Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র ১ – অনুবাদ : মাসরুর আরেফিন

    ফ্রানজ কাফকা এক পাতা গল্প619 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    দি স্টোকার

    দি স্টোকার

    একটি খণ্ডাংশ

    [Stoker কথাটির কোনো জুতসই বাংলা শব্দ নেই। ইঞ্জিনের চুলায় কয়লা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে বলা হয় Stoker। অন্য কথায় জাহাজের বয়লার রুমে (যেখানে পানি গরম করে বাষ্প করা হয়) কাজ করা কয়লা-শ্রমিক।]

    যখন ষোলো বছরের কার্ল রসমান– যাকে তার গরিব বাবা-মা আমেরিকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন, কারণ এক কাজের মেয়ের প্রলোভনে পড়ে সে একটা বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে– ধীর হয়ে আসা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে নিউ ইয়র্ক পোতাশ্রয়ে ঢুকল, তার চোখে পড়ল স্ট্যাচু অব লিবার্টি (অনেক দূর থেকেই সে দেখছিল ওটা) যেন হঠাৎ আরো তীব্র রোদের আলোয় স্নান করছে। তরবারি ধরা হাত এমনভাবে উপরে উঠে গেছে যেন মাত্র তোলা হয়েছে, আর ঐ মহিলার চারপাশে বাতাস খেলে যাচ্ছে বাধাহীন।

    ‘কী উঁচু!’ মনে মনে বলল সে। জাহাজ ছাড়ার কোনো চিন্তা তার মাথায় নেই, আর সংখ্যায় বাড়তে থাকা কুলিরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে যাচ্ছে, ওভাবে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে রেলিংয়ের গায়ে পড়ল সে।

    এক কমবয়সী লোক, এই সমুদ্রযাত্রায় তার সঙ্গে সামান্য পরিচয় হয়েছিল কার্লের, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন: “তোমার কি এখনো তীরে নামার ইচ্ছা নেই কোনো? ‘ওহ্, আমি তো রেডি,’ একটু হেসে বলল কার্ল, আর উচ্ছ্বসিত হয়ে (এবং এ কারণেও যে সে তরতাজা কিশোর) ট্রাংকটা কাঁধে তুলে দেখাল। কিন্তু যখন কার্ল তাকিয়ে দেখছে তার এই পরিচিত লোকটা ভিড়ের চাপে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, হাতের ছড়িটা এক দুবার নাড়াচ্ছেন তিনি, আতঙ্কের সঙ্গে তার মাথায় এল –সে তার ছাতা ফেলে এসেছে। নিচে। তাড়াতাড়ি সে পরিচিত লোকটাকে বলল –মনে হলো উনি খুশি হলেন না খুব একটা –কিছুক্ষণের জন্য তার ট্রাংকটা দেখে রাখতে, আর ঠিক এই জায়গাটা যেন পরে খুঁজে পেতে সমস্যা না হয় সেজন্য চারপাশে একটু দেখে নিল, তারপর ছুট লাগাল। নিচে নামতেই সে হতাশ হলো যে, গ্যাংওয়েটা, যেটা ধরে গেলে তার পথ অনেক কমে আসত, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এই প্রথমবারের মতো, মনে হয় সব যাত্রী যে এখন নামবে তেমন কোনো কারণে। তাকে এখন বেশ কষ্ট করে পথ খুঁজে পেতে হচ্ছে অনেক ছোট ছোট কামরার মধ্য দিয়ে, একটার পর একটা ছোট সিঁড়ি বেয়ে নেমে, এমন অনেক করিডর ধরে হেঁটে যেগুলো শুধু পাক খাচ্ছে বারবার, তারপর একটা খালি কামরার মধ্য দিয়ে গিয়ে যেখানে পড়ে আছে পরিত্যক্ত একটা লেখার টেবিল –এই সব শেষে, যেহেতু এদিকটায় সে আগে মাত্র এক-দুবারই এসেছে আর তাও অন্য মানুষদের সঙ্গে, সে বুঝল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। বিভ্রান্ত হয়ে (আর যেহেতু একটা লোকও সে দেখেনি কোথাও, শুধু মাথার উপরে শুনছে হাজারটা মানুষের বিরামহীন পায়ের আওয়াজ, আর এখন দূরে শোনা গেল ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার সময়ের ধুকধুক দম-থেমে-যাওয়া একটা শেষ শব্দ) কোনোকিছু না-ভেবেই সে বাড়ি মারতে লাগল একটা ছোট দরজায়, ঘুরতে ঘুরতে এমনিই ওখানে এসে হাজির হয়েছে সে।

    ‘তালা দেওয়া নেই,’ ভেতর থেকে চিৎকার এল, আর কার্ল সত্যিই স্বস্তির এক শ্বাস ফেলে খুলল দরজাটা। এইভাবে পাগলের মতো দরজায় বাড়ি মারছো কেন? একটা বিরাট মানুষ বললেন, কার্লের দিকে বলতে গেলে তাকালেনই না। কেবিনের ছাদে কীরকম যেন এক ফাঁক দিয়ে ঘন-অন্ধকার-মাখানো আলো –উপরের ডেকটাতে আলো দেওয়ার পরে আর এর বেশি ঔজ্জ্বল্য নেই– এই শোচনীয় কেবিনটাতে ঢুকেছে; এখানে গুদামঘরের মাল-সামানের মতো একসঙ্গে বোঁচকা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একটা দেয়ালে লাগানো সরু বিছানা, একটা ছোট আলমারি, একটা চেয়ার, আর ওই লোক। আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি,’ বলল কার্ল, ‘এত দিনের সাগর পাড়িতে আসলে ঠিকমতো কখনো খেয়াল করিনি, এখন বুঝছি এটা যে কী ভয়ংকর বড় জাহাজ। ঠিকই ধরেছ, লোকটা বললেন একধরনের গর্ব নিয়ে, একটা ছোট সুটকেসের তালা ধরে উদ্দেশ্যহীন খেলা করছেন তিনি, বারবার দুই হাতে চেপে ধরছেন বন্টুটা আর শুনছেন সেটা কীভাবে ফট করে লেগে যায়। ভেতরে আসো, তাহলে,’ লোকটা বলতে লাগলেন, ‘নাকি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে!’ ‘আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?’ কার্ল জিজ্ঞাসা করল। ওহ্ খোদা, না, কী যে প্রশ্ন করো!’ ‘আপনি জার্মান? জানতে চাইল কার্ল, নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইছে সে, কারণ আমেরিকায় নতুন আসা মানুষেরা কী ভয়াবহ দুর্গতির মধ্যে পড়ে, বিশেষ করে আইরিশদের হাতে, সে গল্প সে অনেক শুনেছে। তা আমি বটে, ঠিক ধরেছ, বললেন লোকটা। কার্ল তার পরও ইতস্তত করছে। তখনই তিনি হঠাৎ দরজার হাতল টেনে দরজা লাগিয়ে দিলেন, কার্লকে এক ঝাঁকিতে কেবিনে নিজের দিকে টেনে নিলেন। ‘গ্যাংওয়েতে দাঁড়িয়ে কেউ আমার ঘরে উঁকি মারুক তা আমি একদম পছন্দ করি না, বললেন তিনি, আবার এখন সুটকেসটা নিয়ে পড়েছেন, যে ব্যাটাই এদিক দিয়ে যায়, একটু উঁকি দেবেই, কে আছে তা সারা দিন সহ্য করবে! কিন্তু গ্যাংওয়েতে তো কেউ নেই,’ বলল কার্ল, দেয়ালে-লাগানো সরু বিছানাটায় অস্বস্তির সঙ্গে ঠেসে আছে সে। ‘হ্যাঁ এখন কেউ নেই,’ বললেন লোকটা। আমরা তো এখন নিয়েই কথা বলছি নাকি? ভাবল কার্ল, এই লোকের সঙ্গে কথা বলা তো ভারি কঠিন।’ ‘বিছানায় শুয়ে পড়ো, ওখানে জায়গা বেশি পাবে,’ বললেন তিনি। কার্ল কোনোমতে হামা দিয়ে উঠল, শুরুতে হাতে ভর দিয়ে লাফিয়ে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে সে হেসে ফেলল জোরে। কিন্তু বিছানায় ঠিকমতো উঠতেও পারেনি, তখন চেঁচিয়ে বলল: ‘ওহ্ খোদা, আমার ট্রাংকের কথা তো পুরো ভুলে গেছি। কেন, কোথায় তা?’ ‘উপরে, ডেকে, আমার চেনা একজন ওটা পাহারা দিচ্ছে। কী যেন তার নাম?’ তারপর সে তার মায়ের সেলাই করে দেওয়া এক গোপন পকেট থেকে বের করে আনল একটা ভিজিটিং কার্ড, তার মা এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার কথা মাথায় রেখেই তার জ্যাকেটের লাইনিংয়ের ভেতরে ওটা বানিয়ে দিয়েছেন। ‘বাটারবম, ফ্রানৎস বাটারবম।

    ‘ট্রাংকটা কি খুব দরকার তোমার?’ ‘অবশ্যই। তাই যদি হয় তাহলে অচেনা এক লোকের কাছে ওটা রেখে এলে কেন?’ ‘নিচে এখানে আমার ছাতা ফেলে রেখে গিয়েছিলাম। ওটা নেওয়ার জন্য যখন দৌড়ালাম মনে হলো ট্রাংক সঙ্গে টানার কোনো দরকার নেই। তারপর পথ হারিয়ে ফেললাম। তুমি কি একা, সঙ্গে কেউ যাচ্ছে না? ‘হ্যাঁ আমি একা,’ বলল কার্ল, মনে মনে ভাবল, মনে হয় এই লোকের সঙ্গে লেগে থাকাটাই ভালো হবে। এর চেয়ে ভালো বন্ধু হঠাৎ করে আর পাব কোথায়?’ ‘ছাতার কথা বাদই দিলাম, এখন তো তোমার ট্রাংকটাও হারাল। তারপর লোকটা চেয়ারে বসলেন, মনে হচ্ছে কার্লের ঘটনাটায় উনি একটু আগ্রহ বোধ করা শুরু করেছেন। আমার কিন্তু মনে হয় না যে ট্রাংকটা গেছে। যা খুশি তা-ই তুমি মনে করতে পারো,’ বললেন লোকটা, তার ছোট, কালো, ঘন চুলে প্রবলভাবে চুলকালেন, কিন্তু জাহাজে মানুষের নৈতিক চেহারা বদলে যায় বন্দরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তোমার এই বাটারবম হামবুর্গে হলে মনে হয় ঠিকই তোমার ট্রাংক দেখে রাখত, কিন্তু এখানে যদুর বুঝি, বাটারবম আর ট্রাংক –দুটোই গেছে এতক্ষণে।’ ‘আমার তো তাহলে এক্ষুনি উপরে গিয়ে দেখা উচিত, বলল কার্ল, চারপাশে তাকাল কীভাবে বের হবে তা বুঝতে। যেখানে আছে সেখানেই থাকো,’ বললেন লোকটা, কালের বুকে হাত দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে ধাক্কা মেরে ওকে বিছানায় ফেরত পাঠালেন। কিন্তু কেন? রেগে গিয়ে জানতে চাইল কার্ল। কারণ ওটার কোনো মানে নেই,’ বললেন লোকটা, একটু পরেই আমি নিজেও যাচ্ছি, তখন দুজনে একসঙ্গে যাওয়া যাবে। হয় তোমার ট্রাংক চুরি হয়ে গেছে, তাহলে তো করার আর কিছুই নেই; না হয় ওই লোক এখনো ওটা পাহারা দিচ্ছে, তাই যদি হয় তাহলে সে একটা বোকা, তার পাহারা চালিয়ে যাওয়াই উচিত; কিংবা সে আসলেই একজন সৎ মানুষ, তাই ওটা ওখানেই ফেলে রেখে গেছে, সে ক্ষেত্রে জাহাজ যখন একদম খালি হয়ে যাবে, তখন অনেক সহজেই আমরা ওটা খুঁজে পাব। তোমার ছাতার বেলায়ও একই কথা। এই জাহাজের পথঘাট আপনার চেনা?’ সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল কার্ল, তার কাছে মনে হলো ফাঁকা জাহাজে তার জিনিসগুলো আরো সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে এই আপাত যুক্তিসংগত ধারণাটার মধ্যে একটা গোপন কোনো ফ্যাকড়া আছে। আমাকে চিনতেই হবে– আমি বয়লার রুমে কাজ করি,’ বললেন লোকটা। আপনি স্টোকার!’ কার্ল খুশিতে চিল্লিয়ে উঠল, এই আবিষ্কার তার সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে; এবার দুই কনুইতে ভর দিয়ে উঠে আরো কাছে থেকে সে তাকাল লোকটার দিকে। স্লোভাকদের সঙ্গে আমি যে ছোট কেবিনটায় ঘুমাতাম, ওটার উল্টো দিকে দেয়ালে একটা ফাঁক ছিল, ওখান থেকে ইঞ্জিনরুমের ভেতরটা দেখা যেত।’ ‘হ্যাঁ, ওখানেই এদ্দিন কাজ করেছি আমি,’ বললেন স্টোকার। যন্ত্রপাতির কাজে আমার সব সময়ই আগ্রহ অনেক,’ বলল কার্ল, তার চিন্তার সুতো ধরেই, আর আমাকে যদি বাধ্য হয়ে আমেরিকা আসতে না হতো, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই একসময় ইঞ্জিনিয়ারই হতাম আমি।’ ‘বাধ্য হয়ে কেন আসতে হলো? ওহ কারণ!’ বলল কার্ল, হাত নাড়িয়ে পুরো আলোচনাটা খারিজ করে দিয়ে। একই সঙ্গে সে মুখে একটা হাসি নিয়ে তাকাল স্টোকারের দিকে, যেন যে কথাটা সে বলবে না এমনকি তা নিয়েও ওনার প্রশ্রয় চাচ্ছে। “নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল,’ বললেন স্টোকার, বোঝা যাচ্ছে না তিনি কি কার্লকে কথাটা বলতে উৎসাহিত করছেন, নাকি না। এখন আমিও পারব ইঞ্জিন রুমে স্টোকার হতে,’ বলল কার্ল, ‘আমার বাবা-মা’র আর যায়-আসে না আমি কী হই না হই।’ ‘আমার চাকরি গেছে,’ বললেন স্টোকার, আর এ বিষয়টা পুরো মাথায় রেখেই ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন দুই হাত, পা দুটো সরু বিছানায় ছুঁড়ে দিলেন –পরনে তার শক্ত, ঢালাই-লোহার রঙের ভাজ-ভাঁজ হওয়া ট্রাউজার– টান টান হতে। কার্লকে দেয়ালের দিকে আরো সরে যেতে হলো। আপনি কি জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছেন?’ ‘ঠিক ধরেছো, আজ চলে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু কেন? এই কাজ ভালো লাগে না?’ ‘মানে, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সব। সব সময় প্রশ্নটা চাকরি পছন্দ করা বা না-করার নয়। আসলে তুমিই ঠিক, আমার ভালো লাগে না। আমার মনে হয় না, তুমি আসলেই স্টোকার হওয়ার কথা চিন্তা করছ, কিন্তু না চিন্তা করলেই হওয়াটা সবচেয়ে সোজা। আমি তোমাকে স্পষ্ট করেই বলব, স্টোকার হোয়ো না। ওই ইউরোপে যদি তোমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে থেকে থাকে, তাহলে এখানে পড়াশোনা করতে অসুবিধা কোথায়? আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলো ইউরোপের থেকে অনেক অনেক ভালো। হতে পারে ওগুলো ভালো,’ বলল কার্ল, কিন্তু পড়াশোনা করার মতো কোনো টাকাপয়সা আমার নেই। একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম– একজন লোক সারা দিন এক দোকানে কাজ করত, তারপর সারা রাত পড়াশোনা করত, একসময় ডক্টরেট করে ফেলল আর তারপর মনে হয় মেয়র হলো, কিন্তু ওরকম হতে গেলে কী সাংঘাতিক মনের জোর লাগে, আপনার মনে হয় না? সত্যি বলি, আমার অত মনের জোর নেই। স্কুলে কখনোই ভালো ছাত্র ছিলাম না আমি, সেই জন্য স্কুলকে গুডবাই বলতে একটুও কষ্ট হয়নি। আমার ধারণা, এখানকার স্কুলগুলো আরো কড়া। আর আমি বলতে গেলে ইংরেজি একদমই জানি না। তা ছাড়া এটাও তো সত্যি, এখানকার লোকেরা বিদেশিদের বিরুদ্ধে অনেক পক্ষপাতে ভরা, আমার তা-ই মনে হয়। তুমি সেটাও বুঝে গেছ, বেশ তো? তাহলে ঠিক আছে। মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হবে। দ্যাখো, এটা একটা জার্মান জাহাজ, এর মালিক হলো হামবুর্গ-আমেরিকা শিপিং লাইন, তাই যদি হয় তাহলে জাহাজে শুধু জার্মানরা কেন কাজ করছে না? চিফ ইঞ্জিনিয়ার কেন রুমানিয়ান? ওর নাম শুবাল। অবিশ্বাস্য। ওই অসভ্য শুয়োর আমাদের জার্মানদের কিনা জার্মান জাহাজে বসে জুলুম করে। ভেবো না যে’– শ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন তিনি, হাত ঝাঁপটা দিলেন চারপাশে– ‘আমি অভিযোগটা জানাচ্ছি স্রেফ এমনি এমনিই। আমি জানি, তোমার কোনো ক্ষমতা বা প্রভাব নেই, তুমি নিজেও স্রেফ একটা গরিব ছেলে। কিন্তু, সত্যি আক্ষেপ হয়!’ এরপর তিনি টেবিলে হাতের মুঠো দিয়ে কয়েকবার বাড়ি মারলেন, তার চোখ দুটো প্রতিটা বাড়ির মধ্যে নিবদ্ধ। কত কত জাহাজে আমি কাজ করেছি’– এবার তিনি একনাগাড়ে বিশটা নাম বলে গেলেন, ওরা সব মিলে যেন একটাই শব্দ; কার্লের মাথা চক্কর দিতে লাগল– ‘নাম-খ্যাতি সবই হয়েছে, প্রশংসা কম পাইনি, ক্যাপ্টেন যেমন চান ঠিক সে রকমই আমার কাজের মান, এমনকি অনেক বছর কাজ করেছি একই জাহাজে’– তিনি উঠে দাঁড়ালেন যেন এটাই তার কর্মজীবনের প্রধান সাফল্য– ‘আর এইখানে এই বেটপ জাহাজে, সবকিছু এরা করে বই মেনে, মানুষের কোনো বুদ্ধির কোনো দরকারই নেই, আর এখানে কিনা আমাকে দিয়ে চলে না, আমি এখানে সব সময় শুবালের পথের কাঁটা, আমি একটা ফাঁকিবাজ, আমাকে নাকি বের করে দেওয়া উচিত, আর আমি নাকি মাইনে পাচ্ছি স্রেফ দয়ার ওপরে। বুঝতে পারছো এসব তুমি? আমি পারছি না। আপনার উচিত হবে না এসব সহ্য করা, কার্ল বলে উঠল অনেক উত্তেজিত হয়ে। এখানে নিচে এই স্টোকারের বাংকে তার এত নিজের বাড়ির মতো স্বচ্ছন্দ লাগছে যে সে প্রায় একদম ভুলেই বসেছে কোথাকার এক অচেনা মহাদেশের উপকূলে এক জাহাজের অজানা খোলের ভেতর সে শুয়ে আছে। ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়েছেন আপনি? তাকে বলেছেন আপনার অধিকার যেন আপনি পান সেটা দেখতে? ওহ্, ভাগো তুমি, ভাগো। তোমাকে এখানে সহ্য হচ্ছে না আমার। আমি কী বলছি তা তুমি কিছুই শুনছো না, আর তারপর কিনা উপদেশ দিচ্ছ। আমি কী করে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করব!’ স্টোকার ক্লান্তিতে ভেঙে আবার বসে পড়লেন, মুখটা ঢাকলেন তার দুই হাতে।

    এর চেয়ে আর কী ভালো উপদেশ দেব ওনাকে? মনে মনে বলল কার্ল। তার মনে হলো এখানে বসে থেকে এমন উপদেশ দেওয়ার চেয়ে (যে উপদেশকে স্রেফ নির্বুদ্ধিতা ভাবা হচ্ছে) তার বরং ট্রাংক আনতে যাওয়াই অনেক অনেক ভালো হতো। তার বাবা, ট্রাংকটা চিরদিনের জন্য তার জিম্মায় সঁপে দেওয়ার সময়, ঠাট্টা করে জিগ্যেস করেছিলেন: ‘কদিন তোমার থাকবে ওটা? আর এখন এই মূল্যবান জিনিসটা কিনা মনে হচ্ছে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল পাকাপোক্তভাবে। শুধু এটাই সান্ত্বনা যে তার বাবার পক্ষে সম্ভব না তার এখনকার অবস্থা জানা, এমনকি তিনি যদি খোঁজখবর করেন, তা-ও। শিপিং কোম্পানি খুব বেশি হলে এটাই বলতে পারবে যে, সে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত পৌঁছেছে। কার্লের সত্যি মন খারাপ হলো যে ট্রাংকের জিনিসপত্তর তার বলতে গেলে ব্যবহারই করা হয়নি, যেমন তার জামাটা –ওটা অনেক আগেই বদলানো উচিত ছিল। হিসাব করে চলার কী বাজে উদাহরণ; এই এখন, কর্মজীবনের ঠিক গোড়াতে যখন তার দরকার সুন্দর জামাকাপড় পরে থাকা, তাকে কিনা হাজির হতে হবে একটা নোংরা জামা পরে। এটুকু ছাড়া তার ট্রাংক হারানোর তেমন ভয়ংকর কিছু ঘটে যায়নি, কারণ যে সুটটা সে এখনো পরে আছে সেটা ট্রাংকেরটার চেয়ে সত্যি অনেক ভালো। ট্রাংকে রাখা সুটটা আসলে একটা বাড়তি সুট, শুধু জরুরি কোনো দরকারেই পরার জন্য, আর এমনকি সে রওনা হওয়ার আগে তার মাকে ওটাতে ঝটপট কিছু তালিপট্টিও দিতে হয়েছিল। এ সময় তার মনে পড়ল ট্রাংকে একটু ভেরোনিজ সালামিও রয়ে গেছে, তার মা এটা দিয়েছিলেন বিশেষ বাড়তি খাবার হিসেবে, কিন্তু সে শুধু একটুখানিকই খেয়েছে ওটা, সাগরে থাকতে তার খিদে একদম চলে গিয়েছিল, আর জাহাজের সবচেয়ে নিচের ক্লাসের যাত্রীদের যে স্যুপ দেওয়া হতো তাতেই তার ভালোমতো চলে যেত। তবে এখন সালামিটা পেলে সত্যি মন্দ হতো না, স্টোকারকে দিতে পারত সে ওটা। এইরকম লোকদের সামান্য জিনিস উপহার নিয়েও যে কত সহজে মন জয় করা যায়, তা কার্ল শিখেছে তার বাবার কাছ থেকে। তিনি যাদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন এমন নিম্নপদস্থ সব কর্মচারীর মন কীভাবে জয় করে ফেলতেন সামান্য সিগার উপহার দিয়েই। এখন কার্লের দেওয়ার মতো আছে শুধু তার টাকাটাই, আর যদি তার ট্রাংক সত্যিই খোয়া গিয়ে থাকে, তাহলে আপাতত ওতে হাত দেওয়া ঠিক হবে না। আবার তার চিন্তা চলে গেল ট্রাংকটার দিকে, এখন সে সত্যিই বুঝতে পারছে না কেন সে সমুদ্রযাত্রার পুরোটা সময় অমন করে ট্রাংক পাহারা দিয়ে এসেছে (ওটার চিন্তায় বলতে গেলে তার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল), আর তাহলে এখন কেন অত সহজেই ওটা হারিয়ে যেতে দিচ্ছে। তার মনে পড়ল পাঁচ রাত কীভাবে সে সারাক্ষণ এক ছোট স্লোভাক ছেলেকে, যে তার বায়ে দুই বার্থ দূরে ঘুমাত, সন্দেহ করেছে ট্রাংকটা হাতিয়ে নেওয়ার মতলব আঁটছে বলে। এই স্লোভাকটা স্রেফ অপেক্ষা করত কখন কার্ল ক্লান্তির চোটে শেষমেশ এক মুহূর্তের জন্য একটু ঘুমিয়ে পড়বে, যেন তখন সে তার লম্বা লাঠিটা দিয়ে (যেটা নিয়ে সে দিনের বেলায় সারাক্ষণ খেলত কিংবা প্র্যাকটিস করত) ট্রাংকটা নিজের কাছে টেনে নিতে পারে । দিন হলেই এই স্লোভাক একটা গোবেচারা চেহারা বানাত, কিন্তু রাত নামামাত্র একটু পর পর সে উঠে বসত তার বার্থে আর কার্লের ট্রাংকটার দিকে ঠারেঠোরে তাকাত কেমন বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। কার্ল এ সবকিছু দেখতে পেত পরিষ্কার, কারণ সব সময়ই এখানে ওখানে কেউ-না-কেউ থাকত যে কি না ইমিগ্র্যান্টের অস্থিরতা নিয়ে জ্বালিয়ে রাখত কোনো ছোট বাতি (জাহাজের নিয়মকানুনে এটা করা মানা) আর ইমিগ্রেশন এজেন্সিগুলোর দুর্বোধ্য সব পুস্তিকার মানে বোঝার চেষ্টা চালাত। ওরকম কোনো বাতি যদি কার্লের কাছাকাছি কোথাও জ্বলত, তাহলে কার্ল একটুখানি ঘুমিয়ে নিতে পারত, কিন্তু সেটা যদি থাকত দূরে কিংবা সবকিছু যদি থাকত অন্ধকার, তাহলে তাকে চেখে খুলে রাখতে হতো। এই কাজটার চাপে কার্ল পুরোপুরি শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল, আর এখন মনে হচ্ছে ঐ সব কষ্ট ফাও গেছে। ওহ, আবার যদি কোথাও কোনো দিন ঐ বাটারবমের সঙ্গে তার একটু দেখা হতো!

    সেই সময় কেবিনের বাইরের নীরবতা, এতক্ষণ পর্যন্ত পুরো নীরবই ছিল সব, ভেঙে গেল দূর থেকে আসা অনেক শব্দে– বাচ্চাদের পায়ের টোকার মতো পরপর ছোট, তীক্ষ্ণ তালের টোকা; ওগুলো কাছে চলে এসেছে, নিয়মিত গতিতে বেড়েই চলেছে, অবশেষে শোনাল কুচকাওয়াজ করা লোকেদের শান্ত চলার শব্দের মতো। স্পষ্টত তারা এক লাইনে এগোচ্ছে, সরু গ্যাংওয়েতে অবশ্য এ ছাড়া কোনো উপায়ও নেই, আর মনে হলো অস্ত্রের ঠুনঠানের মতো আওয়াজ শোনা গেল। কার্ল তার ট্রাংক আর স্লোভাকদের নিয়ে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বিছানায় টান টান হয়ে ঘুমে ঢলে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে মাত্র, চমকে উঠে বসল আর স্টোকারকে কনুই দিয়ে গুতো মারল জলদি সজাগ করার জন্য, কারণ দলটার মাথার দিক মনে হচ্ছে ঠিক তাদের দরজায় পৌঁছে গেছে। জাহাজের বাদক দল এরা,’ বললেন স্টোকার, ‘এ কদিন ডেকের উপর বাজিয়েছে আর এখন বাঁধাছাদা করতে চলে যাচ্ছে। সব এখন শেষ, আমরা যেতে পারি। আসো! তিনি কার্লের হাত ধরলেন, বাংকের উপরে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছোট ফ্রেমে বাধা ম্যাডোনার ছবি শেষ মুহূর্তে খুলে নিলেন, বুকের পকেটে ভরলেন সেটা, তারপর তার সুটকেস তুললেন, আর তিনি ও কার্ল তড়িঘড়ি কেবিন থেকে বের হলেন।

    ‘এখন আমি অফিসে যাব আর বত্সদের আমার মনে যা আছে সব একটু ঝাড়ব। যাত্রীরা সব চলে গেছে, এখন আর বলতে বাধা নেই। এই কথাটাই স্টোকার একটু এদিক-সেদিক করে বারবার বলতে লাগলেন, আর হাঁটতে হাঁটতে এক পা পাশে বাড়িয়ে চেষ্টা করলেন তাদের পথের উপর দিয়ে দৌড়ানো একটা ইঁদুরকে থেঁতলে দেওয়ার, কিন্তু এতে করে ইঁদুরটা স্রেফ বরং আরো জোরে ছুট লাগাল ওর গর্তের ভেতরে, একদম ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। তা ছাড়া, লোকটা চলছেও বেশ ধীরে, তার পা দুটো লম্বা হলেও ঠিক ও কারণেই শরীরের আকার হিসেবে অসুবিধাজনক।

    তারা পার হলেন রান্নাঘরের একটা অংশ দিয়ে –ওখানে নোংরা অ্যাপ্রন-পরা বেশ কয়েকটা মেয়ে– অ্যাপ্রনগুলো ভেজাচ্ছে ইচ্ছা করেই– থালাবাসন ধুচ্ছে বড় বড় গামলায়। স্টোকার লাইন নামের একটা মেয়েকে ডাকলেন নিজের কাছে, মেয়েটার হকোমরের নিচে বেড় দিয়ে একটা হাত রাখলেন, আর ওকে টেনে সঙ্গে নিয়ে গেলেন একটু দূরে, পুরোটা সময় মেয়েটা ফাজিল একটা ঢঙে শরীর চেপে রেখেছে স্টোকারের বাহুতে। ‘আজ তো মজুরি পাওয়ার দিন, আসবে নাকি সাথে? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কষ্ট করার কী দরকার? তুমি নিয়ে আসো না আমার টাকাটা,’ মেয়েটা তার হাতের ফাঁক গলে দৌড়ে পালানোর সময় বলল। সুন্দর ছেলেটা পেলে কোথায়?’ পেছন থেকে চিৎকার করল সে, কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না। সবগুলো মেয়ে একসঙ্গে ফেটে পড়ল হাসিতে, ওরা তাদের কাজ থামিয়ে দিয়েছে।

    কিন্তু কার্ল আর স্টোকার চলতে লাগল। ওরা এসে হাজির হলো একটা দরজার সামনে, দরজার মাথাটা ত্রিকোণ গঠনের, আর সেটাকে ধরে রেখেছে ছোট গিল্টি করা কিছু নারীমূর্তি। কোনো জাহাজের ফিটিং হিসেবে নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি অপচয়। কার্ল বুঝতে পারল জাহাজের এই অংশে সে আগে কখনো পা রাখেনি; সম্ভবত এত দিন সমুদ্রে এটা ছিল প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত জায়গা, কিন্তু জাহাজটার মহা ধোয়াধুয়ির ঠিক আগে এখন মনে হয় পার্টিশনগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আসলেও ওদের দেখা হয়েছে কাঁধে ঝাড় নিয়ে হাঁটা কিছু লোকের সঙ্গে, স্টোকারকে সম্ভাষণ জানিয়েছে ওরা। এত নানা রকমের কাজকর্ম দেখে অবাক হয়ে গেল কার্ল, নিচে থাকতে এর কিছুই সে প্রায় টের পায়নি। এ ছাড়া গ্যাংওয়ে ধরে লাগিয়ে রাখা হয়েছে বিদ্যুতের তার, একটা ছোট ঘণ্টা বাজছে অবিরাম।

    সম্মানের সঙ্গে একটা দরজায় টোকা দিলেন স্টোকার, আর যখন কেউ একজন বলে উঠল, ‘ভেতরে আসো!’ তিনি কার্লকে হাত নেড়ে বোঝালেন, যেন ভেতরে ঢুকতে সে ভয় না পায়। কার্ল ওভাবেই ঢুকল ভেতরে কিন্তু দরজা থেকে বেশি দূর আর এগোল না। কামরাটার তিনটে জানালার বাইরে সে দেখল সাগরের ঢেউ, ওগুলোর উজ্জ্বলতা দেখে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল আরো, যেন বা পাঁচ দিন ধরে সে বিরামহীন তাকিয়ে তাকিয়ে সমুদ্র দেখেনি। বড় বড় জাহাজগুলো একটা আরেকটার পথে কাটাকুটি করে যাচ্ছে, উঁচু হয়ে আসা ঢেউয়ের সামনে হার মানছে যার যার ওজন মেনেই। চোখ আধবোজা করে দেখলে মনে হচ্ছে জাহাজগুলো নিজেদের মালের ভারে যেন টলমল করে চলেছে। ওগুলোর মাস্তুলের মাথায় উড়ছে লম্বা কিন্তু সরু কিছু পতাকা, জাহাজের চলার কারণে শক্ত টান টান হলেও কিছুটা পতপত করছে সামনে-পেছনে। তোপধ্বনি শোনা গেল, মনে হয় কোনো যুদ্ধজাহাজ থেকে আসছে; ওরকম একটা জাহাজ চলে গেল একদম কাছ দিয়ে, ওটার কামানের নলে ইস্পাতের বর্মের উপর সূর্যের আলো পড়ে জ্বলছে, মনে হচ্ছে নলগুলো যেন আদর-সোহাগ পাচ্ছে জাহাজটার ঢেউয়ের উপর সোজা, মসৃণ কিন্তু দোল-খেয়ে-চলা থেকে। আকারে ছোট জাহাজ ও নৌকাগুলো, অন্তত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, দেখতে লাগছে ওরা আছে বহু দূরে, আর অবিরাম ঝাঁক বেঁধে চলছে বড় জাহাজগুলোর ফাঁকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে দাঁড়িয়ে নিউ ইয়র্ক শহর, এর আকাশছোঁয়া দালানগুলোর লাখো জানালা নিয়ে তাকিয়ে আছে কালের দিকে। হু, এই কামরায় বোঝা যায় আপনি আছেন কোথায়।

    একটা গোল টেবিলে তিন ভদ্রলোক বসে আছেন, এদের একজন জাহাজের অফিসার –পরনে জাহাজের নীল রঙের ইউনিফর্ম, অন্য দুই অফিসার এসেছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে, তাদের গায়ে কালো আমেরিকান ইউনিফর্ম। টেবিলের উপর নানা ডকুমেন্ট রাখা বিরাট গাদা করে, জাহাজের অফিসার ওগুলোতে প্রথমে চোখ বোলালেন হাতে একটা কলম নিয়ে, তারপর এগিয়ে দিলেন অন্য দুজনের দিকে, ওনারা এবার পড়ছেন ওগুলো, এবার ওখান থেকে তুলে নিচ্ছেন বিশেষ বিশেষ অংশ, এবার ওগুলো ভরে নিচ্ছেন যার যার ব্রিকফেসে– শুধু ব্যতিক্রম যখন কিনা এ দু’জনের একজন (যিনি সমানে দাঁত দিয়ে সূক্ষ্ম আওয়াজ করে যাচ্ছেন) তার সহকর্মীকে লেখার জন্য বয়ান করছেন কোনোকিছু।

    জানালার কাছের একটা ডেস্কে আকারে ছোট এক ভদ্রলোক বসে আছেন পিঠ দরজার দিকে দিয়ে, তিনি ব্যস্ত প্রকাণ্ড সব লেজার খাতা নিয়ে, এক সারিতে ওগুলো তার সামনে রাখা মাথাসমান উঁচু একটা বেশ মজবুত বইয়ের তাকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা খোলা ক্যাশ বাক্স, যেটা –অন্তত প্রথম দেখায়– মনে হচ্ছে শূন্য।

    দ্বিতীয় জানালাটার কাছে কোনোকিছু নেই, ওটা থেকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখা যাচ্ছে বাইরে। কিন্তু তৃতীয় জানালার ওখানে দাঁড়িয়ে দুই ভদ্রলোক, কথা বলছেন, নিচুগলায়। এদের একজন জানালার পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো, তারও পরনে জাহাজের ইউনিফর্ম, খেলছেন তার তরবারির হাতলটা নিয়ে। তিনি যার সঙ্গে কথা বলছেন সেই ভদ্রলোক জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়ানো, আর মাঝেমধ্যে যেই তিনি নড়ছেন, অন্য মানুষটার বুকে সারি করে লাগানো ডেকোরেশন রিবনগুলোর খানিকটা চোখে পড়ছে। এই পরের জন পরে আছে সিভিলিয়ান পোশাক, তার হাতে একটা পাতলা ছোট বাঁশের ছড়ি যেটাও (তার দুই হাত ওভাবে কোমরের কাছটায় রাখার কারণে) কিনা বের হয়ে আছে তরবারির মতো।

    এসব দেখার বেশি সময় কার্ল পেল না, কারণ একটু পরেই একজন পরিচারক এসে হাজির হলো তাদের সামনে আর স্টোকারের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন স্টোকারের এখানে কোনো কাজ নেই। জিজ্ঞাসা করল, সে এখানে কী চাচ্ছে। স্টোকার উত্তর দিলেন, যে রকম নরম গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সেই একই রকম গলায় যে জাহাজের বেতনভাতা ও ভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত চিফ পার্সারের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। পরিচারক হাত নেড়ে এই অনুরোধে নিজের অসম্মতি জানিয়েও পা টিপে, গোলটেবিলটা এড়াতে ওটার চারপাশে বিরাট বৃত্ত বানিয়ে, হেঁটে গেল বিরাট লেজারখাতাগুলো নিয়ে ব্যস্ত ভদ্রলোকের কাছে। এই ভদ্রলোক –পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে– পরিচারকের কথা শুনে জমে বরফ হয়ে গেলেন, কিন্তু শেষে ঘুরে তাকালেন সেই লোকের দিকে যে তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, আর তারপর ভয়ংকর অঙ্গভঙ্গি করে স্টোকারকে (সেই সঙ্গে কোনো ঝুঁকি না-নেওয়ার জন্য পরিচারককেও) ইশারা দিতে লাগলেন সোজা বিদায় হওয়ার। তখন পরিচারক ফিরে এল স্টোকারের কাছে, আর যেন বা গোপন কোনো বার্তা তাকে বলছে সেরকম গলায় বলল: এই কামরা থেকে এক্ষুনি ভাগো!’

    এই কথা শুনে স্টোকার মাথা নিচু করে কার্লের দিকে তাকালেন, মনে হচ্ছে কার্ল যেন তার প্রেয়সী যার কাছে তিনি নীরবে তার দুঃখের কথা জানাচ্ছেন। আর অন্য কিছু না ভেবেই কার্ল ছুটে গেল সোজা কামরাটার উল্টো পাশে, এমনকি একটু ঘষাও খেল অফিসারের চেয়ারের সঙ্গে; পরিচারক দৌড়াল তার পিছু পিছু, নিচু হয়ে, দুই হাত বাড়িয়ে। তৈরি তাকে ধরার জন্য, মনে হচ্ছে সে যেন কোন একটা বড় পোকামাকড় ধরছে; কিন্তু চিফ পার্লারের ডেস্কে কার্লই পৌঁছাল প্রথমে, ডেস্কটা আঁকড়ে থাকল যেন পরিচারক তাকে টেনে বের করে দিতে না পারে।

    স্বাভাবিক যে পুরো কামরাটা তৎক্ষণাৎ সরগরম হয়ে উঠল। টেবিলে বসা জাহাজের অফিসার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন; বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসারেরা চুপচাপ কিন্তু মন দিয়ে দেখতে লাগলেন; জানালায় দাঁড়ানো দুই ভদ্রলোক এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেছেন; পরিচারক যখন দেখল এইসব উঁচু পদের আর ক্ষমতাশালী লোকজনও এখন ব্যাপারটায় আগ্রহ দেখাচ্ছে, সে বুঝল তার আর এখানে দরকার নেই, পিছপা হলো সে। দরজার কাছে স্টোকার চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সেই সময়ের জন্য, যখন তার সাহায্যের দরকার পড়বে। অবশেষে চিফ পার্সার ওনার হাতলওয়ালা চেয়ারে বো করে শরীরটা জোরে ঘোরালেন ডান দিকে।

    কার্ল তার গোপন পকেট হাতড়াতে লাগল, ওখানে কী আছে তা সবাইকে দেখাতে তার কোনো অস্বস্তি নেই। এরপর নিজের পরিচয় নিয়ে কিছু বলার বদলে সে তার পাসপোর্ট বের করে খুলে রাখল ডেস্কটাতে। চিফ পার্সার মনে হলো এই পাসপোর্টকে কোনো দামই দিলেন না, তিনি ওটা দু আঙুলে গুঁতো দিয়ে সরিয়ে দিলেন, এরপরই কার্ল (যেন এই অনুষ্ঠানিকতাটুকু ভালোভাবে শেষ হয়ে গেছে) ওটা আবার ঢুকিয়ে রাখল পকেটে।

    ‘আমাকে যদি একটু বলার অনুমতি দেন, এরপর শুরু করল সে, “আমার মতে এই স্টোকার ভদ্রলোকের ওপরে অন্যায় করা হয়েছে। জাহাজে শুবাল নামের এক লোক আছে যে ওনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। এই স্টোকার অনেক জাহাজে কাজ করেছেন, সবগুলোর নাম ওনার মুখস্থ, আর সবগুলোতেই ওনার কাজে সবাই পুরো সন্তুষ্ট ছিল; অনেক পরিশ্রমী মানুষ তিনি, খুব নিষ্ঠার সঙ্গে নেন নিজের কাজটুকু, তাই আমি বুঝতেই পারি না কেন স্রেফ এই জাহাজে, যেখানে পালতোলা জাহাজগুলোর মতো তেমন বিরাট কোনো খাটাখাটনির কাজ নেই, তিনি ঠিকভাবে নিজের কাজ সামলাতে পারবেন না। তার মানে, অন্য কিছু নয়, স্রেফ মিথ্যা বদনামের কারণেই ওনার উন্নতি হচ্ছে না, এই মিথ্যা অপবাদ ওনার নিশ্চিত প্রাপ্য সুনামটুকু কেড়ে নিচ্ছে। আমি শুধু বিষয়টার ওপর একটু সাধারণ আলোকপাত করলাম; এবার উনি নিজে ওনার অভিযোগগুলো আপনাদের খুলে বলবেন।’ কার্ল তার ভাষণটা দিল এখানে উপস্থিত সব কজন ভদ্রলোকের উদ্দেশে, কারণ সবাই আসলে তার কথা শুনছিলেন আর কার্লের কাছে এটাও মনে হলো যে এখানে অন্তত একজন তো ন্যায়পরায়ণ লোক থাকবেন আর একা চিফ পার্সারই সেই ন্যায়পরায়ণ লোক হওয়ার বদলে এতগুলো লোকের মধ্যে কোন একজনের সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেই সঙ্গে চালাকি করে কার্ল এই সত্য গোপন করল যে স্টোকারের সাথে তার পরিচয় হয়েছে মাত্র কিছু আগে। তবে তার ভাষণ আরো অনেক ভালো হতো যদি ছোট বাঁশের ছড়িওয়ালা ভদ্রলোকের (ছড়িটা আসলেও তার এখনকার জায়গা থেকেই প্রথমবারের মতো তার চোখে পড়ল) লাল মুখটা তার মনোযোগ নষ্ট না করত।

    ‘সব সত্যি কথা, প্রত্যেকটা শব্দ,’ বললেন স্টোকার, কেউ তাকে তখনো কিছু জিজ্ঞাসা করেনি কিংবা তার দিকে তাকায়ওনি। স্টোকারের এই অতিরিক্ত তড়িঘড়ি মারাত্মক কোনো সর্বনাশই ডেকে আনত যদি-না ডেকোরেশন রিবন লাগানো ভদ্রলোক – কার্ল এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে উনিই আসলে এই জাহাজের ক্যাপ্টেন– এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত না নিয়ে ফেলতেন যে তিনি স্টোকারের কথা শুনবেন। তিনি তার হাত বাড়ালেন আর স্টোকারকে ডাকলেন: এখানে আসো!’ তার গলা এমন কঠিন যে মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়েও বাড়ি মারা যাবে। তবে এখন সবকিছু নির্ভর করছে স্টোকারের আচরণের ওপর, যদিও তার কেস্টার ন্যায়বিচার পাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কার্লের কোনোই সন্দেহ নেই।

    সৌভাগ্য বলতে হয়, এ সময় পরিষ্কার হয়ে উঠল যে স্টোকার পৃথিবীর নানা ঘাট দেখা অভিজ্ঞ একজন মানুষ। ব্যতিক্রমী এক শান্ত ভঙ্গিমায় তিনি তার ছোট সুটকেসে হাত ঢুকিয়ে, যা খুঁজছিলেন তা প্রথমবারেই খুঁজে পেয়ে, এক তোড়া কাগজ বের করে আনলেন, সেই সঙ্গে একটা নোট বই; তারপর তিনি পার্সারকে পুরো উপেক্ষা করে (যেন এটাই পরিষ্কার তার যাওয়ার রাস্তা) ওগুলো নিয়ে পৌঁছালেন ক্যাপ্টেনের কাছে আর জানালার চৌকাঠের উপর বিছিয়ে রাখলেন তার তথ্য-প্রমাণ। চিফ পার্লারের আর কোনো উপায় থাকল না ঐ দুজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া। নালিশ জানানোর ব্যাপারে এই লোকের বিরাট কুখ্যাতি রয়েছে, ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলতে লাগলেন তিনি, ‘ইঞ্জিন রুমে যতক্ষণ না থাকে তার চেয়ে বেশি সময় সে থাকে আমার অফিসে। ওর কারণে শুবালের, এমনিতে কত শান্ত মানুষ সে, প্রায় মাথা বিগড়ে যাওয়ার দশা। এখন তুমি শোনো!’– এ সময় তিনি ঘুরলেন স্টোকারের দিকে –এই দফায় তুমি তোমার ধৃষ্টতার চূড়ান্ত করে ছাড়ছ। মজুরি রুম থেকে বলো এরই মধ্যে কতবার একেবারে উচিত কারণে তোমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে তোমার ঐসব পুরোপুরি, সম্পূর্ণ আর সব সময়ই অযৌক্তিক দাবিদাওয়াগুলোর জন্য? তখন কতবার বলো তুমি দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছ এই পার্লারের অফিসে? কতবার বলো তোমাকে ভদ্রভাবে বলা হয়েছে যে শুবালই তোমার ঊর্ধ্বতন বস্, আর স্রেফ তাকেই, স্রেফ তাকেই খুশি করে কাজ করতে হবে তোমার? আর তুমি এখন। সোজা একেবারে ক্যাপ্টেনের এখানে এসে হাজির, এমনকি নির্লজ্জের মতো জ্বালাচ্ছ ওনাকে, আর কত বড় সাহস যে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ এই বাচ্চা ছোঁড়াকে, ওকে শিখিয়ে-পড়িয়ে এনেছ তোমার ফালতু নালিশগুলো বলার মুখপাত্র বানিয়ে –ঐ ছোঁড়াকে আমি তো এর আগে জাহাজে দেখিইনি কখনো।

    বেশ কষ্টে কার্ল নিজেকে সামলাল সামনে লাফিয়ে পড়া থেকে। কিন্তু এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন হস্তক্ষেপ করে বসেছেন এই কথা বলে: ‘লোকটা কী বলে আমরা শুনব। শুবাল আসলেই আমার চাওয়ার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করা শুরু করেছে, যদিও এই কথা বলে আমি তোমার পক্ষে বলছি না কিছু। এই শেষ কথাটা স্টোকারকে উদ্দেশ করে বলা হলো; খুব স্বাভাবিক যে তিনি হঠাৎ একবারেই তার পক্ষে চলে যেতে পারেন না, কিন্তু মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক পথেই আগাচ্ছে। স্টোকার শুরু করলেন তার কথা, অনেক নারাজির সঙ্গে শুবালকে ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করলেন তিনি। চিফ পার্সারের খালি ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে কার্লের কী আনন্দই না হচ্ছিল, স্রেফ মজা করতেই সে বারবার চিঠির ওজন মাপার যন্ত্রটা চাপ দিতে লাগল।– শুবাল সাহেব পক্ষপাতদুষ্ট! শুবাল সাহেব বিদেশিদের পক্ষ নিয়ে চলেন! শুবাল সাহেব স্টোকারকে ইঞ্জিনরুম থেকে বের করে দিয়েছেন, তাঁকে দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করিয়েছেন, নিঃসন্দেহে স্টোকারের কাজ নয় তা! –একবার এমনকি শুবাল সাহেবের কাজ পারা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলো, বলা হলো তার কর্মদক্ষতা যতটুকু না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি বাহ্যিক । এ সময় কার্ল একাগ্র চোখে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে, এমন এক বিশ্বাসের ভঙ্গি নিয়ে যে উনি যেন তার সহকর্মী –কার্ল চাচ্ছে স্টোকারের এই কিছুটা আনাড়ির মতো কথা বলার কারণে ক্যাপ্টেন যেন আবার তার বিপক্ষে চলে না যান। কিন্তু সবকিছুর পরেও এটাই সত্যি যে কোনো নির্দিষ্ট কিছু পাওয়া গেল না তার এই এক ঝুড়ি কথার মধ্যে থেকে, আর যদিও ক্যাপ্টেন এখনো একঠায় তাকিয়ে আছেন সামনে (তার দুচোখে সংকল্প যে এই দফায় তিনি স্টোকারের কথা একদম শেষ পর্যন্ত শুনেই ছাড়বেন), অন্য ভদ্রলোকেরা এরই মধ্যে অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলেন, আর এটা খুব অলক্ষুনে ব্যাপার যে একটু বাদেই কামরাটাতে স্টোকারের গলার সেই ভরাট রাজত্ব আর থাকল না। প্রথমে সিভিলিয়ান পোশাক-পরা ভদ্রলোক তার বাঁশের ছড়ি নিয়ে খেলা শুরু করলেন, নকশা করা কাঠের মেঝেটাতে টোকা দিতে লাগলেন মৃদুভাবে। স্বভাবতই অন্য ভদ্রলোকেরা মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছেন ওনার দিকে; বন্দর-কর্তৃপক্ষ থেকে আসা লোক দুজন, তাদের পরিষ্কার অনেক তাড়া, আবার দেখতে শুরু করলেন কাগজপত্র, কিছুটা অন্যমনস্কভাবে তারা ওল্টাতে লাগলেন ওগুলো; জাহাজের অফিসার আবার তার টেবিলটার কাছে ফিরে গেলেন, আর চিফ পার্সার, বুঝে গেছেন যে তিনি একরকম জিতেই গেছেন, একটা শ্লেষভরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। একমাত্র পরিচারক ছাড়া আর সবার মধ্যেই এই মনোযোগ হারানোর ব্যাপারটা দেখা গেল; বড় ও ক্ষমতাবান লোকজনের বুড়ো আঙুলের নিচে গরিবের কী হাল হয় সে ব্যাপারে একটু হলেও তার সমবেদনা আছে– সে কালের দিকে একনিষ্ঠ তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে যেন তার বলার আছে কিছু।

    ইতোমধ্যে জানালার বাইরে বন্দরের জীবন বয়ে চলেছে নিজের গতিতে; পাহাড়সমান উঁচু ড্রামের গাদা নিয়ে একটা মালবাহী জাহাজ ধীরে চলে গেল পাশ দিয়ে, ড্রামগুলো নিশ্চয়ই খুব চমৎকার করে বাঁধা, যে জন্য তারা গড়িয়ে পড়ছে না –ওটার কারণে এই কামরাটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এল; ছোট ছোট মোটরববাটগুলো, হাতে সময় থাকলে কার্ল যেগুলো আরো ভালো করে দেখতে পারত, পানির উপর দিয়ে সোজা তীরের মতো উড়ে চলেছে, স্টিয়ারিং হুইল ধরে খাড়া দাঁড়ানো মানুষগুলোর সামান্য ছোঁয়াও মেনে চলছে একদম; এখানে-ওখানে অদ্ভুত কিছু ভাসমান বস্তু নিজেদের খেয়ালখুশিমতো মাথা তুলছে অস্থির ঢেউয়ের ভেতর থেকে, আবার। তখুনি তার অবাক চোখের সামনে ডুব মারছে ওরা; সমুদ্রগামী জাহাজগুলো থেকে নৌকাভর্তি যাত্রী নিয়ে নাবিকেরা ঘামতে ঘামতে দাঁড় টানছে, যাত্রীরা চুপচাপ আর আশা নিয়ে বসে আছে সেই একই আসনে, যেখানে তাদের ঠেসে বসানো হয়েছে, যদিও এদের কেউ কেউ মাথা ঘুরিয়ে চারপাশের চলমান দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। বিরামহীন এক চলাচল, অস্থির শক্তির কাছ থেকে অস্থিরতা প্রবাহিত হয়ে চলেছে অসহায় মানবজাতি আর তাদের ক্রিয়াকর্মের মধ্যে!

    কিন্তু এখন যেখানে প্রয়োজন দ্রুত, স্পষ্ট আর সবচেয়ে নির্ভুল বর্ণনার, সেখানে স্টোকার করছেটা কী? কোনো সন্দেহ নেই সে সবকিছু একটা ফেনা বানিয়ে ফেলেছে আর তার হাত দুটো কিছুক্ষণ যাবৎ এমন কাঁপছে যে জানালার চৌকাঠের উপর কাগজগুলো ধরে রাখতেই তার কষ্ট হচ্ছে; কম্পাসের যতগুলো দিক আছে সবগুলো থেকে তার মাথায় এসে বন্যার মতো এসে জমা হচ্ছে শুবালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, তার হিসেবে এদের প্রতিটাই যথেষ্ট শুবালকে চিরদিনের মতো কবরে ঠুসে দিতে— কিন্তু বাস্তবে ক্যাপ্টেনের জন্য সে যা দাঁড় করাল তা সবকিছুর একটা করুণ জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছুই না। এখন বেশ কিছুটা সময় ধরে বাঁশের ছড়ি হাতে ভদ্রলোক ছাদের দিকে তাকিয়ে হালকা শিস বাজাচ্ছেন; বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসাররা জাহাজের অফিসারকে তাদের টেবিলে শেষমেশ ঠেসে ধরেছেন এবং মনে হচ্ছে না তাকে আর একবারও ওখান থেকে উঠতে দেবেন; চিফ পার্সারকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে শুধু ক্যাপ্টেনের শান্ত স্থির ভাবটার কারণেই তিনি ফেটে পড়া থেকে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন; পরিচারক দাঁড়িয়ে আছে সামরিক কায়দার ‘সাবধান’ ভঙ্গিতে, অপেক্ষা করছে তার ক্যাপ্টেন থেকে যেকোনো সময় স্টোকারের জন্য আদেশ আসার ।

    এ অবস্থায় এসে কার্ল আর নিষ্ক্রিয় থাকতে পারল না। সে, অতএব, আস্তে এগোল এই দলটার দিকে, মাথার মধ্যে খুব দ্রুত ভেবে নিচ্ছে কী করে কতটা সুনিপুণভাবে তাকে সামাল দিতে হবে পুরো পরিস্থিতি। সত্যিই, এখনই সময় তা করার; আর যদি সে সামান্য দেরিও করে, দেখা যাবে তাদের দুজনকেই ধরে বের করে দেওয়া হয়েছে এখান থেকে। ক্যাপ্টেন হয়তো বা আসলেই একজন ভালো মানুষ আর ছাড়া বিশেষ করে এখন (এমনটাই ভাবল কার্ল) তার হয়তো কোনো নির্দিষ্ট কারণ আছে নিজেকে ন্যায়পরায়ণ প্রভু হিসেবে দেখানোর, কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও তিনি তো অমন কোনো বাদ্যযন্ত্র না, যা আপনি ধুমধাম পেটাতেই থাকবেন যতক্ষণ না সেটা ভেঙেচুরে পড়ছে– তবে স্টোকার তাকে ঠিক ওরকম কিছুই ভেবে নিয়েছেন, যদিও মেনে নিচ্ছি, তা তার বুকের ভেতরের অপরিসীম ক্রোধের কারণেই।

    অতএব কার্ল স্টোকারকে বলল: আপনাকে কথাগুলো আরো সহজ করে বলতে হবে, আরো পরিষ্কারভাবে, আপনি এখন যেভাবে বলছেন তাতে ক্যাপ্টেন তো আপনার কথার সঠিক মূল্যায়ন করে উঠতে পারছেন না। আপনার কি মনে হয় ক্যাপ্টেন জাহাজের সব ইঞ্জিনিয়ার, সব ছেলেছোকরাকে নামে চেনেন, তাদের ডাকনামে চেনা তো বাদই দিন, আর তাই আপনাকে কার কথা বলছেন তা বোঝানোর জন্য স্রেফ এদের কারো একটা নাম বললেই হয়ে যাবে? আপনার নালিশগুলো একটু বাছাই করে নিন, সবচেয়ে দরকারিগুলো আগে বলুন আর বাকিগুলো তারপর গুরুত্ব বুঝে বুঝে একটার পর একটা, তাহলে দেখবেন আপনার হয়তো আর বেশিরভাগ নালিশই জানানোও লাগছে না। আপনি সব সময় আমাকে তো কত পরিষ্কারভাবে বলেছেন কথাগুলো!’ আমেরিকায় যদি কেউ ট্রাংক চুরি করতে পারে তো তাহলে মাঝে মধ্যে একটু গুল মারলে কিছু যায় আসে না, অজুহাতের মতো করে নিজেকে বোঝাল সে।

    আহ্ শুধু যদি এতেই হয়ে যেত সব! নাকি এরই মধ্যে আসলে অনেক দেরি হয়ে গেছে? স্টোকার এই পরিচিত কণ্ঠ শোনামাত্র আসলেই থামিয়ে দিলেন তার কথা, কিন্তু তার দুচোখ আত্ম-অহমিকার আঘাতে আঘাতে, ভয়ংকর সব স্মৃতির তাড়নায় আর তার এখনকার চূড়ান্ত রকম দুঃখ-বেদনা মিলে অশ্রুর ভারে এতই অন্ধ হয়ে গেছে যে তিনি কার্লকে প্রায় আর চিনতেই পারছেন না। কিন্তু কীভাবে– কার্লের মাথায় এল চিন্তাটা, সে এখন নীরব হয়ে গেছে একই রকম নীরব স্টোকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে –কিন্তু কীভাবে এখন তিনি হঠাৎ করে তার কথা বলার ভঙ্গি বদলে ফেলবেন, বিশেষ করে যখন তিনি বিশ্বাস করেন যে শ্রোতাদের কাছ থেকে সামান্যতম সাড়া না পেয়েও তার যা-যা বলার ছিল সবই তিনি এরই মধ্যে বলে ফেলেছেন, আর অন্যদিকে এটাও মনে করছেন যে এখনো তার কথা শুরুই হয়নি, তবে এই ভদ্রলোকেরা পুরো জিনিসটা আবার যে একদম শুরু থেকে শুনবেন সে আশা প্রায় দুরাশাই। আর ঠিক এ রকম একটা সময় কিনা কার্ল, তার একমাত্র মিত্র, এসে হাজির, আর তাকে ভালো ভালো উপদেশ ঝাড়তে ঝাড়তে বরং দেখিয়ে দিচ্ছে যে, হ্যাঁ, সবকিছুর একদম গুড়ে বালি।

    ‘আহ্ আমি যদি জানালার বাইরে না-তাকিয়ে থেকে আরেকটু আগে এগিয়ে আসতাম, মনে মনে বলল কার্ল এবং স্টোকারের সামনে মাথা নিচু করে সে তার শরীরের দুই পাশে ট্রাউজারের সেলাইতে চাপড় মারতে লাগল –এটা সংকেত যে সব আশা শেষ ।

    কিন্তু স্টোকার ভুল বুঝলেন এটা, কার্লের ব্যবহারে তিনি সম্ভবত তার প্রতি কোনো গোপন তিরস্কার ঝাড়ার গন্ধ পেয়েছেন, কার্লের ধারণা বদলাবার সৎ ইচ্ছা থেকে তিনি এবার এগিয়ে গেলেন নিজের অপকর্মের মাথায় মুকুট পরাতে– কার্লের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। এটা করার আর সময় পেলেন না তিনি, এখনই করতে হলো যখন কিনা গোলটেবিলে বসা ভদ্রলোকেরা বহু আগেই মেজাজ হারিয়ে বসেছেন এই অনর্থক বকবকানি শুনে শুনে, যা তাদের দরকারি কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, যখন চিফ পার্সার একটু একটু করে আর বুঝে উঠতে পারছেন না ক্যাপ্টেনের ধৈর্যের বিষয়টা, মনে হচ্ছে হুমকি দিচ্ছেন যেকোনো সময় রাগে ফেটে পড়ার, যখন পরিচারক বেচারা (তার প্রভুদের জগতে আবার পুরোপুরি নিজেকে বসিয়ে নিয়েছে সে) স্টোকারকে মাপছে বুনো চোখে তাকিয়ে, এবং যখন শেষমেশ বাঁশের ছড়িঅলা ভদ্রলোক (ক্যাপ্টেন নিজে যার দিকে বন্ধুত্বের চোখে তাকাচ্ছেন মাঝে মধ্যে) স্টোকারের প্রতি পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে আর সত্যি বলতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একটা ছোট নোটবই বের করেছেন আর শুরু করেছেন (তার মন নিঃসন্দেহে অন্য কিছুর মধ্যে) একবার নোট বই আরেকবার কার্লের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে বেড়াতে।

    ‘হ্যাঁ আমি জানি, আমি জানি,’ বলল কার্ল, তার কষ্ট হচ্ছে স্টোকার তাকে মুষলধারে যা বলে যাচ্ছে তা সহ্য করে যেতে, তবু ঝগড়ার চূড়ান্ত মুহূর্তেও সে কোনোমতে বন্ধুত্বের একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে দিল ঠিকই, আপনার কথাই ঠিক, আপনার কথাই যে ঠিক, আমার তা নিয়ে কখনোই সন্দেহ হয়নি।’ কার্লের ভয় হচ্ছিল স্টোকারের সামনে পেছনে সমানে নড়তে থাকা হাত হয়তো তাকে ঘুষিই মেরে বসবে, তাই হয়তো তার মন চাইছিল ও দুটো ধরে বসার, কিন্তু তার থেকেও বেশি সে চাইছিল স্টোকারকে ঠেলে এককোনায় নিয়ে যাবে, কানে কানে কিছু শান্ত করার মতো কথা বলবে, এমন কথা যা অন্য কারো শোনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্টোকার আর নিজের মধ্যে নেই। কার্লের এমনকি এটা ভেবে একটু সান্ত্বনাও মিলল যে ওনার এই মহা বেপরোয়া অবস্থার শক্তি দিয়ে উনি এই সাত ভদ্রলোককে একদম ভ্যাবাচ্যাকাও খাইয়ে দিতে পারেন। যা-ই হোক না কেন, ডেস্কের দিকে চটজলদি একটু তাকালেই তো দেখা যাচ্ছে অনেক পুশ-বাটনওয়ালা একটা প্যানেল পড়ে আছে, ওগুলো লাগানো বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে; ওটার উপর হাত দিয়ে একটামাত্র চাপ দিলেই তো পুরো জাহাজ আর এর সব গ্যাংওয়ে ভরা শত্রুভাবাপন্ন মানুষজন, সবাই সোজা ঝাঁপিয়ে পড়বে বিদ্রোহে।

    এ সময় বাঁশের ছড়িওয়ালা ভদ্রলোক, এতক্ষণ যিনি কোনো আগ্রহই দেখাননি, কার্লের কাছে এলেন, আর অত জোরে না তবে স্টোকারের চিৎকার ছাপিয়ে শোনার মতো জোরে জিজ্ঞাসা করলেন: “তোমার নামটা কী জানতে পারি আমি? ঠিক সে সময়, যেন ভদ্রলোকের এই কথাটার জন্য দরজার পেছনে কেউ ওঁত পেতে ছিল, একটা টোকা শোনা গেল। পরিচারক তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে, ক্যাপ্টেন হা-সূচক মাথা নাড়লেন। তা দেখে পরিচারক দরজার কাছে গিয়ে সেটা খুলে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝারি গড়নের এক লোক, পরনে একটা ফ্রক-কোট; তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে ঠিক ইঞ্জিনের কাজ করার জন্য মানানসই তিনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তা-ই– শুবাল। কার্ল যদি সবার চোখ দেখে এটা না-ও বুঝতে পারত যে এই লোকটাই শুবাল (সবার চোখেই সে দেখল একধরনের তৃপ্তি, ক্যাপ্টেনও তা থেকে বাদ যান না), তবু সে ঠিকই শেষমেশ, আতঙ্ক নিয়েই, তা বুঝতে পারত স্টোকারকে দেখেই –তিনি নিজের বাড়িয়ে রাখা দুহাতের মাথায় মুঠি দুটো এমন শক্তি দিয়ে পাকিয়ে রেখেছেন যে মনে হচ্ছে এই মুঠি পাকানোই তার অস্তিত্বের সবচেয়ে মৌলিক বিষয়, এর জন্য তিনি তার শরীরের সবটুকু প্রাণশক্তিও বিসর্জন দিতে রাজি। তার পুরো শক্তি, এমনকি যেটুকু শক্তির বলে তিনি সোজা দাঁড়িয়ে রয়েছেন তা-ও সব কেন্দ্রীভূত তার দুই মুঠোয়।

    তাহলে এই সেই শত্রু, তাকে তার জমকালো স্যুটে দেখাচ্ছে বেশ তাজা আর। প্রাণচঞ্চল, তার বগলে একটা হিসাবের খাতা সম্ভবত, এটাতে আছে স্টোকারের কাজের ও মজুরির হিসাব; তিনি লজ্জাহীনভাবে এটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন– সবগুলো মুখের দিকে পর পর তাকিয়ে– যে তার প্রথম লক্ষ্য এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মেজাজ মর্জি বোঝা। এমনিতেই এই সাত ভদ্রলোক নিশ্চয় আগে থেকেই তার বন্ধুমানুষ আর ক্যাপ্টেনের যদি তার ব্যাপারে আগে কিছুটা ভিন্নমত থেকেও থাকে –কিংবা তিনি হয়তো সেটার ভানই করেছিলেন শুধু –এখন স্টোকার তাকে এরকম জ্বালাতন করার পর মনে হয় আর তিনি শুবালের মধ্যে সামান্য দোষও দেখছেন না। স্টোকারের মতো একজন মানুষের জন্য কোনো শাস্তিই যথেষ্ট কঠিন নয়; সে হিসেবে শুবালকে যদি আগে কোনো কারণে ভর্ৎসনা করা যায় তা হচ্ছে তিনি কেন এত দিনেও স্টোকারের অবাধ্যতাকে যথেষ্ট বশে আনতে পারেননি, যে কারণে আজ স্টোকার ক্যাপ্টেনের সামনে হাজির হওয়ারও সাহস দেখাতে পারল।

    তা সত্ত্বেও এমন ভাবা অযৌক্তিক নয় যে স্টোকার আর শুবালের মধ্যেকার এই বিবাদ আরো উঁচু কোনো বিচারালয়ের মনে যে প্রতীতি জন্মত, মানুষের মনেও ঠিক একই হবে; কারণ শুবাল ছদ্মবেশে নিজের ধূর্ততা যতই লুকিয়ে রাখুক না কেন, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে চিরকাল সে সেটাই করে যেতে পারবে। তার চারিত্রিক শয়তানির মাত্র একটা ঝলক এই ভদ্রলোকগুলোর সামনে সব সাফ-সাফ তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট; কার্ল দেখে ছাড়বে। যেন তা-ই ঘটে। এরই মধ্যে সে এই মানুষগুলোর চাতুর্য, তাদের দুর্বলতা, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা মন-মেজাজ বিষয়ে একটা ধারণা পেয়েছে, সেদিক থেকে দেখলে এখানে। যে-সময়টা সে এতক্ষণ ব্যয় করেছে তা একেবারে বৃথা যায়নি। শুধু যদি স্টোকার আরেকটু শক্তভাবে দাঁড়াতে পারতেন, কিন্তু মনে হচ্ছে উনি লড়াই পুরো ছেড়ে দিয়েছেন। যদি কেউ তার সামনে শুবালকে একটু ধরে রাখত, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে তার হাতের মুঠি দিয়েই শুবালের ঘৃণ্য মাথাটা ফেড়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু ঐ সামান্য কটা পা সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সম্ভবত তার আর নেই। কেন তাহলে কার্ল আগে থেকেই দেখতে পেল না, যেটা কিনা সহজেই অনুমান করা সম্ভব ছিল –যে শুবাল শেষমেশ এখানে হাজির হবেই, নিজের ইচ্ছায় নাও যদি হয় তাহলে ক্যাপ্টেনের ডাকে? কেন সে এখানে একটা দরজা দেখে স্রেফ ঢুকে পড়ার বদলে (ঠিক যেটা তারা আসলেই করেছে একদম ক্ষমার অযোগ্য রকমের বিনা প্রস্তুতিতে) বরং আসার পথে স্টোকারের সঙ্গে যুদ্ধের একটা নিখুঁত পরিকল্পনা আলোচনা করে আসেনি? স্টোকার কি আদৌ কথা বলতে পারবেন, বলতে পারবেন হ্যাঁ বা না, যেমনটা তার বলা লাগবে জেরার মুখোমুখি পড়লে? সবকিছু ঠিকমতো চললে আশা করা যায় যে জেরা-পর্ব হবে। স্টোকার দাঁড়িয়ে থাকলেন ওখানে, পা দুটো ফাঁক করে, হাঁটু সামান্য নুইয়ে, মাথা অল্প তুলে, আর তার হাঁ-করা মুখ দিয়ে বাতাস ঢুকছে ও বেরোচ্ছে যেন নিজের শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো ফুসফুস আর তার ভেতরে নেই।

    অন্যদিকে কার্লের নিজেকে মনে হচ্ছে খুবই তেজিয়ান আর সজাগ, যেমনটা সম্ভবত কখনোই বাড়িতে মনে হয়নি তার। আহ্, শুধু যদি তার বাবা-মা তাকে দেখতে পারত এখন– একটা ভালো উদ্দেশ্যের জন্যে কোন বিদেশ-বিভুঁইয়ে, সম্মাননীয় সব লোকজনের সামনে এক লড়াইতে নেমেছে সে, যদিও এখনো বিজয়ী হয়নি, তবু চূড়ান্ত বিজয়ের পথে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। তার ব্যাপারে তারা কি মন বদলাবেন না? তাদের দুজনের মাঝখানে তাকে বসিয়ে কি তার প্রশংসা করবেন না? একবার, শুধু কি একবার তার এই গভীর অনুরক্তিতে ভরা চোখের দিকে তাকাবেন না? কী অনিশ্চিত সব প্রশ্ন আর এগুলো জিজ্ঞাসা করার জন্য কী অনুপুযুক্ত এক সময়!

    ‘আমি এখানে এসেছি, কারণ আমার বিশ্বাস, স্টোকার আমাকে একধরনের অসততার দায়ে দোষী করছে। রান্নাঘরের এক মেয়ে আমাকে বলেছে সে স্টোকারকে এখানে আসতে দেখেছে। ক্যাপ্টেন, স্যার, এবং আপনারা অন্য ভদ্রমহোদয় যারা আছেন, আমি আমার কাগজপত্র দিয়ে তার প্রতিটা অভিযোগ খণ্ডন করতে তৈরি আছি, আর যদি দরকার হয়, তাহলে অনেক নিরপেক্ষ ও সংস্কারমুক্ত সাক্ষীরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যারা তাদের বক্তব্য দেবে।’ এই হচ্ছে শুবালের কথা। নিঃসন্দেহে স্বচ্ছ পুরুষোচিত বক্তব্য, আর শ্রোতাদের চেহারায় যে পরিবর্তন এল তা দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন দীর্ঘক্ষণের মধ্যে এই প্রথম কোনো মানুষের কথা শুনলেন। তাই আর আশ্চর্য কী যে তারা ধরতেই পারলেন না এই সুন্দর বক্তব্যের মধ্যেও যে আসলে কতটা ফাঁক আছে। কেন ‘অসততা’কেই তার প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ হিসেবে তুলে ধরলেন তিনি? তার জাতীয়তাসংক্রান্ত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ‘অসততা’ বিষয়ে শুরু হয়েছিল, নাকি তা ছিল তার জাতীয়তাবিষয়ক কুসংস্কার নিয়ে? রান্নার ওখানের একটা মেয়ে স্টোকারকে

    এই অফিস আসতে দেখল আর তাতেই শুবাল সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন সবকিছু? তার। এই বুঝে ফেলার পেছনে কি আসলে নিজের অপরাধবোধই কাজ করেনি? আর তিনি একেবারে সাক্ষীদের ধরে নিয়ে হাজির করালেন, উপরন্তু এটাও বলে ফেললেন যে তারা নিরপেক্ষ ও সংস্কারমুক্ত? কী নির্লজ্জ নোংরা চালাকি, একদম নির্লজ্জ নোংরা চালাকি! আর এই ভদ্রলোকেরা তা সহ্য করে গেলেন, এমনকি এটা ওনারা সদাচরণ হিসেবে মেনেও নিলেন? কেন তিনি রান্নাঘরের মেয়েটার খবর দেওয়া আর তার এখানে আসার মধ্যে পরিষ্কার এতগুলো সময় ব্যয় হতে দিলেন? এর কি একটাই কারণ ছিল না যে স্টোকার এই ভদ্রলোকদের ধাপে ধাপে এতটাই ক্লান্ত করে ফেলুক, যেন তারা তাদের স্বচ্ছ বিচারবুদ্ধির (ওটাতেই তো শুবালের সবচেয়ে ভয়) পুরোটাই খুইয়ে বসেন? তিনি তো দরজার ওপাশে নিঃসন্দেহে লম্বা সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু টোকা কি স্রেফ তখনই দিলেন না যখন শুনলেন ঐ ভদ্রলোক একটা মামুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন, মানে যখন তার মনে যথেষ্ট আশা জাগল যে স্টোকার ব্যাটা খতম?

    সবই একদম পরিষ্কার, শুবাল না-বুঝেই সব পরিষ্কার করে দিয়েছেন সবার কাছে, কিন্তু ঐ ভদ্রলোকদের বোঝার সুবিধা করে দিতে সবকিছু একটু ভিন্ন ও আরো সাফ-সাফ তুলে ধরতে হবে ওনাদের সামনে। ওনাদের একেবারে নাড়িয়ে দিতে হবে। চলো তাহলে কার্ল, জলদি, সাক্ষীরা এসে পড়ার আর সবকিছু ডুবিয়ে দেওয়ার আগে তোমার হাতে যে কটা মিনিট আছে অন্তত তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করো।

    কিন্তু ঠিক ঐ মুহূর্তেই ক্যাপ্টেন হাত তুলে শুবালকে থামিয়ে দিলেন, তাতে করে শুবাল (যেহেতু তার বক্তব্য মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত করা হলো) চটজলদি পাশে সরে গেলেন আর বিড়বিড় করে আলাপ শুরু করলেন পরিচারকের সঙ্গে। পরিচারক শুরু থেকেই এঁটে আছে তার সঙ্গে। তাদের আলাপের মধ্যে তারা অনেকবার পাশে তাকাচ্ছেন স্টোকার ও কার্লের দিকে, আর খুবই জোরাল সব আকার-ইঙ্গিত করে যাচ্ছেন। শুবালকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি তার পরবর্তী মহাভাষণের জন্য মহড়া দিচ্ছেন।

    ‘মিস্টার জ্যাকব, আপনি কী যেন জানতে চাচ্ছিলেন এই কিশোর ছেলেটার কাছে? চুপচাপ এমন সময়ে ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলেন বাঁশের ছড়ি হাতে ভদ্রলোককে।

    ‘হ্যাঁ, তা ঠিক,’ বললেন ঐ লোক, তাকে দেখানো সৌজন্যটুকুর উত্তরে একটু মাথা নোয়ালেন। তারপর আবার তিনি কার্লকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নামটা কী, জানতে পারি?

    কার্ল ভাবল এই মহা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটায় সবচেয়ে বড় অবদান রাখার সোজা পথ হচ্ছে তার এই একগুয়ে প্রশ্নকর্তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পথের থেকে সরিয়ে দেওয়া, তাই অতি সংক্ষেপে উত্তর দিল সে, এমনকি পাসপোর্ট দেখিয়ে (ওটা তাকে খুঁজে পাওয়ার ঝক্কি সামলাতে হতো) নিজের পরিচয় দেওয়ার রীতিও না মেনে: কার্ল রসমান।

    ‘সত্যি, তাই! জ্যাকব নামের ভদ্রলোক বললেন, তারপর প্রথমে এক পা পেছালেন মুখে প্রায় অবিশ্বাসের এক হাসি নিয়ে। ক্যাপ্টেন, সেই সঙ্গে চিফ পার্সার, জাহাজের অফিসার, সত্যি বলতে এমনকি পরিচারকও– সবাই কার্লের নাম শুনে মহা বিস্ময়ের ভঙ্গি করলেন। একমাত্র বন্দর-কর্তৃপক্ষের অফিসার দুজন আর শুবাল কোনো। বিকার দেখালেন না।

    ‘সত্যি তাই! মিস্টার জ্যাকব আবার বললেন আর কিছুটা শক্ত হয়ে হেঁটে কার্লের কাছে গেলেন, তাহলে আমি তো তোমার মামা জ্যাকব আর তুমি আমার প্রিয় ভাগনে। আমার একেবারে শুরু থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল!’ ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে গিয়ে বললেন তিনি, তারপর কার্লকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন; নীরবে এর সবটা সহ্য করে গেল কার্ল।

    ‘আর আপনার নামটা?’ কার্ল জিগ্যেস করল আলিঙ্গন থেকে ফের ছাড়া পেয়ে, খুবই বিনয়ের সঙ্গে কিন্তু একটুও বিচলিত না হয়ে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে ঘটনার এই নতুন মোড় স্টোকারের জন্য কী ফল বয়ে আনতে পারে তা অনুমান করার। তবে এ মুহূর্তে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না যে এর থেকে শুবাল কোনো লাভ ঘরে তুলতে পারবেন।

    ‘ইয়ং ম্যান, মনে হচ্ছে তুমি তোমার সৌভাগ্যের বিষয়টা বুঝতে পারোনি, ক্যাপ্টেন বললেন, তার বিশ্বাস কার্লের প্রশ্নটা মিস্টার জ্যাকবের আত্মমর্যাদায় আঘাত দিয়েছে, কারণ এই ভদ্রলোক জানালার কাছে সরে গেছেন, এটা পরিষ্কার যে তিনি অন্যদের কাছ থেকে তার চেহারার অস্থিরতাটুকু লুকাতে চাচ্ছেন, মুখ হালকা চাপড় দিয়ে দিয়ে মুছছেন একটা রুমালে। তোমাকে যিনি তোমার মামা হিসেবে পরিচয় দিলেন, উনি সিনেটর এডওয়ার্ড জ্যাকব। সুতরাং তুমি যেমনটা আগে ভাবছিলে তার ঠিক উল্টো, এখন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা উজ্জ্বল কর্মজীবন। এই কথাটা হঠাৎ এই ঘটনার চমকের মধ্যেও যদুর পারো ভালোভাবে বুঝে নাও আর নিজেকে সংহত করো!

    ‘এটা সত্যি যে আমার আমেরিকায় জ্যাকব নামের এক মামা আছেন,’ বলল কার্ল, ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে, কিন্তু যদি আমি ঠিকভাবে বুঝে থাকি, জ্যাকব হচ্ছে এই সিনেটরের স্রেফ বংশনাম।’

    ‘হ্যাঁ, তা ঠিক, ক্যাপ্টেন বললেন, প্রত্যাশাভরা গলায়।

    ‘কিন্তু আমার মামা জ্যাকব, যিনি আমার মায়ের ভাই, তার তো জ্যাকব হচ্ছে নামের প্রথম অংশ, আর তার বংশনাম তো হবে আমার মায়ের যা বংশনাম তা-ই; আমার মায়ের বিয়ের আগের পারিবারিক নাম ছিল বেন্ডেলমেয়ার।’

    ‘জেন্টেলমেন!’ কার্লের এই কথা শুনে জোরে বলে উঠলেন সিনেটর, জানালার পাশে নিজেকে সুস্থির করে তোলার এই বিরতির পরে তিনি এখন প্রফুল্ল। বন্দর-কর্তৃপক্ষের দুই অফিসার বাদে বাকি যারা আছেন সবাই হাসিতে ফেটে পড়লেন– কারো হাসি মনে হচ্ছে সহানুভূতির, কারোটা আবার দুর্বোধ্য।

    ‘কিন্তু আমি তো এত হাস্যকর কিছু বলিনি,’ ভাবল কার্ল।

    ‘জেন্টেলমেন,’ আবার বললেন সিনেটর, ‘আপনারা আমার বা আপনাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একটা ছোট পারিবারিক ব্যাপারে অংশ নিয়ে ফেলেছেন, আর তাই আমার আর ব্যাখ্যা না দিয়ে কোনো উপায় নেই, কারণ আমার মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন বাদে– ক্যাপ্টেনের নাম বলতেই দুই জনের মধ্যে মাথা নোয়ানুয়ি বিনিময় হলো একচোট –‘আর কেউ পুরো পরিস্থিতিটা ধরতে পারছেন না।

    ‘এবার তো আমাকে প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শুনতে হয়, কার্ল মনে মনে বলল; সে একটু আড়চোখে দেখে খুশি যে স্টোকারের মধ্যে আবার প্রাণ ফিরে আসা শুরু হয়েছে।

    ‘এই যে এতগুলো বছর আমি আমেরিকায় সাময়িক ডেরা বেঁধেছি– যদিও সাময়িক কথাটা আমার মতো মনেপ্রাণে একজন আমেরিকার নাগরিকের জন্য ঠিকভাবে খাটে না –এই দীর্ঘ এতগুলো বছর আমি এখানে আছি আমার ইউরোপিয়ান আত্মীয়দের কাছ থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। তার কারণ যদি বলতে হয়, তাহলে প্রথম কথা হলো, এখানে তা বলাটা সমীচীন না আর দ্বিতীয়ত, ওগুলো বলা আমার জন্য সত্যি অনেক কষ্টের। আমার এমনকি ভাবতে ভয় হয় যে হয়তো আমার এই প্রিয় ভাগনেকে ওগুলো একসময় বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না; আমার ভয়, তা করতে গেলে দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে তার বাবা-মা আর তাদের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে মুখ খুলে বসতে হবে।

    ‘উনি আমার মামা– কোনো সন্দেহ নেই, কার্ল মনে মনে বলল, কান খাড়া করে শুনছে সে, খুব সম্ভব উনি নিজের নাম বদলেছেন।

    ‘আমার প্রিয় এই ভাগনেকে– কোদালকে কোদাল বলতে আমাদের কোনো ইতস্তত করা উচিত না– তার বাবা-মা স্রেফ বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, ঠিক যেভাবে কেউ কোনো দুষ্টু বিড়ালকে ঘর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আমার ভাগনে কী করেছে যে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হলো, সেটা আড়াল করার আমার কোনোভাবেই কোনো ইচ্ছা নেই, আর আমেরিকায় কোনোকিছু আড়াল করার সংস্কৃতিও নেই, কিন্তু তার অপরাধটা এমনই যে স্রেফ ওটার নাম উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট ক্ষমা এমনিতেই হয়ে যায়।

    ‘বাহ্, খারাপ বলেননি তো উনি, ভাবল কার্ল, ‘কিন্তু তাই বলে উনি সবাইকে সবটা বলে দেন সেটাও চাচ্ছি না। তবে এমনিতেই ওনার সব জানা সম্ভবও নয়। কোত্থেকে জানবেন?

    ‘ঘটনা হচ্ছে,’ বলতে লাগলেন তার মামা, বাঁশের ছড়িটা সামনে মেঝেতে পুঁতে ওতে ভর দিয়ে মাঝেমধ্যে হালকা সামনের দিকে নুয়ে নুয়ে (পুরো আলোচনাটা নিশ্চিত একটা অকারণ গাম্ভীর্য পেয়ে যেত, কিন্তু এমনটা করে তিনি সেটা এড়াতে সক্ষম হলেন), ‘ঘটনা হচ্ছে একটা কাজের মেয়ে ওকে কুকর্মে প্রলুব্ধ করেছিল, ইয়োহান্না ব্রামার নাম ওই মেয়ের, পঁয়ত্রিশের মতো বয়স হবে। “কুকর্মে প্রলুব্ধ হওয়া” কথাটা ব্যবহার করে আমি কিন্তু কোনোভাবেই আমার ভাগনেকে অসম্মান করতে চাচ্ছি না, কিন্তু অন্য কোনো একই রকম উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

    কার্ল এরই মধ্যে তার মামার বেশ কাছে চলে এসেছে, এ সময়ে সে এই গল্প শুনে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কী হলো তা এখানে উপস্থিত সবার মুখ দেখে আঁচ করার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কেউই হাসছে না, সবাই শুনছে ধৈর্য ধরে আর গভীর মনোযোগে। আর–ই হোক একজন সিনেটরের ভাগনেকে নিয়ে তো আর সুযোগ-পেলাম-আর-হেসে-ফেললাম। এমনটা হয় না। খুব বেশি হলে স্টোকার হয়তো কার্লকে নিয়ে একটু হাসছে, যদিও খুব মৃদুভাবে; তা যদি হয়ও তা তো ভালোই, তার মানে ওনার মধ্যে জীবন ফিরে আসছে, আর দ্বিতীয় কথা হলো, ওনার হাসি ক্ষমাও করা যায়, কারণ নিচে ওনার কেবিনে কার্ল ঠিক এই গল্পটাই লুকাতে চাইছিল, যা এখন একদম সবার সামনে কীভাবে খোলাসা হয়ে গেল।

    ‘এখন কী হয়েছে, এই ব্রামার মেয়েটার, কার্লের মামা বলতে লাগলেন, ‘কার্লের ঔরসে একটা সন্তান হলো, এক স্বাস্থ্যবান পুত্রসন্তান, যাকে ব্যাটাইজ করা হলো জ্যাকব নাম দিয়ে, বোঝাই যাচ্ছে আমার, মানে এই অধমের নামটা মাথায় রেখে; আমার ভাগনে নিশ্চয় তাকে আমার কথা এমনিই গল্প-টল্পে বলেছিল কিন্তু মেয়েটার মধ্যে সেটাই হয়তো গভীর ছাপ ফেলেছিল আমার ব্যাপারে। আমাকে বলতেই হবে, ভাগ্য ভালো যে এমনটা হয়েছিল। কারণ বাচ্চা ও মায়ের খোরপোশ কিংবা আর কোনো পারিবারিক কেলেঙ্কারি। বেএড়ানোর জন্য যখন ছেলের বাবা-মা –এখানে আমাকে বলতেই হচ্ছে যে ওই দেশে। এসব বিষয়ে কী আইন কিংবা ছেলের বাবা-মার অন্য আর অবস্থা কেমন সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই –তাদের ছেলেকে, মানে আমার ভাগনেকে, আমেরিকার জাহাজে তুলে দিলেন, ছেলের থাকা-খাওয়া ভরণ-পোষণের সামান্য কোনো ব্যবস্থা না করেই তারা করলেন সেটা, যা আপনারা পরিষ্কার দেখতেই পাচ্ছেন; তার মানে এই কিশোর বালক শিগগিরই, তার নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে গিয়ে খুবই সম্ভব যে হয়তো নিউ ইয়র্ক জাহাজঘাটার কোনো অলিগলিতে লজ্জাকর এক নিয়তিকে মেনে নিত (যদিও অন্তত আমেরিকায় যে এখনো অলৌকিক ঘটনাও ঘটে, তা আমি অস্বীকার করছি না), যদি না ঐ কাজের মেয়েটা আমাকে একটা চিঠি পাঠাত, যে চিঠি লম্বা পথ ঘুরে আমার হাতে এসেছে মাত্র গত পরশু, সেখানে মেয়েটা পুরো গল্প লিখে জানিয়েছে আমাকে, সেই সঙ্গে আমার ভাগনের বিষয়ে একটা বিবরণও দিয়ে পাঠিয়েছে আর বেশ বুদ্ধি করে জাহাজের নামও লিখে জানিয়েছে। জেন্টেলমেন, আপনাদের যদি মজা দেওয়ার আমার ইচ্ছা থাকত তাহলে ঐ চিঠি থেকে একটা বা দুটো অংশ জোরে পড়লেই চলত’– তিনি এ সময়ে পকেট থেকে দুটো বিশাল বড়, ঘন হাতে লেখা নোট বইয়ের পাতা বের করলেন আর ওগুলো দেখালেন– “নিঃসন্দেহে লেখাটা আপনাদের মন কেড়ে নিত, বেশ সাধারণ কিন্তু সৎ একধরনের চাতুরীর সঙ্গে ওটা লেখা, আর বাচ্চার বাবার জন্য অনেক ভালোবাসায় ভর্তি। কিন্তু আপনাদের গল্পটা বোঝানোর জন্য যতটুকু নিতান্ত দরকার তার চেয়ে বেশি কাউকে মজা দিতে চাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই, কিংবা আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তে আমার ভাগনের এমন কোনো অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না আমি, যা খুব সম্ভব সে এখনো নিজের ভেতরে লালন করছে; সে যদি চায় তো চিঠিটা সে এখনই মন ভালো করার জন্য নিজের কামরায় গিয়ে চুপচাপ পড়তে পারে, কামরা তার জন্য তৈরিই আছে।

    কিন্তু কার্লের ঐ মেয়ের জন্য কোনো টান নেই। অবিরাম পেছনে সরতে থাকা এক অতীতের ভিড়ে ভরা মুখগুলোর মধ্যে ঐ সে বসে আছে ওখানটায় তার রান্নাঘরের বাসনকোসন রাখার আলমারির পাশে, তার কনুই দুটো মার্বেলের স্ল্যাবের উপরে রেখে। যখনই সে রান্নাঘরে আসবে বাবার জন্য এক গ্লাস পানি নিতে কিংবা মায়ের কোনো নির্দেশ তাকে জানাতে, তখনই মেয়েটা তাকাবে তার দিকে। কখনো দেখা যাবে সে চিঠি লিখছে আলমারিটার ওমাথায় তার বেঢপ আসনে বসে, আর কার্লের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রেরণা নিচ্ছে ওটা লেখার। কখনো চোখের উপরে একটা হাত রাখা থাকবে তার, তখন আর তার কাছে কোনো শুভেচ্ছা-সম্ভাষণ পৌঁছানো যাবে না। কখনো সে রান্নাঘরের পাশে তার ছোট কামরায় দেখা যাবে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, একটা কাঠের ক্রসের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছে; কার্ল তখন ওই ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে হালকা খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে। তাকে দেখবে লাজুক ভঙ্গিতে। কখনো রান্নাঘরে ছুটোছুটি করে বেড়াবে সে, আর যদি কার্ল গিয়ে তার পথের ওপরে পড়ে, তাহলে ডাকিনী মেয়েদের মতো হাসতে হাসতে লজ্জায় পিছিয়ে যাবে সে। কখনো কার্ল ভেতরে ঢোকার পরে সে বন্ধ করে দেবে রান্নাঘরের দরজা, আর যতক্ষণ না কার্ল বাইরে যেতে দেওয়ার জন্য কাতর মিনতি করছে, ততক্ষণ দরজার হাতল আঁকড়ে ধরে থাকবে। কখনো সে এমন জিনিস এনে দেবে যা কার্ল মোটেই চায়নি তার কাছে আর নীরবে ওগুলো খুঁজে দেবে কার্লের হাতের মুঠোয়। কিন্তু একদিন সে তাকে ডাকল কার্ল’ বলে, আর তাকে (তখনো সে এই অপ্রত্যাশিত ঘনিষ্ঠতার বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি) অনেক মুখ ভেংচিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিয়ে গেল তার ছোট ঘরটায়, উদ্যত হলো ওটার দরজা তালা দিতে। দুই বাহু দিয়ে কার্লের গলা পেঁচিয়ে ধরল সে, প্রায় দম বন্ধ করে দিচ্ছিল তার, আর কার্লকে তার কাপড় খুলে দেয়ার মিনতি জানাতে জানাতে সে আসলে কার্লেরই কাপড়চোপড় খুলে নিল আর তাকে এমনভাবে শোয়ালো তার বিছানায় যে মনে হলো সে কার্লকে আর কোনো দিনও চলে যেতে দিতে চায় না, চায় যে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত তাকে সে আদর দিয়ে বুকে পুষে রাখবে। ওহ্ কার্ল, ওহ কার্ল আমার!’ সে চিৎকার করতে লাগল, তার দিকে তাকাল এমনভাবে যে সে যেন নিশ্চিত করতে চাচ্ছে কার্ল তারই, কার্ল তখন দেখতে পারছে না কোনোকিছুই, তার শুধু ওই অতগুলো উষ্ণ বিছানার চাদর-টাদরে (মেয়েটা যেগুলো কার্লের সুবিধার জন্যই মনে হয় উঁচু গাদা করে রেখেছিল) অস্বস্তিই লাগছিল বরং । তারপর সে শুলো কার্লের পাশে, চেষ্টা করল কার্লের কাছ থেকে কিছু গোপন কথা বের করতে, কিন্তু কার্ল তাকে কোনো গোপন কিছুই বলতে পারল না, এতে সে অসন্তুষ্ট হলো খানিকটা, হয় ঢং করে, নয়তো সত্যি সত্যিই। সে ঝাঁকাল কার্লকে, তার হৃৎস্পন্দন শুনল, তার স্তন দুটো সে কার্লকে দিল একই কাজ করার জন্য, কিন্তু কার্লকে রাজি করানো গেল না তাতে; সে তার নগ্ন পেট চেপে ধরল কার্লের গায়ে, কার্লের দুই পায়ের মাঝখানে হাত দিয়ে হাতড়াতে লাগল (এটাতে কার্লের এমন ঘেন্না হলো যে সে বালিশ থেকে তার মাথা ও ঘাড় ঝাঁকিয়ে তুলে ফেলল), তারপর মেয়েটা তার পেট দিয়ে কার্লকে ধাক্কা দিল বেশ কয়েকবার; কার্লের মনে হলো মেয়েটা তার শরীরেরই একটা অংশ, আর হয়তো সে কারণেই সে পরাভূত হলো নৈরাশ্যের এক ভয়ংকর অনুভূতির কাছে। শেষমেশ কার্ল কাঁদতে কাঁদতে পৌঁছাল নিজের বিছানায়, মেয়েটা তাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করল যেন সে আবার আসে। পুরো ঘটনা স্রেফ এটুকুই, আর তার মামা এটাকে কী বিরাট এক কেচ্ছা বানিয়ে ছেড়েছেন। আচ্ছা তাহলে মেয়েটা তার কথাও মনে করেছে আর এখানে তার পৌঁছানোর কথা তার মামাকে জানিয়েছে। মন বড় আছে তো মেয়েটার; কার্ল আশা করছে তার এই ঋণ একদিন সে শোধ করতে পারবে।

    ‘তাহলে এখন,’ জোরে বললেন সিনেটর, ‘আমি তোমার কাছ থেকে পরিষ্কার শুনতে চাই আমি কি তোমার মামা, নাকি না?

    ‘আপনি আমার মামা,’ বলল কার্ল, ওনার হাতে চুমু খেল, উত্তরে নিজের কপালে হএকটা চুমু পেল সে। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমি অনেক খুশি, কিন্তু এটা আপনার ভুল ভাবনা যে আমার বাবা-মা শুধু আপনার বদনামই করেন। ওটা যদি বাদও দেন, তবু আপনার বক্তব্যে বেশ কিছু ভুল ছিল, তার মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি যেমনটা বললেন, বাস্তবে সব আসলে তেমন ঘটেনি। তবে এটাও সত্যি, এত দূর থেকে কোনোকিছুর বিচার করা খুব কঠিন আর আমার ধারণা এমন কোনো বিষয়ে যাতে এখানে উপস্থিত ভদ্রলোকদের এমনিতেই কোনো বিশেষ আগ্রহ থাকার কথা নয়, সে রকম কোনো বিষয়ের খুঁটিনাটি যদি ঠিকভাবে বলা না-ও হয়, তাতে বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই।

    ‘খুবই ভালো বলেছ, সিনেটর বললেন, কার্লকে নিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেনের কাছে, ক্যাপ্টেন দেখেই মনে হচ্ছে কার্লের প্রতি সমব্যথী। তারপর জিগ্যেস করলেন: “কি, আমার ভাগনে কী চমৎকার না?

    ‘আমি খুশি,’ বললেন ক্যাপ্টেন, এমনভাবে মাথা নোয়ালেন যা কেবল সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া লোকদের পক্ষেই করা সম্ভব, যে আপনার ভাগনের সঙ্গে পরিচয় হলো, মিস্টার সিনেটর। আমার জাহাজের জন্য এটা বিশেষ সম্মানের যে আপনাদের সাক্ষাৎ আমাদের জাহাজেই হলো। কিন্তু জাহাজের সবচেয়ে নিচের ক্লাসে এই এত বড় সমুদ্রযাত্রা এক অগ্নিপরীক্ষা বটে; তবে আমরা জানবই বা কী করে যে নিচে ওখানে কারা আছে? কোনো সন্দেহ নেই ওই ক্লাসের যাত্রীদের ভ্রমণটা যেন যদুর সম্ভব সহনীয় হয় তার সব চেষ্টাই আমরা করি, আমেরিকান শিপিং কোম্পানিগুলোর থেকে অনেক বেশি তো বটেই, তবু আমাকে স্বীকার করতেই হবে তাদের এই ভ্রমণকে আমরা এখনো আনন্দের করে তুলতে পারিনি।’

    ‘আমার কোনো ক্ষতি হয়নি এতে,’ বলল কার্ল।

    ‘আমার কোনো ক্ষতি হয়নি এতে!’ সিনেটর একই কথা বললেন জোরে হাসতে হাসতে। বে’শুধু আমার ভয় যে আমি মনে হয় আমার ট্রাংক হারিয়ে– আর এই সঙ্গেই সবকিছু ফিরে এল কার্লের মাথায়, যা যা ঘটেছে আর যা যা আরো করা বাকি –সব। সে তার চারপাশে তাকাল, দেখল তারা সবাই তার দিকে স্থির তাকিয়ে তাদের যার যার আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রতি শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ের ধাক্কায় বোবা হয়ে। শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসার দুজন, অন্তত তাদের কঠিন ও আত্মতৃপ্ত চেহারা দেখে যেটুকু বোঝা গেল, আক্ষেপ করছেন এরকম একটা অসময়ে এসে হাজির হওয়ার জন্য; আর যা-কিছু চলছে কিংবা আরো যা-কিছু ঘটতে পারে –ঐ সবের চেয়ে মনে হচ্ছে তাদের কাছে অনেক বেশি অর্থ বহন করে এখন টেবিলের উপরে রাখা তাদের পকেটঘড়িটা।

    মজার ব্যাপার যে ক্যাপ্টেনের পরে প্রথম যে মানুষটা কার্লকে নিজের সহানুভূতির কথা জানালেন, তিনি স্টোকার। মন থেকে তোমাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি,’ বললেন তিনি আর কার্লের হাত ধরে ঝাঁকালেন, এটা করতে গিয়ে চেষ্টা করলেন কৃতজ্ঞতা-জাতীয় কিছু একটা প্রকাশ করারও। তারপর যখন তিনি সিনেটরের দিকে ঘুরলেন একই কথা বলতে আর একই কাজ করতে, সিনেটর এমনভাবে এক পা পিছিয়ে গেলেন যেন স্টোকার তার সীমা অতিক্রম করে ফেলছেন; সঙ্গে সঙ্গে স্টোকার নিবৃত্ত করলেন নিজেকে।

    কিন্তু অন্যরা এবার বুঝতে পারল কী তাদের করা উচিত, তারা দেরি না করেই কার্ল আর সিনেটরকে ঘিরে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে গেলেন সবাই। ফলে এটাও ঘটল যে কার্ল এমনকি শুবালের কাছ থেকেও শুভেচ্ছাবাক্য পেল, সে তা গ্রহণ করল এবং তাকে ধন্যবাদ জানাল। সবকিছু ফের শান্ত হওয়ার পরে সবার শেষে এলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের ঐ দুজন, তারা ইংরেজিতে দুটো শব্দ বললেন, তাতে বেশ একটা হাসি-তামাশার জোগাড় হলো।

    সিনেটর এখন এই আনন্দজনক ঘটনাটা পুরোপুরি উপভোগ করার মেজাজে আছেন, তিনি তার নিজের ও অন্যদের সুবিধার্থে কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ের কথা স্মরণ করতে লাগলেন; কোনো সন্দেহ নেই, সবাই সেগুলো স্রেফ বরদাস্তই করলেন না, আগ্রহভরে শুনতেও লাগলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি সবার মনোযোগ কাড়লেন এটা বলে যে তিনি কার্লকে চেনার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্নগুলো (যেগুলোর কথা মেয়েটা তার চিঠিতে লিখেছে) তার নোট বইতে টুকে রেখেছিলেন, যাতে করে দরকার পড়লে তক্ষুনি সেগুলো দেখে নিতে পারেন। তারপর স্টোকার যখন তার বাকসর্বস্ব বক্তৃতা দিয়ে চলছিল তিনি তখন স্রেফ কিছু একটা করতে হবে, তাই নোট বইটা বের করে মজা করার জন্যই কার্লের চেহারার সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মেয়েটার বর্ণনার– গোয়েন্দার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেগুলো নিশ্চিতভাবেই খুব কাজের কিছু ছিল না। নিজের ভাগনেকে তাহলে এভাবেই খুঁজে পেতে হয়!’ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তিনি, এমন একটা স্বরে কথাটা বললেন যে তিনি চাইছেন আবার একবার সবাই তাকে অভিনন্দন জানাক।

    ‘এখন স্টোকারের কী হবে?’ কার্ল তার মামার শেষ কথাটা উপেক্ষা করে জানতে চাইল। তার এই নতুন অবস্থায় তার মনে হলো মাথায় যা আসে সেটাই সে বলে ফেললেও কোনো অসুবিধা নেই।

    ‘স্টোকার তার যা প্রাপ্য তা-ই পাবে,’ সিনেটর বললেন, ‘ক্যাপ্টেন যেটা ঠিক মনে করেন। তা ছাড়া আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্টরও বেশি হয়েছে এই স্টোকারকে নিয়ে, আর আমি নিশ্চিত, এখানে উপস্থিত প্রত্যেক ভদ্রলোকই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত।

    ‘কিন্তু যখন প্রশ্নটা ন্যায়বিচারের তখন তো তা বললে হবে না,’ বলল কার্ল। সে দাঁড়িয়ে আছে তার মামা এবং ক্যাপ্টেনের মাঝখানে আর তার মনে হচ্ছে, সম্ভবত এ জায়গায় দাঁড়ানোর কারণেই, যে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা এখন তারই হাতে।

    তবে স্টোকারকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তার হাত দুটো তিনি অর্ধেক খুঁজে রেখেছেন ট্রাউজারের বেল্টের মধ্যে, তার উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গির কারণে বেল্টটা আর সেই সঙ্গে তার নকশা-করা জামার একটুখানি এখন বেরিয়ে এসেছে। এটা নিয়ে তার সামান্য মাথাব্যথাও নেই; এখন যেহেতু তার দুঃখের সব কথা উগরে দেওয়া শেষ, তারা সবাই তার শরীরে ঝুলে থাকা ক’টা ছেঁড়া কাপড়চোপড় দেখলেই পারেন, তারপর তারা তাকে তুলে নিয়ে গেলেও পারেন। তিনি কল্পনা করলেন যে এখানে উপস্থিত সবার মধ্যে সবচেয়ে নিচু পদের লোক হিসেবে পরিচারক ও শুবালের কাঁধেই পড়বে তার প্রতি এই শেষ দায়টুকু দেখানোর দায়িত্ব। এরপরে কী শান্তিই না মিলবে শুবালের, কেউ আর তার মাথা বিগড়ে দেবে না, যেমনটা বলেছিলেন চিফ পার্সার। ক্যাপ্টেনের তখন জাহাজে শুধু রুমানিয়ানদের নিতে কোনো বাধা থাকবে না, সবখানে শুধু রুমানিয়ান ভাষাতেই কথা বলা হবে, হতে পারে ওভাবে সবকিছু সত্যিই আরো ভালো চলবে। পার্লারের অফিসে আর কোনো স্টোকারকে শোনা যাবে না উচ্চ স্বরে বক্তৃতা করছে, শুধু তার এই শেষ বাকস্বর্বস্ব বক্তৃতাটুকু মানুষ দয়া করে মনে রাখবে, যেহেতু সিনেটর পরিষ্কার বলেছেন যে ওই বক্তৃতাই ছিল তার ভাগনেকে চিনতে পারার পেছনে পরোক্ষ কারণ। এই ভাগনে অবশ্য এমনিতেই আগে বেশ কবার চেষ্টা করেছে তাকে সাহায্য করতে, অতএব মামা-ভাগনের পরিচয় হওয়ার পেছনে তার যে অবদান, সেটার পুরস্কার তার অনেক আগেই পুরোপুরি পাওয়া হয়ে গেছে; কার্লের কাছ থেকে আর বেশি কিছু চাওয়ার কোনো কথা স্টোকারের এখন এমনকি মাথাতেই নেই। তা ছাড়া, সে যদি কোনো সিনেটরের ভাগনেও হয়, তবু সে তো আর এই জাহাজের ক্যাপ্টেন নয়; আর বলা বাহুল্য, ক্যাপ্টেনের মুখ থেকেই তো আসবে সেই ভয়ংকর রায়।– তার চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই স্টোকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন কার্লের দিকে তাকানোটা এড়ানোর, যদিও শত্রুতে ভরা এই কামরাটায় দুর্ভাগ্যক্রমে চোখ দুটো বিশ্রাম দেওয়ার মতো অন্য আর কোনো জায়গা নেই।

    ‘পরিস্থিতিটাকে ভুল বুঝো না,’ সিনেটর কার্লকে বললেন, ‘হতে পারে বিষয়টা ন্যায়বিচারের, কিন্তু একই সঙ্গে এটা শৃঙ্খলারও বিষয়। আর জাহাজে ক্যাপ্টেনকেই নিষ্পত্তি করতে হয় দুটো বিষয়েরই, বিশেষ করে শেষেরটার।’

    ‘তা ঠিক, বিড়বিড় করে বললেন স্টোকার। যারা এটা শুনতে পেলেন এবং বুঝতে পারলেন, তারা মৃদু হাসলেন অস্বস্তি নিয়ে।

    ‘আমরা কিন্তু এরই মধ্যে ক্যাপ্টেনকে তার অফিশিয়াল কাজে অনেক বেশি সময় ধরে বাধা দিয়ে ফেলেছি, নিউ ইয়র্কে জাহাজ মাত্র পৌঁছেছে, কোনো সন্দেহ নেই বিশাল কাজের স্তূপ জমে আছে ওনার, তাই আসলে আমাদের এক্ষুনি জাহাজ ছেড়ে যাওয়া উচিত, কোনো দরকার নেই দুই ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যেকার এই অতি তুচ্ছ বিষয়ের বিরাট ঝগড়াটায় একদম অদরকারি নাক গলিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বানিয়ে ফেলার আর সবকিছু আরো খারাপ করার । প্রিয় ভাগনে আমার, তোমার আচরণের ধরনটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি, আর ঠিক সে কারণেই আমার অধিকার আছে তোমাকে এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যাওয়ার।

    ‘আপনার জন্য আমি এক্ষুনি একটা নৌকা নামিয়ে দিতে বলছি,’ বললেন ক্যাপ্টেন, একবারও (এটা খুবই অবাক করল কার্লকে) সামান্য কোনো আপত্তি জানালেন না তার মামার কথাগুলোতে, যদিও ওগুলোকে নিজের মর্যাদা নিজে হারানোর পরিষ্কার উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। চিফ পার্সার ছুটে গেলেন তার ডেস্কে আর টেলিফোনে সারেংকে জানালেন ক্যাপ্টেনের আদেশ।

    ‘সময় খুব জলদি চলে যাচ্ছে, মনে মনে বলল কার্ল, ‘কিন্তু সবার মনে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। আমি তো সত্যি এখন আমার মামাকে ছেড়ে যেতে পারি না, মাত্র উনি আমাকে খুঁজে পেয়েছেন। ক্যাপ্টেন নিঃসন্দেহে মার্জিত ভদ্রলোক, কিন্তু ওটা ঐ পর্যন্তই। যখন বিষয়টা শৃঙ্খলা নিয়ে কিছু, ওনার ঐ মার্জিত আচরণ তখন হাওয়া হয়ে যাবে; আমি নিশ্চিত, আমার মামা ক্যাপ্টেনের একেবারে মনের কথাটাই বলছিলেন। শুবালের সঙ্গে আমি কথা বলতে যাচ্ছি না; আমার বরং আক্ষেপ যে তার সঙ্গে আমি হাত মিলিয়েছি আর এখানে উপস্থিত অন্যরা তো সেফ গোনার মধ্যেই পড়ে না।

    মনের মধ্যে এসব ভাবতে ভাবতেই কার্ল ধীরে স্টোকারের ওখানটায় গেল, তার ডান হাত বেল্ট থেকে টেনে বের করে নিজের হাতে রাখল, যেন হালকাভাবে ওজন নিচ্ছে ওটার। কিছু বলছেন না কেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা করল সে। পড়ে পড়ে সব সহ্য করে যাচ্ছেন কেন?

    স্টোকার শুধু তার ভুরু কোঁচকালেন, মনে হচ্ছে তিনি মনের কথা বলার কোনো পথ খুঁজছেন। তিনি মাথা নিচু করে তাকালেন কার্লের এবং তার হাতের দিকে।

    ‘আপনার ওপর অন্যায় করা হয়েছে, এই জাহাজের অন্য যে-কারো ওপরে এতটা হয়নি; এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কার্ল তার আঙুলগুলো স্টোকারের আঙুলের মধ্যে দিয়ে সামনে-পেছনে করতে লাগল। স্টোকার চকচক করতে থাকা চোখে চারপাশে তাকালেন; মনে হচ্ছে, তিনি উপভোগ করছেন কোনো পরম সুখ যেটা নিয়ে কারোরই উচিত না তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হওয়ার।

    ‘কিন্তু আপনাকে তো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে, হ্যাঁ বা না, একটা তো বলতে হবে, নতুবা মানুষ সত্য জানবে কী করে? আমি যেভাবে বলছি আপনি শপথ করেন যে তেমনটা করবেন, কারণ আমার অনেক ভয় হচ্ছে, সংগত কারণেই ভয় হচ্ছে যে আমি আর নিজে আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। আর এবার কার্ল স্টোকারের হাতে চুমু খাওয়ার সময় ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিল, সে ওই ভাঁজ-পড়া ও প্রায় প্রাণহীন হাতটা নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরল তেমন কোনো এক সম্পদের মতো, যার মালিকানা এবার ছেড়ে দিতে হবে।– কিন্তু এরই মধ্যে তার সিনেটর মামা তার পাশে চলে এসেছেন, কার্লকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি, অতি সামান্যই জোর করতে হয়েছে তাকে।

    ‘স্টোকার তো মনে হয় তোমাকে জাদু করে ফেলেছে, তিনি বললেন, আর কার্লের মাথার উপর দিয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে গভীর বোঝাবুঝির একটা দৃষ্টিতে তাকালেন। তোমার। নিঃসঙ্গ লাগছিল, তুমি স্টোকারকে সঙ্গী হিসেবে পেলে, আর এখন তুমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ; এর সবকিছুই তোমার গুণের কথা। কিন্তু এসব জিনিস অন্তত আমার কথা ভেবে হলেও বেশি দূর নিতে নেই; আর তোমাকে তো তোমার অবস্থানটাও বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

    দরজার বাইরে একটা হাঙ্গামা শোনা গেল; চিৎকার কানে আসছে, এমনকি শুনতে মনে হচ্ছে কাউকে নিষ্ঠুরভাবে দরজার উপর ঠেসে ধরা হয়েছে। একজন নাবিক কিছুটা আলুথালু অবস্থায় ভেতরে ঢুকল, তার কোমরে একটা মেয়েদের অ্যাপ্রন বাঁধা। বাইরে একগাদা মানুষ জড়ো হয়েছে, সে চিৎকার দিয়ে উঠল, তার কনুই দিয়ে তো মারার ভঙ্গি করছে, যেন এখনো তাকে ভিড়ের মধ্যে ধাক্কিয়ে চলতে হচ্ছে। অবশেষে সে সুস্থির হলো, ক্যাপ্টেনকে এবার স্যালুট দিতে যাবে তখন তার চোখে পড়ল অ্যাপ্রনটা, টেনে সে ছিঁড়ে ফেলল ওটা, ছুঁড়ে মারল মেঝেতে আর চিৎকার দিয়ে বলল: ‘কী জঘন্য কাজ, তারা আমাকে মেয়েদের অ্যাপ্রন পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এরপর সে আওয়াজ তুলল গোড়ালিতে আর স্যালুট ঠুকল। কে যেন হেসে ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু ক্যাপ্টেন কঠোরভাবে বললেন: ‘সবাই খুব চাঙা দেখছি। বাইরে এসব লোকজন কারা?

    ‘ওরা সব আমার সাক্ষী, সামনে এগিয়ে এসে বললেন শুবাল, ‘আমি ওদের বদ আচরণের জন্য বিনয়ের সঙ্গে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। সমুদ্রযাত্রা শেষ হলে যা হয়, ক্রুরা সব কখনো কখনো একটু মাথা-খারাপ মতো হয়ে ওঠে।

    ‘সবগুলোকে এক্ষুনি ভেতরে ডাকো! ক্যাপ্টেন আদেশ দিলেন, আর তারপর সঙ্গে সঙ্গে সিনেটরের দিকে ঘুরে বিনয়ের স্বরে কিন্তু তড়বড় করে বললেন: আপনাকে কি মিস্টার সিনেটর আমি সম্মানের সঙ্গে বলতে পারি যে দয়া করে আপনার ভাগনেকে নিয়ে এই নাবিকের সঙ্গে যাবেন? ও আপনাদের নৌকার কাছে নিয়ে যাবে। আমার বলার কোনো দরকারই থাকে না যে, মিস্টার সিনেটর, আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে এই পরিচয় হওয়াতে আমি কত খুশি আর নিজেকে কত সম্মানিত বোধ করছি। আমার এখন শুধু এটাই আশা যে আপনার সঙ্গে শিগগির আবার ঐ আমেরিকান জাহাজের অবস্থা নিয়ে আমাদের মাঝপথে থেমে যাওয়া আলোচনাটা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলবে, আর হতে পারে আজকের মতো এরকম আনন্দের সঙ্গেই আমাদের আলোচনা সেদিনও থেমে যাবে ফের একবার।

    ‘আপাতত এই একটা ভাগনেই যথেষ্ট, হাসতে হাসতে বললেন কার্লের মামা। এখন অনুগ্রহ করে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ নিন; বিদায়। এমনটা কোনোভাবেই অসম্ভব না যে আমরা, আমাদের এর পরের বারের ইউরোপ যাত্রায়’– তিনি কার্লকে উষ্ণভাবে জড়িয়ে ধরলেন –“আপনার সঙ্গে আরো একটু বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাব।’

    ‘আমি তাতে অনেক খুশি হব,’ বললেন ক্যাপ্টেন। দুই ভদ্রলোক হাত মেলালেন; কার্ল স্রেফ নীরবে চটজলদি ক্যাপ্টেনের দিকে একটু বাড়াতে পারল তার হাত, কারণ ক্যাপ্টেন ইতোমধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেছেন জন পনেরো মানুষ নিয়ে, ওরা বানের তোড়ের মতো এই কামরায় ঢুকছে শুবালের নেতৃত্বে, ওদের চোখে সামান্য ভীতির চিহ্ন কিন্তু ঠিকই এখনো অনেক হইচই করে যাচ্ছে। নাবিক সিনেটরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইল, তারপর ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পথ বের করে দিল তার ও কালের জন্য, তাদের কোনো ন্টকষ্টই হলো না মাথা-নোয়ানো সারিগুলির মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে। মনে হচ্ছে যে এই মানুষেরা, যারা আসলেই একদল সরল হাস্যকৌতুকে ভরা লোক, শুবালের সঙ্গে স্টোকারের ঝগড়াকে একটা ঠাট্টা হিসেবে নিয়েছে, এমনকি ক্যাপ্টেনের সামনে এসেও তারা তাদের সেই মজা করা থামাতে পারছে না। এদের মধ্যে কার্লের চোখে পড়ল লাইন নামের সেই রান্নাঘরের মেয়েকেও, সে কার্লের দিকে একবার বা দুবার উচ্ছ্বসিত চোখ টিপে নাবিকের মেঝেতে ছুঁড়ে দেওয়া অ্যাপ্রনটা বেঁধে গায়ে পরতে লাগল, কারণ ওটা তার।

    তখনো তারা হাঁটছেন নাবিকের পেছন পেছন, অফিস থেকে বের হয়ে একটা ছোট গ্যাংওয়ে দিয়ে গিয়ে আর কয়েক পা হাঁটার পর তারা এসে হাজির হলেন একটা ছোট দরজার সামনে, ওটা থেকে একটা ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে তাদের জন্য তৈরি রাখা নৌকায়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া নাবিক একটামাত্র লাফেই গিয়ে উঠল নৌকাটায়, ওটার নাবিকেরা সব উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করল। সিনেটর কার্লকে মাত্র সতর্ক করছেন যে খুব সাবধানে নামতে হবে সিঁড়ি দিয়ে, তখন কার্ল –তখনো সে সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপে– ভয়ংকর ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল। সিনেটর তার ডান হাত রাখলেন কার্লের চিবুকের নিচে, তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে আর বাঁ হাতটা গায়ে বুলিয়ে শান্ত করতে লাগলেন তাকে। এভাবেই তারা ধীরে নিচে নেমে এলেন, এক পা এক পা করে, আর জড়াজড়ি করেই নৌকায় গিয়ে উঠলেন; নৌকায় সিনেটর কার্লকে বসালেন ঠিক তার সামনের ভালো একটা সিটে। সিনেটরের কাছ থেকে ইশারা পেয়ে নাবিকেরা ধাক্কা মেরে নৌকা ছাড়িয়ে নিল জাহাজ থেকে এবং তখনই যাত্রা শুরু করল, দাঁড় টানতে লাগল পুরো টান মেরে মেরে। জাহাজ থেকে নৌকা তখনো মাত্র কয়েক গজ দূরেও যায়নি, অপ্রত্যাশিতভাবে কার্ল আবিষ্কার করল তাদের নৌকা জাহাজের ঠিক সেই পাশটাতে যেখানে পার্লারের কামরার জানালা থেকে তাদের দেখা যাচ্ছে। তিনটে জানালাতেই ভিড় করে আছে শুবালের সাক্ষীরা, তারা খুবই আপন বন্ধুর ভঙ্গিতে স্যালুট করছে আর হাত নাড়ছে তাদের উদ্দেশে; এমনকি কার্লের মামাও হাত তুললেন এর উত্তরে, আর নাবিকদের একজন তার দাঁড় টানার মসৃণ তাল না-ভেঙেই কী করে যেন সক্ষম হলো তাদের দিকে ফুঁ দিয়ে একটা চুমু ছুঁড়ে দিতে। সত্যি মনে হচ্ছে যেন স্টোকার বলে আর কেউ নেই। কার্ল তার মামার দিকে তাকাল আরো ভালো করে, ওনার দুই হাঁটু প্রায় ছুঁয়ে আছে তার দুটো, আর কার্লের সন্দেহ জাগা শুরু হলো এই লোক কোনো দিন তার মনে স্টোকারের জায়গাটা নিতে পারবে কি না তা নিয়ে। তার মামা কার্লের চোখ এড়িয়ে গেলেন, তিনি তাকিয়ে থাকলেন তাদের নৌকা দোলাতে থাকা ঢেউগুলোর দিকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট – ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি
    Next Article দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা

    Related Articles

    ফ্রানজ কাফকা

    দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা

    October 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025
    Our Picks

    সাহিত্যিকদের ছদ্মনাম

    October 28, 2025

    অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স ও অন্যান্য প্রসঙ্গ – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025

    আলস্যের জয়গান – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 28, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }