Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ৪

    ৪

    বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের ভিড়ে ফ্লেরেন্টিনো আরিজা এতক্ষণ কারো চোখে পড়ে নি। ফারমিনা ডাজাকে দেখে তাঁর মনে হল তাঁর বুক বুঝি ভেঙে যাচ্ছে। সমবেদনা জানানোর তাড়াহুড়ার মধ্যে ফারমিনা ডাজা তাঁকে চিনতে পারে নি, যদিও গত রাতের যাবতীয় কাজকর্মে তার চাইতে সাহায্য করতে বেশি প্রস্তুত আর কেউ ছিল না, সকল কাজে তার মতো দক্ষতার পরিচয়ও আর কেউ দেয় নি। রান্নাঘরে তিনিই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, কফির যেন ঘাটতি না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখেন, যখন প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আনা চেয়ার যথেষ্ট হল না তখন তিনিই অন্যত্র থেকে আরো চেয়ার আনার ব্যবস্থা করেন, বাড়িতে যখন আর ফুলের মালার স্থান সঙ্কুলান হল না তখন সেগুলি উঠানে রাখার আয়োজনও তিনিই করেন। ডাক্তার লাসিডে অলিভেল্লার ওখানে তাঁর রজত-জয়ন্তির উৎসব যখন তুঙ্গে তখন দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে তাঁর অতিথিরা এ বাড়িতে ছুটে আসেন। এখন তাঁরা আম গাছের নিচে গোল হয়ে বসে কথাবার্তা বলছেন। তাঁদের জন্য যথেষ্ট ব্র্যান্ডির সরবরাহ যেন অব্যাহত থাকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাও সুনিশ্চিত করেন। রাতদুপুরে পলাতক তোতা যখন পাখা ছড়িয়ে মাথা উঁচু করে হঠাৎ খাবার ঘরে উদিত হয় তখন কি করতে হবে তাও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নির্ভুল ভাবে উপলব্ধি করেন। পাখিটিকে দেখে সারা বাড়ির মধ্য দিয়ে একটা বিহ্বল কাঁপুনির স্রোত বয়ে যায়। সবার মনে হল এটা অনুতাপের সুনিশ্চিত নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। তোতাটি তার নির্বোধ মুখস্থ করা বুলির একটিও উচ্চারণ করার আগেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার ঘাড় চেপে ধরে তাকে একটা আচ্ছাদিত খাঁচায় পুরে আস্তাবলে নিয়ে যান। তিনি যাবতীয় কাজ এমনই বিচক্ষণতার সঙ্গে করেন যে তাকে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো বলে কারো মনেই হয় নি, বরং সবার মনে হল যে পরিবারের এই দুঃসময়ে তিনি এক অমূল্য সাহায্য দান করছেন।

    তাঁকে দেখে যেমন মনে হত তিনি তাই ছিলেন : একজন অচপল কাজের মানুষ। তিনি ছিলেন কৃশকায়, তাঁর দেহ ছিল ঋজু, ত্বকের রঙ শ্যামলা, দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো, রুপার ফ্রেমের গোলাকার চশমার পেছনে চোখ দুটি ঔৎসুক্যে ভরা, নাকের নিচে পুরানোকালীন রোমান্টিক গোঁফ, অগ্রভাগ ছিল মোম দিয়ে পাকানো। কপালের কাছে তাঁর অল্প যেটুকু চুল ছিল তা তিনি উপর দিকে টেনে আঁচড়ে, চুলের ঔজ্জ্বল্যবর্ধক বিশেষ প্রসাধনী লাগিয়ে, তাঁর চকচকে চাঁদির মাঝখানে চেপে বসিয়ে রাখতেন, পুরোপুরি টাকের একটা সমাধান হিসেবে। স্ত্রীলোকের প্রতি তাঁর সহজাত সৌজন্য এবং তাঁর ধীরগতিসম্পন্ন আচরণ সবাইকে তাৎক্ষণিক ভাবে আকৃষ্ট করতো, কিন্তু এগুলি একজন প্রতিষ্ঠিত অকৃতদারের ক্ষেত্রে খানিকটা সন্দেহজনক গুণাবলি বলেও বিবেচিত হত। গত মার্চ মাসে তাঁর ছিয়াত্তর বছর পূর্ণ হয়েছে। এ ঘটনাটি লুকিয়ে রাখার জন্য তিনি যথেষ্ট অর্থ, কৌশল ও ইচ্ছাশক্তি ব্যয় করেছেন। তাঁর আত্মার একাকিত্বের মধ্যে তিনি সুনিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করতেন যে এই পৃথিবীতে তাঁর মতো এত দীর্ঘকাল ধরে কোন মানুষ আরেকজন মানুষকে নীরবে নিভৃতে এমন ভাবে ভালবাসেনি।

    ডাক্তার উরবিনোর মৃত্যুর রাতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা খবরটা শোনার সময় যে পোশাকে ছিলেন তখনও সেই পোশাক পরেই ছিলেন। সব সময় তিনি ওই পোশাকই পরতেন, জুন মাসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও : ভেস্ট সমেত গাঢ় রঙের স্যুট, সিল্কের বো-টাই, সেলুলয়েডের কলার, ফেল্টের হ্যাট, হাতে কালো চকচকে ছাতা যা তিনি ছড়ি হিসেবেও ব্যবহার করতেন। কিন্তু যখন রাতের আঁধার কেটে আলো ফুটতে শুরু করে তখন তিনি মৃতদেহের নৈশকালীন প্রহরা থেকে দু’ঘণ্টার জন্য নিজেকে সরিয়ে নেন। দু’ঘণ্টা পর তিনি ফিরে আসেন উদীয়মান সূর্যের মতো তাজা, সযত্নে দাড়ি কামানো, তাঁর ড্রেসিংটেবিলের লোশন দ্বারা শরীর সুরভিত। এখন তাঁর পরনে বিশেষ ধরনের কালো ফ্রক কোট, যা শুধু শেষকৃত্যানুষ্ঠান ও পবিত্র সপ্তাহের ক্রিয়াকাণ্ডের সময় পরা হয়, গলায় উইঙ্গ কলার ও টাই-এর পরিবর্তে শিল্পীর বো, মাথায় একটা বাউলার হ্যাট। হাতে ছাতাও আছে, শুধু অভ্যাসের জন্যই নয়, দুপুরের আগেই যে বৃষ্টি নামবে সে সম্পর্কে তিনি ছিলেন সুনিশ্চিত। তিনি ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজাকে সে কথা জানিয়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা একটু এগিয়ে আনার কথা বললেন। ওরা চেষ্টাও করেন, কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিলেন জাহাজী পরিবারের সদস্য, তিনি ছিলেন ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির সভাপতি এবং মনে করা হত যে আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো জ্ঞান তাঁর আছে। কিন্তু বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ, পাব্লিক এবং প্রাইভেট কর্পোরেশনসমূহ, সামরিক ব্যান্ড, স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর অর্কেস্ট্রা, বিভিন্ন স্কুল ও ধর্মীয় সংস্থার সঙ্গে আগে থেকে ঠিক করা ছিল যে শেষকৃত্যানুষ্ঠান হবে বেলা এগারোটায়, এখন তা পরিবর্তন করা সম্ভব হল না। ফলে যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হবে বলে আশা করা গিয়েছিল তা বিধ্বংসী বর্ষণের কারণে একটা চরম বিশৃঙ্খল ঘটনায় পরিণত হল। খুব কম লোকই কাদামাটি ভেঙে ঔপনিবেশিক যুগের সিবা গাছ দ্বারা সুরক্ষিত পারিবারিক সমাধিস্থলে এসে পৌঁছতে পারলেন। গাছটির শাখা-প্রশাখা সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। আগের দিন অপরাহ্নে ওই একই শাখা-প্রশাখার নিচে, কিন্তু দেয়ালের অপর পাশে, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে, ক্যারিবীয় শরণার্থীরা জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে সমাহিত করেছিল। তাঁর পাশেই ওরা তাঁর কুকুরকেও কবর দেয়, সে-অনুরোধই তিনি করে গিয়েছিলেন।

    যে অল্প কয়েকজন শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যন্ত থেকে যান ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি ততক্ষণে ভিজে চুপচুপ। তিনি বাড়ি ফিরলেন খুবই ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়। এত বছরের নিখুঁত যত্ন ও সতর্কতা এবং অত্যন্ত বেশি রকম সাবধানতা অবলম্বনের পর এবার বুঝি তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। তিনি একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে এক গ্লাস লেমোনেড খেলেন, বিছানায় শুয়ে দুটো অ্যাসপিরিনের বড়ির সঙ্গে তা পান করলেন, গায়ে একটা উলের কম্বল জড়ালেন, তারপর যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর শরীরের যথার্থ ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হল ততক্ষণ তাঁর গা থেকে বালতি বালতি ঘাম ঝরালেন। তারপর তিনি যখন আবার ফারমিনা ডাজাদের বাড়িতে ফিরে গেলেন তাঁর মনে হল তাঁর প্রাণশক্তি তিনি পুরোপুরি ফিরে পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ফারমিনা ডাজা বাসভবনের সকল শাসনভার আবার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বাড়িঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে, দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য তা প্রস্তুত, পাঠাগারের বেদিতে তিনি প্যাস্টেলে আঁকা তাঁর স্বামীর একটি প্রতিকৃতি সাজিয়ে রেখেছেন, ফ্রেমের চারপাশে কালো রেখা এঁকে দিয়েছেন। আটটা নাগাদ গত রাতের মতই লোকের ভিড় ও গরম দেখা গেল, কিন্তু বিশেষ প্রার্থনাটি শেষ হলে একজন সবার কাছে একটা অনুরোধ প্রচার করলেন, সবাই যদি এখন আর দেরি না করে বিদায় গ্রহণ করেন তাহলে রবিবারের পর এই প্রথম বারের মতো সদ্য বিধবা একটু বিশ্রাম নিতে পারবেন।

    বেশির ভাগ মানুষকে ফারমিনা ডাজা পাঠাগারের বেদির সামনে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন, তবে অন্তরঙ্গ বন্ধুদের তিনি রাস্তার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, যেন তিনি নিজের হাতে সেখানে তালা লাগাতে পারেন, যা তিনি চিরকাল করেছেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত যা তিনি করবেন। এই সময় তিনি দেখতে পেলেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে, শোক পালনের কাপড় পরে জনশূন্য বসার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি খুশি হলেন, কারণ বহু বছর তিনি তাকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছিলেন এবং এই প্রথম তিনি তাকে স্পষ্ট দেখলেন, বিস্মৃতি দ্বারা পরিশোধিত, কিন্তু তাকে ধন্যবাদ দেবার আগেই তিনি বুকের ওপর তার হ্যাট চেপে ধরেন, ঈষৎ কম্পমান কিন্তু মর্যাদাশীল, আর তখন যে ফোঁড়াটি এতকাল তার জীবনকে ধরে রেখেছিল সেটা বিস্ফোরিত হল।

    তিনি বললেন, ফারমিনা, আমি অর্ধশতাব্দি ধরে এই সুযোগটির জন্য অপেক্ষা করেছি, যেন আমি আমার চিরন্তন বিশ্বস্ততা ও অন্তহীন ভালবাসার শপথের কথা আবার তোমাকে জানাতে পারি।

    ফারমিনা ডাজার মনে হল তিনি যেন একটি উন্মাদ ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে আসলে হোলি স্পিরিট দ্বারা অনুপ্রাণিত, এ কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তাঁর তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত ইচ্ছা হয়, তার স্বামীর মৃতদেহ যখন কবরের ভেতরে এখনো উষ্ণ, সেই সময়ে এই গৃহকে এভাবে অপবিত্র করার জন্য তিনি তাকে অভিশাপ দেবেন। কিন্তু তাঁর বিশাল ক্রোধের মর্যাদাই তাকে তা করতে দিল না। তিনি শুধু বললেন, এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আর যে ক’বছর বেঁচে থাকো তোমার মুখ আর এখানে দ্বিতীয়বার দেখিয়ো না। তিনি রাস্তার দরজাটা বন্ধ করতে শুরু করেছিলেন, সেটা খুলে আবার বললেন, আর আমি আশা করি খুব বেশি বছর তুমি বাঁচবে না।

    তিনি তখন নির্জন রাস্তায় তাঁর পদধ্বনি মিলিয়ে যেতে শুনলেন, তখন অতি ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করলেন। দরজার আড়াআড়ি পাল্লা দুটি তুলে দিলেন, দরজায় তালা লাগালেন। তারপর একাকী নিজের নিয়তির মুখোমুখি হলেন।

    তখনো তাঁর বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হয় নি, সেই সময়ের কথা তাঁর মনে পড়লো। তখন তিনি যে নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন তার ওজন ও আকার সম্পর্কে তিনি কখনো সম্পূর্ণ সচেতন হন নি, যে নাটক তাঁকে অনুসরণ করবে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম বারের মত তিনি অশ্রু বিসর্জন করলেন, কোনো সাক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া, তিনি সর্বদা যেভাবে চোখের জল ফেলতেন সেই ভাবে। তিনি চোখের জল ফেললেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্য, নিজের একাকিত্ব ও ক্রোধের জন্য, আর যখন তিনি তাঁর শূন্য শয়ন ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি চোখের জল ফেললেন তাঁর নিজের জন্য, কারণ তাঁর কুমারিত্ব বিসর্জন দেবার পর থেকে তিনি কদাচিৎ ওই শয্যায় একাকী রাত্রি যাপন করেছেন। তাঁর স্বামীর প্রতিটি জিনিস আবার তাঁর চোখে জল এনে দিল; শোভা বাড়াবার জন্য সুতার গুচ্ছযুক্ত তাঁর চটি জোড়া, বালিশের নিচে তাঁর পাজামা, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাঁর প্রতিবিম্বের অনুপস্থিতি, নিজের ত্বকে স্বামীর দেহের গন্ধের অভাব। একটা অস্পষ্ট ভাবনায় তিনি কেঁপে উঠলেন; একটা মানুষ যাদের ভালবাসে তাদের উচিত মৃত্যুর সময় তাদের সব জিনিস নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। শয্যা গ্রহণের জন্য তৈরি হতে তিনি কারো সাহায্য নিতে চাইলেন না, ঘুমাতে যাবার আগে তিনি কিছু খেতে চাইলেন না। শোকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন ঈশ্বর যেন আজ রাতে ঘুমের মধ্যে তাঁর প্রাণ হরণ করেন। তারপর নগ্ন পদে, কিন্তু পুরো পোশাক পরা অবস্থায়, ওই আশা নিয়ে, তিনি যেখানে শুলেন সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি যে ঘুমিয়ে পড়েছেন তা তিনি বুঝতেই পারেন নি, কিন্তু ঘুমের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তিনি তখনো বেঁচে আছেন, তাঁর শয্যার অর্ধেকটা খালি পড়ে আছে, সব সময় তিনি যেভাবে শুতেন আজো সেই ভাবে শুয়ে আছেন, শয্যার বাঁ ধারে, নিজের বাঁ পাশে, কিন্তু শয্যার অন্য পাশে অন্য একটা দেহের ওজন যে ওখানে নেই তাও উপলব্ধি করলেন তিনি। ঘুমাতে ঘুমাতেই তিনি ভাবলেন যে এই ভাবে তিনি আর কোনো দিন ঘুমাতে পারবেন না, তারপর ঘুমের মধ্যেই তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, শয্যায় তাঁর নিজের জায়গায় শুয়ে, নিজের অবস্থান একটুও পরিবর্তন না করে, তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতে থাকলেন, রাতা মোরগগুলি ডেকে উঠার পরও অনেকক্ষণ তিনি ঘুমিয়ে থাকলেন, তারপর ঘৃণিত সূর্যের প্রভাত- আলো তাঁকে জাগিয়ে দিলো, তাঁর স্বামীকে ছাড়া। আর শুধু তখনই তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন যে তিনি মরে না গিয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন, ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন, আর কাঁদতে কাঁদতে মৃত স্বামীর কথা যতটা ভেবেছেন তার চাইতে বেশি ভেবেছেন ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা।

    অন্যদিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, একান্ন বছর নয় মাস চার দিন আগে তাঁর যে দীর্ঘ বিক্ষুব্ধ প্রেম ফারমিনা ডাজা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল তারপর থেকে এক মূহূর্তের জন্যও ওর কথা ভাবা বন্ধ করেন নি। তাকে কোনো দৈনন্দিন হিসেব রাখতে হয় নি, কোনো কুঠুরীর দেয়ালে প্রতিদিনের জন্য দাগ কাটতে হয় নি, কারণ ওকে মনে করিয়ে দেবার জন্য একটা না একটা কিছু তার জীবনে প্রতিদিনই ঘটেছে। ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মায়ের সঙ্গে জানালার রাস্তার একটা ভাড়া বাড়ির অর্ধেকটা নিয়ে থাকতো। সেখানে তার মা, তাঁর তরুণী জীবন থেকেই, টুকিটাকি জিনিসের একটা দোকান চালাতেন। পুরনো জামা-কাপড় কেটে আর ন্যাকড়া ইত্যাদি দিয়ে ব্যান্ডেজ তৈরি করে যুদ্ধাহতদের জন্য তিনি সে সব বিক্রি করতেন। ফ্লোরেন্টিনো ছিল তাঁর একমাত্র সন্তান। বিখ্যাত জাহাজ মালিক ডন পায়াস ভি লোয়াইজার সঙ্গে একটা সাময়িক সম্পর্কের ফলে ওর জন্ম হয়। যে তিন ভাই ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে ম্যাগডালেনা নদী বক্ষে বাষ্পচালিত নৌযান চলাচলে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত করেছিলেন ডন পায়াস ছিলেন তাঁদেরই একজন।

    তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর পুত্রের বয়স দশ বছর। তিনি গোপনে ওর খরচপত্র যোগালেও কখনো আইনের চোখে তাকে সন্তানের স্বীকৃতি দেন নি, তার ভবিষৎ সংস্থানের জন্যও কোনো ব্যবস্থা করেন নি। বাবার মৃত্যুর পর তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। তখন সে ডাক বিভাগে যোগ দেয়। সেখানে তার ওপর বস্তা খোলার, চিঠি পত্র বাছাই করে আলাদা করার এবং যে দেশ থেকে ডাক এসেছে তার পতাকা দপ্তরের দরজায় উড়িয়ে দিয়ে জনসাধারণকে খবর দেয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়।

    ওর সুবিবেচনা বোধ ও কাণ্ডজ্ঞান টেলিগ্রাফ যন্ত্রপরিচালক জার্মান দেশত্যাগকারী লোটারিও থুগুটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের সময় ক্যাথিড্রালে অর্গান বাজাতেন, তা ছাড়া নিজ গৃহে ছাত্রছাত্রীদের সংগীত শিক্ষাও দিতেন। লোটারিও থুগুট ফ্লোরেন্টিনোকে মোর্স সঙ্কেত ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা কিভাবে পরিচালিত হয় তা শিখিয়ে দেন। আর তাঁর কাছ থেকে বেহালা বাদনে কয়েক দিন শিক্ষা গ্রহণের পরই সে প্রায় পেশাদার বাদকের মতো বাজাতে সক্ষম হয়। ফারমিনা ডাজার সঙ্গে যখন তার প্রথম দেখা হয় তখন নিজের সামাজিক বৃত্তে তার বিপুল চাহিদা। সে সাম্প্রতিকতম নাচগুলি নাচতে পারে, ভাবালু কবিতাবলী মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারে। বন্ধুবর্গের প্রেমিকদের উদ্দেশে রাতের বেলা তাদের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাতে সে ছিল সর্বদাই রাজি। খুব কৃশকায় ছিল সে, তার কালো চুলে সুবাসিত পোমেড মাখিয়ে সে তার মাথায় বসিয়ে রাখতো। ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য তাকে চশমা পরতে হত, যার ফলে তার অসহায় চেহারা আরো প্রকট হয়ে উঠতো চোখের অসুবিধা ছাড়াও সে ভুগতো দীর্ঘকালীন কোষ্ঠকাঠিন্যে, যার জন্য তাকে জীবনভর এনিমা নিতে হয়। তার একটা কালো স্যুট ছিল, প্রয়াত পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, কিন্তু তার মা ট্রান্সিটো আরিজা সেটার এতো যত্ন নিতেন যে প্রতি রবিবারই সেটাকে নতুন মনে হত। তার দুর্বল চেহারা, তার সংযম, তার অনুজ্জ্বল পোশাক সত্ত্বেও ফ্লোরেন্টিনোও তাদের সঙ্গে, কালক্ষেপণের জন্য, বাজি ধরতো, যতদিন পর্যন্ত না ফারমিনা ডাজার সঙ্গে তার দেখা হয়, আর তখনই তার নিষ্পাপ সারল্যের সমাপ্তি ঘটে।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রথমবার ফারমিনা ডাজাকে দেখে এক অপরাহ্নে। লোটারিও থুগুট তাকে লোরেঞ্জো ডাজা নামক এক ব্যক্তির কাছে একটা টেলিগ্রাম পৌঁছে দিতে বলে। লোরেঞ্জো ডাজার বাসার হদিস কেউ জানতো না। ফ্লোরেন্টিনো তাকে ইভাঞ্জেল পার্কের একটি প্রাচীন জরাজীর্ণ বাড়িতে খুঁজে বের করে। বাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত, ভেতরের উঠানে ফুলের টবগুলিতে আগাছা জন্মেছে, একটা পাথরের ফোয়ারা দেখা গেল যার মধ্যে কোনো জল নেই, বাড়িটাকে মনে হল পরিত্যক্ত মঠের মতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বারান্দার খিলানে ঢাকা পথ দিয়ে নগ্নপদ দাসীকে অনুসরণ করার সময় কোথাও কোনো মানুষের শব্দ শুনতে পেল না। তার চোখে পড়ল মুখ বন্ধ করা কয়েকটা পিচ বোর্ডের বাক্স আর ইট মিস্ত্রির কিছু হাতিয়ার। সেগুলি অব্যবহৃত চুন ও কয়েকটা সিমেন্টের বস্তার মধ্যে পড়ে আছে, কারণ তখন বাড়ির একটা আমূল সংস্কারের কাজ চলছিল। উঠানের একেবারে শেষ প্রান্তে একজন খুব মোটা লোক একটা অস্থায়ী দপ্তরে বসে আছেন, তাঁর কোঁকড়ানো জুলফি বেড়ে উঠে তাঁর গোঁফের সঙ্গে মিশেছে, তিনি একটা দেরাজের ওপাশে বসে দিবানিদ্রারত। তিনিই লোরেঞ্জো ডাজা, শহরে খুব বেশি পরিচিত নন, কারণ তিনি এখানে এসেছেন এখনো দু’বছর হয় নি, আর তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও বেশি ছিল না।

    তিনি যেভাবে তারবার্তাটি গ্রহণ করলেন মনে হল এটা বুঝি তাঁর অশুভ স্বপ্নেরই সম্প্রসারণ। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এক ধরনের সরকারি অনুকম্পার সঙ্গে তাঁর ধূসর- নীল চোখের দিকে তাকালো। তিনি অনিশ্চিত আঙুল দিয়ে সিল-মোহর ভাঙার চেষ্টা করছিলেন, বেশ ভীত, বহু টেলিগ্রাম-প্রাপকের চোখে মুখে ফ্লোরেন্টিনো এটা লক্ষ করেছে, তারা মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত না করে কোনো টেলিগ্রামের কথা ভাবতেই পারে না। ভদ্রলোক টেলিগ্রামটা পড়ার পর তাঁর স্থৈর্য ফিরে পেলেন। তিনি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, সুখবর। তারপর তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বাধ্যতামূলক পাঁচ রিয়াল দিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে তাকে জানিয়ে দিলেন যে খবরটা খারাপ হলে তিনি তাকে পয়সাটা দিতেন না। অতঃপর তিনি করমর্দন করে তাকে বিদায় দিলেন। এটা ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ, টেলিগ্রাম বিলিকারীর সঙ্গে সাধারণত এ রকম করা হত না। রাস্তার দরজার দিকে ফিরে যাবার সময় আবার দাসী তার সঙ্গ নিল, তাকে পথ দেখাবার জন্য ততটা নয় যতটা তার ওপর নজর রাখার জন্য, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এবার বুঝলেন যে বাড়িতে আরো মানুষ আছে। উঠানের উজ্জ্বলতা তখন এক মহিলার কণ্ঠস্বরে ভরপুর, তিনি পাঠ্য পুস্তকের একটা পাঠ পুনরাবৃত্তি করছিলেন। সেলাই কক্ষের পাশ দিয়ে যাবার সময় ফ্লোরেন্টিনো জানালা দিয়ে একজন বয়স্ক মহিলা ও একজন অল্প বয়সী মেয়েকে একটা বই পড়তে দেখলেন। ওরা দুজন খুব কাছাকাছি চেয়ারে বসে আছে, মহিলার কোলের উপর একটা খোলা বই। দৃশ্যটা বিচিত্র মনে হল তার কাছে; মেয়ে মাকে পড়তে শেখাচ্ছে। তার ধারণা শুধু অংশত ভুল ছিল, মহিলা বালিকার মা নয়, তার পিসি, যদিও নিজের সন্তানের মতোই তিনি তাকে লালনপালন করেছেন। পড়ালেখায় বাধা পড়ে নি কিন্তু জানালার ওপার দিয়ে কে যাচ্ছে তা দেখার জন্য মেয়েটি চোখ তুলে ওদিকে তাকিয়েছিল, আর ঐ আকস্মিক চাউনিই প্রেমের এমন এক ঘূর্ণি ঝড় তোলে যা অর্ধশতাব্দি পরে আজও থামে নি।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লোরেঞ্জো ডাজা সম্পর্কে যা জানতে পারে তা এই : তিনি কলেরা মহামারীর পর তাঁর একমাত্র কন্যা ও এক অবিবাহিতা বোনকে নিয়ে সান হুয়ান ডি লা সিনেগা থেকে এখানে চলে আসেন। ওকে যারা জাহাজ থেকে নামতে দেখে তাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে তিনি স্থায়ী ভাবে বাস করার জন্য এখানে এসেছেন, কারণ একটি সুসজ্জিত ভবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তিনি তার প্রায় সবই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মেয়েটির অল্প বয়সে তার মা মারা যায়। ভদ্রলোকের বোনের নাম এসকোলাস্টিকা, চল্লিশ বছর বয়স, একটা মানত পালনের জন্য তিনি রাস্তায় বেরুবার সময় সেন্ট ফ্রান্সিস সম্প্রদায়ের পোশাক পরতেন, আর বাড়িতে থাকার সময় তিনি কোমরে জড়িয়ে রাখতেন একজন অনুতাপকারীর রজ্জু। মেয়েটির বয়স তের বছর, মৃত মায়ের নামেই তার নাম ফারমিনা।

    লোরেঞ্জা ডাজাকে একজন সম্পন্ন লোক বলে অনুমান করা হত, কারণ তিনি কোনো কাজ করেন বলে কারো জানা ছিল না, তবু তিনি বেশ ভালো ভাবে থাকতেন এবং ইভানজেল পার্কের বাড়িটির জন্য নগদ টাকা প্রদান করেছিলেন, দু’হাজার স্বর্ণ পেসো। তারপরও বাড়িটির সংস্কারের জন্য তাকে ওই অঙ্কের অন্তত দ্বিগুন ব্যয় করতে হয়। তাঁর মেয়ে প্রেজেন্টেশান অব ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমিতে পড়াশোনা করছে। দুই শতাব্দি ধরে সমাজের সম্ভ্রান্ত তরুণীরা সেখানে পরিশ্রমী হবার কলাকৌশল শিখেছে এবং সুবাধ্য স্ত্রী হবার গুণাবলী অর্জন করেছে। ঔপনিবেশিক যুগে এবং গণতন্ত্রের প্রথম ক’বছর স্কুলটি শুধু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন পরিবারের মেয়েদেরই ছাত্রী হিসেবে গ্রহণ করতো, কিন্তু স্বাধীনতার ফলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া প্রাচীন পরিবারগুলিকে নতুন যুগের বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করতে হয় এবং যে সব প্রার্থী বেতন দিতে সক্ষম তাদের সবার জন্য, রক্তের রঙ নির্বিশেষে, অ্যাকাডেমিকে তার দরজা খুলে দিতে হয়। শুধু একটাই অলঙ্ঘনীয় শর্ত ছিল, ছাত্রীকে অবশ্যই ক্যাথলিক বিয়ের বৈধ সন্তান হতে হবে। যাই হোক, স্কুলটি ছিল ব্যয়বহুল এবং ফারমিনা ডাজা যে সেখানে পড়ে এই তথ্যটি তার পরিবারের সামাজিক অবস্থান না হোক, অর্থনৈতিক অবস্থানের সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে এটা উৎসাহিত করলো, কারণ তার মনে হলো কাঠ বাদামের মতো চোখের ওই সুন্দরী কিশোরী তার স্বপ্নের আয়ত্ত্ব বহির্ভূত নয়। কিন্তু মেয়েটির বাবার কঠোর শাসনব্যবস্থা একটা দুর্বার বাধার জন্ম দিল। আর সব মেয়ের মতো ফারমিনা ডাজা অন্য মেয়েদের সঙ্গে দল বেঁধে কিংবা কোনো বৃদ্ধা পরিচারিকার সঙ্গে স্কুলে যায় না, সে সব সময় স্কুলে হেঁটে যায় তার অবিবাহিতা পিসির সঙ্গে এবং তার আচরণ থেকে বোঝা যায় যে তাকে বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা বা অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দিতে দেয়া হয় না।

    নিঃসঙ্গ শিকারি হিসেবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার গোপন জীবন শুরু হয় নিষ্পাপ ও সরল ভাবে। সকাল সাতটা থেকে ছোট্ট পার্কটির সব চাইতে নিভৃত বেঞ্চে সে বসে থাকতো, ভান করতো যেন বাদাম গাছগুলির ছায়ার নিচে বসে কবিতার বই পড়ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নীল ডোরা কাটা ইউনিফর্ম পরা ওই অসম্ভব মেয়েটিকে তার স্কুলের দিকে হেঁটে যেতে না দেখা যেত ততক্ষণ পর্যন্ত সে বসে থাকতো। মেয়েটির পরনের মোজা ছিল হাঁটু পর্যন্ত, মাথায় মোটা একটা বেণী, যার শেষ প্রান্তে ফুলের মতো করে ফিতা বাঁধা। নিজের সহজাত অহঙ্কারী ভঙ্গিতে সে হেঁটে যেতো, মাথা উঁচু, চোখ দুটি অচঞ্চল, দ্রুতগতি, নাক সোজা সামনের দিকে, বইয়ের ব্যাগ আড়াআড়ি করে দুই বাহুর নিচে বুকের কাছে ধরা, তার হরিণীর মতো চলন দেখে মনে হত সে যেন মধ্যাকর্ষণের প্রভাবমুক্ত। তার সঙ্গে তাল রাখতে ব্যস্ত পাশে পাশে চলা পিসি ফ্লোরেন্টিনোকে তার কাছে যাবার কোনো সুযোগই দিল না। পিসির পরনে তার চিরাচরিত বাদামি রঙের পোশাক ও সেন্ট ফ্রান্সিসের রজ্জু। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দিনে চারবার করে তাদের পথপরিক্রমা দেখতো, আর রবিবারে একবার, তারা যখন হাই ম্যাস-এর প্রার্থনার পর গীর্জা থেকে বেরিয়ে আসতো। মেয়েটিকে দেখাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। একটু একটু করে সে তাকে আদর্শায়িত করে তুললো, তার মধ্যে আরোপ করলো অসম্ভব সব গুণাবলী এবং কল্পিত আবেগ-অনুভূতি, আর দু’সপ্তাহ পর সে তাকে ছাড়া আর কিছু বা অন্য কারো কথা ভাবতেই পারলো না। তখন সে ফারমিনা ডাজাকে একটা চিঠি পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিল, একটা সহজ সরল চিঠি, কাগজের উভয় পৃষ্ঠায় তার চমৎকার নোটারির হাতের লেখায়। বেশ কয়েক দিন সে চিঠিটা তার পকেটে নিয়ে ঘুরলো, কেমন করে ওটা তার হাতে দিবে তা নিয়ে প্রচুর ভাবলো, ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে আরো কয়েক পাতা লিখলো, ফলে মূল চিঠিটা একটা প্রশংসাসূচক অভিধানের রূপ নিলো। পার্কে ওর পথ চেয়ে বসে থাকার সময় প্রায়ই সে যে সব বই পড়তো, যা তার প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, তাই তাকে তার চিঠিতে ওই প্রশংসাসূচক শব্দাবলী যোগ করার প্রেরণা যোগায়

    চিঠিটা ওর কাছে পৌঁছে দেবার একটা উপায় খুঁজে পাবার উদ্দেশ্যে সে প্রেজেন্টেশান অ্যাকাডেমির অন্য ছাত্রীদের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের অবস্থান ছিল তার জগতের চাইতে বড় বেশি দূরে। তাছাড়া, অনেক চিন্তার পর, তার মনে হলো যে তার অভিপ্রায়ের কথাটা অন্য কাউকে জানানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবু সে একটা খবর যোগাড় করতে সক্ষম হলো। এই শহরে আসার কয়েক দিন পর ফারমিনা ডাজা এক শনিবার একটা নাচের পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছিল কিন্তু তার বাবা তাকে সেখানে যাবার অনুমতি দেন নি। তিনি তাঁর চূড়ান্ত মতামত জানিয়ে দিয়েছিলেন, যথা সময়ে সবই হবে। ইতিমধ্যে চিঠিটা ষাট পাতার বেশি হয়ে গিয়েছিল, কাগজের দু’দিকে লেখা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার গোপন ভালবাসার ভার আর বইতে পারলো না। সে সব কথা তার মাকে খুলে বললো, একমাত্র তাঁর সঙ্গেই সে তার চিন্তাভাবনা ভাগ করে নিতে পারতো। প্রেমের ব্যাপারে পুত্রের অপাপবিদ্ধ সরলতায় মায়ের চোখে জল দেখা দিল। তিনি নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে পথ দেখাতে চেষ্টা করলেন। তিনি প্রথমে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন যে মেয়েটির হাতে তার গীতিকাব্যময় কাগজের তাড়া তুলে দেয়া ঠিক হবে না, এর ফলে তার স্বপ্নের গভীরতা দেখে সে শুধু ভীত হয়ে পড়বে, কারণ মায়ের ধারণায় হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপারে মেয়েটিও তাঁর পুত্রের মতোই কাঁচা ও অনভিজ্ঞ। প্রথম কাজ হবে ফ্লোরেন্টিনো যে তার সম্পর্কে উৎসাহী সে ব্যাপারে তাকে সচেতন করে তোলা, তখন সে তার প্রেম নিবেদনে অত অবাক হবে না এবং বিষয়টা ভেবে দেখার সময় পাবে। সর্বোপরি তিনি বললেন, যে মানুষটিকে তোমার পক্ষে আনতে হবে তিনি হলেন মেয়ের পিসি।

    কোনো সন্দেহ নেই যে দুটি উপদেশই ছিল বিজ্ঞজনোচিত, কিন্তু সেগুলি আসে বড় দেরিতে। আসলে, ফারমিনা ডাজা যে দিন তার পিসিকে পড়াবার সময় জানালার ওপাশ দিয়ে কে যাচ্ছে দেখার জন্য একটু চোখ তুলেছিল তখনই সে ফ্লোরেন্টিনোর অসহায় ভঙ্গি দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে দিন রাতে খাবার সময় তার বাবা যখন টেলিগ্রামটির কথা বলেন তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কেনো এ বাড়িতে এসেছিল এবং জীবিকার জন্য সে কি করে ফারমিনা তা জানতে পারে। এ তথ্যটি তার উৎসাহ ও কৌতূহল বাড়িয়ে তোলে, কারণ আরো অনেকের মতো ওই সময়ে ফারমিনাও টেলিগ্রাম আবিষ্কারকে জাদুবিদ্যার মতো একটা কিছু মনে করতো। এর পর সে যখন ওকে প্রথম বারের মতো ছোট্ট পার্কটিতে গাছের ছায়ায় একটা বই পড়তে দেখে তখনই সে ওকে চিনতে পারে, যদিও সে যে ওখানে কয়েক সপ্তাহ ধরেই বসে থাকছে এটা তার পিসির কাছ থেকে শোনার আগ পর্যন্ত সে ওই ঘটনায় কিছু মাত্র বিচলিত হয় নি। এর পর প্রতি রবিবার প্রার্থনার শেষে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা যখন ওকে আবার দেখতে পেল তখন পিসির মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না যে এই সাক্ষাৎগুলি আকস্মিক নয়। তিনি বললেন, ও আমার জন্য এতো কষ্ট করছে না। তাঁর আপাত-বিশুষ্ক আচরণ ও অনুতাপকারীর পোশাক সত্ত্বেও পিসি এসকোলাস্টিকার জীবন সম্পর্কে একটা স্বভাবজ আগ্রহ ছিল এবং দুষ্টুমিতে সহযোগিতা করার জন্য ছিল একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। এগুলিই তার সব চাইতে বড় গুণ এবং তাঁর ভাইঝির প্রতি একটা মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে এই ব্যাপারটাই তাঁর মধ্যে অপ্রতিরোধ্য আবেগের জন্ম দিল। ফারমিনা ডাজা অবশ্য তখন পর্যন্ত প্রেমের বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত, সে সম্পর্কে তার মনে কোনো সাধারণ ঔৎসুক্যও জাগ্রত হয় নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সম্পর্কে যে একমাত্র অনুভূতি তার হয় তা হলো এক ধরনের অনুকম্পা, কারণ তার মনে হলো যে মানুষটা অসুস্থ। কিন্তু তার পিসি তাকে বললেন যে একটা মানুষের আসল স্বভাব জানতে অনেক দিন লাগে, আর তার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে মানুষটি পার্কে বসে বসে ওদের যাওয়া আসা লক্ষ করে সে যদি অসুস্থ হয়েই থাকে তাহলে সেটা হলো প্রেম রোগ।

    প্রেম বর্জিত ভালোবাসার একমাত্র সন্তানটির জন্য এসকোলাস্টিকা পিসি ছিলেন স্নেহ ও সহমর্মিতার এক সুন্দর আধার। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনিই তাকে মানুষ করেছেন। ফারমিনা ডাজার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি পিসির চাইতে একজন সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীর মতোই বেশি আচরণ করেছেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার উপস্থিতি লক্ষ করা তাদের দুজনের জন্যই সময় কাটাবার একটা বিনোদনমূলক উপকরণে পরিণত হলো। দিনে চারবার, ছোট্ট ইভানজেলিস পার্কের মধ্যে দিয়ে আসা যাওয়ার সময়, উভয়েই, প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও প্রায় সর্বদাই কালো পোশাক পরা, কৃশকায়, ভীতু, সাধারণ দেখতে, গাছের নিচে বসে বই পড়ার ভান করা তরুণটিকে দ্রুত চোখে দেখতো। আর তরুণটি চোখ তুলে তার জীবনের দুই অনমনীয় উদাসীন রমণীকে একবারও তার দিকে না তাকিয়ে পার্কের মধ্য দিয়ে চলে যাবার দৃশ্যটি দেখবার আগেই, ওদের দুজনের মধ্যে যে আগে তাকে দেখতো সে তার হাসি চাপতে চাপতে বলতো, ওই যে, দেখা যাচ্ছে ওকে।

    পিসি বলতেন, বেচারা! আমি সঙ্গে থাকি বলে ও তোমার কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না, কিন্তু তার অভিপ্রায় যদি তুচ্ছ ও হাল্কা না হয় তাহলে একদিন ও আসবেই এবং তোমাকে একটা চিঠি দেবে।

    নানা রকম অসুবিধার কথা পূর্বাহ্নে অনুমান করে তিনি ফারমিনাকে নীরব সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতে শেখালেন, নিষিদ্ধ প্রেমের ক্ষেত্রে যা ছিল এক অপরিহার্য কৌশল। এই সব ছেলেমিভরা অপ্রত্যাশিত ক্রীড়া কৌতুক ফারমিনা ডাজার চিত্তে এক অচেনা কৌতূহলের জন্ম দিল, কিন্তু ব্যাপারটা যে আরো অনেক দূর যেতে পারে সে কথা পরবর্তী কয়েক মাস ধরে তার মনেই হয় নি। কখন যে খেলাটা একটা সার্বক্ষণিক চিন্তায় পরিণত হল তা সে খেয়াল করতেই পারলো না। ওকে দেখার তাগিদে এখন তার রক্ত টগবগ করে ওঠে, আর একদিন রাতে সে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো, কারণ তার মনে হলো তার বিছানার পায়ের দিকের অন্ধকার থেকে ও যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর সে মনপ্রাণ দিয়ে কামনা করলো তার পিসির ভবিষ্যদ্বাণী যেন সত্য হয়, সে ঈশ্বরের প্রার্থনা জানালো ও যেন তাকে লেখা ওর চিঠিটা তার হাতে দেবার সাহস পায়, ও কি লিখেছে ফারমিনা শুধু সেটা জানতে চায়, আর কিছু না।

    কিন্তু তার প্রার্থনা বিফলে গেল। বরং উল্টো ফল হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন তার মায়ের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলে তখনই ব্যাপারটা ঘটে। মা তার সত্তর পৃষ্ঠাব্যাপী প্রশংসায়পূর্ণ চিঠি ফারমিনাকে দেয়া থেকে পুত্রকে নিবৃত্ত করলেন, আর ওদিকে ফারমিনা বছরের বাকি দিনগুলি ব্যর্থ প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিল। ডিসেম্বরের ছুটি এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক চিন্তা হতাশায় রূপান্তরিত হল, কেমন করে ছুটির ওই তিন মাস সে ফ্লোরেন্টিনোকে দেখতে পাবে, ফ্লোরেন্টিনোইবা কেমন করে তাকে দেখবে, তখন তো সে আর হেঁটে হেঁটে স্কুল যাবে না। বড় দিনের আগের রাতেও তার দুর্ভাবনার অবসান হল না, কিন্তু গির্জায় মধ্য রজনীর প্রার্থনার পর ভিড়ের মধ্যে ওকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে চমকে উঠলো, একটা প্রচণ্ড অস্থিরতায় তার হৃদয় মন মথিত হল। সে মাথা ঘোরাবার সাহস পেল না, বাবা আর পিসির মাঝখানে বসেছিল সে। ওরা যেন তার অস্থিরতা লক্ষ না করে সেজন্য নিজেকে তার নিয়ন্ত্রণ করতে হল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে গির্জা থেকে বেরুবার সময় সে ওকে এতো কাছে অনুভব করলো, এতো পরিষ্কার ভাবে, যে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তির প্রভাবে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হল, আর তখনই সে ওকে দেখতে পেল, তার চোখের কাছ থেকে এক হাতেরও কম দূরত্বে। সে দেখতে পেল তার হিমশীতল চোখ, তার বিষণ্ণ মুখ, ভালোবাসার আতঙ্কে তার প্রস্তরীভূত ঠোঁট। নিজের দুঃসাহসে আতঙ্কিত হয়ে সে পিসি এসকোলাস্টিকার হাত আঁকড়ে ধরল যেন সে পড়ে না যায়, আর পিসি তাঁর হাতের লেসের দস্তানার মধ্য দিয়ে ওর বরফশীতল ঘাম দেখতে পেলেন, আর তাঁর হাতে ঈষৎ চাপ দিয়ে তিনি তাকে তাঁর নিঃশর্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আর ওদিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আতসবাজি আর ঢোলের বাদ্যধ্বনির মধ্যে, দরজায় দরজায় রঙিন আলোর মালার মধ্যে, শান্তির জন্য চিৎকার করা জনতার মধ্যে ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো একজন মানুষের মতো, তার অশ্রু জলের ভেতর দিয়ে আনন্দ উৎসব দেখতে দেখতে, সকাল পর্যন্ত লক্ষ্যহীনভাবে পথে পথে ঘুরলো, চোখ ধাঁধানো বিভ্রান্তির মধ্যে তার মনে হল, ঈশ্বর নয়, সে-ই যেন ওই রাতে পুনর্জন্মগ্রহণ করেছে। এর পরের সপ্তাহে দিবানিদ্রার জন্য নির্ধারিত সময়ে ফারমিনা ডাজাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় ফারমিনা ও তার পিসিকে দোরগোড়ায় বাদাম গাছগুলির নিচে বসে থাকতে দেখল সে এবং তখন থেকে তার চিত্তবিভ্রম আরো বেড়ে গেল। প্রথম দেখার সময় সেলাই ঘরে ওই অপরাহ্নে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে দৃশ্য দেখেছিল বর্তমানে তারই পুনরাবৃত্তি দেখল সে, এবার ঘরের বাইরে : মেয়েটি তার পিসিকে পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার স্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া ফারমিনাকে অন্য রকম দেখালো। সে এখন পরে আছে বহু ভাঁজ দেয়া একটা আঁটো জ্যাকেট, গ্রিক ধাঁচের, আর মাথায় জড়িয়ে রেখেছে তাজা গার্ডেনিয়া ফুলের একটা মালা, তাকে দেখাচ্ছিল মুকুট পরিহিতা কোনো দেবীর মতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পার্কটিতে বসে থাকলো, তাকে যে দেখা যাবে সে সম্পর্কে সে সুনিশ্চিত ছিল এবং এখন আর সে বই পড়ার ভান করলো না। সে চুপচাপ বসে থাকলো কোলের উপর তার খোলা বইটা রেখে, তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ থাকলো কুহকিনী মেয়েটির ওপর, যার হৃদয়ের চোখ কিন্তু তার ওপর একবারও পড়লো না।

    প্রথমে তার মনে হয়েছিল যে বাদাম গাছের নিচে পড়ালেখার ব্যাপারটা অপরিকল্পিত, বাড়ির ভেতরে সারাক্ষণ মেরামতের কাজ চলছিল, তাই এই ব্যবস্থা, কিন্তু পরবর্তী দিনগুলির অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝলো যে আগামী তিন মাস, প্রতিদিন অপরাহ্নে এই একই সময়ে, ফারমিনা ডাজাকে এখানে দেখা যাবে এবং ওই বিশ্বাস তাকে নতুন আশায় পূর্ণ করলো। ও যে তাকে দেখেছে এমন কোনো আভাস সে পায় নি, কিন্তু ওর ঔদাসীন্যের মধ্যে এমন একটা দীপ্তি ছিল যা তাকে লেগে থাকতে উৎসাহ যোগালো। তারপর জানুয়ারির শেষ দিকে এক অপরাহ্ণে ওর পিসি তাঁর চেয়ারের উপর বই খাতা রেখে, ভাইঝিকে দোরগোড়ায় একা ফেলে ভেতরে চলে গেলেন। আর বাদাম গাছ থেকে হলুদ পাতার রাশি ঝিরঝির করে বৃষ্টির মতো ওর মাথার ওপর পড়তে থাকলো। এটা একটা পূর্ব পরিকল্পিত সুযোগ এই উচ্চণ্ড চিন্তায় উদ্দীপিত হয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রাস্তা অতিক্রম করে ফারমিনা ডাজার সামনে এসে দাঁড়ালো, এতো কাছে যে সে ওর নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনলো, নাকে ফুলের গন্ধ পেলো, যে গন্ধ সে সারা জীবন ওর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রাখবে। সে মাথা উঁচু করে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়ালো, মাত্র অর্ধশতাব্দি পরে আবারও সে যে ভাবে দাঁড়াবে, এবং ওই একই কারণে। সে বললো, আমি শুধু তোমাকে আমার একটা চিঠি গ্রহণ করতে বলছি।

    ফারমিনা ডাজা তার কণ্ঠস্বর যে রকম শুনলো সে রকম হবে বলে ভাবে নি। তীক্ষ্ণ, পরিষ্কার, সুনিয়ন্ত্রিত, যার সঙ্গে তার বিষণ্ণ উদাসীন ভাবভঙ্গির কোনো মিল নেই। ওর এম্ব্রয়ডারি থেকে চোখ না তুলে ফারমিনা জবাব দিল, আমার বাবার অনুমতি ছাড়া আমি এটা গ্রহণ করতে পারি না। ওর কণ্ঠের উষ্ণতায় ফ্লোরেন্টিনোর গায়ে কাঁটা দিল, ওর চাপা গলার সুরেলা ধ্বনি সে তার বাকি জীবনে ভুলবে না। কিন্তু সে নিজেকে স্থির রেখে দ্বিধাহীন ভাবে বললো, তাহলে সেটা নিয়ে এসো। তারপর তার আদেশের মধ্যে একটা অনুরোধের সুর লাগিয়ে তাকে একটু কোমল করলো, বললো, এটা জীবন মরণের ব্যাপার। ফারমিনা ডাজা তার দিকে মুখ তুলে তাকালো না, তার সেলাই বন্ধ করলো না, কিন্তু তার সিদ্ধান্তের দরজাটা একটু ফাঁক করে দিল, যে ফাঁক দিয়ে গোটা পৃথিবী ঢুকে পড়তে পারতো। ও বললো, প্রতিদিন বিকালে এসো, আর আমি আসন পরিবর্তন না করা পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সামনের সোমবারের পূর্ব পর্যন্ত ওর কথার অর্থ বুঝতে পারে নি। সে দিন তার ছোট্ট পার্কের বেঞ্চ থেকে সে একই দৃশ্য দেখলো, তবে একটু পরিবর্তনসহ। এসকোলাস্টিকা পিসি বাড়ির ভেতর যাবার পর ফারমিনা ডাজা উঠে দাঁড়ালো, তার পর অন্য চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন রাস্তা পেরিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কোটের কলারের ভাঁজ করা অংশে লাগানো ছিল একটা সাদা ক্যামেলিয়া ফুল। সে বললো, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হল এটা। ফারমিনা ডাজা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো না, কিন্তু দ্রুত তার চারপাশটা দেখে নিল, গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যে জনশূন্য রাস্তাঘাট দেখলো, বাতাসের ঝাপটায় মরা পাতাগুলির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য লক্ষ করলো। তারপর বললো, দাও আমাকে।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এক সময় ওকে তার সত্তর পৃষ্ঠার চিঠিটা দিতে চেয়েছিল কিন্তু পরে আধ পৃষ্ঠায় তার ধীর স্থির সুস্পষ্ট বক্তব্যটি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়। সে প্রতিশ্রুতি দিল তার নিখুঁত বিশ্বস্ততার এবং তার চিরস্থায়ী ভালোবাসার। সে তার কোটের ভেতরের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সেলাইরত মেয়েটির বিচলিত চোখের সামনে তুলে ধরলো, মেয়েটি তখনো তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারে নি। সে আতঙ্কে প্রস্তরীভূত একটা হাতে কম্পমান নীল খামটা দেখল, সে তার এম্ব্রয়ডারির ফ্রেমটা উঁচু করে তুলে ধরলো যেন ও তার ওপর চিঠিটা ফেলে দিতে পারে, সে যে ওর আঙুলির কাঁপুনি দেখেছে সেটা সে স্বীকার করতে চাইলো না। আর তখনই ব্যাপারটা ঘটলো। বাদাম গাছের পাতার মধ্যে একটা পাখি নড়ে উঠলো আর তার পুরীষ ঝরে পড়লো সূচি কাজটির উপরে। ফারমিনা ডাজা দ্রুত ফ্রেমটা সরিয়ে নিয়ে চেয়ারের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল, ও যেন কী ঘটেছে তা দেখতে না পায়, আর তখন সে প্রথম বারের মতো ওর মুখের দিকে তাকালো, তার নিজের মুখ তখন যেন আগুনের তাপে লাল ও তাতানো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখে কিন্তু কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না, চিঠিটা হাতে ধরে সে শুধু বললো, এটা সুলক্ষণ। ফারমিনা ডাজা ওকে ধন্যবাদ জানালো, তার প্রথম হাসিটি ওকে উপহার দিল, তারপর ওর কাছ থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে, ভাঁজ করে, বডিসের ভেতর লুকিয়ে ফেললো। এর পর ফ্লেরেন্টিনো আরিজা তার কোটে লাগানো ক্যামেলিয়া ফুলটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো, কিন্তু সে ওটা গ্রহণ করলো না, বললো, এ ফুল প্রতিশ্রুতির ফুল। তারপর ওর খেয়াল হল যে তাদের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তখন ও আবার তার স্থৈর্যের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে বললো, এখন যাও, আর আমি না বলা পর্যন্ত ফিরে এসো না।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে প্রথম দেখার পরই তার মা সেটা জানতে পারেন, মাকে বলার আগেই, কারণ তিনি দেখলেন যে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ক্ষুধা নাই, সারা রাত বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করে। কিন্তু ওর চিঠির উত্তরের প্রত্যাশায় থাকার সময় তার অবস্থা জটিলতর হল। সে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হল, সবুজ বমি করলো, তার আচার-আচরণে বৈকল্য দেখা দিল, মাঝে মাঝে তার মূর্ছা যাবার মতো হতে লাগলো। এ সব দেখে মা ভয় পেলেন। তাঁর কাছে উপসর্গগুলি প্রেমের বিপর্যয়ের চাইতে কলেরার বিধ্বংসী রূপ বলেই বেশি মনে হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ধর্মপিতা, এক বৃদ্ধ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, মা তাঁকে ডেকে আনলেন। মা যখন গোপন শয্যাসঙ্গিনীর জীবনযাপন করছিলেন তখন থেকেই তিনি তাঁর কাছে নিজের যাবতীয় সুখ-দুঃখ ও সঙ্কটের কথা খুলে বলে এসেছেন। এই চিকিৎসকও রোগীর অবস্থা দেখে শঙ্কিত হলেন। নাড়ি দুর্বল, ঘন ভারি নিঃশ্বাস, মুমূর্ষু মানুষের মতো ফ্যাকাসে ঘাম হচ্ছে। কিন্তু তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে গায়ে জ্বর নেই, শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই, রোগীর একমাত্র সুনির্দিষ্ট অনুভূতি হল আশু মৃত্যুর জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তিনি কয়েকটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বিচক্ষণ প্রশ্ন করলেন, প্রথমে রোগীকে, তারপর রোগীর মাকে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে প্রেমের উপসর্গ আর কলেরার উপসর্গের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তিনি রোগীর স্নায়ুকে প্রশমিত করার জন্য লিনডেন ফুলের রস খেতে বললেন, তারপর বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে অন্য কোথাও ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন, দূরত্বের মধ্যে সে হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পাবে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চাইলো শুধু নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে দিতে, তাতেই তার আনন্দ।

    ট্রান্সিটো আরিজা ছিলেন মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কোয়াড্রন। তার দেহের এক- চতুর্থাংশ রক্ত ছিল নিগ্রো রক্ত আর তিন-চতুর্থাংশ শ্বেতাঙ্গ রক্ত। আনন্দের জন্য তাঁর সহজ প্রবণতা দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে গিয়েছিল, পুত্রের দুঃখ-যন্ত্রণায় তিনি এখন একটা আনন্দ লাভ করলেন, তাকে তিনি নিজের দুঃখ-যন্ত্রণা বলে মনে করলেন। পুত্র প্রলাপ বকতে শুরু করলে তিনি তাকে চিকিৎসক নির্দেশিত রস পান করালেন, তাকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করার জন্য তার গায়ের উপর উলের কম্বল একটার পর একটা চাপালেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে তার চরম অবসন্ন অবস্থা উপভোগ করতেও উৎসাহিত করলেন।

    তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন, এখন তোমার বয়স অল্প, এখনই এর সুযোগ নাও, যতখানি পারো যন্ত্রণা ভোগ করো, এ সব জিনিস সারাজীবন ধরে পাবে না। ডাক বিভাগের লোকজন অবশ্য এই ভাবনার সঙ্গে একমত হলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাজকর্মে অবহেলা পরিলক্ষিত হল। অমনোযোগের ফলে ডাক আসবার পর পতাকা তুলতে গিয়ে সে ভুলভাল করলো। এক বুধবার সে জার্মান পতাকা তুলে দেয়, অথচ সেদিন জাহাজটা ছিল লেল্যান্ড কোম্পানির এবং সেটা ডাক নিয়ে এসেছিল লিভারপুল থেকে। আরেক দিন সে উড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা, অথচ জাহাজটা ছিল জেনারেল ট্রান্স আটলান্টিক কোম্পানির এবং সেটা ডাক নিয়ে এসেছিল সাঁৎ নাজার থেকে। প্রেমের বিভ্রান্তি ডাক বিলির ক্ষেত্রে নানা রকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলো, লোকজনের কাছ থেকে বহু অভিযোগ এলো এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে তার চাকরি খোয়ায় নি তার মূলে ছিল লোটারিও থুগুটের আনুকূল্য। তিনি তাকে টেলিগ্রাফের কাজে নিযুক্ত রাখলেন এবং গির্জার বাদন দলে বেহালা বাজাবার জন্য সঙ্গে নিয়ে যেতে লাগলেন। ওদের দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক, একজন পিতামহ ও আরেকজন পৌত্র হতে পারতো, তাই তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা বোঝা কঠিন ছিল। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে যেমন তাদের সুন্দর সমঝোতা ও প্রীতির সম্পর্ক ছিল, বন্দরের সরাইখানাগুলিতেও তাই ছিল। সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থা নির্বিশেষে সবাই সন্ধ্যায় ওই সরাইখানাগুলিতে গিয়ে জড়ো হত, মাতাল ভিখিরি পালিয়ে আসতো ভাজা মালিট মাছ ও নারকেল-ভাত খাবার লোভে। লোটারিও থুগুট টেলিগ্রাম অফিসের শেষ পালার কাজ সমাপ্ত করে এই রকম একটা সরাইখানায় চলে আসতেন, অনেক সময় সকাল পর্যন্ত সেখানে বসে বসে জ্যামাইকান পাঁচমিশালী সুরা পান করতেন আর আন্টিলীয় পালের জাহাজগুলি থেকে ডাঙ্গায় নেমে আসা পাগলা মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে স্ফূর্তি করতেন। তিনি ছিলেন স্থূলকায়, ঘাড়টা ছিল ষাঁড়ের মতো, মুখে সোনালি দাড়ি, আর রাতে বেরুবার সময় তিনি মাথায় চাপাতেন একটা লিবার্টি ক্যাপ, শুধু যদি ঘণ্টার একটা মালা থাকতো তাঁর সঙ্গে তা হলে তাঁকে অবিকল সন্ত নিকোলাসের মতো দেখাতো। সপ্তাহের অন্তত একটি রাত তিনি শেষ করতেন কালো একটি মেয়েকে নিয়ে, যাদের তিনি অভিহিত করতেন রাতের পাখি বলে, যারা নাবিকদের জন্য গজিয়ে ওঠে স্বল্পস্থায়ী হোটেলে অর্থের বিনিময়ে জরুরি ভিত্তিতে ভালোবাসা বিক্রি করতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে দেখা হবার পর তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হল এক ধরনের হাকিমী আনন্দ নিয়ে তাকে নিজের স্বর্গের গোপন আনন্দযজ্ঞে দীক্ষিত করার চেষ্টা। যে সব রাতের পাখিকে তিনি সর্বোত্তম মনে করতেন তাদের মধ্য থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্য মেয়ে নির্বাচন করার দায়িত্ব নিলেন তিনি, তাদের সঙ্গে দাম ও তাদের কামকলা নিয়ে আলোচনা করলেন, নিজের টাকা থেকে তাদের সেবার জন্য ওদের প্রাপ্য অর্থ অগ্রিম মিটিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রাজি হল না। তার কৌমার্য এখনো অক্ষত আছে এবং সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভালোবাসা ছাড়া সে তার কৌমার্য বিসর্জন দেবে না!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.