Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার – আইজাক আসিমভ

    নাজমুছ ছাকিব এক পাতা গল্প298 Mins Read0

    ৫. অবরোধ ভেদ করে

    ২১. মহাকাশে অবকাশ

    অবরোধ ভেদ করে বেরিয়ে আসা গেল নির্বিঘ্নে। স্পেস এর বিস্তৃতি এত সীমাহীন যে অনন্তকাল ধরে যত নেভি ছিল বা হতে পারত সবগুলো মিলেও পুরো স্পেস এর উপর নজরদারি করতে পারবে না। মাত্র একটা শিপ, একজন দক্ষ পাইলট এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাগ্যের সহায়তা পেলে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো তৈরি করে নেওয়া যাবে।

    শীতল দৃষ্টি এবং শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে টোরান তার মহাকাশযান এক নক্ষত্রের সন্নিহিত অঞ্চল থেকে আরেক নক্ষত্রের দিকে নিয়ে গেল। নক্ষত্রের এত কাছে থাকায় অতিরিক্ত মধ্যাকর্ষণ ইন্টারস্টেলার জাম্প কঠিন এবং জটিল করে তুললেও, একই সাথে শত্রুর ডিটেকশন ডিভাইস ও অকার্যকর হয়ে পড়বে।

    এবং নিপ্রাণ মহাকাশের ভিতরের বৃত্ত পেরিয়ে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল টোরান। তিন মাসের ভিতর এই প্রথম তার মনে হচ্ছে যেন নিঃসঙ্গতা কেটে গেছে। কারণ এখান থেকে সাব ইথারিক সংবাদ আদানপ্রদান শত্রু পক্ষ ধরতে পারবে না মোটেই।

    এক সপ্তাহে ফাউণ্ডেশন-এর উপর ক্রমশ প্রভাব বিস্তারের নীরস আর প্রশংসায় ভরপুর সংবাদ ছাড়া আর কিছু ছিল না, সপ্তাহটা ছিল যখন টোরান একটা তৃরিত জাম্প দিয়ে পেরিফেরি থেকে বেরিয়ে আসছে।

    এবলিং মিস এর ডাক শুনে সে চার্ট থেকে চোখ তুলে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে।

    “কী হয়েছে?” মাঝখানের ছোট চেম্বারে নেমে এল টোরান, বেইটা এটাকে পরিণত করেছে লিভিং রুমে।

    মাথা নাড়ল মিস, “জানি না। মিউলের সংবাদ পাঠক একটা স্পেশাল বুলেটিনের ঘোষণা দিয়েছে। ভাবলাম তুমিও হয়তো শুনতে চাইবে।”

    “ভালো। বেইটা কোথায়?”

    “ডিনারের ব্যবস্থা করছে।”

    ছোট কট-ম্যাগনিফিসো যাতে ঘুমায়-তার কিনারে বসে অপেক্ষা করছে টোরান। মিউলের আপ্রচার মূলক স্পেশাল বুলেটিন বরাবরই একঘেয়ে। প্রথমে সামরিক বাদ্যযন্ত্র তারপর ঘোষকের তেলতেলে মুখ। শুরুতেই থাকে গুরুত্বহীন খবরগুলো। একটার পর একটা। তারপর একটু বিরতির পরে ট্রাম্পেটের বাজনা ধীরে ধীরে শ্রোতার উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।

    কষ্ট করে সহ্য করল টোরান। আপন মনে বিড় বিড় করছে মিস।

    সংবাদপাঠক প্রচলিত শব্দ ব্যবহার কবে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন শুরু করল। মহাকাশে সংগঠিত এক লড়াইয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ইস্পাত এবং রক্তপাতের ঘটনা শব্দে রূপান্তর করে চলেছে।

    লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যামিল এর অধীনস্থ র‍্যাপিড ক্রুজার স্কোয়াড্রন আজ ইজ এর টাস্ক ফোর্স এর উপর প্রবল হামলা চালায়-” ঘোষকের ছবি মুছে গিয়ে কালো মহাশূন্যে মরণ পণ লড়াইয়ে ব্যস্ত যুদ্ধযানগুলোর ছুটোছুটির দৃশ্য ফুটে উঠল। নিঃশব্দ বিস্ফোরণের দৃশ্যের মাঝেই ঘোষকের কণ্ঠ বেজে চলেছে।

    লড়াই এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল হেভি ক্রুজার ক্লাস্টার এর সাথে শত্রুপক্ষের ‘নোভা’ শ্রেণীর তিনটি শিপের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ।

    স্ক্রিনের দৃশ্য পাল্টে ফুটে উঠল বিশাল এক যুদ্ধযানের ছবি আর চকচকে শিপ নিয়ে উন্মাদ আক্রমণকারী চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে, বাঁক নিয়ে আবার ফিরে এল গোত্তা মেরে ছুটল আক্রমণের উদ্দেশ্যে এবং ক্লাস্টারের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে আক্রমণ চালিয়ে বিস্ফোরিত হল। প্রজ্বলিত শক্রযান এড়ানোর জন্য সামনের দিকে কিছুটা নিচু হল দানবের মতো যুদ্ধযানটা।

    সংঘর্ষের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মসৃণ নিরাবেগ গলায় বর্ণনা করে গেল সংবাদ পাঠক।

    কিছুক্ষণ বিরতির পর একই কণ্ঠস্বর বর্ণনা করে চলল নেমনের যুদ্ধের। তবে এবার আরো উদ্দীপক শব্দ এবং বিস্তারিত বর্ণনা ব্যবহার করল ঘোষক। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা বিধ্বস্ত নগরী-হাত বাধা ক্লান্ত বন্দিদের দৃশ্য।

    নেমন সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়েছে।

    আবার নীরবতা-এবং প্রত্যাশিত কর্কশ বাদ্যযন্ত্র। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা লম্বা করিডর, দু পাশে সারিবাধা সৈনিক, তার শেষ মাথায় দ্রুত পায়ে একজন সরকারি মুখপাত্র এসে দাঁড়াল, পরনে কাউন্সিলরের ইউনিফর্ম।

    নীরবতা অসহ্য ঠেকল দুই শ্রোতার কাছে।

    তারপর যে কণ্ঠস্বর শোনা গেল সেটা গম্ভীর ধীরস্থির এবং কঠিন :

    “আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসকের নির্দেশে ঘোষণা করা হচ্ছে। যে, হেভেন নামক গ্রহ, যুদ্ধে বিরতি দিয়ে পরাজয় বরণ করে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। এই মুহূর্তে আমাদের শাসকের সৈনিকেরা অবস্থান নিয়েছে গ্রহের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোতে। সকল ধরনের বিরোধীতা দমন করা হয়েছে শক্ত হাতে।”

    মূল সংবাদপাঠককে আবার দেখা গেল স্ক্রিনে। জানিয়ে দিল গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ পাওয়া গেলেই সেটা প্রচার করা হবে। তারপর শুরু হল একটা সঙ্গীতানুষ্ঠান। পাওয়ার অফ করে দিল মিস!

    এলোমেলো পদক্ষেপে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল টোরান। তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই করল না সাইকোলজিস্ট।

    বেইটা কিচেন থেকে বেরিয়ে আসার পর খবরটা তাকে জানাল মিস “ওরা হেভেন দখল করে নিয়েছে।”

    “এত জলদি?” অবিশ্বাসে চোখ দুটো গোলাকার হয়ে গেছে বেইটার, কিছুটা অসুস্থ মনে হল তাকে।

    “বিনা যুদ্ধে (বিনা ছাপার…)-” থেমে কথাগুলো পেটের ভেতর নামিয়ে দিল আবার। “টোরানকে একা থাকতে দাও। ওর মন ভালো নেই। ওকে ছাড়াই খেতে বসব।”

    একবার পাইলট রুমের দিকে তাকাল বেইটা “ঠিক আছে!”

    ম্যাগনিফিসোর দিকে ওরা খুব একটা মনযোগ দিল না। সে অবশ্য চুপচাপ খাচ্ছেও খুব কম। শুধু ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনে, মনে হচ্ছে যেন তার প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে আতঙ্কের প্রবাহ চুঁইয়ে পড়ছে।

    অন্যমনস্কভাবে বরফ দেওয়া ফুট-ডেজার্টের বাটিটা সরিয়ে কর্কশ গলায় এবলিং মিস বলল, “দুটো বণিক বিশ্বযুদ্ধ করে গেছে শেষ পর্যন্ত। তারা যুদ্ধ করল, রক্ত ঝরালো, পরাজিত হল, কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। শুধু হেভেন-ঠিক ফাউণ্ডেশন-এর মতো-”

    “কিন্ত কেন? কেন?”

    মাথা নাড়ল সাইকোলজিস্ট। এখানেই আসল সমস্যা। প্রতিটি অস্বাভাবিক ঘটনা মিউলের চরিত্রের নিদর্শন। প্রথম সমস্যা, মাত্র এক হামলাতে বিনা রক্তপাতে মিউল কীভাবে ফাউণ্ডেশন দখল করল-যেখানে স্বাধীন বণিক বিশ্বগুলো তখনো প্রতিরোধ করে চলছিল। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের উপর আবরণ তৈরি করা একটা নিচু মানের অস্ত্র-আমরা অনেকবার এটা নিয়ে আলোচনা করেছি, যতক্ষণ না ব্যাপারটা আমাকে অসুস্থ করে তোলে। কিন্তু চালাকিটা শুধু কাজ করে ফাউণ্ডেশন এর বেলায়।

    “রাণুর ধারণা ছিল,” এবলিং মিস এর গ্রিজলি ভালুকের মতো ভুরু জোড়া ঘনিষ্ঠ হল, “জিনিসটা সম্ভবত রেডিয়্যান্ট-উইল-ডিপ্রেসর। হেভেনে হয়তো কাজ করেছে। কিন্তু ইজ বা নেমন এর বেলায় কেন ব্যবহার করা হয়নি-যারা এখন ফাউণ্ডেশন-এর প্রায় অর্ধেক ফ্লিট নিয়ে এখন পর্যন্ত মিউলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ বজায় রেখেছে। হ্যাঁ, খবরে দেখা দৃশ্যে আমি ফাউণ্ডেশন শিপ চিনতে পেরেছি।”

    “ফাউণ্ডেশন, তারপর হেভেন,” ফিসফিস করে বলল বেইটা। “বিপদ মনে হয় আমাদের পিছু পিছু ধেয়ে আসছে, কিন্তু স্পর্শ করছে না। প্রতিবারই মাত্র চুল পরিমাণ সময়ের আগেই বিপদ থেকে বেরিয়ে এসেছি। বরাবরই কী এমন ঘটবে?”

    কিন্তু এবলিং মিস শুনছে না তার কথা, নিজের চিন্তাতেই কথা বলে চলেছে,”কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে-আরেকটা সমস্যা, বেইটা। মনে আছে খবরে বলা হয়েছিল যে মিউলের ক্লাউনকে টার্মিনাসে পাওয়া যায়নি; ধারণা করা হচ্ছে সে হেভেনে চলে গেছে বা অপহরণকারীরা তাকে সেখানে নিয়ে গেছে। ওর নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্ব আছে, বেইটা, আমরা এখনো সেটা ধরতে পারিনি। ম্যাগনিফিসো নিশ্চয়ই এমন কিছু জানে মিউলের জন্য যা বিপজ্জনক। আমি নিশ্চিত।”

    ম্যাগনিফিসো, চেহারা ফ্যাকাশে, ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে, প্রতিবাদের সুরে বলল, “সায়ার…নোবল লর্ড…অবশ্যই, আমার অনেক কিছুই মনে নেই, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যদুর সম্ভব বলেছি, এবং আপনি প্রোব দিয়ে আমার ভেতর থেকে আমি যা জানি, কিন্তু জানতাম না যে আমি জানি সেগুলোও বের করে এনেছেন।”

    “জানি…জানি। ব্যাপারটা অনেক ছোট। এতই ছোট যে আমি বা তুমি কেউই চিনতে পারছি না। অথচ আমাকে বের করতেই হবে-নেমন আর ইজ এব পতন ঘটবে খুব শিগগিরই এবং তারপর শুধু অবশিষ্ট থাকব আমরা, স্বাধীন ফাউণ্ডেশন এর সর্বশেষ বিন্দু।”

    গ্যালাক্সির মূল অংশ পাড়ি দেওয়ার সময় নক্ষত্রের ঝাঁক আরো ঘন হতে লাগলো। গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড বাড়তে লাগলো লাফিয়ে লাফিয়ে আন্তনাক্ষত্রিক জাম্পের ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়িয়ে তুলল। সতর্ক না হলেই বিপদ।

    টোরান সতর্ক হল যখন একটা জাম্পের পর তাদের শিপ গিয়ে পড়ল একটা রেড জায়ান্টের শক্তিশালী মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের মাঝে এবং নিদ্রাহীন বারো ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রমের পরই সেখান থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হতে পারল।

    চার্টের অসম্পূর্ণতা, নিজের অদক্ষতা, অপারেশন এবং ম্যাথমেটিক্যাল অভিজ্ঞতার অভাবের কারণেই টোরান বাধ্য হয়ে ফিরে গেল পুরোনো যুগের জাম্পগুলোর মধ্যবর্তী অবস্থান প্লট করে করে এগোনোর পদ্ধতিতে।

    ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মতো। এবলিং মিস টোরানের হিসাবগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখে, বেইটা বিভিন্ন পদ্ধতিতে একটা সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এমনকি ম্যাগনিফিসোকেও একটা কাজ দেওয়া হল। মেসিন থেকে শুধু হিসাবগুলো বের করা, একবার বুঝিয়ে দেওয়ার পরই প্রচুর আনন্দ পেল কাজটাতে এবং নিজের দক্ষতা প্রমাণ করল বিস্ময়করভাবে।

    ফলে এক মাসের ভেতর বেইটা শিখল কীভাবে গ্যালাকটিক লেন্সের কেন্দ্র থেকে অর্ধেক দূরে শিপের ত্রিমাত্রিক মডেলের সাহায্যে চলার পথের উত্তপ্ত লাল রেখাটাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, এবং বিদ্রুপারক সুরে বলতে পারে, ‘জানো জিনিসটা দেখতে কেমন? একটা দশ পাওয়ালা কেচোর মতো, যেন বদহজমের রোগে ধরেছে কেচোটাকে। আসলে তুমি আমাদেরকে আবার হেভেনেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”

    “নিয়ে যাব” হাতের চার্টে একটা জোরালো ঘুসি মেরে গজ গজ করল ট্র্যাভিজ “তুমি মুখ বন্ধ না করলে সেটাই করতে হবে।”

    “এবং,” বলে চলেছে বেইটা, “সম্ভবত দ্রাঘিমাংশের ঠিক মাঝ দিয়ে সোজা এগোলে একটা পথ পাওয়া যাবে।”

    “তাই, বোকা, আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে ওভাবে পথ বের করতে হলে পাঁচ শ শিপের পাঁচ শ বছর লাগবে। তা ছাড়া সোজা রাস্তাগুলো এড়িয়ে চলাই উচিত ওই পথে সম্ভবত শত্রুপক্ষের শিপ গিজ গিজ করছে। তা ছাড়া-”।

    “ওহ, গ্যালাক্সি, কচি খোকার মতো ভয় দেখানো বন্ধ করো।” খপ করে টোরানের চুল টেনে ধরল সে।”

    “আউচ! ছাড়ো!” আর্তনাদ করে উঠলো টোরান, তারপর বেইটার কবজিতে টান মেরে দুজনেই পড়ে গেল মেঝেতে, সেখানে বেইটা টোরান আর চেয়ার গুলো মিলে একটা জট পাকানো অবস্থা সৃষ্টি করেছে। যেন রুদ্ধশ্বাস কোনো রেসলিং ম্যাচ চলছে, যাতে কুস্তির কোনো চিহ্ন নেই, আছে শুধু খিলখিল হাসি আর হাত পায়ের দাপাদাপি।

    হন্তদন্ত হয়ে ম্যাগনিফিসে ঢোকার পর নিজেকে আলাদা করে নিল টোরান।

    “কী ব্যাপার?”

    উদ্বেগে ক্লাউনের মুখের প্রতিটি রেখা টান টান। বিশাল নাকের ডগাটা সাদা হয়ে গেছে। “যন্ত্রগুলো কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে, স্যার। আমি কিছু জানি না বলে কোনোটাতে হাত দিইনি-”

    দুই সেকেন্ডের ভেতর পাইলট রুমে হাজির হল টোরান। শান্ত সুরে ম্যাগনিফিসোকে নির্দেশ দিল, “এবলিং মিস কে ঘুম থেকে উঠাও। এখানে আসতে বল।”

    বেইটা আঙুল চালিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করার চেষ্টা করছে। তাকে বলল টোরান, “আমরা ধরা পড়ে গেছি, বে?”

    “ধরা পড়ে গেছি?” হাত দুটো দুপাশে ঝুলে পড়ল শিথিলভাবে। “কার কাছে?”

    “গ্যালাক্সি জানে”, বিড়বিড় করল টোরান, “তবে আমার ধারণা ওদের কাছে ব্লাস্টার আছে এবং সেটা চালাতে জানে।”

    চেয়ারে বসে এরই মধ্যে সে শিপ এর আইডেন্টিফিকেশন সাব-ইথারে পাঠানো শুরু করেছে।

    যখন একটা বাথ রোব গায়ে চাপিয়ে ঘুম জড়ানো চোখে এবলিং মিস প্রবেশ করল, অতিরিক্ত শান্ত গলায় তাকে বলল টোরান, “মনে হচ্ছে ফিলিয়া নামক কোনো এক স্বাধীন রাজ্যের সিমান্তে ঢুকে পড়েছি।”

    “কখনো নাম শুনিনি,” কাটাকাটা গলায় বলল মিস।

    “আমি ও না,” জবাব দিল টোরান, “কিন্তু একটা ফিলিয়ান শিপ আমাদের থামিয়েছে, কেন, আমি জানি না।”

    ফিলিয়ান শিপ এর ক্যাপ্টেন ইন্সপেক্টরের সাথে এল ছয় জন সশস্ত্র সৈনিক। লোকটা বেটে, পাতলা চুল, পাতলা ঠোঁট। চামড়া খসখসে। চেয়ারে বসে হাতের ফোলিও খুলে সাদা একটা পৃষ্ঠা বের করার আগে কাশল কর্কশভাবে।

    “আপনাদের পাসপোর্ট এবং শিপ আইডেন্টিফিকেশন, প্লিজ।”

    “নেই।” জবাব দিল টোরান।

    “নেই?” বেল্ট থেকে মাইক্রোফোন খুলে কথা বলল দ্রুত, “তিন জন পুরুষ, একজন মহিলা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই।” সেইসাথে নোট লিখল খোলা পৃষ্ঠায়।

    “কোত্থেকে এসেছেন?” পরবর্তী প্রশ্ন।

    “কোথায় সেটা?”

    “ত্রিশ হাজার পারসেক, ট্রানটরের আশি ডিগ্রি পশ্চিমে। চল্লিশ ডিগ্রি-”

    “নেভার মাইণ্ড, নেভার মাইণ্ড!” টোরান দেখল তার প্রশ্নকারী লিখছে পয়েন্ট অফ অরিজিন-পেরিফেরি।

    “কোথায় যাচ্ছেন?” প্রশ্ন করা থামায়নি ফিলিয়ান।

    “ট্রানটর সেক্টর।”

    “উদ্দেশ্য?”

    “আনন্দ ভ্রমণ।”

    “কার্গো?”

    “নেই।”

    “হুম্‌-ম্‌-ম্‌। ঠিক আছে, চেক করতে হবে।” মাথা নাড়তেই সশস্ত্র দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল কাজে। বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টা করল না টোরান।

    “ফিলিয়ান টেরিটোরিতে কেন এসেছেন?” ফিলিয়ানের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের কোনো ছোঁয়া নেই।

    “কোথায় এসেছি জানতাম না। ভালো চার্ট নেই আমাদের কাছে।”

    “না থাকার জন্য একশ ক্রেডিট জরিমানা-সেই সাথে অন্যান্য ফী দিতে হবে।”

    আবার মাইক্রোফোনে কথা বলল-তবে বলার চেয়ে শুনল বেশি। তারপর টোরানকে জিজ্ঞেস করল, “নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সম্বন্ধে কিছু জানেন?”

    “সামান্য,” সতর্কভাবে জবাব দিল টোরান।

    “তাই? পেরিফেরির লোকদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম আছে। একটা স্যুট পরে আমার সাথে আসুন।”

    সামনে বাড়ল বেইটা। “ওকে নিয়ে কী করবেন আপনারা?”

    হালকা টানে তাকে সরিয়ে আনল টোরান, ঠাণ্ডা সুরে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় যেতে হবে?”

    “আমাদের পাওয়ার প্ল্যান্টের সামান্য মেরামতের প্রয়োজন। ও যাবে আপনার সাথে।” লোকটা আঙুল তুলল সরাসরি ম্যাগনিফিসোর দিকে, আর আতঙ্কে ছানা বড়া হয়ে উঠল ম্যাগনিফিগোর চোখ।

    “ও গিয়ে কী করবে?” আক্রমণের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল টোরান।

    শীতল দৃষ্টি তুলে তাকাল অফিসার। “এই অঞ্চলে দস্যুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কুখ্যাত দস্যুর চেহারার বর্ণনা আছে আমাদের কাছে। শুধু একটু মিলিয়ে দেখা আর কিছু না।”

    ইতস্তত করছে টোরান, কিন্তু ছয়টা ব্লাস্টারের বিরুদ্ধে তর্ক করার কিছু নেই। কাপবোর্ডের দিকে হাত বাড়াল স্যুট বের করার জন্য।

    এক ঘণ্টা পর, ফিলিয়ান শিপে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল টোরান “মোটরের কোনো সমস্যা আমার চোখে পড়ছে না। বাসবার, এলটিউব, সব ঠিক মতো কাজ করছে। এখানের ইনচার্জ কে?”।

    “আমি,” শান্তভাবে জবাব দিল হেড ইঞ্জিনিয়ার।

    “আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান-”

    পথ দেখিয়ে তাকে অফিসারস লেভেলে নিয়ে আসা হল। ছোট এন্টি রুমে একজন মাত্র কেরানি বসে আছে।

    “আমার সাথে যে লোক এসেছিল, সে কোথায়?”

    “একটু অপেক্ষা করুণ,” জবাব দিল কেরানি।

    ম্যাগনিফিসোকে নিয়ে আসা হল ঠিক পনের মিনিট পর।

    “ওরা তোমাকে কী করেছে?” দ্রুত জিজ্ঞেস করলো টোরান।

    “কিছু না। কিছু না।” না বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো।

    দুই শ পঞ্চাশ ক্রেডিট দিয়ে ফিলিয়ানদের দাবি মেটানো হল-তারমধ্যে পঞ্চাশ ক্রেডিট দ্রুত ছাড়া পাওয়ার জন্য এবং আবার তারা বেরিয়ে এল মুক্ত মহাকাশে।

    ওরা ফেরার পর জোর করে একটু হাসল বেইটা, আর দাঁত বের করা হাসি দিয়ে টোরান বলল, “ওটা ফিলিয়ান শিপ না-আরও কিছুক্ষণ নড়ছি না এখান থেকে। এদিকে এসো।”

    ওর চারপাশে সবাই ভিড় জমাল।

    “ওটা ফাউণ্ডেশন শিপ আর লোকগুলো মিউলের চামচা।”

    হাত থেকে পড়ে যাওয়া সিগারটা তুলে এবলিং বলল, “এখানে? আমরা ফাউণ্ডেশন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার পারসেক দূরে।”

    “এবং আমরা এখানে এসেছি। ওদের আসতে বাধা কোথায়। গ্যালাক্সি, এবলিং আপনার ধারণা একটা শিপ দেখলে আমি চিনতে পারব না। আমি বলছি ওটা ফাউণ্ডেশন শিপ, ফাউণ্ডেশন ইঞ্জিন।”

    “ওরা এখানেই কীভাবে আসল?” যুক্তিবোধ জাগিয়ে তোলার সুরে জিজ্ঞেস করল বেইটা। মহাকাশে দুটো নির্দিষ্ট শিপের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?”

    “ওসব ভেবে কী হবে?” গরম হয়ে উঠল টোরান। “পরিষ্কার বোঝা যায় আমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে।”

    “অনুসরণ?” অবজ্ঞার সুরে জিজ্ঞেস করল বেইটা। “হাইপার স্পেসের মধ্য দিয়ে?”

    ক্লান্তভাবে বাধা দিল এবলিং মিস, “সম্ভব-দক্ষ একজন পাইলটের হাতে খুব ভালো একটা শিপ থাকলে সম্ভব। কিন্তু সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।”

    “আমি তো ট্রেইল লুকানোর কোনো চেষ্টা করিনি।” বুঝানোর সুরে বলল টোরান। “টেক অফ করে একেবারে সোজা পথে এগিয়েছি। একটা অন্ধও আমাদের যাত্রা পথ হিসাব করে নিতে পারবে।”

    “চলার পথের অল্প কয়েকটা চিহ্ন সে ধরতে পারবে।” চেঁচিয়ে বলল বেইটা। “যেরকম উদ্ভটভাবে তুমি জাম্প করেছ, তাতে প্রাথমিক গন্তব্য পর্যবেক্ষণ করে কিছুই বোঝা যাবে না। একাধিকবার জাম্প শেষে ভুল জায়গায় বেরিয়ে এসেছি।”

    “সময় নষ্ট হচ্ছে,” দাঁতে দাঁত চেপে বলল টোরান। “ওটা মিউলের দখল করা ফাউণ্ডেশন শিপ। আমাদের সার্চ করেছে। ম্যাগনিফিসোকে নিয়ে আমার কাছ থেকে আলাদা রেখেছে। তোমাদের সন্দেহ হলেও যেন কিছু করতে না পারো জিম্মি হিসেবে নিয়ে গেছে আমাকে। আর এই মুহূর্তে আমরা ওটাকে মহাকাশেই জ্বালিয়ে দিতে যাচ্ছি।”

    “দাঁড়াও, দাঁড়াও” হাত টেনে ধরে তাকে থামাল মিস। “তোমার ধারণা ওটা শত্রুদের শিপ। আর শুধু মনে করেই তুমি আমাদের সবার মরার ব্যবস্থা করবে? থিংক, ম্যান, ওই মরামাসগুলো বিপদসংকুল গ্যালাক্সির অসম্ভব পথ পাড়ি দিয়ে এতদূর এসেছে শুধু আমাদের চেহারা দেখে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।”

    “হয়তো আমরা কোথায় যাই সেটা জানার প্রতিই ওদের আগ্রহ।”

    “তা হলে আমাদের থামালো কেন, কেন মনের ভেতর সন্দেহ ঢুকিয়ে দিল? তুমি এভাবে দুপথেই চলতে পারো না।”

    “আমি আমার পথেই চলব। ছাড়ন, এবলিং, অন্যথায় আপনাকে আমার আঘাত করতে হবে।”

    উঁচু আসন বিশিষ্ট প্রিয় চেয়ারে বসা অবস্থাতেই সামনে ঝুকল ম্যাগনিফিসো উত্তেজনায় তার লম্বা নাক লাল হয়ে আছে। “কথার মাঝখানে কথা বলার জন্য ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার ছোট মনে হঠাৎ করেই এক অস্বাভাবিক ভাবনার উদয় হয়েছে।”

    টোরানের বিরক্তি বুঝতে পেরেই বেইটা এবলিং এর সাথে যোগ দিল তাকে শক্ত করে ধরে রাখার কাজে। “বলো, ম্যাগনিফিসো। আমরা সবাই তোমার কথা শুনছি।”

    “ওদের শিপ এ থাকার সময় গোলকধাঁধার মতো বিভ্রান্তিকর কোনো ঘটনায় মানুষ যেমন জড়পদার্থের মতো হতবুদ্ধি হয়ে যায় আমিও ভয়ে তেমনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। আসলে কী ঘটেছে পুরোপুরি মনে নেই আমার। অনেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কথা বলছিল। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শেষে-যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে একটুকরো রোদ এসে পড়ল-একটা মুখ আমি চিনতে পারলাম। মাত্র এক নজর, ক্ষণিকের জন্য-অথচ পুরো স্মৃতি এখনো আমার মনে জ্বলজ্বল করছে।”

    “কে সে?” জিজ্ঞেস করল টোরান।

    “ঐ সেই ক্যাপ্টেন, অনেকদিন আগে যে আমাদের সাথে ছিল, যখন আপনি আমাকে প্রথম বিপদ থেকে রক্ষা করেন।”

    নিঃসন্দেহে ম্যাগনিফিসোর উদ্দেশ্য ছিল সবার ভেতরে চাঞ্চল্য তৈরি করা এবং লমুখের বাঁকানো হাসিতে পরিষ্কার বোঝা গেল সে সফল হয়েছে।

    “ক্যাপ্টেন…হ্যান…প্রিচার?” কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল মিস। “তুমি নিশ্চিত, কোনো ভুল হয়নি?”

    “স্যার, আমি কসম খেয়ে বলছি,” এবং একটা কঙ্কালসার হাত রাখল পাতলা বুকের উপর। “এই সত্যি কথাটা আমি মিউলের সামনেও এমনভাবে কসম খেয়ে বলতে পারবো যে সে তার সমস্ত ক্ষমতা দিয়েও সেটা অস্বীকার করতে পারবে না।”

    বেইটার মুখে নিখাদ বিস্ময়, তা হলে এত সবকিছু কেন ঘটছে?”

    অধীর আগ্রহ নিয়ে তার মুখোমুখি হল ক্লাউন, “মাই লেডি, আমার একটা ধারণা আছে। ধারণাটা আমার মাথায় এসেছে একেবারে তৈরি অবস্থায়, যেন গ্যালাকটিক স্পিরিট সেটা আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।” টোরানের তারস্বর প্রতিবাদ ছাপিয়ে তাকে কথা বলতে হচ্ছে উচ্চস্বরে।

    “মাই লেডি,” সে শুধু মাত্র বেইটাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে, “যদি এই ক্যাপ্টেনের আমাদের মতোই নিজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে; হঠাৎ করে আমাদের মুখোমুখি হয়ে সেও ভাবতে পারে যে আমরা তাকে অনুসরণ করছি। ছোট্ট যে প্রহসনটা সে করল তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?”

    “তা হলে তার শিপে আমাদের নিয়ে গেল কেন?” জিজ্ঞেস করল টোরান। “ওটার কোনো অর্থ নেই।”

    “কেন, অবশ্যই আছে,” প্রচণ্ড উৎসাহে উঁচু গলায় বলল ক্লাউন। “সে পাঠিয়েছে তার অধীনস্থদের যারা আমাদের চেনে না কিন্তু মাইক্রোফোনে আমাদের বর্ণনা দিয়েছে। যে ক্যাপ্টেন এসেছিল। সে আমার কিম্ভুত কিমাকার চেহারা দেখে অবাক হয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই-কারণ, এই বিশাল গ্যালাক্সিতে আমার চেহারার সাথে মিলবে এমন লোক বলতে গেলে নেই। আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে আমি ছিলাম প্রমাণ।”

    “আর তাই সে আমাদের ছেড়ে দিল?”।

    “ওর উদ্দেশ্য কি, সেটা কতখানি গোপনীয়, আমরা জানি? সে শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে আমরা শত্রু নই। সেটা হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার মিশনেরই ক্ষতি হবে।”

    “গোয়ার্তুমি করো না, টোরি। ওর কথায় ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।” ধীরগলায় বলল বেইটা।

    “এরকমটা হতে পারে,” একমত হল মিস।

    সবার সম্মিলিত বিরোধীতার মুখে নিজেকে অসহায় মনে হল টোরানের। ক্লাউনের ব্যাখ্যায় কিছু একটা আছে যা তাকে খোঁচাচ্ছে। কোথাও একটা গলদ আছে। একটু বিভ্রান্ত এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও দমে এল ভেতরের রাগ।

    “মুহূর্তের জন্য, ফিস ফিস করল সে, “আমার মনে হয়েছিল মিউলের একটা শিপ আমরা পেয়েছি।”

    এবং মাতৃভূমি হেভেনের অপমানে বিশ্ন হয়ে উঠল তার চোখ দুটো।

    বাকিরা সেটা ধরতে পারল।

    *

    নিওট্রানটর…ডেলিকাস এর ছোট্ট গ্রহ, মহাবিপর্যয়ের পর নতুনভাবে নামকরণ করা হয়, প্রায় এক শতাব্দী এটা ছিল ফার্স্ট এম্পায়ার এর সর্বশেষ রাজবংশের কেন্দ্রবিন্দু। এটা ছিল এক অপরিচিত অখ্যাত বিশ্ব এবং অখ্যাত সাম্রাজ্য এবং তার অস্তিত্ব ছিল কয়েকটা আইনের বলে। প্রথম নিওট্রানটোরিয়ান রাজ বংশের অধীনে…

    এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা—

    *

    ২২. নিও ট্রানটরে মরণ থাবা

    নাম নিওট্রানটর! নিওট্র্যানটর! এবং মাত্র এক নজরেই মহা গৌরবান্বিত আসল ট্র্যানটরের সাথে নতুনটার পার্থক্য পরিষ্কার ধরা পড়বে। মাত্র দুই পারসেক দূরে এখনো জ্বলছে পুরোনো ট্রানটরের সূর্য এবং বিগত শতাব্দীর গ্যালাক্সির ইম্পেরিয়াল ক্যাপিটাল এখনো মহাকাশ ভেদ করে নিজ কক্ষপথে নিঃশব্দে তার অনন্ত ঘূর্ণন অব্যাহত রেখেছে।

    পুরোনো ট্রানটরে মানুষ বাস করে এখনো। খুব বেশি না-এক শ মিলিওন সম্ভবত, যেখানে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেই চল্লিশ বিলিওন মানব সন্তানের কোলাহলে মুখর ছিল এই গ্রহ। পুরো গ্রহটাকে ছাদের মতো ঢেকে রাখা ধাতব আবরণের ভিত্তি হিসেবে বহুতল ভবনগুলো এখন ছিন্নভিন্ন ফাঁকা-এখনো ব্লাস্টারের আঘাতে তৈরি হওয়া গর্ত আর পোড়া দাগ চোখে পড়ে-চল্লিশ বছর আগের মহাবিপর্যয়ের নিদর্শন।

    সত্যি অদ্ভুত যে, যে বিশ্ব নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দুই হাজার বছর ছিল গ্যালাক্সির কেন্দ্রবিন্দু-শাসন করেছে সীমাহীন মহাকাশ, ছিল এমন সব শাসক আর আইন প্রণেতার বাসস্থান যাদের অদ্ভুত খেয়ালের মূল্য দিতে হত বহু পারসেক দূরের মানুষকেও-তা মাত্র একমাসের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। সত্যি অদ্ভুত যে, যে বিশ্ব প্রায় এক সহস্রাব্দ আগ্রাসী দখলদারদের হাত থেকে বেঁচে যায় এবং আরো এক সহস্রাব্দ অবিরাম বিদ্রোহ আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায়-শেষ পর্যন্ত ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। সত্যি অদ্ভুত যে, গ্যালাক্সির গৌরব এভাবে পচা শবদেহে পরিণত হবে।

    এবং মর্মান্তিক

    মানুষের পঞ্চাশটা প্রজন্মের এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ পুরোপুরি ক্ষয় হতে আরো এক শতাব্দী লাগবে। শুধু ক্ষমতাহীন কিছু মানুষ সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ফেলে রেখেছে।

    বিলিওন বিলিওন মানুষের মৃত্যুর পর যে কয়েক মিলিওন মানুষ বেঁচে থাকে তারা গ্রহের ধাতব আবরণ সরিয়ে উন্মুক্ত করে মাটি, যে মাটির বুকে বহু সহস্র বছর পৌঁছেনি সূর্যের আলো।

    মানব জাতির অসীম প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা যান্ত্রিক উৎকর্ষতা, প্রকৃতির খামখেয়াল থেকে মুক্ত অতি উন্নত শিল্পায়নের মাঝে আবদ্ধ উন্মুক্ত এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এখন জন্মায় গম আর অন্যান্য শস্য। সুউচ্চ টাওয়ারগুলোর ছায়ায় চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল।

    কিন্তু নিওট্রানটর ছিল-মহান ট্রানটরের ছায়ায় বেড়ে উঠা অখ্যাত এক সুশীতল গ্রাম্য গ্রহ, অন্তত মহাবিপর্যয়ের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা থেকে পালিয়ে একটা রাজ পরিবার সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত এবং পৌঁছেই সব রকম প্রতিরোধ এবং বিদ্রোহ তারা দমন করে শক্ত হাতে, নিষ্ঠুর গর্বে। সেখানে তারা এক আবছায়া গৌরবের মহিমা বুকে আঁকড়ে রেখে ইম্পেরিয়াল এর শেষ টুকরো হিসেবে বিবর্ণ শাসন চালাতে থাকে।

    বিশটা কৃষিভিত্তিক বিশ্ব মিলে তৈরি হয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার।

    ড্যাগোবার্ট নবম, বিশটা বিশ্বের অবাধ্য জমিদার এবং গোমড়ামুখো কৃষকদের হর্তাকর্তা বিধাতা, গ্যালাক্সির সম্রাট, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স।

    সেই রক্ত ঝরানো দিনে নিজের পিতৃদেবের সাথে যখন এখানে আসে তখন ড্যাগোবার্ট নবম পঁচিশ বছরের এক টগবগে তরুণ, স্মৃতিতে তখনো এম্পায়ারের অসীম গৌরব আর মহিমা জাজ্বল্যমান। কিন্তু তার পুত্র, যে হয়তো একদিন হবে ড্যাগোবার্ট দশম জন্মেছে এই নিওট্রানটরে।

    জর্ড কোম্যাসনের উন্মুক্ত এয়ার কার এই শ্রেণীর বাহন হিসেবে নিওট্রানটরে প্রথম এবং সর্বশেষ। কোম্যাসন নিওট্র্যানটরের সবচেয়ে বড় ভূ-স্বামী, ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। বরং শুরু। কারণ প্রথমে সে ছিল মধ্য বয়সী সম্রাটের শাসনের বেড়াজালে আটকে থাকা তরুণ ক্রাউন প্রিন্স এর সহচর এবং কুমন্ত্রণা দাতা। এখন সে মধ্যবয়সী ক্রাউন প্রিন্স-যে বর্তমানে সম্রাটকে শাসন করে-তার সহচর এবং কুমন্ত্রনা দাতা।

    জর্ড কোম্যাসনের এয়ার কার বহুমূল্য রত্ন খচিত, সোনার গিল্টি করা, মালিকের পরিচয় আর আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এয়ারকারে বসে সে পর্যবেক্ষণ করছে সামনের বিস্তীর্ণ ভূমি যার সবটাই তার, মাইলের পর মাইল ছড়ানো গমের ক্ষেত যার সবটাই তার, বড় বড় মাড়াইকল এবং ফসল কাটার যন্ত্র যার সবগুলোই তার, কৃষক এবং যন্ত্রপাতির চালক যাদের সবাই তার-এবং সতর্কতার সাথে নিজের সমস্যা বিবেচনা করল।

    পাশেই তার একান্ত অনুগত বাধ্য শোফার। শিপটাকে মসৃনভাবে বাতাসের উপর ভাসিয়ে রেখেছে আর হাসছে মৃদু মৃদু।

    এয়ার কার, বাতাস এবং আকাশকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল জর্ড কোম্যাসন, “আমি কী বলেছি তোমার মনে আছে, ইচনী?”

    ইচনীর পাতলা বাদামি চুল প্রবল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। চিকন ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ফোকলা দাঁতে এমনভাবে হাসলো যেন মহাবিশ্বের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে নিজের কাছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে তার কথাগুলো বেরিয়ে এল।

    “মনে আছে, সায়ার, এবং আমি অনেক ভেবেছি।”

    “ভেবে কী বের করলে, ইচনী?” প্রশ্নের ভেতর একটা অধৈর্যের ছাপ। ইচনীর মনে পড়ল যে একসময় সে ছিল তরুণ, সুদর্শন, পুরোনো ট্র্যানটরের একজন লর্ভ। নিওট্রানটরে সে অসহায় বৃদ্ধ, বেঁচে আছে শুধুমাত্র জমিদার জর্ড কোম্যাসনের দয়ায়। মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

    পুনরায় ফিসফিস করে বলল, “ফাউণ্ডেশন থেকে যারা আসছে, সায়ার, ওদেরকে হাতে রাখা খুব সহজ। আসছে মাত্র একটা শিপ নিয়ে, লড়াই করার মতো আছে মাত্র একজন। ভাবছি কীভাবে ওদের স্বাগত জানানো যায়।”

    “স্বাগত?” হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বলল কোম্যাসন। “হয়তো। কিন্তু ওই লোকগুলো জাদুকর এবং সম্ভবত ক্ষমতাবান।”

    “ফুহ্। দূরত্বের কারণেই আসলে রহস্য তৈরি হয়েছে। ফাউণ্ডেশন একটা বিশ্ব ছাড়া আর কিছু না। নাগরিকরা শুধুই সাধারণ মানুষ। আপনি গুলি করলে ওরা মরে যাবে।”

    শিপটাকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনলো ইচনী । নিচে একটা নদীর পানি চিকচিক করছে। “আর সবাই একটা লোকের কথা বলছে যে পেরিফেরির বিশ্বগুলোকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে, তাই না?”

    হঠাৎ একটা সন্দেহ দানা বাঁধল কোম্যাসনের মনে, “এ ব্যাপারে কী জানো তুমি?”

    শোফারের মুখের হাসি মুছে গেছে। “কিছুই না, সায়ার। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”

    জমিদারের ইতস্তত ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। কঠিন গলায় বলল, “কোনো কিছুই তুমি এমনি এমনি জিজ্ঞেস করো না, আর খবর সংগ্রহ করার তোমার যে পদ্ধতি সেটার কারণেই তোমার ঘাড় এখনো জায়গামতো আছে। যাই হোক-ওটা যখন তখন কেটে নেওয়া যাবে। এই লোকটা যার কথা শোনা যাচ্ছে-তার নাম মিউল। এক মাস আগে ওর এক প্রতিনিধি এসেছিল…জরুরি কাজে। আমি আরেকজনের অপেক্ষা করছি…এখন…কাজটা শেষ করার জন্য।”

    “আর এই আগন্তক? সম্ভবত ওদেরকে আপনি আশা করেননি?”

    “যে আইডেন্টিফিকেশন থাকার কথা ওদের তা নেই।”

    “শোনা যাচ্ছে যে ফাউণ্ডেশন-এর পতন হয়েছে।”

    “আমি তোমাকে এটা জানাইনি।”

    “শোনা যাচ্ছে,” শীতল গলায় বলল ইচনী, “আর কথাটা যদি সত্যি হয় তা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ফাউণ্ডেশনারদের আটক করে মিউলের লোকদের জন্য অপেক্ষা করা যায়।”

    “তাই?” কোম্যাসন কিছুটা দ্বিধান্বিত।

    “আর, সায়ার, এটা জানা কথা যে, একজন কনকোয়ারার এর বন্ধু হচ্ছে সর্বশেষ শিকার। এটা হচ্ছে আররক্ষার উপায়। যেহেতু সাইকিক প্রোব নামে একটা জিনিস আছে, আর আমরা চারটা ফাউণ্ডেশন মস্তিষ্ক পেতে যাচ্ছি। ফাউণ্ডেশন সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জানা যাবে, এমনকি মিউলের ব্যাপারেও। তখন আর মিউল আমাদের উপর ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারবে না।”

    উপরের শান্ত নীরবতায় একটু ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের প্রথম চিন্তায় ফিরে এল কোম্যাসন। “কিন্তু যদি ফাউণ্ডেশন-এর পতন না ঘটে। কথাটা যদি মিথ্যে হয়। ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে ওরা কখনো পরাজিত হবে না।”

    “সায়ার, সেইসব যুগ আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি যখন আশার বাণী শুনিয়ে মানুষকে শান্ত রাখা হতো।”

    “তারপরেও যদি পতন না ঘটে। চিন্তা করে দেখো! যদি পতন না ঘটে। মিউল অবশ্য আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে-” বেশি কথা বলা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মুখের লাগাম টেনে ধরল সে। “সবই দম্ভোক্তি। কিন্তু দম্ভোক্তি হচ্ছে বাতাস আর একটা চুক্তি হল শক্ত পাথরের মতো।”

    নিঃশব্দে হাসল ইচনী। “অবশ্যই চুক্তি শক্ত পাথরের মতো, তবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত। গ্যালাক্সির শেষ মাথায় ফাউণ্ডেশন-এর চাইতে ভয়ের আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।

    “প্রিন্স ঝামেলা করবে,” নিজের মনেই বিড়বিড় করল কোম্যাসন।

    “সেও তা হলে মিউলের সাথে যোগাযোগ করেছে?”

    নিজের আরতৃপ্তির অভিব্যক্তি গোপন রাখতে পারল না কোম্যাসন। “আমি যেভাবে করেছি ঠিক সেভাবে যোগাযোগ করতে পারেনি। কিন্তু আজকাল খুব বেশি অস্থির। সামলানো কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। যেন শয়তান ভর করেছে। আমি যদি লোকগুলোকে আটক করি আর সে নিজের উদ্দেশ্যে তাদেরকে ছিনিয়ে নেবে-কারণ ওর সূক্ষ্ম বুদ্ধির বড় অভাব। আমি এখন ওর সাথে বিবাদে জড়াতে চাই না।” ভুরু কুঁচকালো বিরক্তিতে।

    “আগন্তুকদের গতকাল এক নজর দেখেছিলাম। মেয়েটা অদ্ভুত। পুরুষদের মতোই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। মাথাভর্তি কালো চুল, ফর্সা চামড়া।” শোফারের কণ্ঠে এমন একটা উষ্ণতা যে বিস্মিত হয়ে তাকাতে বাধ্য হল কোম্যাসন।

    “বাকি সবাইকে আপনি নিজের কাছে রাখতে পারবেন, যদি মেয়েটাকে প্রিন্সের হাতে তুলে দেন।”

    কোম্যাসনের মুখের অভিব্যক্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “দারুণ বুদ্ধি! সত্যিই দারুণ! গাড়ি ঘোরাও। আর ইচনী সব কিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলে আমরা তোমার মুক্তির ব্যাপারে আরো কথা বলব।”

    অনেকটা নিজের কুসংস্কারকে আরো দৃঢ় করার জন্যই যেন ফিরে এসে কোম্যাসন দেখতে পেল তার জন্য একটা পারসোন্যাল ক্যাপসুল অপেক্ষা করছে। ক্যাপসুলটা এমন ওয়েভলেংথে এসেছে যা খুব অল্প কয়েকজনই জানে। চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল কোম্যাসনের মুখে। মিউলের প্রতিনিধি আসছে এবং ফাউণ্ডেশন-এর পতন হয়েছে সত্যি সত্যি।

    .

    ইম্পেরিয়াল প্যালেস সম্বন্ধে বেইটার যে ধারণা ছিল তার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই, এবং সে খানিকটা হলেও হতাশ। কামরাটা ছোট, অতি সাধারণ এবং প্রায় নিরাভরণ। ফাউণ্ডেশনে মেয়রের বাসস্থানের তুলনায় এই প্রাসাদ কুঁড়েঘরের মতো।

    একজন সম্রাট দেখতে কেমন হবে সেই সম্বন্ধে বেইটার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই তাকে দেখাবে না কারো বুড়ো দাদুর মতো। নিশ্চয়ই তিনি হবেন না দুর্বল, অসমর্থ, ফ্যাকাশে বৃদ্ধ- অথবা নিজের হাতে চা পরিবেশন করবেন না এবং অতিথির আরাম আয়েশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না।

    কিন্তু হচ্ছে ঠিক তাই।

    ড্যাগোবার্ট নবম পেয়ালাগুলো শক্ত করে ধরে চা ঢালার সময় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন।

    “আমার বেশ ভালো লাগছে, মাই ডিয়ার। এই সময়টা আমি দরবারের আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত থাকতে পারি। বহুদিন আমার আউটার প্রভিন্স থেকে আসা সাক্ষাৎ প্রার্থীদের খেদমত করার সুযোগ পাই না। আমার পুত্র এখন বিষয়গুলো দেখাশোনা করে। কারণ আমার বয়স হয়েছে। আমার পুত্রের সাথে তোমাদের পরিচয় হয়নি? চমৎকার ছেলে। শুধু মাথা গরম, তবে ওটা বয়সের দোষ। স্বাদবর্ধক ক্যাপসুল লাগবে কারো? না?”

    কথার তোড় থামানোর চেষ্টা করল টোরান, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি”

    “বলো?”

    “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি, অনাহুত ভাবে আপনাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্য। আমাদের ছিল না।”

    “মূর্খ, বিরক্ত করার কিছু নেই। আজকে রাতে অফিসিয়াল রিসিপশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার আগে পুরো সময়টা আমাদের। তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো? বহুদিন অফিসিয়াল রিসিপশনের ব্যবস্থা হয় না। তুমি বলেছিলে তোমরা অ্যানাক্রন প্রদেশ থেকে এসেছে।”

    “ফাউণ্ডেশন থেকে, ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি!”

    “হ্যাঁ, ফাউণ্ডেশন। মনে পড়েছে। চিনতে পেরেছি। অ্যানাক্রন প্রদেশে অবস্থিত। ওখানে কখনো যাইনি। চিকিৎসক আমাকে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছে। অ্যানাক্রনের ভাইসরয় এর কাছ থেকে সম্প্রতি কোনো রিপোর্ট পেয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। ওখানকার অবস্থা কেমন?” উদ্বিগ্নভাবে শেষ করলেন তিনি।

    “সায়ার,” বিড়বিড় করল টোরান, “আমরা কোনো অভিযোগ নিয়ে আসিনি।”

    “খুশির কথা। আমার ভাইসরয়ের প্রশংসা করতে হবে।”

    অসহায় ভঙ্গিতে মিস এর দিকে তাকাল টোরান, আর মিস এর ভারী গলা গমগম করে উঠল কামরার ভেতর, “সায়ার, আমাদের বলা হয়েছে যে ট্রানটরের ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে যেতে হলে আপনার অনুমতি লাগবে।”

    “ট্রানটর?” হালকা গলায় প্রশ্ন করলেন সম্রাট ‘ট্রানটর?”

    তারপর বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল তার মুখ। “ট্রানটর?” ফিসফিস করলেন তিনি। “এখন মনে পড়েছে। আমি ওখানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি, পিছনে থাকবে ঝাঁকে ঝাকে শিপ, তোমরা আমার সাথে যাবে। আমরা সবাই মিলে বিদ্রোহী গিলমারকে পরাজিত করব। আমরা সবাই মিলে আবার গড়ে তুলব এম্পায়ার।”

    তার পেছন দিকে হেলানো মাথা সোজা হল, কণ্ঠে ভর করল তারুণ্যের সজীবতা, দৃষ্টিতে কাঠিণ্য। তারপর আবার নেতিয়ে পড়লেন, দুর্বল গলায় বললেন, “কিন্তু গিলমার মারা গেছে, বোধহয় মনে পড়ছে আমার-হ্যাঁ। হা! গিলমার মৃত! ধ্বংস হয়ে গেছে ট্রানটর-মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল-তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো?”

    বেইটার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল ম্যাগনিফিসো, “উনি কী আসলেই সম্রাট। আমার ধারণা ছিল সত্যিকারের সম্রাট হবেন সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জ্ঞানী।”

    ইশারায় তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দিল বেইটা। তারপর বলল, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি যদি আমাদের ট্র্যানটরে যাওয়ার একটা অনুমতি পত্রে সই করে দেন তা হলে সবারই লাভ হবে।”

    “ট্রানটরে?” সম্রাটের অভিব্যক্তি আবারো নির্বোধ জড়বুদ্ধির পাগলের মতো।

    “সায়ার, অ্যানাক্রনের ভাইসরয় আপনাকে জানাতে বলেছে যে, গিলমার এখনো বেঁচে আছে।”

    “বেঁচে আছে, বেঁচে আছে!” বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠলেন ড্যাগোবার্ট। কোথায়? আবার যুদ্ধ হবে!”

    “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি, সেটা এখনো জানা যায়নি। ভাইসরয় শুধু ব্যাপারটা আপনার নজরে দিতে বলেছে, এবং একমাত্র ট্রানটরে যেতে পারলেই তাকে খুঁজে বের করা যাবে এবং একবার বের করতে পারলেই-”

    “হ্যাঁ হ্যাঁ-অবশ্যই বের করতে হবে- বৃদ্ধ সম্রাট স্খলিত পদক্ষেপে দেয়ালের কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা আঙুলে ছোট ফটোসেলটা স্পর্শ করলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ফিস ফিস করে বললেন, “আমার চাকর বাকররা আসেনি। ওদের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।”

    একটা সাদা কাগজে আঁকাবাঁকা করে কিছু লিখলেন তিনি, শেষ করলেন উজ্জ্বল “ডি” দিয়ে। “গিলমার এবার বুঝবে তার সম্রাটের ক্ষমতা কতখানি। তোমরা যেন কোত্থেকে এসেছো? অ্যানাক্ৰণ? কী অবস্থা ওখানে? এখনো কী ম্রাটের নাম ওখানে যথেষ্ট শক্তিশালী?”

    শিথিল আঙুল থেকে নির্দেশপত্রটা নিল বেইটা, “ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টিকে জনগণ জান দিয়ে ভালবাসে। জনগণের প্রতি আপনার ভালবাসা সর্বজনবিদিত।”

    “অ্যানাক্রনে আমার এই জনগণদের একবার দেখতে যাবো। কিন্তু চিকিৎসক বলেছে… কী বলেছে আমার মনে নেই, কিন্তু চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, “তোমরা কী গিলমারের ব্যাপারে কিছু বলছিলে?”

    “জি না, ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি।”

    “ওকে আর এগোতে দেওয়া যাবে না। যাও তোমার লোকদের গিয়ে বলল ট্র্যানটর প্রতিরোধ করবে। ফ্লিটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমার পিতা এবং নর্দমার কীট বিদ্রোহী গিলমারকে মহাকাশেই তার বিদ্রোহ সমেত নিকেশ করা হবে।”

    টলমল পায়ে হেঁটে গিয়ে তিনি একটা চেয়ারে বসলেন, চোখে আবারো সেই বোধবুদ্ধিহীন জড় দৃষ্টি। “কী বলছিলাম যেন?”

    দাঁড়িয়ে মাথা সামান্য নিচু করে কুর্নিশ করল টোরান। ইওর ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির অনেক দয়া। কিন্তু সাক্ষাতের জন্য আমাদের যে সময় বেধে দেওয়া হয়েছিল তা শেষ হয়েছে।

    যখন ড্যাগোবার্ট দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন তখন তাকে মনে হল সত্যি সত্যি সম্রাট, আর সাক্ষাৎপ্রার্থীরা পিছিয়ে একে একে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

    –বেরোতোই বিশজন সশস্ত্র লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলল। একজনের হাতে ছোট একটা অস্ত্র শোভা পাচ্ছে।

    ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেল বেইটা, কিন্তু আমি কোথায়? এই অনুভূতি ছাড়াই। বৃদ্ধ সম্রাট, বাইরের অস্ত্রধারী লোকগুলো-সব তার পরিষ্কার মনে আছে। আঙুলের জোড়াগুলোর শিরশিরানি ভাব থেকে বুঝতে পারছে স্টান্ট পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে।

    চোখ বন্ধ রেখেই সে দুটো কণ্ঠস্বরের প্রতি মনযোগ দিল।

    দুটো কণ্ঠস্বরের একটা ধীর স্থির সতর্ক, কিছুটা কৌতুকপূর্ণ। অন্যটা চিকন, কর্কশ এবং অনেকটা চটচটে তরল পদার্থ নির্গত হওয়ার মতো করে সবেগে ছুটে বেরোচ্ছে। চিকন কণ্ঠস্বরটাই কর্তৃত্বপূর্ণ।

    শেষ কথাগুলো শুনতে পেলো বেইটা, “বুড়ো পাগলটা মরবে না। আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে, আর ধৈর্য রাখতে পারছি না, কোম্যাসন। আমাকে পেতেই হবে। আমার ও তো বয়স হচ্ছে।”

    “ইওর হাইনেস, প্রথমেই দেখতে হবে এই লোকগুলোর কাছ থেকে আমরা কী উপকার পেতে পারি। হয়তো আপনার বাবার কাছে এই মুহূর্তে যত ক্ষমতা আছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা আমাদেরকে পাইয়ে দিতে পারে।”

    চিকন কণ্ঠস্বরটা ফিসফিসানিতে পরিণত হল, শুধু একটা শব্দ শুনতে পেল বেইটা, “-মেয়েটা-” কিন্তু অন্য কণ্ঠস্বরটা নিচু হলেও শোনা যাচ্ছে। তোষামোদ করছে, “ড্যাগোবার্ট, আপনার বয়স হয়নি। যারা বলে আপনার বয়স বিশের বেশি তারা মিথ্যে কথা বলে।”

    দুজন হেসে উঠল এক সাথে। আর বেইটার রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে। ড্যাগোবার্ট-ইওর হাইনেস-বৃদ্ধ সম্রাট তার মাথা গরম ছেলের কথা বলেছিলেন, এবং ওদের ফিসফিসানির অর্থ এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কিন্তু মানুষের বাস্তব জীবনে এমন ঘটনা ঘটে না-

    টোরানের গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলল সে। টোরানের মুখ ঝুঁকে ছিল তার উপর। চোখ খুলতে দেখে সেই মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। হিংস্র স্বরে বলল টোরান, “সম্রাটের কাছে এই হঠকারিতার জবাব দিতে হবে। ছেড়ে দাও আমাদের।”

    চিকন কণ্ঠস্বর এগোল টোরানের দিকে। লোকটা চর্বি সর্বস্ব, নিচের চোখের পাপড়ি গভীরভাবে পাফ করা, মাথার চুল ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। টুপিতে একটা ধূসর পালক, এবং পোশাকের প্রান্তগুলোতে রুপোলী ধাতব স্পঞ্জের নকশা করা।

    ভীষণ আমোদে নাক কুঁচকালো সে। “সম্রাট? পাগল সম্রাট?”

    “তার নির্দেশ পত্র আছে আমার কাছে। কেউ আমাদের আটকে রাখতে পারবে না।”

    “কিন্তু আমি সাধারণ কেউ না। আমি রিজেন্ট এবং ক্রাউন প্রিন্স, এবং সেভাবেই সম্বোধন করবে। আমার বাবা মাঝে মাঝে দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিয়ে আনন্দ পান। আমরা ওটা নিয়ে অনেক রসিকতা করি। এ ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্ব নেই।”

    এবার দাঁড়াল বেইটার সামনে। তার নিশ্বাসে তীব্র ঝাঝালো গন্ধ পেল বেইটা।

    “ওর চোখ দুটো খুব সুন্দর, কোম্যাসন-বাইরে নিয়ে গেলে আরো ভালো লাগবে। আমার মনে হয় চলবে। সুস্বাদু খাবারের চমৎকার এক ডিশ, কী বলো?”

    নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করে উঠল টোরান। পাত্তা দিল না ক্রাউন প্রিন্স আর বেইটা টের পেল তার চামড়ার উপরে কেমন ঠাণ্ডা প্রবাহিত হচ্ছে। এবলিং মিস এখনো অচেতন, মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের উপর। কিন্তু এই বিপদের মাঝে একটা জিনিস খেয়াল করে অবাক হল বেইটা। ম্যাগনিফিসোর চোখ দুটো খোলা, দৃষ্টি ধারালো, যেন জেগে আছে অনেকক্ষণ থেকেই। তাকাল বেইটার দিকে।

    মাথা নেড়ে ক্রাউন প্রিন্সকে দেখিয়ে করুণ সুরে বলল, “ও আমার ভিজি-সোনার নিয়ে গেছে।”

    ঝট করে নতুন কণ্ঠের দিকে ঘুরল প্রিন্স, “এটা তোর, রাক্ষসের বাচ্চা।” কাঁধে ঝোলানো বাদ্যযন্ত্রটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল। অদক্ষভাবে আঙুল চালিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করছে, “তুই এটা বাজাতে পারিস, রাক্ষস?”

    মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো।

    “আপনি ফাউণ্ডেশন-এর একটা শিপ দখল করেছেন, হঠাৎ বলল টোরান। সম্রাট কোনো ব্যবস্থা না করলেও ফাউণ্ডেশন ঠিকই ব্যবস্থা করবে।”

    ধীরস্থিরভাবে জবাব দিল কোম্যাসন, “কিসের ফাউণ্ডেশন? মিউল কী মরে গেছে?”

    কোনো জবাব নেই। হাসির সাথে প্রিন্স এর অসমান দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ক্লাউনের বাঁধন খুলে, টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হল ভিজি-সোনার।

    “বাজা রাক্ষস” আদেশ দিল প্রিন্স। “এই বিদেশী মহিলার সম্মানে একটা প্রেমের সঙ্গীত বাজা। ওকে বলে দে, যে আমার বাবার জেলখানাটা কোনো প্রাসাদ না, কিন্তু সে চাইলে তাকে আমি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারি যেখানে প্রতিদিন সাঁতার কাটবে গোলাপজলে-এবং বুঝতে পারবে একজন প্রিন্স এর ভালবাসা কী জিনিস।”

    একটা মার্বেল পাথরের টেবিলে বসে অলসভাবে পা দোলাতে লাগল প্রিন্স। ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে টোরান নিজের কষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলল। জ্ঞান ফিরে এসেছে এবলিং মিস এর। চোখ খুলে গোঙাচ্ছে।

    ঢোক গিলল ম্যাগনিফিসো, “আমার আঙুল নাড়াতে পারছি না-”

    “বাজা রাক্ষস!” ধমকে উঠল প্রিন্স, নির্দেশ পেয়ে আলো কমিয়ে দিল কোম্যাসন, তারপর বুকের উপর হাত বেধে অপেক্ষা করতে লাগল।

    বাদ্যযন্ত্রের উপর ম্যাগনিফিসোর আঙুল নেচে বেড়াতে শুরু করল, দ্রুত নাচের ছন্দে-একটা তীক্ষ্ণ, ধারালো রং ধনু তৈরি হল কামরার ভেতর। একটা নিচু লয়ের সুর ধ্বনি বাজতে লাগল-দম বন্ধ করা, গা শিউরে উঠা। সুরটা চড়া হতে হতে পরিণত হল বিষণ্ণ হাসিতে, এবং তার সাথে শোনা যাচ্ছে একরকম নীরস ঘণ্টাধ্বনি।

    ধীরে ধীরে পাতলা হতে লাগলো অন্ধকার। ভাঁজ করা অনেকগুলো অদৃশ্য কম্বলের মাঝ দিয়ে সঙ্গীতের শব্দ বেইটার কানে পৌঁছল। আলোর দীপ্তি দেখে মনে হল কোনো গর্তের মাথায় মাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে।

    আপনা আপনিই চোখ দুটো টান টান করল বেইটা। আলো বাড়লে ও সবকিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে থাকল। অলসভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে চোখ ধাঁধানো সব রঙে এবং হঠাৎ করেই সঙ্গীতটা খসখসে হয়ে উঠল-ক্রমশ চড়া হচ্ছে। অশুভ সুর । মূৰ্ছনার তালে তালে আলোটা দ্রুত কমছে বাড়ছে। যেন বিষাক্ত কোনো কিছু ব্যথায় মোচড়াচ্ছে, চিৎকার করছে।

    একটা অদ্ভুত আবেগের সাথে লড়াই করে হাঁপিয়ে গেল বেইটা। টাইম ভল্ট এবং হেভেনে শেষ দিনে যে রকম অনুভূতি হয়েছিল, ঠিক একই অনুভূতি। সেই ভয়ংকর, বিরক্তি কর, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো চরম হতাশা। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে এই হতাশায় ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে।

    তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেলো সঙ্গীত। মাত্র পনের মিনিট স্থায়ী হয়েছে। থেমে যাওয়াতে আনন্দের এক আরামদায়ক প্রবাহ বয়ে গেল তার শরীরে। আলো জ্বলে উঠার পর দেখল তার মুখের কাছে ম্যাগনিফিসোর মুখ।

    “মাই লেডি, আপনি কেমন আছেন?”

    “ভালো, তুমি এই ধরনের বাজনা বাজালে কেন?”

    কামরার অন্যদের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল সে। টোরান আর মিস অসহায় ভাবে আটকে আছে দেয়ালের সাথে। কিন্তু এই দুজনকে ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে গেল আরো সামনে। টেবিলের পায়ের কাছে এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছে প্রিন্স। কোম্যাসন মুখ হাঁ করে বন্য উন্মাদের মতো আর্তনাদ করছে।

    ম্যাগনিফিসো তার দিকে এক পা এগোতেই কুঁকড়ে গেল কোম্যাসন, চেঁচিয়ে উঠল পাগলের মতো। ফিরে এসে অন্যদের বাধন খুলে দিল ম্যাগনিফিসো। ভূ স্বামীর ঘাড় ধরে তাকে টেনে তুলল টোরান। “তুমি আমাদের সাথে যাবে-যেন শিপে ফিরতে কোনো সমস্যা না হয়।”

    দুই ঘণ্টা পর, শিপের কিচেনে ম্যাগনিফিসের সামনে ঘরে তৈরি বিশাল এক পাই এনে রাখল বেইটা, আর ম্যাগনিফিসো মহাকাশে ফিরে আসা উদযাপন করার জন্য ভদ্রতার ধার না ধেরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার উপর।

    “ভালো হয়েছে, ম্যাগনিফিসো?”

    “উম্-ম্‌-ম্‌-ম্‌!”

    “ম্যাগনিফিসো?”

    “জি, মাই লেডি?”

    “ওখানে তুমি কী বাজিয়েছিলে?”

    গুঙিয়ে উঠল ক্লাউন, “আপনার…আপনার না শোনাই ভালো। অনেকদিন আগে শিখেছিলাম, আর নার্ভাস সিস্টেমের উপর ভিজি সোনার নিখুঁতভাবে কাজ করে। খারাপ জিনিস সন্দেহ নেই। এবং অবশ্যই আপনার মতো নিষ্পাপ মানুষের জন্য না।”

    “ওহ, ম্যাগনিফিসো, তোষামোদ করো না। তুমি যতটা ভাবছ আমি ততো নিষ্পাপ না। ওরা যা দেখেছে আমিও কী তাই দেখেছি।”

    “বোধ হয় না। বাজিয়েছি শুধু মাত্র ওদের জন্য। আপনি যদি কিছু দেখে থাকেন দেখেছেন শেষ প্রান্তগুলো-অনেক দূর থেকে।”

    “সেটাই যথেষ্ট। তুমি জানো ম্যাগনিফিসো, প্রিন্সকে তুমি একেবারে নক আউট করে দিয়েছ?”

    বড় একটুকরো পাই মুখে দিয়ে হাসিমুখে বলল ম্যাগনিফিসো, “আমি ওকে মেরে ফেলেছি, মাই লেডি।”

    “কি?” বিষম খেলো বেইটা।

    “যখন থামাই তখনই সে মরে গেছে, নইলে বাজিয়েই যেতাম। কোম্যাসনকে নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ওর সবচেয়ে বড় ভয় ছিল মৃত্যু অথবা নির্যাতন। কিন্তু, মাই লেডি, এই প্রিন্স আপনার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, আর-” ক্রুদ্ধ এবং বিব্রত ভাব দিয়ে চুপ করল সে।

    একটা অদ্ভুত চিন্তা গ্রাস করল বেইটাকে, কিন্তু জোড় করে সেটা তাড়িয়ে দিল। “ম্যাগনিফিসো, তোমার অনেক সাহস।”

    “ওহ, মাই লেডি।” লজ্জায় পাইয়ের ভেতর লাল হয়ে উঠা নাক ডোবালো সে।

    এবলিং মিস পোর্ট হোলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। ট্রানটরের অনেক কাছে চলে এসেছে ওরা-গ্রহটার চকচকে ধাতব আবরণ ভীষণ রকম উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। টোরান পাশেই দাঁড়ানো।

    খানিকটা তিক্ততা মিশ্রিত সুরে বলল সে, “আমরা খামোখাই এসেছি, এবলিং। মিউল আমাদের চাইতে এগিয়ে আছে।”

    কপাল ঘষল এবলিং মিস। তার মোটা শরীর অনেক শুকিয়ে গেছে। আপন মনেই বিড় বিড় করল।

    বিরক্ত হল টোরান। “আমি বলছি ওই লোকগুলো জানে ফাউণ্ডেশন-এর পতন ঘটেছে। আমি বলছি-”

    “অ্যাঁ?” তাকাল মিস, কিংকর্তব্যবিমুঢ়, তারপর আলতোভাবে টোরানের কব্জি ধরল, একটু আগের আলোচনার ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন, “টোরান…আমি ট্র্যানটরের দিকে তাকিয়েছিলাম। তুমি জানো…কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি…নিওট্রানটরে আসার পর থেকেই। কেমন যেন এক ধরনের ব্যাকুলতা ভেতর থেকে আমাকে ঠেলছে, চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টোরান, আমি পারব, আমি জানি আমি পারব। আমার মনে এখন সবকিছুই পরিষ্কার-আগে কখনো এত পরিষ্কার ছিল না।”

    টোরান শ্রাগ করল, কথাগুলো তার আরবিশ্বাস বাড়াতে পারেনি।

    “মিস?”

    “বলো?”

    “নিওট্রানটর থেকে বেরুনোর সময় ওদের কোনো শিপ পিছু নিতে দেখেছেন?”

    ভাবতে হল না বেশিক্ষণ, “না।”

    “আমি দেখেছি। হয়তো কল্পনা, কিন্তু মনে হল যেন ওটা সেই ফিলিয়ান শিপ।”

    “ক্যাপ্টেন প্রিচার যেটাতে ছিল?”

    “স্পেস জানে কে ছিল। ম্যাগনিফিসো কী দেখেছে সেই জানে-কিন্তু ওটা আমাদের অনুসরণ করে এখানে এসেছে, মিস।”

    এবলিং মিস নীরব।

    কঠিন গলায় বলল টোরান, “কী হয়েছে আপনার, অসুস্থ?”

    মিস এর দৃষ্টি চিন্তামগ্ন উজ্জ্বল, অস্বাভাবিক। কোনো জবাব দিল না সে।

    *

    ২৩. ট্রানটরের ধ্বংসস্তূপ

    ট্রানটরের বুকে কোনো বস্তুর অবস্থান খুঁজে বের করায় যে সমস্যা গ্যালাক্সির অন্য কোনোখানে সেই সমস্যা হয় না। হাজার মাইল দূর থেকে অবস্থান চিহ্নিত করার মতো কোনো মহাদেশ বা মহাসাগর নেই। মেঘের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ার মতো কোনো নদী, হ্রদ বা দ্বীপ নেই।

    ধাতু-আচ্ছাদিত-বিশ্ব ছিল- এখনো আছে। পুরোটাই একটা শহর। আউটার স্পেস থেকে বহিরাগতরা শুধুমাত্র ইম্পেরিয়াল প্যালেস চিনতে পারত অনায়াসে। অবতরণের একটা জায়গা খুঁজে বের করার জন্য বেইটা প্রায় এয়ার কারের উচ্চতায় পুরো গ্রহটা বারবার চক্কর দিচ্ছে।

    মেরু অঞ্চলে ধাতব গম্বুজগুলোর উপরে বরফের প্রলেপ দেখে বোঝা যায় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক যন্ত্রগুলো পুরোপুরি নষ্ট বা সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কারো মনোযোগ নেই। সেদিক থেকে ওরা এগোল দক্ষিণ দিকে। মাঝে মাঝে চোখে যা পড়ছে নিওট্রানটর থেকে সংগ্রহ করা অপর্যাপ্ত মানচিত্রের সাথে তা মিলিয়ে নিচ্ছে বা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

    কিন্তু জায়গাটা চোখে পড়ার পর আর কোনো সংশয় থাকল না। গ্রহের ধাতব আবরণের মাঝে পঞ্চাশ মাইলের মতো উন্মুক্ত প্রান্তর। একশ বর্গমাইলেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত অস্বাভাবিক সবুজ উদ্ভিদের সমারোহ, প্রাচীন ইম্পেরিয়াল বাসস্থানগুলোকে ঘিরে রেখেছে।

    পাখির মতো বাতাসে ভেসে থাকল বেইটা, ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান নির্ণয় করল। পথ দেখানোর জন্য আছে শুধু বিশাল বিশাল কতগুলো প্রশস্ত পায়ে চলা সড়ক। মানচিত্রে সেগুলোকে দেখানো হয়েছে লম্বা তীরচিহ্ন সংবলিত কতগুলো উজ্জ্বল ফিতার মতো।

    মানচিত্রের যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় দেখানো হয়েছে সেখানে অনুমান করেই পৌঁছতে হবে। সমতল জায়গাটা নিশ্চয়ই এক সময় ছিল কোনো ল্যাণ্ডিং ফিল্ড। ওটার উপরে পৌঁছে ধীরে ধীরে অবতরণ করতে লাগল বেইটা।

    মনে হল যেন এক বিশৃঙ্খল ধাতুর সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে তারা। আকাশ থেকে দেখা মসৃণ সৌন্দর্য এখন পরিণত হয়েছে ভাঙা, তোবড়ানো ধ্বংসস্তূপে। গম্বুজগুলোর অগ্রভাগ কেটে কে যেন ছোট করে দিয়েছে, মসৃণ দেয়ালগুলো বাঁকা হয়ে আছে গেটে বাগ্রস্ত রোগীর মতন, এবং মাত্র এক ঝলকের জন্য উন্মুক্ত মাটি চোখে পড়ল- সম্ভবত কয়েকশ একর হবে-চাষ করা হয়েছে সেখানে।

    .

    শিপটা যখন সর্তকভাবে অবতরণ করছে লী স্যান্তার তখন অপেক্ষায় ছিল। অদ্ভুত শিপ, নিওট্রানটর থেকে আসেনি, এবং ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অদ্ভুত শিপ এবং আউটার স্পেস এর লোকগুলোর সাথে লেনদেনের অর্থ স্বল্পস্থায়ী শান্তির দিন শেষ, আবার সেই যুদ্ধ এবং রক্তপাত পূর্ণ দিনগুলোর ফিরে আসার সম্ভাবনা। স্যান্তার ছিল গ্রুপ লিডার; প্রাচীন বইগুলো ছিল তার দায়িত্বে আর পুরোনো দিনের কথা সে বইয়ে পড়েছে। ওই দিনগুলো ফিরে আসুক সে চায় না।

    শিপ সমতলে নামতে আরো দশ মিনিট। কিন্তু এর মাঝেই পুরোনো স্মৃতিগুলো সব ভিড় জমালো। মনে পড়ল শৈশবের সেই বিশাল ফার্মের কথা কিন্তু তার স্মৃতি বলতে শুধু ব্যস্তপায়ে মানুষের ছুটোছুটি। তারপর তরুণ পরিবারগুলো নতুন মাটির সন্ধানে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া শুরু করে। সে তখন দশ বছরের বালক; একমাত্র সন্তান, ভীত, বিহ্বল।

    নতুন করে সব শুরু করতে হয়; বিরাট আকৃতির ধাতব স্ল্যাবগুলো সরিয়ে উন্মুক্ত মাটিতে নিড়ানি দেওয়া হয়; আশপাশের ভবনগুলো ভেঙে সমান করে দেওয়া হয় মাটির সাথে; বাকিগুলো রেখে দেওয়া হয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহারের জন্য। শুরু হয় চাষাবাদের কাজ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা হয় প্রতিবেশী ফার্মগুলোর সাথে ।

    ক্রমেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই সাথে বৃদ্ধি পায় আরশাসনের প্রয়োজনীয়তা। মাটির বুকে জন্ম নেওয়া একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠে কঠিন পরিশ্রমী মনোবল নিয়ে। ঐ দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন যেদিন তাকে গ্রুপ লিডার নির্বাচিত করা হয়।

    আর এখন গ্যালাক্সি হয়তো অনাহুতভাবে তাদের একাকী শান্তি ভঙ্গ করবে।

    শিপ অবতরণ করছে। নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে সে। পোর্টের দরজা খুলে বেরিয়ে এল চারজন, সতর্ক। তিনজন পুরুষ, তরুণ, বৃদ্ধ এবং, হালকা পাতলা একজন। এবং একজন নারী এমনভাবে পাশাপাশি হাঁটছে যেন সেও পুরুষদের সমকক্ষ। হাত থেকে দুটো চকচকে দাড়ির চুল ফেলে সামনে বাড়ল স্যান্তার।

    মহাজাগতিক সংকেত অনুযায়ী শান্তির চিহ্ন দেখাল সে। হাত দুটো সামনে। পরিশ্রমে শক্ত হয়ে যাওয়া তালু দুটো উপরে তোলা।

    তরুণ লোকটা সামনে এগিয়ে এসে তার ভঙ্গি অনুকরণ করল। “শান্তি।”

    অদ্ভুত উচ্চারণ, কিন্তু শব্দগুলো বোঝা যায়। প্রতি উত্তরে সে বলল, “শান্তি। আমাদের দল আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আপনারা ক্ষুধার্ত? খাবার পাবেন। তৃষ্ণার্ত? পানীয় পাবেন।”

    জবাব এল বেশ ধীরে ধীরে, “অসংখ্য ধন্যবাদ। নিজেদের বিশ্বে ফিরে আপনাদের এই আতিথেয়তার কথা আমরা সবাইকে বলতে পারব।”

    আজব উত্তর, কিন্তু চমৎকার। তার পিছনে গ্রুপের অন্যরা হাসছে। বাড়ির আড়াল থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসতে লাগল।

    নিজের কোয়ার্টারে এসে স্যান্তার গোপন জায়গা থেকে একটা চমৎকার বাক্স বের করে অতিথিদের প্রত্যেককে একটা করে লম্বা পেট মোটা সিগার দিল । মেয়েটার সামনে এসে ইতস্তত করল খানিকক্ষণ। পুরুষদের সাথে একই সারিতে বসেছে মেয়েটা। হয়তো আগন্তকদের সমাজে এটা স্বীকৃত।

    হাসিমুখে একটা সিগার নিল মেয়েটা, ধরিয়ে সুগন্ধি ধোয়া ছাড়ল। বিরক্তি গোপন করল লী স্যান্তার।

    খানাপিনার সময় তাদের আলোচনা মোড় নিল ট্র্যানটরের কৃষিকাজের দিকে।

    বৃদ্ধ একজন জিজ্ঞেস করল, “হাইড্রোফোনিক্স হলে কেমন হয়? আমার ধারণা ট্রানটরের মতো বিশ্বে হাইড্রোফোনিক্স একমাত্র সমাধান।”

    মাথা নাড়ল স্যান্তার। অনিশ্চিত বোধ করছে। বই পড়া জ্ঞানের সাথে বিষয়টা মেলাতে পারছে না সে। “কেমিক্যালের সাহায্যে কৃত্রিম চাষাবাদ? না, ট্র্যানটরে হবে না। শিল্পোন্নত গ্রহে হাইড্রোফোনিক্স প্রয়োজন হয়-যেমন, অনেক বড় কোনো কেমিক্যাল ইণ্ডাস্ট্রিজ, কিন্তু যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের সময় ইন্ডাস্ট্রিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্য সংকট তৈরি হয়। চাহিদা অনুযায়ী সব খাবার কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করা সম্ভব না। অনেক সময় খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। মাটিই অনেক ভালো-সবসময় নির্ভর করা যায়।”

    “আপনাদের খাদ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত?”

    “পর্যাপ্ত; হয়তো বৈচিত্র্যহীন। গৃহপালিত পশু পাখি থেকে আমরা ডিম এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যগুলো পাই-কিন্তু মাংসের সরবরাহ মূলত নির্ভর করে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর।”

    “বাণিজ্য,” তরুণ সম্ভবত আগ্রহী হল খানিকটা। “আপনারা তা হলে বাণিজ্য করেন। কিন্তু কী রপ্তানি করেন?”

    “ধাতু” কাঠখোট্টা জবাব। “আপনি নিজেই দেখছেন ধাতুর কোনো কমতি নেই। একেবারে পরিশোধিত অবস্থায় আছে সব। নিওট্রানটর থেকে ওরা শিপ নিয়ে আসে, আমাদের দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে ধাতু তুলে নিয়ে যায়-এভাবে আমাদের চাষের জমির পরিমাণ বাড়ছে-বিনিময়ে আমরা পাই মাংস, টিনজাত ফল, ফুড কনসেনট্রেট, খামারের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। সবাই লাভবান।”

    খাবারের তালিকায় ছিল রুটি, পনির এবং অত্যন্ত চমৎকার স্বাদের ভেজিটেবল সুপ। আমদানি করা একমাত্র খাবার ছিল হিমায়িত ফলের ডেজার্ট। সেটা খাওয়ার সময়ই নিজেদের আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল অতিথিরা। তরুণ ট্র্যানটরের একটা মানচিত্র বের করল। শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করল স্যান্তার, শুনল মনোযোগ দিয়ে, বলল গম্ভীর গলায়। “ইউনিভার্সিটি গ্রাউণ্ড পবিত্র স্থান। আমরা কৃষকরা সেখানে চাষাবাদ করি না। নিজের ইচ্ছায় কখনো সেখানে যাই না। আমাদের আরেক সময়ের কয়েকটা নিদর্শনের মধ্যে এটা একটা এবং যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই রাখতে চাই।”

    “আমরা জ্ঞানের অন্বেষণকারী। কোনো কিছু নষ্ট করব না। আমাদের শিপ আপনারা জিম্মি হিসেবে রাখতে পারেন।” প্রবল আগ্রহের সাথে প্রস্তাব দিল বৃদ্ধ।

    “তাহলে আমি আপনাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি।” বলল স্যান্তার

    সেই রাতে আগন্তকরা ঘুমানোর পর নিওট্রানটরে একটা মেসেজ পাঠালো লী স্যান্তার।

    *

    ২৪. কনভার্ট

    ওরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ভবনগুলোতে ঢুকল তখন ট্রানটরের বিরল জনজীবনে কোনো ছেদ পড়ল না। পরিবেশটা গম্ভীর এবং নিঃসঙ্গ নীরবতায় পূর্ণ।

    ফাউণ্ডেশনের আগন্তকরা জানে না কীভাবে মহাবিপর্যয়ের রক্ত ঝরানো দিন এবং রাতগুলো পাড়ি দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় অক্ষত থেকেছে। জানে না কীভাবে যখন এমনকি ইম্পেরিয়াল ক্ষমতা পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থী ধার করা অস্ত্র এবং অনভিজ্ঞ সাহসিকতা নিয়ে গ্যালাক্সির তাবৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের সংরক্ষক এই পুণ্য স্থানকে রক্ষা করার জন্য একটা প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখার জন্য সাতদিনব্যাপী যুদ্ধ এবং একটা যুদ্ধবিরতির চুক্তির কথা তারা জানে না যখন এমনকি ইম্পেরিয়াল প্রাসাদ পর্যন্ত গিলমার এবং তার সৈনিকদের পদভারে মুখরিত ছিল।

    ফাউণ্ডেশনার, যারা প্রথমবার এখানে এসেছে তাদের মনে হল যে, যে বিশ্ব চাকচিক্যময় অতীত থেকে কঠিন এক নতুন বিশ্বে পরিণত হচ্ছে তার মাঝে এই জায়গা শান্ত, গৌরবময় অতীতের চমৎকার নিদর্শন।

    একদিক থেকে তারা অনুপ্রবেশকারী। বিষণ্ণ নীরবতা তাদেরকে প্রতাখ্যান করল। মনে হল একাডেমিক অ্যাটমোস্ফিয়ার এখনো টিকে আছে এবং তারা এসে বিরক্ত করায় যেন তাকিয়ে আছে রাগত চোখে।

    লাইব্রেরি ভবনটা ছোট, অবাক হতে পারে অনেকেই। কিন্তু আসলে এটা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এবং এর নৈঃশব্দ তুলনাহীন। রিসেপসন রুমের দেয়াল চিত্রগুলোর সামনে থামল এবলিং মিস।

    কথা বলল ফিসফিস করে এখানে ফিসফিস করে কথা বলাই নিয়ম : “আমার মনে হয় ক্যাটালগ রুম পিছনে ফেলে এসেছি। এখান থেকেই আমাকে শুরু করতে হবে।”

    তার কপালে এক ধরনের তেলতেলে ভাব, হাত কাঁপছে, “আমাকে বিরক্ত করা যাবে না, টোরান। আমার খাবার তুমি নিচে দিয়ে যেতে পারবে?”

    “আপনি যেভাবে বলবেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করব। আপনি চাইলে আমরা আপনার অধীনে-”

    “না, আমাকে একা থাকতে হবে।”

    “আপনার ধারণা আপনি যা চাইছেন সেটা পাবেন।

    এবং মৃদু আরবিশ্বাসী গলায় জবাব দিল এবলিং মিস, “আমি জানি আমি পারব!”

    টোরান এবং বেইটা এই প্রথমবারের মতো বিবাহিত জীবনের কয়েক বছরের মধ্যে পুরোপুরি স্বাভাবিক সংসার শুরু করতে পারল। অদ্ভুত ধরনের সংসার। রাজকীয় পরিবেশে তারা অস্বাভাবিক সাধারণ জীবনযাপন করছে। খাবার সংগ্রহ করছে প্রধানত লি স্যান্তারের ফার্ম থেকে বিনিময়ে তারা দেয় ছোট ছোট নিউক্লিয়ার গ্যাজেট, যা যে-কোনো ট্রেড শিপেই পাওয়া যায়।

    ম্যাগনিফিসো কীভাবে যেন লাইব্রেরির প্রজেক্টর ব্যবহার করা শিখে নিয়েছে এবং এবলিং মিস এর মতোই নাওয়া খাওয়া ভুলে অ্যাডভেঞ্চার বা রোমান্টিক গল্প কাহিনীতে ডুবে থাকছে।

    নিজেকে পুরোপুরি কবর দিয়ে রাখল এবলিং। সাইকোলজি রেফারেন্স রুমে একটা দোল খাঁটিয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ওজন কমছে দ্রুত, গায়ের রং বদলে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। তার কর্কশ কথোপকথন আর প্রিয় অভিশাপ বাক্যগুলো হালকা মৃত্যুবরণ করেছে। অনেক সময়তো টোরান বা বেইটাকে চিনতেও কষ্ট হয়।

    পুরোপুরি সে নিজের ভেতরে মগ্ন। ম্যাগনিফিসো খাবার নিয়ে এসে প্রায়ই অদ্ভুত মুগ্ধ মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখে বৃদ্ধ সাইকোলজিস্ট একটার পর একটা সমীকরণ রূপান্তর করে যাচ্ছে। অসংখ্য বুক ফিল্ম ঘেটে তথ্য সংগ্রহ করছে, সীমাহীন মানসিক শ্রম ব্যয় করে কোন গন্তব্যে পৌঁছতে চাইছে শুধু সেই জানে।

    অন্ধকার কামরায় ঢুকে তীক্ষ্ণ গলায় ডাকল টোরান, “বেইটা!”

    একটা অপরাধবোধের কাটা খচ করে বিধল বেইটার মনে। “হ্যাঁ? তুমি আমাকে চাও, টোরি?”

    “অবশ্যই আমি তোমাকে চাই। স্পেস, অন্ধকারে বসে কী করছ তুমি। ট্রানটরে আসার পর থেকেই তোমার আচরণ বদলে গেছে। কী হয়েছে?”

    “ওহ্, টোরি, থামো,” ক্লান্ত গলায় বলল সে।

    “ওহ টোরি থামো,” অধৈর্য ভঙ্গিতে মুখ ভেংচালো টোরান। তারপর হঠাৎ কোমল গলায় বলল, “আমাকে বলবে না কী হয়েছে, বে? কিছু একটা তোমাকে বিরক্ত করছে।”

    “না! কিছু না, টোরি। তুমি যদি অনবরত এরকম খুঁত খুঁত করো, আমি পাগল হয়ে যাবো। আমি শুধু-ভাবছি।”

    “কী ভাবছো?”

    “কিছুই না। ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভাবছি মিউলের কথা, হেভেন, ফাউণ্ডেশন এবং সবকিছু। ভাবছি এবলিং মিস এর কথা, সেকি সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন খুঁজে বের করতে পারবে, পারলেও কী উপকার হবে-এরকম হাজার হাজার বিষয়। খুশি?” তার কণ্ঠস্বর উত্তেজিত।

    “শুধু চিন্তাভাবনা হলে থামিয়ে দাও। ওতে কোনো ফায়দা হবে না। তুমি কী পরিস্থিতি পাল্টাতে পারবে?”

    উঠে দাঁড়িয়ে দুর্বলভাবে হাসল বেইটা। “ঠিক আছে। আমি খুশি। এই দেখো কেমন সুন্দর করে হাসছি।”

    বাইরে ম্যাগনিফিসোর উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল, “মাই লেডি-”

    “কী ব্যাপার? এসো-”

    দরজার সামনে বিশালদেহী, কঠিন মুখের লোকটাকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেলো বেইটার

    “প্রিচার,” আর্তনাদ করল টোরান। শ্বাসরুদ্ধ গলায় বেইটা বলল, “ক্যাপ্টেন! আমাদের কীভাবে খুঁজে বের করলেন?”

    পা বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকল হ্যান প্রিচার। তার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার, সমতল এবং অনুভূতি শূন্য, “আমার র‍্যাঙ্ক এখন কর্নেল-মিউলের অধীনে।”

    “মিউলের…অধীনে!” ধীরে ধীরে টোরানের কণ্ঠস্বর নির্জীব হয়ে পড়ল। তিনজনে মিলে একটা অদ্ভুত নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ম্যাগনিফিসে গিয়ে লুকালো টোরানের পিছনে, বাধা দিল না কেউ।

    হাত দুটো পরস্পরের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল বেইটা, তারপরেও কাঁপুনি থামল না। “আপনি আমাদের গ্রেপ্তার করবেন? সত্যি সত্যি ওই পক্ষে যোগ দিয়েছেন?”

    দ্রুত জবাব দিল কর্নেল “আমি আপনাদের গ্রেপ্তার করতে আসিনি। আপনাদের সাথে দেখা করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি আমাকে। আমি শুধু এসেছি পুরোনো বন্ধুত্ব ঝালাই করতে। অবশ্য আপনারা যদি সুযোগ দেন।”

    রাগে টোরানের মুখের কাঠামো বদলে গেছে, “আমাদের কীভাবে খুঁজে পেলেন? ওই ফিলিয়ান শিপে ছিলেন তা হলে? অনুসরণ করে এসেছেন?”

    প্রিচারের কাঠের পুতুলের মতো মুখে হয়তো কিছুটা বিব্রত ভাব, “আমি ফিলিয়ান শিপে ছিলাম! আসলে আপনাদের সাথে আমার দেখা… অনেকটা… দৈবক্রমে।”

    “এটা এমন এক দৈবঘটনা গাণিতিকভাবে যা অসম্ভব।”

    “না, শুধু অভাবনীয়। কাজেই আমার বক্তব্য মেনে নেওয়া যায়। যাই হোক, ফিলিয়ানদের কাছে আপনি স্বীকার করেছিলেন-নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ফিলিয়া নামে কোনো জাতি নেই আসলে-যে আপনারা ট্র্যানটরে আসবেন। যেহেতু মিউল এরই মধ্যে নিওট্রানটরের সাথে যোগাযোগ করেছে, আপনাদের ওখানে আটক করা সহজ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি পৌঁছানোর আগেই চলে আসেন। তবে বেশিক্ষণ আগে না। ট্রানটরের ফার্ম মালিকদের সতর্ক করার মতো যথেষ্ট সময় ছিল। তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যেন আপনাদের পৌঁছানোর খবর আমাকে জানায়। সেই খবর পেয়েই এসেছি। বসতে পারি? আমি বন্ধু হিসেবেই এসেছি, বিশ্বাস করুন।”

    বসল সে। মাথা নিচু করে ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে টোরান। বেইটা চা তৈরিতে ব্যস্ত।

    ঝট করে মাথা তুলল টোরান, “বেশ অপেক্ষা করছেন কেন-কর্নেল? কী রকম বন্ধুত্ব করবেন আপনি? যদি গ্রেপ্তার না হয় তা হলে কী? নিরাপত্তা হেফাজত। আপনার লোকদের ডেকে নির্দেশ দিন।”

    ধৈর্য ধরে মাথা নাড়ল প্রিচার। “না, টোরান। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, শুধু বোঝাতে এসেছি আপনারা যা করছেন তা কতখানি অকার্যকর। যদি বোঝাতে ব্যর্থ হই তা হলে চলে যাবো। ব্যস আর কিছু না।”

    “আর কিছু না? বেশ, আপনার মতবাদ প্রচার করুন, বক্তৃতা শুনিয়ে বিদায় হোন। আমাকে চা দিও না, বেইটা।”

    প্রিচার এক কাপ নিল, ধন্যবাদ জানাল গম্ভীর গলায়। চায়ে চুমুক দিয়ে সরাসরি তাকাল টোরানের দিকে, “ মিউল একটা মিউট্যান্ট। মিউট্যাশনের স্বাভাবিক প্রকৃতি বিচার করলে তাকে পরাজিত করা যাবে না।”

    “কেন? কী ধরনের মিউট্যাশন?” ঝাঁজালো তিরস্কারের সুরে জিজ্ঞেস করল টোরান। “নিশ্চয়ই আপনি আমাদের জানাবেন, অ্যাঁ?”

    “হ্যাঁ, জানাবো, আপনি জানলেও তার কোনো ক্ষতি হবে না। মিউল মানুষের ইমোশনাল ব্যালেন্স অ্যাডজাস্ট করতে পারে। সস্তা কৌশলের মতো শোনাচ্ছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করা যায় না।”

    “ইমোশনাল ব্যালেন্স?” বলল বেইটা, “একটু ব্যাখ্যা করবেন কি? আমি বুঝতে পারিনি।”

    “আমি বলছি যে একজন দক্ষ জেনারেলের ভেতর যে-কোনো আবেগ-যেমন ধরা যাক, মিউলের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য, বা মিউলের বিজয়ের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনের মতো আবেগ-নিবেদিত করা তার জন্য খুব সহজ। তার জেনারেলদের সবাই ইমোশন্যালি কন্ট্রোল্ড। ওরা কখনো বেঈমানি করতে পারবে না; কখনো দুর্বল হবে না-এবং এই কন্ট্রোল স্থায়ী। তার ভয়ংকর শত্রুও মুহূর্তের মধ্যে তার বিশ্বাসী অধীনস্থে পরিণত হয়। কালগানের ওয়ারলর্ড নিজ গ্রহ তার হাতে ছেড়ে দিয়ে এখন ফাউণ্ডেশন-এর ভাইসরয়।”

    “আর আপনি,” বেইটার কথায় তিক্ততার ছাপ। “নিজের আদর্শের সাথে বেঈমানি করে ট্রানটরে মিউলের প্রতিনিধি। আই সি!”

    “আমার কথা শেষ হয়নি। মিউলের ক্ষমতা উল্টো দিক থেকে কাজ করে আরো ভালো। হতাশা এক ধরনের ইমোশন! ঠিক সময় মতো, ফাউণ্ডেশন-এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা-হেভেনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা-হতাশায় ডুবে যায়। ঐ বিশ্বগুলো প্রায় বিনাযুদ্ধে পরাজিত হয়।”

    “আপনি বলতে চান,” চাপা উত্তেজনায় কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করল বেইটা। “টাইম ভল্টে যে অনুভূতি তার কারণ মিউল আমার ইমোশনাল কন্ট্রোল নিয়ে প্রতারণা করছিল।

    “আমার, আপনার, সবার। হেভেনের শেষ দিনগুলো কেমন ছিল?”

    মুখ ঘুরিয়ে নিল বেইটা।

    আন্তরিকভাবে বলে চলেছে কর্নেল প্রিচার, “একটা বিশ্বের উপর যখন তার শক্তি কাজ করে, তখন একজনের উপর ও কাজ করবে। এমন একটা শক্তির বিরুদ্ধে আপনি কী করবেন যে শক্তি ইচ্ছে হলেই আপনার নিজের ইচ্ছায় আরসমর্পণ করাতে পারে; ইচ্ছে হলেই আপনাকে বানিয়ে নিতে পারে বিশ্বস্থ চাকর?”

    “কথাগুলো যে সত্যি, আমি কীভাবে বুঝব?” ধীরে ধীরে বলল টোরান।

    “ফাউণ্ডেশন বা হেভেন কেন পরাজিত হয়েছে আপনি বলতে পারবেন? আমার কনভার্সনের কোনো ব্যাখ্যা আপনি দিতে পারবেন? থিংক ম্যান, আমি-আপনি-বা পুরো গ্যালাক্সি মিউলের বিরুদ্ধে কী করতে পেরেছি এতদিনে?”

    চ্যালেঞ্জ অনুভব করল টোরান, “বাই দ্য গ্যালাক্সি, আমি পারব!” হঠাৎ হিংস্র আত্মতৃপ্তিতে চিৎকার করে উঠল সে, “আপনার চমৎকার মিউল নিওট্রানটরের সাথে চুক্তি করেছিল। সেখানে আমাদের আটক করার কথা, তাই না? ওই কন্টাক্টগুলো এখন মৃত বা আরো খারাপ অবস্থায় আছে। ক্রাউন প্রিন্সকে আমরা মেরে ফেলেছি এবং অন্য লোকটাকে গর্দভ বানিয়ে রেখে এসেছি। মিউল আমাদের থামায়নি, চাইলেও পারত না।

    “মোটেই না। ওরা আমাদের লোক ছিল না। ক্রাউন প্রিন্স ছিল সাধারণ এক মদ্যপ লোক। অন্য লোকটা ছিল আসলেই একটা গর্দভ। নিজের গ্রহে অনেক ক্ষমতা থাকলেও যোগ্যতা ছিল না। ওরা ছিল নিষ্ঠুর। আমাদের কাজ হত না।”

    “ওরাই আমাদের বন্দি করেছিল বা করার চেষ্টা করেছিল।”

    “আবারো না। কোম্যাসনের ব্যক্তিগত দাস-নাম ইচনী। বন্দি করার বুদ্ধিটা তারই। লোকটা বৃদ্ধ হলেও আমাদের সাময়িক উদ্দেশ্য পূরণ ঠিকই হয়েছে। ওকে আপনারা চেষ্টা করলেও মারতে পারতেন না।”

    চরকির মতো পাঁক খেয়ে তার দিকে ঘুরল বেইটা। চায়ের কাপে একবারও চুমুক দেয়নি সে। “আপনার মন্তব্য অনুযায়ী, আপনার ইমোশন টেম্পার* [*মানসিক অবস্থা বা মেজাজ কোমল এবং শান্ত হওয়া বা করা] করা হয়েছে। মিউলের প্রতি আপনার আনুগত্য বিশ্বাস এক ধরনের মেকি এবং আরোপিত বিশ্বাস। আপনার মতামতের আর কোনো মূল্য নেই। বাস্তব বোধ বুদ্ধি হারিয়েছেন আপনি।”

    “আপনার ধারণা ভুল,” ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কর্নেল। “আমার ইমোশন শুধুমাত্র ফিক্সড। আমার যুক্তি বুদ্ধি ঠিক আগের মতোই আছে। হয়তো কন্ট্রোল্ড ইমোশনের কারণে একটা নির্দিষ্ট পথে চলতে প্রভাবিত হবে। কিন্তু সেটা সকল ধরনের চাপ মুক্ত। এবং এখন আমি অনেক কিছুই বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছি, পূর্বের স্বাধীন ইমোশনাল ট্রেণ্ড দিয়ে যা বুঝতে পারিনি।”

    “আমি এখন জানি যে মিউলের কর্মসূচি একটা চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা। কনভার্ট করার পর থেকে আমি সাত বছর আগে তার পরিকল্পনার শুরু থেকে সবটাই জানতে পারি। মিউট্যান্ট মেন্টাল পাওয়ার দিয়ে সে প্রথমে একদল দস্যুকে বশীভূত করে। তাদের সাহায্যে-এবং নিজের ক্ষমতা দিয়ে সে একটা গ্রহ দখল করে। তার সাহায্যে-এবং নিজের ক্ষমতা দিয়ে নিজের হাত প্রসারিত করতে থাকে যতক্ষণ না কালগানের ওয়ারলর্ড তার বশীভূত হয়। প্রতিটা কাজের ভেতর যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির ছাপ স্পষ্ট। কালগান নিজের পকেটে আসার পর তার হাতে চলে আসে একটা প্রথম শ্রেণীর ফ্লিট। এবং সেটার সাহায্যে-এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে-সে ফাউণ্ডেশনে আক্রমণ করে।

    “ফাউণ্ডেশন হচ্ছে মূল চাবিকাঠি। গ্যালাক্সির এই অংশই শিল্পে সর্বাধিক অগ্রসর। আর এখন যেহেতু ফাউণ্ডেশন-এর নিউক্লিয়ার কৌশল তার হাতে চলে এসেছে, সেই গ্যালাক্সির আসল মাস্টার। ঐ কৌশলের সাহায্যে-এবং নিজের ক্ষমতা দিয়ে-এম্পায়ারের অবশিষ্ট অংশকে আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করবে। বৃদ্ধ সম্রাট এখন প্রায় উন্মাদ-বাঁচবে না বেশিদিন, এমনকি ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ও তার নেই। তারপর গ্যালাক্সির কোন বিশ্ব তার বিরোধীতা করতে পারবে?”

    “গত সাত বছরে সে একটা এম্পায়ার গড়ে তুলেছে। সেলডনের সাইকোহিস্টোরি আগামী সাত শ বছরেও যা সম্পন্ন করতে পারবে না, মিউল তা পরবর্তী সাত বছরেই সম্পন্ন করবে। গ্যালাক্সিতে আবার ফিরে আসবে শান্তি এবং শৃঙ্খলা।

    “আপনারা ঠেকাতে পারবেন না-কাঁধের ধাক্কায় একটা গ্রহকে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতোই বোকামি এটা।”

    প্রিচারের বক্তব্যের পর দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল। কাপের অবশিষ্ট চা অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, সেটা খালি করে আবার পূরণ করে নিল। চুমুক দিতে লাগলো ধীরে সুস্থে। অন্যমনস্কভাবে বুড়ো আঙুলের নোখ খুটছে টোরান। বেইটার অভিব্যক্তি শীতল, চেহারা ফ্যাকাশে।

    তারপর চিকন গলায় বেইটা বলল, “আমাদের কনভিন্স করতে পারেননি। যদি মিউল আমাদের চায় তা হলে তাকে নিজে এসে আমাদের কনভার্ট করতে হবে। আমার ধারণা, কনভার্সনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আপনি লড়াই চালিয়ে গেছেন, তাই না।”

    “হ্যাঁ,” কর্নেল প্রিচারের গম্ভীর জবাব।

    “তা হলে আমরাও সেই সুযোগ চাই।”

    উঠে দাঁড়াল কর্নেল প্রিচার। চূড়ান্ত গলায় বলল, “তা হলে বিদায়। আগেই বলেছি আমার বর্তমান মিশনের সাথে আপনাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই এখানে আপনাদের উপস্থিতি রিপোর্ট করার প্রয়োজন নেই। এটাকে দয়া বলে ভাববেন না। মিউল আপনাদের থামাতে চাইলে, নিঃসন্দেহে আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবে। আপনারা থামতে বাধ্য হবেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু করার দরকার নেই আমার।”

    “ধন্যবাদ”, দুর্বলভাবে বলল বেইটা।

    “ম্যাগনিফিসো, কোথায় সে? বেরিয়ে এসো, ম্যাগনিফিসো। আমি তোমাকে মারবো না-”

    “ওকে নিয়ে কী করবেন?” হঠাৎ উদ্দীপনার সাথে জিজ্ঞেস করল বেইটা।

    “কিছুই না। ওর ব্যাপারে ও কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি। শুধু জানি যে ওকে খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু সময় হলে মিউল ঠিকই খুঁজে নেবে। আমি কিছুই বলব না। আপনারা হাত মেলাবেন না আমার সাথে?”

    মাথা নাড়ল বেইটা, টোরান তার হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

    কর্নেলের ইস্পাতের মতো দৃঢ় কাঁধ সামান্য ঝুলে পড়েছে। দরজার সামনে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল :

    “আরেকটা কথা, ভাববেন না যে আপনাদের আরবিশ্বাসের কারণ আমি জানি না। সবাই জানে আপনারা সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন খুঁজছেন। মিউল সময় মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোনো কিছুই আপনাদের সাহায্য করবে না কিন্তু আপনাদের আমি অন্য এক সময়ে চিনতাম, হয়তো আমার চেতনার কোনো একটা বোধ কাজটা করতে আমাকে বাধ্য করেছে; আমি আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি, চূড়ান্ত বিপদ হওয়ার আগেই চেষ্টা করেছি সরিয়ে নেওয়ার, গুড বাই।”

    স্যালুট করে চলে গেল সে।

    মূর্তির মতো নীরব নিশ্চল টোরানের দিকে ঘুরে ফিসফিস করে বলল বেইটা, “ওরা সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর কথাও জানে।”

    লাইব্রেরির এক গুপ্তস্থানে উপরের ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে অচেতন এবলিং মিস ঘোড় অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠুরীর ভেতরে আলো জ্বালিয়ে বিজয়ের আনন্দে আপন মনে বিড় বিড় করে উঠল।

    *

    ২৫. সাইকোলজিস্টের মৃত্যু

    ওই ঘটনার পর এবলিং মিস বেঁচেছিল মাত্র দুই সপ্তাহ।

    এবং ওই দুই সপ্তাহে তার সাথে বেইটার দেখা হয়েছে মাত্র তিনবার। প্রথমবার, কর্নেল প্রিচার যেদিন এসেছিল সেই রাতে। দ্বিতীয়বার এক সপ্তাহ পরে। তৃতীয়বার আরো একসপ্তাহ পরে-শেষদিন-যেদিন মিস মারা যায়।

    প্রথম, কর্নেল প্রিচার যে সন্ধ্যায় আসে সেই রাতের প্রথম কয়েক ঘণ্টা কাটে নিরানন্দ ভাবে।

    “টোরি, চলো এবলিংকে সব জানাই।”

    “তোমার ধারণা ওতে লাভ হবে?” টোরানের নিষ্প্রভ জিজ্ঞাসা।

    “আমরা মাত্র দুজন। এই অসহনীয় স্নায়বিক চাপ অনেক বেশি। হয়তো সে সাহায্য করতে পারবে।”

    “লোকটা বদলে গেছে অনেক। অল্প কয়েক দিনেই শুকিয়ে কেমন পাখির মতো হালকা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সে আমাদের সাহায্য করতে পারবে না-কোনোদিন। মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনোকিছুই আর আমাদের সাহায্য করতে পারবে না।

    “ওভাবে বলো না, টোরি। এরকম কথা শুনলে মনে হয় মিউল আমাদের ধরতে আসছে। চলো এবলিংকে জানাই সব-এক্ষুনি”

    লম্বা ডেস্ক থেকে মাথা তুলে ঢুলু ঢুলু চোখে ওদের এগিয়ে আসতে দেখল এবলিং। তার পাতলা চুল এলোমেলো, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

    “কেউ দেখা করবে আমার সাথে?”

    হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসল বেইটা, “আমরা কী আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম? চলে যাবো?”

    “চলে যাবে? কে? বেইটা? না, না, থাকো! ওখানে চেয়ার আছে না? আমি দেখতে পাচ্ছি-” আঙুল তুলে অস্পষ্টভাবে নির্দেশ করল একদিকে।

    ঠেলে দুটো চেয়ার সামনে আনল টোরান। তাতে বসে সাইকোলজিস্ট এর শীর্ণ একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিল বেইটা, “আপনার সাথে কথা বলা যাবে, ডক্টর?” টাইটেল ধরে আগে কখনো সম্বোধন করেনি সে।

    “কিছু হয়েছে?” তার নিষ্প্রাণ চোখে কিছুটা সজীবতা ফিরে এল, রং ফিরে এল ফ্যাকাশে চোয়ালে। “কিছু হয়েছে?”

    “ক্যাপ্টেন প্রিচার এসেছিলেন। আমাকে বলতে দাও, টোরি। ক্যাপ্টেন প্রিচারের

    “হ্যাঁ-হ্যাঁ-” ঠোঁটে চিমটি কেটে আবার ছেড়ে দিল মিস। “লম্বা লোক। ডেমোক্র্যাট।”

    “হ্যাঁ। মিউলের মিউট্যাশনের ব্যাপারটা সে ধরতে পেরেছে। আমাদের জানাতে এসেছিল।”

    “কিন্তু ওটা তো নতুন কিছু না। অনেক আগেই জানা হয়ে গেছে। প্রকৃতই বিস্মিত সে। “আমি তোমাদের জানাইনি? বলতে ভুলে গেছি?”

    “কী বলতে ভুলে গেছেন?” দ্রুত জিজ্ঞেস করল টোরান।

    “অবশ্যই মিউলের মিউট্যাশনের ব্যাপারটা। হি টেম্পারস উইথ ইমোশন। ইমোশনাল কন্ট্রোল! তোমাদের জানাইনি? ভুলে গেলাম কেন?” নিচের ঠোঁট মুখে পুরে ভাবতে লাগল সে।

    ধীরে ধীরে সজীবতা ফিরে এল তার কণ্ঠে, চোখের পাতাগুলো চওড়া হল, যেন তার বিমুঢ় মস্তিষ্ক চট করে তেলতেলে মসৃণ এক পথে চলতে শুরু করেছে। কথা বলছে স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো। শ্রোতাদের কারো দিকেই নির্দিষ্ট করে তাকাল না, বরং তাকাল দুজনের মাঝখানে। “আসলে খুব সহজ। কোনো বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। সাইকোহিস্টোরি গণিতের তৃতীয় মাত্রার সমীকরণের সাহায্যে দ্রুত নির্ণয় করা যাবে-কিছু মনে করো না। পুরো ব্যাপারটা সবার বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করা যাবে-সহজ কথায়-এবং যুক্তির ভিত্তিতে-সাইকোহিস্টোরিক্যাল ফেনোমেনার সাথে পুরোপুরি বেমানান।

    “নিজেকেই প্রশ্ন করো-হ্যারি সেলডনের সযত্নে গড়ে তোলা স্কিম তথা হিস্টোরিকে কোন জিনিসটা আপসেট করতে পারবে, হাহ?” পিটপিট করে পালাক্রমে দুজনের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল সে। “সেলডনের মূল অনুমিতি কী ছিল? প্রথম, এক হাজার বছরের মধ্যে মানব সমাজের মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না।”

    “এখন ধরা যাক, গ্যালাক্সির টেকনোলজিতে অনেক বড় পরিবর্তন দেখা দিল, যেমন, এনার্জি ব্যবহারের সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতির আবিষ্কার, যা ইলেকট্রনিক নিউরোবায়োলজির চূড়ান্ত উৎকর্ষতা। সামাজিক পরিবর্তনের কারণে সেলডনের মূল সমীকরণগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি, ঘটেছে?”

    “আবার ধরা যাক, ফাউণ্ডেশন-এর বাইরের কোনো শক্তি ভয়ংকর এক অস্ত্র তৈরি করল যা দিয়ে ফাউণ্ডেশন-এর সকল অস্ত্র থামানো সম্ভব। সেই কারণে হয়তো একটা ধ্বংসারক পরিবেশ তৈরি হত, যদিও সম্ভাবনা কম। কিন্তু সেরকম কিছুও ঘটেনি। মিউলের নিউক্লিয়ার ফিল্ড ডিপ্রেসর নিচুমানের অস্ত্র এবং প্রতিহত করা কঠিন কিছু না। এক মাত্র এখানেই সে শক্তির পরিচয় দিয়েছে, যদিও দুর্বলভাবে।

    “কিন্তু দ্বিতীয় একটা অনুমিতি আছে। অনেক বেশি সূক্ষ্ম! সেলডন ধরে নিয়েছেন উদ্দীপনার সাথে মানুষের আচরণ স্থির থাকবে। মেনে নিলাম, প্রথম অনুমিতিটা সঠিক, তা হলে কোনো-না-কোনোভাবে দ্বিতীয় অনুমিতিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো উপাদান নিশ্চয়ই মানবজাতির ইমোশনাল রেসপন্স এর ভিত নড়িয়ে দিয়েছে, নইলে সেলডন ব্যর্থ হতেন না এবং ফাউণ্ডেশন-এর ও পতন ঘটত না। এবং সেই উপাদান মিউল ছাড়া আর কী হতে পারে?

    “ঠিক বলেছি? আমার রিজনিং এ কোনো ভুল আছে?”

    সুডৌল হাত পিঠে বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে লাগল বেইটা, “কোনো ভুল নেই, এবলিং।”

    শিশুর মতো উফুল্ল হল মিস। “এরকম অনেক কিছুই এখন সহজে বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি আমার ভেতরে কী ঘটছে এসব। আগে যা ছিল কঠিন রহস্য, এখন সেগুলোই জলের মতো সহজ। কোনো সমস্যা নেই। আমার অনুমান, থিওরি সবই যেন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে জন্ম নিচ্ছে। ভেতরের একটা শক্তি আমাকে চালাচ্ছে…ফলে থামতে পারছি না…আমার খেতে বা ঘুমাতে ইচ্ছা করেনা…শুধু কাজ…আর কাজ…আর কাজ…”

    কণ্ঠস্বর ফিসফিসানিতে পরিণত হল; নীল শিরা বের হয়ে যাওয়া দুর্বল হাত আলতোভাবে ফেলে রেখেছে কপালের উপর। দৃষ্টিতে একটা উন্মাদনা এসেই চলে গেলো।

    আগের চেয়ে শান্ত গলায় বলল, “তো, মিউলের মিউট্যাশনের ব্যাপারটা তোমাদের জানাইনি, তাই না? কিন্তু… তোমরা জানো?”

    “ক্যাপ্টেন প্রিচার, এবলিং, মনে আছে?”

    “ও তোমাদের বলেছে?” কণ্ঠে রাগের ছোঁয়া। কিন্তু জানল কীভাবে?”

    “মিউল তাকে কণ্ডিশনড করে ফেলেছে। এখন সে কর্নেল, মিউলের অনুগত। সে আমাদের বোঝাতে এসেছিল যেন মিউলের কাছে আরসমর্পন করি। এবং সে তাই বলেছে-আপনি যা বললেন।”

    “তা হলে মিউল জানে আমরা এখানে? দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে-ম্যাগনিফিসো কোথায়? তোমাদের সাথে নেই।?”।

    “ঘুমাচ্ছে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, আপনি জানেন।” অধৈর্য গলায় বলল টোরান।

    “তাই? তোমরা যখন আসে তখন কী আমি ঘুমাচ্ছিলাম?”

    “হ্যাঁ। এখন আর কাজ করতে পারবেন না। সোজা বিছানায়। টোরি, একটু সাহায্য করো। আমাকে ধাক্কা দিয়ে লাভ হবে না, এবলিং, ভাগ্য ভালো যে আপনাকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়া করাইনি। জুতোগুলো খুলে দাও, টোরি, আর আগামী কাল তুমি এসে পুরোপুরি ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার আগেই উনাকে খোলা বাতাসে ঘুরিয়ে আনবে। নিজের অবস্থা একবার দেখুন, এবলিং, কেমন বুড়িয়ে গেছেন। খিদে পেয়েছে?”

    মাথা নাড়ল এবলিং এবং ঘুম জড়ানো চোখে বিছানা থেকে তাকাল। “আগামী কাল ম্যাগনিফিসোকে পাঠাবে।”

    বেড শিটটা ভালো করে ঘাড়ের কাছে গুঁজে দিল বেইটা। “আগামী কাল আমি নিজে আসব পরিষ্কার কাপড় নিয়ে। প্রথমে গোসল করবেন, তারপর ফার্মগুলোতে বেড়াতে যাবেন। গায়ে সূর্যের আলো লাগাবেন।”

    “আমি পারবো না, দুর্বল গলায় বলল মিস। “শুনেছো? আমি ভীষণ ব্যস্ত।”

    তার লম্বা চুলগুলো বালিশের উপর মাথার চার পাশে রুপোলী তারের মতো ছড়িয়ে আছে। এমনভাবে ফিসফিস করল যেন গোপন সংবাদ জানাচ্ছে, “তোমরা সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন পেতে চাও, তাই না?”

    দ্রুত তার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল টোরান, “সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন? বলুন এবলিং।”

    বেডশিটের নিচ থেকে একটা হাত বের করে দুর্বল আঙুল দিয়ে টোরানের আস্তিন আঁকড়ে ধরল মিস। “হ্যারি সেলডনের সভাপতিত্বে একটা সাইকোলজিক্যাল সম্মেলনে ফাউণ্ডেশনগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঐ সম্মেলনের ছাপানো প্রতিবেদন গুলো পেয়েছি। পঁচিশটা মোটা মোটা ফিল্ম। এরই মধ্যে ভালোভাবে চোখ বুলিয়েছি।”

    “তো?”

    “তো, ফার্স্ট ফাউণ্ডেশন বের করা খুব সহজ। যদি তুমি সাইকোহিস্টোরি জানো। সমীকরণগুলো বুঝতে পারলে দেখবে বারবার ওটার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টোরান, সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর কথা কেউ বলেনি। ওটার ব্যাপারে কোথাও কোনো রেফারেন্স নেই।”

    “তা হলে নেই?”

    “অবশ্যই আছে,” রাগে চিৎকার করল মিস “কে বলেছে নেই? কিন্তু ওটার ব্যাপারে বলা হয়েছে খুব কম। ওটার গুরুত্ব এবং সবকিছু-গোপন থাকলেই ভালো, রহস্যের আড়ালে থাকাই ভালো। বুঝতে পারছো না? দুটোর মধ্যে ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেলডন সম্মেলনের সব প্রতিবেদন আমি পেয়েছি। মিউল এখনো জিততে পারেনি।”

    দৃঢ়তার সাথে আলো নিভিয়ে দিল বেইটা। “ঘুমান!”

    নিঃশব্দে উপরের শোবার ঘরে ফিরে এল বেইটা আর টোরান।

    পরের দিন এবলিং মিস গোসল করে নিজে নিজেই পোশাক পরল। বেরিয়ে ট্রানটরের সূর্য দেখল, গায়ে লাগলো ট্র্যানটরের বাতাস। দিন শেষে ফিরে এসে আবার ঢুকল লাইব্রেরির বিশাল কুঠুরিতে। আর কোনোদিন বেরোয়নি সেখান থেকে।

    .

    পরের সপ্তাহে, জীবন যথা নিয়মে বয়ে চলেছে। নিত্ত ট্রানটরের সূর্য ট্রানটরের রাতের আকাশে নিরুত্তাপ, উজ্জ্বল নক্ষত্র। ফার্মগুলো ব্যস্ত বসন্তকালীন চাষাবাদের কাজে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর মরুভূমির মতো নীরব। গ্যালাক্সি একেবারে ফাঁকা। যেন মিউলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না কোনো কালে।

    বেইটা ভাবছে। টোরান একটা সিগারেট ধরাল। দিগন্ত ঘিরে থাকা অগণিত গম্বুজের ফাঁকে একটুকরো নীল আকাশ চোখে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে টোরান বলল, “দিনটা খুব চমৎকার।”

    “হ্যাঁ। লিস্টের সবকিছু দেখে নিয়েছ, টোরি?”

    “নিশ্চয়ই। আধা পাউণ্ড মাখন, কয়েক ডজন ডিম, সিম-সব আছে এখানে। কোনো ভুল হবে না।”

    “চমৎকার। দেখো সবজিগুলো যেন তাজা হয়, জাদুঘরের প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে এসো না আবার। ভালো কথা, ম্যাগনিফিসোকে দেখেছো?”

    “সকালের নাস্তার পরে তো আর দেখিনি। বোধহয় এবলিং মিস এর সাথে নিচে আছে। বুক ফিল্ম দেখছে কোনো।”

    “ঠিক আছে। সময় নষ্ট করো না; ডিনারের জন্য ডিমগুলো লাগবে আমার।”

    মৃদু হাসি এবং হাত নেড়ে চলে গেল টোরান।

    ধাতব জঙ্গলের ওপাশে টোরান চলে যাওয়ার পর ফিরল বেইটা। কিছুক্ষণ ইতস্তত করল রান্নাঘরের দরজার সামনে। তারপর ঘুরে সরাসরি এগোল নিচের কুঠুরীগুলোতে নামার এলিভেটরের দিকে।

    প্রজেক্টরের আইপিসে চোখ ঠেকিয়ে স্থাণুর মতো বসে আছে এবলিং। তার পাশেই একটা চেয়ারে আঠার মতো সেটে আছে ম্যাগনিফিসো, তীক্ষ্ণ ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিস এর দিকে।

    কোমলগলায় ডাকল বেইটা, “ম্যাগনিফিসো।” লাফিয়ে দুপায়ে সোজা হল ম্যাগনিফিসো, আন্তরিক সুরে জবাব দিল, “মাই লেডি!”

    “ম্যাগনিফিসো, টোরান ফার্মের দিকে গেছে। ফিরতে দেরি হবে। তুমি কী একটা মেসেজ নিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো ওর কাছে যাবে? আমি লিখে দিচ্ছি।”

    “সানন্দে, মাই লেডি। আপনাকে খুশি রাখার জন্য আমি সব করতে পারি।”

    মিস এর সাথে এখন সে একা, লোকটা একবিন্দু নড়েনি, তার কাঁধে দৃঢ়ভাবে হাত রেখে ডাক দিল সে, “এবলিং-”

    জড়ানো কান্নার সুরে জবাব দিল সাইকোলজিস্ট, “কী ব্যাপার?” নাক কুঁচকালো। “বেইটা তুমি? ম্যাগনিফিসো কোথায়?”

    “একটু বাইরে পাঠিয়েছি। আপনার সাথে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।” প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা করে উচ্চারণ করল সে। “আপনার সাথে কথা বলতে চাই এবলিং।”

    আবার প্রজেক্টরের দিকে ফেরার চেষ্টা করল সাইকোলজিস্ট, কিন্তু কাঁধের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। পোশাকের নিচে হাড়গুলো স্পষ্ট অনুভব করল বেইটা। ট্রানটরে আসার পর তার গায়ের মাংসগুলো যেন স্রেফ উবে গেছে। মুখটা পাতলা, হলুদ বর্ণ, দু সপ্তাহের না কামানো দাড়ি। কাঁধ দুটো বেশ ঝুলে পড়েছে। বসে থাকা অবস্থাতেও সেটা বেশ বোঝা যায়।

    “ম্যাগনিফিসো আপনাকে বিরক্ত করছে না তো, এবলিং? দিন রাত তো আপনার সাথে পড়ে থাকে।”

    “না, না, না! মোটেই না। কেন? ও থাকলে আমার কোনো অসুবিধা নেই। চুপচাপ বসে থাকে, আমাকে বিরক্ত করে না। মাঝে মাঝে আমাকে ফিল্মগুলো এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করে; যেন বলার আগেই সে জানে কখন কোনটা দরকার। ওকে থাকতে দাও?”

    “ঠিক আছে-কিন্তু, এবলিং, ও আপনাকে অবাক করে না? আমার কথা শুনছেন? ও আপনাকে অবাক করে না?”

    মাথা ঝাঁকালো এবলিং মিস। “না। কী বোঝাতে চাও?”

    “বোঝাতে চাই, কর্নেল প্রিচার এবং আপনি দুজনেই বলেছেন মিউল মানুষের ইমোশন কণ্ডিশন করতে পারে। কিন্তু আপনি কী নিশ্চিত? মনে হয় না এই থিওরির মাঝে ম্যাগনিফিসো একটা ভ্রান্তি?”

    নীরবতা।

    সাইকোলজিস্টকে ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার একটা প্রবল ইচ্ছা দমন করল বেইটা। “কী হয়েছে আপনার, এবলিং? ম্যাগনিফিসো ছিল মিউলের ক্লাউন। তা হলে তাকে কণ্ডিশনড করে তার আবেগকে অনুরাগ এবং বিশ্বাসে পরিণত করা হয়নি কেন।”

    “কিন্তু…কিন্তু তাকে অবশ্যই কণ্ডিশনড করা হয়েছে, বে! তোমার কী ধারণা জেনারেলদের যেভাবে বিচার করে ক্লাউনকেও একইভাবে বিচার করবে মিউল? পরের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন আনুগত্য এবং বিশ্বাস, কিন্তু ক্লাউনের ক্ষেত্রে তার শুধু প্রয়োজন ভয়। তুমি লক্ষ্য করোনি যে ম্যাগনিফিসোর অবিরাম আতঙ্ক অনেকাংশেই শারীরিক? তোমার কী মনে হয় একজন মানুষের সবসময় আতঙ্কিত হয়ে থাকাটা স্বাভাবিক? এরকম সীমাহীন ভয় কৌতুকে পরিণত হয়। সম্ভবত মিউলের কাছে এটা ছিল কৌতুকের বিষয়-এবং প্রয়োজনীয় যেহেতু এটা ম্যাগনিফিসোর কাছ থেকে আমাদের সাহায্য পাবার আশা কমিয়ে দেবে।

    “তার মানে মিউলের ব্যাপারে ম্যাগনিফিসো আমাদের যা বলেছে তা মিথ্যে?”

    “আমাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। শারীরিক ভয়ের আবরণ দিয়ে আসল সত্যটার উপর রং চড়ানো হয়েছে। ম্যাগনিফিসো যেমন বর্ণনা করেছে শারীরিক দিক দিয়ে মিউল ওরকম ভয়ংকর কিছু না। মেন্টাল পাওয়ার বাদ দিলে সে অতি অতি সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু ম্যাগনিফিসোর কাছে নিজেকে সুপারম্যান হিসাবে উপস্থাপন করে সে মজা পায়-শ্রাগ করল মিস। “ম্যাগনিফিসোর দেওয়া তথ্যের আর কোনো গুরুত্ব নেই।”

    “তা হলে কী?”

    কিন্তু ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মিস। ফিরে গেল প্রজেক্টরে।

    “তা হলে কী? সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন?”

    ঝট করে চোখ ফেরালো সাইকোলজিস্ট। “ওই সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলেছি। মনে পড়ছে না। সময় হয়নি এখনো। কী বলেছি?”

    “কিছুই না,” জবাব দিল বেইটা। “ওহ, গ্যালাক্সি আপনি কিছুই বলেননি, কিন্তু আমি শুনতে চাই, কারণ আমি ভীষণ ক্লান্ত। কখন শেষ হবে এইসব কিছু?”

    কিছুটা অনুতপ্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল এবলিং মিস, “বেশ, মাই…মাই ডিয়ার। তোমাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাই…কারা আমার বন্ধু। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো কথাই আমার বলা উচিত নয়। গোপনীয়তার প্রয়োজন আছে কিন্তু মিউলের কাছ থেকে তোমার কাছ থেকে না, মাই ডিয়ার।” বেইটার কাঁধে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে লাগল সে।

    “সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর ব্যাপারে কদুর জানেন?”

    নিজের অজান্তেই ফিসফিস করতে লাগলো সে। “তুমি জানো সেলডন কীভাবে পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখেছেন? সেলডন সম্মেলনের রিপোর্টগুলো আমাকে মোটেই সাহায্য করেনি। অন্তত আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত উপলব্ধি না আসা পর্যন্ত। এখনো সেটাকে মনে হয়-অস্পষ্ট। সম্মেলনের প্রতিবেদনগুলো অপ্রাসঙ্গিক; সবসময় অস্পষ্ট। অনেকবারই আমার মনে হয়েছে, ওই সম্মেলনে যারা যোগ দিয়েছে তারা পর্যন্ত জানতো না কী আছে সেলডনের মনে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে সম্মেলনটাকে সেলডন ব্যবহার করেছেন একটা ঢাল হিসেবে এবং পুরো কাঠামোেটা তৈরি করেছেন তিনি একা-”

    “ফাউণ্ডেশনগুলোর?”

    “সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর! আমাদের ফাউণ্ডেশন একেবারেই সাধারণ। কিন্তু সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন শুধুই একটা নাম। ওটার বিস্তারিত পরিচয় লুকিয়ে আছে জটিল গণিতের ভেতর। এখনো অনেক ব্যাপার বুঝতে পারছি না কিন্তু গত সাতদিন থেকে সেগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করেছে, একটা অস্পষ্ট ছবি তৈরি হচ্ছে।

    “এক নম্বর ফাউণ্ডেশন হল ফিজিক্যাল সায়েন্টিস্টদের বিশ্ব। গ্যালাক্সির মৃতপ্রায় বিজ্ঞানকে এখানে জমিয়ে রাখা হচ্ছে যেন নির্দিষ্ট শর্তাধীনে আবার বাঁচিয়ে তোলা যায়। কোনো সাইকোলজিস্ট পাঠানো হয়নি। অদ্ভুত হলেও নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ ব্যাখ্যা হল, সেলডনের সাইকোহিস্টোরি তখনই ভালো মত কাজ করবে যখন পৃথক কার্যকরী এককগুলো-হিউম্যান বিয়িং–জানবে না অনাগত ভবিষ্যতে কী হবে, এবং পরিস্থিতির সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবে। বুঝতে পারছো, মাই ডিয়ার”

    “হ্যাঁ, ডক্টর।”

    “তা হলে মন দিয়ে শোন। দুই নাম্বার ফাউণ্ডেশন হল মেন্টাল সায়েন্টিস্টদের বিশ্ব। আমাদের বিশ্বের মিরর ইমেজ। ফিজিক্স নয়, সাইকোলজিই হচ্ছে মূল ক্ষমতা। বুঝতে পারছ।”

    “না।”

    “চিন্তা করো, বেইটা মাথা খাটাও। সেলডন জানতেন যে তার সাইকোহিস্টোরি শুধু সম্ভাবনার কথা বলতে পারে। নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারে না। সবসময়ই ভুলের একটা সীমা ছিল। সময়ের সাথে সেই সীমা বৃদ্ধি পেয়েছে জ্যামিতিক হারে। স্বভাবতই সেলডন যতদূর পেরেছেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমাদের ফাউণ্ডেশন সাইন্টিফিক্যালি প্রচণ্ড শক্তিশালী। এটা যে-কোনো আর্মি বা অস্ত্রকে পরাজিত করতে পারে। শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু মিউলের মতো একজন মিউট্যান্ট এর মেন্টাল অ্যাটাকের বিরুদ্ধে কী করতে পারে?”

    “সেটা ঠেকানোর দায়িত্ব সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর সাইকোলজিস্টদের!” উত্তেজনা বোধ করল বেইটা।

    “হ্যাঁ, হা, হা! অবশ্যই!”

    “কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কিছুই করেনি।”

    “কিছুই যে করেনি, তুমি কীভাবে জানো?”

    চিন্তা করল বেইটা। “জানি না। আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

    “না। অনেক ব্যাপারই আমি জানি না। সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন- একেবারে তৈরি অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের মতোই চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এগোতে হয়েছে। নক্ষত্রই জানে এখন তারা কতখানি শক্তিশালী। তারা কী মিউলকে ঠেকানোর মতো শক্তিশালী হতে পেরেছে? সবচেয়ে বড় কথা তারা কী মিউল নামক বিপদের ব্যাপারে সচেতন? তাদের কী যোগ্য কোনো নেতা আছে?”

    “কিন্তু যদি তারা সেলডন প্ল্যান অনুসরণ করে, তা হলে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন অবশ্যই মিউলকে ঠেকাবে।”

    “আহ,” মিস এর মুখে চিন্তার ভাজ, “সেই একই কথা? কিন্তু সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন প্রথমটার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। অনেক অনেক বেশি জটিলতা, এবং সেইসাথে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। এবং যদি সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন মিউলকে পরাজিত না করতে পারে, তা হলে খুব ভয়ংকর অবস্থা-সত্যিই ভয়ংকর। সম্ভবত মানব জাতির পরিসমাপ্তি।”

    “না।”

    “হ্যাঁ। যদি মিউলের বংশধররাও তার মতো ক্ষমতা পায়-বুঝতে পারছ? হোমা স্যাফিয়েন্সরা বাধা দিতে পারবে না। তখন একটা কর্তৃত্বশালী জাতির উদ্ভব ঘটবে-একটা নতুন শাসকগোষ্ঠী-সেইসাথে মানুষ পরিণত হবে নিচু জাতের দাস শ্ৰেণীতে। তাই না?”

    “হ্যাঁ।”

    “আর যদি মিউল একটা ডাইন্যাস্টি স্থাপন করতে সক্ষম নাও হয়, সে তার ক্ষমতা দিয়ে একটা জঘন্য সাম্রাজ্য তৈরি করবে। তার মৃত্যুর পরেই এটা শেষ হয়ে যাবে। সে আসার আগে গ্যালাক্সি সেখানে ফিরে যাবে যেখানে শুধু তখন আর কোনো ফাউণ্ডেশন থাকবে না একটা সুসংগঠিত শক্তিশালী সেকেণ্ড এম্পায়ার গড়ে ভোলার জন্য। অর্থাৎ হাজার বছরের অরাজকতা। তার মানে দাঁড়ায় কোনো দিকেই ভরসা নেই।”

    “কী করতে পারি আমরা? সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনকে সতর্ক করে দেওয়া যায় না।?” |||||||||| “করতেই হবে, নইলে ওরা না জেনেই বিপদে পড়বে, সেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে । কিন্তু তাদেরকে সতর্ক করার কোনো উপায় নেই।”

    “কোনো উপায় নেই?”

    “ওদের অবস্থান আমি জানি না। দে আর অ্যাট দ্য আদার এণ্ড অব দ্য গ্যালাক্সি’ ব্যাস এইটুকুই। এই কথাটার হাজার রকম অর্থ হয়।”

    “কিন্তু এবলিং, ওখানে কিছু নেই।” অস্পষ্টভাবে মোটা মোটা ফিল্মগুলো দেখাল সে।

    “না, নেই। যেখানে আমি খুঁজে পেতে পারি, সেখানে নেই। এই গোপনীয়তার নিশ্চয়ই কোনো অর্থ আছে। অবশ্যই কোনো কারণ আছে-” আবার একটা বিমুঢ় ভাব ফিরে এল দৃষ্টিতে। “তুমি এখন যাও। অনেক সময় নষ্ট করেছি আর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে-সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

    চোখের পিঁচুটি পরিষ্কার করে ভুরু কুঁচকালো সে।

    ম্যাগনিফিসোর মৃদু পায়ের শব্দ শোনা গেল, “আপনার স্বামী বাড়ি ফিরেছে মাই লেডি।”

    এবলিং মিস ক্লাউনকে কিছু বলল না। মনযোগ দিল প্রজেক্টরে।

    সন্ধ্যায় সব শুনে মন্তব্য করল টোরান। “তোমার মতে ওর কথায় কোনো ভুল নেই, বে? সে আসলেই-” ইতস্তত করল।

    “সে ঠিকই বলেছে। সে অসুস্থ-আমি জানি। যে পরিবর্তন, ওজন কমে যাওয়া, কথা বলার ভঙ্গি-সে অসুস্থ। কিন্তু মিউল বা সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর বিষয়টা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত, ওর কথা শোেন। আউটার স্পেসের আকাশের মতোই পরিষ্কার সে। সে জানে কী নিয়ে কথা বলছে। আমি তাকে বিশ্বাস করি।”

    “তা হলে আশা আছে।” অর্ধেক মন্তব্য অর্ধেক স্বগতোক্তির মতো শোনাল কথাটা।

    “আমি…আমি জানি না। হয়তো! হয়তো না! এখন থেকে আমি একটা ব্লাস্টার রাখব সাথে।” চকচকে ব্যারেলের অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দেখাল সে, যদি টোরি। যদি-”

    “যদি কী?”

    হিস্টিরিয়া গ্রস্তের মতো হাসল বেইটা। “কিছু মনে করো না। হয়তো আমিও একটু পাগলামি করছি-এবলিং মিস এর মতো।”

    তারপর এবলিং মিস এর জীবনের বাকি ছিল মাত্র সাত দিন। সেই সাতদিনও পেরিয়ে গেল একটার পর একটা নিঃশব্দে।

    টোরানের কাছে মনে হল চারপাশে কেমন একধরনের নেশায় আচ্ছন্ন ভাব। উষ্ণ দিন এবং নীরব নিঃশব্দতা তাকে আলস্যে ভড়িয়ে তুলল। যেন জীবনের সব বৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে, পরিণত হয়েছে অসীম শীত নিদ্রায়।

    মিস পুরোপুরি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তার অসম্ভব পরিশ্রম থেকে এখনো কিছু ফল লাভ হয়নি। বেইটা বা টোরান কেউ তাকে দেখছে না। শুধু ম্যাগনিফিসোর যাওয়া আসা দেখে বোঝা যায় সে এখনো বেঁচে আছে। ম্যাগনিফিসোও অনেক বদলে গেছে। গম্ভীর চিন্তামগ্ন, খাবার নিয়ে গিয়ে উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে।

    বেইটা গুটিয়ে গেছে নিজের ভেতর। আগের সেই প্রাণোচ্ছলতা নেই, আরবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। সে নিজেও দুঃশ্চিন্তা কমানোর জন্য সঙ্গীর কাছে আশ্রয় খোঁজে। এবং যখন টোরান ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে ধরে রেখে ব্লাস্টারে আঙুল বোলাচ্ছিল, সে দ্রুত সরিয়ে নেয় অস্ত্রটা, তারপর জোর করে হাসে।

    “এটা দিয়ে তুমি কী করবে, বে?”

    “শুধু কাছে রাখছি। সেটা কোনো অপরাধ?”

    “একদিন তোমার মোটা মাথাটাই উড়ে যাবে।”

    “গেলে যাবে। খুব বেশি ক্ষতি হবে না।” বিবাহিত জীবন টোরানকে শিখিয়েছে যে যখন স্ত্রীর মুড ভালো থাকে না তখন তার সাথে তর্ক করাই ভালো। সে একটু শ্রাগ করে চলে গেল।

    শেষ দিন, ওদের উপস্থিতিতে ভয়ে আতকে উঠল ম্যাগনিফিসো। সন্ত্রস্তভাবে আঁকড়ে ধরল তাদের। “জ্ঞানী ডক্টর আপনাদের ডাকছে। তার শরীর ভালো নেই।

    আসলেই অসুস্থ। বিছানায় শোয়া। চোখগুলো অস্বাভাবিক রকম বড়, অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। চেনাই যাচ্ছে না।

    “এবলিং!” কেঁদে ফেলল বেইটা।

    “আমাকে কথা বলতে দাও,” মিনমিনে গলায় বলল সাইকোলজিস্ট, দুর্বল বাহুতে ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হল। “বলতে দাও। আমি শেষ; দায়িত্বটা তোমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। আমি কোনো নোট রাখিনি; খসড়া হিসাবগুলো সব নষ্ট করে ফেলেছি। কেউ যেন না জানে। সব তোমাদের মনে রাখতে হবে।”

    “ম্যাগনিফিসো,” কড়া গলায় আদেশ করল বেইটা। “উপরে যাও।”

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠল ক্লাউন। তার বিষণ্ণ চোখ দুটো মিস এর উপর।

    দুর্বলভাবে ইশারা করল মিস, “ও থাকলে কোনো অসুবিধা নেই; থাকো ম্যাগনিফিসো।

    দ্রুত বসে পড়ল ক্লাউন। বেইটা চোখ নামিয়ে নিল মেঝের দিকে। ধীরে, খুব ধীরে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল।

    কর্কশ ফিসফিস সুরে মিস বলল, “আমি জানি সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন জয়ী হবে, যদি সময়ের আগেই ধরা না পড়ে। নিজেদের তারা গোপন রেখেছে; সেই গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে; তার কারণ আছে। তোমরা যাবে সেখানে। আমার কথা শুনছ?”

    প্রায় যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল টোরান, “হ্যাঁ, হা! বলুন কীভাবে যেতে হবে। এবলিং? কোথায়?”

    “বলছি,” মিস-এর কণ্ঠ দুর্বল।

    কিন্তু বলতে পারেনি কখনো।

    বেইটা, বরফের মতো সাদা মুখ, ব্লাস্টার তুলে গুলি করল, হাততালির মতো একটা শব্দ প্রতিধ্বনি তুলল বদ্ধ জায়গায়। কোমর থেকে উপরের দিকে মিস-এর। শরীরের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু পিছনের দেয়ালে একটা পোড়া গর্ত। বেইটার শিথিল আঙুল থেকে ব্লাস্টার খসে পড়ল মেঝেতে।

    *

    ২৬. অনুসন্ধানের সমাপ্তি

    কারো মুখে কথা নেই। বিস্ফোরণের শব্দের প্রতিধ্বনি গড়িয়ে চলে গেল নিচের কুঠুরীগুলোর দিকে, পরিণত হল গমগমে ভগ্ন শব্দে। মিলিয়ে গেল ফিসফিসানিতে। তার আগে খসে পড়া ব্লাস্টারের তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দে চাপা পড়ল একবার। ম্যাগনিফিসোর তীব্র আর্তনাদ মসৃণ হল, ডুবে গেল টোরানের অব্যক্ত গর্জনের মাঝে।

    যন্ত্রণাকাতর এক নীরবতা নেমে এল।

    বেইটার মাথা নোয়ানো। এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দুতে আলো লেগে চিকচিক করে উঠল। শিশু বয়সের পর আর কখনো কাঁদেনি বেইটা।

    টোরানের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু সে শিথিল করার চেষ্টা করল না।–মনে হল পরস্পরের সাথে সেঁটে থাকা দাঁতগুলো আর কোনোদিন আলগা করতে পারবে না। ম্যাগনিফিসোর মুখ ফ্যাকাশে, নিষ্প্রাণ।

    শেষ পর্যন্ত চেপে থাকা দাঁতের ফাঁক দিয়ে অচেনা কণ্ঠে বলল টোরান, “তুমি তা হলে মিউলস ওমেন। ও তোমাকে দলে টেনেছে!”

    মাথা তুলল বেইটা। মুখে যন্ত্রণাকাতর কৌতুকের ছাপ, “আমি মিউলস ওম্যান? কী চমৎকার!”

    জোর করে হাসল একটু। চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিল, কণ্ঠস্বরে ফিরে এল প্রায় স্বাভাবিকতা। “সব শেষ, টোরান; এখন বলা যায়। কতদূর রক্ষা করেছি, আমি জানি না। তবে এখন সব খুলে বলা যায়।”

    সম্ভবত প্রচণ্ড চাপের কারণেই টোরানের উত্তেজনা শিথিল হল। “কী বলবে, বে? আর কী বলার আছে?”

    “বলব, যে দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু নিয়ে এসেছে। এর আগেও আমরা ধারণা করেছিলাম। মনে নেই? সব সময় বিপদ আমাদের পিছু লেগেছিল, কিন্তু কীভাবে যেন অল্পের জন্য বেঁচে যাই। আমরা ফাউণ্ডেশন-এ গেলাম-এবং সেটা পরাজিত হল, অথচ স্বাধীন বণিকেরা তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে-কিন্তু হেভেনে যাওয়ার জন্য সময়মতো বেরিয়ে আসতে পারলাম। পৌঁছলাম হেভেনে এবং সেটা পরাজিত হল, কিন্তু আবারো সময়মতো বেরিয়ে আসতে পারলাম। গেলাম নিওট্রানটর এবং কোনো সন্দেহ নেই যে এই মুহূর্তে ওটা মিউলের পক্ষে যোগ দিয়েছে।”

    মাথা নাড়ল টোরান, “বুঝতে পারছি না।”

    “টোরি, এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটে না। তুমি আর আমি অতি সাধারণ মানুষ; এক বছরের মধ্যে আমাদের একটার পর একটা রাজনৈতিক ঝড়ের শিকার হওয়ার কথা না, যদি না সেই ঝড় আমাদের সাথেই থাকে, যদি না জীবাণুর উৎসটাকে আমরা সব সময় কাছে রাখি। এখন বুঝতে পারছো?”

    ঠোঁট দুটো চেপে বসল টোরানের। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহের দিকে, যা এক সময় ছিল মানুষ। অসুস্থ বোধ করল সে।

    “চলো এখান থেকে বেরোই, বে। ভোলা বাতাসে যাই।”

    আকাশে মেঘ জমেছে। ঝড়ো বাতাসে বেইটার চুল এলোমেলো হয়ে গেল। ম্যাগনিফিসো এতক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছিল, এবার পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল তাদের সাথে।

    “এবলিং মিস কে তুমি খুন করেছ, কারণ তোমার ধারণা সেই জীবাণুর উৎস?” বেইটার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কা খেল সে। ফিসফিস করে বলল, “সেই মিউল?” কথাগুলো নিজেরই বিশ্বাস হল না।

    “এবলিং মিউল? গ্যালাক্সি; না! ও মিউল হলে আমি তাকে খুন করতে পারতাম না। আমার অঙ্গভঙ্গি থেকে সহজেই আমার ইমোশন ধরে ফেলত সে, তারপর সেটাকে ভালভাসা, অনুরাগ ভয়, আতঙ্ক যা ইচ্ছা হয় তাই বানিয়ে দিত না। এবলিংকে আমি খুন করি। কারণ সে মিউল না; আমি তাকে খুন করি, কারণ সে জেনে ফেলেছিল সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন কোথায় এবং দুই সেকেণ্ডের মধ্যেই গোপন কথাটা মিউলকে জানিয়ে দিত।

    গোপন কথাটা মিউলকে জানিয়ে দিত,” বোকার মতো পুনরাবৃত্তি করল টোরান। “মিউলকে জানাতো”

    তারপর আর্তনাদ করে তীব্র আতঙ্কে ফিরে তাকাল মিউলের ভাড়ের দিকে যে মাটিতে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, কী নিয়ে আলোচনা চলছে সেই ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন।

    “ম্যাগনিফিসো?”

    “শোন, নিওট্রানটরে কী হয়েছিল মনে আছে? ওহ, একটু ভাবো, টোরি-”

    কিন্তু শুধু মাথা নেড়ে বিড় বিড় করতে লাগল টোরান।

    ক্লান্ত সুরে বলে চলেছে বেইটা, “নিওট্রানটরে একজন মানুষ মারা যায়। অথচ কেউ তাকে স্পর্শ করেনি। তাই না? ভিজি সোনার বাজাচ্ছিল ম্যাগনিফিসো, যখন তার বাজনা শেষ হয় ক্রাউন প্রিন্স তখন মৃত। অদ্ভুত, তাই না? এটা কী অস্বাভাবিক না, যে ক্রিয়েচার জগতের সবকিছুর ভয়ে তটস্থ শুধু ইচ্ছা শক্তি দিয়ে খুন করার ক্ষমতা তার আছে।”

    “লাইট-ইফেক্ট এবং বাজনা দুটোর নিখুঁত ইমোশনাল ইফেক্ট”

    “হ্যাঁ, ইমোশনাল ইফেক্ট। যথেষ্ট বড়। ইমোশনাল ইফেক্ট হচ্ছে মিউলের বিশেষত্ব। দৈবঘটনা হিসেবে ধরে নেওয়া যায় যে সে এরকম ভয়ংকরভাবে খুন করতে পারে। কারণ মিউল তার মাইণ্ড টেম্পার করেছে। কিন্তু টোরান ভিজি-সোনারের যে কম্পোজিশনটা প্রিন্সকে খুন করে সেটার এক ঝলক আমি দেখেছি। সামান্য কিন্তু তাতেই টাইম ভল্টে যে অনুভূতি হয়েছিল সেই রকম অনুভূতি হয়। সীমাহীন হতাশা। টোরান, সেই অনুভূতি চিনতে আমার ভুল হয় না।”

    মেঘ জমল টোরানের মুখে। “আমিও…অনুভব করেছি। মনে ছিল না। কখনো চিন্তাও করিনি-”

    “সেই সময় প্রথম আমার মাথায় চিন্তাটা আসে। একটা অস্পষ্ট অনুভূতি-ইনটুইশন। কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু তারপর প্রিচার এসে মিউল এবং তার মিউট্যাশনের কথা জানায়। মুহূর্তের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে। টাইমভল্টের হতাশা তৈরি করেছিল মিউল; নিওট্রানটরে হতাশা তৈরি করে ম্যাগনিফিসো। সেই একই ইমোশন। কাজেই মিউল আর ম্যাগনিফিসো একই ব্যক্তি। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে না, টোরি? ঠিক যেন জ্যামিতির অনুমিতি। থিংস ইকুয়াল টু সেম থিংস আর ইকুয়াল টু ইচ আদার।”

    হিস্টিরিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু অপরিসীম জোর খাঁটিয়ে নিজেকে আরস্থ করল, “আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। যদি ম্যাগনিফিসোই হয় মিউল, আমার আবেগ সে জানে-এবং নিজের উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারবে। ওকে জানতে দেওয়ার সাহস আমার ছিল না। তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম। সৌভাগ্যক্রমে, সেও আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল; এবলিং মিস এর প্রতি খুব বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। মিস কথা বলার আগেই তাকে খুন করার পরিকল্পনা করি আমি। গোপনভাবে, এতই গোপনভাবে যে নিজেকে বলারও সাহস হয়নি। যদি মিউলকে খুন করতে পারতাম কিন্তু ঝুঁকি ছিল তাতে। ধরা পড়ে যেতাম হয়তো। তখন সব হারাতে হত।”

    কর্কশ গলায় বলল টোরান, “অসম্ভব। ওই অদ্ভুত ক্রিয়েচারটার দিকে দেখো। সে মিউল? আমাদের কথা পর্যন্ত শুনছে না।”

    কিন্তু নির্দেশিত আঙুল অনুসরণ করে যখন তাকাল সে, ম্যাগনিফিসো তখন দৃঢ় সতর্ক, দৃষ্টি ধারালো, গভীর উজ্জ্বল। বাচনভঙ্গি অচেনা, “আমি শুনেছি, বন্ধু। শুধু বসে বসে ভাবছিলাম, এত কৌশলে এবং বুদ্ধি খাঁটিয়ে চমৎকার একটা পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু সামান্য ভুলে কত বড় ক্ষতি হল।”

    হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে এল টোরান, যেন ভয় পাচ্ছে ক্লাউন তাকে স্পর্শ করবে বা তার নিশ্বাস সংক্রামিত হবে।

    মাথা নেড়ে অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দিল ম্যাগনিফিসো, “আমি মিউল।”

    শারীরিক দিক দিয়ে তাকে আগের চেয়ে বিশাল কিছু মনে হল না; কাঠির মতো সরু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, লম্বা নাকের ভাঁজ থেকে শুধু হাস্যকর রূপটা সরে গেছে; তার আচরণ দৃঢ় আরবিশ্বাসী।

    জন্মগত সহজতায় পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে সে।

    প্রশ্রয়ের সুরে বলল সে, “বসুন আপনারা। যেভাবে আরাম বোধ করবেন। খেলা শেষ, আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাবো। আমার একটা দুর্বলতা-আমি চাই মানুষ যেন আমাকে বোঝে।

    এবং যখন সে বেইটার দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি হয়ে গেল আবার কোমল বাদামি; ম্যাগনিফিসো দ্য ক্লাউনের দৃষ্টি।

    “মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা আমার শৈশবে ঘটেনি। হয়তো আপনারা বুঝবেন। আমার অস্বাভাবিক দৈহিক আকৃতি, অদ্ভুত নাক, এসব নিয়েই জন্মাই। আমাকে দেখার আগেই আমার মা মারা যায়। বাবার পরিচয় জানি না। স্বাভাবিক শৈশব আমার জন্য ছিল অসম্ভব। সীমাহীন মানসিক নির্যাতনের মধ্যে আমি বেড়ে উঠতে থাকি, নিজের প্রতি করুণা এবং অন্যের ঘৃণা নিয়ে। তখন থেকেই সবাই আমাকে জানত অস্বাভাবিক বলে। সবাই এড়িয়ে চলত; বেশিরভাগ ঘৃণায়, কিছু কিছু ভয়ে। অদ্ভুত ঘটনা ঘটত-নেভার মাইণ্ড-আমি যে মিউট্যান্ট, এটা বের করতে ক্যাপ্টেন প্রিচারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু নিজে বুঝতে পেরেছিলাম বিশ বছর বয়সে।”

    মেঝেতে বসে কথা শুনছে টোরান আর বেইটা। ম্যাগনিফিসো-বা মিউল পায়চারি করছে তাদের সামনে। বুকের উপর হাত বেঁধে মাথা নিচু করে কথা বলছে।

    “আমার স্বাভাবিক ক্ষমতার ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করি ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি। আমার কাছে মানুষের মাইণ্ড এক ধরনের ডায়াল, ইমোশন চিহ্নিত করার জন্য যে ডায়ালে অনেকগুলো পয়েন্টার আছে। দুর্বল চিত্র, কিন্তু এর চাইতে ভালো ব্যাখ্যা আমি কীভাবে দেব? ধীরে ধীরে শিখলাম যে আমি মানুষের মাইণ্ডে পৌঁছতে পারি এবং পয়েন্টারটাকে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারি। সেখানেই আটকে রাখতে পারি। অন্যেরা এই কাজটা পারে না, সেটা বুঝতে আরো বেশি সময় লেগেছিল।

    “যাই হোক, আমার ক্ষমতার ব্যাপারে আমি সচেতন হয়ে উঠলাম। এবং সেই সাথে প্রথম জীবনের ভোগ করা দুঃসহ যন্ত্রণার ক্ষতি পূরণের ইচ্ছা প্রবল হল। আপনারা হয়তো বুঝবেন। হয়তো বোঝার চেষ্টা করবেন। অদ্ভুত, অস্বাভাবিক হয়ে উঠা কতো কঠিন-যার মন আছে, সে বুঝতে পারে। মানুষের কৌতুককর নিষ্ঠুরতা। অন্যের থেকে আলাদা! বহিরাগত।

    “সেই অভিজ্ঞতা আপনাদের কখনো হয়নি।”

    আকাশের দিকে তাকিয়ে গোড়ালি দিয়ে মেঝেতে তাল ঠুকতে লাগল ম্যাগনিফিসো। “কিন্তু আমি শিখে নিলাম, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি গ্যালাক্সি বদলে দিতে পারি। ওরা ওদের ইনিংস খেলেছে। আর আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি-প্রায় বাইশ বছর। এবার আমার পালা। এবং গ্যালাক্সির জন্য অস্বাভাবিক কিছুই উপযুক্ত! আমি একা! ওরা কোয়াড্রিলিয়ন!”

    থেমে দ্রুত তাকাল একবার বেইটার দিকে। কিন্তু আমার একটা দুর্বলতা ছিল। আমার নিজের কিছু ছিল না। যা পেয়েছি, সব অন্যের হাত দিয়ে মিডলম্যানের মাধ্যমে। সব সময়ই! প্রিচারের কাছে তো শুনেছেনই কীভাবে আজকের অবস্থানে পৌঁছাই। ফাউণ্ডেশন যখন দখল করি-তখনই দৃশ্যপটে আপনাদের আবির্ভাব ঘটে।

    “ফাউণ্ডেশন দখল ছিল আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ। তাকে পরাজিত করার জন্য শাসকশ্রেণীর বিশাল অংশের উপর আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। হালকা পাতলাভাবে করতে পারতাম-কিন্তু সহজ কোনো উপায় নিশ্চয় আছে, সেটাই আমি খুঁজতে লাগলাম। আসলে একজন শক্তিশালী লোক যদি পাঁচ শ পাউণ্ড ওজন তুলতে পারে তার মানে এই না যে সবসময়ই তুলবে। ইমোশনাল কন্ট্রোল বেশ কঠিন। প্রয়োজন ছাড়া আমি এটাকে ব্যবহার করতে চাই না। তাই ফাউণ্ডেশনে হামলা করার আগে আমার মিত্র খুঁজে বের করার প্রয়োজন হয়।

    “ক্লাউনের ছদ্মবেশে, ফাউণ্ডেশন থেকে যেসব এজেন্ট আমার সম্পর্কে খোঁজ, খবর করতে আসে তাদের উপর নজর রাখতে শুরু করি। আমি এখন জানি যে ক্যাপ্টেন হ্যান প্রিচারকেই আমি খুঁজছিলাম। ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাই আপনাদের। আমি একজন টেলিপ্যাথ আর, মাই লেডি, আপনি এসেছিলেন ফাউণ্ডেশন থেকে। ওটাই আমাকে বিপথে পরিচালিত করে। পরে প্রিচারের আমাদের সাথে যোগ দেয়াটা মারারক ছিল না, কিন্তু ঠিক ওই সময় থেকেই আমি মারারক ভুল করা শুরু করি।

    প্রচণ্ড রাগের সাথে বলল টোরান, “দাঁড়াও। কালগানে যখন একটা স্টান্ট পিস্তল নিয়ে লেফটেন্যান্টের মুখোমুখি হয়ে তোমাকে বাঁচাই তখন তুমি আমাকে ইমোশন্যালি কন্ট্রোল করছিলে। অর্থাৎ পুরো সময়ই তুমি আমাকে টেম্পার করে রেখেছ।”

    ম্যাগনিফিসোর মুখে চিকন হাসি। “কেন নয়? আপনার কাছে কী স্বাভাবিক মনে হয়েছে? নিজেকেই প্রশ্ন করুন-স্বাভাবিক অবস্থায় কী আমার মতো অস্বাভাবিক কাঠামোর একজনকে বাঁচানোর জন্য জীবনের উপর ঝুঁকি নিতেন? পরে নিশ্চয়ই বেশ অবাক হয়েছিলেন।”

    “হ্যাঁ, হয়েছিল,” নিরাসক্ত গলায় বলল বেইটা।

    “যাই হোক, টোরানের কোনো বিপদ হত না। লেফটেন্যান্টকে কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল আমাদেরকে যেন ছেড়ে দেয়। আমরা তিনজন এবং প্রিচার চলে আসি ফাউণ্ডেশন এবং দ্রুত আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায় খুঁজতে থাকি। যখন প্রিচারের কোর্ট মার্শাল হচ্ছে, তখন আমরাও ছিলাম সেখানে। আমি ব্যস্ত ছিলাম। ওই বিচার অনুষ্ঠানের সামরিক বিচারকরাই পরে যুদ্ধে স্কোয়াড্রনগুলোর নেতৃত্ব দেয়। খুব সহজেই ওরী আত্মসমর্পণ করে এবং হোরলেগরে আমার নেভি জয়ী হয়।

    “প্রিচার এর মাধ্যমে ড. মিস এর সাথে আমার দেখা হয়। সেই সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় একটা ভিজি সোনার এনে দিয়ে আমার কাজ আরো সহজ করে দেয়।”

    “কনসার্টগুলো!” বাধা দিল বেইটা। “আমি মিলানোর চেষ্টা করছিলাম। এখন বুঝতে পারছি।”

    “হ্যাঁ। ভিজি সোনার একরকম ফোকাসিং ডিভাইস হিসেবে কাজ করে। ইমোশনাল কন্ট্রোলের জন্য এটা আসলেই একটা পুরোনো ডিভাইস। এটা দিয়ে আমি বহুসংখ্যক মানুষকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই। ফাউণ্ডেশন এবং হেভেনে কনসার্টের মাধ্যমেই আমি আসমর্পণের অনুভূতি তৈরি করি।

    “কিন্তু, এবলিং মিস ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সে হয়তো-” একটা হতাশা গ্রাস করল ম্যাগনিফিসোকে, কিন্তু কাটিয়ে উঠল সেটা, “ইমোশনাল কন্ট্রোলের কতগুলো বিশেষ দিক আছে, যা আপনারা জানেন না। ইনটুইশন, দিব্যজ্ঞান যাই বলুন না কেন সবই ইমোশন। আমি তাই মনে করি। বুঝতে পারেননি। তাই না?”

    একটা না বোধক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল, “হিউম্যান মাইণ্ড সর্বনিম্ন ক্ষমতায় কাজ করে। নিজের ক্ষমতার মাত্র বিশ পার্সেন্ট ব্যবহার করে। যখন কেউ তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করে আমরা সেটাকেই বলি ইনটুইশন বা দিব্যজ্ঞান। আমি মানুষের মস্তিষ্ককে সম্পূর্ণ প্রচেষ্টা নিয়োগ করতে উদ্দীপ্ত করতে পারি। যার উপর প্রয়োগ করা হয়, সে মারা যায়, কিন্তু কার্যকরী-নিউক্লিয়ার ফিল্ড-ডিপ্রেসর কালগানের এক টেকনিশিয়ানের উপর এরকম অধিক চাপ প্রয়োগ করে বানিয়েছিলাম।

    “এবলিং মিস এর যোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। ফাউণ্ডেশন-এর সাথে যুদ্ধের অনেক আগেই আমি এম্পায়ারের কাছে প্রতিনিধি পাঠাই-তখনই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন-এর কথা জানতে পারি। তখন থেকেই আমি খুঁজছি। স্বভাবতই পাইনি এবং স্বভাবতই জানি যে আমি পাবই-এবং সমাধান ছিল এবলিং মিস। একটা উঁচু মানের দক্ষ মাইণ্ড থাকাতে সে হয়তো হ্যারি সেলডনের পুরো গবেষণা ডুপ্লিক্যাট করতে পারত।

    “আংশিকভাবে, সে সফল। আমি তাকে সামর্থ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যাই। নিষ্ঠুর কাজ কিন্তু ফলদায়ক। শেষ পর্যন্ত সে মারাই যেত। কিন্তু” আবারো একটা হতাশা বাধা দিল তাকে। “সে যথেষ্ট দিন বেঁচে থেকেছে। আমরা তিনজনে মিলে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনে যেতে পারতাম। এটাই হতে পারত শেষ যুদ্ধ-কিন্তু আমার ভুলের জন্য।”

    কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল টোরান, “তুমি কী ভুল করেছো?”

    “কেন, আপনার স্ত্রী। আপনার স্ত্রী অসাধারণ মানুষ। জীবনে কখনো এমন কারো সাথে দেখা হয়নি। আমি…আমি…” হঠাৎ করেই ম্যাগনিফিসোর কণ্ঠ ভেঙে গেল। আরস্থ হল অনেক কষ্টে। তার চার পাশে একটা আনন্দের আভা। “তার ইমোশন কন্ট্রোল না করলেও সে আমাকে পছন্দ করে। প্রথম দেখায়। আমাকে দেখে সে অবাক হয়নি বা হাসেনি। পছন্দ করে।

    “বুঝতে পারছেন না? বুঝতে পারছেন না আমার কাছে তার অর্থটা কি? এর আগে কেউ-যাই হোক, আমি…সেটা সযত্নে লালন করতে থাকি। তার মাইণ্ড আমি টেম্পার করিনি। মূল অনুভূতি বজায় রাখতে দেই। এটাই আমার ভুল। আমার নিজের ইমোশন আমাকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যেখানে আমি অন্য সকলের মাস্টার।

    “আপনি টোরান সবসময় ছিলেন কন্ট্রোল্ড। অথচ কখনো সন্দেহ করেননি, আমাকে কখনো প্রশ্ন করেননি; আমার ভেতরে অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি। যেমন যখন ‘ফিলিয়ান’ শিপ আমাদের থামায়। ওরা আমাদের অবস্থান জানতো, কারণ আমি সব সময় তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলাম যেমন সব সময় যোগাযোগ ছিল আমার জেনারেলদের সাথে। যখন থামানো হল আমাকে নিয়ে যাওয়া হল হ্যান প্রিচারকে কনভার্ট করার জন্য। যখন বেরিয়ে আসি তখন সে একজন কর্নেল। পুরো ঘটনা আপনার সামনে ঘটে, কিন্তু কিছুই ধরতে পারেননি। আমার ব্যাখ্যা বিনা প্রশ্নে মেনে নেন। বুঝতে পারছেন?

    দাঁত বের করে হাসল টোরান এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল, “জেনারেলদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ রেখেছিলে?”

    “তেমন জটিল কিছু না। হাইপারওয়েভ ট্রান্সমিটার চালানো সহজ এবং পোর্টেবল। আমি ধরাও পড়তাম না। কেউ দেখে ফেললেও তার স্মৃতিতে ঘটনাটা থাকত না।

    “নিওট্র্যানটরে আমার ইমোশন আবার আমার সাথে বেঈমানি করে। বেইটা আমার কন্ট্রোলে ছিল না তারপরেও সন্দেহ করতে পারত না যদি ক্রাউন প্রিন্সের ব্যাপারটা অন্যভাবে সামলাতাম। বেইটার প্রতি তার আচরণ আমাকে রাগিয়ে তোলে। আমি তাকে খুন করি। চরম বোকামি হয়েছে সেটা।

    “এবং এখনো আপনারা সন্দেহ করলেও, নিশ্চিত হতে পারতেন না। যদি আমি প্রিচারের বকবকানি থামিয়ে দিতাম এবং মিস এর দিকে আরেকটু কম মনযোগ দিতাম।” শ্রাগ করল সে।

    “এখানেই শেষ?” জিজ্ঞেস করল বেইটা।

    “এখানেই শেষ।”

    “এবার কী হবে তা হলে?”

    “আমি আমার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদি এবলিং মিস এর মতো বুদ্ধিমান এবং উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আরেকজনকে পাই। নয়তো অন্য কোনোভাবে আমাকে সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন খুঁজে বের করতে হবে। একদিক দিয়ে আপনারা আমাকে পরাজিত করেছেন।”

    এবার উঠে দাঁড়াল বেইটা, বিজয়িনীর মতে, “একদিক দিয়ে? শুধু একদিক দিয়ে। আমরা তোমাকে পুরোপুরি পরাজিত করেছি। ফাউণ্ডেশন-এর বাইরে তোমার বিজয়গুলোর কোনো মূল্য নেই। ফাউণ্ডেশন-এর দখলটাও খুব সামান্য বিজয়, কারণ তাতে তোমার সমস্যাগুলো কমছে না। তোমাকে অবশ্যই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন পরাজিত করতে হবে-এবং এই সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনই তোমাকে পরাজিত করবে। তোমার একমাত্র সুযোগ হচ্ছে হামলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই সেটাকে খুঁজে বের করে নিঃশেষ করে দেওয়া। কিন্তু তুমি পারবে না। এখন থেকে প্রতি মুহূর্তে তারা তোমার জন্য তৈরি হতে থাকবে। এই মুহূর্তে, এই মুহূর্ত থেকেই হয়তো কাজ শুরু হয়ে গেছে। বুঝতে পারবে-যখন তারা আক্রমণ করবে। তোমার স্বল্প দিনের ক্ষমতা শেষ। তুমি ইতিহাসের পাতায় একজন রক্তলোলুপ হানাদার ছাড়া আর কিছুই না।”

    জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সে, প্রায় হাঁপানোর মতো, “আমরা তোমাকে পরাজিত করেছি, আমি আর টোরান। এখন আমি মরলেও খুশি।”

    কিন্তু মিউলের বিষণ্ণ চোখগুলো আবার ম্যাগনিফিসোর অনুরক্ত বাদামি চোখে পাল্টে গেছে। “আমি আপনাকে বা আপনার স্বামীকে মারব না। আমাকে আঘাত করাও আপনাদের পক্ষে অসম্ভব। আর আপনাদের মেরে ফেললেও এবলিং মিস ফিরে আসবে না। আমার ভুলের দায় বহন করতে হবে আমাকেই। আপনি আর আপনার স্বামী যেতে পারেন। নির্বিঘ্নে চলে যান, আমি যাকে বলি-বন্ধুত্ব-সেই খাতিরে।”

    তারপর হঠাৎ গর্বের সুরে বলল, “কিন্তু আমি এখনো মিউল। গ্যালাক্সির সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। এখনো আমি সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করতে পারি।”

    শান্ত শীতল দৃঢ়তার সাথে শেষ তীরটা ছুঁড়ে দিল বেইটা, “তুমি পারবে না। সেলডনের উপর এখনো আমার বিশ্বাস আছে। তুমি তোমার ডাইন্যাস্টির প্রথম এবং শেষ শাসক।

    নতুন একটা চিন্তা আঁকড়ে ধরল ম্যাগনিফিসোকে। “আমার ডাইন্যাস্টি? হ্যাঁ, কথাটা অনেকবারই ভেবেছি যে আমি একটা ডাইন্যাস্টি তৈরি করব।”

    তার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বরফের মতো জমে গেল বেইটা। মাথা নাড়ল ম্যাগনিফিসো, “কী ভাবছেন বুঝতে পারছি। অকারণ ভয় পাচ্ছেন। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে আমি খুব সহজেই আপনাকে সুখী করতে পারতাম। হয়তো কৃত্রিম, কিন্তু আসল ইমোশনের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যরকম না। আমি নিজেকে বলি মিউল-কিন্তু সেটা আমার ক্ষমতার কারণে না-অবশ্যই।”

    সে চলে গেল। পিছন ফিরে তাকাল না।

    -: শেষ :-

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ
    Next Article টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নাজমুছ ছাকিব

    সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফরওয়ার্ড দ্য ফাউণ্ডেশন – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    ফাউণ্ডেশন্স এজ – আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    নাজমুছ ছাকিব

    প্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন -আইজাক আসিমভ

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.