Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প547 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো

    আগেকার দিনে মেয়েরা শাড়ি কুঁচিয়ে নিয়ে পরতো। হালকা মিহি ‘খড়কে ড়ুরে’ ‘চাঁদের আলো’ ‘গঙ্গাজলী’। কড়া করে মোচড় দিয়ে দিয়ে পাকানো সেই কোঁচানো শাড়িকে বাঁধন খুলে বিছিয়ে দিলে, তার ছোট ছোট ঢেউতোলা জমিটা যেমন দেখাতো, গঙ্গাকে এখন যেন তেমনি দেখতে লাগছে।

    জোয়ার নেই, ভাঁটা নেই, স্থির গঙ্গা।

    শুধু বাতাসের ধাক্কায় ছোট ছোট তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ কোঁচানো গঙ্গাজলী শাড়ীর মত একূল ওকুল আঁচল বিছিয়ে তিরতির করে কাঁপছে।

    এখন পড়ন্ত বিকেল, এখন গঙ্গা আর গঙ্গাতীরের শোভার তুলনা নেই, এই শোভার শেষবিন্দুটুকু পান করে তবে এই বারান্দা থেকে উঠবেন সেজদি। যার নাম পারুল, আর যাকে নাম ধরে ডাকবার এখানে কেউ নেই।

    এই তার পুজো, এই তার ধ্যান, এই তার নেশা। রোদ পড়লেই গঙ্গার ধারের বারান্দায় এসে বসে থাকা। হাতে হয়তো একটা বই থাকে, কিন্তু সে বই পড়া হয় না। এ সময়টা যেন নিজেকে নিয়ে ওই গঙ্গারই মত কোনো অতল গভীরে ড়ুবে যান তিনি।

    ফর্সা রং, ধারালো মুখ, ঈষৎ কোঁকড়ানো হালকা রুক্ষ চুলে রুপোলি ব্রাশের টান। সম্পূর্ণ নিরাভরণ হালকা পাতলা দেহটি ঘিরে যে সাদা থান আর ব্লাউজ, তার শুভ্রতা যেন দুধকেও হার মানায়। সাদা ফুলের সঙ্গেই বরং তুলনীয়।

    পাড়ার মহিলারা কখনো কখনো বেড়াতে আসেন, সধবা বিধবা দু দলই। আর পথে বেরোলে অবশ্যই ফর্সা কাপড় পরেন, কিন্তু এখানে এসে বসলে তাদের সে শুভ্রতা সম্ভ্রম হারায়।

    মহিলারা বিস্ময়-প্রশ্ন করে বসতেও ছাড়েন না, কোন ধোবায় আপনার কাপড় কাচে দিদি? কী ফর্সা করে! আর বাড়িতেও যে আপনি কি করে কাপড় এত ফর্সা রাখেন! আমাদের তো বাবা রান্নাঘরে গেলাম, আর কাপড় ঘুচে গেল।

    সেজদি এতো কথার উত্তরে শুধু মৃদু হেসে বলেন, আমার রান্নার ভারী বহর!

    সেজদি অল্প কথার মানুষ।

    অনেক কথার উত্তরে ছোট দুএকটি লাইনেই কাজ সারতে পারেন। মহিলারা নিজেই অনেক কথা বলে, তারপর যাই দিদি, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম বলে চলে যান।

    সেজদি এ কথাতেও হৈ-হৈ করে প্রতিবাদ করে ওঠেন না। শুধু তেমনি হাসির সঙ্গে বলেন, আমার আবার সময় নষ্ট! সারাক্ষণই তো সময়!

    গমনোন্মুখ মহিলাকুল আবার থমকান, ঈষৎ ঈর্ষা আর ঈষৎ প্রশংসায় বলে ওঠেন, কি জানি ভাই, কি করে যে আপনি এতো সময় পান! আমরা তো এতোটুকু সময় বার করতে হিমসিম খেয়ে যাই! ইহ-সংসারের খাজনা আর শেষ হয় না! •

    সেজদি এ উত্তর দিয়ে বসেন না, খাবেন না কেন হিমসিম, কাজের তালিকা যে আপনাদের বিরাট। নিত্য গঙ্গা নাইবেন, নিত্য যেখানে যত বিগ্ৰহ আছেন তাদের অনুগ্রহ করতে যাবেন, নিত্য ভাগবত পাঠ শুনতে বেরোবেন। তাছাড়া বাড়িতেও কেউ এক ডজন ঠাকুর নিয়ে ফুলচন্দন দিতে বসবেন, কেউ তুলসীর মালা নিয়ে হাজার জপ করতে বসবেন।

    নিত্য এতগুলি নিত্যের নৈবেদ্য যুগিয়ে তবে তো আপনারা অনিত্য ইহ-সংসারের খাজনা দিতে বসেন। তার মধ্যেও আছে ইচ্ছাকৃত কাজ বাড়িয়ে তোলার ধরন! ভরা জল আবার ভরা, মাজা কলসী আবার মাজা, কাচা কাপড়কে আকাচা সন্দেহে আবার কাচা, এসব বাদেও—তুচ্ছ জিনিসকে উচ্চমূল্য দিতে অবকাশকে গলা টিপে মারেন। একমুঠো কাঁকর-ভর্তি চাল, একমুঠো কয়লার গুঁড়ো, এ যে আপনাদের কাছে সময়ের থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।

    না, এসব কথা বলেন না সেজদি।

    তিনি শুধু হেসে বলেন, আপনাদের সংসার করা, আর আমার সংসার করা! কীই বা সংসার!

    নিজের আর নিজের দিন নির্বাহের আয়োজনের সম্পর্কিত কথায় ভারী কুণ্ঠা সেজদির। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কী রাঁধলেন? উত্তর দিতে সেজদি যেন লজ্জায় মরে যান। তাছাড়া রান্নার পদ সম্পর্কে বলতে গেলেই তো বিপদ। সেজদির অন্নপাত্রে একাধিক পদের আবির্ভাব দৈবাতের ঘটনা। শুধু যখন ছেলেরা কেউ ছুটিতে বেড়াতে আসে তখনই–

    বাইরে থাকে ছেলেরা। ছুটি হলেই কলকাতা তাদের টানে। দুটি হলেই বৌ-ছেলে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে মনকে বলে, চলো কলকাতা। অবশ্য এটা সম্ভব হয়েছে দুই ছেলেরই শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় বলে। তা নইলে হয়তো বলতে হতো–চলো মধ্যপ্রদেশ, চলো উত্তরবঙ্গ।

    স্বামীর ছুটির সুযোগে বৌদের গন্তব্যস্থল আর কোথায় হবে বাপের বাড়ি ছাড়া? আদিঅন্তকালই যে এই নিয়ম চলে আসছে, স্বয়ং মা দুর্গাই তার প্রমাণ। বৃন্তচ্যুত ফুলের মর্মকথা কারো জানা নেই, কিন্তু বৃন্তচ্যুত নারী-সমাজের মর্মকথা ধরা পড়ে তাদের এই পিত্ৰালয়প্রীতিতে।

    থাকবেই তো প্রীতি।

    শৈশবের সোনার দিনগুলি যেখানে ছড়িয়ে আছে স্মৃতির সুরভি হয়ে, কৈশোরের রঙিন দিনগুলি যেখানে বিকশিত হয়েছে, কম্পিত হয়েছে, আশা-আনন্দে দুলেছে, সেখানটার জন্যে মন ছুটবে না? যেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই একান্ত প্রিয়জনের মুখ, সেখানে আকর্ষণ দুর্বার হবে না?

    হয়।

    তাই বৌরা স্বামীর ছুটি হলে বলে, ছুটিতে কাশ্মীরে বেড়াতে যাবার কথা বলছো, কিন্তু মা না অনেকদিন থেকে বলছেন–

    ছেলেরা অতএব বাক্সবিছানা বেঁধে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে শিবঠাকুরের মতো গিরিবাজের গৃহেই এসে উদিত হয়। শ্বশুরের বাড়ি ছোট, ঘর কম, কি অন্য অসুবিধে, এসব চিন্তা বড় করে না। শুধু হয়তো ছুটির তিরিশ দিনের মধ্যে থেকে তিনদিন কেটে বার করে নিয়ে নিজের মায়ের কাছে ঘুরে আসে।

    এটা অবশ্য শুধু অনামিকা দেবীর সেজদির ঘরেই ঘটছে তা নয়, ঘরে ঘরেই এই ঘটনা। মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে, বোঝে না শুধু স্বামীরও হৃদয় নামক একটা বস্তু আছে।

    প্রবাসে চলে গেলে পুরুষ বেচারীদেরও যে শৈশব-কল্যের সেই স্মৃতিময় ঘরখানির জন্য হৃদয়ের খানিকটা অংশে থাকে একটি গভীর শূন্যতা, তা মেয়েরা বুঝতে চায় না। পুরুষের আবার মন কেমন কি? তাই ওই তিনদিনের বরাদ্দে যদি আর দুটো দিন যোগ হয়ে যায়, বৌ অনায়াসেই ঝঙ্কার দিয়ে বলতে পারে, তুমি তো ছুটির সবটাই ওখানে গিয়ে কাটিয়ে এলে?

    অনেক কিছু প্রোগ্রাম থাকে তাদের, তিরিশ দিনের ঠাসবুনুনি। সেই বুনুনি থেকে দুএকটা সুতো সরিয়ে নিলেও ফাঁকটা প্রকট হয়ে ওঠে।

    সেজদির দুই বৌ দুধরনের, কিন্তু ছুটিতে বাপের বাড়ির ব্যাপারে প্রায় অভিন্ন। তবু বড় বৌ কদাচ কখনো চন্দননগরে অ্যাসে, ছোট বৌ কদাচ না।

    ওরা এলে সেজদির সংসারটা সংসারের চেহারা নেয় দুতিন দিনের জন্যে।

    তাছাড়া সারা বছর শুধু একটি অখণ্ড স্তব্ধতা।

    পাড়ার মহিলারা দৈবাৎই আসেন, কারণ মোহনের মার সঙ্গে ওঁদের সুরে মেলে না। যেটুকু আসেন, নিতান্তই কৌতূহলের বশে। নিতান্তই সংবাদ সংগ্রহের আশায়, নচেৎ বলতে গেলে সেজদি তো জাতিচ্যুত।

    গঙ্গাবক্ষে বাস করেও মোহনের মা নিত্য তো দূরের কথা, যোগেযাগেও গঙ্গাস্নান করেন না, পুজো করেন না, হিন্দু বিধবা-জনোচিত বহুবিধ আচারই মানেন না। এমন কি জানেনও না। বিধবাকে যে হরির শয়ন পড়ার পর পটল আর কলমি শাক খেতে নেই, একথা জানতেন না তিনি, তারকের মা সেটা উল্লেখ করায় হাসিমুখে বলেছিলেন, তাই বুঝি? কিন্তু হরির শয়নকালের সঙ্গে পটল-কলমির সম্পর্ক কি?

    তারকের মা গালে হাত দিয়েছিলেন, ওমা শোনো কথা! বলি মোহনের মা, কোন বিলেতে মানুষ হয়েছিলে তুমি গো? শ্ৰীহরি যে কলমি শাকের বিছানায়, পটলের বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমোন, তাও জানো না? সেদিনকে-ইয়ে তোমার সেই অম্বুবাচীর দিনকের কথায় আমরা তো তাজ্জব! দত্তদিদি ফুলকুমারী আর আমি হেসে বাঁচি না। অম্বুবাচীতে বিধবাকে আগুন স্পর্শ করতে নেই শুনে তুমি আকাশ থেকে পড়লে!..যাই বলে ভাই, তোমার চোখ-কান বড় বন্ধ! ঘরে না হয় শাশুড়ী-ননদ ছিল না, পাড়াপাড়শীর সংসারও তো দেখে মানুষ!

    সেজদির বড় ছেলের নাম মোহন।

    তাই সেজদি এই মহিলাকুলের অনেকের কাছেই মোহনের মা নামে পরিচিত।

    সেজদির স্বামী অমলবাবুর বদলির চাকরি ছিল, জীবনের অনেকগুলো দিনই সেজদির বাইরে বাইরে কেটেছে, শেষের দিকে অমলবাবু দেশের পোড়ো ভিটের সংস্কার করে, গঙার ধার ঘেঁষে এই বারান্দাটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এ বারান্দা তোমার জন্যে। তুমি কবি মানুষ। স্বামী সেজদিকে ভালবাসতেন বৈকি, খুবই ভালবাসতেন, কিন্তু তার নিজস্ব ধরনের সেই ভালবাসা-কিন্তু ও কথা থাক। পৃথিবীতে কত মানুষ, কে কার ছাঁচে ঢালা?

    কেউ না।

    তবু যারা বুদ্ধিমান, তারা সুবিধে আর শান্তির মুখ চেয়ে নিজের ধারালো কোণগুলো ঘষে ক্ষইয়ে ভোঁতা করে নিয়ে অন্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। নিয়ত সংঘর্ষের হাত এড়ায়।

    তারা জানে সংসার করার সাধ থাকলে, ওই ধারালো কোণগুলো তো থাকবে না, যাবেই ক্ষয়ে। শুধু সেটা যাবে নিয়ত সংঘর্ষের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতায়। তার থেকে নিজেই ঘষে নিই।

    আর যারা বুদ্ধিমান নয় এবং সংঘর্ষকে ভয় পায়, তারা একপাশে সরে থাকে, নিজেকে নিয়ে গুটিয়ে থাকে। তারা কদাচ কখনো একটি মনের মতো মন পেলে, তবেই সেখানে নিজেকে খোলে।

    সেজদি বুদ্ধিমতী নয়।

    সেজদি এদের দলে।

    সেজদি তাই ওই তারকের মা, ফুলকুমারীদের সঙ্গে একথা বলে তর্ক করতে বসেন না, আপনাদের শ্ৰীহরির গোলোক বৈকুণ্ঠে কি অন্য বিছানা জোটেনি? মা-লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ফাঁকা? তাই ভদ্রলোককে কলমি-পটলের শরণাপন্ন হতে হয়? অথবা এ তর্কও করেন না, বাড়িতে যদি শুধু বিধবা মা আর ছেলেরা থাকে, মা ওই আগুন-নিষেধ পালন করতে না খাইয়ে রাখবে তাদের? রেঁধে দেবে না? কথাগুলো তো মনে এসেছিল সেজদির।

    হয়তো সেজদি এই তর্ককে বৃথা শক্তিক্ষয় বলে মনে করেন, অথবা সেজদি ওই মহিলা দলের সমালোচনাকে তেমনি গুরুত্ব দেন না। হয়তো তাদের তেমন গ্রাহ্য করেন না।

    সেজদিকে বাইরে যতই অমায়িক মনে হোক, ভিতরে ভিতরে হয়তো দস্তুর মতো উন্নাসিক।

    তাই তিনি ছেলেদের বিদায়দানকালে কখনো চোখের পাতা ভিজে করেন না, কখনো আবার শীগগির আসিস বলে সজল মিনতি জানান না।

    হাসি-কথার মধ্য দিয়েই তাদের বিদায় দেন।

    নাতি-নাতনীদের যে তার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়, তারা এলে যে মনটা ভরে ওঠে, একথা সেজদির মোহন শোভন জানে না। তাই তারা খেয়ালও করে না, মায়ের কাছে নিয়ে যাই ওদের।

    শুধু শোভনের মেয়েটা বড় বেশী সুন্দর দেখতে হয়েছে বলে একবার দেখাতে নিয়ে এসেছিল। শুধু মোহনের ছোট ছেলের একবার পক্স হওয়ায় বড়টিকে মার কাছে কিছুদিনের জন্য রেখে গিয়েছিল। ছেলের দিদিমারা তখন সপরিবারে তীর্থে গেছেন।

    আসানসোলে থাকে মোহন, খুব একটা দূরত্ব তো নয়।

    শোভন অনেক দূরে।

    শোভনের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাইলের হিসেব দিয়ে সে দূরত্বকে আর মাপা যাচ্ছে না।

    অথচ আগে শোভনই মার বড় নিকট ছিল। শোভনই প্রথম ভাল আর বড়ো কোয়ার্টার পাওয়া মাত্ৰই মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।… বলেছিল, তোমার একা পড়ে থাকা চলবে না।

    কিন্তু শোভনের এই বোকাটে সেণ্টিমেণ্ট শোভনের বৌ সহ্য করবে কেন? বরের ওই আহ্লাদেপনার তালে তাল দিতে গেলে তার নিজের জীবনের সব তাল বেতাল হয়ে যাবে না? সব ছন্দপতন হয়ে যাবে না?

    তার এই ছবির মতো সাজানো সংসারে শাশুড়ী বস্তুটা একটা অদ্ভুত ছন্দপতন ছাড়া আর কি?…দুচার দিনের জন্যে এসে থাকো, আদর করবো যত্ন করবো, ব্যবহার কাকে বলে তা দেখিয়ে দেব। কিন্তু শেকড় গাড়তে চাইলে?

    অশ্বখের চারাকে চারাতেই বিনষ্ট করতে হয়।

    আদুরে বেড়ালকে পয়লা রাত্তিরেই কাটতে হয়।

    শোভনের বৌ জানতো একথা।

    শোভনের বৌ তার জানা বিদ্যেটা প্রয়োগ করতে দেরি করেনি।

    হয়তো কিছুটা দেরি করতো, হয়তো একবারও শোভনতা-অশোভনতার মুখ চাইতো, যদি শাশুড়ী তার সাধারণ বিধবা বুড়ীর মত ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের মধ্যেই নিমগ্ন থাকতো। যদি কৃতী ছেলের বৌয়ের সঙ্গে যেমন সসম্ভ্রম ব্যবহার করতে হয় তা করতো, যদি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার পদ্ধতিতে বৌকে ডিঙিয়ে ছেলের সঙ্গে বসে গল্প না জুড়তো।

    কিন্তু শোভনের নির্বোধ মা সাহেব ছেলেকে সাহেবের দৃষ্টিতে না দেখে ছেলের দৃষ্টিতে দেখতে গেলেন। শোভনের মা ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘরের ছায়াও না মাড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেন, পশম বুনতে শুরু করলেন।

    বুনলেন অবশ্য শোভনের জন্যেই, কিন্তু কে চায় সে জিনিস? বৌ কি বুনতে জানে না? আর সেই জানাটা জানাবে না?

    .

    সেজদি তাই ছেলেকে বললেন, বললে তুই আমায় মারবি শোভন, আমার কিন্তু গঙ্গার ধারের সেই বারান্দাটার জন্যে বেজায় মন-কেমন করছে। আমায় বাবু একটু পৌঁছে দিয়ে আয়। তোর ছুটি না থাকে তোর চাপরাসী-টাসী কাউকে দিয়ে—

    শোভন হয়তো ভিতরে ভিতরে কিছুটা টের পাচ্ছিল, শোভন হয়তো একটা অদৃশ্য উত্তাপের মধ্যেই কাটচ্ছিল, কিন্তু অকস্মাৎ এতটার জন্যে প্ৰস্তুত ছিল না। মায়ের শক্তির উপর আস্থা ছিল তার।

    শোভনের অতএব অভিমান হল।

    হয়তো শোভন তার মায়ের প্রকৃতিই বেশী পেয়েছে। তাই শোভন হাঁ হাঁ করে উঠলো না। শোভন শুধু বললো, আজই যেতে চাও?

    কী মুশকিল! আজই কি রে! কাল পরশু তোর সুবিধে মতো-

    থাকাটা একেবারেই অসম্ভব হলো?

    শোভনের মা হালকা গলায় হেসে বললেন, নাঃ, তুই দেখছি বড্ড রেগে যাচ্ছিস। কিন্তু সত্যিই রে, কদিন ধরে কেবলই সেই গঙ্গা-গঙ্গা মন করছে।

    শোভন বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। মানে সব চেয়ে বেঠিকের সময় যে কথাটা বলে লোকে। ঠিক আছে—অর্থাৎ ঠিক নেই।

    সেজদির ছেলে কি মাকে নিষ্ঠুর ভাবলো না? সে কি মনে করলো না-মা আমার মনের দিকটা দেখলেন না? মার অহমিকাটাই বড় হলো? জানি রেখা তেমন নম্র নয়, কিন্তু করা যাবে কি? সবাই কি সমান হয়? আমি ওকে নিয়ে ঘর করছি না?

    হয়তো শোভনের মা ছেলের মুখের রেখার এই ভাষা পড়তে পারলেন, কিন্তু তিনি বলে উঠতে গেলেন না, ওরে তুই যতটুকু দেখতে পাস, সেইটুকুই সব নয়।

    শোভনের মা সমন্ত অপরাধের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নিয়ে হাস্যমুখে ছেলের বাড়ি থেকে সরে এলেন। এই সরে আসাটা কি অপরাধ হলো পারুলের? অনামিকা দেবীর সেজদির? মোহন-শোভনের মার?

    তা অপরাধী বৈকি।

    ছেলে-বৌয়ের একান্ত ভক্তির নৈবেদ্য পায়ে ঠেলে একটা তুচ্ছ মান অভিমান নিয়ে খরখরিয়ে চলে যাওয়াটা অপরাধ নয়?

    আশেপাশে সমন্ত কোয়ার্টারের বাসিন্দারা এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে আরো অবাক হল।

    একদিন বৌ শাশুড়ীর রাত্রের আহারের ক্ষীর করে রাখতে ভুলে গিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছিল বলে, চলে যাবে মানুষ ছেলের বাড়ি ছেড়ে? ছিঃ!

    কেউ কেউ বললো, দেখলে কিন্তু ঠিক এরকম মনে হতো না।

    রেখা মুখের রেখার অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে বললে, বাইরে থেকে যা দেখা যায় তার সবটাই সত্যি নয়।

    আশ্চর্য!

    আশ্চর্য কিছুই নয়, বড় ছেলের সংসারেও তো ঠিক এই করেছিলেন!

    যারা পারুলকে ভালবাসতো, তারা একটু মনঃক্ষুন্ন হল, যারা বান্ধবীর শাশুড়ীকে বা বন্ধুর মাকে ভালবাসার মতো হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না, তারা শুধু খানিকটা নিন্দে করলো।

    তারপর আর শোভনের সংসারে শোভনের মার অস্তিত্বের কোনো স্মৃতি রইল না। শোভনের জন্যে সেই আধবোনা সোয়েটারটা অনেকদিন পর্যন্ত ট্রাঙ্কের উপর পড়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

    শোভনের দামী কোয়ার্টারে সুন্দর লন, গেঞ্জি-ট্রাউজার পরা সাহেবদের এবং কোমরে আঁচল জড়ানো মেমসাহেবদের টেনিস-কল্লোলে-মুখরিত হতে থাকলো, শোভনের খাবার টেবিল প্রায়শই নিমন্ত্রিত অতিথির অভ্যর্থনার আয়োজনে প্ৰফুল্লিত হতে থাকলো, শোভনের ঘর যখন তখন রেখার উচ্ছ্বসিত হাসিতে মুখরিত হতে থাকলো।

    তবে আর শোভন তার ভিতরের একটি বিষণ্ণ শূন্যতাকে লালন করে করে দুঃখ পেতে যাবে কেন?

    হৃদয়ভারাবনত জননী, আর অভিমান উত্তপ্ত স্ত্রী, এই দুইয়ের মাঝখানে অপরাধীর ভূমিকা নিয়ে পড়ে থাকায় সুখই বা কোথায়? একটাকে তো নামাতেই হবে জীবন থেকে?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }