Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফেরারী অতীত – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤷

    ফেরারী অতীত

    তখনো ভালো করে ফর্সা হয়নি, বিশ হাত দূরে চোখ চলে না। কামরার মধ্যে বেশ একটা গুঞ্জন উঠতে রামকৃষ্ণবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। সামনে পাশে পিছনে ফটাফট জানলা খোলার শব্দ।

    পামবান ব্রিজ আসছে। গাড়ির গতি কমেছে। ওই ব্রিজ পার হলে খানিকক্ষণের মধ্যে রামেশ্বরম–সাদা বাংলায় রামেশ্বর। যাত্রীদের এই ব্রিজ সম্পর্কে একটু বাড়তি আগ্রহের কারণ আছে। এই সেতু পেরুলে মহামোক্ষ ক্ষেত্র। সেতুর এধারে বন্ধন ওধারে মুক্তি। ওই সেতু উত্তরণের আগে পার্থিব জগতের যা-কিছু সব ওধারেই ফেলে এসো।

    কজন সত্যিই তাই আসে রামকৃষ্ণবাবু জানেন না। তবু নির্লিপ্ত মুখে তিনিও সামনের জানলাটা খুললেন। ট্রেন ব্রিজে উঠলেই অন্যরকম শব্দ। এদিকের সবই ছোট লাইনের ছোট ট্রেন। তা সত্ত্বেও ব্রিজে ওঠার আগে থেকেই গাড়িটার শম্বুকগতি একেবারে। এটা কোনো নিরাপত্তার কারণে কি যাত্রীদের সুবিধার্থে রামকৃষ্ণবাবু জানেন না।

    আবছা অন্ধকার ভেদ করা একটা একাগ্রতা নিয়ে দেখতে লাগলেন তিনিও। শতসহস্র সেতুর মতোই একটা। তবে নীচে নদীর বদলে সমুদ্র–সমুদ্রের ফালিও বলা যেতে পারে। সেতুটা বিশাল বটে, অনেকক্ষণ লাগল পার হতে। কামরার মধ্যে মেয়ে পুরুষদের সমুদ্রে পয়সা ফেলার হিড়িক পড়ে আছে। লোভ কাম মোহ মাৎসর্যের প্রতীক দুনিয়া তিননয়া পাঁচনয়া দশনয়া সিকি আধুলি বিসর্জন দিয়ে মুক্ত মন নিয়ে মহাধামে পদার্পণের প্রেরণা কিনা এটা রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী জানেন না। একটি মহিলার তার দেড় বছরের শিশুকে দিয়েও সমুদ্রে পয়সা ফেলার উদ্দীপনা লক্ষ্য করে নিজের মনেই হেসেছেন।

    রামেশ্বরে গাড়ি থামল যখন, চারদিক বেশ পরিষ্কার। যাত্রীদের নামার তাড়ায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রামকৃষ্ণবাবু অপেক্ষা করলেন খানিক। তাঁর কোন তাড়া নেই। তিনি তীর্থ করতে আসেননি। কোনো মানত নিয়েও আসেননি। এখানে এক দিন থাকবেন। কি তিন দিন নিজেও জানেন না। ভালো লাগলে দুতিন দিন কাটাবেন, না লাগলে আবার বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভালই লাগছে তাঁর। জীবনের এই প্রৌঢ় প্রহরে থার্ড ক্লাস কামরার সর্বসাধারণের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরে বেশ একটা বৈচিত্র্যের স্বাদ উপভোগ করছেন। এদের কেউ তাকে চেনে না, কেউ জানে না, কেউ ঈর্ষা করে না, কেউ তোষামোদ করতেও আসে না। নামের মোহ, নামের। যশখ্যাতি, প্রতিপত্তির শেকল থেকে একটা মুক্তির স্বাদ যে এভাবে অনুভব করা যায়। –রামকৃষ্ণবাবু দীর্ঘদিনের আরাম-ঘরে বন্দী থেকে সেটা যেন ভুলতেই বসেছিলেন। …বাড়ির গাড়িতে মেয়ে আর ছোট ছেলে সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে এসে মাদ্রাজ মেলের ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ কামরায় তুলে দিয়ে গেছল। বড় আর সেজ ছেলে খুঁতখুঁত করছিল।–এয়ার কনডিশনে গেলেই ভালো হত। তিন বউমা রেশারেশি করে যাত্রার সুব্যবস্থায় উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু শেষ পর্যন্ত একটা হোলড অল আর ছোট সুটকেস ভিন্ন আর কিছুই নিতে রাজি হলেন না দেখে তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছে। শ্বশুরের একটু বিবাগী মনোভাব লক্ষ্য করে ভিতরে ভিতরে যেন উতলা হয়েছে তারা। ফার্স্ট ক্লাস থেকে বেরিয়ে থার্ড ক্লাস কামরায় এ-ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি, জানলে তাদের চোখগুলো কপালে উঠত। মেয়ে বার-বার করে বলে দিয়েছে, দুদিন পরে পরে একখানা করে চিঠি দেবে বাবা, নইলে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় থাকব। বড় বউমা বলেছিল, ঠিকঠিক খবর না পেলে কিন্তু আপনার ছেলে কাজকর্ম ফেলে মাদ্রাজ ছুটবে। তখন অন্য বউমাদের দিকে চেয়ে রামকৃষ্ণবাবুর মনে হয়েছে- এ-রকম কথা ওদেরও বলার ইচ্ছে ছিল।

    ..মাদ্রাজে পৌঁছে তিনি টেলিগ্রামে পৌঁছানো-সংবাদ এবং কুশল সংবাদ দিয়েছেন। তারপর সাতদিনের মধ্যে অনির্দিষ্ট পর্যটনে বেরিয়ে পড়ার আগে তাদের চিঠি লিখে জানিয়েছেন, এত ভালো আছি যে এক জায়গায় আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বেরিয়ে পড়ছি, কখন কোথায় থাকব এরপর ঠিক নেই, নিয়মিত চিঠিপত্র না পেলে একটুও চিন্তা কোরো না।

    …দেখলে কেউ বলবে না রামকৃষ্ণবাবুর বয়েস এখন সাতান্ন। শরীর শক্ত মজবুত এখনো। চুলের তলায় তলায় কিছুটা পাক ধরেছে, একটা দাঁত নড়েনি বা পড়েনি। এখন তার পোশাক ঢোলা পাজামা আর ঢোলা রঙিন পাঞ্জাবি। এই পোশাকে বয়েস আরো কম দেখায়। এভাবে বেরিয়ে পড়ার পর রামকৃষ্ণবাবু যেন একটা ভারী মহার্ঘ্য জিনিস ফিরে পেয়েছেন। সেটা তাঁর যৌবন আর যৌবনস্মৃতি। শক্তসমর্থ লোকের মতোই ঘোরাফেরা করছেন–কারো মুখাপেক্ষী নন, সম্পূর্ণ নিজের ওপর নির্ভরশীল। …দীর্ঘদিন ধরে এই আত্মপ্রত্যয়টুকুই তিনি খুইয়ে চলেছিলেন। ছেলেমেয়ে বউমা নাতি নাতনী পরিবৃত হয়ে তিনি যেন অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বেশ একটা খোশমেজাজের জরা নেমে আসছিল তার ভিতরে বাইরে।

    ..প্রত্যয়ের এই নতুন স্বাদে ভরপুর হয়ে স্ত্রীর কথাও চিন্তা করেছেন বইকি। আজ পাশে সে শুধু সে থাকলে বেশ হত। স্ত্রীর বেড়াবার ঝোঁকও ছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু তখন সাফল্যের ভরা জোয়ারে ভাসছেন, এই জোয়ার থেকে কেউ তটে এসে বিরাম চায় না।

    গাড়ি ফাঁকা। যাত্রীরা সব নেমে গেছে।

    রামকৃষ্ণবাবু উঠলেন। কুলীর মাথায় হোলড়-অল আর ছোট সুটকেস তুলে দিয়ে প্রথমে রেলওয়ের রিটায়ারিং রুমের সন্ধানে এলেন।

    সিঙ্গল রুম ভাড়া হয়ে গেছে, ডাবল রুমের ভাড়া বেশি–সেটা খালি আছে। রামকৃষ্ণবাবু সেটা বুক করে মালপত্র রেখে নিশ্চিন্ত।

    রামেশ্বরে এসে সমুদ্রস্নান না করলে আসাটাই অসমাপ্ত। পুণ্যের লোভ না থাকলেও সমুদ্রস্নানের ইচ্ছে আছে রামকৃষ্ণবাবুর। মুখ-হাত ধোওয়া চা-খাওয়া ইত্যাদির পর গামছা আর নতুন একপ্রস্থ পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধে ফেলে বেরিয়ে এলেন। রামেশ্বরের মন্দির এবং স্নানের জায়গা কাছাকাছি। স্নান সেরে মন্দিরে পূজো দেওয়ার বিধি।

    টমটমে করে স্নানের বাঁধানো চাতালের সামনে নামলেন। স্টেশন থেকে তিন। কোয়ার্টার মাইল পথ হবে–রোদ চড়া তখন।

    এ-সময় সমস্ত মানুষেরই গন্তব্যস্থান ওই একটি। টমটম থেকে নামতেই দুজন পাণ্ডার চেলা দুদিক থেকে এগিয়ে এলো। এদিকের পাণ্ডার সঙ্গে তাদের তফাৎ হল তারা বিনীত বেশ। রামকৃষ্ণবাবু মাথা নাড়লেন, পাণ্ডার দরকার নেই। একটু চেষ্টা করে একজন সরে গেল, আর একজন ছোকরা কিন্তু লেগেই থাকল। সে আবার জামা জুতো রাখার ভার নেবে, পূজোর সব ব্যবস্থা এবং দর্শনাদি করিয়ে দেবে, এমন কি আজকের বিশেষ পূণ্যদিনে ওই যে মাতাজী এসেছেন রামঝরক্কা থেকে, তারও দর্শনলাভের এবং আশীর্বাদলাভের ব্যবস্থা করে দেবে।

    সমুদ্রের ডানদিক ঘেঁষা উঁচু বিশাল বাঁধানো চাতালের একদিকে হাততুলে দেখালো সে। সেখানে দস্তুরমতো মেয়ে-পুরুষের ভিড়। অর্থাৎ মাতাজীর দর্শন এবং আশীর্বাদ। লাভ করছে তারা।

    রামকৃষ্ণবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু লোকটা নাছোড়। সবিনয়ে বলতে লাগল, দেবস্থানম-এ এসেও ছেলেমেয়ের কল্যাণের জন্য পূজো দেবে না এ কেমন কথা বাবুজী– ভগবানের কাছে ডালি দাও, ছেলেপুলের ভালো হবে।

    এইবার রামকৃষ্ণবাবু থমকালেন। ছেলেমেয়ের কল্যাণ তিনি চান, মঙ্গল চান। পূজো দিলে কতটুকু কল্যাণ বা মঙ্গল হবে জানেন না, কিন্তু না দিলে ক্ষতি হবে কিনা কে জানে। আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাননি, কোথায় কি আছে, কোন জায়গার কি স্থানমাহাত্ম কে জানে?…কাতারে কাতারে লোক সমুদ্রে স্নান করছে, সকলেই তারপর পূজো দেবে। কিছুই যখন জানেন না কি হয়, আত্মাভিমান নিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার দরকার কি? তাছাড়া এখানে কে চিনছে, কে জানছে তাঁকে? পরে ছেলেমেয়েদেরও জানার দরকার নেই…এই আত্মপ্রসাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার দরকার কি?

    চেলার হাতে জামাকাপড় জিম্মা করে কোমরে গামছা জড়িয়ে তিনি সমুদ্রে নামলেন। তার আগে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলেন, পাণ্ডার চেলা তরতর করে ওই বাঁধানো উঁচু চাতালে উঠে গেল। মন্ত্র-মোক্ষদাতারা সব ওখানেই বসে।

    অনেকক্ষণ ধরে চান সেরে উঠে এলেন। নুন-জলে গা চটচট করছে। ঘরে ফিরে আবার একদফা চান করতে হবে। কিন্তু খুব তাজা লাগছে এখন, আর বয়েসটা যেন আরো কম ঠেকছে নিজেরই।

    ডালি হাতে পাণ্ডা চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে। ভিজে জামাকাপড় বদলানোর নামে সে ঘনঘন মাথা নাড়লে। সিক্তবস্ত্রে পূজো দেওয়ার বিধি। বলল, চাতালের ওই পুরোহিতের কাছে মন্ত্রপাঠ শেষ করে মন্দিরে যেতে হবে। তারপর দ্বাদশ কুণ্ডর মিঠে জলে স্নান করে দর্শন ও পূজো শেষ করতে হবে।

    মিঠে জলের স্নান ছাড়াও নিজের সহিষ্ণুতা যাচাইয়ের ইচ্ছেও হল। নেমে গেছেন। যখন রামকৃষ্ণবাবু–সব ঠিক আছে।

    এগারোটি টাকা আগে গুনে দিয়ে পুরোহিতের সামনে আসনে বসলেন। পুরোহিত জিজ্ঞাসা করলেন, কার কল্যাণে পূজো?

    একটু ভেবে রামকৃষ্ণবাবু তিন ছেলে আর মেয়ের নাম করলেন। মনে মনে তাদের সুমতি প্রার্থনা করলেন। পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র আওড়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই বিমনা হয়ে পড়লেন। ছেলেদের, মেয়ের, বউমাদের একে একে সকলের মুখগুলো চোখে ভাসল রামকৃষ্ণবাবুর–আর কিছু না চেয়ে শুধু সুমতি চাইলেন কেন?

    না, বাইরের আচরণে কোনদিন কারো ওপর বিরূপ হননি রামকৃষ্ণবাবু। কিন্তু চাপা খেদ বা ক্ষোভ একটু ছিল বইকি। নিজের স্ত্রীর মেজাজপত্র খুব ভালো ছিল না। হয়তো একটু অল্পেতেই রেগে যেতেন। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু ঠিকই অনুভব করতেন ছেলেরা বা বউমারা তাদের মা বা শাশুড়ীর ওপর তুষ্ট ছিল না খুব। ওদের আচরণে আঘাত পেয়ে স্ত্রীকে অনেক সময় স্তব্ধ দেখেছেন। ছেলেদের অথবা ছেলের বউদের কিছু বলতেন না, স্ত্রীকেই বোঝাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মনের ব্যথা মনেই চাপা থাকত।

    শাশুড়ীর পরে কর্তৃত্বের হাত-বদল হয়েছে। ছেলেরা চোখ রাখে তার ওপর, বউমারা যথাসাধ্য সেবা-যত্ন করে, মেয়ে একদিন অন্তর একদিন এসে বাপের খবর নেয়। তবু সে-সবের কোনো তাপ যেন বুকের তলায় স্পর্শ করে না। উল্টে টুকরো টুকরো এক-একটা ব্যাপার মনে পড়লে হাসি পায়। কিন্তু সে-হাসি খুব সুখের নয়। … বাড়িটা তিন ছেলের নামে লেখাপড়া করে দেবার পর মেয়ে-জামাইয়ের মুখ শুকনো-শুকনো মনে হয়েছে। বাড়িটার দাম ধরে তার তিন ভাগের এক ভাগ নগদ টাকা মেয়ে-জামাইয়ের নামে চালান করার সময় আবার ছেলেদের বা বউমাদের মুখে তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি।

    ..গল্প উপন্যাস মিলে কম করে দেড়শ বই আছে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর; এই সাতান্ন বছর বয়সেও সম্পাদক আর প্রকাশকদের তাগিদের জ্বালায় অস্থির হতে হয়। সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকরা এখনো বাড়িতে হানা দেয়। তার লেখা বহু উপন্যাস গল্প এযাবত ছবি হয়ে গেছে–আরো অনেক হতে পারে। এ ছাড়াও ওই দেড়শ গল্প-উপন্যাসের বইগুলো বেশির ভাগই সচল এখনো। মাস গেলে মোটা রয়েলটি আসে। এই সব বই কিভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে ছেলেদের আর মেয়ের মনে সেজন্যে একটু প্রচ্ছন্ন উদ্বেগ আছে মনে হয়। ছেলেরা একবার হালকা কথাবার্তার ফাঁকে এই প্রসঙ্গ উত্থাপনও করেছিল।

    হঠাৎ সচকিত রামকৃষ্ণবাবু, পুরোহিতের মন্ত্র পড়ানো কখন শেষ হয়েছে কে জানে–বাবুকে ভাব-তন্ময় মনে করে পুরোহিত আর তার চেলা নির্বাক।

    ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। চাতাল অনেকটা ফাঁকা এখন। কোণের দিকের মাতাজীর সামনে মাত্র পাঁচ-সাতটি মেয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে এখন। বাতাসে তার লালপাড় শাড়ির আঁচল উড়ছে। একটু উঁকি দিলেই রামকৃষ্ণবাবু মাতাজীর মুখ দেখতে পেতেন, কিন্তু সে-রকম কোন আগ্রহ হলো না।

    চেলা মন্দিরের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দক্ষিণভারতে বহু মন্দির কল্পনাতীত স্থপতিমাহাত্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে। রামেশ্বরের মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয়। এর করিডরটিই শুনেছি চার হাজার ফুট।

    পুরী বারাণসী গয়াধাম ইত্যাদি দ্বাদশ কূপের চব্বিশ বালতি মিঠে জল তার মাথায় ঢাললো পাণ্ডার চেলা। স্বচ্ছ জল, ভালো লাগল। তারপর সেই ভিজে জামা-কাপড়ে চল্লিশ মিনিট লাইনে দাঁড়ানোর পর দর্শন এবং পূজো শেষ।

    গায়ে ভিজে জামা-পাজামা, খালি পা, বাইরে মাটি তেতে আছে, মাথার ওপর সূর্য জ্বলছে। এবারে একটু ক্লান্ত বোধ করছেন রামকৃষ্ণবাবু। চেলার সঙ্গে চাতালে এসে উঠলেন আবার–সেখানেই শুকনো জামা-কাপড়। কোণের মাতাজীর সামনে জনাতিনেক লোক তখন। রমণী এদিকেই চেয়ে আছেন–সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে রামকৃষ্ণবাবু আড়চোখে তাকালেন একবার–কালোকুলো মুখের একপাশ দেখতে পেলেন। রমণী তার দিকেই চেয়ে আছেন মনে হল, কিন্তু রামকৃষ্ণবাবুর তখন ঘরে ফেরার তাড়া। সোজা চাতালের আড়ালে চলে গেলেন। জামা-পাজামা বদলে ভিজেগুলো হাতে তুলে নেবার আগে একজন স্থানীয় লোক এসে চেলাটির কানে কানে কি বলতেই। সে ব্যস্তসমস্ত মুখে চলে গেল।

    রামকৃষ্ণবাবু সোজা চাতাল থেকে নেমে এলেন। চেলার প্রাপ্য সে আগেই পেয়েছে। মাতাজীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সে কথা বলছে। মাথায় কাপড় তোলা মাতাজীর কালো মুখের একটু আভাস মাত্র পেয়েছেন। তা দক্ষিণভারতে রূপসী রমণীর দর্শনলাভ একটা বিরল, ব্যাপার।

    বিকেলে আবার বেড়াবার জন্য রাস্তায় নামলেন। পায়ে পায়ে টাঙ্গা আর টমটম ঘেঁকে ধরছে–এখানকার যাত্রীদের পাঁচ পা হাঁটতে দেখলেও ওরা বরদাস্ত করতে চায় না। সমুদ্র বা মন্দিরের দিকে এগোতে মালা-অলা আর শাক-অলারাও সঙ্গ নিতে ছাড়ে না।

    –রামঝরুক্কা–বাবুজী রামঝরুক্কা চলিয়ে!

    কম করে দশটা টাঙ্গাঅলার মুখে এই একই হাঁকডাক শুনলেন রামকৃষ্ণবাবু। রামঝরুক্কা কি ব্যাপার বোধগম্য হল না।

    এক ছোকরা টাঙ্গাঅলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, রামঝরুক্কা কেয়া হ্যায়?

    সাগ্রহে টাঙ্গা থেকে নেমে এসে ও বলল, রামজীকো চরণ দর্শন হোগা, নসিব হো তো মাতাজী কো গানা ভি শুনিয়েগা–আই-এ সাব, বৈঠিয়ে।

    উঠে বসেই পড়লেন।

    দুদিকের তেঁতুল-সারির মাঝখান দিয়ে সুন্দর পাকা রাস্তা। মাইল তিনেক বাদে। রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের সামনে এসে থেমেছে। সামনে একতলা সমান প্রশস্ত বাঁধানো চাতাল, তার ও-পাশে একতলার মতো সিঁড়ি ভাঙলে মন্দির।

    চাতালের সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো। সেটা পড়ে হাসিই পেয়ে গেল। জায়গা বা মন্দিরের নাম হল রামজী রুককা। অর্থাৎ সীতা অন্বেষণের পথে রামজী এখানে থেমেছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের অপর প্রান্তে স্বর্ণলঙ্কার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন।

    মন্দিরে উঠলেন। চারদিকে রেলিং-ঘেরা বাঁধানো চাতালের মাঝখানে ছোট মন্দির। সেখানে রামজীর পাষাণ-চরণচিহ্ন। সেই দর্শন সারতে এক মিনিটও লাগে না। চাতালের চারদিকে ঘুরে সমুদ্র দেখাটা সত্যিই লোভনীয়। সেই উদ্দেশ্যে সবে দরজা দিয়ে। বেরিয়েছেন–সেখানকার একজন লোক তার কাছে এসে সবিনয়ে জানালো, মাতাজী বোলাতে।

    এ আবার কি বিড়ম্বনা রে বাবা! মাতাজী তাকে ডাকেন কেন? গানের সমজদার ভেবেছেন নাকি? চারদিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কঁহা মাতাজী?

    মন্দিরের পিছনটা দেখিয়ে লোকটা তাকে রেলিংঘেরা চাতাল ধরে পিছনদিকে নিয়ে চলল।

    লালপেড়ে শাড়িপরা সকালের সেই রমণী বসে। সোজা সামনের দিকে অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে মুখ। পিছন থেকে কালো দেহের আঁট-বাঁধুনী দেখে খুব বেশি বয়েস মনে হল না মাতাজীটির। ইনি ওখানে বসে রামকৃষ্ণবাবুর এইস্থানে আগমন টের পেয়ে লোকমারফৎ ডেকে পাঠালেন কি করে? হয়তো আসার সময় দেখে থাকবেন!

    নমস্তে।

    –নমস্কার। বোসো। বলতে বলতে তার দিকে ঘুরে তাকালেন মাতাজী।

    সেই মুহূর্তে মাথার মধ্যে এই পৃথিবীটাই বুঝি উল্টেপাল্টে যেতে লাগল রামকৃষ্ণবাবুর। কিন্তু বাইরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। বিস্ফারিত চোখে দেখছেন। দেখার পরেও বিশ্বাস করবেন কি করবেন না জানেন না।…তেইশ বছরের একটা মেয়ের মুখে চোখে সর্ব অঙ্গে তিরিশটা বছর জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায়? কেমন দাঁড়ায়? অথচ আশ্চর্য, এঁর সামনে এসে দাঁড়ালে, ভালো করে একটু তাকালে, তিরিশ বছর আগের সেই তেইশ বছরের মেয়েকে চিনতে একটুও সময় লাগে না। রামকৃষ্ণবাবুরও সময় লাগল না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।

    মাতাজী এবারে খানিকটা ঘুরেই বসলেন তার দিকে। হাসিমাখা স্নিগ্ধ মুখ।…তিরিশ বছর আগে ওই মুখে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা ছিল না, আজও নেই। কিন্তু সেদিনও মুখের হাসিটুকু ভালো লাগত, আজ সেটা স্নিগ্ধ কমনীয় লাগছে।

    –চিনতে পারছ না?

    দাঁড়িয়ে থাকার দরুন মাথার চুল আরো বেশি উড়ছে রামকৃষ্ণবাবুর। মাথা নাড়লেন। পারছেন।

    সামনের ঝকঝকে মেঝে দেখিয়ে মাতাজী বললেন, তাহলে বোসো–সকালে রামেশ্বরের ঘাটে দেখার পর থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

    বাহ্যজ্ঞানরহিতের মতো রামকৃষ্ণবাবু বসলেন। চেয়েই আছেন মুখের দিকে। এভাবে সামনে বসতে, মুখের দিকে চেয়ে থাকতে এ-বয়সে কোনো দ্বিধা বা সংকোচ থাকার কথা নয়। তার ওপর ইনি মাতাজী এখানকার। শ্রীরামচন্দ্রের চরণদর্শনে যারা আসছে, অলিন্দ ঘুরে তারা একবার মাতাজীকৈও দর্শন করছে–তফাতে দাঁড়িয়ে দুহাত জুড়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। হয়তো তাঁর নির্দেশেই মন্দিরের ভক্ত দুটি আপাতত কাউকে কাছে আসতে দিচ্ছে না।

    মুখের ওই হাসি এখন আরো অদ্ভুত লাগছে রামকৃষ্ণবাবুর।… তার থেকে চার বছরের ছোট, অর্থাৎ তিপ্পান্ন হবে বয়েস এখন। তেতাল্লিশও দেখায় না। কালো মুখের চামড়ায় যেটুকু ভাজ পড়েছে তাও জরার দাগ মনে হয় না। দুই ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসি দুই গালের দিকে ছড়িয়ে ওই ভঁজের মধ্যে পড়ে যেন অদ্ভুত চিকচিক করছে।–তারপর উপচে উঠে চোখের কালো তারার দিকে ধাওয়া করছে। বাতাসে বিশৃঙ্খল হয় বলেই হয়তো চুলের বোঝা টান করে পিছনে এসে গোড়ায় শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। বন্ধনীর নীচে একপিঠ চুল কোমরের নীচ পর্যন্ত তাণ্ডব জুড়ে দিয়েছে। কান দুটো চুলে ঢাকা পড়েনি, ওই হাসি যেন শেষে কানের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়েছে।

    খুব হালকা সুরে বললেন, এ জায়গাটার মাহাত্ম আছে, একদিন রামচন্দ্র রুকেছিলেন এখানে, আজ রামকৃষ্ণ রুকলেন।

    রামকৃষ্ণবাবু বলতে পারতেন, রামচন্দ্র সীতা-সন্ধানে এসেছিলেন, রামকৃষ্ণের কোনো হারানো-প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই।

    কিছুই বললেন না। চেয়ে আছেন। দেখছেন।

    রামেশ্বরের ঘাটে দেখলাম বেশ ধর্মেকর্মে মতি হয়েছে।…একবার ফিরেও তাকালে না।

    রামকৃষ্ণবাবু আত্মস্থ করলেন নিজেকে। এ-রকম বিড়ম্বনা ভোগ করার তার অন্তত কোনো কারণ নেই! জবাব দিলেন, কলকাতার শুভা গাঙ্গুলী এখানে মাতাজী হয়ে বসে থাকতে পারেন, এটা কোনো কল্পনার মধ্যে ছিল না—

    রমণীর মুখে সেই অদ্ভুত সুন্দর নিঃশব্দ হাসিটা আরো যেন বেশি উপচে পড়ছে।–তাছাড়া চেহারাটাও ফিরে তাকানোর মতো নয়।

    কেন যে হঠাৎ আবার বিব্রত বোধ করছেন রামকৃষ্ণবাবু, জানেন না। কোনো একদিন দেখা হলে কৈফিয়ত তো তারই নেবার কথা। ঘরে আর একজনকে আনার পরেও এই এক রমণীকে দীর্ঘদিন ভুলতে পারেন নি। ভুলবেন কি করে, নিরুদ্দেশ হবার পরেও কম করে তিন চার বছর রেডিওতে আর রেকর্ডে তার গান বাজার কামাই নেই। তারপর অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই বিস্মৃত হয়েছেন।

    যে লোকটি তাকে মাতাজীর কথা বলে এদিকে নিয়ে এসেছিল, সে অদূরে এসে দাঁড়াল। তাদের মাতাজী সপ্রশ্ন চোখে তাকাতে সে জানান দিল, টাঙ্গাঅলা বাবুজীকে ভাকছে।

    স্পষ্ট হিন্দীতে মাতাজী নির্দেশ দিল, আমার নাম করে তাকে বলে দাও অনেকক্ষণ বসতে হবে–বাবু ডবল ভাড়া দেবেন। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলিয়ে তার চোখে চোখ রেখে দেখলেন একটু।–তোমার তাহলে তিন ছেলে আর এক মেয়ে এখন?

    ঈষৎ বিস্ময়ে মাথা নাড়লেন রামকৃষ্ণবাবু- তাই।

    -না, মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানি না, যে পাণ্ডার মারফত ওদের কল্যাণে পুজো দিলে তার কাছে শুনলাম!…তা একা তীর্থে এলে, স্ত্রীকে নিয়ে এলে না কেন?

    –তিনি অনেক বড় তীর্থে চলে গেছেন।

    মহিলা থমকালেন একটু।–কতদিন আগে?

    –বছর দেড়েক।

    শুভ গাঙ্গুলী ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন একটা।ভাগ্যবতী বলতে হবে। …ছেলেমেয়েদের সব বিয়ে-থা হয়ে গেছে?

    মাথা নাড়লেন– হয়েছে।

    –তারা কেমন?

    –ভালো।

    -এ বয়সে একলা তোমাকে তীর্থ করতে ছেড়ে দিলে?

    –তীর্থে বেরোইনি আমি–মাদ্রাজ থেকে হঠাৎ ঘোরাঘুরির নেশায় পেয়ে বসেছে।

    ভিতরটা ভয়ানক উসখুস করে উঠছে রামকৃষ্ণবাবুর। কৈফিয়ত চাইবার সময় আর প্রয়োজন বহুকাল আগে ফুরিয়েছে। এখন শুধু কৌতূহল একটু।…প্রতিশ্রুতি ভুলে, ভবিষ্যৎ ভুলে, গান ফেলে তিরিশটা বছর আগে শুভ গাঙ্গুলী হঠাৎ কার সঙ্গে ওভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছল, আর এখন সেই মানুষের খবর কি- ঠোঁটের ডগায় বার বার এই প্রশ্নটাই আসছে শুধু।

    ..তিরিশটা বছর অনায়াসে চোখের সামনে থেকে সরে গেছে রামকৃষ্ণবাবুর। তিরিশটা কেন, তারও ঢের বেশি।

    . …ন’দশ বছর বয়েস থেকেই নিজের কালো কুৎসিত বয়েস সম্পর্কে সজাগ ছিল একটা মেয়ে। তার নাম শুভাশুভ গাঙ্গুলী। রামকৃষ্ণবাবুর দিদির ভাসুরের মেয়ে। মধ্যবিত্ত অবস্থার মানুষ। সেই কুৎসিত মেয়েটা এমন কিছু গুণের অধিকারিণী হতে চেয়েছিল, যার আলোয় রূপের খেদ ঢাকা পড়ে যেতে পারে।

    …সেরকম গুণের অধিকারিণী হতে পেরেছিল। গান- চৌদ্দ বছর বয়সে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। তেইশ বছরের মধ্যে তার রেকর্ডের ছড়াছড়ি। বড় বড় সব জলসা থেকে ডাক আসে, সিনেমায় প্লে-ব্যাকের ডাক আসে। শেষের দুটো বছর রেকর্ড আর প্লে-ব্যাকের দরুন অবিশ্বাস্য টাকা এসেছিল সেই মেয়ের হাতে।

    ..আর যে ছেলেটার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে তার হৃদ্যতা, তার নাম রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। শুভার মা নেই, ভাসুর-ভাসুরঝির বাস দিদির কাছেই।…ওই মেয়ে তার লেখক জীবনের প্রথম প্রেরণা। তার সঙ্গে প্রতিটা লেখা নিয়ে কত আলোচনা, কত মতভেদ।

    নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবেন স্থির করে ফেলেছিলেন রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী।

    …বাইরেটা কুৎসিত কিন্তু ভেতর তো সুন্দর। চোখ বুজে গান শোনে যখন, স্থান কাল ভুল হয়ে যায়।…তা ছাড়া বয়সেরও একটা রূপ আছে, সেই রূপই চোখে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। শুভার গানের কদর চারদিকে যতো বাড়ছে–রূপের প্রশ্নটা ততো গৌণ ভাবতে চেষ্টা করেছেন রামকৃষ্ণ।

    কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গে মেয়েটা হাসে শুধু। হাঁ-না কিছুই বলে না। কালো মুখে রঙের ছোপ লাগে সেটা অবশ্য রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর চোখ এড়ায় না। ওদিকে গানের টাকা আসছে–ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে- রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী অন্তত চারজনকে জানেন, যাদের যে-কোনো একজন শুভার একটু চোখের ইশারা পেলে বিয়ে করে তাকে সাদরে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী ঠাট্টা করে ওদের নিয়ে। শুভ গাঙ্গুলী হাসে খুব। বলে, স্টুডিওতেও জনাতিনেক আছে যারা পাগল করে ছাড়লে!

    মনস্থির করে ফেলার পরেও ওই মেয়ের সাড়া না পেয়ে ভিতরে ভিতরে রামকৃষ্ণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন। অথচ মেয়েটা যে তার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে সেই। আভাসও পেয়েছেন। গানের জন্যে যে মেয়েকে সাধ্যসাধনা করতে হয়, সেই মেয়ে নিরিবিলিতে তাঁকে দশখানা গান শোনাতেও আপত্তি করে না।

    …ছেলেটার সাতাশ আর মেয়েটার তেইশে এক বিপর্যয় ঘটে গেল। ওই মেয়ে প্রশ্রয় না দিলেও প্রেমিকের সংখ্যা বাড়ছে দেখে ছেলেটার ইদানীং মেজাজ চড়া প্রায়ই।

    বৃষ্টিতে কলকাতা ভেসে যাচ্ছিল সেই রাতে। দিদি-জামাইবাবু কোথাও বেরিয়ে আটকে গেছেন বোধহয়। তিনতলার ঘরে চোখ বুজে একের পর এক গান শুনে যাচ্ছিলেন রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। এক-একটা গান শেষ হলে শুভার চোখে চোখ মেলছিলেন। হঠাৎ উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল ছেলেটা। শুভার মুখে শংকা, চোখে বিস্ময়।–কি?

    রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী এগিয়ে এলেন। খুব কাছে। তানপুরা সরিয়ে দিলেন। তারপর শক্ত দুই হাতে একেবারে বুকের ওপর টেনে আনলেন ওকে। আমাদের বিয়ে হবে কি হবে না?

    – ছাড়ো, আঃ!

    বাধা পড়ল। দুটো পুরু ঠোঁটের মধ্যে শব্দটা হারিয়ে গেল। অসহিষ্ণু তাড়নায় মেয়েটাকে, বুঝি গ্রাস করে ফেলবেন।–বিয়ে হবে কি হবে না?

    সমস্ত মুখে বেগুনে রং শুভার। কাঁপছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। –কি করছ! ছাড়ো, কেউ এসে গেলে–

    আবার আসুরিক বাধা পড়ল। তারপর আবার সেই প্রশ্ন। আমাদের বিয়ে হবে কি হবে না?

    হাল ছেড়ে ওই মেয়ে কালো টানা-টানা দুই অসহায় চোখ তার মুখের ওপর রাখল।–হবে। ছাড়ো।

    এই ঘটনার ঠিক পাঁচদিনের মাথায় ওই মেয়ে নিখোঁজ।…যে চারটে ছেলে তার প্রত্যাশায় বাড়িতে আসত, তাদের দেখা মিলেছে। রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী আর তাদেরও ধারণা, স্টুডিওরই কোনো একান্ত গুণগ্রাহীকে নিয়ে শুভ গাঙ্গুলী উধাও হয়েছে। দিদির মুখে শুনেছে, যাবার আগে ওই পাঁচদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে নিজের নামের সব টাকাও তুলে নিয়ে গেছে।

    ….তিরিশ বছর বাদে এই দেখা।

    রামকৃষ্ণবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছ?

    তেমনি হাসিমুখে মহিলা জবাব দিলেন, তোমাকেই দেখছি।… তিরিশটা বছর কেটে গেল, এ যেন বিশ্বাস হয় না, মনে হয় সব সেদিনের কথা। চোখ বুজে তোমার সেই গান শোনা আজও যেন চোখের সামনে দেখছি।

    রামকৃষ্ণবাবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। পুরনো দিনের স্মৃতির শুধু এটুকুই চোখে ভাসার কথা নয়।

    রমণীর কালো মুখে খুশিভরা কৌতুক।–আচ্ছা, তোমার বউ রূপসী ছিলেন নিশ্চয়?

    –রূপসী না হোক, মোটামুটি ভালোই ছিলেন দেখতে। জবাবটা দিতে পেরে মনে মনে খুশী হলেন রামকৃষ্ণবাবু।

    মুখ টিপে হাসছেন মহিলা। আবার কি মনে পড়ল হঠাৎ। মুখে সেই রকমই কৌতুকের মিষ্টি ছটা–আর তোমার পরের সব বইয়ের নায়িকারাও কি প্রায় সুন্দরী নাকি?

    এবারে আর রামকৃষ্ণবাবু জবাব দিলেন না। ভিতরে ভিতরে কেন যে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন জানেন না। পুরনো স্মৃতি সবই মুছে গেছল, তিরিশ বছর বাদে আবার সেটা তাজা করে তোলার ব্যাপারে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। ভিতরে তার একটাই কৌতূহল। শুভ গাঙ্গুলীকে আজ তিনি এখানে এই বিজনে এ অবস্থায় দেখছেন কেন? অথচ কালো মুখের ওই হাসির সঙ্গে যেন সত্তার যোগ-পিছনে যা ফেলে এসেছেন। তার জন্যে যেন এতটুকু খেদ নেই, ক্ষোভ নেই।

    প্রশ্নের সুযোগ মহিলাই দিলেন। বললেন, এতকাল পরে দেখা, আমার কোনো। খবর জিজ্ঞাসা করলে না তো?

    –জিজ্ঞাসা করলে বলবে?

    –ওমা, না বলার কি আছে!

    –এই জীবনে অভ্যস্ত হতে তোমার কতদিন লেগেছে?

    –বেশি দিন না। গানের কল্যাণে ভারী সহজেই সব সয়ে গেল।

    –অর্থাৎ যার জন্যে তোমার এতখানি আত্মত্যাগ, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই তোমাকে ছেড়ে গেছেন?

    জবাব দিলেন না। রামকৃষ্ণবাবুর আবার মনে হল, কালো মুখের তলায় তলায় আবার সেই বিচিত্র হাসির উৎসমুখ যেন খুলে গেছে। কালো ত্বকের ভিতর দিয়ে সেই হাসির তরঙ্গও বুঝি দুচোখ মেলে দেখার মতো।

    -জবাব দিলে না! রামকৃষ্ণবাবু বললেন, তবু আরো একটু কৌতূহল আমার –আমাদের সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যে মানুষটিকে সেদিন অনুগ্রহ করেছিলে তাকে কি আমি চিনি?

    সমস্ত মুখেই হাসি চিকচিক করছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রামকৃষ্ণবাবুর। এবারে মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লেন মহিলা– অর্থাৎ চেনেন।

    -নাম বলবে না বোধ হয়?

    –বললে কি করবে, তিরিশ বছর বাদে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে ছুটবে?

    –না, শুধু জানার ইচ্ছে। আর সত্যিই তুমি সুখী কিনা!

    কালো মুখে সেই হাসির নিঃশব্দ তরঙ্গের ছেদ নেই। হাসিমাখা দুই চোখ তার। চোখের ওপর অপলক কৌতুকে স্থির হয়ে আছে। তেমনি মিষ্টি স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর মহিলার। বললেন, তার নাম রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী–যে ভদ্রলোক চোখ বুজে আমার গান। শুনত আর কল্পনার জোয়ারে ভাসত, যার গল্পের নায়িকারা সকলেই সুন্দরী, আর যে ভদ্রলোক আমাকে ছেড়ে আমার গানকে বিয়ে করার জন্য একেবারে ক্ষেপে উঠেছিল! আমি সরে এসে তাকে রক্ষা করতে পেরেছি, নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। –আমার মতো সুখী কে আছে!

    মুহূর্তের মধ্যেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা তোলপাড় কাণ্ড ঘটে গেল বুঝি রামকৃষ্ণবাবুর ভিতরে ভিতরে। তারপর নির্বাক, নিষ্পন্দ, বিমূঢ়, একেবারে।

    কালো মুখের হাসির আলো মিলায়নি একটুও। ঈষদুচ্চ স্নিগ্ধ গলায় ডাকলেন, লছমন!

    স্থানীয় সেই লোকটি এগিয়ে এলো।

    মহিলা সুন্দর হিন্দীতে বললেন, বাবুজী যাবেন এখন, অন্ধকার হয়ে আসছে, সঙ্গে গিয়ে টাঙ্গায় তুলে দিয়ে এসো।

    কথার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, হাসির তরঙ্গ কমেছে, কিন্তু সমস্ত মুখে তার কমনীয় রেশ ছড়িয়ে আছে। বললেন, ভজনের সময় হল, আমার আর বসার জো নেই

    যন্ত্রচালিতের মতো উঠলেন রামকৃষ্ণবাবুও। বিমূঢ় নেত্রে চেয়ে আছেন তেমনি। চোখে পলক পড়ে না।

    …শুভ গাঙ্গুলী তিরিশ বছর আগে মুছেই গেছে।

    সামনে যাকে দেখছেন তিনি মাতাজী।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমডেল – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article দুজনার ঘর – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }