Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল – মিচিও কাকু

    মিচিও কাকু এক পাতা গল্প488 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৩. সমান্তরাল মহাবিশ্ব

    ‘কিন্তু স্যার, আপনি কি সত্যিই বোঝাতে চাচ্ছেন যে এই জায়গার ওই পাশে, মানে ওই প্রান্তে এ রকম আরও অন্য মহাবিশ্বও থাকতে পারে?’, পিটার বলল।

    প্রফেসর বিড়বিড় করে বললেন, ‘এর চেয়ে বড় সম্ভাবনা আর কী হতে পারে। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, স্কুলে তারা কী শেখায়।’

    –সি এস লুইস, দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ডরোব

    শুনুন : দরজার ওপাশের একটা ভালো মহাবিশ্বের এক নরক আছে; চলুন যাই।

    –ই ই কানিংমস

    বিকল্প কোনো মহাবিশ্ব থাকা কি সত্যিই সম্ভব? হলিউডের স্ক্রিপ্টরাইটারের জন্য প্রিয় একটি হাতিয়ার আছে। স্টার ট্রেকের মতো ধারাবাহিকে তাকে বলা হয় ‘মিরর, মিরর’। দুর্ঘটনাক্রমে একবার অদ্ভুত এক প্যারালাল ইউনিভার্সে পাঠানো হয়েছিল ক্যাপ্টেন কার্ককে। সেখানে ফেডারেশন অব প্ল্যানেটের অশুভ সাম্রাজ্য দখল করেছিল নৃশংস বিজয় আর লোভ ও লুটপাটের মাধ্যমে। ওই মহাবিশ্বে স্পুক ভয়ংকরদর্শন এক দাড়ি পরেছিল। আর সাংঘাতিক এক দস্যু দলের নেতায় পরিণত হন ক্যাপ্টেন কার্ক। প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমিয়ে ও তাদের শীর্ষ নেতাদের গুপ্তহত্যা করে ধীরে ধীরে তারা সামনে এগিয়ে যায়।

    বিকল্প মহাবিশ্বের কারণে আমরা অনুসন্ধান করতে পারি, মহাবিশ্বের ‘এমন যদি হতো’ ও এর মনোরম, মজার সম্ভাবনাগুলো। যেমন সুপারম্যান কমিকসে অনেকগুলো বিকল্প মহাবিশ্ব আছে। সেখানে সুপারম্যানের নিজের গ্রহ ক্রিপ্টন কখনো ধ্বংস হয় না। কিংবা সুপারম্যান শেষ পর্যন্ত ভদ্রগোছের ক্ল্যার্ক কেন্ট হিসেবে তার সত্যিকার পরিচয় উদ্ঘাটন করতে পারে। অথবা সে লুইস ল্যানকে বিয়ে করে আর তাদের সুপার বাচ্চাকাচ্চা হয়। প্রশ্ন হলো, সমান্তরাল মহাবিশ্ব কি শুধু টোয়ালাইট জোন-এ বর্ণিত কাল্পনিক কোনো রাজ্য, নাকি আধুনিক পদার্থবিদ্যায় তার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে?

    ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, প্রাচীন প্রায় সব সমাজে ঈশ্বর বা প্রেতাত্মাদের বাসস্থান হিসেবে অন্য স্থানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত মানুষ। খ্রিষ্টীয় চার্চ স্বর্গ, নরক ও প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাস করে। নির্বাণে ও বিভিন্ন ধরনের সচেতনতায় বিশ্বাস করে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা। অন্যদিকে হাজারো স্থানের অস্তিত্বে বিশ্বাস হিন্দুদের।

    স্বর্গের অবস্থান সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ববিদদের ধারণা, ঈশ্বর হয়তো উচ্চতর মাত্রার কোনো স্থানে থাকেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, উচ্চতর মাত্রার অস্তিত্ব যদি থাকে, তাহলে ঈশ্বরের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের হয়তো সহজ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বহুবিধ মাত্রার কোনো সত্ত্বা ইচ্ছেমতো অদৃশ্য ও আবির্ভূত হতে পারে, কিংবা দেয়ালের ভেতর দিয়ে হেঁটে অন্য পাশে চলে যেতে পারে। এসব ক্ষমতা সাধারণত ঈশ্বরের ওপর আরোপ করা হয়।

    সম্প্রতি প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারণাটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে অন্যতম বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ‘বাস্তবতা’ আসলে কী, তার অর্থ আবারও বিবেচনার ব্যাপারে জোর দেয় বিভিন্ন ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্স। বিভিন্ন প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে এই বিতর্কের বাজি আসলে খোদ বাস্তবতার অর্থই প্রকাশ করে।

    বিজ্ঞানে বর্তমানে অন্তত তিন ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে জোর আলোচনা করা হয় :

    ১. হাইপারস্পেস বা উচ্চতর মাত্রা

    ২. মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব ও

    ৩. কোয়ান্টাম প্যারালাল ইউনিভার্স বা কোয়ান্টাম সমান্তরাল মহাবিশ্ব

    হাইপারস্পেস

    যে প্যারালাল ইউনিভার্স দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি হলো উচ্চতর মাত্রার। আমাদের সাধারণ জ্ঞান অনুযায়ী, আমরা ত্রিমাত্রিক (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা) বিশ্বে বসবাস করি। স্থানের মধ্যে কোনো বস্তুকে আমরা কীভাবে নড়াচাড়া করছি, তা এখানে ধর্তব্যের বিষয় নয়। এখানে সব অবস্থানকে ব্যাখ্যা করা যায় মাত্র তিনটি স্থানাঙ্ক দিয়ে। আসলে এ তিনটি মাত্র সংখ্যা দিয়ে আমাদের নাকের ডগা থেকে শুরু করে দূরতম ছায়াপথসহ যেকোনো বস্তুকে মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গার অবস্থান চিহ্নিত করা যায়।

    চতুর্থ স্থানিক মাত্রা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খায় না বলে মনে করা হয়। ধরা যাক, কোনো ঘরে যদি ধোঁয়া ভরে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে ওই ধোঁয়া অন্য কোনো মাত্রায় অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা যায় না। মহাবিশ্বের কোথাও কোনো বস্তু হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে কিংবা অন্য মহাবিশ্বে সেটা উদয় হতেও দেখা যায় না। এর মানে, যেকোনো উচ্চতর মাত্রা যদি সত্যিই থাকে, তাহলে তা অবশ্যই পরমাণুর চেয়েও অনেক ছোট।

    তিনটি স্থানিক মাত্রাই গ্রিক জ্যামিতির মৌলিক ভিত্তি তৈরি করেছে। যেমন অ্যারিস্টটল তাঁর রচনা ‘অন হেভেন’-এ লিখেছেন, ‘রেখা এক দিকে বিস্তৃত হয়, তলের বিস্তৃতি দুই দিকে আর ঘনকের তিন দিকে। আর এই বাইরে অন্য কোনো বিস্তৃতি বা মাত্রা নেই। কারণ, এই তিনটিই সব। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার টলেমি প্রথম প্রমাণ করেন, উচ্চতর মাত্রা থাকা অসম্ভব। তাঁর রচনা ‘অন ডিসটেন্স’-এ এ-সম্পর্কিত যুক্তিটি দেখান তিনি। সেটি ছিল এ রকম : তিনটি রেখা আঁকুন, যারা পরস্পরের ওপর লম্ব (কোনো ঘরের কোনায় রেখা গঠন করার মতো)। তিনি বলেন, স্পষ্টত অন্য তিনটির ওপর চতুর্থ কোনো লম্বরেখা আঁকা সম্ভব নয়। কাজেই চতুর্থ মাত্রা থাকাও অসম্ভব। (তিনি আসলে প্রমাণ করেছেন যে আমাদের মস্তিষ্ক চতুর্থ মাত্রার দৃশ্যমান করে তুলতে অক্ষম। মজার ব্যাপার হলো, আপনার ডেস্কের পিসি সব সময় হাইপারস্পেসে গণনা করে।)

    প্রায় দুই হাজার বছর ধরে, যেসব গণিতবিদ চতুর্থ মাত্রা থাকার সম্ভাবনা দিয়ে কথা বলার দুঃসাহস দেখাতেন, তাঁরাই উপহাসের শিকার হতেন। ১৮৬৫ সালে চতুর্থ মাত্রার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করেন গণিতবিদ জন ওয়ালিস। একে প্রকৃতির দানব হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। গ্রিক দানব কাইমেরা বা সেন্টর চেয়েও এর থাকার সম্ভাবনা কম বলে মনে করতেন ওয়ালিস। উনিশ শতকে গণিতবিদদের রাজপুত্র নামে পরিচিত কার্ল গাউস চতুর্থ মাত্রার গণিতের অনেকাংশ নির্ণয় করলেও তা প্রকাশ করতে ভয় পান। চতুর্থ মাত্রার কারণে প্রবল প্রতিক্রিয়া হবে বলে তা নিয়ে ভীত ছিলেন তিনি। তবে সমতল, ত্রিমাত্রিক গ্রিক জ্যামিতি সত্যি সত্যি মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে কি না, তা গোপনে পরীক্ষা করে দেখেন গাউস। পরীক্ষার জন্য তাঁর সহকারীদের তিনটি পাহাড়চূড়ায় পাঠান তিনি। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটি করে লন্ঠন। এভাবে অনেক বড় এক ত্রিভুজ তৈরি হয়। গাউস এরপর ওই ত্রিভুজের প্রতিটি প্রান্তের কোণ মাপেন। অভ্যন্তরীণ বা অন্তঃস্থ সব কোণ যোগ করে ১৮০ ডিগ্রি হতে দেখে তিনি যারপরনাই হতাশ হন। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, গ্রিক জ্যামিতির যদি বিচ্যুতি ঘটেও থাকে, তাহলে সেগুলো অবশ্যই এত ক্ষুদ্র হবে যে, লন্ঠন দিয়ে তা শনাক্ত করা যায়নি।

    উচ্চতর মাত্রার মৌলিক গণিত লেখার দায়িত্ব গাউস তাঁর ছাত্র জর্জ বার্নার্ড রিম্যানের ওপর ছেড়ে দেন (কয়েক দশক পর এটাই আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে আমদানি করা হয়েছিল)। রিম্যান যেন একঝটকায় দুই হাজার বছরের গ্রিক জ্যামিতিকে উল্টেপাল্টে দিলেন। ১৮৫৪ সালে আলোচিত এক বক্তৃতায় সেটি উপস্থাপন করেন তিনি। এভাবে রিম্যান উচ্চতর, বক্র মাত্রার মৌলিক গণিত প্রতিষ্ঠা করেন। এই গণিত আমরা আজও ব্যবহার করি।

    ১৮০০-এর দশকের শেষ দিকে রিম্যানের অসাধারণ এই আবিষ্কার ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, লেখক, দার্শনিক ও চিত্রশিল্পীদের কাছে চতুর্থ মাত্রা বেশ আলোড়ন তোলে। সত্যি বলতে কি, পিকাসোর কিউবিজম চতুর্থ মাত্রার মাধ্যমে আংশিক অনুপ্রাণিত। চিত্রশিল্প ইতিহাসবিদ লিন্ডা ডালরিম্পল হেন্ডারসন এমনই মনে করেন। (পিকাসোর আঁকা ছবিতে নারীদের চোখ সামনের দিকে আর নাক পাশে রেখে আসলে চতুর্থমাত্রিক দৃষ্টিকোণ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ চতুর্থ মাত্রা নিচ থেকে দেখা হলে নারীর মুখ, নাক ও কান মাথার পেছনটা একই সঙ্গে দেখা সম্ভব।) হেন্ডারসন লিখেছেন, ‘কৃষ্ণগহ্বরের মতো চতুর্থ মাত্রারও রহস্যময় গুণাগুণে আচ্ছন্ন, যা পুরোপুরি বোঝা যায় না। বিজ্ঞানীরাও তার পুরোটা বোঝেন না। তবু ১৯১৯ সালের পর আপেক্ষিক তত্ত্ব বাদে কৃষ্ণগহ্বর বা অন্য কোনো সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিসের চেয়ে চতুর্থ মাত্রার প্রভাব অনেক বেশি বোধগম্য।’

    অন্য চিত্রশিল্পীরাও চতুর্থ মাত্রা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ছবি এঁকেছেন। সালভাদর দালির কর্পাস হাইপারকিউবিকাস ছবিতে এক মঞ্চের সামনে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে ক্রুশটি ত্রিমাত্রিক ও ভাসমান। এটি আসলে একটি টেসারক্ট, অর্থাৎ একটি পাক খোলা চতুর্থমাত্রিক ঘনক। তাঁর বিখ্যাত পারসিস্ট্যান্স অব মেমোরি ছবিতে তিনি সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। সে জন্য গলিত ঘড়িগুলোকে ব্যবহার করেছেন রূপক হিসেবে। মার্সেল ডুকাম্পের ‘ন্যুড ডিসেন্ডিং আ স্টেয়ারকেস’ শিরোনামের ছবিটি আঁকা হয়েছে সময়কে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে উপস্থাপন করে। এখানে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নেমে যাওয়া এক নগ্নিকার ছবি আঁকা হয়েছে টাইম ল্যাপস মোশন ব্যবহার করে। অস্কার ওয়াইল্ডের গল্প ‘দ্য ক্যান্টারভিল গোস্ট’তেও চতুর্থ মাত্রা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একটি বাড়িতে হানা দেওয়া এক ভূতকে চতুর্থ মাত্রায় বসবাস করতে দেখা যায় এ গল্পে।

    এইচ জি ওয়েলসের বেশ কয়েকটি গল্পে চতুর্থ মাত্রার বিষয়টি এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘ইনভিজিবল ম্যান, দ্য প্ল্যাটনার স্টোরি আর দ্য ওয়ান্ডার ভিজিট।’ (আমাদের মহাবিশ্ব অন্য এক সমান্তরাল মহাবিশ্বের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়েছে—এটি পরবর্তীকালে হলিউডের চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি উপন্যাসের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। একবার দুর্ঘটনাক্রমে এক শিকারির গুলি খেয়ে অন্য মহাবিশ্ব থেকে এক দেবদূত আমাদের মহাবিশ্বে পড়ে যায়। আমাদের মহাবিশ্বের সব ধরনের লোভ, লালসা আর স্বার্থপরতা দেখে হতাশ হয়ে একসময় দেবদূতটি আত্মহত্যা করে।

    সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা কৌতুককর করে তুলে ধরেছেন রবার্ট হেনলিন দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট বইয়ে। সমান্তরাল মহাবিশ্বে এক উন্মাদ অধ্যাপকের আন্তমাত্রিক স্পোর্টস কারে চড়ে ঘুরে বেড়ানো চার সাহসী ব্যক্তির দলকে এখানে চিত্রিত করেছেন হেনলিন।

    টিভি সিরিজ স্লাইডার-এ এক ছোট ছেলে একটি বই পড়ে এমন একটি যন্ত্র বানানোর অনুপ্রেরণা পায়, যার মাধ্যমে সে সমান্তরাল মহাবিশ্বে যেতে সক্ষম হয়। (মজার ব্যাপার হলো, বইটিতে ছোট্ট ছেলেটি যে বই পড়েছিল, সেটি ছিল আমার লেখা হাইপারস্পেস।)

    তবে ঐতিহাসিকভাবে চতুর্থ মাত্রা নিয়ে পদার্থবিদদের আগ্রহ ছিল খুব সামান্যই। কারণ, উচ্চতর মাত্রার এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এ অবস্থা বদলে যায় ১৯১৯ সালে পদার্থবিদ থিওডর কালুজার অতিমাত্রায় বিতর্কিত এক গবেষণাপত্র লেখার পর। উচ্চতর মাত্রা থাকার ইঙ্গিত দেওয়া হয় এই গবেষণাপত্রে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব দিয়ে শুরু করলেও তিনি একে পাঁচ মাত্রায় বসিয়ে দেখান (সময়ের জন্য এক মাত্রা ও স্থানের জন্য মাত্রা চারটি। কারণ, স্থান-কালের মাত্রায় সময় চতুর্থ মাত্রা। পদার্থবিদেরা এখন চতুর্থ স্থানিক মাত্রাকে পঞ্চম মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করেন)। পঞ্চম মাত্রা যদি ছোট থেকে ছোট হতে থাকে, তাহলে সমীকরণগুলো বিস্ময়করভাবে দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। এর এক খণ্ড আইনস্টাইনের প্রমিত আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, অন্যদিকে অন্য খণ্ডটি হয়ে যায় ম্যাক্সওয়েলের আলোর তত্ত্ব!

    এটি ছিল বিস্ময়কর এক উদ্ঘাটন। হয়তো আলোর গুপ্ত রহস্য লুকিয়ে আছে এই পঞ্চম মাত্রায়। খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধানে আঁতকে ওঠেন। এ সমাধানে আলো আর মহাকর্ষের মার্জিত একত্রকরণের জোগান দেয় বলে মনে করা হয়েছিল। (কালুজার প্রস্তাবে আইনস্টাইন এতটাই ধাক্কা খেয়েছিলেন যে তিনি দীর্ঘ দুই বছর গবেষণাপত্রটি ঝুলিয়ে রাখেন। অবশেষে এটি প্রকাশের অনুমতি দেন তিনি। এক চিঠিতে আইনস্টাইন কালুজাকে লেখেন, ‘একটি পাঁচ মাত্রিক সিলিন্ডার মহাবিশ্বের মাধ্যমে [একটি একীভূত তত্ত্ব] অর্জনের এই ধারণা আমার মাথাতেও কখনো আসেনি। প্রথম দর্শনে, আপনার ধারণাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কারণ, আপনার তত্ত্বের আনুষ্ঠানিক ঐক্য বিস্ময়কর।’

    অনেক বছর ধরে পদার্থবিদেরা প্রশ্ন করে আসছেন : আলো যদি তরঙ্গ হয়, তাহলে তরঙ্গায়িত বিষয়টি কী? শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে আলো বিলিয়ন আলোকবর্ষ পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু শূন্যস্থান হলো ভ্যাকুয়াম, সেখানে কোনো বস্তু থাকে না। তাহলে ভ্যাকুয়ামের মধ্যে তরঙ্গায়িত ঢেউ আসলে কী? কালুজার তত্ত্বে এ সমস্যার জোরালো এক উত্তর পেয়েছি আমরা। এ তত্ত্বমতে, আলো হলো পঞ্চম মাত্রায় আন্দোলন বা ঢেউ। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো আলোর সব ধর্ম সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে। পঞ্চম মাত্রায় তরঙ্গের চলাচলের ক্ষেত্রেও এ সমীকরণগুলো প্রকাশ করতে পারে বেশ সহজভাবে।

    কল্পনা করুন, একটি অগভীর পুকুরে মাছ সাঁতার কাটছে। তারা হয়তো তৃতীয় মাত্রার উপস্থিতি কখনোই বুঝতে পারে না; কারণ, তাদের চোখ পাশের দিকে বসানো। তারা শুধু সামনে ও পেছনে আর বাঁ ও ডানে সাঁতার কাটতে পারে। তাদের কাছে তৃতীয় মাত্রা অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু ধরা যাক, পুকুরটিতে বৃষ্টি হচ্ছে। তারা তৃতীয় মাত্রা দেখতে না পেলেও পুকুরের পৃষ্ঠতলে ঢেউয়ের ছায়া স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে। একইভাবে পঞ্চম মাত্রায় আলোর ঢেউয়ের চলাচল হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে কালুজা তত্ত্ব।

    আবার পঞ্চম মাত্রা কোথায় আছে, তার উত্তরও দিয়েছেন কালুজা। আমরা যেহেতু পঞ্চম মাত্রার কোনো প্রমাণ দেখতে পাই না, কাজেই মাত্রাটি অবশ্যই কুঁকড়ে এতই ছোট হয়ে আছে যে, তা পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। (একটি দ্বিমাত্রিক পাতলা কাগজের টুকরো নিন। এরপর একে গোল করে একটি সিলিন্ডার বানান। দূর থেকে এই সিলিন্ডার দেখতে একমাত্রিক রেখার মতো দেখায়। এভাবে একটি দ্বিমাত্রিক বস্তু কুঁকড়ে একমাত্রিক বস্তুতে পরিণত হয়।)

    কালুজার গবেষণাপত্র শুরুতে বেশ একটা উত্তেজনার জন্ম দেয়। কিন্তু পরের বছরগুলোতে বেশ কিছু আপত্তি উঠতে থাকে তাঁর তত্ত্ব নিয়ে। নতুন এই পঞ্চম মাত্রার আকার কত? এটা কীভাবে কুঁকড়ে গেল? এর উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।

    অনেক দশক ধরে থেমে থেমে এই তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন আইনস্টাইন। ১৯৫৫ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তত্ত্বটি বেশ দ্রুতই বিস্মৃতির অতলে চলে যায়। এরপর তা পদার্থবিজ্ঞানের বিবর্তনের ইতিহাসে কেবল অদ্ভুত এক পাদটীকায় পরিণত হয়।

    স্ট্রিং থিওরি

    অবশ্য এই সবকিছুই বদলে গিয়েছিল সুপারস্ট্রিং থিওরি নামে চমকপ্রদ নতুন এক তত্ত্ব হাতে আসার পর। ১৯৮০-এর দশকে পদার্থবিদেরা সাব-অ্যাটমিক বা অতিপারমাণবিক কণা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। প্রতিবার তাঁরা একটি পরমাণুকে শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণা ত্বরকযন্ত্রের মাধ্যমে ভাঙতে গিয়ে নতুন নতুন আরও অনেক কণা খুঁজে পাচ্ছিলেন। এটি হতাশাজনক বিষয়ে পরিণত হয়। তাই জে রবার্ট ওপেনহাইমার শেষমেশ ঘোষণা দিয়ে বসেন, পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার এই বছর সেই পদার্থবিদকে দেওয়া হবে, যিনি নতুন কোনো কণা আবিষ্কার করবেন না। (গ্রিক-ধ্বনি যুক্ত অতিপারমাণবিক কণার বিস্তৃতি দেখে খোদ এনরিকো ফার্মিও আতঙ্কিত হয়েছিলেন। সে কারণে তিনি বলেন, ‘আমি যদি সবগুলো কণার নাম মনে রাখতে পারতাম, তাহলে নির্ঘাত আমি উদ্ভিদবিজ্ঞানী হয়ে যেতাম।’) কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রমের পর কণাদের এই চিড়িয়াখানাকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল সাজানো সম্ভব হয়। বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ ব্যয়ে, হাজার হাজার প্রকৌশলী ও পদার্থবিদের ঘাম আর ২০টি নোবেল পুরস্কার বেদনাদায়কভাবে জড়ো করার বিনিময়ে টুকরো টুকরোভাবে গড়ে ওঠে স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল। সত্যিই অসাধারণ তত্ত্ব এটি, যা অতিপারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান-সম্পর্কিত সব কটি পরীক্ষামূলক তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে খাপ খায়।

    কিন্তু সব কটি পরীক্ষামূলক সাফল্য থাকার পরও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের গুরুতর এক ত্রুটি রয়ে গেছে। স্টিফেন হকিং এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটি বিশ্রী আর সাময়িক।’ এতে অন্তত ১৯টি মুক্ত প্যারামিটার (ধ্রুবকবিশেষ) আছে (এর মধ্যে কণার ভর ও অন্য কণাদের সঙ্গে তাদের আন্তক্রিয়ার শক্তি ও রয়েছে)। আরও আছে ৩৬টি কোয়ার্ক ও প্রতি-কোয়ার্ক, উপকণার তিনটি হুবহু ও অনাবশ্যক কপি আর অদ্ভুত নামধারী কিছু অতিপারমাণবিক কণা। এসব অতিপারমাণবিক কণার মধ্যে রয়েছে টাউ নিউট্রিনো, ইয়াং-মিলস গ্লুয়ন, হিগস বোসন, ডব্লিউ বোসন ও জেড কণা। সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটি হলো, স্ট্যান্ডার্ড মডেল মহাকর্ষ নিয়ে কিছুই বলে না। প্রকৃতি তার সর্বোচ্চ ও মৌলিক স্তরে এতটা এলোমেলো আর চরমভাবে শ্রীহীন হতে পারে, সেটা বিশ্বাস করাও শক্ত। এমন কোনো তত্ত্বকে শুধু এর জন্মদাতাই ভালোবাসতে পারে। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পুরোদস্তুর শ্রীহীন প্রকৃতি সম্পর্কে সব কটি অনুমান নতুন করে বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হয়েছেন পদার্থবিদেরা। আর কিছু কিছু ছিল ভয়ানকভাবে ভুল।

    পদার্থবিজ্ঞানের গত কয়েক শতাব্দী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গত শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোকে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি অসাধারণ তত্ত্বে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এর একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব (যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়) এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (যা মহাকর্ষের ব্যাখ্যা দেয়)। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এ তত্ত্ব দুটি একত্রে মৌলিক পর্যায়ে সব ভৌত জ্ঞানের সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম তত্ত্বটি খুবই ছোট জগৎ ব্যাখ্যা করে, অর্থাৎ অতিপারমাণবিক কোয়ান্টাম জগৎ। এখানে কণাগুলো দারুণ নৃত্য প্রদর্শন করে, অস্তিত্বে যখন-তখন আসে-যায় আর একই সময়ে দুটি জায়গায় উদয়ও হয়। অন্যদিকে বৃহৎ জগৎ ব্যাখ্যা করে দ্বিতীয় তত্ত্বটি। যেমন ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর আর বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। মসৃণ পৃষ্ঠতল, প্রসারিত নকশা ও বক্র পৃষ্ঠতলের ভাষা ব্যবহার করে তত্ত্বটি। তত্ত্ব দুটি সব দিক দিয়েই পরস্পরের বিপরীত। কারণ, তারা ভিন্ন ধরনের গণিত ব্যবহার করে, ভবিষ্যদ্বাণী করে ভিন্ন ধরনের, একই সঙ্গে উপস্থাপন করে ভিন্ন ধরনের ভৌত চিত্র। বিষয়টি এমন যেন প্রকৃতির দুটি হাত। কিন্তু হাত দুটি পরস্পরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রক্ষা করে না। আবার তত্ত্ব দুটি একত্রকরণের সব রকম চেষ্টা করতে গিয়ে অর্থহীন সব উত্তর পাওয়া গেছে। অর্ধশতাব্দী ধরে পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মধ্যে বন্দুকের মুখে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা দেখেছেন, নতুন তত্ত্বের তোড়ে খোদ তাঁদেরই চোখমুখ উড়ে গেছে। কারণ, এর মাধ্যমে এমন সব অসীম উত্তর পাওয়া যায়, সাধারণভাবে যার কোনো অর্থই হয় না।

    অবশ্য সুপারস্ট্রিং তত্ত্বের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এসব বদলে যায়। এ তত্ত্ব অনুসারে, ইলেকট্রন ও অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণা একটি স্ট্রিং বা সুতার কম্পন ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সুতাগুলো অতি ক্ষুদ্র এক রাবার ব্যান্ডের মতো আচরণ করে। রাবার ব্যান্ডে আঘাত করলে তা বিভিন্নভাবে কম্পিত হয়। আর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কম্পনের প্রতিটি বিভিন্ন অতিপারমাণবিক কণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এভাবেই আমাদের কণা ত্বরকযন্ত্রে পাওয়া শত শত অতিপারমাণবিক কণাকে ব্যাখ্যা করে সুপারস্ট্রিং থিওরি। এদিকে আইনস্টাইনের তত্ত্ব আসলে স্ট্রিংয়ের অন্যতম সর্বনিম্ন কম্পনের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

    স্ট্রিং থিওরিকে থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিংবদন্তিতুল্য এই সার্বিক তত্ত্বের খোঁজে আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ ৩০টি বছর ব্যর্থভাবে হাতড়ে বেড়িয়েছেন। একক ও সমন্বিত এমন এক তত্ত্ব চেয়েছিলেন আইনস্টাইন, যা পদার্থবিদ্যার সব সূত্রকে সংক্ষিপ্ত করতে পারবে। আবার যে তত্ত্ব দিয়ে ঈশ্বরের মন পড়ার সুযোগ পাবেন তিনি। মহাকর্ষের সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্বের একীভূত করার ক্ষেত্রে স্ট্রিং থিওরি যদি সঠিক হয়, তাহলে এটি সম্ভবত বিজ্ঞানের চরম অর্জনে পরিণত হবে। দুই হাজার বছর আগে গ্রিকরা প্রশ্ন করেছিল, বস্তু কী দিয়ে তৈরি—এর মধ্য দিয়ে হয়তো তার জবাব পাওয়া যাবে।

    তবে সুপারস্ট্রিং থিওরি উদ্ভট বৈশিষ্ট্যটি হলো, এই স্ট্রিং বা সুতাগুলো স্থান- কালের শুধু নির্দিষ্ট মাত্রাতে কম্পিত হতে পারে। অর্থাৎ সুতাগুলো কম্পিত হতে পারে শুধু ১০ মাত্রাতে। অন্য কোনো মাত্রায় কেউ যদি স্ট্রিং থিওরি গঠনের চেষ্টা করে, তাহলে তত্ত্বটি গাণিতিকভাবে ভেঙে পড়ে বা অকার্যকর হয়ে যায়।

    আমাদের মহাবিশ্ব অবশ্যই চতুর্থমাত্রিক (যার তিনটি স্থানিক মাত্রা ও একটি সময়ের মাত্রা)। এর মানে, অন্য ছয়টি মাত্রা অতি অবশ্যই কোথাও না কোথাও চুপসে বা কুঁকড়ে গেছে, ঠিক কালুজার পঞ্চম মাত্রার মতো।

    এসব উচ্চতর মাত্রা আছে নাকি নেই, তা প্রমাণ করতে সম্প্রতি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে শুরু করেছেন পদার্থবিদেরা। উচ্চতর মাত্রাগুলো থাকার প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হতে পারে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের বিচ্যুতি খুঁজে বের করা। আমরা হাইস্কুলে শিখেছি, বাইরের মহাকাশে যতই যাওয়া যায় পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বা মহাকর্ষ ততই কমতে থাকে। আরও সঠিকভাবে বললে, দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে মহাকর্ষ কমতে থাকে। কিন্তু এর একমাত্র কারণ হলো আমরা একটি ত্রিমাত্রিক বিশ্বে বাস করি। (পৃথিবীর চারপাশে একটি গোলকের কথা কল্পনা করুন। গোলকের পৃষ্ঠতলে পৃথিবীর মহাকর্ষ সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাই গোলকটি যত বড় হবে, মহাকর্ষও দুর্বল হবে তত। কিন্তু গোলকের পৃষ্ঠতল যেহেতু তার ব্যাসার্ধের বর্গের অনুপাতে বাড়ে, তাই গোলকের পৃষ্ঠতলে যখন মহাকর্ষের শক্তি ছড়াবে, তখন তা অবশ্যই গোলকের ব্যাসার্ধের বর্গের অনুপাতে কমে যাওয়ার কথা।

    কিন্তু মহাবিশ্বের যদি চারটি স্থানিক মাত্রা থাকে, তাহলে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাকর্ষ কমা উচিত কিউব বা ঘনক হিসেবে। অন্যদিকে মহাবিশ্বের স্থানিক মাত্রাসংখ্যা যদি n হয়, তাহলে মহাকর্ষ কমে যাওয়ার কথা n-1 পাওয়ার বা ঘাত হিসেবে। নিউটনের বিখ্যাত বিপরীত বর্গীয় সূত্র অসাধারণ নির্ভুলতায় মহাকাশীয় দূরত্বে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সে কারণে আমরা অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে শনি গ্রহের বলয়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার মতো মহাকাশ অনুসন্ধান যান পাঠাতে পেরেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের আগ পর্যন্ত নিউটনের বিপরীত বর্গীয় সূত্র গবেষণাগারে ছোট দূরত্বে কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।

    ছোট দূরত্বে বিপরীত বর্গীয় সূত্র প্রথম পরীক্ষা করা হয় ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে নেতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। এতে দৃশ্যত কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্ব নেই বলে মনে হয়, অন্তত কলোরাডোতে নেই। কিন্তু যেসব পদার্থবিদ একই পরীক্ষা আরেকবার আরও সূক্ষ্মভাবে করে দেখার আশা করেন, এ নেতিবাচক ফল তাঁদের ক্ষুধা কেবল বাড়িয়ে দিয়েছিল।

    তা ছাড়া ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চালু হওয়া লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার নতুন ধরনের কণার অনুসন্ধান চালাবে। এই কণাকে বলা হচ্ছে স্পার্টিকেল (এসপার্টিকেল) বা সুপারপার্টিকেল। এটি সুপারস্ট্রিংয়ের উচ্চতর কম্পন (আপনার চারপাশে যা দেখছেন, তার সবই সুপারস্ট্রিংয়ের নিম্নতম কম্পন)। স্পার্টিকেল যদি এলএইচসিতে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তা আমাদের মহাবিশ্ব দেখার দৃষ্টিকোণে নতুন বিপ্লব ঘটাবে। মহাবিশ্বের নতুন এই চিত্রে স্ট্যান্ডার্ড মডেল শুধু সুপারস্ট্রিংয়ের নিম্নতম কম্পনের প্রতিনিধিত্ব করে।

    পদার্থবিদ কিপ থর্ন বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির (কোয়ান্টাম মহাকর্ষ) সূত্রগুলো বুঝতে পারবেন। আর এটি স্ট্রিং থিওরির একটি রূপ হিসেবে পাওয়া যাবে।’

    উচ্চতর মাত্রা ছাড়াও আরেক ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে স্ট্রিং থিওরি। একে বলা হয় মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব।

    মাল্টিভার্স

    স্ট্রিং থিওরিতে এখনো নাছোড়বান্দার মতো একটি প্রশ্ন ঝুলে আছে। সেটি হলো : স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি আলাদা সংস্করণ থাকার কারণ কী? কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে মহাকর্ষকে সফলভাবে একীভূত করেছে স্ট্রিং থিওরি, কিন্তু এটি পাঁচটি উপায়ে করা যায়। অধিকাংশ পদার্থবিদ যেখানে একটি অনন্য সার্বিক তত্ত্ব আশা করেন, সেখানে বেশ বিব্রতকর ব্যাপার এটি। যেমন আইনস্টাইন জানতে চাইতেন, এই মহাবিশ্ব তৈরিতে ঈশ্বরের কোনো পছন্দ ছিল কি না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সবকিছুর একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বটি অনন্য হওয়া উচিত তাহলে পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি কেন থাকবে?

    আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির এডওয়ার্ড উইটেন আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পল টাউনসেন্ড ধারণা করলেন, এই পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি আসলে একই তত্ত্ব। তবে এটি তখনই কেবল একই তত্ত্ব হবে যদি এতে আরও ১১তম একটি মাত্রা যোগ করা হয়। ১১তম মাত্রার সুবিধা হলো, পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বই একটি তত্ত্বে পতিত হয়। সব দিক দিয়েই তত্ত্বটি অনন্যই বটে। কিন্তু সেটি তখনই সম্ভব যদি আমরা ১১তম মাত্রার পাহাড়চূড়ায় আরোহণ করতে পারি।

    ১১তম মাত্রায় নতুন গাণিতিক বস্তু থাকতে পারে, যাকে বলা হয় মেমব্রেন বা পর্দা (যেমন কোনো গোলকের পৃষ্ঠতলের মতো)। সবচেয়ে চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণটি ছিল এটি : কোনো কিছু যদি ১১ মাত্রা থেকে ১০ মাত্রায় নেমে যায়, তাহলে পাঁচটি স্ট্রিং তত্ত্ব আবির্ভূত হবে। এদের সবগুলোই একক মেমব্রেন থেকে শুরু হবে। কাজেই পাঁচটি স্ট্রিং তত্ত্বের সবগুলো আসলে ১১ মাত্রা থেকে ১০ মাত্রায় একটি পর্দা সরানোর ভিন্ন ভিন্ন উপায়মাত্র।

    (এটি বুঝতে চাইলে, একটি বিচবলের কথা কল্পনা করুন, যার চারদিকে বিষুবরেখা বরাবর একটি রাবার ব্যান্ড টানা আছে। ধরা যাক, একটি কাঁচি দিয়ে বিচবলটিকে দুই টুকরো করা হলো। এর এক ভাগ রাবার ব্যান্ডের ওপরে ও আরেক ভাগ নিচে। কাজেই রাবার ব্যান্ড বরাবর বিচবলটি ওপরে ও নিচে কাটা হলো। এখন শুধু বাকি আছে রাবার ব্যান্ডটি, অর্থাৎ একটি স্ট্রিং। একইভাবে, আমরা যদি ১১তম মাত্রাকে কুঁকড়ে ফেলি, তাহলে বাকি থাকবে শুধু বিষুবরেখার পর্দা, যা আসলে একটি স্ট্রিং। আসলে গাণিতিকভাবে পাঁচ উপায়ে এটি কাটা যেতে পারে। এর ফলে ১০ মাত্রায় ৫টি ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রিং থিওরির দেখা পাই আমরা।)

    ১১ মাত্রার কারণে আমরা নতুন এক চিত্র পাই। এতে এটিও বোঝা যায়, মহাবিশ্বের নিজেই হয়তো একটি পর্দার মতো, যা স্থান-কালের একটি মাত্রায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার এসব মাত্রার সবগুলোই ক্ষুদ্র নয়। আসলে এসব মাত্রার কয়েকটি হয়তো আসলে অসীম।

    এতে এই সম্ভাবনা দেখা যায়, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো অন্য কোনো মহাবিশ্বের সঙ্গে একটি মাল্টিভার্সে টিকে আছে। সাবানের ভাসমান অসংখ্য বুদ্বুদ বা পর্দার কথা কল্পনা করুন। ১১ মাত্রিক হাইপারস্পেসের বিশাল ক্ষেত্রে সাবানের প্রতিটি বুদের মতো একেকটি মহাবিশ্ব ভাসছে। এসব বুদ্বুদ অন্যান্য বুদ্বুদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে, কিংবা আলাদাও হয়ে যেতে পারে। এমনকি ফটাস করে উদয় ও মিলিয়ে যেতেও পারে। কে জানে, আমরা হয়তো এ রকম কোনো এক বুদ মহাবিশ্বের ত্বকে বসবাস করছি।

    এমআইটির ম্যাক্স টেগমার্কের বিশ্বাস, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এসব সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছায়াপথের অস্তিত্বের চেয়ে খুব বেশি বিতর্কিত মনে হবে না। প্রায় ১০০ বছর আগেই অন্য ছায়াপথের অস্তিত্বকে বলা হতো আইল্যান্ড ইউনিভার্স বা দ্বীপ মহাবিশ্ব।

    স্ট্রিং থিওরি কয়টি মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে? স্ট্রিং থিওরির অন্যতম বিব্রতকর বৈশিষ্ট্য হলো, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব, যাদের প্রতিটি আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ ধরনের মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা আছে এক গুগলসংখ্যক (গুগল হলো ১০-এর ঘাত ১০০টি শূন্য বা ১০১০০)।

    এসব মহাবিশ্বের মধ্যে সাধারণত যোগাযোগ অসম্ভব। আমাদের দেহের পরমাণুগুলো অনেকটা ফ্লাইপেপারে আটকে থাকা মাছির মতো। আমাদের মেমব্রেন বা পর্দা মহাবিশ্বের সঙ্গে আমরা তিনটি মাত্রায় অবাধে চলাচল করতে পারি। কিন্তু এই মহাবিশ্ব থেকে লাফ দিয়ে কোনো হাইপারস্পেসে যেতে পারি না। কারণ, আমাদের মহাবিশ্বে আমরা আঠার মতো আটকে আছি। তবে স্থান-কাল বক্র হওয়ার কারণে মহাকর্ষ এসব মহাবিশ্বের মধ্যে অবাধে ভেসে থাকতে পারে।

    সত্যি বলতে কি, এমন একটি তত্ত্ব আছে, যেখানে বলা হয়, ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু যে ছায়াপথের চারপাশে থাকা বস্তুর একটি অদৃশ্য রূপ। হয়তো এগুলো সাধারণ বস্তুর মতো, তবে তা কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে ভেসে বেড়াচ্ছে। এইচ জি ওয়েলস তাঁর ইনভিজিবল ম্যান উপন্যাসে বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের ওপরে চতুর্থ মাত্রায় ভেসে থাকতে পারে, তাহলে সে অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারবে। দুটি সমান্তরাল কাগজের কথা চিন্তা করুন। ধরা যাক, একটি কাগজের ওপরে এসব ভেসে আছে। একইভাবে, মনে করা হয়, গুপ্তবস্তুও হয়তো সাধারণ কোনো ছায়াপথ, যা আমাদের ওপরের অন্য কোনো পর্দা মহাবিশ্বে ভেসে আছে। আমাদের ওই ছায়াপথের মহাকর্ষ অনুভব করতে পারি আমরা। কারণ, মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে ঝরে পড়তে পারে। কিন্তু অন্য ছায়াপথগুলো আমাদের কাছে অদৃশ্য মনে হবে; কারণ, ওই ছায়াপথের নিচ দিয়ে আলো চলাচল করে। এই উপায়ে ছায়াপথটির মহাকর্ষ থাকবে, কিন্তু তা আমাদের কাছে অদৃশ্য হয়ে থাকবে। এ ব্যাখ্যার সঙ্গে গুপ্তবস্তুর বর্ণনা মিলে যায়। (অবশ্য আরেকটি সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সেটি হলো গুপ্তবস্তু হয়তো সুপারস্ট্রিংয়ের পরবর্তী কোনো কম্পনে গঠিত। চারপাশে আমরা যা দেখি, যেমন পরমাণু ও আলো, এগুলো সুপারস্ট্রিংয়ের নিম্নতম কম্পন ছাড়া আর কিছুই নয়। গুপ্তবস্তুও হয়তো উচ্চতর কোনো কম্পন হতে পারে।)

    এমনও হতে পারে, সমান্তরাল মহাবিশ্বের অধিকাংশই হয়তো মৃত। যাদের মধ্যে ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর মতো অতিপারমাণবিক কণাদের গঠনহীন গ্যাস আছে। এসব মহাবিশ্বে প্রোটন হয়তো অস্থিতিশীল হবে। কাজেই আমাদের জানা সব বস্তু ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। জটিল বস্তুতে থাকে পরমাণু ও অণু। তাই এসব মহাবিশ্বে জটিল বস্তুর কোনো অস্তিত্বই হয়তো থাকবে না। অন্যান্য সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোতে হয়তো এর ঠিক বিপরীত চিত্র পাওয়া যাবে। সেখানে এমনও জটিল বস্তু থাকতে পারে, যা আমাদের কল্পনাতীত। প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের সমন্বয়ে গঠিত একধরনের পরমাণুর বদলে সেখানে হয়তো বিভিন্ন ধরনের স্থিতিশীল চমকপ্রদ বস্তু থাকতে পারে।

    এসব মেমব্রেন মহাবিশ্বগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়তে পারে। তাতে এক মহাজাগতিক আতশবাজির সৃষ্টি হবে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন পদার্থবিদ মনে করেন, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে দুটি বিশাল আকারের পর্দার মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের অনুমান, আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে প্রচণ্ড সংঘর্ষে। মজার ব্যাপার হলো, তাঁদের এই অদ্ভুত ধারণাটি পরীক্ষামূলক ফলাফল অনুসন্ধান করে দেখা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, পৃথিবীর চারপাশে চক্কর খাওয়া ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ফলাফলের সঙ্গে এটি বেশ ভালোভাবে মিলে যায়। (একে বলা হয় বিগ স্প্ল্যাট থিওরি।)

    মাল্টিভার্স তত্ত্বের একটি তথ্য এর পক্ষে আছে। প্রকৃতির ধ্রুবকগুলো বিশ্লেষণ করার সময় দেখা যায়, সেগুলো এমন নির্ভুলভাবে সমন্বয় করা, যা প্রাণের অস্তিত্বের জন্য জরুরি। আমরা যদি পারমাণবিক বলের শক্তি বাড়াই, তাহলে নক্ষত্রগুলো এতই দ্রুত পুড়ে যাবে যে, কোনো প্রাণ সৃষ্টিই হতে পারবে না। আবার পারমাণবিক বলের শক্তি কমিয়ে দিলে নক্ষত্র জ্বলে উঠতে পারত না কখনোই। তাতে প্রাণেরও অস্তিত্ব থাকত না। আবার মহাকর্ষ বল বাড়ালে, আমাদের মহাবিশ্ব বিগ ক্রাঞ্চ বা মহাসংকোচনের মাধ্যমে অতি দ্রুত মরে যেত। মহাকর্ষের শক্তি কমিয়ে দিলে মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হতে থাকত যে তা চলে যেত বিগ ফ্রিজ বা মহাশীতল অবস্থায়। আসলে প্রকৃতির ধ্রুবকগুলোতে অনেকগুলো দুর্ঘটনা জড়িত, যার কারণে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে। স্পষ্টত, আমাদের মহাবিশ্ব অনেকগুলো প্যারামিটারের গোল্ডিলক জোনের মধ্যে আছে। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য এর সবগুলো সুষমভাবে সমন্বয় করা। কাজেই এই উপসংহারে আসা যায়, হয়তো ঈশ্বর আছেন। তিনিই আমাদের মহাবিশ্ব এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন, যাতে এখানে প্রাণ টিকে থাকতে পারে। কিংবা এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন সমান্তরাল মহাবিশ্ব থাকতে পারে, যাদের অনেকগুলো মৃত। এ ব্যাপারে ফ্রিম্যান ডাইসন বলেন, ‘মহাবিশ্বকে এমন মনে হয় যেন সে জানত, আমরা একদিন এখানে আসব।’

    কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার মার্টিন রিস এ সম্পর্কে লিখেছেন, এই সুষম সমন্বয় আসলে মাল্টিভার্সের প্রমাণ দেয়। পাঁচটি ভৌত ধ্রুবক (যেমন বিভিন্ন বলের শক্তি) আছে, সেগুলো এমন সুষমভাবে সমন্বয় করা, যা প্রাণের অস্তিত্বের অনুমোদন দেয়। তিনি বিশ্বাস করেন, অসীমসংখ্যক মহাবিশ্বও থাকতে পারে, যেগুলোতে প্রকৃতির এসব ধ্রুবক প্রাণের টিকে থাকার পক্ষে উপযোগী নয়।

    এটি সেই নামকরা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল বা মানুষ-সম্পর্কিত নীতি। এই নীতির দুর্বল সংস্করণ অনুযায়ী প্রাণের টিকে থাকার উপযোগী করে আমাদের মহাবিশ্ব সুষমভাবে সমন্বয় করা হয়েছে (কারণ, এই বিবৃতিটি সঠিক প্ৰমাণ করতেই আমরা এখানে এসেছি)। শক্তিশালী সংস্করণ অনুযায়ী আমাদের অস্তিত্ব সম্ভবত একটি নকশা বা উদ্দেশ্যের উপজাত। অধিকাংশ বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ববিদ অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপালের দুর্বল সংস্করণের সঙ্গে একমত। তবে অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল বিজ্ঞানের নতুন কোনো নীতি কি না, যা নতুন কোনো আবিষ্কার ও পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে কি না, নাকি অনস্বীকার্য কোনো বিষয়ে এটি সাধারণ কোনো বিবৃতি, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।

    কোয়ান্টাম তত্ত্ব

    উচ্চতর মাত্রাগুলো ও মাল্টিভার্সের পাশাপাশি আরেক ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্ব আছে। একসময় এটি আইনস্টাইনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি বর্তমানে পদার্থবিদদেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে এটি। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ইউনিভার্স বা কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব, যা সাধারণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ভবিষ্যদ্বাণী করে। কোয়ান্টাম ফিজিকসের মধ্যকার প্যারাডক্সগুলো খুবই দুর্ধর্ষ বলে মনে হয়। সে জন্য নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যানও বলতে পছন্দ করতেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব কেউই বোঝে না।

    মজার ব্যাপার হলো, মানুষের প্রস্তাবিত যেকোনো তত্ত্বের মধ্যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সফলতম তত্ত্ব হওয়ার পরও দৈবঘটনা, ভাগ্য আর সম্ভাবনার বালুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। নিউটনের তত্ত্ব বস্তুর গতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত ও জোরালো জবাব দেয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব এর চেয়ে একেবারে আলাদা। এটি শুধু সম্ভাবনার কথা বলে। লেজার, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, টিভি, সেলফোন, রাডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেনসহ আধুনিক যুগের বিস্ময়গুলোর ভিত্তি হলো এই সম্ভাবনার বালুকণা।

    এই প্যারাডক্স বা হেঁয়ালির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যা (এটি প্রণয়ন করেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি এই সম্ভাবনার ব্যাখ্যাটিকে ধ্বংস করতে হেঁয়ালিপূর্ণভাবে সমস্যাটি তুলে ধরেন)। শ্রোডিঙ্গার তাঁর তত্ত্বের এই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি এই জঘন্য কোয়ান্টাম জাম্পিংয়ের সঙ্গে আটকে যায়, তাহলে এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করব।’

    শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের প্যারাডক্সটা এ রকম : একটা বিড়ালকে একটি শক্তভাবে বন্ধ করা বাক্সে রাখা হয়েছে। বাক্সের ভেতরে একটি বন্দুক বিড়ালটির দিকে তাক করে রাখা হয়েছে (বন্দুকটির ট্রিগার এক গাইগার কাউন্টারের সঙ্গে যুক্ত। তার পাশে আছে এক টুকরো ইউরেনিয়াম)। সাধারণভাবে ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয় হলেই গাইগার কাউন্টার চালু হয়। তারপর বন্দুকটি থেকে গুলি বের হয়ে বিড়ালটিকে মেরে ফেলবে। ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয় হতেও পারে, না-ও পারে। তাই বিড়ালটি মারাও যেতে পারে, আবার না-ও যেতে পারে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান এটুকুই বলে।

    কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, ইউরেনিয়াম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না আমরা। কাজেই এখানে আমাদের দুটি সম্ভাবনা যোগ করতে হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত পরমাণু ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে যোগ করতে হবে অক্ষত ইউরেনিয়াম পরমাণুর ওয়েভ ফাংশনকে। কিন্তু এর মানে দাঁড়ায়, বিড়ালটি বর্ণনা করতে গেলেও আমাদের বিড়ালটির দুটি অবস্থার (মৃত ও জীবিত) কথা যোগ করতে হবে। কাজেই বিড়ালটি মৃতও নয়, আবার জীবিতও নয়। এতে আসলে একটি মৃত বিড়াল ও একটি জীবিত বিড়ালের যোগফল থাকবে। ফাইনম্যান একবার লিখেছিলেন, ‘কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রকৃতিকে এমনভাবে বর্ণনা করে, যা সাধারণ জ্ঞানে উদ্ভট বলে মনে হয়। কিন্তু তবু এটি পরীক্ষার সঙ্গে খাপ খায়। কাজেই আমি আশা করি, আপনিও প্রকৃতিকে উদ্ভট হিসেবে মেনে নেবেন।

    আইনস্টাইন ও শ্রোডিঙ্গারের কাছে বিষয়টি অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছিল। ‘বস্তুগত বাস্তবতায়’, অর্থাৎ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে বিশ্বাস করতেন আইনস্টাইন। নিউটনিয়াম দৃষ্টিভঙ্গিতে সাধারণ বুদ্ধিতে, বস্তুরা নির্দিষ্ট অবস্থায় টিকে থাকে, অনেকগুলো সম্ভাব্য অবস্থার যোগফলে নয়। কিন্তু তারপরও এই উদ্ভট ব্যাখ্যাটি আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ডের গভীরে ঢুকে গেছে। এটি ছাড়া আধুনিক ইলেকট্রনিকস (আর আমাদের দেহের পরমাণু) টিকে থাকতে পারত না। (আমাদের সাধারণ জগতে আমরা মাঝেমধ্যে কৌতুক করে বলি যে, এটি ছাড়া ‘আংশিক গর্ভবতী’ হওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে এর অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে আমরা একই সঙ্গে অগর্ভবতী, গর্ভবতী, একটি সন্তান, বয়স্ক নারী, কিশোরী, পেশাজীবী নারী ইত্যাদির সবগুলো সম্ভাব্য অবস্থার যোগফল হিসেবে টিকে থাকি।)

    এই নাছোড়বান্দা প্যারাডক্সের সমাধান করার অনেক রকম উপায় আছে। কোপেনহেগেন স্কুলের কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করতেন, একবার বাক্সটি খুলে ফেললে, আপনি পরিমাপ করতে পারবেন। আবার বিড়ালটি মৃত নাকি জীবিত, তা-ও নির্ধারণ করতে পারবেন। কারণ, ওয়েভ ফাংশন তখন কলাপস বা ভেঙে একটি একক অবস্থায় পৌঁছাবে। আর তখন আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেবে। ওয়েভ বা তরঙ্গ অদৃশ্য হয়ে শুধু কণাই পড়ে থাকবে সেখানে। এর মানে হলো, বিড়ালটি এখন একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকবে (মৃত বা জীবিত নয়)। তা ছাড়া তাকে বর্ণনার জন্য এখন আর ওয়েভ ফাংশনের প্রয়োজন হবে না।

    কাজেই এখানে অদৃশ্য দেয়াল আছে। এ দেয়ালটি পরমাণুর অদ্ভুত জগৎ আর মানুষের ম্যাক্রোস্কোপিক জগৎকে আলাদা করে রেখেছে। পারমাণবিক জগতের জন্য সবকিছুই সম্ভাবনার তরঙ্গ দিয়ে বর্ণনা করা হয়। এখানে পরমাণুগুলো একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে পারে। কোনো অঞ্চলে তরঙ্গ যত বড় হবে, ওই বিন্দুতে সেই কণা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়বে। কিন্তু বস্তু যত বড় হয়, তাদের এই তরঙ্গ ভেঙে যায়। বস্তুটি তখন নির্দিষ্ট অবস্থায় টিকে থাকে। এভাবে আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান জয়ী হয়।

    (আইনস্টাইনের বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তিনি আকাশের চাঁদের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ইঁদুর চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখে বলেই কি চাঁদটা ওখানে দেখা যাচ্ছে?’ কিছু ক্ষেত্রে কোপেনহেগেন স্কুলের জবাব হবে সম্ভবত হ্যাঁ-বোধক।)

    অধিকাংশ পিএইচডি পাঠ্যপুস্তকে সযত্নে আসল কোপেনহেগেন স্কুলকে মেনে চলে। তবে এটি বাদও দেন অনেক গবেষক-পদার্থবিদ। আমাদের কাছে এখন ন্যানোটেকনোলজি আছে। এর মাধ্যমে নিপুণভাবে কাজে লাগানো যায় প্রতিটি পরমাণুকে। কাজেই যেসব পরমাণু দ্রুত অস্তিত্বে আসা-যাওয়া করে, সেগুলো স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো কাজে লাগানো যায়। আসলে মাইক্রোস্কোপিক ও ম্যাক্রোস্কোপিক জগতের মধ্যে কোনো অদৃশ্য দেয়াল নেই। এদের মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে।

    আধুনিক পদার্থবিদ্যার মর্মমূলে বিঁধে থাকা এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এখনো একমত হওয়া যায়নি। বিভিন্ন কনফারেন্সে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীর সরোষে অন্য তাত্ত্বিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। এক দৃষ্টিভঙ্গিতে, মহাবিশ্বজুড়ে অবশ্যই ‘মহাজাগতিক চেতনা’ থাকা উচিত। কোনো বস্তুকে পরিমাপ করার সময়ে সেটি হঠাৎ লাফিয়ে অস্তিত্বশীল হয়। আর এই পরিমাপের কাজটি করে সচেতন জীব। কাজেই এখানে মহাজাগতিক চেতনা থাকতেই হবে, যা মহাবিশ্বজুড়ে বিস্তৃত থেকে নির্ধারণ করবে আমরা কোন অবস্থায় আছি। নোবেলজয়ী ইউজিন উইগনারের মতো অনেকের ধারণা, এর মাধ্যমে ঈশ্বরের বা কোনো মহাজাগতিক চেতনার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। (উইগনার লিখেছেন, ‘চেতনার প্রসঙ্গ ছাড়া [কোয়ান্টাম তত্ত্বের] নিয়মগুলো পুরোপুরি মানানসইভাবে সূত্রবদ্ধ করা সম্ভব হতো না।’ এমনকি তিনি হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শনের প্রতিও আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়, মহাবিশ্ব এক সর্বব্যাপী চেতনায় জড়িয়ে আছে।)

    এ প্যারাডক্সের আরেক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, অনেক মহাবিশ্ব থাকার ধারণা। ১৯৫৭ সালে এটি প্রস্তাব করেন হিউগ ইভেরেট। এতে বলা হয়, মহাবিশ্ব সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে থাকে একটি জীবিত বিড়াল আর অন্য ভাগে এক মৃত বিড়াল। এর মানে, যখন কোয়ান্টাম ঘটনা ঘটে, তখন সমান্তরাল মহাবিশ্বের ব্যাপক বিস্তার ঘটে বা তার শাখা-প্রশাখা থাকে। তাই যেকোনো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে। কাজেই এমন সমান্তরাল মহাবিশ্বও থাকতে পারে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী নাৎসি বাহিনী। কিংবা এমন মহাবিশ্বও থাকা সম্ভব, যেখানে স্প্যানিশ আর্মাডা কখনো পরাজিত হয়নি আর তাই সবাই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। অন্য কথায়, ওয়েভ ফাংশন কখনো ভেঙে যায় না। শুধু তার নিজের পথে চলমান থাকে আর চমকপ্রদভাবে অসংখ্য মহাবিশ্বে বিভক্ত হয়ে যায়।

    এমআইটির পদার্থবিদ অ্যালান গুথ বলেন, ‘এমন এক মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে, যেখানে এলভিস প্রিসলি এখনো জীবিত এবং সেখানে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন আল গোর।’ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক উইলজেক বলেন, ‘আমাদের ওপর চেতনা ভর করে, যা অসীমভাবে আমাদের নিজেদের বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য কপি। যারা তাদের সমান্তরাল জীবন যাপন করছে এবং প্রতিটি মুহূর্তেই আরও প্রতিলিপি লাফিয়ে অস্তিত্বশীল হচ্ছে আর আমাদের বিভিন্ন ধরনের বিকল্প ভবিষ্যতের মধ্যে চলে যাচ্ছে।’

    একটি দৃষ্টিভঙ্গি পদার্থবিদদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, যাকে বলা হয় ডিকোহেরেন্স বা অসংগতি। এই তত্ত্বমতে, এসব সমান্তরাল মহাবিশ্বের সবগুলো সম্ভব, তবে আমাদের ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে সেগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। (যেমন তাদের সঙ্গে আমাদের ওয়েভ ফাংশন ঐকতানে কম্পিত হয় না)। কাজেই তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো মিথস্ক্রিয়াও নেই। এর মানে, আপনার শোবার ঘরের ভেতর ডাইনোসর, এলিয়েন, জলদস্যু, ইউনিকর্নের ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে একত্রে সহবাস করছেন। এদের প্রত্যেকে তাদের মহাবিশ্বকে জোরালোভাবে বাস্তব বলে মনে করছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

    নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গের মতে, এটা অনেকটা আমাদের ঘরে একটি রেডিও স্টেশন টিউন করার মতো। আপনি জানেন, আপনার ঘরে সারা দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত রেডিও স্টেশনের সিগন্যালের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আপনার রেডিও কেবল একটিই স্টেশন টিউন করছে। কাজেই এর সঙ্গে অন্য স্টেশনগুলোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। (সংক্ষেপে বলা যায়, ওয়েনবার্গ মনে করেন, অনেক মহাবিশ্বের ধারণা আসলে অন্য ধারণাগুলো ছাড়া একটি শোচনীয় ধারণা। )

    তাহলে কি কোনো বর্বর ফেডারেশন অব প্ল্যানেটের ওয়েভ ফাংশনও আছে, যারা দুর্বল গ্রহগুলোতে লুণ্ঠন চালাচ্ছে আর শত্রুদের হত্যা করছে? হয়তো আছে। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তাহলে ওই মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

    কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব

    হিউগ ইভেরেট অন্য পদার্থবিদদের সঙ্গে তাঁর ‘বহু মহাবিশ্ব’ তত্ত্ব আলোচনা করার সময় ধাঁধা লাগানো আর নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া পান। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ব্রাইস ডিউইট এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতি অভিযোগ তোলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘নিজেকে বিভক্ত বলে ভাবতে পারি না আমি।’ তবে এর জবাবে ইভেরেট বলেন, এটা অনেকটা গ্যালিলিওর সমালোচকদের মতো কথা। একসময় তারাও বলেছিল, পৃথিবী যে ঘুরছে, তা বুঝতে পারছে না তারা। (ডিউইট ক্রমেই ইভেরেটের মতের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এই তত্ত্বের নেতৃস্থানীয় সমর্থকে পরিণত হয়েছেন।)

    কয়েক দশক ধরে ‘বহু মহাবিশ্ব’ তত্ত্ব দুর্বোধ্যতার কারণে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। এটি সত্যিই বেশ উদ্ভট এক ব্যাপার। প্রিন্সটনে ইভেরেটের উপদেষ্টা জন হুইলার অবশেষে উপসংহার টানেন, এ তত্ত্বের সঙ্গে অনেকগুলো অতিরিক্ত লটবহর জড়িয়ে আছে। তবে একটি কারণে ইভেরেটের তত্ত্বটি এখন হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণটি হলো পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সর্বশেষ অস্ত্রটি এতে প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেটি হলো কোয়ান্টায়িত হতে বাধা দিচ্ছে, খোদ মহাবিশ্বকেও। পুরো মহাবিশ্বে অনিশ্চয়তার নীতি ব্যবহার করা হলে স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের মাল্টিভার্সের দিকে নিয়ে যায়।

    কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাজকারবার পরমাণুর অতি ক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে। আর কসমোলজি বা বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ব গোটা মহাবিশ্ব নিয়ে কাজ করে। তাই এ প্রেক্ষাপটে কোয়ান্টাম কসমোলজির ধারণাটি প্রথমে বেশ স্ববিরোধী বলে মনে হয়। তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে মহাবিস্ফোরণের সময় এই মহাবিশ্ব একটা ইলেকট্রনের চেয়েও অনেক ছোট ছিল। সব পদার্থবিদ এখন একমত, ইলেকট্রন অবশ্যই কোয়ান্টায়িত। অর্থাৎ তাদের সম্ভাবনার তরঙ্গ সমীকরণ (ডিরাকের সমীকরণ) দিয়ে প্রকাশ করা যায়। পাশাপাশি তারা সমান্তরাল অবস্থাতেও থাকতে পারে। কাজেই ইলেকট্রন যদি কোয়ান্টায়িত হয় ও মহাবিশ্ব যদি কোনো এক সময় একটা ইলেকট্রনের চেয়েও ছোট হয়ে থাকে, তাহলে মহাবিশ্বও অতি অবশ্যই সমান্তরাল অবস্থায় থাকতে পারে। এ তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবে ‘বহু বিশ্ব’ ধারণায় নিয়ে যায়।

    তবে নীলস বোরের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যাটি পুরো মহাবিশ্বে ব্যবহার করা হলে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। পিএইচডি পর্যায়ে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সব কোর্সে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা শেখানো হয়। তবে এটি একজন পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ ও ওয়েভ ফাংশন ভেঙে পড়ার ওপর নির্ভর করে। ম্যাক্রোস্কোপিক বা বৃহৎ পরিসরের জগৎ সংজ্ঞায়িত করতে এই পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া অপরিহার্য। কিন্তু পুরো মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণের জন্য মহাবিশ্বের ‘বাইরের’ পর্যবেক্ষক কীভাবে থাকতে পারে? একটি ওয়েভ ফাংশন যদি মহাবিশ্বের বর্ণনা দেয়, তাহলে কোনো বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছে মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন কলাপস করতে পারে কীভাবে? আসলে, মহাবিশ্বের বাইরে থেকে কারও পক্ষে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করার এই অক্ষমতাকে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার সবচেয়ে বড় ত্রুটি মনে করা হয়।

    ‘বহু বিশ্ব’ তত্ত্বে এই সমস্যার সমাধান খুব সহজ। এ ক্ষেত্রে মহাবিশ্বকে কেবল অনেকগুলো সমান্তরাল অবস্থার মধ্যে থাকতে হবে, যার সবগুলো একটি প্রধান ওয়েভ ফাংশন দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হবে। একে বলা হয় মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন। কোয়ান্টাম কসমোলজিতে ভ্যাকুয়ামের কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা অস্থিরতা হিসেবে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল বা স্থান-কালের ফেনায় অতি ক্ষুদ্র বুদ্বুদ হিসেবে। স্থান-কালের ফেনায় অধিকাংশ শিশু মহাবিশ্বের একটি মহাবিস্ফোরণ থাকে এবং তারপর তারা অতি দ্রুত মহাসংকোচনের মুখে পড়ে। এ কারণেই আমরা তাদের দেখতে পাই না। কারণ, তাদের অতি ক্ষুদ্র ও তাদের অর্জনও অতি সংক্ষিপ্ত। তারা ভ্যাকুয়াম থেকে অতি দ্রুত হাজির হয়, তারপর আবারও মিলিয়ে যায়। এর মানে হলো, শূন্যস্থানও শিশু মহাবিশ্বের উদয় ও হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপার ঘটছে। তবে সেগুলো এতই ক্ষুদ্র যে আমাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে তাদের শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু কোনো এক কারণে স্থান-কালের ফেনায় এ রকম একটি বুদ মহাসংকোচনের বিলীন হয়ে যায়নি, বরং ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। এই বুদ্‌দটিই আমাদের মহাবিশ্ব। অ্যালান গুথের মতে, এর মানে হলো পুরো মহাবিশ্বটা হলো চূড়ান্তভাবে ফ্রি লাঞ্চ।

    কোয়ান্টাম কসমোলজিতে পদার্থবিদেরা শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সদৃশ কিছু দিয়ে শুরু করেন, যেটি ইলেকট্রন ও পরমাণুর ওয়েভ ফাংশনের শাসনের অধীন। ডিউইট-হুইলারের সমীকরণ ব্যবহার করেন তাঁরা। এটি মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশনে কাজ করে। শ্রোডিঙ্গারের ওয়েভ ইকুয়েশন সাধারণত স্থান ও কালের প্রতি বিন্দু সংজ্ঞায়িত করে। কাজেই স্থান ও কালের ওই বিন্দুতে একটি ইলেকট্রন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা হিসাব করতে পারবেন আপনি। তবে মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন সম্ভাব্য সব মহাবিশ্বের ওপর সংজ্ঞায়িত। নির্দিষ্ট মহাবিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করার সময় মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন যদি অনেক বড় হয়, তাহলে তার মানে মহাবিশ্বটির ওই নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

    এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেছেন হকিং। তিনি দাবি করেন, অন্যান্য মহাবিশ্বের মধ্যে আমাদের মহাবিশ্বটি বিশেষ একটি। আমাদের মহাবিশ্বের জন্য মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন অনেক বড়। আর অন্যান্য মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এই ওয়েভ ফাংশন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। সুতরাং অন্যান্য মহাবিশ্ব মাল্টিভার্সে টিকে থাকতে পারে, যার সম্ভাবনা ছোট ও সসীম, কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের সম্ভাবনা সবচেয়ে বড়। আসলে হকিং এভাবে স্ফীতিতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই চিত্রে স্ফীতিশীল এক মহাবিশ্ব শুধু অস্ফীতিশীল কোনো মহাবিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি সম্ভাবনাময় হয়ে থাকে। কাজেই আমাদের মহাবিশ্বের একটা স্ফীতি পর্যায় ছিল।

    আমাদের মহাবিশ্ব যে স্থান-কালের ফেনার শূন্যতা থেকে এসেছে—এ তত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয় বলে মনে হয়। কিন্তু কিছু সাধারণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে বেশ খাপ খায় এটি। প্রথমত, আমাদের মহাবিশ্বের ভেতরে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ মোট পরিমাণ শূন্য বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন অনেক পদার্থবিদ। আমরা যদি মেনে নিই, বাইরের মহাকাশের মহাকর্ষ প্রবল শক্তিসম্পন্ন, তাহলে তার একমাত্র কারণ হলো ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ পরস্পরকে নিখুঁতভাবে বাতিল করে। পৃথিবীতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে যদি সামান্য পরিমাণও ভারসাম্যহীনতা থাকে, তাহলে হয়তো পৃথিবীর সবকিছুকে পরস্পরের সঙ্গে আটকে রাখা মহাকর্ষীয় বলের ওপর এটি আধিপত্য বিস্তার করত। এতে পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করে ফেলার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে যাবে সেটি। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে এই ভারসাম্য কেন রয়েছে? এটি ব্যাখ্যা করার সহজ উপায় হলো অনুমান করে নেওয়া যে আমাদের মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে। আর শূন্যের চার্জ তো শূন্যই হয়।

    দ্বিতীয়ত, আমাদের মহাবিশ্বের স্পিন বা ঘূর্ণনও শূন্য। অনেক বছর ধরে কার্ট গোডেল বিভিন্ন ছায়াপথের ঘূর্ণন যোগ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, আমাদের মহাবিশ্বও ঘুরছে। তবে জ্যোতির্বিদেরা এখন বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের সর্বমোট স্পিন শূন্য। এ ঘটনাকেও খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়, যদি মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসে থাকে। কারণ, শূন্যের স্পিনও শূন্য।

    তৃতীয়ত, আমাদের মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে—এই বিবৃতি ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে, কেন মহাবিশ্বের মোট বস্তু-শক্তির পরিমাণ এতই ছোট যে, হয়তো সেটি শূন্যও হতে পারে। আমরা যখন বস্তুর ধনাত্মক শক্তি এবং মহাকর্ষের সঙ্গে জড়িত ঋণাত্মক শক্তি যোগ করি, তখন দেখা যায়, এই দুটি পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্ব যদি আবদ্ধ ও সসীম হয়, তাহলে বস্তু-শক্তির মোট পরিমাণ নিখুঁতভাবে শূন্য হওয়া উচিত। (আমাদের মহাবিশ্ব যদি উন্মুক্ত ও অসীম হতো, [সম্ভবত এটি সত্য নয়], তবে স্ফীতিশীল তত্ত্ব ইঙ্গিত করে, মহাবিশ্বের বস্তু-শক্তির মোট পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে ছোট হবে।)

    মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে কি যোগাযোগ আছে?

    এটি কিছু লোভনীয় প্রশ্নের দ্বার খুলে দেয় : পদার্থবিদেরা যদি বিভিন্ন ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বের সম্ভাবনা বাতিল করতে না পারেন, তাহলে কি ওই সব মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব? সেখানে বেড়াতে যাওয়া যাবে? কিংবা ওই সব মহাবিশ্বের প্রাণীরা কি আমাদের দেখতে আসতে পারে?

    আমাদের কাছ থেকে সম্পর্কহীন এসব কোয়ান্টাম মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগকে খুবই অসম্ভব ঘটনা বলে মনে হয়। এসব মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক না থাকার কারণ হলো, আমাদের পরমাণুগুলো চারপাশের পরিবেশের আরও অসংখ্য পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। প্রতিবার ধাক্কা খাওয়ার সময় এসব পরমাণুর ওয়েভ ফাংশন কিছুটা কলাপস করে বা ভেঙে যায়। এতে সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যা কমে যায়। প্রতিটি সংঘর্ষ সম্ভাবনার পরিমাণ সংকুচিত করে ফেলে। ট্রিলিয়নসংখ্যক এসব পারমাণবিক মিনি-কলাপসের যোগফল আমাদের এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যে আমাদের দেহের পরমাণুগুলো একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় পুরোপুরি কলাপস করেছে। আইনস্টাইনের বস্তুগত বাস্তবতা হলো একধরনের বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার কারণ হলো, আমাদের দেহে অনেক পরমাণু আছে, প্রতিটিই পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে এবং তাতে প্রতিবারই সম্ভাব্য মহাবিশ্বের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

    ক্যামেরায় ভেতর দিয়ে ফোকাসের বাইরের ছবির দিকে তাকানোর মতো এটা। এটি অতি ক্ষুদ্র জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে সবকিছুই অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট বলে মনে হয়। কিন্তু প্রতিবার আপনি যখন ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করেন, ততই ছবিটি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ফুটে উঠতে থাকে। প্রতিবেশী পরমাণুর সঙ্গে ট্রিলিয়নসংখ্যক অতি ক্ষুদ্র সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত এটি। এতে প্রতিবার সম্ভাব্য মহাবিশ্বের সংখ্যা কমে আসে। এভাবে আমরা মসৃণভাবে অস্পষ্ট অতি ক্ষুদ্র জগৎ থেকে বৃহত্তর জগতে স্থানান্তর করতে পারি।

    কাজেই আমাদের সঙ্গে মিল আছে, এমন অন্য কোয়ান্টাম মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের মিথস্ক্রিয়া করার সম্ভাবনা শূন্য নয়। তবে আপনার দেহের পরমাণুর সংখ্যার মতো এটি খুব দ্রুত কমে যায়। আপনার দেহে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু আছে। সে কারণে ডাইনোসর বা এলিয়েন বসতি আছে, এমন মহাবিশ্বের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করার সম্ভাবনা অসীমভাবে অতি ক্ষুদ্ৰ। হিসাব করলে দেখতে পাবেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার জন্য আপনাকে মহাবিশ্বের জীবনকালের চেয়েও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে থাকতে হবে।

    কাজেই কোয়ান্টাম সমান্তরাল মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটি বাতিল করা না গেলেও তা অতি বিরল ঘটনা। কারণ, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কসমোলজিতে ভিন্ন এক সমান্তরাল মহাবিশ্বের মুখোমুখি হতে হয়। সেটি হলো, অসংখ্য মহাবিশ্বের মাল্টিভার্স, যারা সাবানের বুদ্বুদ ভেসে থাকার মতো পরস্পরের পাশাপাশি টিকে থাকতে পারে। মাল্টিভার্সে অন্য মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটি ভিন্ন প্রশ্ন। এটি নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে টাইপ থ্রি সভ্যতার জন্য তা হয়তো সম্ভবও হতে পারে।

    আগেই আলোচনা করেছি, স্থানের মধ্যে ছিদ্র করতে কিংবা স্থান-কালের ফেনা বিবর্ধিত করতে যে শক্তির প্রয়োজন, তা প্ল্যাঙ্ক শক্তির মতো। সেখানে আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্থান ও কাল এই শক্তিস্তরে স্থিতিশীল থাকে না। এটি আমাদের মহাবিশ্ব ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে (ধরে নেওয়া যায়, অন্যান্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে আর আমরা এভাবে মারা পড়ব না।)।

    এর পুরোটাই একাডেমিক প্রশ্ন নয়। কারণ, মহাবিশ্বের সব বুদ্ধিমান প্রাণী একদিন মহাবিশ্বের সমাপ্তির মুখোমুখি হবে। তাই হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের সব বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য একটি পরিত্রাণের উপায় হয়ে দাঁড়াবে মাল্টিভার্স তত্ত্ব। পৃথিবীর চারপাশে চক্কর খাওয়া ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট (WMAP) থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত নিশ্চিত করেছে, মহাবিশ্ব একটি ত্বরিত হারে প্রসারিত হচ্ছে। একদিন আমরা হয়তো সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। পদার্থবিদেরা একে বলেন বিগ ফ্রিজ বা মহাশীতলতা। ক্রমান্বয়ে পুরো মহাবিশ্ব কালো হয়ে যাবে। আকাশের সব নক্ষত্র নিভে যাবে দপ করে। মহাবিশ্বজুড়ে তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে মৃত নক্ষত্র, নিউট্রন স্টার আর কৃষ্ণগহ্বর। এমনকি তাদের মধ্যে থাকা পরমাণুগুলোও ক্ষয় হতে শুরু করবে। মহাবিশ্বের তাপমাত্রা প্রায় পরম শূন্যের কাছাকাছি চলে যাবে। তাতে প্রাণ ধারণ করা কোনোভাবে সম্ভব হবে না।

    মহাবিশ্ব এ পর্যায়ে যেতে শুরু করলে, কোনো উন্নত সভ্যতা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত মৃত্যু দেখতে পাবে। তখন হয়তো অন্য মহাবিশ্বে চলে যাওয়ার কথা ভাববে তারা। ওই সব প্রাণীর জন্য জমে মরে যাওয়া, নয়তো চলে যাওয়া—দুটোর যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। সব বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য পদার্থবিদ্যার সব সূত্র একধরনের মৃত্যু পরোয়ানার মতো। তবে সূত্রগুলোতে পালিয়ে যাওয়ারও উপায় আছে।

    এ ধরনের কোনো সভ্যতা হয়তো পরমাণু ত্বরকযন্ত্র থেকে বিপুল শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। তাদের হয়তো এমন লেজার বিমও থাকতে পারে, যার আকার সৌরজগতের সমান। কিংবা প্ল্যাঙ্ক শক্তি অর্জনের জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তিকে একক বিন্দুতে ঘনীভূত করার মতো স্টার ক্লাস্টারও থাকতে পারে তাদের কাছে। এগুলো অর্জন করে কোনো ওয়ার্মহোল বা অন্য মহাবিশ্বে যাওয়ার রাস্তা খুলে ফেলার মতো যথেষ্ট হবে। টাইপ থ্রি সভ্যতা হয়তো এ রকম বিপুল শক্তি ব্যবহার করে থাকতে পারে। এর মাধ্যমে কোনো ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে রাস্তা খুলে অন্য মহাবিশ্বে চলে যেতে পারবে তারা। তখন তাদের পেছনে পড়ে থাকবে আমাদের মৃত্যুমুখী মহাবিশ্ব। এভাবে আবারও নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারে তারা।

    গবেষণাগারে শিশু মহাবিশ্ব সম্ভব?

    এই ধারণাগুলো যতই অসম্ভব বলে মনে হোক না কেন, এগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন পদার্থবিদেরা। যেমন, মহাবিস্ফোরণ কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা আমরা যখন বুঝতে চেষ্টা করি, তখন ওই বিস্ফোরণের শর্ত কী কী, তা বিশ্লেষণ করতে হয়। অন্য কথায়, আমাদের জিজ্ঞেস করতে হয় : গবেষণাগারে একটি শিশু মহাবিশ্ব কীভাবে বানানো যায়? স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব ধারণার অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা আন্দ্রেই লিন্ডে বলেন, “আমরা যদি শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারি, তাহলে হয়তো ঈশ্বরকে শুধু মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সংজ্ঞায়িত না করে, তাঁকে আরও সূক্ষ্ম কোনো কাজের জন্য পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে।’

    ধারণাটি নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগে, মহাবিস্ফোরণ শুরু হওয়ার জন্য কতটা শক্তির দরকার, তা হিসাব করতে গিয়ে নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল পদার্থবিদদের। তখন লোকজন অবাক হয়ে ভাবতে বসল, গবেষণাগারে যদি কোনো স্থানে বিপুল পরিমাণ শক্তি রাখা হয়, তারপর তাতে অনেকগুলো কামান দাগা হয়, তাহলে কী ঘটবে? এর মাধ্যমে কি একটা মিনি মহাবিস্ফোরণ ঘটানোর মতো যথেষ্ট শক্তি জড়ো করা যাবে?’ জিজ্ঞেস করেছিলেন লিন্ডে।

    কোনো বিন্দুতে বিপুল পরিমাণ শক্তি জড়ো করা হলে সেখানে স্থান-কাল ভেঙে একটি কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হবে। এর বেশি কিছু নয়। তবে ১৯৮১ সালে এমআইটির অ্যালান গুথ ও লিন্ডে প্রস্তাব করলেন ইনফ্লেশন বা স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের। বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের কাছে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে তত্ত্বটি। এই ধারণা অনুসারে মহাবিস্ফোরণ বিপুল বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হবে। তবে আগের অনুমানের চেয়েও অনেক দ্রুত ঘটেছিল এই বিস্ফোরণ (স্ফীতিশীল মহাবিশ্বের ধারণাটি কসমোলজির অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। যেমন মহাবিশ্বকে সুষম হতেই হবে কেন? রাতের আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের যেদিকে তাকাই, সেখানেই এক সুষম মহাবিশ্ব দেখা যায়। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর থেকে এই বিপুল বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি। স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বে এই ধাঁধার উত্তরে বলা হয়, তুলনামূলক সুষম স্থান-কালের অতি ক্ষুদ্র একটি টুকরো বিস্ফোরিত হয়ে পুরো দৃশ্যমান মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে।) একলাফে স্ফীতির সূচনার জন্য গুথ অনুমান করেন, সময়ের শুরুতে স্থান-কালের অতি ক্ষুদ্র বুদ্‌দ ছিল। সেটি বিপুলভাবে স্ফীত হয়ে বর্তমানের মহাবিশ্বে পরিণত হয়েছে।

    স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের এক ছোবলে অনেকগুলো মহাজাগতিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। আবার মহাকাশের ডব্লিউএমএপি ও কোর স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া বর্তমানের সব তথ্য-উপাত্তের সঙ্গেও এটি বেশ মানানসই। কাজেই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের জন্য এটি প্রশ্নাতীত এক পদপ্রার্থীতে পরিণত হয়েছে।

    এত কিছুর পরও স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব বেশ কিছু বিব্রতকর প্রশ্ন তুলেছে। যেমন এই বুদ হঠাৎ স্ফীত হতে শুরু করল কেন? এই প্রসারণ বন্ধ হয়ে পরিণতিতে বর্তমানের মহাবিশ্ব গঠিত হলো কীভাবে? একবার স্ফীতির ঘটনা ঘটলে এটা কি আবারও কখনো ঘটবে? মজার ব্যাপার হলো, কসমোলজিতে স্ফীতিশীল তত্ত্বটি শীর্ষস্থানীয় হলেও ঠিক কোন ঘটনার কারণে স্ফীতির ঘটনা ঘটল আর এটি বন্ধ হলো কেন—সেসব সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।

    বিরক্তিকর এসব প্রশ্নের জবাব দিতে ১৯৮৭ সালে এমআইটির অ্যালান গুথ আর এডওয়ার্ড ফাহরি আরেকটি হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন তোলেন। সেটি হলো : অগ্রসর কোনো সভ্যতা তাঁদের মহাবিশ্বকে কীভাবে স্ফীত করতে পারবে? তাঁদের অনুমান, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে মহাবিশ্বের স্ফীতি কীভাবে শুরু হয়েছিল, সে-সম্পর্কিত গভীর প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারবেন তাঁরা।

    তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, যদি যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি কোনো এক বিন্দুতে ঘনীভূত করা যায়, তাহলে স্থান-কালের অতি ক্ষুদ্র বুদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত হবে। কিন্তু বুদ্বুদগুলো খুব ছোট হলে তারা স্থান-কালের ফেনায় আবারও ফিরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বুদ্বুদগুলো যদি যথেষ্ট বড় হয়, তাহলেই কেবল তারা প্রসারিত পুরো একটি মহাবিশ্ব গঠন করতে পারবে।

    অন্যদিকে নতুন এই মহাবিশ্বের জন্মের বাইরে, হয়তো ৫০০ কিলোটন নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণের চেয়ে খুব বেশি দরকার হবে না বলে মনে হয়। একে দেখে মনে হবে, হয়তো কোনো ছোট্ট বুদ্বুদ মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে গিয়ে ছোট এক পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বুদের ভেতর একটি গোটা নতুন মহাবিশ্ব হয়তো প্রসারিত হতে থাকবে। সাবানের একটি বুদের কথা কল্পনা করুন, যেটি বিভক্ত হয়ে আরও ছোট বুদ্বুদে পরিণত হয়ে কোনো শিশু সাবানের বুদে পরিণত হয়। এই খুদে সাবানের বুদ হয়তো দ্রুতবেগে প্রসারিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন সাবানের বুদে পরিণত হতে পারে। একইভাবে মহাবিশ্বের ভেতরেও আপনি স্থান-কালের বিপুল বিস্ফোরণ এবং একটি পুরো মহাবিশ্বের সৃষ্টিপ্রক্রিয়াও দেখতে পারবেন।

    শক্তির সূচনার মাধ্যমে একটি বড় বুদ প্রসারিত হয়ে পুরো মহাবিশ্বে পরিণত হতে পারে কি না, তা দেখতে ১৯৮৭ সালের পর অনেক তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে। সাধারণভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটি হলো, ইনফ্লেশন বা স্ফীতি। একটি নতুন কণা স্থান-কালকে অস্থিতিশীল করে তোলে। আর এ কারণেই এই বুদ্বুদ গঠন করে ও তাকে প্রসারিত করে।

    ২০০৬ সালে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। সে সময় একটি মনোপোলের সঙ্গে একটি শিশু মহাবিশ্বের সূচনা করতে নতুন একটি প্রস্তাবকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে শুরু করেন পদার্থবিদেরা। যেসব কণা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর শুধু যেকোনো একটি মেরু বহন করে তাকে বলা হয় মনোপোল বা এক মেরু। মনোপোল কখনো দেখা না গেলেও অনুমান করা হয় যে তারাই আদিম মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তারা এতই ভারী যে গবেষণাগারে এদের তৈরি করাও কঠিন। তবে তারা বিপুল ভরের হওয়ার কারণেই কোনো মনোপোলের মধ্যে আরও শক্তি ঢুকিয়ে দিলে শিশু মহাবিশ্বের জন্ম দেওয়া সম্ভব। এটিই প্রসারিত হয়ে একসময় প্রকৃত মহাবিশ্বে পরিণত হবে।

    পদার্থবিদেরা মহাবিশ্ব কেন বানাতে চান? লিন্ডে বলেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গিটা হলো, আমাদের সবাই ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে।’ কিন্তু এর বাইরে নতুন মহাবিশ্ব বানানোর কিছু বাস্তব কারণও রয়েছে : আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচা।

    মহাবিশ্বের বিবর্তন

    কিছু পদার্থবিদ এই ধারণাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, যাকে বলে একেবারে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সীমানায়। প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের মহাবিশ্ব ডিজাইনের ক্ষেত্রে কোনো বুদ্ধিমান সত্তার হাত আছে কি না।

    গুথ ও ফাহরির চিত্রে কোনো অগ্রসর সভ্যতা একটি শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারে। ভৌত ধ্রুবকগুলো (যেমন ইলেকট্রন ও প্রোটনের ভর ও চারটি প্রাকৃতির বলের শক্তি) একই থাকবে। কিন্তু কোনো অগ্রসর সভ্যতা যদি এমন শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করে, যেখানে মৌলিক ধ্রুবকগুলো কিছুটা আলাদা হয়? তাহলে শিশু মহাবিশ্বটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হতে থাকবে। শিশু মহাবিশ্বের প্রতি প্রজন্ম তার আগের প্রজন্ম থেকে কিছুটা আলাদা হতে থাকবে।

    আমরা যদি মৌলিক ধ্রুবকগুলোকে মহাবিশ্বের ডিএনএ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে এর মানে হবে, বুদ্ধিমান কোনো জীব হয়তো এমন শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারবে, যার ডিএনএ কিছু আলাদা। ক্রমান্বয়ে মহাবিশ্বগুলো বিকশিত হতে থাকবে। এগুলোর মধ্যে যে মহাবিশ্বের ডিএনএ বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশের জন্য সবচেয়ে ভালো, তার বংশবিস্তার করা হবে।

    লি স্মোলিনের আগের ধারণা নিয়ে পদার্থবিদ এডওয়ার্ড হ্যারিসন মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন। যে মহাবিশ্বটি মাল্টিভার্সে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, তার মধ্যেই সঠিকভাবে সবচেয়ে ভালো ডিএনএ আছে। সেটিই অগ্রসর সভ্যতার জন্য মানানসই। এভাবে তারা আরও শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করবে। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ সহজ মানে হলো, সেই মহাবিশ্বগুলো টিকে থাকবে, যেগুলো অগ্রসর সভ্যতা গঠনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে।

    এই চিত্র সঠিক হলে মহাবিশ্বের মৌলিক ধ্রুবকগুলো প্রাণের টিকে থাকার উপযোগী করে কেন সুষমভাবে সমন্বয় করা, তা ব্যাখ্যা করবে এটি। এর সহজ অর্থ হলো, যে মহাবিশ্বগুলোর কাঙ্ক্ষিত মৌলিক ধ্রুবকগুলো প্রাণের সঙ্গে মানানসই, সেগুলোই মাল্টিভার্সে বংশবিস্তার করে। (মহাবিশ্বের এই বিবর্তনের ধারণা বেশ আকর্ষণীয়। কারণ, এটি অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল-সংক্রান্ত সমস্যাটির ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে এই ধারণাটির জটিলতাও আছে। সেটি হলো, এটি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয় ও যাচাইযোগ্য কোনো প্রতিপাদ্য নয়। এ ধারণাটি বোঝার জন্য আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ থিওরি অব এভরিথিং পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে।)

    সমান্তরাল মহাবিশ্বের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য বর্তমানে আমাদের প্রযুক্তি একেবারেই আদিম। কাজেই একে দ্বিতীয় শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এখানে। তবে এখন করা অসম্ভব হলেও এটি পদার্থবিদ্যার কোনো সূত্র লঙ্ঘন করে না। কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ বছরে এই অনুমান হয়তো টাইপ থ্রি সভ্যতার জন্য নতুন প্রযুক্তির ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।

    তথ্যনির্দেশ

    টেসারেক্ট : জ্যামিতিতে ঘনকসদৃশ চতুর্থ মাত্রিক বস্তু।

    স্ফীতি তত্ত্ব : একেবারেই আদিম মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণের সংক্ষিপ্ত কাল, যখন মহাবিশ্ব আয়তনে বিপুল পরিমাণ প্রসারিত হয়েছিল। মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্বের দ্রুত প্রসারণ ব্যাখ্যার জন্য এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে সফল তত্ত্ব। ১৯৭০-এর দশকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অ্যালেস্কি স্টারোবিস্কি, অ্যালান গুথ আর অ্যান্দ্রেই লিন্ডে এ তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন।

    কোয়ান্টাম মহাকর্ষ : কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতাকে একীভূত করা একটি তত্ত্ব।

    অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল : আমরা এই মহাবিশ্ব এভাবে দেখি; কারণ, এটি যদি অন্য রকম হতো, তাহলে একে পর্যবেক্ষণ করার জন্য হয়তো আমাদের অস্তিত্বই থাকত না—এই ধারণা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারালাল ওয়ার্ল্ডস : বিকল্প মহাবিশ্বের বিজ্ঞান ও আমাদের ভবিষ্যৎ – মিচিও কাকু
    Next Article দ্য লাস্ট ডন – মারিও পুজো

    Related Articles

    মিচিও কাকু

    প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস : বিকল্প মহাবিশ্বের বিজ্ঞান ও আমাদের ভবিষ্যৎ – মিচিও কাকু

    November 10, 2025
    মিচিও কাকু

    দ্য গড ইকুয়েশন : থিওরি অব এভরিথিংয়ের খোঁজে – মিচিও কাকু

    November 10, 2025
    মিচিও কাকু

    ফিজিক্স অব দ্য ফিউচার – মিশিও কাকু

    November 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }