Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্লেটোর সংলাপ – সরদার ফজলুল করিম

    প্লেটো এক পাতা গল্প366 Mins Read0
    ⤶

    ল্যাচেস

    চরিত্রাবলি

    লীসিম্যাকাস (এরিসটাইডিসের পুত্র)
    মেলেসিয়াস (থুসিডাইডিসের পুত্র)
    লীসিম্যাকাস এবং মেলেসিয়াসের পুত্রদ্বয়
    নিসিয়াস
    ল্যাচেস
    সক্রেটিস

    .

    লীসিম্যাকাস : নিসিয়াস এবং ল্যাচেস, তোমরা বর্ম-যোদ্ধার প্রদর্শনী দেখেছ।

    মেলেসিয়াস এবং আমি তোমাদেরই এই প্রদর্শনী দেখার জন্য একটি উদ্দেশ্য নিয়ে আহ্বান করে এনেছি। এবার সেই উদ্দেশ্যটিই আমরা ভেঙে বলছি। কেননা আমাদের মধ্যে সঙ্কোচ বা সংগোপনের কিছু নেই–একথা নিশ্চয় তোমরা স্বীকার করবে। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাদের দুজনার নিকট থেকে একটি উপদেশ গ্রহণ করা। কিন্তু অনেকে উপদেশ গ্রহণ করার বিষয়টিকে উপহাসের ব্যাপার বলে মনে করেন এবং কেউ তাদের নিকট উপদেশ গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তারা তাদের আপন মনের কথাকে প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। কেউ উপদেশ চাইলে তার আপন বিবেচনার চেয়ে উপদেশ গ্রহীতার মনোবাসনা আন্দাজ করে তদনুযায়ী তার প্রশ্নের জবাব দেন। কিন্তু তোমাদের উভয়কে আমরা উত্তম বিচারক হিসাবে জানি বলে এবং তোমরা যা বিবেচনা কর সঠিকভাবে তাকেই প্রকাশ করবে জেনেই পরামর্শের জন্য তোমাদের আহ্বান করেছি। আমার এই ভূমিকার মূল বিষয় হচ্ছে : মেলেসিয়াস এবং আমার দুটি পুত্র আছে। পুত্রদের নির্দেশ করে। এটি হচ্ছে মেলেসিয়াসের পুত্র থুসিডাইডিস। তার পিতামহের নামানুযায়ী তার এ নামকরণ। আর এটি আমার পুত্র। এটির নামও তার পিতামহের নামানুযায়ী রাখা হয়েছে এরিস্টটল। আমরা আমাদের পুত্রদের এখন থেকেই যথাসাধ্য শিক্ষিত করে তুলতে চাই। শিশু তার শৈশব অতিক্রম করে তারুণ্যে প্রবেশ করেই সাধারণত আপন ইচ্ছামতো চলতে চায়। আমরা এটি পছন্দ করিনে। আমরা স্থির করেছি, এখন থেকেই আমরা সর্বোত্তম যত্নে আমাদের পুত্রদের শিক্ষিত করে তুলব। আমরা জানি তোমাদেরও পুত্র সন্তান রয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই তাদের চরিত্রের গঠন এবং উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য করেছ। যদি তা করা সম্ভব না হয়ে থাকে তা হলে এ কর্তব্য সম্পর্কে আমরাও তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তা হলে এস আমরা সবাই মিলিতভাবে আমাদের এই গুরুদায়িত্ব পালন বিষয়ে পরস্পরকে সাহায্য করি। আমার ভূমিকাটি বিরক্তিকর মনে হলেও, আমি বিস্তৃত করে বলতে চাই, কী প্রকারে আমরা এই সমস্যার সম্মুখীন হলাম। মেলেসিয়াস এবং আমি একসঙ্গেই বাস করি। আমাদের পুত্রগণও আমাদের সঙ্গেই বাস করে। এবার খুলে বলছি। আমরা প্রায়শই ছেলেদের সঙ্গে আমাদের পিতৃপুরুষদের যুদ্ধ এবং শান্তিকালীন মহৎ কার্যাবলির উল্লেখ করে আলাপ করি। মিত্রদের সঙ্গে ব্যবহারে কিংবা নগর শাসনের বিষয়ে তাঁদের মহৎ কীর্তির কথা আমরা উল্লেখ করি। কিন্তু আমাদের নিজেদের এমন কোনো কীর্তিকথা নেই যা আমরা আমাদের পুত্রদের নিকট উল্লেখ করতে পারি। সত্যকথা বলতে কি, আমাদের পরপুরুষদের সম্মুখে পিতৃপুরুষদের তুলনায় আমাদের এই দীনতা লজ্জার বিষয়। আমাদের এই দৈন্যের জন্য আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের দায়ী করছি। কেননা, তরুণ বয়সে তারা আমাদের কোনো কিছু শিক্ষা না দিয়ে আমাদের নষ্ট করে দিয়েছেন। তারা অপর সবার বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন। কিন্তু আমাদের বিষয়ে তারা সামান্য দৃষ্টিও দেন নি। পুত্রদের সম্মুখে এই দৃষ্টান্ত রেখে আমরা তাই বলছি; তারাও যদি আমাদের ন্যায় অবাধ্য এবং আরামপ্রিয় হয় তা হলে সম্মানের সঙ্গে বিকাশলাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আজ যদি তারা ক্লেশ স্বীকার করে, তা হলে হয়তো পিতামহের যে সম্মানিত নাম তারা ধারণ করছে তার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবে। সুখের বিষয় যে, আমাদের পুত্রগণ আমাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী আদেশ পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমাদের এখন কর্তব্য হচ্ছে, সঠিকভাবে নির্ধারণ করা, কোন জ্ঞানের সাধনা কিংবা জীবিকার উপায় তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে। আমাদের জনৈক বন্ধু এ প্রসঙ্গে বর্মযুদ্ধের কৌশল শিক্ষার কথা বলেছেন। তার বিবেচনায় এটি তরুণদের জন্য একটি বিশেষ মূল্যবান গুণ। এই বন্ধুই বর্মযোদ্ধার প্রদর্শনীর প্রশংসা করেছেন এবং আমাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন আমরাও সে প্রদর্শনী দেখে আসি। আমরা স্থির করেছি এই বর্মযোদ্ধাকে আমরা দেখব এবং তোমাদের দুজনকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। একইসঙ্গে, তোমাদের আপত্তি না হলে, আমরা আমাদের পুত্রদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়েও আলাপ করব বলে স্থির করেছি। এই বিষয়টিই আমি তোমাদের নিকট বলতে চেয়েছিলাম। আমি আশা করি এবার তোমরা এই বর্মযুদ্ধের কৌশলের বিষয়ে তোমাদের মতামত প্রকাশ করবে। এতদ্ব্যতীত অপরাপর যেসব শিক্ষাকে যুবকদের জন্য তোমরা অবাঞ্ছিত বলে বিবেচনা কর তারও উল্লেখ করবে। এবার বল, আমাদের এই প্রস্তাবটিতে তোমাদের সম্মতি রয়েছে কি না।

    নিসিয়াস : আমরা কথা বলতে গেলে, লীসিম্যাকাস এবং মেলেসিয়াস, আমি তোমাদের একথা বলতে পারি যে, তোমাদের এই প্রস্তাবটি শুনে আমি অবশ্যই সুখী হয়েছি।

    ল্যাচেস : অবশ্যই। তা ব্যতীত লীসিম্যাকাস তার এবং মেলেসিয়াসের পিতা সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সে অভিমতকেও আমি স্বীকার করি। প্রকৃতপক্ষে এ মন্তব্য কেবলমাত্র আমাদের পিতৃপুরুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এ মন্তব্য আমাদের ন্যায় যারা রাষ্ট্রীয় কার্যাদিতে ব্যাপৃত রয়েছে তাদের সবার উপরই সমভাবে প্রযোজ্য। লীসিম্যাকাস সঠিকভাবেই বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যাপৃত এ সমস্ত নাগরিক আপন সন্তানদের প্রতি এবং ব্যক্তিগত বিষয়াদির প্রতি অনবহিত হয়ে থাকেন। লীসিম্যাকাস, তোমার এ মন্তব্য অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণদের শিক্ষা বিষয়ে আমাদের পরামর্শের চেয়ে তোমরা সক্রেটিসের উপদেশ কেন গ্রহণ করছ না? সক্রেটিস তোমার এলাকাতেই বাস করেন। তদুপরি সক্রেটিস সর্বদাই এরূপ স্থানসমূহে তার সময় যাপন করেন যেখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ তরুণদের জন্য প্রয়োজনীয়

    লীসিম্যাকাস : একথা কি যথার্থ যে সক্রেটিস এ সমস্ত বিষয় নিয়েও চিন্তা করেছে?

    ল্যাচেস : অবশ্যই লীসিম্যাকাস।

    নিসিয়াস : ল্যাচেসের ন্যায় সক্রেটিস সম্বন্ধে একথা আমিও জানি। কেননা, সম্প্রতি সক্রেটিস আমার পুত্রদের সংগীত শিক্ষার জন্য এ্যগাথোকসিলের শিষ্য ডামনকে নিযুক্ত করে দিয়েছিল। তার নিয়োজিত শিক্ষক শুধুমাত্র একজন সংগীতজ্ঞ নন। তিনি একজন সর্বগুণে গুণান্বিত ব্যক্তি। তরুণদের উপযুক্ত সঙ্গী হিসাবে তিনি অবশ্যই অমূল্য।

    লীসিম্যাকাস : সক্রেটিস! নিসিয়াস কিংবা ল্যাচেস–যারা আজ বয়সের ক্ষেত্রে আমার পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন তরুণদের সঙ্গে তারা সম্পর্কশূন্য হয়ে পড়েছেন। কেননা বার্ধক্যের জন্য তারা গৃহের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেন। কিন্তু সফ্রোনিকাসের পুত্র সক্রেটিস, তোমার অবশ্যই তরুণদের বিষয়ে আমাদের উপদেশ দানে উপকৃত করা কর্তব্য। তোমার পিতার একজন পুরাতন বন্ধু হিসাবে তোমার নিকট হতে এরূপ সাহায্য পাওয়ার বিশেষ দাবিও আমার রয়েছে। তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা এরূপ ছিল যে, তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি। তোমার নামের উল্লেখে এখন আমার স্মরণ হচ্ছে যে, তরুণদের কথোপকথনে সক্রেটিসের উচ্চ প্রশংসা আমি শুনতে পেয়েছি। আমি অবশ্য তাদের জিজ্ঞাসা করি নি যে, যার সম্পর্কে তারা এত প্রশংসা সে সফ্রোনিকাসেরই পুত্র কি না? (পুত্রদের লক্ষ্য করে বৎসগণ, এবার তা হলে আমায় বল, তোমরা কি এই সক্রেটিস সম্পর্কেই প্রায়শ আলাপ করে থাক?

    পুত্র : হ্যাঁ পিতা, ইনিই সেই সক্রেটিস।

    লীসিম্যাকাস : সক্রেটিস, তুমি তোমার পিতার নাম বহন কর শুনে আমি সত্যই বড় প্রীত হয়েছি। তোমার পিতা একজন বিশেষ মহৎ ব্যক্তি ছিলেন। তোমার সাক্ষাতে আমাদের উভয় পরিবারের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে ভেবে আমি বিশেষ আনন্দবোধ করছি।

    ল্যাচেস : সত্যই লীসিম্যাকাস, দেখো, সক্রেটিস যেন আমাদের পরিত্যাগ করে যেতে na পারেন। কেননা, আমি দেখেছি সক্রেটিস শুধু তাঁর পিতার নামের সম্মানই রক্ষা করছেন না–সক্রেটিস তার দেশের সম্মান রক্ষা করছেন। ডেলিয়াসের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হটে আসার সময়ে সক্রেটিস আমার সঙ্গী ছিলেন। আমি তোমাকে একথা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, অপর সবাই যদি সক্রেটিসের মতো হতো তা হলে আমাদের দেশের সম্মান সেদিন অবশ্যই রক্ষিত হতো এবং সেদিনের সেই বিরাট পরাজয়ও সংঘটিত হতো না।

    লীসিম্যাকাস : সক্রেটিস, এ তো খুবই উচ্চ প্রশংসা। তোমাকে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে দেখেছেন এবং যে কাজকে তার প্রশংসার যোগ্য বলে মনে করেন সেই বিশ্বস্ত প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট থেকেই এসেছে সেই কাজের জন্য তোমার প্রশংসা। তোমার এই প্রশংসা শুনে আমার হৃদয়ে আনন্দের ধারা বইছে। আমি আশা করি, তুমি আমাকেও তোমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে গ্রহণ করবে। সক্রেটিস, অনেক পূর্বেই আমাদের নিকট তোমার আসা উচিত ছিল। আমার গৃহকে তোমার আপন গৃহ বলে বোধ করা উচিত ছিল। সে যা হোক, আজ যখন আমরা পরস্পরকে আবিষ্কার করতে পেরেছি তখন তুমি নিশ্চয়ই আমার গৃহে আসবে এবং আমার সঙ্গে এবং এই তরুণদের সঙ্গে তুমি আলাপ করবে–যেন এইভাবে তোমার পিতার আমি যেরূপ বন্ধু ছিলাম, তেমনি তোমারও বন্ধু বলে পরিগণিত হতে পারি। আশা করি, তুমি আমার এ অনুরোধটি গ্রহণ করবে। তা হলে পরবর্তী সময়ে আমি হয়তো সাহসপূর্বক তোমার কর্তব্য সম্পর্কে দু’একটি উপদেশও দিতে পারব। কিন্তু যে প্রসঙ্গ অর্থাৎ বর্মযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের আলোচনা উত্থাপিত হয়েছিল সে সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কী? বর্মযুদ্ধ কি আমাদের পুত্রদের শিক্ষা দিলে কোনো উপকার লাভ হবে?

    সক্রেটিস : মাননীয় লীসিম্যাকাস, এ বিষয়ে আমি আমার পরামর্শদানের চেষ্টা করব। আপনার অন্যান্য উপদেশও আমি মেনে চলব। কিন্তু আপনার চেয়ে আমি অল্পবয়স্ক এবং অনভিজ্ঞ। সুতরাং আমার চেয়ে অধিক বয়স্ক এবং অভিজ্ঞরা এ প্রসঙ্গে কী অভিমত ব্যক্ত করেন তাই আমার সর্বপ্রথম শ্রবণ করা সংগত। তৎপরেই মাত্র সেই অভিমতের সঙ্গে আমার কিছু যোগ করার থাকলে আমি তা যোগ করতে পারি এবং তাদের নিকট ও আপনার নিকট আমার মতামতকে ব্যক্ত করতে পারি। তাই বলছি, নিসিয়াস বা অপর কেউ আলোচনাটি শুরু করুন।

    নিসিয়াস : আমি তাতে আপত্তি করছিনে, সক্রেটিস। বর্মযুদ্ধ বিষয়ে আমার অভিমত হচ্ছে, যুবকদের জন্য এই কৌশলটি আয়ত্ত করা বিভিন্নভাবেই উপকারী। কেননা অবসর সময়ে এটিকে তারা অবসর বিনোদনের প্রিয় ক্রীড়াসমূহের এমন একটি হিসাবে গ্রহণ করতে পারে যেটি তাদের দৈহিক স্বাস্থ্যের কোনো হানি না ঘটিয়ে তার উন্নতিই হ্যাঁবে। দৈহিক অপর কোনো ক্রীড়াই বর্মযুদ্ধের চেয়ে উত্তম বা কঠিন হতে পারে না। অশ্বচালনা এবং বর্মযুদ্ধ এ সকলই হচ্ছে স্বাধীন নাগরিকের উপযুক্ত ক্রীড়া। কেননা এ সমস্ত কৌশলে দক্ষ তরুণগণই আমাদের সামরিক বাহিনীর সৈনিক। এরাই সংঘর্ষের কৌশলে শিক্ষিত। তদ্ব্যতীত প্ৰকত যুদ্ধক্ষেত্রে যখন সঙ্বদ্ধভাবে নির্দিষ্ট স্থান রক্ষা করে যুদ্ধ পরিচালিত হয় তখনো এ কৌশলের মূল্য কম নয়। কিন্তু ছত্রভঙ্গ অবস্থায় তোমার যখন একাকী শত্রুসৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করে আক্রমণ করা আবশ্যক হয়, কিংবা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করার সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করতে হয় তখন বর্মযুদ্ধের মূল্য সমধিক। একথা নিঃসন্দেহ যে, বর্মযুদ্ধে দক্ষ সৈনিককে এক কিংবা একাধিক বিপক্ষ সৈন্যও আঘাত হানতে পারে না। এরূপভাবে আক্রান্ত হলেও সুবিধার দিকটিই তার পক্ষে প্রবল থাকবে। তদুপরি এরূপ কৌশলের শিক্ষা ব্যক্তির মনকে অপুর মহৎ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। কেননা, যে যুদ্ধে শিক্ষিত সে স্বাভাবিকভাবে সামরিক শিক্ষার পরবর্তী শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে সৈন্যবাহিনী সংগঠনের সঠিক পদ্ধতিকেও জানতে চাইবে। এই শিক্ষায় যখন সে শিক্ষিত হয়ে উঠবে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা যখন একবার তার মনে জাগরিত হয়ে উঠবে তখন সে অধিনায়কের সমগ্র কৌশলকেই আয়ত্ত করার জন্য জাগরিত হয়ে উঠবে তখন সে অধিনায়কের সমগ্র কৌশলকেই আয়ত্ত করার জন্য অগ্রসর হবে। কেননা, একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় ন যে, অপরাপর সামরিক কৌশলের শিক্ষা একজন নাগরিকের পক্ষে অবশ্যই মূল্যবান ও সম্মানিত শিক্ষা। এবং বর্মযুদ্ধের কৌশলকে অপর সব সামরিক শিক্ষার সূচনা হিসাবেই গণ্য করা চলে। অপর একটি সুবিধার কথাও আমি উল্লেখ করতে পারি। এ সুবিধাটিও নগণ্য নয়। এই কৌশলের শিক্ষা সৈনিককে যুদ্ধক্ষেত্রে অধিকতর সাহসী এবং আত্মস্থ হতে সাহায্য করবে। উপরন্তু আর একটি বিষয়েও আমি বলব। এটিকে অপর সবাই হয়তো সামান্য বলে বিবেচনা করবে। কিন্তু বিষয়টি সামান্য নয়। বর্মসজ্জা সৈনিকের জন্য উপযুক্ত বাহ্য-দৃশ্যও তৈরি করে। বর্মসজ্জায় তার আকৃতি শত্রুর হৃদয়ে ত্রাসের সঞ্চার করবে। সুতরাং লীসিম্যাকাস, এই সমস্ত কারণে আমার অভিমত হচ্ছে তরুণদের এই কৌশলে শিক্ষিত করা আবশ্যক। কিন্তু ল্যাচেস অবশ্যই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। ল্যাচেসের অভিমত শুনতে পেলে আমি খুবই সুখী হবো।

    ল্যাচেস : নিসিয়াস, একথা আমি বলছিনে যে, কোনো একটি কৌশল শিক্ষা করা উচিত নয়। কেননা, সব জ্ঞানই উত্তম। তদুপরি অপরাপর সবাই যখন মনে করেন যে, এই কৌশলটি জ্ঞানেরই একটি শাখা, তখন এটিকে অবশ্যই শিক্ষা করা আবশ্যককিন্তু তা যদি না হয়, এবং যারা কৌশলের শিক্ষাদাতা তারা যথার্থ শিক্ষক না হয়ে যদি প্রবঞ্চক হয়; কিংবা এ জ্ঞান যদি বিশেষ মূল্যবান জ্ঞান না হয়, তা হলে এ জ্ঞানের সার্থকতা কী? আমার এরূপ কথা বলার কারণ হচ্ছে এই যে, বর্মযুদ্ধের কৌশল সত্যই যদি মূল্যবান হতো তা হলে যে ল্যাসিডেমোনীয়গণ প্রতিপক্ষের উপর জয়লাভের জন্য সমরবিজ্ঞানের সব শাখাকেই আয়ত্ত করেছে। তাদের নিকট বর্মযুদ্ধের কৌশলটি অনাবিষ্কৃত থাকতে পারত না। ল্যাসিডিমোনীয়গণ যদি এ কৌশলকে আবিষ্কার করতে সক্ষম না হতো তা হলেও এই কৌশলের পণ্ডিতগণ অবশ্যই এ সত্য আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হতেন না যে, হেলেনবাসীদের মধ্যে ল্যাসিডিমোনীয়গণই এই কৌশল সম্পর্কে সমধিক আগ্রহী এবং এদের মধ্য থেকেই বর্মযুদ্ধ কৌশলে দক্ষ এবং সম্মানিত যোদ্ধা তার কৌশল প্রদর্শনে সমস্ত জাতির মধ্যেই সম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারত, যেমন করে আমাদের মধ্যে বিষাদের সম্মানিত কবি মনে করেন যে, তিনি বিষাদাত্মক নাটক রচনার ক্ষমতা রাখেন এবং তাই তিনি জীবিকার্জনের জন্য প্রতিবেশী কোনো স্থানে ভ্রমণ করার পরিবর্তে সরাসরি এথেন্সে এসে তার নাটকের প্রদর্শনী করে থাকেন। অপরদিকে আমি লক্ষ করেছি যে, বর্মযোদ্ধাগণ ল্যাসিডিমোনিয়াকে অভেদ্য রাজ্য বলেই বিবেচনা করেন। এ স্থানে তারা তাদের স্পর্শটুকুও রাখার ভরসা বোধ করে না। তার চেয়ে বরঞ্চ তারা এ রাজ্যকে পরিহার করে চতুর্দিকে পরিক্রম করবে। এবং অপর সকলের নিকট তাদের কৌশলের প্রদর্শনী দেখাবে, কিন্তু স্পার্টাবাসীদের সম্মুখে তারা উপস্থিত হতে সাহস সঞ্চয় করতে পারে না। এমনকি, স্পার্টার যে সমস্ত যোদ্ধা নিজেরাই স্বীকার করবে যে, তারা প্রথম সারির যোদ্ধা নয় তাদের কাছেও বর্মযোদ্ধাগণ উপস্থিত হতে ভরসা বোধ করে না। তদুপরি লীসিম্যাকাস, প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে আমি এই ভদ্রমহোদয়দের অনেকের সাক্ষাৎ লাভ করেছি এবং তাদের চরিত্রের পরিমাপও আমি তোমাকে দিতে পারি। বস্তুত, ‘অসিবিদ্যায় পারদর্শী’ এই ভদ্রমহোদয়দের কেউই যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারে নি। আমি এদের চরিত্রে একটা ভবিতব্যতার ভাব দেখেছি। অপর সমস্ত কলাকৌশলের ক্ষেত্রে যেখানে সযত্ন চর্চার মাধ্যমেই দক্ষতা অর্জন করা হয়, সেখানে বর্মযোদ্ধাগণই একমাত্র ব্যতিক্রম। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের দুর্দম এই স্টেসিসের কথাই ধর। এর ক্রীড়াকৌশল আমি এইমাত্র প্রত্যক্ষ করেছি। দর্শকদের সম্মুখে সে তার কলাকৌশলের বিশেষ আড়ম্বরপূর্ণ মহড়াই দেখিয়েছে। কিন্তু এই যোদ্ধাকে আমি অপর একটি সময়েও দেখেছি। সে সময়ে যোদ্ধর অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে কৌশলের প্রদর্শনী করেছিল সেটি বর্তমান প্রদর্শনীর চেয়ে উত্তমই হয়েছিল। একটা জাহাজের ছিল এ নাবিক। এই জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটেছিল অপর একটি মালবাহী জাহাজের। আমাদের যোচ্বর ছিল এমন একটি অস্ত্রে সজ্জিত যার অর্ধখণ্ড বল্লম এবং অপর অর্ধ কাস্তে সদৃশ। অস্ত্রের এই তুলনাহীন আকৃতি যোদ্ধার তুলনাহীন চরিত্রেরই উপযুক্ত ছিল। সে যা হোক, আমাদের দীর্ঘ কাহিনী হ্রস্ব করে আমি শুধু বিশিষ্ট আবিষ্কার বল্লমকাস্তের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেটুকু বিবৃত করছি। আমাদের বীর বর্মযোদ্ধা অস্ত্র চালনা করছিল। এই যুদ্ধরত অবস্থায় যোদ্ধার অস্ত্রখানির কাস্তের দিকটি অপর জাহাজের দড়িদড়ায় শক্ত করে আটকে গেল। স্টেসিলাস তো টানাটানি করল অনেক। কিন্তু তার কাস্তেকে অপর জাহাজের দড়ির জট থেকে মুক্ত করে আনতে সমর্থ হলো না। জাহাজ দুটির অবস্থান ছিল এরূপ যে, একটি অপরটির বিপরীত দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যোদ্ধৃবর তো প্রথমে তার বল্লম ধরে আপন জাহাজে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু অপর জাহাজটি তাকে অতিক্রম করে অগ্রসর হওয়াতে তার বল্লমে জোর টান পড়ল এবং স্টেসিলাসকেও বল্লমের সঙ্গে টেনে চলল। বর্মযোদ্ধা বাধ্য হয়ে তার হাতের বাঁধন আলগা করে দিল- কেবলমাত্র বল্লমের বাটটি তার হাতে রইল। অপর জাহাজের যাত্রীগণ করতালি দ্বারা আমাদের যোদ্ধার এই হাস্যকর অবস্থাকে উপভোগ করতে লাগল। এদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে লক্ষ্য করে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করল। নিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ড যোদ্ধার পায়ে এসে আঘাত করাতে যোদ্ধা যখন হাতের মুষ্টি একেবারে আলগা করে তার কাস্তে-বল্লমকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল এবং তার মোহমুক্ত অস্ত্রখানি মালবাহী জাহাজে ঝুলন্ত অবস্থায় যখন একটি মনোহর দৃশ্যের সৃষ্টি করল, তখন তার আপন জাহাজের নাবিকগণের পক্ষেও আর সংযম রক্ষা করা সম্ভব হলো না। তারাও এবার হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি একথা অবশ্য অস্বীকার করছিনে যে, এরূপ কৌশলের বৈশিষ্ট্য কিছু রয়েছে। আমি শুধুমাত্র আমার অভিজ্ঞতাকেই বর্ণনা করলাম। এবং আমি পূর্বেও যেরূপ বলেছি এখনো সেরূপ বলছি যে, আলোচিত বিষয়টি হয় এমন একটি কৌশল যার উপকারিতা সামান্যই, অথবা এটি আদৌ কোনো কৌশল নয়, শুধুমাত্র কৌশলের জবরদস্তি। সুতরাং উভয়ত এ কৌশল আয়ত্ত করা অর্থহীন। কেননা, আমার অভিমত হচ্ছে, এই কৌশলের অধিকারী যদি কাপুরুষ হয় তা হলে সে কার্যক্ষেত্রে হঠকারী হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে সে অধিকতর বিপজ্জনক হবে। অপরদিকে সে যদি সাহসী হয় তা হলে তার সামান্য ত্রুটি নির্দেশ করার জন্য অপর সবাই প্রতীক্ষা করবে এবং পরাজয়ের মুহূর্তে সে বিরাটভাবে পরাজিত হবে। কেননা, এরূপ ভানকারীদের বিরুদ্ধে ঈর্ষারও সঞ্চার হয়। কারণ, কোনো ব্যক্তি যদি অপরিসীম সাহস-সম্পন্ন না হয়, তথাপি সে এরূপ সাহসের অধিকারী বলে যদি দাবি করে তা হলে তাকে উপহাসের পাত্র হতেই হয়। লীসিম্যাকাস, এই কৌশলের বাঞ্ছনীয়তা সম্পর্কে এই হচ্ছে আমার অভিমত। কিন্তু আমি পূর্বেই বলেছি, সক্রেটিসকে এ প্রশ্নের জবাব অবশ্যই দিতে হবে এবং তার অভিমত ব্যক্ত না করা অবধি তুমি তাকে যেতে দিও না।

    লীসিম্যাকাস : সক্রেটিস, এখন আমি তোমার অভিমত চাচ্ছি। এ অভিমতের প্রয়োজনীয়তা এখন অধিকতর এই কারণে যে, আমাদের দুজন সভাসদই পরস্পর ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এবার এমন একজন পরামর্শদাতার আবশ্যক যিনি এই বিরোধের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম হবেন। তাঁরা দুজনে একমত হলে এরূপ মধ্যস্থের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু এখন ল্যাচেস একদিকে ভোট দিয়েছেন এবং নিসিয়াস বিপরীত দিকে, তখন আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, সক্রেটিস, তুমি আমাদের এই বন্ধুর মধ্যে কোন বন্ধুর সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ কর?

    সক্রেটিস : নাগরিক লীসিম্যাকাস, আপনি কি তা হলে এক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্যের মতকেই গ্রহণ করেন।

    লীসিম্যাকাস : অবশ্যই সক্রেটিস। তদ্ব্যতীত আমার কি করণীয় থাকতে পারে?

    সক্রেটিস : মেলেসিয়াস, আপনিও কি এই অভিমতই পোষণ করেন? আপনি যদি আপনার পুত্রের শরীর গঠনের ক্রীড়াকৌশল নিয়ে আলোচনা করতেন, তা হলে কি সে ব্যাপারে আমাদের সংখ্যাধিক্যের মত গ্রহণ করতেন? কিংবা এমন কোনো ব্যক্তির মত জানতে চাইতেন, যিনি একজন দক্ষ শিক্ষক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শিক্ষিত হয়েছেন?

    মেলেসিয়াস : এ বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিকেই জিজ্ঞাস করতাম। তাই তো যুক্তিসংগত।

    সক্রেটিস : সেক্ষেত্রে তার একটি ভোটই আমাদের মিলিত চারটি ভোটের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হতো?

    মেলেসিয়াস : অবশ্যই।

    সক্রেটিস : আমি মনে করি তার কারণ হচ্ছে, একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বিষয়-জ্ঞানের উপরই নির্ভর করে, মানুষের সংখ্যার উপর নয়।

    মেলেসিয়াস : নিশ্চয়ই।

    সক্রেটিস : তা হলে এটিই কি সংগত নয় যে, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সে বিষয়ে আমাদের কারো সঠিক জ্ঞান আছে কিনা, তাই সর্বপ্রথমে জিজ্ঞাসা করা? এমন জ্ঞান যদি কারো থাকে তা হলে সে ব্যক্তি হিসাবে একজন হলেও তার অভিমতই গ্রহণ করা কর্তব্য, আমাদের অভিমতকে গ্রহণ করা উচিত নয়। আমাদের কারো যদি সেরূপ জ্ঞান না থাকে তা হলে আমাদের নূতন উপদেশ গ্রহণ করা আবশ্যক। কেননা, আপনি এবং লীসিম্যাকাস যে-বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেটি কি ক্ষুদ্র বিষয়? তা নয়। আপনারা কি এক্ষেত্রে আপনাদের সর্বোত্তম সম্পদের ঝুঁকি গ্রহণ করছেন না? কেননা, সন্তানই হচ্ছে আমাদের সম্পদ। তাদের ভালো কিংবা মন্দ, সৎ কিংবা অসৎ হয়ে গড়ে ওঠার উপরই পিতার সংসারের শৃঙ্খলা নির্ভর করে।

    মেলেসিয়াস : একথা সত্য।

    সক্রেটিস : তা হলে এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন?

    মেলেসিয়াস : অবশ্যই।

    সক্রেটিস : বেশ, এবার তা হলে আমাদের আলোচ্য বিষয়টি বিচার করা যাক, অর্থাৎ কে সর্বোত্তম শিক্ষক। সর্বোত্তম শিক্ষক হিসাবে কি আমাদের তাঁকেই গ্রহণ করা উচিত নয় যিনি কৌশলটি নিজে জানেন এবং তাকে আয়ত্ত করেছেন এবং যার নিজের শিক্ষাদাতাও ছিলেন সর্বোত্তম?

    মেলেসিয়াস : আমাদের সেরূপ শিক্ষকই গ্রহণ করা কর্তব্য।

    সক্রেটিস : কিন্তু যে বিষয়ের জন্য আমরা শিক্ষক অনুসন্ধান করছি সে বিষয়ের প্রকৃতির প্রশ্নটিই কি প্রথম আলোচ্য নয়?

    মেলেসিয়াস : সক্রেটিস, তোমার বক্তব্যের অর্থটি আমি অনুধাবন করতে পারছিনে।

    সক্রেটিস : অর্থটি আমি সহজ করে বলছি। আমি মনে করি, আমরা যখন প্রশ্ন তুলি, আমরা কৌশলটিতে দক্ষ কিংবা দক্ষ নয় এবং আমাদের কোনো শিক্ষক ছিল কি na, তখন পর্যন্ত আমরা আলোচনার বিষয়টি নির্দিষ্ট করি নি।

    নিসিয়াস : একথা তুমি কেন বলছ, সক্রেটিস? আমাদের আলোচ্য বিষয়টি কি এই নয় যে, তরুণদের বর্মযুদ্ধে শিক্ষিত করা উচিত কি না?

    সক্রেটিস : হ্যাঁ, সেকথা সত্য বটে। তথাপি একটি পূর্ব-প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্নটির দৃষ্টান্ত এভাবে দেওয়া চলে : কেউ যখন চোখে ঔষধ প্রয়োগের কথা বলে তখন সে কি ঔষধ সম্পর্কে চিন্তা করে, না তার চোখের বিষয়ে ভাবে?

    নিসিয়াস : সে চোখ সম্পর্কেই চিন্তা করে।

    সক্রেটিস : তেমনি কেউ যখন একটি অশ্বকে বল্লাবদ্ধ করে তখন সে অশ্বের কথাই চিন্তা করে, বল্লার কথা নয়?

    নিসিয়াস : ঠিকই।

    সক্রেটিস : এক কথায়, সে যখন কোনো কিছু অপর কিছুর জন্য চিন্তা করে তখন সে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করে–উপায় সম্পর্কে নয়।

    নিসিয়াস : খুবই সত্য কথা।

    সক্রেটিস : আমাদেরও বর্তমান উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণদের আত্মিক উন্নতি বিধানের জন্য জ্ঞান অন্বেষণ?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ

    সক্রেটিস : এবং আমরা বিচার করছি, আমাদের মধ্যে কেউ এমন রয়েছে কিনা যে আত্মার উন্নয়নকার্যে পারদর্শী বা সফলকাম এবং সেজন্য আমাদের মধ্যে উত্তম শিক্ষাদাতাও কারো ছিল কি না?

    ল্যাচেস : কিন্তু সক্রেটিস, তুমি নিশ্চয়ই এ-ও লক্ষ্য করেছ যে, অনেক ক্ষেত্রে যাদের কোনো শিক্ষক ছিল না তারাই যাদের শিক্ষক ছিল তাদের চেয়ে একটি বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী।

    সক্রেটিস : হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। আমি সেরূপ দেখেছি। তথাপি আপনি নিশ্চয়ই তেমন পারদর্শিতার উপর আস্থাস্থাপন করবেন না, যদি সে তার আপন বিষয়ে পারদর্শিতার কথা বলা ব্যতীত কোনো বাস্তব কাজে তার প্রমাণ উপস্থিত করতে সক্ষম না হয়।

    ল্যাচেস : সে কথা সত্য।

    সক্রেটিস : সুতরাং ল্যাচেস এবং নিসিয়াস! লীসিম্যাকাস এবং মেলেসিয়াস যখন তাঁদের সন্তানদের আত্মিক উন্নতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এ সম্পর্কে আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তখন আমাদেরও প্রকাশ করা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের কোনো শিক্ষক ছিল কিনা এবং থাকলে তারা কে; তদুপরি আমাদের প্রকাশ করা প্রয়োজন তারা তরুণদের জন্য উপযুক্ত গুণসম্পন্ন এবং অভিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন কিনা এবং সঠিকভাবে আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন কি না। আমাদের মধ্যে কেউ যদি বলেন যে, তাঁর শিক্ষক ছিল না, কিন্তু তিনি নিজেই এ বিষয়ে পারদর্শী, তা হলে তারও প্রকাশ করা প্রয়োজন এথেন্সবাসী কিংবা বিদেশী, দাস কিংবা স্বাধীন নাগরিক, কাকে তিনি উন্নত করেছেন এবং কাদের শিক্ষাদাতা হিসাবে তিনি স্বীকৃত। কিন্তু কেউ যদি শিক্ষাদাতা কিংবা নিজ সাধিত কর্ম কোনো কিছুই দেখাতে না পারেন, তা হলে তার অবশ্যই অপর কোনো উপযুক্ত লোক অন্বেষণের জন্য বলা আবশ্যক এবং নিজের হাতে সুহৃদবর্গের সন্তানদের দায়িত্ব নিয়ে তাদের বিনষ্ট করা এবং তদ্দারা চরম অভিযোগের পাত্র হওয়া উচিত নয়। লীসিম্যাকাস এবং মেলিসিয়াস, আপনাদের নিকট আমার নিজের কথা বললে আমাকে প্রথমেই একথা স্বীকার করতে হবে যে, শৈশব থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গুণার্জনের কৌশল শিক্ষা দেবার ন্যায় কোনো শিক্ষক আমার ছিল না। বেতনভুক শিক্ষক সফিস্ট সম্প্রদায়ের কাউকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করার সামর্থ্য আমার ছিল না। এবং সফিস্টগণই ছিলেন নৈতিক চরিত্র উন্নয়নের একমাত্র শিক্ষক সম্প্রদায়। নিসিয়াস এবং ল্যাচেসের কথা আমি জানি না। তারা হয়তো-বা এই বিদ্যার শিক্ষক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। কেননা, আমার চেয়ে তারা অধিক পরিচিত। কিন্তু আমি নিজে এ কৌশল আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হই নি। নিসিয়াস এবং ল্যাচেস আমার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠও বটে। কাজেই তারা এ শিল্পকলা আবিষ্কারে অধিকতর শিক্ষিত করার অধিকার তাদের রয়েছে। তা না। হলে, কোন শিক্ষা বা জীবিকা তরুণদের উপকার সাধন করবে এবং কোন শিক্ষা তা করবে না–এরূপভাবে নির্দিষ্ট করে তারা অভিমত ব্যক্ত করতেন না। তাঁদের উভয়ের উপর আমার আস্থা রয়েছে। কিন্তু আমার বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এই যে, তারা দুজন পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করছে। সুতরাং মাননীয় লীসিম্যাকাস, ল্যাচেস যেমন আমার সম্পর্কে বলেছেন যে, আমি উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত যেন আমাকে যেতে দেওয়া না হয়, তেমনি আমি বলছি, আপনি ল্যাচেস এবং নিসিয়াসকেও অবস্থান করতে বলুন এবং তাদের আপনি প্রশ্ন করুন। আপনি তাদের বলুন : সক্রেটিস স্বীকার করেছে যে, এ-বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই। তোমরা এ-বিষয়ে সঠিক মত পোষণ করছ, সে সিদ্ধান্ত করতেও সে অপারগ। শিক্ষার কোন কৌশলটি তোমরা নিজেরা আবিষ্কার করেছ কিংবা অপরের নিকট থেকে গ্রহণ করেছ। অপরের নিকট থেকে বিষয়টিতে তোমরা শিক্ষিত হয়ে থাকলে আমাদের নিকট বল, তোমাদের শিক্ষক কে ছিলেন এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অপর কারাই-বা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তোমরা দুজন যদি রাজনৈতিক কার্যাবলিতে বিশেষ ব্যাপৃত থেকে থাক, তা হলে আমরা নিজেরাই এই শিক্ষকদের নিকট যেতে পারব। উপঢৌকন দানে বা অপর কোনো উপায়ে তাদের মনে আগ্রহের সঞ্চার করতে পারব, যাতে তারা আমাদের সন্তানদের শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেন, যেন তারা হীনচেতা হয়ে বৃদ্ধিলাভ না করে এবং আপন পিতৃপুরুষদের সুনাম কলঙ্কিত না করে। তোমরা নিজেরাই যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিক আবিষ্কারক হও, তা হলে তোমরা তোমাদের পারদর্শিতার কিছু প্রমাণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত কর। কাদের তোমরা শিক্ষা দিয়েছ এবং কারা তোমাদের শিক্ষায় হীনম্মন্যতা থেকে মহত্তে উন্নীত হয়েছে? কেননা তোমরা যদি এক্ষেত্রে নবাগত হয়ে থাক, তা হলে বিপদের দিক হচ্ছে এই যে, তোমরা হয়তো তোমাদের পরীক্ষার কার্যটি ‘দাসের দেহের উপর না চালিয়ে তোমাদের এবং বন্ধুজনদের সন্ততির উপরই চালাবে এবং প্রবাদ বাক্যের কথায় ‘হাড়ি গড়তে জাহাজ ভাঙার’ পরিণতি ঘটে যাবে। কাজেই তোমরা বল, কোন গুণের তোমরা অধিকারী কিংবা অধিকারী নও। লীসিম্যাকাস, আপনি এই প্রশ্নের জবাবটি তাদের নিকট হতে গ্রহণ করুন; তার পূর্বে তাঁদেরও আপনি যেতে দেবেন না।

    লীসিম্যাকাস : বন্ধুগণ, সক্রেটিসের বক্তব্যকে আমি বিশেষভাবেই সমর্থন করি। কিন্তু নিসিয়াস এবং ল্যাচেস, তোমরাই স্থির কর, তোমরা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হতে এবং এরূপ ব্যাখ্যাদানে সম্মত হবে কি না। একথা নিশ্চিত যে, মেলেসিয়াস এবং আমি তোমাদের উত্তর শুনতে পেলে বিশেষ সুখী হবো। কেননা, আমার কথার শুরুতেই আমি বলেছি, আমরা তোমাদের উপদেশ গ্রহণ করতে চেয়েছি এজন্য যে, তোমাদের যখন আমাদের ন্যায় সন্তান রয়েছে এবং তারা যখন শিক্ষার বয়সপ্রাপ্ত হয়েছে, তখন তোমরাও অবশ্যই সমস্যাটি সম্পর্কে চিন্তা করেছ। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে সক্রেটিসকে এ বিষয়ে সঙ্গী করে নাও এবং পরস্পর পরস্পরকে প্রশ্ন কর এবং জবাব দাও। এই পদ্ধতিই উত্তম। কেননা, সক্রেটিস যথার্থই বলেছে : আমাদের দায়িত্বের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়েই আমরা আলোচনা শুরু করেছি। আমি আশা করি, তোমরা আমার অনুরোধটি অমান্য করবে না।

    নিসিয়াস : মাননীয় লীসিম্যাকাস, আমার মনে হচ্ছে আপনি সক্রেটিসের পিতাকেই জানতেন। সক্রেটিসকে আপনি জানেন না। সক্রেটিসকে আপনি হয়তো কেবল তার শিশুবয়সে তার অপরাপর সাথীদের সঙ্গে বা তার পিতার সঙ্গে বিসর্জনের উৎসবসমূহে দেখে থাকবেন। কিন্তু আমার স্পষ্টতই মনে হচ্ছে যে, সক্রেটিস বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার পরে আপনি তাকে দেখেন নি।

    লীসিম্যাকাস : একথা তুমি কেন বলছ, নিসিয়াস?

    নিসিয়াস : কেননা, আমার মনে হচ্ছে, আপনি বুঝতে পারছেন না যে, সক্রেটিসের সঙ্গে যদি কেউ কোনো আলোচনায় উৎসাহ প্রদর্শন করে তা হলে সে অবশ্যই তার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়বে এবং আলোচ্য বিষয় যাই হোক না কেন, সক্রেটিস তাকে যুক্তির জালে ক্রমান্বয়েই চক্রাকারে জড়িত করে ফেলবে। অবশেষে সে দেখতে পারে যে, যুক্তির দাবিতে সক্রেটিসের নিকট আপন জীবনের অতীত ও বর্তমানের ইতিবৃত্ত তাকে বলে যেতে হচ্ছে। একবার যদি কেউ সক্রেটিসের যুক্তিজালে ধরা পড়ে যায়, তা হলে একথা নিশ্চিত যে, পরিপূর্ণরূপে পরীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত তার যুক্তি নেই। আমি তার এ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। আমি জানি, আমি যেরূপ বলেছি, সক্রেটিস অবশ্যই সেরূপ করবে এবং তার হাতে আমার দুর্গতি ঘটবে। কেননা, তার আলাপের আমি একজন ভক্ত। আমি একথাও মনে করি যে, কোনো জ্ঞানী লোক যদি আমাদের ত্রুটি বা ভ্রান্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাতে ক্ষতির কিছু নেই। যে নিন্দাবাদকে ভয় করে না সে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করে।’ জ্ঞানী সলোনের একথা যথার্থ। সে যতদিন বাঁচবে ততদিন সে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং এমন কথা সে ভাববে না যে, বয়সের বার্ধক্য আপনা হতেই মানুষের জ্ঞানের বৃদ্ধি হয়। সক্রেটিসের জেরা আমার নিকট অপরিচিত বা অপ্রিয় কোনোটাই নয়। প্রকৃতপক্ষে একথা আমি জানতাম যে, সক্রেটিস যেখানে উপস্থিত রয়েছে, সেখানে আলোচনার বিষয় আমাদের পুত্রদের অতিক্রম করে নিজেদের উপরই এসে পড়বে। সুতরাং আমার দিক থেকে আমি বলতে পারি যে, সক্রেটিসের পদ্ধতি অনুযায়ী আলোচনাতে অংশগ্রহণ করতে আমি অবশ্যই সম্মত রয়েছি। কিন্তু ল্যাচেসের বক্তব্য কী, তাকেই আপনি জিজ্ঞাসা করুন।

    ল্যাচেস : নিসিয়াস, এ প্রসঙ্গে আমার বিশেষ একটি মনোভাব বা বলতে পার দুটি মনোভাব হচ্ছে এই যে, অনেকের নিকট আমি আলোচনাপ্রেমিক বলে পরিচিত, আবার অনেকের নিকট আমি আলোচনার ঘৃণাকারী নামেও পরিচিত। কেননা, সত্যকারের গুণসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি যখন জ্ঞানের কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, সে আলোচনা শ্রবণ করতে আমি আনন্দ বোধ করি। তার কথা ও কাজের ঐক্যকে আমি লক্ষ করি। এরূপ ব্যক্তিকে আমি বীণার চেয়েও সংগতির ছন্দে বাধা যথার্থ সংগীতজ্ঞ বলে বিবেচনা করি। কেননা, তিনি যথার্থই তার জীবনের কথা ও কাজের এমন সংগতি সৃষ্টি করেছেন, যে সংগতি আয়োনীয় বা ফ্রিজীয় বা লীডীয় কৌশল নয়-0যা নিশ্চিতরূপেই গ্রিসীয় এবং ডোরীয়। এরূপ ব্যক্তির মুখের শব্দই আমাকে আনন্দিত করে তোলে। তাঁর আলাপ শ্রবণকালে নিজেকে আলোচনার বিশেষ অনুরাগী বলেই বোধ হয়। মনে হয় যেন তার কণ্ঠ নির্গত শব্দ আমি পান করছি। কিন্তু যে ব্যক্তির কথা ও কাজে ঐক্য নেই তার বাক্য আমার মনে বিরক্তির সঞ্চার করে। এরূপ ব্যক্তির বাক্য যত মধুর তার সম্পর্কে আমার ঘৃণা তত অধিক এবং তখন নিজেকে আমার আলোচনাবিরাগী বলে বোধ হয়। সক্রেটিস সম্পর্কে আমি এই বলতে পারি, তার বাক্য আমি শুনি নি, তবে তার কাজের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। তার কাজই প্রমাণ দেয় যে, স্বাধীন এবং মহৎ চিন্তা তার স্বভাবজাত। এখন যদি সে কাজের সঙ্গে তার কথার ঐক্য দেখতে পাই তা হলে তার সঙ্গে আমি ঐকমত্যই হবো। এরূপ ব্যক্তি দ্বারা জিজ্ঞাসিত হওয়াকে আমি আনন্দের বিষয় বলেই মনে করব। তাঁর নিকট হতে জ্ঞান অর্জন করাতে আমার মনে কোনো বিরক্তির সঞ্চার হবে না। কেননা, সলোন যেরূপ বলেছেন আমিও সেরূপ বলব, জ্ঞান অর্জন করে আমি বৃদ্ধ হই তে আমার আপত্তি নেই। তবে আমার একটি বিষয়ের উপর জোর। সে হচ্ছে, শুধু মহৎ জ্ঞানই আমি অর্জন করতে চাই। সক্রেটিসকে অবশ্যই একজন উত্তম শিক্ষক হতে হবে। অন্যথায় ছাত্র হিসাবে আমি খুব বুদ্ধিমান বা ‘উপাদেয়’ বোধ হবে না। শিক্ষকের বয়স অল্প, কিংবা সে বিশেষ খ্যাত নয়, এটি আমার নিকট কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। সুতরাং সক্রেটিস, একথাই আমার নিশ্চিত জেনো যে, তুমি আমায় যেমন ইচ্ছা খণ্ডন কর এবং আমার জীবন সম্পর্কে যা জানতে চাও তা জেনে নিয়ো। বিপদের মুহূর্তে তুমি আমায় সাথীত্ব এবং সাহস দিয়ে যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছ তার জন্য তোমার সম্পর্কে আমি এরূপ উচ্চ ধারণাই পোষণ করি। কাজে কাজেই তুমি যদৃচ্ছা প্রশ্ন কর এবং আমাদের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য নিয়ে তুমি কোনো সঙ্কোচ করো না।

    সক্রেটিস : আমি জানি, আপনাদের উভয়ের কেউই আমার সঙ্গে আলাপ বা পরামর্শ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন না।

    লীসিম্যাকাস : এটিই তো আমাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব আমাদের যেমন, সক্রেটিস, তেমনি তোমারও। কেননা, তোমাকে আমরা একজন বলেই গণ্য করি। সুতরাং তুমিই আমার ভূমিকা গ্রহণ করে নিসিয়াস এবং ল্যাচেস-এর নিকট হতে আমাদের জ্ঞেয় বিষয়কে জেনে নাও। আমি বৃদ্ধ হয়েছি। স্মৃতিশক্তিও আমার : দুর্বল। কী কী প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা করব কিংবা কী তার জবাব তা আমি ইতোমধ্যেই বিস্মৃত হয়েছি। অধিকন্তু, আমার কথার মধ্যে কোনো বাধা উপস্থিত হলে আমি একেবারেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। সুতরাং আমার অনুরোধ হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই আলোচনাটি চালিয়ে যাও। আমি তোমাদের গৃহীত সিদ্ধান্তকেই কার্যকর করব।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস এবং ল্যাচেস, আসুন আমরা লীসম্যাকাস-এর অনুরোধটি রক্ষা করি। যে প্রশ্ন আমাদের নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আমরা নিজেরাই যদি সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি, তাতে ক্ষতি কিছু নেই। প্রশ্নটি হচ্ছে : কারা আমাদের শিক্ষাদাতা ছিলেন এবং কাদের উন্নতি সাধন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।’ ভিন্নতর পন্থাটির মারফতও আমরা একই স্থানে গিয়ে পৌঁছতে পারি। ভিন্নতর পন্থাটির বৈশিষ্ট্য হবে, মৌলিক নীতির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া। কেননা, আমরা। যদি নিশ্চিতভাবে জানি যে, কোনো কিছুর যোগ সাধন দ্বারা আমরা অপর কিছুর উন্নতি সাধন করতে পারব এবং এরূপ যোগ সাধন আমাদের পক্ষে সম্ভব, তা হলে এ অনুমানও সঠিক যে, আমরা জানি, জ্ঞাত বিষয়টিকে আয়ত্ত করার সর্বোত্তম পন্থাটিও আমাদের জ্ঞাত। আমার বক্তব্যটি আপনাদের নিকট হয়তো স্পষ্ট হলো na। তা হলে আমার বক্তব্যটি এভাবে পরিষ্কার করতে দিন। মনে করুন, দৃষ্টিমান চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি অধিকতর দৃষ্টিশক্তির যোগদান বৃদ্ধি পাবে। মনে করুন, দৃষ্টিমান চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি অধিকতর দৃষ্টিশক্তির যোগসাধনে বৃদ্ধি পাবে। মনে করুন, দৃষ্টিশক্তির সেরূপ যোগসাধনও আমাদের পক্ষে সম্ভব। তা হলে নিশ্চয়ই দৃষ্টিশক্তি কাকে বলে তাও আমরা জানি। এবং কোন উত্তম ও সহজ কৌশলে এই গুণের অর্জন সম্ভব সে উপদেশ দান আমাদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু আমরা যদি দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তির প্রকৃতিকেই না জানি তা হলে আমাদের চক্ষু, কর্ণ বা দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি লাভের কোনো উত্তম উপদেশ দান সম্ভব নয়।

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, তোমার একথা সত্য।

    সক্রেটিস : ল্যাচেস, অথচ আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ দুই বন্ধু ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের অনুরোধ করেছেন যেন আমরা বলে দিই, কীভাবে ন্যায়পরায়ণতার গুণ দ্বারা তাদের সন্তানদের আত্মিক উন্নতি সম্ভব?

    ল্যাচেস : খুবই সত্য কথা।

    সক্রেটিস : তা হলে আমাদের কি সর্বপ্রথম ন্যায়পরতার প্রকৃতিকেই উপলব্ধি করা আবশ্যক নয়? কেননা, যার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নিজেরাই অজ্ঞ, তাকে অর্জন করার সর্বোত্তম পন্থার পরামর্শদান আমাদের পক্ষে কি করে সম্ভব?

    ল্যাচেস : না, আমি মনে করি না, সেরূপ উপদেশ আমরা দিতে পারি।

    সক্রেটিস : তা হলে আসুন, আমরা ধরে নিই যে, ন্যায়পরতার প্রকৃতি আমরা জানি।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ।

    সক্রেটিস : এবং যা আমাদের জ্ঞাত তাকে বলার ক্ষমতাও নিশ্চয়ই আমাদের আছে?

    ল্যাচেস : অবশ্যই।

    সক্রেটিস : সমগ্র ন্যায়পরতা নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করব, এমন কথা আমি বলিনে। কেননা, তা করার সাধ্য হয়তো আমাদের নেই। প্রথমে আমরা দেখব, তার অংশ সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে কি না। তা হলে অনুসন্ধান কিংবা বিচারের কাজটি আমাদের পক্ষে সহজসাধ্য হবে।

    ল্যাচেস : তুমি যেরূপ বলেছ, সেরূপই করা যাক।

    সক্রেটিস : তা হলে ন্যায়পরতার কোন অংশ আমাদের নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন? যে অংশের চর্চা বর্মযুদ্ধের উন্নয়ন সাধন করে, তাকেই আমাদের নির্দিষ্ট করা উচিত নয় কি? এবং ন্যায়পরতার সেই অংশটিকে কি সাহস হিসাবে অনুমান করা হয় na?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, অবশ্যই।

    সক্রেটিস : তা হলে ল্যাচেস, আমরা বরঞ্চ সাহসের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। তৎপর আমরা বিবেচনা করে দেখব, যুবক সম্প্রদায় অধ্যয়ন এবং অধ্যবসায়ের সাহায্যে কী প্রকারে এই গুণকে অর্জন করতে পারে? আপনি যদি জানেন তা হলে আমাকে বলুন, সাহস বিষয়টি কী?

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, তোমার এ প্রশ্নের জবাবদান আমি খুব কঠিন বলে মনে করিনে। সাহসী অবশ্যই সে, যে যুদ্ধে আপন স্থানকে পরিত্যাগ করে পলায়ন করে না, যে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলে–সাহসী অবশ্যই সে। এ বিষয়ে আর সন্দেহ কি?

    সক্রেটিস : খুবই উত্তম কথা। তবু আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমি হয়তো আমাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারি নি। তারই জন্য যে প্রশ্নটি আমার জানার ইচ্ছা তার চেয়ে ভিন্নতর প্রশ্নের জবাব আপনি দিয়েছেন।

    ল্যাচেস : তোমার একথার অর্থ কী?

    সক্রেটিস : আমি ব্যাখ্যা করে বলতে চেষ্টা করছি। যে আপন স্থানে দাঁড়িয়ে শত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করে, আপনি তাকেই সাহসী বলবেন। নয় কি?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, অবশ্যই আমি তাকে সাহসী বলব।

    সক্রেটিস : আমারও তাই বলা সংগত। কিন্তু আপনি সেই যোদ্ধাকে কী বলবেন, যে আপন স্থানে না থেকে পলায়নরত অবস্থাতেও শক্রর সঙ্গে লড়াই করে? ল্যাচেস; পলায়নরত অবস্থাতে কী করে তা সম্ভব?

    সক্রেটিস : কেন, সিদিয়াবাসীগণ যার জন্য বিখ্যাত? অর্থাৎ তারা পলায়নও করে এবং শত্রুর পশ্চাদ্ধানও করে–যেমন হোমার তার ইনিসের অশ্ব সম্পর্কে বলেছেন : তারা জানত, কী করে দ্রুততার সঙ্গে যত্রতত্র হটতে এবং এগোতে হয়।’ হোমার ইনিসের প্রশংসা করেও বলেছেন : ‘ইনিসের ভীতি এবং পলায়ন উভয় সম্পর্কেই জ্ঞান ছিল। ইনিস ছিল ভীতি এবং পলায়নের কৌশলী যোদ্ধা।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, সক্রেটিস হোমার তা বলেছেন। কেননা, তুমি যেমন সিদিয়ার অশ্বারোহী সম্পর্কে তোমার উক্তি করেছ, হোমার তেমনি শকট-বাহিনী সম্পর্কে তাঁর কথা বলেছেন। এদের উভয়েরই সগ্রামের পদ্ধতি হচ্ছে ঐরূপ। কিন্তু ভারী অস্ত্রবাহী গ্রিক যোদ্ধা, আমি যেরূপ বলেছি, সেরূপ আপন স্থানে থেকেই যুদ্ধ করে।

    সক্রেটিস : তা হলে ল্যাচেস, ল্যাসিডিমোনীয়দের ব্যতিক্রম হিসাবে গ্রহণ করতে হয়। কেননা, তারাও যখন প্ল্যাটিয়ার যুদ্ধে পারসীয় বাহিনীর হাল্কা বর্মের সম্মুখীন হয়েছিল তখন আপন স্থানে দাঁড়িয়ে লড়াই করার পরিবর্তে পশ্চাদপসরণ করেছিল। কিন্তু যে-মুহূর্তে পারসীয় সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল তখন পুনরায় অশ্বারোহী বাহিনীর ন্যায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং এমনিভাবে প্ল্যাটিয়ার যুদ্ধে জয়লাভও করেছিল।

    ল্যাচেস : সে কথা সত্য।

    সক্রেটিস : এজন্যই আমি বলেছিলাম যে, আমার প্রশ্নটি আমি যথার্থভাবে আপনার

    নিকট উপস্থিত করতে পারি নি। সেজন্য আপনার জবাবদানটিও সঠিক হয় নি। কেননা আমি কেবলমাত্র ভারী অস্ত্রবাহী যোদ্ধাদের সাহস সম্পর্কেই প্রশ্ন করতে চাই নি। অশ্বারোহী কিংবা অপর যে-কোনো রীতির যোদ্ধার সাহস সম্পর্কেই প্রশ্ন করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। তদ্ব্যতীত প্রশ্নটি এই নয় যে, শুধুমাত্র সংগ্রামক্ষেত্রে সাহসী কে। প্রশ্নটি হচ্ছে, কে সমুদ্রে, সঙ্কটে, রোগ কিংবা দারিদ্র্যের মধ্যে কিংবা রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সাহসী। সাহস শুধু ক্লেশ কিংবা ভীতির বিরুদ্ধেই নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কে বাসনা এবং বিলাসের বিরুদ্ধেও সংগ্রামে সাহসী; কে শক্রর সঙ্গে পশ্চাদপসরণে কিংবা পশ্চাদ্ধাবনে সাহসী। সেখানেই এই সাহসের প্রশ্ন?। তাই নয় কি, ল্যাচেস?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, একথা অবশ্যই সত্য।

    সক্রেটিস : এরা সবাই সাহসী। কিন্তু কেউ বা ভোগে সাহসী, কেউ বা ক্লেশ সহনে সাহসী। এবং আমার ধারণা অনেকে একই অবস্থায় কাপুরুষও বটে।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, খুবই সত্য।

    সক্রেটিস : আমার প্রশ্ন সাধারণত সাহস বা ভীতি সম্পর্কে। আমি সাহস সম্পর্কেই আলোচনাটি শুরু করব। আমার প্রশ্নটিকে পুনরায় আমি উপস্থিত করছি। উল্লিখিত সমস্ত ক্ষেত্রে সাহস বলে যাকে অভিহিত করা হয় তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য কী? আমার কথাটি কি আপনার নিকট এবার স্পষ্ট হলো?

    ল্যাচেস : না, খুব বেশি স্পষ্ট হয় নি।

    সক্রেটিস : আমি বলছি : আমরা প্রশ্ন করতে পারি, দ্রুততা গুণটি কী? অর্থাৎ দৌড়াবার ক্ষেত্রে কিংবা বীণাবাদনে, ভাষণদান বা শিক্ষাগ্রহণে-–এরূপ বিভিন্ন কার্যে হাত, পা, মুখ, কণ্ঠ, মন প্রভৃতির যে-কোনো কার্যে আমরা যে সাধারণ গুণটি দেখতে পাই–সেটি কী? সেটিকে কি আপনি দ্রুততা বলে অভিহিত করবেন না?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, অবশ্যই।

    সক্রেটিস : মনে করুন, আমাকে কেউ প্রশ্ন করল : সক্রেটিস দ্রুততা বলে যে শব্দ তুমি ব্যবহার করছ তার বিভিন্ন প্রয়োগের সাধারণ গুণটি কী, আমাদের বল। তা হলে আমাকে বলতে হবে : দৌড়, ভাষণ বা অপর কোনো কার্যে যে-গুণ অল্প সময়ে অধিক ফলদান করে, তাকেই আমরা দ্রুততা বলে অভিহিত করব।

    ল্যাচেস : তোমার এ উত্তর যথার্থই হবে।

    সক্রেটিস : তা হলে ল্যাচেস, অনুরূপভাবে আপনি আমায় বলুন : সাহস দ্বারা কোন সাধারণ গুণকে বুঝানো হবে? অর্থাৎ কোন সাধারণ গুণকে সাহস বলে আরাম ও ক্লেশ প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে?

    ল্যাচেস : সাহসের সার্বিক চরিত্রের কথা বললে, আমার মনে হয়, সাহস হচ্ছে আত্মার ধৈর্য বা সহনশীলতা।

    সক্রেটিস : আমাদের প্রশ্নের জবাবদানের জন্য এরূপই বলা আবশ্যক। কিন্তু তথাপি আমার মনে হয় না যে, সমস্ত সহিষ্ণুতাকেই সাহস বলে বিবেচনা করা চলে। আমার যুক্তি হচ্ছে : আমার বিশ্বাস, ল্যাচেস, আপনি সাহসকে অবশ্যই একটি মহৎ গুণ বলে বিবেচনা করেন।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, সাহস অবশ্যই একটি অতি মহৎ গুণ।

    সক্রেটিস : এবং বিজ্ঞের সহিষ্ণুতাকেও আপনি অবশ্যই মহৎ বলবেন?

    ল্যাচেস : অবশ্যই। অতি মহৎ।

    সক্রেটিস : কিন্তু মূর্থের সহিষ্ণুতাকে আপনি কী বলবেন? মূখের সহিষ্ণুতাকে কি খারাপ এবং ক্ষতিকর বলা উচিত নয়?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, তাই।

    সক্রেটিস : কিন্তু যা খারাপ এবং ক্ষতিকর, তাকে কি আপনি মহৎ বলতে পারেন?

    ল্যাচেস : না, সক্রেটিস, আমার সেরূপ বলা উচিত নয়।

    সক্রেটিস : তা হলে এরূপ সহিষ্ণুতাকে আপনি সাহস বলে অভিহিত করবেন না। কেননা, এরূপ সহিষ্ণুতা মহৎ নয়। কিন্তু সাহস অবশ্যই মহৎ।

    ল্যাচেস : তুমি ঠিকই বলেছ।

    সক্রেটিস : তা হলে আপনার বক্তব্যানুযায়ী কেবলমাত্র বিজ্ঞের সহিষ্ণুতাই সাহস? ল্যাচেস; হ্যাঁ, তাই।

    সক্রেটিস : এবার তা হলে ‘বিজ্ঞ’ কথাটিকে ধরা যাক : কিসে বিজ্ঞ? ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব কিছুতেই বিজ্ঞ? দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরুন, এক ব্যক্তি অর্থ ব্যয়ে সহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে। কেননা সে জানে যে, ‘অর্থব্যয়ে সহিষ্ণুতা তার পরিণামে অধিকতর অর্থ বহন করে আনবে। এরূপ লোককে কি আপনি সাহসী বলবেন? ল্যাচেস; অবশ্যই না।

    সক্রেটিস : ধরা যাক, এক ব্যক্তি চিকিৎসক। তার পুত্র বা অপর কোনো রোগীর ফুসফুসের প্রদাহ ঘটেছে। রোগী আবেদন জানাচ্ছে যেন চিকিৎসক বিশেষ কিছু খেতে বা পান করতে অনুমতি দেন। চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে সে অনুমতি প্রত্যাখ্যান করছেন। আপনি কি একে সাহস বলবেন?

    ল্যাচেস : না, এটিও পূর্বের ন্যায়ই সাহস নয়।

    সক্রেটিস : বেশ, যুদ্ধে যে সহিষ্ণুতা তার কথা ধরুন। একজন যোদ্ধা যুদ্ধে সহিষ্ণু। সে সংগ্রামে ইচ্ছুক। সে জানে এবং বিজ্ঞতার সঙ্গে পরিমাপ করে দেখেছে যে অপর সাথীগণ তাকে যুদ্ধকালে সাহায্য করবে; তার প্রতিদ্বন্দ্বী সৈন্য তার চেয়ে শক্তিতে দুর্বল এবং সংখ্যায় ন্যূন। তদুপরি আমাদের যোদ্ধা জানে যে, স্থানগত অবস্থান প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে অধিকতর সুবিধাজনক। এরূপ যোদ্ধা যখন বিজ্ঞতার সঙ্গে প্রস্তুতি এবং পরিমাপ সহকারে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে তখন তাকে আপনি সাহসী বলবেন–কিংবা তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর যে যোদ্ধা বিপরীত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে, কাকে সাহসী বলবেন? কিংবা কে অধিক সাহসী?

    ল্যাচেস : আমার বিবেচনায় অপর যোদ্ধাই অধিক সাহসী।

    সক্রেটিস : কিন্তু অপর যোদ্ধার সাহস নিশ্চয় প্রথম যোদ্ধার তুলনায় মূখের সাহস?

    ল্যাচেস : একথা ঠিক।

    সক্রেটিস : তা হলে আপনি বলতে চান যে, অশ্বারোহী বাহিনীর যে যোদ্ধা অশ্ব চালনার জ্ঞান সহকারে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে সে তত সাহসী নয়, যত সাহসী সেই অশ্বারোহী যোদ্ধা যে অনুরূপ জ্ঞান ব্যতিরেকেও সহিষ্ণুতা সহকারে যুদ্ধ করে?

    ল্যাচেস : আমি সেই রূপই বলব।

    সক্রেটিস : তেমনি যে ধনুক বা অপর কোনো অস্ত্র প্রয়োগের জ্ঞানের ভিত্তিতে সাহস প্রদর্শন করে সে তত সাহসী নয়, যত সাহসী হচ্ছে সে, যে এরূপ প্রয়োগ কৌশলের জ্ঞান ব্যতিরেকেই সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ তাই।

    সক্রেটিস : এবং কেউ যদি ডুব দেওয়ার কৌশল না জেনেও একটি কূপের ভিতর অবতরণ করে অনেক সময় অবধি টিকে থাকতে পারে কিংবা অনুরূপ কোনো কাজে সক্ষম হয়, তা হলে তাকে আপনি যে ব্যক্তি ডুব দেওয়ার কৌশল জানে তার চেয়ে অধিক সাহসী বলবেন?

    ল্যাচেস : তা তো বটেই। এ ব্যতীত অপর কি বলা সম্ভব?

    সক্রেটিস : হ্যাঁ, যদি সেরূপই মনে করা হয়, তা হলে অপর আর কিছু বলা সম্ভব নয়।

    ল্যাচেস : আমিও সেরূপই মনে করি।

    সক্রেটিস : কিন্তু যে ব্যক্তি এরূপ বিপদের ঝুঁকি নিয়েও সাহসিকতা প্রদর্শন করে, সে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির এ সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে, তার তুলনায় অবশ্যই বুদ্ধিহীন।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, সে কথা সত্য।

    সক্রেটিস : তথাপি সাহসকে একটি মহৎগুণ হিসাবেই স্বীকার করা হয়েছে, নয় কি?

    ল্যাচেস : ঠিক।

    সক্রেটিস : কিন্তু এখন বিপরীতভাবে আমরা বুদ্ধিহীন ধৈর্যকে সাহস বলছি। অথচ পূর্বে বুদ্ধিহীন ধৈর্যকে আমরা অসম্মানজনকই মনে করেছি।

    ল্যাচেস : একথাও সত্য।

    সক্রেটিস : কিন্তু এরূপ বলা কি আমাদের পক্ষে সংগত?

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, এখন আমি নিশ্চিত যে এরূপ বলা আমাদের পক্ষে সংগত নয়।

    সক্রেটিস : তা হলে ল্যাচেস আপনার এই অভিমত অনুসারে আপনার কিংবা আমার কারো জীবনই ডোরীয় সুরে বাঁধা নয়। কেননা আমাদের কথা ও কাজে সংগতি নেই। ডোরীয়াবাসীদের কথা ও কাজে সংগতি বিরাজমান। বর্তমান আলোচনারত আমাদের দেখে যে কেউ বলবে যে আমরা কার্যক্ষেত্রে সাহসী হতে পারি–কিন্তু বর্তমান আলোচনায় আমরা কোনো সাহসের পরিচয় দিতে পারি নি।

    ল্যাচেস : একথা অবশ্য সত্য।

    সক্রেটিস : কিন্তু আমাদের এই অবস্থাটি কি আনন্দদায়ক?

    ল্যাচেস : বরঞ্চ ঠিক বিপরীত।

    সক্রেটিস : তার চয়ে বরঞ্চ আসুন, যে নীতি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তাকেই অন্তত আংশিকভাবে আমরা স্বীকার করে নিই।

    ল্যাচেস : কী পরিমাণ আমরা স্বীকার করব এবং কোন নীতির কথাই বা তুমি বলছ, সক্রেটিস?

    সক্রেটিস : ধৈর্য বা সহন শক্তির নীতি। সাহস সম্পর্কে অনুসন্ধান কার্যে আমাদেরও কিছুটা ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতে হবে। তা হলেই সাহস আমাদের দুর্বল চিত্তকে পরিহাস করবে না। কেননা, পরিশেষে আমরা হয়তো দেখব যে, ধৈর্য এবং সাহস অভিন্ন।

    ল্যাচেস : যদিও আমি এরূপ অনুসন্ধান কার্যে অভ্যস্ত নই, তা হলেও সক্রেটিস, তোমার সঙ্গে অগ্রসর হতে আমি সম্মত আছি। মতামতের বিবৃতিসমূহ ইতোমধ্যেই আমার মনে বিতর্কের একটি স্পৃহা সৃষ্টি করেছে। আমি নিজের মতটি ঠিকভাবে প্রকাশ করতে অসমর্থ বলে নিজেই বিশেষ দুঃখিত। কেননা, সে আমার প্রকাশের অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে আয়ত্ত করে তার প্রকৃতিকে প্রকাশ করা আমার পক্ষে যেন সম্ভব হচ্ছে না।

    সক্রেটিস : কিন্তু প্রিয় বন্ধু, যে উত্তম খেলোয়াড়, তার আলস্য পরিহার করে চিহ্নিত পথ ধরে অগ্রসর হওয়াই উচিত নয় কি?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার অগ্রসর হওয়া উচিত।

    সক্রেটিস : আসুন তা হলে আমরা নিসিয়াসকেও আমাদের এই খেলায় যোগদানের আহ্বান জানাই। তিনি আমাদের চেয়ে উত্তম খেলোয়াড় হতে পারেন। আপনি কী বলেন?

    ল্যাচেস : আমারও এটি মনঃপূত।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, আপনিও তা হলে আমাদের সঙ্গে যোগদান করুন। দেখতে পাচ্ছেন, আমরা যুক্তির সমুদ্রে ঢেউয়ের দোলায় দুলছি এবং খাবি খাচ্ছি। আপনার বন্ধুদের দুর্দশায় সাহায্য করার জন্য আপনি এগিয়ে আসুন। আপনি আমাদের অন্তিম অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন। আপনিই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন এবং আপনার নিজের মতকেও এভাবে সুনির্দিষ্ট করতে পারবেন। শুধুমাত্র আপনি বলুন : সাহস সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন।

    সিনিয়াস : সক্রেটিস, আমার বিবেচনায়, তুমি কিংবা ল্যাচেস সাহসের সঠিক সংজ্ঞা দিচ্ছ না। কেননা, তোমার নিজের মুখ থেকে অন্য সময়ে আমি যে সুন্দর কথাটি শুনেছি সেটিই তুমি বিস্মৃত হয়েছ।

    সক্রেটিস : সেটি কী নিসিয়াস?

    নিসিয়াস : আমি তোমাকে প্রায়শই বলতে শুনেছি : প্রত্যেক মানুষই আপন জ্ঞানের ক্ষেত্রে উত্তম এবং অজ্ঞানের ক্ষেত্রে অধম।’

    সক্রেটিস : একথা অবশ্যই সত্য, নিসিয়াস।

    নিসিয়াস : সুতরাং সাহসী যদি উত্তম হয় তা হলে সে জ্ঞানীও?

    সক্রেটিস : ল্যাচেস, আপনি নিসিয়াসের বক্তব্য শুনছেন কি?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, আমি তার কথা শুনেছি, কিন্তু আমি সঠিকভাবে তাকে অনুধাবন করতে পারছিনে।

    সক্রেটিস : আমার মনে হচ্ছে, আমি তাকে বুঝতে পারছি। আমার মনে হচ্ছে নিসিয়াস। বলতে চাচ্ছেন : ‘সাহসও এক প্রকার জ্ঞান।’

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, তার দ্বারা সে কি বুঝতে যাচ্ছে?

    সক্রেটিস : এ প্রশ্ন আপনি তাকেই জিজ্ঞাসা করুন।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, আমি তাই করছি।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, আপনি তা হলে বলুন, এই বিজ্ঞতার দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাইছেন? কেননা আপনি নিশ্চয়ই এই বিজ্ঞতার দ্বারা বাঁশি বাজানোর বিজ্ঞতাকে বুঝাতে চাইছেন না?

    নিসিয়াস : অবশ্যই আমি তা বুঝতে চাইনে।

    সক্রেটিস : কিংবা বীণাবাদনের বিজ্ঞতাকেও নয়?

    নিসিয়াস : না, তাও নয়।

    সক্রেটিস : তা হলে আপনার এই জ্ঞানের প্রকৃতি কি এবং কিসের বিষয়ে এই জ্ঞান? ল্যচেস : সক্রেটিস, আমি মনে করি, তোমার প্রশ্নটি অতি উত্তম হয়েছে। আমিও চাচ্ছি, নিসিয়াস বলুক তার জ্ঞান বা বিজ্ঞতার প্রকৃতি কী?

    নিসিয়াস : ল্যাচেস, আমি বলতে চাই : সাহস হচ্ছে সেই জ্ঞান, যা যুদ্ধে কিংবা অপর কোনো কার্যে ভীতি কিংবা আস্থার সৃষ্টি করে।

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, দেখ কী অদ্ভুত তার কথা।

    সক্রেটিস : ল্যাচেস, আপনি একথা কেন বলছেন?

    ল্যাচেস : কেন বলব না? নিশ্চয়ই সাহস এক বস্তু এবং বিজ্ঞতা ভিন্নতর।

    সক্রেটিস : কিন্তু নিসিয়াস তো সে কথাই অস্বীকার করছেন।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, সেটি সে অস্বীকার করছে এবং সেখানেই সে মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে।

    সক্রেটিস : তাঁকে গালমন্দ করার চেয়ে আসুন, আমরা তাকে পরামর্শ দান করি।

    নিসিয়াস : ল্যাচেস আমাকে পরামর্শ দানে ইচ্ছুক নয়। কেননা সে নিজে নির্বোধের ন্যায় কথা বলে। এখন আমাকেও সে নির্বোধ প্রমাণ করতে চাচ্ছে।

    ল্যাচেস : খুবই খাঁটি কথা নিসিয়াস। তুমি যথার্থই নির্বোধের ন্যায় কথা বলেছ এবং আমি তোমাকে তা দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাচ্ছি : চিকিৎসকগণ কি রোগেরবিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত নন? কিংবা যারা সাহসী তারা সে বিপদকে জানে? অথবা তুমি বলবে, চিকিৎসক এবং সাহসী–এ দুটিই এক কথা?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, কিছু জানা এবং সাহসী হওয়া, এক কথা হতে পারে না। কৃষক কৃষিকার্যের বিপদাদি জানতে পারে–কিংবা অপর কোনো কারিগরের এমন জ্ঞান থাকতে পারে, যা তার আপন বিদ্যায় আস্থা কিংবা ভীতির সঞ্চার করতে পারে কিন্তু সেজন্য তারা বিন্দু পরিমাণ অধিক সাহসী নয়।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, ল্যাচেস কী বলতে চাইছেন? আমার মনে হচ্ছে, তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন।

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, সে কিছু বলছে বটে। কিন্তু তা সত্য নয়।

    সক্রেটিস : কী করে?

    নিসিয়াস : কেননা, ল্যাচেস দেখছে না যে, চিকিৎসকের জ্ঞান হচ্ছে আরাম এবং ব্যারাম সম্পর্কে জ্ঞান। রোগীকে সে শুধু এটুকুই বলতে পারে। ল্যাচেস তুমি কি মনে কর, চিকিৎসক জানে, রোগীর নিকট আরাম কিংবা ব্যারাম, কোনটি কখন অধিক ভীতিপ্রদ? এমন রোগী তো হতে পারে যার রোগশয্যা থেকে আর মুক্তি পাওয়াই সংগত নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি কি মনে কর, জীবন সর্বদাই মৃত্যুর চেয়ে উত্তম, মৃত্যুও কি অনেক সময়ে কাম্য হতে পারে না?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, তা হতে পারে?

    নিসিয়াস : তা হলে যার মৃত্যুই শ্রেয় এবং যার জীবনই শ্রেয়–এদের উভয়ের নিকট কি একই বস্তু ভীতিজনক বলে বোধ হতে পারে?

    ল্যাচেস : না, তা অবশ্য নয়।

    নিসিয়াস : তা হলে তুমি মনে কর, আশা এবং আশঙ্কায় যারা বিজ্ঞ, তাদের ব্যতীত আর কেউ–অর্থাৎ চিকিৎসক কিংবা কোনো শিল্পীর পক্ষে একথা জানা সম্ভব? আমি এরূপ বিজ্ঞকেই সাহসী বলি।

    সক্রেটিস : ল্যাচেস, নিসিয়াসের কথার অর্থটি কি আপনি বুঝতে পারেন?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। এবং আমি মনে করি, সে যেরূপ বলছে তাতে ভবিষ্যদ্বক্তারাই হচ্ছে সাহসী। কেননা তারা ব্যতীত আর কে জানে, মৃত্যু কিংবা জীবন উত্তম? কিন্তু নিসিয়াস, তুমি কি নিজেকে একজন ভবিষ্যদ্বক্তা বলতে চাচ্ছ? কিংবা বলব, তুমি ভবিষ্যদ্বক্তা বা সাহসী, কোনোটিই নও?

    নিসিয়াস : কী বলছ তুমি ল্যাচেস? তুমি কী বলতে চাচ্ছ, ভবিষ্যদ্বক্তার আশা ও আশঙ্কার কারণ জানা সম্ভব?

    ল্যাচেস : অবশ্যই আমি তাই বলছি। সে ব্যতীত অপর কে জানবে?

    নিসিয়াস : কেন? আমি যার কথা বলছি সে জানবে। কেননা যে ভবিষ্যদ্বক্তা সে শুধু ভবিষ্যৎ ঘটনার আভাসই জানবে। মৃত্যু কিংবা রোগ, সম্পদের বিনষ্টি বা যুদ্ধে জয়-পরাজয়–অথবা অপর কোনো প্রতিযোগিতার ফলাফল প্রভৃতির আভাস সে জানতে পারে। কিন্তু এ সমস্ত বিষয়ের ফলভোগ কার নিকট উত্তম হবে, সে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যদ্বক্তা কিংবা যে ভবিষ্যদ্বক্তা নয়, তাদের কেউ স্থির করে দিতে পারে না।

    ল্যাচেস : সক্রেটিস, আমি নিসিয়াসের বক্তব্যের উদ্দেশ্যটি বুঝতে পারছিনে। কেননা সে তার সাহসী ব্যক্তিকে ভবিষ্যদ্বক্তা কিংবা চিকিৎসক–কিংবা অপর কোনো চরিত্র হিসাবে উপস্থিত করছে না। জানি না সে তাকে দেবতা বা ভগবান বলতে চাইছে কি না। আমার মনে হচ্ছে, সে অর্থহীন কথা বলছে। বারংবার সে তার যুক্তিগুলিকে বেভাজ করে দিচ্ছে, যেন সে নিজেকে যে অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে, তাকে গোপন করে রাখতে সক্ষম হয়। সক্রেটিস, তুমি এবং আমি ঠিক সেরূপই করতাম, যদি অসংগতির ভাবটিকে আমরা এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেতাম। বিচারালয়ের তর্কে এরূপ করা আমাদের যুক্তিসংগত হতে পারে। কিন্তু বন্ধুবর্গের আলোচনার ক্ষেত্রে কেউ নিজেকে এরূপভাবে শব্দের কারচুপির মাধ্যমে কেন প্রকাশ করবে?

    সক্রেটিস : ল্যাচেস, আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে তার এরূপ করা সংগত নয়। কিন্তু এমন তো হতে পারে যে, নিসিয়াস তার কথা গুরুত্ব সহকারেই বলছেন। শুধুমাত্র কথার জন্য তিনি কথা বলছেন না? আমরা বরঞ্চ তাকে কথার অর্থ ব্যাখ্যা করতে বলি, এবং তার পক্ষে যদি যুক্তি থাকে তা হলে আমরা তার সঙ্গে একমত হবো। তা যদি না হয়, তা হলে আমরাই তাকে পথ বাতলে দেব।

    ল্যাচেস : তোমার ইচ্ছা হয়, তুমি প্রশ্ন কর, সক্রেটিস। আমি তাকে যথেষ্টই প্রশ্ন করেছি।

    সক্রেটিস : হ্যাঁ, আমার না করার কোনো কারণ নেই এবং আমার প্রশ্ন আমাদের উভয়ের উদ্দেশ্যই সফল করবে।

    ল্যাচেস : আচ্ছা বেশ।

    সক্রেটিস : তা হলে নিসিয়াস, আপনি আমাকে বলুন। না, বরঞ্চ বলছি আপনি আমাদের বলুন। কেননা ল্যাচেস এবং আমি একই যুক্তির সঙ্গী। আপনি বলুন, সাহস বলতে আপনি কি আশা-আশঙ্কার হেতুর জ্ঞানকে বুঝাতে চেয়েছেন?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ আমি তাই বলছি।

    সক্রেটিস : এবং প্রত্যেকের এই জ্ঞান থাকা সম্ভব নয়? চিকিৎসক কিংবা ভবিষ্যদ্বক্তা এদের কেউ নিশ্চয় এ জ্ঞানে জ্ঞানী নয়। এবং এরূপ লোক সাহস অর্জন না করে সাহসী হতে পারে না–একথাই আপনি বলতে চাচ্ছিলেন?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, আমি তাই বলছিলাম।

    সক্রেটিস : তা হলে দেখা যাচ্ছে, এটি নিশ্চয়ই এমন কোনো বিষয় নয়, যা প্রবাদের ভাষায় ‘যে-কোনো শূকর’ জানতে পারে। সুতরাং যে-কেউই সাহসী হতে পারে না?

    নিসিয়াস : না, তা পারে না। আমি তাই মনে করি।

    সক্রেটিস : না, স্পষ্টতই তা পারে না। ক্রোসীয় শূকর অবশ্যই বিরাট। কিন্তু সেই বড় জন্তুকেও আপনি নিশ্চয়ই সাহসী বলবেন না। একথা আমি কোনো রহস্যাকারে বলছিনে। একথা আমি বলছি এজন্য যে, আপনার সাহসের তত্ত্বকে–অর্থাৎ ‘সাহস হচ্ছে আশা এবং ভীতির হেতু উপলব্ধি’-এই তত্ত্বকে যদি কেউ গ্রহণ করেন, তা হলে তার পক্ষে কোনো বন্য জন্তুকে সাহসী বলা সম্ভব হয় না। কেননা, সিংহ, ব্যাঘ্র, বন্যশূকর কিংবা অপর কোনো জন্তুকে সাহসী বলতে হলে বলতে হয় যে, এ সমস্ত জম্ভও এমন জ্ঞানের অধিকারী, সে-জ্ঞান অতি অল্প সংখ্যক মানুষেরই থাকা সম্ভব। এবং সেই জ্ঞানের জন্যই এ সমস্ত জন্তু সাহসী। আপনার তত্ত্বকে স্বীকার করলে বলতে হয় যে, সিংহ, হরিণ, মহিষ, বানর এদের কারোই সাহসী হওয়ার কোনো দাবি থাকতে পারে না।

    ল্যাচেস : সাবাস সক্রেটিস! অতি উত্তম বলেছ। এবং আমিও আশা করি, নিসিয়াস, তুমি দয়া করে বলবে, যে-সমস্ত জম্ভকে আমরা সকলে সাহসী বলে জানি, তারা মনুষ্য জাতির চেয়ে অধিক জ্ঞানী কি না? অথবা সর্বজনস্বীকৃত মতকে অস্বীকার করেও তুমি সাহসের সঙ্গে বলবে যে, এ সমস্ত জন্তু সাহসী নয়?

    নিসিয়াস : ল্যাচেস, যে-সমস্ত জন্তু অজ্ঞ হয়েও বিপদ সম্পর্কে ভীতিহীন তাদের আমি আদৌ সাহসী বলিনে। তাদের আমি বলি ভয়হীন এবং অচেতন। যেমন ধর ছোট্ট শিশু। তুমি কি মনে করতে পার যে, ছোট্ট শিশুকে আমি সাহসী বলব, যেহেতু সে বিপদ কাকে বলে জানে না এবং বিপদকে সে ভয় করে না। আমার দৃষ্টিতে সাহস এবং ভয়হীনতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমার মতে চিন্তাপূর্ণ সাহস এমন একটি গুণ, যে-গুণ খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু হঠকারিতা, ভয়হীনতা বা সাহসে কোনো পূর্ব-চিন্তার আবশ্যক হয় না। সেজন্য যত্রতত্র এ গুণটিকে পাওয়া যায়। পুরুষ, স্ত্রী, শিশু, পশু এদের অনেকের মধ্যেই তাই সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। তোমরা এবং সাধারণভাবে অপর সকলে। যাকে ‘সাহসী কাজ’ বল, আমি তাকে হঠকারিতা বলি। সাহসী কাজ হচ্ছে, সচেতন কাজ। ল্যাচেস; সক্রেটিস, তুমি অবলোকন কর, কী দক্ষতার সঙ্গে নিসিয়াস নিজেকে শব্দ সজ্জায় ভূষিত করছে এবং তারই মাধ্যমে সে সাহসী সব মানুষ এবং প্রাণীকে তাদের প্রাপ্য সাহসের সম্মান থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস পাচ্ছে।

    নিসিয়াস : ল্যাচেস, তুমি ভীত হয়ো না। তোমার সাহসকে আমি স্বীকার করতে সম্মত রয়েছি। তুমি, লামাকাস এবং অনেক এথেন্সবাসী আছে, যারা সত্যিই সাহসী এবং জ্ঞানী।

    ল্যাচেস : একথার জবাবও আমি দিতে পারতাম। কিন্তু আমি উগ্র স্বভাব এক্সেনীয় বলে পরিচিত হতে চাইনে বলে নিরস্ত হলাম।

    সক্রেটিস : ল্যাচেস আপনি ওঁর জবাব দিতে যাবেন না। আমার মনে হচ্ছে, আপনি তাঁর জ্ঞানের উৎস জ্ঞাত নন। নিসিয়াসের সব জ্ঞান আসছে তার বন্ধু ড্যামনের নিকট থেকে। ড্যামন হচ্ছে প্রডিকাসের সর্বক্ষণের সঙ্গী এবং সফিস্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রডিকাস হচ্ছে কূটতর্কে সর্বাধিক কৌশলী ব্যক্তি।

    ল্যাচেস : হ্যাঁ সক্রেটিস, এরূপ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মর বিচার বিশ্লেষণ সফিস্টকেই সাজে, যাকে এথেন্সনগরী তার রাষ্ট্রব্যবস্থার অধিনায়ক হিসাবে নির্বাচিত করেছে, তাকে নয়।

    সক্রেটিস : একথা সত্য, প্রিয় বন্ধু। কিন্তু বিরাট রাজনীতিজ্ঞের বিরাট বুদ্ধিও আবশ্যক। আমার মনে হয়, নিসিয়াসের সংজ্ঞার তাৎপর্যটা বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

    ল্যাচেস : বেশ, সে কাজ তুমি কর।

    সক্রেটিস : আমি সে কাজটি অবশ্যই করব, বন্ধুবর। কিন্তু আপনি মনে করবেন না, এ কাজের অংশীদারত্ব থেকে আপনাকে আমি বাইরে রাখব। কেননা আমি আশা করি, আপনিও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখবেন এবং সমস্যাটি আলোচনায় আমার সঙ্গে যোগদান করবেন। ল্যাচেস; তুমি যদি আমার জন্য সেটি উচিত মনে কর, তা হলে আমি সেরূপ করব।

    সক্রেটিস : হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। কিন্তু নিসিয়াস, আমার অনুরোধ, আপনি পুনরায় শুরু করুন। আপনার স্মরণ আছে, আমরা আলোচনার শুরুতে সাহসকে ন্যায়পরায়ণতার অংশ বলে বিবেচনা করেছি।

    [পেজ নাম্বার ‘২২৫’ মিসিং]

    রয়েছে। এবং এজন্যই আইনের বিধানেও ভবিষ্যদ্বক্তা হচ্ছে অধিনায়কের অধীন। কিন্তু অধিনায়ক ভবিষ্যদ্বক্তার অধীন নয়। ল্যাচেস, আমার একথা কি ঠিক নয়?

    ল্যাচেস : খুই ঠিক।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, আপনি কি মনে করেন যে, একটি বিজ্ঞানের একই বিষয়ের ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান সম্পর্কে জ্ঞান থাকে?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমার মতও তাই।

    সক্রেটিস : এবং সাহসকে আপনি ভীতি এবং আশার জ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন।

    নিসিয়াস : আমি তা করেছি।

    সক্রেটিস : কিন্তু ভয় বা আশা হচ্ছে ভবিষ্যৎ অমঙ্গল বা মঙ্গল?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, তাই।

    সক্রেটিস : এবং একটি বিজ্ঞান একই বিষয়ে ভবিষ্যৎ বা যে-কোনো বিষয়বস্তু হচ্ছে ভয় বা আশা। কেননা ভয় বা আশা হচ্ছে শুধুমাত্র ভবিষ্যতের বিষয়! সাহস যদি জ্ঞান বা বিজ্ঞান হয় তা হলে অপরাপর বিজ্ঞানের ন্যায় তাকে শুধু ভবিষ্যতের মঙ্গল অমঙ্গল নিয়ে চিন্তা করলে চলে না। তাকে অতীত, বর্তমান বা যে-কোনো সময়ের বিষয় নিয়েই চিন্তা করতে হয়।

    নিসিয়াস : আমার তাই বোধ হয়।

    সক্রেটিস : তা হলে নিসিয়াস, আপনি যে জবাব দিয়েছেন সেটি সাহসের সমগ্র সত্তা নিয়েই। কিন্তু আপনার বর্তমান মত অনুসারে সাহস শুধু ভীতি এবং আশারই জ্ঞান নয়, সাহস হচ্ছে সর্ব সময়ের মঙ্গল-অমঙ্গলের সৃষ্টি কীভাবে ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটবে তা হলে সে কি স্বয়ংসম্পূর্ণ, ত্রুটিহীন এবং সর্বগুণান্বিত হয়ে যায় না? ন্যায়বিচার, স্থৈর্য বা পবিত্রতা কোনো গুণেই তখন সে অপূর্ণ থাকে না। সব গুণের আধার হয়ে সে জানে, কোনটি বিপদ এবং কোনটি বিপদ নয়। এবং সে বিপদ প্রাকৃতিক বা অতি-প্রাকৃতিক, যাই হোক, তার বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করতে সে সক্ষম। মঙ্গলের নিশ্চয়তা বিধানেও সে সক্ষম। কেননা সে জানে দেবতা বা মানুষের, কার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা আবশ্যক।

    নিসিয়াস : সক্রেটিস, তোমার বক্তব্যে বহুল পরিমাণ সত্যতা রয়েছে বলেই আমার বোধ হচ্ছে।

    সক্রেটিস : কিন্তু নিসিয়াস, সাহসের এই নতুন সংজ্ঞা সাহসকে অংশ না করে সমগ্র ন্যায়পরতায় পরিণত করবে।

    নিসিয়াস : তাই মনে হচ্ছে।

    সক্রেটিস : কিন্তু আমরা মনে করেছিলাম যে, সাহস হচ্ছে ন্যায়পরতার একটি অংশ মাত্র।

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, আমরা সেইরূপ বলেছিলাম।

    সক্রেটিস : তা হলে সে কথাটি আমাদের বর্তমান কথার বিরোধী?

    নিসিয়াস : তাই দেখা যাচ্ছে।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, তা হলে সাহসকে আমরা এখনও আবিষ্কার করতে পারি নি?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, সত্য কথা।

    সক্রেটিস : আপনি নিজেও তাকে অংশ বলেছেন। কিন্তু অংশ শুধু একটি নয়। অংশ আরো রয়েছে। সব অংশ মিলে যে সমগ্র হয়েছে, তাকেই ন্যায়পরয়ণতা বলা হয়।

    নিসিয়াস : অবশ্যই।

    সক্রেটিস : আপনি কি অংশের প্রশ্নে আমার সঙ্গে একমত? কেননা, আমি মনে করি যে ন্যায়বিচার, ধৈর্য প্রভৃতি সব গুণই হচ্ছে ন্যায়পরয়ণতা এবং সাহসের অংশসমূহ। আপনিও কি এরূপই মনে করেন?

    নিসিয়াস : অবশ্যই।

    সক্রেটিস : উত্তম। তা হলে এ পর্যন্ত আমরা দুজনে একমত। সুতরাং আসুন আমরা আর এক পা অগ্রসর হই এবং ভীত এবং আশাপূর্ণ সম্পর্কেও ঐকমত্য হওয়ার চেষ্টা করি। এ বিষয়ে আপনি একরূপ চিন্তা করবেন এবং আমি ভিন্নরূপ মনে করব এটি আমার ইচ্ছা নয়। তা হলে আমি আমার মতটিকে প্রথমে প্রকাশ করি। আমি যদি ভ্রান্ত হই, আপনি তা হলে আমাকে সংশোধন করে দিবেন। আমার মতে ‘ভীত’ এবং ‘আশাপূর্ণ’ কথার অর্থ হচ্ছে, যা বর্তমান কিংবা অতীত নয় কিন্তু ভবিষ্যতের মঙ্গল-অমঙ্গলের আশা কিংবা আশঙ্কাকে সৃষ্টি করে তাই। ল্যাচেস, আপনি এ মতটি কি স্বীকার করেন না?

    ল্যাচেস : হ্যাঁ, সক্রেটিস, আমি এ মতটি সম্পূর্ণরূপেই স্বীকার করি।

    সক্রেটিস : নিসিয়াস, এটিই আমার মত। ভীতিপ্রদ বা ভীতিজনক বস্তু হচ্ছে ভবিষ্যতের অমঙ্গল। আশা হচ্ছে মঙ্গলের সম্ভাবনা। আপনি কি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত?

    নিসিয়াস : হ্যাঁ, আমি তোমার কথা স্বীকার করি।

    সক্রেটিস : এবং এ সমস্ত বিষয়ের জ্ঞানকেই আপনি সাহস বলছেন?

    নিসিয়াস : নির্দিষ্টভাবে আমি তাই বলি।

    সক্রেটিস : বেশ, এবার দেখা যাক, আপনি ল্যাচেস এবং আমার সঙ্গে একটি তৃতীয় বিষয়েও একমত কি না?

    নিসিয়াস : কী সে বিষয়?

    সক্রেটিস : বলছি। তার এবং আমার একটি মত হচ্ছে যে, জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের ব্যাপারে একথা বলা চলে না যে, অতীতের এক বিজ্ঞান, বর্তমানের অপর এক বিজ্ঞান এবং ভবিষ্যতের মঙ্গল-অমঙ্গলের অপর এক তৃতীয় বিজ্ঞান রয়েছে। আমাদের উভয়ের মতে সব নিয়ে বিজ্ঞান একটিই। দৃষ্টান্তস্বরূপ : স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে একটিই বিজ্ঞান; কৃষিকার্যের বিজ্ঞান সম্পর্কেও একই কথা। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের উৎপাদনের প্রশ্ন নিয়ে কৃষিবিজ্ঞান। অধিনায়কত্বের প্রশ্নটি যদি বিবেচনা করেন তা হলে এ বিষয়ে আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, অধিনায়কের অবশ্যই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উত্তম জ্ঞান রয়েছে। ভবিষ্যদ্বক্তার সে অধীনস্থ নয়, বরঞ্চ ভবিষ্যদ্বক্তাই তার অধীন। কেননা সামরিক অধিনায়ক ভবিষ্যদ্বক্তার চেয়ে উত্তমরূপেই জানে যুদ্ধক্ষেত্রে কী হার সম্ভাবনা

    নিসিয়াস : না, আমরা পারি না।

    ল্যাচেস : কিন্তু, বন্ধু নিসিয়াস, আমার জবাবে তুমি যেরূপ ঘৃণার ভাব দেখিয়েছিলে, তাতে আমি আশা করেছিলাম, সাহসকে তুমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে। ড্যামনের জ্ঞানের শলাকা তোমাকে কিছুটা আলোকিত করবে বলেই তো আমাদের বিশেষ ভরসা ছিল।

    নিসিয়াস : ল্যাচেস! আমি দেখতে পাচ্ছি, সাহস সম্পর্কে তোমার একমাত্র ইচ্ছা এটিই দেখা যে, আমিও তোমার ন্যায় অজ্ঞতা প্রকাশ করি কি না। কিন্তু আমি মনে করি, মারাত্মক বিষয় এই নয় যে, সবার যা জানা উচিত, আমরা দুজনই সমানভাবে সে বিষয়ে অজ্ঞ। তুমি জগতের অপর সকলের ন্যায়ই নিজের দিকে তাকাবার চেয়ে অপরের দুর্বলতাই অন্বেষণ কর। আমি মনে করি, আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা আমরা করেছি এবং কোনো মত যদি ত্রুটিপূর্ণভাবেও প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তা হলে তাকে ড্যামন এবং অপরাপর জ্ঞানীর সাহায্যেই সংশোধন করা সম্ভব। অবশ্য যে ড্যামনকে তুমি দেখ নি, তিনি তোমার হাসির পাত্র। এ বিষয়ে আমি নিজে যখন যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবো, তখন তোমাকেও আমি কিছু দান করতে পারব। কেননা, তোমার জ্ঞানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে বলেই বোধ হচ্ছে।

    ল্যাচেস : নিসিয়াস তুমি একজন দার্শনিক, সেকথা আমি জানি। তা হলেও লীসিম্যাকাস এবং মেলেসিয়াস যেন তাদের সন্ততির শিক্ষার জন্য আমাদের কাউকে উপদেষ্টা হিসাবে গ্রহণ না করেন। এ বিষয়ে আমি পূর্বেই বলেছি, এখনও বলছি, সক্রেটিসের নিকট থেকে জবাব না পেয়ে তারা যেন সক্রেটিসকে যেতে না দেন। আমার নিজের পুত্রগণ যদি যথেষ্ট বয়স্ক হতো তা হলে আমি নিজে তাদের সম্পর্কে সক্রেটিসের পরামর্শ গ্রহণ করতাম।

    নিসিয়াস : সক্রেটিস যদি তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত থাকে তা হলে তোমার এ প্রস্তাব সম্পর্কে আমি অবশ্যই একমত হবো। নাইসেরেটাসের শিক্ষক হিসাবে আমি অপর কারো কথা চিন্তা করতে পারিনে। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, বিষয়টি তার নিকট উল্লেখ করলে সক্রেটিস নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে অপর শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে। লীসিম্যাকাস, সে হয়তো আপনার কথা শুনতে সম্মত হবে।

    লীসিম্যাকাস : হ্যাঁ, নিসিয়াস, তার শুনা উচিত। কেননা আমি তার জন্য যে কাজ করব, অপর অনেকের জন্যই সে কাজ করতে সম্মত হবো না। সক্রেটিস, তুমি কি বলছ? এবার কি তুমি সম্মত হবে? তুমি কি এবার তরুণদের উন্নয়নের কার্যে আমাদের সাহায্য করবে?

    সক্রেটিস :লীসিম্যাকাস, বস্তুত কারো উন্নয়নেই আমার অসম্মত হওয়া অন্যায়। বর্তমান আলোচনা হতে যদি আপনি মনে করেন যে নিসিয়াস এবং ল্যাচেসের এ সম্পর্কে সেরূপ জ্ঞান নেই যেরূপ জ্ঞান আমার আছে, তা হলে আমাকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই যখন একই সংশয়ের মধ্যে রয়েছি, তখন আমাদের মধ্যে একের পরিবর্তে অপরকে আপনি এ দায়িত্ব কেন দিবেন? আমি মনে করি, কারো এরূপ করা উচিত নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে। আমি বরঞ্চ একটি পরামর্শ দিতে চাই। পরামর্শটি আমাদের নিজেদের বাইরে যাওয়া সংগত নয়। প্রিয় বন্ধুগণ! আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য হচ্ছে, সর্বপ্রথম তার নিজের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষকের অনুসন্ধান করা। কেননা, তরুণদের চেয়ে আমাদেরই শিক্ষাদাতার প্রয়োজন সমধিক। তারপরই মাত্র তরুণদের উন্নয়নের জন্য উত্তম শিক্ষক আমরা অনুসন্ধান করতে পারি। এ কার্যে অর্থ ব্যয়ে সঙ্কোচ কিংবা অপর কোনো চিন্তাকে আমাদের মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা নিজেদের উন্নতি সাধন না করে যেমন রয়েছি তেমন থাকব। এরূপ পরামর্শ আমি দিতে পারিনে। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে আমাদের বিদ্যালয়ে যেতে দেখে যদি কেউ পরিহাস করে, তা হলে আমি হোমারের বাণী উদ্ধৃত করে বলব :

    “গরজের ক্ষেত্রে সঙ্কোচ সংগত নয়।”

    সুতরাং আমাদের সম্পর্কে কী বলা হবে তাকে উপেক্ষা করে আসুন আমরা তরুণদের শিক্ষা দানই আমাদের আপন শিক্ষায় পরিণত করি।

    লীসিম্যাকাস : সক্রেটিস, তোমার প্রস্তাবটিকে আমি উত্তম মনে করি। এবং আমি যেমন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ, তেমনি তরুণদের সঙ্গে বিদ্যালয়ে যেতে সবচেয়ে আগ্রহান্বিত। তোমার প্রতি আমার একটি আবেদন : আগামী প্রত্যূষে তুমি আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত হও। তখন এ বিষয়টি নিয়ে আমরা পরস্পর পুনরায় আলোচনা করতে পারব। বর্তমানের জন্য এস আমরা প্রসঙ্গটির আলোচনা এখানে সমাপ্ত করি।

    সক্রেটিস : লীসিম্যাকাস, আপনার প্রস্তাবমতো আমি আগামী কল্য আপনার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হবো।…

    ⤶
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিসাশন – পিয়া সরকার
    Next Article সাত সাগরের মাঝি – ফররুখ আহমদ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }