Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফরওয়ার্ড দ্য ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    নাজমুছ ছাকিব এক পাতা গল্প493 Mins Read0

    ৩.১ ডর্স ভেনাবিলি

    তৃতীয় পর্ব : ডর্স ভেনাবিলি

    ভেনাবিলি, ডর্স–হ্যারি সেলডনের পুরো জীবনটাই অনিশ্চয়তা আর অসংখ্য লৌকিক উপাখ্যানে ভরপুর, আর এই কারণেই তার এমন একটা জীবনী তৈরি করার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ যে জীবনীতে বাস্তব তথ্য সংকলিত করা যাবে। সম্ভবত সেলডনের জীবনের সবচাইতে দুর্বোধ্য অংশ হচ্ছে, ডর্স ডেনাবিলির সাথে তার সম্পর্ক। ডর্স ভেনাবিলির সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু এইটুকুই জানা গেছে যে তার জন্ম সিনায়, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপনা করার জন্য স্ট্রিলিং-এ আসে। কিছুদিন পরেই হ্যারি সেলডনের সাথে তার দেখা হয় এবং আঠাশ বছর সেলডনের সঙ্গিনী হিসেবে বাস করে। সত্যি কথা বলতে কি তার জীবনটাও সেলডনের জীবনের মতো কিংবদন্তীময়। তার গতি এবং শারীরিক শক্তি নিয়ে অসংখ্য গল্প দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। তাকে আঁড়ালে ডাকা হতো, “দ্য টাইগার ওমেন।” তার চলে যাওয়াটা আরো বেশী দুর্বোধ্য এবং রহস্যময়। কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কি ঘটেছে সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র তথ্যও নেই। ইতিহাসবিদ হিসেবে তার যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়

    –এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা

    .

    ১.

    ওয়ানডার বয়স এখন প্রায় আট, গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী–সবার ক্ষেত্রেই এভাবে হিসাব করা হয়। ইতিমধ্যেই সে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সংযত আচরণ, মসৃণ লম্বা হালকা বাদামী চুল। চোখের রং নীল হলেও ক্রমশই তা গাঢ় বর্ণ ধারণ করছে এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো তার বাবার মতো বাদামীতে গিয়ে ঠেকবে।

    গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে আছে ওয়ানডা।–ষাট।

    এই সংখ্যাটাই তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কয়েকদিন পরেই দাদুর জন্মদিন এবং সেটা হবে ষাটতম–ষাট অনেক বড় সংখ্যা। ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে কারণ এই নিয়ে সে খারাপ একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে।

    মাকে খুঁজতে লাগল। জিজ্ঞেস করা দরকার।

    মাকে খুঁজে পাওয়া খুব একটা কঠিন হলো না। দাদুর সাথে কথা বলছে নিশ্চয়ই জন্মদিনের ব্যাপারে। ইতস্ততঃ করতে লাগল ওয়ানডা। দাদুর সামনে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।

    ওয়ানডা যে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত সেটা বুঝতে তার মায়ের কোনো সমস্যা। হলো না। সে বলল, “এক মিনিট, হ্যারি, আগে দেখি ওয়ানডা এমন করছে কেন। কি হয়েছে, সোনা?”

    ওয়ানডা মায়ের হাত টেনে ধরল। “এখানে না, মা। ব্যক্তিগত।”

    হ্যারি সেলডনের দিকে ঘুরল মানীলা। “দেখলেন কত তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যায়? ব্যক্তিগত জীবন। ব্যক্তিগত সমস্যা। নিশ্চয়ই, ওয়ানডা। তোমার ঘরে গেলে কেমন হয়?”

    “হ্যাঁ, মা।” ওয়ানডার চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠল।

    হাত ধরাধরি করে দুজন চলে গেল। তারপর মানীলা জিজ্ঞেস করল, “এবার বল সমস্যাটা কি, ওয়ানডা?”

    “ব্যাপারটা দাদুকে নিয়ে, মা।”

    “দাদু! তোমাকে বিরক্ত করার মতো কিছু করতে পারেন তিনি আমার তা মনে হয় না।”

    “কিন্তু করেছেন।” হঠাৎ করেই ওয়ানডার দুচোখ পানিতে ভরে উঠল। “দাদু কি মারা যাচ্ছেন?”

    “তোমার দাদু? এই চিন্তাটা তোমার মাথায় কে ঢোকাল?”

    “বয়স ষাট হচ্ছে। অনেক বুড়ো।”

    “না। বয়স কম না এটা ঠিক আবার বুড়োও বলা যাবে না। মানুষ আশি, নব্বই এমনকি একশ বছরও বাঁচে–আর তোমার দাদু যথেষ্ট সুস্থ সবল। তিনি আরো বেশীদিন বাঁচবেন।”

    “সত্যি?” নাক দিয়ে শ্বাস টানল সে।

    মানীলা তার মেয়ের দুধ শক্ত করে ধরে সরাসরি চোখের দিকে তাকাল, “আমরা সবাই একদিন মারা যাব, ওয়ানডা। ব্যাপারটা তোমাকে আমি বুঝিয়ে বলেছি। যাই হোক, সেই একদিনটা না আসা পর্যন্ত আমরা মাথা ঘামাব না। তুমি বড় হয়ে নিজের বাচ্চা কাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তোমার দাদু বেঁচে থাকবেন। দেখে নিও। এবার চলল আমার সাথে। আমি চাই তুমি দাদুর সাথে কথা বলবে।”

    আবারো নাক টানল ওয়ানডা।

    অসীম স্নেহ নিয়ে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকালেন সেলডন। বললেন, “কি হয়েছে, ওয়ানডা? মন খারাপ কেন?”

    ওয়ানডা মাথা নাড়ল।

    মেয়ের মায়ের দিকে তাকালেন সেলডন। “কি হয়েছে, মানীলা?”

    মানীলাও মাথা নাড়ল। “ও নিজেই আপনাকে বলবে।”

    বসলেন সেলডন। কোলের উপর হালকা চাপড় মেরে বললেন, “এসো, ওয়ানডা। এখানে বসে তোমার সমস্যা আমাকে বল।”

    মেনে নিল সে, খিলখিল করে একটু হাসল ও, “আমি ভয় পেয়েছি।”

    “বুড়ো দাদু থাকতে ভয়ের কিছু নেই।”

    মুখ বাঁকা করল মানীলা। “ভুল শব্দ।”

    তার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন সেলডন। “দাদু!”

    “না। বুড়ো।”

    এই কথাতেই বোধহয় বাধ ভেঙ্গে পড়ল। জোরে কেঁদে উঠল ওয়ানডা। “তুমি বুড়ো হয়ে গেছ, দাদু।”

    “তাই তো মনে হয়, আমার বয়স এখন ষাট।” মাথা নামিয়ে ওয়ানডার কানে কানে বললেন, “আমারও পছন্দ হচ্ছে না, ওয়ানডা। সেজন্যই আমি খুশি যে তোমার বয়স মাত্র সাত থেকে আট হতে চলেছে।”

    “তোমার সব চুল সাদা, দাদু।”

    “সবসময় এমন ছিল না। মাত্র কিছুদিন আগে সাদা হয়েছে।”

    “সাদা চুলের অর্থ তুমি মারা যাচ্ছ দাদু।”

    সেলডনকে মর্মাহত দেখাল। মানীলাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলছে এসব?”

    “আমি জানি না, হ্যারি। সবটাই ওর নিজের ধারণা।”

    “আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।” ওয়ানডা বলল।

    কেশে গলা পরিষ্কার করলেন সেলডন। “আমরা সবাই যখন তখন দুঃস্বপ্ন দেখি, ভালো যে আমরা দেখি। দুঃস্বপ্ন আমাদের দুঃশ্চিন্তাগুলোকে দূর করে দেয় বলেই তো আমরা বেঁচে থাকতে পারি।”

    “স্বপ্নটা ছিল তোমার মৃত্যু নিয়ে, দাদু।”

    “আমি জানি। আমি জানি। মৃত্যু নিয়ে দুঃস্বপ্ন হতেই পারে কিন্তু সেটাকে গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। আমাকে দেখ। দেখছ না আমি কেমন সুস্থ–হাসিখুশি আর হাসছি? দেখে কি মনে হয় আমি মারা যাচ্ছি? বল।”

    “ন্‌-না।”

    “এইতো বুঝতে পেরেছ। এখন গিয়ে খেলা কর আর পুরো ব্যাপারটা ভুলে যাও। কয়েকদিন পরেই আমার জন্মদিন। সবাই অনেক আনন্দ করবে। যাও।”

    উৎফুল্ল মন নিয়ে চলে গেল ওয়ানডা, কিন্তু মানীলাকে থাকার জন্য ইশারা করলেন সেলডন।

    .

    ২.

    সেলডন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি মনে হয়, এই ধারণাটা ওয়ানডা কোথায় পেয়েছে?”

    “বাদ দিন, হ্যারি। ওর একটা সালভানিয়ান টিকটিকি ছিল, সেটা মরে গেছে, মনে আছে? তার এক বন্ধুর বাবা দুর্ঘটনায় মারা যায় আর হলোভশনে সবসময়ই মৃত্যু দেখছে। আজকাল বাচ্চাদের কাছ থেকে মৃত্যুর ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। আর আমি সেটা চাইও না। মৃত্যু জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ; এটা তাকে বুঝতে হবে।”

    “আমি সবার মৃত্যুর কথা বলছি না, মানীলা। আমি আমার নিজের মৃত্যুর কথা বলছি। এই চিন্তাটা ওর মাথায় ঢুকল কিভাবে?”

    ইতস্ততঃ করতে লাগল মানীলা। হ্যারি সেলডনকে সে ভীষণ পছন্দ করে। সে ভাবল, কে পছন্দ না করে, কাজেই কথাটা কীভাবে বলি।

    আবার নাইবা বলে কীভাবে? কাজেই বলল, “হ্যারি, আপনি নিজেই ওর মাথায় চিন্তাটা ঢুকিয়েছেন।”

    “আমি?”

    “অবশ্যই, গত একমাস ধরে অনবরত বলছেন যে আপনার বয়স ষাট হয়ে গেছে আর সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে অভিযোগ করছেন যে বুড়ো হয়ে গেছেন। শুধুমাত্র এই কারণেই সবাই মিলে পর্টির ব্যবস্থা করছে, আপনাকে খুশি করার জন্য।”

    “ষাট বছরে পা দেয়াটা হাসির কোনো ব্যাপার নয়,” সেলডন রাগের সুরে বললেন। “অপেক্ষা কর! অপেক্ষা কর! নিজেই বুঝবে।”

    “বুঝব–যদি ভাগ্যে থাকে। অনেক মানুষই ষাট বছর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। যাইহোক, সবসময়ই যদি ষাট বছরের কথা আর বুড়ো হয়ে গেছি বলেন তাহলে বাচ্চা একটা মেয়ে তো ভয় পাবেই।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। “দুঃখিত। কিন্তু মেনে নেয়া কঠিন। আমার হাতের দিকে দেখ। ভাজ পড়ে যাচ্ছে, এবং কিছুদিনের মাঝেই শিরা-উপশিরা বেরিয়ে পড়বে। এখন আর আগের মতো খালি হাতে মারামারি করতে পারি না। যে কোনো বাচ্চাই আমাকে কাবু করে ফেলতে পারবে।”

    “অন্যান্য ষাট বছর বয়সীদের সাথে আপনার পার্থক্যটা কোথায়? কিন্তু অন্তত আপনার মাথা তো এখনো কাজ করছে। আপনি নিজেই কতবার বলেছেন যে ওটাই আসল ব্যাপার।”

    “জানি। কিন্তু আমি আমার পুরনো শরীরটা খুব মিস করছি।”

    মানীলা সামান্য একটু ঠাট্টার সুর মিশিয়ে বলল, “বিশেষ করে যেখানে ডর্সের। বয়স বাড়ছে না মোটেই।”

    “তাই হবে বোধহয়-” অস্বস্তির সাথে বললেন সেলডন। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন এই ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ।

    শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আছে মানীলা। সমস্যা হচ্ছে মানুষটা বাচ্চাদের ব্যাপারে কিছুই জানে না–অথবা বলা ভালো যে মানুষের ব্যাপারেই কিছু জানে না। বিশ্বাস করা কঠিন যে আগের সম্রাটের অধীনে তিনি দশ বছর ফার্স্ট মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন অথচ মানব চরিত্রের কিছুই জানেন না।

    অবশ্য তার ধ্যানধারণা জুড়ে রয়েছে সাইকোহিস্টোরি যা কোয়াড্রিলিয়ন মানুষ নিয়ে কাজ করে, এক হিসাবে যার অর্থ দাঁড়ায় তিনি আসলে কোনো মানুষ নিয়ে কাজ করেন না। অন্তত এককভাবে। আর বাচ্চাদের ব্যাপারটা তিনি কিভাবে বুঝবেন যেখানে রাইখ ছাড়া তার কোনো সন্তান নেই। তাছাড়া রাইখের বারো বছর বয়সে তিনি তাকে পোষ্য নিয়েছিলেন। এখন দেখছেন ওয়ানডাকে, যে তার কাছে বিশাল এক রহস্য–হয়তো তাই থেকে যাবে।

    অসীম মমতা নিয়ে কথাগুলো ভাবল মানীলা। চারপাশের যে জগত্তাকে বুঝতে পারেন না সেই জগৎ থেকে সেলডনকে রক্ষা করার একটা অদম্য আকাক্ষা রয়েছে তার। এই একটা ক্ষেত্রেই তার এবং শ্বাশুড়ী, ডর্স ভেনাবিলির মিল এবং সংঘাত হ্যারি সেলডনকে রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা।

    দশ বছর আগে মানীলা সেলডনের জীবন বাঁচিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার, ডর্স ঘটনাটাকে ধরে নিয়েছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্যের উপর হস্তক্ষেপ এবং মানীলাকে কোনোদিনই ক্ষমা করে নি।

    প্রতিদান হিসেবে মানীলার জীবন বাঁচিয়েছেন সেলডন। চোখ বন্ধ করতেই পুরো দৃশ্যটা পরিষ্কার ফুটে উঠল। যেন তার সামনে এই মুহূর্তেই ঘটনাগুলো ঘটছে।

    .

    ৩.

    ক্লীয়ন হত্যাকাণ্ডের পরের সপ্তাহ–জঘন্য এক সপ্তাহ। পুরো ট্রানটরের অরাজকতা ছিল সীমার বাইরে।

    হ্যারি সেলডন তখনো ফার্স্ট মিনিস্টার হিসেবে অফিসে বসছেন, তবে তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। মানীলা ডুবানকুয়াকে একদিন অফিসে ডাকলেন।

    “আমার এবং রাইখের জীবন বাঁচানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সুযোগ করে উঠতে পারি নি।” তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে গত সপ্তাহে কোনো কিছু করারই সুযোগ ছিল না আমার।”

    “পাগল গার্ডেনারের ভাগ্যে কি ঘটেছে?” জিজ্ঞেস করল মানীলা।

    “মেরে ফেলা হয়েছে! সাথে সাথে! বিনা বিচারে! লোকটা পাগল এই কথা বলে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। যদি সে অন্য কিছু করত, অন্য কোনো অপরাধ করত, তার পাগলামী প্রমাণ করা যেত এবং হয়তো বেঁচে থাকত। কিন্তু সম্রাটকে খুন করা–“ বিষণ্ণ ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন সেলডন।

    “এখন কি হবে, ফাস্ট মিনিস্টার?”

    “আমার ধারণাটা তোমাকে বলি। এ্যানটান রাজবংশ শেষ হয়ে গেছে। ক্লীয়নের ছেলে ক্ষমতায় বসতে রাজী হবে না বোধহয়। নিজেও খুন হয়ে যাওয়ায় ভয় পাচ্ছে। সেজন্য তাকে দোষ দেয়া যায় না। তার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোর কোনো একটায় পারিবারিক জমিদারীতে নিরুপদ্রব জীবন কাটানো। ইম্পেরিয়াল হাউজের সদস্য বলে তার কোনো সমস্যা হবে না। তোমার আর আমার ভাগ্য অতটা ভালো নাও হতে পারে।”

    মানীলা ভুরু কোঁচকালো। “কেন, স্যার?”

    কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন সেলডন। “এমন একটা কথা উঠার সম্ভাবনা আছে যে, তুমি যেহেতু গ্লেব এডোরিনকে হত্যা করেছ সে তার ব্লাস্টার ফেলে দেয় এবং ম্যান্ডেল বারের জন্য তা সহজলভ্য হয়ে উঠে। ওই একই অস্ত্র দিয়েই বার সম্রাটকে খুন করে। কাজেই অপরাধটা ঘটার পিছনে তোমারও বড় একটা অবদান রয়েছে এবং এমনকি এই কথাও বলা হতে পারে যে পুরো ঘটনাটাই ছিল পূর্বপরিকল্পিত।”

    “কিন্তু সেটা হাস্যকর। আমি সিকিউরিটি এস্টাবলিশম্যান্টের সদস্য, শুধু দায়িত্ব পালন করেছি–যা আদেশ দেয়া হয়েছে তাই করেছি।”

    বিষণ্ণ ভঙ্গীতে হাসলেন সেলডন। “তুমি যুক্তিসহকারে কথা বলছ কিন্তু আগামী অনেকদিন যুক্তি কোনো কাজে আসবে না। বৈধ উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতিতে এখন যা ঘটবে তা হলো সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য।”

    (পরবর্তী বছরগুলোতে, যখন মানীলা সাইকোহিস্টোরির কার্য পদ্ধতি কিছুটা বুঝতে শিখেছে, অবাক হয়ে ভেবেছে যে কি ঘটতে চলেছে তা বোঝার জন্য সেলডন এই কৌশলটা ব্যবহার করেছিলেন কিনা, কারণ সত্যিই সামরিক শাসন জারি হয়। যদিও ওই মুহূর্তে বিষয়টা নিয়ে তিনি একটা কথাও বলেন নি।)

    “যদি সামরিক শাসন জারি হয়,” তিনি বলে যাচ্ছেন, “তখন খুব দ্রুত কঠিন শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার দরকার হবে। যে কোনো ধরনের অসন্তোষ শক্ত হাতে দমন করতে হবে, দৃঢ় মনোবল এবং নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে হবে, যুক্তিবোধ এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হলেও। ওরা যদি তোমাকে সম্রাটকে খুন করার চক্রান্তে জড়িত বলে অভিযুক্ত করে, তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে নয় বরং ভয় দেখিয়ে জনগণকে দমিয়ে রাখার জন্য।

    “একইভাবে ওরা এই কথা বলতে পারে যে আমিও ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। হাজার হোক, গার্ডেনারদের স্বাগত জানাতে আমি উপস্থিত ছিলাম, যদিও দায়িত্বটা আমার ছিল না। যদি না যেতাম, আমাকে হত্যা করার কোনো প্রচেষ্টা হতো না, তোমাকে পাল্টা আঘাত করতে হতো না, এবং সম্রাট হয়তো বেঁচে থাকতেন বুঝতে পেরেছ কি বলছি?”

    “বিশ্বাসই হচ্ছে না ওরা এমন করবে।”

    “করবে না হয়তো। আমি একটা প্রস্তাব দেব যা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওরা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।”

    “কি সেটা?”

    “আমি ফাস্ট মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার প্রস্তাব দেব। আমাকে ওদের দরকার নেই, কাজেই আমি চলে যাব। তবে কথা হচ্ছে, ইম্পেরিয়াল কোর্টে আমার সমর্থন ব্যাপক, আউটারওয়ার্ল্ডগুলোর জনগণ আমাকে পছন্দ করে। যদি ইম্পেরিয়াল গার্ডের সদস্যরা আমাকে পদত্যাগে বাধ্য করে, তারপর যদি ওরা আমার মৃত্যুদণ্ড নাও দেয়, তবুও বিপদে পড়বে। কিন্তু যদি আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করি এবং বিবৃতি দিয়ে বলি যে এখন আসলে ট্র্যানটর এবং এম্পায়ারের জন্য সামরিক শাসনই উত্তম তাহলে বরং ওদের উপকারই করব।”

    তারপর খানিকটা আমুদে সুরে বললেন, “তাছাড়া সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারটা আছে।”

    (এই প্রথমবারের মতো শব্দটা শুনল মানীলা।)

    “সেটা কি জিনিস?”

    “বিষয়টা নিয়ে আমি গবেষণা করছি। সাইকোহিস্টোরির ক্ষমতার উপর ক্লীয়নের ছিল সীমাহীন বিশ্বাস–সত্যি কথা বলতে কি আমার চেয়েও বেশী এবং ইম্পেরিয়াল কোর্টের অনেকেই মনে করে যে সাইকোহিস্টোরি হচ্ছে বা হতে পারে প্রচণ্ড কার্যকরী এক হাতিয়ার যা সরকারের অনুকূলে ব্যবহার করা যাবে–সেটা যে ধরনের সরকারই হোক না কেন।

    “এই বিজ্ঞানের বিস্তারিত না জানাটা কোনো বিষয় নয়। আমি জানাতে চাইও না। জ্ঞানের স্বল্পতাই পরিস্থিতির উপর অন্ধবিশ্বাস তৈরি করবে। আর তাই ওরা আমাকে গবেষণা চালিয়ে যেতে দেবে। অন্তত আমি তাই আশা করি। আর এখানেই তোমার কথা আমার মনে পড়ল।”

    “আমার কোন কথা?”

    “ওদের সাথে চুক্তির শর্ত হবে এটাই যে তোমাকে সিকিউরিটি এস্টাবলিশম্যান্ট থেকে পদত্যাগ করতে দিতে হবে এবং হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট করে তোমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। এটা আমি আদায় করে নিতে পারব।”

    “কিন্তু আপনি যা বলছেন তাতে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে।”

    “তোমার ক্যারিয়ার, যেভাবেই হোক, শেষ হয়ে গেছে। ধরা যাক ইম্পেরিয়াল গার্ড তোমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিল না, কিন্তু তুমি কি মনে কর যে ওরা তোমাকে সিকিউরিটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে দেবে?”

    “তাহলে আমি কি করব? জীবন চলবে কেমন করে?”

    “সেই দায়িত্ব আমার, মিস, ডুবানকুয়া। আমি স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিপুল পরিমাণের আর্থিক সহায়তা পাব সাইকোহিস্টোরি গবেষণার জন্য। তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেয়া কোনো সমস্যাই না।”

    বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মানীলা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেন-”

    সেলডন বললেন, “তুমি যে প্রশ্নটা করেছ আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তুমি রাইখের এবং আমার জীবন বাঁচিয়েছ। কেমন করে ভাবলে যে সেই ঋণ আমি শোধ করার চেষ্টা করব না?”

    তিনি যেমন বলেছিলেন সেভাবেই হলো সব কিছু। জাকজমকের সাথে দশ বছর ধরে পালনকৃত দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিলেন সেলডন। সবেমাত্র গঠিত সামরিক সরকার–আর্মড ফোর্স এবং ইম্পেরিয়াল গার্ডের বিশেষ কিছু অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত জান্তার কাছ থেকে বিশাল এক প্রশংসাপত্রও পেলেন। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলেন তিনি এবং মানীলা ডুবানকুয়া, সিকিউরিটি অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়ে সেলডন আর তার পরিবারের সাথে এল।

    .

    ৪.

    রাইখ কামরায় ঢুকল, গরম নিশ্বাস দিয়ে হাত উষ্ণ করার চেষ্টা করছে। আমি সবসময়ই বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ার পক্ষে। গম্বুজের ভেতরে পরিবেশ সবসময় একরকম থাকলে নিশ্চয়ই কারো ভালো লাগবে না। যদিও আজকে ওরা একটু ঠাণ্ডা এবং বায়ু প্রবাহ নির্ধারণ করেছে। আমার মনে হয় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অভিযোগ তোলাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

    “আমি ঠিক নিশ্চিত নই এটা আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের দোষ কিনা।” সেলডন বললেন। “আসলে সবকিছুই এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।”

    “আমি জানি। অবক্ষয়,” হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গোঁফ আঁচড়াল রাইখ। কাজটা সে প্রায়ই করে। সম্ভবত কয়েকদিন ওয়িতে গোঁফবিহীন থাকাটা ভুলতে পারছে না। শরীরের মধ্যভাগ খানিকটা স্ফীত হয়েছে রাইখের। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখী গৃহকর্তা। এমনকি তার ডাল বাচনভঙ্গীও দূর হয়ে গেছে।

    পাতলা কভারঅল খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, “ওল্ড বার্থডে বয়, কেমন আছ?”

    “ভোলোর চেষ্টা করছি। অপেক্ষা কর, মাই সন। কিছুদিনের মধ্যেই তোমার চল্লিশতম জন্মদিন। দেখব ব্যাপারটা তোমার কেমন লাগে।”

    “ষাট বছর হওয়ার মতো মজার হবে না।”

    “ফাজলামী রাখো।” মানীলা বলল, ঘষে ঘষে রাইখের হাত গরম করার চেষ্টা করছে সে।

    সেলডন দুহাত ছড়িয়ে বললেন, “আমরা ভুল করছি, রাইখ। তোমার স্ত্রীর মতে ষাট বছর নিয়ে আমার মাত্রাতিরিক্ত অভিযোগের কারণেই ওয়ানডার মাথায় আমার মৃত্যুর চিন্তা ঢুকেছে।”

    “তাই নাকি? এই ঘটনা। আমাকে দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হড়বড় করে একটা দুঃস্বপ্নের কথা বলছিল। ওটা তোমার মৃত্যু নিয়ে ছিল?”

    “নিঃসন্দেহে।”

    “যাই হোক, ধীরে ধীরে বুঝতে শিখবে। দুঃস্বপ্ন বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।”

    “আমি এতো সহজে উড়িয়ে দিতে পারছি না।” মানীলা বলল। “মেয়েটা অনবরত দুঃস্বপ্ন নিয়েই ভাবছে। শরীর খারাপ করবে। আমি পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখতে চাই।”

    “তুমি যা বল, মানীলা।” সম্মতির সুরে জবাব দিল রাইখ। “তুমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, তুমি যা বলবে–বিশেষ করে ওয়ানডার ব্যাপারে তাতে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।” এবং সে পুনরায় গোঁফ আঁচড়াল।

    তার প্রিয়তমা স্ত্রী। মানীলাকে প্রিয়তমা স্ত্রী বানানো এতো সহজ হয় নি। রাইখের এখনো মনে আছে কথাটা শুনেই মায়ের আচরণ কেমন হয়েছিল। অন্যেরা দুঃস্বপ্নের কি জানে। ডর্সের প্রচণ্ড রাগের কথা মনে পড়লেই এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে আতংকিত হয়ে পড়ে সে।

    .

    ৫.

    ডেসপারেন্স এর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম যে স্মৃতিটা রাইখের মনে আছে সেটা হলো দাড়ি কামানো।

    চিবুকে ভাইব্রোরেজরের স্পর্শ টের পেয়ে দুর্বল গলায় বলল, “নাপিত মিয়া, উপরের ঠোঁটে কোথাও যেন না কাটে। আমি আমার গোঁফ ফেরত চাই।”

    সেলডন আগেই নাপিতকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন সব। আশ্বস্ত করার জন্য মুখের সামনে একটা আয়না তুলে ধরল সে।

    ডর্স পাশেই বসেছিল। বলল, “ওকে কাজ করতে দাও, রাইখ, খামোখা উত্তেজিত হয়ো না।”

    রাইখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ পরপরই ডর্সের উপর পড়তে লাগল। তবে কিছু বলল না। নাপিত চলে যাওয়ার পর ডর্স জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে, রাইখ?”

    “জঘন্য।” বিড়বিড় করে জবাব দিল সে। “এতো বেশী হতাশ বোধ করছি। আর সহ্য হচ্ছে না।”

    “ডেসপারেন্সের কারণে। একটু সময় লাগবে। তবে ঠিক হয়ে যাবে।”

    “বিশ্বাসই হচ্ছে না। কতদিন হলো?”

    “বাদ দাও। সময় লাগবে, তোমার দেহে পূর্ণমাত্রায় ঢোকানো হয়েছিল।”

    বিরামহীনভাবে তার দৃষ্টি চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। “মানীলা আমাকে দেখতে এসেছিল?”

    “ওই মেয়েটা?” (মানীলাকে এই নামে এবং এই সুরে ডর্সের সম্বোধনে রাইখ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে।) “না। তুমি এখনো সুস্থ হও নি বলে কাউকে আসতে দেয়া হচ্ছে না।”

    রাইখের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে দ্রুত যোগ করল ডর্স, “আমার কথা আলাদা কারণ আমি তোমার মা, রাইখ। যাইহোক, ওই মেয়েটাকে কেন দেখতে চাও? কারো সাথে দেখা করার অবস্থা তোমার নেই।”

    “বরং এটাই ওর সাথে দেখা করার সবচেয়ে বড় কারণ,” বিড়বিড় করে বলল রাইখ। “জীবনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তেও আমি তাকে পাশে চাই।” তারপর নিস্তেজ

    ভঙ্গীতে পাশ ফিরল। “আমি ঘুমাব।”

    হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল ডর্স ভেনাবিলি। ওইদিনই পরে একসময় সেলডনকে বলল সে, “রাইখকে নিয়ে কি করব বুঝতে পারছি না, হ্যারি। কিছুই বুঝতে চাইছে না।”

    “সে অসুস্থ, ডর্স,” সেলডন বললেন। “ছেলেটাকে একটু সময় দাও।”

    “সারাক্ষণ শুধু ওই মেয়েটার কথাই বলছে। নাম ভুলে গেছি।”

    “মানীলা ডুবানকুয়া। মনে রাখার জন্য খুব একটা কঠিন নাম নয়।”

    “আমার ধারণা রাইখ মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায়, সংসার করতে চায়।”

    “রাইখের বয়স ত্রিশ–নিজের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যথেষ্ট বয়স।”

    “নিশ্চয়ই ওর বাবা মা হিসেবে আমাদেরও কিছু বলার থাকতে পারে।”

    দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন হ্যারি। এবং আমার বিশ্বাস, যা বলার তুমি ঠিকই বলেছ, ডর্স। এবং এটাও নিশ্চিত যে, বলেই যখন ফেলেছ রাইখ তার ইচ্ছেমতোই কাজ করবে।”

    “এই তোমার শেষ কথা। রাইখ ওইরকম একটা মেয়েকে বিয়ে করবে আর তুমি বসে বসে দেখবে। কিছুই বলবে না।”

    “তুমি আমার কাছে কি আশা কর, ডর্সঃ মানীলা রাইখের জীবন বাঁচিয়েছে। কথাটা কি আমি ভুলে যাব। সে আমারও জীবন বাঁচিয়েছে।”

    এই কথাগুলো সম্ভবতঃ ডর্সকে আরো রাগিয়ে তুলল। “তুমিও তার জীবন বাঁচিয়েছ। সমান সমান।”

    “আমি আসলে কিছুই করি নি-”

    “অবশ্যই করেছ। তোমার পদত্যাগ এবং সমর্থন সেনাবাহিনীর বদমাশগুলোর কাছে বিক্রি না করলে ওরা তাকে খুন করত।”

    “আমি যদিও আসলে কিছু করতে পেরেছি বলে মনে হয় না, তারপরেও ধরে নিলাম যে প্রতিদান দিয়েছি, রাইখ তো দেয়নি। তাছাড়া প্রিয়, ডর্স, সরকারের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য করার সময় আমি আরো সতর্ক থাকতাম। বর্তমান সময়টা ক্লীয়নের শাসন আমলের মতো সহজ হবে না। তুমি যা বলবে সেটা ওদের কানে পৌঁছে দেয়ার জন্য চারপাশে অনেক গুপ্তচর ছড়িয়ে আছে।”

    “সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। ওই মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি না। আশা করি তাতে কেউ বাধা দেবে না।”

    “অবশ্যই বাধা দেবে না। কিন্তু কোনো লাভও হবে না।”

    দৃষ্টি নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেলডন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। ডর্সের কালো চোখ দুটো রাগে গনগন করছে। চোখ তুললেন তিনি।

    “আমি জানতে চাই, ডর্স, কেন? কেন তুমি মানীলাকে এতো অপছন্দ কর। সে আমার আর রাইখের জীবন বাঁচিয়েছে। সে সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে আমরা দুজনেই মারা যেতাম।”

    একই রকম তেজের সাথে জবাব দিল ডর্স, “নিশ্চয়ই, হ্যারি। কথাটা আমি অন্য সবার চেয়ে ভালোভাবে জানি। সে যদি ওখানে না থাকত, তোমাদের বাঁচানোর জন্য আমি কিছুই করতে পারতাম না। নিঃসন্দেহে তুমি মনে কর যে আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু যতবারই ওই মেয়েটাকে দেখি, নিজের ব্যর্থতার কথা মনে পড়ে। জানি এই আচরণ যুক্তিহীন–কিন্তু আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কাজেই ওকে পছন্দ করার কথা বলো না আমাকে। পারব না।”

    কিন্তু পরের দিন ডর্সকেও পিছিয়ে যেতে হলো যখন ডাক্তার বলল, “আপনার ছেলে মানীলা নামের এক মেয়ের সাথে দেখা করতে চায়।”

    “কারো সাথে দেখা করার মতো অবস্থা নেই ওর,” কড়া ধমক লাগাল ডর্স।

    “বরং উল্টোটাই সত্যি। সে এখন সুস্থ। দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। তাছাড়া ভীষণ জেদ করছে। আমার মনে হয় না তাকে বাধা দেয়া ঠিক হবে।”

    অগত্যা মানীলাকে আসতে দেয়া হলো এবং হাসপাতালে আসার পর এই প্রথম আনন্দের আভাস ফুটল রাইখের চেহারায়।

    পরিষ্কার ডর্সকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করল সে। মুখ কঠিন করে চলে গেল।

    এবং রাইখ একদিন সত্যি সত্যি বলল, “সে আমাকে গ্রহণ করতে রাজী হয়েছে, মা।”

    “তুমি কি আশা করেছিলে আমি অবাক হব, বোকা ছেলে?” ডর্স বলল। “অবশ্যই সে তোমাকে গ্রহণ করবে। তুমি তার একমাত্র সুযোগ, যেহেতু সে এখন অসহায়, চাকরীচ্যুত…”

    “মা, তুমি যদি আমাকে হারাতে চাও তাহলে ঠিক পথেই এগোেচ্ছ। এভাবে কথা বলবে না।”

    “তোমার যাতে ভালো হয় আমি তাই চিন্তা করছিলাম।”

    “নিজের ভালো নিজেই চিন্তা করব, ধন্যবাদ। আমি কারো উপরে উঠার সিঁড়ি নই–এই চিন্তাটা তুমি মাথা থেকে বের করে দিতে পার। আমি সুদর্শন নই। বেটে। বাবা এখন আর ফার্স্ট মিনিস্টার নন। আমার কথাবার্তা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের মতো। আমাকে নিয়ে অহংকার করার কি আছে। আরো ভালো কাউকে খুঁজে নিতে পারবে, কিন্তু সে আমাকে চায়। এবং তোমাকে সত্যি কথা বলছি আমিও তাকে চাই।”

    “কিন্তু তুমি তো জান সে কি?”

    “অবশ্যই জানি। মানীলা সেই মেয়ে যাকে আমি ভালোবাসি। মানীলা সেই মেয়ে যে আমাকে ভালোবাসে। এর বেশী কিছু জানার দরকার নেই।”

    “তোমার প্রেমে পড়ার আগে কি ছিল সে? ওয়িতে আন্ডারকভারে থাকার সময় সে কি করত তার কিছুটা তুমি জানো–তুমি ছিলে তার ‘এ্যাসাইনমেন্ট।’ এমন আরো কতগুলো এ্যাসাইনমেন্ট ছিল? অতীত জানার পরেও তুমি ওর সাথে বাস করতে পারবে, দায়িত্ব পালনের নামে যা করেছে সেটা জানার পরেও? এখন তুমি আদর্শ দেখাতে পারছ। কিন্তু কয়েকদিন পরেই তোমাদের প্রথম ঝগড়া হবে–অথবা দ্বিতীয় অথবা উনিশতম–এবং ধৈর্য হারিয়ে তুমি ঠিকই বলবে, “বে!”

    রাগে দিশেহারা হয়ে গেল রাইখ, “চুপ কর। যখন ঝগড়া হবে, আমি তাকে বোকা, ছিচকাদুনে, অবুঝ, নিষ্কর্মা পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন হাজারো নামে ডাকব। আমাকে বলার মতো অনেক শব্দও সে খুঁজে নিতে পারবে। কিন্তু তার সবই হবে সংযত এবং রাগ পড়ে গেলে সবই ভুলে যেতে পারব।”

    “এখন মনে হচ্ছে–কিন্তু সময় আসলে ঠিকই বুঝবে।”

    রাইখের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বলল, “মা, তুমি বাবার সাথে প্রায় বিশ বছর ধরে বাস করছ। বাবাকে সামলানো সত্যি কঠিন। মাঝে মাঝে তোমাদের তর্ক হয়েছে আমি শুনেছি। এই বিশ বছরে বাবা কি তোমাকে এমন কোনো কথা বলেছে। যাতে তোমার অসম্মান হয়? আমি বলেছি? তাহলে কিভাবে আশা করলে এখন। বলব–যত রাগই হোক।”

    নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে ডর্স। রাইখ বা সেলডনের মুখে যেভাবে আবেগ ফুটে উঠে তার চেহারায় ঠিক সেরকমভাবে আবেগ ফুটে উঠে না। যদিও এটা পরিষ্কার যে সে বাক্য হারা হয়ে গেছে।

    “সবচেয়ে বড় কথা, সুযোগ কাজে লাগাল রাইখ (যদিও কাজটা করতে তার খারাপ লাগল) “তুমি আসলে মানীলাকে হিংসা কর কারণ সে বাবার জীবন বাঁচিয়েছে। তুমি চাওনা এই কাজটা অন্য কেউ করে। কিন্তু তোমার কোনো সুযোগ ছিল না। তুমি কি চেয়েছিলে মানীলা যেন এন্ডোরিনকে খুন না করে বাবা যেন মারা যায়? আমিও?”

    ডর্স নিস্তেজ সুরে বলল, “সে একা যেতে চেয়েছিল। আমাকে কোনো অবস্থাতেই সাথে নিত না।”

    “কিন্তু সেটা তো মানীলার দোষ নয়।”

    “এই কারণেই তুমি ওকে বিয়ে করতে চাও? কৃতজ্ঞতা?”

    “না। ভালোবাসা।”

    এবং বিয়েটা হয়ে গেল, কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে রাইখকে বলল মানীলা, “হয়তো তোমার অনুরোধে তোমার মা এসেছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে গম্বুজের নিচে যে ঝড়ো, মেঘ ওরা তৈরি করে তার চেহারাটা ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছে।”

    হেসে ফেলল রাইখ। “এটা তোমার কল্পনা।”

    “মোটেই না। কেমন করে মানাব?”

    “ধৈর্য ধর। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

    কিন্তু ডর্স ভেনাবিলি কোনোদিনই ক্ষমা করে নি।

    বিয়ের দুবছর পরে ওয়ানডার জন্ম হয়। বাচ্চাটার প্রতি ডর্সের আচরণ রাইখ আর মানীলার আশার চেয়েও বেশী ফুটে উঠল, কিন্তু ওয়ানডার মা রাইখের মায়ের কাছে “ওই মেয়েটা হয়েই রইল।

    .

    ৬.

    হ্যারি সেলডন বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। তাকে পালাক্রমে ডর্স, রাইখ এবং মানীলার ভাষণ শুনতে হয়েছে। সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে বয়স ষাট হওয়া মানেই বুড়ো হয়ে যাওয়া নয়।

    আসলে ওরাই বুঝতে পারছে না। সাইকোহিস্টোরির ধারণাটা প্রথম যখন তার মাথায় আসে তখন তার বয়স ত্রিশ। বত্রিশ, যখন তিনি ডিসেনিয়াল কনভেনশনে বিখ্যাত বক্তৃতা উপস্থাপন করেন, পরের ঘটনাগুলো এখনো তার কাছে মনে হয় যেন মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গিয়েছিল। ক্লীয়নের সাথে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারের পর তাকে পুরো ট্র্যানটরে পালিয়ে বেড়াতে হয়, দেখা পান ডেমারজেল, ডর্স, ইউগো এবং রাইখের। মাইকোজেন, ডাল আর ওয়ির মানুষগুলোর কথা না হয় বাদই থাকল।

    বয়স ছিল চল্লিশ যখন তিনি ফাস্ট মিনিস্টার হন এবং পঞ্চাশ যখন সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন, এখন তার বয়স ষাট।

    ত্রিশ বছর তিনি সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাটিয়েছেন। আর কত বছর লাগবে? আর কত বছর তিনি বাঁচবেন? সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্ট অসমাপ্ত রেখে তিনি মারা যাবেন?

    আসলে মরে যাওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়, নিজেকে বোঝালেন তিনি। আসল দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্ট অসমাপ্ত রেখে যাওয়া।

    ইউগো এমারিলের কাছে গেলেন তিনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা দুজন খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, যেহেতু সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের আয়তন ক্রমেই বড় হচ্ছে। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিককার বছরগুলোতে শুধু তিনি আর এমারিল কাজ করতেন–আর কেউ ছিল না। কিন্তু এখন

    এমারিলের বয়স এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি–তরুণ বয়স নয় মোটেই–এবং তার প্রাণচাঞ্চল্য থেমে গেছে পুরোপুরিই। সারাজীবনে সাইকোহিস্টোরির উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই আকর্ষণ বোধ করে নি সে : মেয়েমানুষ, সঙ্গী-সাথী, শখ বা আমোদ প্রমোদের অন্য কোনো উপাদান, কোনো কিছুই না।”

    চোখ পিট পিট করে সেলডনের দিকে তাকালো এমারিল, আর সেলডন পুরনো সাথীর পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য না করে পারলেন না। আংশিক কারণ হয়তো এই যে এমারিলকে তার চোখগুলো নতুন করে তৈরি করাতে হয়েছে। এখন দেখতে কোনো অসুবিধা হয় না কিন্তু পাপড়ি ফেলে বেশ ধীরে ধীরে, মনে হয় ঘুম কাতুরে একজন মানুষ।

    “কি মনে হয়, ইউগো?” জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। “আশার আলো দেখা যাচ্ছে?”

    “আশার আলো? হ্যাঁ, বোধহয়। নতুন যে ছেলেটা এসেছে, টামউইল ইলার, তুমি তো ওকে চেন?”

    “অবশ্যই। আমিই ওর নিয়োগ দিয়েছিলাম। বেপরোয়া, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। কেমন কাজ করছে?”

    “ও সাথে থাকলে যে আমি স্বস্তি বোধ করি না, হ্যারি, এই কথা হলপ করে বলা যায়। ছেলেটার বিকট হাসি আমাকে নার্ভাস করে তোলে। কিন্তু সে মেধাবী। সমীকরণের নতুন পদ্ধতিটা সুন্দরভাবে প্রাইম রেডিয়্যান্টে বসে গেছে এবং মনে হয় ওগুলো বিভ্রান্তিকর সমস্যার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব করে তুলবে।”

    “মনে হয়? নাকি হবে?”

    “এখনই বলা যাবে না, তবে আমি আশাবাদী। অনেকগুলো বিষয় নিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি, ওগুলো মূল্যহীন হলে নতুন সমীকরণগুলো ভেঙ্গে যেত। কিন্তু তা হয় নি বরং নতুন সমীকরণগুলো টিকে গেছে। আমি ওগুলোকে ‘অনৈরাজ্যক সমীকরণ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছি।”

    “সমীকরণগুলোর নিখুঁত কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়েছি বলে তো মনে হয় না।”

    “না, পাইনি, যদিও ছয়জনকে দায়িত্ব দিয়েছি, তাদের মধ্যে ইলার আছে অবশ্যই।” এমারিল তার প্রাইম রেডিয়্যান্টের দিকে ঘুরল–সেলডনের নিজেরটার মতোই উন্নত আর জটিল বাতাসে আঁকাবাঁকা হয়ে ঝুলে থাকা উজ্জ্বল সমীকরণগুলো দেখছে সে–এতো ছোট, এতো ঘন যে পরিবর্ধন ছাড়া পড়া অসম্ভব। “নতুন সমীকরণগুলো যুক্ত করলে আমরা হয়তো ভবিষ্যদ্বাণী শুরু করতে পারব।”

    “এখন যতবারই প্রাইম রেডিয়্যান্টটা দেখি,” চিন্তিত সুরে বললেন সেলডন, “ততবারই অবাক হয়ে ভাবি ইলেকট্রো ক্ল্যারিফায়ার কি অসাধ্য সাধন করেছে, ভবিষ্যতের সরল পথ এবং আঁকাবাঁকা গলিপথে কি নিবিড়ভাবে সকল উপাদান ধারণ করতে পেরেছে। এটাও ইলারের আইডিয়া, তাই না?”

    “হ্যাঁ। সে আর সিনডা মোনি যন্ত্রটার ডিজাইন তৈরি করে দিয়ে সাহায্য করেছে।”

    “প্রজেক্টে নতুন নতুন মেধাবী ছেলে মেয়েদের নিয়োগ দেয়াটা সত্যিই ভালো হয়েছে। আমার ভুলগুলো ওরা ভবিষ্যতে সংশোধন করে নিতে পারবে।”

    “তোমার ধারণা ইলারের মতো কেউ একজন ভবিষ্যতে প্রজেক্টের নেতৃত্ব দেবে?” জিজ্ঞেস করল এমারিল, এখনো প্রাইম রেডিয়্যান্ট দেখছে।

    “হয়তো। তুমি আর আমি অবসর নেয়ার পর অথবা আমাদের মৃত্যুর পর।”

    এই মন্তব্যে স্বস্তি পেল এমারিল। যন্ত্রটা বন্ধ করে বলল, “অবসর নেয়ার আগে বা মারা যাওয়ার আগে আমি কাজটা শেষ করে যেতে চাই।”

    “আমিও চাই, ইউগো, আমিও চাই।”

    “সাইকোহিস্টোরি গত দশ বছরে আমাদের ভালোই পথ নির্দেশ দিয়েছে।”

    কথাটা সত্যি, কিন্তু সেলডন জানেন এটা নিয়ে বিজয়োল্লাস করার কিছু নেই। ঘটনাগুলো বড় কোনো চমক ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে গেছে।

    সাইকোহিস্টোরির ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ক্লীয়নের মৃত্যুর পর যেভাবেই হোক কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হবে–সেই ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল ঝাপসা এবং অনিশ্চিত। কিন্তু কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা গেছে। ট্র্যানটর এখন যথেষ্ট শান্ত। এমনকি একটা হত্যাকাণ্ড এবং একটা রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরেও, কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয় নি।

    সম্ভব হয়েছে সামরিক শাসনের কারণে–জাভার ব্যাপারে ডর্স যখন বলে ওই মিলিটারি হারামজাদাগুলো ঠিকই বলে। তার আরো অনেক অভিযোগই সত্যি বলে প্রমাণিত হবে। যাই হোক, তারা এম্পায়ারের প্রতিটি অংশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে এবং আরো অনেকদিন পারবে। অন্তত ততদিন, প্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহে সাইকোহিস্টোরির ভূমিকা শুরু করার জন্য যা যথেষ্ট।

    ইউগো গত কিছুদিন ধরেই ফাউণ্ডেশন স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছে পৃথক, বিচ্ছিন্ন, এম্পায়ার থেকে স্বাধীন–আন্ন অন্ধকার যুগের ধ্বংসস্তূপ থেকে অগ্রগতি এবং আরো উন্নত নতুন এম্পায়ার গড়ে তোলার সূতিকাগার হিসেবে যা ভূমিকা পালন করবে। সেলডন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন।

    কিন্তু তার সময়ের ভীষণ অভাব, এবং বুঝতে পারছেন (তিক্ত মনে) তারুণ্যের উদ্যম কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার বুদ্ধিমত্তা যদিও এখনো যথেষ্ট তীক্ষ্ণ এবং ক্রিয়াশীল, কিন্তু আগের মতো কাজ করার ক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা নেই। এবং জানেন যে সময় যতই গড়াবে ততই আরো কমতে থাকবে।

    হয়তো তরুণ এবং মেধাবী ইলারের হাতেই সবকিছু ছেড়ে দেয়া উচিত। সেলডনকে স্বীকার করতেই হলো এবং লজ্জিত হলেন কারণ ভাবনাটা কোনোভাবেই তার মনঃপুত হলো না। সাইকোহিস্টোরি তিনি এই জন্য আবিষ্কার করেন নি যে তার সুফল এবং খ্যাতি হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ ভোগ করবে। সবচেয়ে খারাপ কথা হচ্ছে, ইলারকে তিনি হিংসা করেন এবং বুঝতে পারছেন এর জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত।

    তারপরেও, অনুভূতি যতই অযৌক্তিক হোক না কেন, তরুণদের উপর তাকে নির্ভর করতেই হবে–অস্বস্তি হলেও কিছু করার নেই। সাইকোহিস্টোরি এখন আর তার এবং এমারিলের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি ফার্স্ট মিনিস্টার থাকাকালীন সময়ে এই কার্যক্রম পরিণত হয়েছে সর্ববৃহৎ সরকারী অনুদানপুষ্ট এবং বিশাল বাজেটের প্রজেক্টে, সবচেয়ে অবাক ব্যাপার তিনি পদত্যাগ করে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পরেও এর আয়তন ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। বিশাল জাকজমকপূর্ণ নামটা মনে করে মুচকি হাসলেন হ্যারি–দ্য সেলডন সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্ট অ্যাট স্ট্রিলিং ইউনিভার্সিটি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটাকে বলে শুধুই প্রজেক্ট।

    নিঃসন্দেহে সামরিক জান্তা প্রজেক্টটাকে দেখছে সম্ভাব্য রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, এবং যতদিন তা দেখবে, ফান্ড কোনো সমস্যাই না। বন্যার মতো ক্রেডিট আসছে। বিনিময়ে একটা বাৎসরিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয়, সেটাও তেমন জটিল কিছু না। শুধু অনার্থিক বিষয়গুলোই দেখাতে হয়। জান্তার সদস্যদের গণিত তেমন আকৃষ্ট করে না।

    পুরনো সহকর্মীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় তিনি বুঝতে পারলেন যে সাইকোহিস্টোরি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে অন্তত এমারিল সন্তুষ্ট কিন্তু সেলডন অনুভব করলেন যে আবারও হতাশার কালো চাদর ঘিরে ধরছে তাকে।

    ধরে নিলেন যে আসন্ন জন্মোৎসবটাই তাকে বিরক্ত করে মারছে। সবার কাছে এটা আনন্দ উৎসব, কিন্তু হ্যারি তাতে কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না। শুধু তার বুড়ো বয়সটাই সবাইকে জানানো হচ্ছে।

    তাছাড়া, এটা তার দৈনন্দিন রুটিন ব্যহত করছে। হ্যারি অভ্যাসের দাস। তার অফিস এবং সংলগ্ন অনেকগুলো কামরা খালি করে ফেলা হয়েছে। বেশ অনেকদিন হলো তিনি স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারছেন না। তার মূল অফিসটাকেই সম্ভবত উৎসবের কেন্দ্র বানানো হবে। তারপর আবার কাজকর্ম শুরু করার মতো পরিস্থিতি ফিরে আসতে আরো বেশ কয়েকটা দিন লাগবে। শুধুমাত্র এমারিলের কাছে কেউ পাত্তা পায়নি। সে তার অফিস ধরে রাখতে পেরেছে।

    সেলডন বুঝতে পারছেন না বুদ্ধিটা কার। ডর্সের নয়। কারণ তার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা জানে ডর্স। এমারিল এবং রাইখেরও নয়। ওই দুজন তো নিজেদের জন্মতারিখটাই মনে রাখতে পারে না। তার সন্দেহ বুদ্ধিটা মানীলার।

    কিন্তু জিজ্ঞেস করার পর মানীলা জানাল সে নয়, বুদ্ধিটা দিয়েছে টামউইল ইলার।

    সেই মেধাবী ছেলেটা, ভাবলেন সেলডন। সব বিষয়েই মেধাবী।

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঝামেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হলেই বাঁচেন।

    .

    ৭.

    দরজার ফাঁক দিয়ে শুধু মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল ডর্স, “আসতে পারি।”

    “না, মোটেই না। কেন তোমাকে আসতে দেব?”

    “এটা তো তোমার কাজ করার জায়গা না।”

    “জানি,” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। “আমাকে আমার কাজের জায়গা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে জন্মদিনের উৎসবের জন্য। কবে যে শেষ হবে।”

    “দেখলে তো। ওই মেয়েটার মাথায় একটা কিছু ঢুকলেই হলো, করেই ছাড়বে।”

    সাথে সাথে দল বদলালেন সেলডন। “ওতো ভালোর জন্যই করছে।”

    “রক্ষে কর। যাইহোক, আমি অন্য বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। জরুরী।”

    “বল, কি বলতে চাও?”

    “ওয়ানডার স্বপ্নটা নিয়ে আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম-” ইতস্তত করতে লাগল সে।

    গলার ভেতর থেকে গার্গল করার মতো একটা শব্দ বের করে আনলেন সেলডন। “আমি বিশ্বাস করি না। বাদ দাও।”

    “না। স্বপ্নটার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চেয়েছ কখনো?”

    “কেন বাচ্চা মেয়েটাকে কষ্ট দেব?”

    “রাইখ বা মানীলাও জিজ্ঞেস করে নি। কাজেই দায়িত্বটা আমার কাঁধেই এসে পড়ে।”

    “খামোখা প্রশ্ন করে কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছ?”

    “কারণ আমার মন বলছে করা উচিত,” গম্ভীর সুরে বলল ডর্স। “প্রথমতঃ স্বপ্নটা যখন দেখেছে তখন সে তার নিজের ঘরে ছিল না।”

    “তাহলে কোথায় ছিল?”

    “তোমার অফিসে।”

    “আমার অফিসে কি করছিল?”

    “উৎসবটা কোথায় হবে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু কামরাটা ছিল খালি। শুধু তোমার চেয়ারটা ছিল। লম্বা পিঠঅলা ভাঙ্গা চেয়ারটা–যেটা তুমি আমাকে বদলাতে দাও নি।”

    বহুদিনের পুরনো একটা বিষয় তুলে আনায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হ্যারি। “ওটা ভাঙে নি। আমার নতুন আরেকটা দরকার নেই। বলে যাও।”

    “তোমার চেয়ারে বসে ওর মনে হয় যে তুমি হয়তো উৎসবটা উপভোগ করতে পারবে না। তাতে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। তারপর নিজেই আমাকে বলেছে যে সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল কারণ কিছুই পরিষ্কার মনে নেই, শুধু এইটুকুই বলতে পেরেছে। যে স্বপ্নে দুজন পুরুষকে কথা বলতে শুনেছে সে–মহিলা নয়, এই বিষয়ে নিশ্চিত।”

    “কি বলছিল ওরা?”

    “পরিষ্কার কিছু বলতে পারছে না। বোঝই তো এই রকম পরিস্থিতি মনে রাখা ওর জন্য কত কঠিন। ওর মতে লোক দুজন মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিল এবং সে ধরে নেয় মৃত্যুটা তোমার কারণ তুমি বুড়ো হয়ে গেছ। দুটো শব্দ পরিষ্কার মনে রাখতে পেরেছে। সেটা হলো, লেমনেড ডেথ।”

    “কি?”

    “লেমনেড ডেথ।”

    “অর্থ কি?”

    “জানি না। যাই হোক, আলোচনা শেষ করে লোক দুজন চলে যায় আর সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ওখানেই অনেকক্ষণ বসে থাকে। এরপর থেকেই তার মনটা এখনো বিষণ্ণ হয়ে আছে।”

    ডর্সের কথাগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন সেলডন। তারপর বললেন, “কেন আমরা বাচ্চা একটা মেয়ের স্বপ্নকে এতো গুরুত্ব দিচ্ছি?”

    “প্রথমে আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করা উচিত, হ্যারি, যে ওটা আসলেই স্বপ্ন ছিল কি না।”

    “কি বলতে চাও?”

    “ওয়ানডা কিন্তু সরাসরি কখনোই বলেনি যে ওটা স্বপ্ন ছিল। বারবারই বলছে যে, হয়তো ঘুম এসে গিয়েছিল। ঠিক এই কথাগুলোই বলেছে সে। কখনোই বলে নি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বলেছে হয়তো ঘুম এসে গিয়েছিল।”

    “তো, যোগ বিয়োগ করে কি পেলে?”

    “ওর হয়তো খানিকটা ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল আর ওই অবস্থাতেই দুজন পুরুষকে সত্যিকার দুজন পুরুষ, স্বপ্ন নয়–কথা বলতে শুনে।”

    “সত্যিকার মানুষ? লেমনেড ডেথ দিয়ে আমাকে খুন করার কথা বলছিল?”

    “হ্যাঁ, সেইরকমই কিছু।” ।

    “ডর্স,” ধমকের সুরে বললেন সেলডন, “আমি জানি তুমি আমার জন্য সবসময়ই চারপাশে বিপদ দেখতে পাও, কিন্তু এটা একটু বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে কেউ খুন করতে চাইবে কেন?”

    “এর আগেও দুবার চেষ্টা করা হয়েছে।”

    “হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি চিন্তা করে দেখ। প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ক্লীয়ন আমাকে ফার্স্ট মিনিস্টার পদে নিয়োগ দেয়ার কিছুদিন পরেই। স্বাভাবিক ভাবেই আমার নিয়োগ ইম্পেরিয়াল কোর্টের অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। তাদেরই কিছু ভেবেছিল আমাকে সরিয়ে দিতে পারলে তারা নিজেরাই সবকিছু ভালোভাবে সামলে নিতে পারবে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হয় যখন জোরামাইটরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। ওরা ভেবেছিল আমি ওদের পথের কাঁটা–তাছাড়া নামাত্রির প্রতিশোধ নেয়ার স্বপ্নটাও ছিল।

    “সৌভাগ্যক্রমে কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয় নি, কিন্তু এখন তৃতীয় প্রচেষ্টা কেন হবে? আমি এখন আর ফাস্ট মিনিস্টার নই। বয়স্ক এক গণিতবিদ, কিছুদিন পরেই অবসর নেব এবং নিঃসন্দেহে আমার কাছ থেকে কারো ভয়ের কিছু নেই। জোরানুমাইটদের জড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা হয়েছে, নামাত্রির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে বহুদিন আগেই। আমাকে খুন করার কোনো মোটিভ নেই।

    “কাজেই, ডর্স শান্ত হও। যখন আমাকে নিয়ে খুব বেশী ভাব তখন তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায় আর তাতে আরো বেশী নার্ভাস হয়ে পড়। আমি সেটা চাই না।”

    উঠে দাঁড়াল ডর্স, “হ্যারি” ডেস্কে দুহাতে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে বলল, “তোমার জন্য বলাটা খুব সহজ, কিন্তু আসলে কোনো মোটিভ দরকারও নেই। এই মুহূর্তে আমাদের প্রশাসন দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং তারা চাইলে–“

    “থামো!” কড়া আদেশ দিলেন সেলডন। তারপর ভীষণ শান্ত সুরে বললেন, “আর একটাও কথা না, ডর্স। প্রশাসনের বিরুদ্ধে আর একটাও কথা বলবে না। তাহলে তুমি যে বিপদের আশংকা করছ সেটাই বাস্তব হবে।”

    “আমি শুধু তোমার সাথে কথা বলছি, হ্যারি।”

    “এই মুহূর্তে আমার সাথেই কথা বলছ, কিন্তু বোকার মতো কথা বলার অভ্যাস যদি হয়ে যায় তাহলে অন্যদের সামনেও কোনোদিন মুখ ফসকে বলে ফেলবে তাদের কেউ খবরটা পৌঁছে দেবে জায়গামতো। রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে শেখ, প্রয়োজনের খাতিরেই।”

    “আমি চেষ্টা করব, হ্যারি,” ডর্স বলল, কণ্ঠের বিরক্তি ভাবটা গোপন রাখতে পারল না। বেরিয়ে গেল সে।

    তার চলে যাওয়া দেখলেন সেলডন। ডর্সের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে খুবই কম। এতোই কম যে মনে হয় বয়স বাড়ে নি মোটেই। যদিও সে মাত্র দুবছরের ছোট সেলডনের থেকে। আঠাশ বছরে সেলডনের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তার হয় নি।

    ডর্সের কেশরাজি ধূসর হয়ে গেছে, কিন্তু তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয় নি। গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে অনেকখানি; কণ্ঠস্বরে ভারিক্কি ভাব এসেছে এবং অবশ্যই পরিধান করে মধ্যবয়সী নারীদের পোশাক। কিন্তু তার গতি এখনো আগের মতোই তীক্ষ্ণ এবং ক্ষিপ্র। যেন প্রয়োজনের সময় হ্যারিকে রক্ষা করার ক্ষমতা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না কেউ।

    দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হ্যারি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে এভাবে সর্বক্ষণ নিরাপত্তার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে থাকা মাঝে মাঝে সত্যিই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

    .

    ৮.

    প্রায় সাথে সাথেই মানীলা এসে ঢুকল সেলডনের সাথে দেখা করার জন্য।

    “দুঃখিত, হ্যারি, ডর্স কি বলছিল?”

    মাথা তুললেন সেলডন। কাজের মাঝখানে শুধু বাধা আর বাধা।

    “তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ওয়ানডার স্বপ্নের ব্যাপারটা।”

    “আমি জানতাম। ওয়ানডা বলছিল যে ডর্স তাকে এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করছে। মেয়েটাকে তিনি শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না কেন? ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে দুঃস্বপ্ন দেখা একটা ভয়ংকর অপরাধ।”

    “আসলে,” আশ্বস্ত করার সুরে বললেন সেলডন, “স্বপ্নের একটা অংশ ওয়ানডার মনে পড়েছে। সম্ভবতঃ তোমাকে বলে নি। স্বপ্নে সে লেমনেড ডেথ’ বলে একটা কথা শুনেছে।”

    “হুমম!” কিছুক্ষণ ভাবল মানীলা, তারপর বলল, “এটা তো মাথা ঘামানোর মতো কোনো বিষয় নয়। ওয়ানডা লেমনেডের জন্য পাগল এবং আশা করছে পার্টিতে প্রচুর খেতে পারবে। আমিও তাকে কথা দিয়েছি যে মাইকোজেনিয়ান ড্রপ মেশানো কিছু লেমনেড খেতে দেব।”

    “কাজেই লেমনেডের কাছাকাছি কোনো শব্দ শুনলেই মনে মনে সেটাকে লেমনেড বলেই মনে করবে।”

    “হ্যাঁ। সেরকমই তো হওয়ার কথা, তাই না?”

    “ভাবতে হবে যে আসলে সে কি শুনেছিল? ভুল ব্যাখ্যা করার জন্য নিশ্চয়ই কোনো একটা শব্দ তার কানে ঢুকেছে?”

    “আমার তা মনে হয় না। কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ের স্বপ্ন নিয়ে আমরা বুড়োরা এতো মাথা ঘামাচ্ছি কেন? প্লীজ, আমি চাই না এই বিষয়ে ওর সাথে কেউ আর কথা বলে। তাতে ওর মন আরো খারাপ হবে।”

    “আমি একমত। ডর্সকে বোঝাব যেন সে এই বিষয়ে কথা আর না বলে অন্তত ওয়ানডার সাথে।”

    “ঠিক আছে। তিনি ওয়ানডার দাদী, হ্যারি, তাতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমি মেয়ের মা, এবং আমার ইচ্ছাটাই প্রধান।”

    “নিশ্চয়ই,” বললেন সেলডন, তারপর অপসৃয়মান মানীলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই আরেক সমস্যা–দুই নারীর চিরায়ত দ্বন্দ্ব।

    .

    ৯.

    টামউইল ইলারের বয়স ছত্রিশ। চার বছর আগে ঊর্ধ্বতন গণিতবিদ হিসেবে সেলডন সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে যোগ দেয়। যথেষ্ট লম্বা সে, অনবরত চোখ পিট পিট করা তার মুদ্রাদোষ এবং আত্মভোলা মানুষ।

    চুলের রং বাদামী, খানিকটা ঢেউ খেলানো, বেশী নজর কাড়ে কারণ সে চুল লম্বা রাখে। হাসির ভঙ্গীটা অদ্ভুত, কিন্তু তার গাণিতিক দক্ষতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।

    ইলার এসেছে ওয়েস্ট ম্যানডানভ ইউনিভার্সিটি থেকে। তার নিয়োগ নিয়ে এমারিল যে কি পরিমাণ সন্দিহান হয়ে পড়েছিল তা মনে পড়লে সেলডন এখনো মুচকি হাসেন। অবশ্য এমারিল সবকিছুতেই সন্দেহপ্রবণ। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে (সেলডন নিশ্চিত) যে সাইকোহিস্টোরি তার আর হ্যারির ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

    কিন্তু এখন এমনকি এমারিলও স্বীকার করে নিয়েছে যে ইলারের নিয়োগের ফলে তার নিজের কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে। ইউগোর মতে, “তার বিশৃঙ্খলা এড়ানোর কৌশল সত্যিই অদ্বিতীয় এবং চমৎকার। প্রজেক্টের আর কারো মাথায় এই ধারণা আসে নি। আমার মাথায় আসে নি। তোমার মাথাতেও আসে নি, হ্যারি।”

    “আসলে,” রুষ্ট স্বরে বলেছিলেন সেলডন, “আমার বয়স হয়ে গেছে।”

    “শুধু যদি,” এমারিল জবাব দিয়েছিল, “সে ওরকম বিকটভাবে না হাসত।”

    “হাসি অভ্যাসের ব্যাপার। ওখানে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু সেলডন নিজেই ইলারকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না। ইলারের সমীকরণগুলোকে এখন বলা হচ্ছে “অনৈরাজ্যক সমীকরণ।” এটা সেলডনের জন্য খানিকটা অপমানজনক যে তিনি কখনো এই ধরনের সমীকরণের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেন নি। ইলেকট্রো ক্ল্যারিফায়ারের মূলনীতিগুলো তৈরি করতে পারেন নি বলে কখনো বিব্রতবোধ করেন নি সেলডন। ওটা তার বিষয় নয়। কিন্তু অনৈরাজ্যক সমীকরণ, এই বিষয়ে তার অন্তত ভাবা উচিত ছিল–বা অন্তত কাছাকাছি পৌঁছানো উচিত ছিল।

    যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন তিনি। সেলডন পুরো সাইকোহিস্টোরির ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন এবং অনৈরাজ্যক সমীকরণ এই ভিত্তির উপর ভর করেই তৈরি হয়েছে। তিন দশক আগে সেলডন যা করেছেন ইলার কি সেটা করতে পারত? সেলডন মনে করেন যে পারত না। এবং মূল ভিত্তিটা তৈরি করে দেয়ার পর ইলার অনৈরাজ্যবাদের মূলনীতিগুলো তৈরি করতে পেরেছে, এটা নিয়ে খুব বেশী হৈ চৈ করার কি কোনো দরকার আছে?

    কথাগুলো নিঃসন্দেহে যৌক্তিক এবং সত্য, তারপরেও ইলারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন সেলডন। খানিকটা কোণঠাসা। সময়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত বৃদ্ধকাল মুখোমুখী হয়েছে টগবগে তারুণ্যের।

    বয়সের ব্যবধান বোঝানোর মতো আচরণ কখনো ইলার করে নি। সেলডনকে সবসময়ই পূর্ণ সম্মান দেখিয়েছে এবং কখনোই বোঝানোর চেষ্টা করে নি যে বৃদ্ধ মানুষটা তার জীবনের সেরা সময় পার হয়ে এসেছে।

    ইলার আসন্ন উৎসব নিয়ে ভীষণ উৎসাহী এবং সেলডন জানতে পেরেছেন যে জন্মদিন পালন করার প্রস্তাবটা ইলারই দিয়েছে। (এটা কি সেলডন বুড়ো হয়ে গেছেন তা বোঝানোর একটা নোংরা কৌশল? সম্ভাবনাটা সাথে সাথেই বাতিল করে দিলেন। যদি এই কথা তিনি বিশ্বাস করেন তাহলে বলতে হবে যে ডর্সের মতো তিনিও সন্দেহ প্রবণ হয়ে পড়ছেন।)।

    ইলার তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “মাস্ট্রো–“ চোখ মুখ কুঁচকালেন সেলডন, প্রজেক্টের পদস্থ সদস্যদের কাছ থেকে হ্যারি নাম শুনতেই বেশী পছন্দ করেন। কিন্তু এই নগণ্য বিষয় নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে হলো না। “মাস্ট্রো,” ইলার বলল, “সবাই জানে যে আপনাকে জেনারেল ট্যানারের সাথে দেখা করার জন্য ডাকা হয়েছে।”

    “হ্যাঁ। সে জান্তার বর্তমান প্রধান এবং আমার ধারণা সে আসলে সাইকোহিস্টোরির কথা জানতে চায়। ক্লীয়ন এবং ডেমারজেলের আমল থেকেই ওরা আমার কাছে সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে প্রশ্ন করছে।” (নতুন প্রধান। জান্তা আসলে কেলিডোস্কোপের মতো। নিয়মিত ব্যবধানে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের পতন ঘটে এবং নতুন কেউ আচমকা সামনের সারীতে চলে আসে।)

    “কিন্তু আমি যতদূর বুঝতে পারছি যে সে এখনই দেখা করতে চাইছে। জন্মদিনের উৎসবের মাঝখানে।”

    “সেটা কোনো ব্যাপার না। আমাকে ছাড়াও তোমরা আনন্দ করতে পারবে।”

    “না, পারব না, মাস্ট্রো। আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আমরা কয়েকজন প্রাসাদে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকারের তারিখটা পিছানোর জন্য বলেছি।”

    “কি?” ভীষণ বিরক্ত হলেন সেলডন। “বোকার মতো কাজ করেছ তোমরা বিপদ হতে পারত।”

    “খুব সহজেই হয়ে গেছে। মেনে নিয়েছে ওরা আর এই সময়টা আপনার দরকার।”

    “কেন?”

    ইতস্ততঃ করছে ইলার। “আমি খোলাখুলি কথা বলতে পারি, মাস্ট্রো?”

    “নিশ্চয়ই। আমি কখনো না করেছি।”

    লজ্জা পেল ইলার, ফর্সা চেহারা খানিকটা লাল হলো, কিন্তু কণ্ঠস্বর দৃঢ়। “যা বলতে চাই সেটা বলা তত সহজ না, মাস্ট্রো। গণিতের ক্ষেত্রে আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। এই প্রজেক্টের কারো মনেই এই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। এমনকি এম্পায়ারের কারো মনেও যদি তাদের জানা থাকে আপনি কে এবং যদি তারা গণিত বোঝে–সম্ভবত কোনো দ্বিমত নেই। যাইহোক, আপনাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কোনো সুযোগ তাদেরকে দেয়া হয় নি।”

    “কথাটা আমিও জানি, ইলার।”

    “আপনি যে জানেন তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষদের সামলানোর কোনো দক্ষতা আপনার নেই। বরং বলা উচিত বোকা মানুষদের। আপনি ছল চাতুরী জানেন না, প্রশ্নের জবাব এড়ানোর কৌশল জানেন না, এবং আপনি যদি এমন এক মানুষের মুখোমুখী হন যে একই সাথে ক্ষমতাবান এবং বোকা তখন অতি সহজেই প্রজেক্টের জন্য বিপদ ডেকে আনবেন সেই সাথে নিজের জীবনের জন্যও, কারণ আপনি অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ।”

    “কি হচ্ছে এসব? আমি কি ছোট বাচ্চা? আমি দীর্ঘদিন রাজনীতিবিদদের সামলেছি। নিশ্চয় তোমার মনে আছে যে আমি দশ বছর ফার্স্ট মিনিস্টার ছিলাম।”

    “মাফ করবেন, মাস্ট্রো, সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। ফার্স্ট মিনিস্টার ইটো ডেমারজেলের সাথে আপনি কাজ করেছেন, যার ছিল সব বিষয়েই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সম্রাট ক্লীয়নের সাথে যে ছিল আপনার বন্ধু। এখন আপনাকে মোকাবেলা করতে হবে সামরিক লোকদের যারা বুদ্ধিমানও নয় বন্ধুও নয়–সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ব্যাপার।”

    “সামরিক লোকদেরও আমি ভালোভাবে সামলেছি।”

    “তাদের কেউ জেনারেল ডুগাল ট্যানারের মতো ছিল না। আমি তাকে চিনি। সে অন্যরকম।”

    “তুমি চেন? দেখা হয়েছে?”

    “ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, কিন্তু সে ম্যানডানভ থেকে এসেছে। আপনি জানেন আমিও ওই সেক্টর থেকেই এসেছি। জান্তার সাথে যোগ দিয়ে শীর্ষপদে উঠার আগে সে ওখানকার ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিল।”

    “কি জানো ওর সম্বন্ধে?”

    “মূর্খ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বদরাগী। এই লোকটাকে আপনি সহজে সামলাতে পারবেন না–বা নিরাপদে। কি ভাবে কি করা যায় তার একটা পরিকল্পনার জন্য সপ্তাহটা আপনি কাজে লাগাতে পারেন।”

    নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন সেলডন। ইলারের কথায় যুক্তি আছে। নিজের মতো একটা পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছেন তিনি। কিন্তু জানেন যে তারপরেও প্রচণ্ড ক্ষমতাধর অথচ বোকা, আত্মম্ভরী এবং বদরাগী একজনকে সামলানো সহজ হবে না।

    . অস্বস্তির সাথে বললেন, “অসুবিধা হবে না। সামরিক জান্তার অবস্থা ট্রানটরে এই মুহূর্তে সবচাইতে নড়বড়ে। ওরা প্রয়োজনের অনেক বেশী সময় টিকে আছে।”

    “আমরা কি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছি। সামরিক জান্তার স্থায়িত্ব বিষয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না।”

    “তোমার অনৈরাজ্যক সমীকরণ ব্যবহার করে এমারিল কিছু হিসাব নিকাশ করেছে।” খানিক বিরতি দিয়ে বললেন, “ভালো কথা, আমি শুনেছি যে কয়েকটা উপসিদ্ধান্ত এখন ইলার সমীকরণ নামে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

    “আমি করি নি, মাস্ট্রো।”

    “আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না, কিন্তু আমি চাই যে সাইকোহিস্টোরির উপাদানগুলো কার্যকারীতার ভিত্তিতে পরিচিতি পাক, ব্যক্তিগত নাম যুক্ত হলেই তিক্ততার সৃষ্টি হবে।”

    “বুঝতে পেরেছি এবং আমি আপনার সাথে একমত, মাস্ট্রো।”

    “সত্যি কথা বলতে কি,” এক ধরনের অপরাধবোধ নিয়ে কথাগুলো বললেন সেলডন, “যখন সবাই বলে বেসিক সেলডন ইকুয়েশন্স অব সাইকোহিস্টোরি তখন আমার ভালো লাগে না। কিন্তু সমস্যা হলো যে এই নামটা একেবারে শুরু থেকেই চলে আসছে, এখন পরিবর্তন করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না।”

    “আশা করি আপনি আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, মাস্ট্রো, আপনার কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার মতে, এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে সাইকোহিস্টোরি বিজ্ঞান আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব আপনাকে দিতে দ্বিধা বোধ করবে। যাই হোক, আপনি অনুমতি দিলে আমরা আবার জেনারেল ট্যানারের আলোচনায় ফিরে আসতে পারি।”

    “আর কি বলার আছে?”

    “ভাবছি যদি আপনি তার সাথে দেখা না করেন। কোনো আলোচনা না করেন।”

    “সে আদেশ করলে কিভাবে তা এড়ানো যাবে?”

    “তাকে জানাতে পারেন যে আপনি অসুস্থ এবং নিজে না গিয়ে অন্য কাউকে পাঠাতে পারেন।”

    “কাকে”

    ইলার জবাব দিল না কিন্তু তার নিরবতাই পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল সে কার কথা ভাবছে।

    সেলডন বললেন, “ধরে নিচ্ছি তুমি নিজে যাওয়ার কথাই ভাবছ।”

    “সেটাই কি ভালো হবে না? আমি জেনারেলের নিজের সেক্টরের নাগরিক। এটা খানিকটা হলেও গুরুত্ব বহন করবে। আপনি ব্যস্ত মানুষ, বয়স হয়েছে, পুরোপুরি সুস্থ নন এই কথা তাকে বোঝানো যাবে সহজেই। যদি আপনার বদলে আমি দেখা করি–মাফ করবেন, মাস্ট্রো–আমি আপনার চাইতে দক্ষ কৌশলে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারব।”

    “অর্থাৎ মিথ্যে কথা বলবে।”

    “যদি প্রয়োজন হয়।”

    “তোমাকে ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে।”

    “খুব বেশী না। মনে হয় না আমাকে মেরে ফেলার আদেশ দেবে, যদিও কাজটা তার জন্য খুবই সহজ, কাজেই শাস্তি মওকুফের আবেদন করার সুযোগ থাকবে। অথবা আমার হয়ে আপনি তার কাছে আবেদন করতে পারেন যে অল্প বয়স এবং অনভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে যেন আমাকে ক্ষমা করা হয়। যাই হোক, আমি বিপদে পড়লেও সেটা আপনি বিপদে পড়ার চেয়ে কম ক্ষতিকর হবে। আমি প্রজেক্টের কথা চিন্তা করছি, যা আমাকে ছাড়া অনেক কিছুই করতে পারবে কিন্তু আপনাকে ছাড়া এক পাও এগোতে পারবে না।”

    ভুরু কুঁচকে সেলডন বললেন, “তোমার পেছনে গাঢাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, ইলার। লোকটা যদি আমার সাথে দেখা করতে চায় তাহলে আমার সাথেই দেখা হবে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাব আর আমার বদলে অন্য কেউ ঝুঁকি নেবে আমি সেরকম মানুষ নই। আমাকে তুমি কি মনে কর, ইলার?”

    “সহজ সরল এবং সৎ মানুষ–অথচ প্রয়োজন একজন চতুর মানুষের।”

    “আমি চতুর হওয়ার চেষ্টা করব–যদি প্রয়োজন হর। দয়া করে আমাকে খাটো করে দেখোনা ইলার।”

    অসহায় ভঙ্গীতে কাঁধ নাড়ল ইলার, “বেশ। আপনার সাথে বেশী তর্ক করার সাহস আমার নেই।”

    “তাছাড়া, ইলার, মিটিং এর তারিখ পেছানো তোমার উচিত হয় নি। জন্মদিন বাদ দিয়েই আমি জেনারেলের সাথে দেখা করতাম। উৎসবের পরিকল্পনা ও আমার না।” শেষের কথাগুলো আরো গম্ভীরভাবে বললেন।

    “আমি দুঃখিত।” জবাব দিল ইলার।

    “বেশ,” হতাশ ভঙ্গীতে বললেন সেলডন। “দেখা যাক কি হয়।”

    ইলারকে রেখে চলে এলেন তিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে তার আরো কঠোর হওয়া উচিত ছিল যেন অধীনস্তরা আদেশের বাইরে যাওয়ার সাহস না পায়। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন প্রচুর সময়, প্রচুর শ্রম এবং তখন হয়তো আর সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ করার সময়ই পেতেন না। আর তাছাড়া, তেমন মনোবৃত্তিও তার নেই।

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। এমারিলের সাথে কথা বলতে হবে।

    .

    ১০.

    কোনোরকম সাড়াশব্দ না দিয়েই এমারিলের অফিসে ঢুকলেন সেলডন।

    “ইউগো,” কর্কশ সুরে বললেন তিনি, “জেনারেল ট্যানারের সাথে মিটিংটা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।” বিধ্বস্ত ভঙ্গীতে একটা চেয়ারে বসলেন।

    অভ্যাসবশত কাজ থেকে মনযোগ সরাতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল এমারিলের। শেষ পর্যন্ত মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “কি কারণ দেখিয়েছে?”

    “সে বাদ দেয় নি। কয়েকজন ছাত্র মিলে তারিখটা পেছানোর ব্যবস্থা করেছে যেন জন্মদিনের উৎসবটা যথাযথ ভাবে পালন করা যায়। আমি বিরক্ত হয়েছি।”

    “তুমি ওদেরকে করতে দিলে কেন?”

    “আমার অনুমতির জন্য বসে থাকে নি। নিজেরাই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।” হতাশ ভঙ্গীতে কাঁধ নাড়লেন সেলডন, “আমারই দোষ। আমি ছেলেমানুষের মতো ষাট বছর নিয়ে অভিযোগ করেছি বলেই সবাই ঠিক করেছে একটা উৎসব করে আমাকে উত্যুলু করা উচিত।”

    “অবশ্য, সপ্তাহটা আমরা কাজে লাগাতে পারব।” এমারিল বলল। সামনে ঝুকলেন সেলডন। সতর্ক হয়ে উঠেছেন। “খারাপ কিছু ঘটেছে?”

    “না। আমি কিছু পাই নি, তবে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে তো ক্ষতি নেই। দেখ, হ্যারি, ত্রিশ বছরের ভেতর এই প্রথম সাইকোহিস্টোরি ভবিষ্যদ্বাণী করার পর্যায়ে পৌঁছেছে। খুব বেশী কিছু না–মানব জাতির অবিশ্বাস্য বিশাল মহাসাগরের অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দু–কিন্তু এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ঠিক আছে। আমরা সুযোগটা নিতে চাই, বুঝতে চাই কিভাবে কাজ করে, নিজেদের কাছে প্রমাণ করতে চাই যে সাইকোহিস্টোরি ঠিক তাই যা আমরা ভেবেছি : আ প্রেডিকটিভ সাইন্স। কাজেই কোনো কিছুই আমাদের সমীকরণ থেকে বাদ পড়ে নি তা আবার নিশ্চিত করাতে ক্ষতি তো হবে না। এমন কি অতি ক্ষুদ্র এই ভবিষ্যদ্বাণীটাও ভীষণ জটিল এবং আরো এক সপ্তাহ আমি খুশি হয়েই এটা পরীক্ষা করে দেখব।”

    “ঠিক আছে তাহলে। জেনারেলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমি আবার তোমার সাথে কথা বলব যদি শেষ মুহূর্তে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। এর মাঝে, ইউগো, এই ব্যাপারে কোনো তথ্য যেন অন্যদের কাছে না যায়–কারো কাছেই না। যদি ব্যর্থ হই, আমি চাই না প্রজেক্টের সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়ে। তুমি আর আমি মেনে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

    এমারিলের মুখে বিষণ্ণ একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। “তুমি আর আমি। তোমার মনে আছে যখন আমরা দুজনেই ছিলাম তখন কিভাবে কাজ করতাম?”।

    “আমার ভালোভাবেই মনে আছে এবং ভেবো না যে ওই দিনগুলোর অভাব আমি বোধ করি না। আমাদের তখন কিছুই ছিল না”।

    “ইলেকট্রো ক্ল্যারিফায়ারই ছিল না, প্রাইম রেডিয়্যান্ট তো দূরের কথা।”

    “কিন্তু দিনগুলো ছিল সুখের।”

    “সুখের,” মাথা নেড়ে এমারিল বলল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ – আইজাক আসিমভ
    Next Article সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    Related Articles

    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন্স এজ – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    প্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন -আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.