৃতি তার মনে গেঁথে ছিল। একবার মেলাতে সে এক জাদুকরকে দেখেছিল, জাদুকর তার উপরের ও নিচের দু’পাটি দাঁত খুলে সামনের টেবিলের উপর রাখার পর দাঁতের পাটি দুটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে কথা বলেছিল। দ্বিতীয়ত, ছেলেবেলা থেকে সে দাঁতের ব্যথায় এত কষ্ট পেয়ে এসেছে, প্রেম তাকে যে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা দিয়েছে প্রায় সেই রকম, সে কষ্টের হাত থেকে সে এবার পুরোপুরি মুক্তি পাবে। এটাকে তার টাকের মতো মনে হল না। বার্ধক্য এখানে কোনো চোরাগুপ্তা অন্যায় আঘাত পাচ্ছে না। তাছাড়া তার মনে হল গন্ধকজারিত তেতো নিঃশ্বাস সত্ত্বেও তার নকল দাঁতের হাসি তার চেহারার উন্নতি সাধন করবে। অতএব কোনো বাধা না দিয়ে সে ডাক্তার অ্যাডোনের তাতানো সাঁড়াশির সামনে নিজেকে সমর্পণ করলো। অতঃপর, রোগমুক্তির পর স্বাস্থ্যের ক্রমোন্নতির সময়টা সে সহ্য করলো একটা মালটানা খচ্চরের চরম ঔদাসীন্য নিয়ে।

    কাকা দ্বাদশ লিও অস্ত্রোপচারের সমস্ত খুঁটিনাটি এতো মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলেন যে মনে হল যেন তাঁর নিজের মাংসের ওপরই অস্ত্র চালানো হচ্ছে। নকল দাঁত সম্পর্কে তাঁর অনন্য উৎসাহের পেছনে একটা কারণ ছিল। ম্যাগডালেনা নদীপথে তাঁর প্রথম যাতায়াতের সময় তাঁর অসামান্য সঙ্গীত প্রীতির ফলে একটা ঘটনা ঘটে। সে রাত ছিল পূর্ণিমার রাত। জাহাজ গামারা বন্দরের প্রবেশমুখে পৌঁছলে লিও একজন জার্মান সারভেয়ারের সঙ্গে একটা বাজি ধরলেন, কাপ্তানের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা ইতালীয় রোমান্টিক গান গেয়ে তিনি অরণ্যের প্রাণীদের জাগিয়ে তুলতে পারেন। তিনি বাজিটা প্রায় হারতে বসেছিলেন। নদীর অন্ধকারের মধ্যে জলাভূমি থেকে ভেসে এলো সারসদের পাখা ঝাপটানির শব্দ, জলের বুকে কুমিরের লেজ আছড়ানোর শব্দ, ভীত শ্যাড মাছের ডাঙায় লাফিয়ে পড়ার শব্দ, কিন্তু গানের শেষ টানে পৌঁছে মনে হল গায়ক বোধ হয় তাঁর সঙ্গীতের প্রবল শক্তির কারণে এখন তাঁর ধমনী ছিন্ন করে ফেলবেন, আর ঠিক ওই সময়ে তাঁর সমাপ্তিসূচক নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নকল দাঁতের পাটি মুখ থেকে ঝুপ করে খুলে জলের মধ্যে পড়ে গেল।

    টেনেরিফ বন্দরে জাহাজকে তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। ওই সময়ে তাঁর জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরেক সেট দাঁত বানাতে হয়। সেটা নিখুঁতভাবে ফিট করে। কিন্তু ফেরার পথে আরেকটি বিপর্যয় ঘটে। কাকা দ্বাদশ লিও কিভাবে তাঁর দাঁত খোয়ান কাপ্তানের কাছে সে কাহিনী বলছিলেন। তা দেখাতে গিয়ে তিনি তার ফুসফুস ভরে জঙ্গলের আগুনে-বাতাস বুকে টেনে নেন, তারপর তাঁর সাধ্যানুযায়ী উচ্চগ্রামে গলা তোলেন, নদী তীরে রোদ পোহানো জাহাজের অগ্রগতির দিকে পলকহীন চোখে তাকানো কুমিরগুলিকে ভীতিতাড়িত করার জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে গলার স্বর ওই উচ্চগ্রামে ধরে রাখেন, আর তখনই তাঁর নতুন নকল দাঁতের সেটটি আবার নদীর স্রোতের মধ্যে ঝুপ করে পড়ে যায়। এর পর থেকে তিনি বাড়তি দাঁতের সেট সর্বত্র রাখতে শুরু করেন, বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়, তাঁর দেরাজের টানায়, তাঁর কোম্পানির তিনটি জাহাজের প্রত্যেকটিতে। তাছাড়া বাইরে খেতে যাবার সময় তিনি তাঁর কাশির ট্যাবলেটের বাক্সে এক সেট দাঁত ঢুকিয়ে সেটা তাঁর পকেটে রেখে দিতেন, কারণ একবার কড়া ভাজা শুয়োরের মাংস চিবুতে গিয়ে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল। পাছে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকেও অনুরূপ বিশ্রী বিস্ময়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাই তিনি ডাক্তার অ্যাডোনেকে প্রথম থেকেই ওর জন্য দু’সেট দাঁত বানিয়ে দিতে বললেন, একটা শস্তা উপাদান দিয়ে তৈরি, আপিসে দৈনন্দিন কাজের জন্য, অন্যটা রবিবার ও ছুটির দিনের জন্য, ওটায় মাঢ়ির দাঁত বাঁধানো থাকবে সোনা দিয়ে, তাতে করে বাস্তবতার একটা ছোঁয়া লাগবে। অবশেষে এক উৎসবের দিনে, রবিবার, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার নতুন স্বরূপতা নিয়ে রাস্তায় ফিরে এলো, মনে হল এই পৃথিবীতে তার স্থান অন্য কোনো একজন অধিকার করে নিলো।

    তার মায়ের মৃত্যু ঘটে এই সময়ে। বাড়িতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এখন একা থাকে। এটা ছিল চমৎকার এক পোতাশ্রয়, তার ভালোবাসার পদ্ধতির সঙ্গে অতিশয় সামঞ্জস্যপূর্ণ। চারিদিকের বাড়িতে অবশ্য অসংখ্য জানালা ছিল, তা থেকেই এই রাস্তার নাম, ওই জানালাগুলি দেখে মনে হত তার পেছনে পর্দার আড়ালে বুঝি অসংখ্য চোখ লুকিয়ে আছে, তা সত্ত্বেও বাড়িটির অবস্থান ছিল কৌশলগত দিক থেকে চমৎকার। কিন্তু এই বাড়ি তো বানানো হয়েছে ফারমিনা ডাজাকে, শুধু ফারমিনা ডাজাকে, সুখী করার জন্য, তাই তার সব চাইতে ফলপ্রসূ বছরগুলিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বহু সুযোগ হাতছাড়া হতে দিলো কিন্তু অন্য রকম প্রেম দিয়ে তার এই বাড়ি কলুষিত করলো না। সৌভাগ্যবশত কোম্পানিতে তার প্রতি ধাপ পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে গোপন সুযোগসমূহ, যার মধ্যে বাস্তব ক্ষেত্রে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি। দারোয়ানদের সহযোগিতায় এখন সে রাতের বেলায় কিংবা রবিবারে কিংবা ছুটির দিনে তার অফিসঘরটি ব্যবহার করতে পারে। একবার, তখন সে কোম্পানির প্রথম সহ-সভাপতি, এক রবিবারের কর্মচারী মেয়েকে নিয়ে সে জরুরি প্রেমলীলায় লিপ্ত হয়। নিজের চেয়ারে বসে মেয়েটিকে সামনে পা ছড়িয়ে বসিয়ে সে যৌন কর্ম শুরু করে, এমন সময় কোনো রকম সতর্ক ধ্বনি না করে হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে যায়, ভেতরে উঁকি দেন কাকা দ্বাদশ লিও, যেন ভুলক্রমে তিনি অন্য কোনো ঘরে ঢুকে পড়ছিলেন, চশমার কাচের ওপর দিয়ে তিনি বড় বড় চোখ করে ভ্রাতুষ্পুত্রকে লক্ষ করলেন, তারপর একটুও না চমকে বললেন, “কী কাণ্ড! তোমার বাবাও ঠিক এই ভাবেই এসব কাজ করতো।’ তারপর যাবার মুহূর্তে সুদূর পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, দরজাটা বন্ধ করে দেবার আগে বললেন, ‘আর, সিনোরিটা, স্বচ্ছন্দে চালিয়ে যান, আমি আমার আত্মমর্যাদার নামে শপথ করে বলছি আপনার মুখ আমি দেখি নি।’

    এ বিষয়ে দ্বিতীয় বার আর কোনো কথা হয় নি। কিন্তু পরের সপ্তাহ থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার আপিসে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সোমবার সকালে হুড় হুড় করে কয়েকজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি তার ঘরে ঢুকে পড়ে ছাদে একটা ঘূর্ণমান পাখা বসালো। আগে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকলো কয়েকজন তালা চাবির মিস্ত্রি, তারা এমন শব্দ করলো যে মনে হল তারা বুঝি যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। তারা দরজায় এমন একটা তালা লাগালো যেটা ভেতর থেকে হুড়কা দিয়ে বন্ধ করা যায়। তারপর এলো কাঠমিস্ত্রির দল। কোনো কারণ না দেখিয়েই তারা নানা মাপজোঁক নিলো। সোফাসেটির লোকজন এলো গাদাগাদা ছাপা সুতি কাপড় নিয়ে, দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিলছে কিনা দেখার জন্য। পরের সপ্তাহে ঘরে ঢুকলো একটা বিশাল ডবল-কাউচ, ডায়োনিসীয় আবহ মাখা ফুলের নকশা আঁকা কাপড়ে ঢাকা তার নরম গদি, তার বিশালত্বের কারণে ওটাকে দরজা দিয়ে ঢোকানো যায় নি, ঢোকাতে হয় জানালা পথে। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে ওরা এই কাজগুলি করে, এমন একটা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে যা অনিচ্ছাকৃত বলে মনে হয় না এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সব আপত্তির উত্তর তারা দিত একটিমাত্র বাক্যে ‘হেড অফিসের নির্দেশ।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কখনোই জানতে পারে নি এই সব অনাহূত হস্তক্ষেপের পেছনে তার কাকার কোনো অনুগ্রহ প্রদর্শন ছিল, নাকি তার অন্যায় আচরণের মুখোমুখি হতে তাকে বাধ্য করার জন্য এটা ছিল তার কাকার একটা একান্ত ব্যক্তিগত পদ্ধতি। প্রকৃত সত্যটি কখনোই তার মনে জাগে নি। আসলে কাকা দ্বাদশ লিও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে উৎসাহিতই করছিলেন, কারণ তিনি শুনেছিলেন যে ওর স্বভাব ও চালচলন বেশির ভাগ মানুষের চাইতে ভিন্ন রকম, আর এই প্রতিবন্ধকতার জন্যই তিনি তাকে তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে ঘোষণা করতে পারছিলেন না এবং এই বিষয়টি তাঁকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিলো।

    দ্বাদশ লিও লোয়াইজার পরিস্থিতি তাঁর ভাই-এর মতো ছিল না। তিনি ষাট বছরের স্থিতিশীল বিবাহিত জীবনযাপন করেছেন, তিনি জনক হন চার পুত্র ও এক কন্যার। তিনি তাদের সবাইকে তাঁর সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পর পর কয়েকটি আকস্মিক সংঘটনের ফলে, যেসব ঘটনা সমকালীন উপন্যাসে খুব প্রচলিত থাকলেও বাস্তব জীবনে তেমন কিছু ঘটতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করতো না, তাঁর চার পুত্রই এক এক করে মারা যায়, ঠিক সেই সময়ে যখন তারা ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হতে শুরু করেছিল। আর তাঁর কন্যার নদীভিত্তিক কোনো পেশার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, তার কাছে পঞ্চাশ মিটার উঁচু ভবনে বসে হাডসন নদীতে নৌযান চলাচল অবলোকন করাই ছিল বেশি আনন্দদায়ক। এ সময় একটা গল্প চালু হয়। পর পর যে আকস্মিক ঘটনাগুলি ঘটে তার পেছনে কোনো না কোনো ভাবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অশুভ চেহারা ও তার ভ্যাম্পায়ারের ছাতার একটা ভূমিকা ছিল কেউ কেউ এটা বিশ্বাসও করতো।

    যখন ডাক্তারের নির্দেশে কাকা অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা স্বেচ্ছায় তার রবিবাসরীয় প্রেম কিছু পরিমাণে বিসর্জন দিল। সে তার কাকার সঙ্গে তাঁর নির্জন গ্রামের আবাস স্থলে যেতে শুরু করলো, তাদের যানবাহন হল নগরীর একেবারে প্রথম মোটর গাড়িগুলির একটি। ওটা স্টার্ট দিতে হত সামনের হাতল ঘুরিয়ে আর তার পশ্চাদমুখী ধাক্কা ছিল এতো শক্তিশালী যে প্রথম ড্রাইভারের কাঁধের হাড় স্থানচ্যুত হয়ে যায়। কাকা-ভাইপো ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতো। বৃদ্ধ কাকা শুয়ে থাকতেন সিল্কের সুতায় তাঁর নামাঙ্কিত দোলনা-শয্যায়, সব কিছু থেকে দূরে, সমুদ্রের দিকে পিঠ রেখে, ক্রীতদাসদের পুরনো উপবনাঞ্চলে, চিরহরিৎ গুল্মের গন্ধে ভরপুর বারান্দা থেকে অপরাহ্ণ বেলায় দেখা যেতো সিয়েরার তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালার শৃঙ্গগুলি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও তার কাকা নদীপথে নৌ চলাচলের বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলাপ করতে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো না এবং এখনো এই মন্থর অপরাত্নগুলিতে, মৃত্যু যখন অদৃশ্য অতিথি হিসাবে সর্বদা উপস্থিত থাকতো, ওই একই অবস্থা বিরাজ করছিলো। কাকা দ্বাদশ লিওর একটা সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল, নদীপথে নৌ চলাচল ব্যবস্থা যেন কখনো ইউরোপীয় কর্পোরেশনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী দেশের অভ্যন্তরীল নয়া-উদ্যোক্তাদের হাতে চলে না যায়। তিনি বলতেন, ‘এ ব্যবসা সব সময় উপকূলাঞ্চলীয় মানুষদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এটা যদি দেশের মধ্যাঞ্চলের মানুষের করায়ত্ত হয় তাহলে তারা আবার তা জার্মানদের হাতে তুলে দেবে।’ তাঁর এই চিন্তা ছিল তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক না হলেও তিনি তাঁর এই মন্তব্য পুনরুচ্চারণ করতে ভালোবাসতেন : ‘আমার বয়স প্রায় একশো বছর হল, আমি সব কিছু বদলে যেতে দেখেছি, এমনকি মহাবিশ্বে তারার অবস্থান পর্যন্ত, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত এদেশে কোন কিছু বদলাতে দেখি নি। ওরা এখানে তিন মাস অন্তর অন্তর নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করে, নতুন আইন বানায়, কিন্তু আমরা এখনো বাস করছি ঔপনিবেশিক যুগে।’

    তাঁর মেসন ধর্মভাইরা সব অশুভ-অকল্যাণের দায়দায়িত্ব ফেডারালবাদের ওপর চাপিয়ে দিলে তিনি সর্বদা উত্তর দিতেন, ‘সহস্র দিবসের সংগ্রাম তেইশ বছর আগে ‘৭৬-এর যুদ্ধের সময়েই পরাজয় বরণ করে নিয়েছিল।’ রাজনীতির প্রতি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ঔদাসীন্য ছিল চরম পর্যায়ের। সে এই সব ঘন ঘন ক্রমবর্ধমান বিরক্তিকর বক্তৃতা শুনতো যেভাবে একজন মানুষ সমুদ্রের ধ্বনি শোনে সেই ভাবে। কিন্তু কোম্পানির কোনো কর্মসূচির কথা উঠলেই সে হয়ে উঠতো এক প্রচণ্ড তার্কিক। তার মত ছিল কাকার মতের বিপরীত। তার বিবেচনায় নদীপথে নৌ চলাচল ব্যবস্থার, যা সব সময়েই ছিল বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায়, যাবতীয় বাধাবিপত্তি একটিমাত্র কাজের মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব। জাতীয় কংগ্রেস ক্যারিবীয় নদী কোম্পানিকে নিরানব্বই বছর একদিনের জন্য যে একচেটিয়া নৌযানের অধিকার দিয়েছে তা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করলেই সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে। তার কাকা আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘আমার নামের মিতা লিওনা তার অপদার্থ নৈরাজ্যিক তত্ত্বাবলী দিয়ে তোমার মাথায় এই ধারণা ঢুকিয়েছে।’ কিন্তু এই কথাটা ছিল শুধু অর্ধসত্য। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল জার্মান কমোডোর জোহান বি. এলবার্স-এর অভিজ্ঞতা, যার মহৎ বুদ্ধিমত্তা মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিগত উচ্চাশার জন্য বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার কাকা অবশ্য মনে করতেন যে এলবার্সের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার কারণে তিনি ব্যর্থ হন নি, তিনি ব্যর্থ হন তাঁর অবাস্তব অঙ্গীকারসমূহের জন্য। তিনি এদেশের সমস্ত ভূগোলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে টেনে নিয়েছিলেন : এর নদীর নাব্যতা রক্ষা করা, বন্দরের স্থাপনাসমূহ, ভূমিতে প্রবেশপথ, যাতায়াত ব্যবস্থা সব কিছুর কর্তৃত্বভার তিনি নিজের হাতে গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাকা বলতেন, প্রেসিডেন্ট সাইমন বলিভারের তীব্র বিরোধিতা কোনো হাসির ব্যাপার ছিল না।

    তাঁর বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সহযোগীরা এই মতদ্বৈধতাকে দেখতো বিয়ের ব্যাপারে তর্কবিতর্কের মতো, যেখানে দু’পক্ষের যুক্তিই ছিল যথার্থ। বৃদ্ধের একগুঁয়েমি তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হত, এই জন্য নয় যে তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন, আগের মতো আর স্বপ্নচারী নেই, বরং এই জন্য যে তিনি এবং তাঁর ভাইরা, কারো সহায়তা ছাড়াই, সেই বীরত্বময় যুগে সারা বিশ্বের শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলেন তার ফসল তিনি এই ভাবে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন না। আর তাই, তিনি যখন তাঁর সমস্ত অধিকারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন যেন আইনগত সময় অতিক্রান্ত হবার আগে সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে তখন কেউ তাঁকে বাধা দিত না। কিন্তু অকস্মাৎ, যখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার সমস্ত হাতিয়ার সমর্পণ করে দিয়েছিল, তখন এক চিন্তাবিধুর অপরাহ্ণে কাকা দ্বাদশ লিও তাঁর শতবর্ষের সকল অধিকার ত্যাগ করতে রাজি হলেন, শুধু একটা সম্মানজনক শর্ত আরোপ করলেন তিনি, এটা তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ঘটবে না।

    এটা ছিল তাঁর শেষ কাজ। এর পর তিনি আর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলাপ করেন নি, কাউকে এসব সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে পরামর্শও করতে দেন নি, তাঁকে করুণা করতে পারে এমন কাউকে তাঁর সামনে আসা থেকে বিরত রাখতে তিনি সম্ভাব্য সব কিছু করেন। একটা ভিয়েনার দোল-চেয়ারে বসে তিনি আস্তে আস্তে দুলতেন, পরিচারক তাঁর পাশের টেবিলে সর্বদা রেখে যেতো এক পট গরম কালো কফি, আর বোরিক অ্যাসিড দেয়া এক গ্লাস জলে দু’ পাটি নকল দাঁত, যা তিনি কোনো দর্শনার্থী না এলে এখন আর পরতেন না, ওই ভাবে বসে তিনি তাঁর বারান্দা থেকে নিরন্তর বরফঢাকা সিয়েরা পবর্তমালা দেখতে দেখতে তাঁর দিনগুলি কাটিয়ে দিতেন। খুব অল্পসংখ্যক বন্ধুবান্ধবদের তিনি দেখা দিতেন, আর তিনি তাদের কাছে সুদূর অতীতের কথাই শুধু বলতেন, নদীপথে নৌ চলাচলেরও আগের কথা। কিন্তু এখনো তার আলাপের একটা নতুন বিষয় অবশিষ্ট ছিল : ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিয়ে করুক তাঁর ওই ইচ্ছার কথা।

    তিনি বলতেন, ‘আমার বয়স যদি পঞ্চাশ বছর কম হত তাহলে আমি আমার নামের মিতা লিওনাকে বিয়ে করতাম। ওর চাইতে ভালো স্ত্রীর কথা আমি কল্পনা করতে পারি না।‘

    তার এতো বছরের শ্রম শেষ মুহূর্তে এই অদৃষ্টপূর্ব পরিস্থিতিতে ব্যর্থ হয়ে যাবে সে আশঙ্কায় ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বুক কেঁপে উঠলো। সে বরং সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দেবে, মৃত্যুবরণ করবে, তবু ফারমিনা ডাজার সামনে সে হার মানবে না। সৌভাগ্যবশত কাকা দ্বাদশ লিও ও ব্যাপারে আর পীড়াপীড়ি করলেন না। তাঁর বিরানব্বই বৎসর বয়সে তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে একমাত্র উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে কোম্পানি থেকে অবসর নিলেন।

    ছয় মাস পরে, সর্বসম্মতিক্রমে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেকটারস-এর সভাপতি এবং জেনারেল ম্যানেজার পদে অভিষিক্ত হল। কার্যভার গ্রহণ করার দিন, শ্যাম্পেন পানের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন-পালার পর, তাঁর দোল- চেয়ার থেকে উঠে না দাঁড়াবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে অবসর গ্রহণ করা বৃদ্ধ সিংহ একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন, যা হয়ে দাঁড়াল অনেকটা মৃত্যু পরবর্তী শোকবাণীর মতো। তিনি বললেন, তাঁর জীবনের শুরু ও শেষ হয় দু’টি দৈব নিয়ন্ত্রিত ঘটনার মাধ্যমে। প্রথম, মুক্তিদাতা যখন তুরবাকো গ্রামে মৃত্যুর অভিমুখে তাঁর দুর্ভাগ্যপীড়িত ভ্রমণ করছিলেন তখন তিনি তাঁকে কোলে করে নিয়ে যান। দ্বিতীয়, নিয়তির বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি কোম্পানির জন্য একজন যোগ্য উত্তরাধিকারী খুঁজে পেয়েছেন। অবশেষে, নাটকটাকে অনাটকীয় করে তোলার জন্য তিনি উপসংহারে বললেন, ‘এই জীবন থেকে আমি শুধু একটা ব্যর্থতার অনুভূতি নিয়ে বিদায় নিচ্ছি, অসংখ্য শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে গান গাওয়ার পর আমি আমার নিজেরটায় গাইতে পারলাম না।’

    বলাই বাহুল্য যে তিনি টোস্কা অপেরার একটা গান দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি টানেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল তখনও অটল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মন আর্দ্র হয়ে ওঠে, কিন্তু তার প্রকাশ ঘটে শুধু ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সময় কণ্ঠস্বরের ঈষৎ কাঁপুনির মধ্যে। ঠিক এই ভাবেই সে তার জীবনে যা কিছু করেছে, যা কিছু ভেবেছে, যত উপরে উঠেছে, সব কিছুরই মূলে ছিল তার তীব্র দৃঢ় সঙ্কল্প, ফারমিনা ডাজার ছায়ায় তার নিয়তিকে সাফল্যমণ্ডিত করার মুহূর্তে সে জীবিত থাকবে, তার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

    তবে সে রাতে তার জন্য লিওনা কাসিয়ানি যে পার্টি দেয় সেখানে শুধু ফারমিনা ডাজার স্মৃতিই তার সঙ্গী হয় নি। তার সঙ্গী হয়েছিল আরো অনেকের স্মৃতি : যারা সমাধিক্ষেত্রে ঘুমিয়ে আছে, তার লাগানো গোলাপ গাছগুলির মধ্য থেকে যারা তার কথা ভাবছে; যারা এখনো সেইসব বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে যেখানে একদা তাদের স্বামীরা মাথা রেখেছিলো, চাঁদের আলোয় যাদের মাথায় দেখা যাচ্ছে সোনালি শিং। একজনকে না পেয়ে সে ওদের সবাইকে একই সঙ্গে একই সময়ে পেতে চেয়েছিল, যখনই তার বুকের মধ্যে ভয় জেগে উঠতো তখনই সে এই চাহিদা অনুভব করতো। তার সব চাইতে কঠিন সময়েও, সব চাইতে খারাপ মুহূর্তেও, সে তার এতো বছরের অসংখ্য প্রেমিকাদের সঙ্গে, যতো দুর্বলই হোক, একটা যোগসূত্র রক্ষা করে এসেছে, সে তাদের সবার জীবন সম্পর্কে সর্বদা খোঁজখবর রেখেছে।

    আর তাই সে রাতে তার মনে পড়লো রোসাল্বাকে, একেবারে প্রথম নারী, যে তার কৌমার্যের পুরস্কারটি ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যার স্মৃতি আজো তার মনে প্রথম দিনের মতোই বেদনা জাগিয়ে তোলে। চোখ বন্ধ করলেই সে ওর মসলিনের পোশাক পরা আর সিল্কের ফিতা লাগানো টুপি মাথায় চেহারা স্পষ্ট দেখতে পায়, জাহাজের ডেকে বসে তার ছেলের খাঁচায় দোল দিচ্ছে। তার জীবনের বিগত বছরগুলিতে সে বহুবার ওর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছে, ও কোথায় জানে না, তার শেষ নাম কি তাও জানে না, তাকেই সে খুঁজছে কিনা তাও জানে না, তবু তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে অর্কিডকুঞ্জের মধ্যে সে তাকে কোথাও না কোথাও খুঁজে পাবেই। কিন্তু প্রত্যেক বারই, শেষ মুহূর্তে কোনো বাস্তব অসুবিধা কিংবা তার নিজেরই ইচ্ছাশক্তির অসময়োচিত ব্যর্থতার জন্য, জাহাজের সিঁড়ি যখন টেনে তুলে ফেলা হচ্ছে তখন সে তার যাত্রা স্থগিত করে দেয়, আর এমন একটা কারণে যার সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে অবধারিত রূপে ফারমিনা ডাজা জড়িত ছিল।

    তার মনে পড়লো বিধবা নাজারেতের কথা, একমাত্র তার সঙ্গেই সে জানালার সরণীতে তার মায়ের গৃহের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করেছিল, যদিও সে নয়, তার মা-ই তাকে ডেকে এনেছিলেন। অন্যদের চাইতে তাকেই সে বেশি বুঝতো, কারণ বিছানায় তার মন্থরতা সত্ত্বেও তার মধ্য থেকে মমতার এতো উজ্জ্বল বিচ্ছুরণ ঘটতো যে ফারমিনা ডাজার অভাব সে অনেকখানি পূরণ করেছিল। কিন্তু তার স্বভাবচরিত্র ছিল গলির বেড়ালের মতো, তার মমত্বের শক্তির চাইতেও অদম্য, যার অর্থ ওরা দুজনই হয়ে উঠল বিশ্বাসভঙ্গকারী। তবু প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ওরা মাঝে মাঝেই পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, কারণ তাদের ছিল বন্ধুকধারীদের শ্লোক : ‘অবিশ্বস্ত কিন্তু আনুগত্যহীন নয়।’ একমাত্র বিধবা নাজারেতের ক্ষেত্রেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দায়িত্ব নিয়েছিল। সে যখন শুনলো যে ও মারা গেছে এবং নিঃস্বদের মতো তার কবর দেয়া হচ্ছে তখন ও নিজের খরচে তাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা করে, আর তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে শোক করার জন্য সেই ছিল একমাত্র ব্যক্তি।

    আর যেসব বিধবাদের সঙ্গে সে প্রেম করেছিল তাদের কথাও তার মনে পড়লো। যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের মধ্যে সব চাইতে বেশি বয়সের হল প্রুডেনসিয়া পিটার, সকলের কাছে সে পরিচিত ছিল দু’জনের বিধবা বলে, কারণ দুই স্বামীর মৃত্যুর পরও সে জীবিত ছিল। তার কথা মনে পড়লো ফ্লোরেন্টিনো আরিজার। অন্য প্রুডেনসিয়ার কথাও তার মনে পড়লো, আরেলানোর মহাপ্রেমিক বিধবা, যে পটপট করে তার কাপড়ের বোতামগুলি ছিঁড়ে ফেলতো, যেন আবার সেগুলি সেলাই করে যথাস্থানে লাগিয়ে দেবার সময়টুকু ফ্লোরেন্টিনোকে ওখানে কাটাতে হয়। আরো ছিল জোসেফা, জুনিগার বিধবা, তার প্রেমে এমন পাগল যে ওর বাগানের ফুল কাটার কাঁচি দিয়ে তার লিঙ্গ কর্তন করতে সে প্রস্তুত ছিল, যেন তার না হলে সে অন্য কারোও কখনো হতে না পারে।

    এঞ্জেলেস আলফারোর কথাও তার মনে পড়লো, সবার চাইতে স্বল্পক্ষণস্থায়ী, সবার চাইতে বেশি ভালোবাসার পাত্রী, যে ছ’মাসের জন্য সঙ্গীত বিদ্যালয়ে এসেছিল চেল্লো-বেহালা-বীণা ইত্যাদির বাদন শিক্ষাদানের জন্য। ফ্লোরেন্টিনোকে নিয়ে সে তার বাড়ির ছাদে অনেক চন্দ্রালোকিত রাত কাটিয়েছে, জন্মের সময় যে রকম সম্পূর্ণ নিরাভরণ ছিল ঠিক সেই রকম অবস্থায়, অদ্ভুত সুন্দর চেল্লো বাজাতো, আর তার সোনালি ঊরু দুটির মধ্যে ওই ধ্বনি যেন একটা মানবিক কণ্ঠ লাভ করতো। প্রথম চাঁদনি রাত থেকেই তাদের তীব্র প্রেমের অনভিজ্ঞতার দরুন উভয়েরই বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কিন্তু ও যেভাবে এসেছিল সে ভাবেই একদিন চলে গেল, এক সামুদ্রিক জাহাজে, বিস্মৃতির পতাকা উড়িয়ে, তার কোমল যৌনতা ও পাপী চেল্লো নিয়ে। চন্দ্রালোকিত ছাদে যা পড়ে রইলো তা হল একটি পতপত করা বিদায়কালীন সাদা রুমাল, দূর দিগন্তে একটা বিষণ্ণ নিঃসঙ্গ পায়রার মতো। সে যেন ছিল কবিতা উৎসবে পরিবেশিত এক পক্তি কবিতা। তার সঙ্গে থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা জিনিস শিখেছিলো, যদিও না উপলব্ধি করেই এ অভিজ্ঞতা তার ইতিমধ্যে কয়েকবার লাভ হয়েছিল : তুমি একই সময়ে কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমে করতে পারো, প্রত্যেকের সঙ্গে একই রকম বেদনা বোধে আক্রান্ত হতে পারো এবং কারো সঙ্গেই তোমার বিশ্বাসঘাতকতা করার দরকার হয় না। জাহাজঘাটার জনতার মধ্যে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ক্রোধে সে আপন মনে বলে উঠলো, ‘তোমার বুকের মধ্যে একটা বেশ্যালয়ের চাইতেও বেশি জায়গা আছে।’ এঞ্জেলেসের সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনায় সে অনর্গল অশ্রু বিসর্জন করলো। কিন্তু ওর জাহাজটা চক্রবালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মধ্যেকার সমস্ত জায়গা আবার অধিকার করে নিলো ফারমিনা ডাজার স্মৃতি।

    তার মনে পড়লো অ্যান্ড্রিয়া ভারোনের কথাও। গত সপ্তাহে সে ওর বাড়ির বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো, কিন্তু বাথরুমের গোলাপি আলো তাকে সতর্ক করে জানিয়ে দেয় যে এখন সে ঢুকতে পারবে না, তার আগে আরেক জন ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছে। আরেকজন : পুরুষ অথবা নারী, কারণ প্রেমের পাগলামির ক্ষেত্রে এই ধরনের খুঁটিনাটি নিয়ে অ্যান্ড্রিয়া ভারোনের কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। ফ্লোরেন্টিনোর তালিকায় যারা ছিল তার মধ্যে একমাত্র সে-ই দেহের বিনিময়ে জীবিকা অর্জন করতো, তবে সে ওটা করতো নিজের খুশিমতো, তার ব্যবসা দেখার জন্য তার কোনো ম্যানেজার ছিল না। ওই সময়ে প্রচ্ছন্ন বারাঙ্গণা হিসাবে তার খ্যাতি কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিলো, আর সে যথার্থই যোগ্য হয়ে উঠেছিলো তার অন্য নামটির, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই ভদ্রমহোদয়া।’ সে রাজ্যপাল ও রণতরীর প্রধানদের পাগল করে তুলেছিলো, বিখ্যাত যোদ্ধা ও লেখকরা, যদিও তারা যতোটা ভাবতেন ততটা বিখ্যাত তারা ছিলেন না, অবশ্য কেউ কেউ ছিলেন, তারা ওর কাঁধে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলতেন। আর প্রেসিডেন্ট রাফায়েল রেয়েস, নগরীতে তাঁর ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যে, ওর সঙ্গে দ্রুত আধ ঘণ্টা সময় কাটান এবং আইন মন্ত্রণালয়ে ওর উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য ওকে একটা পেনশন প্রদান করেন, যদিও সেখানে সে তার জীবনের একদিনের জন্যও কোনো কাজ করে নি। তার দেহের মাধ্যমে যতটুকু আনন্দ সে দিতে পারতো তা সে সানন্দে বিতরণ করতো। সবাই তার অশোভন কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকলেও কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ আনতো না, কারণ তার কুকর্মের খ্যাতনামা সহযোগীগণ যেমন নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেন তেমনি তার সুরক্ষার ব্যবস্থাও করতেন, তাঁরা জানতেন যে কোনো কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ হলে ওর চাইতে তাঁদেরই ক্ষতি হবে বেশি। তার ক্ষেত্রেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভালোবাসার জন্য অর্থ না প্রদানের তার পবিত্র নীতি ভঙ্গ করে, আর অ্যান্ড্রিয়া ভারোন-ও পয়সা ছাড়া দেহ দান না করায় তার নীতি ভঙ্গ করে শুধু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্যই। তাকে উপভোগ করতে চাইলে তার স্বামীকেও পয়সা দিতে হত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও অ্যান্ড্রিয়া ভেরোনা একটা ব্যবস্থায় সম্মত হল, তারা প্রতীকী মূল্য হিসাবে এক পেসো আদান-প্রদান করবে, তবে অ্যান্ড্রিয়া তা নিজের হাতে গ্রহণ করতো না, আর আরিজাও তা ওর হাতে তুলে দিতো না। তারা উভয়ে একটা খেলনা ব্যাংকে ওই পয়সা ফেলে দিতো এবং যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হবার পর তারা একদিন লেখকদের চত্বরে গিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা একটা সুন্দর জিনিস কিনলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সঙ্কটের সময় তাকে এনিমা নিতে হত। এর মধ্যে যে একটা বৈশিষ্ট্যময় ইন্দ্রিয়পরায়ণতা আছে তা অ্যান্ড্রিয়া ভেরোনাই তাকে বুঝিয়ে দেয় এবং তারপর তারা দুজনে একসঙ্গে এনিমা নিয়ে তাদের উন্মত্ত অপরাহ্ণগুলিতে তাদের প্রেমের মধ্যে আরো নতুন প্রেম সৃষ্টি করার প্রয়াস পেতো।

    তার এতগুলি বিপজ্জনক মিলন পর্বের মধ্যে সে যে মাত্র একটি নারীর কাছ থেকে এক বিন্দু তিক্ততার স্বাদ পেয়েছিলো সেটাকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার সৌভাগ্য বলে বিবেচনা করতো। ওই নারী ছিল বঙ্কিম দেহধারিণী সারা নরিয়েগা, যার শেষ দিনগুলি কাটে ডিভাইন কোপার্ডেস পাগলা গারদে। সেখানে সে এমন অসম্ভব অশ্লীল জরাগ্রস্ত কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে যে তাকে আলাদা করে রাখতে হয়, নইলে সে অন্য পাগলিনীদের আরো পাগল করে দিতো। তবে, আর.সি.সি.র পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আর কাউকে দিয়ে ফারমিনা ডাজার স্থান পূরণের চেষ্টা করার মতো বিশেষ সময় বা ইচ্ছা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ছিল না। ধীরে ধীরে সে একটা নিয়মের মধ্যে চলে আসে, সে শুধু তাদের ওখানে যেতো যারা ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে তাদের সঙ্গে শুতো, যতক্ষণ তার ভালো লাগতো, যতক্ষণ তার পক্ষে সম্ভব হতো, যত দিন তারা বেঁচে থাকতো। যে পেন্টেকস্ট রবিবার জুভেনাল উরবিনো যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তার জন্য অবশিষ্ট ছিল একজন, মাত্র একজন, যার বয়স সবে চৌদ্দ পূর্ণ হয়েছে এবং তখন পর্যন্ত তাকে প্রেমে পাগল করে দেবার মত যা কারো কাছে ছিল না তার সব কিছুই ছিল ওই মেয়ের মধ্যে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.