Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প547 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২৪. নমিতার জীবনে নাটক ছিল না

    নমিতার জীবনে নাটক ছিল না, নমিতা এক দীনহীন পরিচয়ের মধ্যে অতি সাধারণ জীবন বহন করছিল, নমিতার প্রাপ্তির ঘর ছিল শূন্য। তাই নমিতার মধ্যে থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল, দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠেছিল সেই প্রতিবাদ, তাই নমিতা আকস্মিক এক নাটকীয়তায় মোড় নিয়ে ওর জীবনটাকেই নাটক করে তুললো, কিন্তু অনেক প্রাপ্তির গৌরর বহন করে আলোকোজ্জ্বল মঞ্চেই যাদের ঘোরাফেরা, তাদের মধ্যে থেকেও প্রতিবাদ ওঠে কেন?

    পারুলের ছোট ছেলে শোভনের বৌ রেখার স্বামী তো তার সম্পত্তির ট্যাক্স খাজনা দিতে কসুর করেনি! তবু সে তার সম্পত্তিকে হাতে রাখতে পারছে না। দশ বছরের বিবাহিত জীবনযাপনের পর রেখা হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে, এই ফাঁকিতে ভরা দাম্পত্যজীবন বহনের কোনো মানে হয় না।

    অথচ এযাবৎ সকলেই দেখেছে আর জেনেছে, ওদের সেই জীবন একেবারে ভরাভরন্ত। তাতে ফাঁকই বা কোথায়, ফাঁকিই বা কোথায়?

    উপরওলা-মুক্ত সংসার, সুখী পরিবার, বশংবদ স্বামী, বিনীত ভৃত্য, অগাধ প্রাচুর্য, অবাধ স্বাধীনতা, ছবির মত বাড়ি, সাহেববাড়ির মত ড্রইংরুম, ফুলে ভরা বাগান, ফুলের মত ছেলেমেয়ে, অনুরক্ত প্রতিবেশী, পদমর্যাদায় সমৃদ্ধ স্বামীর অনুগত অধস্তনের দল, এক কথায় যে কোনো মেয়ের ঈর্ষাস্থল এই জীবনে মণ্ডিত রেখা নামের মহিলাটি তো একেবারে পাদপ্রদীপের সামনে বিরাজ করেছে এতদিন-ঝলমলে মূর্তিতে। রেখার চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, দৃষ্টি ভঙ্গিমায়, ঠোঁটের বঙ্কিমরেখায় উচ্ছ্বসিত হয়েছে সেই ঝলমলানির ছটা, হঠাৎ এ কী?

    জীবনভার নাকি দুর্বহ হয়ে উঠেছে তার! যে স্বামীর সঙ্গে তার চিন্তায়-ভাবনায়, ইচ্ছায় বাসনায়, রুচিতে-পছন্দে কোনোখানে মিল নেই, সে স্বামীর সঙ্গে একত্রে বসবাস তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

    পারুল ছেলের পরাজিত পর্যন্ত মুখের দিকে একটুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, তুই ঠাট্টা করছিস না তো শোভন।

    সেটা হলে আমার পক্ষে ভালো হতো অবশ্যই, শোভন আস্তে বলে, কিন্তু হঠাৎ তোমার সঙ্গে এমন ঠাট্টা করতে আসবো কেন বল? ছেলেটাকে তোমার কাছে রাখতে এলাম, মেয়েটাকে ছাড়লো না। হোক সেটা বাপ-মরার মত মামার বাড়িতে মানুষ।

    পারুল মনে মনে কেঁদে উঠে বলে, তার মানে তোকে দুজনকেই ছেড়ে থাকতে হবে?

    তাছাড়া উপায় কি?

    পারবি?

    প্রশ্নটা করে ফেলে পারুল, কিন্তু করেই লজ্জিত হয়, সত্যি না পারা শব্দটার কি কোন অর্থ আছে? মানুষ কী না পারে?

    সেই প্রশ্নটাই করে শোভন, না পারা শব্দটার কোনো মানে আছে মা?

    তা বটে। কিন্তু,ঈষৎ দ্বিধায় থেমে পড়ে অবশেষে মনে জোর করে বলে ফেলে পারুল, তোদের কি তাহলে ছাড়াছাড়িটা পাকা হয়ে গেছে শোভন?

    বেপরোয়া পারুলেরও ‘ডিভোর্স’ শব্দটা মুখে আটকায়। সন্তানের বিধ্বস্তু মুখ বড় গোলমেলে জিনিস।

    শোভন অদ্ভুত একটু হেসে বলে, পাকাপাকি? না কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছয়নি এখনো, এক্ষুনি ওঠাতে গেলে অসুবিধে আছে। তাতে অনেক হাঙ্গামা। জানো তো সবই, একজনকে মহা পাপিষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে না পারলেও কাজটা সহজে হয় না। এটা তার থেকে সুবিধের, ধীরে ধীরে সিঁড়ি নামা। বছর তিনেক সেপারেট থাকতে পারলেই বিচ্ছেদটা অনায়াসে হবে। কোর্ট আপত্তির পথ পাবে না।

    যতোক্ষণ শ্বাস, ততোক্ষণ আশ।

    পারুল তবু যেন মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে। হয়তো এই দূরে থাকার অবকাশে পরস্পরের অভাব অনুভব করে ভুল বুঝতে পারবে, হয়তো নিত্য সাহচর্যের বিতৃষ্ণা ধুয়ে মুছে গিয়ে নতুন আগ্রহ অনুভব করবে। হয়তো এই বাচ্চা দুটোই একটা দারুণ সমস্যা ঘটিয়ে ওদের সমস্যাকে লঘু করে দেবে।

    ছেলেটাকে ছেড়েই কি থাকতে পারবে রেখা? যে রেখা বরাবর সমস্ত পরিবেশটাকে বলে চেপে ধরে রাখতে চেয়েছে আপন বাসনামুঠির মধ্যে, যে রেখা কোনদিন নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি? ছেলের জন্যে মন কেমন করলেই সে প্রবল হয়ে উঠবে, আপন অনুকুলে স্রোতকে বইয়ে নেবে।

    শোভন?

    ও হয়তো তখন কৃতার্স হয়ে ভাববে–বাচলাম বাবা।

    এক্কেবারে সব সম্ভাবনার মুল যে একেবারে কোপ পড়েনি, এটুকুই আশায়।

    শেভনের ছেলেটাকে একটা গল্পের বই দিয়ে গঙ্গার ধারের বারান্দায় বসিয়ে রেখে এসেছে তাই কথা চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না।

    ছেলের সামনে চায়ের পেয়ালাটা এগিয়ে দিয়ে পারুল বললো, কিন্তু তোদের এই রুচির অমিলটা হলো কখন? নিজেকে গলিয়েটলিয়ে দিব্যি তো এক ছাঁচে ঢাই করে ফেলেছিলি?

    ঈষৎ হালকাই হয় পারুল, ইচ্ছে করেই হয়।

    শোভন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার তাই মনে হতো?

    শুধু আমার কেন বাবা, সকলেরই হতো।

    সকলের কথা থাক, তোমার নিজের কথাই বলো।

    তা আমারই বা না হবে কেন বাপু? দেখে তো এসেছি কিছুটা। তোকে তো কোথাও খুঁজে পাইনি।

    শোবন একটু হেসে বলে, যে বস্তুটি তুমি হেন মেয়েও খুঁজে পাওনি, সেই সুক্ষ সুগভীর বস্তুটি তোমার বৌ ঠিক খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার করে ফেলেছে মা। আর ফেলেই ক্ষেপে উঠেছে।

    শোভন চায়ের পেয়ালায় মনোযোগী হয়।

    পারুল আস্তে বলে, কিন্তু নিজেদের হৃদয়ের দ্বন্দ্বই বড়ো হয়ে উঠলো তোদের কাছে? ছেলেমেয়ে দুটোর কথা ভাববি না?

    আমাদের কাছে এ কথা ভাবছ কেন মা? আমি তো চেষ্টার ত্রুটি করিনি!

    বেশ, না হয়ে ওদের মার কাছেই। কিন্তু তোর কোনো রকমে সাধ্য হলো না ওটা ম্যানেজ করা?

    কই আর হলো?

    শোভল বলে, সব কিছুরই শেষ পর্যন্ত তো একটা সীমা আছেই। ম্যানেজ করারও আছে।

    তাহলে এখন দাঁড়াচ্ছে, তুই তোর কাজের জায়গার চলে যাচ্ছিস, বৌমা বাপের বাড়ি থাকছে, এবং ছেলেটা এখানে আর মেয়েটা সেখানে। অর্থাৎ ভাইবোনের যে একটা সুখের সঙ্গ, সেটা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বেচারারা। মেয়েটা তবু মা পাচ্ছে, ছেলেটা তাও না।

    শোভন একটু হালকা গলায় বলে ওঠে, তেমনি বাবার মাকে পাচ্ছে।

    থাম তুই। পারুল প্রায় ধমক দিয়ে বলে, বাজে কথা রাখ। যে বাবার মাকে বেচারী জন্মে জীবন চক্ষে দেখেনি বললেই হয়, তাকে পেয়ে তা কৃতার্থ হয়ে যাবে একেবারে! সত্যি, আমি তো ওটার মুখের দিকে তাকাতেও পারছি না। বুড়ো ধাড়ী দুটো মা-বাপ তাদের হৃদয় সমস্যাকে এতো জটিল করে তুললো যে, ভেবে দেখছে না ওদের মুখগুলো হেট হয়ে গেল! এতোদিনের আনন্দের, আহ্লাদের, গৌরবের জীবন থেকে হঠাৎ যেন তোরা ওদের একটা দারুণ লজ্জার, দুঃখ আর অপমানের জীবনে গড়িয়ে ফেলে দিলি। এই পৃথিবীতে ওদের পরিচয়পত্রটা কত মলিন বিবর্ণ হয়ে গেল সে হুঁশ আছে? জীবনে কখনো ওরা মা-বাপকে ক্ষমা করতে পারবে?

    পারলেই অবাক হবো। পারবে না।

    সেই গ্লানির বোঝা তাদের জীবনকে ভারী করে তুলবে না?

    পারুল স্বভাবত কখনোই উত্তেজিত হয় না, কিন্তু এখন পারুলকে উত্তেজিত দেখালো।

    শোভন বিধ্বস্ত গলায় বলে, জানি তুলবে। অসহনীয় করে তুলবে। কিন্তু আমি কি করবো বলো? এসব যুক্তি যে দেখাইনি তা তো নয়?

    কিন্তু তোদের বিরোধটা কোথায় ঘটলো? কবে কখন কী সূত্রে?

    পারুল যেন জিনিসটাকে লঘু করে দেখিয়ে ছেলের মনের ভারটা লঘু করে দিতে চায়। যেন দুটো অবোধ ছেলেমেয়ে ঝগড়াঝাটি করে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছে, পারুল তাদের সামলে দেবে।

    শোভন হয়তো মায়ের এই মনোভাব বোঝে, হয়তো বা বোঝে না, ভাবে মা ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না।

    শোভন তাই মার দিকে সরাসরি তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে, বিরোধ? সর্বক্ষেত্রে। বরাবর চিরদিন। তবু অবিরত চেষ্টা করে এসেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেষ্টায় হেরে গেলাম। ও বলছে আমি নাকি কোনোদিন চেষ্টা করিনি।

    পারুলের একটা নিঃশ্বাস পড়ে, গভীর গাঢ়। পারুল জানলা দিয়ে চোখ ফেলে দেখে শোভনের ছেলেটা গল্পের বইখানা মুড়ে রেখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। পারুলের হঠাৎ মনে হলো এর থেকে করুণ দৃশ্য সে বোধ করি জীবনে আর কখনো দেখেনি।

    পারুল নিজের ছেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, হার মানলি?

    মানলাম। পারা গেল না!

    পারুল অন্য প্রসঙ্গে এলো।

    বললো, তোর ছেলে তো কেষ্ট-বিষ্ণু বাবাদের ছেলের রীতিতে বিলিতি ইস্কুলে পড়তো, এখানে ওর দশা কী হবে?

    এখন যে দশায় উপনীত হয়েছে তার সঙ্গে ম্যানেজ করতে হবে। ঠাকুমার হাতের বড়ির ঝোল খাবে, আর বাংলা ইস্কুলে পড়বে।

    পারুল একটু কঠিন মুখে বলে, তার মানে যে-কালকে তোরা “সেকাল” বলে নাক কোচকাতিস, সেই কালের থেকে এক পা-ও এগোয়নি। তোরাও সে যুগের মত ছেলেপুলেগুলোকে নিজেদের জিনিসপত্তর ছাড়া আর কিছুই ভাবিস না। অথবা তাদের খেলনা পুতুল। সেকালেও তো এই ছিল। ওদের মুখ কে চাইতো? ওরা যেন নিজেদের শখ সাধ মেটানোর উপকরণ মাত্র। নিজেদের সুবিধে-অসুবিধের বশেই তাদের ব্যবস্থা, কেমন? কিন্তু এ যুগে তো তোরা অনেক বড় বড় কথা বলতে শিখেছিস, ওদের জন্যে অনেক ব্যবস্থা অনেক আয়োজন, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলালো কই? সন্তানের জন্যে যে স্বার্থত্যাগের দরকার আছে, জেদ অহঙ্কার ত্যাগের দরকার আছে, তা তো ভাবছিস না তোরা একালের মা-বাপ? তোদের সুবিধের অনুপাতে ওদের জীবনের ছক। এতোদিন তোরা ওকে তোর পদমর্যাদা আর ঐশ্বর্যের মাপকাঠিতে ফেলে–ওয়া শোওয়া পড়ায় খেলায় প্রতিটি ব্যাপারে সাহেব করে মানুষ করছিলি, হঠাৎ এখন তোদর ইচ্ছে-বাসনার হাঁচে ফেলে ওর জন্যে ঠাকুমার হাতে বড়ির ঝোল আর পাততাড়ি বগলে পাঠশালে যাওয়া বরাদ্দ করছিস, আবার যদি হঠাৎ খেয়াল হয়, হয়তো মাথা ন্যাড়া করে ব্রহ্মচর্য আশ্রমে পাঠিয়ে দিরি, অথবা একেবারে পাশা উন্টে ফেলে ছুঁচলো জুতো আর ড্রেনপাইপ প্যান্ট পরিয়ে আমেরিকায় চালান করতে চাইবি। ওরও যে একটা মন আছে দেখবি না, আর সে মনে মা-বাপের জন্যে কী সঞ্চিত হচ্ছে ভেবেও দেখবি না?

    শোভন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে।

    শোভন বলে, ভেবো না মা, এসব কথা আমি ভাবিনি! অথবা রেখাকে বোঝাতে চেষ্টা করিনি! কিন্তু কিছুতেই যদি না বোঝে কী করবো বল? তাহলে ছেলেটাকেও ওর হাতে তুলে দিয়ে নিজে একেবারে দেউলে বনে যেতে হয়।

    পারুলের মনটা বেদনায় টনটন করে ওঠে। পারুলের নিজের বক্তব্যের জন্য লজ্জা হয়, সত্যি নিতান্ত নিরুপায় হয়েই তো মায়ের কাছে ছুটে এসেছে বেচারা। এখানে তো অহমিকাকে বড় করে তোলেনি।

    পারুল অতএব বাতাস হালকা করবার চেষ্টা করে। বলে ওঠে, তা বৌমার এতই বা কাঠ জেদ কেন বল্ তো বাপু? তুই এই বুড়ো বয়সে আর কারুর বৌয়ের প্রেমে-ট্রেমে পড়ে বসিসনি

    শোভন হঠাৎ মাথা হেঁট করে। তারপর আস্তে বলে, শ্রদ্ধা বলেও একটা বস্তু থাকে। ও সেটাকেও বরদাস্ত করতে পারে না।

    পারুল ছেলের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। পারুল যেন রহস্যের মূল দরজা খুঁজে পায় হঠাৎ। তবে সেটা বলে ফেলে না। বলে, সেটা কি একটা বিরোধের বস্তু?

    শুধু সেটাই নয়, বললাম তো, প্রতিপদে রুচির অমিল, এ জীবন ওর অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমি সঙ্কীর্ণচিত্ত, ও উদার। আমি গ্রাম্য, ও আধুনিক। আমি ভগবান-বিশ্বাসী, ওর মতে সেটা কুসংস্কার।

    .

    পরদিন রাত্রে পারুল তার চিঠির কাগজের প্যাডটা নিয়ে বসলো।

    শোভন ছেলে রেখে চলে গেছে, কারণ ছুটি নেই তার। ছেলেটা পারুলের চৌকির কাছে আর একটা সরু চৌকির ওপর শুয়ে আছে। মশারির মধ্যে থেকে বোঝা যাচ্ছে না ও ঘুমিয়ে পড়েছে না জেগে আছে।…এখন খোলা জানলা দিয়ে গঙ্গার বাতাস এসে মশারিটাকে দোলাচ্ছে, কিন্তু সব দিন বাতাস থাকবে না, গুমটের দিন আসবে, সেদিন কী হবে ওর? জন্মাবধি যার বিজলী পাখার হাওয়ায় অভ্যাস! পারুলের এই মফঃস্বলের বাড়িতে তো ও জিনিসটি নেই।

    শুধু ও জিনিসটি কেন, অনেক অনেক জিনিসই তো নেই যাতে ও অভ্যস্ত। প্রতি মুহূর্তেই কি বিদ্রোহী হয়ে উঠবে না ওর মন? অথবা নিজেকে হতভাগ্য বেচারী ভেবে হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়বে না?

    আমার মনে হচ্ছে তাই হবে, লিখলো পারুল, এরকম মৃদু আর চাপা স্বভাবের ছেলেমেয়েরা তাই হয়। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই এরা আছে, এই হতভাগ্যের দল। আমাদের সমাজেও এলো। প্রতিরোধের উপায় নেই। কিন্তু বকুল, আমরা কি মেয়েদের এই স্বাধীনতারই স্বপ্ন দেখেছিলাম? আমরা, আমাদের মা-দিদিমারা? তুই তো গল্প-উপন্যাস লিখিস, কতো জীবন তৈরী করিস, আমার অভিজ্ঞতা সত্যি মানুষ নিয়ে, তাই আজকাল যেন ভেবে ভেবে বল পাচ্ছি না। এ যুগ কি ব্যক্তি-স্বাধীনতা আর মেয়েদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে এদেশেও সেই একটা হতভাগ্য জাতি সৃষ্টি করলো, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জাতিরা যা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছে। যে হতভাগ্যেরা শিশুকালে বাল্যকালে তাদের জীবনের পরম আশ্রয় হারিয়ে বসে ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায় কঠিন হয়ে উঠবে, উজ্জ্বল হবে, স্বেচ্ছাচারী হবে, সমাজদ্রোহী হবে, অথবা একটা হীনমন্যতায় ভুগে ভুগে জীবনের আনন্দ হারাবে, উৎসাহ হারাবে, বিশ্বাস হারাবে।

    বিশাস হারানোর মত ভয়ঙ্কর আর কী আছে বল? ক’দিন আগেও যে ছেলেটা জানতে, আমার এই রাজপুত্তরের পোস্টটা চোরাবালির ওপর প্রতিষ্ঠিত, আমার রাজ্যপাট আবুহোসেনের রাজ্যপাটের মত এক ফুয়ে ফর্সা হয়ে যাবে, আজ আচমকা এই অবস্থায় পড়ে গিয়ে সে যদি পৃথিবীর ওপরই আর বিশ্বাস রাখতে না পারে, তাকে দোষ দেব কেমন করে?

    ভগবানের মারও অবস্থার বিপাক ঘটায়, কিন্তু তাতেও দুঃখ থাকে, বেদনা থাকে, হয়তো এক রকমের লজ্জাও থাকে, কিন্তু অপমান থাকে না, গ্লানি থাকে না।

    ও যখন ভাবতে বসবে তার এই দুর্দশার জন্যে দায়ী তারই মা-বাপ, যাদের কাছে এযাবৎ নিতান্ত নিশ্চিন্ত হয়ে কাটিয়ে আসছিল, তখন ওর ভিতরটা কী জ্বালায় জ্বলবে ভা।

    তোর মনে আছে বকুল, যেদিন হিন্দু বিবাহে বিচ্ছেদের আইন পাস হলো, সেদিন আমি ঠাট্টা করে আক্ষেপ করেছিলাম, আহা আমাদের মায়ের আমলে যদি এটি হতো, তাহলে সে ভদ্রমহিলা সারাজীবন এমন বেড়া-আগুনে পুড়ে মরতেন না। ঠাট্টাই, তবু আক্ষেপের কোথাও একটু সত্যিও কি ছিল না? আজ মনে হচ্ছে আমাদের মায়ের জীবনে তেমন সুযোগ এলে আমাদের কি দশা ঘটতো?

    শোভন চলে যাবার পর থেকে ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। শুনি ছোট বোনটাকে প্রাণতুল্য ভালবাসে, সেটাকে ওর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, কী নিষ্ঠুরতা! নিজের ছেলেকেই আমার একটা হৃদয়হীন পিশাচ মনে হচ্ছে।

    অথচ কারণটা কি? শুধু জেদ, অহমিকা! শুধু রুচির অমিল, শুধু মতের অমিল। অর্থাৎ বনিয়ে থাকতে পারার অক্ষমতা! কিন্তু ওই অমিলের কারণগুলো যদি শুনিস মনে হবে সবই ঠাট্টা।

    একজন চেয়েছে জীবনযাত্রার প্রণালীটা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্ত্য-ধর্মী হোক, অন্যজন চেয়েছে প্রণালীটা পাশ্চাত্ত্যধর্মী হয় হোক, তবু তাতে প্রাচ্যের একটু আভাস মেশানো থাক। ছেলেমেয়েরা সাহেব হোক তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু তারা যে আসলে বাঙালী, সেটা যেন ভুলে না যায়।

    অতএব প্রথমজন বলেছে, খিচুড়ি চলবে না, যা হবে তা একরকম হবে, অপরজন বলেছে, জন্মসূত্রটা তো এড়াতে পারবে না, ওটা তো বদলাবার বস্তু নয়, অতএব?

    শেষ পর্যন্ত বিরোধটা গিয়ে ঠেকেছে সংঘর্ষে।

    এক হিসেবে দোষটা আমার ছেলেরই।

    বেড়ালটাকে পয়লা রাত্তিরেই কাটতে হয়।

    প্রথম দিকে আত্মমহিমা অথবা উদারতা দেখাতে, অথবা নিতান্তই মোহাচ্ছন্ন বশ্যতায় বেড়ালকে ইচ্ছামত খেলতে দিয়েছো তুমি, এখন হঠাৎ সে পাতে মুখ দিয়েছে বলে তলওয়ার বার করে কাটতে চাইলে চলবে কেন?

    ভালবাসার বশ্যতা এক, আর নিরুপায়ের ভূমিকায় অন্ধ আত্মসমর্পণ আর এক। এ যুগের পুরুষরা ওই বিভেদটার সীমারেখা নির্ণয় করতে অক্ষম হয়েই তো জীবনে অনিষ্ট ডেকে আনছে।

    .মনে হচ্ছে সমাজের চাকাটা হঠাৎ যেন আমূল ঘুরে গেছে। যেখানে একটু নড়লে কাজ ঠিক হতো, সেখানে এই একেবারে উল্টোটা চোখে কেমন ধাক্কা মারছে।

    জানি না আমার বড় ছেলের সংসারেও আবার এই ঢেউ এসে লাগে কিনা। সেখানেও তো অমিলের চাষ। আর ওই ছেলেমেয়ে নিয়েই। মোহনের মতে ছেলেমেয়েদের দোষ-ত্রুটি হলে বুঝিয়ে শিক্ষা দিয়ে সংশোধন করা উচিত, মোহনের বৌয়ের মত পিটিয়ে সায়েস্তা করাই একমাত্র উপায়। এ বিষয়ে সে আমাদের পিতামহী প্রপিতামহীদের সঙ্গে একমত। আসলে ‘গ্রাম্যতা’ বস্তুটা একটা চরিত্রগত ব্যাপার। ওটা শহুরে জীবনের পরিবেশ পেলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার নয়।

    অথচ আবার দেখছি, মোহন ছেলেকে একটু কঠিন কথা বলে শাসন করতে গেলে তার বৌয়ের এমনই প্রাণ ফেটে যায় যে তদ্দণ্ডে ছেলেকে মাথায় তুলে আদর করতে বসে দেখিয়ে দেখিয়ে। মা-বাপের এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওরা খানিকটা বেশ মজা পায়। আবার কখনো ওদের উলুখড়ের দশা ঘটে।

    বিরোধ পদে-পদেই! একজনের মতে ওদের খাওয়া নিয়ে জুলুম করা পীড়নেরই নামান্তর, অন্যজনের মতে অহরহ জগতের যাবতীয় পুষ্টিকর খাদ্য তাদের একটি ক্ষুদ্র উদরভাণ্ডে চালান করে দেবার তালে সর্বদা জুলুম করাই মাতৃ-কর্তব্য।

    অন্য দিকেও মোহনের ইচ্ছা তার অধস্তনের অফিসেই বিরাজ করুক, বসের বাড়িতে এসে ‘বস’-গিন্নীকে বৌদি ডেকে চাকরগিরি না করুক, অথচ মোহনের বৌয়ের ইচ্ছে তার স্বামীর অধস্তনেরা সবাই এসে তার পায়ে পড়ক। যেন ‘বস’-গিন্নী মরতে বললে মরে, আর বাচতে বললে বাঁচে।

    মোহনের মতে যা করবে মাত্রা রেখে। বন্যাত্রাণ তহবিলে মোটা চাদা দিতে চাও দাও, শ্লোগান দিয়ে পথে নেমে পড়বার অথবা অভিনয় করতে স্টেজে ওঠবার কী দরকার? বৌয়ের মতে সেটাই জরুরী দরকার।

    মোহন যদি বলে বৌয়ের রাত দশটা পর্যন্ত বাইরে আড্ডা দেওয়াটা বাড়াবাড়ি, বৌ পরদিন রাত এগারোটায় বাড়ি ফেরে তার মহিলা সমিতির কাজের ছুতোয়।

    তবু নাকি মোহনের বৌ তার বন্দীজীবনকে ধিক্কার দেয়।

    এ শুধু আমার সংসারের কথা নয়, প্রায় সব সংসারেরই কথা। হয়তো কলসী থেকে দৈত্যকে বার করলে এই দশাই ঘটে।

    অথবা দৈত্যটা বেরিয়েই ছাড়তো, এ যুগের হতভাগারা সেটাই লোকচক্ষে আড়াল দেবার জন্যে বশংবদ স্বামীর ভূমিকা অভিনয় করে চলে, যতক্ষণ না শেষ পর্যন্ত অসহ্য হয়ে ওঠে।

    এক যুগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত অপর যুগ করে, এই বোধ হয় ইতিহাসের নিয়ম। কিন্তু ইতিহাসটা যখন প্রিয়জনের জীবনে আবর্তিত হয়, তখন নির্লিপ্তর ভূমিকায় থাকা শক্ত বৈকি। ভেবেছিলাম এতে পটু হয়ে গেছি। দেখছি ধারণাটা মজবুত নয়।

    সেজদির চিঠি বকুল কখনো পাওয়া মাত্র তাড়াতাড়ি যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে না, কিন্তু আজ পড়ছিল, লেটার বক্সের কাছ থেকে একটুখানি সরে এসেই। আজকে ওর মনে হলো হয়তো একটা ভাল খবর বয়ে এনেছে চিঠিটা। হয়তো চিঠি খুলেই দেখবে, পোড়ারমুখী মেয়েটা হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে রে বকুল! দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাই চিঠি লিখতে বসলাম।

    এই ধরনের একটু আশা নিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ বুলোতে গিয়ে বকুল যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেল। এ কী খবর! এ কোন্ ধরনের কথা!

    বকুল নিচতলার বসবার ঘরটাতেই বসে পড়লো। চিঠিখানা আর একবার উল্টে নিয়ে গোড়া থেকে পড়তে শুরু করলো, আবার খানিকটা পড়ে মুড়ে রাখলো।

    মনে পড়লো বিবাহ-বিচ্ছেদ বিল যেদিন পাস হলো, লিখেছিল বটে ওই কথাটা সেজদি। লিখেছিল, আমাদের মা বেঁচে থাকতে যদি এ আইনটা চালু হতো রে বকুল! ভদ্রমহিলা হয়তো, কিন্তু প্রয়োজন যেখানে তীব্র, আইনের সুবিধে কি সেখান পর্যন্ত পৌঁছয়? ওই ‘সুযোগ’ বস্তুটা তো অপব্যবহারেই ব্যবহার হয় বেশী। নইলে শোভনের বৌ

    ভাবনায় ছেদ পড়লো, হঠাৎ বাইরে রীতিমত একটা সোরগোল শোনা গেল। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর একসঙ্গে কলবর করে আসছে, হৈ চৈ করছে, কাকে যেন ডাক দিচ্ছে।

    পাশের খোলা দরজাটা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো বকুল, একটা খোলা ট্রাক ভর্তি করে একদল ছেলেমেয়ে এসে এ-বাড়ির সামনেই গাড়িটাকে থামিয়েছে। তাদের সকলের হাতে একখানা করে রঙিন রুমাল, উর্ধবাহু হয়ে তারা সেই রুমাল উড়িয়ে পপত্ করে নাড়ছে, আর দুর্বোধ্য একটা শব্দের চিৎকারে কাকে যেন ডাকছে।

    বকু বুঝতে পারলো না ওরা কে?

    ওদের সাজসজ্জাই বা এমন অরুচিকর কেন? ছেলেগুলো টাইট ট্রাউজারের ওপর একটা করে বহুবর্ণ রঞ্জিত কলার দেওয়া গেঞ্জি পরেছে, সেটাও আবার এমন টাইট যে ভেবে অবাক লাগছে মাথা গলিয়ে পরে দেহটাকে ওর খাপে খাপে ঢুকিয়েছে কী করে! আর মেয়েগুলো? চোখ বুজতে ইচ্ছে হলো বকুলের। ইঞ্চিকয়েক কাপড়ে তৈরী যে ব্লাউজগুলো পরেছে তারা, তার হাতা আর গলা এতোখানি কাটা যে মনে প্রশ্ন জাগে, ওই কয়েক ইঞ্চি কাপড়ই বা খরচ করা কেন? আর শাড়ি কি ওরা পরতে শেখেনি এখনো? তা নইলে অমন অদ্ভুত রকমের শিথিল কেন? কোমরের বাঁধন কোমর থেকে খসে পড়ে বেশ খানিকটা নেমে গিয়ে ভিতরের সায়াটাকে দৃশ্যমান করে তুলেছে, আঁচলের যে সামান্য কোণটুকু কাঁধে থাকবার কথা সেটুকু কাধ থেকে নেমে হাতের উপর পড়ে আছে, চুল রুক্ষ আলুথালু, হান্ত নাড়!, দু’একজনের কানে এতো বড় বড় দুল ঝুলছে যেটা ওই ন্যাড়া হাতের সঙ্গে বিশ্রী বেমানান।

    হাত তুলে রুমাল ওড়ানো আর উল্লাসভঙ্গীর ফলেই বোধ করি বেশবাস এমন অসংবৃত, মনে হচ্ছে ওই স্বল্পাবৃত দেহটা বোধ করি এখনি পুরো অনাবৃত হয়ে পড়বে।

    আর চুলগুলো? জীবনে তেল তো দূরস্থান, চিরুনিও পড়েনি যেন!

    কে এরা?

    এদের ভঙ্গীই বা এমন অশ্লীল কেন? এমনিতে তো দেখে ভদ্রঘরের ছেলেমেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। ভদ্রঘরের ছেলেমেয়েরা এমন কুৎসিত অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করে? আর ওই চিৎকার? শেয়ালের ডাকের মত একটা বিচিত্র ‘হু’ ধ্বনি দিয়ে নিয়ে সমস্ত রাস্তাটাকে যেন মূহর্তে সচকিত করে তুললো ওরা!

    হয়তো উদ্দেশ্যটা তাই। ওদের পার্শ্ববলয়ে যারা রয়েছে তাদের সচকিত করে তোলা, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এটাই লক্ষণীয় হবার পদ্ধতি ওদের।

    এ ধরনের বলগা-ছাড়া উল্লাসধ্বনি একমাত্র খেলার মাঠেই দেখা যায়, এ রকম উল্লাসভঙ্গী বারোয়ারী পূজার বিসর্জনকালে ধুনুচি নৃত্যে!

    কিন্তু এ-বাড়ির দরজায় থেমেছে কেন ওরা? ডাকাডাকি করছে কাকে?

    ওদের বেশবাসে, আচরণ-ভঙ্গীতে কোনো রাজনৈতিক পাটি বলেও মনে হচ্ছে না, নেহাতই একটা অভব্য বেপরোয়া হুল্লোড়ের দল। দল বেঁধে কোথাও চলেছে, এ-বাড়ির কাউকে ডেকে নিতে এসেছে বোধ হয়।

    কিন্তু ঐ দলে এ বাড়ি থেকে কে যাবে? তবে কি–

    ভাবতে হলো না বেশীক্ষণ, যাকে ডাকাডাকি করছে সে নেমে এলো সাজসজ্জা সমাপ্ত করে। এই ঘর দিয়েই বেরোবে। হাতের ব্যাগ লোফালুফি করতে মরতে ঢুকে এলো। আর

    এখানে বকুলকে দেখে ঈষৎ থমকে গিয়ে বলে উঠলো, আপনি এখানে বসে যে?

    অপূর্বর মেয়ে।

    বকুল প্রায় বিহ্বল হয়েই তার নাতনীর দিকে তাকিয়ে দেখলো। এই সাজে সেজে এই অসভ্য ছেলেগুলোর সঙ্গে হুল্লোড় করতে যাবে অপূর্বর মেয়ে!

    ও মেয়ের অনেক ইতিহাস আছে, অনেক ঘটনা জানা আছে বকুলের। তবু চোখের সামনে ওকে দেখে, আর ওদের সঙ্গীদের দেখে বকুল যেন এখন একটা অশুচি স্পর্শের অনুভূতিতে সিটিয়ে গেল।

    ব্লাউজের গলার এবং পিঠের কাট এতো নামিয়ে ব্লাউজটা গায়ের সঙ্গে আটকে রেখেছে কি করে সত্যভামা? নাভির এতো নীচে শাড়িটাকে পরেছে কি করে? ওই নখগুলো এতো লম্বা লম্বা হলে কী করে? ও কি নিজেই বুঝে ফেলেছে ওর ওই দেহখানা ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই, নেই কোনো সম্পদ? তাই ওই দেহটাকেই

    কী অশ্লীল! কী অরুচিকর!

    তবু ওর কথার উত্তর দিতে হলো, কারণ ও এ-বাড়ির। ও অপূর্বর মেয়ে

    বকুল বললো, ওরা কি তোকেই ডাকতে এসেছে নাকি?

    হ্যাঁ তো-, কৃত্রিম একটা গলায়, অবাঙালীর মুখের বাংলা উচ্চারণের মত উচ্চারণে বলে ওঠে সত্যভামা, পিকনিকে যাচ্ছি আমরা।

    ওরাই সঙ্গী?

    তবে?

    কোথায় পিকনিক?

    কী জানি? অপূর্বর মেয়ে তার আধ-ইঞ্চি প্রমাণ ফলস নখ বসানো হাত দুটো একটি অপূর্ব কায়দায় উন্টে বলে, যেখানে মন চাইবে! আচ্ছা টাটা!

    একটি লীলায়িত ছন্দে কোমর দুলিয়ে ঘরের সামনের সিঁড়ি দুটো ডিঙিয়ে নেমে গেল ও।

    সঙ্গে সঙ্গে ওই ট্রাকের মধ্যে একটা প্রচণ্ড উন্নাসরোল যেন ফেটে পড়লো এসসেছে–এসসেছে।

    একটা ছুঁচলো দাড়িওলা ছেলে হঠাৎ রুমালখানা হাত থেকে ছেড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে সুর করে গেয়ে উঠলো–এসে গেছে বিপিন সুধা–বাতের ওষুধ আর খেও না।

    কিন্তু বকুল কেন অপলক তাকিয়ে আছে?

    বকুল কি মুখটা ফিরিয়ে নেওয়া যায় এ কথা ভুলে গেছে?

    তাই বকুল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, টপাস করে ট্রাক থেকে একটা ছেলে লাফিয়ে নেমে পড়ে অবোধচন্দ্রের প্রপৌত্রীকে দুহাতে ধরে উঁচু করে তুলে ধরলো, আর ট্রাকের উপর থেকে গোটা দুই ছেলে ঝুঁকে পড়ে বাগিয়ে তুলে নিলো তাকে।

    বিরাট গর্জন করে গাড়িটা ছেড়ে গেল।

    সমবেত কণ্ঠে একটা ইংরিজি গানের লাইন শুনতে পাওয়া গেল। বাজল সুর।

    সেই সুরটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত শুনতে পেলো বকুল।

    কিন্তু সেই সুরে কি একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল বকুল? তাই অনড় হয়ে বসেই রইলো?

    বকুলের মা একদা বিধাতার কাছে মাথা কুটে এই হতভাগা দেশের মেয়েদের বন্ধনগ্রস্ত জীবনের মুক্তি চেয়েছিল। চেয়েছিল তার মা-ও, সেই প্রার্থনার বর কি এই রূপ নিয়ে দেখা দিচ্ছে?

    এই মুক্তিই কি চেয়েছিল তারা?

    তাদেরই ঘরের মেয়ের এই স্বচ্ছন্দবিহারের বিকাশ দেখে স্বর্গ থেকে পুলকিত হচ্ছে তারা?

    বকুল একটু আগেও ভাবছিল ওরা কে? ওরা কোন্ সমাজ থেকে বেরিয়ে এসেছে?

    বকুল এখন তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। ওরা প্রবোধচন্দ্রের সমাজ থেকেই বেরিয়েছে। হয়তো প্রবোধচন্দ্রের দাদা সুবোধচন্দ্রের যে প্রপৌত্রী সাইকেলে ভারত ভ্রমণ করতে বেরিয়েছে, সেও এমনি প্রগতিশীল, সেও হয়তো ধরে নিয়েছে অসভ্যতাটা সভ্যতার চরম সীমা। ধরে নিয়েছে উচ্ছৃঙ্খলতাই মুক্তির রূপ, ধরে নিয়েছে সব কিছু ভাঙাই হচ্ছে প্রগতি।

    সুবর্ণলতা! তোমার কান্নায় উদব্যস্ত হয়ে উঠেই ক্রুর বিধাতা তোমার জন্য একটি কুটিল ব্যঙ্গের উপঢৌকন প্রস্তুত করছিলেন। অথবা একা তোমার জন্যে নয়, তোমার দেশের জন্য।

    অনেকক্ষণ পরে বকুল তিনতলায় নিজের ঘরে উঠে গেল, আর তখনই ওর আচ্ছন্নতা কেটে সহজ চিন্তা ফিরে এলো।

    এরাই সমাজের সবখানিকটা নয়।

    ওই পিকনিক পার্টিরা।

    পারুলের চিঠিখানা আবার খুলে চোখকে মেলে দিলো বকুল তার উপর।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }