Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফাউণ্ডেশন্স এজ – আইজাক আসিমভ

    নাজমুছ ছাকিব এক পাতা গল্প463 Mins Read0

    ২. ট্র্যাভিজকে গ্রেফতার

    ১১.

    ট্র্যাভিজকে গ্রেফতার করার পরের দিনটা খুব ভালো কাটল মেয়র ব্র্যান্নোর। কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করে তার কাজের অতিরিক্ত প্রশংসা করেছে।

    তবে তিনি জানেন কাউন্সিল অল্প সময়ের ভেতর এই জড়তা কাটিয়ে উঠে তার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সে কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে তিনি ট্র্যাভিজের ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন।

    যে সময় ট্র্যাভিজ এবং পেলোরেট পৃথিবী নিয়ে আলোচনা করছে, সেই সময় মান লী-কম্পর মেয়রের অফিসে সহজ ভঙ্গিতে বসে আছে। মেয়র আরেকবার তার প্রশংসা করলেন।

    কম্পর খাট এবং হালকা পাতলা গড়নের, ট্র্যাভিজের থেকে মাত্র দুই বছরের বড়। দুজনেই কাউন্সিলম্যান হিসাবে নতুন, তরুণ এবং প্রাণচঞ্চল, বোধহয় এই কারণেই তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এছাড়া দুজনের ভেতর আর কোনো মিল নেই।

    ট্র্যাভিজ অস্থির, রাগী, কম্পরের ভেতর রয়েছে নির্মল আত্মবিশ্বাস। কারণটা বোধহয় তার ব্যাতিক্রমী সোনালি চুল এবং নীল চোখ। যার কারণে কম্পরকে (ব্র্যান্নোর বিচারে) কিছুটা মেয়েলী মনে হয়, ফলে মেয়েরা তাকে ট্র্যাভিজের চেয়ে কম পছন্দ করে। কম্পর কখনো নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করে না, যদিও তার লম্বা চুলগুলো সবসময় আঁচড়ানো থাকে। চোখের রং বুঝানোর জন্য সে সব সময় হালকা নীল আই শ্যাডো ব্যবহার করে।

    মেয়েদের প্রতি কম্পরের আকর্ষণ কম। একমাত্র স্ত্রীকে নিয়ে অনেক দিন ধরে একত্রে বাস করছে। তবে এখনো সন্তান গ্রহণের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করেনি। তার কোনো গোপন প্রেমিকা আছে একথা কেউ বলতে পারবে না। ট্র্যাভিজের সাখে এখানেও তার পার্থক্য রয়েছে। ট্র্যাভিজ চাদরের রং পরিবর্তন করার মতো ঘন ঘন বান্ধবী পরিবর্তন করে।

    কোডেলের ডিপার্টমেন্ট দুই কাউন্সিলম্যানের ব্যাপারে কিছুই জানতে বাকি রাখেনি। কোডেল নিজেও সবসময়ের মতো সহজ ও হাসিখুশী ভঙ্গিতে একটা সোফায় বসে আছে।

    কাউন্সিলম্যান কম্পর, ব্র্যান্নো বলেন, তুমি ফাউণ্ডেশনের যথেষ্ট সেবা করেছ। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, তোমাকে সবার সামনে প্রশংসা করা যাচ্ছেনা। আবার তোমার কাজের মূল্যায়ন সাধারণভাবে করা উচিত না।

    কম্পর হাসল। তার দাঁতগুলো সাদা এবং ঝকঝকে। ব্র্যানো মুহূর্তের জন্য ভাবলেন, সিরিয়াস সেকটরের সবার দাঁতগুলো যদি এমন হতো। কম্পর প্রায়ই বলে তার মায়ের মা, যার চুলগুলো ছিলো সোনালি এবং চোখ দুটো ছিল নীল, তিনি ছিলেন সিরিয়াস সেকটরের বাসিন্দা। তবে কোডেলের মতে কম্পরের দাবীর সঠিক কোনো প্রমাণ নেই।

    মেয়েরা মেয়েদের মতোই, কোডেল একবার বলেছিল।

    ব্র্যান্নো শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, মেয়েদের ব্যাপারে তোমার তাই। ধারণা?

    কোডেল হেসে বলেছিল, আমি সাধারণ মেয়েদের কথা বলছি।

    ফাউণ্ডেশনের জনগণ আমার কথা জানুক বা না জানুক–আপনি জানলেই চলবে। কম্পর বলল।

    আমি জানি এবং কখনো ভুলব না। মনে করো না যে তোমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছ সেটা তোমাকে শেষ করতে হবে। আমরা ট্র্যাভিজের ব্যাপারে আরো জানতে চাই।

    ট্র্যাভিজের ব্যাপারে আমি সব বলেছি।

    আমি বিশ্বাস করি না, বলা ভালো সব বলে দিয়েছ বলেই তুমি বিশ্বাস করো। যাই হোক আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। জেনোভ পেলোরেট নামে এক ভদ্রলোককে তুমি চেন?

    কম্পরের কপালে এক মুহূর্তের জন্য ভাঁজ পড়েই সমান হয়ে গেল। সতর্ক গলায় বলল, কখনো দেখে থাকলে হয়তো চিনতাম। কিন্তু নাম শুনে মনে হচ্ছে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

    সে একজন স্কলার।

    এমনভাবে ঠোঁট গোল করল কম্পর যেন কোনো স্কলারের সাথে তার পরিচয়। থাকতে পারে, মেয়রের এমন প্রত্যাশায় সে অবাক হয়েছে।

    পেলোরেট এক অদ্ভুত চরিত্র, মেয়র বল্লেন। সে তার নিজের কোনো। উচ্চাকাঙ্খা পূরণের জন্য ট্রানটরে যেতে চায়। ট্র্যাভিজ তার সাথে যাবে। তুমি যেহেতু ট্র্যাভিজের অনেকদিনের পুরোনো বন্ধু, হয়তো তার চিন্তা-ভাবনা বুঝতে পারবে। এখন তুমিই বলো–ট্র্যাভিজ কি ট্র্যানটরে যেতে রাজী হবে?

    আপনি যদি এমন ব্যবস্থা করেন যে ট্র্যাভিজ মহাকাশযান চালিয়ে ট্রানটরে যেতে বাধ্য হয়, তাহলে সে আর কি করতে পারবে। নিশ্চয়ই আশা করেন না যে সে বিদ্রোহ করে জাহাজ দখল করে নেবে।

    বুঝতে পারনি। সে আর পেলোরেট একা থাকবে এবং ট্র্যাভিজের হাতে থাকবে নিয়ন্ত্রণ।

    আপনি জানতে চান ট্র্যাভিজ নিজের ইচ্ছায় ট্র্যানটরে যাবে কি না?

    ঠিক তাই।

    ম্যাডাম মেয়র, সে কি করবে আমি জানব কিভাবে?

    কাউন্সিলম্যান কম্পর, তুমি ট্র্যাভিজের বেশ কাছাকাছি ছিলে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব নিয়ে তার বিশ্বাসের কথা তুমি জানো। সে কখনো বলেনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কোথায় থাকতে পারে বা কোথায় খুঁজতে হবে?

    কখনোই না, ম্যাডাম মেয়র।

    তোমার কি মনে হয়, ট্র্যাভিজ খুঁজে পাবে?

    কম্পর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। আমি মনে করি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সেটা যাই হোক বা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, আর্কেডির সময়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। আর্কেডির গল্পগুলো আমি বিশ্বাস করি।

    তাই? তাহলে বন্ধুর সাথে বেঈমানী করলে কেন? ট্র্যাভিজ যদি এমন কিছুর পেছনে লেগে থাকত যার কোনো অস্তিত্বই নেই, তাহলে তার অদ্ভুত ধারণা প্রচার করে কতটুকু ক্ষতি করতে পারত?

    শুধু যে ব্যাপারটা সত্যি হলেই ক্ষতি হবে, এমন তো না। তার ধারণা অদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু সেগুলো টার্মিনাসের জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, মহাজগতের ঐতিহাসিক নাটকে ফাউণ্ডেশনের ভূমিকা নিয়ে তাদের মনে ভয় ও সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে ফলে ফেডারেশনের উপর ফাউণ্ডেশনের নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, ধূলিসাৎ হয়ে যাবে আরেকটি মহাজাগতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন। আপনি নিজেও তাই ভেবেছেন মেয়র, নইলে তাকে কাউন্সিল থেকে বের করে দিতেন না, আর এখন বিনা বিচারে নির্বাসনে পাঠাতেন না। জিজ্ঞেস করতে পারি, কেন এমন করেছেন, মেয়র?

    বলতে পার সতর্কতা। খুব সামান্য হলেও সম্ভাবনা থাকতে পারে ট্র্যাভিজের কথাই ঠিক, সেটা মারাত্মক হতে পারে।

    কম্পর কিছুই বলল না।

    ব্র্যান্নোই আবার কথা বল্লেন, আমি এমন এক অবস্থানে আছি যেখানে খুব সামান্য সম্ভাবনা ও হিসাবে রাখতে হয়। যাই হোক, আবার জিজ্ঞেস করছি, তোমার কোনো ধারণা নেই ট্র্যাভিজ কোথায় যেতে পারে বা সে জানে কিনা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কোথায়?

    না।

    এই ব্যাপারে কখনো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি?

    না, দেয়নি

    কখনোই দেয়নি? চিন্তা করে বলো।

    কখনোই না। কম্পর ভদ্রগলায় বলল।

    কোনো ইঙ্গিত, ঠাট্টা করে বা অন্যমনস্কভাবে কিছু বলেনি? এমন কোনো আচরণের কথা মনে পড়ে না যা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে?

    কোনোটাই না ম্যাডাম মেয়র। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নিয়ে তার কথাবার্তা ছিল অস্পষ্ট তারার মতো। আপনি জেনেশুনেই সময় নষ্ট করছেন।

    তুমি কি হঠাৎ দলবদল করছ, যে বন্ধুকে আমার হাতে তুলে দিয়েছ তাকে রক্ষা করছনা তো?

    আপনার হাতে তাকে তুলে দেয়াটা আমার কর্তব্য বলে মনে করেছি। এটা নিয়ে আমার মনে কোনো অনুতাপ নেই, বা আমার আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

    তাহলে তুমি বলতে পারছনা মহাকাশযান পাওয়ার পর ট্র্যাভিজ কোথায় যাবে?

    আমি আগেই বলছি

    কিন্তু কাউন্সিলম্যন, মেয়রের বয়স্ক মুখে অসংখ্য ভাঁজ পড়ে চেহারা আরো বিষণ্ণ করে তুলল, আমি জানতে চাই সে কোথায় যাবে।

    সেই ক্ষেত্রে, আমি মনে করি আপনার উচিত জাহাজে একটা হাইপার রিলে বসানো।

    কথাটা আমিও ভেবেছি, কাউন্সিলম্যান। কিন্তু ট্র্যাভিজ বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ লোক এবং আমার ধারণা যত কৌশলেই লুকানো হোক সে ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলবে–যদিও জিনিসটা এমনভাবে বসানো হবে যেন জাহাজের ক্ষতি না করে সেটা সরানো যাবে না।

    চমৎকার বুদ্ধি।

    সমস্যা শুধু একটাই, মেয়র বললেন, সে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে পুরোপুরি স্বাধীন মনে না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের পথে যাবে না। তাতে আমার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

    তাহলে আপনি জানতে পারছেন না সে কোথায় যাবে।

    পারি যদি একটা পুরোনো কৌশল ব্যবহার করি। যে লোক জটিল কৌশলের কথা ভেবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে সে কখনো পুরোনো কৌশলের কথা চিন্তা করবেনা।–আমি ট্র্যাভিজকে অনুসরণের কথা ভাবছি।

    অনুসরণ?

    ঠিক তাই। আরেকজন চালক এবং আরেকটা মহাকাশযানের সাহায্যে। দেখ তুমি নিজে কতখানি অবাক হয়েছ। ট্র্যাভিজও অবাক হবে। মহাকাশে আরেকজন অনুসরণকারীর কথা সে কল্পনাও করবে না। তারপরেও আমরা ব্যবস্থা করব, যেন তার জাহাজে আধুনিক মাস-ডিটেকশন ডিভাইস না থাকে।

    ম্যাডাম মেয়র, আপনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি যে মহাকাশে উড্ডয়নের ব্যাপারে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মহাকাশে একটা জাহাজ নিয়ে আরেকটা জাহাজকে অনুসরণ করা একেবারেই অসম্ভব। ট্র্যাভিজ প্রথম হাইপার স্পেশাল জাম্প দিয়েই পালিয়ে যেতে পারবে। এমনকি সে যদি নাও জানে যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে, প্রথম জাম্পই হবে তার মুক্তির পথ। তার জাহাজে একটা হাইপার রিলে না বসালে, তাকে ট্রেস করা যাবে না।

    আমার অভিজ্ঞতার অভাব আছে মেনে নিচ্ছি। তোমার আর ট্র্যাভিজের মতো আমার ন্যাভাল ট্রেনিং নেই। কিন্তু আমার উপদেষ্টারা বলেছে-যারা তোমাদের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত-জাম্প এর সময় যদি মহাকাশযানের লক্ষ্য, গতি এবং ত্বরণ পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে হাইপার স্পেশাল জাম্পের মাধ্যমে সেটি কোথায় পৌঁছবে সেটা। অনুমান করা যাবে। একটা ভালো কম্পিউটার এবং ভালো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একজন অনুসরণকারীর পক্ষে জাম্পটা হুবহু নকল করে ট্রেইলের অপর প্রান্তের খুব কাছাকাছি পৌঁছানো অসম্ভব হবে না-বিশেষ করে যদি অনুসরণকারীর কাছে ভাল একটা মাস ডিটেক্টর থাকে।

    সেটা একবার সম্ভব হতে পারে। কম্পর জোর গলায় বলল, এমনকি দুবারও সম্ভব হতে পারে, যদি অনুসরণকারীর ভাগ্য খুব ভালো হয়। কিন্তু সেই পর্যন্তই, এর বেশি হবে না। আপনি এটার উপর ভরসা করতে পারেন না।

    হয়তো পারি।–কাউন্সিলম্যান কম্পর, তুমি অনেক হাইপার রেসে অংশ নিয়েছ। বুঝতেই পারছ তোমার ব্যাপারে আমরা অনেক কিছু জানি। তুমি অসম্ভব ভালো একজন পাইলট এবং হাইপার জাম্পে কোনো প্রতিযোগীকে অনুসরণ করার ব্যপারে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছ।

    কষ্পরের চোখদুটো বড় হয়ে গেছে। চেয়ারে বসে থাকা অবস্থাতেই তার দেহ অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মোচড় খেলো। আমি তখন কলেজে পড়তাম। এখন আমার বয়স হয়েছে।

    খুব বেশি না। পঁয়ত্রিশ হয়নি এখনো। তুমি ট্র্যাভিজকে অনুসরণ করবে কাউন্সিলম্যান। সে যেখানে যাবে, তুমি তার পেছনে লেগে থাকবে এবং আমার কাছে রিপোর্ট করবে। ট্র্যাভিজ রওয়ানা দেয়ার কিছুক্ষণ পরে তুমিও যাবে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্র্যাভিজ রওয়ানা দেবে। রাজী না হলে তোমাকে জেলে ঢোকানো হবে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে। ব্যর্থ হলে আর কখনো ফিরে আসবে না। সেই চেষ্টা করলে মহাকাশেই তোমাকে ধ্বংস করে দেয়া হবে।

    ঝট করে উঠে দাঁড়ালো কম্পর। আমার একটা জীবন আছে। অনেক দায়িত্ব আছে। স্ত্রী আছে। এগুলো ছেড়ে যেতে পারব না।

    তোমাকে পারতেই হবে। আমরা যারা ফাউণ্ডেশনের সেবা করার ব্রত নিয়েছি তাদেরকে প্রয়োজন হলে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

    আমি আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাব।

    আমাকে বোকা পেয়েছ? তোমার স্ত্রী এখানেই থাকবে।

    জিম্মি হিসেবে?

    তোমার যা খুশী ভাবতে পার। আমি বরং বলব যে তুমি যাচ্ছ বিপদের মাঝে। আমার দয়ালু মন চায় না তোমার স্ত্রীও বিপদে পড়ক। এখানেই সে নিরাপদ থাকবে। তোমার আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই। এখন থেকে তুমিও ট্র্যাভিজের মতো বন্দী। তুমিতো জানোই আমাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে অন্তত টার্মিনাসের আনন্দ উল্লাস থেমে যাওয়ার আগে। ভয় হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আমার ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়বে।

    .

    ১২.

    আপনি তার সাথে নরম আচরণ করেননি, ম্যাডাম মেয়র। কোডেল বলল।

    মেয়র নাক সিঁটকে বললেন, কেন করব। সে বন্ধুর সাথে বেঈমানী করেছে।

    সেটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।

    হয়েছে। কিন্তু পরের বেঈমানীটা নাও হতে পারে।

    কেন ভাবছেন, আবার সে বেঈমানী করবে?

    শোন, লিয়নো, মেয়র অধৈর্য স্বরে বল্লেন, যে একবার বেঈমানী করে সে সারাজীবনই সন্দেহের তালিকায় থাকে।

    অর্থাৎ কম্পর আবার ট্র্যাভিজের সাথে মিলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তারা দুজন মিলে হয়তো

    তুমি নিজেও বিশ্বাস করো না। ট্র্যাভিজ বোকা এবং একগুয়ের মতো তার লক্ষ্যে স্থির থাকে। তার অভিধানে বিশ্বাসঘাতকতা বলে কোনো শব্দ নেই এবং সে আর কখনোই, কোনো অবস্থাতেই কম্পরকে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করবে না।

    মাফ করবেন, মেয়র। হয়তো আপনার কথা বুঝতে পারি নি। আপনি কম্পরকে কতটুকু বিশ্বাস করবেন? কিভাবে বুঝবেন যে সে ট্র্যাভিজকে অনুসরণ করে ঠিকমতো রিপোর্ট করবে? স্ত্রীর ভালমন্দের প্রতি কম্পরের দায়দায়িত্ব বা স্ত্রীর কাছে ফিরে আসার ব্যাকুলতার উপর নির্ভর করছেন?

    দুটোই, তবে এই দুটোর উপর পুরোপুরি নির্ভর করছি না। কম্পরের জাহাজে হাইপার রিলে বসানো হবে। ট্র্যাভিজ ধারণা করবে যে তাকে অনুসরণ করা হতে পারে, তাই সে সতর্ক থাকবে। কিন্তু কম্পর অনুসরণকারী, তাকেও অনুসরণ করা হতে পারে একথা সে ভাববে না। আর যদি সে হাইপার রিলে পেয়েই যায়, তখন আমাদেরকে তার স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণের উপর নির্ভর করতে হবে।

    কোডেল হাসল। চিন্তা করা যায়, এক সময় আমি আপনাকে শিখিয়েছিলাম। যাই হোক অনুসরণ করার উদ্দেশ্য কি?

    দ্বিগুণ নিরাপত্তা। যদি কোনো কারণে ট্র্যাভিজ ধরা পড়ে যায় তখন কম্পর কাজ চালিয়ে যাবে এবং ট্র্যাভিজ যে খোঁজ এনে দিতে পারে নি কম্পর সেটা এনে দেবে।

    আরেকটা প্রশ্ন। যদি ট্র্যাভিজ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে পায় এবং ট্র্যাভিজ বা কম্পরের মাধ্যমে আমরা সেটা জানতে পারি কিংবা দুজনের জীবনের বিনিময়ে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হই, তখন কি হবে?

    আমার ধারণা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন এখনো টিকে আছে, লিয়নো। সেলডন প্ল্যান আমাদেরকে আর খুব বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। মহান হ্যারী সেলডন এটা তৈরি করেছিলেন সাম্রাজ্যের ধ্বংসের দিনগুলোতে, যখন টেকনোলজীর অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল পুরোপুরি। সেলডন ছিলেন তার সময়ের সেরা, কিন্তু তার কিংবদন্তীর সাইকোহিন্ত্রী বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই বিজ্ঞান ক্রমাগত উন্নয়নশীল টেকনোলজীতে প্রয়োগ করা যাবেনা। ফাউণ্ডেশন টেকনোলজীতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, বিশেষ করে গত এক শতাব্দীতে। আমরা যে মাস ডিটেকশন তৈরি করেছি সেটা আগে কল্পনাও করা যায়নি, বর্তমান যুগের কম্পিউটার মানুষের চিন্তার সাথে সাড়া দিতে পারে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমাদের রয়েছে মেন্টাল শিল্ডিং। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন যদি এই মুহূর্তে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেও, আর খুব বেশিদিন পারবে না। আমি ক্ষমতায় থাকার শেষবছরে টার্মিনাসকে নতুন পথে চালাতে চাই।

    আর যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন না থাকে?

    সাথে সাথে আমরা নতুন পথে যাত্রা শুরু করব।

    .

    ১৩.

    অনেক সাধনার পর ঘুম আসলেও ট্র্যাভিজ বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারল না। দ্বিতীয়বার তার কাঁধে ছোঁয়া লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।

    জেগে উঠলেও তার দৃষ্টি এখনো ঝাপসা। বুঝতে পারছে না অপরিচিত বিছানায় কেন সে শুয়ে আছে। কি কি?

    পেলোরেট ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল, দুঃখিত, কাউন্সিলম্যন ট্র্যাভিজ। তুমি আমার অতিথি, তোমাকে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া উচিত। কিন্তু মেয়র এসেছেন। পেলোরেট বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ফ্লানেলের পাজামা, শরীর সামান্য কাঁপছে। ট্র্যাভিজের সব মনে পড়ে গেল। এখন সে পুরোপুরি সজাগ।

    মেয়র বসে আছেন পেলোরেটের লিভিং রুমে, সবসময়ের মতো ধীর, স্থির আত্মবিশ্বাসী। সাথে কোডেলও আছে। ধীরে ধীরে তা দিচ্ছে সাদা গোঁফে।

    ট্র্যাভিজ স্যাশ ঠিক করতে করতে অবাক হয়ে ভাবল এই দুজন–মেয়র আর কোডেল–কখনো আলাদা হবে?

    কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, কাউন্সিল জড়তা কাটিয়ে উঠেছে? তারা বুঝতে পারছে যে তাদের একজন সঙ্গী নেই?

    কিছুটা, তোমার কোনো উপকার হবে না তাতে, মেয়র বল্লেন। এখনো বলপ্রয়োগ করে তোমাকে বের করে দিতে পারব, কোনো সন্দেহ নেই। তোমাকে এখন আলটিমেট স্পেসপোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে।

    টার্মিনাস স্পেসপোর্টে যাবনা, ম্যাডাম মেয়র? হাজার হাজার লোক চোখের

    পানি দিয়ে আমাকে বিদায় জানাবে, সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছেন?

    কৌতুক করার অভ্যাস ফিরে পেয়েছ তাহলে। খুশী হলাম। আলটিমেট স্পেসপোর্ট থেকে তুমি আর প্রফেসর পেলোরেট গোপনে যাত্রা করবে।

    এবং কখনো ফিরে আসব না?

    এবং হয়তো কখনো ফিরে আসবে না। যদি গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি প্রয়োজনীয় কিছু জানতে পার, আমি নিজেই তোমাকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনব।

    ট্র্যাভিজ স্বাভাবিকভাবে মাথা নাড়ল, হতেও পারে।

    অনেক কিছুই হতে পারে। যাই হোক, তুমি আরামেই থাকবে। সবচেয়ে আধুনিক ছোট একটা ক্রুজার দেয়া হচ্ছে তোমাকে, নাম ফার স্টার, হোবার ম্যালোর ক্রুজারের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। একজনই চালাতে পারবে, তবে তিনজন লোকের আরামে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

    ট্র্যাভিজ এক ঝটকায় তার হালকা মেজাজ ঝেড়ে ফেলল। পুরোপুরি অস্ত্রসজ্জিত?

    না, তবে সুসজ্জিত। যেখানেই যাবে, তুমি ফাউণ্ডেশনের নাগরিকের মর্যাদা পাবে এবং প্রয়োজন হলে ফাউণ্ডেশন কন্সলের সাহায্য নেবে, কাজেই অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনে যে কোনো জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে তবে পরিমাণ সীমিত।

    আপনি অসাধারণ।

    আমি জানি, কাউন্সিলম্যান। কিন্তু, কাউন্সিলম্যান, বুঝতে চেষ্টা কর। তুমি প্রফেসর পেলোরেটকে পৃথিবী অনুসন্ধানে সাহায্য করছ। তুমি যাই ভাব না কেন, আসলে যাচ্ছ পৃথিবী অনুসন্ধানে। যাদের সাথে তোমার দেখা হবে, সবাইকে এটা বোঝাতে হবে এবং সবসময় মনে রাখবে যে ফার স্টারে কোনো অস্ত্র নেই।

    আমি যাচ্ছি পৃথিবী অনুসন্ধানে, ট্র্যাভিজ বলল। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি।

    তাহলে তুমি যেতে পার।

    মাফ করবেন। আরেকটু বাকি রয়ে গেল। আমি পুরোনো মহাকাশযান চালিয়েছি। কিন্তু আধুনিক যুগের ছোট মডেলের ক্রুজার চালাইনি। যদি না চালাতে পারি তখন কি হবে।

    আমাকে বলা হয়েছে ফার স্টার পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড।–আধুনিক মহাকাশযানের কম্পিউটার চালাতে না জানলেও চলবে। কম্পিউটারই তোমার যা জানার প্রয়োজন সব বলে দেবে। আর কিছু?

    ট্র্যাভিজ বিতৃষ্ণা নিয়ে নিজের পোশাকের দিকে তাকালো। পোশাক দরকার।

    সব জাহাজে পাবে। স্যাশ না কি বলে সেগুলোও দেয়া হয়েছে। প্রফেসরের প্রয়োজনীয় সবকিছুও দেয়া হয়েছে। তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি কোনো মেয়ে সঙ্গী। দিতে পারছি না।

    খুব খারাপ, ট্র্যাভিজ বলল। থাকলে ভালো হতো, অবশ্য এই মুহূর্তে তেমন পছন্দের কেউ নেই। যাই হোক গ্যালাক্সি বেশ জনবহুল এবং একবার এখান থেকে বেড়িয়ে আমার যা খুশী তাই করতে পারব।

    সঙ্গীকে বিরক্ত না করে যা তোমার ভালো লাগে করবে।

    তিনি দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি তোমার সাথে স্পেসপোর্টে যাব না। কিন্তু সাথে অন্যরা যাবে। করতে বলা হয়নি এমন কিছু তুমি করো না। পালানোর চেষ্টা করলে রক্ষীরা সাথে সাথে তোমাকে মেরে ফেলবে।

    আমি পালানোর কোনো চেষ্টা করব না, ম্যাডাম মেয়র, ট্র্যাভিজ বলল। তবে একটা কথা

    হ্যাঁ, বলো?

    ট্র্যাভিজ নিজের মনের ভেতর থেকে শব্দগুলো বাছাই করে নিয়ে মৃদু হেসে কথাগুলো বলল, সময় আসবে, ম্যাডাম মেয়র, যেদিন আপনি আমার কাছে কিছু চাইবেন। তখন আমি আমার ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব, কিন্তু গত দুদিনের কথা আমি ভুলব না।

    মেয়র ব্র্যান্নো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমাকেও একটু নাটক করতে দাও। যদি সেই সময় আসে, তো আসবে, কিন্তু এখন-আমি কিছুই চাই না।

    .

    মহাশূন্যে

    ১৪.

    এমন চমৎকার এবং ঝকঝকে-তকতকে মহাকাশযান ট্র্যাভিজ আগে কখনো দেখেনি। প্রথম দর্শনেই এটার প্রেমে পড়ে গেল সে।

    ছোট আকৃতির মহাকাশযান। গতি ও শক্তির জন্য আধুনিক গ্র্যাভিটিক ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। বড় কথা হচ্ছে এতে রয়েছে সর্বাধুনিক কম্পিউটার পদ্ধতি। আকারে বড় হলে এই সুবিধাগুলো পাওয়া যেত না।

    পুরনো মহাকাশযান চালানোর জন্য এক থেকে দুই ডজন নাবিকের প্রয়োজন হতো। কিন্তু এই ছোট যান চালানোর জন্য একজনই যথেষ্ট। শিফটিং ডিউটি পালনের জন্য একজন অতিরিক্ত চালক রাখা যেতে পারে। এই একটা যান দিয়েই। ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের বাইরের যে কোনো মহাকাশযান বহরের সাথে লড়াই করা যাবে। প্রচলিত যে কোনো যানের কাছ থেকে দ্রুতগতিতে পালিয়ে যাওয়া যাবে।

    যানের কাঠামো চকচকে মসৃণ। প্রতি ঘনমিটার জায়গা সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে বাইরে থেকে এর আয়তন সম্বন্ধে ধারণা করা যাবেনা। মিশনের ব্যাপারে কোনো বক্তব্যই ট্র্যাভিজকে খুব বেশি মুগ্ধ করতে পারে নি, যতটা মুগ্ধ করেছে এই মহাকাশযান।

    ব্র্যান্নো দ্য ব্রোঞ্জ কৌশলে তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিপজ্জনক মিশনে জড়িয়ে ফেলেছেন। মেয়র পরিস্থিতি এমন তৈরি করেছেন যাতে ট্র্যাভিজ কি করতে পারে সেটা দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে হয়তো সে মেয়রের প্রস্তাব মেনে নিত না।

    পেলোরেট একেবারে অবাক। বিশ্বাস করতে পার, মহাকাশযানের হাল এ আলতোভাবে একটা আঙ্গুল রেখে বলল, আমি কখনো স্পেসশীপের এত কাছে আসিনি।

    আপনি যখন বলছেন অবশ্যই বিশ্বাস করব, প্রফেসর, কিন্তু ম্যানেজ করলেন। কিভাবে?

    সত্যি বলছি নিজেও জানি না, ট্র্যাভিজ। জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছি শুধু গবেষণা করে। যখন তোমার একটা শক্তিশালী কম্পিউটার থাকবে যা দিয়ে গ্যালাক্সির যে কোনো কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করা যাবে, তখন তোমাকে ছুটোছুটি করার প্রয়োজন হবে না। ভেবেছিলাম স্পেসশীপগুলো আরো বড় হয়।

    এটা ছোট একটা মডেল, তবে এই আকৃতির অন্য যে কোনো যানের তুলনায় এর ভেতরে প্রচুর জায়গা রয়েছে।

    অসম্ভব, তুমি ঠাট্টা করছ।

    না, না। সত্যি বলছি। এটাই হচ্ছে মধ্যাকর্ষণ শক্তি চালিত প্রথম মহাকাশযান।

    বুঝিয়ে বল। পদার্থ বিজ্ঞানের খুব বেশি ব্যাখ্যা থাকলে বলার দরকার নেই। তুমি যা বলবে আমি তাই মেনে নেব। মানবজাতির উৎপত্তি এবং মূল গ্রহ নিয়ে আমার ব্যাখ্যা যেমন তুমি মেনে নিয়েছ।

    দেখি চেষ্টা করে, প্রফেসর। হাজার হাজার বছর ধরে মহাকাশে উড্ডয়নের জন্য আমরা রাসায়নিক ইঞ্জিন, আয়োনিক ইঞ্জিন এবং হাইপার এটমিক ইঞ্জিন ব্যবহার করে আসছি। সেগুলো সবই বিশালাকৃতির। পুরনো ইম্পেরিয়াল নেভীর। যানগুলো ছিল পাঁচশ মিটার লম্বা কিন্তু ভিতরে নড়াচড়া করার জায়গা থাকত না। এই মহাকাশযান হচ্ছে সর্বশেষ সংযোজন, উড্ডয়নের জন্য এটি বিপরীত মধ্যাকর্ষণ। শক্তিকে ব্যবহার করে। যে যন্ত্রের সাহয্যে কাজটি করা হয় সেটি খুব ছোট এবং সাধারণত মহাকাশযানের হাল এ বসানো থাকে। যন্ত্রটা না থাকলে আমাদের হাইপার এটমিক-

    একজন রক্ষী এগিয়ে এল, আপনারা উঠে পড়ুন।

    ধীরে ধীরে আকাশে ভোরের আলো ফুটছে, তবে সূর্য উঠতে এখনো আধঘণ্টা বাকি।

    ঐভিজ চারদিকে তাকালো। আমার জিনিসপত্র সব তোলা হয়েছে?

    জি, কাউন্সিলম্যান, সবই তোলা হয়েছে।

    পোশাক, মনে হয় সেগুলো আমার গায়ে লাগবেনা বা পছন্দ হবে না।

    রক্ষী হঠাৎ করেই হেসে ফেলল, অনেকটা বালকসুলভ হাসি। আমারো তাই মনে হয়, সে বলল। মেয়র গত ত্রিশ থেকে চল্লিশ ঘণ্টা অতিরিক্ত খাঁটিয়েছেন শুধু আপনার পছন্দের জিনিসগুলো সংগ্রহ করার জন্য। শুনুন, রক্ষী চারপাশে তাকালো। যেন তার হঠাৎ বন্ধুসুলভ আচরণ কারো চোখে না পড়ে, আপনারা দুজন ভাগ্যবান। সবচেয়ে ভালো জাহাজ পেয়েছেন। সব সুযোগ সুবিধা রয়েছে, অস্ত্র ছাড়া। আপনারা আসলে দুধের সাগরে ভাসছেন।

    টক দুধ, সম্ভবত, ট্র্যাভিজ বলল। বেশ, প্রফেসর আপনি তৈরি।

    এটা যখন আছে, আমি তৈরি, পেলোরেট মুখে বলল, আর হাত তুলে প্লাস্টিকের ব্যাগে ঢোকানো বিশ সেন্টিমিটার চওড়া একটা গোলাকার বস্তু দেখালো। ট্র্যাভিজের। হঠাৎ খেয়াল হলো বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় থেকেই জিনিসটা প্রফেসরের হাতে। রয়েছে। একবারও হাতছাড়া করে নি। এমনকি সকালের নাস্তা করার সময়ও না।

    কি এটা, প্রফেসর?

    আমার পুরো লাইব্রেরি, একটা মাত্র ডিস্কে। বিষয়বস্তু অনুযায়ী ইনডেক্স করা আছে। এই জাহাজকে তোমার বিস্ময়কর মনে হয়, এই ডিস্কটাকে কি বলবে। একটা পুরো লাইব্রেরি! সারাজীবন আমি যা সংগ্রহ করেছি! চমৎকার! চমৎকার

    বেশ, ট্র্যাভিজ বলল, আমরা আসলেই দুধের সাগরে ভাসছি।

    .

    ১৫.

    ভিতরে ঢুকেই ট্র্যাভিজ অবাক হয়ে গেল। মহাকাশযানে জায়গার ব্যবহার সত্যিই অসাধারণ। একটা স্টোররুম, সেখানে খাবার, কাপড়, ফিল্ম এবং খেলারসরঞ্জামে ঠাসা। একটা জিমনেশিয়াম, একটা পার্লার এবং দুটো আলাদা বেডরুম রয়েছে।

    এই ঘরটা বোধহয়, ট্র্যাভিজ বলল, আপনার, প্রফেসর, কারণ এখানে একটা এফ এক্স রিডার রয়েছে।

    চমৎকার, পেলোরেট সন্তুষ্ট হয়ে বলল। এতদিন বোকার মতো মহাকাশ ভ্রমণ এড়িয়ে চলেছি। এখানে আমি থাকতে পারব মাই ডিয়ার, ট্র্যাভিজ। কোনো অসুবিধা হবে না।

    যা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বড়। ট্র্যাভিজ আনন্দের সাথে বলল।

    ইঞ্জিনগুলো আসলেই হাল এ বসানো হয়েছে?

    ইঞ্জিন বা কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তো আছেই। আমাদেরকে জ্বালানী মজুদ করে রাখতে হবে না বা পথে থামতেও হবে না। আমরা মহাবিশ্বের মৌলিক। শক্তি ভাণ্ডারকে ব্যবহার করব-ফলে জ্বালানী বা ইঞ্জিন সবই ওখানে। ট্র্যাভিজ হাত দিয়ে বাইরের দিকে দেখালো।

    আমি ভাবছি যদি কোনো গোলমাল হয়, তখন কি করব?

    স্পেস নেভিগেশনের উপর ট্রেনিং আছে, কিন্তু এধরনের কোনো যান চালাইনি। মধ্যাকর্ষণ নিয়ে কোনো গোলমাল দেখা দিলে, আমি বোধহয় কিছু করতে পারব না।

    তুমি এই যান চালাতে পারবে তো?

    ঠিক বলতে পারছি না।

    এটা কি স্বয়ংক্রিয় যান? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল। আমরা শুধুই যাত্রী, বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

    সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে বা মহাকাশ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্য স্বয়ংক্রিয় ফেরীর কথা আমি জানি। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় হাইপার স্পেস ট্রাভেলের কথা কখনো শুনিনি।

    চারপাশে তাকালো ট্র্যাভিজ। ভয় হচ্ছে মেয়র বোধহয় আরো বড় কোনো কৌশল করেছেন। হয়তো সে জানেনা, কিন্তু ফাউণ্ডেশন আন্তসৌরজগতীয় যাতায়াত ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছে। সেই ক্ষেত্রে এই মহাকাশযানের আসবাবপত্রের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ট্রানটরে যেতে হবে।

    হঠাৎ উৎফুল্ল স্বরে সে বলল, প্রফেসর, আপনি এখানে বসে থাকুন। মেয়র আমাকে বলেছিলেন মহাকাশযান সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড। যদি আপনার ঘরে একটা এফ এক্স রীডার থাকে, তাহলে আমার ঘরে একটা কম্পিউটার থাকতে বাধ্য। আপনি এখানে আরাম করুন, আমি চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি।

    পেলোরেট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। ট্র্যাভিজ, মাই ডিয়ার চ্যাপ, তুমি জাহাজ থেকে নেমে যাবে নাতো?

    তেমন কোনো ইচ্ছা নেই, প্রফেসর। চেষ্টাও যদি করি, নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমাকে আবার ধরে আনা হবে। মেয়রের ইচ্ছা না আমি পালিয়ে যাই। আমি শুধু জানার চেষ্টা করছি কিভাবে ফার স্টারকে চালানো যাবে। ট্র্যাভিজ হাসল, আপনাকে একা ফেলে যাবনা, প্রফেসর।

    নিজের জন্য নির্ধারিত শোবার ঘরে ঢোকার সময়ও সে হাসছিল, কিন্তু ভিতরে ঢুকেই সে হয়ে গেল আরো ধীর স্থির শান্ত। মহাকাশযান যে গ্রহের আশেপাশে থাকবে সেই গ্রহের সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা অবশ্যই রয়েছে। পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো মহাকাশযানের কথা কল্পনাই করা যায় না। তাছাড়া কোনো না কোনো স্থানে-সম্ভবত দেয়ালের কোটরে-মেয়রের অফিসের সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা থাকতে বাধ্য।

    ট্র্যাভিজ সতর্কতার সাথে দেয়াল, বিছানার মাথার কাছটা এবং সুন্দর করে সাজানো ফার্নিচারগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। এখানে কিছু না পেলে পুরো যান খুঁজে দেখতে হবে।

    ঘুরে প্রায় বেরিয়ে আসছিল, এমন সময় ডেস্কের হালকা বাদামী পৃষ্ঠদেশে একটা আলোর ঝলক চোখে পড়ল। আলোর একটা বৃত্ত, পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে কম্পিউটার নির্দেশনা।

    আহ!

    হার্টবিট বেড়ে গেল তার। কম্পিউটার অনেক আছে, আছে এমন সব প্রোগ্রাম যাঃ তৈরি করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। ট্র্যাভিজ কখনো নিজের বুদ্ধিকে খাটো করে দেখেনি। কিন্তু সে গ্র্যাণ্ডমাস্টার না। অনেকেই কম্পিউটার চালাতে পারে, অনেকেই পারে না এবং ট্র্যাভিজ ভলোমতোই জানে সে কোন দলে পড়ে।

    ফাউণ্ডেশন নেভীতে ট্র্যাভিজ ছিল লেফটেন্যান্ট এবং একবার অফিসার অব দ্যা ডে নির্বাচিত হয়েছিল। সেই সময় নেভীশিপের কম্পিউটারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে, কিন্তু একক কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি-এবং অফিসার অব দ্যা ডে হিসেবে যতটুকু জানা প্রয়োজন তার বেশি জানার চেষ্টা করেনি।

    প্রোগ্রামের বিস্তারিত বর্ণনাসহ বিপুল পরিমাণ প্রিন্টআউট তাকে দেয়া হয়েছিল। টেকনিক্যাল সার্জেন্ট ক্র্যাসনেট-এর কথা তার এখনো মনে আছে। ক্র্যাসন্যাট এমন। ভাবে কম্পিউটারের বর্ণনা দিয়েছিল যেন এটা গ্যালাক্সির সবচেয়ে জটিল বাদ্যযন্ত্র, অথচ অনায়াস দক্ষতার সাথে অপারেট করত। কিন্তু ক্র্যাসন্যাটও খুব বেশি জানতনা।

    দ্বিধাগ্রস্তভাবে ট্র্যাভিজ আলোর বৃত্তে একটা আঙ্গুল রাখল, সাথে সাথে ডেস্কটপ পুরোটা আলোকিত হয়ে উঠল, তার মাঝখানে রয়েছে দুই হাতের করতলের দুটো আউটলাইন-একটা ডান হাতের, একটা বা হাতের। মসৃণভাবে ডেস্কটপ পয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকা হয়ে গেছে।

    ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসল ট্র্যাভিজ। কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছে, তাকে কি করতে হবে।

    আউটলাইনের উপর হাত দুটো রাখল সে, কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা। যেখানে স্পর্শ করেছে ডেস্কটপের সেই জায়গাটা মনে হচ্ছে মখমলের মতো মসৃণ-হাত দুটো যেন ডুবে যাচ্ছে।

    অবাক হয়ে সে তার হাতের দিকে তাকালো, কারণ, সেগুলো মোটেই ডোবেনি, নিজের চোখেই দেখতে পারছে। অথচ অনুভূতি বলছে স্পর্শ করার সাথে সাথে। ডেস্কের পৃষ্ঠদেশ সরে গেছে। আর একটা কিছু উষ্ণ, কোমল কিন্তু হালকাভাবে তার দুটো হাত চেপে ধরেছে।

    ব্যস? এখন কি করতে হবে?

    চারপাশে তাকালো একবার, তারপর চোখ বন্ধ করল। যেন কেউ তাকে নির্দেশ দিয়েছে।

    কিছুই শোনেনি সে, কিছুই না।

    কিন্তু মাথার ভেতরে, যেন তার নিজেরই অন্যমনস্ক ভাবনা, সেভাবে শব্দ তৈরি হচ্ছে, চোখ বন্ধ কর। শান্ত হও। আমরা যোগাযোগ করছি।

    হাতের মাধ্যমে?

    ট্র্যাভিজের ধারণা ছিল চিন্তার সাহায্যে কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করতে হলে মাথায় হুড পড়তে হবে, খুলি আর চোখের মাঝখানে একসঙ্গে একগাদা ইলেকট্রোড লাগানো থাকবে।

    হাত?

    কেন হবে না? ট্র্যাভিজের মনে হচ্ছে সে ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রায় আধোঘুমে রয়েছে, কিন্তু ভাবনা-চিন্তা পরিষ্কার। হাত হবে না কেন?

    চোখ শুধুই অনুভূতির অঙ্গ। ব্রেইন শুধুই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক, হাড়ের খাঁচায় আবদ্ধ এবং কর্মক্ষম শরীর থেকে দূরে। হাতই হচ্ছে শরীরের কর্মক্ষম অংশ।

    হাত দিয়েই মানুষ অনুভব করে, মহাবিশ্ব পরিচালিত করে।

    মানুষ তার হাত নিয়ে অনেক ভেবেছে। হাতই হচ্ছে সমস্ত প্রশ্নের জবাব। হাত অনুভব করতে পারে, স্পর্শ করতে পারে, ভাঙতে পারে, মোচড়াতে পারে। অনেক প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট উন্নত মানের, কিন্তু তাদের হাত নেই-আর এখানেই রয়েছে। আসল পার্থক্য।

    তার আর কম্পিউটারের হাত এক হওয়ার ফলে তাদের চিন্তা-ভাবনাও এক হয়ে গেছে। এখন চোখ ভোলা রাখল না বন্ধ করল সেটা কোনো ব্যাপার না। খোলা থাকলে তার দৃষ্টিশক্তি বাড়বেনা বা বন্ধ করলে কমবে না।

    অন্য দিকে ঘরের সবকিছুই সে দেখতে পারছে, শুধু যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকেই না। তার চারপাশে উপরে নিচে সবকিছুই সে পরিষ্কার দেখতে পারছে।

    মহাকাশযানের প্রতিটি ঘর সে দেখতে পারছে, সেই সাথে বাইরেও দেখতে পারছে। সূর্য উঠেছে, ভোরের কুয়াশার কারণে সূর্যের দীপ্তি বেশি ছড়িয়ে পড়েনি। সূর্যের দিকে তাকাতে পারছে সরাসরি, কারণ কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোর তরঙ্গ ফিল্টার করে দিচ্ছে।

    অনুভব করতে পারছে বাইরের মৃদুমন্দ বাতাস আর উষ্ণতা। শুনতে পারছে বিশ্বের ছড়ানো সমস্ত শব্দ। গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র, মহাকাশযানের দেয়ালের দুর্বল বিদ্যুৎ তরঙ্গ তার কাছে ধরা পড়ল।

    বিস্তারিত কিছু না জেনেই মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সে সচেতন হয়ে উঠল। সে শুধু জানে এই যানকে উপরে উঠাতে হলে ঘোরাতে হলে, গতি বাড়াতে হলে বা অন্য কোনো সুযোগ ব্যবহার করতে হলে, পুরো প্রক্রিয়াটা হবে নিজের শরীর পরিচালনা করার মতো সহজ। তাকে শুধু ইচ্ছা শক্তি ব্যবহার করতে হবে।

    তার ইচ্ছাশক্তিই সব না। কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটা শব্দ তৈরি হচ্ছে। এখন সে জানে ঠিক কখন এবং কিভাবে মহাকাশযান উড্ডয়ন করবে। এই ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাশক্তি কাজ করবে না। কিন্তু তারপরেও সে নিশ্চিত, নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

    কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হয়ে তার সচেতনতা বেড়ে গেছে। উপরের বায়ুস্তর অনুভব করতে পারছে, আবহাওয়ার প্যাটার্ন দেখতে পারছে। যে যানগুলো উপরে উঠছে বা নিচে নামছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে পারছে। সবকিছুই বিবেচনা করতে হবে এবং কম্পিউটার করছেও। যদি না করত, তাহলে ট্র্যাভিজ জানে, কম্পিউটারকে দিয়ে এই কাজগুলো করিয়ে নেয়ার জন্য শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করলেই চলবে।

    বড় বড় প্রোগ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই; টেকনিক্যাল সার্জেন্ট ক্র্যাসনেট-এর কথা মনে পড়তেই সে একটু হাসল। গ্র্যাভিটিক যে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে, সেটা তার জানা ছিল। কিন্তু কম্পিউটার এবং ইচ্ছাশক্তির সমন্বয় একটা বিপ্লব তৈরী করবে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

    সময়ের ব্যাপারেও সে সচেতন। চোখ বন্ধ করেই টার্মিনাসের স্থানীয় সময় এবং গ্যালাক্সির স্ট্যান্ডার্ড সময় বলে দিতে পারবে।

    ছাড়া পাবে কিভাবে?

    চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই তার হাত দুটো মুক্ত হয়ে গেল এবং ডেস্কটপ ফিরে গেল আগের অবস্থানে আর ট্র্যাভিজ পড়ে থাকল নিজের অনুভূতি নিয়ে।

    অন্ধ আর অসহায় মনে হলো নিজেকে, যেন একটা মহাশক্তি তাকে আগলে রেখেছিল, কিন্তু এখন ছেড়ে চলে গেছে। সে যেন বুঝতেই পারছেনা যে আবার। যোগাযোগ তৈরি করা যাবে। অনুভূতিটা তাকে প্রায় কাঁদিয়ে দিল।

    নিজেকে স্বাভাবিক করতে বেশ কষ্ট হলো ট্র্যাভিজের, তারপর অনিশ্চিত এলোমেলো পদক্ষেপে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

    রীডার তৈরি করে ফেলেছে পেলোরেট। খুব ভালো কাজ করছে, চোখ তুলে বলল। চমৎকার একটা সার্চ প্রোগ্রাম রয়েছে।–কন্ট্রোল খুঁজে পেয়েছ, মাই বয়?

    হ্যাঁ, প্রফেসর। সব ঠিক আছে।

    তাহলে টেকঅফের প্রস্তুতি নিতে হয়। মানে নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলছি। কি করতে হবে কিছুই জানিনা। এখানেও কিছু খুঁজে পাইনি, তাই ভয় লাগছে। লাইব্রেরিটা চালু করতে হবে আমাকে। যে ভাবেই হোক কাজ শুরু করতে হবে।

    কোনোভাবেই প্রফেসরের কথার তোড় থামাতে না পেরে ট্র্যাভিজ উঁচু গলায় কথা বলতে বাধ্য হলো। কিছুই করতে হবে না প্রফেসর। এন্টি গ্র্যাভিটির তুলনা হয়না। তুরণ ও বেগের কোনো পরিবর্তনই ধরতে পারব না। কারণ সবগুলো পরিবর্তন হবে একই সাথে।

    তার মানে, আমরা কখন এই গ্রহ ছেড়ে মহাশূন্যে পৌঁছব, জানতেই পারব না।

    ঠিক তাই, কারণ এই মুহূর্তে গ্রহের উপরের বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আউটার স্পেসে পৌঁছে যাব।

    .

    ১৬.

    পেলোরেট একটা ঝাঁকুনি খেল, মুখে না বল্লেও বোঝাই যাচ্ছে অস্বস্তি বোধ করছে। একবার ডানে একবার বামে তাকাচ্ছে।

    ট্র্যাভিজের মনে পড়ল প্রথম মহাকাশে যাওয়ার সময় তার নিজের কেমন লেগেছিল।

    যতটা সম্ভব স্বভাবিক গলায় কথা বলল সে, জেনভ, (এই প্রথমবারের মতো সে প্রফেসরকে এত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বোধন করল, তবে প্রয়োজন আছে, কারণ এই মুহূর্তে একজন অভিজ্ঞ লোক অনভিজ্ঞ একজনকে বোঝাচ্ছে।) আমরা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফাউণ্ডেশন নেভীর সবচেয়ে ভালো জাহাজে রয়েছি আমরা। অস্ত্র না থাকলেও গ্যালাক্সির এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ফাউণ্ডেশনের নাম আমাদেরকে রক্ষা করবে না। তারপরও যদি কোনো জাহাজ আক্রমণ করতে আসে, তখন মুহূর্তের মধ্যেই পালানো যাবে। আর নিশ্চিত থাক, এই জাহাজ আমি ভালোভাবেই চালাতে পারব।

    চিন্তাটা আসলে বিশাল শূন্যতার গো-গোলান।

    কেন টার্মিনাসের চারপাশেই তো শূন্যতা। ভূ-পৃষ্ঠে যখন থাকি তখন স্পেস আর আমাদের মাঝখানে শুধু বাতাসের পাতলা একটা স্তর থাকে। আমরা শুধু সেই গুরুত্বহীন স্তরটাকে পার হয়ে এসেছি।

    যতই গুরুত্বহীন হোক, এই বাতাসই আমরা নিঃশ্বাস নেই।

    এখানেও নিঃশ্বাস নিতে পারব। যানের ভিতরের বাতাস টার্মিনাসের বাতাসের চেয়েও পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ এবং থাকবেও তাই।

    আর মেটিওরাইট এর ব্যাপারে কি হবে?

    এই ব্যাপারে আবার কি হবে?

    বায়ুমণ্ডল আমাদের মেটিওরাইট থেকে রক্ষা করে। রেডিয়েশন থেকেও রক্ষা করে। এখানে কি হবে?

    মানুষ বিশ হাজার বছর মহাশূন্যে চলাচল করছে, আমার মনে হয়

    বাইশ হাজার, হত্ৰুকিয়ান ক্রনোলজী অনুযায়ী এটা পরিষ্কার যে

    যথেষ্ট! তুমি কোনো মেটিওরাইট দুর্ঘটনা বা রেডিয়েশনে কারো মৃত্যুর কথা শুনেছ?–মানে, অতিসম্প্রতি? বিশেষ করে ফাউণ্ডেশনের কোনো যানের বেলায়?

    আমি আসলে খবরের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দেই না, তবে আমি একজন ইতিহাসবিদ, মাই বয়, এবং

    হ্যাঁ, কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সময় পাল্টেছে। মেটিওরাইটগুলো এত বেশি বড় হয় না যে সেগুলোকে আমরা ধ্বংস করতে পারব না। চারটা মেটিওরাইট যদি চারদিক থেকে আঘাত করে তাহলে হয়তো আমরা শেষ, কিন্তু সেই সম্ভাবনা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগও হবে না।

    মানে তুমি যদি কম্পিউটারে থাক?

    না, ট্র্যাভিজ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল। আমি নিজে কম্পিউটার চালালে কিছু বোঝার আগেই শেষ হয়ে যাব। কম্পিউটার নিজেই সব নিয়ন্ত্রণ করবে, কাজ করবে তোমার বা আমার চেয়ে মিলিয়নগুণ বেশি দ্রুত। হঠাৎ এক হাত সামনে বাড়ালো, চলো, জেনভ, কম্পিউটার কি করতে পারে তোমাকে দেখাই, মহাকাশ দেখতে কেমন সেটাও জানবে। চলো।

    পেলোরেট ঢোক গিলল। মুখে বোকা হাসি। বুঝতে পারছি না, জানতে হবে কিনা, গোলান।

    অবশ্যই তুমি বুঝবে না, জেনভ, কারণ তুমি জানইনা সেখানে কতকিছু আছে জানার। নিজেকে একটু বদলাও! চলো আমার ঘরে!

    ট্র্যাভিজ প্রায় টেনে হিঁচড়ে পেলোরেটকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। তুমি কখনো গ্যালাক্সি দেখেছ, জেনভ? কম্পিউটারের সামনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল। কখনো এর দিকে তাকিয়েছ?

    আকাশের দিকে?

    অবশ্যই। আর কোথায়?

    দেখেছি। সবাই দেখেছে। উপরের দিকে তাকালেই দেখা যায়।

    পরিষ্কার অন্ধকার রাতে কখনো তাকিয়েছ, যখন ডায়মন্ডগুলো ঠিক দিগন্তের নিচে থাকে?

    ডায়মন্ড হচ্ছে টার্মিনাসের রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল একঝাঁক নক্ষত্র, মাত্র বিশ ডিগ্রি বিস্তৃত এবং রাতের অধিকাংশ সময়ই দিগন্তের নিচে অবস্থান করে। এগুলো ছাড়াও অনুজ্জ্বল অসংখ্য নক্ষত্র জালের মতো ছড়িয়ে আছে। খালি চোখে তাকালে গ্যালাক্সির ঝাপসা সাদাটে আভা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না-কারণ টার্মিনাস, প্রিংএর মতো প্যাচানো গ্যালাক্সির সর্বশেষ বাহুর সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থিত।

    দেখেছি। সাধারণ দৃশ্য।

    অবশ্যই সাধারণ দৃশ্য, ট্র্যাভিজ বলল। তাইতো কেউ দেখেনা। কেন দেখবে যদি সবসময়ই দেখা যায়। কিন্তু এখন দেখবে, টার্মিনাস থেকে না, যেখানে মেঘ আর কুয়াশা সব সময় বাধা তৈরি করে। এখন যা দেখবে, টার্মিনাস থেকে তুমি কখনো তা দেখোনি–কিভাবে তাকাবে, সেটা কোনো ব্যাপার না, আকাশ কতটুকু পরিষ্কার আর অন্ধকার তাও কোনো ব্যাপার না। কি মনে হচ্ছে জানো, যদি তোমার মতো এটা আমার প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ হতো, তাহলে গ্যালাক্সির নগ্ন সৌন্দর্য প্রথমবারের মতো উপভোগ করতে পারতাম।

    পেলোরেট-এর দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ট্র্যাভিজ। বসো, জেনভ। কিছুটা সময় লাগতে পারে। কম্পিউটারের সাথে আমাকে অভ্যস্ত হতে হবে। যতটুকু বুঝতে পারছি যা দেখব সবই হলোগ্রাফিক, কাজেই কোনো ধরনের স্ক্রিন প্রয়োজন হবে না। এটা সরাসরি আমার ব্রেইনের সাথে যোগাযোগ করে। তবে মনে হয় যে কোনো বিষয়ের ইমেজ তৈরি করতে পারব, যেন তুমিও দেখতে পার-বাতিগুলো নেভাবে?-না, কি বোকা আমি। কম্পিউটারকে দিয়েই কাজগুলো করাতে পারি। তুমি বসে থাক।

    ট্র্যাভিজ কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ তৈরি করল, হাতে উষ্ণ আর ঘনিষ্ঠ ছোঁয়া অনুভব করছে।

    বাতিগুলো অনুজ্জ্বল হতে হতে একেবারে নিভে গেল। অন্ধকারে পেলোরেট উসখুস করছে।

    ভয় পেয়োনা, জেনভ। কম্পিউটার সামলাতে আমার কিছুটা সমস্যা হবে। একটু ধৈর্য ধর। দেখেছ? অর্ধেক বৃত্তের মতো?

    অর্ধবৃত্তের মতো আলোর একটা বিন্দু তাদের সামনে অন্ধকারে ঝুলে আছে, অস্পষ্ট কাঁপা কাঁপা, কিন্তু ধীরে ধীরে উজ্জ্বল আর স্পষ্ট হচ্ছে।

    পেলোরেট-এর গলা আতঙ্কিত শোনালো। ওটা টার্মিনাস? এত দূরে চলে এসেছি?

    হ্যাঁ, খুব দ্রুত এগোচ্ছি আমরা।

    মহাকাশযান টার্মিনাসের রাতের অংশকে পাড়ি দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন আলোকিত চাঁদের অর্ধেক। ট্র্যাভিজের প্রচণ্ড ইচ্ছে হলো মহাকাশযান দিনের অংশের দিকে নিয়ে যায়, যেন টার্মিনাসের সমস্ত সৌন্দর্য একসাথে ধরা পড়ে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল।

    পেলোরেটের কাছে ব্যাপারটা অভিনব মনে হলেও, খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। এত বেশি ছবি মানচিত্র আর গ্লোব তৈরি করা হয়েছে যে প্রত্যেকটি শিশু পর্যন্ত জানে টার্মিনাস গ্রহ দেখতে কেমন। পানিপূর্ণ গ্রহ-প্রচুর পানি রয়েছে এখানে কিন্তু খনিজসম্পদ একেবারেই নেই। কৃষিকাজে অগ্রসর, ভারি শিল্পে অনগ্রসর অথচ টেকনোলজি এবং মিনিয়েচারাইজেশনে গ্যালাক্সির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

    কম্পিউটারের মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে তারা এখানে বসেই টার্মিনাসের মানুষ বসবাসকারী দশ হাজার দ্বীপের প্রত্যেকটিই দেখতে পারবে, দেখতে পারবে প্রায় একটা মহাদেশের সমান দ্বীপ, যে দ্বীপ পুরোটাই হচ্ছে টার্মিনাস সিটি, এবং টার্ন!

    শুধুই একটা চিন্তা এবং ইচ্ছাশক্তির অনুশীলন, কিন্তু সামনের দৃশ্য সাথে সাথে পাল্টে গেল। চাঁদের মতো উজ্জ্বল টার্মিনাস তাদের দৃষ্টিসীমার প্রান্তে চলে গেল তারপর একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল। নক্ষত্রহীন অন্ধকার মহাকাশ একটা ধাক্কা মারল তার চোখে।

    গলা পরিষ্কার করে নিল পেলোরেট। টার্মিনাসকে আবার ফিরিয়ে আনো, মাই বয়। মনে হচ্ছে অন্ধ হয়ে গেছি। গলার স্বর কঠিন।

    অন্ধ হওনি, দেখ!

    সামনের দৃষ্টিক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে আলোকভেদ্য এক ধোয়াসা তৈরি হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে, উজ্জ্বল হচ্ছে। একসময় ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরেই।

    সংকোচন!

    ইচ্ছাশক্তির আরেকটি অনুশীলন এবং গ্যালাক্সি পিছিয়ে গেল যেন একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপের উল্টোদিক দিয়ে কেউ দেখছে। গ্যালাক্সি সংকুচিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের উজ্জ্বলতা নিয়ে একটি কাঠামো তৈরি হলো।

    উজ্জ্বলতা!

    আয়তনের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর যেহেতু টার্মিনাস গ্যালাকটিক প্ল্যানের সবচেয়ে দূরের সৌরজগতের অন্তর্ভুক্ত, গ্যালাক্সির সর্বশেষ প্রান্ত বোঝা যাচ্ছেনা। শক্তিশালী স্প্রিং-এর মতো টার্মিনাসের আলোকিত অংশের মাঝখানে অন্ধকার ছায়াপথের অগোছালো রেখা। নিউক্লিয়াসের মসৃণ কুয়াশা–দূরত্বের কারণে ছোট এবং গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে।

    পেলোরেট বিস্মিত গলায় ফিসফিস করে বলল, ঠিকই বলেছ। এই জিনিস আমি কখনো দেখিনি। ভাবতেও পারিনি এতকিছু আছে।

    স্বাভাবিক। তোমার আর এর মাঝখানে যখন টার্মিনাসের বায়ুমণ্ডল থাকে তখন অর্ধেকও দেখতে পারবেনা। টার্মিনাসের ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তো নিউক্লিয়াসগুলো দেখতেই পাবে না।

    আমরা কত কাছ থেকে দেখছি, তাই না?

    না। কম্পিউটার আমাদেরকে যেকোনো দিক থেকে দেখাতে পারবে। আমাকে মনে মনে ভাবলেই চলবে–মুখে বলতে হবে না।

    কো-অর্ডিনেটস পরিবর্তন!

    কোনোভাবেই আদেশ বলা চলে না। তারপরেও গ্যালাক্সির ইমেজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ট্র্যাভিজের মন কম্পিউটারকে গাইড করে পছন্দ মতো ইমেজ তৈরি করে নিল।

    গ্যালাক্সিকে এখন গ্যালাকটিক প্ল্যানের সঠিক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। দেখাচ্ছে বিশাল উজ্জ্বল ঘূর্ণাবর্তের মতো, এখানে সেখানে সাপের মতো আঁকাবাঁকা কালো রেখা, কোথাও আলোর ছোট ছোট বিন্দু, আর কেন্দ্রে রয়েছে নিরুত্তাপ বৈশিষ্ট্যহীন উজ্জ্বল আভা।

    কম্পিউটার এখান থেকে পঞ্চাশ হাজার পারসেক দূরের জায়গা কিভাবে দেখছে? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল, তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, প্রশ্নটা করার জন্য দুঃখিত। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।

    এই কম্পিউটারের ব্যাপারে আমি নিজেও তোমার মতোই জানি। ট্র্যাভিজ বলল। যে কোনো সাধারণ কম্পিউটার কো-অর্ডিনেট এডজাষ্ট করে গ্যালাক্সির যে কোনো অবস্থান দেখাতে পারে। সে নিজেই ঠিক করবে কোনখান থেকে শুরু করতে হবে। কাজেই যখনই কোনো ইমেজ দেখা যাবে তার মাঝখানে ফাঁকা বা কালো দাগ দেখা যাবে। তবে এক্ষেত্রে

    হ্যাঁ?

    আমরা চমৎকার দৃশ্য দেখতে পারছি। আমার মনে হয় কম্পিউটারে গ্যালাক্সির সম্পূর্ণ মানচিত্র ঢোকানো আছে, যার ফলে সে গ্যালাক্সির যে কোনো ইমেজ তৈরি করতে পারছে।

    সম্পূর্ণ মানচিত্র মানে?

    প্রতিটি নক্ষত্রের বিশেষ কো-অর্ডিনেট অবশ্যই কম্পিউটারের মেমোরী ব্যাংকে রয়েছে।

    প্রতিটি নক্ষত্র? পেলোরেট-এর গলা অবাক শোনালো।

    বেশ, হয়তো তিনশো বিলিয়নের সবগুলো নেই। মানুষ বাস করে এমন গ্রহগুলোর উপর যে নক্ষত্রগুলো আলো দেয় সেগুলো থাকবে, বিশেষ করে স্পেকট্রাল কে শ্রেণীর নক্ষত্র এবং তার চেয়েও উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো তো অবশ্যই আছে। তার মানে অন্তত প্রায় পচাত্তর বিলিয়ন।

    মানুষের বসতি স্থাপনকৃত সিস্টেমের প্রতিটি নক্ষত্র?

    একেবারে নির্ভুল বলতে পারব না, হয়তো সবগুলো নেই। হ্যারী সেলডনের সময় বাসযোগ্য সিস্টেম ছিল প্রায় পঁচিশ মিলিয়ন-শুনতে অনেক মনে হলেও আসলে প্রতি বারো হাজার নক্ষত্রের মধ্যে মাত্র একটা ছিল বাসযোগ্য। সেলডনের মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচশ বছরে সাম্রাজ্যের পতন নতুন নতুন গ্রহে বসতি স্থাপন ঠেকাতে পারে নি। বরং আমার মনে হয় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো অনেক গ্রহ রয়েছে যেখানে মানুষ বসবাস শুরু করতে পারে। কাজেই নতুন হিসেবে ধরো ত্রিশ মিলিয়ন। এমনও হতে পারে নতুন গ্রহগুলোর কথা ফাউণ্ডেশনের রেকর্ডে নেই।

    কিন্তু পুরনোগুলো? অবশ্যই থাকবে।

    তাইতো মনে হয়। অবশ্য নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারব না। দীর্ঘ সময় মানুষ বাস করছে এমন কোনো সিস্টেম বাদ পড়ে গেলে আমি অবাকই হব। তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।

    ট্র্যাভিজের হাতদুটো আরো শক্ত হয়ে গেল, মনে হচ্ছে যেন কম্পিউটারের মুঠোর আরো ভেতরে চলে যাচ্ছে। কোনো প্রয়োজন নেই জোরে চেপে ধরার; তাকে শুধু শান্তভাবে চিন্তা করতে হবে, টার্মিনাস!

    তার ভাবনার সাথে সাড়া দিয়ে ঘূর্ণাবর্তের শেষ প্রান্তে একটা লাল বিন্দু জ্বলজ্বল করে উঠল।

    ওই যে আমাদের সূর্য, সে উত্তেজিত গলায় বলল। টার্মিনাস এই নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে।

    আহ্, পেলোরেট বলল নিচু প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাসের সাথে।

    গ্যালাক্সির মাঝখানে কিন্তু কেন্দ্রীয় সাদাটে আভা থেকে দূরে এক পাশের ঝাঁক ঝক নক্ষত্রের মাঝে একটা হলুদ বিন্দু জ্বলে উঠল। বিন্দুটা গ্যালাক্সির যে প্রান্তে টার্মিনাস রয়েছে তার অনেক কাছে।

    এবং ওটা হচ্ছে, ট্র্যানটরের সূর্য।

    আরেকটা দীর্ঘশ্বাস, তারপর পেলোরেট বলল, তুমি নিশ্চিত? সবাই বলে ট্রানটর গ্যালাক্সির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত।

    একদিক দিয়ে কথাটা ঠিক। অন্য যে কোনো জনবহুল সিস্টেম থেকে ট্র্যানটর কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে একটা ব্ল্যাকহোল এবং প্রায় এক মিলিয়ন নক্ষত্র। বলা যায় জায়গাটা প্রায় নরক। যতদূর জানি মূল কেন্দ্রে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই এবং সম্ভবত কোনো প্রাণী টিকে থাকতে পারবে না। ট্রানটর প্যাচানো বাহুর সবচেয়ে ভিতরে অবস্থিত এবং বিশ্বাস করো, যদি ওই গ্রহের রাতের আকাশ দেখ, তোমার আসলেই মনে হবে যেন এটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে। এর চারপাশে রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে নক্ষত্র।

    তুমি ট্র্যানটরে গিয়েছিলে, গোলান? পেলোরেটের গলায় পরিষ্কার হিংসা।

    না, তবে ট্রানটরের আকাশের হলোগ্রাফিক ছবি দেখেছি।

    ট্র্যাভিজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে গ্যালাক্সির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাবতে অবাক লাগছে মিউলের যুগে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অনুসন্ধানের সময় তারা কিভাবে গ্যালাকটিক মানচিত্র ব্যবহার করেছিল-এবং এই বিষয়ের উপর কত বই লেখা হয়েছে, ছবি তৈরি হয়েছে।

    এবং এর কারণ হ্যারী সেলডন প্রথমেই বলেছিলেন যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন থাকবে গ্যালাক্সির বিপরীত শেষ প্রান্তে, যাকে বলা যায় স্টারস এন্ড।

    গ্যালাক্সির বিপরীত শেষ প্রান্ত! ট্র্যাভিজের চিন্তার সাথে সাথেই সামনের দৃশ্যে টার্মিনাস থেকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত একটা পাতলা নীল সরল রেখা দেখা গেল। ট্র্যাভিজ প্রায় লাফিয়ে উঠল। সে সরাসরি এই রেখার আদেশ দেয়নি কিন্তু পরিষ্কার চিন্তা করেছিল এবং কম্পিউটারের জন্য সেটাই যথেষ্ট।

    তবে অবশ্যই গ্যালাক্সির বিপরীত দিক পর্যন্ত টানা এই সরল রেখা হ্যারী সেলডনের অপর প্রান্তকে বোঝায় না। আর্কেডি ডেরিল একটা প্রবাদ তৈরি করেছিল এখন সবাই সত্য বলে মেনে নিয়েছে, প্রবাদটা হচ্ছে বৃত্তের শেষ প্রান্ত নেই।

    ট্র্যাভিজ তার চিন্তা থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কম্পিউটার অনেক বেশি দ্রুত। নীল সরল রেখা অদৃশ্য হয়ে তার জায়গায় টার্মিনাসের সূর্যকে ছেদ করে একটা নীল বৃত্ত গ্যালাক্সিকে ঘিরে ফেলল।

    বৃত্তের শেষ প্রান্ত নেই। যদি বৃত্তটা টার্মিনাস থেকে শুরু হয় এবং কেউ অপর প্রান্ত খোঁজা শুরু করে তাহলে আবার সে টার্মিনাসেই ফিরে আসবে। টার্মিনাসেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, প্রথম এবং দ্বিতীয় বাস করত একই গ্রহে।

    কিন্তু যদি এমন হয় যে, আসলে পাওয়া যায়নি-তাদের খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটা কল্পনাপ্রসূত-তখন কি হবে? সরল রেখা এবং বৃত্তের মাঝে কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

    তুমি ধাঁধা তৈরি করছ? নীল বৃত্তটা কিসের? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।

    নিজেকে পরীক্ষা করছিলাম।–তুমি পৃথিবী লোকেট করতে চাও।

    এক দুই মুহূর্তের নীরবতা, তারপর পেলোরেট বলল, তুমি ঠাট্টা করছ?

    না। চেষ্টা করে দেখতে পারি।

    চেষ্টা করল। কিছুই হলো না।

    দুঃখিত, ট্র্যাভিজ বলল।

    নেই? পৃথিবী নেই?

    বোধহয় ঠিকমতো নির্দেশ দিতে পারিনি, তবে আসল কারণ আমার মনে হয় কম্পিউটারের রেকর্ডে পৃথিবীর নাম নেই।

    অন্য কোনো নামে থাকতে পারে।

    ট্র্যাভিজ কথাটা সাথে সাথে লুফে নিল। অন্য নামটা কি, জেনভ?

    পেলোরেট কোনো কথা বলল না, ট্র্যাভিজ অন্ধকারেই হাসল। মনে হচ্ছে ঘটনাগুলো খাপে খাপে বসছে। এভাবেই চলুক আরো কিছুক্ষণ। ইচ্ছা করেই বিষয়বস্তু পরিবর্তন করল, বোধহয় সময়কে চালানো যাবে।

    সময়! কিভাবে করবে?

    গ্যালাক্সি সবসময় আবর্তিত হচ্ছে। পুরো গ্যালাক্সি প্রদক্ষিণ করতে টার্মিনাসের লাগবে আধা বিলিয়ন বছর। কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলের ভিত্তিতে প্রতিটি নক্ষত্রের গতি, কম্পিউটারে রেকর্ড করা থাকতে পারে। যদি থাকে, তবে কম্পিউটার প্রতিটি গতি মিলিয়ন গুণ বর্ধিত করে দৃশ্যে রূপান্তর করতে পারবে। চেষ্টা করে দেখা যাক।

    প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করার কারণে ট্র্যাভিজের মাংসপেশী শক্ত হয়ে গেল-গ্যালাক্সিকে দুহাতে ধরে ঝাঁকাচ্ছে, মোচড় দিচ্ছে, প্রবল বাধার মুখে ঘুরতে বাধ্য করছে।

    নড়ছে গ্যালাক্সি। ধীরে ধীরে সর্বশক্তি নিয়ে, যে দিকে ঘুরলে প্যাচানো বাহু আরো শক্ত হবে সেদিকে মোচড় খাচ্ছে।

    সময় বয়ে যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে–মিথ্যা, কৃত্রিম সময়। প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল নক্ষত্রগুলো।

    এখানে সেখানে কয়েকটি বড় নক্ষত্র লাল এবং উজ্জ্বল হতে হতে রেড জায়ান্টে পরিণত হলো। তারপর কেন্দ্রীয় ঝাঁকের একটা নক্ষত্র হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে গ্যালাক্সিকে নিপ্রভ করে দিয়েই মিলিয়ে গেল। পরপর আরো কয়েকটি বিস্ফোরিত হলো।

    সুপারনোভা, ট্র্যাভিজ হিস-হিস করে বলল।

    কম্পিউটার কি আগেই বলতে পারবে কখন কোন নক্ষত্রের মৃত্যু হবে। নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে নির্দেশ করার জন্য এটা একটা সরল মডেল।

    পেলোরেট খসখসে গলায় বলল, গ্যালাক্সি মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত প্রাণী, হামাগুড়ি দিয়ে চলছে।

    ঠিক, ট্র্যাভিজ বলল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঠিকমতো অভ্যস্ত না হতে পারলে, একটানা বেশিক্ষণ চালাতে পারব না।

    সে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে নিল। গ্যালাক্সির গতি থেমে গিয়ে ফিরে আসল আগের অবস্থায়।

    ট্র্যাভিজ চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেলছে। জানে যে টার্মিনাসের সর্বশেষ আবহাওয়া স্তর পার হয়ে এসেছে। কাছাকাছি মহাকাশের সমস্ত যান চিহ্নিত করতে পারছে।

    একবারও মনে হলো না পরীক্ষা করে দেখে এই যানগুলোর মধ্যে হুবহু তার গ্র্যাভিটিক যানের মতো কোনো যান রয়েছে কিনা।

    .

    স্পিকার

    ১৭.

    ট্রানটর!

    সুদীর্ঘ আট হাজার বছর এই গ্রহ ছিল এক বিশাল এবং মহাপরাক্রমশালী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, যার অধীনস্ত ছিল ক্রমবর্ধমান ইউনিয়ন অফ প্ল্যানেটারী সিস্টেম। পরবর্তী বার হাজার বছর ট্র্যানটর ছিল গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী, যার সীমানা ছিল সম্পূর্ণ গ্যালাক্সি।

    ট্রানটরকে বাদ দিয়ে এম্পায়ারের কথা চিন্তা করা ছিল অসম্ভব।

    এম্পায়ারের ধ্বংস যখন অনিবার্য, ঠিক তখনই ট্র্যানটর জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়। আসলে এম্পায়ার যে তার গতিশীলতা হারিয়েছে, ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলেছে, সেটা কেউ ধরতে পারেনি, তার কারণ ট্রানটর সবসময় ঝকমকে ধাতুতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত।

    ট্র্যানটর নিজেকে পরিণত করেছিল গ্যালাক্সির রক্ষক নগরীতে। আইনের মাধ্যমে। জনসংখ্যা সবসময় পঁয়তাল্লিশ বিলিয়নে স্থির রাখা হতো। ভূ-পৃষ্ঠে সবুজের একমাত্র অস্তিত্ব ছিল ইমপেরিয়াল প্যালেস এবং গ্যালাকটিক বিশ্ববিদ্যালয়/লাইব্রেরি কমপ্লেক্স।

    ট্র্যানটরের সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ ধাতু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। গ্রহের মরুভূমি এবং উর্বর ভূমিগুলো পর্যন্ত ধাতু দিয়ে আবৃত করে তৈরি করা হয়েছিল বাসস্থান, প্রশাসনিক জঙ্গল, কম্পিউটার স্থাপনা, যন্ত্রপাতি এবং খাদ্যের বিশাল বিশাল স্টোর হাউজ। মহানগরীর সীমাহীন করিডরগুলো বিস্তৃত ছিল মহাদেশগুলোর একেবারে গভীর পর্যন্ত। খাদ্য এবং খনিজ পদার্থের একমাত্র (কিন্তু অপর্যাপ্ত) স্থানীয় উৎস ছিল মহাসাগরগুলো। সেগুলোকে পরিণত করা হয়েছিল বিশাল প্রাকৃতিক অ্যাকুয়ারিয়ামে।

    অন্যান্য যেসব গ্রহ থেকে ট্রানটর তার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করত সেগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল কয়েক হাজার স্পেসপোর্ট, দশ হাজার যুদ্ধযান, কয়েক লক্ষ বাণিজ্য জাহাজ এবং এক মিলিয়ন স্পেস ফ্রেইটারস।

    কোনো নগরীই এর আগে এত কঠিনভাবে রিসাইকলড হয়নি। গ্যালাক্সির অন্য কোনো গ্রহ কখনোই সৌরশক্তির এত বিপুল ব্যবহার করতে সক্ষম হয়নি। চকচকে। রেডিয়েটরগুলো ট্রানটরের পাতলা বায়ুমণ্ডলের মধ্যে ছড়ানো থাকত। রাতের অংশে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপরে উঠে কৃত্রিম আলো বিকীরণ করত আর দিনের অংশে রেডিয়েটরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে থাকত।

    জ্ঞান ও প্রযুক্তির ঠিক এরকম সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে ট্রানটর এম্পায়ারকে পরিচালনা করত।

    পরিচালনা ছিল দুর্বল, কিন্তু এম্পায়ারকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা ছিল অসম্ভব। কারণ, এটা ছিল এত বিশাল যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাটও একটা মাত্র বিশ্ব থেকে সেটাকে পরিচালনা করতে পারত না। কাজেই সেই বিধ্বংসী যুগে যখন ইম্পেরিয়াল ক্রাউন তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে, আমলাতান্ত্রিকতা, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি আর নির্লজ্জতা ঘিরে ফেলে পুরো গ্যালাক্সিকে তখন সাম্রাজ্যকে দুর্বলভাবে পরিচালনা ছাড়া ট্র্যানটরের আর কিছু করার ছিলনা।

    তবে এরকম খারাপ পরিস্থিতিতেও ছিল একটা স্বয়ংক্রিয় গতিশীলতা। ট্র্যানটরকে বাদ দিয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করা যেত না।

    সাম্রাজ্যের পতন অব্যাহত গতিতে বেড়ে চলল। কিন্তু ট্র্যানটর যতদিন ট্রানটর ছিল ততদিন পর্যন্ত সাম্রাজ্যের একটা অংশ টিকে ছিল গর্ব, আভিজাত্য, অনাগত ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবিতা, ক্ষমতা এবং সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে।

    একমাত্র যখন অকল্পনীয় ঘটনা ঘটল-যখন সম্পূর্ণ পতন ঘটল ট্র্যানটরের; যখন হত্যা করা হলো তার মিলিয়ন মিলিয়ন নাগরিকদের এবং বিলিয়ন বিলিয়ন নাগরিকদের না খেয়ে মেরে ফেলার জন্য রাখা হলো; যখন বারবারিয়ান ফ্লীটের আক্রমণে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তার বিশাল ধাতব আবরণ তখনই সবাই বাস্তবিক অনুধাবন করতে পারল যে ধ্বংস হয়ে গেছে সাম্রাজ্য। যারা বেঁচে ছিল তারা আর হারানো গৌরব ফিরে পাবার চেষ্টা করেনি এবং মাত্র এক প্রজন্মের ভেতরই মানব ইতিহাসের একসময়ের মহাসমৃদ্ধিশালী বিশ্ব ট্র্যানটর পরিণত হলো এক অচিন্তনীয় ধ্বংসস্তূপে।

    এই ঘটনা প্রায় দুইশ পঞ্চাশ বছর আগের। বাকি গ্যালাক্সিতে এখনো। সমৃদ্ধিশালী ট্র্যানটরের কথা কেউ ভুলে যায়নি। এখনো এই গ্রহ ঐতিহাসিক গল্প উপন্যাসের প্রিয় বিষয়, সুখময় অতীতের আনন্দময় প্রতীক। এখনো মানুষ বলতে ভালোবাসে সকল নক্ষত্রযান ট্র্যানটরে অবতরণ করে, বা নিজেদেরকে ট্রানটরের সাথে তুলনা করতে পছন্দ করে।

    বাকি গ্যালাক্সিতে

    কিন্তু ট্রানটরের নিজের বেলায় কথাটা সত্যি না! এখানে পুরানো ট্র্যানটরের কথা ভুলে গেছে সবাই। সরিয়ে ফেলা হয়েছে ভূ-পৃষ্ঠের ধাতব আবরণ, প্রায় সবখানেই। এখন এটা আত্মনির্ভরশীল কৃষকদের গ্রহ, যেখানে বাণিজ্যিক যানগুলো খুব কম আসে, আসলেও অধিবাসীরা বিরক্ত হয়। অফিসিয়ালী ট্র্যানটর নাম ব্যবহার করা হলেও অধিবাসীদের কাছে শব্দটা জনপ্রিয় না, বর্তমান ট্র্যানটরিয়ান উচ্চারণে এই গ্রহের নাম হেম গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যার প্রতিশব্দ হোম অর্থাৎ বাড়ি।

    কুইন্ডর স্যান্ডেস আধোঘুম আধোজাগরণের মধ্যে কথাগুলোই ভাবছিলেন, এই অবস্থাতেই তার মনকে গতিশীল কিন্তু অগোছালো চিন্তার স্রোতে ছেড়ে দিতে পারেন।

    গত আঠারো বছর ধরে তিনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ফার্স্ট স্পিকার, এবং আরো দশ বা বারো বছর এই পদে থাকতে পারবেন যদি তখনো তার মন পুরোপুরি কর্মক্ষম থাকে এবং তিনি রাজনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন।

    ফার্স্ট স্পিকার টার্মিনাসের মেয়র, প্রথম ফাউণ্ডেশনের প্রশাসকের হুবহু। প্রতিচ্ছবি, মিরর ইমেজ, অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। টার্মিনাসের মেয়র পুরো গ্যালাক্সিতে পরিচিত, আর প্রথম ফাউণ্ডেশন সবগুলো। বিশ্বের কাছে শুধুই ফাউণ্ডেশন। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ফার্স্ট স্পিকার শুধু তার সহযোগীদের কাছে পরিচিত।

    তবে প্রকৃতপক্ষে তার এবং তার পূর্বসূরীদের অধীনস্ত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের হাতেই রয়েছে প্রকৃত ক্ষমতা। ফাউণ্ডেশনের হাতে আছে ফিজিক্যাল পাওয়ার কারিগরি এবং মারণাস্ত্র। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের হাতে আছে মেন্টাল পাওয়ার, মন এবং নিয়ন্ত্রণ শক্তি। দুই পক্ষের ভেতর লড়াই বাধলে, প্রথম ফাউণ্ডেশন যতই মারণাস্ত্র নিয়ে আসুক কিছুই করতে পারবেনা, যদি যারা সেগুলো চালাবে তাদের। মনকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নিয়ন্ত্রণ করে।

    কিন্তু আর কত দিন তিনি এই গোপন শক্তির আনন্দে মাতোয়ারা থাকবেন।

    তিনি পঁচিশতম ফার্স্ট স্পিকার এবং অন্য অনেকের চেয়ে বেশি সময় ধরে এই পদে রয়েছেন। হয়তো তার এখন সরে দাঁড়ানো উচিত নতুনদের জায়গা করে দেয়ার জন্য। স্পিকার জেনডিবল দলের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী এবং নবীন। আজ রাতে জেনডিবলের সাথে তিনি কিছুটা সময় কাটাবেন। সে জন্যই অপেক্ষা করছেন। তিনি কি এই তরুণকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করতে চান?

    সব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় তিনি এখনো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবেন নি। এই ক্ষমতা তিনি উপভোগ করেন।

    তিনি নিশ্চুপ বসে আছেন, বৃদ্ধ কিন্তু এখনো দায়িত্ব পালনে সক্ষম। ধূসর চুল, অবশ্য সেগুলো সব সময়ই ছিল হালকা রঙের আর মাত্র এক ইঞ্চি লম্বা চুল রাখেন, ফলে প্রায় বোঝাই যায় না। হালকা নীল রঙের চোখ, পোশাক ট্রানটোরিয়ান কৃষকদের মতো।

    ফার্স্ট স্পিকার পারতেন, যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, হ্যামিশ জনগণের একজন। হয়ে থাকতে, তবে তার গোপন শক্তি থাকত না। যে কোনো সময়ই তিনি তার চোখ ও মনকে তাদের উপর স্থির করে নিজের ইচ্ছামতো চালাতে পারতেন এবং পরে তারা কিছুই মনে রাখতে পারত না।

    এরকম খুব কমই ঘটে, বলতে গেলে প্রায় ঘটেই না। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের স্বর্ণালী নিয়ম ছিল, বাধ্য না হলে কিছুই করবেনা, কিন্তু যখন করবে দ্বিধাহীন চিত্তে করবে।

    নরম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফার্স্ট স্পিকার। রাজকীয় প্রাসাদের বিষণ্ণ ধ্বংসস্তূপকে সাথে নিয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বসবাস করার সময় যে কারো মনেই প্রশ্ন আসতে পারে কতখানি ভালো ছিল এই নিয়ম।

    অরাজকতার যুগে স্বর্ণালী নিয়ম পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্য যে সেলডন প্ল্যান সেটাকে ধ্বংস না করে ট্রানটরকে রক্ষা করার কোনো উপায় ছিল না। পয়তাল্লিশ বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করা হয়তো মানবিক হতো, কিন্তু তার ফলে প্রথম সাম্রাজ্য সুযোগ পেয়ে যেত। তখন হয়তো এক শতাব্দীতে আরো বড় বিপর্যয় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং হয়তো কখনোই দ্বিতীয় সাম্রাজ্য

    প্রথম যুগের ফার্স্ট স্পিকারগণ কয়েক দশক ধরে চেষ্টা করেও বিপর্যয় ঠেকানোর কোনো উপায় খুঁজে পাননি–ট্র্যানটর এবং দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের অবশ্যম্ভাবী সংগঠনকে এক সাথে রক্ষা করার কোনো পথ বের করতে পারেন নি। তাই যাতে সবচেয়ে কম ক্ষতি হয় সেটাই নির্বাচন করা হলো এবং মৃত্যু ঘটল ট্রানটরের।

    সেই সময়কার দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনাররা যেভাবেই হোক সক্ষম হলো বিশ্ববিদ্যালয়/লাইব্রেরি কমপ্লেক্স রক্ষা করতে, যে কারণে চিরকাল তাদেরকে দোষ দেয়া হবে। যদিও কেউ সরাসরি বলে না যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর রক্ষা করার কারণেই মিউলের নাটকীয় উত্থান ঘটেছিল, তবে সবসময়ই ধারণা করা হয় যে দুটোর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে।

    এই ঘটনা সবকিছুকে কতখানি বিপর্যস্ত করেছিল।

    বিপর্যয়ের দশকগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় মিউলের উত্থান ঘটেছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের স্বর্ণযুগে।

    সেলডনের মৃত্যুর পরবর্তী দুইশ পঞ্চাশ বছর দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নিজেকে লাইব্রেরির অভ্যন্তরে কবর দিয়ে রেখেছিল, শুধু সাম্রাজ্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য। তারা একটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজে কাজ করত লাইব্রেরিয়ানের, ভুলে যাওয়া গ্যালাকটিক লাইব্রেরির প্রতি যে সমাজের কোনো আগ্রহ ছিলনা। ব্যাপারটা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের উদ্দেশ্যের সাথে মিলে গিয়েছিল।

    সেটা ছিল অত্যন্ত জঘন্য জীবন। তারা শুধু সেলডন প্ল্যান অপরিবর্তিত রেখেছিল, যখন গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কথা না জেনেই, তাদের সাহায্য ছাড়াই প্রথম ফাউণ্ডেশন টিকে ছিল আরো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে।

    সেই মহাবিপর্যয়ই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে মুক্ত করে-আরেকটি কারণ (তরুণ জেনডিবলের মতে এটাই প্রধান কারণ) মহাবিপর্যয় ঘটতে দেয়া হলো কেন।

    মহাবিপর্যয়ের পর সাম্রাজ্য একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এবং তারপরে ট্র্যানটরের বেঁচে থাকা অধিবাসীরা কখনোই বিনা আমন্ত্রণে দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের সীমানায় পা ফেলেনি। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনাররা লক্ষ্য রেখেছে বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়

    লাইব্রেরি কমপ্লেক্স যেন পরবর্তী পুনর্গঠনের হাত থেকেও রক্ষা পায়। প্রসাদের ধ্বংসস্তূপও সংরক্ষণ করা হয়েছে। গ্রহের প্রায় সব জায়গা থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে ধাতু। বিশাল সীমাহীন করিডরগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে, ভরাট করা হয়েছে, ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে; সবকিছুই চাপা পড়েছে পাথর আর মাটির নিচে–সব, শুধু এই জায়গাটা ছাড়া, এখানে প্রাচীন উন্মুক্ত খোলা স্থানে এখনো ধাতব আবরণ রয়েছে।

    এটা হতে পারে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন, সাম্রাজ্যের পুণ্যসমাধি, কিন্তু ট্রানটরিয়ানদের কাছে-হ্যামিশ জনগণের কাছে-এই জায়গা অশুভ, অশরীরী প্রেতাত্মাদের বাসস্থান। শুধু দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনাররাই পা ফেলে প্রাচীন করিডরে বা টাইটানিয়ামের উজ্জলতাকে স্পর্শ করে।

    তার পরেও সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেল মিউলের কারণে।

    মিউল সত্যি সত্যি ট্র্যানটরে এসেছিল। সে আসল ব্যাপার বুঝতে পারলে কি ঘটত। তার বাস্তব অস্ত্রগুলো ছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী, তার মেন্টাল অস্ত্রগুলো ছিল আরো বেশি শক্তিশালী। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সবসময়ই বাধ্য না হলে কিছু করত না। তাছাড়া তাৎক্ষণিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে আরো বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

    মিউলকে থামানো সম্ভব হয়েছিল বেইটা ডেরিলের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে-এবং সেটাও ঘটেছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সাহায্য ছাড়া!

    তারপর স্বর্ণযুগে তখনকার ফার্স্ট স্পিকাররা সক্রিয় হয়ে উঠার পথ খুঁজে পেলেন, থামিয়ে দিলেন মিউলের আগ্রাসন, শেষ পর্যন্ত তার মন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলেন। এবং তারপর প্রথম ফাউণ্ডেশনকে থামালেন, যারা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিপজ্জনকভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। প্রীম পালভার, উনিশতম ফার্স্ট স্পিকার এবং সবার সেরা, বিপদ থেকে সবাইকে উদ্ধার করলেন–সেজন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল এবং তিনিই রক্ষা করলেন সেলডন প্ল্যান।

    একশ বিশ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আবার তার আগের অবস্থানে ফিরে গেছে, নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে ট্র্যানটরের অশুভ স্থানে। এখন তারা সাম্রাজ্যের কাছ থেকে নিজেদের গোপন করে রাখেনি বরং গোপন করে রেখেছে প্রথম ফাউণ্ডেশনের কাছ থেকে প্রথম ফাউণ্ডেশন প্রায় গ্যালাকটিক এম্পায়ারের মতোই বিশাল এবং কারিগরি প্রযুক্তিতে আরো বেশি উন্নত।

    ফার্স্ট স্পিকার আরামে চোখ বন্ধ করলেন। তিনি এমন একটা অবস্থার মধ্যে আছেন যাতে না স্বপ্ন দেখছেন, না সচেতন চিন্তা করছেন।

    হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। ট্র্যানটর এখনো গ্যালাক্সির কেন্দ্রবিন্দু, কারণ এখানে রয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন, এম্পায়ারের চেয়েও শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান।

    প্রথম ফাউণ্ডেশনকে পরিচালিত করতে হবে সঠিক পথে। যতই শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র থাক, কিছুই করতে পারবে না, যতক্ষণ তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মেন্টালী কন্ট্রোড হবে।

    তারপর দ্বিতীয় এম্পায়ার তৈরি হবে, কিন্তু এটা প্রথমটার মতো হবে না। বরং একটা ফেডারেটেড এম্পায়ার হিসেবে তৈরি করা হবে, প্রতিটি অংশে থাকবে পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসন, যেন কেউই বেশি শক্তিশালী হতে না পারে, বা একক কেন্দ্রীভূত সরকারের কোথাও কোনো দুর্বলতা না থাকে। নতুন এম্পায়ার হবে বন্ধনহীন, অনেক বেশি সুষম, স্থিতিস্থাপক এবং তাকে সবসময় সবসময়ই পথ নির্দেশনা দেবে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের লুকানো নারী ও পুরুষরা। তখনো ট্র্যানটর হবে রাজধানী, পয়তাল্লিশ বিলিয়ন জনগণ নিয়ে যতটা শক্তিশালী ছিল, মাত্র চল্লিশ হাজার সাইকোহিস্টারিয়ান নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

    ফার্স্ট স্পিকার চমকে উঠলেন। সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরী নেই। তিনি কি ফিসফিস করছিলেন? তিনি কি জোরে কিছু বলেছেন?

    দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিয়ম হচ্ছে বেশি জানো, বলো কম, আর ফাস্ট স্পিকারদের জানতে হয় সবচেয়ে বেশি, বলতে হয় সবচেয়ে কম।

    তিনি হাসলেন, যখন সবাই বুঝতে পারবে যে দ্বিতীয় এম্পায়ারের উদ্দেশ্য হচ্ছে ট্র্যানটরের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা তখন ট্রানটোরিয়ান দেশপ্রেমিক হতে সবারই লোভ হবে। সেলডন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন পাঁচ শতাব্দী আগেই।

    বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলেন না ফার্স্ট স্পিকার। জেনডিবলের আসার সময় হয়নি এখনো।

    স্যান্ডেস অধীর হয়ে এই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের প্রতীক্ষা করছেন। জেনডিবল বয়সে তরুণ, ফলে সে নতুন আঙ্গিকে সেলডন প্ল্যান বিচার করতে পারবে এবং হয়তো অন্যদের চোখে যা ধরা পড়বেনা, তার চোখে সেটা ধরা পড়বে। স্যান্ডেস নিজেও হয়তো তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবেন।

    কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না প্রীম পালভার-মহান পালভার নিজে-কোল বেনজাম যেদিন প্রথম ফাউণ্ডেশনকে থামানোর ব্যাপারে প্রথম তার সাথে কথা বলতে আসে, সেখান থেকে কতখানি লাভবান হয়েছিলেন। বেনজাম, সেলডনের পরে যিনি তাত্ত্বিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেই সাক্ষাৎকারের কথা কখনো আলোচনা করেননি, তবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি একুশতম ফার্স্ট স্পিকার হয়েছিলেন। অনেকেই বেনজামকে পালভারের চেয়েও বেশি মূল্যায়ন করে থাকে।

    জেনডিবল কি বলতে পারে, সেটা ভেবে স্যান্ডেস বেশ অবাক হচ্ছেন। প্রথা অনুযায়ী মেধাবী তরুণরা একা ফার্স্ট স্পিকারের মুখোমুখি হয়ে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে উপস্থাপন করে। প্রথম সাক্ষাৎ-এর বিষয়বস্তু অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে, নইলে ধ্বংস হয়ে যাবে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন।

    চার ঘণ্টা পর জেনডিবল তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তরুণের মধ্যে কোনো জড়তা নেই।

    স্যান্ডেস বললেন, তুমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার সাথে ব্যাক্তিগতভাবে দেখা করতে চেয়েছ, স্পিকার। তুমি কি দয়া করে সংক্ষেপে বলবে?

    এবং জেনডিবল শান্ত গলায় বলল, যেন একটু আগে ডিনারে কি খেয়েছে তার বর্ণনা দিচ্ছে, ফার্স্ট স্পিকার, সেলডন প্ল্যান একেবারেই অর্থহীন।

    .

    ১৮.

    অন্যরা তার ব্যাপারে কি ভাবল সেটা নিয়ে জেনডিবল কখনো মাথা ঘামায়নি। এমন কোনো সময়ের কথা তার মনে পড়েনা যে সময় নিজেকে অস্বাভাবিক বলে মনে। হয়নি। মাত্র দশ বছর বয়সে তার মাইন্ডের তীক্ষ্ণতা দেখে একজন এজেন্ট তাকে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের জন্য রিক্রুট করে।

    তারপর অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করে এবং মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে মহাকাশযানের প্রতিক্রিয়ার সাথে সাইকোহিস্টোরীর সম্পর্ক নিজের গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেয়। সাইকোহিস্টোরী তাকে নেশার মতো বুঁদ করে ফেলে। তার সমবয়সী অন্যরা যখন গলদঘর্ম হচ্ছে ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন নিয়ে, সেই সময়। সে সেলডনের মৌলিক রচনাগুলো ঠোঁটস্থ করে ফেলেছে।

    মাত্র পনের বছর বয়সে ভর্তি হয় ট্রানটর গ্যালাকটিক ইউনিভার্সিটিতে। (ইউনিভার্সিটি অফ ট্র্যানটরের নতুন অফিসিয়াল নাম), সেই সময় তার জীবনের লক্ষ্য কি জিজ্ঞেস করা হলে সে ভদ্র গলায় উত্তর দিয়েছিল, আমার জীবনের লক্ষ্য চল্লিশ পেরোবার আগেই ফার্স্ট স্পিকার হওয়া।

    ফার্স্ট স্পিকার হওয়ার জন্য নিজের ভেতরে যোগ্যতার অভাব কখনো অনুভব করেনি সে। এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে সে নিশ্চিত, শুধু লক্ষ্য হচ্ছে তরুণ বয়সে পদটি বাগিয়ে নেয়া। প্রীম পালভার নিজে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে ফার্স্ট স্পিকার হয়েছিলেন।

    জেনডিবল যখন এই কথা বলেছিল তখন প্রশ্নকারীর অভিব্যক্তি কেঁপে গিয়েছিল কিছুটা, কিন্তু এরই মধ্যে সাইকোল্যাংগুয়েজে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছে সে, ফলে এই কম্পন ব্যাখ্যা করতে তার অসুবিধা হয়নি। বুঝতে পেরেছিল প্রশ্নকারী তার রেকর্ডে ছোট একটা নোট যোগ করবে, সেটা হচ্ছে, এই লোককে সামলানো কঠিন।

    অবশ্যই, জেনডিবলকে সামলানো সবসময়ই কঠিন।

    এখন তার বয়স ত্রিশ। দুমাসের মাথায় একত্রিশে পা দেবে। ফার্স্ট স্পিকার হওয়ার জন্য তার হাতে সময় রয়েছে নয় বছর এবং জানে যে সে সফল হবেই। বর্তমান স্পিকারের সাথে আজকের সাক্ষাৎকার তার পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং সঠিক আচরণ প্রকাশের জন্য সে তার সাইকোল্যাংগুয়েজের দক্ষতকে ঘষামাজা করে আসেনি।

    যখন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের দুজন স্পিকার নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করে তাদের ভাষা হয় গ্যালাক্সির অন্য যে কোনো ভাষার চেয়ে ব্যতিক্রম। এই ভাষায় কোনো শব্দ নেই, রয়েছে সূক্ষ্ম আকার ইঙ্গিত, অনেকটা মাইন্ডের সূক্ষ্ম পরিবর্তন।

    অন্য কেউ এই ভাষা বুঝতে পারবে না, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে চিন্তা তরঙ্গের আকারে প্রচুর তথ্য আদান প্রদান হয়ে যাবে, লিখে সেটা বর্ণনা করা যাবে না।

    স্পিকারদের ভাষার সুবিধা হচ্ছে দ্রুতগতি এবং সূক্ষ্মতা। অসুবিধা হচ্ছে, আসল অনুভূতি কখনো গোপন করা যায় না।

    ফার্স্ট স্পিকারের ব্যাপারে জেনডিবল নিজের ভাবনা নিয়ে সচেতন। সে জানে ফার্স্ট স্পিকার এমন একজন মানুষ, যিনি তার মেন্টাল পাওয়ারের শীর্ষ অবস্থা পার হয়ে এসেছেন। ফাস্ট স্পিকার-জেনডিবলের মতে-কোনো সমস্যা আশা করছেন লো, সমস্যা মোকাবেলা করার কোনো প্রশিক্ষণ নেই, যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় সেটা মোকাবেলা করার দক্ষতা তার নেই। সুনাম এবং জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি আকস্মিকভাবে তৈরি একজন মানুষ।

    এই সবকিছু জেনডিবলকে শুধু শব্দ, ইঙ্গিত বা মৌখিক ভাবভঙ্গির আড়ালে রাখলে চলবেনা, তার নিজস্ব চিন্তার আড়ালেও রাখতে হবে। ফার্স্ট স্পিকারের কাছ থেকে আড়ালে রাখার কোনো সঠিক পদ্ধতি তার জানা নেই।

    নিজের ব্যাপারে ফার্স্ট স্পিকারের অনুভূতি জানার কোনো চেষ্টা সে করছে না। তবে আন্তরিকতা এবং সৌজন্যমূলক পরিবেশ অনুভব করতে পারছে এবং নিজে যাতে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ না করে সেজন্য মনকে ঠিক করে নিল।

    চেয়ারে হেলান দিয়ে মৃদু হাসলেন ফার্স্ট স্পিকার। তিনি টেবিলের উপর পা তুলে বসেন নি, তবে তার আচরণ জেনডিবলকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রাখার জন্য যথেষ্ট।

    স্যান্ডেস বল্লেন, সেলডন প্ল্যান অর্থহীন? কি চমৎকার মন্তব্য! তুমি সম্প্রতি প্রাইম রেডিয়্যান্ট দেখেছ, স্পিকার জেনডিবল?

    প্রাইম রেডিয়্যান্ট নিয়ে আমি প্রায়ই গবেষণা করতাম, ফার্স্ট স্পিকার। এটা ছিল আমার দায়িত্ব আর আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার।

    তুমি কি শুধু তোমার প্রয়োজনীয় অংশগুলো নিয়ে স্টাডি করেছ? ছোট ছোট অংশগুলো পরীক্ষা করেছ-এখানে একটা সমীকরণের সমাধান, ওখানে সমন্বয় সাধন, এভাবে? পুরোটা পর্যবেক্ষণ করা আমার কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ইঞ্চি ইঞ্চি করে প্রাইম রেডিয়্যান্ট পর্যবেক্ষণ করার উপকারিতা রয়েছে-তবে পুরোটা একসাথে পর্যবেক্ষণ করা আরো বেশি মজার। সত্যি কথা বলতে কি স্পিকার, আমি অনেকদিন থেকে কাজটা করি না। তুমি আমার সাথে যোগ দেবে?

    জেনডিবলের বেশিক্ষণ চুপ করে থাকার সাহস হলো না, কাজটা তাকে করতেই হবে। ব্যাপারটা আমার জন্য সম্মানের ও আনন্দের, ফার্স্ট স্পিকার।

    ফাস্ট স্পিকার তার ডেস্কের পাশে একটা লিভারে চাপ দিলেন। প্রত্যেক স্পিকারের কক্ষেই এধরনের একটা লিভার রয়েছে, জেনডিবলের কক্ষেও রয়েছে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন একটা সমতাবাদী সমাজ। ফার্স্ট স্পিকারের একমাত্র অফিসিয়াল সুবিধা হচ্ছে তিনি সবার আগে কথা বলেন।

    লিভারে চাপ দেয়ার ফলে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই আবার ভরে গেল মৃদু আলোয়। দুই লম্বা দেয়াল মসৃণ উজ্জ্বল সাদাটে আলোয় ভরে উঠল, তারপর সেখানে ফুটে উঠল পরিষ্কারভাবে প্রিন্ট করা সমীকরণ। এত ছোট যে। পড়াই যাচ্ছেনা।

    যদি তোমার আপত্তি না থাকে, ফার্স্ট স্পিকার বলেন, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন এখানে আর কেউ উপস্থিত নেই, বিবর্ধন আরো কমিয়ে নেব যেন একসাথে অনেক বেশি অংশ দেখতে পারি।

    পরিষ্কার প্রিন্টগুলো চুলের মতো ছোট হয়ে গেল, উজ্জ্বল ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখাচ্ছে ঝাপসা কালো আঁকাবাকা রেখার মতো।

    চেয়ারের হাতলের কনসোলের বোতাম স্পর্শ করলেন ফার্স্ট স্পিকার। আমরা এটাকে একেবারে শুরুতে নিয়ে যাব-হ্যারি সেলডনের জীবনকালে-তারপর ছোট ছোট ধাপে সামনে এগোব। এমনভাবে এগোব যেন একসাথে মাত্র একদশকের ডেভেলপম্যান্ট দেখতে পারি। এভাবে যে কেউই ইতিহাসের চমৎকার প্রবাহ দেখতে পারবে, কোথাও কোনো বিচ্যুতি ঘটবে না। তুমি বোধহয় কখনো এভাবে করোনি।

    ঠিক এভাবে কখনো করিনি, ফার্স্ট স্পিকার।

    করা উচিত ছিল। চমৎকার অনুভূতি। শুরুর দিকে পাতলাভাবে ছড়ানো কালো নকশাগুলো খেয়াল করো। প্রথম কয়েক দশক বিকল্প সুযোগ বেশি ছিল না। শাখাপথগুলো সময়ের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে গুনিতকহারে। কারণ একটা শাখা নির্বাচন করার ফলে ভবিষ্যতের অনেকগুলো শাখা বন্ধ হয়ে যেত। অবশ্যই ভবিষ্যতের বিষয়ে খেয়াল করতে হবে কোন শাখা আমরা নির্বাচন করব।

    আমি জানি, ফার্স্ট স্পিকার। গলার শুকনো ভাব জেনডিবল চেষ্টা করেও দূর করতে পারল না।

    ফার্স্ট স্পিকার ব্যাপারটা পাত্তা দিলেন না। লাল রঙের লাইনগুলো দেখো। এগুলোর মধ্যে একটা প্যাটার্ন রয়েছে। থাকবেই, যেহেতু প্রত্যেক স্পিকার সেলডনের মূল পরিকল্পনায় সংশোধনী যোগ করে নিজেদের স্থান তৈরি করে নেয়। এটা বলার কোনো উপায় নেই যে ঠিক কোনখানে একটা সংশোধনী যোগ করা যাবে বা একজন স্পিকার কোন অংশে তার আগ্রহ খুঁজে পাবে এবং আমার অনেকদিন থেকেই মনে হচ্ছে সেলডনের কালো এবং স্পিকারের লাল প্রতাঁকের সংমিশ্রণ একটা শক্ত নিয়ম অনুসরণ করে যা সময়ের উপর বেশি নির্ভরশীল।

    জেনডিবল দেখছে বছরগুলো একে একে পার হয়ে যাচ্ছে, লাল আর কালো সারিগুলো তৈরি করেছে প্রায় সম্মোহনী প্যাটার্ন। অবশ্য প্যাটার্ন কোনো বিষয় না, বিষয় হচ্ছে এর ভেতরে যে প্রতীকগুলো রয়েছে।

    এখানে সেখানে উজ্জ্বল নীল রং-এর কিছু তৈরি হচ্ছে, প্রবাহিত হচ্ছে ছোট নদীর মতো, বিভক্ত হচ্ছে বিভিন্ন শাখায় তারপর মিশে যাচ্ছে লাল বা কালো প্রতাঁকের সাথে।

    ফার্স্ট স্পিকার বল্লেন, ডেভিয়েশন ব্লু, এবং দুজনের ভেতর বিতৃষ্ণা তৈরি হলো। আমরা বারবার এর কবলে পড়েছি, এবং আমরা বিচ্যুতির শতকে পৌঁছেছি।

    দুজনেই পরিষ্কার বলতে পারবে ঠিক কখন মিউলের বিধ্বংসী ক্ষমতা পুরো গ্যালাক্সি গ্রাস করে ফেলে, কারণ প্রাইম রেডিয়্যান্ট হঠাৎ করেই ঝাপসা হয়ে গেছে। এবং বিভিন্ন দিক থেকে ছোট নদীর মতো নীল রং-এর অনেকগুলো শাখা ছড়িয়ে পড়ল। এক সময় মনে হলো পুরো ঘরটাই নীল দূষণে ভরে গেছে।

    নীল দূষণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ধীরে ধীরে ঝাপসা ও হালকা হয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি ঘটল দীর্ঘ শতাব্দী পূর্বে। যখন শেষ হলো এবং সেলডন প্ল্যান আবার লাল ও কালো রং-এ ফিরে এলো, তখন পরিষ্কার ধরা পড়ল প্রীম পালভারের অবদান।

    অনওয়ার্ড, অনওয়ার্ড

    বর্তমান সময়, ফার্স্ট স্পিকার আনন্দের সাথে বল্লেন।

    অনওয়ার্ড, অনওয়ার্ড

    চিকন কালো বিন্দুর নিখুঁত বুনটের মাঝখানে লাল বিন্দু তৈরি হলো।

    এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় এম্পায়ারের প্রতিষ্ঠা, ফার্স্ট স্পিকার বল্লেন।

    তিনি প্রাইম রেডিয়্যান্ট বন্ধ করে দিলেন, পুরো কক্ষ আবার স্বাভাবিক আলোয় ভরে উঠল।

    আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা। জেনডিবল বলল।

    হ্যাঁ, ফার্স্ট স্পিকার হাসলেন, এবং তুমি আবেগ প্রকাশ করতে চাওনা। কোনো ব্যাপার না। আমি যা বলতে চাই সেটা শোনো।

    প্রথমেই খেয়াল করবে যে প্রীম পালভারের পরে ডেভিয়েশন বু একেবারেই অনুপস্থিত অন্যভাবে বলা যায় গত বার দশকে এর উপস্থিতি ছিল না। তারপরে খেয়াল করবে যে আগামী পাঁচ শতাব্দীতে পঞ্চম মাত্রার বেশি বিচ্যুতির সম্ভাবনা নেই। আরো খেয়াল করবে যে আমরা সাইকোহিস্টোরীর সংশোধন দ্বিতীয় এম্পায়ার প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময় পর্যন্ত বিস্তৃত করেছি। তুমি তো জানোই হ্যারি সেলডন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা হলেও তিনি সবজান্তা ছিলেন না বা হতেও পারতেন না। আমরা তার চেয়েও অগ্রসর। সম্ভবত সাইকোহিস্টোরী তিনি যতটুকু জানতেন আমরা জানি তার চেয়ে বেশি।

    সেলডন তার গণনা শেষ করেছিলেন দ্বিতীয় এম্পায়ার পর্যন্ত আমরা সেটাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছি। দ্বিতীয় এম্পায়ারের পরবর্তী সময়ের জন্য যে নতুন হাইপার প্ল্যান তার বেশির ভাগটাই আমার করা এবং সেই কারণেই আমি পৌঁছতে পেরেছি আজকের অবস্থানে।

    এগুলো বলার কারণ হলো যেন তুমি আমাকে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা না বলো। এতকিছু জানার পরও কিভাবে বললে সেলডন প্ল্যান অর্থহীন? এটা একেবারে নিখুঁত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এটা বিচ্যুতির শতক পেরিয়ে এসেছে-এজন্য পালভারের প্রতিভাকে সম্মান জানাতে হয়। আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে এটি নিখুঁত। এর কোনখানে দুর্বলতা, ইয়ংম্যান, যার কারণে তুমি বলছ এই প্ল্যান অর্থহীন?

    জেনডিবল দু-পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি ঠিকই বলেছেন, ফার্স্ট স্পিকার। সেলডন প্ল্যানে কোনো খুঁত নেই।

    তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছ তাহলে?

    না, ফার্স্ট স্পিকার। নিখুঁত ভাবটাই হচ্ছে এই প্ল্যানের সবচেয়ে বড় খুঁত। এর নির্ভুলতা একটা মারাত্মক ব্যাপার।

    .

    ১৯.

    ফার্স্ট স্পিকার নিজের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন এবং তিনি অবাক হচ্ছেন এক্ষেত্রে জেনডিরুলের অদক্ষতা দেখে। তরুণ প্রতিবারই চেষ্টা করছে তার অনুভূতি গোপন রাখতে, কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হচ্ছে।

    স্যাভেস বিরক্তি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। জেনডিবলের গড়ন হালকা পাতলা, উচ্চতা মাঝারি, পাতলা ঠোঁট এবং কঙ্কালসার দুটি হাত। কালো পাথুরে চোখ, মনে হয় সবসময় ধিকিধিকি জ্বলছে।

    ফার্স্ট স্পিকার জানেন নিজের ধারণা থেকে তাকে হটানো প্রায় অসম্ভব।

    তুমি ধাঁধা তৈরি করছ, স্পিকার। তিনি বল্লেন।

    ধাঁধার মতো শোনাচ্ছে, ফার্স্ট স্পিকার, কারণ সেলডন প্ল্যানের অনেক কিছুই আমরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছি।

    তুমি কোন বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন তুলছ তাহলে?

    এই প্ল্যানের ভিত্তি নিয়ে। আমরা সবাই জানি-যাদের আচরণ অনুমানের জন্য এই পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে তাদের কাছে এর বৈশিষ্ট্য বা অস্তিত্ব প্রকাশ হয়ে পড়লে এটি কাজ করবে না।

    আমার ধারণা হ্যারি সেলডন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমার আরো মনে হয় তিনি এটাকে সাইকোহিস্টোরীর মৌলিক দুটি অনুমিতির একটি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

    তিনি মিউলের বিষয় বিবেচনা করেননি, ফার্স্ট স্পিকার এবং মিউল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের গুরুত্ত্ব প্রকাশ করে দেয়ার পর প্রথম ফাউণ্ডেশন আমাদেরকে কিভাবে নেবে সেটাও বিশ্লেষণ করেন নি।

    হ্যারি সেলডন-এক মুহূর্তের জন্য ফার্স্ট স্পিকার কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে, গেলেন। হ্যারি সেলডনের প্রতিচ্ছবির কথা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের জানা আছে। তাদের কাছেও সেলডনের দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক, ফটোগ্রাফিক, হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি রয়েছে। কিন্তু সেগুলো সবই তার জীবনের শেষ কয়েক বছরের। সবই একজন সহৃদয় বৃদ্ধলোকের, কয়স এবং জ্ঞানের ভারে সারা মুখে বলিরেখা দেখা দিয়েছে, পুরো অবয়ব জুড়ে প্রতিভার ছটা।

    কিন্তু ফাস্ট স্পিকারের মনে পড়ল সেলড়নের তরুণ বয়সের একটা ছবির কথা, ছবিটাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি, কারণ সেলড়নের বৃদ্ধ অবয়ব সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি ছবিটা দেখেছিলেন এবং তার হঠাৎ করেই মনে হলো স্টর জেনডিবুল দেখতে অনেকটা তরুণ সেলডনের মতো।

    অসম্ভব! এ ধরনের কুসংস্কার যখন তখন যে কারো মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তিনিও ব্যতিক্রম নন। তার সামনে যদি এখন ছবিটা থাকত তরে দেখে নিতে পারতেন যে তিনি যা ভাবছেন, সবই কল্পনা। তারপর এমন একটা চিন্তা এই মুহূর্তে তার মাথায় কি করে এলো।

    তিনি সচেতন হয়ে উঠলেন। ব্যাপারটা ছিল এক মুহূর্তের কম্পূন-চিন্তার সামানয় বিচ্যুতি-অন্য কেউ ধরতে না পারলেও একজন স্পিকার ঠিকই ধরতে পারবে। জেনডিবল যেমন খুশি ব্যাখ্যা করতে পারে।

    হ্যারি সেলডন, তিনি আবার নরম সুরে বললেন, ভালভাবেই জানতেন অনেক বিষয়ই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন না এবং সে কারণেই তিনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন তৈরি করেছিলেন। আমরাও মিউলের ব্যাপারটা ধরতে পারিনি, কিন্তু যখন সেই আক্রোশ আমাদের উপর এসে পড়ল সেটাকে থামিয়ে দেই। এখানে গলদটা কোথায়?

    একটাই, জেনডিবল বলল, প্রথম ফাউণ্ডেশনের সাথে আমাদের লড়াই এখনো শেষ হয়নি।

    জেনডিবলের বলার স্বরে সূক্ষ্ম তারতম্য। সে ফার্স্ট স্পিকারের কণ্ঠস্বরের কম্পনকে অনিশ্চয়তা হিসেবে ধরে নিয়েছে।

    ফার্স্ট স্পিকার তিরস্কারের স্বরে বললেন, আমাকে অনুমান করতে দাও। প্রথম ফাউণ্ডেশনে এমন ধরনের মানুষ রয়েছে যারা চার শতাব্দীর অস্থিরতা এবং গত বারটি দশকের শান্তির সাথে তুলনা করে এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন ভালভাবেই সেলডন প্ল্যানের রক্ষণাবেক্ষণ করছে-এবং অবশ্যই তারা সঠিক উপসংহারে পৌঁছেছে। তারা হয়তো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আসলে ধ্বংস হয়নি-এবং অবশ্যই তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক, প্রকৃতপক্ষে আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে প্রথম ফাউণ্ডেশনের রাজধানী বিশ্বের এক তরুণ, তাদের প্রশাসনের একজন সদস্য ঠিক এমনই মনে করে-আমি অবশ্য নামটা ভুলে গেছি-

    গোলান ট্র্যাভিজ, জেনড়িবল নরম সুরে বলল। ব্যাপারটা আমিই প্রথম খেয়াল করি এবং আপনার কাছে পাঠাই।

    ওহ? ফার্স্ট স্পিকার অতিরিক্ত ভদ্র গলায় বললেন। এই লোকের উপর তোমার মনযোগ আকৃষ্ট হলো কেন?

    টার্মিনাস থেকে আমাদের একজন এজেন্ট তাদের নতুন নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্যদের নিয়ে রিপোর্ট পাঠায়-সম্পূর্ণ রুটিন ওয়র্ক, তাই অন্য স্পিকাররা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আমার চোখে পড়েছে কারণ এই রিপোর্টে গোলান ট্র্যাভিজ নামে নতুন কাউন্সিলম্যানের ব্যাপারে অনেক কিছু বলা হয়েছিল। বর্ণনা থেকে তাকে আমার মনে হয়েছে আত্মবিশ্বাসী এবং আক্রমণাত্মক।

    তার ভেতর নিজের মতো সাহসিকতা দেখতে পেয়েছ, তাই না?

    মোটেই না, জেনডিবল শক্ত গলায় বলল। সে এমন একজন বেপরোয়া লোক যার অসম্ভব কাজ করার প্রতি আগ্রহ রয়েছে, যে বর্ণনা আমার বেলায় প্রযোজ্য না। যাই হোক আমি খুব ভালোভাবে স্টাডি করেছি। ছোট বেলায় তাকে রিক্রুট করতে পারলে আমাদের জন্য একটা সম্পদ হতো সে।

    হয়তো, ফার্স্ট স্পিকার বললেন, কিন্তু তুমি জানো আমরা টার্মিনাস থেকে রিক্রুট করি না।

    ভালোভাবেই জানি। যাই হোক আমাদের প্রশিক্ষণ ছাড়াই তার ভেতর অস্বাভাবিক ইনটুইশন তৈরি হয়েছে। অবশ্য পুরোপুরি অগোছালো। তাই আমি অবাক হইনি যখন সে বুঝতে পারল যে আমরা এখনো টিকে আছি। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় আমি আপনাকে জানাই।

    আমি ধরে নিচ্ছি নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে।

    আমাদের অস্তিত্বের ব্যাপারটা ধরে ফেলার পর সে তার অতি উন্নত ইনটুইশন এমন বিশৃঙ্খল পদ্ধতিতে ব্যবহার করল যার ফলে তাকে টার্মিনাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

    ফার্স্ট স্পিকার ভুরু কপালে তুললেন। তুমি আচমকা থেমে গেছ। তুমি চাও আমি বিষয়টার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলি। কম্পিউটার ব্যবহার না করে মেন্টালি সেলডন সমীকরণের খসড়া হিসাব প্রয়োগ করে দেখা যাক কেন তীক্ষ্ণ বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়র, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী তরুণকে গ্যালাক্সিতে চিৎকার করারই সুযোগ দেননি বরং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। অথচ তিনি ভালোভাবেই জানেন আমরা এখনো টিকে আছি। আমার মতে ব্র্যান্নো দ্য ব্রোঞ্জ ধরে দিয়েছেন। ট্র্যাভিজকে বের করে দেয়াই হবে টার্মিনাসের জন্য নিরাপদ।

    তিনি ট্র্যাভিজকে বন্দী করে রাখতে পারতেন বা গোপনে মেরে ফেলতে পারতেন।

    সমীকরণগুলো একক ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করা যায় না, প্রয়োগ করতে হয় দলবদ্ধ মানুষের উপর। তাই ব্যক্তিগত আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় না, তবে অনুমান করে নিচ্ছি যে মেয়র এমন একজন ব্যক্তি মানুষ যিনি মনে করেন বন্দী করা বা মেরে ফেলা অনেক বেশি নিষ্ঠুর।

    জেনডিবল চুপ। কিছুই বলছে না। তার নীরবতা ফার্স্ট স্পিকারকে অনিশ্চিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু তাকে রাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়।

    তারপর জেনডিবল বলল, আমার ধারণা সেটা না, আমার মতে ট্র্যাভিজ, এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হুমকি-এমনকি মিউলের চেয়েও বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

    .

    ২০.

    জেনডিবল সন্তুষ্ট। তার বক্তব্য বেশ জোরালোভাবে কাজ করেছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন ফার্স্ট স্পিকার। এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ জেনডিবলের হাতে। মনে কোনো সন্দেহ থাকলেও ফার্স্ট স্পিকারের পরের কথাতেই সেটা দূর হয়ে গেল।

    সেলডন প্ল্যান অর্থহীন, তোমার এই কথার সাথে কি এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

    জেনডিবল নিশ্চিত হয়ে জুয়া খেলল, এমনভাবে চাল দিল যেন ফার্স্ট স্পিকার সামলে উঠতে না পারেন। ফার্স্ট স্পিকার, প্রিম পালভারই বিচ্যুতির শতকের তুমুল বিশৃঙ্খলার পর সেলডন প্ল্যানকে আবার আগের ধারায় ফিরিয়ে আনেন। প্রাইম রেডিয়্যান্ট পর্যবেক্ষণ করে আপনি দেখতে পারবেন পালভারের মৃত্যুর দুই দশক পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা বজায় ছিল, তারপর আর কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। কৃতিত্বটা পালভারের পরবর্তী ফাস্ট স্পিকারদের দিতে হয়, কিন্তু সেটা অসম্ভব।

    অসম্ভব? স্বীকার করছি আমরা কেউই পালভারের মতো না, কিন্তু অসম্ভব কেন?

    আপনি কি আমাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেবেন, ফার্স্ট স্পিকার? সাইকোহিস্টোরী গণিত ব্যবহার করে আমি আপনাকে পরিষ্কার দেখাতে পারব যে বিশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব। মাত্র আধঘণ্টা সময় প্রয়োজন। ইচ্ছে হলে আপনি আমাকে সুযোগ নাও দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্পিকারদের মিটিং ডেকে সেখানে ব্যাখ্যা করব। কিন্তু সেজন্য আমার প্রচুর সময় নষ্ট হবে।

    হ্যাঁ, এবং আমি হয়তো একটা পরিচিত মুখ হারাব।–এখনি আমাকে ব্যাখ্যা করে শোনাও। কিন্তু তোমাকে সতর্ক করে দেয়া প্রয়োজন। ফার্স্ট স্পিকার নিজেকে সামলানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তোমার কথা যদি অর্থহীন কিছু হয়, আমি সেটা ভুলবনা।

    যদি আমার কথা অর্থহীন প্রমাণ হয়, জেনডিবল অহংকারের সাথে বলল, আমি সাথে সাথে পদত্যাগ করব।

    সময় লাগল আসলে আধঘণ্টারও বেশি, কারণ ফার্স্ট স্পিকার বারবার গণিত নিয়ে প্রশ্ন তুললেন।

    কিছুটা সময় জেনডিবল নষ্ট করল তার মাইক্রো রেডিয়্যান্ট নিয়ে। এই ডিভাইস দিয়ে বিশাল পরিকল্পনার যে কোনো অংশকে বের করে আনা যায়, তার জন্য কোনো দেয়াল বা ডেস্ক সাইজ কনসোল প্রয়োজন হয় না। মাত্র এক দশক আগে থেকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, কিন্তু ফার্স্ট স্পিকার এর ব্যবহার জানেন না। জেনডিবল এ ব্যাপারে সচেতন।

    জেনডিবল যন্ত্রটা ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুলে ধরে চার, আঙ্গুল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার হাত চালানোতে মনে হয় যেন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে।

    কথার সাথে সাথে তার তৈরি সমীকরণগুলো সাপের মতো এঁঝোরেকে আগুপিছু করছে। ইচ্ছে করলেই সে যে কোনো ব্যাখ্যা, অনুমিতি এবং দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক গ্রাফ তৈরি করতে পারবে।

    জেনডিবলের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার এবং সূক্ষ্ম। ফার্স্ট স্পিকার হাল ছেড়ে দিলেন। আমি এমন বিশ্লেষণ কখনো দেখিনি। কার কাজ এটা?

    ফার্স্ট স্পিকার, এটা আমার নিজের। মৌলিক গর্ণিতগুলো আমি তৈরি করেছি।

    চমৎকার স্পিকার, জেনডিবল। এ ধরনের গবেষণাই মোর ফার্স্ট স্পিকার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে, যদি আমি মারা যাই ৰা অবসর নেই।

    আমি ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখিনি, ফার্স্ট স্পিকার–কিন্তু যেহেতু আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না, আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আশা করি আমি একদিন ফার্স্ট স্পিকার হব। শুধু এই পদে যে বসরে তাকে কিছু নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হবে, সেটা পরিষ্কার আমার কাছে।

    হ্যাঁ ফার্স্ট স্পিকার বললেন। অপ্রয়োজনীয় ভদ্রতা বিপজ্জনক হতে পারে। কি ধরনের নিয়ম? হয়ন্তে বর্তমান ফার্স্ট স্পিকারও সেগুলো মেনে চলতে পারে।

    মার্জিত আত্মসমর্পণ, এবং জেনডিবল হঠাৎ করেই বৃদ্ধের প্রতি নরম হয়ে পড়ল, কারণ সে ফার্স্ট স্পিকারের আসল উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছে।

    ধন্যবাদ, ফার্স্ট স্পিকার, আপনার সাহায্য আমার দারুণভাবে প্রয়োজন। আপনার সুনিপুণ নেতৃত্ব ছাড়া বাকী সদস্যদের কিছুই বোঝাতে পারব না। আমার ধারণা, আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আমাদের নীতিতে বিচ্যুতির শতক সংশোধন করা ছিল অসম্ভব অথবা তার পরে সমস্ত শিলা দূর করা একেবারেই অসম্ভব।

    পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, ফার্স্ট স্পিকার বললেন। যদি তোমার গণিত শুদ্ধ হয় তবে সেলডন প্ল্যান আগের ধারায় ফিরিয়ে এনে সঠিকভাবে কাজ করানোর জন্য। ছোট মানব গোষ্ঠী–এমনকি একক ব্যক্তির আচরণ ব্যাখ্যা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

    ঠিক তাই। যদিও সাইকোহিস্টোরী গণিতে সেটা সম্ভব নয়, তারপরও বিশৃঙ্খলা নিশ্চিহ্ন হবে না এবং সবচেয়ে বড় কথা পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকতে দেয়া যাবে না। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেলডন প্ল্যানের নির্ভুলতাই এর সবচেয়ে বড় খুঁত বলতে আমি কি বুঝিয়েছিলাম।

    হয় সেলডন প্ল্যানের ভেতর বড় কোনো বিশৃঙ্খলা রয়েছে, অথবা তোমার গণিতে কোনো ভুল আছে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সেলডন প্ল্যানে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি, তার মানে তোমার গণিতে কোনো ভুল আছে-যদিও আমি ধরতে পারছি না।

    আপনি ভুল করছেন, জেনডিল বলল, তৃতীয় সম্ভাবনা বাদ দিয়ে। সেলডন প্ল্যানে বিশৃঙ্খলা না থাকাও সম্ভব এবং আমার গণিতে ভুল না থাকাও সম্ভব।

    তৃতীয় সম্ভাবনাটা দেখতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।

    ধরা যাক সেলডন প্ল্যান এমন এক উন্নত সাইকোহিস্টোরিক্যাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যার দ্বারা এমনকি একজন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব এবং এমন এক পদ্ধতি যা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের হাতে নেই। শুধু তখনই আমার গণিতের দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব যে সেলডন প্ল্যানে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।

    কিছুক্ষণের জন্য (দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী) ফার্স্ট স্পিকার চুপ থাকলেন। তারপর বল্লেন, এমন কোনো উন্নত সাইকোহিস্টোরীক্যাল পদ্ধতির কথা আমার জানা নেই, তোমার আচরণে আমি নিশ্চিত যে তুমিও জানো। তুমি বা আমি জানিনা, আমাদের অজান্তে দলের অন্য কারো হাতে মাইক্রোসাইকোহিন্ত্রী থাকার সম্ভাবনা খুব কম। তুমি একমত?

    আমি একমত।

    তাহলে হয় তোমার বিশ্লেষণ ভুল অথবা মাইক্রোসাইকোহিন্ত্রী রয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের বাইরের কারো হাতে।

    ঠিক তাই, ফার্স্ট স্পিকার, পরের সম্ভাবনাটাই ঠিক।

    তুমি প্রমাণ করতে পারবে?

    না পারব না; কিন্তু ভেবে দেখুন-এরই মধ্যে একজন একক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে সেলডন প্ল্যান প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল কিনা?

    আমার ধারণা তুমি মিউলের কথা বলছ?

    হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

    মিউল শুধু ধ্বংস করতে পারত। সমস্যা হচ্ছে সেলডন প্ল্যান খুব ভালোভাবে চলছে, তোমার গণিত যতটুকু শুদ্ধ করা যায় তারচেয়েও নিখুঁত ভাবে। তোমার প্রয়োজন এন্টি মিউল-যারা মিউলের মতো প্ল্যানটাকে গ্রাস করতে পারবে কিন্তু কাজ করবে বিপরীত উদ্দেশ্য নিয়ে ধ্বংস না করে রক্ষা করবে।

    ঠিক, ফার্স্ট স্পিকার। মিউল কি? একটা মিউট্যান্ট। কিন্তু সে কোত্থেকে এসেছিল? কিভাবে এসেছিল? কেউ জানে না। যেখান থেকে এসেছিল সেখানে তার মতো অনেকেই থাকতে পারে?

    অবশ্যই না। মিউলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা জানা যায় সেটা হচ্ছে তার কোনো জোড়া নেই। নাকি তুমি ব্যাপরটা কিংবদন্তী বলে উড়িয়ে দিয়েছ?

    আমি মিউলের বংশধরদের কথা বলছিনা। হয়তো মিউল এমন কোনো গোষ্ঠীর বিদ্রোহী সদস্য যাদের মিউলের মতো ক্ষমতা রয়েছে-এখন তারা দলে ভারী হয়েছে-যারা নিজেদের কোনো উদ্দেশ্যে সেলডন প্ল্যান ধ্বংস না করে সমর্থন করছে।

    গ্যালাক্সির কসম, কেন তারা সমর্থন করবে?

    আমরা কেন সমর্থন করি? আমরা এমন একটা দ্বিতীয় এম্পায়ারের পরিকল্পনা করেছি যেখানে আমরা অথবা আমাদের বুদ্ধিমান বংশধররা সিদ্ধান্ত নেবে। যদি অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠী আমাদের চেয়েও দক্ষভাবে এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করে, তারা আমাদের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে চাইবে না। আমাদের কি খুঁজে দেখা উচিত না তারা কিরকম দ্বিতীয় এম্পায়ার আমাদের উপহার দিতে যাচ্ছে?

    তুমি কিভাবে খুঁজে বের করবে?

    বেশ, টার্মিনাসের মেয়র গোলান ট্র্যাভিজকে কেন বের করে দিলেন। এভাবে তিনি একজন সম্ভাব্য বিপজ্জনক চরিত্রকে সুযোগ দিলেন গ্যালাক্সিতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর। তিনি মানবজাতির কল্যাণ চান, আমি বিশ্বাস করি না। ঐতিহাসিকভাবে প্রথম ফাউণ্ডেশনের শাসকরা আচরণ করেন বাস্তবতা অনুযায়ী। আসলে আমার ধারণা মেয়র এন্টি-মিউলদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করেছেন। আমি মনে করি ট্র্যাভিজ তাদের এজেন্ট, আমাদের জন্য বিপজ্জনক। ভয়ংকর রকম বিপজ্জনক।

    ফাস্ট স্পিকার বললেন, সেলডনের কুসম, হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু বাকী সদস্যদের বোঝাবো কি করে?

    ফার্স্ট স্পিকার, আপনি আপনার সুনামকে খাটো করে দেখছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন -আইজাক আসিমভ
    Next Article ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ – আইজাক আসিমভ

    Related Articles

    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফরওয়ার্ড দ্য ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    প্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন -আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.