Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র ১ – অনুবাদ : মাসরুর আরেফিন

    ফ্রানজ কাফকা এক পাতা গল্প619 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    প্রথম দীর্ঘ রেলভ্রমণ: ম্যাক্স ব্রড ও ফ্রানৎস কাফকা

    প্রথম দীর্ঘ রেলভ্রমণ: ম্যাক্স ব্রড ও ফ্রানৎস কাফকা

    (যৌথভাবে লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস ‘রিচার্ড ও স্যামুয়েল’-এর প্রথম অধ্যায়)

    আমরা দুজনে মিলে যে ভ্রমণবিষয়ক ডায়েরি লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম, তার শুধু প্রথম অধ্যায়টিই লেখা হয়েছে; এটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রাগের সাহিত্য সাময়িকী হাল্ডাররাটার-এ (প্রাগ, মে ১৯১২ সংখ্যা)। নিচের মুখবন্ধটি ছাপা হয়েছিল ভূমিকা হিসেবে:

    ‘রিচার্ড ও স্যামুয়েল– কেন্দ্রীয় ইউরোপ অঞ্চলে সংক্ষিপ্ত সফর’ নামের ছোট আকারের বইয়ে দুই বন্ধুর সমান্তরাল ভ্রমণ-ডায়েরি দুটি একসঙ্গে স্থান পাবে, এই ছিল পরিকল্পনা। এ দুই বন্ধুর স্বভাব একদম আলাদা।

    স্যামুয়েল বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এক তরুণ যে তার জ্ঞানার্জনের উচ্চাশা অর্জন করতে চায় সাড়ম্বর ভঙ্গিমায়, জীবন ও শিল্পের সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল এক সুবিবেচনা থেকে, তবে শুকনো ও পণ্ডিতি মনোভঙ্গি সম্পূর্ণ পরিহার করেই। অন্যদিকে রিচার্ডের বিশেষ আসক্তি আছে, এমন কোনো বিষয়ই নেই; সে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে রেখেছে অব্যাখ্যেয় আবেগের কাছে, বিশেষ করে তার সুস্বভাবের কাছে, কিন্তু তার সীমিত ও খাপছাড়া অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তার এত বেশি ঐকান্তিক ও সরল-সোজা স্বাধীনচিত্তটি বেরিয়ে আসে যে তাকে কখনোই খেয়ালি হাস্যকর চরিত্র বলে ভুল করা যাবে না। পেশায় স্যামুয়েল একটি শিল্পকলা সমিতির সেক্রেটারি, রিচার্ড ব্যাংক-কেরানি। স্যামুয়েলের আয়-রোজগারের অন্য ব্যবস্থাও আছে, তবু অলস জীবন সহ্য হবে না বলেই সে কাজ করাটা বেছে নিয়েছে; রিচার্ডের কাজ করতে হয় জীবনধারণের তাগিদেই, ঘটনাচক্রে তার পেশায় সে সফল এবং অনেক প্রশংসাও পাচ্ছে।

    নির্দিষ্ট এই ভ্রমণটিতেই এ দুজন, যদিও স্কুলজীবন থেকে তারা বন্ধু, দীর্ঘদিনের মধ্যে প্রথমবারের মতো একা একত্রে হয়েছে। তারা একজন আরেকজনের কাজ ও কথায় মজা পায়, কিন্তু তারা পরস্পরকে আসলে বোঝে না। নানাভাবেই তাদের মধ্যে চলে আকর্ষণ বিকর্ষণের এই খেলা। আমরা বর্ণনা করেছি যে কীভাবে প্রথমে তাদের এই সম্পর্ক অতি ব্যাকুল এক গাঢ়তায় জ্বলে উঠেছিল, তারপর মিলান ও প্যারিসের বিপজ্জনক প্রেক্ষাপটে ঘটা নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে কীভাবে তা একসময় শান্ত হয়ে পারস্পরিক পুরুষোচিত বোঝাপড়ায় রূপ নেয়, শক্ত ও পাকাপাকি বন্ধুত্বে এসে স্থির হয়। এই ভ্রমণ শেষ হয় দুই বন্ধুর তাদের মেধা এক নতুন, মৌলিক ও শৈল্পিক খাতে ব্যয় করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে।

    এই লেখার উদ্দেশ্য দুজন পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের কত রকম মাত্রাবিন্যাস হওয়া সম্ভব তা দেখানো আর একই সঙ্গে যে দেশগুলো তারা ঘুরল তাদের ওপর, দুটি ভিন্ন কোণ থেকে, দ্বৈত আলো ফেলা; আর তার মাধ্যমে এই দেশগুলোকে এক তরতাজা, নতুন তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা যেমনটি কিনা প্রায়ই, অন্যায্যভাবেই, আমরা ঘটতে দেখি স্রেফ অদ্ভুত ও চমকপ্রদ বেড়ানোর জায়গাগুলোর ক্ষেত্রে।

    প্রথম দীর্ঘ রেলভ্রমণ

    (প্রাগ-জুরিখ)

    স্যামুয়েল: ট্রেন ছাড়ল দুপুর ১টা ২ মিনিটে, তারিখ: ২৬ আগস্ট ১৯১১।

    রিচার্ড: স্যামুয়েল তার সেই পুরোনো ছোট, পকেট ডায়েরিতে সামান্য কিছু টুকে রাখল দেখে আমার আগের সেই সুন্দর চিন্তাটা আবার ফিরে এল যে আমাদের দুজনেরই উচিত যার যার জার্নালে এই ভ্রমণের সবকিছু লিখে রাখা। আমি তাকে বললাম কথাটা। প্রথমে সে একমত হলো না, পরে রাজি হলো– দুটো ক্ষেত্রেই সে আমাকে কারণ কী তা বলল, দুবারই আমি মনে হয় একদম ভাসা। ভাসা বুঝলাম সে কী বলতে চাচ্ছে, তবে সেটা কোনো ব্যাপার নয়, ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দুজনকেই জার্নাল রাখতে হবে। এবার সে অনেক হাসল আমার নোটবুকটা দেখে –ওটা পুরো কালো কাপড়ে বাঁধাই করা, নতুন, অনেক বড়, চতুর্ভুজ আকারের, দেখতে লাগে স্কুলের খাতার মতো। আমি আগে থেকেই জানতাম, এই নোটবুক পকেটে নিয়ে পুরো ভ্রমণটা করা সহজ হবে না আর যা ই বলি না কেন, এটা একটা বিড়ম্বনাই। তবে, তাকে সঙ্গে নিয়েই আমি জুরিখে আরেকটু সুবিধাজনক একটা নোটবুক কিনতে পারি। তার একটা কালির কলমও আছে। আমি ওটা মাঝেমধ্যে ধার নেব।

    স্যামুয়েল: একটা স্টেশনে আমাদের জানালার ঠিক বাইরেই চার-চাকার এক ঘোড়ার গাড়িতে একজন চাষি মহিলা। একজন হাসছে, তার কোলে আবার একজন ঘুমোচ্ছে। জেগে উঠে সে আমাদের দিকে হাত নাড়াল, তার আধো ঘুমের মধ্যে যেন আমাদের ইঙ্গিত দিল: ‘আসো। আমরা যে তার কাছে যেতে পারছি না। তা নিয়ে সে যেন ঠাট্টা করল। অন্য কামরায় একটা শ্যামলা, বীরের মতো গড়নের এক মহিলা –একদম নিশ্চল। তার মাথা সোজা পেছনে ঝুঁকে আছে, সে তাকিয়ে আছে জানালার শার্সির কাঁচের দিকে। ডেলফি-র ভবিষ্যৎ বলতে পারা ডাইনিবুড়ি।

    রিচার্ড: কিন্তু আমার ভালো লাগল না সে যেভাবে ঐ চাষি মহিলাদের সম্ভাষণ জানাল- মিষ্টি কথায় মন-ভোলানো, ভণ্ড, রমণীমোহন ও প্রায় মোসাহেবির ঢঙে। ট্রেন এখন স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে, স্যামুয়েল এবার মহা বিপদে পড়ে গেছে– তার মাথার টুপি নাড়াচ্ছে আর বিরাট বড় এক হাসি দিয়ে মুখ ফাঁক করে আছে। নাকি আমি বাড়িয়ে বলছি? স্যামুয়েল আমাকে তার একটু আগে লেখা জার্নাল পড়ে শোনাল, আমার অনেক ভালো লাগল তা। চাষি মেয়েগুলোকে আমার আরো ভালোভাবে দেখা উচিত ছিল। খুব অস্কুটভাবে গার্ড জিজ্ঞেস করল, যেন সে ধরেই নিয়েছে যাত্রীরা সবাই এই পথে অনেক রেলভ্রমণ করেছে, আমরা কেউ পিল্‌সেন পৌঁছে কফি খাব কি না। কফি অর্ডার করলেই প্রতিটি অর্ডারের জন্য সে কামরার জানালায় সেঁটে দিচ্ছে একটা ছোট সবুজ টিকিট, ঠিক যেমনটা তারা করত মিস্ড্রয়ে, তখনো জাহাজ ভেড়ার জেটি চালু হয়নি, অনেক দূরে থাকতেই স্টিমারগুলো সংকেত-দেওয়ার সরু ও লম্বা পতাকা তুলে জানাত যাত্রীদের তীরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কতগুলো নৌকা লাগবে। স্যামুয়েলের মিসড্রয় সম্বন্ধে আদৌ কোনো ধারণা নেই। পরিতাপের বিষয়, আমি তার সঙ্গে ওখানে যাইনি কখনো। কী চমৎকার সময় ছিল তখন! এবারের ভ্রমণও চমৎকার হবে। ভ্রমণটা বেশি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, ট্রেন বেশি জোরে চলছে; ভ্রমণে বেরোবার জন্য আজকাল আমার মন কেমন আকুলিবিকুলি করে! একটু আগের আমার তুলনাটা কত সেকেলে, মিস্ড্রয়ে জেটি এসেছে পাঁচ বছর হয়ে গেছে। পিসেন নেমে প্ল্যাটফর্মে কফি। যদি টিকিট থাকে, তাহলে এসে না নিলেও চলে, আর টিকিট আদৌ না থাকলেও কফি মেলে।

    স্যামুয়েল: প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম আমাদের কামরা থেকে একটা অচেনা মেয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পরে জানলাম, ওর নাম ডোরা লিপ্পার্ট। সুন্দর, চওড়া নাক, সাদা লেসের ব্লাউজের গলার কাছটা ছোট করে কাটা। এই ভ্রমণে এটা পারস্পরিক অভিজ্ঞতার প্রথম ঘটনা; কাগজের ব্যাগে রাখা মেয়েটার বড় হ্যাট হালকাভাবে তাকের থেকে পড়ে গেল, পড়ল এসে আমার মাথায়। আমরা জানলাম, সে এক অফিসারের মেয়ে, তার বাবাকে ইনস্ক্রকে বদলি করা হয়েছে, সে তার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, অনেক দিন তাদের দেখেনি সে। পিসেনে সে একটা প্রকৌশল অফিসে চাকরি করে –সারা দিন কাজ থাকে, অনেক কাজ, কিন্তু তার ভালোই লাগে কাজ করতে, তার জীবন সুখেই যাচ্ছে। অফিসে সহকর্মীরা তাকে ডাকে: ‘আমাদের আদরের পোষা মুরগি’, ‘আমাদের ছোট চড়ই’– এসব নামে। অনেক পুরুষ সহকর্মীর মধ্যে সে-ই বয়সে সবচেয়ে কম। ওহ, অফিসে কী যে মজা! টুপি-কোট রাখার ঘরটাতে মানুষের হ্যাট অদল-বদল করে দিচ্ছি, ডেস্কে সকালের কাজের তালিকা ঝুলিয়ে দিচ্ছি কিংবা লেখালেখির জায়গাটাতে আঠা দিয়ে কলম আঁটকে রাখছি। আমাদেরও সুযোগ মিলল ওরকম চমৎকার একটা ধোকাবাজিতে অংশ নেওয়ার। সে অফিসে তার সহকর্মীদের একটা পোস্টকার্ড পাঠাচ্ছে, সে লিখছে: ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, শেষমেশ সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে গেছে। আমি ভুল ট্রেনে চড়ে বসেছি, এখন আমি জুরিখে। উষ্ণতম শুভেচ্ছা। আমাদের জুরিখ থেকে কার্ডটা ডাকে দিতে হবে। আমরা যেহেতু ‘ভদ্রলোক’, সে আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখছে যে আমরা পোস্টকার্ডটায় অন্য কোনোকিছু যোগ করব না। অফিসে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে, কোনো সন্দেহ নেই, তারা টেলিগ্রাম পাঠাবে আর খোদাই জানে আর কী করবে। সে ভাগনারের খুব ভক্ত, কখনোই ভাগনারের কোনো শো সে মিস করে না, সেদিন ইসোডে হিসেবে কুর্জকে যদি তোমরা একটু দেখতে, সে এই এখন ভাগনার-ভেজেডঙ্ক চিঠিগুলো পড়ছে, বইটা সে সঙ্গে করে ইনস্ক্রকে নিয়ে যাচ্ছে, এক ভদ্রলোক তাকে ওটা দিয়েছে, সেই একই লোক যে তাকে পিয়ানোর স্বরলিপি বাজিয়ে শোনায়। দুর্ভাগ্যের কথা যে তার নিজের পিয়ানোর মেধাটা নেই বললেই চলে, সেটা অবশ্য আমরা তার গুনগুন করে আমাদেরকে শোনানো কিছু রাগিণী শুনে এরই মধ্যে বুঝে গেছি। সে চকোলেটের মোড়ক জমাতে ভালোবাসে, এখন সে রুপালি মোড়ক জমিয়ে জমিয়ে একটা বড় বল বানাচ্ছে, ওটা তার সঙ্গেই আছে। এই বলটা সে তার এক মেয়েবন্ধুকে দেবে, এটা দিয়ে কী কাজ হবে তা আর বলল না। আর সিগার-ব্যান্ড জমানোও তার শখ, মোটামুটি নিশ্চিত ওই ব্যান্ডগুলো সে জমাচ্ছে কোনো ট্রে-র নকশায় কাজে লাগবে বলে। ট্রেনে প্রথম কোনো বাভারিয়ান গার্ড দেখা গেল। তাকে দেখে সে অস্ট্রিয়ান সৈনিকদের বিষয়ে, সাধারণ অর্থে সৈনিকদের বিষয়ে, ছোট করে এবং যুক্তিতথ্য ছাড়াই আমাদের তার মতামত শোনানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল; একজন অফিসারের মেয়ে হিসেবে তার বক্তব্য খানিকটা স্ববিরোধী ও অস্পষ্ট বলতে হবে। তার হিসেবে শুধু অস্ট্রিয়ান আর্মিই কর্তব্যকাজে ঢিলা, তা নয়, জার্মান আর্মিও তাই, পৃথিবীর সবখানের আর্মিই এমন। কিন্তু সে-ই কি অফিসের জানালার কাছে ছুটে যায় না যখন রাস্তা দিয়ে কোনো মিলিটারি বাজনাদল যায়? না, সে যায় না, কারণ তারা সত্যিকারের মিলিটারিই না। তার ছোট বোন অবশ্য পুরো আলাদা। ইনস্ক্রক অফিসারদের ক্যাসিনোতে সে সব সময় নাচছে। কিন্তু তার কথা যদি বলি, সামরিক উর্দি তাকে একটুও আকর্ষণ করে না, অফিসারদের। নিয়ে তার কোনো রকম কোনো ভালো লাগাটাগা নেই। এটা পরিষ্কার যে অফিসারদের বিষয়ে তার এই মনোভঙ্গির জন্য ঐ ভদ্রলোক যে তাকে পিয়ানোর স্বরলিপি ধার দেয় সে অনেকাংশে দায়ী, কিন্তু সেইসঙ্গে আমরাও একটু দায়ী বটে– ফার্থ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমরা একসাথে এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটলাম, রেলের ভেতরে ওরকম স্থির বসে থাকার কারণে তার এখন বাইরে হেঁটে নিজকে অনেক ঝরঝরে লাগছে,তার হাতের তালু দিয়ে সে তার কোমরের দিকটায় নিচের দিকে টেনে টেনে নিজেকে স্বচ্ছন্দ করল। রিচার্ড, খুব সিরিয়াসলি, আর্মিদের পক্ষ নিয়ে বলতেই থাকল। ডোরার পছন্দের অভিব্যক্তিগুলো: গর্জিয়াস–০.৫ অ্যাকসেলারেশন– ফায়ার –চটপট– ঢিলা।

    রিচার্ড: ডোরা এল.-এর গোল গোল গাল, তাতে ছড়িয়ে আছে অনেক ব্লন্ড চুল; কিন্তু তার গাল দুটো এমনই রক্তহীন যে ওখানে কোনো লালিমা দেখতে হলে অনেকক্ষণ আঙুল দিয়ে টিপে রাখতে হবে। তার কোমর ও নিতম্ব এঁটে রাখা করসেট্রা ভালো না, তার বুকের উপর দিয়ে এর কিনারগুলো তার ব্লাউজকে দুমড়ে-কুঁচকে রেখেছে; ওখান থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে হচ্ছে।

    ভালো হয়েছে যে আমি তার মুখোমুখি বসেছি, পাশে বসিনি। পাশে বসা কারো সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না। স্যামুয়েল অবশ্য আমার পাশে বসতেই পছন্দ করে; ডোরার পাশে বসাও তার পছন্দের। অন্যদিকে আমার যদি কেউ পাশে বসে তো আমার মনে হয় কোনো জেরা-তল্লাশি চলছে। মোদ্দা কথা, পাশে বসা কারও জন্য আপনার চোখ তৈরি থাকে না, তার দিকে তাকাতে হলে আগে আপনাকে নিজের চোখ পুরো ওদিকে ঘুরিয়ে নিতে হয়। সত্য যে ডোরা। ও স্যামুয়েলের কথাবার্তা থেকে আমি মাঝেমধ্যে বাইরে পড়ে যাচ্ছি, কারণ আমি বসে আছি উল্টোদিকের সিটে, এটা বিশেষ করে ঘটছে যখন ট্রেন জোরে ছুটছে; সব সুবিধা সবার একসঙ্গে হয় না। তার পরও, আমি এরই মধ্যে এটাও দেখেছি যে তারা পাশাপাশি বসে থেকেও কোনো কথা বলছে না, যদিও সেটার দৈর্ঘ্য কখনো কয়েক সেকেন্ডের বেশি হবে না; তবে, তাদের কথা না-বলায় আমার দোষ নেই কোনো।

    তার প্রশস্তি আমাকে গাইতেই হবে; সে খুব গানপাগল। মেয়েটি স্যামুয়েলকে গুনগুনিয়ে কিছু শোনালে আমি জানি স্যামুয়েল, সম্ভবত, বাঁকা হাসি দিচ্ছে। হয়তো ব্যাপারটা পুরো ঠিক না, কিন্তু যা-ই বলি, একটা বড় শহরে পুরো একা একা থাকা এক মেয়ের জন্য সংগীতের প্রতি এরকম উষ্ণ টান থাকা কি প্রশংসনীয় না? সে এমনকি একটা পিয়ানো ভাড়া করে এনেছে তার ঘরে; তার ঘরটাও ভাড়া নেওয়া ঘর। শুধু কল্পনা করুন: পিয়ানো (প্রবল-পিয়ানো!) বাসায় টেনে আনার সেই লেনদেনটা কত জটিল, একটা আস্ত পরিবারের জন্যও কত জটিল এক বিষয়, আর সেখানে একা দুর্বল একটা মেয়ে! কী পরিমাণ স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা লাগে ঐ কাজের জন্য!

    শহরে তার থাকার বন্দোবস্ত নিয়ে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম। সে থাকে তার দুই মেয়েবন্ধুর সঙ্গে, এদের একজন রোজ তাদের রাতের খাবার কিনে নিয়ে আসে একটা খাবারের দোকান থেকে। তারা একসঙ্গে মজায় দিন কাটায়, অনেক হাসে। এই সবকিছু যে একটা পেট্রল-ল্যাম্পের আলোতে ঘটে, তাতে আমার মনে কেমন যেন একটা বাজে সন্দেহের উদ্রেক হয়, কিন্তু আমি তা বলতে চাই না। এটা অবশ্য স্পষ্ট যে ওই বাজে আলো নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কারণ তার মতো উদ্যম যে মেয়ের, ব্যাপারটা তার মাত্র এক দিন মাথায় এলেই সে তো নিশ্চিত কবে বাড়িওয়ালির কাছ থেকে আরো ভালো আলো জোর করে আদায় করে নিত।

    যেহেতু আলাপ চলাকালে তাকে তার হাতব্যাগ খুলে ভেতরের সবকিছু আমাদের দুজনকে দেখাতে হলো, আমাদের চোখে পড়ল একটা ওষুধের বোতল– ওটার মধ্যে নোংরা হলুদমতো ওষুধ। এবার জানলাম, তার স্বাস্থ্য বেশি ভালো যাচ্ছে না, সে অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিল। অসুখ মোটামুটি সেরে গেলেও তার এখনো খুব কাহিল লাগে। অফিসের বস্ নিজে তাকে বলেছে, (তার প্রতি এদের আচরণ সত্যি প্রশংসার যোগ্য) তাকে শুধু আধা দিন অফিস করলেই চলবে। আস্তে আস্তে তার অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে এই আয়রন মিকশ্চারটা খেতে হয়। আমি তাকে বোতলটা জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার উপদেশ দিলাম। আমার সঙ্গে মোটামুটি একমত হলো সে (কারণ ওষুধটার স্বাদ জঘন্য), কিন্তু আমার কথাটা নিল হালকাভাবেই, যদিও আমি সামনে তার আরো কাছে ঝুঁকে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে আমার ধারণা ব্যাখ্যা করতে লাগলাম– আমার কথা পরিষ্কার, মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য প্রাকৃতিক চিকিৎসাই সবচেয়ে ভালো; আমি তাকে সাহায্য করার সৎ ইচ্ছা নিয়েই, কিংবা অন্তত একটা মেয়েকে –যে বেশি কিছু জানে না– ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এসব বললাম, বেশ অনেকক্ষণের জন্য এই মেয়ের কাছে নিজেকে কোনো ভাগ্যবান বিধাতা বলেই মনে হলো আমার। যেহেতু সে হাসতেই থাকল, আমি থামলাম। আবার স্যামুয়েল যে আমার লেকচারের পুরোটা সময় তার মাথা নাড়াচ্ছে, তাতে আমার বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি হলো আরো। আমি স্যামুয়েলকে চিনি। সে ডাক্তারে বিশ্বাস করে, ভাবে, প্রাকৃতিক চিকিৎসা একটা হাস্যকর বিষয়। তা কেন, তা আমি খুব ভালো করেই জানিঃ স্যামুয়েলের কখনো ডাক্তারের দরকার পড়েনি, তাই এসব বিষয় নিয়ে কখনো তাকে গভীরভাবে ভাবতেও হয়নি, যেমন নিজেকে সে ঐ জঘন্য মিকশ্চার খাওয়ার ভূমিকায় ভাবতেও অসক্ষম। আমি যদি এই মেয়েটার সঙ্গে একা থাকতাম, আমি তাকে আমার বিশ্বাসে ঠিকই বিশ্বাস করাতে পারতাম। কারণ, আমি যদি ও বিষয়ে ঠিক না হয়ে থাকি, তাহলে কোনো বিষয়েই আমি ঠিক না!

    একেবারে শুরু থেকেই মেয়েটার রক্তশূন্যতার কারণগুলো আমার কাছে পরিষ্কার। অফিস। অন্য সবকিছুর মতোই অফিসের জীবনকেও কৌতুক হিসেবে দেখা যায় (মেয়েটা আন্তরিক অর্থেই সে হিসেবেই দেখে তার অফিসকে, ভালোমতোই ধোকা খাওয়ানো হয়েছে তাকে), কিন্তু মূলগত অর্থে, নির্যাসের দিক থেকে এর অ-সুখী পরিণাম বিবেচনায়, অফিসের জীবন কী? আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি আমি কী বলছি। আর একটা বেচারা মেয়ের কথা চিন্তা করুন– অফিসে বসে আছে, তার পরনের স্কার্ট এ কাজের জন্য উপযুক্ত করে বানানো না, একটা শক্ত কাঠের চেয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামনে পেছনে নড়তে হচ্ছে তাকে সারাক্ষণ। তাই তার সুগোল দুই নিতম্বের ছাল উঠে গেছে আর তার স্তন দুটো ডেস্কের কিনারে ঘষা খেতে খেতে! বাড়িয়ে বলছি? যা-ই বলুন, কোনো মেয়ে অফিসে কাজ করছে, সেটা আমার কাছে সব সময়ই মন-খারাপ-করা দৃশ্য।

    স্যামুয়েল ইতোমধ্যে তার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সে তাকে পটিয়ে (আমি তা কখনোই পারতাম না) আমাদের সঙ্গে খাবার বগিতে আসতেও রাজি করিয়ে ফেলেছে। আমরা হেঁটে খাবার বগিতে ঢুকলাম, চারপাশে অচেনা সব যাত্রী, আমরা তিনজন যে একসঙ্গে, একদল, তা আমাদের হাবভাবে খুব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এ কথাটা এখানে লিখে রাখা উচিত, বন্ধুত্ব গাঢ় করার জন্য নতুন পরিবেশ খুব উপকারী। আমি এখন সত্যি সত্যিই তার পাশে বসে আছি, আমরা ওয়াইন খেলাম, আমাদের হাতে ছোঁয়া লাগল, আমাদের পারস্পরিক ছুটিতে বেড়ানোর মন-মেজাজ আমাদেরকে একটা পরিবারে রূপ দিল।

    মিউনিখে আমাদের আধা ঘণ্টা অপেক্ষার সময়, এই ব্যাটা স্যামুয়েল মেয়েটির হাসিমাখা বিরোধিতা সত্ত্বেও (বাইরে যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে, মেয়েটি তার যুক্তি আরো জোরালো করতে পারল) তাকে রাজি হতে বাধ্য করল যে আমরা গাড়িতে একটু ঘুরে আসব। স্যামুয়েল যখন গাড়ি খুঁজতে গেছে, স্টেশন হলে সে আমাকে বলল, বলতে গিয়ে আমার হাত ধরে বসল: ‘প্লিজ, আমরা না যাই। আমার একদমই যাওয়া ঠিক হবে না। যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তোমাকে বলছি, কারণ তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। তোমার বন্ধুকে বলে কোনো লাভ নেই। তার মাথা একেবারে খারাপ!’ আমি গাড়িতে চড়ে বসলাম, পুরো ব্যাপারটা আমার জন্য কষ্টের, এতে আমার খুব স্পষ্ট মনে পড়ে গেল দি হোয়াইট স্লেভ নামের এক সিনেমার কথা, ঐ ছবিতে নিষ্পাপ এক নায়িকাকে অচেনা কিছু লোকজন ঠিক একটা রেলস্টেশনের বাইরে অন্ধকারে জোর করে গাড়িতে ওঠায়, তারপর নিয়ে চলে যায়। স্যামুয়েল, অন্যদিকে, আছে ফুর্তি-মনে। যেহেতু গাড়ির বড় হুড আমাদের দৃষ্টি অনেকটা আটকে দিয়েছে, আমরা সত্যিকার অর্থে আশপাশের দালানগুলোর শুধু একতলা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি, তা-ও কষ্ট করে। এখন রাত। মাটির নিচের ঘরের মতো লাগছে। কিন্তু স্যামুয়েল সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দুর্গ ও গির্জাগুলোর উচ্চতা নিয়ে সুন্দর কাল্পনিক অনেক অনুমান করে যেতে লাগল। যেহেতু গাড়ির পেছনের অন্ধকার সিটে বসে ডোরা একদম মুখ বন্ধ করে আছে আর আমি ভয় পাচ্ছি কোনো একটা কাণ্ড ঘটবে, স্যামুয়েল মনে হয় অবশেষে একটু অবাক হলো, তারপর আমার হিসেবে একটু বেশি গতানুগতিক ঢঙে জানতে চাইল: ‘কী ব্যাপার, ফ্রয়লাইন, আমার ওপরে রাগ না তো? আমি কি কিছু করেছি?’ ইত্যদি ইত্যাদি। সে উত্তর দিল: ‘যেহেতু আমি চলেই এসেছি, তাই তোমার আনন্দ নষ্ট করতে চাচ্ছি না। কিন্তু তোমার আমাকে এখানে আনাটা ঠিক কাজ হয়নি। আমি যদি “না” বলি, তোমাকে বুঝতে হবে যে তার কারণ আছে। আমার গাড়িতে ওঠা উচিত হয়নি। কেন?’ সে জিজ্ঞেস করল। তোমাকে সেটা বলতে পারছি না। তোমার নিজের থেকেই বোঝা উচিত, কোনো মেয়ের জন্য, এ রকম রাতের বেলায় ছেলেদের সঙ্গে গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোটা ঠিক কাজ না। তা ছাড়া অন্য আরেকটা কারণও আছে। তুমি ধরে নিতে পারো যে আমি এনগেজড়…।’ আমরা, দুজনেই যার যার মতো, চাপা শ্রদ্ধা-সম্মান নিয়ে, গুপ্তরহস্য ভেদ করলাম যে ওই ভাগনার ভদ্রলোকের ব্যাপারটা তাহলে বোঝা গেল। যাক, আমার নিজেকে গালি দেওয়ার এখানে কিছু নেই, তার পরও তার মন চাঙা করার জন্য আমি চেষ্টা করতে লাগলাম। স্যামুয়েলও, মেয়েটার প্রতি এই এতক্ষণ ধরে একটু অভিভাবকসুলভ আচরণের পর, মনে হলো কাজটাতে অনুতাপ করছে, সে তার কথাবার্তা শুধু আমাদের রেলভ্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখল। গাড়ির ড্রাইভার আমাদের অনুরোধে অদৃশ্য বিল্ডিংগুলোর (যেগুলো সাইটসিয়িংয়ে দেখানো হয়) নাম বলতে লাগলেন জোরে জোরে। ভেজা অ্যাসফল্টের উপর গাড়ির চাকা, সিনেমার যন্ত্রপাতির মতো, শাঁ শাঁ শব্দ করতে লাগল। আবার আমি ভাবলাম দি হোয়াইট স্লেভ-এর কথা। এই লম্বা, নিঃসঙ্গ, বৃষ্টিধোয়া কালো রাস্তাগুলো। আমরা সবচেয়ে পরিষ্কার দেখলাম মনে হয় ফোর সিজনস্ রেস্তোরাঁ-র বিশাল পর্দা ওঠানো জানালাগুলো, শুনলাম এটা এখানকার সবচেয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোর একটি। রেস্তোরাঁর উর্দি পরা ওয়েটার কুর্নিশ করছে এক-টেবিল ভরা অতিথিদের। একটা মূর্তি পার হলাম, এটাকে ভাগনার মেমোরিয়াল বলে চালিয়ে দেওয়ার মজার আইডিয়া এল আমাদের মাথায়– ডোরা এতক্ষণে একটু আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। আমরা মাত্র এক মুহূর্তের জন্য থামলাম ‘ফ্রিডম মনুমেন্ট’-এ, এর ফোয়ারাগুলো থেকে বৃষ্টির মধ্যে পানি ছিটকে বেরোচ্ছে। ইজার নদীর উপরে সেতু, আমরা স্রেফ আন্দাজ করলাম যে ওটা ওখানে। পুরো ‘ইংলিশ গার্ডেন জুড়ে অভিজাত লোকজনের ভিলা। লুডভিগজ স্ট্রাসে, থিয়েটিনার গির্জা, ফেলড়হারন হল, শর বিয়ার কোম্পানি। আমি জানি না কীভাবে সম্ভব, কিন্তু আমি চিনতে পারছি না কিছুই, যদিও মিউনিখে এর আগে এসেছি বেশ কবার। জেন্ডলিংগার গেট স্টেশন, আমি মহা উদ্বিগ্ন ছিলাম (ডোরার কথা ভেবেই) সময়মতো পৌঁছাতে পারব কি না। অতএব, কোনো নির্দিষ্ট দূরত্বে যাওয়ার জন্য স্প্রিং যেভাবে মোড়ানো হয়, আমরাও তেমন ট্যাক্সি-মিটারের ঘড়ির হিসাবে ঠিক কুড়ি মিনিটে শাঁ করে শহরটা একটু চক্কর দিয়ে এলাম।

    আমাদের ডোরাকে আমরা পাহারা দিয়ে নিয়ে, ঠিক যেন আমরা ওর মিউনিখবাসী আত্মীয়, তুলে দিলাম ইনস্ক্রকে যাওয়ার ট্রেনের কামরায়, সেখানে কালো পোশাক পরা এক মহিলা (আমাদেরকে ভয় পাওয়ার চাইতে ডোরার ওকেই বেশি ভয় পাওয়া উচিত) তাকে রাতে দেখে রাখবে বলে জানাল। শুধু এই এতক্ষণে আমি বুঝলাম যে কোনো মেয়েকে আমাদের দুজনের কাছে বিশ্বাস করে সঁপে দেওয়া যায়।

    স্যামুয়েল: ডোরার সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা একদম বিফলে গেল। যতই এটা এগোচ্ছিল, ততই সবকিছু আরো খারাপ হয়ে উঠছিল। আমি চাচ্ছিলাম রেলযাত্রায় ক্ষান্ত দিয়ে মিউনিখে রাত কাটাব। রেগেনুজবার্গের কাছাকাছি কোথাও রাতের খাবার খাওয়া পর্যন্ত আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা টুকরা। কাগজে কিছু কথা লিখে আমি তা রিচার্ডকে জানানোর চেষ্টা করলাম। ওকে দেখে মনে হলো না সে আদৌ ওটা পড়ল, শুধু ওটা পকেটে ঢোকানোর কথাই মনে হয় ভাবছিল সে। যা হোক, কোনো ব্যাপার না, ওই বেরসিক চিড়িয়াকে পাত্তা দিতে আমার বয়েই গেছে। শুধু রিচার্ড ওকে নিয়ে যা একটা হাঙ্গামা করল– তার সাড়ম্বর উপদেশ আর বীরত্ব দেখিয়ে। এর কারণেই মেয়েটা তার ফালতু ভাব নিল ওইভাবে, প্রথম দিককার চেয়েও অনেক বেশি করে, আর শেষমেশ গাড়িতে দুজনেই হয়ে উঠল একেবারে অসহ্য। আমরা যখন বিদায় জানালাম, সে যে কী সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেল, আমি ওরকমই যে হবে তা জানতাম। রিচার্ড, যে কিনা, কোনো ভুল নেই, তার সুটকেস বয়ে দিচ্ছিল, এমনভাবে সে আচরণ করছিল, যেন মেয়েটা তাকে তার প্রাপ্যের বেশি অনুগ্রহ দেখিয়েছে, আমার তখন তিই লাগছিল শুধু। সংক্ষেপে বলতে গেলে: মেয়েরা, যারা একা ভ্রমণ করে কিংবা এভাবে-ওভাবে বা কোনোভাবে দেখাতে চায় যে তারা মুক্ত, স্বাধীনচেতা, সেসব মেয়ের উচিত কিনা অন্যদের মতো ছেলেদের সঙ্গে রংঢঙের ভান করা; এটা মনে হয় ইতোমধ্যে অনেক সেকেলে আচরণ হয়ে গেছে –প্রথমে একটা ছেলেকে একটু চুলকানি দেবে, তারপর তার চারপাশে বেড়া দিয়ে দেবে, ছেলেটার এর পরের বিভ্রান্ত অবস্থার সুযোগ নেবে। মেয়েদের এই আচরণ বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না, সহজেই বোঝা যায়, তখন দ্রুত বেড়ার মধ্যে ঘিরে পড়তেই বরং স্বচ্ছন্দ লাগে, ছেলেটাকে সে সম্ভবত যতটুকু বেড়ার মধ্যে ঘিরে দেওয়ার ইচ্ছা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি হলেও তখন খুশিই লাগে।

    আমরা আমাদের কামরায় ঢুকলাম, ওখানে আমাদের লাগেজগুলো পড়ে ছিল, এটা নিয়ে রিচার্ডের উদ্বেগের কমতি ছিল না। রিচার্ড তার সবসময়ের মতো ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, মাথার নিচে কম্বল গুটিয়ে বালিশ বানাচ্ছে আর তার ভারী ওভারকোট এমনভাবে ঝুলিয়েছে যে ঘেরটা তার মুখের উপরে শামিয়ানার মতো হয়ে গেল। অন্যের প্রতি সম্মান-সমীহ ছাড়াই সে যেভাবে এসব করে, তা আমার ভালোই লাগে; বিশেষ করে প্রশ্নটা যদি হয় তার ঘুমের, তাহলে সে আমাকে জিজ্ঞেস না করেই আলো নিভিয়ে দেবে, যদিও সে জানে আমি ট্রেনে ঘুমাতে পারি না। যেভাবে সে তার সিটে শরীর টান টান করে শোবে তাতে মনে হবে অন্য সহযাত্রীদের যে-কারো চেয়ে ওই সিটের ওপরে তার অধিকারটাই বেশি; আর তারপর তক্ষুনি শান্তির ঘুমে ঢলে পড়বে। এর পরও এই মানুষটার সার্বক্ষণিক অভিযোগ যে তার ঘুম হয়নি।

    এই কামরায় আমরা ছাড়া আছে দুই ফরাসি বালক (জেনেভা থেকে আগত দুই হাইস্কুল ছাত্র)। এদের একজন মাথায় কালো চুল, সারাক্ষণ হাসে, রিচার্ড যে তার বসার জন্য বলতে গেলে কোনো জায়গাই রাখেনি (এতখানিই পা ছড়িয়ে শুয়েছে রিচার্ড), তাতেও সে হাসে, পরে রিচার্ড এক মিনিটের জন্য একটু উঠল, সবাইকে বলল সিগারেট একটু কম খেতে, তখন ছেলেটি একটুও দেরি না করে রিচার্ডের বিছানার বেশকিছু অংশ কেড়ে ফেরত নিল । ভ্রমণে বেরোলে এসব ছোটখাটো বিবাদ ভিন্ন ভাষার লোকজন কীরকম নীরবে আর কত বেশি হালকা মেজাজে চালিয়ে যায়, কেউ কারো কাছে মাফ চায় না, কেউ কাউকে গালি দেয় না। ফরাসি ছেলে দুটোর জন্য আমার রাত পার করাটা একটু সহজ হলো –তারা। বিস্কুটের একটা টিন বারবার একজন আরেকজনকে দিচ্ছে কিংবা কাগজ পেঁচিয়ে সিগারেট বানাচ্ছে, কিংবা এক মিনিট পর পরই করিডরে যাচ্ছে, ওখানে একজন অন্যজনকে ডাকাডাকি করছে, তারপর আবার ফিরে এসে বসছে। লিনডাউ তে সেই হাসি, রাতের এই সময়টার কথা চিন্তা করলে অবাক হতে হয় ওই জোর হাসি শুনে। ভিন দেশের ট্রেনের গার্ড দেখতে কেমন যে জোকারের মতো লাগে, যেরকম ফাৰ্থ-এ আমাদের লেগেছিল বাভারিয়ান গার্ডকে দেখে, তার বিরাট লাল ব্যাগ যেটা প্রায় তার পায়ের কাছে ডানা ঝাঁপটানোর মতো বাড়ি মারছিল। বাইরে লেক অব কনস্টান, ট্রেনের আলো পড়ে তার পানি ঝিকমিক করছে, কেমন কোমল দেখাচ্ছে, লেকের অন্য পাড়ে দূরের আলো পর্যন্ত সেই ঝিকিমিকি, অন্য পাড়টা অন্ধকার ও কুয়াশাঢাকা –দীর্ঘ ও টানা অনেকক্ষণ দেখা গেল এই দৃশ্য। স্কুলে শেখা একটা পুরোনো কবিতা মনে পড়ল: ‘লেক অব কনস্টানস্ পার হওয়া সওয়ারি’। বেশ অনেকটা সময় ব্যয় করলাম স্মৃতি থেকে কবিতাটি তৈরি করতে। তিনটে সুইস লোক ঠেলেঠুলে ঢুকল। একজন সিগারেট খাচ্ছে। অন্য দুজন। বাইরে গেলে আরেকজন থেকে গেল, তাকে দেখতে শুরুতে অলীক মনে হলেও ভোরের দিকে দৃশ্যমান হয়ে উঠল সে। সে রিচার্ড ও ফ্রেঞ্চ ছেলেটার মধ্যেকার জায়গা দখলের বিবাদ মিটিয়ে দিল, দুজনকেই অসুবিধায় ফেলে ঠিক দুজনের মাঝখানে বসে গেল সে, কঠিন হয়ে ওখানে বসে থাকল রাতের বাকি পুরোটা, তার দু-হাঁটুর মাঝখানে তার পর্বতারোহণের ছড়ি। রিচার্ড প্রমাণ করল বসে থেকেও ঘুমানো একই রকম সম্ভব।

    সুইজারল্যান্ড আমাকে অবাক করে– কারণ আমি দেখি রেললাইনের পুরোটা ধরে সব ছোট শহর ও গ্রামের বাড়িগুলো আলাদা আলাদা দাঁড়ানো, তাদের ভঙ্গির মধ্যে জোরালো ও বলিষ্ঠ এক স্বাধীনতার ছাপ। সেন্ট গ-এ কোনো দুটো বাড়ির মধ্যেই আর সংযোগরাস্তা নেই। ভালো জার্মান স্বাতন্ত্রবোধের সম্ভবত এটি একটি প্রকাশ। বাড়িগুলোর পাশের মাটির অসাম্য ও তারতম্য থাকায় এ প্রকাশ আরো সহজ হয়েছে– প্রতিটা বাড়িরই জানালার শাটার গাঢ় সবুজ, আর ছাদের প্রান্তভাগ ও রেলিংগুলোতে অনেক সবুজ রঙের ছোঁয়া –এ কারণে সব মিলে দেখতে লাগে ভিলার মতো। তার পরও (শুধু একটা বাড়িতেই) দেখা গেল অফিসও খোলা হয়েছে, থাকার ও ব্যবসায়ের জায়গা একই চাঁদের নিচে। ভিলা থেকে ব্যবসা করার এই ব্যবস্থা আমাকে খুব বেশি মনে করিয়ে দিল আর. ভাজারের উপন্যাস দি অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর কথা।

    রোববার, ভোর পাঁচটা, ২৭ আগস্ট। সব জানালা এখনো বন্ধ, সবাই ঘুমে। একটা অনুভূতি আমাকে তাড়াচ্ছে: আমরা সবাই এই ট্রেনের মধ্যে বন্দী, ট্রেনের চারপাশের বাতাসের সঙ্গে তুলনায় একমাত্র পচা বাতাস শুধু ট্রেনের। ভেতরেই, সেটাতে শ্বাস নিচ্ছি আমরা, আর তখন বাইরের ভূপ্রকৃতি কী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে, এই দৃশ্য ভালোভাবে দেখতে হলে কোনো রাতের ট্রেনের অবিরাম জ্বলতে থাকা আলোর নিচে বসে থেকেই দেখতে হবে। এই খুলে যাওয়ার খেলায় প্রথমে বলতে হয় অন্ধকার পর্বতমালার কথা, তাদের ও ট্রেনের মাঝখানে খুবই সরু উপত্যকা; এরপর ভোরের কুয়াশা, চারদিকে তা ছড়িয়ে দিয়েছে এক শুভ্র দীপ্তি, দেখে মনে হচ্ছে দরজার উপরে পাখার মতো যে জানালা থাকে তা থেকে যেন বেরোচ্ছে এই রশ্মিগুলো; এরপর ধাপে ধাপে তৃণভূমি চোখে পড়া শুরু হলো, এত সতেজ যেন কখনো ছোঁয়াই হয়নি, সবুজ আর প্রাণরসে টসটসে, এ বছরের এই খরার সময়ে তা দেখে আমি অবাকই হচ্ছি; শেষমেশ সূর্য যখন ওঠা শুরু হলল, ঘাসগুলো একটা ধীর রূপান্তর-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মলিন হয়ে উঠল। গাছগুলোর বিশাল ভারী সব। শাখার সুচালো প্রান্তভাগ ঝাঁক বেঁধে নেমে এসেছে কাস্ত্রে একেবারে নিচ পর্যন্ত।

    গাছের এ ধরনের আকার সুইস শিল্পীদের আঁকা ছবিতে দেখা যায়, আর আজকে পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম ওসব ছবি বোধহয় স্রেফ বিশেষ ভঙ্গিমার এক অঙ্কনশৈলী।

    এক মা তার বাচ্চাদের নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তায় রোববারে হাঁটতে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে আমার মনে পড়ে গেল ঔপন্যাসিক গটফ্রিড কেলারের কথা, তিনিও বড় হয়েছিলেন মায়ের কাছে।

    চারণভূমির পুরোটা জুড়ে চোখ-ধাঁধানো যত সুন্দর বেড়া দেওয়া; অনেকগুলোই বানানো ধূসর কাঠ দিয়ে, মাথা পেনসিলের মতো সূঁচালো, প্রায়ই মূল কাঠ থেকে ওই পেনসিল মাথার কাছে এসে দুদিকে বেরিয়ে গেছে। আমরা ছোট থাকতে পেনসিলের থেকে সিস বের করার জন্য ওভাবে পেনসিলের মাথা কেটে দুই ভাগ করতাম। এ রকম বেড়া আমি এর আগে কখনো দেখিনি। তার মানে প্রতিটা দেশেরই, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বস্তুগুলোর পাশাপাশি, অভিনবত্ব দেখানোর কিছু-না-কিছু থাকেই, আর ওসব অভিনব জিনিস দেখে খুশিতে নাচতে গিয়ে সত্যিকারের যা অসাধারণ, সেটার কথা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না।

    রিচার্ড: সকালের প্রথম সময়টাতে ধ্যানমগ্ন সুইজারল্যান্ড। লোকদেখানো ভঙ্গিতে খুব সুন্দর কোনো একটা ব্রিজ দেখার জন্য স্যামুয়েল আমাকে ডেকে তুলেছে; আমি উঠে তাকাতে তাকাতে অবশ্য ব্রিজ পার হয়ে গেছি; তার এই সরব ও সরাসরি পদক্ষেপের কারণেই বোধ হয় সুইজারল্যান্ড তার মাথার মধ্যে শক্তপোক্তভাবে ঢুকে গেল। আমি প্রথমে, অনেক অনেকক্ষণ ধরে, একে দেখলাম আমার ভেতরে ও বাইরে বিরাজমান এক গোধূলির আবছায়ার মধ্যে থেকে।

    অস্বাভাবিক ভালো ঘুমিয়েছি আমি গত রাতে, ট্রেনে প্রায়ই আমার এরকম ভালো ঘুম হয়। ট্রেনে আমি আক্ষরিক অর্থেই খুব গুছিয়ে ঘুম যাই। প্রথমে আরাম করে গা-ছেড়ে দিয়ে বসি, সবশেষে ছেড়ে দিই আমার মাথা, প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে নানা কায়দায় বসে-টসে দেখি কোনটা সুবিধাজনক, আমার চারপাশের সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি, কোনো ব্যাপারই নয় ওরা সবাই চারদিক থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে কি না; বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মূল কাজটা আমি করি আমার ওভারকোট কিংবা বেড়ানোর টুপি দিয়ে মুখ ঢাকার মাধ্যমে –আর নতুন এক আসনে ওভাবে জেঁকে বসার ফলে শরীর জুড়ে যে আরাম ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়, তাতেই একটু পরে ঘুমের জগতে ভেসে যাই আমি। শুরুতে, নিঃসন্দেহে, অন্ধকার থাকলে অনেক সুবিধা হয়, কিন্তু পরে আর তার দরকার পড়ে না। লোকজন তখন, আগের মতো, কথা বলে গেলেও কোনো সমস্যা হয় না; প্রকৃতির বিধানগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে: মন। দিয়ে ঘুমাচ্ছে এমন কোনো মানুষ তার থেকে অনেক দূরে বসে বকবক করতে থাকা অন্য আরেকজন মানুষের জন্য একটা চিহ্ন, একটা স্মারক, জেগে থাকা লোকটির পক্ষে সেই স্মারক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। রেলগাড়ির কামরার মতো অন্য আর কোনো জায়গা বোধ হয় নেই যেখানে জীবনের একদম উল্টো দুটো দিক এভাবে এত কাছাকাছি, সরাসরি ও বিস্ময়কর নৈকট্যের মধ্যে চলে আসে; আর যাত্রীরা একে অন্যকে এরকম অনবরত দেখতে থাকার কারণে দেখা যায় সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে একজন আরেকজনকে প্রভাবিত করে বসছে। তাই ঘুমন্ত কেউ যদি অন্যদের মধ্যে রাতারাতি তক্ষুনি ঘুম ঢুকিয়ে দিতে নাও পারে, তবু তার কারণে অন্যরা ঠিকই অনেক শান্ত, চুপচাপ ও ধ্যানী হয়ে ওঠে, এতটাই ধ্যানী যে (ঘুমন্ত লোকটি অবশ্য এটা চায়নি) তারা সিগারেট খেতে শুরু করে দেয়, দুর্ভাগ্যক্রমে যেটা হয়েছে এই রেলভ্রমণে, যেখানে শালীন স্বপ্নের সুন্দর আবহাওয়ার মধ্যে আমাকে ভকভক করে গিলতে হয়েছে সিগারেটের ধোঁয়া।

    ট্রেনে আমার ভালো ঘুম হওয়ার আমি ব্যাখ্যা করতে পারি এভাবে: অতিরিক্ত কাজের থেকে আমার যে স্নায়ুচাপ হয়, সাধারণত তার কারণে, তার হট্টগোল মাথায় ঢুকে যাওয়ার কারণে আমি ঘুমাতে পারি না; পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে যখন এর সঙ্গে যোগ হয় রাতের হাজারো ছড়ানো-ছিটানো শব্দ, যেমন মানুষের বড় বাসাগুলো থেকে আসা শব্দ, রাস্তা থেকে আসা শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা চাকার গড়গড়ানির শব্দ, প্রত্যেক মাতালের ঝগড়ার শব্দ, সিঁড়িতে প্রতিটা পা ফেলার প্রতিধ্বনির শব্দ –এসব মিলে আমার এত বিরক্তি হয় যে আমি প্রায়ই আমার ঘুম না-হওয়ার কারণে দায়ী করি বাইরের এসব শব্দকে। অন্যদিকে ট্রেনে চড়লে যাত্রাপথের নিয়মিত হাজার শব্দের একঘেয়েমি, তা সে বগির স্প্রিং ঘোরা থেকে আসুক কি চাকার ঘর্ষণ থেকে আসুক কি রেলের পাতের সংযোগস্থলের ধাক্কা থেকে আসুক কিংবা এই পুরো কাঠ, কাঁচ ও লোহার কাঠামোর কম্পন থেকেই আসুক –তা এমন এক পরম প্রশান্তির পর্যায়ে উঠে যায় যে সেখানে পৌঁছানোর কারণে আমার ঘুম চলে আসে, আপাতদৃষ্টিতে কোনো সুস্থ মানুষ যেভাবে শান্তিতে ঘুমায় সে রকম ঘুম। এই আপাতদৃষ্টি দিয়ে অবশ্য ইঞ্জিন থেকে আসা কান ফুটো করা শিসের কিংবা ট্রেনের গতি বাড়া কমার উৎপাতের কিংবা কোনো স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে দেখলে নিশ্চিত যে অনুভূতি হতে থাকে তার ব্যাখ্যা হয় না; এসব যেভাবে পুরো ট্রেনের শরীরের মধ্যে ঢুকে যায়, একইভাবে ওরা ঢুকে পড়ে আমার ঘুমের পুরোটা বেড় দিয়েও, তাতে করে একসময় জেগে উঠতে বাধ্য হই আমি। তখন কানে আসে, এতে অবশ্য অবাক হই না কোনো, স্টেশনের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, এমন সব জায়গা যা আমি কোনো দিন পার হব ভাবিনি, যেমন এবারের সফরেই হলো: লিডাউ, কনস্টানস্, আরো মনে হয় রোমানস্হর্ন; এই নাম ডাকা থেকে অত আনন্দ হয় না, যেটা নিশ্চিত হতো জায়গাগুলো স্বপ্নে দেখলে; বরং উল্টোটাই, স্রেফ বিরক্তিই হয়। যাত্রা চলাকালীন যদি আমাকে ঘুমের থেকে জাগানো হয়, তাহলে অন্য সময় ঘুম থেকে জাগানোর চেয়ে ধাক্কাটা বেশি লাগে; কারণ, তা ট্রেনে ঘুমের স্বভাব বা রীতিবিরুদ্ধ একটা কাজ। আমি তখন চোখ খুলি আর একটুখানিকের জন্য জানালার দিকে তাকাই। ওখানে খুব বেশিকিছু আমার চোখে পড়ে না, আর যা চোখে পড়ে তার ধারণা নিতে পারি কেবল স্বপ্নের ভেতরে-থাকা কোনো মানুষের অলস উপলব্ধি দিয়েই। তার পরও আমি হলফ করে বলতে পারি, ভারূটেমবার্গের কোথাও (ঠিক যেন ভারূটেমবার্গ জায়গাটা আমার অনেক চেনা, এমনভাবে বলছি), রাত প্রায় দুটোর দিকে আমি এক লোককে দেখেছি তার গায়ের বাড়ির বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে তার পড়ার ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা, আলো পুরো জ্বলছে, যেন সে এইমাত্র বাইরে এসেছে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আগে তার মাথা একটু ঠান্ডা করার জন্য। লিডাউ স্টেশনে গানের শব্দে রাতের শরীরটা ভরে ছিল, স্টেশনে ঢোকার মুখে, আবার স্টেশন ছাড়ার সময়েও, আর যদিও শনি ও রোববারের মাঝখানের রাতে রেলযাত্রায় যে-কেউ যাত্রার পথ ধরে সপ্তাহান্তের নাইট লাইফের অনেক হইচইয়ের মধ্যে দিয়েই যাবেন, তাতে অবশ্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে সামান্যই, ঘুম মনে হয় তাতে করে ততটাই আরো গাঢ় হয় যতটা বাইরের উৎপাত আরো সশব্দ হয়ে ওঠে। গার্ডরাও দেখি যে প্রায়ই আমার ঘোলা হয়ে আসা জানালার শার্সির বাইরে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, কাউকে ঘুম থেকে ওঠানো তাদের উদ্দেশ্য নয়, তারা স্রেফ তাদের দায়িত্বটুকুই পালন করছে, ফাঁকা স্টেশনে গলার বাড়তি জোরের সঙ্গে চিল্লিয়ে বলছে জায়গার নাম, নামের এক অক্ষর এই কামরার আর অন্য অক্ষরগুলো সামনের দিকের কামরার বাইরে হেঁটে যেতে যেতে। আমার সঙ্গের যাত্রীরা তখন তাদের মাথার মধ্যে জায়গার নামটা হয় পুরো তৈরি করার কসরত করছে, না হয় তারা আরো একবার উঠে জানালা সাফ করে বাইরে লেখা স্টেশনের নাম পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে; তবে আমি কিন্তু ততক্ষণে আবার কাঠের গদিতে মাথা হেলান দিয়েছি।

    যা হোক, আমি মনে করি কেউ যদি ট্রেনে ওরকম ভালো ঘুমাতে পারে যেমনটা আমি পারি– স্যামুয়েল বলে সে নাকি সারা রাত চোখ খুলে বসে থাকে তাহলে তাকে একেবারে গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত ঘুমাতে দেওয়া উচিত; এটা উচিত না যে সে ওরকম গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবে একটা রেলবগির ছোট কামরার ভেতরে, কোনার মধ্যে, ঠাসাঠাসি করে আছে, মুখ তেলতেলে, শরীর ঘর্মাক্ত, চুল একদম উষ্কখুষ্ক, কাপড়চোপড় চব্বিশ ঘণ্টা রেলভ্রমণের ধুলো-কালিতে মাখামাখি, দাঁত ব্রাশ নেই, একটু মুক্ত বাতাস নেই, আর এভাবেই আরো অনেক অনেক ঘন্টা চলা তার নিয়তিতে লেখা। শরীরে জোর থাকলে ওরকম ঘুম যে-কেউ পারলে ঘৃণা করত, কিন্তু তা বলে তো লাভ নেই; আমার বরং স্যামুয়েলের মতো মানুষদেরকে ঈর্ষা হয়, যারা হয়তো ছাড়া ছাড়া একটু ঘুম দিয়েছে, তাই নিজেদের যত্ন নিতে পেরেছে অনেক বেশি, প্রায় পুরো ভ্রমণটাই করেছে মানসিকভাবে সচেতন থেকে আর তাদের মাথা অক্ষত ও পরিষ্কার রাখতে পেরেছে ঘুমের যাবতীয় আগ্রাসন থেকে সন্দেহ নেই, সেই আগ্রাসন তাদেরও ছেড়ে দিয়ে রাখেনি। সকালে, বাস্তবিকই, আমি ছিলাম সম্পূর্ণ স্যামুয়েলের দয়ার ওপরে।

    আমরা জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম পাশাপাশি, আমি স্রেফ তাকে খুশি করার জন্যই; যখন সে আমাকে জানালার বাইরে সুইজারল্যান্ডের যতটা দেখা যাচ্ছে। তা দেখাল, বলল আমি ঘুমানোর কারণে কী কী সব দেখা মিস করেছি, আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম, সেসবের প্রশংসা করলাম ওর মুখ থেকে শুনেই। এটা ভালো যে, আমার এই এখনকার মতো মন-মেজাজ সে হয় ধরে উঠতে পারে না কিংবা খেয়াল করে না, কারণ আমি দেখি বরং এরকম সময়েই সে আমার প্রতি গাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (অন্য সময় যখন আমি মনে করি তার বন্ধুত্ব আমার বেশি প্রাপ্য, তখনকার চেয়ে বেশি)। আমি ভাবছিলাম শুধু ডোরা লিপপার্টের কথা। নতুন কারো সঙ্গে ক্ষণিকের দেখা হলে, বিশেষ করে যদি মেয়েদের সঙ্গে হয়, আমার জন্য কোনো আন্তরিক মতামতে পৌঁছানো কঠিন হয়ে ওঠে। কারণ দেখা যায় পরিচয় যত সামনে এগোচ্ছে, আমি ততই নিজের দিকে তাকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছি (নিজেকে ব্যস্ত রাখার জিনিসের আমার কমতি নেই), অতএব ক্ষণিকের যে অনুভূতিগুলো আমার হয় এবং সাথে সাথেই আমি যা হারিয়ে বসি, দেখা যায় তার অতি হাস্যকর সামান্য এক অংশই আমি ফসল হিসেবে ঘরে তুলতে পেরেছি। অন্যদিকে, স্মৃতিচারণার সময়, এই অল্পপরিচয়ের মানুষগুলো অনেক বড় হয়ে ওঠে, অনেক আদরণীয় হয়ে ওঠে, কারণ স্মৃতির মধ্যে তারা নীরব-নিস্ফুপ, নিজেদের কাজেই ব্যস্ত আর আমাদের উপস্থিতি পুরো ভুলে গিয়ে আমাদের প্রতি তাদের ঔদাসীন্য দেখিয়ে যায়। তবু ডোরার জন্য (স্মৃতিতে এখন আমার সবচেয়ে নিকটের মানুষ সে) এত বেশি আমার মন-কেমন-করার অন্য একটা কারণও আছে। আজ সকালে আমি জেনেছি স্যামুয়েল আমার একটা অভাব পূরণ করতে পারবে না। সে আমার সঙ্গে ভ্রমণে বেরোতে রাজি, কিন্তু তাতে কী? তার মানে তো হচ্ছে ভ্রমণের অত দিনের পুরো সময় ধরে আমার পাশে থাকবে কাপড়চোপড়ে পুরো গা ঢাকা এক পুরুষমানুষ, যার শরীর আমি হয়তো দেখব শুধু গোসলের সময়েই, যদিও সে দৃশ্য দেখার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছাও আমার নেই। আমি যদি কাঁদতে চাই তাহলে স্যামুয়েল, নিঃসন্দেহে, তার বুকে মাথা রেখে আমাকে কাঁদতে দেবে, কিন্তু তার সঙ্গে থেকে, তার ঐ পুরুষালি চেহারা, তার ঐ পরিচ্ছন্ন সুচালো দাড়ির নড়াচড়া, তার ঐ শক্ত করে বন্ধ করে রাখা মুখ (আর তো নিশ্চয়ই বলার দরকার নেই)– এসবের দিকে তাকিয়ে আমার সেই মুক্তির কান্না কি আদৌ কোনো দিন চোখ পর্যন্ত উঠে আসবে?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট – ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি
    Next Article দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা

    Related Articles

    ফ্রানজ কাফকা

    দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা

    October 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }