Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প547 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১০. সে যুগের কোনো স্পষ্ট অবয়ব

    না, এ যুগে সে যুগের কোনো স্পষ্ট অবয়ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও সে দুরন্ত সংহারের মূর্তি নিয়ে মুহূর্তে মুহূর্তে রেণু রেণু করে উড়িয়ে দিচ্ছে বহুযুগসঞ্চিত সংস্কারগুলি, উড়িয়ে দিচ্ছে চিরন্তন মূল্যবোধগুলি, অভ্যস্ত ধ্যান-ধারণার অবলম্বনগুলি, আবার কোথাও সে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ীর মত আজও তার বহু সংস্কারে বোঝাই ঝুলিটি কাঁধে নিয়ে শিকড় গেড়ে বসে পাপপুণ্য, ভালোমন্দ,–ইহলোক-পরলোকের চিরাচরিত খাজনা যুগিয়ে চলেছে।

    তাই এ যুগের মানসলোকে সত্যের চেহারাও অস্থির অস্পষ্ট। দোদুল্যমান দৰ্পণে প্রতিফলিত প্রতিবিম্বের মত সে চেহারা কখনো কম্পিত, কখনো বিকৃত, কখনো দ্বিধাগ্ৰন্ত, কখনো যেন অসহায়। যেন ঝড়ে বাসাভাঙা পাখি ডানা ঝাপটে ঝাপটে পাক খেয়ে মরছে, এখনো ঠিক করে উঠতে পারছে না, ঝড় থামলে পুরনো বাসাটাই জোড়াতালি দিয়ে আবার গুছিয়ে বসবে, নাকি নতুন গাছে গিয়ে নতুন বাসা বাঁধবে!

    কিন্তু বড় কি থামবে?

    ভাঙনের ঝড় কি ভেঙেচুরে তছনছ না করা পর্যন্ত থামে? সে কি ওই আদ্যিকালের বুড়ীটাকে শিকড় উপড়ে তুলে ফেলে না দিয়ে ছাড়ে?

    অথবা হয়তো থামে।

    হয়তো ছাড়ে।

    কোথায় যেন একটা রফা হয়ে যায়। তখন বুড়ীটাকে দেখতে পাওয়া না গেলেও শিকড়টা থাকে যায় মাটির নীচে। নিঃশব্দে সে আপন কাজ করে যায়। তাই এই বিশ্বনস্যাতের যুগেও মহাত্মা আর মহারাজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বেড়ে চলেছে ভাগ্যগণনা কাৰ্যালয় আর গৃহশান্তির রত্ন-কবচ।

    তাই যখন সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতার জয়ডঙ্কায় আকাশবাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে, এখনও শুধু মাত্র চামড়ার রঙের তারতম্যের ছুতোয় মানুষ মানুষের চামড়া ছড়িয়ে নিচ্ছে! এবং যখন মানুষের একটা দল চাঁদে পৌঁছবার সাধনায় আকাশ পরিক্রম করছে, তখন আর একটা দল সভ্যতার সব পথ-পরিক্রমা শেষ করে ফেলেছি বলে আবার গুহার দিকে মুখ ফিরিয়ে চলতে যাচ্ছে।

    একটানা এতোখানিকটা বলে বক্তা একবার থামলেন। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বহু আসন-বিশিষ্ট বিরাট সুরম্য হল। সভার উদ্যোক্তা মোটা টাকা দক্ষিণা এবং অক্লান্ত ধর্নার বিনিময়ে একটি সন্ধ্যার জন্য সংগ্রহ করেছেন এই হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্য সম্মেলনের জন্য। ওই ভাবেই বেশ কয়েকদিন থেকে প্রচার কার্য চলেছে। অভিনব সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাহিত্য সম্মেলন। আসুন অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করুন। পঁচিশ টাকা, দশ টাকা ও পাঁচ টাকা। দুই টাকার টিকিট কেবলমাত্র অনুষ্ঠান-দিবসে হল-এ বিক্রয়!…আর একটি ঘোষণা, এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্রের বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-তৃতীয়াংশ দুঃস্থত্রাণ সমিতির হস্তে অৰ্পণ করা হইবে।

    মানুষ যে যথেষ্ট পরিমাণে হৃদয়বান তা এই প্রবেশপত্ৰ সংগ্রহের উদগ্র আগ্রহের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিনদিন আগেই উচ্চ মূল্যের টিকিট নিঃশেষিত, হল-এ বিক্রয়ের বিকল্পনার নির্বুদ্ধিতায় বিপর্যন্ত উদ্যোক্তারা পুলিসের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছেন।

    দুঃস্থদের জন্যে প্ৰাণ না কাঁদলে কি এতোটা হতো? নিন্দুকেরা হযতো অন্য কথা বলবে, কিন্তু নিন্দুকে কি না বলে? অন্য কথা বলাই তো তাদের পেশা। যাই হোক-দুঃস্থদের জন্যেই হোক, অথবা দুর্লভদের জন্যই হোক, সব টিকিট বিক্ৰী হয়ে গেছে।

    আর সে সংবাদ ঢাক পিটিয়ে প্রচার করাও হয়েছে।

    অতএব আশা করা অসঙ্গত নয় সামনের ওই সারিবদ্ধ আসনের সারির জমজমাট ভরাট ভরাট রূপ দেখতে পাওয়া যাবে।

    কিন্তু কোথায় সেই ভরাট রূপ?

    কোথায় সেই পূর্ণতার সমারোহ?

    আজকের সম্মেলনের প্রধান বক্তা সুবিখ্যাত অধ্যাপক চক্তপানি চট্টোপাধ্যায় তার বক্তৃতার মাঝখানে একবার দম নিয়ে হল-এর শেষপ্রান্ত অবধি তাকিয়ে দেখলেন। না, মানুষ নেই, শুধু চকচকে ঝকঝকে গদি আটা মূল্যবান আসনগুলি শূন্য হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে।

    কেবলমাত্র সামনের কয়েকখানি আসন, যাতে নাকি অতিথি ছাপমারা, তারা জনাকয়েক বিশিষ্ট অতিথিকে হৃদয়ে ধারণ করে বসে আছে। এদের হয়তো গাড়ি করে আনা হয়েছে, তাই এর সভার শোভা হয়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য সাংবাদিক, বাকি সব বিশিষ্ট নাগরিক। এরা এরা সভায় উপস্থিত ছিলেন বলে কাগজে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়, এরা হচ্ছেন তারা।

    চক্ৰপাণি এদের অনেককেই বেশ চেনেন, অনেকের মুখ চেনেন।

    কিন্তু এঁদের কাউকেই তো নবযুগের বাহক বলে মনে হচ্ছে না, তবে যুগের বাণী কাদের শোনাবেন চক্ৰপাণি?

    অথচ তার ভাষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যুগসাহিত্যে সত্য। অবশ্য সত্যি বলতে, ওই শিরোনামটার প্রকৃত অর্থ তাঁর কাছে তেমন প্রাঞ্জল মনে হয়নি, খুব ভালো বুঝতে পারেননি উদ্যোক্তারা আসলে ওই শব্দটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন, অথবা জনা তিন-চার মহা মহা সাহিত্যরথীদের ডেকে এনে তাদের কাছে কী শুনতে চেয়েছেন।

    তবু অধ্যাপকদের ভাষণের জন্য আটকায় না, যে কোনো বিষয়বস্তু নিয়েই তারা ঘন্টার পর ঘণ্টা সারগর্ভ ভাষণ দিতে পারেন। চক্ৰপাণি আবার শুধু অধ্যাপক নন, অধ্যাপকসাহিত্যিক! প্রৌঢ়ত্বের কাছে ছুঁই ছুঁই বয়েস, ছাত্রমহলে বিশেষ প্রতিভাজন (যেটা নাকি এ যুগে দুর্লভ) এবং পাঠক-মহলে আজও অম্লানজ্যোতি নায়ক। অতি আধুনিকদের প্রবল কলকল্লোলেও চক্ৰপাণির জয়জয়কার অব্যাহতই আছে। অস্তুতঃ তাঁর রচিত গ্রন্থের বিক্রয়-সংখ্যা দেখে তাই মনে হয়।

    কিন্তু বক্তৃতা-মঞ্চে দাঁড়ালে কেন সেই অগণিত ভক্ত-সংখ্যাকে দেখতে পাওয়া যায় না? কেন গোনাগুনতি কয়েকটা চেনা-মুখের পিছনে শুধু শূন্যতার অন্ধকার?

    অথচ ওই চেয়ারগুলির ন্যায্য মালিক আছে।

    এসেওছে তারা। শুধু ঝুটঝামেলা কতকগুলো বক্তৃতা শোনবার ভয়ে হল-এর বাইরে এদিক ওদিক ঘুরছে, ঝালমুড়ি অথবা আইসক্ৰীম খাচ্ছে, আড্ডা মারছে।

    তাছাড়া আরো আকর্ষণ আছে, গায়ক-গায়িকার সঙ্গে কিছু নায়ক-নায়িকার নামও ঘোষণা করা হয়েছে, যাঁরা নাকি দুঃস্থদের কল্যাণে বিনা দক্ষিণায় কিছু শ্রমদান করতে স্বীকৃত হয়েছেন। তারা যে শুধু অভিনয়ই করেন না, কণ্ঠসঙ্গীতেও সক্ষম, সেটা স্পষ্ট তাদের সামনে বসে দেখা যাবে। এখন কথা এই–সেই নায়ক-নায়িকারা অবশ্যই আকাশপথে উড়ে এসে মঞ্চাবতরণ করবেন না। গাড়ি থেকে নেমে প্ৰকাশ্য রাজপথ দিয়েই আসতে হবে তাঁদের। সেই অনবদ্য দৃশ্যের দর্শক হবার সৌভাগ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবে, এমন মুর্খ কে আছে!

    ওরা এসে প্রবেশ করলে উল্লাসধ্বনি দিয়ে তবে ভিতরে ঢোকা যাবে। টিকিটে সিট নম্বর আছে ভাবনা কি?

    প্ৰথম বক্তা চক্ৰপাণি বুদ্ধিমান হলেও অবস্থাটা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। বিরাট প্রেক্ষাগৃহের বিরাট শূন্যতার দিকে তাকিয়ে প্রতিষ্ঠানের সম্পাদককে ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছিলেন, আরম্ভ তো করবো, কিন্তু শুনবে কে? ফাকা চেয়ারগুলো?

    সম্পাদক সবিনয়ে বলেছিলেন, সবাই এসে যাবে স্যার।

    কিন্তু ওই আশ্বাসবাণীর মধ্যে আশ্বাস খুঁজে পাননি চক্ৰপাণি। কাজেই আবারও বলেছিলেন, আর কিছুটা অপেক্ষা করলে হতো না?

    শুনে সম্পাদক এবং স্থায়ী সহ-সভাপতি হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, আর দেরি করলে চলবে না স্যার! আপনাদের এই চারজনের ভাষণ সাঙ্গ হতে-হতেই তো সভার বারোটা বেজে যাবে। মানে সকলেই তো স্যার-ধরলে কথা থামায় কে? আপনার বক্তৃতাই যা একটু শোনবার মতো। বাকি সবাই-

    এ মন্তব্য অবশ্য খুবই নিম্নসুরে বলা হয়েছিল, উদ্যোক্তারা তো অভদ্র নয় যে চেঁচিয়ে কোনো মন্তব্য করে বসবেন।

    চক্ৰপাণির সন্নিকটে বসেছিলেন সাহিত্যিক মানস হালদার। তিনি আবার বিশিষ্ট একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদকও। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস নেই বলে খানকয়েক ফুলস্ক্যাপ কাগজের দুপিঠে খুদে খুদে অক্ষরে তাঁর বক্তব্য লিখে এনেছেন। তিনি উসখুস করে বলেন, তা আপনাদের কার্ডে লেখা রয়েছে ছটা। এখন পৌনে সাতটা পর্যন্তও-

    ব্যাপার কি জানেন স্যার-, সম্পাদক হাত কচলে বলেন, আর্টিস্টরা সব বড্ড দেরী করে আসেন কিনা। আর ওনাদের জন্যেই তো এত সেল। পয়সা খরচ করে সাহিত্য শুনতে কে অ্যাসে বলুন?

    না, না, ছেলেটা সাহিত্য বা সাহিত্যিকবৃন্দকে অবমাননা করবে মনস্থ করে বলেনি কথাটা। নেহাতই সারল্যের বশে সহজ কথাটা বলে বসেছে।

    মানস হালদার চাপা ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, তা হলে এই সাহিত্য সম্মেলনের ফার্স কেন?

    ছেলেটা এ প্রশ্নের উত্তরে সারল্যের পরাকাষ্ঠা দেখায়। অমায়িক গলায় বলে, তা যা বলেছেন। তবে কি জানেন, ফাংশানের খরচ তুলতে স্যুভেনির তো একটা বার করতেই হয়, আর তাতে নামকরা লেখকদের লেখা না থাকলে অ্যাডভার্টাইজমেণ্ট পাওয়া যায় না। কাজেকাজেই-মানে বুঝছেনই তো, আপনাদের লেখা নেবো। অথচ-ইয়ে একবার ডাকবো না এটা কেমন দেখায় না? তাই যাঁদের যাঁদের লেখা নেওয়া হয়েছে, বেছে বেছে শুধু তাদেরই ডাকা হয়েছে, দেখবেন লক্ষ্য করে। নচেৎ সাহিত্য নিয়েঃ বকবকানি শুনতে কার আর ভালো লাগে? কথা তো ঢের হয়েছে আমাদের দেশে, কাজের কাজ কিছু নেই, কেবল কথার ফুলঝুরি।

    ছেলেটা নিজেও যে অনেক ভালো ভালো কথা শিখেছে তার পরিচয় দিতে নিজেই ফুলঝুরির ঝুরি ছড়ায়, দেশ কোথায় যাচ্ছে বলুন! রুচি নেই, সভ্যতা নেই, সৌন্দর্যবোধ নেই, গভীরতা নেই, চিন্তাশীলতা নেই, কেবলমাত্ৰ কথার স্রোত ভাসছে। তাই স্যার আমাদের শশাঙ্কদা বলে দিতে বলেছেন, আপনাদের ভাষণগুলো একটু সংক্ষিপ্ত করবেন। ভারী মজার কথা বলেন উনি–, ছেলেটা একসার দাঁত বার করে নিঃশব্দে হেসে বলে, বললেন, ভাষণ সংক্ষিপ্ত না হলে শ্রোতারা সম্যকরূপে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আরো একটা কথা, আর্টিস্টদের গুমোর জানেন তো-একটু বসে থাকতে হলেই, অন্যত্র কাজ আছে বলে উঠে চলে যাবেন। একজন বিখ্যাত গায়িকা তো আবার গানের সময় সভায় কেউ একটি কথা বললেই উঠে চলে যান। শিল্পী তো! ভীষণ মুডি। বিগলিত হাস্যে ছেলেটি বলে, শেষ পর্যন্ত থাকবেন তো স্যার? শেষের দিকে ভালো আর্টিস্টদের রাখা হচ্ছে।

    কিন্তু তোমাদের সভানেত্রী?

    এসে গেছেন স্যার। মেয়েছেলে হলে কি হবে, খুব পাংচুয়াল। তা ওনাকে নিয়ে পড়েছে একদল কলেজের মেয়ে, অটোগ্রাফ খাতা এনেছে সঙ্গে করে। এই যে উইংস-এর ওদিকে। এসে বসে যাবেন, আপনি শুরু করে দিন না।

    চক্ৰপাণি বিরক্তভাবে বলেছিলেন, তাই কি হয়? সভার একটা কানুন আছে তো?

    আপনি তো বলছেন স্যার, এদিকে আমাদের যে মিনিটে মিনিটে মিটার উঠছে।

    মিটার উঠছে!

    অধ্যাপক–সাহিত্যিক সভয়ে এদিক–ওদিক তাকান।

    মিটার উঠছে? কিসের মিটার?

    আজ্ঞে এই হল-এর। ছেলেটি তার গুজগুঁজে কথার মধ্যেই একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলে, অনেক ধরে–করে কনসেশনেই পাঁচশো টাকা! ধরুন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা। দশটা বেয়ঙ্ক গেলেই–ঘণ্টা পিছু একস্ট্রা একশো টাকা। তা হলেই বলুন মিটার ওঠাটা ভুল বলেছি কিনা! আপনাদের এই সাহিত্যের কচকচি না থামতেই যদি আর্টিস্টরা কেউ কেউ এসে পরেন, কী অবস্থা হবে?

    ছেলেটা একদা চক্ৰপাণির ছাত্র ছিল, তাই এত অন্তরঙ্গতার সুর! কিন্তু ওই শিশুজনসদৃশ সরল অথচ গোঁফদাড়ি সম্বলিত দীর্ঘকায় প্রাক্তন ছাত্রটিকে দেখে চক্ৰপাণির স্নেহধারা উথলে উঠছে বলে মনে হল না। নীরস গলায় প্রশ্ন করেছিলেন, কেন, কী অবস্থা হবে?

    কী হবে সে কি আর আমি আপনাকে বোঝাবো স্যার? সময় নষ্ট হতে দেখলে অডিয়েন্স ক্ষেপে যাবে। কী রকম দিনকাল পড়েছে দেখছেন তো? ওই তো সভানেত্রী এসে গেছেন। তবে আর কি!

    তবে আর কি করা!

    মাইকের প্রথম বলি চক্ৰপাণি চট্টোপাধ্যায় যুগসাহিত্যে সত্য নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন।

    বলছিলেন, কিন্তু বার বার সামনের ওই শূন্য আসনের সারির দিকে তাকাচ্ছিলেন।…আর ভাবছিলেন, এ যুগের স্পষ্ট চেহারা কি তবে এই শূন্যবক্ষ প্রেক্ষাগৃহের মতো?

    তবে ভাবছিলেন বলে যে থেমে থেমে যাচ্ছিলেন তা নয়। একবারই শুধু থেমেছিলেন। তারপর আবার একটানা বলে চলেন–শিল্পী সাহিত্যিক কবি বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদ, এদের তাই আজ বিশেষ সঙ্কটের দিন। তাঁরাও আজ দ্বিধাগ্ৰন্ত। তারা কি চিরাচরিত সংস্কারের মধ্যেই নিমজ্জিত থেকে গতানুগতিক ভাবে সৃষ্টি করে যাবেন, যা নতুন নতুন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নতুন সত্য উদঘাটিত করবেন, এই প্রশ্ন আজ সকলের মধ্যে।

    গুটিগুটি দুটি তরুণ এসে ঢুকে পিছনের সারিতে বসেছিল, চাপা গলায় হেসে উঠে একজন অপরজনকে বলে উঠলো, লে হালুয়া! ওই সত্যটা কি আজব চীজ বল দেখি? সত্য সত্য কবে এতো মাথা খুঁড়ে মরে কেন দাদুরা?

    বাছাদের নিজেদের সব কিছুই ক্রমশঃ মিথ্যে হয়ে আসছে বলে বোধ হয়!

    দূর বাবা, এতোক্ষণ পরে এসে ঢুকলাম, তাও বসে বসে বক্তিমে শুনতে হবে? কৰ্তারা মধু পরিবেশনের আগে খানিকটা করে নিমের পাঁচন গেলায় কেন বল দিকি?

    ওই ফ্যাশান!

    চক্ৰপাণি তখনও বলে চলেছেন, এই যুগকে তবে কোন নামে অভিহিত করবো? অনুসন্ধানী যুগ? যে যুগ তন্নভন্ন করে খুঁজছে, যাচাই করছে কোথায় সেই অভ্রান্ত সত্য, যা মানুষকে সমন্ত মিথ্যা বন্ধন থেকে মুক্ত করে-

    আবার সেই সত্য! কালো রোগা ছেলেটা সাদা সাদা দাঁত বার করে হেসে অনুচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠে, সত্য মারা গেছে দাদু! তাকে খুঁজে বেড়ানো পণ্ডশ্রম!

    চক্ৰপাণি ভালো বলছেন, তথাপি অপর বক্তারা ঘন ঘন হাত উল্টে উল্টে ঘড়ি দেখছিলেন। মানস হালদার বেজার মুখে পকেটে হাত দিয়ে টিপে টিপে নিজের লিখিত ভাষণটি অনুভব করছিলেন আর বিড়বিড় করছিলেন, নাঃ, লোকটা দেখছি, একাই আর সকলের বারোটা বাজিয়ে দিলো। উদ্যোক্তাদের উচিত প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া। ওদেশে এরকম হয় না। সে একেবারে সামনে ঘড়ি রেখে কাজ! আমাদের দেশে? হুঁ!

    তা উদ্যোক্তাদের আছে সে শুভবুদ্ধি, তাদের একজন আস্তে পিছন থেকে এসে সবিনয়ে জানালেন, একটু সংক্ষেপ করবেন স্যার!

    সংক্ষেপ?

    চক্ৰপাশি ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে সামনের দিকে তাকালেন, সবে দুচারটি করে লোক এসে বসতে শুরু করেছে এবং সবে বক্তব্যের গোড়া বাঁধা হয়েছে, এখন কিনা সংক্ষেপের অনুরোধ?

    তবে তিনি নাকি আদৌ রগচটা নন, বরং কৌতুকপ্ৰিয়, তাই কৌতুকের গলায় একটি তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে বক্তব্যের উপসংহার করে দিলেন। কিন্তু তাঁর সেই বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণ মন্তব্যটি মাঠেই মারা গেল।

    বাইরে থেকে ঘরে তুমুল একটা হর্ষোচ্ছাসের ঢেউ খেলে গেল, এসে গেছেন! এসে গেছেন!

    কে এসে গেছেন?

    যার জন্যে এই তুমুল হর্ষ?

    আঃ, জিজ্ঞেস করবার কী আছে? ওঁকে না চেনে কে?

    উনি এসে গেছেন। পিছনে পিছনে ওঁর তবলচি।

    তারপর আরও এক নায়ক। তাঁর সঙ্গে এক নায়িকা।

    বলা বাহুল্য, এরপর আর সাহিত্য-বক্তৃতা চলে না। মানস হালদার, সিতেশ বাগচী এবং সভানেত্রী অনামিকা দেবী নিতান্তই অবাঞ্ছিত অতিথির মতো তাঁদের ভাষণ সংক্ষেপে শেষ করে নিলেন, মঞ্চাধিপতি সেই ভাইস প্রেসিডেন্ট তারস্বরে ঘোষণা করলেন, সাহিত্য-সভা শেষ হলো। এইবার আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। আপনারা অনুগ্রহ করে স্থির হয়ে বসুন।

    কিন্তু দোদুল্যমান পর্দার সামনে কে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে? দোদুল্যমান চিত্তের মৃদু গুঞ্জন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গদি একখানা পেলে আর কোনো মিঞাই ছাড়তে চান না। শেষক্ষণ পর্যন্ত গদি আঁকড়ে বসে থাকবো এই পণ। এই ভাষণ শুনতে এলেই আমার ওই গদি আঁকড়ানোদের কথা মনে পড়ে যায়।

    আহা বুঝছিস না, কে কতো পণ্ডিত, কার কতো চিন্তাশক্তি, বোঝাতে চেষ্টা করবে না?

    সবাইকে ওনাদের ছাত্র ভাবে, তাই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আর আশ মেটে না। কোন নতুন কথাটা বলবি বাবা তোরা! সেই তো কেবল লম্বা লম্বা কোটেশন! অমুক এই বলেছেন, তমুক এই বলেছেন! আরে বাবা, সে-সব বলাবলি তো ছাপার অক্ষরে লেখাই আছে, সবাই পড়েছে, তুই কী বলছিস তাই বল?

    পর্দার ওপারে তখন জুতো খুঁজতে খুঁজতে অধ্যাপক-সাহিত্যিক ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেছিলেন, এতোক্ষণ অসংস্কৃতির আসর চলছিল সেটা শেষ হলো, এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আরম্ভ। সংস্কৃতির বেশ একখানা প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা বেরিয়েছে দেশে! সংস্কৃতি মানে নাচ গান! কী বলুন অনামিকা দেবী?

    অনামিকা দেবীর চটি যথাস্থানেই পড়ে আছে, তিনি অতএব আত্মস্থ গলায় বলেন, তাই তো দেখি আর আশ্চৰ্য হই, কে যে এই নতুন ব্যাখ্যার ব্যাখ্যাকার।

    কে আর! এই ফাংশানবাজরা!

    মানস হালদারের জুতোটা মঞ্চে ওঠার বাঁশের সিঁড়িয়ে নীচে ঢুকে পড়েছিল, তিনি সেটা টেনে যার করতে করতে কঠিন-পেশী-পেশী-মুখে বলেন, এই ফাংশানবাজরাই দেশের মাথা খেলো! কী পাচ্ছি আমরা ছেলেদের কাছে? আমাদের পরবর্তীদের কাছে? হয় পলিটিক্স, নয় ফাংশান! কোনো উচ্চ চিন্তা নেই, উচ্চ আদর্শ নেই, সুস্থ একটা কর্মপ্রচেষ্টা নেই, শুধু রাস্তায় রাস্তায় রকবাজি! নাঃ, এ ছাড়া আর কিছুই পাচ্ছি না আমরা ছেলেদের কাছে।

    অনামিকা দেবী এই সব প্ৰবলদের সঙ্গে তর্ক করতে ভয় পান। জানেন এদের প্রধান অস্ত্ৰই হবে প্ৰাবল্য। অনামিকা দেবীর সেখানে তাই হার। ওঁর প্রশ্নে শুধু মৃদু হাসেন।

    উত্তরটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।

    আমরা ওদের কাছে কিছুই পাচ্ছি না। ঠিক। কিন্তু ওরাই বা আমাদের কাছে কী পাচ্ছে?

    আদর্শ? আশ্রয়? সভ্যতা? সত্য?

    ওরা নেমে এসে সামনের সারিতে নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। অস্তুতঃ দুএকটি গান শুনে না গেলে ভালো দেখায় না।

    যদিও ভালো গানের আশা দুরাশা।

    প্ৰথমে শুধু দায়েপড়ে নেওয়া গায়কদের গান। হয় এরা বেশী টাকা দিয়েছে, অথবা এরা উদ্যোক্তাদেরই কেউ। সারমেয়র সামনে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে রেখে তাকে ছুটিয়ে নেওয়ার মতো, ভালো আর্টিস্টদের শেষের জন্যে ঝুলিয়ে রেখে এইগুলি পরিবেশিত হবে একটির পর একটি।

    দশটা বেজে যাবে?

    যাক না।

    বারোটা বাজিলেই বা কী! ঘণ্টা পিছু একশো টাকা বৈ তো নয়! পুষিয়ে যাবে।

    প্রধান অতিথি সভানেত্রীকে উদ্দেশ করে চাপা গলায় ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন, এতে মিটার ওঠে না, দেখছেন?

    হাসলেন অনামিকা দেবী, দেখছি তো অনেক কিছুই।

    সত্যি দেখছেন তো অনেক কিছুই!

    তার ভূমিকাটাই তো দর্শকের।

    .

