Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রৌঢ়ের বউ

    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প12 Mins Read0

    প্রৌঢ়ের বউ

    রসিকের প্রৌঢ়ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই মৃত্যুভয়। মরণের অবিরাম গুঞ্জন, আমি আসিতেছি, আমি আসিতেছি, শুনিয়াও না শুনিবার সতেজ ঔদ্ধত্য ঝিমাইয়া পড়ায় এই বয়সে মানুষের প্রথম খেয়াল হয়, দূর হইতে মরণ আশ্বাস দিয়া বলিতেছে, এখনো সময় হয় নাই, একটু অপেক্ষা কর। মরণের স্বাদ পাইতে পাইতে বৃদ্ধ ভাবে, দেরি আছে, এখনো দেরি আছে : জীবন বিস্বাদ হওয়ায় প্রৌঢ় ভাবে, হায়, দিন যে আমার ফুরাইয়া আসিল।

    তাই, রসিক ভাবিত, দু দিনের জন্য কচি একটা মেয়েকে বউ করিয়া বাড়িতে আনা উচিত হইবে না। কেবল তাই নয়, ছেলেমানুষ বউ নিজে কত ছেলেমানুষি করিবে আর তার কাছে কত ছেলেমানুষি আশা করিবে ভাবিলেও রসিকের বড় অস্বস্তি বোধ হইত। আর কি তার সে বয়স আছে? প্রতিদান দেওয়া দূরে থাক, অল্পবয়সী বউয়ের অন্তহীন ন্যাকামি হাসিমুখে সহ্য করিয়া চলাও কি তার পক্ষে সম্ভব হইবে? যে চলিয়া গিয়াছে সে ছিল জননী ও গৃহিণী, আসিবে একটি চঞ্চলা বালিকা। তার সঙ্গে কি বনিবে রসিকের?

    প্রয়োজন ছিল না, ইচ্ছা ছিল না, তবু একদিন রসিকের বিবাহ হইয়া গেল।

    একদিন অসময়ে তাকে অন্দরে ডাকিয়া সুলোচনা বলিল, এই মেয়েটিকে দ্যাখো তো ঠাকুরপো। ওর নাম সুধারানী।

    রসিক থতমত খাইয়া বলিল, তাই নাকি? তা, বেশ তো।

    কচি খুকি নয়, বেশ বড়সড়ো মেয়েটি। মুখখানা গম্ভীর। মেঝেতে জাঁকিয়া বসিবার ভঙ্গিতে কেমন একটু গিনি গিন্নি ভাব আছে। রসিক তো জানিত না সুলোচনাই সুধারানীকে চওড়া কালোপাড় শাড়িখানি পরাইয়াছে, কানের দুল খুলিয়া ফেলিয়া বালা আর অনন্ত পরাইয়াছে, চুলের জটিল বিন্যাস নষ্ট করিয়া মাঝখানে সিঁথি কাটিয়া পিছন দিকে টানিয়া বাঁধিয়া দিয়াছে আর ধমক দিয়া বলিয়াছে : মুখ হাঁড়ি করে বসে থাকো বাছা, একটু যদি লজ্জা করবে আমার দেওরকে দেখে, একটু যদি চঞ্চল হবে…,। সুধারানীকে রসিকের তাই মন্দ লাগিল না।

    তারপর সুলোচনার কাছেই শোনা গেল, মেয়েটার নাকি বয়স হইয়াছে অনেক। গরিব বাপ নাকি বিবাহ দিতে পারে না, কুড়ি পার হইয়া মেয়ে তাই হইয়া গিয়াছে বুড়ি। সময়মতো বিবাহ হলে অ্যাদ্দিনে তিন ছেলের মা হত, ঠাকুরপো।

    বিবাহ করার জন্য এতদিন সকলের অনুরোধ উপরোধ যথারীতি চলিতেছিল, সুলোচনার ব্যবস্থাতেই বোধ হয় এবার সেটা দাঁড়াইয়া গেল রীতিমতো আক্রমণে। রসিক হার মানিয়া বলিল, তবে তাই হোক

    সুধারানীকে দেখার জন্য হার মানার ইচ্ছা তার কতটুকু জাগিয়াছিল বলা কঠিন।

    .

    এমনই কপাল সুধারানীর, প্রথমবারের আলাপে প্রথম শব্দটিকেই সে রসিকের মন বিগড়াইয়া দিল। রসিকের মনে অনুতাপ, আত্মসমর্থন, দ্বিধা সংকোচ ঔৎসুক্যের আলোড়ন চলিতেছিল, কখনো জাগিতেছিল বিষাদ, কখনো প্রত্যাশার আনন্দ। নিজেকে নিয়াই সে বড় ব্যস্ত হইয়াছিল।

    একদিন রাত প্রায় এগারটার সময় বাহিরের ঘরে কাজ করার নামে সে আকাশপাতাল ভাবিতেছে, ধীরে ধীরে সুলোচনা ঘরে আসিয়া বলিল, ঠাকুরপো, একটিও নাকি কথা কও নি বউয়ের সঙ্গে? একটা দুটো পর্যন্ত নাকি কাজ কর এখেনে? ছি ঠাকুরপো, ছি, এমন করে কি কষ্ট দিতে আছে ছেলেমানুষের মনে? ঘরে লুকিয়ে চুপিচুপি আজ কাঁদছিল।

    ভালো উদ্দেশ্যেই সুলোচনা বানানো কথাটা বলিয়াছিল, কিন্তু ফলটা হইল বিপরীত। রসিক ভাবিল, ছেলেমানুষ? কাঁদিতেছিল? কী সর্বনাশ! এতটুকু যার ধৈর্য নাই তার কাছে তবে আর কী আশা করা চলিবে?

    তবু বিবাহ যখন করিয়াছে, মেয়েটির মনে কষ্ট না দেওয়াই কর্তব্য বিবেচনা করিয়া রসিক আজ প্রথম রাত একটার আগে, সুধারানীকে ঘুমে অচেতন হইয়া পড়িবার সুযোগ না দিয়াই ঘরে গেল। ভাবিল, সুধারানীকে বুঝাইয়া দিবে, এসব অবহেলা নয়, আদরযত্ন স্নেহমমতার অভাব তার হইবে না। তবে রসিক বুড়া হইয়া পড়িয়াছে কিনা, মানাইয়া চলিতে হইলে সুধারানীর একটু ধীর স্থির শান্ত না হইলে চলিবে কেন?

    খাটের একপ্রান্তে পা ঝুলাইয়া সুধারানী বসিয়াছিল, আস্তে আস্তে দুলাইতেছিল দুটি পা। হয়তো আনমনে, নয়তো অভ্যাসের বশে। একে তো তাকে দেখিলেই মনে হয় কার যেন সে প্রতীক্ষা করিতেছে, তার উপর ঠিক তার বড় মেয়েটির মতো দু পাশে হাত রাখিয়া বসিয়া পা দুলাইতে দেখিয়া রসিক হতাশ হইয়া গেল। হয়তো সুলোচনা জানাইয়া দিয়া গিয়াছে এখনই স্বামী ঘরে আসিবে, কিন্তু এমন বেশে প্রেমিকের পথ চাওয়া এমন অধীর প্রতীক্ষা কেন? হরিণীর মতো চঞ্চলা যে দশ বছরের মেয়ে, তার অনুকরণে পা দোলানো কেন?

    রসিককে দেখিয়া সুধারানী একটু জড়সড় হইয়া বসিল সামান্য একটু। বেশি লজ্জা করিতে সুলোচনা বারণ করিয়া দিয়াছে। রসিক গম্ভীর মুখে হাত দুই তফাতে বসিল, সভায় আসন গ্রহণ করার মতো আড়ম্বরের সঙ্গে।

    কী বলিয়া কথা আরম্ভ করা যায়? এত জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা রসিকের, এত ধীর স্থির শান্ত তার প্রকৃতি, একটি তরুণীর সঙ্গে কথা আরম্ভ করিতে গিয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম কি দেখা দিল রসিকের কপালে? হায় রে কপাল, সতের বছর আগে বিবাহের রাত্রেই প্রমীলার সঙ্গে কথা বলিতে গিয়া তার তো কথা খুঁজিতে হয় নাই, ঘর খালি হওয়া মাত্র চাপা গলায় মহাকাব্যের ছন্দে আদরের সুরে আপনা হইতেই যেন উচ্চারিত হইয়াছিল, কেমন লাগছে? এখন থেকে তুমি আমার হয়ে গেলে।

    অনিশ্চয়তায় বিপন্ন মানুষের মতো চিবুকে আঙুল ঘষিতে ঘষিতে শেষে রসিক বলিল, তোমায় ক’টা কথা বলব সুধা

    সুধা কিছুই বলিল না।

    আমার বয়েস হয়েছে, তোমার হয়তো আমাকে ঠিক পছন্দ হয় নি

    শুনিয়া চেষ্টা করা গম্ভীর মুখে কী দুষ্টামিভরা হাসিই যে দেখা দিল সুধারানীর; কানের দুলে আলোর ঝলক তুলিয়া মাথা নিচু করার পলকটির মধ্যে মানুষকে মর্মাহত করা কী তীক্ষ্ণ চকিত দৃষ্টিতেই একবার সে চাহিয়া নিল রসিকের চোখের দিকে। অস্ফুটস্বরে সে বলিল, ধেৎ।

    রসিক নীরবে তার কাজের ঘরে চলিয়া গেল, যখন মনে হইল এতক্ষণ সুধার পক্ষে জাগিয়া থাকা অসম্ভব, তখনো ফিরিয়া গেল না। কাজের ঘরেই শুইয়া রহিল। প্রমীলার আমলেও এ ঘরে তার জন্য একটি বিছানা প্রস্তুত থাকিত, যদিও তখন এ বিছানায় সে ঘুমাইত কদাচিৎ।

    এ ঘরে রাত কাটানোর ব্যবস্থা অবশ্য স্থায়ী করা গেল না, লোকে বলিবে কী? কাজের নামে এখানে অনেক রাত পর্যন্ত কাটানো চলে, বিশেষ কাজের নামে মাঝে মাঝে দু-একটা রাত কাবার করাও চলে, কিন্তু ফাজিল একটা মেয়ে বউ হইয়া অন্দরে প্রমীলার শয়ন ঘরটি দখল করিয়াছে বলিয়াই সে ঘরটিকে তো জীবন হইতে একেবারে ছাঁটিয়া ফেলা যায় না। প্রৌঢ় রসিকের পক্ষে ওরকম ছেলেমানুষি করা অসম্ভব।

    ফাজিল বউটাকেও একেবারে বাদ দিয়া দিন কাটানো যায় না। বিশেষত সুলোচনা যখন আছে এবং কোমর বাঁধিয়া রসিকের পিছনে লাগিয়াছে। নানা ছুতায় সুলোচনা সুধারানীকে রসিকের কাছে পাঠায়, এমন অবস্থাই সৃষ্টি করে যে রসিকের দৈনন্দিন জীবনের অনেকগুলি খুঁটিনাটি প্রয়োজন সুধারানীকে ছাড়া মিটিবার কোনো উপায় থাকে না। তার ফলে সুধারানীর অস্তিত্ব রসিকের কাছে খানিকটা অভ্যস্ত হইয়া যায়, টুকরা টুকরা সান্নিধ্যে বাহিরের একটা সহজ সম্পর্ক তাদের মধ্যে গড়িয়া ওঠে, ছোটবড় অনেক উপলক্ষে প্রশ্ন আর জবাবের ধাঁচের আলাপ আলোচনাও চলে, কিন্তু আর কিছুই হয় না। মধ্যস্থের চেষ্টায় কবে কোন স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল ঘটিয়াছিল, চাঁদের আলো, ফুলের গন্ধ, ফাল্গুনের হাওয়া, রাতজাগা বাজেকথার কাব্য, এইসব চিরকালের মধ্যস্থ ছাড়া?

    সুলোচনা বলে, ব্যাপার কী বল তো ঠাকুরপো? সুধাকে তোমার পছন্দ হয় নি?

    রসিক বলে, বুড়ো বয়সে আবার পছন্দ অপছন্দ।

    তবু ব্যাপারটা কী শুনি না? না হয় বললেই আমায়?

    সুধা বড় ফাজিল বউঠান। ফাজিল মেয়ের সঙ্গে ইয়ার্কি দেবার বয়স কি আমার আছে, আজ বাদে কাল চোখ বুজব আমি?

    সুলোচনা এবার রাগ করিয়া বলে, ফাজিল! সুধা ফাজিল! একটা সাত ছেলের মা বুড়িকে এনে দিলে তুমি সুখী হতে, না? সাত ছেলের মাও কিন্তু একটু আধটু ফাজলামি করে ঠাকুরপো, আর দশটা মানুষের মতো। তোমার মতো গণেশ ঠাকুর সবাই নয়।

    সুলোচনার রাগ দেখিয়া রসিকের মনের অশান্তি বাড়িয়া যায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছা তো করে তার সুধারানীকে বউয়ের মতো আদর করিতে, কিন্তু অনেক দিন আগে প্রমীলার সঙ্গে যে ছেলেমানুষি খেলার আবছা স্মৃতিটুকু শুধু মনে আছে, আজ সে খেলার পুনরভিনয় আরম্ভ করার কথা ভাবিলেই তার যে ভয় হয়, বিতৃষ্ণা জাগে। মনে হয়, দূরে বসিয়া থাকিলে যার মুখখানি বিষণ্ন হইয়া থাকে, গম্ভীরভাবে তাদের সম্পর্কের গভীর সমস্যার কথা তুলিলে যে দুষ্টামির হাসি হাসে, কাছে গিয়া বসিলেই যার লজ্জা সংকোচ ভীরুতার অসহ্য ন্যাকামি দেখা দেয়, অপটু একটু সেবাযত্নের চেয়ে সর্বাঙ্গের লাবণ্য, মুখের কথা আর চোখের চাহনি দিয়া যে দিবারাত্রি মন ভুলানোর চেষ্টা করে, তাকে আপন করিতে গেলে সং সাজিতে হইবে, অভিনয় করিতে হইবে হাস্যকর। অন্য কিছুতে সুধারানীর মন উঠিবে না, আর কোনো খেলা সে বুঝিবে না। প্রমীলার সঙ্গে যে খেলা তার চলিত শেষের দিকে, তার গাম্ভীর্য গভীরতা আর মাধুর্যের খবর তো সুধারানী জানে না। সাংসারিক সমস্যার আলোচনা যে চটুল প্রেমের কাকলির চেয়ে প্রীতিকর হইতে পারে, বুঝাইয়া বলিতে গেলে সুধারানী মুচকি মুচকি হাসে। প্রমীলার প্রথম বয়সের সেই গা-জ্বালানো হাসি, চুম্বন ছাড়া আর কিছু দিয়াই সে হাসি মুছিয়া নেওয়া যাইত না।

    সুলোচনা যতই চেষ্টা করুক, রসিক তাই মনের বিরাগ জয় করিয়া কোনোমতেই নতুন বউকে কাছে টানিতে পারে না এবং এমনিভাবে দিন কাটিতে থাকে। সুধারানীর মুখের বিস্ময় ও বিষাদের ভাব ঢাকিয়া ক্ৰমে ক্ৰমে এক দুর্বোধ্য অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতে থাকে।

    .

    কাজের ঘরে প্রতিদিন রাত্রি একটা পর্যন্ত জাগিয়া থাকিতে প্রথম প্রথম রসিকের কষ্ট হইত, মাঝে মাঝে বিছানায় শুইয়া কাজ করিতে গিয়া কখন ঘুমাইয়া পড়িত খেয়ালও থাকিত না। তারপর কীভাবে তার সে স্বাভাবিক ঘুমের ঘোর কাটিয়া গিয়াছে, এখন আর ঘুম আসে না, ঘুমাইতে চাহিলেও নয়। জাগিয়া থাকার জন্য তাকে আর কোনো চেষ্টাই করিতে হয় না। একসময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়, বাড়ি আর পাড়াটা ধীরে ধীরে নিঝুম হইয়া আসে, এই ঘরে শুধু জাগিয়া থাকে রসিক একা। মাথার মধ্যে মৃদু যন্ত্রণা বোধ হয়, দু চোখ জ্বালা করিতে থাকে কিন্তু ঘুম আসে না। সমস্ত জগৎ চারদিকে ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়িতেছে অনুভব করিতে করিতে নিজের চিন্তা আর কল্পনার জগৎ যেন স্পষ্ট আর উজ্জ্বল হইয়া উঠিতে থাকে।

    প্রমীলার জন্য তখন রসিকের বড় কষ্ট হয়, অবুঝ শিশুর মতো তার মন ফিরিয়া চায় প্রমীলাকে। সমস্ত জগতের বিরুদ্ধে একটা যুক্তিহীন ক্রুদ্ধ অভিযোগ জাগিয়া ওঠার সঙ্গে তার মনে হয়, প্রমীলা থাকিলে এত রাত পর্যন্ত জাগিতে দিত না, জোর করিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিত, শুধু কপালে হাত বুলাইয়া ঘুম আনিয়া দিত তার চোখে।

    অন্দরের ঘরে গিয়া সুধারানীকে ঘুমাইয়া থাকিতে দেখিয়া রসিকের সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরিয়া যায়। ইচ্ছা হয়, লাথি মারিয়া ঘুম ভাঙাইয়া তাকে ঘরের বাহির করিয়া দেয়। স্বামীর আগে যে ঘুমাইয়া পড়ে, স্বামীকে যে ঘুম পাড়াইতে জানে না, সে কি মেয়েমানুষ, সে কি বউ?

    .

    সেদিন রাত্রি সবে দশটা বাজিয়াছে। পাড়ার একজন গল্প করিতে আসিয়াছিল। হাতের আড়ালে তাকে হাই তুলিতে দেখিয়া রসিক আশ্চর্য হইয়া বলিল, শরীর খারাপ নাকি হে?

    না, দুপুরে ঘুমোই নি, ঘুম পাচ্ছে।

    একটু পরে আরেকবার হাই তুলিয়া সে চলিয়া গেল। রসিক ভাবিল, কোনো ছুতায় মানুষটাকে অনেক রাত পর্যন্ত আটকাইয়া রাখিতে পারিলে ঘুমের সঙ্গে তার লড়াইটা দেখা যাইত। মাঝরাত্রে নিদ্রাহীন চোখে তার জাগিয়া থাকার কসরত দেখিয়া একটু কি আমোদ পাওয়া যাইত না? তা ছাড়া, ঘুম হয়তো সংক্রামক। চোখের সামনে ঘুমে একজনের দেহ অবশ আর চেতনা আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে দেখিয়া তার চোখেও হয়তো একটু আবেশ আসিত ঘুমের

    না, তা আসিত না। সুধারানীকে ঘুমে অচেতন হইয়া পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াও কি একদিন তার ঘুম আসিয়াছে?

    কাজে আর মন বসিল না, উৎসাহ নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চেয়ারটা একটু পিছনে ঠেলিয়া দিয়া হেলান দিয়া বসিয়া টেবিলে পা তুলিয়া দিল। ঠিক সামনেই দেয়ালের গায়ে বড় একটি ফটো টাঙানো, দামি ফ্রেমের মধ্যে সাধারণ ঘরোয়া সাজে প্রমীলা দাঁড়াইয়া আছে, মুখে দুষ্টামিভরা তৃপ্তির হাসি। ফটোখানা ছাড়া এদিকের দেয়ালটি একেবারে ফাঁকা, এখানে ওখানে কতকগুলি পেরেকের দাগ শুধু আছে। বুঝা যায়, আরো দু-চার খানা ফটো বা ছবি এ দেয়ালে টাঙানো ছিল, সরাইয়া ফেলা হইয়াছে।

    গড়গড়ার নল মুখে দিয়া টানিতে গিয়া রসিকের খেয়াল হইল, প্রমীলার ফটো ঘিরিয়া একটা নূতনত্বের আবির্ভাব ঘটিয়াছে, কালও যার অস্তিত্ব ছিল না— টাটকা ফুলের একটি মালা। তাই বটে, সন্ধ্যার পর ঘরে ঢুকিয়া মৃদু একটু ফুলের গন্ধ সে পাইয়াছিল।

    তারপর তামাকের ধোঁয়ায় কখন সে গন্ধ চাপা পড়িয়া গিয়াছে, ফ্যানের বাতাসে কোথায় উড়িয়া গিয়াছে, খেয়ালও থাকে নাই।

    কিন্তু প্রমীলার ফটোতে হঠাৎ টাটকা ফুলের মালা জড়াইল কে? এ বুদ্ধি জাগিল কার? প্রথম কয়েক মাস সে নিজেই বিকালে বেড়াইয়া ফিরিবার সময় মোড়ের দোকান হইতে মালা কিনিয়া আনিয়া ফটোতে পরাইয়া দিত, একদিন বাসি মালাটি খুলিয়া নতুন মালা পরাইয়া দিবার সময় হঠাৎ তার মনে হইয়াছিল, ফুলের মালা ঘুষ দিয়া স্মৃতির মর্যাদা বজায় রাখিতে চেষ্টা করার মতো ছেলেমানুষি আর হয় না। এ কথা কেন মনে হইয়াছিল কে জানে, সেদিন হইতে আর সে মালা কেনে নাই। এতদিন পরে আবার ফুলের মালা দিয়া প্রমীলার স্মৃতিকে পূজা করিল কে?

    অন্দরের দরজা একটু ফাঁক করিয়া বাড়ির চাকর নিখিল ঘরের মধ্যে একবার উঁকি দিয়া চলিয়া গেল। রোজ এই সময় এমনিভাবে সে একবার উঁকি দিয়ে যায়। দু-চার মিনেটের মধ্যে সুধারানী সন্তর্পণে ঘরে ঢুকিয়া টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়ায়, মৃদুস্বরে অনুরোধ জানায়, খেতে চলো। আজো সে আসিল, রসিকের টেবিলে তোলা পায়ের কাছেই টেবিলে হাত রাখিয়া সহজভাবে মুখের দিকে চাহিবার চেষ্টায় চিবুক পর্যন্ত চোখ তুলিয়া বলিল, খেতে যাবে না?

    পা নামাইয়া রসিক সোজা হইয়া বসিল।

    রসিক জানে, এসব সুলোচনার ব্যবস্থা। খাইতে বসিবার সময় হইলে সুলোচনার হুকুমে নিখিল আসিয়া দেখিয়া যায় ঘরে বাহিরের লোক কেউ আছে কি না, তারপর সুলোচনার হুকুমেই সুধারানী তাকে ডাকিতে আসে। অল্পদিন আগে তার যে বিবাহ হইয়াছে এ কথা ভুলিয়া গিয়া অনেক দিনের পুরোনো বউয়ের মতো একটু গিনি গিন্নি ভাব দেখানোর করুণ চেষ্টার মধ্যেও রসিক সুলোচনার শিক্ষা ও পরামর্শ স্পষ্টই দেখিতে পায়। কোনো দিন সে আমোদ পায়, কোনো দিন মমতা বোধ করে। আজ কিন্তু মনটা বিগড়াইয়া গিয়াছিল।

    তুমি মালা দিয়েছ?

    প্রশ্নে নয়, গলার আওয়াজে সুধারানীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। চিরদিন সে বড় ভীরু, তার উপর কুমারী জীবনের অন্তে এই প্রৌঢ় বিপত্নীকের বউ হইয়া খাপছাড়া অস্বাভাবিক অবস্থায় তার দিন কাটিতেছে।

    এসব ঢং শিখলে কোথায়? যেখানেই শিখে থাক, আমি ওসব পছন্দ করি না। বুঝলে?

    নির্বাক সুধারানীর আঙুলে আঁচলের কোণটা জড়াইয়া যাইতে থাকে আর রসিক নিজের ওপর বিরক্ত হইয়া ভাবে যে রাগ না করিয়াও এমন কড়া কথা সে বেচারিকে বলিল কেন? এসব কিছু বলার ইচ্ছাও তো তার ছিল না। প্রমীলার ফটোতে মালা-টালা সে যেন আর না দেয়, শুধু এই কথাটা সে সুধারানীকে বলিবে ভাবিয়াছিল। সুধারানী যদি এখন কাঁদিয়া ফেলে সে কী করিবে?

    সুধারানী কিন্তু কাঁদাকাটা করিল না, একটু কাঁদো কাঁদোও মনে হইল না তার মুখখানা। একটু রাগের ভঙ্গিতেই যেন দাঁত দিয়া ঠোঁট চাপিয়া ধরিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থামিয়া সে ফিরিয়া যাওয়ার উপক্রম করিল। তখন একটা সন্দেহ মনে জাগায় রসিক বলিল, যেয়ো না, শোনো। বউঠান তোমাকে মালা দিতে বলেছে নাকি?

    জানি না। আমিই যদি দিয়ে থাকি, কী করবে তুমি? মারবে?

    জবাব, জবাব দেওয়ার ভঙ্গি, গলার সুর সমস্তই অপ্রত্যাশিত। রসিক আশ্চর্য হইয়া গেল। সুধারানীও যে এতখানি অভিমান করিয়া অন্যায় ভর্ৎসনার এমন ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ জানাইতে পারে এ যেন একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আজ পর্যন্ত একবারও সুধারানীকে সে এমনভাবে কথা বলিতে শোনে নাই। হয়তো সুযোগ দেয় নাই বলিয়া, সুযোগ পাইলে আগেই হয়তো সে এমনিভাবে ফোঁস করিয়া উঠিয়া প্রমাণ করিয়া দিতে পারিত নতুন বউ হইলেও সে কাপড়মোড়া তের বছরের ছিঁচকাঁদুনে খুকি নয়। রসিকের মনে হয়, আজো এইমাত্র সে যেন সুধারানীর অস্তিত্ব প্রথম অনুভব করিয়াছে, এতদিন সে যেন থাকিয়াও ছিল না।

    তাই, কয়েক মুহূর্তের জন্য সে যেন ভুলিয়াই গেল যে সুধারানী প্রমীলা নয়। প্রমীলা রাগ করিলে যেভাবে তার রাগ ভাঙানো একরকম অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল রসিকের, আজো তেমনইভাবে বড় রকম ভূমিকা করিয়া সে রাগ দূর করিতে গেল সুধারানীর। কিন্তু বেশি দূর এগোনো গেল না, হাত ধরিয়া প্রাথমিক আদরের ভোঁতা কয়েকটা কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াই সে চাহিয়া দেখিল, সুধারানীর গাল বাহিয়া টসটস করিয়া জল পড়িতেছে।

    প্রমীলা হইলে কাঁদিত না। আগে হইতে কাঁদিতে থাকিলেও কান্না বন্ধ করিয়া দিত। মুখের মেঘ কাটিয়া হাসি ফুটিতে হয়তো সময় লাগিত অনেকক্ষণ, কিন্তু চোখের জল ফেলিয়া সে ন্যাকামি করিত না।

    সুধারানীর ছেলেমানুষি কান্না সচেতন করিয়া দেওয়ায় রসিক অপ্রস্তুত হইয়া থামিয়া গেল। সোহাগের কথা বন্ধ করিয়া ভদ্রতা করিয়া বলিল, খিদে পেয়েছে, চলো খেয়ে আসি। রান্না হয় নি?

    সুধারানী চোখ মুছিয়া বলিল, হয়েছে। রাগ করলে?

    রসিক জবাব দিল না। ক’দিন আগে তার ক্রন্দনশীলা দশ বছরের মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে হঠাৎ থামিয়া যাওয়ায় সেও এমনিভাবে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, রাগ করেছ বাবা? বলিয়া বাপের রাগের ভয়ে নিজের কান্না সে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউদারচরিতানামের বউ
    Next Article সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }