Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক পাতা গল্প715 Mins Read0

    প্রেম ও কলেরা – ৯

    ৯

    ডাক্তার উরবিনো তাঁর শেষ প্রয়াস হিসাবে প্রেজেন্টেশান অব দি ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমির প্রধান সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ-এর সাহায্য চাইলেন। যে-পরিবার উভয় আমেরিকায় তাঁদের সমাজকে প্রথম থেকে সাহায্য সমর্থন দিয়ে এসেছে তার একজন সম্মানিত সদস্যের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। একদিন সকাল ন’টায় একজন নবদীক্ষিত সন্ন্যাসিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফারমিনা ডাজার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। ও তখন স্নান করছিল। ওই আধঘণ্টা সময় তারা দুজন পাখির খাঁচাগুলির সামনে আনন্দেই কাটিয়ে দেন। সিস্টার ছিলেন একজন পুরুষালি জার্মান, কণ্ঠস্বর কর্কশ, চোখের দৃষ্টি কঠোর ও অহঙ্কারী, যার সঙ্গে তাঁর বালিকা-সুলভ আবেগ-অনুভূতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফারমিনা ডাজা তাঁকে ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুকে যতো ঘৃণা করতো পৃথিবীর আর কোনো জিনিসকে অতো ঘৃণা করতো না। তাঁর কপট ধার্মিকতার কথা মনে করেই ওর সারা গা গুলিয়ে এলো। বাথরুমের জানালা দিয়ে ও তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে তার স্কুল জীবনের যাবতীয় নির্যাতনের স্মৃতি জেগে উঠলো, প্রতিদিনের উপাসনার অসহনীয় একঘেঁয়েমি, পরীক্ষার আতঙ্ক, নবদীক্ষিত সন্ন্যাসিনীদের ক্রীতদাস সুলভ পরিশ্রম, আধ্যাত্মিক দারিদ্র্যে বিকৃত ওই জীবনের সব কিছু। অন্য দিকে সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ ওকে এমন সানন্দ সম্ভাষণ করলেন যা মনে হল আন্তরিক। ও যেভাবে বেড়ে উঠেছে ও পরিপক্কতা অর্জন করেছে তাতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন, বিশেষ সুবিবেচনা ও বিচার বুদ্ধির সঙ্গে তার সংসার পরিচালনার প্রশংসা করলেন তিনি, উঠানের সর্বত্র সুরুচির পরিচয় আর অঙ্গারপাত্রে কমলার কুঁড়ির জন্য ওকে অভিনন্দিত করলেন। তিনি নতুন সন্ন্যাসিনীকে বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে বললেন, যেন কাকের খাঁচার খুব কাছে না যায় সে বিষয়ে তাকে সাবধান করে দিলেন, ওরা কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার চোখ খুবলে নিতে পারে। তারপর তিনি একটা নির্জন জায়গার খোঁজ করলেন যেখানে তিনি একান্তে ফারমিনা ডাজার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারবেন, আর ফারমিনা তখন তাঁকে ড্রয়িংরুমে আমন্ত্রণ জানালো।

    সাক্ষাৎপর্বটি হল সংক্ষিপ্ত এবং তিক্ত। সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ আনুষ্ঠানিকতায় সময় ক্ষেপণ না করে সরাসরি বললেন যে তাঁরা ফারমিনা ডাজাকে সসম্মানে তাঁদের শিক্ষাঙ্গনে আবার গ্রহণ করবেন, ওর বহিষ্কারের কারণ শুধু সব কাগজপত্র থেকেই নয়, সমাজের স্মৃতি থেকেও মুছে ফেলা হবে এবং সে তার পড়াশোনা শেষ করে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করার সুযোগ পাবে। ফারমিনা ডাজা বিভ্রান্ত বোধ করলো, সে এর কারণ জানতে চাইলো।

    সিস্টার বললেন, ‘এটা এমন একজনের অনুরোধ যিনি যা চান তার সব কিছুই পাবার যোগ্যতা রাখেন এবং তাঁর একমাত্র ইচ্ছা তুমি যেন সুখী হও। তুমি কি জানো তিনি কে?’

    এইবার ও বুঝলো। ও নিজেকে প্রশ্ন করলো যে-মহিলা একদিন একটা সরল নিষ্পাপ চিঠির জন্য তার জীবন দুবির্ষহ করে তুলেছিলেন তিনি আজ কোন অধিকারে একজনের প্রেমের দূতিয়ালি করতে এসেছেন, কিন্তু সে এ প্রশ্ন করার সাহস পেল না। তার পরিবর্তে সে শুধু বললো, হ্যাঁ, সে লোকটিকে চেনে এবং সেই সুবাদেই সে এটাও জানে যে তার জীবনে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার তাঁর নেই।

    সিস্টার বললেন, ‘তিনি শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি নিশ্চিত যে তোমার বাবা কোনো আপত্তি করবেন না।’

    তার বাবা যে এই সাক্ষাতের ব্যাপারে সাহায্য করেছেন এটা বুঝতে পেরে ফারমিনা ডাজার রাগ আরো বেড়ে গেল।

    ও বললো, ‘আমার অসুখের সময় আমরা পরস্পরকে দুবার দেখেছি, এখন আবার আমাদের একে অন্যকে দেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।‘

    সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ বললেন, ‘মাথায় এক রত্তি বুদ্ধি থাকলে যে কোনো মেয়ে ওই মানুষটিকে মহান ঈশ্বরের একটা বড় উপহার বলে মনে করতো।’

    তিনি তাঁর গুণাবলী, তাঁর একনিষ্ঠতা, যন্ত্রণাপীড়িত মানুষের সেবায় তাঁর নিবেদিতচিত্ততার কথা বলে গেলেন। বলতে বলতে তিনি তার পোশাকের হাতার মধ্য থেকে মার্বেলে যিশুর প্রতিকৃতি খোদাই করা একটা সোনার জপমালা বের করে সেটা ফারমিনা ডাজার চোখের সামনে দোলাতে লাগলেন। এটা ছিল উত্তরাধিকার সূত্রেপ্রাপ্ত একটি মূল্যবান পারিবারিক জিনিস, একশো বছরেরও বেশি পুরনো, সিয়েনার স্বর্ণকার কর্তৃক খোদাই করা, স্বয়ং চতুর্থ ক্লেমেন্ট কর্তৃক আশীষধন্য।

    সিস্টার বললেন, ‘এটা তোমার।‘

    ফারমিনা ডাজার ধমনী দিয়ে সমুদ্রগর্জনের মতো রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করলো, তারপর সে সাহস সঞ্চয় করে বললো, ‘আপনার মতে, আপনার মতে, ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তাহলে এখন আপনি একাজটা কেন করছেন তা আমি বুঝতে পারছি না।’

    সিস্টার এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি ওই মন্তব্যের অর্থই বুঝতে পারেন নি কিন্তু তাঁর চোখের পাতা লাল হয়ে উঠলো। তিনি ওর চোখের সামনে জপমালাটি দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘আমার সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসা তোমার জন্য মঙ্গলদায়ক হবে, কারণ আমার পরে আর্চবিশপ আসবেন, তখন ব্যাপারটা ভিন্ন রূপ নেবে।

    ফারমিনা ডাজা বললো, ‘আসুন তিনি।’

    সিস্টার তাঁর হাতার মধ্যে সোনার জপমালাটি আবার ঢুকিয়ে দিয়ে, অন্য হাতাটির ভেতর থেকে এটা প্রচুর ব্যবহৃত গুল্লি পাকানো রুমাল বের করে তাঁর হাতের মুঠিতে সেটা শক্ত করে ধরে, ফারমিনার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন তিনি ওকে অনেক দূর থেকে দেখছেন আর তাঁর মুখে ফুটে উঠলো একটা অনুকম্পার হাসি।

    ‘বেচারী! তুমি এখনো ওই লোকটার কথা ভাবছো।’

    ফারমিনা ডাজা তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তিটি নিজের মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করলো, চোখের পাতা না ফেলে এক দৃষ্টিতে সিস্টারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, নীরবে তাঁর উক্তিটি নিয়ে ভাবতে লাগলো, তারপর গভীর সন্তোষের সঙ্গে সিস্টারের পুরুষালি চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠতে দেখলো। সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ তাঁর গুল্লি পাকানো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, ‘তোমার বাবা ঠিকই বলেন, তুমি একটা অসম্ভব গোঁয়ার একরোখা মেয়ে।’

    আর্চবিশপ আসেন নি, তাই অবরোধের সমাপ্তি এখানেই ঘটতে পারতো, যদি না ওই দিনই হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ তার খালাতো বোনের সঙ্গে বড় দিন উদযাপনের জন্য এখানে এসে উপস্থিতি হত এবং এই ব্যাপারটা ওদের দুজনের জীবনই বদলে দিল। সকাল পাঁচটায় ওরা রিওহাচার জাহাজে তাকে স্বাগত জানালো। সমুদ্র-পীড়ায় অর্ধমৃত একদঙ্গল যাত্রী পরিবৃত হয়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু হিল্ডাব্রান্ডা উদ্ভাসিত মুখে জাহাজ থেকে নেমে এলো, সমুদ্রবক্ষে বাজে একটা রাত কাটাবার পর এখন উদ্দীপ্ত, পুরোদস্তুর একজন মহিলা। ও সঙ্গে নিয়ে এসেছে কয়েক খাঁচা জ্যান্ত টার্কিমোরগ, আর ওদের উর্বর ভূমির যাবতীয় ফলমূল, যেন ওর অবস্থান কালে এখানে খাবারদাবারের বিন্দুমাত্র ঘাটতি না পড়ে। ওর বাবা লিসিমাকো সাঞ্চেজ একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ছুটির সময়ে পার্টির জন্য তাদের যদি সঙ্গীত শিল্পীর দরকার হয় তাহলে তাঁকে যেন জানানো হয়, তাঁর হাতে সর্বোত্তম শিল্পীর দল আছে, তা ছাড়া পরে তিনি কয়েক বাক্স আতশবাজিও পাঠিয়ে দেবেন। তিনি আরো জানিয়ে দিলেন যে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তিনি মার্চের আগে আসতে পারবেন না, কাজেই মজা করার জন্য ওরা অঢেল সময় পাবে।

    দুই বোন সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলো। প্রথম দুপুর থেকেই তারা একসঙ্গে স্নান করতে শুরু করে, নগ্নদেহে, চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে একে অপরের হাত-পা ধুইয়ে দেয়। তারা পরস্পরের গায়ে সাবান মাখালো, পরস্পরের উকুন দূর করলো, তাদের নিতম্ব ও শান্ত স্তনের তুলনা করলো, অন্যের দর্পণে নিজেকে দেখলো, যাচাই করতে চেষ্টা করলো শেষ বার একে অন্যকে নগ্নাবস্থায় দেখার পর নিষ্ঠুর কাল এই সময়ের মধ্যে তাদের সঙ্গে কীরকম আচরণ করেছে। হিল্ডাব্রান্ডা ছিল বড়সড়ো, নিরেট, ত্বকের রঙ সোনালি, কিন্তু গায়ের লোম বর্ণসঙ্করের মতো, ছোট, কোঁকড়ানো, ইস্পাতের উলের মতো। অন্য দিকে, ফারমিনা ডাজার নগ্নতা ছিল সাদাটে, দীর্ঘ রেখায় বিন্যস্ত, ত্বক নির্মল, চুল সোজা। গালা প্লাসিডিয়া তার শোবার ঘরে দুটি হুবহু এক রকম খাট পেতে দিয়েছিল কিন্তু মাঝে মাঝে তারা এক শয্যায় শুতো এবং ভোর পর্যন্ত সারা রাত গল্প করে কাটিয়ে দিতো। ওরা দুজন ছিনতাইকারী গুণ্ডাদের লম্বা সরু সিগার টানতো, হিল্ডাব্রান্ডা তার ট্রাঙ্কে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলো, ধূমপানের পর তার বিশ্রী গন্ধ তাড়াবার জন্য ওরা ঘরের মধ্যে আর্মেনীয় কাগজ পোড়াতো। ফারমিনা ডাজা জীবনে প্রথম ধূমপান করে ভালেদুপারে, তারপর সেটা অব্যাহত রাখে ফোনেস্কা ও রিভহাচায়, যেখানে দশ জ্ঞাতি বোন ঘর বন্ধ করে একসঙ্গে ধূমপান আর পুরুষ মানুষ নিয়ে গাল গল্প করতো। ফারমিনা ডাজা উল্টো করে ধূমপানের কৌশল শিখে ফেলে আগুন জ্বালানো প্রান্তটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে, যুদ্ধের সময় পুরুষেরা যেভাবে ধূমপান করতো সেই ভাবে, যেন শত্রু পক্ষ তাদের সিগারেটের আলো দেখে তাদের অবস্থান না বুঝতে পারে। এখন বাড়িতে হিল্ডাব্রান্ডাকে পেয়ে সে রোজ রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ধূমপান করতে আরম্ভ করলো, আর তখনই এ অভ্যাসটা তার মজ্জাগত হয়ে যায়, তবে এটা সে সর্বদা গোপন রাখতো, তার স্বামীর কাছ থেকেও, সন্তানদের কাছ থেকেও, সে যে লোকজনের সামনে প্রকাশ্যে ধূমপান করা অশোভন মনে করতো শুধু সেজন্য নয়, ব্যাপারটার মধ্যে গোপনীয়তার যে আনন্দ আছে তা উপভোগ করার জন্যও বটে।

    হিল্ডাব্রান্ডার বাবা-মা তার ওপর এই সফর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা হিল্ডাব্রান্ডা ও তার অসম্ভব প্রেমিকের মধ্যে একটা স্থানিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যদিও তাঁরা এমন ভাব করছিলেন যে মেয়েকে তাঁরা এখানে পাঠিয়েছেন ফারমিনাকে একটা ভালো পাত্র নির্বাচনে সাহায্য করার জন্য। হিল্ডাব্রান্ডা মা-বাবার প্রস্তাব মেনে নেয়, মনে মনে ঠিক করে যে ফারমিনার মতো সেও, বিস্মৃতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে, আর তাই ফোনেস্কার টেলিগ্রাফ কর্মীর সঙ্গে সে একটা ব্যবস্থা করে এসেছে, তার সমস্ত বার্তা সে সর্বোচ্চ বিজ্ঞতার সঙ্গে এখানে পাঠিয়ে দেবে। এই পরিস্থিতিতে সে যখন জানলো যে ফারমিনা ডাজা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তখন তার মোহ ভঙ্গের তিক্ততা তাকে বড় বেশি বাজলো। ভালোবাসা সম্পর্কে হিল্ডাব্রান্ডার ছিল একটা সর্বজনীন ধারণা, একটা ভালোবাসার ক্ষেত্রে কিছু ঘটলে তার প্রভাব বিশ্বজুড়ে অন্য ভালোবাসাগুলির ওপরও পড়বে। তবু সে তার পরিকল্পনা ত্যাগ করলো না। সে একাই টেলিগ্রাফ আপিসে গেল, তার নিজের ব্যাপারে সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সাহায্য চাইবে। তার প্রচণ্ড সাহস ফারমিনা ডাজার মনে এক বিষণ্নতার সঙ্কটের জন্ম দিল।

    হিল্ডাব্রান্ডা ওকে চিনতে পারতো না। ফারমিনা ডাজার কথা শুনে সে ওর যে মূর্তি নিজের মনে গড়ে তুলেছিল তার সঙ্গে ওর বাস্তব চেহারার কোনো মিল নেই। প্রথম দর্শনেই তার মনে হল ফারমিনার নিশ্চয়ই উন্মাদ-দশা ঘটেছিল, নইলে এরকম মানুষের সঙ্গে প্রেমে পড়া তো অসম্ভব। প্রায় অদৃশ্য এক কেরানি, বেত্রাহত কুকুরের মতো দেখতে, পরনের কাপড় জামা অপদস্থ কোনো পাদ্রীর মতো, তার গম্ভীর আচরণ দিয়ে কারো হৃদয়ে তোলপাড় তোলা ছিল অসম্ভব। কিন্তু একটু পরেই সে তার প্রথম ধারণার জন্য অনুতপ্ত হল, কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কোনো পরিচয় না জেনেই তাকে নিঃশর্ত সাহায্যদানে রাজি হয়। ও তার অবস্থা যতখানি উপলব্ধি করেছিল আর কারো পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। ও তার পরিচয় জানতে চাইলো না, তার ঠিকানা ও না। ওর সমাধান ছিল খুব সহজ। প্রতি বুধবার বিকালে সে টেলিগ্রাফ আপিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার হাতে তার প্রেমিকের বার্তাগুলি তুলে দেবেন, ব্যস, আর কিছু নয়। কিন্তু হিল্ডাব্রান্ডা যখন তার লিখিত বার্তা ওর কাছে নিয়ে এল তখন সেটা পড়ার পর ফ্লোরেন্টিনো বললো ও যদি কিছু পরামর্শ দেয় সে কি তা গ্রহণ করবে? হিল্ডাব্রান্ডা রাজি হলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রথমে লাইনের ভেতরে ভেতরে কিছু সংশোধন করলো, দু’এক জায়গা মুছে দিয়ে নতুন করে লিখলো, শেষে আর জায়গা না থাকায় পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা বার্তা লিখে দিল, যেটা হিল্ডাব্রান্ডার কাছে মনে হল অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী। সে যখন টেলিগ্রাফ অফিস ত্যাগ করলো তখন তার দু’চোখ অশ্রুসজল।

    সে ফারমিনা ডাজাকে এসে বলল, ও দেখতে বিশ্রী আর বিমর্ষ চেহারা, কিন্তু তার আগাগোড়া ভালোবাসায় পূর্ণ।

    ফারমিনা ডাজা সম্পর্কে যা হিল্ডাব্রান্ডার সব চাইতে খারাপ লাগে তা হল তার একাকিত্ব। সে ওকে বললো, ওকে দেখে মনে হয় ও যেন কুড়ি বছরের এক অনূঢ়া বুড়ি। সে নিজে অভ্যস্ত ছিল বিশাল বাড়ির ছড়ানো-ছিটানো পরিবারের পরিবেশে, সেখানে কোনো এক বিশেষ সময়ে কতো জন বাস করছে কিংবা কতো জন খাচ্ছে সে সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারতো না। তাই হিল্ডাব্রান্ডার পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন ছিল কেমন করে তার বয়েসী একটি মেয়ে মঠের সন্ন্যাসিনীর মতো এরকম নিঃসঙ্গ ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতে পারে। আর ব্যাপারটা ছিল সত্য : সকাল ছ’টায় জেগে ওঠার পর থেকে রাতে শোবার ঘরে আলো নিভিয়ে দেবার পূর্ব পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা ব্যস্ত থাকতো শুধু সময় কাটানো নিয়ে। জীবন তার ওপর চাপানো ছিল বাইরে থেকে। প্রথমে, মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে দুধওয়ালা সদর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে তার ঘুম ভাঙাতো। তারপর হত মেছুনীর করাঘাত, শ্যাওলার শয্যায় শায়িত মৃত্যুপথযাত্রী লাল সামুদ্রিক মাছের সম্ভার একটা বাক্সে নিয়ে সে আসতো, তারপর আসতো জাঁকানো ফল বিক্রেতারা, মারিয়া লা বাহা থেকে শাকসব্জী নিয়ে আর সান জামিন্টো থেকে নানা রকম ফল নিয়ে। তারপর সমস্ত দিন ধরে কেউ না কেউ দরজায় ধাক্কা দিতেই থাকে : ভিক্ষুক, লটারির টিকিট বিক্রি করা মেয়েরা, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সিস্টার, গুচ্ছের কাহিনী নিয়ে ছুরি ধার করানোর লোক, বোতল কেনার লোক, পুরনো সোনা কেনার লোক, পুরনো খবরের কাগজ কেনার লোক, তাস দেখে, হাতের রেখা দেখে, কফির দানা দেখে, জলের গামলায় জল দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করার দাবীদার নকল জিপসির দল। গালা প্লাসিডিয়া সারা সপ্তাহ ধরে শুধু দরজা খুলতো আর বন্ধ করতো, ক্রমাগত বলে যেতো, না, আর একদিন এসো, কিংবা বারান্দা থেকে বিরক্তি ভরে চিৎকার করে বলতো, আর জ্বালাতন করো না, আমাদের যা যা দরকার সব কেনা হয়ে গেছে। সে এতে উদ্দীপনা ও শোভনতার সঙ্গে এসকোলাস্টিকা পিসির জায়গা অধিকার করে নিয়েছিল যে ফারমিনা প্রায়ই ওদের দুজনকে তার মনের মধ্যে গুলিয়ে ফেলতো। ওর মধ্যে ছিল সত্যিকার ক্রীতদাসের নিবেদিতচিত্ততা। অবসর পেলেই সে কাজের মাঝে গিয়ে চাদর-পর্দা ইত্যাদি ইস্ত্রি করতো। ওগুলি সে তুলে রাখতো নিখুঁত ভাবে, ল্যাভেন্ডার দিয়ে আলমারিতে। তার সদ্য ধোয়া জামাকাপড়ই যে সে ইস্ত্রি ও ভাঁজ করে রাখতো তাই নয়, ব্যবহার না করার জন্য যেগুলি হয়তো ঈষৎ অনুজ্জ্বল হয়ে গেছে সেগুলিও সে সযত্নে ইস্ত্রি করতো। ফারমিনা ডাজার মা ফারমিনা সাঞ্চেজ মারা গেছেন চৌদ্দ বছর আগে, তাঁর কাপড়জামাও গালা প্লাসিডিয়া একই রকম যত্নের সঙ্গে আলমারিতে গুছিয়ে রাখতো। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত ছিল ফারমিনার। কি রান্না হবে, কি কি জিনিস কিনতে হবে, প্রতিটি পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তার নির্দেশ দিতো ফারমিনা ডাজা। সে-ই ঠিক করে দিতো এই বাড়ির পুরো জীবনধারা, যেখানে আসলে ঠিক করার কিছুই ছিল না। খাঁচাগুলি ধুয়ে পরিষ্কার করে পাখিদের খাওয়ানোর পর, ফুল গাছগুলির পরিচর্যার শেষে, ফারমিনা আর কি করবে ভেবে পেত না। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হবার পর সে প্রায়ই দিবানিদ্রার সময় যে শুয়ে পড়তো পর দিনের আগে আর জেগে উঠতো না। ছবি আঁকার ক্লাসগুলি ছিল সময় কাটাবারই একটা ঈষৎ প্রীতিপ্রদ পন্থা।

    এস্কোলাস্টিকা পিসির বিতাড়নের পর থেকে বাবার সঙ্গে ওর স্নেহের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল, তবে কেউ কাউকে অযথা বিরক্ত না করে একসঙ্গে থাকার একটা পথ উভয়েই বের করে নিয়েছিল। ফারমিনা ঘুম থেকে ওঠার আগেই লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যেতেন। দুপুরের খাবার টেবিলে তিনি কদাচিৎ অনুপস্থিত থাকতেন, যদিও তিনি প্রায় কিছুই মুখে দিতেন না, প্যারিস ক্যাফের আহার পূর্ববর্তী সুরা আর খুচরা এটা-ওটা খেয়েই তিনি তৃপ্ত থাকতেন। রাত্রেও কিছু খেতেন না। ওরা টেবিলে তাঁর খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতো, সব কিছু একটা থালায়, তার ওপর আরেকটা থালা চাপানো থাকতো, যদিও সবাই জানতো যে পরদিন প্রাতরাশের আগে তিনি কিছু ছোঁবেন না, তখন এই সব আবার গরম করে তাঁর সামনে পরিবেশন করা হত। সপ্তাহে এক দিন তিনি মেয়েকে সংসার খরচের টাকা দিতেন, সতর্কতার সঙ্গে হিসাব করে, এবং এটা পরিচালনা করতেন কঠোর ভাবে, তবে মেয়ে যদি কোনো অপ্রত্যাশিত খরচের জন্য কখনো বাড়তি কিছু টাকা চাইতো তখন তিনি সানন্দে তার অনুরোধ রাখতেন। তবে তিনি কখনো মেয়ের কাছ থেকে তার খরচের কোনো হিসাব নিতেন না, কিন্তু তাঁর মেয়ে সর্বদা এমন ভাবে সব হিসাব বুঝিয়ে দিত যে মনে হত সে যেন কোনো ধর্মীয় বিচারালয়ে তার কাজের কৈফিয়ত দিচ্ছে। নিজের ব্যবসার প্রকৃতি বা অবস্থা সম্পর্কে তিনি মেয়েকে কোন দিন কিছু বলেন নি, বন্দরে তাঁর অফিসে তাকে কখনো নিয়ে যান নি, সেটা এমন একটা জায়গায় অবস্থিত ছিল যেখানে বাবার সঙ্গেও ভদ্র ঘরের মেয়েদের যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। লোরেঞ্জো ডাজা রাত দশটার আগে বাড়ি ফিরতেন না। যুদ্ধের অপেক্ষাকৃত কম সঙ্কটকালীন সময়ে তখন সান্ধ্য আইন বলবৎ হত। তার আগে পর্যন্ত তিনি প্যারিস ক্যাফেতে একটার পর একটা খেলায় অংশ নিতেন। সালোঁর সব খেলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী, ভালো একজন শিক্ষকও। তিনি বাড়ি ফিরতেন অপ্রমও অবস্থায়, মেয়ের ঘুম বা বিশ্রামে কখনো ব্যাঘাত ঘটাতেন না, যদিও ঘুম থেকে উঠে অ্যানিসেট সুরার প্রথম গ্লাসটি পান করার পর থেকে সারাদিন নিয়মিত বিরতি দিয়ে তিনি ওই সুরা পান চালিয়ে যেতেন, সেই সঙ্গে আগুন না ধরানো তাঁর সিগারের প্রান্তদেশ চিবুতে থাকতেন। কিন্তু একদিন রাতে ফারমিনা তাঁর ফেরার শব্দ পেলো। সে সিঁড়িতে তাঁর কসাক-পদধ্বনি শুনলো, দোতলার হলঘর থেকে তাঁর ভারি ঘন নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনলো, তারপর শুনলো ওর শোবার ঘরের দরজায় তাঁর হাতের চেটো দিয়ে সজোরে করাঘাতের শব্দ। ও দরজা খুলে বাবার বাঁকানো চোখ আর জড়িত গলা শুনে এই প্রথম ভয় পেল।

    ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’, তিনি বললেন। ‘আমাদের সর্বস্ব হারিয়েছি আমরা!’

    শুধু ওই টুকুই বললেন তিনি, আর একটি কথাও না এবং তিনি যে সত্য কথা বলেছিলেন তা বুঝবার মতো কোনো কিছু ঘটলোও না। কিন্তু ওই রাতের পর ফারমিনা ডাজা উপলব্ধি করলো যে এই বিশ্বসংসারে সে একা। তার প্রাক্তন সহপাঠীরা যে-স্বর্গে আছে তার দ্বার তার জন্য বন্ধ। সে বাস করছে একটা সামাজিক শূন্যতার মধ্যে, বিশেষ করে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হবার পর থেকে। সে তার প্রতিবেশীদের প্রতিবেশী নয়, কারণ ওদের কাছে তার অতীত ছিল সম্পূর্ণ অজানা, ওরা তাকে দেখেছে শুধু প্রজেন্টেশান অব দি ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমির স্কুলের ইউনিফর্মে। তার বাবার ভুবন ছিল ব্যবসায়ী আর জাহাজে মাল তোলা ও খালাস করার লোকজনের ভুবন, আর প্যারিস ক্যাফের আশ্রমে ভিড় করা যুদ্ধের শরণার্থীদের ভুবন, আর নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন মানুষদের ভুবন। গত বছর ছবি আঁকার ক্লাস তার নিঃসঙ্গতা কিছুটা প্রশমিত করেছিল, তার শিক্ষক দলীয় ভাবে ক্লাস নেয়া পছন্দ করতেন, তাই তিনি অন্য ছাত্রীদেরও ফারমিনা ডাজাদের সেলাই ঘরে নিয়ে আসতেন, কিন্তু তার জন্য ওরা সবাই ছিল স্বল্পকালীন ধার করা বন্ধু, তাদের স্নেহ-প্রীতি ক্লাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতো। হিল্ডাব্রান্ডা চেয়েছিলো বাড়িটা খুলে দিতে, তার মধ্যে হাওয়া বইয়ে দিতে, তার বাবার গানবাজনার শিল্পীদের আর আতশবাজির বাক্স নিয়ে আসতে, আর কার্নিভালের নাচের আয়োজন করতে, ওই সব উৎসবের ঝোড়ো বাতাস ফারমিনার পোকায় খাওয়া মনটাকে চাঙ্গা করে তুলতে পারতো, কিন্তু এই পরিকল্পনাগুলি কোনো কাজে এলো না, খুব সহজ একটা কারণে, আমন্ত্রণ করবার মতো কেউ তাদের ছিল না।

    তবুও হিল্ডাব্রান্ডাই ফারমিনা ডাজাকে আবার জীবনের মধ্যে ঠেলে দিল। ছবি আঁকার ক্লাসের পর সে বিকালে শহরে ঘুরে বেড়াতে রাজি হল। সে রোজ তার পিসি এস্কোলাস্টিকার সঙ্গে যে পথে যেতো, তার জন্য ছোট পার্কটার যে বেঞ্চে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বই পড়ার ভান করে বসে থাকতো, তাদের চিঠি তারা যেখানে লুকিয়ে রাখতো, যে পথ ধরে ফ্লোরেন্টিনো তাদের অনুসরণ করতো, যে অশুভ জায়গায় একদা হোলি অফিসের কারাগার অবস্থিত ছিল, যাকে পরে পুনর্নির্মাণ করে প্রেজেন্টেশান অব দি ক্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমিতে রূপান্তরিত করা হয়, যে জায়গা সে তার সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে ঘৃণা করে সব সে হিল্ডাব্রান্ডাকে দেখালো। তারা টিলার উপরে নিঃস্বদের সমাধিস্থলে আরোহণ করলো, ফ্লোরিন্টিনো আরিজা বাতাসের অনুকূলে ওইখানে দাঁড়িয়ে তার বেহালা বাজাতো যেন ফারমিনা ডাজা তার বিছানায় শুয়ে ওর সুরধ্বনি শুনতে পায়, আর ওখানে দাঁড়িয়ে তারা দুজন সমগ্র ঐতিহাসিক নগরীটি দেখতে পেল, বাড়িঘরের ভাঙা ছাদ, ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল, কাঁটাবনের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গগুলির জঞ্জাল, উপসাগরে দ্বীপপুঞ্জের আভাস, জলাভূমিতে গরিবদের ঝুপড়ি, সুবিস্তীর্ণ ক্যারিবীয় অঞ্চল।

    বড়দিনের আগের রাতে ওরা মধ্যরজনীর বিশেষ উপাসনায় যোগ দিতে ক্যাথিড্রালে যায়। যে-আসনে বসে ফারমিনা ডাজা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় বাজনা সব চাইতে স্পষ্ট ভাবে শুনতে পেতো ঠিক সেই আসনেই সে বসলো, এই রকম এক রাতে যেখানে সে প্রথম ওর ভীতিবিহ্বল চোখ খুব কাছে থেকে দেখতে পায় সে স্থানটি সে হিল্ডাব্রান্ডাকে দেখালো। তারপর তারা দুজন সাহস করে, আর কারো সঙ্গ ছাড়াই, কলমপেশাজীবীদের চত্বরে যায়, মিষ্টি কেনে, আজব কাগজের দোকানে ঢুকে মজা পায়, আর ফারমিনা ডাজা ওর কাজিনকে ওই জায়গাটি দেখায় যেখানে সে অকস্মাৎ আবিষ্কার করে যে তার প্রেম একটা মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কিন্তু এতক্ষণ উপলব্ধি করে নি যে বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত তার প্রতিটি জায়গা, তার নিকট অতীতের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কর্তৃক মহিমান্বিত, মনে হয় ওটা ছাড়া তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। হিল্ডাব্রান্ডা এদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সে ব্যাপারটা স্বীকার করলো না, কারণ, ভালোর জন্য হোক কি মন্দের জন্য হোক, ফ্লোরেন্টিনো আরিজাই যে তার জীবনের একমাত্র ঘটনা ছিল তা সে কখনোই স্বীকার করতে রাজি হত না।

    এই সময় শহরে একজন বেলজীয় ফটোগ্রাফার এসে উপস্থিত হয়। সে তার স্টুডিও সাজিয়ে বসে কলমপেশাজীবীদের চত্বরের শেষ প্রান্তে, আর যাদের পয়সা আছে তারা এই সুযোগে নিজেদের ছবি তুলিয়ে নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে ফারমিনা ও হিল্ডাব্রান্ডা ছিল একেবারে প্রথম দলে। ওরা ফারমিনা সাঞ্চেজের কাপড়ের আলমারি খালি করে ফেললো, দুজনে ভাগ করে নিলো সব চাইতে সুন্দর পোশাক, ছাতা, টুপি, জুতা, আর নিজেদের সাজালো মধ্য-শতকের অভিজাত মহিলাদের মতো করে। গালা প্লাসিডিয়া ওদের সাহায্য করলো ওদের বক্ষবন্ধনীর ফিতা বাঁধতে, ফোলানো ঢোলা স্কার্টের নিচে তারের কাঠামোর নিচে কি ভাবে নড়তে চড়তে হবে তা সে ওদের শিখিয়ে দিল, কি ভাবে দস্তানা পরতে হবে আর উঁচু হিলের বুটের বোতাম কি ভাবে লাগাতে হবে তা দেখিয়ে দিল। হিল্ডাব্রান্ডা একটা চওড়া প্রান্তের উট পাখির পালক বসানো টুপি বেছে নিলো, পালকগুলি তার কাঁধের উপর ঝুলে পড়েছে। ফারমিনা বেছে নিলো একটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক মডেলের টুপি, তার গায়ে বসানো প্ল্যাস্টারের ফল আর পশমের ফুল। তারপর আয়নায় নিজেদের দেখে ওরা হেসে কুটিকুটি হল, তাদের দিদিমাদের পুরনো দিনের আলোকচিত্রের সঙ্গে নিজেদের সাদৃশ্য দেখলো তারা, তারপর উৎফুল্ল চিত্তে প্রাণখুলে হাসতে হাসতে নিজেদের ছবি তোলাবার জন্য তারা পথে নামলো। বারান্দা থেকে গালা প্লাসিডিয়া দেখলো খোলা ছাতা মাথায় ওরা পার্ক পেরিয়ে যাচ্ছে, উঁচু হিলের জুতা পরে একটু টলমল করছে, ফোলানো স্কার্টের নিচে নিজেদের শরীর ঠেলে দিচ্ছে, যেন বাচ্চাদের হাঁটাচ্ছে, আর ও তাদের আশীর্বাদ করলো, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো ওদের সুন্দর প্রতিকৃতির জন্য।

    স্টুডিওর সামনে ততক্ষণে বিরাট ভিড় জমে গেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পানামার বক্সিং প্রতিযোগিতায় বেনি সেন্টেনো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তার ছবি তোলা হচ্ছে। সেন তার বক্সিং-এর খাটো প্যান্ট পরে আছে, হাতে বক্সিং-এর দস্তানা, মাথায় মুকুট, ওই ছবি তোলা বেশ কষ্টকর, লড়াই করার ভঙ্গিটা পুরো এক মিনিট ধরে রাখতে হবে, বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়াও চলবে না, আর যখনই সে প্রতিপক্ষের আক্রমণ বাঁচাবার জন্য বিশেষ ভঙ্গিতে তার হাত একটু তুললো তখনই তার ভক্তরা উল্লাসে ফেটে পড়ে তাকে অভিনন্দন জানালো, আর সেও ওদের খুশি করার জন্য তার কলাকৌশল প্রদর্শনের লোভ সামলাতে পারলো না। ফারমিনা আর হিল্ডাব্রান্ডার পালা যখন এলো তখন আকাশে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি আসন্ন, তবু ওরা তাদের মুখে মণ্ডের মতো পাউডার মাখাতে দিল, তারপর শ্বেত পাথরের স্তম্ভের গায়ে আরাম করে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, আরাম পেয়ে প্রয়োজনের চাইতে বেশি সময় ওরা ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। একটা কালজয়ী চিত্র হয়েছিল ওটা। প্রায় একশো বছর বয়সে হিল্ডাব্রান্ডা যখন তার ফ্লোর ডি মারিয়ার খামার বাড়িতে মারা যায় তখন তার শোবার ঘরের তালা চাবি দেয়া আলমারিতে গন্ধ মাখানো চাদরের ভাঁজে ওরা এই ছবির একটা কপি পায়, সঙ্গের চিঠিতে একটা ভাবনার ফসিল ধৃত ছিল, ধূসর ও মলিন হয়ে গেছে। ফারমিনা ডাজা বহু বছর ধরে তার কপিটা তাদের পারিবারিক অ্যালবামের প্রথম পাতায় সেঁটে রেখেছিল, তারপর সেটা কখন এবং কিভাবে উধাও হয়ে যায় কেউ জানে না, কিন্তু অবিশ্বাস্য কয়েকটা ঘটনা চক্রের মাধ্যমে এক সময় সেটা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার হাতে গিয়ে পড়ে, তখন ওদের দুজনের বয়সই ষাট পেরিয়ে গেছে।

    স্টুডিও থেকে বেরিয়ে ফারমিনা আর হিল্ডাব্রান্ডা দেখলো যে সামনের খোলা চত্বর লোকে লোকারণ্য, বাড়ির বারান্দাগুলিতেও কোনো জায়গা খালি নেই। তারা ভুলে গিয়েছিল যে তাদের মুখে মাঢ় দেয় পাউডার মাখানো, ঠোঁটে চকোলেটের রঙ লাগানো, পরনের পোশাকের সঙ্গে আজকের দিন যা যুগের কোনো সম্পর্ক নেই। জনতা তাদের দেখে বিড়াল-ডাক ডাকলো, ঠাট্টা-বিদ্রূপে মেতে উঠলো। ওদের ঘৃণা-তাচ্ছিল্য থেকে পালাতে চাইলো তারা দুজন। জনতা তাদেরকে ঘিরে ফেললো, এমন সময় সোনালি রঙের অশ্বচালিত একটা জুড়িগাড়ি জনতার মধ্য দিয়ে পথ কেটে এগিয়ে এলো। বিড়াল- ডাক বন্ধ হল, আর প্রতিকূল জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। হিল্ডাব্রান্ডা দেখল এক ব্যক্তি গাড়ির পাদানিতে এক পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথায় সাটিনের টপ হ্যাট, জামায় ব্রোকেডের কাজ, অভিজ্ঞ হাবভাব, চোখে স্নিগ্ধ মাধুর্য, কর্তৃত্বব্যঞ্জক উপস্থিতি, লোকটিকে প্রথম দেখার এই স্মৃতি হিল্ডাব্রান্ডা কখনো ভোলে নি।

    আগে কখনো না দেখলেও সে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলে। গত মাসে ফারমিনা ডাজা আলতো ভাবে তাঁর উল্লেখ করেছিল, তাঁর সম্পর্ক কোনো উৎসাহ দেখায় নি ও। একদিন বিকালে ও মারক্যুই ডি কাসালডুয়েরোর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে চায় নি, ওই বাড়ির দোরগোড়ায় সোনালি অশ্বচালিত একটা জুড়ি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। গাড়িটির মালিক কে সেকথা ও তাকে বলেছিল, তাঁর প্রতি ওর বিরূপ মনোভাবের কারণ ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিনি যে ওর পাণিপ্রার্থী সে বিষয়ে একটি কথাও বলে নি। হিল্ডাব্রান্ডা তারপর তাঁর সম্পর্কে দ্বিতীয় বার চিন্তা করে নি, কিন্তু আজ তাঁকে জুড়ি গাড়িটির দরজার সামনে, পাদানিতে এক পা আর মাটিতে এক পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, সে তাঁকে চিনে ফেলে, আর তার মনে হল লোকটি যেন রূপকথার জগত থেকে উঠে এসেছে এবং তখন ফারমিনা ডাজার মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারলো না!

    ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো বললেন, ‘দয়া করে উঠে পড়ন, যেখানে যেতে চান আমি আপনাদের সেখানেই পৌঁছে দেবো।’

    ফারমিনা ডাজা প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছিল কিন্তু হিল্ডাব্রান্ডা তার আগেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করে ফেলে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো লাফ দিয়ে নিচে নেমে, তাঁর আঙ্গুলের অগ্রভাগ দিয়ে, প্রায় স্পর্শ না করে হিল্ডাব্রান্ডাকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলেন। উপয়ান্তর না দেখে ফারমিনা ডাজাও তার পেছন পেছন উঠে পড়লো, ভীষণ বিব্রত বোধ করলো সে, তার মুখ যেন পুড়ে যাচ্ছে।

    ওদের বাড়ি কাছেই, মাত্র তিন ব্লকের দূরত্ব। ওরা লক্ষ করে নি, কিন্তু ডাক্তার নিশ্চয়ই কোচোয়ানকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগেছিল। গাড়িতে হিল্ডাব্রান্ডা আর ফারমিনা বসলো প্রধান আসনে, আর ডাক্তার ওদের উল্টোদিকে, গাড়ির পেছন দিকে মুখ করে। ফারমিনা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে ফেললো, কিন্তু হিল্ডাব্রান্ডাকে খুব খুশি মনে হলো, আর তার খুশি ডাক্তারকে ততোধিক খুশি করে তুললো। গাড়ি চলতে শুরু করতেই হিল্ডাব্রান্ডা অনুভব করলো চামড়ার আসনের উষ্ণ গন্ধ, ভেতরের অন্তরঙ্গ নিভৃতি, আর সে বলে উঠল যে এই রকম চমৎকার জায়গায় স্বচ্ছন্দে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দেয়া যায়। একটু পরেই সে আর ডাক্তার হাসতে আরম্ভ করলো, একে অন্যকে কৌতুক কাহিনী শোনালো যেন তারা অনেক দিনের বন্ধু, তারপর তারা শুরু করলো বাকবৈদগ্ধ্যের প্রতিযোগিতা, একটা খাপছাড়া শব্দের পাশে আরেকটা খাপছাড়া শব্দ বসিয়ে শব্দের মজার খেলা খেলতে লাগলো। ওরা ভান করলো যেন ওরা কি করছে ফারমিনা তা বুঝতে পারছে না, যদিও ওরা দুজনেই জানতো ফারমিনা যে তাদের কথা শুধু বুঝতেই পারছে তাই নয়, সে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছেও, আর আসলে ওরা সেজন্যই ওটা করছিলো। অনেকক্ষণ হাসাহাসির পর হিল্ডাব্রান্ডা জানালো যে সে তার বুট জুতার নির্যাতন আর সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তার বললেন, ‘এর সমাধান অতি সহজ। দেখা যাক, কে আগে খুলতে পারে।’

    তিনি তাঁর নিজের জুতার ফিতা খুলতে আরম্ভ করলেন। হিল্ডাব্রান্ডার পক্ষে কাজটা সহজ হল না, কারণ শক্ত করে আটকানো বক্ষবন্ধনীর জন্য তার নিচু হতে অসুবিধা হচ্ছিল। ডাক্তার ইচ্ছা করে সময় নিলেন, অবশেষে হিল্ডাব্রান্ডা বিজয়ীর হাসি হেসে তার স্কার্টের তলা থেকে নিজের বুট জোড়া উঁচু করে তুলে ধরলো, যেন এই মাত্র পুকুর থেকে সে মাছ ধরলো। তারা উভয়ে ফারমিনার দিকে তাকালো, অস্তগামী সূর্যের রশ্মি তার সোনালি অরিওল পাখির মতো অপরূপ মুখের এক পাশে পড়ে তাকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। তিনটি কারণে ফারমিনা ডাজা ভীষণ রেগে গেছে : প্রথমত, একটা অবাঞ্ছিত অবস্থায় পড়েছে সে, দ্বিতীয়ত, হিল্ডাব্রান্ডা একটা ছিনালের মতো আচরণ করছে, তৃতীয়ত, সে নিশ্চিত যে গাড়িটা বৃত্তাকারে ঘুরছে তো ঘুরছেই যেন তাদের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়। কিন্তু ততক্ষণে হিল্ডাব্রান্ডা বল্গাহীন হয়ে উঠেছে। সে বলল, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি আমাকে যা কষ্ট দিচ্ছিল তা জুতা নয়, এই তারের খাঁচাটা।’

    ডাক্তার বুঝলেন যে ও তার ফোলানো স্কার্টের কথা বলছে। তিনি দ্রুত ধাবমান সুযোগটা খপ করে ধরে ফেললেন, ‘এর সমাধান অতি সহজ। খুলে ফেলুন।’ তারপর তিনি হাতের ভেল্কিবাজের মতো চোখের পলকে পকেট থেকে তাঁর রুমাল বার করে চোখ ঢাকা দিয়ে বললেন, ‘আমি তাকাবো না।’

    তাঁর কালো গোল করে ছাঁটা দাড়ি আর অগ্রভাগ মোম দিয়ে ছুঁচালো করা গোঁফ দিয়ে ঘেরা তাঁর ঠোঁটের নির্মল পবিত্রতা চোখ দুটি রুমাল দিয়ে আড়াল করার ফলে আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়লো। হিল্ডাব্রান্ডা ফারমিনার দিকে তাকালো, সে দেখলো যে এখন ও আর ক্ষিপ্ত নয়, বরং ভীত, কি জানি সে কি সত্যিই তার স্কার্ট খুলে ফেলবে? হিল্ডাব্রান্ডা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেল, ইশারায় জানতে চাইলো : ‘এখন আমরা কি করবো? ফারমিনাও ইশারার ভাষাতেই উত্তর দিলো, ওরা যদি এক্ষুনি সোজা বাড়ি ফিরে না যায় তাহলে সে চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ঝাঁপ দেবে।

    ডাক্তার বললেন, ‘আমি অপেক্ষা করে আছি।’

    হিল্ডাব্রান্ডা বলল, ‘এখন দেখতে পারেন।’

    ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যখন তাঁর চোখ বাঁধা রুমাল খুলে ফেললেন তখন দেখলেন যে হিল্ডাব্রান্ডা বদলে গেছে। তিনি বুঝলেন যে খেলা শেষ হয়েছে এবং খুব ভালো ভাবে তা শেষ হয় নি। তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে কোচোয়ান গাড়ি ঘুরিয়ে ইভানজেলস পার্কের মধ্যে ঢুকলো। বাতিওয়ালা রাস্তার আলোগুলি জ্বালতে শুরু করেছে। সবগুলি গির্জা থেকে সান্ধ্যকালীন উপাসনার ঘণ্টাধ্বনি বেজে চলেছে। হিল্ডাব্রান্ডা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। সে ঈষৎ উদ্বিগ্ন হল, সে কি ফারমিনার বিরক্তি উৎপাদন করেছে? অমনোযোগের সঙ্গে সে ডাক্তারের করমর্দন করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলো। ফারমিনাও তাই করলো, কিন্তু সে যখন তার সাটিনের দস্তানা পরা হাতটা টেনে নিতে চেষ্টা করল তখন ডাক্তার ওর আংটির আঙ্গুলে চাপ দিয়ে বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি।’

    ফারমিনা ওর হাতটা আরো জোরে টানলো, তখন দেখা গেল ডাক্তারের হাতে তার শূন্য দস্তানাটা ঝুলছে, ফারমিনা আর তা উদ্ধার করার জন্য অপেক্ষা করলো না। সে কিছু না খেয়ে সোজা বিছানায় শুতে চলে গেল। হিল্ডাব্রান্ডা রান্নাঘরে গালা প্লাসিডিয়ার সঙ্গে তার রাতের খাওয়া শেষ করে, যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব করে তাদের শোবার ঘরে এসে ঢুকলো, আর তারপর তার সহজাত বুদ্ধিদীপ্ত চটুলতার সঙ্গে বিকালের ঘটনাবলীর ওপর মন্তব্য করতে লাগলো। ডাক্তার উরবিনোর সুরুচি ও মাধুর্যের কথা, তাঁর সম্পর্কে ওর নিজের উচ্ছ্বাস, কিছুই সে গোপন করার চেষ্টা করলো না। ফারমিনা কিছু বললো না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে রেগে আগুন হল। এক পর্যায়ে হিল্ডাব্রান্ডা জানালো যে ডাক্তার উরবিনো যখন নিজের চোখ বেঁধে নিয়েছিলেন তখন তাঁর গোলাপি ঠোঁটের পেছনে তাঁর নিখুঁত দন্তপাতির ঔজ্জ্বল্য দেখে তার অদম্য ইচ্ছা হচ্ছিল তাঁকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে একেবারে গিলে ফেলতে। ফারমিনা ডাজা ঘুরে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুলো, তার মুখে কোনো অভিযোগের চিহ্ন নেই, বরং হাসি ছিল একটু, কিন্তু সে সর্বান্তকরণে এই আলাপের ইতি টানতে চাইলো। সে বললো, ‘তুমি না, একটা বেশ্যারও অধম!’

    রাতে ফারমিনার ভালো ঘুম হল না। সে সর্বত্র ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে দেখলো, তিনি হাসছেন, গান গাইছেন, রুমাল বাঁধা চোখের নিচে তাঁর দাঁতের মধ্য থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে, তিনি একটা শব্দের খেলা খেলছেন যার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই, সেই খেলার মধ্য দিয়ে তিনি ফারমিনাকে ঠাট্টা করছেন, তিনি ভিন্ন একটা গাড়ি করে নিঃস্বদের সমাধিক্ষেত্রে উঠে গেলেন। ভোর হবার অনেক আগে তার ঘুম ভাঙ্গলো, ক্লান্ত দেহমন নিয়ে সে শুয়ে থাকলো, চোখ বন্ধ, আরো কতো অগণিত বছর তাকে বাঁচতে হবে সে কথা ভাবলো সে। পরে, হিল্ডাব্রান্ডা যখন স্নান করছে, সে যথাসম্ভব দ্রুত একটা চিঠি লিখলো, যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সে চিঠিটা ভাঁজ করলো, সমান দ্রুততার সঙ্গে সেটা খামে পুরলো, তারপর হিল্ডাব্রান্ডা বাথরুম থেকে বেরুবার আগেই গালা প্লাসিডিয়ার হাত দিয়ে চিঠিটা ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর কাছে পাঠিয়ে দিল। তার সব চিঠির মতো এটাও ছিল তার নিজস্ব স্বকীয়তায় বিশিষ্ট, একটি শব্দ বেশি নেই, একটি শব্দ কম নেই, ওই চিঠিতে সে জানিয়ে দিল, হ্যাঁ, ডাক্তার তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

    ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন শুনলো যে ফারমিনা ডাজা একজন ডাক্তারকে বিয়ে করতে যাচ্ছে যিনি বিত্তবান, যার পারিবারিক ঐতিহ্য প্রাচীন ও গৌরবোজ্জ্বল, যিনি পড়াশোনা করেছেন ইউরোপে এবং বয়সের তুলনায় ইতিমধ্যে অসামান্য খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন, তখন তাকে তার হতাশার অতল গহ্বর থেকে তুলে আনবার মতো কোনো শক্তি এই পৃথিবীর কোথাও ছিল না। ট্রান্সিটো আরিজা তাঁর যথাসাধ্য করলেন, তার চাইতেও বেশি করলেন, একজন প্রেমিকা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য যেসব কৌশল প্রয়োগ করতে পারতো তার সবই প্রয়োগ করলেন, কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। ফ্লোরেন্টিনোর কথা বন্ধ হল, ক্ষুধা তিরোহিত হল, সারা রাত সে কাটাতে লাগলো না ঘুমিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে, কিন্তু সপ্তাহের শেষ নাগাদ সে আবার খাওয়া- দাওয়া শুরু করলো। তখন ট্রান্সিটো আরিজা তিন ভাই-এর মধ্যে বর্তমানে একমাত্র জীবিত ভাই ডন দ্বাদশ লিও লোয়াইজার কাছে একটা আবেদন নিয়ে গেলেন। ওঁকে কোনো কারণ না জানিয়ে, তাঁর ভাইপোকে তাঁদের নৌ-কোম্পানিতে যে কোনো একটা চাকরি দিতে বললেন, যে কোনো চাকরি, শুধু সেটা যেন হয় ম্যাগডালেনার দুর্গম অরণ্য অঞ্চলের একটা বন্দরে, যেখানে কোনো ডাক বা টেলিগ্রাম পৌঁছয় না, যেখানে এই অভিশপ্ত নগরীর কোন খবরই কেউ তাকে দিতে পারবে না। কাকা ফ্লোরেন্টিনোকে চাকরি দিলেন, তাঁর ভাই-এর বিধবা স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত নয়, তাঁর মনে হল ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর অবৈধ ছেলেকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি তাকে ভিলা ডি লেইভায় টেলিগ্রাফ অপারেটারের চাকরি দিলেন। ওটা ছিল এক নিদ্রাতুর শহর, এখান থেকে বিশ দিনের পথ, ‘জানালার সড়ক’ থেকে প্রায় তিন হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন তারবার্তার মাধ্যমে তার নিয়োগপত্র পেল তখন সে ওটাকে কোন বিবেচনার মধ্যেই আনলো না, কিন্তু লোটারিও থুগুট তাঁর জার্মানসুলভ যুক্তিতর্ক দিয়ে তাকে বুঝিয়ে দিল যে এর মাধ্যমে তার জন্য লোক- প্রশাসনে একটা উজ্জ্বল চাকরি জীবনের পথ খুলে যাবে। তিনি ওকে বললেন, “ভবিষ্যতের আসল পেশা হবে টেলিগ্রাফ, বুঝলে?” তিনি খরগোশের লোমের লাইনিং দেয়া এক জোড়া দস্তানা, একটা হ্যাট যা স্টেপ অঞ্চলে পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতো আর জমকালো কলার দেয়া একটা ওভারকোট, যা বেভেরিয়ার বরফশীতল শীতকালেও কাজে দিয়েছে তার হাতে তুলে দিলেন। লিওকাকা তাকে দুটো সার্জের স্যুট ও একজোড়া ওয়াটারপ্রুফ বুট দিলেন, এগুলি ছিল তাঁর বড় ভাই-এর জিনিস, তিনি তাকে পরের জাহাজে একটা ক্যাবিনের ব্যবস্থাও করে দিলেন। ফ্লোরেন্টিনো ছিল তার বাবার চাইতে কম মোটাসোটা, জার্মান থুগুটের মতো অত লম্বা নয়, তার মা ছেলের মাপে কাপড়গুলি ছোট করে দিলেন। ঊষর পাহাড়ি অঞ্চলের কঠোরতা প্রতিরোধের জন্য তিনি তাকে উলের মোজা আর লম্বা আন্ডারওয়্যার কিনে দিলেন। অসহনীয় দুঃখ কষ্টে কঠিন হয়ে যাওয়া ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার যাত্রার প্রস্তুতিতে এমন ভাবে অংশ নিলো যেন সে একটা মরা মানুষ, সে যেন নিজেই নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বন্দোবস্ত করছে। তার লৌহকঠিন ঔদাসীন্য নিয়ে মা ছাড়া আর কাউকে সে তার অবদমিত ভালোবাসার কথা বলে নি, এখনও ওই একই ঔদাসীন্য নিয়ে সে তার যাবার কথা কাউকে বললো না, কারো কাছ থেকে বিদায় নিলো না, কিন্তু চলে যাবার ঠিক প্রাক্কালে, সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, হৃদয়ের অপ্রতিরোধ্য তাড়নায় সে একটা শেষ চূড়ান্ত কাজ করলো যার ফলে তার মৃত্যুও হতে পারতো। সেদিন মাঝরাতে সে তার রবিবারের স্যুটটি পরে একা ফারমিনা ডাজার বারান্দার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো, সে তার স্বরচিত ওয়ালটজের প্রেম- রাগিনী বাজাবে, ফারমিনার জন্যই সে যা রচনা করেছিল, যার সুর শুধু তারা দুজনই জানে, যা গত তিন বছর ধরে তাদের ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সে বাজালো, তার বেহালাকে অশ্রুজলে সিক্ত করে, কথাগুলি সে অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, আর ছড়ের প্রথম টান থেকেই যে তীব্র ধ্বনি উত্থিত হল তার তাড়নায় সড়কের কুকুরগুলি, তারপর গোটা শহরের সব কুকুর উচ্চ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, কিন্তু তারপর, ধীরে ধীরে, ওই সুর-লহরীর জাদুময় প্রভাবে তারা শান্ত হয়ে গেল এবং একটা অপার্থিব নীরবতার মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বাদন থেমে গেল। বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়ালো না, সড়কেও কাউকে দেখা গেল না, এমনকি নৈশ প্রহরীকেও না, যে সেরেনাদ থেকে কিছু উপরি প্রাপ্তির জন্য সব সময় তার তেলের লণ্ঠন হাতে নিয়ে ছুটে আসতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার এ কাজটা ছিল প্রেতের তাড়না থেকে মুক্তি পাবার একটা উপায়। সে বেহালাটা তার বাক্সে ঢুকিয়ে, পেছন পানে একবারও না তাকিয়ে, প্রাণহীন রাস্তা ধরে হেঁটে চলে গেল, তার একবারও মনে হল না যে সে আগামীকাল ভোরে চলে যাচ্ছে, বরং তার মনে হল আর কোন দিন না প্রত্যাবর্তনের অলঙ্ঘনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বহু বছর আগে এখানে থেকে চলে গিয়েছিল।

    ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির হুবহু একরকম তিনটি জাহাজ ছিল, কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পায়াস ভি লোয়াইজার সম্মানে একটির নাম তাঁর নামে রাখা হয়। দোতলা কাঠের বাড়ির মতো একটা জাহাজ, প্রশস্ত মসৃণ লোহার কাঠামোর ওপর তৈরি, পাঁচ ফুট জল পেলেই যা নদীর বিভিন্ন গভীরতা দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম ছিল। এর আগের জাহাজগুলি নির্মিত হয়েছিল সিনসিনাটিতে, মধ্য-শতকে, ওহায়ো আর মিসিসিপের মধ্যে চলাচল করা জাহাজের কিংবদন্তির মডেলের অনুকরণে, যার দুদিকে ছিল দুটি বিশাল চাকা, যা ঘুরতো কাঠের অগ্নিচালিত বয়লারের শক্তিতে। ওই জাহাজগুলির মতোই ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির জাহাজগুলির ছিল একটা নিচের তলার ডেক, প্রায় জলের সমান স্তরে, সেখানেই ছিল ইঞ্জিন, জাহাজের রান্না ঘর, আর ঘুমাবার জায়গা, নাবিকরা ওখানেই নানা উচ্চতায় পাশাপাশি বা আড়াআড়ি করে তাদের দড়ির ঝুলন্ত বিছানা টানিয়ে রাখতো। উপরের ডেক-এ ছিল জাহাজের সেতু, কাপ্তান এবং অন্যান্য অফিসারদের ক্যাবিন, বিনোদন ও খাবার ঘর, যেখানে সপ্তাহে অন্তত একদিন বিশেষ সম্মানিত যাত্রীদের নৈশাহার ও তাস খেলার আমন্ত্রণ জানানো হত। মধ্যবর্তী ডেক-এ ছিল ছয়টি প্রথম শ্রেণীর ক্যাবিন, মাঝখানের পথের দু’পাশে অবস্থিত, ওই পথটাই সাধারণ খাবার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হত, আর জাহাজের সামনের দিকে ছিল বসবার জায়গা, নদীর দিকে মুখ করা, চারপাশে খোদাই করা কাঠের রেলিং আর লোহার স্তম্ভ, বেশির ভাগ যাত্রী রাতের বেলায় ওখানেই তাদের দোলনা ঝুলিয়ে শুতো। পুরনো দিনের জাহাজগুলির মতো এই জাহাজগুলির প্যাড- চাকা দুপাশে ছিল না, তার পরিবর্তে এসব জাহাজের একেবারে পেছন দিকে ছিল একটা বিশাল চাকা, তার প্যাডগুলি সমান্তরাল ভাবে বসানো, আর এই চাকার অবস্থান ছিল যাত্রীদের ডেক-এর টয়লেটগুলির ঠিক নিচে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জুলাই-র এক রবিবারে সকাল সাতটায় জাহাজে উঠেছিল। প্রথম বারের মত সফরকারীরা জাহাজে উঠেই সব কিছুর আগে গোটা জাহাজটা ঘুরে দেখতো, সহজাত একটা ঔৎসুক্যের বশে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার এটা করা হয় নি। কেবলমাত্র সন্ধ্যার দিকে সে তার নতুন পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়। জাহাজ তখন কালামার গ্রামের পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রস্রাব করার জন্য সে পেছনের দিকে যায়, আর তখনই সে টয়লেটের ফোকর দিয়ে তার পায়ের নিচে অতিকায় প্যাড়-চাকাটিকে সবেগে ঘুরতে দেখে, ভূমিকম্পের উদ্বিগরণের মতো সেটা চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছে অজস্র ফেনার পুঞ্জ আর বাষ্প।

    ও আগে কোথাও ভ্রমণ করে নি। তার সঙ্গে একটা টিনের তোরঙ্গে ছিল রুক্ষ নিষ্ফলা পাহাড়ি অঞ্চলের উপযোগী কাপড় জামা, পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত কয়েকটি সচিত্র উপন্যাস, যা সে প্রতি মাসে আলাদা আলাদা কিনে নিজের হাতে কার্ডবোর্ডের মলাট লাগিয়ে সেলাই করে নিয়েছিল, তার প্রেমের কবিতার বইগুলি, যেখানে থেকে সে স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতো, আর যার পাতাগুলি বারবার নাড়াচাড়া ও পড়ার ফলে প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। সে তার বেহালা নিয়ে আসে নি, নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সে ওটাকে বড় বেশি একাত্ম করে ফেলেছিলো। কিন্তু তার মা প্রায় জোর করে তার সঙ্গে একটা খুব জনপ্রিয় ও খুব কাজের একটা হোল্ড-অল দিয়ে দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল বালিশ, চাদর, একটা ছোট দস্তার চ্যাম্বারপট আর মশারি, সব কিছুই শোলার মাদুরে পাটের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, যে-দড়ির সাহায্যে জরুরি প্রয়োজনের সময় সে দোলনা টানিয়ে নিতে পারবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এসব নিতে চায় নি, ক্যাবিনেই তো খাট, বিছানার চাদর ইত্যাদি থাকবে, কিন্তু প্রথম রাত থেকেই মায়ের বিবেচনা-বোধের জন্য সে আরেক বার তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার কারণ দেখতে পেয়েছিল। জাহাজ ছাড়ার শেষ মুহূর্ত নৈশকালীন আনুষ্ঠানিক কাপড় জামা পরা এক যাত্রী জাহাজ এসে উঠলেন। তিনি সেদিন খুব ভোরেই এখানে এসেছিলেন, ইউরোপ থেকে আসা একটা জাহাজে, তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক গভর্নর স্বয়ং। তিনি অবিলম্বে তাঁর ভ্রমণ যাত্রা অব্যাহত রাখতে চান। তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর স্ত্রী ও কন্যা, উর্দিপরা ভৃত্য, সোনার ফিটিংসহ সাতটা বড় বড় তোরঙ্গ, এতো বড় এবং ভারি যে সিঁড়ি দিয়ে সেগুলি উপরে ওঠাতে বেশ কষ্ট হয়। এই আকস্মিক অপ্রত্যাশিত যাত্রীদের জায়গা করে দেয়ার জন্য জাহাজের কাপ্তান, কুরাসাও-এর এক বিশালদেহী পুরুষ, অন্যান্য যাত্রীদের একান্ত দেশাত্মবোধের কাছে আবেদন জানালেন। তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বললেন যে ওই ভদ্রলোক ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন, এখানকার পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত শাসনকর্তার দায়িত্বভার নিয়ে, এখন যাচ্ছেন প্রজাতন্ত্রের রাজধানীতে। কাপ্তান ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে স্পেনীয় শাসন থেকে তাদের মুক্তি সংগ্রামে ওই দেশ যে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা দান করেছিল সেকথা মনে করে দিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম একটি বিশিষ্ট পরিবারের জন্য কোন ত্যাগ স্বীকারই বেশি হতে পারে না, আমাদের সবারই উচিত তাঁরা স্বদেশে যেমন আরাম ও স্বস্তিতে থাকেন এখানেও তা নিশ্চিত করা। বলাবাহুল্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁদের জন্য তার নিজের ক্যাবিন ছেড়ে দেয়।

    প্রথমে এজন্য তার কোনো দুঃখ হয় নি। বছরের ওই সময়ে নদী ছিল ভরাট, প্রথম দুরাত্রি কোনো রকম কষ্ট ছাড়াই জাহাজ এগিয়ে যেতে থাকে। পাঁচটার সময়, রাতের আহার পর্বের শেষে, খালাসিরা যাত্রীদের মধ্যে ভাঁজ করা ক্যানভাসের খাট বিতরণ করতো, প্রত্যেক যাত্রী তখন যেখানে জায়গা পেত সেখানেই খাট পেতে নিজের বালিশ চাদর বের করে মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়তো। যাদের কাছে দোলনা-শয্যা ছিল তারা সেলুনে তা টানিয়ে নিতো, আর যাদের কিছুই ছিল না তারা খাবার ঘরে টেবিলের উপর টেবিলক্লথ গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়তো, যে টেবিল ক্লথগুলি গোটা ভ্রমণ যাত্রার সময়ে দুবারের বেশি ধোয়া হয় নি। রাতের বেশির ভাগ সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জেগে কাটিয়ে দিতো, তার মনে হত সে নদীর নির্মল বাতাসে ফারমিনা ডাজার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে, ওর স্মৃতি তার একাকিত্বের যন্ত্রণাকে লাঘব করছে, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে একটা অতিকায় জন্তুর মতো এগিয়ে চলা জাহাজের শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে সে শুনতে পেত ফারমিনা ডাজার গান, তারপর এক সময় দিগন্তের বুকে প্রভাত সূর্যের রক্তিমাভা ফুটে উঠতো, আর যেন হঠাৎ করেই নির্জন চারণভূমি আর কুয়াশাঘেরা জলা অঞ্চলে একটা নতুন দিন জেগে উঠতো। আর তখন সে তার মায়ের প্রজ্ঞার আরেকটা প্রমাণ পেল, সে অনুভব করলো যে ভুলে যাবার যন্ত্রণা সইবার মতো ধৈর্য ও শক্তি তার আছে।

    কিন্তু তিন দিন অনুকূল জলরাশির পর জাহাজ চলাচল একটু কঠিন হল, বিভিন্ন জায়গায় বালুচর ও প্রতারণমূলক প্রচণ্ড স্রোতের মুখোমুখি হল তাদের জাহাজ। নদী কর্দমাক্ত হল, ক্রমান্বয়ে সরু হতে লাগল, দু’পাশে দেখা গেল জটলা পাকানো বিশাল আকারের গাছের জঙ্গল, মাঝে মাঝে চোখে পড়লো জাহাজের বয়লারের জন্য স্তূপীকৃত কাঠের পাশে একটা খড়ের চালাঘর। টিয়া পাখির চিঁ চিঁ শব্দ আর অদৃশ্য বানরকুলের চিৎকার যেন মধ্যদিনের গরম আরো তীব্র করে তুলতো। রাত্রে জাহাজ নোঙর করে রাখতে হত, ঘুমিয়ে নেবার জন্য, তখন বেঁচে থাকার মতো এই অতি সাধারণ ঘটনাও মনে হতো অসহ্য। তখন গরম আর মশার উৎপাতের সঙ্গে যুক্ত হত জাহাজের রেলিং- এ শুকোবার জন্য ঝুলিয়ে দেয়া লবণ মাখানো মাংসের চিলতার উৎকট গন্ধ। বেশির ভাগ যাত্রী, বিশেষ করে ইউরোপীয়রা, তাদের ক্যাবিনের গুমোট ও দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পাবার জন্য ডেকের উপর পায়চারি করে রাত কাটিয়ে দিতো, যে তোয়ালে দিয়ে তাদের অনিঃশেষ ঘাম মুছতো সেই তোয়ালে দিয়েই ডাকু পোকামাকড়গুলি নিজেদের গা থেকে ঝেড়ে ফেলতো। সকালে তাদের দেখা যেতো ক্লান্ত-অবসন্ন, পোকার কামড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে গেছে।

    তার ওপর আরেকটা বিপদ দেখা দিল। এদেশে থেকে থেকে উদারপন্থী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে যে গৃহ- যুদ্ধ বাধতো সম্প্রতি নতুন করে ওই রকম একটা গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কাপ্তান যাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য কঠোর প্রাক-সতর্কতা অবলম্বন করলেন। তখনকার দিনে নদীপথে ভ্রমণকারীদের একটা প্রিয় বিনোদন ছিল নদীর প্রশস্ত বালুতীরে রোদ পোহানো কুমীরগুলিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া। কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি কিংবা উত্তেজনা এড়াবার জন্য কাপ্তান ওই বিনোদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। পরবর্তী এক সময়ে একটা বিতর্ককে উপলক্ষ করে যাত্রীরা যখন পরস্পরবিরোধী দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায় তখন তিনি সবার অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেন, প্রতিশ্রুতি দেন যে সফর শেষে তিনি প্রত্যেককে তাদের অস্ত্র ফেরত দেবেন। তারা যাত্রা শুরু করবার পরদিন সকালে জাহাজ আরোহণ করেছিলেন একজন ব্রিটিশ মন্ত্রী, শিকারের সাজসরঞ্জাম নিয়ে, একটা ছোট রাইফেল ও বাঘ শিকারের জন্য একটা দোনলা শক্তিশালী রাইফেল সঙ্গে নিয়ে। কাপ্তান তাঁকেও রেহাই দেন নি। এর পর আরেকটি ঘটনায় বাধা-নিষেধ কঠোরতর হল। টেনেরিফ বন্দরের কাছে প্লেগের হলুদ পতাকা উড়িয়ে তাদের পাশ দিয়ে একটা জাহাজকে চলে যেতে দেখলো ওরা। কাপ্তান ওই ভীতিপ্রদ সঙ্কেত সম্পর্কে আর কোনো তথ্য জানতে পারলেন না, কারণ ওরা তাঁর সিগনালের কোনো উত্তর দেয় নি। কিন্তু ওই দিনই আরেকটা জাহাজের সঙ্গে ওদের দেখা হল। সেটা গরু-বাছুর বোঝাই হয়ে জ্যামেইকা যাচ্ছিল। ওরা জানালো যে প্লেগ-পতাকাবাহী জাহাজটি দুজন কলেরার রোগীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নদীপথে এখনো তাদের যে- জায়গা অতিক্রম করতে হবে সেখানে কলেরা মহামারীর রূপ নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করে চলেছে। এবার যাত্রীদের জাহাজ থেকে অবতরণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গেল, শুধু বন্দরে নয়, লোকালয়হীন যে সব জায়গায় কাঠ নেবার জন্য জাহাজ থামে সেখানেও। ফলে, আরো ছয় দিন পর শেষ বন্দরে পৌঁছবার পূর্ব পর্যন্ত সময়ে যাত্রীদের মধ্যে কয়েদিদের অভ্যাস পরিব্যাপ্ত হল। তাদের হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো যৌন আবেদনময় অশ্লীল ডাচ পোস্ট কার্ডের প্যাকেট, কোথা থেকে এগুলি এলো কেউ বলতে পারে না, তবে নদীবক্ষের প্রবীণ অভিজ্ঞ সফরকারীরা বললেন যে কাপ্তানের সুবিখ্যাত সংগ্রহের এটা ছিল অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনন্দ বিধানের পরিবর্তে এটাও শুধু তাদের ক্লান্তি ও অবসাদ বাড়িয়ে তুললো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিধিবদ্ধ ইসলামী আইন – গাজী শামছুর রহমান
    Next Article নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    Related Articles

    গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    নিঃসঙ্গতার একশ বছর – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

    August 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.