Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ২০

    ২০

    শেষ সতর্ক-ভেঁপু বাজার পর ডাক্তার উরবিনো ডাজা ও তার স্ত্রী ফারমিনা ডাজাকে কোনো রকম নাটক না করে। বিদায় সম্ভাষণ জানালো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঘাটে নামার সিঁড়ি পর্যন্ত তাদের সঙ্গে এলো, ডাক্তার উরবিনো ডাজা এক পাশে সরে দাঁড়ালো যেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার স্ত্রীর পেছন পেছন সিঁড়িতে উঠতে পারে, আর তখনই সে টের পেলো যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও এই ভ্রমণ যাত্রায় যাচ্ছে। ডাক্তার উরবিনো ডাজা তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব লুকাতে পারলো না। সে বললো, ‘আমরা তো এটা আলোচনা করি নি।’

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে তার ক্যাবিনের চাবি দেখালো, উদ্দেশ্যটা ছিল স্পষ্ট, তার ক্যাবিন হল সাধারণ ডেকের একটা সাধারণ ক্যাবিন। কিন্তু ডাক্তার উরবিনো ডাজার কাছে এটা নিষ্পাপ সরলতার যথেষ্ট প্রমাণ বলে মনে হল না। সে আতঙ্কিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো, নিমজ্জমান একটি মানুষের মতো সাহায্য প্রার্থনা করলো, কিন্তু তার স্ত্রীর চোখ দুটি ছিল বরফের মতো শীতল। সে খুব নিচু কর্কশ গলায় শুধু বললো, ‘তুমিও?’ হ্যাঁ, সেও তার বোন ওফেলিয়ার মতো মনে করতো যে একটা বয়সে প্রেম ব্যাপারটা অশোভন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন সে দ্রুত সামলে নিতে সক্ষম হল, সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে করমর্দন করে তার কাছ থেকে বিদায় নিলো। ওই করমর্দনের মধ্যে যতখানি কৃতজ্ঞতা ছিল তার চাইতে বেশি ছিল আত্মসমর্পণের ভাব।

    অভ্যর্থনা কক্ষের রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওদের দুজনকে জাহাজ থেকে নেমে যেতে দেখলো। ঠিক যেমন সে আশা করছিলো, চাইছিলো, তাই হল। তাদের গাড়িতে উঠবার আগে ডাক্তার উরবিনো ডাজা ও তার স্ত্রী পেছনে ঘুরে তার দিকে তাকালো, সে ওদের উদ্দেশে বিদায়ী হাত নাড়ালো, আর ওরাও একই ভাবে উত্তর দিলো। মালপত্রের প্রাঙ্গণের ধুলার আড়ালে ওদের গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো, তারপর পোশাক পাল্টাবার জন্য তার ক্যাবিনে গেল। কাপ্তানের ব্যক্তিগত খাবার ঘরে জাহাজে প্রথম ডিনারের জন্য সে উপযুক্ত কিছু একটা পরবে।

    চমৎকার সন্ধ্যা-রাত কাটে। কাপ্তান দিয়েগো সামারিতানো নদীর বুকে তার চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ নানা রসালো গল্প শোনালো, কিন্তু সে যে মজা পাচ্ছে এটা দেখাবার জন্য ফারমিনা ডাজাকে খুব কষ্ট করতে হয়। আটটার সময় শেষ সতর্ক-ভেঁপু বাজানোর পর দর্শনার্থীদের নেমে যেতে হয়, জাহাজ থেকে অবতরণের সিঁড়িও তুলে ফেলা হয়, কিন্তু কাপ্তান তার খাওয়া শেষ করে সেতুর উপর গিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জাহাজ ছাড়লো না। ফারমিনা ডাজা ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রেলিং- এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো, তাদের চারপাশে হৈচৈ করা যাত্রীদল, কে সঠিক ভাবে শহরের আলোগুলি চিহ্নিত করতে পারে তা নিয়ে তারা বাজি ধরছে, অবশেষে জাহাজ উপসাগর থেকে বেরিয়ে এলো, অদৃশ্য নালা-খাল ও জলাভূমি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা জেলে নৌকাগুলির দোদুল্যমান আলোকমালার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলো, তারপর বড় ম্যাগডালেনা নদীর খোলা হাওয়ায় পড়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো। তখন ব্যান্ডবাদন দল একটা জনপ্রিয় সুর বাজালো, যাত্রীদের সানন্দ পদধ্বনির হুটোপুটি শোনা গেল, সবাই ছুটলো পাগলের মতো, শুরু হয়ে গেল নাচ।

    ফারমিনা ডাজার কাছে নিজের ক্যাবিনে গিয়ে আশ্রয় নেয়াই উত্তম মনে হয়। সারা সন্ধ্যা সে একটি কথাও বলে নি, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে ওর নিজের ভাবনায় ডুবে থাকতে দেয়। শুধু একবার তার ক্যাবিনের বাইরে শুভরাত্রি জানাবার জন্য সে তার চিন্তাধারায় বাধা দেয়, কিন্তু ফারমিনা ক্লান্ত হয় নি, তার শুধু একটু শীত শীত করছিল, সে বললো, তারা তার নিজস্ব ডেকে বসে কিছুক্ষণ নদী দেখতে পারে। ফ্লোরেন্টিনো দুটো বেতের আরাম কেদারা রেলিং-এর কাছে টেনে আনলো, বাতিগুলি নিভিয়ে দিলো, ওর কাঁধের উপর একটা উলের শাল জড়িয়ে দিলো, তারপর পাশে এসে বসলো। সে ওর জন্য ছোট্ট তামাকের কৌটাটা নিয়ে এসেছিল, বিস্ময়কর দক্ষতার সঙ্গে একটা সিগারেট বানিয়ে আগুন ধরানো মাথাটা মুখের মধ্যে পুরে ফারমিনা ধীরে ধীরে ধূমপান করতে লাগলো, কোনো কথা বললো না, আরো দুটো সিগারেট বানিয়ে পরপর সে ওই দুটো খেলো, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটু একটু করে চুমুক দিয়ে দুই থার্মস পাহাড়ি কফি শেষ করে ফেললো।

    দিগবলয়ের ওপারে নগরীর আলোগুলি মিলিয়ে গিয়েছিল। পূর্ণ চাঁদের আলোয় অন্ধকার ডেক থেকে মসৃণ নীরব নদী আর দু’পাশের চারণভূমি একটা দ্যুতিময় প্রান্তরের মতো দেখাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে বিশাল অগ্নিকুণ্ডের পাশে খড়ের কুটির দেখা যাচ্ছে, এখানে জাহাজের বয়লারের জন্য কাঠ বিক্রি করা হয় সেই সঙ্কেত দিচ্ছে। তার যৌবনের নদীভ্রমণের কিছু ধূসর স্মৃতি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তখনো ছিল, এখন নদীর দৃশ্য বিদ্যুতের ঝলকের মতো তার মনে আবার তা জীবন্ত করে জাগিয়ে তুললো, তার মনে হল ওই সব মাত্র গতকালের ঘটনা। সে ফারমিনা ডাজাকে কয়েকটা শোনালো, ভেবেছিলো এগুলি হয়তো তার মধ্যে কিছু উৎসাহের সঞ্চার করবে কিন্তু অন্য একটা জগতে ডুবে গিয়ে ও অব্যাহত ভাবে ধূমপান করতে থাকলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজের স্মৃতিচারণা বন্ধ করে ওকে ওর স্মৃতি নিয়ে থাকতে দিলো, আর এই সময়ে সে একটার পর একটা সিগারেট বানিয়ে, নিজেই তা ধরিয়ে, ওর হাতে দিতে লাগলো, যতক্ষণ না কৌটাটা খালি হয়ে যায়। মাঝরাতের পর বাজনা বন্ধ হয়, যাত্রীদের কণ্ঠস্বর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, শোনা যায় নিদ্রাতুর ফিসফিস শব্দ, আর ডেকের অন্ধকার ছায়ায়, কেউ কোথাও নাই, দুটি হৃদয় জাহাজের নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের সঙ্গে তাল রেখে স্পন্দিত হতে থাকে।

    অনেকক্ষণ পরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নদীর আলোয় ফারমিনা ডাজার দিকে তাকালো। তাকে দেখালো একটা অশরীরী প্রাণীর মতো, একটা হাল্কা নীল আলোয় ওর খোদাই করা মুখ কোমল দেখাচ্ছিলো, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টের পেল যে সে নিঃশব্দে কাঁদছে। কিন্তু ওকে সান্ত্বনা দেবার পরিবর্তে কিংবা তার অশ্রু বিসর্জন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, যা ফারমিনা চাইছিলো, সে তার আতঙ্কের কাছে আত্মসমর্পণ করে বললো, ‘তুমি কি একা থাকতে চাও?’

    ফারমিনা ডাজা বললো, ‘যদি চাইতাম তাহলে তোমাকে ভেতরে আসতে বলতাম না।’

    তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অন্ধকারের মধ্যে দুটি বরফ শীতল আঙ্গুল প্রসারিত করলো, অন্ধকারের মধ্যে অপর হাতটা খুঁজলো, তাকে পেলো তার জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু, ওই একটি চকিত মুহূর্তেই, তাদের এটা বুঝবার মতো স্বচ্ছ চেতনা ছিল যে স্পর্শ করার আগে তারা যেমন কল্পনা করেছিলো তাদের বুড়ো হাড়ের হাত দুটি সে রকম নয়। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আবার হাত দুটি তাদের কল্পনার মতোই হয়ে গেল। ফারমিনা ডাজা তার মৃত স্বামীর কথা বলতে শুরু করলো, এমনভাবে যেন তিনি এখনো বেঁচে আছেন, আর তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা উপলব্ধি করলো, নিজেকে ওর জিজ্ঞাসা করার সময় এসেছে, মর্যাদার সঙ্গে, রাজকীয় ভাবে, বেঁচে থাকবার অদম্য কামনা নিয়ে, যে-প্রেম এখন প্রভুহীন অবস্থায় তার মধ্যে পরিত্যক্ত পড়ে আছে তা নিয়ে তার কি করা উচিত।

    ফারমিনা ডাজা ধূমপান বন্ধ করলো যেন যে হাত তখনো তার হাতের মধ্যে ধরা ছিল সেটা ছেড়ে দিতে না হয়। সে ব্যাপারটা বুঝবার আকুলতায় মগ্ন হয়ে রইলো। তার স্বামীর চাইতে ভালো স্বামী সে কল্পনা করতে পারলো না, অথচ এখন তাদের জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে আনন্দের চাইতে অসুবিধার দিকগুলিই তার বেশি চোখে পড়লো, বড় বেশি পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, অর্থহীন তর্ক-বিতর্ক, পরিণতিহীন ক্রোধ। অকস্মাৎ সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘এতো ঝগড়াঝাঁটি আর এতো সমস্যার মধ্যে কেমন করে একটা মানুষ এতোগুলি সুখী বছর কাটাতে পারে তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমি সত্যিই জানি না, এ কি প্রেম নাকি অন্য কিছু?” যতক্ষণ সে অনেক কিছু বলে নিজেকে ভারমুক্ত করলো ততক্ষণ কেউ একজন চাঁদের বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলো। জাহাজ স্থির গতিতে এগিয়ে চলেছে, এক পায়ের সামনে আরেক পা দিয়ে : একটা বিশাল সতর্ক-সজাগ জন্তু। ফারমিনা ডাজা তার ব্যাকুলতা থেকে ফিরে এলো, বললো, ‘এখন যাও।’

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর হাতে একটা মৃদু চাপ দিলো, ওর দিকে একটু ঝুঁকলো, তার গালে একটা চুমু খেতে চাইলো, কিন্তু ফারমিনা ডাজা বাধা দিয়ে তার ভাঙা কোমল গলায় বললো, ‘এখন না, আমার গায়ে এখন একটি বৃদ্ধা রমণীর গন্ধ।

    সে শুনলো অন্ধকারের মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো চলে যাচ্ছে, সিঁড়ির বুকে সে তার পদধ্বনি শুনলো, আগামীকাল পর্যন্ত সে তার অস্তিত্বকে মুছে যেতে শুনলো। ফারমিনা ডাজা আরেকটা সিগারেট ধরালো। ধূমপান করতে করতে সে দেখতে পেলো ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে, পরনে অনবদ্য লিনেনের স্যুট, চেহারায় পেশাদারী দৃঢ়তা, চোখে-মুখে চোখ ধাঁধানো আকর্ষণ, দেখলো তাঁর সরকারি প্রেম, অতীতের অন্য এক জাহাজ থেকে তিনি তাঁর সাদা হ্যাট এক পাশে কাত করে বিদায় নিচ্ছেন। তিনি একবার তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা পুরুষরা সংস্কারের হতভাগ্য দাস, কিন্তু একটি নারী যদি কোনো পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হবার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে এমন কোনো দেয়াল নাই যা সে লঙ্ঘন করতে পারবে না, এমন কোনো দুর্গ নাই যা সে ধ্বংস করবে না, এমন কোনো নৈতিক বিবেচনা নাই যা সে একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলবে না : দুর্ভাবনা করার মতো কোনো ঈশ্বর কোথাও নাই।’ ভোর না হওয়া পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা নিশ্চল হয়ে বসে থাকলো, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা ভাবলো, ছোট্ট ইভাঞ্জেলস পার্কের সেই বিষণ্ণ প্রহরীর কথা নয়, ওই স্মৃতি তার মনে সামান্যতম স্মৃতিবিধুরতাও জাগালো না, সে ভাবলো বর্তমান ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা, বৃদ্ধ, খোঁড়া পা, কিন্তু বাস্তব, যে মানুষটা সব সময়ই তার হাতের নাগালের মধ্যে ছিল আর যাকে সে কখনোই স্বীকার করে নি। জীবন্ত জাহাজটি তাকে নিয়ে নতুন দিনের প্রথম গোলাপ সম্ভারের ঐশ্বর্যের পানে এগিয়ে চললো, আর এই মুহূর্তে সে ঈশ্বরের কাছে শুধু একটি প্রার্থনা জানালো, নতুন দিনটি কি ভাবে শুরু করতে হবে ফ্লোরেন্টিনে আরিজা যেন তা জানে।

    জেনেছিলো সে। সে জাহাজের স্টুয়ার্ডকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল ফারমিনা ডাজা যতক্ষণ ঘুমাতে চান তাঁকে যেন ততক্ষণ ঘুমাতে দেয়া হয়। ঘুম থেকে উঠে ফারমিনা ডাজা তার রাতের টেবিলের উপর দেখলো একটা ফুলদানিতে একটা তাজা সাদা গোলাপ ফুল, এখনো তার গায়ে শিশিরবিন্দু লেগে আছে, তার পাশে আছে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার একটা চিঠি, ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার পর যতগুলি পৃষ্ঠা লেখা সম্ভব হয়েছে তাই লিখেছে সে। একটা শান্ত স্নিগ্ধ চিঠি, গত রাতের পর থেকে সে তার নিজের মনের যে অবস্থা অনুভব করেছে তাই সে প্রকাশ করেছে এ চিঠিতে : তার অন্যান্য চিঠির মতোই সমান গীতিকাব্যিক, তার সব চিঠির মতোই সমান অলঙ্কারবহুল, কিন্তু এবার এসবের ভিত্তি ছিল নির্ভুল বাস্তবতা। পড়তে পড়তে ফারমিনা ডাজার বুক নির্লজ্জের মতো তোলপাড় করে উঠলে সে একটু বিব্রত বোধ করলো। চিঠির শেষে একটা অনুরোধ ছিল, তৈরি হবার পর সে যেন স্টুয়ার্ডকে খবর দেয়, কারণ কাপ্তান তাদের দুজনকে জাহাজ চালানোর কিছু রীতি কৌশল দেখাবার জন্য তার সেতুর উপর অপেক্ষা করছে।

    এগারোটার সময় সে তৈরি হয়ে গেল। ফুলের সুরভি মেশানো সাবান দিয়ে সে স্নান করেছে, তার গন্ধ বেরুচ্ছে তার শরীর থেকে, পরেছে একটা সাদাসিধা ধূসর রঙের বিধবাদের পোশাক, গতরাতের উথাল-পাতাল অবস্থার কোনো চিহ্ন নাই এখন তার মধ্যে। সে স্টায়ার্ডকে একটা মিতাচারী প্রাতরাশ পরিবেশন করতে অনুরোধ জানালো। স্টুয়ার্ডের পরনে ছিল শুচিশুভ্র সাদা পোশাক, সে ছিল কাপ্তানের নিজস্ব সেবায় নিয়োজিত। ফারমিনা ডাজা কিন্তু তাকে এসে নিয়ে যাবার জন্য কাউকে কোনো খবর দিলো না, একাই উপরে উঠে গেল। মেঘমুক্ত আকাশের ঔজ্জ্বল্য তার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কাপ্তানের সঙ্গে কথা বলছিলো। ফারমিনার মনে হল ওকে ভিন্ন রকম দেখাচ্ছে, সে এখন ওকে ভিন্ন চোখে দেখছে শুধু সেজন্য নয়, ও সত্যিই বদলে গেছিল। জীবনভর সে পরেছে শেষকৃত্যে যাবার উপযোগী কাপড়-জামা, এখন তার পায়ে আরামপ্রদ সাদা জুতা, পরনে ঢিলেঢালা প্যান্ট, গলা খোলা লিনেনের শার্ট, খাটো হাতা, বুক পকেটে দেখা যাচ্ছে তার নামাঙ্কিত রুমাল। তার মাথায় একটা সাদা স্কটিশ টুপি, ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য চোখে তার চিরকালীন চশমা, তার ওপর কালো কাচ, যা খুলে নেয়া যায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে এই সবই সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে, এই ভ্রমণ যাত্রার জন্যই এসব কেনা হয়েছে, ব্যতিক্রম ছিল শুধু তার অনেক দিনের পরা খয়েরি রঙের চামড়ার বেল্টটা, প্রথম নজরেই তা ফারমিনা ডাজার চোখে পড়ে, স্যুপের পেয়ালায় একটা মাছির মতো। স্পষ্টতই শুধু তার জন্য ওকে এই রকম সুসজ্জিত দেখে ফারমিনা ডাজার মুখে আগুনের মতো লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো, চেষ্টা করেও সে তা দমন করতে পারলো না। ওকে সুসম্ভাষণ করার সময় তাকে বিব্রত দেখালো, আর তার বিব্রত অবস্থা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে অধিকতর বিব্রত করলো। তারা উভয়েই যে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো আচরণ করছে এই উপলব্ধি ছিলো আরো বিব্রতকর এবং তারা উভয়েই যে ব্রিত এই সত্যটি তাদের আরো এতোটা বিব্রত করে তুললো যে কাপ্তান সামারিতানো একটা অনুকম্পার শিহরণসহ তা লক্ষ না করে পারলো না। সে পরবর্তী দু’ঘণ্টা ধরে জাহাজের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ও জাহাজ চালানোর সাধারণ রীতি কৌশল ওদের কাছে ব্যাখ্যা করে ওদেরকে ওদের বিব্রতকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো। জাহাজ চলছিলো খুব ধীর গতিতে, শুকনা বালির চড়ার মধ্য দিয়ে, এঁকেবেঁকে সাবধানে পথ কেটে। ওই সব বালির চড়া যেন দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু নদীর মোহনায় জল যেমন উত্তাল থাকে এখানে তা ছিল না, এখানে তা শান্ত, পরিষ্কার, জ্বলন্ত সূর্যের নিচে ধাতুর মতো উজ্জ্বল। ফারমিনা ডাজার মনে হল এটা একটা বালুর দ্বীপাকীর্ণ ব-দ্বীপ।

    কাপ্তান বললো, ‘নদীর এই-ই আমাদের অবশিষ্ট আছে।‘

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নদীর এই পরিবর্তন দেখে যথার্থই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। পর দিন যা দেখলো তাতে সে আরো অবাক হল, জাহাজ চালানো কঠিন হয়ে ওঠে, সে বুঝলো যে জলরাশির জনক ম্যাগডালেনা ছিল বিশ্বের বৃহত্তম নদীগুলির অন্যতম, এখন তা স্মৃতির একটা মরীচিকা মাত্র। কাপ্তান সামারিতানো জানালো, পঞ্চাশ বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বন উজাড় করে ওরা নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে : নৌযানগুলির বয়লারসমূহ বিশাল বিশাল গাছের ঘন অরণ্যকে গিলে খেয়েছে। ওই বৃক্ষরাজির গুরুভারই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার প্রথম নদী ভ্রমণ ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলো। ফারমিনা ডাজা তার স্বপ্নের প্রাণীগুলি আর দেখবে না। শিকারিরা নিউ অর্লিয়ান্সের চামড়া পাকা করার কারখানাগুলির চাহিদা মিটাবার জন্য কুমারগুলিকে নির্মূল করে দিয়েছে। ওই প্রাণীগুলি খাল-খাড়ির পাশে নদীতীরে মুখ হাঁ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মড়ার মতো পড়ে থাকতো, প্রজাপতি আর ফড়িং ধরার জন্য। গাছগাছালি ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে তীক্ষ্ণ শিস দেয়া টিয়া পাখির ঝাঁক আর পাগলের মতো চিৎকার করা বানরের পাল অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুশুক জাতীয় যে মানাতিগুলি তাদের বিশাল স্তনে তাদের শিশুদের দুধ খাওয়াতো, নদীতীরে শুয়ে যারা পরিত্যক্ত নারীর গলায় ক্রন্দন করতো, তারা এখন এক বিলুপ্ত প্রজাতি। শিকারিরা নিছক ক্রীড়ার স্বার্থে বর্মাচ্ছাদিত বুলেট ছুড়ে তাদের নিঃশ্বেষ করে দিয়েছে।

    ওই প্রাণীগুলির জন্য কাপ্তান সামারিতানোর প্রায় একটা মাতৃসুলভ মমতা ছিল। তার কাছে ওদের মনে হত কোনো অসংযমী প্রেম কর্তৃক অভিশপ্ত মহিলাদের মতো। সে প্রচলিত একটা লোকগল্পে বিশ্বাস করতো যে প্রাণীজগতে এরাই ছিল একমাত্র নারীকুল যাদের কোনো পুরুষ সঙ্গী থাকতো না। আইন থাকা সত্ত্বেও যারা জাহাজ থেকে এদের উপর গুলি ছুড়তো সে সব সময় তার বিরোধিতা করেছে। একবার নর্থ ক্যারোলাইনার এক শিকারি, বৈধ কাগজপত্র নিয়েই, কাপ্তানের নিষেধ অমান্য করে তার স্প্রিঙ্গফিল্ড রাইফেলের লক্ষ্যভেদী আঘাতে এক মা-মানাতির মাথা গুঁড়িয়ে দেয়। বাচ্চাটা শোকে-দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে মায়ের বুকের ওপর পড়ে থাকে। তাকে দেখাশোনা করার জন্য কাপ্তান এতিম শিশুটিকে জাহাজে তুলে আনে আর খুন করা মায়ের মৃতদেহের পাশে নির্জন নদীতীরে শিকারিকে ফেলে রেখে আসে। কূটনৈতিক প্রতিবাদের ফলে কাপ্তানকে ছ’মাস কারাগারে কাটাতে হয়, সে তার জাহাজ চালাবার লাইসেন্স প্রায় খোয়াতে বসে, কিন্তু ওই একই কাজ করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে সে জেল থেকে বেরিয়ে আসে, যতবার প্রয়োজন হবে ততবারই সে তাই করবে। ঘটনাটা ছিল ঐতিহাসিক। মাতৃহারা শিশুটি সান নিকোলাস ডি লা বারাঙ্কাসের বিরলপ্রাণী চিড়িয়াখানায় বড় হয়ে ওঠে, অনেক দিন বাঁচে, কিন্তু নদীর কূলে দেখা পাওয়া ওই প্রজাতির প্রাণীকুলের মধ্যে সেই ছিল সর্বশেষ!

    কাপ্তান বললো, ‘আমি যতবার ওই জায়গা দিয়ে যাই ততবারই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ওই হতভাগা ভিনদেশীটা যেন আবার আমার জাহাজে ওঠে, তাহলে আমি আবারও ওইখানে ফেলে রেখে যাবো।’

    এ পর্যন্ত ফারমিনা ডাজার মনে কাপ্তানের জন্য কোনো প্রীতির ভাব জাগে নি, কিন্তু দয়াদ্রচিত্ত দৈত্যের মতো মানুষটার কাহিনী তাকে এতই নাড়া দেয় যে এরপর কাপ্তান ওর হৃদয়ে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে নেয়। ওর ভুল হয়নি, তাদের ভ্রমণ যাত্রা সবে শুরু হয়েছে, সামনে আরো অনেক ঘটনা ঘটবে যা তার মূল্যায়নের যথার্থতা স্পষ্ট করে তুলবে।

    দুপুরের খাওয়ার সময় না হওয়া পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সেতুর উপর থাকলো। অপর তীরের কালামার শহর অতিক্রম করার অল্প পরেই লাঞ্চ পরিবেশিত হয়। মাত্র কয়েক বছর আগে এই শহরে সারাক্ষণ উৎসব অনুষ্ঠান লেগে থাকতো, আর আজ এটা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত বন্দর, রাস্তাঘাট জনশূন্য। জাহাজ থেকে ওরা দেখলো মাত্র একজন সাদা পোশাক পরা নারী, রুমাল নেড়ে ওদের ডাকছে। ফারমিনা ডাজা বুঝতে পারলো না কেন ওর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখেও ওকে জাহাজে তুলে নেয়া হল না। কাপ্তান ওকে জানালো যে ও আসলে জলে ডুবে মরা এক মেয়ের প্রেত, মিথ্যা সঙ্কেত দিয়ে জাহাজকে ভুলিয়ে ওপারের বিপজ্জনক ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলে। ওরা এতো কাছে দিয়ে গেল যে ফারমিনা ডাজা সূর্যালোকে ওকে স্পষ্ট দেখলো, ওর যে কোনো অস্তিত্ব নাই সে সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ রইলো না, কিন্তু তার মনে হল ওই মুখ তার পরিচিত।

    দিনটা ছিল দীর্ঘ ও উষ্ণ। লাঞ্চের পর ফারমিনা ডাজা তার অপরিহার্য দিবানিদ্রার জন্য নিজের ক্যাবিনে ফিরে গেল, কিন্তু কানের ব্যথার জন্য তার ভালো ঘুম হল না। নিজেদের জাহাজের পাশ দিয়ে আর.সি.সি.-র অন্য কোনো জাহাজ গেলে ভেঁপু বাজিয়ে শুভ-সম্ভাষণ জানানোর রীতি ছিল বাধ্যতামূলক। বারাঙ্কা ভিয়েজার কয়েক মাইল উজানে ওই রকম একটা জাহাজ তাদের পাশ দিয়ে উল্টো দিকে চলে যাবার সময় দু’জাহাজের ভেঁপু বেজে ওঠে। ওই শব্দে ফারমিনা ডাজার কানের ব্যথা আরো বেড়ে যায়।

    আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রধান অভ্যর্থনা কক্ষে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। বেশির ভাগ যাত্রীই ওখানে এমনভাবে ঘুমাচ্ছিল যেন এখন রাত দুপুর। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রোসাল্ববাকে স্বপ্নে দেখলো, ঠিক যেখানে ওকে জাহাজ থেকে নামতে দেখেছিলো ওর কাছাকাছি জায়গায় পৌছে, শুধু এখন শিশুটিকে নয়, সে স্বপ্নে রোসাল্বাকে ছাদ থেকে ঝোলানো খাটটায় শুয়ে থাকতে দেখলো। স্বপ্নটা ছিল এমনই রহস্যজনক ও আমুদে যে বাকি বিকালটা কাপ্তান আর কাপ্তানের পরিচিত দুই বন্ধুর সঙ্গে ডমিনো খেলতে খেলতে সে ওটা উপভোগ করলো।

    সূর্য ডোবার পর আবহাওয়া একটু ঠাণ্ডা হল, জাহাজও যেন আবার প্রাণ ফিরে পেলো। যাত্রীরা, মনে হল, একটা ঘোরের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা স্নান করেছে, ধোয়া কাপড়-জামা পরেছে, অভ্যর্থনা কক্ষে বেতের চেয়ারে বসে নৈশাহারের জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক পাঁচটার সময় একজন খাবার পরিবেশক ডেকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে গির্জার ঘণ্টা বাদকের মতো একটা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে খাবার পরিবেশিত হওয়ার ঘোষণা দিল। সবাই ঠাট্টার ভঙ্গিতে করতালি দিয়ে ওই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো। খাওয়ার সময়ে ব্যান্ড নাচের বাজনা বাজাতে শুরু করে, তারপর নাচ চলতে থাকে মধ্যরজনী পর্যন্ত।

    কানের ব্যথার জন্য ফারমিনা ডাজার খেতে ইচ্ছা করছিল না। একটা নির্জন গিরিখাতের পাশে স্তূপ করে রাখা কাঠ জাহাজের বয়লারের জন্য তোলা হচ্ছিল। ফারমিনা ডাজা বসে বসে তা দেখছিল। কোথাও আর কিছুই নাই, শুধু কাঠের স্তূপ, আর একটি অতি বৃদ্ধ লোক, যে সব কিছু তত্ত্বাবধান করছিল। কয়েক মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী আছে বলে মনে হল না। ফারমিনা ডাজার জন্য এই রকম বিরতি ছিল দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, ইউরোপের সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে এটা ছিল অচিন্তনীয়, তার ওপর গরমটা ছিল এতো তীব্র যে তার শীতল করা পর্যবেক্ষণ ডেকেও সে তার আঁচ অনুভব করছিল। কিন্তু নোঙ্গর তুলে জাহাজ চলতে শুরু করতেই অরণ্যের হৃদয়ের গন্ধ নিয়ে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগলো। ব্যান্ডের বাজনা হয়ে উঠলো আরো প্রাণবন্ত। সিটিও নুয়েভো শহরে দেখা গেল মাত্র একটি বাড়ির মাত্র একটি জানালায় মাত্র একটি আলো। বন্দর দপ্তর কোনো মালপত্র বা কোনো যাত্রীর সঙ্কেত দিল না, তাই কোনো সম্ভাষণ না করেই জাহাজ তার পাশ দিয়ে চলে গেল।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার ক্যাবিনের দরজায় টোকা না দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য কী কৌশল অবলম্বন করে ফারমিনা ডাজা সারাটা বিকাল তা নিয়ে ভেবেছে, কিন্তু আটটা নাগাদ ওর সাহচর্যের জন্য নিজের ব্যাকুলতা সে আর দমন করতে পারলো না। সে বারান্দায় বেরিয়ে এলো, ওখানে হয়তো ওর দেখা পাবে, তখন ভান করবে যেন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। তাকে বেশি দূর যেতে হল না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বারান্দায় একটা বেঞ্চে বসে ছিল, ইভাঞ্জেলস পার্কে যেমন বসে থাকতো সেই ভাবে, নীরব এবং নিঃসহায়, দু’ঘণ্টার ওপর সে ভেবে চলেছে, কিভাবে ফারমিনা ডাজার সঙ্গে সে দেখা করবে। এখন দেখা হতেই তারা উভয়েই অবাক হবার একই ভঙ্গি করলো, দুজনেই বুঝলো যে এটা একটা ভান, তারপর তারা দুজন একসঙ্গে প্রথম শ্রেণীর ডেকে পায়চারি করতে লাগলো। ডেক তখন ছিল তরুণ- তরুণীতে পূর্ণ, উচ্ছল ছাত্রদল ছুটি হয়ে যাওয়ার শেষলগ্নে ক্লান্ত না হয়ে পড়া পর্যন্ত হৈচৈ-এ লিপ্ত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আর ফারমিনা ডাজা পানপ্রকোষ্ঠে গিয়ে বসলো, তারাও যেন দুজন ছাত্র, তারা বোতলে ভরা কোমল পানীয় পান করলো, আর তখন ফারমিনা ডাজা হঠাৎ নিজেকে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে দেখতে পেলো, সে বলে উঠলো, ‘কী সংঘাতিক!” ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে জিজ্ঞাসা করলো, কী সে ভাবছিলো যা তাকে এতো বিচলিত করলো।

    ‘ওই বৃদ্ধ দম্পতি’, সে বললো। ‘ওই যাদেরকে নৌকায় পিটিয়ে খুন করা হয়।’

    বাজনা থামার পর, অন্ধকার পর্যবেক্ষণ ডেকে অনেকক্ষণ প্রশান্ত চিত্তে কথা বলার শেষে, ওরা দুজন এবার যার যার ঘরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। চাঁদ ছিলো না আকাশে, আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, দিগ্বলয়ে বিদ্যুতের ঝলসানি মুহূর্তের জন্য ওদের দুজনকে আলোকিত করে দিচ্ছিল, কিন্তু বজ্রগর্জন হচ্ছিল না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে সিগারেট বানিয়ে দিচ্ছিলো কিন্তু ও দু’চারটার বেশি খায় নি, ওর কানের ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য থেমে থাকে, কিন্তু তারপর যখনই তাদের জাহাজ অন্য একটি জাহাজের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কিংবা কোনো ঘুমন্ত একটা গ্রাম অতিক্রম করছিল, কিংবা নদীর জলের মাপ নেবার জন্য গতি কমিয়ে দিচ্ছিল, আর ভেঁপু বাজাচ্ছিল ওই সব সময়ে, তখনই ওর কানের ব্যথা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে বলে, কী গভীর আকুলতা নিয়ে সে কবিতা উৎসবের সময়, বেলুন উড্ডয়নের সময়, সার্কাসের কসরৎ দেখানোর সময় ওকে লক্ষ করেছে, কি প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে সে সারা বছর বিভিন্ন সরকারি উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে শুধু ওর দেখা পাবার জন্য। ফারমিনা কিন্তু সে যে শুধু ওকে দেখার জন্য এসব জায়গায় উপস্থিত থাকতো তা কল্পনাও করতে পারে নি। কিন্তু গত প্রায় এক বছর ধরে সে ওর চিঠিপত্র পড়ার পর ভেবেছে ও কেন কবিতা উৎসবের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় নি, ফারমিনা ডাজার কোনো সন্দেহ ছিল না যে অংশ নিলে সে অবশ্যই পুরস্কার পেতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নির্দ্বিধায় মিথ্যা করে বললো, সে শুধু ওর জন্য লেখে, তার কবিতা কেবল ওরই জন্য, সে একাই শুধু ওই সব কবিতা পড়ে। এবার অন্ধকারের মধ্যে ফারমিনা ওর হাতের জন্য নিজের হাত বাড়ালো, কিন্তু গত রাতে তার হাত যেমন ফ্লোরেন্টিনোর হাতের জন্য অপেক্ষা করে ছিলো, এখন ওর হাতকে সে রকম অপেক্ষমাণ দেখলো না। বরং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যেন অবাক হল, আর তার বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে বললো, ‘মেয়েরা কী অদ্ভুত।’

    ফারমিনা হেসে উঠলো, একটা তরুণ ঘুঘুর ভরাট গলার হাসি, আর আবারও তার নৌকার ওই বৃদ্ধ দম্পতির কথা মনে হল। ওই ছবি তার বুকে খোদাই হয়ে গেছে, চিরকাল তা তাকে তাড়া করবে, কিন্তু আজ রাতে সে ওটা সহ্য করতে পারবে, কারণ তার নিজেকে মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ প্রশান্ত, উৎকণ্ঠামুক্ত, কোনো অপরাধ বোধ নাই তার, জীবনে খুব কমই সে এই রকম অনুভূতির স্বাদ পেয়েছে। সে সকাল পর্যন্ত ওই ভাবে বসে থাকতো, নীরবে, ওর হাত তার হাতের মধ্যে বরফ শীতল ঘামে ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু সে আর তার কানের ব্যথা সহ্য করতে পারলো না। তাই, বাজনা থামার পর, অভ্যর্থনা কক্ষে সাধারণ যাত্রীদের ঝুলন্ত দোলনার হট্টগোল থিতিয়ে এলে, সে টের পেলো যে ওর সঙ্গে থাকার ইচ্ছার চাইতেও তার কানের ব্যথা বেশি হয়ে উঠেছে। সে জানতো যে ওকে বললেই তার ব্যথা কিছু উপশম হবে, কিন্তু ওকে সে কোনো দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় নি, তাই ওকে সে কিছু জানালো না। তার মনে হল সে যেন ওর সঙ্গে সারা জীবন কাটিয়েছে। তার ব্যথা উপশমের জন্য জাহাজ ঘুরিয়ে বন্দরে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব হবে না।

    আজ রাতের পরিস্থিতি কি হতে পারে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তা অনুমান করেছিল। সে আর এগুলো না। ওর ক্যাবিনের সামনে সে ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে চুম্বন করতে চাইলে ফারমিনা ডাজা তার বাঁ গাল বাড়িয়ে দেয়। সে ভারি নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও চুমু খেতে চাইলে ফারমিনা ডাজা এবার তার ডান গাল বাড়িয়ে দেয়, আর এমন একটা চটুল ভঙ্গিতে যা ফ্লোরেন্টিনো ওর স্কুল-ছাত্রীর বয়সেও ওর মধ্যে দেখে নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আবারও জেদ করলো, ফারমিনা ডাজা তখন তার ঠোঁট তুলে ধরলো, তার মধ্যে এমনই প্রচণ্ড কাঁপুনি দেখা দিলো যে তা দমন করার জন্য ও হেসে উঠলো, তার বাসর রাত্রির পর এই রকম হাসি সে ভুলে গিয়েছিল। সে বলল, ‘উঃ, জাহাজে উঠলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়।’

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কেঁপে ওঠে। ও নিজে যেমন বলেছিল তাই অনুভব করলো সে। ওর মধ্যে সে বার্ধক্যের টকে যাওয়া গন্ধ পেলো। তবু, ঘুমন্ত দোলনাগুলির গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে নিজের ক্যাবিনে যেতে যেতে সে একটা কথা মনে করে সান্ত না পেলো, সে নিজেও নিশ্চয়ই একই রকম গন্ধ উপহার দিয়েছে, সে ওর চাইতে চার বছরের বড়, ও-ও একই রকম গন্ধ পেয়েছে তার মধ্যে এবং একই রকম অনুভূতি জেগেছে তার মনে। এটা হল মানবিক উত্তেজনা-অস্থিরতার গন্ধ, সে তার সব চাইতে বয়স্ক প্রেমিকাদের মধ্যে এই গন্ধ পেয়েছে, ওরাও যেমন পেয়েছে তার মধ্যে। বিধবা নাজারেত, যে কিছুই নিজের মধ্যে চেপে রাখতো না, তাকে একবার আরো স্থূলভাবে বলেছিলো, ‘এখন আমাদের মধ্য থেকে মুরগির খোঁয়াড়ের গন্ধ নির্গত হয়।’ ওরা দুজন পরস্পরকে সহ্য করতো, কারণ তারা ছিল সমান প্রতিপক্ষ : আমার গন্ধ বনাম তোমার গন্ধ। পক্ষান্তরে, প্রায়ই আমেরিকার ভিসুনার যত্ন নেয়ার সময় সে ওর গায়ে বাচ্চার গন্ধ পেতো, তার মধ্যে তখন জেগে উঠতো মাতৃসুলভ অনুভূতি, তবে ও হয়তো তার গন্ধ অপছন্দ করছে এই ভাবনা তাকে বিচলিত করতো। কিন্তু এই সবই এখন অতীতের বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কথা হল এই যে সুদূর অতীতের এক বিকালে পিসি এস্কোকলাস্তিকা টেলিগ্রাফ আপিসের কাউন্টারের ওপর তাঁর প্রার্থনা পুস্তক ফেলে রেখে আসার পর থেকে আজ রাতে সে যে বিপুল সুখ অনুভব করেছে এমন আর সে কখনো অনুভব করে নি।

    পাঁচটার সময় তার একটু ঝিমুনি আসে। এই সময় জাহাজের এক কর্মচারী জাম্রানো বন্দরে তাকে জাগিয়ে তুলে তার হাতে একটা জরুরি টেলিগ্রাম দেয়। লিওনা কাসিয়ানির সই করা গতকালের তারিখ দেওয়া টেলিগ্রামে ভয়ঙ্কর খবরটা ছিল এক লাইনের, ‘গতকাল আমেরিকা ভিসুনা মারা গেছে, কারণ অজ্ঞাত।’ সকাল এগারোটার সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টেলিগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে লিওনা কাসিয়ানির কাছ থেকে বিশদ খবর নিলো। যুবা বয়সে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসাবে কাজ করার পর এই প্রথম সে নিজের হাতে খবর গ্রহণ ও বিতরণ করলো। আমেরিকা ভিসুনা তার ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করে এবং নিদারুণ মানসিক বিষাদে আক্রান্ত হয়। স্কুলের হাসপাতাল থেকে এক শিশি লডেনাম চুরি করে এনে সে গোটা শিশির ওষুধ খেয়ে ফেলে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অন্তরের অন্তঃস্থলে বুঝতে পারলো এটাই ঘটনার সবটুকু নয়। কিন্তু না, আমেরিকা ভিসুনা কোনো কিছু লিখে রেখে যায় নি যার সূত্র ধরে এই ঘটনার জন্য অন্য কাউকে দোষী করা যায়। ওর পরিবারের লোকজনকে লিওনা কাসিয়ানি খবর দিয়েছিল, তারা পুয়ের্টো পাড়ি থেকে এখনই এসে পড়বে। শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদিত হবে আজই বিকাল পাঁচটায়। এই স্মৃতির যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে চলমান রাখার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সামনে একটা পথই খোলা ছিল। সে ওটাকে তার মন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেললো। তবু, এর পর সে যে ক’বছর বেঁচে ছিল মাঝে মাঝে, অকস্মাৎ, কোনো কারণ ছাড়াই, ওই স্মৃতি একটা পুরানো ক্ষতচিহ্নের মতো তাকে পীড়িত করতো।

    পরবর্তী দিনগুলি ছিল গরম, মনে হচ্ছিল অন্তহীন। নদী হয়ে উঠলো সরু ও কর্দমাক্ত। তার প্রথম ভ্রমণের সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিশাল বৃক্ষরাজির যে জঙ্গল দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিল এখন সেখানে দেখা গেল শুধু ভস্মীভূত সমতল ভূমি, নৌযানগুলির বয়লারের ক্ষুধা মিটাতে জঙ্গলের পর জঙ্গল উজাড় হয়ে গেছে, আর দেখা গেল পাণ্ডব বর্জিত ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামের পর গ্রাম, প্রচণ্ড খরার দিনেও যেখানে রাস্তা কাদা- জলে ভেসে যায়। রাতের বেলায় বালুকাময় তীর থেকে মানাতির রহস্যময় গানের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায় না, তার পরিবর্তে তাকে জাগিয়ে তোলে সাগরের দিকে ভেসে যাওয়া ফুলে ওঠা মৃতদেহের গা গুলিয়ে ওঠা দুর্গন্ধ। কাপ্তান তার স্বভাববিরুদ্ধ গম্ভীর মুখে বললো, ‘আমাদের ওপর নির্দেশ এসেছে যাত্রীদের যেন বলা হয় যে এগুলি দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া মানুষদের মৃতদেহ।’ এক সময় যেখানে টিয়া পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকার আর অদৃশ্য বানরের প্রচণ্ড হট্টগোল মধ্যদিনের উত্তাপকে তীব্র করে তুলতো এখন সেখানে বিরাজ করছে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত অঞ্চলের বিশাল নীরবতা।

    জাহাজের জন্য কাঠ সংগ্রহের জায়গাগুলি ছিল এতো স্বল্পসংখ্যক ও এতো দূরে দূরে অবস্থিত যে চতুর্থ দিন নাগাদ ‘নয়া বিশ্বস্ততা’-র জ্বালানি ফুরিয়ে গেল। প্ৰায় এক সপ্তাহ তারা এক জায়গায় অচল হয়ে পড়ে থাকলো, জাহাজের মাল্লারা ভস্মীভূত জায়গাগুলিতে কোথাও কোনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের ডালপালা পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখলো। চারদিক সম্পূর্ণ জনশূন্য। কাঠুরেরা তাদের পথের রেখা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, ধরণীর প্রভুদের হিংস্রতার সামনে থেকে সবাই পালিয়ে গেছে, অদৃশ্য কলেরা থেকে সবাই পালিয়ে গেছে, শূককীটের যে যুদ্ধ সরকার তার দিশেহারা বিধানসমূহের সাহায্যে গোপন করার প্রয়াস পাচ্ছিল তার সামনে থেকে সবাই পালিয়ে গেছে। আর, ইত্যবসরে, যাত্রীরা তাদের একঘেয়েমি কাটাবার জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো, শিকার অভিযানে বেরুলো, ফিরে এলো জ্যান্ত গোসাপ নিয়ে, তারপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাদের চিরে ফেলে পেটের ভেতর থেকে নরম, প্রায় স্বচ্ছ, ডিমের ঝাঁক বের করে ফেলে, গাঁট বাঁধার সূঁচ দিয়ে আবার সেলাই করে শুকোবার জন্য জাহাজের রেলিং-এ ঝুলিয়ে দিল। শিকারিদের পথ ধরে তাদের পেছন পেছন এলো নিকটবর্তী গ্রামগুলির দারিদ্র্যপীড়িত বেশ্যার দল, নদীতীর ঘেঁষে খাড়ির পাশে তারা তৈরি করলো অস্থায়ী তাঁবু, তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে এলো গান-বাজনা আর মদ, আর আটকে পড়া জাহাজের চারপাশে নদী জুড়ে মেতে রইলো পানোল্লাসে।

    আর. সি. সি.-র প্রেসিডেন্ট হবার অনেক আগে থেকেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নদীর অবস্থা সম্পর্কে ভয়াবহ রিপোর্ট পেয়ে আসছিলো, কিন্তু সে ওসব, বলতে গেলে, পড়তোই না। সহকর্মীদের আশ্বস্ত করে সে বলতো, ‘যতদিনে কাঠ ফুরিয়ে যাবে ততদিনে জাহাজের জ্বালানির জন্য তেলের ব্যবহার চালু হয়ে যাবে।’ তার সারা মন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল ফারমিনা ডাজার ভাবনায়, নদী নিয়ে সে ভাবেই নি, যখন প্রকৃত অবস্থা সে বুঝলো তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে, আরেকটা নতুন নদী নিয়ে আসা ছাড়া কারো আর কিছু করার ছিল না। নদীর জলের অবস্থা যখন সব চাইতে ভালো ছিল তখন জাহাজকে রাতে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, আর তখন বেঁচে থাকার মতো সহজ ব্যাপারটাই অসহনীয় হয়ে উঠতো। বেশির ভাগ যাত্রী, বিশেষ করে ইউরোপীয়রা, তাদের ক্যাবিনের মহামারীর মতো পচা দুর্গন্ধ পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসতো, রাত ভর ডেকের ওপর পায়চারি করতো, যে-তোয়ালে দিয়ে তাদের গায়ের অবিরল ঘামের স্রোতধারা মুছতো সেই তোয়ালে দিয়েই যাবতীয় শিকারি পোকামাকড় তাড়াতো। সকাল বেলা তাদের দেখাতো ক্লান্ত, অবসন্ন, গায়ের বিভিন্ন জায়গা পোকার কামড়ে স্ফীত। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এক ইংরেজ পর্যটক এই ভ্রমণ সম্পর্কে, যা শেষ করতে ডিঙি নৌকায় ও খচ্চরের পিঠে প্রায় পঞ্চাশ দিন লাগতো, লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে যতো কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক ভ্রমণ আছে তার মধ্যে এটা হল অন্যতম।’ বাষ্পচলিত নৌ চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার প্রথম আশি বছরে ওকথা আর যথার্থ ছিল না, কিন্তু কুমিরের পাল যখন শেষ প্রজাপতিটিও খেয়ে ফেললো, মাতৃসুলভ মানাতিরা যখন উধাও হয়ে গেল, টিয়া পাখির ঝাঁক, বানরকুল আর গ্রামগুলি যখন নিশ্চিহ্ন হল, সব, সব কিছু যখন শেষ হয়ে গেল, তখন ওই উক্তি আবার সত্য হয়ে উঠলো।

    কাপ্তান হেসে উঠে বললো, ‘কোনো সমস্যা নাই, কয়েক বছরের মধ্যে আমরা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকের ওপর দিয়ে বিলাসবহুল মোটর গাড়ি চালাবো।’

    প্রথম তিন দিন ফারমিনা ডাজা আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঘেরাটোপ দেয়া পর্যবেক্ষণ ডেকের কোমল বসন্তকালীন আবহাওয়ায় সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু কাঠের সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হল, তাদের ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা ব্যর্থ হল, আর তখন ‘রাষ্ট্রপতির কক্ষসমূহ’-র অবস্থা হল উষ্ণ স্নানাগারের মতো। ফারমিনা রাতগুলি টিকে থাকলো খোলা জানালা দিয়ে নদীর হাওয়া আসার জন্য, তার তোয়ালে নেড়ে সে মশার ঝাঁক তাড়াতে লাগলো, কারণ জাহাজ নোঙর ফেলে থাকার সময় পোকামাকড় প্রতিহত করার বোমাগুলি কোনো কাজে এলো না। তার কানের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল, তারপর এক সকালে জেগে উঠে সে দেখলো যে সব যন্ত্রণা অকস্মাৎ অন্তর্হিত হয়েছে, পুরোপুরি, পিষে মেরে ফেলা একটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো। সেদিন রাতের আগে সে বুঝতেই পারে নি যে তার বাঁ কান শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। সেদিন রাতে তার বাঁ কানের দিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কি একটা কথা বলে, মাথা ঘুরিয়ে তাকে কথা শুনতে হয়, তখনই আসল ব্যাপারটা তার কাছে ধরা পড়ে। তবে এটাকে বার্ধক্যের আরোগ্যাতীত একটা ত্রুটি হিসাবে ধরে নিয়ে সে সহজেই এর কাছে আত্মসমর্পণ করলো।

    সব কিছু সত্ত্বেও দেরিটা তাদের জন্য দৈবের একরকম অনুগ্রহ হয়ে ওঠে | ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একবার কোথাও পড়েছিলো : ‘দুর্বিপাকের সময় প্রেম বৃহত্তর ও মহত্তর হয়ে ওঠে।’ বাতাসের আর্দ্রতা ‘প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে’ তাদের মধ্যে একটা অবাস্তব আলস্য এনে দেয় যেখানে কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই প্রেম করা সহজতর হয়ে ওঠে। তারা রেলিং-এর পাশে আরাম কেদারায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরস্পরের হাত ধরে থাকলো, তাড়াহুড়া না করে চুমু খেলো, ধৈর্যহীনতার খানাখন্দ এড়িয়ে প্রণয়স্পর্শের তূরীয় আনন্দ উপভোগ করলো। হতচেতন করা তৃতীয় রাতে ফারমিনা ডাজা ওর জন্য অপেক্ষা করলো এক বোতল আনিসেৎ সুরা নিয়ে। কাজিন হিল্ডাব্রাণ্ডার সঙ্গে লুকিয়ে সে এই সুরা এক সময় পান করেছে, তারপর বিয়ে এবং ছেলেমেয়ে হবার পর সে তার ধার করা জগতের বান্ধবীদের সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে আনিসে পান করেছে। তার নিয়তি সম্পর্কে সে খুব বেশি স্বচ্ছতার সঙ্গে চিন্তা করতে চায় নি, তাই তার কিছুটা সুরামত্ত হবার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভাবলো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবার জন্য সাহস সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে সে এটা করেছে। ওই অলীক বিশ্বাসে উৎসাহিত হয়ে সে তার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে তার বিবর্ণ ঘাড়, কঠিন বন্ধনীর মাঝে আটকানো তার বুক, তার কটিদেশের ক্ষয়িষ্ণু হাড়, তার শিরাবহুল ঊরু, সর সাদরে আবিষ্কার করতে থাকলো। ফারমিনা ডাজা এই আদর গ্রহণ করলো চোখ বন্ধ করে, সে কেঁপে উঠলো না, নিয়মিত বিরতি দিয়ে ধূমপান ও সুরা পান করতে থাকলো। অবশেষে, ওর প্রণয় স্পর্শ যখন তার পেটের ওপর দিয়ে প্রসারিত হল, ততক্ষণে যথেষ্ট আনিসেৎ সে গলাধঃকরণ করেছে, ফারমিনা ডাজা বললো, ‘যদি করতেই চাই তবে এসো করে ফেলি, কিন্তু বড়দের মতো করে করি।’

    সে ওকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলো, আলো না নিভিয়েই, কোনো রকম কপট বিনয় ছাড়াই, সে তার কাপড়-জামা খুলতে শুরু কররো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে, চেষ্টা করছে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, এবারও যে ব্যাঘ্রকে সে নিধন করেছে তার চামড়া নিয়ে কী করবে ঠিক করতে পারছে না। ফারমিনা বললো, ‘তাকিও না।’ ছাদের উপর থেকে তার চোখ না সরিয়ে ফ্লোরেন্টিনো জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন?’

    ‘কারণ যা দেখবে তা তোমার ভালো লাগবে না।’

    তখন সে ওর দিকে তাকালো, দেখলো কোমর পর্যন্ত তার অনাবৃত শরীর, যেমন কল্পনা করেছিল সেই রকমই। কাঁধের চামড়া কোঁচকানো, স্তন ঝুলে পড়েছে, পাঁজরের উপরে শিথিল ত্বক যেন ব্যাঙের ত্বকের মতো বিবর্ণ ও ঠাণ্ডা। এই মাত্র খুলে ফেলা ব্লাউজটা দিয়ে বুক ঢেকে ফেলে ও আলো নিভিয়ে দিলো। তখন সে তার নিজের পোশাক একটা একটা করে ওর দিকে ছুড়ে দিলো আর ও সঙ্গে সঙ্গে আবার সেগুলি খিলখিল করে হাসতে হাসতে তার দিকে ছুড়ে দিল।

    তারা অনেকক্ষণ চিৎ হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকলো, সুরার প্রভাব যত কেটে যেতে থাকলো ফ্লোরেন্টিনো ততই উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকলো, আর ফারমিনাকে মনে হল প্রশান্ত, প্রায় যেন ইচ্ছাশক্তিহীন, সে কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে যেন বোকার মতো হেসে না ওঠে, মাত্রাতিরিক্ত আনিসেৎ পান করলে অনিবার্য ভাবে তার মধ্যে ওই প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো। ওরা সময় কাটাবার জন্য কথাবার্তা বললো, নিজেদের কথা, দুজনের ভিন্নমুখী জীবনের কথা, যখন যুক্তি-বুদ্ধি সব বলে দিচ্ছে যে তাদের সামনে এখন সময় আছে শুধু মরণের তখন কী অবিশ্বাস্য এই আকস্মিক যোগাযোগ, তারা নগ্নদেহে শুয়ে আছে আটকেপড়া এক জাহাজের এক অন্ধকার ক্যাবিনে। এই শহরে যেখানে কোনো কিছুই গোপন থাকতো না, ঘটনা ঘটবার আগেই সবাই তা জেনে ফেলতো, সেখানে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোনো মেয়ের সঙ্গে সহবাস করেছে এ খবর ফারমিনা ডাজা কখনো পায় নি, তবু সে হাল্কা ভাবে ওকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই ও বিনা দ্বিধায় দৃঢ় কণ্ঠে জানালো, ‘আমি তোমার জন্য আমার কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রেখেছি।’

    ফারমিনা ডাজা কথাটা এমনিতেও বিশ্বাস করতো না, সত্য হলেও না, কারণ তার সব প্রেমপত্রই ছিল অনুরূপ উক্তিতে পূর্ণ, যেখানে প্রকাশভঙ্গির ঔজ্জ্বল্য ছিল অর্থের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবু ও যে রকম দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা বললো তাতে সে খুশি হল। আর হঠাৎ ফ্লোরেন্টিনো আরিজার একটা কথা মনে হল, এই চিন্তাটা ইতিপূর্বে সে তার মনে ঠাঁই দেবার সাহস কখনো পায় নি, ফারমিনা ডাজা নিজে কি রকম বিবাহ বহির্ভূত গোপন জীবনযাপন করেছে? কোনো কিছুতেই সে অবাক হত না, কারণ সে জানতো যে গোপন অভিসারের ক্ষেত্রে মেয়েরাও ছিল ঠিক পুরুষদের মতোই : সেই একই কৌশল, সেই আকস্মিক অনুপ্রেরণা, সেই অনুতাপহীন অবিশ্বস্ততা কিন্তু প্রশ্নটা করা থেকে বিরত থাকার মতো প্রজ্ঞা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ছিল।

    একবার, চার্চের সঙ্গে ফারমিনা ডাজার সম্পর্ক ততদিনে টানটান হয়ে উঠেছিল, পাপকর্ম সম্পর্কে স্বীকারোক্তি শোনার জন্য তার নির্দিষ্ট যাজক, আচমকা তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে কি কখনো তার স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছে, প্রশ্নটা শুনে ফারমিনা ডাজা কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আর একটি কথাও না বলে, বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত না করে, গির্জা ছেড়ে চলে আসে, তারপর সে আর কোনো স্বীকারোক্তি অনুষ্ঠানে যায় নি, ওই যাজকের কাছে নয়, কোনো যাজকের কাছেই নয়। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বিবেচনা বোধ আজ অপ্রত্যাশিত ভাবে পুরস্কৃত হল : ফারমিনা ডাজা আঁধারের মধ্যে তার হাত বাড়িয়ে দিল, ওর পেটের ওপর আদরের স্পর্শ বুলালো, হাত রাখলো ওর পাঁজর আর নিতম্বের মাংসল অংশে, ওর প্রায় নির্লোম কটিতটে। সে বললো, ‘একটা শিশুর মতো তোমার ত্বক।’ তারপর সে চূড়ান্ত পদক্ষেপটা নিলো, খুঁজলো ওকে, পেলো না, হতাশ হয়ে আবার খুঁজলো, তারপর ওকে পেলো, নিরস্ত্র।

    ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘মরে গেছে।’

    মাঝে মাঝে তার এই অবস্থা হয়েছে, আর ওই অশরীরী প্রাণীর সঙ্গে সে বাস করতে শিখে নিয়েছিলো, কিন্তু প্রতিবারই তাকে তা নতুন করে শিখতে হত, যেন এই প্রথমবার। সে ওর হাত ধরে তার নিজের বুকের ওপর স্থাপন করলো ওই হাত, আর ফারমিনা ডাজা অনুভব করলো একটা প্রবীণ ক্লান্তিহীন হৃদয় যেন ত্বক ভেদ করে ফেটে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, স্পন্দিত হচ্ছে যৌবনে পদাপর্ণোদ্যত একটি কিশোরের শক্তি, দ্রুততা ও অনিয়মিত লয়ের সঙ্গে। সে বললো, ‘অতিরিক্ত প্রেম অপ্রেমের মতোই সমান খারাপ।’ কিন্তু তার ওই উক্তির মধ্যে বিশ্বাসের কোনো জোর ছিল না। সে লজ্জিত বোধ করলো, নিজের ওপর তার ভীষণ রাগ হলো, তার ব্যর্থতার দায়ভাগ ফারমিনার ওপর চাপাবার জন্য সে একটা অজুহাত খুঁজলো। ফারমিনা তা বুঝেছিল, সে ওর অরক্ষিত শরীরকে কপট প্রণয় স্পর্শ দ্বারা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলো, একটা বিড়ালীর নিষ্ঠুর আনন্দ স্পৃহা নিয়ে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনের পক্ষে ওই মৃত্যুতুল্য যন্ত্রৱা যখন অসহ্য হয়ে ওঠে তখন সে তার ক্যাবিনে ফিরে যায়। ফারমিনা ডাজা ভোর না হওয়া পর্যন্ত তার কথা ভাবলো, নিজের প্রেম সম্পর্কে এখন সে নিঃসংশয়, কিন্তু একটার পর একটা ধীর তরঙ্গের মতো তার দেহমন থেকে আনিসেতের প্রভাব কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা যন্ত্রণাদগ্ধ আতঙ্ক দ্বারা সে আক্রান্ত হল, ও হয়তো ভীষণ রাগ করেছে, ও হয়তো আর ফিরে আসবে না।

    কিন্তু ও ফিরে আসে, সেই দিনই, চনমনে, নবজীবন প্রাপ্ত, সে ফিরে আসে বেলা এগারোটার মতো অসময়ে, তারপর সে ওর সামনে কাপড় ছাড়তে শুরু করে একটা প্রদর্শনের ভঙ্গিতে। অন্ধকারে যেমন কল্পনা করেছিল আলোতে তাকে ওই রকমই দেখতে পেয়ে ফারমিনা ডাজা আন্দিত হল : এই মানুষটার কোনো বয়স নাই, তার কালো ত্বক একটা খোলা ছাতার মতোই চকচকে ও টানটান, বগল আর কুচকিতে কয়েক গাছা ন্যাতানো কেশ ছাড়া আর কোথাও কোনো লোম নেই। ওর প্রহরী জাগ্রত, ফারমিনা বুঝলো যে সে ওর অস্ত্রকে অতর্কিতে তুলে ধরছে না, বরং ওটা প্রদর্শন করছে যুদ্ধের বিজয়স্মারকের মতো করে, ওই ভাবে সে যেন নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত করছে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ফারমিনা ডাজা গায়ে একটা গাউন জড়িয়ে নিয়েছিল, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে সেটা খোলার সময় পর্যন্ত দিলো না, আর ফারমিনা তার প্রারম্ভিকের দ্রুততা দেখে করুণায় শিহরিত হল। কিন্তু তাতে সে বিচলিত হল না, কারণ এসব ক্ষেত্রে করুণা ও প্রেমর মধ্যে পার্থক্য করা সহজ ছিল না। কিন্তু, শেষ হবার পর, তার নিজেকে মনে হল শূন্য।

    বিশ বছরের মধ্যে সে এই প্রথম যৌন সঙ্গম করলো। এত বছর পর, তার এই বয়সে, ব্যাপারটা কি রকম লাগবে ওই কৌতূহল তাকে পেছনে টেনে রেখেছিল। কিন্তু ফারমিনা ডাজার শরীরও তাকে ভালোবাসে কিনা এটা আবিষ্কার করার সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে দিল না। তাদের সঙ্গম হল দ্রুত এবং ফারমিনা ডাজা ভাবলো, এবার আমরা সব কিছু নষ্ট করে ফেললাম। কিন্তু সে ভুল করেছিল : উভয়ের আশাভঙ্গ সত্ত্বেও, নিজের অপটুত্বের জন্য ফ্লোরেন্টিনোর মনস্তাপ সত্ত্বেও, আনিসেতের পাগলামির জন্য ফারমিনার অনুশোচনা সত্ত্বেও এই ঘটনার পরবর্তী দিনগুলিতে তারা এক মুহূর্তের জন্যও পরস্পরের সঙ্গ ছাড়া হয় নি।

    কাপ্তানের কাছ থেকে একটা লিখিত বার্তা না পেলে ওরা ক্যাবিন ছেড়ে বাইরে আসতো না। কাপ্তান জানালো যে লাঞ্চের পর পরই তাদের জাহাজ সোনালি লা ডোরাডায় পৌঁছে যাবে, তাদের এগারো দিনের ভ্রমণের শেষ বন্দরে। তাদের ক্যাবিন থেকে ফারমিনা ডাজা ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বন্দরের বাড়িঘরের উঁচু অংশ ম্লান রোদে আলোকিত দেখলো এবং তখন বন্দরটির নামকরণের কারণ তারা বুঝলো, কিন্তু যখন আগুনের চুল্লির মতো উত্তাপ তারা অনুভব করলো, রাস্তার উপরের আলকাতরাকে বুদ্বুদের মতো ফুটে উঠতে দেখলো, তখন তাদের কাছে ওই নাম আর তত যথার্থ বলে মনে হল না। ওদের জাহাজ নোঙর করে অপর তীরে, সেখানেই অবস্থিত ছিল সান্টা ফে রেলপথের প্রান্তিক স্টেশনটি।

    যাত্রী নেমে গেলেই ওরা দুজন তাদের আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে আসে। জনশূন্য অভ্যর্থনা কক্ষে ফারমিনা ডাজা কোনো রকম ভর্ৎসনার আশঙ্কা ছাড়া সুবাতাস বুক ভরে টেনে নিলো। জাহাজের সম্মুখাংশ থেকে তারা দুজন হৈচৈ করা লোকজনের ভিড় দেখলো, খেলনার মতো দেখতে রেল গাড়িটির কামরা থেকে তারা তাদের মালপত্র নামাচ্ছিল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন ইউরোপ থেকে আসছে, বিশেষ করে মহিলাদের, তাদের গায়ে শীতের কোট, মাথায় গত শতকের হ্যাট, এই ধূলি ধূসরিত প্রচণ্ড গরমে ওসব পরার কোনো মানেই হয় না। কারো কারো চুলে দেখা গেল সুন্দর ফুল, কিন্তু ইতিমধ্যেই তা গরম শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। তারা স্বপ্নের মতো প্রান্ত রের মধ্য দিয়ে ট্রেন ভ্রমণের পর সবে মাত্র অ্যান্ডীয় মালভূমি থেকে ফিরে এসেছে, কাপড়-জামা বদলে ক্যারিবীয় অঞ্চলের উপযোগী পোশাক পরার সময় পায় নি।

    কর্মব্যস্ত বাজারের মধ্যে একজন অতি বৃদ্ধ লোককে দেখা গেল, মুখে তার সান্ত্বনাতীত অভিব্যক্তি, সে তার ভিখিরির জোব্বার পকেট থেকে মুরগির বাচ্চা বের করে চলেছে। কোনো রকম সতর্ক সঙ্কেত ছাড়া সে তার ছেঁড়াখোঁড়া ওভারকোট পরে জনতার মাঝখান দিয়ে পথ করে এগিয়ে এসেছিলো। বোঝা যাচ্ছিল যে কোটটা ছিল তার চাইতে অনেক লম্বা ও মোটা কোনো ব্যক্তির। সে তার মাথার টুপি খুলে জাহাজঘাটে সেটা উল্টো করে নামিয়ে রাখলো, যেন কেউ টাকা-পয়সা দিতে চাইলে তার মধ্যে ফেলতে পারে। তারপর সে তার পকেটগুলি থেকে মুঠো মুঠো হাল্কা রঙের মুরগির বাচ্চা বের করতে লাগলো, বাচ্চাগুলি যেন তার আঙুলের মধ্য থেকে ক্রমবর্ধমান হারে বেরিয়ে আসছিলো, দেখতে দেখতে গোটা জাহাজঘাটা চিঁ চিঁ করা মুরগি ছানায় ছেয়ে গেল, যাত্রীদের পায়ের ফাঁক দিয়ে ওরা ছোটাছুটি করতে লাগলো, তাদের পায়ের তলায় অনেকগুলি পিষ্ট হলো, যাত্রীরা খেয়ালও করলো না। ফারমিনা ডাজা ওই আশ্চর্য দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হল, তার মনে হল শুধু তার জন্যই বৃদ্ধ এই খেলা দেখাচ্ছে, কারণ আর কেউ-ই ওদিকে দৃষ্টি দিচ্ছিল না। ফারমিনা ডাজা এতোই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে যাত্রীরা কখন ফেরত যাত্রার জন্য জাহাজ উঠতে শুরু করেছে তা লক্ষ করে নি। ওদের মধ্যে কয়েকটা চেনা মুখ দেখলো সে, তার শোক পালনের সময় ওরা তার বাসায় গিয়েছিল, সে ছুটে তার ক্যাবিনে গিয়ে আশ্রয় নিলো। স্বামীর

    মৃত্যুর অল্প ক’দিন পরেই সে এই রকম আনন্দ ভ্রমণে বেরিয়েছে, আর সবাই এটা দেখবে, এর চাইতে তার মরে যাওয়ায় ভালো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে খুঁজতে এসে তার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে নিজেও বিচলিত হল। সে প্রতিশ্রুতি দিল, তাকে ক্যাবিনে বন্দি থাকতে হবে না, অন্য ভাবে তাকে রক্ষা করার একটা উপায় সে অবশ্যই বের করবে।

    নিজেদের ব্যক্তিগত খাবার ঘরে নৈশাহারের সময় হঠাৎ তার মাথায় উপায়টা খেলে গেলো। অনেক দিন ধরে কাপ্তান একটা সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সব সময় সেটা এড়িয়ে গেছে, তার অভ্যস্ত উত্তর দিয়েছে সব সময় : ‘এসব সমস্যার সমাধান আমার চাইতে ভালো ভাবে করতে পারবে লিওনা কাসিয়ানি।’ কিন্তু এবার সে কাপ্তানের কথা মন দিয়ে শুনলো। ঘটনাটা ছিল এই রকম, জাহাজ উন যাবার সময় পণ্য বয়ে নিয়ে যায় কিন্তু ফিরে আসে খালি, আর যাত্রীদের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক তার বিপরীত। কাপ্তান বললো, ‘পণ্যের ক্ষেত্রে বেশি পয়সা পাওয়া যায়, আর তারা কিছুই খায় না।’ এই অবস্থায় দুটি ভিন্ন অঙ্কের ভাড়া নির্ধারণের সম্ভাবনা নিয়ে পুরুষদের ওই বিরক্তিকর আলোচনা ফারমিনা ডাজাকে ক্লান্ত করে তোলে, সে নিস্পৃহ ভাবে খেতে থাকে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আলোচনা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেলো এবং তারপর সে কাপ্তানকে একটা প্রশ্ন করলো, কাপ্তানের মনে হল ওটা হল সমস্যা সমাধানের উপক্রমণিকা। ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘কথার কথা বলছি, কোথাও না থেমে, কোনো পণ্য বা যাত্রী না নিয়ে কোনো বন্দরে জাহাজ না ভিড়িয়ে, ভ্রমণ যাত্রা চালু রাখা কি সম্ভব?’

    কাপ্তান বললো যে সেটা সম্ভব, কিন্তু কথার কথা হিসাবেই। আর. সি. সি.-র ব্যবসায়িক অঙ্গীকার আছে, এ বিষয়ে তার চাইতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বেশি জানেন। পণ্য পরিবহন, যাত্রী, ডাক, ও আরো অনেক কিছু ব্যাপারে কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ, আর বেশির ভাগ চুক্তিই ভাঙার কোনো উপায় নাই। শুধু একটি পরিস্থিতিতে সব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, জাহাজে যদি কলেরা দেখা দেয় তাহলে। তখন জাহাজকে কুয়ারান্টিন করা হয়, জাহাজ তুলে দেয় হলুদ পতাকা, আর নদীবক্ষে সে চলাচল করে জরুরি আইনের আওতায়। এই নদী পথে কলেরার বহু আক্রমণের সময় কাপ্তান সামায়িতানোকে তাই করতে হয়েছে বেশ কয়েক বার, যদিও স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা কাপ্তানকে দিয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেটে সই করিয়ে নিয়েছে যে ওসব ছিল সাধারণ আমাশয় রোগজনিত মৃত্যু। তাছাড়া এই নদীর ইতিহাসে নানা কারণে জাহাজে বহুবার মহামারীর হলুদ পতাকা ওড়াতে হয়েছে, কর এড়ানোর জন্য, কোনো অবাঞ্ছিত যাত্রীকে জাহাজে না তোলার জন্য, কোনো অসুবিধাজনক পরিদর্শনের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টেবিলের নিচ দিয়ে ফারমিনা ডাজার হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে বললো, ‘তাহলে তাই করি আমরা।’

    কাপ্তান চমকিত হল কিন্তু তারপরই এক বুড়ো শেয়ালের সহজাত বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু সে স্পষ্ট বুঝে ফেললো। সে বললো, ‘এই জাহাজ চলে আমার হুকুমে, কিন্তু আমরা চলি আপনার হুকুমে। আপনি যদি এ ব্যাপারে আন্তরিক হন তাহলে লিখিত আদেশ দিন, আমরা এখনই জাহাজ ছেড়ে দেবো।’

    অবশ্যই আন্তরিক ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। সে হুকুমনামা সই করে দিলো। আসলে, স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের উল্লসিত পরিসংখ্যান সত্ত্বেও সবাই জানতো যে কলেরার কাল শেষ হয়ে যায় নি। আর জাহাজ নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। ওরা যে সামান্য পণ্য তুলেছিলো তা অন্য একটি জাহাজে স্থানান্তরিত করা হল, যাত্রীদের জানানো হল যে জাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে, অন্য কোম্পানির একটা জাহাজে করে সকাল বেলা তাদেরকে তাদের গন্তব্য স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হল। এতো সব অনৈতিক কারণে, এমনকি ঘৃণ্য কারণে, জাহাজে কলেরার পতাকা উত্তোলিত করা হয়েছে যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রেমের জন্য কেন এই কাজটা বৈধ বলে বিবেচিত হবে না তা বুঝতে পারলো না। কাপ্তান বললো, ঠিক আছে, তবে পুয়ের্টো নেয়ার-এ জাহাজ থামিয়ে শুধু একজনকে তুলে নিতে হবে, ভ্রমণ যাত্রার বাকি সময়টুকুতে সে কাপ্তানকে সঙ্গ দেবে : কাপ্তানেরও ছিল এক গোপন প্রেমিকা।

    অতএব পরদিন খুব ভোরে ‘নয়া বিশ্বস্ততা’ নোঙর তুললো, কোনো পণ্য বা যাত্রী ছাড়া, জাহাজের প্রধান মাস্তুল থেকে সানন্দে পতপত করে উড়তে থাকলো কলেরার হলুদ পতাকা। সেদিন সন্ধ্যায় পুয়ের্টো নেয়ার থেকে তারা একটি মেয়েকে তুলে নিলো, কাপ্তানের চাইতেও লম্বা, কাপ্তানের চাইতেও মজবুত, এক অসাধারণ সুন্দরী, দাড়ি থাকলেই সার্কাস কোম্পানি ওকে চাকরি দিয়ে দলে নিয়ে নিতো। ওর নাম ছিল জিনাইদা নেভেস, কিন্তু কাপ্তান তাকে ডাকতো ‘আমার বুনো রমণী’ বলে, তার পুরনো বন্ধু, যাকে সে এক বন্দরে তুলে অন্য বন্দরে নামিয়ে দিতো, আর যে জাহাজে উঠে এলেই তাকে অনুসরণ করতো খুশির হাওয়া। মৃত্যুর ওই বিষণ্ন স্থানে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন এনভিগাডো থেকে খচ্চরের পুরনো পদচিহ্ন ধরে একটা দলকে কষ্টেসৃষ্টে এগিয়ে যেতে দেখলো তখন সে আবার রোসাল্বার স্মৃতিতে আক্রান্ত হল। ওখানেই এই সময়ে শুরু হয় প্রচণ্ড অ্যামাজোনীয় বর্ষণ, খুব সামান্য বিরতি দিয়ে ওই বর্ষণ সমানে চলতে থাকে তাদের ভ্রমণের বাকি সময়টা পর্যন্ত। কিন্তু কেউ তাকে আমল দিলো না, এই ভাসমান উৎসবের মাথার ওপর ছিল তাদের নিজস্ব ছাদ। সেদিন রাতে ফারমিনা ডাজা আনন্দোৎসবে তার নিজস্ব অবদান রাখলো, নাবিকদের উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে সে জাহাজের রান্না ঘরে নেমে গিয়ে একটা বিশেষ খাবার সৃষ্টি করলো, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার নাম দিলো ‘ভালোবাসার বেগুন।

    দিনের বেলায় ওরা তাস খেলতো, পেট ফেটে যাবার মতো অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত খেতেই থাকতো, রুক্ষ দিবানিদ্রার পর ক্লান্ত হয়ে পড়তো, আর রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের অর্কেস্ট্রা দল তাদের বাদন শুরু করতো, আর ওরা তখন আনিসে সহযোগে স্যামন মাছ খেতো, যখন আর খাওয়া ও পান করা অসম্ভব হয়ে উঠতো শুধু তখনই তারা থামতো। তাদের এই ভ্রমণ ছিল দ্রুত গতির : জাহাজ এখন হাল্কা, জলের স্রোত অনুকূল, ওপর দিক থেকে ভেসে আসা বন্যার জলে অবস্থা আরো ভালো হয়েছে, ওখানে গত এক সপ্তাহে যত বৃষ্টি হয়েছে এই ভ্রমণের গোটা সময়টাতে তত হয় নি। কলেরাকে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করার জন্য কোনো কোনো গ্রাম থেকে কামানের দয়ালু গর্জন ধ্বনিত হল, জাহাজ থেকে বিষণ্ণ ভেঁপু বাজিয়ে তার কৃতজ্ঞতাসূচক উত্তরও দেয়া হল। নদীপথে যেসব জাহাজের সঙ্গে দেখা হল, তারা সমবেদনার সঙ্কেত দেখালো। মার্সিডিসের জন্মস্থলে মাগাঙ্গুয়ে শহরে ভ্রমণের বাকি পথটুকুর জন্য তারা যথেষ্ট কাঠ তুলে নিলো।

    তার ভালো কানে জাহাজের ভেঁপুর শব্দ শুনে ফারমিনা ডাজা আতঙ্কিত হল, কিন্তু আনিসেতের দুদিন পর সে তার দু’কানেই আগের চাইতে ভালো শুনতে পেলো। সে আবিষ্কার করলো যে গোলাপ আগের চাইতে বেশি সুগন্ধি হয়েছে, পাখি প্রভাতে গান গাইছে আগের চাইতে বেশি মধুর কণ্ঠে, আর শুধু তাকে ঘুম থেকে জাগাবার জন্য ঈশ্বর একটা মানাতি সৃষ্টি করে তাকে স্থাপন করেছেন তামালামেকের পাড়ে। কাপ্তান ওর কণ্ঠধ্বনি শুনতেই জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করলো, আর অবশেষে তারা বিশাল জননীকে দেখতে পেলো বাচ্চাকে বুকে নিয়ে স্তন দান করছে।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজা যে পরস্পরকে কতো ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে সম্পর্কে ওদের দুজনের কেউই সচেতন ছিল না : ফারমিনা ওকে তার এনিমা নিতে সাহায্য করলো, ভোর বেলা ও ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই সে উঠে পড়ে গ্লাসে ভিজিয়ে রাখা ওর নকল দাঁত ব্রাশ করে দিলো, তার নিজের চশমা ভুলভাল করে যেখানে সেখানে রাখার সমস্যারও সমাধান সে করে ফেললো, এখন ওর চশমা দিয়েই সে পড়তেও পারে, সেলাইও করতে পারে। একদিন সকালে সে দেখলো যে অন্ধকারের ভেতর ও তার শার্টে বোতাম লাগাচ্ছে, ফারমিনা কাজটা করার জন্য তাড়াতাড়ি ওর কাছে ছুটে গেল, একজন পুরুষের দুটি স্ত্রী থাকা দরকার ওর সেই আনুষ্ঠানিক উক্তি করার আগেই।

    অন্য দিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অর্কেস্ট্রা দলের কাছ থেকে একটা বেহালা ধার করে আনলো যেন সে পুরনো স্মৃতিকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলতে পারে। এক বেলার মধ্যেই সে ওর জন্য ‘মুকুট শোভিত দেবী’-র ওয়ালটজের সুর আয়ত্ত করে ফেললো, তারপর ওরা এসে তাকে জোর করে নিবৃত্ত না করা পর্যন্ত সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা বাজাতে থাকে। এক রাতে ফারমিনা ডাজা, তার জীবনে এই প্রথম বারের মতো হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে গেলো, ক্রোধ নয়, বেদনার কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে, তার মনে পড়ে যায় ওই বৃদ্ধ দম্পতির কথা, নৌকার মাঝি যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছিল। পক্ষান্তরে নিরন্তর বর্ষণ তাকে তেমন ক্ষুণ্ন করলো না, তার বড় দেরিতে মনে হল যে পারীকে যতটা মেঘাচ্ছন্ন বলে তখন মনে হয়েছিল আসলে হয়তো ততটা ছিল না, আর সাল্টা ফে-র রাস্তা দিয়েও হয়তো তেমন বেশি শেষকৃত্যের মিছিল যায় না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সাহচর্যে আরো অনেক জলপথে ভ্রমণের স্বপ্ন তার দিগ্বলয়ে জেগে উঠলো : পাগলামিভরা ভ্রমণ, সেখানে কোনো ট্রাঙ্কের বহর থাকবে না, সামাজিক দেখা-সাক্ষাতের দায়বদ্ধতা থাকবে না, শুধুই প্রেমের ভ্রমণ।

    বন্দরে পৌঁছবার আগের রাতে কাগজের মালা আর রঙিন আলোকসজ্জাসহ বিশাল এক পার্টির আয়োজন করা হল। রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেল। নিজেদের খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে কাপ্তান আর জিনায়দা উদ্দাম বোলেরো নাচ নাচতে শুরু করলো, তখন ওই নৃত্যগীত সবেমাত্র মানুষের হৃদয় চুরমার করে দিতে শুরু করেছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সাহস করে ফারমিনা ডাজাকে তাদের ব্যক্তিগত ওয়ালটজ নাচটা নাচতে আহ্বান জানালো কিন্তু ফারমিনা তাতে সাড়া দিলো না। কিন্তু সে সারা রাত মাথা নেড়ে আর জুতা ঠুকে তাল রাখলো এবং এক মুহূর্তের জন্য নিজের অজান্তে আসনে বসেই যেন এক পাক নেচে নিলো, আর ওদিকে কাপ্তান তার বুনো তরুণী সঙ্গিনীর সঙ্গে যেন বেলরোর ছায়ায় এক দেহে লীন হয়ে গেল। সে এতো আনিসেৎ পান করলো যে শেষ পর্যন্ত তাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠাতে হল, এমন হাসির দমকে সে আক্রান্ত হল যে তার চোখে জল এসে পড়লো সবাই তখন তার জন্য ভীত হয়ে উঠলো। কিন্তু নিজের ক্যাবিনের সুরভিত মরুদ্যানে প্রবেশের পর, অবশেষে, সে নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলো এবং তখন তারা অভিজ্ঞ দাদা- দাদির প্রশান্ত স্বাস্থ্যকর সঙ্গমে লিপ্ত হল, এই উন্মাদ ভ্রমণের সর্বোত্তম স্মৃতি হিসাবে এটা ফারমিনা ডাজা চিরকাল সংরক্ষণ করবে। কাপ্তান এবং জিনাইদার ধারণার বিপরীতে ওদের নিজেদেরকে নববিবাহিত দম্পতির মতো মনে হল না, এমনকি বিলম্বিত প্রেমিক-প্রেমিকার মতোও নয়, বরং মনে হলো ওরা যেন দাম্পত্য জীবনের কঠিন ক্যালভেরি ওপর দিয়ে এক লাফে সোজা পৌঁছে গেছে ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশান্ত নীরবতার মধ্যে তাদের মনে হল এক বৃদ্ধ বিবাহিত যুগলের মতো, জীবন সম্পর্কে সতর্ক-সজাগ, কামনা-বাসনার ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, আশার নিষ্ঠুর বিদ্রূপের ঊর্ধ্বে, মোহমুক্তির ছায়াশরীরের ওপারে : প্রেমের ওপারে। কারণ তারা তাদের দীর্ঘ যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে জেনেছে যে প্রেম প্রেমই, যে কোনো সময়ে, যে কোনো স্থানে, কিন্তু সেটা মৃত্যুর যতো কাছাকাছি আসতে থাকে তত হয়ে ওঠে আরো দৃঢ় ও সংহত।

    ছ’টার দিকে ওরা ঘুম থেকে উঠলো। ফারমিনা ডাজার মাথা ধরেছে, আনিসেতের সুরভি তার মধ্যে, এমন সময় একটা আকস্মিক অনুভূতি তার হৃদয়কে অসাড় করে দিলো। সে দেখলো ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ফিরে এসেছেন, গাছ থেকে যখন পড়ে যান তার চাইতে এখন তাঁকে আরেকটু মোটা ও তরুণ দেখাচ্ছে, তিনি তাঁর দোলচেয়ারে বসে তাদের বাড়ির দরজায় তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ফারমিনা তার চিন্তার স্বচ্ছতা দিয়ে বুঝলো যে এটা আনিসেতের প্রভাব নয়, এর মূলে রয়েছে তার অত্যাসন্ন প্রত্যাবর্তনের ভাবনা।

    সে বলে উঠলো, ‘ওটা হবে মৃত্যু বরণের মতো।’

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চমকালো, গৃহাভিমুখে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে যে ভাবনা তাকে একটুও শান্তি দিচ্ছিল না ফারমিনা ডাজার কথায় তারই ভাষারূপ ফুটে উঠেছে। তাদের দুজনের কেউই এই ক্যাবিন ছাড়া অন্য কোনো বাড়ির কথা ভাবতে পারছে না, জাহাজে এই ভাবে খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ভাবে খাদ্য গ্রহণের কথা চিন্তা করতে পারছে না, এই জীবন ছাড়া অন্য কোনো জীবনের কল্পনা তারা করতে পারছে না, ভিন্ন রকম সব কিছুই তাদের কাছে মনে হবে অচেনা-অপরিচিত। সত্যিই তা হবে মৃত্যুবরণের মতো। ফ্লোরেন্টিনোর ঘুম আর এলো না, মাথার নিচে দু’হাত আড়াআড়ি করে রেখে সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলো। এক সময় আমেরিকা ভিসুনার জন্য দুঃখে শোকে সে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠলো, সত্যকে সে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না, বাথরুমে ঢুকে দরজায় তালা দিয়ে সে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ কাঁদলো, শেষ অশ্রু বিন্দুটি নিঃসৃত না হওয়া পর্যন্ত। আর তখনই সে যে ওকে কতো গভীর ভাবে ভালোবেসেছিলো নিজের কাছে ওই সত্যটি স্বীকার করার সাহস তার হলো।

    তীরে নামার জন্য কাপড়-জামা পরে তৈরি হয়ে ওরা উপরে উঠলো। জাহাজ তখন সরু খালগুলি আর স্পেনীয় খাড়িপথটা পেছনে ফেলে, ভাঙা পরিত্যক্ত জাহাজ আর তৈল-কূপের মাচাগুলির পাশ দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছিল। ভাইসরয়দের নগরীর সোনালি গম্বুজগুলির ওপর দিয়ে এক উজ্জ্বল বৃহস্পতিবার সবে শুরু হচ্ছে, কিন্তু রেলিং-এর পাশে দাঁড়ালো ফারমিনা ডাজা তার গৌরবের মহামারীর দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারলো না, গোসাপকুল দ্বারা অপবিত্র করা তার পাঁচিলের ঔদ্ধত্য তার কাছে অসহ্য মনে হল : বাস্তব জীবনের এই ভয়াবহ অবস্থা সে কেমন করে সহ্য করবে? ওদের দুজনের কেউ কোনো কথা বললো না, কিন্তু তারা অনুভব করলো যে তাদের কেউই সহজে এর কাছে আত্মসমর্পণ করতে সক্ষম হবে না।

    তারা কাপ্তানকে পেলো খাবার ঘরে, অবিন্যস্ত অবস্থায়, তার স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এই চেহারার কোনো মিল ছিল না, দাড়ি কামায় নি, অনিদ্রার জন্য চোখ দুটি লাল, পোশাক গত রাতের ঘামে এখনো ভেজাভেজা, কথা বলতে বলতে আনিসেতের উদ্গার উঠছে। জিনাইদা তখনো ঘুমাচ্ছে। ওরা নিঃশব্দে প্রাতরাশ খেতে শুরু করলো। এমন সময় স্বাস্থ্য বিভাগের একটা মোটর লঞ্চ থেকে তাদেরকে জাহাজ থামাবার আদেশ দেয়া হল। সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরীদল কাপ্তানকে যে সব প্রশ্ন করলো কাপ্তান জাহাজের সেতুর উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তার উত্তর দিলো। ওরা জানতে চাইলো কি ধরনের মহামারী তারা তাদের জাহাজে বয়ে নিয়ে চলেছে, জাহাজে কতজন যাত্রী আছে, তাদের মধ্যে কতজন অসুস্থ, নতুন সঙ্ক্রমণের আশঙ্কা কতটুকু? কাপ্তান জানালো যে জাহাজে মাত্র তিনজন যাত্রী আছে, তিন জনই কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু তাদের প্রত্যেককেই কঠোর নির্জনতার মধ্যে রাখা হয়েছে। লা ডোরাডায় যাদের জাহাজে ওঠার কথা ছিল তারা এবং জাহাজের সাতাশ জন নাবিক কেউ রোগীদের সংস্পর্শে আসে নি। কিন্তু নিরাপত্তা প্রহরীদলের প্রধান সন্তুষ্ট হল না, সে নির্দেশ দিলো জাহাজ যেন উপসাগর ত্যাগ করে অপরাহ্ণ দু’টা পর্যন্ত লাস মার্সিডিস জলাভূমির কাছে অপেক্ষা করে, ইতিমধ্যে জাহাজটিকে কুয়ারান্টিনে স্থাপন করার কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাবে। সে সশব্দে একটা বাতকর্ম করে জাহাজ ঘুরিয়ে জলাভূমিতে নিয়ে যাবার জন্য হাত নেড়ে আদেশ দিলো।

    ফারমিনা ডাজা ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের খাবার টেবিল থেকে সব কথাবার্তা শুনেছিল, কিন্তু কাপ্তান যেন তা খেয়ালও করলো না। সে নিঃশব্দে খেতে লাগলো এবং যেভাবে সে নৌযানের কাপ্তানদের সৌজন্যের রীতিনীতি পালনের বিরাজমান কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতিকে নস্যাত করে দিলো তাতেই তার মেজাজ যে কতোখানি খারাপ তা বোঝা গেল। ছুরির মাথা দিয়ে সে তার জন্য ভাজা চারটা ডিম ভেঙ্গে, কাঁচাকলার টুকরার সঙ্গে মিশিয়ে, সব একসাথে তার মুখে পুরে বন্য উল্লাসের সঙ্গে চিবুতে থাকলো। ফারমিনা ডাজা ও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেন দুজন ছাত্র স্কুলের বেঞ্চে বসে তাদের পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রহরীদের সঙ্গে কাপ্তানের কথাবার্তার সময় তারা পরস্পরের সঙ্গে একটি বাক্যও বিনিময় করে নি, তাদের জীবনের কী পরিণতি হবে সে সম্পর্কে তাদের সামান্যতম ধারণাও ছিল না, কিন্তু তারা উভয়েই জানতো যে কাপ্তান তাদের কথা ভাবছে, তার কপালের শিরার কম্পন থেকে তারা সেটা বুঝতে পারছিল।

    কাপ্তান তার ভাগের ডিম শেষ করলো, ভাজা কলার থালা শেষ করলো, কফির পাত্র শেষ করলো, আর ততক্ষণে জাহাজ বয়লারকে নিশ্চুপ রেখে উপসাগর ত্যাগ করে, প্রস্ফুটিত লাল জলপদ্ম আর হৃৎপিণ্ডের আকৃতির বড় বড় পাতার মধ্য দিয়ে, খাল পাড়ি দিয়ে জলাভূমিতে ফিরে এলো। চোর জেলের দল ডিনামাইট দিয়ে বহু মাছ মেরে ফেলেছিল, অজস্র মাছ কাত হয়ে জলের উপর ভাসছিল, সমস্ত জল যেন রূপার মতো ঝকঝক করছিলো আর তীক্ষ্ণ ধাতব চিৎকার করে উপরে উড়ছিলো, মনে হল, ধরণীর তাবৎ বিহঙ্গকুল। জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ক্যারিবীয় বাতাস ও পাখিদের চিৎকার, আর ফারমিনা ডাজা তার রক্তের মধ্যে অনুভব করলো তার স্বাধীন ইচ্ছার উন্মাতাল স্পন্দন। তার ডান পাশ দিয়ে বড় ম্যাগডালেনা নদীর হিসাবি মোহনা পৃথিবীর অন্য দিক পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে গেছে।

    প্লেটে যখন আর কোনো খাদ্যবস্তু অবশিষ্ট রইলো না তখন কাপ্তান টেবিল ক্লথের এক কোণা দিয়ে তার ঠোঁট মুছে, নৌযানের কাপ্তানদের শোভন রুচিশীল বাকভঙ্গির খ্যাতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে, দ্রুত কয়েকটি অশালীন অপশব্দ উচ্চারণ করলো। সে ওদের উদ্দেশে কিছু বলছিলো না, কারও উদ্দেশেই কিছু বলছিলো না, সে শুধু তার নিজের ক্রোধের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছিলো। কিছু বর্বরোচিত শাপশাপান্ত করার পর সে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলো, কলেরার পতাকা উড়িয়ে সে নিজেকে যে গাড্ডার মধ্যে ফেলেছে তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার কোনো পথ সে দেখছে না।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চোখের পলক না ফেলে তার কথা শুনলো, জানালা দিয়ে নাবিকের কম্পাসের গায়ে আঁকা পুরো বৃত্তটি, পরিষ্কার দিকচক্রবাল রেখা, ডিসেম্বরের সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত আকাশ, বিস্তীর্ণ জলরাশি যার উপরে চিরকাল জাহাজে চলাচল করা যায় তাদের পানে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, তারপর বললো, ‘চলুন, আমরা যেতে থাকি, যেতে থাকি, যেতে থাকি, আবার আমরা ফিরে যাই লা ডোরাডায়।’

    ফারমিনা ডাজা থরথর করে কেঁপে উঠলো, কারণ সে হোলি স্পিরিটের অনুগ্রহে আলোকিত ওর আগেকার কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলো, সে কাপ্তানের দিকে তাকালো, সেই তাদের নিয়তি। কিন্তু কাপ্তান ফারমিনা ডাজাকে দেখতে পেলো না, কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনুপ্রেরণার প্রচণ্ড শক্তি দেখে সে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল।

    সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনি যা বলছেন সত্যিই কি তাই বোঝাতে চাইছেন?’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জবাব দিলো, ‘জন্মগ্রহণের মুহূর্ত থেকে আমি কখনো একটি কথাও বলি নি যা আমি সত্যিই বোঝাতে চাই নি।’

    কাপ্তান ফারমিনা ডাজার দিকে তাকালো, সে ওর চোখের পাতায় লক্ষ করলো শীতের তুষারের প্রথম ঝিলিক। তারপর সে তাকালো ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দিকে, তার অপরাজেয় শক্তির দিকে, তার নিঃশঙ্ক প্রেমের দিকে এবং বিলম্বে-উপলব্ধ একটি সন্দেহ দ্বারা সে অভিভূত হল, মৃত্যুর চাইতে বেশি জীবনেরই কোনো সীমা-পরিসীমা নাই।

    সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমরা কতকাল এই নিষিদ্ধ যাওয়া-আসা করবো?

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তিপ্পান্ন বছর, সাত মাস, এগারোটি দিবস-রজনী তার উত্তর নিয়ে তৈরি ছিল।

    সে বললো, ‘অনন্তকাল।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.