    অনুষ্ঠান-উদ্যোক্তারা তাঁদের সাহিত্যসভার সভানেত্রী ও উদ্বোধককে সসম্মানে ট্যাক্সিতে তুলে দিলেন। তুলে দিলেন তাদের মালা আর ফুলের তোড়া। তারপরে প্রায় করজোড়ে বললেন, অনেক কষ্ট হলো আপনাদের।

    কথাটা বলতে হয় বলেই বললেন অবশ্য, নইলে মনে মনে জানেন কষ্ট আবার কি? গাড়ি করে নিয়ে এসেছি, গাড়ি চড়িয়ে ফেরত পাঠাচ্ছি, বাড়তির মধ্যে মঞ্চ দিয়েছি মাইক দিয়েছি, একরাশ শ্রোতার সামনে বসে ধানাই-পানাই করবার সুযোগ দিয়েছি, আরামসেই কাটিয়ে দিলে তোমরা এই ঘণ্টা দুই-তিন সময়। কষ্ট যা তা আমাদেরই। কন্যাদায়ের অধিক দায় মাথায় নিয়ে আমরা তোমাদের বাড়িতে বার বার ছুটেছি, মাথায় করে নিয়ে এসেছি, ঘাড়ে করে নিয়ে যাচিছ।

    তবু সৌজন্যের একটা প্ৰথা আছে, তাই ওঁরা হাত কচলে বললেন, আপনাদের খুব কষ্ট হলো।

    তা এরাও সৌজন্যের রীতি পদ্ধতিতে অজ্ঞ নয়। তাই বললেন, সে কি সে কি, কষ্ট বলছেন কেন? বড় আনন্দ পেলাম।

    আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি রয়ে গেছে, ক্ষমা করবেন।

    আ ছি ছি, এ কী কথা। না না, এসব বলে লজ্জা দেবেন না।

    আচ্ছা নমস্কার-যাবো আপনার কাছে। এটা মানস হালদারের উদ্দেশ্যে, কারণ তিনি একটা কাগজের সম্পাদক।

    আচ্ছা নমস্কার—

    গাড়িটা কারো ঘরের গাড়ি হলে হয়তো এই সৌজন্য-বিনিময়ের পালা আরও কিছুক্ষণ চলতো, ট্যাক্সি-ড্রাইভারের অসহিষ্ণুতায় তাড়াতাড়ি মিটলো। গাড়ি ছেড়ে দিলো।

    পিঠে ঠেস দিয়ে গুছিয়ে বসলেন সভানেত্রী অনামিকা দেবী, আর উদ্বোধক মানস হালদার।

    প্রধান অতিথি চক্ৰপাণি চট্টোপাধ্যায়?

    না, তিনি এসব সৌজন্য বিনিময়ের ধার ধারেননি, নিজের গাড়িতে বাড়ি চলে গেছেন একটা মাত্র গান শুনেই। এঁরা দুজন গাড়িহীন, এবং একই অঞ্চলের অধিবাসী, কাজেই একই গতি।

    মানস হালদারের যত্ন সহকারে লেখা ফুসস্ক্যাপ কাগজের গোছা অপঠিত অবস্থায় পকেটে পড়ে আছে সময় সংক্ষেপের আবেদনে যা হোক কিছু বলে সারতে হয়েছে, মনের মধ্যে সেই অপঠনের উষ্মা! যদিও নিজে তিনি একটা সাপ্তাহিকের সম্পাদক, কাজেই শ্রমটা মাঠে মারা যাবার ভয় নেই, স্বনামে বেনামে বা ছদ্মনামে পত্ৰস্থ করে ফেলবেন সেটাকে, তবু মাইকে মুখ দিয়ে দশজন সুধীবৃন্দের সামনে ভাষণ দেওয়ার একটা আলাদা সুখ আছে। সে সুখটা থেকে তো বঞ্চিত হলেন।

    গাড়িটা একটু চলতেই মানস হালদার ক্ষোভতপ্ত স্বরে বলে ওঠেন, এরা সব যে কেনই পায়ে ধরে ধরে ডেকে আনে। আসল ভরসা তো আর্টিস্টরা।

    অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, ওদের দোষ কি? জনগণ যা চায়-

    তা সে শুধু ওদের ডাকলেই হয়, সাহিত্য কেন?

    প্রোগ্রামও তেমনি লম্বা। একাসনে ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, ইন্দ্ৰ চন্দ্র বরুন বায়ূ সবাইকে বসানো চাই। এক ক্ষুরে সবাইয়ের মাথা মুড়োবে, এক তলওয়ারে সবাইয়ের গর্দান নেবে। গোড়ায় যে গায়কদের বসিয়ে দিয়েছে, তারা কী বলুন তো?

    অনামিকা দেবী ওঁর উত্তেজনায় কৌতুক অনুভব করেন, মৃদু হাসির সঙ্গে বলেন, আহা ওই ভাবেই তো নতুনরা তৈরি হবে।

    তৈরি? মানস হালদার মনের ঝাঁজকে মুক্তি দিয়ে বলে ওঠেন, ওই দাঁত উঁচু  ছেলেটা জীবনেও তৈরি হবে বলে আপনার বিশ্বাস?

    এসব কথার উত্তর দেওয়া বড় মুশকিল। নেহাৎ সৌজন্যের জন্যে একটু সায় দিয়ে বসলেই হয়তো পরে তাঁর কানে ফিরে আসবে, তিনিই নাকি নতুনদের বেজায় অবজ্ঞা করেন এবং ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে কড়া সমালোচনা করেছেন। এ অভিজ্ঞতা আছে অনামিকা দেবীর। যে প্রসঙ্গের মধ্যে তিনি হয়তো এতটুকু সায় দেওয়ার কথা উচ্চারণ করেছেন, সেই প্রসঙ্গের পুরো বক্তব্যের দায়িত্বই তার উপরে বর্তেছে।

    অমুক এসে অন্য এক অমুকের কথা তার কাছেই পেশ করে গেছেন। দেখতে দেখতে ক্ৰমশঃ সাবধান হয়ে গেছেন অনামিকা দেবী।

    তাই মৃদু হেসে বর্লেন, অবিশ্বাসেরও কিছু নেই, অভ্যাসে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়।

    মানস হালদার ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, এটা আপনার এড়িয়ে যাওয়া কথা। আমরা অনেক জ্বালায় জ্বলি, কাজেই আপনাদের মতো অতো ভদ্রতা করে কথা বলে উঠতে পারি না। জানেন বোধ হয়, একটা কাগজ চালাই? উইকলি! নতুন লেখক-লেখিকাদের উৎসাহের প্রাবল্যে জীবন মহানিশা। কী বলবো আপনাকে, সাহিত্য জিনিসটা যে ছেলেখেলা নয়, তার জন্যে যে অভ্যাস দরকার, চেষ্টা ও নিষ্ঠা দরকার, তা মানতেই চায় না। একটা লিখলো, তক্ষুনি ছাপাবার জন্যে নিয়ে এলো …আমাদের কী? সব ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে চালান করে দিই-

    কিন্তু, অনামিকা দেবী বলেন, ওর মধ্যে সম্ভাবনার বীজও থাকতে পারে তো? একেবারে না দেখে–

    কী করা যাবে বলুন? বস্তা বস্তা লেখা জমে উঠছে দপ্তরে। দেশসুদ্ধ সবাই যদি সাহিত্যিক হয়ে উঠতে চায়-

    তবু লেখক তৈরি করা, নতুন কলমকে স্বাগত জানানো সম্পাদকেরই ডিউটি।

    ওসব সেকালের কথা অনামিকা দেবী, যেকালে নতুনদের মধ্যে নম্রতা ছিল, ভব্যতা ছিল, প্রতীক্ষার ধৈর্য ছিল। আর একালে? একটুতেই অধৈৰ্য, নিজের প্রতি অগাধ উচ্চ ধারণা, এবং শুধু লেখা ছাপা হবার আনন্দেই বিগলিত নয়, সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণার প্রত্যাশা! নাঃ, দেশের বারোটা বেজে গেছে!

    বলে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মোছেন মানস হালদার।

    ভদ্রলোক অল্পেই উত্তেজিত হন, তা বোঝা গেল।

    অনেকেই হয়। দেখে কৌতুক লাগে।

    অনামিকা দেবী কখনোই খুব বেশী উদ্বেলিত হন না, হন না খুব বেশী উত্তেজিত।

    কিছুক্ষণ আগেই যে বলেছিলেন, আমাদের ভূমিকাটাই তো দর্শকের, সেটা হয়তো কেবলমাত্ৰ কথার কথাই নয়। প্রায় দর্শকের নির্লিপ্ত মন নিয়েই জীবনটাকে দেখে আসছেন তিনি।

    হয়তো তাঁর এ প্রকৃতি গড়ে ওঠার পিছনে তাঁর মায়ের প্রকৃতি কিছুটা কাজ করেছে। অর্থাৎ মায়ের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত।

    বড় বেশী আবেগপ্রবণ ছিলেন অনামিকা দেবীর মা সুবৰ্ণলতা, বড় বেশী স্পর্শকাতর। সামান্য কারণেই উদ্বেলিত হতেন তিনি, সামান্যতেই উত্তেজিত।

    তার মানে সেই সামান্যগুলি তার কাছে সামান্য ছিল না। সংসারের অন্য আর সকলকে যা অনায়াসেই সয়ে নিতে পারে, তিনি তার মধ্যে থেকে কুশ্রীতা দেখে বিচলিত হতেন, রুচিহীনতা দেখে পীড়িত হতেন। মানুষের নীচতা ক্ষুদ্রতা হীনতা দৈন্য তাঁকে যেন হাতুড়ির আঘাত হানতো, সেই আঘাতে চুর্ণ হতেন তিনি।

    অনামিকা দেবীর বয়েস যখন নিতান্তই তরুণী, তখন মা মারা গেছেন, তবু তখনই তিনি মায়ের এই মুঢ়তায় দুঃখবোধ করতেন। মায়ের ওই সদা উদ্বেলিত বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া চিত্তের দিকে তাকিয়ে করুণাবোধ করতেন, বুঝতে পারতেন না সাধারণ ঘটনাগুলোকে এতো বেশী মূল্য কেন দেন তিনি।

    পরে বুঝেছেন, মানুষ সম্পর্কে মার বড় বেশী মূল্যবোধ ছিল বলেই এত দুঃখ পেয়েছেন! পৃথিবীর কাছে বড় বেশী প্রত্যাশা ছিল অনামিকা দেবীর মার, মানুষ নামের প্রাণীদের তিনি মানুষ শব্দটার সংজ্ঞার সঙ্গে মিলোতে বসতেন।

    এই ভুল অঙ্কটা কষতে বসে জীবনের পরীক্ষায় শুধু ব্যর্থই হয়েছিলেন মহিলা, আর পৃথিবীর আঘাতে চূৰ্ণ হয়ে যাওয়া সেই প্রত্যাশার পত্ৰখানার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে নিজেও চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন; মাকে বুঝতে পেরেছিলেন অনামিকা।

    আর সেই চুৰ্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য থেকেই এই পরম শিক্ষাটি অর্জন করেছেন অনামিকা, মানুষ সম্পর্কে ভুল অঙ্ক কষতে বসেন না তিনি।

    কী হলো অনামিকা দেবী? আপনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন যে? বললেন মানস হালদার। নতুন লেখকদের সম্পর্কে আপনার যেন বেশ মমতা রয়েছে মনে হচ্ছে। তা থাকতে পারে, তাদের মুখোমুখি তো হতে হয়নি কখনো?

    অনামিকা দেবী বলেন, তাই হবে হয়তো। মুখোমুখি হতে হলে, বোধ হয় আপনাদের জন্যই মমতা হতো!

    হ্যাঁ, তাই হতো।–, দৃঢ়স্বরে বললেন মানস হালদার। তারপর বললেন, তা ছাড়া আজকালকার কবিতার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারি না, ওর আর বিচার করবো কি? নির্বিচারে বাতিক করে দিই।

    আপনার কাগজে কবিতা দেন না?

    দেব না কেন? নিয়মমাফিক দুটো পৃষ্ঠা কবিতার জন্যে ছাড়া থাকে, যাঁদের নামটাম আছে তারা সাপ ব্যাঙ যা দেন চোখ বুজে ছেপে দিই।

    অনামিকা ঈষৎ কৌতুকের গলায় বলেন, শুনে ভরসা পেলাম। ভবিষ্যতে যদি সাপ ব্যাঙ লিখতে শুরু করি, তার জন্যে একটা জায়গা থাকলো।

    মানস হালদার নড়েচড়ে বসলেন, আপনার সম্পর্কে এটা বলা যায় না, আপনার লেখা কখনো হতাশ করে না।

    কি জানি আপনাদের করে কি না-অনামিকা বলেন, তবে আমাকে করে-

    আপনাকে করে? অর্থাৎ?

    অর্থাৎ কোনো লেখাটাই লিখে শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারি না। মনে হয় যা বলতে চেয়েছিলাম, তেমন করে বলতে পারিনি।

    ওটাই তো আসল শিল্পীর ধর্ম-মানস হালদার বোধ করি মহিলাকে সান্ত্বনা দান করতেই সোৎসাহে বলেন, সত্যিকার শিল্পীরা কখনোই আত্মসন্তুষ্টির মোহে আপনি কবর খোড়েন না। আপনি যথার্থ শিল্পী বলেই–

    আরো সব অনেক ভালো ভালো কথা বললেন মানস হালদার, যা নাকি অনামিকাকে প্রায় আকাশে তুলে দেওয়ার মত। অনামিকা অস্বস্তি অনুভব করেন, অথচ না না, কী যে বলেন গোছের কথাও মুখে যোগায় না, অতএব মানস হালদারের গন্তব্যস্থল এসে গেলে হাঁফ ফেলে বাঁচেন। বাকি পথটুকু একা হবেন, নিজেকে নিয়ে একটু একা থাকতে পাওয়া কী আরামের!

    নমস্কার বিনিময়ের পর নেমে যান মানস হালদার।

    অনামিকা পিঠ ঠেসিয়ে ভাল করে বসেন, আর আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে হারিয়ে যান যেন।

    কিন্তু শুধুই কি মায়ের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত থেকেই অনামিকার প্রকৃতির গঠন? বকুলের কাছ থেকেও কি নয়? বকুলের মধ্যেও কি আবেগ ছিল না? ছিল না মোহ, বিশ্বাস, প্ৰত্যাশা? মার মত তীব্রভাবে না হোক, সুষমার মূর্তিতে?

    বকুলের সে মোহ, সে বিশ্বাস, সে প্রত্যাশা টেকেনি।

    বকুল অতএব অনামিকা হয়ে গিয়ে আবেগ জিনিসটাকে হাস্যকর ভাবতে শিখেছেন।

    তবু সেই সুষমাটুকু?

    সেটুকু কি একেবারে হারিয়ে গেছে?

    বকুলের সেদিনের সেই মূর্তিটা দেখলে তো তা মনে হয় না। বকুল যেন সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সেই সুষমাটুকুকে মনের মধ্যে আগলে রেখেছিল।

    সেই সেদিন, যেদিন পারুল ও–বাড়ি গিয়ে বলেছিল, মা নেই, বাবারও খেয়াল নেই, তাই আমিই বলতে এলাম জেঠাইমা, বিয়েটার আর দেরি করবার দরকার কি?

    নির্মলের জেঠাইমা আকাশ থেকে পড়ে বলেছিলেন, কার বিয়ের কথা বলছিস রে পারু?

    পারুল জানতো এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হবে তাকে, তাই পারুল স্থির গলায় বলেছিল, আমি আর কার বিয়ের কথা বলতে আসবো জেঠাইমা, বকুলের কথাই বলছি!

    জেঠাইমার পাশে নির্মলের মা বসেছিলেন, তার চোখমুখে একটা ব্যাকুল অসহায়তা ফুটে উঠেছিল, তিনি সেই অসহায়-অসহায় মুখটা নিয়ে প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন বড় জায়ের দিকে। কিন্তু বড় জা তার দিকে তাকিয়ে দেখেননি। তিনি পারুলের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে উদাস গলায় বলেছিলেন, তা সে আর আমরা পাড়াপড়শীরা কী করবো বল মা? তোর বাবা তো আমাদের পোছেও না!

    বাবা তো বরাবরই ওই রকম জেঠাইমা, দেখছেন তো এতকাল। কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে বসে থাকলে চলবে না? মা নেই, বৌদিদের কথাও না বলাই ভালো, বকুলটাকে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আমি শান্ত হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে পারি।

    হ্যাঁ, এইভাবেই বলেছিল পারুল।

    বোধ হয় নিজের বুদ্ধির আর বুদ্ধি-কৌশলের উপর বেশ আস্থা ছিল তার, ভেবেছিল একেবারে এইভাবেই বলবো, আবেদন-নিবেদনের বিলম্বিত পথে যাবো না। কিন্তু কতো ভুল আস্থাই ছিল তার!

    জেঠাইমা এবার বোধ করি আকাশেরও ঊর্ধ্বতর কোনো লোক থেকে পড়লেন। সেই আছড়ে পড়ার গলায় বললেন, তোর কথা তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না পারুল! আমাদের কাছে রেখে যাবি বকুলকে? তোর মানী বাবা সে প্রস্তাবে রাজী হবে? নচেৎ আমাদের আর কি, মা-মরা সোমত্ত মেয়েরা যেমন মাসী পিসির কাছে থাকে, থাকতো আমাদের কাছে।

    পারুল তথাপি উত্তেজিত হয়নি, পারুল বরং আরো বেশী ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, এ ধরনের কথা কেন বলছেন জেঠাইমা? আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারেননি, বকুলের বিয়ের কথা আপনার কাছে বলতে এসেছি কেন?

    জেঠাইমা বিরস গলায় বলেছিলেন, এর আবার সত্যি-মিথ্যে কি তা তো বুঝছি না পারু! হেঁয়ালি বোঝবার চেষ্টার বয়েসও নেই। তোমাদের মা আমাকে বড় বোনের তুল্য মান্যভক্তি করতো, আমাদের কাছে একটা পরামর্শ চাইতে এসেছে এটাই বুঝছি। এ ছাড়া আর কি তা তো জানি না।

    নির্মলের মা এই সময় একটুখানি চাপা ব্যাকুলতায় অস্ফটে বলে উঠেছিলেন, দিদি!

    দিদি সেই অস্ফুটের প্রতি কান দেননি।

    হয়তো সমাজের চাকা আজ এমন উল্টো গতিতে ঘোরার কারণই ভই কান না দেওয়া। যাঁরা ক্ষমতার আসনে বসেছেন, গদির অধিকার পেয়েছেন, তারা এই অস্ফুট ধ্বনির দিকে কান দেওয়ার প্রয়োজন বিবেচনা করেননি। তারা আপন অধিকারের সীমা সম্পর্কে সচেতন থাকেননি, অস্ফুটকে দাবিয়ে রেখে শাসনকাৰ্য চালিয়ে যাওয়ার নীতি বলবৎ রেখেছেন, আজ আর তাই সেই অস্ফুটের ভূমিকা কোথাও নেই। আজ সর্বত্র প্রচণ্ড কল্লোল। সেই কল্পোলে, সেই তরঙ্গে ভেসে গেছে উপরওলাদের গদি, ভেসে গেছে তাঁদের শাসনদণ্ড। নির্বাক অসহায় দৃষ্টি মেলে সেই কল্লোলের দিকে তাকিয়ে আছেন এখন উপরওলারা। হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের আশা আর নেই। শুধু যে কেবলমাত্র গুরুজন, এই পদমর্যাদায় যা খুশি করা আর চলবে না তাই নয়, যারা এসে বসলো গদিতে, সেই লঘুজনদের কাছে মৌন হয়ে থাকতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষা হয়তো এই নিয়মেই চলে। কিন্তু নির্মলের মায়ের দল নিহত হলো মধ্যবতী যুদ্ধে।

    অতএব তখন তার ক্ষমতায় ওই দিদি ডাকটুকু ছাড়া আর কিছু কুলোতো না। আর এখন-নাঃ, এখনের কথা থাক।

    তখন দিদি সেদিকে তাকালেন না।

    দিদি বললেন, দুধ চড়িয়ে আসোনি তো ছোটবৌ?

    ছোটবৌ মাথা নাড়লেন।

    ছোটবৌ পারুলের দিকে তাকাতে পারছিলেন না বলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

    পারুল বললে, আমারই ভুল হয়েছিল জেঠাইমা, এভাবে বললে আপনি খেয়াল করতে পারবেন না সেটা খেয়াল করতে পারিনি। স্পষ্ট করেই বলি-নির্মলদার সঙ্গে বকুলের বিয়ের কথা বলতেই আমার আসা। অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে বকুল। নির্মলদাও তো কাজকর্ম করছে——

    জেঠাইমা পারুলকে সব কথাগুলো বলে নেবার সময় দিয়েছিলেন। তারপর সবটা শোনার পর মুখে একটি কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস ছিল তোমার একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, তা দেখছি সে বিশ্বাস ভুল। সাহেব বরের ঘর করে মেমসাহেব বনে গিয়েছ। নির্মলের সঙ্গে বকুলের বিয়ে? পাগল ছাড়া এ প্রস্তাব আর কেউ করবে না পারু!

    কিন্তু কেন বলুন তো? পারুল শেষ চেষ্টাটা করেছিল, হেসে বলেছিল, আপনাদের ওই রাঢ়ী-বারেন্দ্ৰ গাইগোত্র? ওসব আর আজকাল ততো মানে না।

    জেঠাইমা সংক্ষেপে বলেছিলেন, আমরা আজকালের নই পারু।

    নির্মলের মা এই সময় একটা কথা বলে ফেলেছিলেন। অস্ফুটেই বলেছিলেন অবশ্য, পারুর বাবাদের ঘর তো আমাদের উঁচু  দিদি!

    জেঠাইমা ছোট জায়ের দিকে একটি কঠোর ভর্তসনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেছিলেন, তুমি থাম ছোটবৌ! উঁচু -নীচুর কথা নয়, কথাটা রীতিনীতির। যাকগে, অলীক কথা নিয়ে বৃথা গালগল্প করবার সময় আমাদের নেই পারু। তাছাড়া তোমার ওই ধিঙ্গী অবতার বোনটি স্বঘরের হলেও আমি ঘরের বৌ করতাম না বাছা, তা বলে রাখছি। একটা পরপুরুষ বেটাছেলের সঙ্গে যখন তখন ফুসফুস গুজগুজ, তাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা, এসব মেয়েকে আমরা ভাল বলি না।

    পারুলের মুখটা যে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে, সেটা পারুল নিজে নিজেই অনুভব করেছিল, এবং আর একটি কথাও যে বলবার ক্ষমতা ছিল না তার তখন তাও বুঝেছিল। পারুল নিঃশব্দে উঠে এসেছিল।

    তবু বেচারা পারুল তার একান্ত মোহপাত্রটির জন্যে আরও কষ্ট করেছিল। গলির মোড়ে নির্মলকে ধরেছিল। বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা আছে নির্মলদা!

    নির্মল খতমত নেয় বললে, কী কথা?

    পথে দাঁড়িয়ে হবে না সে-কথা, এসো একবার।

    আচ্ছা আগে দেখ, আমাদের জানলায় কেউ আছে কিনা?

    পারুল নিষ্পলকে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, থাকলে কী হয়?

    ওই দৃষ্টিতে বোধ করি অপ্রতিভ হয়েছিল নির্মল। বলেছিল, না, হবে আর কি! তবে জেঠিমাকে তো জানো। দেখতে পেলেই এখুনি জিজ্ঞেস করতে বসবেন, কেন, কী বৃত্তান্ত, ওখানে কী কাজ তোর?

    পারুলের মুখে একটু হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল। পারুল আস্তে আস্তে বলেছিল, থাক, আর কোন কথা নেই তোমার সঙ্গে। কথা আমার হয়ে গেছে।

    নির্মল কোঁচার খুঁটে মুখ মুছতে মুছতে অবাক গলায় বলেছিল, কথা হয়ে গেছে? কোন কথা?

    পারুল একটু বিচিত্ৰ হাসি হেসে বলেছিল, তুমিও দেখছি তোমার জেঠাইমার মত। বিশদ করে না বললে একটুও বুঝতে পারো না। যাক-তাই বলি-বলছিলাম, বাঁড়ির অমতে বিয়ে করবার সাহস আছে তোমার? অথবা বাড়ির অমতকে স্বমতে আনবার শক্তি?

    নির্মল মাথা নীচু করেছিল।

    নির্মল অকারণেই আধার কপালের ঘাম মুছেছিল। তারপর অস্ফুট বলেছিল, তা কী করে হয়?

    হয় না, না?

    নির্মল আবেগরুদ্ধ গলায় বলে উঠেছিল, শুধু মা-বাবা হলে হয়তো আটকাতো না পারুল, কিন্তু জেঠাইমা–? ওঃ, ওঁকে রাজী করানো অসম্ভব?

    তা অসম্ভবই যখন, তখন আর বলবাঁর কি আছে? পারুল হেসে উঠে বলেছিল, যাও, আর তোমায় আটকাবো না। জেঠাইমা হয়তো তোমার দুধ গরম করে নিয়ে বসে আছেন!

    নির্মলের মুখটাও লাল হয়ে উঠেছিল।

    আর বড় বেশী ফর্সা রং বলে খুব বেশী প্রকট হয়ে উঠেছিল।

    নির্মল বলেছিল, তুমি আমায় ঠাট্টা করছ পারুল, কিন্তু ওদের অবাধ্য হব, এ আমি কল্পনাও করতে পারি না।

    ওঁদৈর বলছে কেন? তোমার মা-বাবার তো অমত নেই!

    তাতে কোন ফল নেই পারুল। জেঠাইমার ওপর কথা কইবার ক্ষমতা কারুর নেই।

    ওরে বাবা, তাহলে তো আমারও কোনো কথাই নেই।–, পারুল হঠাৎ খুব কৌতুকের গলায় হেসে উঠেছিল।

    বলেছিল, কিন্তু একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলে ভাই, জেঠাইমার কাছে অনুমতি না নিয়ে পাড়ার মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম-ট্রেম করা ঠিক হয়নি। তাহলে সে মেয়েটা মরতো না।

    আমিও বেঁচে নেই পারুল-, হঠাৎ নির্মলের চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। কোঁচার কাপড় দিয়ে সেই জলটুকু মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল নির্মল, আমার মনের অবস্থা বোঝাবার ক্ষমতা তোমাদের কারুরই নেই পারুল।

    পারুলের কি সেই দিকে তাকিয়ে মমতা হয়েছিল?

    না।

    পারুল বড় নির্মম!

    পারুলের ঘৃণা হয়েছিল। পারুল বলেছিল, মাটির পুতুল।

    কিন্তু বকুলের মনে ওই মাটির পুতুলটার জন্যে অনেকখানি মমতা ছিল। সুষমায় মোড়া সেই মমতাটুকু ৰকুলের কোনো একখানে রয়ে গেছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }