Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফটিকচাঁদ – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প72 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৬

    এই পাঁচ দিনে ফটিক তার কাজ বেশ কিছুটা শিখে নিয়েছে। উপেনবাবু লোক ভাল হওয়াতে অবিশ্যি খুব সুবিধে হয়েছে। তিনি ফটিককে বারো টাকা মাইনে, থাকার জায়গা, আর খেতে দেবেন। এক মাসের মাইনে আগাম দিয়েছেন। উপেনবাবু যে লোক ভাল, সেটা ফটিক সত্যি করে বুঝেছে গতকাল। কাছেই একটা পানের দোকান থেকে উপেনবাবুর জন্য পান আনতে গিয়ে বিশু নামে আরেকটা পানের দোকানের ছেলের সঙ্গে ফটিকের আলাপ হয়। বিশুও সবে মাসখানেক হল কাজে ঢুকেছে। ঢোকার দু’দিনের মধ্যে সে একটা চায়ের কাপ ভাঙে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার একগোছা চুল মালিক বেণীবাবুর হাতে উঠে আসে, আর তারপরেই এক রাবুণে গাঁট্টার চোটে মাথায় আলু বেরিয়ে যায়। উপেনবাবু মারেন না। তিনি ধমক দেন, আর ধমকটা অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে, আর ক্রমে সেটা বদলে গিয়ে একঘেয়ে উপদেশ হয়ে যায়। এই উপদেশটা খেপে খেপে দিনের শেষ অবধি চলতে থাকে। দ্বিতীয় দিনে ফটিক যখন কাচের গেলাসটা ভাঙল, তখন উপেনবাবু প্রথমে মেঝেতে ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর ফটিক যখন টুকরোগুলো গামছায় তুলছে, তখন তিনি মুখ খুললেন—

    ‘কাচের জিনিসটা যে ভাঙলে, কিনতে পয়সা লাগে না? পয়সাটা দিচ্ছে কে? তুমি না আমি? এসব কথাগুলো কাজের সময় খেয়াল রেখো। কাজে ফুর্তি চাই ঠিকই, তার মানে এই নয় যে, হাতে গেলাস নিয়ে লাফাতে হবে। দোকানের জিনিসপত্তর হাতে নিয়ে ভোজবাজি করার জিনিস নয়।’

    উপদেশের কথাগুলো যে উপেনবাবু ঠিক শোনাবার জন্য বলেন তা নয়। দোকানের গোলমালের মধ্যেই ফটিক লক্ষ করেছিল ওঁর ভুরু কুচকোনো আর ঠোঁট দুটো নড়ছে। খদ্দেরের অর্ডার নিয়ে ওদিকে যেতে ওঁর দু-একটা কথা ফটিকের কানে এসে গেছিল। উপদেশ দেবার সময় উপেনবাবু কাজ থামান না, এটা ফটিক লক্ষ করেছে।

    দোকানে নতুন মুখ যে রোজ দেখা যায় তা নয়। বেশিরভাগই যারা আসে তারা রোজই আসে, আর তাদের খাবার সময়টা বাঁধা। শুধু সময় না, অর্ডারটাও বাঁধা। কেউ শুধু চা, কেউ চা-টোস্ট, কেউ চা-ডিম-টোস্ট—এইরকম আর কী। ডিম মানে হয় ডিম পোচ, না-হয় ডিমের মামলেট। কে কী অর্ডার দেয়, সেটা ফটিক এর মধ্যেই বুঝে ফেলতে শুরু করেছে। আজ সকালে সেই রোগা লিকলিকে লোকটা—যে ভীষণ দুঃখ-দুঃখ মুখ করে থাকে—সে এসে তিন নম্বর টেবিলে বসতেই ফটিক তার কাছে গিয়ে বলল, ‘চা আর মাখন-ছাড়া টোস্ট?’ লোকটা সেইরকমই দুঃখ-দুঃখ মুখ করে বলল, ‘চিনে ফেলেছিস এর মধ্যেই?’

    লোক চিনে রাখার মধ্যে ফটিক একটা বেশ মজা পেয়ে গেছে। তবে একটু সাবধানে চলতে হবে, কারণ আজই দুপুরে ও একটা ভুল করে বসেছিল। একজন হলদে শার্ট-পরা মোটা লোককে দেখে চেনা মনে করে যেই বলেছে, ‘চা আর ডবল ডিমের মামলেট?’—অমনই লোকটা হাতের খবরের কাগজ সরিয়ে ফটিকের দিকে ভুরু তুলে বলল, ‘তোর মর্জিমাফিক খেতে হবে নাকি?’

    যেটা ফটিকের সবচেয়ে ভাল লাগছে সেটা হল যে, কাপ-ডিশ নিয়ে চলাফেরাটা ওর ক্রমে সহজ হয়ে আসছে। হারুনদা বলেছিল, ‘দেখবি এসব আস্তে আস্তে কেমন সড়গড় হয়ে আসবে। তখন দেখবি কাজটা একেবারে নাচের ছকে বাঁধা হয়ে গেছে। আসলে এটাও একটা আর্ট। সেই আর্টটা যদ্দিন রপ্ত না হচ্ছে, তদ্দিন মাঝে মাঝে দু’-একটা করে জিনিসপত্তর ভাঙবেই।’

    হারুনদা রোজই বিকেলে একবার আসে। উপেনবাবুকে অবিশ্যি আসল ব্যাপার কিছু বলেনি। ফটিক হয়ে গেছে হারুনের দূর সম্পর্কের ভাই, মেদিনীপুরে থাকে, বাপ-মা কেউ নেই, এক খিটখিটে খুড়ো আছে, যে গাঁজা খায় আর ফটিককে ধরে বেধড়ক মারে। —‘দেখছেন উপেনদা—লোকটা স্রেফ খামচে দিয়ে কনুইয়ের ছাল-চামড়া তুলে দিয়েছে। মাথায় ফোলাটা দেখছেন?—চ্যালাকাঠের বাড়ি।’’ উপেনবাবুও এককথায় রাজি। যে ছেলেটি আছে, তাকে নাকি আর রাখা যাচ্ছে না। সে নাকি পর পর তিন দিন ফাঁকি দিয়ে হিন্দি ফিলিম দেখতে গিয়ে রাত করে ফিরে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে দোষ ঢাকতে গিয়েছিল।

    ফটিকের চেহারার বদল হয়েছে। তার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল কাটিয়ে ছোট করে দিয়েছে হারুনদা। তাতে অবিশ্যি ফটিক কোনও আপত্তি করেনি। চুল ছাঁটার পরে হারুনদা যখন ওকে একজোড়া নতুন হাফপ্যান্ট, দুটো শার্ট, দুটো হাত-কাটা গেঞ্জি আর একজোড়া চটি কিনে দিয়ে বলল, ‘কাজের সময় গেঞ্জি পরবি, তবে পরার আগে একটু চায়ের জলে চুবিয়ে শুকিয়ে নিবি’—তখন ফটিকের হঠাৎ কেন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। বোধহয় ‘কাজ’ কথাটা শুনে নিজেকে বড় মনে হওয়ার জন্যেই। কাজটা তার অভ্যেস হয়ে যাবে এটা ফটিক জানে। সকাল সাড়ে-আটটা থেকে রাত আটটা অবধি হপ্তায় পাঁচ দিন। শনিবার চারটে অবধি, আর রবিবার ছুটি। দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে উপেনবাবুর ছোট কাঠের ঘর, আর সেই ঘরের দরজার বাইরে টিনের ছাউনির তলায় ফটিকের নিজের শোবার জায়গা। প্রথম রাত মশার কামড়ে ঘুম হয়নি, তাই চাদরটা পা থেকে মাথা অবধি জড়িয়ে নিয়েছিল, কিন্তু নিশ্বাসের কষ্ট হওয়াতে বেশিক্ষণ সেভাবে থাকতে পারেনি। পরদিন উপেনবাবুকে বলাতে উনি একটা মশারি এনে দিলেন। তারপর থেকে ঘুম ভালই হচ্ছে। কনুইয়ের ঘা-টা শুকিয়ে এসেছে, মাথার ব্যথাটা মাঝে মাঝে চলে যায় আবার মাঝে মাঝে ফিরে আসে। যেটা একেবারেই ফিরে আসে না, সেটা হল—সে দিন সেই আকাশে তারা দেখার আগের ঘটনাগুলো। ও বুঝেছে, ও নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। হারুনদাও বলেছে যে, যে-জিনিসটা নেই, যেটা শুনি, সেটা নিয়ে ভাবা যায় না।’ মনে পড়লে আপনিই পড়বে রে ফটিক!’

    আসল মজা হয়েছিল গতকাল। গতকাল ছিল রবিবার। হারুনদা বলে দিয়েছিল, তাই ফটিক দোকানেই ছিল। হারুনদা এল দুটোর সময়, সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো একটা থলি। অনেক রংচঙে কাপড়ের টুকরো পাশাপাশি সেলাই করে তৈরি হয়েছে থলিটা। ফটিক হারুনের সঙ্গে উপেনবাবুর দোকান থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শহিদ মিনার।

    এরকম যে একটা জায়গা থাকতে পারে, সেটা ফটিক ভাবতেই পারেনি। মিনারের একটা দিকে মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এত মানুষ এক জায়গায় একসঙ্গে কী করতে পারে, সেটা ফটিকের মাথায় ঢুকল না। হারুন বলল, ‘মিনারের চুড়োয় যদি উঠতে পারতিস—তা হলে দেখতিস, এই ভিড়টার মধ্যে একটা নকশা আছে। দেখতিস ভিড়ের মাঝে মাঝে এক-একটা গোল চক্করের মতো ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকটার প্রত্যেকটাতে একটা কিছু ঘটছে, আর সেইটে দেখবার জন্য গোল হয়ে লোক দাঁড়িয়েছে।’

    ‘রোজ এত লোকের ভিড় হয় এখানে?’ ফটিক জিজ্ঞেস করল।

    ‘ওনলি সানডে’, বলল হারুন, ‘চ’ তোকে দেখাচ্চি। দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবি।’

    ফটিক দেখল বটে, কিন্তু বুঝল বললে একটু বেশি বলা হবে। এত বিরাট ব্যাপার সহজে বোঝা যায় না। এরকম কাজ, এত রকম খেলা, এতরকম ভাষা, এতরকম রং আর এতরকম শব্দ এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে যে, ফটিকের চোখ-কান-মাথা সব একসঙ্গে ধাঁধিয়ে গেল। শুধু যে খেলা হচ্ছে তা তো নয়। একটা দিকে কেবল জিনিস ফেরি হচ্ছে—দাঁতের মাজন, দাদের মলম, বাতের ওষুধ, চোখের ওষুধ, নাম-না-জানা শুকিয়ে যাওয়া শেকড়-বাকল, আর আরও কত কী। এক জায়গায় একটা টিয়াপাখি একগোছা কাগজের মধ্য থেকে একটা করে কাগজ ঠোঁট দিয়ে টেনে বার করে লোকের ভাগ্য বলে দিচ্ছে। একজন লোক কথার তুবড়ি ছেড়ে এক রকম আশ্চর্য সাবানের তারিফ করছে—-লোকটার মাথায় পাগড়ি, গায়ে খাকি প্যান্ট আর দু’-হাতে গোলাপি সাবানের ফেনা। একদিকে একটা লোক গলায় একটা ইয়া মোটা লোহার শিকল ঝুলিয়ে হাত-পা নেড়ে কী যেন বলছে, আর তার চারদিকের লোক হাঁ করে তার কথা শুনছে। তার কাছেই একটা সিমেন্ট-বাঁধানো জায়গার উপর পা ছড়িয়ে বসে একটা ভীষণ ময়লা কাপড়-পরা কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া-চুলো পাগলা-গোছের লোক লাল, কালো আর সাদা খড়ি দিয়ে আশ্চর্য সুন্দর দেব-দেবীর ছবি আঁকছে। লোক চারপাশ থেকে ছুড়ে ছুড়ে পয়সা ফেলছে, সেগুলো ঠং ঠং করে হনুমানের ল্যাজে, রামচন্দ্রের মুকুটে, রাবণের মাথার উপর পড়ছে, কিন্তু লোকটা সেগুলোর দিকে দেখছেই না।

    তবে এটা ফটিক দেখল যে, যেসব জিনিস হচ্ছে—তার মধ্যে খেলাটাই সবচেয়ে বেশি। কেবল একটা জিনিসকে ফটিক খেলা বলবে না কী বলবে ভেবেই পেল না—ফটিকের চেয়েও কয়েক বছরের ছোট একটি ছেলে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর মাথার চার পাশে মাটি চাপা দিয়ে বাতাস ঢোকার ফাঁকটাও বন্ধ করে দিয়েছে আরেকটি বাচ্চা ছেলে। এইভাবে ছেলেটা চিত হয়ে পড়ে আছে তো পড়েই আছে। ফটিক কিছুক্ষণ দেখে ঢোক গিলে বলল, ‘ও হারুনদা, ও যে মরে যাবে!’

    ‘এখানে কেউ মরতে আসে না রে ফটকে’, বলল হারুন,—‘এখানে আসে বাঁচতে। ও-ও বেঁচে যাবে। ও যা করছে, সেটা স্রেফ অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসে কী যে হয় সেটা খালিফ হারুনের খেলা দেখলে বুঝবি।’

    হারুন ওকে নিয়ে গেল ভিড়ের মধ্য দিয়ে, যেখানে ও আগে খেলা দেখাত, সেই জায়গায়। সেখানে এখন একটা মেয়ে খেলা দেখাচ্ছে। দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা। মাটি থেকে প্রায় সাত-আট হাত উঁচুতে টান করে বাঁধা দড়ির উপর দিয়ে দিব্যি এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যাচ্ছে মেয়েটা। ‘মাদ্রাজের মেয়ে’, বলল হারুনদা।

    আরেকটা জায়গায় একটা শূন্যে ঝোলানো লোহার রিং-এর গায়ে আট-দশটা জায়গায় আগুন জ্বলছে দেখে ফটিক হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘ওর ভিতর দিয়ে একটা লোক লাফাবে বুঝি?’

    হারুন হাঁটা থামিয়ে ওর দিকে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মনে পড়ে গেছে? তুই আগে দেখেছিস এ জিনিস?’

    ফটিক ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও পারল না। একটা আলো-বাজনা-ভিড় মেশানো ছবি এক মুহূর্তের জন্য ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেছে। এখন শুধু সামনে যা দেখতে পাচ্ছে, তাই।

    হারুন আবার এগিয়ে গেল, ফটিক তার পিছনে।

    যে জায়গাটায় হারুন খেলা দেখাবে সেখানে এখন কেউ নেই। ডান দিকে একটা ভিড়ের পিছন থেকে ডুগডুগির শব্দ আসছে, ফটিক মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে ভাল্লুকের কালো লোম দেখতে পেয়েছে। ডুগডুগি আর ঢোলক এখানে সব খেলাতেই বাজায়, কিন্তু হারুন থলি থেকে যেটা বার করল, সেটা দুটোর একটাও নয়। সেটা একটা বাঁশি; যেটার পিছন দিকটা সরু আর সামনের দিকটা চওড়া আর ফুল-কাটা। সাতবার পর পর ফুঁ দিল বাঁশিটায় হারুনদা। ফটিক জানে যে, সব শব্দ ছাপিয়ে বাঁশির শব্দ শোনা গেছে ময়দানের এ-মাথা থেকে ও-মাথা।

    এবার বাঁশিটা ওয়েস্ট-কোটের পকেটে রেখে হারুন একটা চিৎকার দিয়ে চমকে দিল ফটিককে।

    ‘ছু-ঊ-ঊ-ঊ-ঊ!
    ছু-ছু-ছু-ছু-ছু-ঊ-ঊ-ঊ!’

    এই এক ডাক আর বাঁশির আওয়াজেই এখান থেকে ওখান থেকে ছেলের দল ছুটে আসতে আরম্ভ করেছে হারুনের দিকে। তারা এসে দাঁড়াতেই হারুন একটা কান-ফাটানো তালি দিয়ে তিনবার পাক খেয়ে একটা ডিগবাজি আর একটা পেল্লায় লাফ দিয়ে তার আশ্চর্য লোক-ডাকার মন্ত্রটা শুরু করে দিল—

    ‘ছু-ছু-ছু-ছু-ছু-ঊ-ঊ-ঊ!
    ছু মন্তর যন্তর ফন্তর
    হর্‌ বিমারি দূর করন্তর
    সাত সমন্দর বারা বন্দর
    চালিস চুহা ছে ছুছুন্দর
    ছু-ঊ-ঊ-ঊ!’

    ‘ছু’ বলেই বাঁশিতে আরেকটা লম্বা ফুঁ দিয়ে, আরেকটা তালি আর আরেকটা ডিগবাজির পর আবার ধরল হারুনদা—

    ‘কাম্! কাম্! কাম্! কাম্!
    ‘কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
    কাম্ সি কাম্ সি চমকদারি
    হর্‌ কিস্‌ম্‌ কি জাদুকারি
    কলকত্তে কি খেল-খিলাড়ি
    লম্বি দাড়ি লং সুপারি
    কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
    কাম্ কামান্ডর ওয়ান্ডর ওয়ান্ডর
    জাগ্‌লর জোকার জাম্পিং ওয়ান্ডর
    ওয়ান্ডর খালিফ হারুন ওয়ান্ডর
    ভেল্‌কি ভেলকাম্‌ কাম্ কমাকম
    কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
    কাম-বয় গুড-বয় ব্যাড-বয় ফ্যাট-বয়
    হ্যাট-বয় কোট-বয় দিস-বয় দ্যাট-বয়
    কালিং অল-বয়, অল-বয় কালিং
    কালিং কালিং কালিং কালিং
    কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!

    বাপ্‌রে, ভাবল ফটিক, কী গলার জোর, কী লোক-ডাকার কায়দা!

    এরই মধ্যে বেশ লোক জমে গেছে হারুনদাকে ঘিরে। হারুন তার থলি থেকে একটা চকরা-বকরা আসন বার করে ঘাসের উপর বিছাল। তারপর তার উপর বসে থলিতে যা কিছু খেলার সরঞ্জাম ছিল, সব একে একে বার করে নিজের দু’পাশে সাজিয়ে রাখল।

    ফটিক দেখল, চারটে নকশা-করা ঝকঝকে পিতলের বল, দুটো প্রকাণ্ড লাট্টু, তার জন্য মানানসই লেত্তি, তিন-চারটে লাল নীল পালক লাগানো বাঁশের কঞ্চি, পাঁচরকম নকশা-করা টুপি—যার একটা হারুনদা মাথায় পরে নিল। ফটিক এতক্ষণ হারুনকে জিনিস সাজিয়ে রাখতে সাহায্য করছিল, এবার হারুন বলল, ‘তুই ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়া, এক-একটা খেলা যেই শেষ হবে, অমনই তালি দিবি।’

    প্রথম দুটো খেলার পর ফটিকই তালি শুরু করল, তারপর অন্যরা দিল। তিন নম্বর খেলা থেকে ফটিককে আর ধরিয়ে দেবার দরকার হয়নি। সত্যি বলতে কী, সে হারুনের কাণ্ড-কারখানা দেখে এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, তালি দেবার কথা আর মনেই ছিল না। শুধু হাতেরই যে কায়দা, তা তো নয়। হারুনের কোমর থেকে উপরের সমস্ত শরীরটাই যেন জাদু। নমাজ-পড়ার মতো করে গোড়ালির উপর বসে অতবড় লাট্টুটায় দড়ি পেঁচিয়ে সেটাকে সামনের দিকে ছুড়ে লেত্তি ফুরোবার ঠিক আগে পিছন দিকে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে সেটা যে কী করে শূন্য দিয়ে ঘুরে এসে আবার হারুনদারই হাতের তেলোয় পড়ছিল—বারবার ঠিক একই ভাবেই একই জায়গায় পড়ছিল—সেটা ফটিকের মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। আর সেখানেই তো শেষ না! লাট্টুটা হাতের তেলো থেকে ওই পালক-লাগানো কাঠির মাথায় বসিয়ে দিল হারুনদা, আর ওই বোমা লাট্টুটা ঘুরতে লাগল ওই পেনসিলের মতো সরু কাঠিটার মাথায়। ফটিক ভাবল এটাই বুঝি খেলার শেষ, এখানেই বুঝি হাততালি দিতে হবে, কিন্তু ওমা—হারুনদা মাথা চিত করে ঘুরন্ত লাটু সমেত কাঠিটা বসিয়ে দিয়েছে ওর থুতনির ঠিক মাঝখানে! তারপর হাত সরিয়ে নিতে লাটুর সঙ্গে সঙ্গে কাঠিটাও ঘুরতে লাগল থুতনির উপর দাঁড়িয়ে—আর সেই সঙ্গে তার গায়ে লাগানো রঙিন পালকগুলো। তারও পরে ফটিক অবাক হয়ে দেখল যে, কাঠিটা আবার মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ঘুরছে, কিন্তু লাট্টুটা ঘুরে চলেছে একটানা।

    ফটিকচাঁদ - অধ্যায় ৬

    পিতলের বলের খেলায় আরও বেশি হাততালি পেল হারুন। দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার বল-এ চলে গেল জাগ্‌লিং দেখাতে দেখাতে। বিকেলের রোদে এমনিতেই বলগুলো ঝলমল করে উঠছে; সেগুলো থেকে আবার আলো ঠিকরে বেরিয়ে হারুনের মুখে পড়াতে মনে হচ্ছে, যেন তার মুখ থেকেই বারবার আলো বেরুচ্ছে।

    সূর্য ডুবে যাওয়া অবধি খেলা চলল। শেষের দিকে পাশের খেলা থেকে অনেক লোক চলে এসেছিল হারুনের খেলা দেখতে। ফটিক অবাক হয়ে দেখছিল বাচ্চারা পর্যন্ত কীরকম পয়সা ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে হারুনের চার পাশে। হারুন কিন্তু খেলার সময় সেগুলোর দিকে দেখছেই না। খেলার শেষে ফটিককে ডেকে বলল, ‘ওগুলো তোল তো।’

    হারুন যতক্ষণে তার ভোজবাজির সরঞ্জাম থলিতে তুলেছে, তার আগেই ফটিকের পয়সা তোলা হয়ে গেছে। গুনে হল আঠারো টাকা বত্রিশ পয়সা। থলি কাঁধে ঝুলিয়ে হারুন বলল, ‘চল্‌, আজ তোকে খাওয়াব—পাঞ্জাবি রুমালি রুটি আর তরখা। নিঘ্‌ঘাৎ এ জিনিস তুই কোনও দিন খাসনি। তারপর মিষ্টি কী খাওয়া যায় সেটা তখন ভেবে দেখা যাবে।’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপুর পাঁচালি – সত্যজিৎ রায়
    Next Article গল্প ১০১ – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }