Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ২

    ২

    উপসাগরের ওপাশে, লা মাঙ্গা আবাসিক জেলায়, ডাক্তার উরবিনোর বাসভবন দাঁড়িয়ে ছিল অন্য এক যুগে। একতলা ভবন, প্রশস্ত ও শীতল, বহিচত্বরের দ্বারমণ্ডপে প্রাচীন গ্রিক ধাঁচের স্তম্ভ, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পচা জলাভূমির শান্ত স্থির জলরাশি আর উপসাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজগুলির ভাঙাচোরা আবর্জনার স্তূপ। প্রবেশ দ্বার থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত মেঝে সাদাকালো চৌখুপি নকশার টালিতে ঢাকা, অনেকেই এটাকে ডাক্তার উরবিনোর অন্যতম নেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেন, তারা ভুলে যেতেন যে শতাব্দির গোড়ার দিকে যে ক্যাটালোনীয় কারিগররা নব্যধনী সম্প্রদায়ের জন্য এই শহর গড়ে তুলেছিলো তাদের সবারই এ ধরনের নকশার প্রতি একটা সাধারণ দুর্বলতা ছিল। বড় বসার ঘরের ছাদ ছিল খুব উঁচু, গোটা বাড়িতেই তা ছিল ওই রকম, রাস্তার দিকে মুখ করা পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছটা জানালা ছিল ওই ঘরে, আর খাবার ঘর থেকে বসার ঘরকে আলাদা করে রেখেছিল একটা সুবিশাল কাচের দরজা, যার গায়ে আঁকা আছে দ্রাক্ষালতা আর থোকাথোকা আঙুর আর ব্রোঞ্জের কুঞ্জবনে বন-দেবতাদের বাঁশির সুরে কাম-প্রলুব্ধ কুমারীকুল। বসার ঘরে জীবন্ত এক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা পেন্ডুলাম ঘড়িটিসহ অভ্যর্থনা কক্ষগুলির যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম ছিল ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকের খাঁটি বিলেতি কাজ, আর দেয়াল থেকে যে সব বাতি ঝুলছিল সেগুলি সব ছিল অশ্রুবিন্দু স্ফটিকের, তাছাড়া সর্বত্রই সাজানো ছিল সেভার্সের বিখ্যাত ফুলদানি ও গোল বাটি, আর ছিল পৌত্তলিক যুগের শান্ত মধুর পল্লী জীবনভিত্তিক কাহিনী থেকে নেয়া সাদা পাথরের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি। কিন্তু ওই ইউরোপীয় সঙ্গতি বাসভবনের বাকি অংশে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে যায়, সেখানে বেতের আরাম কেদারার সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে ভিয়েনার দোল-চেয়ার আর স্থানীয় কারিগরদের তৈরি পা রাখার জন্য চামড়ার নিচু টুল। শোবার ঘরে বিছানার পাশে ঝুলছে সান জাসিন্টোর অপূর্ব দড়ির দোলনা শয্যা, দু’পাশে নানা বর্ণের ঝালর আর সিল্কের সুতা দিয়ে গথিক হরফে মালিকের নাম এম্ব্রয়ডারি করে লেখা। খাবার ঘরের পাশে যে স্থানটুকু আনন্দ- উৎসবমুখর বিশেষ নৈশভোজের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল এখন তা সংগীতকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত সংগীতশিল্পীরা যখন শহরে আসেন তখন এখানে অন্তরঙ্গ ঘরোয়া কনসার্টের আয়োজন করা হয়। নীরবতাকে বাড়াবার জন্য পারীতে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলা থেকে কেনা তুরস্কের গালিচা দিয়ে টালিগুলি আবৃত করা হয়েছে। এ ঘরে একটা সাম্প্রতিক মডেলের গ্রামোফোন আছে, তার পাশে টেবিলে সযত্নে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু রেকর্ড, আর এক কোনায় আছে ম্যানিলা শাল দিয়ে ঢাকা একটা পিয়ানো, যা ডাক্তার উরবিনো আজ বহু বছর ধরে বাজান নি। সারা বাড়ির সর্বত্র একজন নারীর সুবিবেচনা ও যত্নের ছাপ নির্ভুল ভাবে চোখে পড়ে, যে নারীর পদযুগল মাটিতেও দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। কিন্তু লাইব্রেরি ঘরে যে সযত্ন সুন্দর গাম্ভীর্য বিরাজ করতো তা বাড়ির আর কোনো ঘরে দেখা যেত না। বার্ধক্যের হাতে মৃত্যুবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর পাঠাগার হয়ে উঠেছিল ডাক্তার উরবিনোর পবিত্র আশ্রয়স্থল। সেখানে তাঁর পিতার আখরোট কাঠের ডেস্ক ও পাখির পালক ভর্তি চামড়ার আরাম- কেদারাগুলির চারপাশে দেয়াল জুড়ে, এমনকি জানালার তাকে ও কাচের দরজার পেছনে, পাগল করে দেয়া শৃঙ্খলার সঙ্গে তিনি তাঁর তিন হাজার বই হুবহু একই রকম করে নরম চামড়ায় বাঁধিয়ে বই-এর পুটে সোনার জলে নিজের নামের আদ্যাক্ষর লিখিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। বন্দরের কোলাহল ও দুর্গন্ধময় বাতাস অন্য ঘরগুলিতে যে ভাবে ঢুকতো এখানে সে রকম ঢুকতে পারতো না, পাঠাগারে বিরাজ করতো সন্তদের মঠের প্রশান্তি ও সুগন্ধ। ক্যারিবীয় কুসংস্কার অনুযায়ী লোকজন ঘরের দরজা- জানালা খুলে রাখতো যেন ঘর ঠাণ্ডা হতে পারে, বস্তুতপক্ষে যে ঠাণ্ডার কোন অস্তিত্বই ছিল না। ওই কুসংস্কারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে ও বেড়ে উঠে ডাক্তার উরবিনো ও তাঁর স্ত্রী প্রথম যখন তাদের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতেন তখন তাদের খুব মানসিক কষ্ট হতে থাকে। কিন্তু গরমের বিরুদ্ধে রোমানদের কৌশলের সারবত্তা তারা উপলব্ধি করেন। আগস্টের জড়তার সময় রাস্তা থেকে ভেসে আসা উত্তপ্ত হাওয়াকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য দিনে তারা তাদের ঘর বন্ধ রাখতেন, আর পরে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া প্রবেশ করার জন্য সব খুলে দিতেন হাট করে। এর পর থেকে লা মাঙ্গার ক্রোধোন্মত্ত সূর্যের নিচেও তাদের বাড়িই ছিল শীতলতম গৃহ, অন্ধকার করে রাখা শয়নকক্ষে স্বল্পকালীন দিবানিদ্রা ছিল একটা আনন্দের ব্যাপার। অপরাহ্ণে দ্বারমণ্ডপে বসে নিউ অর্লিয়ান্সের দিক থেকে আসা ভারি ভারি ছাই রঙা মালবাহী জাহাজগুলিকে চলে যেতে দেখা, আর গোধূলিলগ্নে ঝলমলে বাতি জ্বালিয়ে কাঠের প্যাডেল চালিত নৌকাগুলিকে নদীর বুকে আসা-যাওয়া করতে দেখা, আর তাদের সঙ্গীতের ধ্বনিতে উপসাগরের বদ্ধ আবর্জনার গন্ধকে কিছুটা পরিশুদ্ধ করার অনুভূতি, সে সবও ছিল মহা আনন্দের ব্যাপার। তারপর ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত, যখন উত্তুরে হাওয়া লোকজনের বাড়ির ছাদ উড়িয়ে নিয়ে যেত, যখন রাতভর সেই হাওয়া কোনো ফাঁক দিয়ে চট করে ঢুকে যাওয়া যায় কিনা ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তা খুঁজে বেড়াতো, তখনো এই বাড়িই ছিল এ অঞ্চলের সব চাইতে সুরক্ষিত বাড়ি। এই রকম সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর গড়া একটা বিয়ে যে সুখের হবে না, তা ভাবার কোনো কারণই কেউ দেখতে পায় নি।

    কিন্তু সেদিন সকালে দশটার আগেই ডাক্তার উরবিনো যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন তিনি কোনো রকম সুখই অনুভব করেন নি। যে দুটি জায়গায় আজ তিনি যান তার ফলে শুধু যে পেন্টেকস্ট উপাসনায় তিনি যোগ দিতে পারেন নি তাই নয়; এতদিন যেখানে সব কিছু সম্পূর্ণ মনে হয়েছিল এখন যেন সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে, তাও এই বয়সে। ব্যাপারটা তাঁর মোটেও ভালো লাগলো না। ডাক্তার লুসিডে অলিভেল্লার আনন্দমুখর মধ্যাহ্ন ভোজ সভায় যাবার আগে তিনি অল্পক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু বাইরের উঠানে ভৃত্যকুল খুব হইচই করছিল। পাখা ছেঁটে দেবার জন্য ওরা তাঁর তোতা পাখিটা খাঁচা থেকে বের করে এনেছিল। ওটা এখন উড়ে গিয়ে আম গাছের সর্বোচ্চ ডালে বসে আছে। তাকে পাকড়াও করার জন্যই ওই হইচই। বিশাল পুচ্ছকে ছোট করে দেয়া ওই ক্ষ্যাপা তোতা আদেশ করলেই কথা বলতো না, কিন্তু যখন কেউ আশা করছে না তখনই সে এতো সুস্পষ্ট ভাবে ও যুক্তি সহকারে কথা বলে উঠতো যে মানুষের মধ্যেও তা ছিল বিরল। ডাক্তার উরবিনো নিজে তাকে শিখিয়েছিলেন, সেই সুবাদে পাখিটা তাঁর কাছ যে সব সুবিধা নিতে পারতো আর কেউ তা পারতো না, এমনকি তাঁর সন্তানরা ছোট থাকার সময়ও তা পারে নি।

    ওই তোতা এ বাড়িতে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাস করছে। এর আগে অন্যত্র সে কতো দিন বেঁচে ছিল তা কেউ জানে না। প্রত্যেক দিন অপরাহ্ণে দিবানিদ্রার পর ডাক্তার উরবিনো তাকে নিয়ে উঠানের চত্বরে বসেন, বাড়ির সব চাইতে ঠাণ্ডা জায়গাটাতে, তারপর তাঁর শিক্ষা-বিজ্ঞানের সবটুকু জ্ঞান ও শক্তি দিয়ে তিনি তাকে শিক্ষা দান করতেন এবং এক সময় ওই তোতা পাখি একজন পাক্কা অ্যাকাডেমিশিয়ানের মতো ফরাসি বলতে লাগলো। তারপর, নেহাৎ ভালবেসে, ডাক্তার তাকে প্রার্থনার সহগামী সঙ্গীত শেখালেন, ল্যাটিনে, আরো শেখালেন সন্ত ম্যাথু বর্ণিত গসপেলের নির্বাচিত অংশ। তিনি তাকে গণিতের চার প্রধান সূত্রগুলিও শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা সফল হয় নি। তাঁর শেষ দিকের ইউরোপ ভ্রমণের সময় তিনি সেখান থেকে একবার একটা গ্রামোফোন নিয়ে আসেন, হাতির শুঁড়ের মতো স্পিকার লাগানো, সবে তা বাজারে বেরিয়েছিল। সেই সঙ্গে তিনি নিয়ে আসেন সাম্প্রতিকতম জনপ্রিয় কয়েকটি গানের রেকর্ড আর তাঁর প্রিয় ধ্রুপদী সুরকারদের কিছু কাজ। তারপর কয়েক মাস ধরে, দিনের পর দিন, বারবার, তিনি ইভেট গিলবার্ট ও অ্যারিস্টাইড ব্রুয়াতেঁর গান বাজাতে থাকেন। ওই দুই শিল্পী বিগত শতাব্দিতে তাঁদের গান দিয়ে ফ্রান্সকে মুগ্ধ করেছিলেন। বারবার শুনতে শুনতে শেষে ওদের গান তোতা পাখিটির মুখস্থ হয়ে গেল, মেয়ের গানগুলি সে গাইতো মেয়ের গলায় আর পুরুষের পুরুষ কণ্ঠে, আর সব শেষে সে প্রগলভ ভঙ্গিতে হা হা করে ভেসে উঠতো, তাকে ফরাসি ভাষায় গান গাইতে শুনে কাজের মেয়েরা যেভাবে হাসতো তাকে নিখুঁত অনুকরণ করে। তার গুণাবলীর কথা এতো ছড়িয়ে পড়েছিল যে দূর- দূরান্ত থেকে বিশিষ্টজন এ শহরে এলে তাকে দেখার অনুমতি প্রার্থনা করতো, আর, একবার, কলার জাহাজে আসা কয়েকজন ইংরেজ পর্যটক তাকে যে কোনো মূল্যে কিনে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে তার সবচাইতে বড় গৌরবের দিন আসে যখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ডন মার্কো ফিডেল সুয়ারেজ তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গসহ তাকে দেখতে এ বাড়িতে আসেন। পাখিটার খ্যাতি কতটুকু সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত তিনি যা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। ওরা এখানে এসে পৌঁছান বিকাল তিনটার দিকে। সরকারি সফরে তাঁরা এই তিন দিন ধরে পরে ছিলেন লম্বা কোট আর উঁচু টুপি। ওই অপরাহে আগস্টের তাতানো আকাশের নিচে তাঁরা গরমে হাঁসফাঁস করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই কৌতূহল নিয়ে ফিরে যেতে হয় যে কৌতূহল নিয়ে তাঁরা এসেছিলেন। তাকে প্রচুর অনুনয়, অনুরোধ, ভীতি প্রদর্শন করা, ডাক্তার উরবিনোর অপমানের কথা বলা, সব রকম চেষ্টা করেও তোতার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের করা যায় নি। ডাক্তারের স্ত্রী অবশ্য স্বামীকে বারবার বলেছিলেন তিনি যেন ওঁদেরকে এই হঠকারি আমন্ত্রণ না জানান।

    ওই ঐতিহাসিক ঔদ্ধত্যের ঘটনার পরও তোতাটি যে তার সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিল তাই ছিল তার ঐশ্বরিক অধিকারের সব চাইতে বড় প্রমাণ। বাড়ির অভ্যন্তরে ওই পাখিটি ছাড়া আর কোনো পশু-পাখির প্রবেশাধিকার ছিল না। একটা ব্যতিক্রম অবশ্য ছিল। একটা মেঠো কচ্ছপ। সবই ভেবেছিল কচ্ছপটা বোধ হয় চিরতরে হারিয়ে গেছে কিন্তু তিন-চার বছরের অনুপস্থিতির পর সে হঠাৎ একদিন রান্নাঘরে এসে হাজির হয়েছিল। তবে তাকে জীবন্ত কোনো প্রাণী বলে মনে করা হতো না। সবাই তাকে সৌভাগ্যের মায়াবি গুণবিশিষ্ট একটা খনিজ বস্তু বলেই মনে করতো এবং তার অবস্থান যে কখন কোথায় সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত হতে পারতো না। জন্তু-জানোয়ারের প্রতি ডাক্তার তাঁর ঘৃণার বিষয়টি স্বীকার করতে চাইতেন না। এই মনোভাব তিনি নানা রকম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও দার্শনিক তত্ত্বাবলীর আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন, অনেকে তাঁর যুক্তি মেনেও নিয়েছিলেন, কিন্তু ওসব দিয়ে তিনি কখনো তাঁর স্ত্রীর বিশ্বাস উৎপাদন করাতে সক্ষম হন নি। ডাক্তার উরবিনো বলতেন, যেসব লোক জন্তু-জানোয়ারকে অতিরিক্ত মাত্রায় ভালবাসে তারা মানুষের প্রতি সর্বাধিক নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে। তিনি বলতেন কুকুর অনুগত নয়, ক্রীতদাসসুলভ; বিড়াল সুবিধাবাদি ও বিশ্বাসঘাতক; ময়ূর মৃত্যুর অগ্রদূত, আমেরিকান তোতা পাখি শুধু সুদর্শন, বিরক্তি উৎপাদক, খরগোশ লোভের পরিপুষ্টিদাতা, বানর তীব্র কামনার বাহক, আর মোরগ অভিশপ্ত প্রাণী, কারণ যিশু খ্রিস্টকে তিনবার প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে তার একটা ভূমিকা ছিল।

    পক্ষান্তরে, ফারমিনা ডাজা, তাঁর স্ত্রী, যিনি তার বর্তমান ৭২ বছর বয়সে তাঁর তরুণীকালের হরিণীর পদক্ষেপ আর বজায় রাখতে পারেন নি, তিনি ছিলেন গ্রীষ্মমণ্ডলীর যাবতীয় ফুল এবং গৃহপালিত পশুর এক অসম্ভব যুক্তিহীন পূজারিণী এবং বিয়ের প্রথম দিকেই প্রেমের অভিনবত্বের সুযোগ নিয়ে তিনি তার বাড়িকে ওই সব জিনিসে এতো বেশি পূর্ণ করে তুলেছিলেন যে তার মধ্যে খুব বেশি বুদ্ধি বা বিবেচনার পরিচয় ছিল না। প্রথমে সংগৃহীত হলো তিনটি ডালমেশীয় কুকুর, যাদের নাম রাখা হয় তিন রোমান সম্রাটের নামে। ওরা এক কুকুরীর অনুগ্রহ লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি করতো, কুকুরীর নাম রাখা হয় মেসালিনা। সে তার নামের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে দশটি বাচ্চা গর্ভে ধারণ করার জন্য যে সময় নিয়েছিল তার চেয়ে বেশি সময় নেয় নয়টি বাচ্চা জন্ম দিতে। ওরা ছাড়াও ছিল কয়েকটি আবিসিনীয় বিড়াল, তাদের মুখের পাশটা দেখাতো ঈগলের মতো, আরো ছিল ট্যারা চোখের শ্যাম দেশীয় বিড়াল আর কমলা রঙের চোখের পারসিক বিড়াল, ওরা ঘরের মধ্যে আবছা প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াত আর তাদের প্রেতিনীর প্রেম-চিৎকার দ্বারা রাতের অন্ধকারকে খানখান করে গুঁড়িয়ে দিতো। কয়েক বছরের জন্য আরো ছিল অ্যামাজান অঞ্চলের একটি বানর, তাকে উঠানে আম গাছের সঙ্গে কোমরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তার জন্য এক ধরনের অনুকম্পা বোধ করতো অনেকে, কারণ তার দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারা ছিল আর্চবিশপ অবডুলিও ই রে-র মতো, সেই একই সরল চোখ, সেই বাঙ্ময় হাত। কিন্তু ফারমিনা ডাজা বানরটাকে এই কারণে অব্যাহতি দেন নি, তিনি তাকে অব্যাহতি দেন এই কারণে যে মহিলাদের সম্মানে আত্মসুখ বিধানের বদ অভ্যাসটি সে রপ্ত করে ফেলেছিল।

    এ সব ছাড়াও বাড়ির বিভিন্ন বারান্দা জুড়ে খাঁচায় খাঁচায় ছিল সর্বপ্রকার গুয়েতেমালীয় পাখি, জলাভূমির লম্বা চঞ্চু বিশিষ্ট পাখি, দীর্ঘ হলুদ পা বিশিষ্ট সারস পাখি, আরো ছিল একটা তরুণ হরিণ যেটা ফুলের টবের লতাপাতা খাবার জন্য জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়তো। এখানকার শেষ গৃহযুদ্ধের অল্প আগে, প্রথম বারের মতো পোপের সম্ভাব্য সফরের কথা উঠলে, তারা গুয়েতেমালা থেকে একটা স্বর্গ-পাখিও আনিয়েছিল, কিন্তু পরে যখন জানা গেল যে পোপের ঐ সফরের কথাটা ছিল ষড়যন্ত্রকারী উদারপন্থীদের ভয় দেখাবার জন্য সরকারের একটা মিথ্যা প্রচারণা মাত্র তখন পাখিটিকে ফেরত পাঠানো হয়, তবে তাকে এখানে আনতে যত সময় লেগেছিল ফেরত পাঠাবার সময় তার চাইতে কম সময় লাগে। আরেকটি ঘটনা ছিল আরো চমকপ্রদ। বালিকা বয়সে তাঁর পিতৃগৃহে ফারমিনা ডাজার ছয়টি সুরভিত কাক ছিল। এখন বিবাহিতা রমণী হিসেবেও এই বাড়িতেও তাঁর ওই রকম কাক রাখার প্রবল ইচ্ছা জাগে। সেই ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে কুরাকাও থেকে আসা চোরাকারবারীদের জাহাজে করে বেতের খাঁচায় পুরে তার জন্য ঠিক একই রকমের ছয়টি সুরভিত কাক আনা হয়। কিন্তু তাদের অনবরত পাখা ঝাপটানি আর তার ফলে সারা বাড়িময় শব- শোভাযাত্রার সময়ের ফুলের মালার গন্ধ সবার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফারমিনার জন্য চার মিটার লম্বা একটা বিশাল অ্যানাকন্ডা সাপও নিয়ে আসা হয়েছিল। তার নিদ্রাহীন শিকারির শ্বাস-প্রশ্বাস শোবার ঘরের অন্ধকার বিঘ্নিত করলেও বর্ষার মাসগুলিতে বাড়িতে হামলা চালানো বাদুড়, গিরিগিটি আর অসংখ্য অপকারী পোকা- মাকড়দের ভীত করে তোলার উদ্দেশ্য ঠিকই সাধিত হয়। ওই সময়ে ডাক্তার উরবিনো তাঁর পেশাগত দায়িত্ব এবং তাঁর নাগরিক ও সাংস্কৃতিক কাজে এতটাই আপাদমস্তক নিমগ্ন ছিলেন যে তিনি এই ধারণা নিয়েই তৃপ্ত থাকতেন যে তাঁর স্ত্রী শুধু ক্যারিবীয় অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী মহিলাই ছিলেন না, অধিকন্তু তিনি ছিলেন তার সব চাইতে সুখী রমণীও। কিন্তু এক বর্ষণসিক্ত অপরাহ্ণে সারা দিনের কাজের শেষে চরম ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে তিনি যে ভয়ানক বিপর্যয়ের দৃশ্য দেখলেন তা তাঁকে তাঁর বিচারবুদ্ধি ফিরিয়ে দিল। বসার ঘর থেকে এবং যত দূর দৃষ্টি যায় তত দূর পর্যন্ত, একটা বিশাল রক্তস্রোতের মধ্যে একগাদা মৃতপশু ভাসছে। কাজের মেয়েগুলি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে বুঝতে পারছে না, হত্যাযজ্ঞের আতঙ্ক থেকে তারা এখনও নিজেদের সামলে তুলতে পারে নি।

    পাহারা দেয়ার কাজে দক্ষ একটা বৃহদাকার শক্তিশালী জার্মান কুকুর হঠাৎ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে পাগল হয়ে যায়, তারপর তার সামনে যে পশুকেই সে দেখতে পায় তাকেই ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। শেষে পাশের বাড়ির মালী প্রচণ্ড সাহস করে তার বড় ক্ষুরধার দা নিয়ে কুকুরটার মুখোমুখি হয় এবং তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। কটা প্রাণীকে কুকুরটা কামড়েছে বা তার সবুজাভ লালা দিয়ে সে কটিকে সংক্রমিত করেছে তা কেউ বলতে পারবে না, তাই ডাক্তার উরবিনো বেঁচে যাওয়া বাকি প্রাণীগুলিকে মেরে ফেলবার আদেশ দিলেন, তারপর তাদের মৃতদেহ একটা বিচ্ছিন্ন মাঠে পুড়িয়ে ফেলা হলো। সমস্ত বাড়িটাকে পুরোপুরি সংক্রমণমুক্ত করার জন্য তিনি মিসারিকোর্ডিয়া হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন। যে একটি মাত্র প্রাণী এ প্রক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়, কারণ তার কথা কারো মনেই হয় নি, সে হলো সৌভাগ্যের মায়াবি গুণসম্পন্ন বিশালাকার কচ্ছপটি।

    ফারমিনা ডাজা প্রথম বারের মতো স্বীকার করলেন যে অন্তত একটা গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর মনোভাব ছিলো সঠিক। এর পর বহু দিন যাবৎ পশু-পাখি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুব সতর্ক। লিনিয়াসের ন্যাচারাল হিস্ট্রি গ্রন্থের রঙিন ছবি দেখেই তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন। তিনি ওই সব ছবি বাঁধাই করে বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন। এই সময়ে একটা ঘটনা না ঘটলে তিনি এই বাড়িতে পশু-পাখি দেখার সব আশা চিরতরে জলাঞ্জলি দিতেন। একদিন খুব ভোরের দিকে চোর বাথরুমের জানালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে পাঁচ প্রজন্ম ধরে রক্ষিত এই পরিবারের রুপার বাসন-কোসন ও থালা-বাটি নিয়ে চম্পট দেয়। ডাক্তার উরবিনো জানালায় জোড়া তালা লাগালেন, ঘরের দরজার ভেতর দিকে আড়াআড়ি করে লোহার পাল্লা বসালেন, তাঁর সব চাইতে মূল্যবান জিনিসপত্র সিন্দুকে উঠিয়ে রাখলেন এবং ঈষৎ দেরি হয়ে গেলেও তাঁর যুদ্ধকালীন অভ্যাস অনুযায়ী রাতে ঘুমাবার সময় বালিশের নিচে তাঁর পিস্তলটা আবার রাখতে শুরু করলেন। কিন্তু একটা হিংস্র কুকুর কেনার প্রস্তাবে, সে কুকুর টিকা দেয়া হোক বা না হোক, ছাড়া থাকুক বা শেকলে বাঁধা থাকুক, তিনি রাজি হলেন না, চোর তাঁর সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে গেলেও তিনি তা করবেন না।

    তিনি জানিয়ে দিলেন, কথা বলতে পারে না এমন কোনো কিছু আর কখনো এ বাড়িতে ঢুকবে না।

    তাঁর স্ত্রী যখন আবার একটা কুকুর কেনার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং তার পক্ষে নানা আপাত যথার্থ যুক্তি দেখাতে থাকেন তখন ওই সব যুক্তিতর্ক থামিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ডাক্তার উপরোক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন, কিন্তু সে সময় তিনি কল্পনাও করেন নি যে তাঁর ওই অতি দ্রুত সাধারণীকৃত উক্তির মূল্য তাঁকে একদিন নিজের প্রাণ দিয়ে দিতে হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ডাজার সহজবোধ্য চরিত্র বেশ সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছিল। তিনি তাঁর স্বামীর সাধারণ উক্তিটিকে আঁকড়ে ধরলেন এবং চুরির ঘটনার বেশ কয়েক মাস পরে কুরাকাও থেকে আসা জাহাজে আবার গিয়ে একটা রাজকীয় পারামারিবো তোতা পাখি ক্রয় করলেন। পাখিটার জন্য তিনি বারো সেন্টাভোর অসম্ভব চড়া দাম দিলেন, তবে তা খুব অন্যায্য হয় নি। নাবিকরা যে অশালীন ভাষায় ঈশ্বর ও ধর্মকে আক্রমণ করতো সেই তোতা সেসব ছাড়া আর কিছুই বলতে না পারলেও ওই গালাগালগুলি সে উচ্চারণ করতো অবিশ্বাস্য মানবিক গলায়। ওটা ছিল চমৎকার একটা তোতা পাখি, যে রকম দেখাতে তার চাইতে হালকা ওজনের, হলুদ মাথা, কালো জিভ, শুধু ওটা দিয়েই তাকে গোরান বনের তোতা থেকে আলাদা করে চেনা যেত, যে সব তোতাদের তার্পিন তেলের জোলাপ দিয়েও কথা বলতে শেখানো যেত না। ডাক্তার উরবিনো প্রশান্ত চিত্তে পরাজয় মেনে নিতে জানতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর উদ্ভাবনপটুতার সামনে নতি স্বীকার করলেন এবং কাজের মেয়েদের দ্বারা উত্তেজিত হবার পর পাখিটির আচার-আচরণ দেখে তিনি যে সত্যিই মজা পাচ্ছেন তা উপলব্ধি করে একটু বিস্মিতও হলেন।

    বৃষ্টির দিনে তার পালকগুলি বর্ষাস্নাত হবার আনন্দে পাখিটির মুখের আগল খুলে যেত, তখন সে অন্য এক যুগের শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করতো, এ বাড়িতে যা শেখার কোনো সম্ভাবনাই তার ছিল না। এ সব দেখে মনে হতো তাকে যেমন দেখায় আসলে সে তার চাইতে বয়সে অনেক বড়ো ছিল। একদিন রাতে চোর আরেকবার চিলেকোঠার ছাদের ছোট জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করলে তোতা পাখিটা জার্মান কুকুরের উচ্চ কণ্ঠের মতো ঘেউ ঘেউ ডাক দিয়ে চোরকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তার ওই চিৎকার সত্যিকার কুকুরের চিৎকারের চাইতে কিছুমাত্র কম বাস্তবানুগ হয় নি। তোতাটা চেঁচিয়ে ওঠে, চোর চোর চোর, ধরো ধরো ধরো। এই ঘটনার পর তোতা পাখিটা সম্পর্কে ডাক্তারের শেষ সন্দেহও ধূলিসাৎ হয়ে যায়, আর তখন তিনি তার ভার নিজের হাতে তুলে নেন, তার জন্য আম গাছের নিচে একটা খাঁচা বানাবার হুকুম দেন, সেখানে তার বসার একটা দাঁড় থাকবে, একটা পাত্রে থাকবে জল, অন্য একটা পাত্রে পাকা কলা, তা ছাড়াও শারীরিক কসরৎ দেখাবার জন্য থাকবে একটা ট্রাপিজ। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত, যখন রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়তো আর উত্তুরে হাওয়ার জন্য বাইরে থাকা অসহ্য হয়ে পড়তো, তখন ঘুমাবার জন্য তাকে শোবার ঘরে নিয়ে আসা হতো, আর কম্বল দিয়ে তার খাঁচা মুড়ে দেয়া হতো, যদিও তার সার্বক্ষণিক ফোলা লালাগ্রন্থির জন্য ভেতরের মানুষদের সুস্থ শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষতি হতে পারে এ রকম একটা সন্দেহ ডাক্তারের ছিলই। বহু বছর ধরে ওরা পাখিটার ডানার পালকগুলি কেটে দিচ্ছিল। ওরা তাকে, সর্বদা ঘোরাফেরায় অভ্যস্ত একটা মানুষের বেঢপ হাঁটার চালে, খুশি মতো, সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে দিতো। কিন্তু একদিন রান্না ঘরের কড়িকাঠ থেকে দুলে দুলে কসরৎ দেখাবার সময় সে নিচের ঝোল ভর্তি মাংসের গরম হাঁড়িতে পড়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে বাবুর্চি তার বড় হাতা দিয়ে দ্রুত তাকে তুলে আনে। তার সারা গা ঝলসে যায়, পালকগুলি পুড়ে যায়, কিন্তু সে মারা পড়ে নি। এরপর থেকে তাকে সব সময় খাঁচায় পুরে রাখা হতো, দিনের বেলাতেও, খাঁচায় পোরা তোতা তাকে শেখানো সব কিছু সম্পূর্ণ ভুলে যায় এই সাধারণ বিশ্বাস সত্ত্বেও। তাকে শুধু ডাক্তার উরবিনোর সঙ্গে তার ক্লাসের জন্য প্রতিদিন বিকাল চারটায় উঠানের চত্বরের ঠাণ্ডা জায়গাটিতে নিয়ে যাওয়া হতো। যথা সময়ে কেউ লক্ষ করে নি যে তার ডানা আবার অনেক বড় হয়ে গেছে, আর সেদিন সকালে ওরা যখন তার ডানা ছেঁটে দেবার উদ্যোগ নেয় তখনই সে পালিয়ে যায়, তারপর আম গাছের উঁচু ডালটিতে গিয়ে বসে থাকে।

    তিন ঘণ্টা চেষ্টার পরও ওরা তাকে ধরতে পারে নি। এ বাড়ির কাজের মেয়েরা প্রতিবেশীদের বাড়ির কাজের মেয়েদের সাহায্য নিয়ে তাকে নানা লোভ দেখিয়ে নামিয়ে আনার জন্য বহু কলাকৌশলের আশ্রয় নেয় কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইলো। সে শুধু পাগলের মতো হো হো করে হাসলো, আর উদারপন্থী দল দীর্ঘজীবি হোক, উদারপন্থী দল দীর্ঘজীবি হোক বলে চিৎকার করলো, যে হঠকারী চিৎকারের জন্য বহু দিলদরিয়া মাতালকে অনেক সময় প্রাণ দিতে হয়েছে। গাছটার পত্রপল্লবের জন্য ডাক্তার উরবিনো তাকে প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলেন না। তিনি স্প্যানিশ ভাষায় ও ফরাসি ভাষায়, এমনকি ল্যাটিনে পর্যন্ত, ওকে নেমে আসার জন্য খোশামোদ করলেন, কিন্তু তোতা পাখিটি তার মতো একই ভাষায়, একই সুরে, এমনকি তার কণ্ঠধ্বনির অনুরূপ বৈশিষ্ট্যসহ জবাব দিলো, কিন্তু বৃক্ষচূড়ায় তার অবস্থান থেকে সে নড়লো না। ডাক্তার উরবিনো যখন বুঝলেন যে স্বেচ্ছায় তার অবস্থান থেকে তাকে নড়ানো যাবে না তখন তিনি নাগরিক অঙ্গনে তার সাম্প্রতিকতম বিনোদনের বিষয় অগ্নিনির্বাপক বিভাগকে খবর দিতে বললেন।

    অল্প কিছুকাল আগেও এখানে স্বেচ্ছাসেবকরা রাজমিস্ত্রিদের মই এনে যেখানেই জল পাওয়া যেত সেখান থেকে বালতি বালতি জল সংগ্রহ করে কোথাও আগুন লাগলে সে আগুন নেভাতো। তাদের কর্মপন্থা এতই বিশৃঙ্খল ছিল যে মাঝে মাঝে তারা নিজেরা আগুনের চাইতে বেশি ক্ষতি সাধন করে ফেলতো। কিন্তু তারপর বছর খানেক হল এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। জন-উন্নয়ন সমিতি, যার অবৈতনিক সভাপতি ছিলেন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, একটা তহবিল সংগঠিত করে। তারা একদল পেশাদার অগ্নিনির্বাপক, সাইরেন ও ঘণ্টাসহ একটি জলের ট্রাক এবং স-বেগে জল নিক্ষেপের জন্য দুটি নমনীয় নলের ব্যবস্থা করল। এসব এতটাই জনপ্রিয় হলো যে গির্জা থেকে ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে কোথাও আগুন লাগার খবর শুনলেই শিক্ষকরা তাদের ক্লাস স্থগিত করে দিতেন যেন ছাত্ররা আগুনের সঙ্গে অগ্নিনির্বাপকদের লড়াই দেখতে পারে। প্রথম দিকে ওরা শুধু এ কাজটাই করতো কিন্তু ডাক্তার উরবিনো পৌর কর্মকর্তাদের কাছে তাঁর হামবুর্গের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। সেখানে তিন দিনের তুষার ঝড়ের পর একটি বাড়ির নিচের তলায় অগ্নিনির্বাপকরা ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া এক বালককে উদ্ধার করে বাঁচিয়ে তোলে। আরেকবার তিনি একটি অগ্নিনির্বাপক দলকে নেপলস-এর এক গলিতে একটা বাড়ির দশতলার বারান্দা থেকে কফিনে পোরা একটি মৃতদেহ নামিয়ে আনতে দেখেছেন। ওই বাড়ির সিঁড়িতে এতো বেশি বাঁক ও মোড় ছিল যে মৃতের পরিবার কফিনটি কিছুতেই সিঁড়ি দিয়ে নামাতে পারছিল না। এই ভাবেই এ শহরের স্থানীয় অগ্নিনির্বাপক দল বিভিন্ন জরুরি সঙ্কটের সময় তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে শেখে, যেমন তালা ভাঙা কিংবা বিষাক্ত সাপ মারা, আর মেডিকেল স্কুলও ছোটখাটো দুর্ঘটনার সময় তাদেরকে সাহায্য দানের উপযুক্ত করে তোলার জন্য প্রাথমিক সেবার প্রশিক্ষণ দিল। এ পরিস্থিতিতে একজন ভদ্রলোকের যাবতীয় গুণসম্পন্ন একটি বিখ্যাত তোতা পাখিকে গাছ থেকে নামিয়ে আনার জন্য তাদের সাহায্য চাওয়ার মধ্যে আশ্চর্য কিছু ছিল না। ডাক্তার উরবিনো বললেন, ওদেরকে আমার কথা বলো। তারপর তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্যের মধ্যাহ্ন ভোজে যাবার জন্য পোশাক পরতে নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন। এই মুহূর্তে সত্যি কথাটা ছিল এই যে, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরের চিঠি তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল এবং তোতা পাখির নিয়তি নিয়ে তিনি সত্যিই তেমন চিন্তিত ছিলেন না।

    ফারমিনা ডাজা কোমরে বেল্ট বাঁধা একটা ঢোলা সিল্কের পোশাক পরেছিলেন। তাঁর গলায় ছিল ছটি অসমান লহরের সত্যিকার মুক্তার কণ্ঠহার আর পায়ে উঁচু হিলের সাটিনের জুতা, যা তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেই শুধু পরতেন। কারণ পায়ের ওপর ওরকম অত্যাচার আর এ বয়সে ভালো লাগতো না। একজন শ্রদ্ধাভাজন মাতামহীর পক্ষে তাঁর এ রকম কেতাদুরস্ত পোশাক হয়তো খুব সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না কিন্তু তাঁর দেহের গড়নে তা মানিয়ে গিয়েছিল। তাঁর হাড়গুলি ছিল দীর্ঘ, দেহের কাঠামো ক্ষীণ ও সোজা, নমনীয় দুটি হাতে বয়সের এক ফোঁটা ছাপ নেই, ছোট করে ছাঁটা ইস্পাত-নীল চুল বাঁকা হয়ে গালের উপর এসে পড়েছে। তাঁর বিয়ের প্রতিকৃতি থেকে তাঁর মধ্যে এখন শুধু অবশিষ্ট আছে তাঁর স্বচ্ছ বাদামি দুটি চোখ আর তাঁর সহজাত অহঙ্কারী ভাব, কিন্তু বয়স তাঁর কাছ থেকে যা হরণ করে নিয়েছিল তার বেশির চাইতেও পুষিয়ে দিয়েছিল তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা আর তাঁর অধ্যবসায়। এখন তিনি খুব ভালো বোধ করছেন: লোহার তারের কোমর বন্ধনী, আঁট করে বাঁধা কটিদেশ, নিতম্বকে প্রকট করার লক্ষ্যে স্কার্টের পেছন দিকে ফোলানো কাঠামো বিশেষের ব্যবহার এখন অতীতের বিষয় হয়ে উঠছিল। সহজে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম, মুক্তিপ্রাপ্ত শরীর, এখন স্ব-মহিমায় নিজেকে তুলে ধরতে পারছে। তাঁর এই ৭২ বছর বয়সেও। ডাক্তার উরবিনো তাঁকে দেখলেন তাঁর ড্রেসিং টেবিলের সামনে। মাথার উপর একটা বৈদ্যুতিক পাখার ব্লেড আস্তে আস্তে ঘুরছে। ফারমিনা তাঁর কাপড়ের ভায়োলেট ফুল শোভিত ঘণ্টাকৃতি টুপিটা মাথায় পরেছেন। শোবার ঘরটি বড়, আলোকোজ্জ্বল, সেখানে একটি বিলেতি খাট, গোলাপি সূচিকাজ করা মশারি দিয়ে সুরক্ষিত, উঠানের গাছগুলির দিকে মুখ করা জানালা দুটি খোলা, সেখান থেকে ঝিঁঝিঁর হইচই-এর শব্দ ভেসে আসছে, আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায় তারা প্রায় দিশেহারা। ফারমিনা ডাজা তাদের মধুচন্দ্রিমা শেষে ফিরে আসার পর থেকেই স্বামীর পোশাক নির্বাচনের ভার নিয়েছিলেন। ঘটনা ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি তাঁর স্বামীর পোশাক ঠিক করে, প্রতিদিন রাতে, চেয়ারের ওপর সাজিয়ে রাখতেন যেন তিনি বাথরুম থেকে এসেই সব কিছু প্রস্তুত দেখতে পান। কখন থেকে তিনি তাঁকে তাঁর কাপড় পরাতে সাহায্য করতে আরম্ভ করেন এবং শেষে পরিয়ে দিতে থাকেন, তা তিনি মনে করতে পারছেন না। কাজটা প্রথমে তিনি ভালবাসা থেকেই শুরু করেন, কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে কোনো কারণ ছাড়াই তাঁকে এটা করতে হচ্ছিল, কারণ উরবিনো আর নিজে-নিজে তাঁর পোশাক পরতে পারছিলেন না। তাঁরা সবেমাত্র তাঁদের বিয়ের সুবর্ণ জয়ন্তি পালন করেছেন, একে অন্যকে ছাড়া বেঁচে থাকার ক্ষমতা এখন আর তাঁদের ছিল না, একে অন্যের কথা না ভেবেও তাঁরা থাকতে পারতেন না, আর তাঁদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছিল। তাঁদের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তি ভালবাসা ছিল, নাকি সুবিধা, সেটা দুজনের কেউই বলতে পারবেন না, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে এই প্রশ্নটি তাঁরা কেউই কখনো নিজেদের করেন নি, কারণ উত্তরটা না জানাই তাঁরা শ্রেয় মনে করেছিলেন। ধীরে ধীরে ফারমিনা আবিষ্কার করেন তাঁর স্বামীর অনিশ্চিত পদক্ষেপ, মেজাজের পরিবর্তন, স্মৃতির বিচ্যুতি, ইদানীং ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠার অভ্যাস, কিন্তু তিনি এগুলিকে চূড়ান্ত ক্ষয়ের দ্ব্যর্থহীন উপসর্গ বলে মনে করেন নি, বরং তিনি মনে করেছিলেন এ সব হচ্ছে এক সুখী শৈশবে প্রত্যাবর্তনের চিহ্নাবলি। তাই তিনি তাঁর সঙ্গে একজন কষ্টকর বুড়ো মানুষের মতো আচরণ না করে তাঁর সঙ্গে আচরণ করতেন একজন জরাগ্রস্ত শিশুর মতো। আর এই ছলনাটুকু ছিল উভয়ের জন্যই বিধাতাকৃত, কারণ এটা তাদেরকে করুণার সীমানার বাইরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

    তাঁরা যদি সময়ে বুঝতেন যে দাম্পত্য জীবনের তুচ্ছ ছোটখাটো কষ্টগুলির চাইতে বড় বড় বিপর্যয়গুলি বেশি সহজে এড়ানো যায় তাহলে তাঁদের উভয়ের জন্যই জীবন ভিন্ন রকম হত। কিন্তু তাঁরা যদি জীবনে একসঙ্গে একটা জিনিসই আবিষ্কার করে থাকেন তাহল এই যে প্রজ্ঞা আমাদের মাঝে যখন আসে তখন আর তা কোনো মঙ্গল সাধন করতে পারে না। বহু বছর ধরে ফারমিনা ডাজা তিক্ত হৃদয়ে তাঁর স্বামীর আনন্দ-উৎফুল্ল প্রভাতগুলি সহ্য করে এসেছেন। নানা অশুভ সম্ভাবনায় পূর্ণ আরেকটি প্রভাতের আবশ্যম্ভাবিতাকে এড়াবার জন্য তিনি তাঁর নিদ্রার শেষ তন্তুগুলি আঁকড়ে ধরে থাকতেন, আর তার স্বামী তখন জেগে উঠতেন একটি নবজাতকের সারল্য নিয়ে: একটি নতুন দিন তাঁর জন্য আরেকটি বিজয়। ফারমিনা শুনতেন মোরগের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বামীর জেগে ওঠার শব্দ। তিনি প্রাণের প্রথম সাড়া দিতেন কোনো কারণ বা যুক্তি ছাড়াই একটা কাশি দিয়ে, মনে হতো তাঁকে জাগাবার জন্যই যেন তিনি ওই কাজটা করেছেন। তিনি তাঁকে বিরক্তিসূচক বিড়বিড় করতে শুনতে পেতেন, শুধু ফারমিনাকে বিরক্ত করার জন্যই যেন তিনি তা করছেন, খাটের পাশেই তাঁর চটি জোড়া থাকার কথা, সে সম্পর্কেই যেন ডাক্তার বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। অন্ধকারের ভেতর স্বামী হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমে যাচ্ছেন, ফারমিনা তাও টের পেতেন। তারপর এক ঘণ্টা তাঁর পড়ার ঘরে কাটিয়ে, যখন ফারমিনা আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন তখন তিনি পোশাক পরার জন্য শোবার ঘরে ফিরে আসতেন, তখনো আলো না জ্বালিয়ে। তাঁকে একবার কোনো এক পার্টিতে তাঁর নিজেকে বর্ণনা করতে বলা হলে তিনি বলেছিলেন, আমি হচ্ছি সেই ব্যক্তি যে অন্ধকারে তার কাপড়-জামা পরে। ফারমিনা তাঁকে নানা সাড়া শব্দ করতে শুনতেন, যার একটি আওয়াজও, তিনি জানতেন, অপরিহার্য ছিল না, ডাক্তার ওই আওয়াজ করতেন ইচ্ছাকৃত ভাবে, যদিও ভান করতেন অন্যরকম, ঠিক যেমন ফারমিনা ঘুমিয়ে থাকার ভান করতেন যদিও তিনি ঠিকই জেগে থাকতেন। ডাক্তারের এ রকম করার উদ্দেশ্যটা ছিল স্পষ্ট। সকাল বেলায় অপটুভাবে হাতড়ে বেড়াবার সময়ই ডাক্তার তাঁর স্ত্রীর জাগ্রত ও দ্বিধাহীন উপস্থিতির প্রয়োজন সবচাইতে বেশি অনুভব করতেন।

    ফারমিনার মতো অতো শোভন-সুন্দর ভাবে কেউ ঘুমাতে জানতো না। শরীরটা ঈষৎ বাঁকা, যেন নাচের ভঙ্গিতে, হাত কপালের ওপর রাখা। কিন্তু তিনি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে না থাকলেও তখনো ঘুমিয়েই আছেন তাঁর এই সুখানুভূতিকে কেউ বিঘ্নিত করলে তিনি অসম্ভব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। ডাক্তার উরবিনো বুঝতে পারতেন যে তাঁর স্ত্রী তাঁর সামান্যতম শব্দ করার জন্য অপেক্ষা করছেন, এমনকি সে শব্দের জন্য তিনি কৃতজ্ঞও হতেন, কারণ তিনি তখন তাকে সকাল পাঁচটার সময় জাগিয়ে দেবার জন্য একজনের ওপর দোষারোপ করতে পারতেন। তাই, দু’এক সময়, উরবিনো যখন অন্ধকারের মধ্যে অভ্যস্ত জায়গায় তাঁর চটি খুঁজে না পেয়ে এদিক ওদিক হাতড়াতেন, ফারমিনা তখন হঠাৎ ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠতেন, কাল রাতে তুমি তোমার চটি বাথরুমে রেখে এসেছো, আর ঠিক তারপরই, তার গলা রাগে সম্পূর্ণ জাগ্রত তখন, তিনি তীব্র কণ্ঠে বলে উঠতেন, এ বাড়ির সব চাইতে খারাপ জিনিস হল এখানে কেউ একটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।

    তারপর ফারমিনা বিছানায় গড়াগড়ি করতেন, নিজের প্রতি সামান্যতম মায়া না দেখিয়ে আলো জ্বেলে দিতেন, দিনের প্রথম বিজয়টা যে তাঁর হয়েছে সে জন্য পরিতৃপ্ত বোধ করতেন। আসলে ব্যাপারটা ছিল এই যে তারা দুজনেই একটা খেলা খেলতেন, অলীক এবং অযৌক্তিক, কিন্তু সব সত্ত্বেও আরামদায়ক: এটা ছিল গার্হস্থ্য প্রেমের বহু বিপজ্জনক আনন্দের মধ্যে একটি। কিন্তু এই রকম একটা তুচ্ছ খেলাই তাদের ত্রিশ বছরের সম্মিলিত জীবন প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। কারণ একদিন বাথরুমে কোনো সাবান ছিল না।

    ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল সুপরিচিত সহজ ভাবে। ডাক্তার উরবিনো তখনো কারো সাহায্য ছাড়াই স্নান করতেন। সেদিন স্নানের শেষে তিনি পোশাক পরার জন্য শোবার ঘরে আসেন, তখনো আলো না জ্বালিয়েই। তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস মতো ফারমিনা ভ্রূণের উষ্ণতা নিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে ছিলেন, চোখ দুটি বোজা, নিঃশ্বাস হালকা, বাহু মাথার উপর দিকে ধরা, যেন কোনো পবিত্র নৃত্যের মুদ্রা। কিন্তু নিত্য দিনের মতো আজও তিনি ছিলেন আধা ঘুমন্ত এবং তাঁর স্বামী সেটা জানতেন। অন্ধকার ঘরে কড়া মাড় দেয়া কাপড়ের প্রলম্বিত খসখসে শব্দের পর ডাক্তার উরবিনো আপন মনে বলে উঠলেন, আজ এক সপ্তাহ ধরে আমি সাবান ছাড়া স্নান করছি।

    এইবার ফারমিনা পুরোপুরি জেগে উঠলেন, ব্যাপারটা তাঁর মনে পড়লো, তিনি বিছানায় গড়ালেন, সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর রাগ ফেটে পড়লো, কারণ যথার্থই তিনি বাথরুমে নতুন সাবান রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। তিন দিন আগে তিনি লক্ষ করেন যে সাবানদানিতে সাবান নেই, কিন্তু তখন তিনি স্নান করতে শুরু করে দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন যে পরে সাবান এনে রেখে দেবেন, কিন্তু ভুলে যান, দ্বিতীয় দিনও, তৃতীয় দিনও। তবে সত্য ঘটনা এই ছিল যে মোটেই এক সপ্তাহ যায় নি, তাঁর স্বামী সে কথা বলেছেন শুধু তার অপরাধবোধ বাড়াবার জন্য, তবু তিনটি অমার্জনীয় দিন কেটে গেল, আর স্বামী যে তাঁর ত্রুটি ধরে ফেলেছেন তা-ই তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুললো। সব সময়ের মতো এবারও তিনি আক্রমণের মাধ্যমেই নিজের প্রতিরক্ষার উদ্যোগ নিলেন। তিনি রাগে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে বললেন, কিন্তু আমি তো রোজ স্নান করেছি, আর সাবান যথাস্থানেই ছিল।

    স্ত্রীর রণকৌশল ডাক্তার উরবিনোর খুব ভালো জানা থাকলেও এবার আর তিনি তা মেনে নিতে পারলেন না। একটা না একটা পেশাগত অজুহাতে তিনি মিসারিকর্ডিয়া হাসপাতালের প্রশিক্ষণার্থী ডাক্তারদের বাবভবনে থাকবার জন্য চলে গেলেন। বিকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁর রোগীদের দেখতে যাবার আগে, শুধু পোশাক বদলাবার জন্য, তিনি নিজের গৃহে ফিরতেন। তাঁর আসার শব্দ শুনলেই ফারমিনা সোজা রান্না ঘরে চলে যেতেন, ভাব দেখাতেন যেন সেখানে কোনো বিশেষ কাজ আছে, তারপর রাস্তায় স্বামীর গাড়ির শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত রান্নাঘরেই থাকতেন। পরবর্তী তিন মাসে যখনই তাঁরা ঝগড়াটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন তখনই তাঁদের অনুভূতি আরো আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে। ডাক্তার ঠিক করেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী স্বীকার করবেন না যে বাথরুমে সাবান ছিল না ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন না। আর ফারমিনাও ঠিক করেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর স্বামী স্বীকার করবেন না যে তিনি তাঁকে জ্বালাবার জন্যই মিথ্যা কথা বলেছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনিও স্বামীর গৃহ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেবেন না।

    ঘটনাটা, অবশ্যই, আগের বহু উত্তাল অশান্ত প্রভাতের আরো অনেক তুচ্ছ ঝগড়ার কথা তাদের স্মৃতিতে নতুন করে জাগিয়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। একটা তিক্ততা জাগিয়ে তোলে অন্যান্য তিক্ততা, পুরনো কাটা জায়গা আবার কেটে যায়, সেখানে নতুন ক্ষত দেখা দেয়, আর উভয়েই গভীর বিষাদের সঙ্গে লক্ষ করেন যে এত বছরের দাম্পত্য লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষকে পুষ্ট করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করেন নি। অবশেষে ডাক্তার উরবিনো প্রস্তাব করলেন যে তাঁরা দুজনেই স্বীকারোক্তি করবেন, দরকার হলে খোদ আর্চবিশপের সামনে, যেন বাথরুমে সাবানদানিতে সাবান ছিল কিংবা সাবান ছিল না সে বিষয়ে ঈশ্বর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর তখনই, আত্মনিয়ন্ত্রণের সকল ক্ষমতা সত্ত্বেও, ফারমিনা ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওই ঐতিহাসিক চিৎকারটি করে ওঠেন, জাহান্নামে যাক আর্চবিশপ!

    ওই অনুচিত উক্তি শহরের ভিত্তি পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে, জন্ম দেয় নানা অপবাদের, যা মিথ্যা প্রমাণ করা সহজসাধ্য ছিল না, এবং জনগণের ঐতিহ্যের অন্ত গত হয়ে যায় তা, যেন কোনো পালাগানের চরণ : জাহান্নামে যাক আর্চবিশপ! ফারমিনা উপলব্ধি করলেন যে তিনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন, স্বামীর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও তিনি আগে থাকতেই অনুমান করতে পারলেন, তাই তিনি পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের হুমকি দিলেন। ওই বাড়ি এখন সরকারি দফতরের জন্য ভাড়া দেওয়া থাকলেও ফারমিনাই তার মালিক। তিনি সে বাড়িতে চলে যাবেন এবং একা সেখানে থাকবেন। হুমকিটা ফাঁকা ছিল না, তিনি সত্যিই চলে যেতে চেয়েছিলেন, মিথ্যা অপবাদের বোঝা বইতে তিনি একটুও রাজি ছিলেন না। তাঁর স্বামী এটা ঠিক সময়ে বুঝতে পারেন। নিজের সংস্কারকে উপেক্ষা করার মতো সাহসও তাঁর ছিল না, তিনি আত্মসমর্পণ করলেন। তার মানে এই নয় যে তিনি স্বীকার করলেন যে বাথরুমে সাবান ছিল, কিন্তু তিনি এতটা নমনীয় হলেন যে তিনি আবার স্ত্রীর সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করতে লাগলেন, যদিও দুজন দু’ঘরে ঘুমাতেন, আর ডাক্তার স্ত্রীর সঙ্গে বাক্য বিনিময় থেকে বিরত থাকলেন। তাঁরা খেতেন নীরবে, নিপুণ ভাবে নিঃশব্দে ঝগড়া করতেন, খবরাখবর আদান-প্রদান করতেন ছেলেমেয়েদের মাধ্যমে, টেবিলের একপাশ থেকে অন্য পাশে, আর ছেলেমেয়েরা বুঝতেই পারতো না যে তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে এখন কথা বলছে না।

    পড়ার ঘরে বাথরুম ছিল না। তাই এ ব্যবস্থা সকালের আওয়াজের সমস্যার সমাধান করে দিল। ডাক্তার তাঁর ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি শেষ করে স্নান করতে আসতেন এবং স্ত্রীর ঘুম না ভাঙার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করতেন। রাতে প্রায়ই উভয়ে একই সঙ্গে বাথরুমে এসে উপস্থিত হতেন, তখন ঘুমের আগে দাঁত মাজার জন্য একজনকে অপরজনের দাঁত মাজা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতে হত। এই ভাবে চার মাস কেটে যাবার পর একদিন বাথরুমে ঢুকতে এসে ডাক্তার দেখলেন যে স্ত্রী ভেতরে আছেন, তখন তিনি একটুখানি পড়ার জন্য তাঁদের জোড়া খাটে শুয়ে পড়লেন, এরকম তিনি মাঝে মাঝেই করতেন, কিন্তু আজ তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। স্ত্রী বেরিয়ে এসে তাঁর পাশে শুয়ে পড়লেন, খানিকটা অযত্নের সঙ্গেই, যেন তিনি জেগে উঠে চলে যান। তিনি একটু নড়েও ওঠেন কিন্তু যাবার পরিবর্তে হাত বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে বালিশে নিজের মাথা আরো ভালো করে রাখলেন। ফারমিনা তাঁর কাঁধ ধরে ধাক্কা দিলেন, তাঁকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেন যে তাঁর পড়ার ঘরে শোবার কথা, কিন্তু তাঁর প্র-প্রপিতামহ-পিতামহীদের পালকের খাটে আবার ফিরে আসাটা তাঁর কাছে এতই আরামদায়ক মনে হলো যে তিনি আত্মসমর্পণ করাই শ্রেয় মনে করলেন। তিনি বললেন, আমাকে এখানে থাকতে দাও। সাবান ছিল।

    বৃদ্ধ বয়সের মোড় ঘুরবার পর এখন ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে দুজনের কেউই বিশ্বাস করতে পারতেন না যে এক সঙ্গে পঞ্চাশ বছর জীবনযাপন কালে সেটাই ছিল তাঁদের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা কাটাকাটি এবং একমাত্র ঘটনা যা তাঁদেরকে তাঁদের সব দায়-দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করার দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এখন বৃদ্ধ ও শান্ত হবার পরও তাঁরা ওই প্রসঙ্গ তোলার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন, কারণ পুরনো ক্ষত থেকে হয়তো আবার রক্তক্ষরণ শুরু হবে, যেন মাত্র গতকালই ঘটেছিল ওই আঘাত দানের ঘটনাটি।

    ডাক্তার উরবিনো ছিলেন প্রথম পুরুষ মানুষ যাকে ফারমিনা ডাজা প্রস্রাব করতে শোনেন। তিনি সেটা শোনেন তাঁদের বিয়ের রাতে। তাঁরা তখন ফ্রান্সের পথে জাহাজের সেরা কক্ষে ফারমিনা সাগর-পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে ছিলেন। এই সময় তাঁর স্বামীর অশ্বের মতো জল নিঃসরণের শব্দ এতো বীর্যবান ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক বলে মনে হয় যে তা তাঁর আসন্ন ধ্বংসযজ্ঞের আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। বছর গড়িয়ে যাবার সঙ্গে ওই জলপ্রবাহ দুর্বল হয়ে যায়, তবু তার স্মৃতি প্রায়ই তাঁর কাছে ফিরে ফিরে আসতো, কারণ প্রতি ব্যবহারের সময় তাঁর স্বামী যে কমোডের কিনারাটা ভিজিয়ে দিতেন সেটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ডাক্তার উরবিনো তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে প্রতি দিনের এই দুর্ঘটনা তাঁর নিজের কোনো অসতর্কতার জন্য ঘটছে না, এর জৈবিক কারণ রয়েছে, একটু ইচ্ছা থাকলেই এই যুক্তি যে কেউ বুঝতে পারত, কিন্তু স্পষ্টতই ফারমিনার সে ইচ্ছা ছিল না। তরুণ বয়সে তাঁর জলপ্রবাহ এতো সুনির্দিষ্ট এবং এতো দ্ব্যর্থহীন ছিল যে স্কুলে বোতল ভর্তি করার সময় লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বদা বিজয়ী হতেন। কিন্তু কালের ধ্বংসাত্মক পরিণতিতে ওই জলপ্রবাহ শুধু যে হ্রাস পেয়েছে তা-ই নয়, সেটা এখন বাঁকা রূপ ধারণ করেছে, চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একটা বিচিত্র ফোয়ারার মতো হয়ে উঠেছে, এখন বহু চেষ্টা করেও তাঁর পক্ষে আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলতেন, যিনি টয়লেট আবিষ্কার করেছেন তিনি পুরুষ মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ডাক্তার একটা প্রাত্যহিক কাজের মাধ্যমে পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রত্যেকবার ব্যবহারের পর তিনি টয়লেট পেপার দিয়ে কমোডের প্রান্তগুলি মুছে দিতেন। তাঁর স্ত্রী এটা জানতেন, কিন্তু বাথরুমে অ্যামোনিয়ার গন্ধ খুব তীব্র না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তিনি এ সম্পর্কে কখনো কিছু বলতেন না, তবে সে রকমটা হলে তিনি যেন একটা অপরাধ আবিষ্কার করে ফেলেছেন সেই ভঙ্গিতে ঘোষণা করতেন, এহ, একেবারে খরগোশের খাঁচার মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়ে এই শারীরিক অসুবিধা ডাক্তার উরবিনোকে একটা চূড়ান্ত সমাধানে অনুপ্রাণিত করেছিল : তিনি বসে বসে প্রস্রাব করতে লাগলেন, যেমন করতেন তাঁর স্ত্রী এবং এর ফলে কমোডটা পরিষ্কার থাকলো, তিনিও তাঁর সমাদরের স্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেন।

    এই পর্বে পৌঁছে ডাক্তার নিজে প্রায় কিছুই করতে পারতেন না। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মারাত্মক বিপদ ঘটানোর আশঙ্কায় তিনি স্নান করার ব্যাপারে বিশেষ সাবধান হলেন। এ বাড়িটি ছিল আধুনিক, তাই পুরনো শহরের বড় বড় বাড়িগুলিতে সিংহের থাবার মতো পা বসানো টিন ও সিসার যে রকম স্নানের টব থাকতো এখানে সে জাতীয় কিছু ছিল না। তিনি তাঁর বাথরুম থেকে আধুনিক স্নানের টবটা স্বাস্থ্যগত কারণে সরিয়ে দিয়েছিলেন : স্নানের টব হল ইউরোপীয়দের আবিষ্কার করা আরেকটা জঘন্য জিনিস। ওরা স্নান করতো শুধু মাসের শেষ শুক্রবারে, তাও যে জলে তারা নিজেদের শরীরের ময়লা পরিষ্কার করার চেষ্টা করতো সেই ময়লা জলের মধ্যেই। তাই তিনি ঘন শক্ত কাঠের একটা বিশাল টব তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন, ফারমিনা ডাজা সেখানে তাঁর স্বামীকে স্নান করিয়ে দিতেন, যেন তিনি এক সদ্যজাত শিশু। গোলাপি-বেগুনি বন্য পাতা আর কমলার খোসা একসঙ্গে মিশিয়ে তাকে জলে ফেলে জল গরম করা হত, তারপর ফারমিনা স্বামীকে সেই জল দিয়ে স্নান করাতেন। স্নান পর্ব এক ঘণ্টার বেশি সময় নিতো। এর প্রভাব ডাক্তারের ওপর এতই স্নায়ুবিক উত্তেজনা প্রশমক ছিল যে তিনি ওই সুগন্ধযুক্ত নির্যাসের মধ্যে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তেন। স্নান করাবার পর ফারমিনা ডাজা তাঁকে কাপড় পরতে সাহায্য করতেন। তিনি তাঁর দু’পায়ের মাঝখানে ট্যালকম পাউডার ছিটিয়ে দিতেন, গায়ের ছোট ছোট ফুসকুড়ির ওপর কোকো মাখন মাখিয়ে দিতেন, এমন মমতার সঙ্গে তাঁকে তাঁর জাঙ্গিয়া পরতে সাহায্য করতেন যে মনে হত সেটা যেন একটি শিশুর ডায়াপার। তারপর তিনি একটি একটি করে তাঁকে তাঁর পুরো পোশাক পরিয়ে দিতেন, মোজা থেকে আরম্ভ করে পোখরাজের পিন দিয়ে তাঁর টাই-র গিঁট বেঁধে দেয়া পর্যন্ত। তাঁদের দাম্পত্য ঊষাগুলি শান্ত হয়ে ওঠে কারণ যে শৈশব তাঁর সন্তানরা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তিনি আবার তাঁর সেই শৈশবের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। ফারমিনাও, অবশেষে, তাঁর পারিবারিক কর্মসূচি মেনে নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর ক্ষেত্রেও বছরগুলি পার হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর ঘুম ক্রমেই কমে যায়, আর সত্তর বছর বয়সে পৌঁছে তিনি দেখলেন যে স্বামীর আগেই তিনি জেগে উঠছেন।

    একজন চিকিৎসক ও ধর্মবিশ্বাসী হিসেবে ডাক্তার উরবিনোর অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। কিন্তু ওই পেন্টেকস্টের রবিবারে চাদর উত্তোলন করার পর জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ- আমুরের শরীরের দিকে তাকিয়ে যা তিনি দেখলেন তা ইতোপূর্বে কখনো দেখেন নি 1 মৃত্যুর সঙ্গে এতো বছরের ঘনিষ্ঠতার পর, তার সঙ্গে এতো দিনের লড়াইয়ের পর, তাকে এতবার উল্টেপাল্টে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর তিনি যেন এই প্রথমবার সরাসরি মৃত্যুকে দেখলেন আর মৃত্যুও যেন তাঁকে দেখলো সরাসরি। না, এটা মৃত্যুভীতি নয়। বহু বছর ধরেই ওই ভয় তাঁর মধ্যে ছিল, তার সঙ্গেই বাস করেছে ওই ভয়। এক রাতে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর থেকেই তাঁর নিজের ছায়ার ওপর আরেকটা ছায়া তাঁকে সর্বদা অনুসরণ করেছে এবং তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে তাঁর চিরদিনের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যু কোনো স্থায়ী সম্ভাবনা নয়, সেটা একটা আশু বাস্তবতা। তবে একদিন তিনি এমন একটা কিছুর শারীরিক উপস্থিতি দেখলেন যা এতদিন ধরে তাঁর কাছে ছিল শুধু একটা কল্পিত বাস্তবতা। এতদিন তিনি জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে একজন সন্ত হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, যে-সন্ত তাঁর নিজের সৌভাগ্যের কথা জানে না, কিন্তু এখন বিধাতা যে এক বিশাল বিহ্বল করা সত্যকে তাঁর সামনে উন্মোচিত করার জন্য জেরেমিয়াকে ব্যবহার করলেন তাতে তিনি আনন্দিতই হলেন। যখন জেরেমিয়ার চিঠি তার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরলো, তার কুটিল অতীত, তার ধোঁকা দেবার অচিন্তনীয় ক্ষমতা, তখন তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর জীবনে একটা চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় কিছু ঘটে গেছে।

    ফারমিনা ডাজা কিন্তু তাঁর বিষণ্ন মনের অবস্থা দিয়ে নিজেকে সংক্রমিত হতে দিলেন না। তিনি যখন ডাক্তারকে প্যান্ট পরতে আর তাঁর জামার দীর্ঘ এক সারি বোতাম লাগাতে সাহায্য করতেন তখন ডাক্তার অবশ্যই সে চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি সফল হন নি, কারণ ফারমিনা ডাজার মনে দাগ কাটা সহজ ছিল না, বিশেষ করে এমন একজন মানুষের মৃত্যু দ্বারা যার জন্য তাঁর কোনো রকম চিন্তাই ছিল না। তার সম্পর্কে তিনি শুধু জানতেন যে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর একজন পঙ্গু মানুষ, ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করে, যাকে তিনি কখনো দেখেন নি, আন্টিলের বহু দ্বীপের মধ্যে একটি দ্বীপে সংঘটিত বহু অভ্যুত্থানের মধ্যে একটি অভ্যুত্থানের সময় যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যে পরে প্রয়োজনের তাগিদে একজন শিশুদের আলোকচিত্রশিল্পী হয়ে ওঠে, বস্তুতপক্ষে প্রদেশের সব চাইতে সফল আলোকচিত্রশিল্পী, আর দাবা খেলায় যে একজনকে হারিয়ে দিয়েছিল যার নাম টোরমলিনো বলে তাঁর মনে পড়ে, যদিও আসলে তার নাম ছিল কাপাব্লাঙ্কা।

    ডাক্তার উরবিনো বললেন, কিন্তু সে তো একটা জঘন্য অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কেইনের এক পলাতক ব্যক্তির বেশি কিছু ছিল না। কল্পনা কর, সে মানুষের মাংস পর্যন্ত খেয়েছে। তিনি যে চিঠির গোপন তথ্যগুলি নিজের সঙ্গে তাঁর কবরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেই চিঠিটা স্ত্রীর হাতে দিলেন কিন্তু ফারমিনা ডাজা সেটা না পড়েই ভাঁজ করা পাতাগুলি তাঁর ড্রেসিং টেবিলের একটা দেরাজে রেখে দেরাজটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। তাঁর স্বামীর বিস্মিত হবার অগাধ ক্ষমতা এবং তাঁর অতিরঞ্জিত মতামতসমূহ, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই অধিকতম দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকে, এ সবের সঙ্গে ফারমিনা সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর মনের সঙ্কীর্ণতা যার সঙ্গে তাঁর পাবলিক ইমেজ ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ তা-ও ফারমিনার জানা ছিল। কিন্তু এবার ডাক্তার যেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে তাঁর স্বামী জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে শ্রদ্ধা করতেন সে এক সময়ে যা করেছিল তার জন্য নয়, বরং শুধুমাত্র একটা ঝোলা পিঠে নিয়ে নির্বাসিত এক ব্যক্তি এখানে আসার পর যা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তার জন্য এবং এতো দিন পরে তার যথার্থ পরিচয় উদ্ঘাটিত হবার ফলে তাঁর স্বামী কেন এতটা বিপর্যস্ত বোধ করছেন এটা তাঁর বোধগম্য হল না। গোপনে একজন রমণী রাখার ব্যাপারটাকে তাঁর স্বামী কেনো এমন ঘৃণ্য বলে বিবেচনা করছেন তাও ফারমিনা বুঝতে পারলেন না, বিশেষ করে এক ধরনের মানুষ যখন এটাকে পুরুষপরাম্পরা ভাবে প্রাপ্ত একটা প্রথা বলে মনে করতো, তা ছাড়া রমণীটি যে জেরেমিয়ার মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্তে তাকে সাহায্য করেছিল সেটা তাঁর কাছে একটা প্রেমের হৃদয় বিদারক প্রমাণ বলেই মনে হল। তিনি বললেন, তার মতো গুরুতর কারণে তুমিও যদি অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে তবে তার বাস্তবায়নে তোমাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য হত। অর্ধ শতাব্দি ধরে অতি সহজ সাধারণ জিনিস বুঝতে তাঁর স্ত্রীর যে অক্ষমতা তাকে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত করে তুলতো এখন ডাক্তার উরবিনো আরেকবার তার মুখোমুখি হলেন। তিনি বললেন, তুমি কিচ্ছু বোঝ না। সে কি ছিল বা কি করেছিল তা আমাকে ক্রুদ্ধ করছে না, সে যে এতো বছর ধরে আমাদের সঙ্গে কী প্ৰচণ্ড ছলনা করেছে সেটাই আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।

    তাঁর চোখ জলে ভরে উঠতে শুরু করলো কিন্তু ফারমিনা তা না দেখার ভান করলেন।

    স্বামীর কথার উত্তরে তিনি বললেন, ও ঠিক কাজটি করেছে। ও যদি সত্য কথা বলতো তাহলে তুমি অথবা ওই রমণী অথবা এই শহরের কেউই, সবাই ওকে যে রকম ভালবেসেছিল সে রকম ভালবাসতো না।

    তিনি তাঁর কোটের বোতামঘরের মধ্যে দিয়ে তাঁর ঘড়ির চেইন সযত্নে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর টাই-এর গিঁট আবার ঠিকঠাক করে তাঁর পোখরাজের টাই পিনটা যথাস্থানে আটকে দিলেন। তারপর তাঁর রুমালে ফ্লোরিডা জল ছিটিয়ে ওই রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ ও ভেজা দাড়ি মুছিয়ে দিয়ে তিনি রুমালটি তাঁর বুক পকেটে গুঁজে দিলেন, আর তার কোণাগুলি ম্যাগনোলিয়া ফুলের মতো করে ছড়িয়ে দিলেন। এমন সময় বাড়ির গভীর অভ্যন্তর থেকে পেণ্ডুলাম ঘড়িতে এগারটা বাজার ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এলো।

    ফারমিনা স্বামীর বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন, তাড়াতাড়ি করো, আমাদের দেরি হয়ে যাবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.