Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প123 Mins Read0

    গোসাঁইপুর সরগরম – ২

    মল্লিক বাড়িও যে অনেকদিনের পুরনো সেটা বলে দিতে হয় না, তবে মেরামতের দরুন বাড়িটাকে আর পোড়ো বলা চলে না। প্রাসাদ না হলেও, অট্টালিকা নিশ্চয়ই বলা চলে এ বাড়িকে। ফটক দিয়ে ঢুকে ডাইনে একটা বাঁধানো পুকুর, বাড়ির দুপাশের ফাঁক দিয়ে পিছনে গাছপালা দেখে মনে হয় ওদিকে একটা বাগান রয়েছে। পাঁচিলটা মেরামত হয়নি, তাই এখানে ওখানে ফাটল ধরেছে, কয়েক জায়গায় আবার দেয়াল ভেঙেও পড়েছে।

    ফটকে একজন দারোয়ান দেখলাম যার হাতে সড়কি আর ঢাল দেখে মনে হল কোনও ঐতিহাসিক নাটকে নামার জন্য তৈরি হয়েছে। সদর দরজার পাশেই ঠিক ওই রকমই হাস্যকর পোশাক-পরা একজন বরকন্দাজ জীবনবাবুকে দেখে এক পেল্লায় সেলাম ঠুকল। এই থমথমে পরিবেশেও এই ধরনের সব অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখে হাসি পাচ্ছিল।

    আমরা একতলাতেই বৈঠকখানায় ফরাসের উপর বসলাম। ঘরে চেয়ার নেই। দেয়ালে যা ছবি আছে সবই হয় দেবদেবীর, না হয় পৌরাণিক ঘটনার। দেয়ালের আলমারির একটা তাকে গোটা দশেক বাংলা বই দেখলাম, বাকি তাকগুলো মনে হল খালি।

    ‘আপনাদের পাখা লাগবে কি? তা হলে দাসুকে লাগিয়ে দিই।’

    এতক্ষণ লক্ষ করিনি, এবার দেখলাম মাথার উপর ঝালরওয়ালা ডবল-মাদুর একটা কাঠের ডাণ্ডা থেকে ঝুলছে, আর ডাণ্ডাটা ঝুলছে সিলিং-এ দুটো আংটা থেকে। ডাণ্ডা থেকে দড়ি বেরিয়ে বাঁ দিকের একটা দরজার উপর দেয়াল ফুঁড়ে বারান্দায় চলে গেছে। এই হল টানা-পাখা, যেটা টানা হয় বারান্দা থেকে, আর হাওয়া হয় ঘরে। অক্টোবর মাস, সন্ধে হয়ে এসেছে তাই গরম নেই; পাখার আর দরকার হল না।

    ‘এটা কী জানেন?’

    জীবনবাবু আলমারিটা খুলে তার থেকে একটা গামছা টাইপের চারকোনা কাপড় বার করে ফেলুদাকে দেখালেন। সেটার বিশেষত্ব এই যে তার এককোণে গেরো দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটা পাথরের টুকরো।

    গামছাটা হাতে নিয়ে ফেলুদার ভুরু কুঁচকে গেল। সে পাথরের উল্টো দিকের কোনাটা হাতে নিয়ে গামছাটাকে বার কয়েক শূন্যে ঘুরিয়ে বলল, ‘তোপসে, উঠে দাঁড়া তো।’

    আমি দাঁড়ালাম আর সেই সঙ্গে ফেলুদাও দাঁড়াল আমার থেকে হাত তিনেক দূরে। তারপর গামছা হাওয়ায় ঘুরিয়ে হাতে ধরা অবস্থাতেই জাল ফেলার মতো করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে পাথরের দিকটা আমার গলায় পেঁচিয়ে গেল।

    ‘ঠগী!’ আমি বলে উঠলাম।

    ফেলুদাই বলেছিল এককালে আমাদের দেশে ঠগীদের দস্যুগিরির কথা। তারা ঠিক এইভাবে পথচারীদের গলায় ফাঁস দিয়ে হ্যাঁচকা টানে তাদের খুন করে সর্বস্ব লুট করে নিত।

    ফেলুদা অবিশ্যি গামছা ধরে টান দেয়নি। সে তক্ষুনি প্যাঁচ খুলে নিয়ে ফরাসে বসে বলল, ‘এ জিনিস আপনি কোথায় পেলেন?’

    ‘মাঝ রাত্তিরে বাবার ঘরের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল কেউ।’

    ‘কবে?’

    ‘আমি আসার কয়েকদিন আগে।’

    ‘এত পাহারা সত্ত্বেও এটা হয় কী করে?’

    ‘পাহারা?’ জীবনবাবু হেসে উঠলেন। ‘পাহারা তো শুধু পোশাকের বাহারে মশাই, মানুষগুলো তো সব গেঁয়ো ভূত, কুঁড়ের হদ্দ। আর তারাও তো বুঝতে পারে বাবুর ভীমরতি ধরেছে। কাজ যা করে সে তো শুধু নাম কা ওয়াস্তে। নেহাত বাড়িতে ডাকাত পড়েনি তাই, নইল বোঝা যেত কার দৌড় কতদূর।’

    ‘এ বাড়িতে আর কে কে থাকেন জানতে পারি কি?’

    ‘বাবা ছাড়া আর আছেন আমার বিধবা ঠাকুমা। তিনি প্রাচীন আমলের লোক তাই দিব্যি আছেন। তা ছাড়া আছেন ভোলানাথবাবু। এঁকে বাজার সরকার বলতে পারেন, ম্যানেজার বলতে পারেন—বাবার ফাইফরমাশ খাটা, দেখাশোনা করা, সবই ইনি করেন। বাবার অসুখ-বিসুখ হলে কবিরাজ ডাকতে হয়, সেটিও ইনিই করেন। কোনও কাজে শহরে যাবার দরকার হলেও ইনিই যান। ব্যস—এছাড়া আর কেউ নেই। অবিশ্যি চাকর আছে; একটি রান্নার লোক, দুটি দারোয়ান, একটি এমনি চাকর—এরা বাড়িতেই থাকে। পালকির লোক আর পাঙখাওয়ালা কাছেই গ্রাম থেকে আসে।’

    ‘এই ভোলানাথবাবু কোথাকার লোক? ক’দিন আছেন?’

    ‘উনি এই গ্রামেরই লোক। আমাদের প্রজা ছিলেন। বাপ-ঠাকুরদা চাষবাস করত। ভোলাবাবু নিজে ইস্কুলে পড়েছেন, বেশ বুদ্ধিমান ছেলে ছিলেন। এখন বয়স ষাটের কাছাকাছি।’

    ‘উনি কি আপনার পিতামহ?’

    ফেলুদা দেয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করল। বিরাট এক জোড়া পাকানো গোঁফ নিয়ে এক জমিদার বাঁ হাত শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর রেখে ডান হাতে একটা রুপোয় বাঁধানো লাঠি ধরে চেয়ারে বসে আছেন। দেখলেই মনে হয় যাকে বলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ।

    ‘হ্যাঁ, উনিই দুর্লভ সিংহ।’

    ‘যাঁর নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত?’

    জীবনবাবু হেসে উঠলেন।

    ‘বাঘ অবিশ্যি এককালে থাকলেও, ঠাকুরদার আমলে ছিল না; তবে হ্যাঁ, ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন ঠিকই। এবং শেমফুলি অত্যাচারী।’

    একজন চাকর একটা ট্রেতে করে একটা পেয়ালা আর দুটো গেলাসে কী যেন নিয়ে এল।

    ‘তা হলে চায়ের পাট উঠিয়ে দেননি আপনার বাবা?’

    ‘আলবত দিয়েছেন। এটা অবিশ্যি চা না, কফি। আমার নিজের একটি কাপ এবং একটিন নেসক্যাফে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসি। সকাল সন্ধে একতলায় বসে খাই। তাই আপনাদের জন্য গেলাস; কিছু মনে করবেন না।’

    ‘মনে করব কেন? এ তো খাঁটি মাদ্রাজি সিসটেম। কোমলা বিলাসে এইভাবে কাঁসার পাত্রে খেয়েছি কফি।’

    দোতলা থেকে মাঝে মাঝেই একটা খটাস্ খটাস্ শব্দ পাচ্ছিলাম; সেটা যে কীসের শব্দ সেটা ফেলুদার প্রশ্ন থেকে বুঝতে পারলাম।

    ‘আপনার বাবা বুঝি খড়ম ব্যবহার করেন?’

    জীবনবাবু একটু হেসে বললেন, ‘সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?’

    ‘এই ঠগীর গামছা ছাড়া আর কী থেকে আপনার ধারণা হল যে আপনার বাবার জীবন বিপন্ন?’

    জীবনবাবু এবার তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে ফেলুদাকে দিলেন। তাতে গোটা গোটা পেনসিলের অক্ষরে লেখা—

    ‘তোমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তোমার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইল। অতএব প্রস্তুত থাকো!’

    ‘এটা এসেছে ৫ই অক্টোবর, আমি আসার আগের দিন। পোস্ট করা হয়েছিল কাটোয়া থেকে। এখান থেকে যে-কেউ গিয়ে ডাকে ফেলে আসতে পারে।’

    ‘কিছু মনে করবেন না—পূর্বপুরুষের পাপটা কী সে ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারলে সুবিধে হত।’

    ‘বুঝতেই তো পারছেন,’ বললেন জীবনবাবু, ‘একটা জমিদার বংশের ইতিহাসে অন্যায়ের তো কতরকম দৃষ্টান্ত থাকতে পারে। কোন পাপের কথা বলছে সেটা কী করে বলি বলুন। আমার ঠাকুরদাদা দুর্লভ মল্লিকই তো কতরকম অত্যাচার করেছেন প্রজাদের উপর।’

    ‘এটা পেয়ে পুলিশে খবর দিলেন না কেন?’

    ‘দুটো কারণে’, একটু ভেবে বললেন জীবনবাবু। ‘এক, এখানে আপনাকে কেউ চিনবে না, তাই যে-লোক হুমকি দিচ্ছে সে সাবধানতা অবলম্বন করার অতটা তাগিদ অনুভব করবে না। দুই, পুলিশ এলে প্রথমে আমাকে সন্দেহ করবে।’

    আমরা দুজনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলাম ভদ্রলোকের দিকে। জীবনবাবু বলে চললেন, ‘বাবার এই অদ্ভুত পরিবর্তনের পর থেকে আমার সঙ্গে তাঁর আর বনিবনা নেই। আমরা শহুরে মানুষ, বিজ্ঞানের অবদানগুলো অত সহজে বর্জন করা আমাদের চলে না মশাই। এটা ঠিক যে ইলেক্‌ট্রিক শকের ফলে বাবা মানসিক শকও পেয়েছিলেন সাংঘাতিক। ঘটনাটা ঘটে পাঁচ বছর আগে। আমি আর বাবা আপিস থেকে ফিরে একসঙ্গে বৈঠকখানায় ঢুকি। অন্ধকারে বাতি জ্বালতে গিয়ে সুইচবোর্ডে একটা খোলা তারে বাবার হাত আটকে যায়। বাইরেই ছিল মেইন সুইচ, আমি দৌড়ে গিয়ে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে অফ করি। তবু কেন জানি বাবার ধারণা হয় যে আমি ব্যাপারটা আরও তাড়াতাড়ি করতে পারতাম। সেই তখন থেকেই। যাই হোক্‌, এখানে এলেই কথা কাটাকাটি হয়। একবার তো রেগে গিয়ে একটা জ্বলন্ত কেরোসিনের ল্যাম্প ছুঁড়ে ফেলে দিই। তার ফলে ফরাসে আগুন-টাগুন ধরে হুলুস্থূল ব্যাপার। পাড়াগাঁতে খবরটা রটে যায়। তারপর থেকে সবাই জানে শ্যাম মল্লিকের সঙ্গে তার ছেলের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। কাজেই বুঝতেই পারছেন কেন পুলিশ ডাকিনি। অবিশ্যি আপনাকে ডাকার আরেকটা কারণ হল আপনার খ্যাতি। আর আমার বিশ্বাস একজন আধুনিক শহুরে লোক সমস্যাটা আরও ভালো বুঝতে পারবে।’

    নেসক্যাফে শেষ হবার আগেই ঘরে ল্যাম্প চলে এসেছে। ওপরে পাঁচালিও বন্ধ হয়েছে। জীবনবাবু বললেন, ‘আপনি বাবার সঙ্গে কি একবার দেখা করতে চান?’

    ‘সেটা হলে মন্দ হত না।’

    সামান্য ক’টা ল্যাম্প-লণ্ঠনের আলোয় এত বড় বাড়ির অনেকখানি যে অন্ধকার থেকে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী? সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় জীবনবাবু পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বার করে জ্বেলে বললেন, ‘এটাও লুকিয়ে আনা।’

    শ্যামলাল মল্লিক তাঁর নিজের ঘরে ফরাসে বসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গড়গড়ার নল হাতে নিয়ে বসে আছেন। জীবনবাবু আর নীচের ছবির দুর্লভবাবু, এই দুজনের সঙ্গেই ভদ্রলোকের চেহারার মিল আছে। হয়তো এই চেহারায় দুর্লভ সিংহের গোঁফ জুড়ে দিলে এঁকেও ডাকসাইটে বলে মনে হয়। এই অবস্থায় দেখে ভয় করে না, যদিও কথা বললে গলার গম্ভীর স্বরে মনে হয় রাগলে ভয়ংকর হতে পারে।

    ‘আপনি এবার আসুন’, গম্ভীর গলায় বললেন শ্যামলালবাবু। যাকে কথাটা বলা হল তিনি ফরাসের এক কোণে বসে ছিলেন। জীবনবাবু তাকে কবিরাজ তারক চক্রবর্তী বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রোগা ডিগ্‌ডিগে চেহারা, ঘন ভুরুর নীচে নাকের উপর পুরু কাচের চশমা, নাকের নীচে একজোড়া পুরু গোঁফ। তারক চক্রবর্তী নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

    ‘গোয়েন্দা দিয়ে কী হবে?’ শ্যামলাল মল্লিক ফেলুদার পরিচয় পেয়েই বিরক্তভাবে প্রশ্ন করলেন। ‘এই চক্রান্তের কিনারা গোয়েন্দার কম্মো নয়। আমার শত্রু আমার ঘরেই আছে এ কথা দুর্লভ মল্লিকের আত্মা বলে দিয়েছেন। সে কথা কাগজে লেখা আছে আমার কাছে। আত্মা ত্রিকালজ্ঞ। জ্যান্ত মানুষ সাহেবি কেতাব পড়ে তার চেয়ে বেশি জানবে কী করে?’

    জীবনবাবু দেখলাম কথাটা শুনে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেলেন। বুঝলাম তিনি ঘটনাটা জানেন না।

    ‘আপনি কি মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়েছিলেন?’

    ‘আমি যাব কেন? সে এসেছিল। আমি তাকে ডেকেছিলাম। আমাকে এইভাবে বিব্রত করছে কে সেটা আমার জানার ছিল। এখন জেনেছি।’

    জীবনবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘কবে এসেছিলেন মৃগাঙ্কবাবু?’

    ‘তুমি আসার আগের দিন।’

    ‘কই, তুমি তো আমাকে বলনি।’

    শ্যামলালবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে সমানে গড়গড়া টেনে চলেছেন। ফেলুদা বলল, ‘দুর্লভ মল্লিকের আত্মা কী লিখে গেছেন সেটা দেখা যায় কি?’

    ভদ্রলোক মুখ থেকে গড়গড়ার নল সরিয়ে লাল চোখ করে ফেলুদার দিকে চাইলেন।

    ‘তোমার বয়স কত হল?’

    ফেলুদা বয়স বলল।

    ‘এই বয়সে এত আস্পর্ধা হয় কী করে? সে লেখার আধ্যাত্মিক মূল্য জানো তুমি? সেটা কি যাকে-তাকে দেখাবার জিনিস?’

    ‘আমায় মাপ করবেন’, ফেলুদা খুব শান্তভাবেই বলল, “আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম আপনার সংকট থেকে কোনও মুক্তির উপায় আপনার পরলোকগত পিতা বলেছেন কিনা।’

    ‘সেটার জন্য কাগজটা দেখাবার কী দরকার? আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। মুক্তির উপায় একটাই—শত্রুকে বিদায় করো।’

    কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ। তারপর ধীরকণ্ঠে জীবনলাল বললেন, ‘তুমি তা হলে আমায় চলে যেতে বলছ?’

    ‘আমি কি তোমাকে আসতে বলেছি কোনওদিন?’

    জীবনবাবু দেখলাম ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, ‘বাবা, তুমি আমার চেয়ে ভোলানাথবাবুর উপর বেশি আস্থা রাখছ, বোধহয় তার পারিবারিক ইতিহাসটা ভুলে যাচ্ছ। ভোলানাথবাবুর বাবা খাজনা দিতে দেরি করায় দুর্লভ মল্লিকের লোক গিয়ে তাঁর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। আর—’

    ‘মূর্খ!’ মল্লিকমশাই দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন! ‘ভোলানাথ তখন ছিল শিশু। ঘটনার ষাট বছরে সে প্রতিশোধ নেবে আমাকে হত্যা করে? এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে সেটা বুঝতে পারছ না?’

    আমরা আর বসলাম। ‘চলুন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি’, বাইরে এসে বললেন জীবনবাবু। ‘আপনারা শর্টকাট চিনে ফিরতে পারবেন না।’

    ফটক থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাকে ডেকে এনে আমি ঝামেলার মধ্যে ফেলতে চাইনি। আপনাকে যে-ভাবে অপমানিত হতে হল তার জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত।’

    ‘গোয়েন্দাদের এ সব ব্যাপারে লজ্জাবোধ থাকে না জীবনবাবু’, বলল ফেলুদা। ‘এখানে এসে আমার আদৌ আপশোষ হচ্ছে না। এ নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না। আমার কেবল আপনার সম্বন্ধেই ভাবনা হচ্ছে। একটা কথা আপনার বোঝা উচিত। হুম্‌কি চিঠি পড়ে ভোলানাথবাবুর কথা মনে হচ্ছে বলেই কিন্তু সন্দেহটা আরও বেশি করে আপনার উপর পড়ছে।’

    ‘কিন্তু গামছা আর চিঠি যখন আসে তখন তো আমি কলকাতায়, মিস্টার মিত্তির।’

    ফেলুদা একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বলল, ‘আপনার যে কোনও অনুচর নেই গোসাঁইপুরে সেটা কী করে জানব জীবনবাবু?’

    ‘আপনিও আমাকে সন্দেহ করছেন?’ শুকনো ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন জীবনবাবু।

    ‘আমি এখনও কাউকেই সন্দেহ করছি না, কাউকেই নির্দোষ ভাবছি না। তবে একটা কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। ভোলানাথবাবু কীরকম লোক?’

    জীবনবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘অত্যন্ত বিশ্বস্ত। এটা স্বীকার না করে উপায় নেই। কিন্তু তাই বলেই কি আমার উপর সন্দেহ পড়বে?’ শেষ প্রশ্নটা মরিয়া হয়ে করলেন জীবনবাবু। ফেলুদা বলল, ‘জীবনবাবু, এখন আমাকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। এবং আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। এ ছাড়া আপনারও উপায় নেই। অপরাধীকে রক্ষা করার রাস্তা আমার জানা নেই। কিন্তু যে নির্দোষ তাকে আমি বাঁচাবই।’

    এতে জীবনবাবু আশ্বস্ত হলেন কিনা সেটা অন্ধকারে তাঁর মুখ না দেখে বোঝা গেল না।

    বাঁশবনটা ফুরিয়ে আসার মুখে ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল জীবনবাবুকে।

    ‘আপনার বাবা তো খড়ম ব্যবহার করেন; খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করেন কি কখনও—বাড়ির বাইরে?’

    ‘বাড়ির ভিতরেই করেন না কখনও, তো বাড়ির বাইরে! এটা অবিশ্যি নতুন কিছু নয়। চিরকালের ব্যাপার।’

    ‘পায়ের তলায় যেন মাটি দেখলাম। তাই জিজ্ঞেস করছি। আর একটা কথা—উনি মশারি ব্যবহার করেন না?’

    ‘নিশ্চয়ই। এখানে সবাই করে। করতেই হয়। কেন বলুন তো?’

    ‘আপনি বোধহয় ল্যাম্পের আলোয় ঠিক বুঝতে পারেননি; ওঁর সর্বাঙ্গে অসংখ্য মশার কামড়ের চিহ্ন।’

    ‘তাই বুঝি?’ বুঝলাম জীবনবাবু খেয়াল করেননি। সত্যি বলতে কি আমিও করিনি। ‘কিন্তু বাবা ত মশারি ব্যবহার করেন। মশারি তো সাহেবদের জিনিস না, ওতে আপত্তির কী আছে?’

    ‘তা হলে বোধহয় ফুটো আছে। একটু দেখবেন তো।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাক্স রহস্য – সত্যজিৎ রায়
    Next Article যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }